2 of 2

উনিশ বছর বয়স – সুচিত্রা ভট্টাচার্য

উনিশ বছর বয়স – সুচিত্রা ভট্টাচার্য

॥ ১ ॥

কলেজ থেকে ফিরেই আশ্চর্য চিঠিটা পেল ঝিনুক। এক টুকরো আকাশের মতো ঝকঝকে নীল খাম। তার গায়ে তারার মতো ছড়িয়ে তার নাম ঠিকানা। কে রে বাবা! হাতের লেখাটা মোটেই মেয়েদের নয়। উঁহু। ভাস্কর, মধুবন কিংবা অরিজিতেরও নয়। ওদের হ্যান্ডরাইটিং ঝিনুকের চেনা। তাহলে! আশপাশের কোনও বীরপুঙ্গব আবার লাভ লেটার দিল নাকি। হতেও পারে। ওরকম স্টুপিড কিছু চিঠি প্রায়ই পায় ঝিনুক। বিশ্রী ভাষায়। ভুল বানানে। অনেক সময় ছেলেগুলোকে ধরেও ফেলে। ওফ। তখন তাদের কী করুণ অবস্থা। তাড়খাওয়া জার্মান স্পিৎজের মতো লেজ গুটিয়ে ছুট ছুট। হাসিও পায়…। ভাবতে ভাবতে বেশ একটু অন্যমনস্ক ভাবেই খামের মুখটা ছিঁড়েছে। যেই না ছেঁড়া, অমনি আসল কালপ্রিটটি তড়াক করে লাফিয়ে একেবারে বাইরে। আরে এ যে সায়ন! সায়ন মিত্র। এ বছর ফাইন্যাল-অ্যাপিয়ার্ড। উইথ ইকো অনার্স। হায়ার সেকেন্ডারির নাইনথ বয়। এবং বিশ্বের এক নম্বর ফাজিল ক্লাবের পাণ্ডা। কিন্তু সায়ন তাকে হঠাৎ চিঠি দিতে গেল কেন? মতলব কি? ঝিনুক ভাল করে চিঠিটা চোখের সামনে ধরল ‘…লিভিং ক্যালকাটা। বোধহয় ফর এভার। অন অক্টোবার টোয়েন্টিসেকেন্ড…’ ব্যাস। মাত্র তিনটেই লাইন। টেলিগ্রাম স্টাইলে। ডেট-ফেটের বালাই নেই। নো ঠিকানা। ইয়া বড় দাদুসাইজের ফুলস্কেপ কাগজের মধ্যিখানে খুদি খুদি লেটারগুলো টিপটিপ করছে। যেন বে অফ-বেঙ্গলে বিন্দু বিন্দু কিছু জেলে নৌকো। তারপর একদম নীচে প্রায় তীরের কাছে এসে গড়ানো ঢেউ—‘উনিশটা দশে ফ্লাইট। আসবি একবার? ডোমেস্টিক লাউঞ্জে? তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। মাইরি।’

টোয়েন্টিসেকেন্ড মানে কাল। ঝিনুক কয়েক সেকেন্ড থমকে রইল। চিঠিটা কি সিরিয়াস? হুঁশ। হতেই পারে না। রোজই তো আড্ডা মারছে এসে ক্যান্টিনে। পরশুও একতলা থেকে হাত নাড়ল। ঝিনুক অবশ্য মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। অ্যাজ ইউস্যয়াল। এর মধ্যে কথা নেই, বার্তা নেই, দুম করে একটা ‘চলে যাওয়া’ আসে কোত্থেকে? এ নির্ঘাত সায়নের নতুন ফর্মে লেগপুলিং। সব সময় কারুর না কারুর পিছনে লেগে আছে। মেয়েদের না খ্যাপালে ভাত হজম হয় না। যত চটে মেয়েরা, ওর তত মজা। প্লেজার। সব থেকে মজা বোধহয় ঝিনুককে খেপিয়ে। সেই যে ফার্স্ট ইয়ারের প্রথম দিন থেকে…। ঝিনুক সজোরে নীচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরল। চেহারাটা একটু হ্যান্ডসাম আর লেখাপড়ায় চোখা হলেই কি সব থেকে স্মার্ট হওয়া যায়? কখ্খনো না। স্মার্টনেসটা ভেতরকার ব্যাপার। তার জন্য অত পস্‌চার মারার দরকার হয় না। চিঠিও লিখতে হয় না কায়দা মেরে। ঝিনুককেই বা কি ভেবেছে ও? মুরগি? না রাস্তার পাগলি? যখন তখন এসে টিজ করবে? এই তো লাস্ট উইকেও ওকে করিডোরে দেখে তড়াং করে রাস্তা আটকে দাঁড়িয়েছে। সরে যাওয়ার আগেই মেডিয়াভাল নাইট হয়ে বসে গেছে হাঁটুর কাছে। তারপর যাত্রাদলের কেষ্টর মতো সে কী গলা কাঁপানোর ভান, —হাই মেরিলিন। আবার এসেছি আমি। তব চরণতলে। সেই অভাগা গ্যারি কুপার।

—আমি ধন্য হয়েছি। ঝিনুকও ভেংচে উঠেছে সঙ্গে সঙ্গে —রাস্তা ছাড়। ক্লাস আরম্ভ হয়ে গেছে।

—ছাড়ব। তার আগে তুই আর একবারটি আমাকে সিডিউস কর। মনরো স্টাইলে। সেদিনের মতো। প্লিইইজ।।

ফার্স্ট ইয়ারের ছেলেমেয়েগুলোও ভিড় জমিয়ে হ্যা হ্যা করে হাসছে। যেন দারুণ কমিক সিন দেখাচ্ছে সায়ন। কেষ্ট মুখার্জির প্রেম নিবেদন। ওফেলিয়াকে। ঝিনুক ভীষণ রেগে গিয়েছিল—‘দ্যাখ, তোকে লাস্ট ওয়ার্নিং দিচ্ছি। লাগতে হলে রাস্তায় গিয়ে অন্য মেয়েদের পেছনে লাগ। আমার সঙ্গে একদম…

—যাহ বাবা, পেছনে লেগেছি কোথায়? সায়ন সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে সাক্ষী মানতে শুরু করেছে ফ্রেশারগুলোকে,—তোরাই বল। আমি অবসিন করেছি কিছু?

কথা বলার ভঙ্গি দেখে ঝিনুকের বন্ধুরাও হেসে কুটিপাটি। সুকন্যা, তনিমা, শবনম। ধারালো বাগে ঝিনুক ঝমঝম এগিয়ে গেছে—এই চলে আয় তো। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওই কলেজছাড়া ক্লাউনটাকে দেখলেই হবে? ক্লাস করবি না? বি কে জি এতক্ষণে বোধহয়…

কাকে গালাগাল দেওয়া? নির্লজ ছেলেটা তখনও চেঁচিয়ে চলেছে—এই ঝিনুক, দাঁড়া, যাস না। শোন শোন…’

—তোর কথা তুই তোর পকেটে রেখে দে।

—বিশ্বাস কর, ইয়ার্কি না। তোর সঙ্গে খুব জরুরি কথা ছিল। রিয়েলি। সুকন্যাদের ছাড়িয়ে সায়ন আবার মুখোমুখি—ক্লাস শেষ হলে ক্যান্টিনে একবার আসিস। প্লিজ। কথা দিচ্ছি বোর করব না।

আহ্লাদ রে। উনি ডাকলেই যে ঝিনুক হ্যাল হ্যাল করে ছুটে যাবে। অত খায় না। ঝিনুকের চোখ দুটো দপদপ করে উঠল। চিঠিটা টান মেরে ফেলে দিল টেবিলের ওপর। জুতো জোড়া এক লাথিতে দরজার কোণে। ওয়ার্ডরোবের পাল্লা থেকে হাসছে জর্জ মাইকেল। উজ্জ্বল চোখ। হাতে গিটার। সেদিকে কটমট তাকিয়ে রইল খানিকক্ষণ। দেবে নাকি লোকটার চোখ গেলে? কিংবা চোয়ালে এক ঘুসি? না, না, না, তোমাকে মারতে যাব কেন? আমার সুনুমুনু। ঝিনুকের মুখ নিভু নিভু হয়েও জ্বলে উঠেছে। উঃ, কী শয়তান ছেলে। কথায় জ্বালিয়ে মন ভরেনি। এবার চিঠি। দাঁড়াও দেখাচ্ছি তোমার মজা। এমন টাইট দেব যে বাছাধন পালাবার পথ পাবে না। আবার ন্যাকা ন্যাকা করে লেখা হয়েছে— তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। দেখাচ্ছি। এমন দ্যাখা দ্যাখাব…। ঝিনুক ভয়ানক আক্রোশে হ্যান্ডব্যাগখানা আছড়ে দিল মেঝেতে। তারপর ঝাঁঝালো গলায় চেঁচিয়ে উঠল—মাআআআ। অনেকক্ষণ এসেছি আমি। এখখুনি খেতে দাও। পেট জ্বলে যাচ্ছে।

॥ ২ ॥

সাততলার ওপর ঝিনুকদের এই ফ্ল্যাটটা বেশ নিরিবিলি। বাইরের দরজা বন্ধ করে দিলেই পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন এক নির্জন দ্বীপ। ব্যালকনিটাতে দাঁড়ালে এরকমই একটা অনুভূতি জাগে ঝিনুকের। বিশেষ করে রাত্রিবেলা। মনে হয় একটা গাঢ় নীল সমুদ্রে একদম আলাদা হয়ে যেন ভেসে রয়েছে। বাবা মা। আর সে। ব্যালকনি থেকে ওপরতলা নীচতলা কিছুই দেখা যায় না। শুধু অনেকটা নীচে রাস্তাটা পড়ে থাকে সমুদ্রতলের মতো। সমুদ্রের কি তল দেখা যায়? বোধহয় না। তবু ঝিনুকের ওরকম মনে হয়। মনে হয় যেন জলের অনেক গভীরে গাড়িঘোড়াগুলো জলজীবদের মতো সাঁতার কাটছে! আর মানুষগুলো হয়ে গেছে পোকা, কাঁকড়া, জেলিফিশ, স্টারফিশ। গুড়গুড় ঘুরছে এদিকে সেদিক। হাত পা নাড়ছে। দেখতে দেখতে ঝিনুকের মনটা যেন কেমন গলে যেতে থাকে। গলতে গলতে একটা একা নদী হয়ে যায়। ভীষণ নিঃসঙ্গ লাগে নিজেকে। বাবা ফেরে অনেক রাতে। মা’ও মাঝে মাঝেই বাড়ি থাকে না। তখন বাড়িতে কেবল সে আর শোভামাসি। রাতদিনের কাজের লোক। আর একগাদা ইকনমিক্সের বই। ক্যালকুলাস। কিংবা সিডনি শেলডন, অ্যালিস্টেয়ার ম্যাকলিন। কখনো বা হেমিংওয়ে, মোঁপাসা, লরেন্স। আজ অবশ্য মা বাড়িতেই। ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখছে। খুব জোর আড-এর গান বেজে চলেছে। প্রতীখ্শা শুরু হবে। মা দু একবার উঁচু গলায় ডাকলও তাকে—ঝিনুক, আরম্ভ হচ্ছে রে। দেখবি তে আয়।

নাহ, ঝিনুকের আজ কিছু ভাল লাগছে না। সিরিয়ালও না। বিকেলের রাগটা পাকতে পাকতে কখন নিটোল একটা মন খারাপ হয়ে গেছে। কেন সে নিজেই জানে না। শবনম একটু আগে ফোন করেছিল—এই, কাল নন্দনে প্রতিদ্বন্দ্বী দেখতে যাবি? কলেজের পর? আঙ্কল টিকিট এনেছে।

ফস করে মুখ থেকে বেরিয়ে গেল—না রে, কাল অন্য কাজ আছে।

কেন বলল কথাটা? ইডিয়েটের মতো? তবে কি তার সাবকনশাস মন এয়ারপোর্ট যাবে ভাবছে? কাল। আশ্চর্য! নিজেকে বুন্ধু, হাঁদা, বোকার ডিম বলে গালাগালি দিতে ইচ্ছে করছে। সায়নের চিঠিটাকে হঠাৎ হঠাৎ বিশ্বাস করে ফেলছে কেন! হয়তো ছেলেটা কোথাওই যাচ্ছে না। পুরো ব্যাপারটাই ফলস। হয়তো দেখতে চায় সত্যিই ঝিনুক যায় কিনা। তাহলে পেছন পেছন গিয়ে রাস্তাতেই বেশ অপদস্থ করা যাবে। কমিকাল সিন ক্রিয়েট করে মজাসে হো হো হাসবে। অসম্ভব। সায়ন মিত্র বিশ্বাসের উপযুক্ত নয়। ভাবতে গিয়ে নিজের চিন্তায় নিজেই বিরক্ত ঝিনুক। যাবার প্রশ্নটা আসে কি করে? ধরে নেওয়া যাক সায়ন সত্যি সত্যি চলে গেল, তাতেই বা কি আসে যায়? বরং একটা আপদ নামবে ঘাড় থেকে।

মাথার ওপর হাত ছড়িয়ে আলগা আড়মোড়া ভাঙল ঝিনুক। ফালতু চিন্তা না করে ম্যাথস নিয়ে বসা দরকার। এস এম-এর নোটটাও ফেয়ার করতে হবে। ব্যালকনি ছেড়ে ঝিনুক নিজের ঘরে ফিরল। দরজা দিয়ে ঢুকতেই সোজাসুজি ছোট আলমারির গায়ে ইমরান খান, রবি শাস্ত্রী আর বরিস বেকার। তিনজনই ঝিনুকের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে। ঝিনুক মুখ ঘুরিয়ে নিল। ওই লোকগুলোকেও এখন অসহ্য লাগছে। ছেলেরা একটু হ্যান্ডসাম হলেই কী যে ভাবে নিজেদের। সঙ্গে গুণফুন থাকলে তো কথাই নেই। ধরাকে সরা জ্ঞান করবে। করুক গে। স্নব কোথাকার! ঝিনুকও কারুর থেকে কম যায় না। রূপে, গুণে। ওদের যদি অহংকার থাকতে পারে, ঝিনুকই বা কম কিসে! খাট ঘুরে জানালার ধারে, ড্রেসিংটেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে। সঙ্গে সঙ্গে বেলজিয়ান গ্লাসে টলমল এক সদ্যযুবতী। যুবতী নয়, মাত্র এই সন্ধেবেলায় ফোঁটা দোলনচাঁপা। ফর্সা, নরম শরীরের হালকা গোলাপি আভা। স্টেপকাট চুলে শ্রাবণের মেঘ। পালক পালক চোখের পাতা। পাতা ছুঁয়ে ভুরু। ঝিনুক ব্রাশ তুলে চুলে কয়েকটা টান দিল। দিয়েই আবার এলোমেলো করে দিয়েছে। ন্যাচারাল শাইন লিপস্টিক ঠোঁটের কাছে এনেও নামিয়ে রাখল। নানারকম মুখভঙ্গি করল আয়নায়। বার তিনেক নিজেকে জিভ ভ্যাংচাল। খোলা বন্ধ করল নাইটির বোতাম। উনিশ বছরের যৌবনটাকে আলতো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখল। মাগো মা, কী তাড়াতাড়ি দিন কেটে যায়। কবে যে এমন একটা বড় সড় মহিলা হয়ে গেল সে! অথচ ভাবলে মনে হয় এই সেদিনের কথা। এই তো কদিন আগে মাধ্যমিক দিল। দেখতে দেখতে হায়ার সেকেন্ডারি। ফার্স্ট ইয়ার। তারপর এই সেকেন্ড ইয়ার-এর শুরু।

হুঁ। কলেজের প্রথম দিনটা ছবির মতো মনে আছে ঝিনুকের। অ্যাডমিশনের পর কমলিকা বলেছিল—ফার্স্ট দিনটা খুব অ্যালার্ট থাকবি ঝিনুক। তুই তো নিজেদের স্কুলে এইচ এস করেছিস, জানিস না কলেজে প্রথম দিন হেভি র‍্যাগিং হয়। স্কুলের ছেলেদের সঙ্গে কলেজের ছেলেদের বহুত ডিফারেন্স।

শুনেই ঝিনুকের সে কী বুক ধড়ফড়। হাঁটু কাঁপা! র‍্যাগিং শব্দটার ভেতরেই যে বাঘের মতো ঘাপটি মেরে থাকে একটা ভীষণ ভয়। কাগজে পড়েছে। শুনেওছে অনেকের মুখে। এই তো গত বছর সুকন্যার দাদাই পালিয়ে এসেছিল। পিঠে একগাদা কালশিটে নিয়ে। কী ভয়ঙ্কর মেরেছিল বেচারাকে। শিরিনের দাদাকে নাকি ফুঁ দিয়ে দিয়ে একটা পয়সা নিয়ে যেতে বলেছিল বারান্দার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত। রাতে শুলেই গায়ে জল ঢেলে দিত।…সেরকম সাংঘাতিক কি কিছু হবে তার কলেজে! স্কুলের ছেলেমেয়ে কলেজে গেলেই অ্যাত্ত পালটে যায়! রীতিমতো এক বুক শঙ্কা নিয়ে কাঁপা পায়ে ক্লাসে ঢুকেছিল প্রথম দিন। ঢুকে ভিতু পাখির মতো এককোণে বসে চুপচাপ। কমলিকা, সুকন্যা, শবনমরাও ফ্যাকাশে। এমন কি ভাস্কর মধুবনরাও সময় গুনছে ঝড়ের। স্যার রোলকল শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে হুড়মুড় ঢুকে পড়ল একপাল ছেলেমেয়ে। কিছু সেকেন্ড ইয়ার। বেশির ভাগই থার্ড। রোগা হিলহিলে একটা মেয়ে স্যারের কাছ থেকে রেজিস্টার চাইল—প্লিজ স্যার, আজকের দিনটা…

কুড়িটা নতুন অনার্স স্টুডেন্টের হৃৎপিণ্ড তখন বন্ধ। প্রচণ্ড ঝড়ের পূর্ব মুহূর্তের গাছেদের মতো নিস্পন্দ। স্যার চলে যেতেই প্ল্যাটফর্মে উঠে দাঁড়িয়েছে তিনজন। জাজদের মতো ভাবভঙ্গি। বাকিরা সামনে। উকিল পজিশনে।

—রোল নাম্বার টোয়েন্টিওয়ান। সিদ্ধার্থ সরকার। উঠে এসো। সিদ্ধার্থ গুটি গুটি পায়ে উঠে গেছে।

—কি রে, তুই গ্রাম থেকে আসছিস?

—গ্রাম নয়। ক্যানিং। সিদ্ধার্থ স্মার্ট হওয়ার চেষ্টা করল প্রাণপণ।

—ক্যানিং ইজ আ কাইন্ড অফ গ্রাম। কাম অন। ফিল্ম দেখিস।

সিদ্ধার্থ ঘাড় নাড়ল।

—রাম তেরি…দেখেছিস?

—হ্যাঁ।

—এখানে আয়। তোকে তিনমিনিট স্পিচ দিতে হবে। সাবজেক্ট—মন্দাকিনী ইন ক্যানিং লোকাল।

যাক। এমন তো কিছু সাংঘাতিক কাণ্ড-কারখানা নয়। সুকন্যা আর ঝিনুক পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসি চাপবাব চেষ্টা করছিল! ভয়টা প্রথম ধাক্কাতেই অনেকটা নেমে গেছে। তরতর করে।

—রোল থার্টিসিক্স, থার্টি সেভেন, থার্টি এইট একসঙ্গে উঠে আয়।

সৈকত, তনিমা আর কমলিকা উঠল।

—মন দিয়ে শোন। সাপোজ তুই আর এ, ম্যান অ্যান্ড ওয়াইফ। আন্ড শী ইজ দা লাভার। লাইক বচ্চন, জয়া আর রেখা। মনে কর, তুই একদিন হাতে-নাতে ধরে ফেলেছিস তোর হাজব্যান্ডকে। স্টার্ট দা ফাইট।

এরকমই সব বিটকেল মজার মজার র‍্যাগিং। ঠিক র‍্যাগিং নয়, র‍্যাগিং-এর বোরখা পরে আলাপ-পরিচয়ের নতুন কৌশল। সুকন্যাকে তো পুরো গ্লাকসো বেবি অ্যাডটা গানের সঙ্গে অ্যাকটিং করে করে দেখাতে হল। শবনম রামায়ণের সীতা আর ইন্দ্রনীল দারা সিং। এপিসোড-অশোকবন। লেজ সামলে হনুমান গদগদ বসে আছে মায়ের সামনে।

এভাবেই এক সময় ঝিনুকের পালা।

—বাহ, তোর ফিগারটা তো দারুণ।

ঝিনুক সলজ্জ হাসল।

থার্ড ইয়ারের শুভশ্রী তখনই প্ল্যাটফর্ম থেকে টেনে নামিয়েছে ছেলেটাকে। সিক্স ফিট টু ফুট হবে। চাংকি পাণ্ডে টাইপ মুখ।

—কিরে, একে পছন্দ হয়? আমাদের সায়ন। সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে তৈরি করে নিয়েছে ঝিনুক। নো ঘাবড়ানো। মুখে ভয়ের ছাপ দেখলেই এরা চেপে ধরছে। কিংবা বেশি চালাকদের।

—কিরে বল, হয় পছন্দ?

—মন্দ কি? ভালই তো। মুহুর্তের অসাবধানে ঝিনুক বুঝি ওভারস্মার্ট।

—দেন থিংক হিম অ্যাজ গ্যারি কুপার। অ্যান্ড ইউ মেরিলিন মনরো। সিডিউস হিম। মাগো, এ কেমন ধারার খেলা ! ঝিনুক থতমত। তার বেলাতেই বা এত কঠিন কেন !

—কি হল? স্টার্ট।

সকলে একসঙ্গে হইচই করছে। হাসছে হাততালি দিয়ে। তাকে ঘিরে। তার মধ্যেই সায়ন কখন সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। মুখে ফিচেলমার্কা হাসি। অসহায় ঝিনুকের কয়েক সেকেন্ড সময় লেগেছিল নিজেকে সামলে নিতে। তারপর হঠাৎই ঘাড় সোজা করে দাঁড়িয়েছে—আমি ওসব পারব না।

—পারবি না মানে?

—পারব না মানে পারব না।

শুভশ্রী খিলখিল হেসে উঠল—তবে কি পারবি তুই?

ঝিনুক চুপ।

—বী আ গুড গার্ল বেবি।

ঝিনুকের তবু ঘাড় ট্যারা।

—ঠিক আছে। ডু এনিথিং ইউ লাইক। উইথ দিস গ্যারি কুপার। অ্যাট লিস্ট মেক হিম টক। তনিমা কানের কাছে ফিসফিস করল—এই বোকা, যা হোক কিছু করে দে না। নইলে এরা… লজ্জায়, অপমানে মাথায় তখন আগুন জ্বলে উঠেছে ঝিনুকের—

—যা ইচ্ছা করতে পারি তো? অন দিস গ্যারি কুপার?

— সিওর। তুই যদি…

কথা শেষ না হতেই দুম করে সায়নের পেটে ঘুসি চালিয়েছে ঝিনুক। একহাতে হেঁচকা টান মেরেছে চুলে। তারপর গুমগুম কিল বুকে পিঠে।

—আরে, আরে করছিস কি?…মেয়েটা কি পাগল নাকি?

ঝিনুক মরিয়া। ক্রমাগত দুহাত একসঙ্গে চালিয়ে যাচ্ছে। পিস্টনের মতো। সায়ন কোনওরকমে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়েছে একসময়। হাঁপাতে হাঁপাতে হাসছে পেট চেপে—ওয়েল ডান বেবি। ওয়েল ডান।

এরপরেই তো সবার সঙ্গে ভাব হয়ে যাওয়া। গলায় গলায়। সিনিয়াররাই সেদিন ক্যান্টিনে নিয়ে গিয়ে খাওয়াল সবাইকে। দুটো করে মাংসের সিঙ্গাড়া, চা—এখন থেকে উই আর অল ফ্রেন্ডস। নো তুমি আপনি বিজনেস। স্রেফ তুই। ডান?

—ডান।

কিন্তু ডান বললেই কি আর সব ডান হয়ে যায়? যায় যে না, তার জীবন্ত প্রমাণ ওই সায়ন মিত্র। পার্ট টু দিয়ে বেরিয়ে গেছে তবু রেহাই নেই। ফার্স্ট ইয়ারটা পুরো বোর করেছে। সেকেন্ড ইয়ারে উঠেও…। দেখতে পেলেই এক কথা—আরেকবার আমার চুলের মুঠিটা চেপে ধর, প্লিজ। সেদিনের মতো ধোলাই দে। পারফেক্ট ম্যাসোকিস্ট। দেবে ধোলাই। শেষবারের মতো মোক্ষম ধোলাই দিতে হবে সায়নকে। এয়ারপোর্টের কথা যখন লিখেছে, যাক না যাক আসবে নিশ্চয়ই। ঝিনুককে টেস্ট করতে। শেষ শিক্ষাটা তখনই পাওনা আছে ছেলেটার। আঙুলে চুল চেপে বিছানায় ঝাঁপ দিল ঝিনুক। ইমরান খান, জর্জ মাইকেলের দল তখনও প্যাট প্যাট তাকিয়ে।

॥ ৩ ॥

সল্টলেক এয়ারপোর্ট মিনি এত আস্তে আস্তে যায় ধারণা ছিল না ঝিনুকের। সেই কখন বাসে উঠেছে। পাঁচটার আগে। ছ’টা বাজতে চলল এখনও কাঁকুড়গাছি এল না। ফুলবাগানের কাছে উৎকট জ্যামে স্থির হয়ে আছে। ঝিনুক ঘড়ি দেখল। ছ’টা বাজতে দশ। ঠিক করেছিল একটু আ’গে আগেই লাউঞ্জে পৌঁছে যাবে। টিকিট কেটে বসে থাকবে চুপচাপ। তারপর…। ব্যস্তমুখে ঝিনুক জানালা দিয়ে মুখ বাড়াল। কলকাতাটা দিনে দিনে জঙ্গল যেন হয়ে যাচ্ছে। বাড়িঘর আর বাড়িঘরের জঙ্গল। তার মধ্যে হিংস্র জন্তুর মতো ছুটে বেড়াচ্ছে বাস, মিনিবাস, লরি, ট্রাম। না, ট্রাম ঠিক জন্তু নয়। সরীসৃপ। আর গাড়ি-ট্যাক্সিগুলো, হরিণশাবক, বুনো শুয়োর। নিজের বানানো উপমাগুলো নিজেরই ভাল লেগে গেল হঠাৎ। ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে রুমাল বার করে মুখের ঘাম মুছল। বেরোনোর আগে ময়শ্চারাইজার মেখেছিল! চোখের পাতায় মাসকারা দিয়েছিল সুন্দর করে। গলে গেছে, না আছে কে জানে। কেন যে নির্বোধের মতো ওসব লাগাতে গেল। মা বারবার ভুরু বেঁকিয়ে দেখছিল তাকে—কাকে সী অফ করতে যাবি বললি? তোদের ক্লাসের ছেলে?

—না। বললাম তো আউটগোয়িং ব্যাচ।

—কি নাম?

—তুমি চিনবে না মা। সায়ন।

— চিনব কি করে? এর কথা তো আগে কোনওদিন বলিসনি। জেরা করতে করতে মার চোখমুখ পুরো ঝানু ব্যারিস্টার। কেন যে মা ল পড়েনি! ঝিনুক তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসেছিল বাড়ি থেকে। মার ক্রসের মুখে কখন কী বেরিয়ে যায়। দুনিয়ার সব কথা এখন আর মা বাবাকে বলা যায় না। সকলেরই কিছু কিছু কথা নিজস্ব থাকে। একান্ত ব্যক্তিগত।

আস্তে আস্তে হামাগুড়ি দিতে শুরু করেছে মিনি। ঝিনুক সিটে সোজা হয়ে বসল। কাঁকুড়গাছি পেরোচ্ছে। ভি আই পি-তে পড়ে স্পিড নিল। প্রথম হেমন্তের বিকেলটা গলতে গলতে মিশে যাচ্ছে কাঁচা অন্ধকারে। দূরে, সল্টলেকের দিকে হালকা কুয়াশার পর্দা। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা বাতাস কেটে বাস ছুটে চলেছে। এয়ারপোর্টের কাছাকাছি এসে গেল। ফাঁকা হতে হতে এখন ভেতরে মাত্র তিন জন যাত্রী। লাস্ট বাট ওয়ান স্টপে তারাও নেমে যেতে আচমকা ঝিনুকের গা ছমছম করে উঠল। ফাঁকা বাসে বসে থাকলে নিজেকেও কি ফাঁকা ফাঁকা লাগে! বুকটা ক্রমশ শুন্য হয়ে যাচ্ছে যেন। নার্ভাসনেস। দূর, ঘাবড়ানোর কি আছে! ঝিনুক বাস থেকে নেমে জোরে শ্বাস টানল। গলাটা কেমন শুকিয়ে আসছে। জিভ খরখরে। একবার বাসটার দিকে ফিরে তাকাল। ফিরে যাবে? হ্যাট, ফিরবে কেন? এত দূর এসে ফেরার কোনও মানেই হয় না। সায়ন নিশ্চয়ই বাবা মার সামনে বাঁদরামি করবে না। আজকালকার ছেলেরা পেরেন্টসদের সামনে হেভি গুডি গুডি থাকে। আজ ওর মুখোশ খুলতে হবে। লালকালো চেক শার্ট আর জিন্স প্যান্ট ঝাড়তে ঝাড়তে ধীর পায়ে এগোল ঝিনুক।

দূর থেকেই দেখতে পেয়েছে সায়ন। হলঘরের মতো বিশাল লাউঞ্জে ছিটিয়ে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের মানুষ। তাদের টপকে সায়ন প্রায় এক লাফে ঝিনুকের কাছে—হাই। এসেছিস তবে?

—দেখতেই পাচ্ছিস।

—আয়। বলেই সান তার হাত ধরেছে। টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে বাবা মার সামনে—এই দ্যাখো, এই হল ঝিনুক। সরি। মেরিলিন মনরো। আমার প্রিয় বন্ধু। আমাদের খুব ভাব।

কী ডাহা মিথ্যে রে বাবা। ঝিনুক হাঁ হয়ে গেল। সায়নের বাবা তাকে বসতে বললেন—কোথায় থাকো তুমি?

—অনেক দূর। সেই গোলপার্ক। ঝিনুকের আগে বলে উঠেছে সানই—আমি যাচ্ছি বলেই তো… ঝিনুক চোখ পাকাতে গিয়েই সামলে নিল। না। সে অত অসভ্য নয়। সায়নের বাবা মার সামনে…। সায়নের মা তার হাত ধরেছেন, সায়ন আচমকা অন্য হাতটা ধরে টান দিল——চল, কফি খেয়ে আসি।

ঝিনুক পাশের প্ল্যাস্টিক চেয়ারটাতে বসে পড়ল।

—কিরে, আয়।

—আমি কফি খাব না।

—লজ্জা? সায়ন ঠোঁট টিপেছে। এ ভঙ্গি ঝিনুকের চেনা। এখখুনি কিছু অদ্ভুতুড়ে কাণ্ড করে বসবে। হয়তো বাবা মার সামনেই। বেহায়া ছেলেরা সব পারে। ওর বাবা মাও মজা পাওয়া মুখে তাকিয়ে ছেলের দিকে। ঝিনুক অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে দাঁড়াল—চল।

কর্নারের কফি বারটার দিকে যেতে যেতে কথা বলছে সায়ন,

—ভাবতেই পারিনি মাইরি তুই সত্যি আসবি।

ঝিনুক চুপ।

—ইচ্ছে করছে হাঁটু গেড়ে তোর সামনে বসে যাই।

মনঃস্থির করে ঝিনুক দাঁড়িয়ে পড়ল—আমি যাচ্ছি।

—কোথায়? সায়ন থমকেছে একটু।

—কোথায় আবার? বাড়ি। দেখবি লিখেছিলি, দেখা তো হয়ে গেছে।

—তোর কিছু বলার নেই?

—কি থাকবে?

—কোথায় যাচ্ছি জিজ্ঞেস কবলি না তো?

—প্রয়োজন নেই।

সঙ্গে সঙ্গে সায়নের মুখটা কেমন বোকা বোকা হয়ে গেছে। ঠোঁট থেকে হাসি মুছে গেল— তোকে খুব জ্বালিয়েছি।

—পুরনো কথা।

—ডু ইউ রিয়েলি হেট মি?

ছেলেটা কেঁদেই ফেলবে নাকি ! ঝিনুকের এতক্ষণে হাসি পেল। কী ভোম্বল ভোম্বল হয়ে গেছে মুখটা। হাসি চেপে একটু এগোল। সায়নের নীলচে চোখে চোখ রেখেছে—ডায়ালগ মারছিস কেন? দিল্লিতে আমার মতো অনেক হাঁদা মেয়ে পাবি। তাদের সঙ্গে প্রাণ খুলে যত খুশি—

—তুই তাহলে জানিস? পলকে সায়নের চোখে একশটা ফ্লোরেসেন্ট টিউব জ্বলে উঠেছে যেন।

—কি?

—এই, আমি যে দিল্লি যাচ্ছি।

—না জানার কি আছে?

সায়ন বুঝি পারলে হাঁটু মুড়ে বসে যায় ঝিনুকের পায়ের কাছে। একেবারে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তার হাত ধরেছে—রিয়েলি তোকে একটা কথা বলার ছিল।

—কি কথা?

—থাক। তুই চটে যাবি। সায়ন ঢোঁক গিলল দুবার। বলতে বলতে চোখমুখ একেবারে অন্যরকম হয়ে গেছে। মোটেই সায়ন-টাইপ নয়। ভালমতন তোতলাতে শুরু করেছে—প্র প্র প্র প্রথম দিনের মতো আর এ এ একবার মারবি আমাকে? প্রচণ্ডভাবে? ফর দা লাস্ট টাইম?

একই সংলাপ। কিন্তু তার প্রেজেন্টেশান চমকে দিয়েছে ঝিনুককে। সায়ন মিত্রও তবে তোতলায়। হাতে চাপটা আরও জোর হচ্ছে,…আই ওয়ান্ট টু বী র‍্যাগড। বাই ইউ ওনলি। টিল ডেথ।

পিএ সিস্টেমে ফ্লাইট নাম্বার ঘোষণা হচ্ছে দিল্লির। ঝিনুকের এখখুনি এক ঝটকায় হাতটা ছাড়িয়ে নেওয়া উচিত। কিংবা ধরা উচিত সায়নের চুলের মুঠি। কিন্তু একি! বুকের মধ্যে বর্ষার ভরা দামোদর ধাক্কা মারছে কেন? দুচোখ ছাপিয়ে বন্যার জল। ঝিনুক জানে না এ জলের উৎস কোথায়।

এ কান্না উনিশ বছর বয়সেরই। হাসি, মজা বা রেগে যাওয়ার মতনই। ঝিনুক বোঝে না।

৩০ অক্টোবর ১৯৮৮

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *