উট হবে না হাঁস হবে!
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ একদিন ভক্তদের বললেন : “দ্যাখো পাঁজিতে বিশ আড়া জলের কথা লেখা আছে কিন্তু নিঙড়োলে এক ফোটাও বেরোবে না।” তার মানেটা কি? ধর্মকথা অজস্র শুনে যাও, পড়ে যাও, কপচে যাও, কিছুই হবে না, আত্মিক উন্নতির জন্য চাই অভ্যাস। ধর্ম অভ্যাসের জিনিস। ফলিত যোগ। করতে হবে। ঠাকুর বলছেন : “তাঁর জন্য কাঁদতে হবে বাপু! ভেতরে অনুভব করতে হবে ভীষণ এক অভাব।” সংসারের সবই করছি, কিন্তু মনটা পড়ে আছে সেই দিকে। যেন বাবুর বাড়ির দাসী। বলছে বটে, আমার হারু, আমার গোপাল! কিন্তু মনে-প্রাণে জানে, এরা আমার কেউ নয়। আসল যারা, তারা পড়ে আছে দেশের বাড়িতে। “ভেবে দেখ মন।”
সংসারের কৌটোতে জীব হলো শুকনো ছোলা। যার কোন স্বাদ নেই। চিবোতে জান বেরিয়ে যায়। ভক্তির জলে অহরহ তাকে চুবিয়ে রাখলে তবেই সেই ছোলা ফুলবে, সবুজ টাপুর-টুপুর হবে, নরম হবে, স্বাদ আসবে, ঘ্রাণ আসবে। জীবনকে প্রেমের জলে ফেলে রাখতে হবে। ভগবৎ প্রেম। এই প্ৰেম তো সহজে আসার নয়। সংসারী জীবের আসক্তি হলো কামিনী আর কাঞ্চনে। ঠাকুর বলছেন : “মাগ-ছেলের জন্যে ঘটিঘটি চোখের জল ফেলতে পার আর তাঁর জন্যে এক ফোঁটা ফেলতে পার না!
প্রশ্ন হলো, কেন আমরা তাঁর জন্য আকুল হব! কি লাভ! আরো কত কি তো ছড়ানো রয়েছে চারপাশে—জীবন, যৌবন, ধন, মান। তিনি আমাকে কি-ই বা দিতে পারেন! না গাড়ি, না বাড়ি, না দেহসুখ। ঠাকুর এই সংশয়ের উত্তরে বলছেন : “মানুষ আপনাকে চিনতে পারলে ভগবানকে চিনতে পারে। ‘আমি কে’ ভালরূপ বিচার করলে দেখতে পাওয়া যায়, ‘আমি’ বলে কোন জিনিস নেই। হাত, পা, রক্ত, মাংস ইত্যাদি–এর কোন্টা ‘আমি’? যেমন প্যাঁজের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে কেবল খোসাই বেরোয়, সার কিছু থাকে না, সেইরূপ বিচার কল্লে ‘আমি’ বলে কিছুই পাইনে! শেষে যা থাকে, তাই আত্মা- চৈতন্য।” এই চৈতন্যটুকুর জন্য তাঁকে চাওয়া।
কালনেমি রাবণকে বড় সুন্দরভাবে বোঝাতে চেয়েছিলেন এই জগতের কার্য-কারণ। রাবণই লক্ষ্মণকে শক্তিপ্রহারে অচৈতন্য করে ফেলেছেন। হনুমান চলেছেন বিশল্যকরণী আনতে ক্ষীরসাগরে। রাবণ কালনেমিকে বলছেন : “তুমি মায়াবলে মুনির বেশ ধারণ করে মহাকপি হনুমানকে যেভাবে হোক আটকে রাখ যাতে রাতটা কেটে যায়, তাহলে লক্ষ্মণের জীবনাবসান হবে।” কালনেমি তখন রাবণকে বললেন : “ঈশ (মানে দণ্ডদাতা) রাবণ, আপনি যা বলবেন, তা আমাকে করতেই হবে আর মারীচের মতো আমাকেও মরতে হবে। আমি মরি ক্ষতি নেই; কিন্তু আপনিও যে সবংশে নির্বংশ হবেন। এখনো সময় আছে, আপনি সীতাকে রামের কাছে ফিরিয়ে দিন, আর বিভীষণকে রাজ্যপাট বুঝিয়ে দিয়ে মুনিদের আশ্রয় রমণীয় কোন বনে গিয়ে বানপ্রস্থী হন। প্রাতে পবিত্র জলে স্নান করে সন্ধ্যাদি নিত্যক্রিয়া সমাপন করে নির্জনে সুখাসনে উপবেশন করুন। ইন্দ্রিয়কে বিষয় থেকে তুলে এনে অন্তরাত্মাভিমুখী করুন। বিচার করুন। বোঝার চেষ্টা করুন আত্মা প্রকৃতি থেকে পৃথক। দেহ, বুদ্ধি, ইন্দ্রিয়াদি, আব্রহ্মস্তম্ব পর্যন্ত, এই বিশাল চরাচর জগৎ হলো প্রকৃতি। ব্রহ্মবিদ্ একেই বলেছেন মায়া। এই প্রকৃতিই জগরূপ বৃক্ষ ও তার সৃষ্টি স্থিতি বিনাশের হেতু। প্রজা সৃষ্টির কারণ। প্রজাদের আবার তিন স্বরূপ।“
কালনেমি কি সুন্দর বোঝাচ্ছেন, ইন্দ্রিয়পর, ভোগী রাবণকে। বলছেন : “এই তিন স্বরূপের এক রূপ হলো লোহিত, মানে যারা রাজসিক। দ্বিতীয় গোষ্ঠী হলো শ্বেত, মানে সাত্ত্বিক, তৃতীয় হলো কৃষ্ণ, মানে তামসিক।
“এই প্রকৃতিই সৃষ্টি করছেন, কাম ক্রোধের আকর পুত্রগণকে আর হিংসা ও তৃষ্ণাদি কন্যাগণকে। সতত, সর্বব্যাপী জ্যোতির্ময় আত্মাকে নিজ গুণসমূহের দ্বারা বিমোহিত করে রেখেছেন এই প্রকৃতি।
“আত্মা ঈশ্বর, কিন্তু এই প্রকৃতির, এই মায়ার নিয়ন্ত্রণে জাগতিক খেলায় মেতে আছেন। আত্মা শুধু নির্বিকার। কিন্তু প্রকৃতির সংসর্গে, মায়াগুণে বিমোহিত। নিজের শুদ্ধ সত্তা বিস্মৃত। তাই বাইরের বিষয় নিয়ে মেতে থাকাটাই জীবের ধর্ম। মায়ার জালকে কেটে বেরিয়ে আসুন মহারাজ, সদ্গুরুর সান্নিধ্যলাভের চেষ্টা করুন, জ্ঞানগর্ভ উপদেশে সম্বিৎপ্রাপ্ত হন, বিষয়দৃষ্টি হতে নিবৃত্ত হন। তাহলেই দেখবেন, জীবাত্মার মুক্তি। শুদ্ধ-বুদ্ধ অবস্থা খুঁজে পাবেন আপনি।”
কালনেমির এই উপদেশই ঠাকুর আরো সহজ করে বললেন : “দুইরকম ‘আমি’ আছে—একটা পাকা ‘আমি’ আরেকটা ‘কাঁচা’। আমার বাড়ি, আমার ঘর, আমার ছেলে—এগুলো কাঁচা ‘আমি’ আর পাকা ‘আমি’ হচ্ছে-আমি তাঁর দাস, আমি তাঁর সন্তান, আর আমি সেই নিত্য-মুক্ত জ্ঞানস্বরূপ।”
ঠাকুর ছিলেন অত্যন্ত বাস্তববোধসম্পন্ন। অবতার বরিষ্ঠায়। তাঁর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ছিল অসীম। জীবন রসিক মহা-সাহিত্যিকও হার মেনে যাবেন তাঁর কাছে। তিনি জানতেন, ‘আমি’ সহজে ঘুচবে না। বলছেন : “শরীর থাকতে আমার আমিত্ব একেবারে যায় না, একটু না একটু থাকেই, যেমন নারকেল গাছের বালদো খসে যায়; কিন্তু দাগ থাকে। কিন্তু এই সামান্য ‘আমিত্ব’ মুক্ত পুরুষকে আবদ্ধ করতে পারে না।”
জনৈক ছোকরা ভক্ত ঠাকুরকে প্রশ্ন করলেন জগৎ যদি মায়া, ভেলকি, এ মায়া যায় না কেন? ঠাকুর বললেন : “সংস্কার-দোষে মায়া যায় না! অনেক জন্ম এই মায়ার সংসারে থেকে থেকে মায়াকে সত্য বলে বোধ হয়। সংস্কারের কত ক্ষমতা শোন—একজন রাজার ছেলে পূর্বজন্মে ধোপার ঘরে জন্মেছিল। রাজার ছেলে হয়ে যখন খেলা করছে, তখন সমবয়সীদের বলছে, ওসব খেলা থাক— আমি উপুড় হয়ে শুই, আর তোরা আমার পিঠে হুসহুস করে কাপড় কাচ।“
ঠাকুর জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তাহলে কি হবে? এক জন্মে নাও হতে পারে। ফিরে ফিরে আসা কর্মগতিতে ভেসে যাওয়া। কবে কোন্ এক জন্মে তিনি হাত ধরে আকর্ষণ করবেন, তা জানা তো নেই জীবের। যতদিন না কৃপা করছেন ততদিন বিষয় বিষে জর্জরিত, আত্মভোলা এক উন্মাদ। কেবল দাও, দাও। আরো চাই, আরো আরো। গাড়ি, বাড়ি, নারী, ক্ষমতা, খ্যাতি। ঠাকুর মানুষের যে লক্ষণ নির্দেশ করেছিলেন, তারই একটি—
“মুখহলসা ভেতরবুঁদে, কানতুলসে দীঘল ঘোমটা নারী।
আর পানাপুকুরের ঠাণ্ডা জল বড় মন্দকারী।”
হাউ হাউ করে সারাদিন অজস্র বকে মরছে এমন মানুষ। জানে না, অনেক কথার অনেক দোষ। আবার ভেতরএঁদে সেও এক ধরন। সবসময় ভেতরে ভেতরে গুমরে মরছে। বুক ফাটে তো মুখ খোলে না। ঈর্ষায়, পরশ্রীকাতরতায় জ্বলে পুড়ে মরছে। এতখানি একটা কালো হোমদা মুখ নিয়ে ঘুরছে ফিরছে। সকলেরই সব হয়ে গেল, আমার কিছু হলো না রে! দীঘল ঘোমটার আড়ালে খ্যামটা নাচ। এরা সব কেমন মন্দকারী, না পানাপুকুরের ঠাণ্ডা জলের মতো। কানে তুলসী, ফোঁটা তিলকচর্চিত মহাভক্তের ভেক। ঠাকুর বলছেন : “সাবধান। ধর্মের ভেক ভারি সাঙ্ঘাতিক।” ঠাকুর বলছেন : “ভক্ত কিংবা জ্ঞানীর ভাব বাইরে থেকে বোঝা বড় কঠিন হয়ে থাকে। যেমন দু-রকম দাঁত দেখা যায়—বাইরের দাঁত কেবল দেখাবার, তার দ্বারা খাওয়া চলে না। আরেক রকম দাঁত মুখের ভেতরে আছে, তার দ্বারা খেয়ে থাকে।” ঠাকুর বলছেন : “ধ্যান করবে মনে, বনে আর কোণে।” এক জটাজুটধারী ব্রহ্মচারী দক্ষিণেশ্বরে এসেছিলেন ঠাকুরকে দর্শন করতে। ঠাকুরের সামনে বসে আর কোন কথা নেই কেবল ‘শিবোহম্’, ‘শিবোহম্’ করতে লাগলেন। ঠাকুর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অবশেষে বললেন : “কেবল ‘শিবোহম্’, ‘শিবোহম্’ করলে কি হবে? যখন সেই সচ্চিদানন্দ শিবকে হৃদয়ে ধ্যান করে তন্ময় হয়ে গিয়ে বোধে বোধ হয়, সেই অবস্থায় বলা চলে। তাছাড়া শুধু মুখে ‘শিবোহম্’ বললে কি হবে? যতক্ষণ তা না হয়, ততক্ষণ সেব্য-সেবক ভাবে থাকাই ভাল।” ঠাকুরের উপদেশে ব্রহ্মচারীর চৈতন্য হলো। তিনি বুঝতে পারলেন নিজের ভুল। যাবার সময় দেওয়ালের গায়ে লিখে রেখে গেলেন—”স্বামী বাক্যে আজ হতে রামচন্দ্ৰ ব্রহ্মচারী সেব্য-সেবক-ভাব প্রাপ্ত হলো।”
মূল প্রশ্নটা হলো, আমরা গৃহী, সংসারের অনিত্য বস্তুকেই আমাদের নিত্য মনে হয়। নিত্য ঈশ্বরকে চিন্তা করে আমাদের কি লাভ! আমরা শুধু চাই, ভোগ চাই, ক্ষমতা চাই, আনন্দ-ফুর্তি চাই। ঈশ্বর কি সেইসব দেবেন? ঠাকুর বলছেন, শোন তাহলে, কেন ঈশ্বরমুখী হবে—”পাথর হাজার বৎসর জলে পড়ে থাকলেও তার ভেতর জল কখনো ঢোকে না; কিন্তু মাটিতে জল লাগলে তখনি গলে যায়। যারা বিশ্বাসী ও ভক্ত, তারা হাজার হাজার আপদ-বিপদের মধ্যে পড়লেও হতাশ হয় না; কিন্তু অবিশ্বাসী মানুষের মন সামান্য কারণে টলে যায়। যাঁরা তর্ক করতে চান, নানারকম সংশয় তুলে নিজেদেরটাকেই ঠিক বলে বোঝাতে চান, ঠাকুর বলতেন : “মতুয়ার বুদ্ধি। সকলেই বলে, আমার ঘড়িই ঠিক চলছে, কিন্তু সব ঘড়িই ভুল। তার্কিক তোমার তর্ক নিয়েই থাক, যদি এক-কথায় বুঝতে পার তো আমার কাছে এস। আর খুব তর্ক-যুক্তি করে যদি বুঝতে চাও তো কেশবের কাছে যাও।” ঠাকুর বলতেন : “গ্রন্থ নয়—গ্রন্থি- গাঁট। বিবেকবৈরাগ্যের সহিত বই না পড়লে পুস্তকপাঠে দাম্ভিকতা, অহঙ্কারের গাঁট বেড়ে যায় মাত্ৰ।“
এক রাজা ঢেঁড়া পিটিয়ে দিলেন—যে পাঠক ভাগবত পাঠ করে তাঁর মনে বৈরাগ্য আনতে পারবে তাঁকে তিনি সমস্ত রাজ্য-পাট দান করে বনে চলে যাবেন। রাজত্বে ভাগবত পাঠকের অভাব ছিল না। বড় বড় সব ভাষ্যকার। রাজা এই ঘোষণার সঙ্গে আরেকটি ভীষণ শর্ত জুড়ে দিলেন—বৈরাগ্য জাগাতে না পারলে ভাগবত-পাঠককে সারা জীবনের মতো কারাগারে ভরে দেওয়া হবে। রাজত্বের লোভে পাঠকরা সব ছুটে এলেন, আর রাজার মনে বৈরাগ্য জাগাতে ব্যর্থ হয়ে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হলেন। অবশেষে সেই রাজ্যের শ্রেষ্ঠ পাঠক, বৃদ্ধ এক ব্রাহ্মণ এগিয়ে এলেন। তাঁর স্ত্রী স্বামীকে সাবধান করে বললেন : “কেন যাচ্ছ? কেউ যা পারল না, তুমি কিভাবে তা পারবে?” ব্রাহ্মণ বললেন : “আমি এত বছর ধরে ভাগবত পাঠ করছি, পাঠক হিসাবে আমার এত খ্যাতি, আমি না পারলে আর কে পারবে ব্রাহ্মণী! আমার ওপর বিশ্বাস রাখ।” ব্রাহ্মণ রাজসভায় গিয়ে পাঠ শুরু করলেন। কিছুক্ষণ পাঠ শোনার পর রাজামশাই বললেন : “খুব হয়েছে, আপনার পাঠ শুনে বৈরাগ্য তো এলোই না, উলটে বিষয়তৃষ্ণা আরো বেড়ে গেল।” ব্রাহ্মণ চলে গেলেন কারাগারে। সেই ব্রাহ্মণের একমাত্র ছেলে গৃহত্যাগ করে অতি বাল্যে সন্ন্যাসী হয়ে চলে গিয়েছিল। সন্ন্যাসাশ্রমের নিয়ম আছে, বার বছর পরে জন্মস্থানে ইচ্ছে করলে একবার আসা চলে। যুবক সন্ন্যাসী সেই অনুসারে এসেছেন। সামনেই মা। তিনি জটাজুটধারী সন্ন্যাসীকে চিনতে পারলেন না নিজের পুত্র বলে। ছেলে দেখছে, মায়ের মাথায় সিঁদুর রয়েছে, কিন্তু বাবাকে দেখতে পাচ্ছে না। সে তখন জিজ্ঞেস করলে : “আপনার স্বামী কোথায় মা?” মা তখন সমস্ত বৃত্তান্ত বললেন। সন্ন্যাসী সব শুনে রাজদরবারে এসে বললেন : “আমি আপনাকে ভাগবত শোনাব।” অল্পবয়সী সেই সন্ন্যাসীর দিকে তাকিয়ে রাজামশাই বললেন : “আপনি আমার শর্ত জানেন তো?” সন্ন্যাসী বললেন : “অবশ্যই জানি।” শুরু হলো পাঠ। প্রথম দিনে পাঠ আর ব্যাখ্যা শুনে রাজামশাইয়ের ভিতরটা আনচান করে উঠল। দ্বিতীয় দিনের পাঠ শেষে রাজা বললেন : “আর প্রয়োজন নেই, আমি শর্ত অনুসারে সমস্ত রাজ্য আপনাকে দিলাম।” সন্ন্যাসী বললেন : “রাজ্য নিয়ে আমি কি করব মহারাজ, বরং আপনি যাঁদের কারাগারে রেখেছেন তাঁদের এইবার মুক্ত করে দিন।” রাজ-আদেশে সবাই মুক্ত হয়ে দরবারে এলেন। তাঁদের মধ্যে সন্ন্যাসীর পিতাও রয়েছেন। তিনি যখন শুনলেন, ঐ যুবক সন্ন্যাসীর পাঠে রাজার বৈরাগ্যোদয় হয়েছে, তাঁর অহঙ্কারে লাগল। তিনি প্রশ্ন করলেন : “এই অসম্ভব সম্ভব হলো কি করে? সন্ন্যাসী, তুমি কি আমার চেয়েও ভাল পাঠক?” সন্ন্যাসী বললেন : “আপনারা দুজনে আমার সঙ্গে বাগানে চলুন।” বাগানে নিয়ে গিয়ে সন্ন্যাসী রাজামশাইকে একটা গাছে বাঁধলেন আর কিছু দূরে অপর একটা গাছে পিতাকে বেঁধে বললেন : “এইবার পরস্পর পরস্পরকে মুক্ত করুন।” পিতা বললেন : “তা কি করে হয়, আমি বাঁধা পড়ে আছি, রাজামশাইয়ের বন্ধন মোচন করব কিভাবে?” সন্ন্যাসী হেসে বললেন : “এইটাই আমার উত্তর। আমার পাঠ আহামরি কিছু নয়, কিন্তু আমি সংসারের বন্ধনমুক্ত। আমি মুক্ত বলেই আপনাদের রাজার বন্ধন খুলতে পেরেছি।” তুলসীদাস ঠিক সেই কারণেই বলছেন—
“অষ্টপ্রহরে একটি প্রহর কিংবা অর্ধ তার,
সাধুর সঙ্গ করিও তুলসী দূরে যাবে দুখভার।”
ঠাকুর বলছেন : “জীবাত্মা-পরমাত্মার মধ্যে এক মায়া-আবরণ আছে। এই মায়া-আবরণ না সরে গেলে পরস্পরের সাক্ষাৎ হয় না। যেমন অগ্রে রাম, মধ্যে সীতা এবং পশ্চাতে লক্ষ্মণ। এস্থলে রাম পরমাত্মা ও লক্ষ্মণ জীবাত্মাস্বরূপ, মধ্যে জানকী মায়া-আবরণ হয়ে রয়েছেন। যতক্ষণ মা জানকী থাকেন, ততক্ষণ লক্ষ্মণ রামকে দেখতে পান না। জানকী একটু সরে পাশ কাটালে তখন লক্ষ্মণ রামকে দেখতে পান।”
শ্রীবশিষ্ঠ রামকে বলছেন : “স্নেহভাজন রাম! এই বিশ্ববিমোহিনী মায়া কি বিচিত্র! এই মায়ায় মোহিত হয়ে জীব সর্ব-ব্যাপ্ত আত্মাকেও জানতে পারে না।”
“যদিদং দৃশ্যতে কিঞ্চিত্তন্নাস্তি কিমপি ধ্রুবম্।
যথা গন্ধর্বনগরং যথা বারি মরুস্থলে।”
—জগৎ আর কিছুই নয়, একটা অপূর্ব মরীচিকা। আকাশের গায়ে গন্ধর্ব-নগর। কী অপূর্ব তার শোভা! ধু ধু মরুভূমিতে মিথ্যা নীল সরোবর। দ্রষ্টা, তুমি যেই চোখ বোজাবে দেখবে কিছুই নেই। সব বাইরের। ভিতরে কিছু নেই।
“স্বজ্ঞানদর্পণে স্ফারে সমস্ত বস্তুজাতয়ঃ।
ইমাস্তাঃ প্রতিবিম্বন্তি সরসীব তটদ্রুমাঃ।”
সরোবরের তীরে গাছ। নিজেরই বিশাল জ্ঞানদর্পণে সেই গাছ, সেই জগতের প্রতিফলন। প্রতিবিম্বন্তি সরসীব তটদ্রুমাঃ। এই হলো মায়া। নির্বিশেষ শুদ্ধ চৈতন্যস্বরূপ আত্মাতে মায়ার স্পন্দনই হলো সৃষ্টি। ঠাকুর একটি গান প্রায়ই গাইতেন—
“ভবে আসা খেলতে পাশা কত আশা করেছিলাম।
আশার আশা ভাঙা দশা প্রথমে পঙ্গুড়ি পেলাম।।
পো বার আঠার ষোল যুগে যুগে এলাম ভাল।
শেষে কচে বারো পড়ে মাগো, পঞ্জাছক্কায় বন্দী হলাম।।”
তুলসী বলছেন : “জীব নাহি জানে কেবা ঈশ্বর, কাহারে বা বলে মায়া। মুক্তি বাঁধন এই সংসারে সকলি শিবের ছায়া।” ঠাকুর সুন্দর একটি গল্প বলতেন—”একজন চাষীর বেশি বয়সে এক ছেলে হয়েছিল। ছেলেটিকে খুব যত্ন করে। ছেলেটি ক্রমে বড় হলো। একদিন চাষী ক্ষেতে কাজ করছে, এমন সময় একজন এসে খবর দিলে যে, ছেলেটির ভারি অসুখ। ছেলে যায় যায়। বাড়িতে এসে দেখে ছেলে মারা গেছে। পরিবার খুব কাঁদছে, কিন্তু চাষার চোখে একটুও জল নেই। প্রতিবেশীদের কাছে তাই পরিবার আরো দুঃখ করতে লাগল যে, এমন ছেলেটা গেল, এর চোখে একটু জল পর্যন্ত নেই। অনেকক্ষণ পরে চাষা পরিবারকে সম্বোধন করে বলল, ‘কেন কাঁদছি না জান? আমি কাল স্বপন দেখেছিলুম যে রাজা হয়েছি, আর সাত ছেলের বাপ হয়েছি। স্বপনে দেখলুম যে, ছেলেগুলি রূপে গুণে সুন্দর। ক্রমে বড় হলো, বিদ্যাধর্ম উপার্জন করলে। এমন সময় আমার ঘুম ভেঙে গেল; এখন ভাবছি যে, তোমার ঐ এক ছেলের জন্য কাঁদব, কি আমার সাত ছেলের জন্য কাঁদব?’ “ কী অপূৰ্ব কথা বলেছেন, ‘মানসোল্লাস-বর্তিকা’–
“অবিচারিতসিদ্ধেয়ং মায়া বেশ্যা বিলাসিনী।
পুরুষং বঞ্চয়ত্যেব মিথ্যাভূতৈঃ স্ববিভ্রমৈঃ।।”
–যুক্তিহীন প্রকাশরূপিণী, বিচিত্র বিলাসকারিণী, বেশ্যাতুল্যা মায়া মিথ্যা-ভূত নানা বিভ্রম সহায়ে পুরুষকে বঞ্চনা করে চলেছে, এর আর শেষ নেই—এই খেলার। এই মিথ্যা আমারই বিষয়-ভোগ-বাসনায় আরো জাঁকিয়ে বসে। আচার্য শঙ্কর এই চক্রটির সুন্দর ব্যাখ্যা দিলেন—বাসনা যেই বাড়ল, মানুষ অমনি মেতে উঠল ভোগপ্রদ সকাম কর্মে। এই কর্মে বাসনা আরো বেড়ে গেল। জীব আগাপাশতলা জড়িয়ে গেল সংসারবন্ধনে। এর আর নিবৃত্তি নেই।
ঠাকুর বিষয়টিকে এগিয়ে দিলেন আমার দিকে। বোঝাপড়া যার যার নিজের সঙ্গে। প্রথমে বিচার! কি বিচার? আমাকে ভূত ধরেছে—”যাকে ভূতে পায় সে যদি জানতে পারে যে তাকে ভূতে পেয়েছে, তাহলে ভূত পালিয়ে যায়। মায়াচ্ছন্ন জীব যদি একবার ঠিক জানতে পারে যে, তাকে মায়ায় আচ্ছন্ন করেছে তাহলে মায়া তার নিকট থেকে তখনি পালায়।
“সংসারে দু-রকম স্বভাবের লোক দেখতে পাওয়া যায়—কতকগুলো কুলোর ন্যায় স্বভাববিশিষ্ট আর কতকগুলো চালুনির ন্যায়। কুলো যেমন ভূষি প্রভৃতি অসার বস্তু সব পরিত্যাগ করে সার বস্তু যে শস্য সেইগুলি আপনার ভেতরে রাখে, সেইরকম কতকগুলি লোক সংসারের অসার বস্তু পরিত্যাগ করে সার বস্তু ভগবানকে গ্রহণ করে। চালুনি যেমন সার বস্তুসকল পরিত্যাগ করে অসার বস্তুগুলি নিজের ভেতর রাখে সেইরূপ সংসারে কতকগুলি লোক সার বস্তু ঈশ্বরকে পরিত্যাগ করে অসার বস্তু কামকাঞ্চনাদি গ্রহণ করে।”
এখন উট হবে, না, হাঁস হবে—নিজেই বিচার কর। পথ গেছে এইভাবে— প্রথমে বৈরাগ্য, তারপর বিশ্বাস, তারপর ভালবাসা, তারপর বিরহ–তুমি কোথায়! শেষে অশ্রু বিসর্জন। আর কোন কিছুর প্রয়োজন নেই। সব আচার- বিচার ব্যর্থ যদি বৈরাগ্যোদয় না হয়। ঠাকুরের কথা আর তুলসীদাসজীর কথা এক—
“তুলসীর মালা গলায় পরিলে যদি পাওয়া যায় হরি,
আমি তবে ভাই ডালাপালাগাছ উখাড়ি গলায় পরি।
পাথর পূজিলে যদি সহজেই পাওয়া যায় হর-হরি
আমি তবে ভাই সোজা চলে যাই, পাহাড়ের পুজো করি।।”
(অনুবাদক : রামপ্রসাদ সেন)
ঠাকুর রামকৃষ্ণ আছেন, আমরাও আছি। তিনি সর্বকালের সর্বমানবের পথপ্রদষ্টা। আমার পথ, তোমার চলা। তিনি জানেন সব ঘুড়ি কাটে না—
“বিষয়ে মেজেছে মাঞ্জা, কর্কশা হয়েছে দড়ি।
ঘুড়ি লক্ষের দুটা একটা কাটে, হেসে দাও মা হাতচাপড়ি।।”
তাঁর ইচ্ছা। তাঁর ইচ্ছা যে, তিনি এইসব নিয়ে খেলা করেন। বুড়িকে আগে থাকতে ছুঁলে দৌড়াদৌড়ি করতে হয় না। সকলেই যদি ছুঁয়ে ফেলে, খেলা কেমন করে হয়, তাই লক্ষের দুটো একটা কাটে, হেসে দাও মা হাতচাপড়ি তিনি মনকে আঁখি ঠেরে ইশারা করে বলে দিয়েছেন, যা এখন সংসার করগে যা। মনের কি দোষ! তিনি যদি আবার দয়া করে মনকে ফিরিয়ে দেন, তাহলে বিষয়-বুদ্ধির হাত থেকে মুক্তি হয়। তখন আবার তাঁর পাদপদ্মে মন হয়।
“মন-গরিবের কি দোষ আছে,
শ্যামা-মা যেমন করান তেমনি করে।।”
একটি হাত রাখ সংসারে, আরেক হাত তাঁর পাদপদ্মে। সময় হলে দু-হাতে ধর তাঁকে। হুঁস রাখ, মানযুক্ত হুঁস, তবেই তুমি মানুষ।