ধর্ম ও দর্শন
বিজ্ঞান
সাহিত্য
1 of 2

উইলিয়াম হার্শেল (১৭৩৮–১৮২২) – ইউরেনাস গ্রহের আবিষ্কারক

উইলিয়াম হার্শেল (১৭৩৮–১৮২২) – ইউরেনাস গ্রহের আবিষ্কারক

পরিবেশই মানুষকে তৈরি করে। পরিবেশের প্রভাবেই মানুষ ভালো আর মন্দ হয়ে থাকে। কিন্তু এর ব্যতিক্রমী চরিত্রও যে নেই, তাতো নয়। এ-রকম চরিত্রের মানুষগুলোই তাঁদের চারপাশের অন্ধকারের আবরণকে ভেদ করে অভিসারী হন আলোকোজ্জ্বল পথের।

ভবিষ্যতে যিনি বিশ্বখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী হবেন, সেই উইলিয়াম হার্শেলের (William Herschel) জন্ম ১৭৩৮ সালের ১৫ নভেম্বর জার্মানির হ্যানোভার শহরে। বাবা ছিলেন একপাল সন্তানের এক অক্ষম জনক। প্রথম জীবনে চাকরি করতেন সামরিক বিভাগে। যুদ্ধে দেহ-মন বিধ্বস্ত হওয়ার পর ঘরে বসে গান শিখিয়ে কোনোরকমে সংসার চালাতেন তিনি।

হ্যানোভারের সামরিক দুর্গের পাশের একটি স্কুলে তাঁর ভাইবোনদের সাথেই স্কুলে যেতেন হার্শেল। কিন্তু বাবা-মায়ের ইচ্ছে ছিল না তাঁদের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখুক। ওরা বড় হয়ে যদি যে যার কাজে লেগে গিয়ে দু-চার পয়সা আয় করতে পারে, তাতেই তাঁর সাহায্য হয়।

কিন্তু হার্শেলের ছিল পড়াশোনার প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহ। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি ইংরেজি এবং ফরাসি ভাষা শিখে ফেলেন। মা তাঁর সব ছেলেমেয়েকেই লেখাপড়া ছেড়ে গান শিখে উপার্জনের পথে নেমে যেতে উৎসাহিত করেছিলেন। কিন্তু পারলেন না শুধু হার্শেলকে বাগ মানাতে। অবশ্য একেবারেই যে পারলেন না, তাও নয়। ছোটবেলায় হার্শেলকেও তাঁর আর সব ভাইবোনের সাথে রাজসভায় গান গাইতে যেতে হতো। তাঁর ছোট ভাই আলেকজান্ডার ভালো বেহালা বাজাতে পারতেন। হার্শেল বাজাতেন বীণা।

কিন্তু গান গেয়ে বাড়ি ফিরেই শুরু হতো তাঁর পড়াশোনা। আর ছোট ভাই আলেকজান্ডারের সঙ্গে বিজ্ঞান নিয়ে সারা রাত জেগে চলত আলোচনা। তাঁদের আলোচনা জুড়ে থাকত নিউটন, লাইরনিৎস ও ইউলার প্রমুখ বিজ্ঞানীর আবিষ্কারের প্রসঙ্গ। এ-রকম আলোচনা করতে করতে কখনও কখনও রাত ভোর হয়ে যেত। মা এসে বেশি রাত জেগে পড়াশোনা করার জন্য দু’ জনকে ধমকাতেও কসুর করতেন না।

হার্শেলের ছিল ছোট এক বোন। নাম ক্যারোলিন লুক্রেটিয়া (১৭৫০-১৮৪৮)। বড় ভাইয়ের প্রতি ছিল তাঁর অপরিসীম শ্রদ্ধা। এসব আলোচনা তাঁর মনেও দারুণ কৌতূহল জাগাত। ক্রমে এই ক্যারোলিনই এসে স্থান দখল করে আলেকজান্ডারের। শেষ পর্যন্ত ক্যারোলিনকে নিয়েই হার্শেল লেগে যান জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চায়। আকাশে তারা দেখার জন্য ছোট বোনকে সঙ্গে নিয়েই তিনি রাতের পর রাত কাটিয়ে দিতেন।

পারিবারিক অবস্থার প্রেক্ষিতে এবং অর্থ উপার্জনের জন্য হার্শের একবার হ্যানোভারের পদাতিক রক্ষীবাহিনীতেও যোগ দিয়েছিলেন। চলে গিয়েছিলেন লন্ডনে। কিন্তু সেখানে বেশিদিন থাকা হয়নি। স্বাস্থ্য ভালো নয়—এই অজুহাতে চাকরি ছেড়ে দিয়ে আবার তিনি ফিরে এসেছিলেন হ্যানোভারে।

১৭৬৭ সালে হার্শেলের পিতার মৃত্যু হয়। এরপর ১৭৭২ সালে ভাই আলেকজান্ডার ও প্রিয় বোন ক্যারোলিনকে নিয়ে চলে যান লন্ডনে। সেখানে বোন ক্যারোলিন দরজির কাজ আর মেয়েদেরকে গান শিখিয়ে যা আয় করতেন, তাই দিয়ে সংসার চালাতেন। বড় ভাই হার্শেল দিনরাত পড়ে থাকতেন আকাশের গ্রহ-নক্ষত্র নিয়ে।

দূরবীন কেনার সাধ্য ছিল না হার্শেলের। তাই অনেক কষ্টে পয়সা জমিয়ে একদিন তিনি আড়াই ফুট লম্বা একটি দূরবীন ভাড়া করে আনেন। আর এই সামান্য যন্ত্র নিয়েই শুরু হয় তাঁর আকাশ-পর্যবেক্ষণের কাজ। শেষে তিনি নিজেই অনেক কলাকৌশল খাটিয়ে তৈরি করে ফেলেন বিশ ফুট লম্বা একটি দূরবীন।

হার্শেলের জীবনের একমাত্র সাধনাই ছিল জ্যোতির্বিজ্ঞানের চর্চা। এ ছিল তাঁর এক প্রচণ্ড নেশা। কোনো বাধাই তাঁকে এই নেশা থেকে নিরস্ত করতে পারেনি।

১৭৭৪ সালে তিনি নিজের মেধা আর দক্ষতা বলে প্রথমে তৈরি করেন পাঁচ ফুট লম্বা গ্রেগরিয়ান দূরবীন। নিউটোনিয়ান দূরবীন তৈরি করেন এর এক বছর পর। এই দূরবীনের সাহায্যে দূরের জিনিসকে ২২২ গুণ বড় করে দেখা যেত।

জ্ঞানসাধনা যে তাঁর কতবড় নেশা ছিল, সে কথা ভাবতে বসলেই অবাক হতে হয়। জীবিকার জন্য তাঁকে তখনও সঙ্গীতবিদ্যার চর্চা করতে হতো। তিনি ছিলেন একটা থিয়েটারে অর্কেস্ট্রা পরিচালনার দায়িত্বে। এতকিছুর পরও রাতের শো-এর সময় যখনি সময় পেতেন, তখনই বাইরে এসে তাকিয়ে থাকতেন আকাশের দিকে। তাঁর এই নিষ্ঠা সম্পর্কে বোন ক্যারোলিন তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, “ভাই যখন লেন্স পালিশ করতেন, তখন তাঁকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য খাইয়ে দিতে হতো। খাওয়ার জিনিস ছিঁড়ে ছিঁড়ে তাঁর মুখে আমি তুলে দিতাম। একবার তাঁর সাত ফুট দীর্ঘ প্রতিফলন যন্ত্র নির্মাণের সময় তিনি ষোলো ঘণ্টা হাত তোলেননি। সাধারণত খাবার সময়টাতেও তিনি কাজে নিমগ্ন থাকতেন।”

ক্রমে হার্শেলের গবেষণার প্রতি সকলের দৃষ্টি আকৃষ্ট হতে থাকে। রয়্যাল সোসাইটির সম্মেলনে পঠিত দুটো প্রবন্ধে তিনি আকাশের অদৃশ্য নক্ষত্র এবং চাঁদের পিঠের পাহাড়-পর্বত সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করেন।

