ঈশ্বরের ভূমিকায় – সমরেশ মজুমদার
তিস্তা ব্রিজ পেরিয়ে জিপটা ছুটছিল ময়নাগুড়ির দিকে। না ঠিক ময়নাগুড়ি নয়, তার আগেই রাস্তাটা ডানদিকে ঝুঁকে গেছে আচমকা। হাওয়া ঝাপট মারছে মুখচোখে, চাকার তলায় ঢালু পিচের রাস্তা পিছলে পিছলে যাচ্ছে। বুড়ো ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল। স্টিয়ারিং দু হাতের থাবায় চেপে বাবু বসে আছেন। চুল উড়ছে বাতাসে। ঘাড়ের পেশি শক্ত। তবু কবজি দুটো একটু একটু কাঁপছে। মাথা দোলাল বুড়ো, তারপর শক্ত হাতে ওপরের শিকটাকে ধরল। ওর একটা পা জিপের বাইরে বের করা। যে কোনও মুহূর্তেই ও লাফিয়ে পড়তে পায়ে—কিছু বিশ্বাস নেই, যে-কোনও মুহূর্তেই লাফানো দরকার হতে পারে।
দোমহনীর মোড়টা আসতেই জিপটা প্রচণ্ড শব্দ করে প্রায় কাত হতে হতে আবার সোজা হয়ে ছুটতে লাগল। আই বাপ্। চট করে লাফাতে গিয়েও সামলে নিল বুড়ো। ঘসঘসে গলায় বলল, ‘একটু ধীরে চললে হয় না বাবু।’
বাবুর কোনও সাড়া নেই। সাড়া যে পাবে না তা জানে বুড়ো। এই জিপটা একদিন যাবে—নির্ঘাত যাবে। অন্তত তিন তিনবার বেঁচে গেছে এই দুই মাসে। ওলটাতে ওলটাতে ওলটায়নি। রাস্তা ছাড়িয়ে পাশের ধানের খেত বা চা-বাগানের মধ্যে গিয়ে গোঁ গোঁ করেছে। তারপর থেকে জিপের পেছনের দিকে বসে থাকে বুড়ো। বসে ফেলে আসা রাস্তার দিকে চোখ কুঁচকে তাকিয়ে থাকে একটা পা ঝুলিয়ে। আর বাবু উড়ে চলেন স্টিয়ারিং আঁকড়ে। অথচ ড্রাইভারের সিটে বসে থাকার কথা বুড়োর। তিনশো টাকা মাইনে আর খাওয়া-পরার চুক্তি হয়েছিল তো এই জন্যেই। এর আগে জিপটা ছিল শিলিগুড়ির হরিপদ সাহার কাছে। বুড়োও ছিল, তা প্রায় বছর দুয়েক হবে। এই বাবু যখন দু মাস আগে নগদ টাকা ফেলে জিপটা কিনে নিলেন, তখন বুড়োকেও নিয়ে নিলেন। পুরনো ড্রাইভার, এ গাড়ির অন্ধিসন্ধি জানে, তা ছাড়া হরিপদ সাহা সার্টিফিকেট দিয়েছিল একদম মেসিনের মতো হাত। চোখ বন্ধ করে চালাতে পারে। বাবুর বয়স কাঁচা, মুখে এখনও নরম ছাপ, ব্যবসায় নেমে অঢেল টাকা আসছে হাতে। কেমন মায়া লেগেছিল বুড়োর। চলে এসেছিল সটান। শিলিগুড়ি থেকে এই গয়েরকাটায়।
কিন্তু দুদিন যেতে না যেতেই বাবু ওকে চালান করে দিলেন পেছনে, ‘আমি যখন গাড়িতে থাকব, তখন খবরদার স্টিয়ারিং-এ হাত দেবে না, বুঝলে হে, অবশ্যি আউট হয়ে গেলে অন্যকথা।’ তাই সারাদিন পেছনে বসে থাকে বুড়ো আর ঝিমোয়। আর একদম রাত এগারোটার পর সেই অন্য কথার সময় মদো মানুষ শ্ৰীনিবাসের চায়ের দোকান থেকে বাবুকে গাড়িতে তুলে স্টিয়ারিং হাতে পায় বুড়ো। মাঝে মাঝে ভাবে বুড়ো, তবে তাকে রেখেছে কেন বাবু, মতলবখানা কি!
তবু আজকে যেন ছুটছে বড্ড বেশি। আশি হবে তো বটেই। ব্যাপারখানা কি! জলপাইগুড়ি শহরে সারাদিন ছোটাছুটি করেছেন বাবু। তারপর এই চারটে বেজে গেলে পি ডবলু ডি অফিসের সামনে যখন জিপে চড়লেন, তখন মুখখানা গম্ভীর। অথচ আসবার সময় তো বেশ ফুর্তিতেই এসেছিলেন। ফুর্তি মানে বাড়ি থেকে বেরুবার সময় বাবুর বউ কি বলতেই বাবু হো হো করে হেসেছিলেন। ব্যবসার কাজে জলপাইগুড়ি যান বাবু, আজও তো তাই গিয়েছিলেন, কিন্তু হলটা কি! জিপটা বড্ড কাঁপছে। হুস হুস করে উলটোদিকের গাড়িগুলো বেরিয়ে যাচ্ছে। ভাগ্যিস রাস্তাটা চওড়া। বাবুর বউটা কিন্তু ভারী ভাল। বুড়ো যখন বারান্দায় পিঁড়ি পেতে খেতে বসে বাবুর বউ তখন সামনে এসে দাঁড়ায়। তারপর খাওয়া-টাওয়া হয়ে গেলে ও যখন উঠে দাঁড়ায় তখন বাবুর বউ ফিসফিস করে বলে, ‘ওর হাতে স্টিয়ারিং ছেড়ো না বুড়ো আমার বড় ভয় করে।’ মাথা দোলায় বুড়ো। বাবুর যে বড় কড়া মুখ। সেই সাতটা বাজতেই বাবু জিপে বসে দুবার হর্ন বাজান। প্যান্টের দড়ি বাঁধতে বাঁধতে ছুটে আসে বুড়ো। ড্রাইভারের সিটে বসে আছেন উনি, মুখে সিগারেট। ‘আমি—’ স্টিয়ারিং-এর দিকে তাকায় বুড়ো। সঙ্গে সঙ্গে আঙুল দিয়ে পেছনটা দেখিয়ে দেন বাবু। দিয়ে ইঞ্জিন চালু করেন। কোনওরকমে পেছনে উঠে বসে ও। বসেই চোখ পড়ে, জানলা দিয়ে বাবুর বউ ওর দিকে তাকিয়ে আছেন। লজ্জায় ঘেন্নায় নাকি ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে বুড়ো। সেই সক্কালে শুরু হয় ব্যাপারটা। প্রথমে মোড়ের শ্রীনিবাসের চায়ের দোকানের সামনে গাড়ি থামে। বাবু তড়াক করে নেমে ভেতরে ঢুকে যান। তখনও ভাল করে খোলেনি দোকান। রুটের বাসগুলোর প্যাসেঞ্জার নিয়ে আসবার সময় হয়নি। বাবুর সঙ্গে ওই মদোমানুষটার একটা বোঝাপড়া আছে। কেবিনের পর্দা ফেলে দুটো বিয়ারের বোতল আর একপ্লেট ছোলা দিয়ে যায় নিজের হাতে। দু নম্বর ব্যবসা এটা। চোখ বন্ধ করে হাঁটু বাজায় বুড়ো গাড়িতে বসে। কিংবা ন্যাকড়া দিয়ে গাড়ির বনেট ঘষে—মুখ দেখা যেত হে এককালে।
বাবুর কোনও ছেলেমেয়ে নেই। চার-পাঁচ বছর তো বিয়ে হল—বাবুর বন্ধুরাই গাড়িতে বসে বলে। বউটা না কি বাঁজা—বাবুর বন্ধুরা বলে শহরে গিয়ে পরীক্ষা করাতে। বাবু হাসেন, বলেন, ‘মাথা খারাপ, শেষে দেখব আমারই এলেম নেই।’ বড় কষ্ট হয় মেয়েটার জন্য। মা মা যাকে দেখতে লাগে সে মা হবে না কেন?
হঠাৎ সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল বুড়োর। পাশ দিয়ে ছুটে যাওয়া একটা ভারী লরির বাতাস যেন পাক খাচ্ছে সর্বাঙ্গে। চাপা গলায় ও বলে ফেলল, ‘বাবু!’
আর সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড শব্দ করে জিপটা থেমে গেল আচমকা। বাবু ব্রেক কষেছেন। থর থর করে কাঁপছে গাড়ি। স্টিয়ারিং থেকে হাত নামিয়ে বাবু বললেন, ‘তোমার বয়স কত হল বুড়ো?’ বুকের ভিতরটা এখনও তির তির করছে। বুড়ো চোখ খুলে দেখল প্রায় জলঢাকা ব্রিজের কাছে এসে গেছে ওরা। ম্যাড়মেড়ে বিকেলের আলো দুপাশের ধানগাছগুলোয় নেতিয়ে আছে। বুড়ো বলল, ‘আর এট্টু হলেই—’।
‘কত বয়স হল?’ বাবুর গলা তেমনি গম্ভীর।
‘আজ্ঞে ষাট।’ কিছু বুঝতে পারছিল না বুড়ো।
ঝুঁকে পড়লেন বাবু। নীচ থেকে একটা চ্যাপ্টা বোতল বের করে গলায় ঢাললেন তারপর বাঁ হাতে সেটাকে বুড়োর দিকে এগিয়ে ধরলেন, ‘একটু মদ্যপান করো।’
আঁতকে উঠল বুড়ো, ‘ছি, ছি, ছি।’
‘ছেনালি রাখো। শিলিগুড়ির ড্রাইভার মাল খায় না আমার চোদ্দো পুরুষ বিশ্বাস করবে না। তোমার শালা একদম নার্ভ নেই, একটু পান করো।’ কড়া গলায় বললেন বাবু।
‘সত্যি বলছি আমি খাই না!’ বুড়োর চোখে জল এসে যাচ্ছিল।
‘কেন খাও না?’ আর এক ঢোঁক খেলেন বাবু।
কি ভাবল বুড়ো। পানসে চোখে লালচে আকাশ দেখল। তারপর বলল, ‘আমার বউ দিব্যি করিয়েছিল, গাড়ি চালালে ওসব খাবে না।’
‘তোমার বউ-এর ছেলেমেয়ে কটি?’
‘এজ্ঞে দশজন।’ বুড়ো ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাল।
‘তা তুমি তো এখন গাড়ি চালাচ্ছ না, নাও গেলো। আমি দিচ্ছি, তোমার বউ কিছু রাগ করবে না। দশ দশটা বাচ্চা—সাবাস জোয়ান।’ হেসে উঠলেন বাবু।
‘আর কটা দিন আছি, প্রতিজ্ঞা ভাঙতে বলবেন না বাবু।’ হাত জোড় করল বুড়ো।
বুঝি জেদ চেপে গেছে বাবু, ‘আঃ, আমি তোমার বউকে বলব তোমার কোনও দোষ নেই, আমি বলেছি, হুকুম করেছি—।’
‘সে তো নেই।’ বুড়ো দেখল দ্রুত সন্ধে হয়ে আসছে।
‘কোথায় গেল? মরে গেছে নাকি!’ বাবুর গলায় বিস্ময়। মাথা দোলাল বুড়ো।
‘যাঃ শালা।’ ঘুরে বসে আবার ইঞ্জিন চালু করলেন বাবু। ঝাঁকুনি দিয়ে আবার চলতে লাগল গাড়ি। বিশ-ত্রিশ-আশি। বুড়ো ঘুরে বসতে বসতে দেখল আধ বোতল মদ ওর পাশের সিটের ওপর টলতে টলতে শুয়ে পড়ল। চট করে আঁকড়ে ধরল ও তারপর আড়চোখে সামনের দিকে চেয়ে পায়ের কাছে ফেলে রাখা এক্সট্রা চাকার খাঁজে গুঁজে দিল সেটাকে। বাইরে এখন প্রায় অন্ধকার হয়ে এসেছে। হেটলাইট জ্বেলে দিয়েছে বাবু। ধূপগুড়ি পেরিয়ে গেল। দশ দশটা বাচ্চা জন্ম দিতে দিতে সে চলে গেল। ছেলেগুলো এখন কোথায় ঠিকঠাক জানে না সে। ছোটটার বয়স এই বাবুর মতোই হবে। মাল খায় কিনা কে জানে। রোগা রোগা আঙুলে মুখ চেপে ধরল বুড়ো। অনেক ভাঁজ পড়ে গেছে। হাতের চেটোয় দাগ যত ঘষে যাচ্ছে মুখের ভাঁজ যেন তত বেশি টেকে।
বাঁ দিকে চা বাগান ডানদিকে কুলি বস্তি। গয়েরকাঁটা এসে যাচ্ছে। আর কয় মাইল, তারপর রাতটা নিশ্চিন্ত। বুড়ো মনে মনে পথটা ফুরিয়ে দিচ্ছিল। এখন রাস্তায় গাড়ি ঘোড়া কম। হাত সোজা রাখো বাবু। মনে মনে বলল বুড়ো। একটা গুনগুনানি শুনতে পেল ও। চকিতে ঘাড় ঘুরিয়ে সামনে তাকাতেই দেখল বাবুর মাথাটা টলছে। আর গান গাইছেন গুনগুন করে। এই প্রথম বাবুকে গান গাইতে শুনল ও। কিন্তু মাথাটা টলছে কেন? সামনের হেটলাইটে অন্ধকার ছিঁড়ে ফালা ফালা হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ চমকে উঠল বুড়ো। ঠিক মধ্যিখানে রাস্তা জুড়ে একটা মোষের গাড়ি যাচ্ছে। চিৎকার করে উঠল ও, ‘বাবু।’ সঙ্গে সঙ্গে মাথা সোজা করে বাবু সামনের দিকে তাকাতে তাকাতে স্টিয়ারিং ঘোরাল। আর জিপটা যেন লাফ দিয়ে আকাশে পড়ে রাস্তায় বাঁ দিকে নেমে গেল। নেমে প্রচণ্ড গতিতে ছুটে ঘাসের জমি পেরিয়ে অন্ধকারে কি সব কুঁড়ে বেরিয়ে একটা গর্তে কাত হয়ে পড়ল।
চারপাশে হই হই শব্দ, লাফিয়ে মাটিতে পড়া বুড়ো উঠে দাঁড়াতেই মনে হল ওর সর্বাঙ্গে একটা যন্ত্রণা তুবড়ির মতো ছড়িয়ে পড়ছে। পেছন দিকে তাকাল ও। একটা খড়ের ঘরের মধ্যে দিয়ে গাড়িটা কুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে। হা ভগবান। ঘরে কি লোক ছিল? চিৎকার করে লোকগুলো আলো হাতে ছুটে যাচ্ছে ঘরটার দিকে। প্রায় টেনে টেনে শরীরটাকে কাত হয়ে থাকা গাড়ির কাছে নিয়ে এল ও। গোঙানি আসছে সামনে থেকে। চাপা গলায় ডাকল বুড়ো, ‘বাবু!’
গোঙানিটা থামল একটু। বাবু! আবার ডাকল বুড়ো। তারপর দেখতে পেল ড্রাইভারের সিট থেকে অর্ধেক শরীরটা বেরিয়ে বাইরে ঝুলছে। গোঙাতে গোঙাতে বাবু বলল, ‘ব্যথা, বড় ব্যথা, জল, একটু জল—।’
জল কোথায় পাবে এখন। বুড়ো হঠাৎ দেখল কেমন চনমনে জ্যোৎস্না উঠেছে হঠাৎ। চারপাশ পরিষ্কার হচ্ছে হঠাৎ। জল নেই কোথাও। ওপাশে ভেঙে পড়া ঘরটায় কান্না উঠছে এবার। কেমন করে কি হয়ে গেল, ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে বুড়ো গাড়ির পেছনে চলে এল। চাকাটা ঠিক আছে—আশ্চর্য বোতলটাও ভাঙেনি। বোতলটা খুলতে খুলতে বাবুর কাছে চলে এল ও। গায়ে হাত দিতেই চটচটে রক্তে হাত মাখামাখি হয়ে গেল বুড়োর। বাবুর মুখ বুকের কাছে তুলে ধরল ও। উত্তেজিত মানুষজনের গলা শুনতে পাচ্ছে সে—এদিকেই আসছে ওরা।
তাড়াতাড়ি, কী ভীষণ মায়ায় বোতলের মুখটা বাবুর মুখে গুঁজে দিল বুড়ো। প্রায় নেতিয়ে পড়া বাবুর মুখটা বাঁ হাতে বুকের কাছে নিয়ে বোতলটা ধরতে ধরতে ওর হঠাৎ মনে পড়ে গেল নিজের দশটা বাচ্চাকে বাঁচাতে এমন করে কোনওদিন তাদের মুখে দুধের বোতল ধরেনি সে।
২৫ জানুয়ারি ১৯৭৬