উৎসর্গ
গজেন্দ্রকুমার মিত্র
অরুণ তাহার প্রকাশকের নিকট হইতে বাড়ি ফিরিল রাত্রি নয়টার পরে। ক্লান্তপদে তিনতলার সিঁড়ি ভাঙ্গিয়া যখন নিজের ছোট ফ্ল্যাটটিতে সে চাবি খুলিয়া ঢুকিল, তখন যেন আর আলো জ্বালিবার মতও দেহের অবস্থা নাই। অবশ্য আলো জ্বালিবার খুব বেশী প্রয়োজনও ছিল না। পুবের জানালায় শুধু শার্সি দেওয়া ছিল, তাহারই মধ্য দিয়া প্রচুর চাঁদের আলো আসিয়া পড়িয়াছে, ঘরের মধ্যে প্রায় সব কিছুই আবছা দেখা যায়। সে পাঞ্জাবি ও গেঞ্জিটা খুলিয়া আলনায় টাঙাইয়া রাখিল, তাহার পর ঘরের জানালাগুলি সব খুলিয়া দিয়া একটা ক্যাম্বিসের চেয়ারের উপর দেহ এলাইয়া দিল।
নীচে তখনও কর্মমুখর কলিকাতা ঘুমাইয়া পড়ে নাই। তখনও ট্রাম-বাস পূর্ণ উদ্যমে চলিয়াছে, দোকান-পাটও সব বন্ধ হয় নাই। শহরের কর্মব্যস্ততার এই মিলিত কোলাহলে এতটা উপরে আসিয়া কেমন যেন মধুরই লাগে। নীচেকার উজ্জ্বল আলো এখানের চন্দ্রালোককে ম্লান করিতে পারে না, কিন্তু তাহার একটা রেশ এ পর্যন্ত পৌঁছায়। বেশ লাগে অরুণের এ ব্যাপারটা সে নিজের একান্ত কাছে কলরব পছন্দ করে না, কিন্তু তাই বলিয়া একেবারে নির্জনবাসেও তাহার প্রাণ যেন হাঁপাইয়া উঠো সেইজন্য ইচ্ছা করিয়াই শহরতলীতে যায় নাই, শহরের জনতামুখর এই বিশেষ ব্যস্ত রাজপথটিতেই আসিয়া ফ্ল্যাট ভাড়া করিয়াছে।
ফ্ল্যাট তো ভারি! মোট দেড়খানা ঘর। ঘর বলিতে ওই একটি, পাশে যে স্থানটি আছে তাহাকে আধখানা ঘর বলিলেও বেশি সম্মান করা হয়—চলন মাত্র, একটি ছোট টেবিল পড়িলেই আর নড়িবার উপায় থাকে না। অন্যান্য ফ্ল্যাটগুলি হইতে তিল তিল করিয়া স্থান বাঁচাইয়া এই অদ্ভুত তিলোত্তমা তাহার অদুষ্টে গড়িয়া উঠিয়াছে। অবশ্য একপক্ষে তাহা ভালই হইয়াছে বলিতে হইবে, নহিলে পনেরো টাকা ভাড়ায় একটা পৃথক ফ্ল্যাটই বা মিলিত কোথায়? অরুণের এখন যা মানসিক অবস্থা, মেসের বাসা সে কল্পনাও করিতে পারে না। অথচ শুধু একজন পুরুষকে ঘরও বড় একটা কেহ ভাড়া দিতে চায় না। আর যদি বা পাওয়া যায়, সেও বড় গোলমাল।
তাহার চেয়ে এই-ই বেশ পনেরোটি টাকা ভাড়া দেয় আর এই বাড়ীরই দারোয়ানকে দেয় সাতটি টাকা। সে-ই দুই বেলা রান্না করিয়া দিয়া যায়। হিন্দুস্থানী দারোয়ান, সুতরাং মাছ-মাংস সে খায় না, দিতেও পারে না। কিন্তু তাহাতে অরুণের বিশেষ অসুবিধা হয় না, নিরামিষই তাহার ভাল লাগে আর একটি ঠিকা ঝি আছে, সে প্রত্যহ সকালে আসিয়া ঘরের কাজ করিয়া দিয়া যায়। এই তাহার সংসার।