হার্শেলের জীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্য ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো ইউরেনাস গ্রহ আবিষ্কার। তিনি এই গ্রহ আবিষ্কার সম্পর্কে তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, “রাতে (১৭৮১ সালের ১৩ মার্চ) ছোট ছোট নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করতে করতে এইচ. জেমিনোরাম-এর কাছাকাছি অন্যান্য নক্ষত্রের চেয়ে বড় একটি নক্ষত্র দেখতে পাচ্ছি বলে আমার মনে হলো। নক্ষত্রটির অসাধারণ আকৃতি দেখে এইচ. জেমিনোরাম এবং অরিগা ও জেমিনির মধ্যকার ছোট নক্ষত্রগুলোর সঙ্গে তুলনা করে এর আকারটা বড় দেখে আমার সন্দেহ হলো। মনে হলো একটা ধূমকেতু। এই ধূমকেতুর গতিপথ নির্ণয় করা হল, পরে দেখা গেল যে, এটা সূর্য থেকে ২৮৮ কোটি কিলোমিটার দূরে এটি আসলে আরেকটি গ্রহ, ধূমকেতু নয়।”

সারা বিশ্ব সচকিত হয়ে এই বিস্ময়কর আবিষ্কারের কথা শুনল। গ্যালিলিওর পর এত বড় আবিষ্কার আর হয়নি। এই গ্রহ আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে অখ্যাত হার্শেল সারা বিশ্বে বিখ্যাত হয়ে উঠলেন। এই আবিষ্কারের সামান্য আগেও তিনি এতটাই অখ্যাত ছিলেন যে, পত্রিকায় তাঁর নামটা পর্যন্ত শুদ্ধ করে ছাপা হলো না। যেমন, এই বিখ্যাত আবিষ্কারের খবর ছাপতে গিয়ে এক পত্রিকায় তাঁর নাম লেখা হয় হারথেল, অন্যটিতে হারথেল, আরেকটাতে হার্মস্ট্যাল।

হার্শেল প্রথমে তাঁর আবিষ্কৃত গ্রহের নামকরণ করেন ব্রিটিশ রাজা তৃতীয় জর্জের নামানুসারে—জর্জিয়াম সাইডাস। পরে এই নাম পালটে তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানের দেবতা ইউরেনিয়ার নামানুসারে রাখেন ইউরেনাস। কয়েক বছর পর হার্শেল তাঁর নবাবিষ্কৃত গ্রহ ইউরেনাসের দুটো উপগ্রহও আবিষ্কার করেন। এ দুটো উপগ্রহের নাম হল—টাইটানিয়া এবং ওবেরন। পরে ইউরেনাসের আরও তিনটি উপগ্রহ আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলো হলো অ্যারিয়েল, আমব্রিয়েল এবং মিরান্ডা।

হার্শেলের আবিষ্কৃত ইউরেনাস গ্রহটির আকৃতি পৃথিবীর প্রায় চার গুণ। সূর্য থেকে এর দূরত্ব ২৮৫ কোটি ৪৪ লক্ষ কিলোমিটার। এই আবিষ্কারের পর পরই তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে এবং তাঁর অর্থকষ্টও কিছুটা দূর হয়। রাজা তৃতীয় জর্জ তাঁকে রাজজ্যোতিষী হিসেবে নিয়োগ করেন মোটা মাইনে দিয়ে। এবার তিনি থিয়েটারের চাকরি ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি জ্যোতির্বিদ্যাচর্চায় আত্মনিয়োগ করেন।

১৭৮৩ সালের ৮ মে তিনি জন পিটের বিধবা পত্নীকে বিয়ে করেন।

হার্শেলের আরেকটি বড় কৃতিত্ব হলো, শনিগ্রহের মাইমাস, জ্যাপিটাস ও এনসিল্যাডাস নামে তিনটি উপগ্রহের আবিষ্কার। এ ছাড়া সৌরকলঙ্ক এবং সূর্যের বায়বীয় পৃষ্ঠদেশ সম্পর্কেও তিনি গবেষণা করেছিলেন।

ছিয়াত্তর বছর পর্যন্ত জ্যোতির্বিজ্ঞানী হার্শেল তাঁর গবেষণাকাজে সক্রিয় ছিলেন। এর পরপরই তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙে পড়তে শুরু করে। এই সময় তিনি এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন যে, প্রায় দাঁড়িয়ে থাকাই অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

১৮২২ সালে হার্শেল পরলোকগমন করেন। তিনি শেষজীবনে তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, “এই দূরবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে আমি মহাশূন্যে অনেক কিছু দেখেছি, যা কোনো মানুষ আগে কোনোদিন দেখেনি। এর সাহায্যে এমন নক্ষত্রের আবিষ্কারও আমি করেছি, যার আলো পৃথিবীতে এসে পৌঁছুতে সময় লাগবে কুড়ি লাখ বছর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *