2 of 3

উচ্ছ্বাস থেকে শ্বাসে

উচ্ছ্বাস থেকে শ্বাসে

“এই কলম্বো থেকে রামনাদ পর্যন্ত আমার পর্যটন যেন এক বিরাট শোভাযাত্রা—হাজার হাজার লোকের ভিড়, আলোকসজ্জা, অভিনন্দন ইত্যাদি! ভারতভূমির যেখানে আমি প্রথম পদার্পণ করি, সেই স্থানে ৪০ ফুট উচ্চ একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি হচ্ছে। রামনাদের রাজা একটি সুন্দর কারুকার্য খচিত খাঁটি সোনার তৈরি বৃহৎ পেটিকায় তাঁর অভিনন্দনপত্র আমাকে দিয়েছেন। তাতে আমাকে ‘His Most Holiness’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে। মাদ্রাজ ও কলকাতা আমার জন্য উদগ্রীব হয়ে রয়েছে, যেন সমগ্র দেশটা আমাকে অভিনন্দিত করবার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। সুতরাং তুমি দেখতে পাচ্ছ, মেরী, আমি আমার সৌভাগ্যের উচ্চতম শিখরে উঠেছি।”

স্বামীজী জনসংবর্ধনার ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে মিস মেরী হেলকে একটি চিঠি লিখে ফেললেন। কেন? নিরাসক্ত যোগী, শক্তির ভিসুভিয়াস স্বামী বিবেকানন্দের বেশ মজা লাগছে। গিয়েছিলেন নিঃশব্দে। গুটিকয় মানুষ সেদিন ‘সি অফ’ করেছিলেন। ভারত তখনো জানত না, বিবেকানন্দ কে! অনেক সন্ন্যাসীর এক সন্ন্যাসী! সেইসময় যাঁরা ঘনিষ্ঠ ছিলেন—তাঁরাও কি ধরতে পেরেছিলেন, কি হতে চলেছে? খ্রীস্টধর্মের বিজয়ঘোষণাই ছিল ধর্মমহাসভার গূঢ় উদ্দেশ্য—সব ধর্মের সেরা ধর্ম। সেই বাঘের ঘরে গিয়ে এই অজ্ঞাত ভারতীয় সন্ন্যাসী কোন অতীত ছাড়াই বিরাট এক ভবিষ্যৎ তৈরি করে ফেললেন। ইতিহাস বলবে—The turning point of Hindu religion. স্বাধীনতা তখনো দূরে। পরাধীনতার অসম্মানে ভারত ন্যুব্জ। পৃথিবীর মানুষ জানেই না প্রকৃত ভারত কি। স্বামীজী চাকাটা ঘুরিয়ে দিলেন। স্বাধীনতার আগেই স্বাধীনতার পতাকাটি উড়িয়ে দিলেন – “Yes, India is a Race far superior to the white men’s west.” এই একটা মানুষ পর্দা ছিঁড়ে দিয়েছে। একটা ‘আর্মি’ যা করতে পারে না, একটি মানুষ তাই করছে। “He has conquered the intellectual world.” স্বামীজী ফিরে এসে দেখছেন, তাঁর জন্য বিজয়ী বীরের সম্মান অপেক্ষা করে আছে। ব্যঙ্গ করে বলছেন : “So you see, Mary, I am on the very height of my destiny.” নিয়তি! আমাকে তুলেছে। পার্থিব শরীর, নামরূপ উঠেছে; কিন্তু বিবেকেই যাঁর আনন্দ তাঁর ভিতরটা কি চাইছে, মন কি চাইছে—”Yet the mind turns to quietness and peace, to the days we had in Chicago, of rest of peace and love.”–তবু আমার মন চিকাগোর সেই নিস্তব্ধ, প্রশান্ত দিনগুলির দিকেই ছুটছে—কী বিশ্রাম- শান্তি ও প্রেমপূর্ণ দিনগুলি! তাই এখনি তোমাকে চিঠি লিখতে বসেছি।”