ইহার বেশি আজ আর সে চায়ও না, বরং এইটুকু স্বাচ্ছন্দ্য বরাবর বজায় থাকিলেই সে খুশী মাস-ছয়েক আগে এই ব্যবস্থার কথাও সে কল্পনা করিতে পারিত না। দুইটি কি তিনটি গোটা পাঁচ-ছয় টাকার টিউশনি সম্বল করিয়া যাহাকে জীবনযাত্রা নির্বাহ করিতে হইত, মেসের দুই বেলা ভাত এবং কোনমতে কোথাও একটু মাথা গুজিবার স্থান, ওইটুকুই ছিল তাহার পক্ষে বিলাসা — একেবারে সম্প্রতি, মাত্র ছয় মাস আগে ভগবান মুখ তুলিয়া চাহিয়াছেন, চল্লিশ টাকা মাহিনার একটা মাস্টারি মিলিয়াছে এবং চাকরিটি টিকিয়া যাইবে বলিয়াই সে আশা করো অন্তত সেই ভরসাতেই সে মাস-তিনেক আগে এই ফ্ল্যাটটা ভাড়া লইয়াছে।
অবশ্য শুধু মাস্টারিই আজ আর তাহার একমাত্র অবলম্বন নয়, প্রায় বছরদুয়েক আগে, গভীর বেদনা এবং নৈরাশ্যের মধ্যে, উপার্জনের আর একটি পথও হঠাৎ সে খুঁজিয়া পাইয়াছিলা খুব ছোটবেলায় স্কুলের ম্যাগাজিনে সে কবিতা ও গল্প লিখিতা এতদিন পরে মানসিক অবসাদে যখন একেবারে ভাঙ্গিয়া পড়িবার উপক্রম হইয়াছিল, তখন সে সেই পুরাতন অভ্যাসের মধ্যেই আবার সান্ত্বনা খুঁজিয়া পাইলা। এবার আর কবিতা লিখিবার চেষ্টা করে নাই, শুধু গল্প। একে। একে দু-একটি সাময়িকপত্রে সে গল্প ছাপাও হইল, ক্রমে তাহার দরুন পাঁচ টাকা সাত টাকা দক্ষিণাও মিলিতে লাগিল। সেদিন যাহা ছিল অঙ্কুর, আজ তাহাই মহীরূহে পরিণত হইয়াছে— বাংলা দেশের এক বিখ্যাত প্রকাশক একেবারে তিন শত টাকা দিয়া তাহার একখানি উপন্যাস লইয়াছেন, এবং সেটি ছাপাও প্রায় শেষ হইয়া আসিয়াছে। আজ তাহারই শেষ কয় পৃষ্ঠার প্রুফ এবং বাকি এক শত টাকার চেক প্রকাশক দিয়া দিয়াছেন।
অরুণ একবার নড়িয়া-চড়িয়া বসিল। প্রুফটা দেখিতেই হইবে, আলোটা জ্বালা দরকার। প্রকাশক মোহিতবাবু অনুরোধ করিয়াছেন, ইস্কুল যাবার পথেই তো প্রেস পড়বে, যদি কিছু মনে করেন, তাহ’লে যাবার পথে প্রুফটা প্রেসে ফেলে দিয়ে গেলে বড্ড ভাল হয়। দশটার আগে পৌঁছলে কাল ছাপা শেষ হয়ে পশু বইটা বেরিয়ে যেতে পারো।
প্রথম উপন্যাস বাহির হইবে। তাহার নিজের আগ্রহও বড় কম নয়। সে আলোটা জ্বালিবার জন্য উঠিয়া দাঁড়াইল।
কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়িয়া গেল মোহিতবাবুর আর একটা কথা, টাইটেলের চার পাতা বাদ দিয়েও আর দুটা পাতা বাঁচছে। ‘উৎসর্গ করিবার যদি কাউকে থাকে তো লিখে দিন না। প্রথম বই আপনার, কাকে উৎসর্গ করবেন ভেবে দেখুন।
কথাটা খুবই সাধারণ কিন্তু ইহার পিছনে কতখানি অপ্রীতিকর চিন্তা এবং স্মৃতিই না জড়াইয়া আছে!
অরুণ আর আলো জ্বালিবার চেষ্টা করিল না। নীচে কোলাহলমুখর, আলোকোজ্জ্বল রাজপথের। দিকে চাহিয়া বহুক্ষণ স্তব্ধভাবে দাঁড়াইয়া রহিল, তাহার পর আবার চেয়ারেই আসিয়া বসিল। তাহার প্রথম বই কাহাকে উৎসর্গ করিবে—এই প্রশ্নটার সামনাসামনি দাঁড়াইয়া আজ এই সত্যটাই সে গভীরভাবে উপলব্ধি করিল যে, পৃথিবীতে তাহার কেহ নাই। আত্মীয়, বন্ধু, স্নেহভাজন কোথায়ও এমন কেহ নাই, যাহার হাতে তাহার বহু বিনিদ্র রজনীর ফল, বহু সাধনার বস্তু এই বইখানি তুলিয়া দেওয়া যায়।
অথচ আজ তাহার সবই থাকিবার কথা। মা খুব অল্প বয়সে মারা গিয়াছিলেন বটে কিন্তু বাবা সে অভাব জানিতে দেন নাই কখনই। অতি যত্নে মানুষ করিয়া বি.এ. পাশ করাইয়া অফিসেও ঢুকাইয়া দিয়াছিলেন এবং সংসারে লোকের অভাব বলিয়া অনেক খুঁজিয়া সুন্দরী পুত্রবধূও ঘরে আনিয়াছিলেন। সেদিন কিন্তু জীবনকে বেশ রঙীন বলিয়াই বোধ হইয়াছিল।
কিন্তু একটি বৎসর কাটিতে না কাটিতে কি কাণ্ডটাই না হইয়া গেল! বাবা মারা গেলেন, তাহারই মাস কয়েকের মধ্যে হঠাৎ অফিসটিও উঠিয়া গেল। সেই যে চাকরি গেল—আর কিছুতেই কোথাও কোন কাজ মিলিল না। এক মাস, দুই মাস করিয়া বৎসর, ক্রমে দুই বৎসর। কাটিয়া গেল। বাবা বিশেষ কিছুই রাখিয়া যাইতে পারেন নাই, সুতরাং একে একে নীলিমার গহনাগুলি সব গেল। তাহার পর ঘরের আসবাব-পত্র, সর্ব শেষে বাসন-কোসনও আর রহিল না। মধ্যে মধ্যে দুই একটি ছোটখাটো টিউশনি হয়ত পায় কিন্তু সেও পাঁচ সাত টাকার মাত্র। তাহাতে খাওয়া পরা বাড়ী-ভাড়া সবগুলি চলে না। তাই বাড়ী ছাড়িয়া সে ফ্ল্যাটে আসিল। সেখান হইতে ভাড়াটে-বাড়ীর নীচের তলায় একখানা অন্ধকার ঘর, তবু ভাড়া দেওয়া যায় না। অপমানের ভয়টা বড় বেশী ছিল বলিয়া বেশী ধার করিতে সে পারিত না। যাহা কিছু সামান্য পাইত কোন মতে ঘর ভাড়াটা দিয়া দিত, সুতরাং নিজেদের ভাগ্যে দিনের পর দিন চলিত উপবাস
উঃ, সে দিনের কথা মনে করিলে আজও বুকের রক্ত হিম হইয়া যায় শুধু নৈরাশ্য ও তিক্ততা এতটুকু আশা, এতটুকু আনন্দের আলোও কোথাও নাই। সারাদিনই প্রায় কাজের চেষ্টায় ঘুরিত। গভীর রাত্রে ক্লান্ত দেহ ও মন লইয়া বাড়ী ফিরিয়া দেখিত, হয়তো নীলিমা তখনও শুষ্ক মুখে তাহার অপেক্ষায় দাঁড়াইয়া আছে। আগে আগে সে প্রশ্ন করিত, নয় তো একটু ম্লান হাসিত, ইদানীং তাহাও আর পারিত না উপর্যুপরি উপবাসে তাহার প্রাণশক্তি গিয়াছিল ফুরাইয়া। দিনের পর দিন এই একই ঘটনা ঘটিয়াছে, তবু একটি কুড়ি টাকা মাহিনার চাকরিও সে জোটাইতে পারে নাই।
অরুণের আত্মীয়-স্বজনরা দারিদ্র্য দেখিয়া বহুদিনই ত্যাগ করিয়াছিলেনা নীলিমারও বিশেষ কেহ ছিল না। অসামান্য রূপ দেখিয়া নিতান্ত গরীবের ঘর হইতেই অরুণের বাবা তাকে আনিয়াছিলেন। সুতরাং এক বেলা আশ্রয় দিতে পারে, খাদ্য দিতে পারে, শেষ পর্যন্ত এমন কেহই যখন আর রহিল না, তখন কোন প্রকার ধার করা বা সাহায্য চাওয়ার চেষ্টাও অরুণ ছাড়িয়া দিল। এরপর চলিতে লাগিল শুধু উপবাস। দুই দিন, তিন দিন অন্তর হয়তো ভাত জোটে, তাও এক বেলা।
অবশেষে নীলিমা আর সহিতে পারিল না। আশ্রয় দিবার আত্মীয় ছিল না বটে, কিন্তু রূপ যথেষ্ট ছিল বলিয়া সর্বনাশ করিবার লোকের অভাব ঘটিল না। অরুণের চরম দুর্দিনে, তাহার ভার বহন করিবার দায়িত্ব হইতে মুক্তি দিয়া নীলিমা একদিন চলিয়া গেল। যাইবার সময় শুধু রাখিয়া গেল এক ছত্র চিঠি–
‘আমি আর সইতে পারলুম না আমাকে ক্ষমা করো। আমার ভার ঘুচলে তুমিও হয়তো এক বেলা খেতে পাবে।’
অরুণ অকস্মাৎ সোজা হইয়া দাঁড়াইল। তাহার মাথা দিয়া তখন যেন আগুন বাহির হইতেছে। সে বাথরুমে গিয়া মাথায় খানিকটা জল থাবড়াইয়া দিল, তাহার পর মুখ-হাত মুছিয়া জোর করিয়া আলোটা জ্বালিয়া প্রুফ দেখিতে বসিল। কাজ সারিতেই হইবে, বৃথা চিন্তা করিবার সময় তাহার নাই।
কিন্তু প্রফ ছিল সামান্য, শীঘ্রই শেষ হইয়া গেল। আবার সেই উৎসর্গের প্রশ্ন সামনে কাগজগুলা খোলাই পড়িয়া রহিল, টেবিল-ল্যাম্পের আলোটা নিঃশব্দে জ্বলিতে লাগিল, সে জানালার মধ্য দিয়া রাস্তার উপরে আর একটা বাড়ীর কার্নিস, যেখানে এক ফালি চাঁদের আলো আসিয়া পড়িয়াছে, সেই দিকে চাহিয়া বসিয়া রহিলা মন তাহার চলিয়া গিয়াছে তখন কত দূরে, অতীতের এক কুৎসিত কর্দমাক্ত মেঘ-ঘন দিনে যেখানে আলোর রেখা মাত্র নাই, সেদিনের কথা মনে পড়িলে আজও তাহার আত্মহত্যা করিতে ইচ্ছা করে—
সেদিন হয়তো তাহার মরাই উচিত ছিল। নিজের স্ত্রী, ভরণ-পোষণের অক্ষমতার জন্য যাহাকে ত্যাগ করিয়া যায়, সে আবার সেই কালামুখ লইয়া বাঁচিয়া থাকে কি বলিয়া? কিন্তু মরিতে সে পারে নাই। হয়তো স্বাভাবিকভাবে মৃত্যু আসিলে সে আদর করিয়াই বরণ করিত, কিন্তু স্বেচ্ছায় জীবনটাকে বাহির করিতে সে পারে নাই, অত দুঃখের পরেও না। বরং গৃহস্থালীর সামান্য যে দুই একটা তৈজস অবশিষ্ট ছিল, তাহাও বেচিয়া একটা মেসে গিয়া উঠিয়াছিল, এবং নিজের মনেও স্বীকার করিতে আজ তাহার লজ্জা হয়, দুই বেলা ভাত খাইতে পাইয়া সে যেন স্বস্তির নিঃশ্বাসই ফেলিয়াছিলা সেই হইতেই সে নিশ্চিন্ত এবং নিঃসঙ্গ।
তাহার পর আবার একটু একটু করিয়া সে নিজের জীবিকার ব্যবস্থা করিতে পারিয়াছে। আজ বরং তাহার অবস্থা সচ্ছলই, কিন্তু এই সচ্ছলতা একদিন যাহার জন্য সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন। ছিল, দুঃখের ঘূর্ণাবর্তে তাহার সেই জীবন-সঙ্গিনীই গিয়াছে হারাইয়া। আজ আর এ স্বাচ্ছন্দ্যের যেন কোন মূল্যই নাই। কোথায় আছে সে কে জানে সুখে আছে কি আরও দুঃখে আছে! কাহার আশ্রয়ে আছে তাই বা কে জানে, সে কেমন লোক! হয়তো বা বাঁচিয়াই নাই। দুঃখে, কষ্টে, দারিদ্র্যে—হয়তো অকালেই এ পৃথিবী হইতে বিদায় লইয়াছে। কথাটা ভাবিতেই অরুণের দুই চোখ অশ্রু-পরিপূর্ণ হইয়া আসিল। বেচারী অত দুঃখই সহিল, আর কয়েকটা দিন ধৈর্য ধরিয়া থাকিলে হয়তো আর ইহার প্রয়োজন হইত না। আজ এই স্বাচ্ছন্দ্যের সেও অংশ লইতে পারিত, আজ আর তাহার প্রথম উপন্যাস কাহাকে উৎসর্গ করিবে, এ প্রশ্ন উঠিত না। সে হয়তো আজও বাঁচিয়া আছে, অথচ এ সমস্যার মীমাংসা করিতে পারিতেছে না অরুণ কিছুতেই।
নীলিমাকেই সে উৎসর্গ করিবে নাকি শেষ পর্যন্ত? কুল-ত্যাগিনী স্ত্রীকে?
দোষ কি?
চিন্তাটা মাথায় আসিবার সঙ্গে সঙ্গে সে যেন অস্থির হইয়া উঠিলা চুপ করিয়া বসিয়া থাকিতে না পারিয়া সঙ্কীর্ণ ঘরের মধ্যেই পায়চারি শুরু করিয়া দিল।
বেচারী নীলিমা, তাহারই বা অপরাধ কি, কি কর্মটাই না করিয়াছে সে! দিনের পর দিন নিরস্তু উপবাস করিয়াছে, লজ্জা নিবারণের কাপড়টুকু পর্যন্ত জোটে নাই। বহুদিন তাহাকে গামছা পরিয়া একমাত্র ছেড়া কাপড় শুকাইয়া লইতে হইয়াছে। তবু—তবু সে গঞ্জনার একটি শব্দও মুখ দিয়া উচ্চারণ করে নাই, কোন প্রকার অনুযোগ করে নাই, আবার স্বামী খাইবে বলিয়া সঞ্চয় করিয়া রাখিয়াছে। শেষ পর্যন্ত যদি সে একদিন দুর্বল হইয়া পড়িয়াই থাকে তো এমন কিছু অপরাধ নয়।
অরুণ তাহার মনের মধ্যে বহু দূর পর্যন্ত দৃষ্টি মেলিয়া দিয়া, আজ বোধ করি প্রথম, লক্ষ্য করিল যে, সেখানে নীলিমার সম্বন্ধে কোন অভিমান, কোন অনুযোগই আর অবশিষ্ট নাই। হয়তো আছে বেদনা-বোধ, কিন্তু তাহার জন্য দায়ী তাহার নিজেরই অদৃষ্ট। যতদিন নীলিমাকে সে পাইয়াছে, কখনও কোনও অভিযোগের কারণই তো সে ঘটিতে দেয় নাই। স্নেহে, প্রেমে, সেবায়, লীলাচাঞ্চল্যে পরিপূর্ণ তাহার সেই কিশোরী বধূর কথা মনে পড়িলে আজও সারা দেহে রোমাঞ্চ হয়। না, যতদিন সে পাইয়াছে, আশ মিটাইয়া পাইয়াছে। এমন দুর্ভাগ্য খুব অল্প লোকেরই হয়। বটে, কিন্তু এমন সৌভাগ্যও কদাচিৎ দেখা যায়। প্রথম যৌবনের, সেই নিশ্চিন্ত জীবনযাত্রার এক একটি বিনিদ্র রজনীর যে মধুস্মৃতি তাহার মনের মধ্যে সঞ্চিত আছে, শুধু সেইগুলি অবলম্বন করিয়াই তো একটা জীবন স্বচ্ছন্দে কাটিয়া যাইতে পারো তবে, তাহার কি কোন মূল্যই নাই, সেজন্য কোন কৃতজ্ঞতা নাই? অরুণের নিজের দোষে, অসীম দুঃখের ফলে, একটি মুহূর্তের দুর্বলতায় যদি তাহার পদলনই হইয়া থাকে তো সেইটাই কি সে মনের মধ্যে বড় করিয়া রাখিবে আর অতখানি প্রেম, অতখানি নিষ্ঠা সব ব্যর্থ হইয়া যাইবে? না, মনের এই দুর্বলতা, এই অন্যায় সংস্কারকে সে কিছুতেই প্রশ্রয় দিবে না, নীলিমাকেই সে প্রথম বই উৎসর্গ করিবে।
নীচে তখন রাজপথ জনবিরল হইয়া গিয়াছে, দোকান-পাটগুলি বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় আলোও হইয়া উঠিয়াছে ম্লান শহরে অশান্ত বিক্ষুব্ধতার উপরে যেন চমৎকার একটি সুষুপ্তি নামিয়া আসিয়াছে, সমস্তটা মিলিয়া একটা করুণ অথচ মধুর শান্তি।
সে খানিকটা যেন কিসের আশায় কান পাতিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। পাশের ফ্ল্যাটে তখনও স্বামী স্ত্রীর আলাপের গুঞ্জন শোনা যাইতেছে, নীচে কোথায় একটা ছেলে কাঁদিতেছে একটানা সুরে। আর সব শান্ত, স্তব্ধ।
সে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া ফিরিয়া আসিয়া আবার চেয়ারে বসিল। তাহার পর দৃঢ় হস্তে প্রফের কাগজগুলা টানিয়া লইয়া উৎসর্গ পৃষ্ঠাটি লিখিয়া দিলা বেশী কিছু নয়, শুধু—’শ্রীমতী নীলিমা দেবী, কল্যাণীয়াসু’।
পরের দিন সন্ধ্যাবেলাই বই বাহির হইয়া গেল। প্রকাশক মোহিতবাবু এক কপি হাতে করিয়া রাত্রে আসিলেন রক্ষিতার বাড়ী উপরে উঠিয়া তাহার সামনে বইখানা ফেলিয়া দিয়া কহিলেন, এই নাও, তোমার সেই বই বেরিয়েছে।
সে বসিয়া কি একটা বুনিতেছিল, তাড়াতাড়ি সেগুলি নামাইয়া রাখিয়া সাগ্রহে বইটা তুলিয়া লইল। চমৎকার বাঁধাই, উপরে রঙিন ছবি, তাহারই মধ্যে ঝকঝক করিতেছে বই ও লেখকের নাম খানিকটা নাড়িয়া-চাড়িয়া বইটা বিছানার পাশে একটা টিপয়ের উপর সযত্নে রাখিয়া দিয়া সে উঠিয়া মোহিতবাবুর স্বাচ্ছন্দ্যের তদ্বিরে মন দিল। চাদর ও জামাটা খুলিয়া তাহার হাতে দিতে দিতে মোহিতবাবু বলিলেন, বাবা বাঁচলাম! যা তাগাদা তোমার, ওই বইটা যেন আমার সতীন হয়ে উঠেছিল!
তাহার পর নীচের ঢালা বিছানাটায় দেহ এলাইয়া দিয়া কহিলেন, রামটহল গেল কোথায়? একটু তামাক দিতে বলো। …বেরুল তো, এখন খরচাটা উঠলে বাঁচি। তোমার কথা শুনে একগাদা টাকা দিয়ে বইটা নিলাম, ওর আদ্ধেক টাকাও কেউ দিত না।
ও পক্ষ তখন কি একটা কাজে ব্যস্ত ছিল, মুখ না ফিরাইয়াই কহিল, নিশ্চয়ই উঠবে। অত ভাল লেখা, লোকে নেবে না?
মুখটা বিকৃত করিয়া মোহিত কহিলেন, কে জানে কি লেখা, আমি কি আর কোনটা পড়েছি ছাই! তুমিই খালি ওঁর নাম করতে গ’লে পড়ো।
হ্যাঁ গো মশাই, শুধু বুঝি আমি? ভালোই যদি না হবে, তাহ’লে অতগুলো মাসিক-পত্র ওঁর লেখা ছাপে কেন?
মোহিতবাবু একটা তাচ্ছিল্যসূচক শব্দ করিয়া কহিলেন, হাঁ, ওদের তো ভারী বুদ্ধি, ওরা যা পায় তাই ছাপো…তোমারও যেমন খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই, যতগুলো কাগজ অরুণবাবুর লেখা ছাপে, সবগুলোই তো তুমি নিতে শুরু করেছ দেখছি।
কি করব, একলা সময় কাটে কি করে আমার? তুমি কিছু ভেবো না, নিশ্চয় ভাল বিক্রি হবে সব কাগজে পাঠিয়ে দাও, দেখবে, ভাল আলোচনা বেরুলেই বিক্রি হতে শুরু হবে।
হ’লেই বাঁচি। একেবারে নতুন লেখক, ভয় করে বড্ড।
মোহিতবাবু খানিকটা চোখ বুজিয়া পড়িয়া রহিলেন। একটু পরে রামটহল তামাক দিয়া যাইতে উঠিয়া বসিয়া গড়ার নলটা হাতে তুলিয়া লইয়া কহিলেন, হ্যাঁ, আর একটা ভারী মজার ব্যাপার বলতে ভুলে গেছি। শুনেছ, ওঁর বউয়ের নামও নীলিমা।
নীলিমা হেঁট হইয়া জলখাবারের থালা রাখিতেছিল, অকস্মাৎ তাহার হাতটা কাঁপিয়া উঠিল, প্রশ্ন করিল, কে বলেছে?
মোহিতবাবু জবাব দিলেন, ওই দেখ না বইটা খুলে, উৎসর্গ করেছেন তার নামে।
নীলিমা তাড়াতাড়ি বইটা খুলিয়া উৎসর্গ পৃষ্ঠাটা বাহির করিল। মিনিট খানেক সেদিকে নিঃশব্দে চাহিয়া থাকিয়া প্রশ্ন করিল, কিন্তু ও যে ওঁর বউয়ের নাম, তা তুমি কেমন ক’রে জানলে?
মোহিতবাবু মুখ হইতে নলটা সরাইয়া বলিলেন, নামটা দেখে ভারী মজা লাগল। বলতে তো পারি না কিছু, ওঁকেই জিজ্ঞাসা করলাম, ইনি কে মশাই? অরুণবাবু জবাব দিলেন, আমার স্ত্রী।’ অদ্ভুত মিল, না?
নীলিমা কোন উত্তর দিল না। তখনও তাহার চোখের সামনে সেই উৎসর্গ পৃষ্ঠাটা ভোলা, কিন্তু অক্ষরগুলি তখন আর চোখে পড়িতেছিল না, সব যেন তাহার দৃষ্টির সম্মুখে লেপিয়া মুছিয়া একাকার হইয়া গিয়াছিল।
আরও মিনিট দুই পরে বইটা বন্ধ করিয়া সে ঈষৎ রুদ্ধ-কণ্ঠে কহিল, বস, তোমার চা-টা নিয়ে আসি—
কিন্তু তখনই সে নীচে গেল না। ওপাশের বারান্দায় দাঁড়াইয়া অনেকক্ষণ গলির উপরের একফালি অন্ধকার আকাশের দিকে নির্নিমেষ নেত্রে চাহিয়া রহিল। তাহার পর কে জানে কাহার উদ্দেশ্যে হাত তুলিয়া নমস্কার করিল।
মোহিতবাবু ততক্ষণে ঘুমাইয়া পড়িয়াছেন।