এই তো সেই মদিনার নিকটবর্তী প্রান্তর। উভয় শিবিরে উচ্চ মঞ্চে রঞ্জিত মহানিশান উড়িতেছে, সমরাঙ্গণে সামরিক নিশান গগন ভেদ করিয়া বায়ুর সহিত ক্রীড়া করিতেছে-অস্ত্র অবিশ্রান্ত চলিতেছে-র্মা র্মা শব্দ হইতেছে। আজ ব্যূহ নাই-সৈন্যশ্রেণীর শ্রেণীভেদ নাই-অস্ত্র চালনায় পারিপাট্য নাই, আত্মপর ভাবিয়া আঘাত নাই,-মরিতেছে, মারিতেছে, আহত হইয়া ভূতলে পড়িতেছে, হু-হুঙ্কার বজ্রনাদে সমরাঙ্গণ কাঁপাইতেছে। আজ উভয় দলের সৈন্য-শোণিত রণভূমি রঞ্জিত হইতেছে। জয়-পরাজয় কাহারো ভাগ্যে ঘটিতেছে না; কিন্তু অলীদ সৈন্য অধিক পরিমাণে মারা পড়িতেছে। আজ মহাসংগ্রাম। উভয় দলে আজ বিষম সমর, দুর্ধর্ষ রণ। সৈন্যগণের চক্ষু ঊর্ধ্বে উঠিয়াছে, মুখাকৃতি অতি কদর্য বিকৃত ভাব ধারণ করিয়াছে;-রোষে, ক্রোধে যেন উন্মত্ত হইয়া চক্ষুতারা ফুটিয়া বাহির হইবার উপক্রম হইয়াছে;-মুখব্যাদানে জিহ্বা, তালু, কণ্ঠ, কণ্ঠনালী পর্যন্ত দৃষ্ট হইতেছে। অস্ত্রাঘাতে যুদ্ধপ্রবৃত্তি নিবৃত্তি হইবে না-মনের তৃপ্তি জন্মিবে না বলিয়াই যেন নখাঘাত, দন্তাঘাতে যুদ্ধপ্রবৃত্তি নিবৃত্তি হইবে না-মনের তৃপ্তি জন্মিবে না বলিয়াই যেন নখাঘাত, দন্তাঘাত জন্য ব্যাকুল রহিয়াছে! প্রান্তরময় সৈন্য, প্রান্তরময় যুদ্ধ। হানিফা আজ স্বয়ং সৈন্যগণের পৃষ্ঠপোষক ও রক্ষক, গাজী রহমান পরিচালক। মহাবীর অলীদও আজ মহাবিক্রম প্রকাশ করিতেছে। এক প্রভাত হইতে অন্য প্রভাত গত হইয়াছে, এখন সূর্যদেব মধ্যগগনে,-কোন পক্ষই পরাজয় স্বীকার করিতেছে না-যুদ্ধেরও ইতি হইতেছে না। অলীদের প্রতিজ্ঞা,-আজ হানিফার শিরচ্ছেদ করিয়া জগতে মহাকীর্তি স্থাপন করিব; হানিফারও চেষ্টা যে, আজ মদিনার পথ পরিষ্কার না-করিয়া ছাড়িব না। হয় অলীদহস্তে জীবন বিসর্জন, না হয় সসৈন্যে মদিনায় প্রবেশ।
গাজী রহমান বলিলেন, “সৈন্যগণ মহাক্লান্ত হইয়াছে। কী করিবে? এত মারিয়াও যখন শেষ করিতে পারিতেছে না, তখন আর উপায় কী?
মোহাম্মদ হানিফা অশ্ব-বল্গা ফিরাইয়া বলিলেন, “আজ উভয় দলের সৈন্য যে প্রকার ক্ষয় হইতেছে, ইহাতে মহাবিপদের আশঙ্কা দেখিতেছি। এখন না নিবারণের উপায় আছে, না উপদেশের সময় আছে, না কথা বলিবার অবসর আছে! অলীদের সমস্ত সৈন্য শেষ হইলেও অলীদ কখনোই পরাভব স্বীকার করিবে না, আমরাও পরাস্ত না করিয়া ছাড়িব না!”
এই প্রকার কথা হইতেছে, এমন সময়ে অলীদ-দলে আনন্দের বাজনা বাজিয়া উঠিল। ওত্বে অলীদ তাহার নূতন সৈনিকদলের ব্যবহার জন্য যে সাজ প্রস্তুত করিয়াছিল, ঠিক সেইরূপ সাজে সজ্জিত সেনাগণ মস্হাব কাক্কার সঙ্গে আসিতেছিল। দূর হইতে তাহাদিগকে দেখিয়া আপন সেনা মনে করিয়া অলীদ মনের আনন্দে বাজনা বাজাইতে আদেশ করিয়াছিল। গাজী রহমানের কর্ণে হঠাৎ ঐ বাজনার রোল মহাবিপজ্জনক ও বিষম বোধ হইতে লাগিল। কারণ উভয় দলই প্রমত্ত কুঞ্জর সম যুদ্ধে মত্ত, কেহই পরাজয় স্বীকার করে নাই; এ সময়ে সন্তোষের বাজনা কেন? গাজী রহমানের বিশাল চক্ষু মদিনা-প্রান্তরের চতুর্দিকে ঘুরিতে লাগিল, চিন্তাস্রোত খরতর বেগে বহিতে লাগিল,-পূর্ব দিকে দৃষ্টি পড়িতেই শরীর রোমাঞ্চিত হইল। যুদ্ধ জয়ের আশা, মদিনা-প্রবেশের আশা,-জয়নাল উদ্ধারের আশা অন্তর হইতে একেবারে সরিয়া গেল।
মোহাম্মদ হানিফাকে বলিলেন, “বাদশাহ নামদার! ঈশ্বরের অভিপ্রেত কার্যে বিপর্যয় ঘটাইতে মানুষের ক্ষমতা নাই। সৈন্যশ্রেণী যে প্রকারে চালনা করিয়াছিলাম, সৈন্যগণও যে বীর বিক্রমে আক্রমণ করিয়াছিল, অতি অল্প সময়মধ্যেই অলীদ বাধ্য হইয়া পরাভব স্বীকারে মদিনার পথ ছাড়িয়া দিত; আর যদি পথ না ছাড়িত, গাজী রহমানের হস্তে নিশ্চয় আজ বন্দি হইত। কিন্তু কী করি? ঐ দেখুন, উহারা যখন আমাদের পশ্চাদ্দিক হইতে আসিতেছে, তখন রক্ষার আর উপায় নাই। সম্মুখে, পশ্চাতে, উভয় দিকে শত্রুসেনা, আর নিষ্কৃতি কোথা? নিশ্চয় বন্দি! আজ সৈন্যসহ আমরা বন্দি!!”
মোহাম্মদ হানিফা বলিলেন, “বহু অশ্বারোহী সৈন্য বটে, পদাতিক সৈন্যও আছে। উহারা যেরূপ বীরদাপে আসিতেছে, শত্রুসেনা হইলে মহাবিপদ, তাহাতে আর সন্দেহ নাই। কিন্তু সন্দেহ অনেক। বাজনাই কী তাহার নিশ্চয়তার প্রমাণ? অথবা ওত্বে অলীদ কি এমনই অবোধ যে না জানিয়া, আপন-পর না ভাবিয়া, আনন্দ-বাজনা বাজাইয়াছে? নিশ্চয় ইহারা দামেস্কের সৈন্য!”
আগন্তুক সৈন্যদল ক্রমেই নিকটে আসিতে লাগিল। অলীদের মনে ধ্রুব বিশ্বাস যে দামেস্ক হইতে মারওয়ান তাহার সাহায্যে আসিতেছে।
অলীদ সদর্পে বলিতে লাগিল, “বন্দি! বন্দি! মোহাম্মদ হানিফা আজ সৈন্যসহ নিশ্চয় বন্দি। আর কী সন্দেহ আছে? আমারই নির্বাচিত চিহ্ন সংযুক্ত নূতন সাজ। দামেস্কের সৈন্য না হইয়া যায় না। বাজাও ডঙ্কা। বাজাও ভেরী! কিসের ভয়? সহস্র হানিফা হইলেও আজ অলীদ হস্তে পরাস্ত! সম্মুখে অস্ত্র, পশ্চাতে অস্ত্র, এতে কি রক্ষা আছে? কার সাধ্য? জগতে এমন কোন বীর নাই যে, সম্মুখ-পশ্চাৎ উভয় দিক্ রক্ষা করিয়া সমানভাবে শত্রু-সম্মুখীন হইতে পারে।”
মনের উল্লাসে উচ্চৈঃস্বরে বলিতে লাগিল, “মোহাম্মদ হানিফা! তুমি কোথায়? তোমার চক্ষু কোন্ দিকে? তুমি কায়মনে যে ঈশ্বরের বল করিয়া যুদ্ধে অগ্রসর হইয়াছ, সেই ঈশ্বরের দোহাই,-একবার পশ্চাৎ দিকে চাহিয়া দেখ। এখনো অলীদ-সম্মুখে অস্ত্র রাখিলে না? এখনো যুদ্ধে বিরত হইলে না? একবার পশ্চাতে চাহিয়া দেখ। তোমার জীবন প্রদীপ এখনই নির্বাণ হইবে। তোমার বুদ্ধিমান মন্ত্রী গাজী রহমানের জীবন এখনই শেষ হইবে। সম্মুখে অলীদ, পশ্চাতে মারওয়ান। এখনো যুদ্ধ? রাখ তরবারি-কর পরাজয় স্বীকার-মঙ্গল হইবে। ক্ষান্ত হও,-ক্ষান্ত হও; আত্মসমর্পণের এ-ই উপযুক্ত সময়। বীরের মান বীরেই রক্ষা করিয়া থাকে। আমি দিব্যচক্ষে দেখিতেছি, তোমাদের সকলের পরমায়ু শেষ হইয়াছে, আর অধিক বিলম্ব নাই। আবার বলি, পশ্চাতে চাহিয়া দেখ,-মহারাজ এজিদের কারুকার্যখচিত উড্ডীয়মান নিশান প্রতি চাহিয়া দেখ।”
গাজী রহমান এ পর্যন্ত নিশান প্রতি লক্ষ্য করেন নাই। অলীদের কথায় নিশান প্রতি চাহিয়াই ঈশ্বরকে শতশত ধন্যবাদ দিলেন। এদিকে অলীদও ভয়ে বিহ্বলপ্রায় হইয়া, বেগে অশ্ব ছুটাইয়া শিবিরাভিমুখে চলিয়া গেল।
মোহাম্মদ হানিফা গাজী রহমানকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ইহার কারণ কী? নিশান দেখিয়া অলীদের মুখ ভারি হইল কেন? ওরূপ দ্রুতবেগে হঠাৎ শিবিরেই-বা চলিয়া গেল কেন?”
“বাদশাহ নামদার! অলীদের বাজনার ধুমে আমি আমার চিন্তাকে ভ্রমপূর্ণ বিপথে চালনা করিয়াছিলাম। অনিশ্চিত, সন্দিহান অনুমানের প্রতি নির্ভর করিয়া যে কার্য করে, তাহাকে বাতুল ভিন্ন আর কী বলিব? আরো অধিক আশ্চর্য যে, একজন সেনাপতি এইরূপ করিয়াছেন! অলীদ যে কি প্রকৃতির সেনাপতি, তাহা আমি এখনো বুঝিতে পারি নাই। কী গুণে এতাধিক সৈন্যের অধিনায়ক হইয়া প্রকাশ্য যুদ্ধে অগ্রসর হইয়াছে তাহাও এক্ষণে বুঝিতে পারিতেছি না। অলীদের প্রতি আমার কিছুমাত্র ভক্তি নাই। আমি আরো আশ্চর্য হইতেছি যে, ইহারা কী প্রকারে মহাবীর হাসান-হোসেনের সহিত যুদ্ধ করিয়াছে, একটু অপেক্ষা করুন, সকলই দেখিতে পাইবেন।”
“আমারও সন্দেহ হইতেছে। ঐ সকল চিহ্নিত পতাকা কখনোই এজিদের নহে।”
“বাদশাহ নামদার! অলীদ আমাকে ভ্রম-কূপে ডুবাইয়াছে; এখন আর কিছুই বলিব না,-সকলই ঈশ্বরের মহিমা।”
এদিকে রণপ্রাঙ্গণে অলীদপক্ষীয় সৈন্য আর তিষ্ঠিতে পারিতেছে না। বাতাহত কদলীবৃক্ষের ন্যায় ভূমিসাৎ হইতেছে। এক দল হত হইলেই যে অন্য দল আসিয়া শূন্য স্থান পূর্ণ করিতেছিল, তাহা আর হইতেছে না। যাহারা সমরে লিপ্ত ছিল, তাহারাই ক্রমে ক্ষয় পাইতে লাগিল।
সন্দেহ দূর হইল। মোহাম্মদ হানিফার সৈন্যগণ জাতীয় পতাকা স্পষ্টভাবে দেখিয়া, সজোরে ঈশ্বরের নাম উচ্চারণ করিয়া, প্রান্তর সহিত রণস্থল কাঁপাইয়া তুলিল। দেখিতে দেখিতে মস্হাব কাক্কা সৈন্যসহ আসিয়া হানিফার সহিত যোগ দিলেন। মস্হাব কাক্কা হানিফার পদচুম্বন করিয়া বলিলেন-
“বিলম্বের কারণ পরে বলিব, এখন কী আজ্ঞা?”
মোহাম্মদ হানিফা বলিলেন, “ভাই! পরে শুনিব,-কথা পরে শুনিব। এখন ধর তরবারি-মার কাফের-তাড়াও অলীদ! মনের কথা কহিতে, দুঃখের কান্না কান্দিতে অনেক সময় পাইব। সে সকল কথা মনেই গাঁথা আছে। এখন প্রথম কার্য,-মদিনায় প্রবেশ। তোমার তরবারি এদিকে চলিতে থাকুক, আমি অন্যদিকে চলিলাম।”
হানিফা অসি উঠাইলেন। মস্হাব কাক্কাও ঈশ্বরের নাম করিয়া শত্রুনিপাতে অসি নিষ্কোষিত করিলেন। উভয়ের সম্মিলনে এক অপূর্ব নবভাবের আবির্ভাব হইল। উভয় দলের বাজনা একত্র বাজিতে লাগিল, উভয় দলের সৈন্য মিলিয়া এক হইয়া চলিল,-অলীদের মনেও নানারূপ চিন্তার লহরী খেলিতে লাগিল; ‘মোহাম্মদ হানিফার সঙ্গেই জয়ের আশা ছিল না, তাহার উপর তত্তুল্য আর একটি বীর হঠাৎ উপস্থিত হইল-অস্ত্রও ধারণ করিল-আর রক্ষা নাই। কিছুতেই আজ রক্ষা নাই।’
অলীদ মহাসঙ্কটে পড়িল। কী করিবে, কিছুই স্থির করিতে পারিতেছে না। অনেকক্ষণ চিন্তার পর মনে মনে সাব্যস্ত করিল, ভাগ্যে যাহা থাকে হইবে, সহসা মস্হাব কাক্কার সম্মুখে যুদ্ধে যাইব না। দেখি মস্হাব কাক্কা কী করেন!
অলীদ গুপ্ত স্থানে বসিয়া দেখিতে লাগিল যে, হানিফা দক্ষিণ পার্শ্বে যাইয়া মদিনাগমন-পথ পরিষ্কার করিতেছেন, মস্হাব কাক্কা বাম পার্শ্বে (তাঁহারই দিকে) অস্ত্রচালনা করিয়া অগ্রসর হইতেছেন, আর বারবার অলীদ-নাম উচ্চারণ করিয়া তাঁহাকে যুদ্ধে আহ্বান করিতেছেন-এবং বলিতেছেন, “অলীদ! শীঘ্র বাহির হও,-শিবির হইতে শীঘ্র বাহির হও! তোমার বীরপণা দেখিতেই আজ ক্লান্ত, পথশ্রান্তভাবেই অস্ত্র ধরিয়াছি। আইস, আর বিলম্ব কি? অলীদ! অলীদ! আইস, আজ তোমাকে দেখিব! ঈশ্বরের দোহাই, তোমাকে আজ ভাল করিয়া দেখিব। তোমার বল, বিক্রম, সাহস সকলই দেখিব। যদি সময় পাই, তবে তোমার তরবারির তেজ, বর্শার ধার, তীরের লক্ষ্য, খঞ্জরের হাত, গদার আঘাত, সকলই দেখিব, ভয় কী? শত্রু যুদ্ধার্থী, তুমি শিবিরে? ছি ছি, বড় ঘৃণার কথা! ছি ছি অলীদ! তুমি না সেনাপতি? এজিদের বিশ্বাসী সেনাপতি!”
মস্হাব কাক্কা অলীদকে ধিক্কার দিয়া, ঘৃণা জন্মাইয়া, যুদ্ধে আহ্বান করিতেছেন, কিন্তু অলীদ গুপ্তভাবে থাকিয়া কী দেখিতেছে, কী চিন্তা করিতেছে, তাহা সেই জানে! তাহার সৈন্যগণের হাবভাবে তাহাকে আরো ব্যতিব্যস্ত হইতে হইল, চতুর্দিকে ভীষণ বিভীষিকাময় মূর্তি দেখিতে লাগিল। যুদ্ধে পরাস্ত হইতে হইবে, মদিনার পথ ছাড়িয়া দিতে হইবে, এখনই ছাড়িয়া দিতে হইবে,-না হয় বন্দিভাবে হানিফার পদানত হইতে হইবে, ইহাতে দুঃখ নাই,-অপমানের কথা নাই। কিন্তু আপন সৈন্য দ্বারা অপমানিত হওয়া বড়ই ঘৃণার কথা ও লজ্জার কারণ মনে করিয়া অলীদ বাধ্য হইয়া সশস্ত্রে মস্হাব কাক্কার সমুখীন হইল।
মস্হাব কাক্কা বলিলেন, “অলীদ! শত্রুসম্মুখে আসিতে, যুদ্ধার্থে রণক্ষেত্রে পদনিক্ষেপ করিতে, তোমার আর কী এত বিলম্ব শোভা পায়? যাহা হউক, আইস, অগ্রে তোমার বাহুবল পরীক্ষা করি। আমি তোমাকে অস্ত্রাঘাতে মারিব না-নিশ্চয় বলিতেছি, তোমার প্রতি মস্হাব কাক্কা কখনোই অস্ত্র নিক্ষেপ করিবে না।”
অলীদ দুটি চক্ষু পাকল করিয়া বলিল, “মহাবীরের দর্প দেখ! অস্ত্রাঘাতে মারিবেন না, কথার আঘাতে মারিবেন।”
“আরে পামর! কথা রাখ্, অস্ত্র র্ধ!”
“মস্হাব! তুমি এইমাত্র আসিয়াছ-এখনই যুদ্ধ? কে না বলিবে-যে দেখিবে সেই বলিবে, যে শুনিবে সেই বলিবে যে, দুর্গম পথশ্রান্তিতে কাতর ছিল, ক্ষণকালও বিশ্রাম করে নাই, যেমনই দেখা অমনই যুদ্ধ, কাজেই পরাস্ত। সেই আমার বিলম্বের কারণ। কিন্তু তুমি তাহা বুঝিলে না-তোমার ভালর জন্যই আমি এতক্ষণ আসি নাই।”
মস্হাব কাক্কা রোষে অধীর হইয়া, সিংহনাদে অলীদের দুই হস্ত দুই হস্তে ধরিয়া সজোরে অলীদ-অশ্বকে পদাঘাত করিলেন, অশ্ব বহু দূরে ছুঁড়িয়া পড়িল। অলীদ কাক্কার হস্তে রহিয়া গেল। মস্হাব অলীদকে লইয়া এক লম্ফে অশ্ব হইতে অবতরণ করিয়া মৃত্তিকায় দণ্ডায়মান হইলেন। বীরবর অলীদ যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়াও কাক্কার হস্ত হইতে হস্ত ছাড়াইতে পারিল না।
মস্হাব বলিলেন, “এই তো প্রথম পরীক্ষা, দ্বিতীয় পরীক্ষাও দেখ।”
এই কথা বলিয়াই অলীদকে শূন্যে উঠাইয়া বলিতে লাগিলেন, “দেখ্ কাফের দেখ্ কাহার কথা সত্য,-আমি কথার আঘাতে মারিতে পারি, কি আছাড় মারিয়া মারিতে পারি!” চতুর্দিক হইতে তখন মহা গোলযোগ হইয়া উঠিল। সৈন্যাধ্যক্ষের প্রাণ যায়, দামেস্করাজ এজিদের সেনাপতি শূন্যে চক্রাকারে ঘুরিয়া ঘুরিয়া প্রাণ হারায়,-বড়ই লজ্জার কথা! অলীদসৈন্য মসহাবের দিকে র্মা র্মা শব্দে মহারোষে অসি নিষ্কোষিত করিয়া আসিতে লাগিল। এদিকে মোহাম্মদ হানিফা ঐ গোলযোগের কারণ জানিতে আসিয়া দেখিলেন, অলীদ কাক্কার হস্তে উত্তোলিত হইয়া চক্রাকারে ঘুরিতেছে, আর রক্ষা নাই।
মোহাম্মদ হানিফা উচ্চৈঃস্বরে বলিতে লাগিলেন, “ভাই মস্হাব, আমার কথা রাখ। ভাই! আমার দিকে একবার চাহিয়া দেখ, কথা রাখ। ভাই, ক্ষান্ত হও। অলীদকে প্রাণে মারিয়ো না, মারিয়ো না। আমি বারণ করিতেছি, উহাকে প্রাণে মারিয়ো না।”
মস্হাব বলিলেন, “আপনার আজ্ঞা শিরোধার্য, কিন্তু আমি ইহাকে একটি আছাড় না মারিয়া ছাড়িব না-তাহাতেই যদি উহার প্রাণ দেহপিঞ্জরে আর না থাকে, কি করিব? উহার প্রতি আমি অস্ত্রের আঘাত করিব না, একথা পূর্বেই বলিয়াছি। এজিদের সেনাপতির বীরত্ব দেখুন, অলীদের বাহুবল দেখুন।”
এই কথা বলিয়াই মস্হাব কাক্কা অলীদকে সজোরে বহুদূর শূন্য হইতে মাটিতে ফেলিয়া দিলেন। অলীদ চতুর্দিক অন্ধকার দেখিতে দেখিতে বিংশতি হস্ত ব্যবধানে ছুটিয়া ছিট্কিয়া পড়িল। ক্ষণকাল অচৈতন্য রহিয়া জগৎ অন্ধকার দেখিল। একটু চমক ভাঙ্গিলেই দক্ষিণ বামে পশ্চাতে চাহিয়া দেখিয়াই, উঠিতে উঠিতে, পড়িতে পড়িতে রণপ্রাঙ্গণ হইতে সভয়ে ফিরিয়া ফিরিয়া চাহিতে চাহিতে শিবিরাভিমুখে মহাবেগে প্রস্থান করিল। অলীদের সৈন্য এখন কাক্কার হস্ত হইতে প্রাণ বাঁচাইবার উপায় খুঁজিতে লাগিল। আর কি করিবে? শেষ পন্থা-পলায়ন।
মস্হাব কাক্কা বীরদর্পে বলিতে লাগিলেন, “আয় রে কাফেরগণ! আয়, মদিনার পথে বাধা দিতে আয়! এই মস্হাব চলিল।”
মস্হাব সমুদয় সৈন্য লইয়া অলীদের শিবির পশ্চাৎ করিয়া যাইতে লাগিলেন। কার সাধ্য মস্হাবকে বাধা দেয়? সে বীরকেশরী সম্মুখে আসিয়া দাঁড়ায়?
গাজী রহমান বলিলেন, “আজ মদিনায় প্রবেশ করিব না, এই যুদ্ধক্ষেত্রের প্রান্ত সীমাতেই থাকিব। সৈন্যগণ মহাক্লান্ত হইয়াছে! আরো কথা আছে; মদিনা প্রবেশের পূর্বে আমাদের কতক সৈন্য নগরের বহির্ভাগে, নগর-প্রবেশ-দ্বারে সর্বদা সজ্জিতভাবে অবস্থিতি করিব। দামেস্কের মন্ত্রী, সৈন্যাধ্যক্ষ, কাহাকেও বিশ্বাস করিতে নাই। ছল, চাতুরী, অধর্ম, প্রবঞ্চনা, প্রতারণা তাহাদের আয়ত্তাধীন-জাতিগত স্বভাব।”
মস্হাব কাক্কা সম্মত হইলেন, মোহাম্মদ হানিফাও গাজী রহমানের কথা গ্রাহ্য করিলেন। সৈন্যগণ অলীদের শিবির লুটপাট করিয়া, খাদ্যসামগ্রী অস্ত্রশস্ত্র যাহা পাইল লইয়া জয় জয় রবে প্রান্তর কাঁপাইয়া, বীরমদে পদনিক্ষেপ করিতে করিতে চলিল!
মস্হাব কাক্কা মোহাম্মদ হানিফাকে বলিলেন, “হজরত! আর একটি কথা। তুরস্ক ও তোগান রাজ্যের ভূপতিদ্বয় আমার সঙ্গে আছেন, তাঁহারা পথে সীমারহস্তে যেরূপ বিধ্বস্ত ও বিপদগ্রস্ত হইয়াছিলেন, তাহার বিস্তারিত বিবরণ পরে বলিব। এক্ষণে একটি শুভ সংবাদ অগ্রে না দিয়া আমি স্থির থাকিতে পারিতেছি না। সেই পাপাত্মা সীমারকে আমি বন্দি করিয়া আনিয়াছি।”
হানিফার মনের আগুন জ্বলিয়া উঠিল-নির্বাণ আগুন দ্বিগুণ বেগে জ্বলিয়া উঠিল-কারবালার কথা মনে পড়িল। হু-হু শব্দে কাঁদিয়া উঠিলেন, মস্হাব অপ্রতিভ হইলেন। কিছুক্ষণ পরে হানিফা মস্হাবের হস্ত ধরিয়া বলিলেন, “ভ্রাতঃ! তুমি আমার মাথার মণি, হৃদয়ের বন্ধু, প্রাণের ভাই! আইস, তোমাকে একবার আলিঙ্গন করি। তুমি সীমারকে বন্দি করিয়াছ-তোমার এ গৌরব, কীর্তি অক্ষয়রূপে জগতে চিরকাল সমভাবে থাকিবে-তুমি বিনামূল্যে আজ হানিফাকে ক্রয় করিলে। ভ্রাতঃ, আমার আর গমনের সাধ্য নাই। সীমারের নাম শুনিয়া আমি অধীর হইয়াছি। আরবের সর্বশ্রেষ্ঠ মহাবীর ভ্রাতৃদ্বয়ের শিরচ্ছেদ বিবরণ শুনা অবধি সীমারকে একবার দেখিব মনে করিয়া আছি। দেখিব, তাহার দক্ষিণ হস্তে কত বল, সে খ র ধরিতে কেমন পটু; তাহাকে কয়েকটি কথামাত্র জিজ্ঞাসা করিব। এ ছাড়া সীমারে আর আমার কোন সাধ নাই। সীমার সম্বন্ধে তুমি যাহা করিবে আমি তাহার সঙ্গী আছি। আর বেশি দূর যাইব না, আজ এখানেই বিশ্রাম।”