এই ধকলে স্বামীজীর শরীর ভেঙে গেল। আমেরিকার অত্যধিক মানসিক ও কায়িক শ্রমে কিছুটা ভেঙেছিল। স্বামীজী ২৬ জানুয়ারি ১৮৯৭ (আশ্চর্য, ২৬ জানুয়ারি আমাদের প্রজাতন্ত্র দিবস!) বিকেল ৩টার সময় জাহাজে এলেন পাম্বান দ্বীপের পাম্বান রোড বন্দরে। রামনাদের রাজা এসে তাঁকে তুলে নিলেন রাজকীয় নৌকায়। রাজতরণী স্বামীজীকে নিয়ে এল পাম্বান সিটিতে। সোজা সভায়। বিশাল আয়োজন। সভা-শেষে রাজশকট তাঁকে নিয়ে এল রাজকীয় বাংলোয়। গাড়ি প্রথমে টানছিল ঘোড়ায়। রাজাদেশে ঘোড়া খুলে দেওয়া হলো। রাজা স্বয়ং পার্ষদদের নিয়ে গাড়ি টানতে লাগলেন। ইতিহাসে বিরল এই দৃশ্য। শ্ৰদ্ধা কোন্ সীমায়! বাঙালীর চিন্তার বাইরে। রাজা, ভূস্বামী গাড়ি টানছেন কার? সন্ন্যাসীর—যিনি হৃদয়ের স্বামী। পাম্বানে তিনদিন। রামেশ্বর-দর্শন। অবশ্য বিদেশযাত্রার প্রাক্কালেও রামেশ্বর গিয়েছিলেন। রাজকীয় সম্বর্ধনা। পাম্বান থেকে রামনাদ, তারপর পরমকুড়ি, মনমাদুরা, মাদুরাই। এই তিন সপ্তাহকাল থাকা, খাওয়া, বিশ্রামের কোন ঠিক-ঠিকানা রইল না। পথশ্রম। দীর্ঘ ভ্রমণ। মাদুরাইতে যখন এলেন তখন শরীর আর চলে না। মাদুরাই থেকে কুম্ভকোনম। কুম্ভকোনমে থাকা সম্ভব হলো না। রাত ৪টায় ট্রেন এল তিরুচিরাপল্লীতে। অসংখ্য মানুষ সেই ভোররাতেই স্বামীজীর আগমন অপেক্ষায় স্টেশনে হাজির। পঠিত হলো অভিনন্দনপত্র—”আমরা আশা করিয়াছিলাম, আপনি অন্তত এখানে পদার্পণ করিয়া আমাদিগকে কৃতার্থ করিবেন। যাহা হউক, মাদ্রাজবাসীরা যে শীঘ্রই আপনাকে পাইবে, ইহাই ভাবিয়া আমরা পরম আনন্দ বোধ করিতেছি!” পরের বৃহৎ নগর তাঞ্জোরে এর কিছু পরে যে-সমাবেশ হলো, সেও বিশাল। অবশেষে কুম্ভকোনম। সেখান থেকে মাদ্রাজ।

“Flowers, Flowers all the way!” মাদ্রাজ থেকে স্বামীজী লিখছেন (১২ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৭) রাখাল মহারাজকে—”আগামী রবিবার ‘মোম্বাসা’ জাহাজে আমার রওনা হবার কথা। স্বাস্থ্য খারাপ হওয়ায় পুনার এবং আরো অনেক স্থানের নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করতে হয়েছে। অতিরিক্ত পরিশ্রমে ও গরমে আমার শরীর অত্যন্ত খারাপ হয়েছে।”

গোলাপ, গোলাপ-পথে পথে। কাঁটাও ছিল। স্বামীজী ঐ-চিঠিতে লিখছেন : “থিওজফিস্টরা ও অন্যান্য সকলে আমাকে ভয় দেখাতে চেয়েছিল; সুতরাং আমাকেও দু-চারটে কথা খোলাখুলিভাবে তাদের শোনাতে হয়েছিল। তুমি জান, তাদের দলে যোগ দিতে অস্বীকার করায় তারা আমাকে আমেরিকায় বরাবর নির্যাতিত করেছে। এখানেও তারা তাই শুরু করতে চেয়েছিল।”

একটু বেসুর তো শোনা যাবেই, তা নাহলে আর মানুষ হলো কি! স্বামীজী স্পষ্ট বললেন : “It goes without saying that a certain amount of good work has been done to India by the society; as such every Hindu is grateful to it and especially to Mrs. Besant … . But that is one thing-and joining the society of the Theosophists is another. Regard and estimation and love are one thing, and swallowing everything anyone has to say, without reasoning, without criticising, without analysing is quite another.”

আমি নরেন্দ্রনাথ। আমি আমার গুরুকে পর্যন্ত যৎপরোনাস্তি বাজিয়ে নিয়েছিলাম। তাঁর সেই উক্তি—”কিরে, এখনো তোর সন্দেহ গেল না!” পওহারী বাবাকেও দেখেছি। সত্যই আমার ধর্ম, ত্যাগই আমার ধর্ম, সেবাই আমার ধর্ম, স্পষ্টবাদিতাই আমার ধর্ম। অতএব মাদ্রাজবাসী আপনারা শুনুন— “There is a report going round that the Theosophists helped the little achievements of mine in America and England. I have to tell you plainly that every word of it is wrong, every word of it is untrue.”

স্বামীজী স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখলেন : “কাজেই আমার মত পরিষ্কার করে বলতে হয়েছিল। এতে আমার কলকাতার বন্ধুদের কেউ যদি অসন্তুষ্ট হয়ে থাকেন তো ভগবান তাঁদের কৃপা করুন।… আমি নিঃসঙ্গ নই—প্ৰভু সৰ্বদাই সঙ্গে আছেন।” হে মমৈকশরণদাতা রামকৃষ্ণ ভগবান!

‘ফাইটার’ স্বামীজী কলকাতায় আসছেন—হাজার হাজার ভক্ত গুণগ্রাহীর উত্তাল সংবর্ধনার ঢেউয়ে আন্দোলিত হতে হতে। সঙ্গে এনেছেন সুচিন্তিত কৰ্ম- পরিকল্পনা। জনসাগর শান্ত হবে। উচ্ছ্বাস প্রশমিত হবে। মানুষ ফিরবে, মানুষ ভুলবে। থাকবে রূঢ় কর্মের বাস্তব জগৎ।

“তোমাদিগকে কেবল ইহাই স্মরণ করাইয়া দিতে চাই যে, আমাদের এই মহান জাতীয় অর্ণবপোত শত শতাব্দী যাবৎ হিন্দুজাতিকে পারাপার করিতেছে। সম্ভবত আজকাল উহাতে কয়েকটি ছিদ্র হইয়াছে—হয়তো উহা কিঞ্চিৎ জীর্ণ হইয়া পড়িয়াছে।… ভারতমাতার সকল সন্তানেরই এই ছিদ্রগুলি বন্ধ করিয়া পোতের জীর্ণসংস্কার করিবার প্রাণপণ চেষ্টা করা উচিত… তাহারা জাগ্রত হউক, তাহারা এদিকে মনঃসংযোগ করুক… অভিশাপ, নিন্দা ও গালিবর্ষণের দ্বারা কোন সৎ উদ্দেশ্য সাধিত হয় না… কেবল ভালবাসা ও সহানুভূতি দ্বারাই সুফলপ্রাপ্তির আশা করা যাইতে পারে।”

১৫ ফেব্রুয়ারি সকালে মোম্বাসা জাহাজ মাদ্রাজ বন্দর ছাড়ল। ১৮ ফেব্রুয়ারি বজবজ। ১৯ ফেব্রুয়ারি ভোরে বজবজ থেকে স্পেশাল ট্রেনে শিয়ালদা। ২০,০০০ মানুষের সমাগম! কোথাও পা ফেলার জায়গা নেই। স্টেশনে ট্রেন ঢুকছে। সকাল সাড়ে ৭টা। ট্রেন ঢোকার আগে হু হু বাঁশি। সঙ্গে সঙ্গে জনতার গগনবিদারী হর্ষধ্বনি। ঐ তো ট্রেনের দরজায় করজোড়ে দাঁড়িয়ে স্বামী বিবেকানন্দ! নামলেন তিনি। “পদধূলি দিন স্বামীজী।” ভূমিষ্ঠ। আনত। হাজার হাজার মানুষ। “জয় পরমহংস রামকৃষ্ণদেব কী জয়।” শতবর্ষ পরে আজ— আমরা রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দময়। উচ্ছ্বাস থেকে শ্বাসে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *