হায়! হায়! এ আবার কী? এ দৃশ্য কেন চক্ষে পড়িল? উহু! কী ভয়ানক ব্যাপার। উহু! কী নিদারুণ কথা! এ প্রবাহ না লিখিলে কী “উদ্ধার-পর্ব” অসম্পূর্ণ থাকিত, না বিষাদ-সিন্ধুর কোন তরঙ্গের হীনতা জন্মিত? বৃদ্ধি নাই, তাই সীমারের বন্ধনে মনে মনে একটু সুখী হইয়াছিলাম। কিন্তু এখন যে প্রাণ যায়! এ বিষাদ-প্রবাহে এখন যে প্রাণ যায়! হায়! হায়! এ সিন্ধুমধ্যে কি মহাশোকের কল্লোলধ্বনি ভিন্ন আনন্দ হিল্লোলের সামান্য ভাবও থাকিবে না; হায় রে কৃপাণ! আবরণবিহীন কৃপাণ!! এজিদের হস্তে কৃপাণ!!! সম্মুখে মদিনার ভাবী রাজা, ঊর্ধ্বদৃষ্টে দণ্ডায়মান। তিন পার্শ্বে সজ্জিত প্রহরী,-এক পার্শ্বে প্রহরী নাই। হাসনেবানু, সাহারাবানু, জয়নাব প্রভৃতির দৃষ্টির বাধা না জন্মে-জয়নালের শিরচ্ছেদন স্বচ্ছন্দে তাঁহাদের চক্ষে পড়ে, সেই উদ্দেশ্যেই বন্দিগৃহের সম্মুখে বধ্যভূমি এবং সেই দিক প্রহরীশূন্য! সন্তানের মস্তক কী প্রকারে ধরায় লুণ্ঠিত হয়, তাহাই মাতাকে দেখাইবার জন্য সে দিক প্রহরীশূন্য! এজিদ্ অসিহস্তে জয়নাল সম্মুখে দণ্ডায়মান।-মারওয়ান নীরব, পুরবাসিগণ নীরব, দর্শকগণ ম্লানমুখে নীরব। এ ঘটনা কেহ ইচ্ছা করিয়া দেখিতে আসে নাই। প্রহরিগণ বলপূর্বক নগরবাসিগণকে ধরিয়া আনিয়াছে।
এজিদের আজ্ঞায় যে সময় জয়নাল আবেদীন বন্দিগৃহ হইতে বলপূর্বক আনিয়াছে, সেই সময় হাসনেবানু অচৈতন্য হইয়াছেন, সেই চক্ষু আর উন্মীলিত হয় নাই। সাহারাবানু, জয়নাব, বিবি সালেমা, জয়নালের হাসি হাসি মুখখানির প্রতি স্থির নেত্রে চাহিয়া আছেন। নিমিষশূন্য চক্ষে জলের ধারা বহিতেছে-অন্তরে, হৃদয়ে, শ্বাসে, প্রশ্বাসে সেই বিপত্তারণ ভগবানের নাম, সহস্র বর্ণে সহস্র প্রকারে, নিঃশব্দে বর্ণিত হইতেছে-জাগিতেছে!
এজিদ্ বলিল, “জয়নাল! তোমার জীবনের এই শেষ সময়। কোন কথা বলিবার থাকে তো বল। তোমার পরমায়ু শেষ হইয়াছে। ঊর্ধ্বদৃষ্টিতে নীরবে আকাশপানে চাহিয়া থাকিলে আর কি হইবে? আমি ভাবিয়াছিলাম, তুমি আমার বশ্যতা স্বীকার করিবে, আমার নামে খোৎবা পড়িবে, আমাকে রাজা বলিয়া মান্য করিবে, আমি তোমাকে ক্ষমা করিব। ঘটনাক্রমে তাহা ঘটিল না, কাজেই শত্রুর শেষ রাখিতে নাই-হাতে পাইয়াও ছাড়িতে নাই। আমি নিশ্চয় জানিয়াছি, তুমি আমার বশ্যতা স্বীকার করিবে না; এ অবস্থায় তোমাকে আর জীবিত রাখিতে পারি না। জীবিত রাখিয়া সর্বদা সন্দিহান থাকা আমার বিবেচনায় ভাল বোধ হয় না। জয়নাল! ঊর্ধ্বে কী আছে? অনন্ত আকাশে সূর্য ভিন্ন আর কী আছে? তুমি আকাশে কি দেখ? আমায় দেখ! আমার হস্তস্থিত শাণিত কৃপাণের প্রতি চাহিয়া দেখ। তোমার মরণ অতি নিকট; যদি কোন কথা থাকে, তবে বল। আমি মনোযোগের সহিত শুনিব।”
জয়নাল আবেদীন বলিলেন, “তোমার সহিত আমার কোন কথা নাই! আমার জীবন-মরণে তোমার সমান ফল। আমি বাঁচিয়া থাকিলেও তোমার নিস্তার নাই, মরিলেও তোমার নিষ্কৃতি নাই; বন্দিখানায় থাকিলেও তোমার উদ্ধার নাই।”
এজিদ্ সরোষে বলিল, “এখনো আস্পর্ধা! এখনো অহঙ্কার! এখনো ঘৃণা! এখনো এজিদে ঘৃণা! এ সময়েও কথা বাঁধুনী। দেখ্, এজিদের নিষ্কৃতি আছে কিনা? দেখ্ এজিদের উদ্ধার আছে কি-না? জীবনে-মরণে সমান ফল? দেখ্ জীবনে-মরণে সমান ফল! এই দেখ্ জীবনে-মরণে সমান-”
এজিদ্ তরবারি উত্তোলন করিতেই মারওয়ান বলিল, “বাদশাহ নামদার! একটু অপেক্ষা করুন। ঐ দেখুন, ওত্বে অলীদের সেই নির্দিষ্ট বিশ্বাসী কাসেদ অশ্বারোহী হইয়া মহাবেগে আসিতেছে। ঐ দেখুন আসিয়া উপস্থিত হইল। একটু অপেক্ষা করুন। যদি হানিফার জীবন শেষ হইয়া থাকে, তবে সে সংবাদ জয়নালকে শুনাইয়া কার্য শেষ করুন। শত্রুর শেষ, কার্যের শেষ, সকল শেষ একেবারেই হইয়া যাউক! বাদশাহ নামদার! একটু অপেক্ষা করুন।”
এজিদের হস্ত নীচে নামিল। কাসেদ্ কী সংবাদ লইয়া আসিল, শুনিতে মহাব্যগ্র, অতি অল্প সময়ের জন্য জয়নালবধে ক্ষান্ত-কাসেদের প্রতি তাহার লক্ষ্য।
কাসেদ্ অভিবাদন করিয়া, ওত্বে অলীদের লিখিত পত্র মারওয়ানের হস্তে দিয়া মলিনমুখে করজোড়ে দণ্ডায়মান হইয়া রহিল। মারওয়ান উচ্চৈঃস্বরে পত্র পাঠ করিতে লাগিল-
“মহারাজাধিরাজ এজিদ্ বাদশাহ নামদারের সর্বপ্রকারের জয় ও মঙ্গল আজ্ঞাবহ কিঙ্করের নিবেদন এই যে, মোহাম্মদ হানিফা চতুর্দশ সহস্র সৈন্যসহ মদিনার নিকটবর্তী প্রান্তরে আসিয়া যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়াছেন। এ পর্যন্ত নগরে প্রবেশ করিতে পারেন নাই। প্রথমদিনের যুদ্ধে আমার সহস্রাধিক সৈন্য মানবলীলা সম্বরণ করিয়াছে। আগামীকল্য যে কী ঘটিবে তাহা কে বলিতে পারে? যত শীঘ্র হয় মারওয়ানকে অধিক পরিমাণে সৈন্যসহ আমার সাহায্যে প্রেরণ করুন। হানিফাকে বন্দি করা দূরে থাকুক, মারওয়ান না আসিলে চিরদাস অলীদ বোধ হয় দামেস্কের মুখ দেখিতে পাইবে না।”
এজিদ্ একটু চিন্তা করিয়া বলিল, “কী বিপদ! এ আপদ কোথায় ছিল? একদিনের যুদ্ধে হাজার সৈন্যের অধিক মারা পড়িয়াছে, এ কী কথা!”
মারওয়ান বলিল, “বাদশাহ নামদার! এ সময় একটু বিবেচনার আবশ্যক, বন্দির প্রাণ বিনাশ করিতে কতক্ষণ।”
“না-না ও-সকল কথা, কথাই নহে। জয়নালকে আর জগতে রাখা যাইতে পারে না। আমি তোমার ভ্রমপূর্ণ উপদেশ আর শুনিতে ইচ্ছা করি না।”
পুনরায় তরবারি উত্তোলন করিতেই দর্শকগণ মধ্যে মহাগোলযোগ উপস্থিত হইল। কেহ পিছু হটিল, কেহ পড়িয়া গেল, কেহ উভয় পার্শ্বে ধাক্কা খাইয়া এক পার্শ্বে সরিল, জনতা ভেদ করিয়া দ্বিতীয় সংবাদবাহী এজিদের সম্মুখে উপস্থিত হইয়া ম্লানমুখে বলিতে লাগিল, “মহারাজ! ক্ষান্ত হউন! জয়নালবধে ক্ষান্ত হউন! বড়ই অমঙ্গল সংবাদ আনিয়াছি। সাধারণের সমক্ষে বলিতে সাহস হয় না।”
এজিদ্ মহারোষে বলিল, “এখানে মোহাম্মদ হানিফা নাই,-বল।” সংবাদবাহী বলিল, “আমরা যাইয়া দেখি সেনাপতি সীমার বাহাদুর নিশীথ সময়ে সৈন্যগণকে তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করিয়া বিপক্ষগণের শিবির বেষ্টন করিয়া রহিয়াছেন। প্রভাতবায়ুর সহিত বিপক্ষদল হইতে অসংখ্য তীর বর্ষণ হইতে লাগিল, দ্বিপ্রহর পর্যন্ত অবিশ্রান্ত তীর চলিল। আমাদের সেনাপতি একপদ ভূমিও অগ্রসর হইতে পারিলেন না; ক্রমে সৈন্যগণ শরাঘাতে র্জর্জ হইয়া ভূতলশায়ী হইতে লাগিল। সেনাপতি সীমার কি মনে করিয়া সন্ধিসূচক শুভ্র পতাকা উড়াইয়া দিলেন, কিছুই বুঝিলাম না,-যুদ্ধ বন্ধ হইল। কোন পক্ষ হইতেই আর যুদ্ধের আয়োজন দেখিলাম না। সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইল, নিশার গভীরতার সহিত বিপক্ষ শিবিরে মহাগোলযোগ উপস্থিত হইল। তাহার পর দেখিলাম যে বিপক্ষ শিবিরে আগুন লাগিয়াছে-দেখিতে দেখিতে কত অশ্ব, কত সৈন্য পুড়িয়া মরিল। তাহার পর দেখিলাম, শিবিরস্থ ভূপতিদ্বয়কে বন্দিভাবে সেনাপতি মহাশয় শিবিরে লইয়া আসিলেন, আনন্দের বাজনা বাজিয়া উঠিল। প্রভাত পর্যন্ত মহাআনন্দ। সূর্য উদয় হইলেই শিবির ভগ্ন করিয়া সেনাপতি মহাশয় দামেস্কনগরে আসিবার উদ্যোগ করিতেছেন, এমন সময় পূর্ব দিক হইতে বহুসংখ্যক অশ্বারোহী সৈন্য বিশেষ সজ্জিতভাবে আসিয়া উপস্থিত হইল। বিপক্ষ দলের মধ্যে যাহারা পলাইয়া গত রাত্রের জ্বলন্ত হুতাশন হইতে প্রাণরক্ষা করিয়াছিল, দূর হইতে তাহাদের জাতীয় চিহ্নসংযুক্ত পতাকা দেখিয়া তাহারা ঐ আগন্তুক দলে ক্রমে ক্রমে মিশিতে লাগিল। দলের অধিনায়ক যেমন রূপবান, তেমনই বলবান। পলায়িত সৈন্যগণের মুখে কি কথা শুনিয়া তিনি চক্ষের পলকে আমাদের সেনাপতি মহাশয়কে সৈন্যগণসহ অশ্বারোহী সৈন্য দ্বারা ঘিরিয়া শৃগাল-কুক্কুরের ন্যায় একে-একে বিনাশ করিতে লাগিলেন। সেনাপতি মহাশয়ের সৈন্যগণ যেন মহামন্ত্রে মোহিত-যেন মায়াপ্রভাবে আত্মবিস্মৃত! শত্রুর তরবারি-তেজে প্রাণ যাইতেছে, দ্বিখণ্ডিত হইয়া ভূতলে পড়িতেছে, এমন আশ্চর্য মোহ কাহারো মুখে কথাটি নাই। কার যুদ্ধ কে করে? পলাইয়া যে প্রাণ রক্ষা করিবে, সে ক্ষমতাও কাহার দেখিলাম না। মহারাজ! দেখিবার মধ্যে দেখিলাম; দামেস্ক সৈন্যমধ্যে যাহারা জীবিত ছিল, হানিফার নাম করিয়া ঐ মহাবীরের সম্মুখে সমুদয় অস্ত্র রাখিয়া নতশিরে দণ্ডায়মান হইল! এই দৃশ্য চক্ষু হইতে সরিতে-না-সরিতে আবার নূতন দৃশ্য।-আমাদের সেনাপতি মহাশয়কে কয়েকজন ভিন্ন দেশীয় সৈন্য, বন্দি অবস্থায় সেই বীর-কেশরীর সম্মুখে আনিয়া উপস্থিত করিল এবং তিনি সেনাপতি বাহাদুরকে ঐ বন্ধনদশায় উষ্ট্রে চড়াইয়া মদিনা অভিমুখে লইয়া গেলেন।”
এজিদ্ হাতের অস্ত্র ফেলিয়া বলিল, “সীমার বন্দি!!!”
মারওয়ান ক্ষণকাল অধোবদনে থাকিয়া বলিল, “মহারাজ! আমি বারবার বলিতেছি, সময় অতিসঙ্কট, মহাসঙ্কট! চারিদিকে বিপদ! যে আগুন জ্বলিয়া উঠিল, ইহা নির্বাণ করিয়া রক্ষা পাওয়া সহজ কথা নহে।” এজিদ্ বলিল, “জয়নাল! যাও, কয়েক দিনের জন্য জগতের মুখ দেখ। মারওয়ানের কথায় আরো কয়েক দিন বন্দিগৃহে বাস কর।”
জয়নাল আবেদীন বলিলেন, “ঈশ্বর রক্ষা না করিলে তোমার কী সাধ্য? মারওয়ানেরই-বা কী ক্ষমতা? আমি বলি, তুমি যাও। আজ হইতে তুমিও তোমার প্রাণের চিন্তা করিতে ভুলিয়ো না! তোমার সময় অতি নিকট। আমি কিছুদিন জগতের মুখ দেখিব, কি তুমি কিছুদিন দেখিবে, তাহার নিশ্চয় কী?”
এজিদ্ মহারোষে জয়নাল আবেদীনকে লক্ষ্য করিতে করিতে চলিয়া গেল। বন্দিগৃহে বন্দি আনীত হইলেন।
জয়নাল আবেদীনের চির-বিরহে আর আমাদিগকে কাঁদিতে হইল না। ঈশ্বরের মহিমা।