‘উপদ্রুত উপকূল’ গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসবে স্বাগত ভাষন
সেই কবে থেকে লিখতে শুরু করেছিলাম আজ আর পষ্ট কোরে মনে পড়ে না। কখনো কোনো অবসরে কিংবা কোনো প্রশ্নের মুখোমুখি হলে এখন যা মনে আসে তা খুব ঝাপসা, এলোমেলো, ছেঁড়া ছেঁড়া কিছু ছবি, কিছু স্মৃতির কষ্ট। শৈশবের দুরন্ত দুপুর, বাবা খুব বদমেজাজী, মা তেমন স্নেহ করে না, কেমন একটা নিরব আকর্ষনে টেনে রাখে শুধু। বন্দরে শ্রমিকের কোলাহল, আর তার পাশে নদী— ভেঁপু বাজিয়ে জাহাজ ছাড়ছে। আমার খুব নিসঙ্গ লাগতো। কন্ঠের নিচে জ’মে উঠতো কষ্টের কান্না। এই ভাবে ভ্রমনের শুরু। তেইশ বছর হেঁটে এসে আজ আবার পেছনে তাকানোর প্রয়োজন হয়েছে। প্রয়োজন হয়েছে নিজের জীবনের দিকে, হৃদয়ের দিকে, বেদনা ও আনন্দের দিকে ফিরে তাকানোর।
লিখতে যখন শুরু করেছিলাম, দিব্যি কেটে বলতে পারি স্থির কোনো দায়িত্ববোধ নিয়ে লিখতে শুরু করিনি। না লিখলে কষ্ট হতো— কেমন এক ধরনের বলতে না- পারার কষ্ট, না-জানানোর কষ্ট। সেই শিশিরের মতো জ’মে ওঠা কষ্টগুলো সরাতে গিয়ে, সেই স্মৃতির মতো বেদনাগুলোকে সঞ্চয় করতে গিয়ে, সেই রোদ্দুরের মতো স্বপ্নগুলোকে সাজাতে গিয়ে আমি লিখতে শুরু করেছিলাম। নিজের সেই ভালো লাগার ঘরের দরজা একদিন খুলে গেল, একদিন সেই ঘরের ভেতর আমি দেখলাম জগত এসে ঠাঁই নিয়েছে, মানুষ এসে ঠাঁই নিয়েছে। আমি সেই জগতের দিকে তাকিয়ে দেখলাম তা আমার নিজের সংসার, আমি সেই মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সবাই এক একজন আমি। দেখলাম আমার মতো চোখের নিচে বেদনার শোকচিহ্ন নিয়ে তারা জেগে আছে, দেখলাম প্রচন্ড দুর্যোগের মধ্যে তারা আগলে আছে আগামীর স্বপ্ন। দেখলাম আমার হাতের মতোই তাদের কারো হাতে ভাগ্যরেখা নেই। তখন আমি আমার শীর্ন অথচ শক্তিমান হাতদুটি মাটিতে রেখে প্রতিজ্ঞা করলাম এই সূর্যহীন জোস্নাহীন অন্ধকারে আমি রোদ্দুর ফিরিয়ে আনবো, পূর্নিমা ফিরিয়ে আনবো।
‘উপদ্রুত উপকূল’ আমার প্রথম কবিতার বই। এদ্দিনের ছড়ানো ছিটানো যে চেহারাটি আমার ছিলো এখন তা একত্রিত হয়ে একটি কাঠামোর মধ্যে, দুটি মলাটের মধ্যে এসে ঠাঁই নিয়েছে। আমার কৃতিত্ব কিংবা ব্যর্থতার বিচারের ভার আপনাদের উপর। কিন্তু বই প্রসঙ্গে একটি কথা বলা প্রয়োজন বোলে আমি মনে করি। সাম্প্রতিককালে বামপন্থি রাজনীতির সঙ্গে যারা জড়িত তাঁরা একধরনের অভিযোগ করেন যে কবিতায় এতো হতাশার কথা কেন? ব্যর্থতা গ্লানি পরাজয়ের কথা কেন? একই বইয়ে এক কবিতায় আশার এবং অন্য কবিতায় হতাশার এই দ্বন্দ্ব কেন? লেখকের মধ্যে এতো কন্ট্রাডিক্স কেন? তাঁদের প্রতি আমার অনুরোধ আপনারা অন্তত নিজের জীবনের দিকে তাকিয়ে দেখুন, অন্তত নিজের একটি দিনকে চেয়ে দেখুন। যে যুবক সকাল বেলা রাজপথে মিছিলের অগ্রভাগে থেকে নেতৃত্ব দেয়, দুপুরের নিসঙ্গ অবসরে তার মায়ের কথা মনে হলে কষ্ট হয়। রাতে সে প্রেমিকার কাছে চিঠি লেখে কিংবা পরাজিত প্রেমের কষ্টে তার ঘুম আসে না।
জীবনকে জান্তবভাবে বিচার করা যুক্তিসংগত নয় বরং তা অবাস্তব। মানুষকে মানুষ হিশেবে নেয়া উচিত। হিশেব নিকেশ কোরে জীবন চলে না, যারা চালাতে যায় তারা হয় নিজেকে প্রতারনা করে, নয়তো জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
* অস্পষ্টতা প্রসঙ্গে
* আমার বিশ্বাস এবং আমার সরল উপস্থাপনা
* উৎসর্গ প্রসঙ্গে