রাজার দক্ষিণহস্ত মন্ত্রী, বুদ্ধি মন্ত্রী-বল মন্ত্রী! মন্ত্রীপ্রবর গাজী রহমানের চক্ষেও আজ নিদ্রা নাই, এ কথা সপ্তবিংশতি প্রবাহের আরম্ভেই প্রকাশ করা হইয়াছে। গাজী রহমান এক্ষণে মহাব্যস্ত। নিশা প্রায় শেষ হইয়া আসিল, গুপ্তচরেরা এ পর্যন্ত ফিরিয়া আসে নাই। আজিকার সংবাদ, দামেস্ক নগরের সংবাদ-এজিদ্ শিবিরের নূতন সংবাদ এ পর্যন্ত কোন সংবাদই প্রাপ্ত হইতে পারেন নাই। দ্বিতীয় দিনে শিবির আক্রমণের উদ্যোগে জয়নাল আবেদীনের প্রাণ বধ হইতে বিরত হইল। ইহাতে কী কোন নিগূঢ় তত্ত্ব আছে? আজ হউক, কাল হউক, শিবির আক্রমণ হইবেই হইবে,-সে ভয়ে জয়নালের প্রাণবধে ক্ষান্ত হইবে কেন?
দূরদর্শী মন্ত্রী উপরোক্ত আলোচনায় চিন্তার বেগ বিস্তার করিয়াছেন। নগর প্রান্তর, শিবির, বন্দিগৃহ, যুদ্ধক্ষেত্র, সৈনিকদল, শূলদণ্ড, এজিদ্, মারওয়ান্, সকলের বিষয় এক-একবার আলোচনা করিতেছেন। আবার মনে উঠিল, জয়নাল বধে ক্ষান্ত থাকিবে কেন? মারওয়ানের কূটবুদ্ধির সীমা বহুদূরব্যাপী। নিশাও প্রায় শেষ হইয়া আসিল, এখনো কেহ শিবিরে ফিরিতেছে না, ইহারই বা কারণ কি? আর যে দুইটি ছদ্মবেশীর কথা শুনিলাম, তাহারা শিবিরের দিকে আসিতেছিল, প্রহরীদিগের সতর্কতায় কৃতকার্য হইতে পারে নাই। দুই-তিনবার চেষ্টা করিয়াও শিবিরের বহির্ভাগ রেখার নিকটে আসা দূরে থাকুক, সহস্র হস্ত ব্যবধান হইতেই ফিরিয়া গিয়াছে। ইহারাই-বা কে? বিশেষ গোপনভাবে চরদিগকে, শেষে পঞ্চবিংশতি আম্বাজী সৈন্যকেও পাঠাইয়াছি। তাহারা-বা কী করিল? মন্ত্রীপ্রবর এই সকল বিষয় চিন্তা করিতে করিতে শিবির-অভ্যন্তরস্থ তৃতীয় দ্বার পর্যন্ত আসিয়া সর্বপ্রধান দ্বারী মালিককে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোন সংবাদ জানিতে পারিয়াছ?”
মালিক বলিলেন, “আমি এ পর্যন্ত কোন সংবাদ প্রাপ্ত হই নাই।”
মন্ত্রীবর মৃদুমন্দপদে চতুর্থ দ্বার পর্যন্ত যাইয়া সাদকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোন সংবাদ নাই?”
সাদ জোড়করে বলিলেন, “আমি যে সংবাদ পাইয়াছি, তাহা বিশেষ প্রয়োজনীয় নহে বলিয়া জানাই নাই।”
“কী সংবাদ?”
“শিবির বহির্দ্বারের চন্দ্ররেখা পর্যন্ত সাহবাজের প্রহরায় আছে! তাহার কিছু দূরেই সীমা-নির্দিষ্ট খর্জুর বৃক্ষ! সেই বৃক্ষের কিঞ্চিৎ দূরে স্তূপাকার শিলাখণ্ডোপরি সেই দুইটি লোক অস্ফুট স্বরে কী আলাপ করিতেছিল। অনুমানে বোধ হয়, তাহারা কোনরূপ দুরভিসন্ধিতেই আসিয়াছিল।”
মন্ত্রীবর আরো চিন্তিত হইলেন। ক্রমে শিবিরের বহির্দ্বার পর্যন্ত যাইয়া দাঁড়াইতেই সুদক্ষ প্রহরী আব্দুল কাদের করজোড়ে বলিল, “শিলা সমষ্টির নিকটে যে দুইজন ছদ্মবেশী বসিয়াছিল, তাহাদের সঙ্গে আর একজন আসিয়া মিশিয়াছে। এ সকল সংবাদে কোন বিশেষ সারত্ব নাই বলিয়া চরেরা পুনরায় গিয়াছে।”
উভয়ে এই কথা হইতেছে, ইতিমধ্যে দামেস্কনগরে প্রেরিত গুপ্তচর দ্বারে প্রবেশ করিতেই মন্ত্রীবরকে দেখিয়া নতশিরে অভিবাদনপূর্বক বলিল, “আজ বড় ভয়ানক সংবাদ আনিতে হইয়াছে। জয়নাল আবেদীন বন্দিগৃহে নাই। এজিদের আজ্ঞায় মারওয়ান জয়নাল আবেদীনকে ধরিয়া আনিতে গিয়াছিল, না পাইয়া ফিরিয়া আসিয়াছে। দামেস্ক নগরে ঘরে ঘরে এজিদের সন্ধানী লোক ফিরিতেছে; রাজপথ, গুপ্তপথ, দীন-দরিদ্রের কুটীর তন্নতন্ন করিয়া খুঁজিয়া বেড়াইতেছে। জয়নাল আবেদীন কোথায় গিয়াছেন, তাহার কোন সন্ধান পাওয়া যাইতেছে না।”
এ সংবাদ শুনিয়া গাজী রহমান একেবারে নিস্তব্ধ হইলেন। বহু চিন্তার পর সাব্যস্ত হইল, জয়নাল আবেদীন নগর হইতে বাহির হইয়াছেন, সন্দেহ নাই। শত্রু হস্তেও পতিত হন নাই। কিন্তু আশঙ্কা অনেক। এই অভাবনীয় সংবাদে মন্ত্রীপ্রবরের মস্তক ঘুরিয়া গেল, মস্তিষ্কের মজ্জা চিন্তাশক্তির অপরিসীম বেগে অধিকতর আলোড়িত হইয়া বিন্দু বিন্দু ঘর্ম-বিন্দুতে ললাট পরিশোভিত হইল।
একজন গুপ্তচর আসিয়া সেই সময় বলিতে লাগিল, “সেই নিশাচরদ্বয় শিলাখণ্ডে বসিয়া আলাপ করিতেছে, কোন কথাই স্পষ্ট বুঝা যাইতেছিল না। কেবল ‘মদিনা’, ‘চতুর’, ‘ফিরিয়া যাই’,-এই তিনটি কথা বুঝা গিয়াছিল। ইতিমধ্যে আর একজন লোক হঠাৎ সেইখানে উপস্থিত হইতেই উহারা যেন ভয়ে ভীত হইয়া গাত্রোত্থান করিল। আগন্তুক জিজ্ঞাসা করিল, ‘তোমরা কে?’ তাহাতে তাহারা উত্তর করিল-‘আমরা পথিক!’ পুনরায় প্রশ্ন-‘পথিক এ-পথে কেন?’ উত্তর-‘পথ ভুলিয়া।’ আবার প্রশ্ন-‘কোথায় যাইবে?’ উত্তর-‘দামেস্ক নগরে।’ ‘কি আশা?’-‘চাকরি’, ‘বসতি কোথায়?’-‘মদিনা।’ চতুর্দিক হইতে শব্দ হইল, ‘আর কোথায় যাইবি? মদিনার লোক চাকরির জন্য দামেস্কে!’ আম্বাজী গুপ্ত সৈন্যগণ বর্শাহস্তে তিনজনকেই ঘিরিয়া ফেলিল, পঞ্চবিংশতি বর্শাফলক তাহাদের বক্ষঃ এবং পৃষ্ঠে উত্থিত হইয়া তিনজনকে বন্দি করিল। প্রভাতে পরিচয়-পরীক্ষার পর মুক্তি।”
মন্ত্রীবর এই সকল কথা মনের সহিত শুনিয়া আদেশ করিলেন, “এখনই আর শত বর্শাধারী সৈন্য লইয়া ভিন্ন ভিন্ন পথে ঐ বন্দি তিনজনকে বিশেষ সতর্কতার সহিত আনিয়া তিন স্থানে আবদ্ধ কর। সাবধান, কাহারো সহিত যেন কেহ আর কোন কথা না কহিতে পারে, দেখা না করিতে পারে।-বন্দিগণ প্রতি কোন প্রকার অবজ্ঞা বা অপমানসূচক কোন কথা কেহ প্রয়োগ না করে। সাবধান! আর তোমরা কেহ দামেস্ক নগরে যাও, কেহ কেহ এজিদ্-শিবিরের নিকটও সন্ধান কর। নিকটবর্তী পর্বত, বন, উপবন, যেখানে মানুষের গতিবিধি যাওয়া-আসা সম্ভব মনে কর, সেইখানেই সন্ধান করিবে। আর সতর্ক হইয়া সর্বদা মনে রাখিয়া দেখিয়ো যে, কেহ কাহাকে ধরিয়া কোথাও লইয়া যায় কি না। যদি ধরিয়া লয়, তাহার অনুসরণে যাইবে-দুই-একজন আসিয়া শিবিরে সংবাদ দিবে, নিশা অবসানের সহিত আমি ইহার সংবাদ তোমাদের নিকট চাহি। চরগণ, আজিই তোমাদের পরিশ্রমের শেষ দিন। আজিকার পরিশ্রমই যথার্থ পরিশ্রম! প্রভুর উপকার ও সাহায্যের জন্য প্রাণপণে সন্ধান লইবে-প্রত্যুষে পুরস্কার। আমি তোমাদের আগমন প্রতীক্ষায় জাগরিত রহিলাম।”
গুপ্তচরগণ মন্ত্রীবরের পদচুম্বন করিয়া স্ব-স্ব গন্তব্যপথে যথেচ্ছা চলিয়া গেল। মন্ত্রীবর চক্ষের পলক ফিরাইতে অবসর পাইলেন না। কে-কোথায়-কোন্ পথে চলিয়া গেল, তাহা স্থির করিতে পারিলেন না। একটু চিন্তা করিয়া আর একটি আজ্ঞা প্রচার করিলেন যে, “নিশাবসানের পূর্বে এজিদ্ শিবিরের নিকট ভেরী বাজাইতে বাজাইতে ঘোষণা করিবে, তিনটি লোক আমাদের হাতে বন্দি, যদি তোমাদের শিবিরস্থ কেহ হয়, তবে সূর্যোদয়ের পর চাহিয়া পাঠাইলেই ছাড়িয়া দিব।” মন্ত্রীবর এই আজ্ঞা প্রচার করিয়া বহির্দ্বার হইতে চলিয়া গেলেন।