1 of 2

ঈশ্বরের বাগান – ৯

।। নয়।।

চার্চের ঠিক সামনে সেই পাগল। গায়ে কিম্ভুতকিমাকার পোশাক। ছেঁড়া তালিমারা উচ্ছিষ্ট জামা পাতলুনে ঢাকা শরীর। নোংরা। গালে দাড়ি। চোখ কোটরাগত। বগলে বোঁচকা। হাতে দম মাধা দমের লাঠি। ন্যাকড়া জড়ানো পালক বাঁধা। একটা লম্বা দাঁত ঠোঁটের ফাঁকে বের হয়ে ঝুলছে। সে বিকেল থেকেই উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। আর কেবল হাঁকছে দম মাধা দম পাগলা মাধা দম।

এখন চার্চের সামনে দাঁড়িয়ে সে মাথায় তেনাকানি বাঁধছে। মাথার ওপরে কাক উড়তে দেখে ভয় পেয়ে গেছে। কারণ এরা বড়ই তাকে ঠোকরায়। তার এখন শত্রুপক্ষ বলতে শহরে এরাই। আর সব মেরে এনেছে। কুকুর বেড়াল সে ঠেঙিয়ে সব তাড়িয়েছে। হাতের লাঠিটা জাদুমন্ত্রের মতো। সে ডাস্টবিনের পাশে ঘোরা ফেরা করলে ভয়ে আর কেউ ত্রিসীমানা মাড়ায় না। কিন্তু কাকেদের বেলায় তার জারিজুরি খাটে না। এরা কোত্থেকে এসে সব ছোঁ মেরে তুলে নেয়। এসব কারণে তার মাথা গরম। তার একটু সতর্ক থাকা দরকার। এবং এখন একমাত্র কাজ দামী মস্তিষ্ককে রক্ষা করা। এর মধ্যেই ঘিলু পোরা আছে। কাকেরা মগজের ঘিলু খেতে খুব ভালভাসে। প্রথমে তেনাকানি, পরে গামছা তারপর বোঁচকা কুঁচকির যত সংগ্রহ করা ন্যাকড়া সব মাথায় পেঁচিয়ে ওটাকে ঢাউস কুমড়ো পটাস বানিয়ে ফেলল।—খা শালারা, কত খাবি খা। কত ঠোকরাবি ঠোকরা। ও বাপ এই বহ্মতালু ভেদ করা আর তোগো কম্ম নয় বাপ। মাথাটা ভারি নিরাপদ ভেবে সঙ্গে সঙ্গে দুটো ডিগবাজি।

একটা ডিগবাজি খেতেই স্বাদ পেয়ে গেল। চোখ ঘুরে যায় উল্টে যায়, মাথা ঘুরে যায়, বড়ই নেশার মতো লাগে। সে পর পর ডিগবাজি খায়। কাঠের দেয়াল পার হয়ে ডিগবাজি খায়, ট্রাম লাইন ফাঁকা পেয়ে সে সম্রাট সিজার হয়ে যায়। সবই তার দখলে। সে সেখানেও ডিগবাজি খায়। তারপরই অগুনতি বাসের ভিড় জটলা। কারা তেড়ে আসে, সে দৌড়ে যায়। যেন বলে, আমার কোনও ভোগ দখলের স্পৃহা নেই বাপু, সব তোদের দান করে দিলাম। যা এবার লুটে পুটে খা।

তারপর সে আর যানবাহনের জন্য মানুষের জন্য প্রতীক্ষা করছিল না। এখন এক পাগলিনীর জন্য তার প্রতীক্ষা। তার আসার কথা। সে তার জুড়িদার এই শহরে। সকাল থেকেই দেখছে না। সে কাছে থাকলে সাহস পায়। তার মনোযোগ বাড়ে। আকর্ষণ বাড়ে। মারামারি করতে পারে। মনুষ্যকুলে এই একজনই তার বলতে গেলে সম্বল—যার সঙ্গে মিনি মাগনায় শুতে পায়। কখনও খেতে পায়।

বর্ষাকাল, অথচ কদিন বৃষ্টি নেই। খাঁ খাঁ শুকনো আকাশ। প্রখর উত্তাপ। প্রখর উত্তাপে তার সঙ্গিনী গায়ে জামা কাপড় রাখতে পারে না। নগ্ন থাকে।

কতবার সে কোমরে গামছা বেঁধে দিয়ে বলেছে—ঢেকে ঢুকে রাখ, কাকের উপদ্রব বেড়েছে। ওটা ঠুকরে তুলে খেলে মজা বুঝবি। কেউ আর তোর দিকে তাকাবে না।

যাতায়াতের পক্ষে বড়ই বিঘ্ন এই পাগল। ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলা পর্যন্ত দায়। কে একজন হেঁকে উঠল, এই উজবুক, ওঠ রাস্তা থেকে। গাড়ি চাপা পড়বি তো। রাজার বাড়ি থেকে গাড়ি বের হচ্ছে। কোটিপতি মানুষের বৌ যাচ্ছে গাড়িতে। সেই গাড়িটা পর্যন্ত ছোঁয়াচে অস্পৃশ্য হয়ে যাবে ভেবে পাগলকে মাঝ রাস্তায় কাটিয়ে চলে যায়। তখন সে দিগ্বিজয়ী বীরের মতো হাসে হা হা হা। জয় জয় হে। জয় দাও প্রভু, কৃপানাথের। জয়রাজা হরিশ্চন্দ্রের। সে কোঁচড় থেকে এক এক করে বাতাসে উড়িয়ে দেয় পাখির পালক। এক মরা কাকের ছানাও সে উড়িয়ে দেয় হাওয়ায়। ওটার গন্ধেই কাকগুলি তার পিছু তাড়া করছিল। সে এতক্ষণে এটা টের পেয়ে ভাঙা ঠেলাগাড়ির নিচে শুয়ে সব দেখছে আর মুচকি হাসছে। তারপর কি ভেবে উঠে এক দৌড়। পাগলিনী সেই ছানাটা হাতে দুলিয়ে যেন বাজার করে ফিরছে মতো বাতিল ঠেলাগাড়ির আস্তানায় গিয়ে ঢুকে পড়ল।

কাকগুলি এখন আর সেই পাগলের মাথায় নেই। পাগলা হরিশ নিশ্চিন্তে হেঁটে গিয়ে দেবদারু গাছটার নিচে বসল। পোড়া বিড়ি বের করল ঝোলাঝুলি থেকে। কাকের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে তার রাজ্য জয়ে বের হবার ইচ্ছা। বের হবার আগে দম নিচ্ছে বসে বসে।

ততক্ষণে পাগলিনী মতিবিবির পালক ছাড়ানো শেষ। আগুন জ্বালল নিচে। খড়কুটোতে বাচ্চাটাকে পুড়িয়ে নিল। তারপর গোগ্রাসে গিলে ফেলল কাকের রোস্ট। বড়ই সুস্বাদু খাবার। জনগণেরা তখন রাস্তায় ভিড় করছে। ট্রাম বাস জ্যামে পড়ে গেছে। দোকানদার, দালাল, ফেরিয়ালা, নাট্যকার, কবি সাংবাদিক অঞ্চলের যে যেখানে ছিল ছুটে এসে দেখল, কাকেরা চলে যাচ্ছে। ধোঁয়া মাংস পোড়া গন্ধ কমে আসতেই কাকেরা সব চলে যেতে থাকল। সামান্য ধোঁয়া উঠছিল ত্রিপলের ফাঁক ফোকরে। হোসপাইপে জল মারতেই এক মূর্তিমতী কলকাতা কল্লোলিনী। সবাইকে দাঁড়িয়ে দাঁত ভ্যাংচাচ্ছে। আসলে এটা কাকতালীয় ব্যাপার ভাবল শহরের লোকেরা। কেউ কেউ বলল, কাকেরা যুদ্ধ করলে দেশে প্লাবন দেখা দেয়। জ্যোতিষিরা বললেন, শনি ও রাহু সিংহে রয়েছে। আগামী দশই জুলাইর মধ্যে একের পর এক গ্রহ গিয়ে সিংহে সন্নিবিষ্ট হচ্ছে। রবি চার জুলাই, শুক্র সাত জুলাই, বৃহস্পতি নয় জুলাই এবং বুধ দশই জুলাই সিংহে মিলিত হচ্ছে শনি ও রাহুর সঙ্গে। এতগুলি গ্রহ সন্নিবেশের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বিবাদ বিসম্বাদ স্বাভাবিক। এই বিবাদ বিসম্বাদের ফলে আর কিছু না হোক কাকেদের আক্রমণ অবশ্যম্ভাবী। এর ফলে বৃহৎ রাষ্ট্রের মধ্যে মনোমালিন্য দেখা দিতে পারে। মধ্য এশিয়ায় ও আফ্রিকায় রক্তপাত ঘটতে পারে। রাজনৈতিক উত্থান পতনেরও সম্ভাবনা আছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াসহ ভারতের কোন কোন অংশে ভূমিকম্প, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহাপ্লাবনেরও আশঙ্কা আছে।

পাগলের এতসব জানার কথা নয়। তার কাজ শুধু সঞ্চয় করে যাওয়া। সে রাস্তায় কিছুই ফেলার জিনিস ভাবে না। যা পায় সঙ্গে নিয়ে নেয়। ভাঙা খুরি হাঁড়ি পাতিল দেশলাইর বাক্স প্লাস্টিকের ছেঁড়া ব্যাগ সবই তার বড় দরকারি। সে তার সঞ্চয় কোথাও ফেলে যায় না। দিনকে দিন সঞ্চয় বাড়তে বাড়তে ওটা ভারি একটা বস্তা হয়ে গেছে। মাথায় তুলতে কষ্ট হয়। সেজন্য সে মাথা থেকে নামাতে ভয় পায়। মাথায়ই থাকে। এবং ঘাড় শক্ত হয়ে যায়। শিরাগুলি শক্ত হয়ে যায়। তবু সে মাথা থেকে নামাতে সাহস পায় না। কে আবার তুলে দিতে এসে ছিনতাই করে নেবে তার চেয়ে এই ভাল বাবা, মাথার জিনিস মাথায় থাক। কিছুই ফেলা যায় না। সেজন্য সে নারকেলের মালা এবং সিগারেটের বাকস দিয়ে মালা গেথে গলায় পরেছিল। পিঠে পুরাতন জামার নিচে পচা ঘামের গন্ধ। রাস্তায় জ্যাম দেখে, ভিড় দেখে মানুষের পাগলামি দেখে হাসছিল। পাগল হেসে হেসে সবাইকে বলছিল, দু-ঘরের মাঝে অথৈ সমুদ্দুর। সে অন্য কোনও সংলাপ খুঁজে পাচ্ছিল না। সে এই একটা কথাই এখন পর্যন্ত মনে রাখতে পেরেছে।

কিন্তু তার বোঁচকার কথা মনে পড়ে গেল। দম মাধা দমের লাঠিটার কথা মনে পড়ে গেল। মানুষের ভিড় দেখে মনে হয়েছিল এরা তার এতদিনের সঞ্চিত সব তৈজসপত্র ছিনতাই করে নেবে। সে বোঁচকা এবং দম মাধা দমের লাঠি ফেলে দেবদারু গাছটার নিচে ছুটে এসেছিল। তার সেই বস্তাটা মাথায় নেই। দাঁড়াতেই মনে পড়ল, ওগুলো সে কোথায় যেন রেখে এল। এত সম্পত্তি ফেলে রাখা ঠিক না। এতে বিপত্তি বাড়ে। কোনটা ফেলে সে কোনটা রক্ষা করবে বুঝতে পারছে না। বস্তাটা মাথা থেকে নামালেই এটা তার সম্পত্তি থাকবে না এমন কখনও মনে হয়। মনে হয় সব সাধারণের সম্পত্তি হয়ে যাবে। এত কষ্ট করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কি দরকার ছিল তবে সম্পত্তি বাড়াবার। একটু উদার হওয়া যায় না! এই দিয়ে থুয়ে সে হাল্কা হতে পারে। ভাবতেই এক দণ্ড আর সে দেরি করতে পারল না। সে লাঠিটা খুঁজতে ছুটে গেল। ওটাতে সে কাকের পালক বেঁধে রেখেছে। বড়ই মূল্যবান বস্তু। হারালে সে বংশে নির্বংশ হবে।

মানুষের বংশে নির্বংশ হওয়া ভাল কথা না। লাঠিটা না থাকলে সে নির্বংশ হতে পারে ভেবে খুবই বিচলিত বোধ করল। যেন বড়ই আতান্তরে পড়ে গেছে। তখন বাস যায় ট্রাম যায়, মানুষের মিছিল যায়। আর দেখে আঁস্তাকুড়টা ক্রমেই বড় হয়ে যাচ্ছে। যেন জাদুমন্ত্র বলে আঁস্তাকুড়টা এই শহরের যত সুখি পায়রা আছে সব পুড়িয়ে খাবে। সে সেটা কিছুতেই হতে দেবে না। লাঠিটা বগলে থাকলে কাকের পালক বাঁধা থাকলে কোন দুষ্ট প্রভাব কাছে ঘেঁষতে পারবে না। সেটা কাঁধে নিয়ে বেড়ালে মানুষের মঙ্গল হবে। এই মানুষের মঙ্গল হবে ভেবেই সে লাঠিটার খোঁজ করছে এত করে। দেখলে মনে হবে তন্ন তন্ন করে খুঁজছে সারাটা রাস্তা। সেই বুড়োটা চুরি করে নেয়নি তো আবার। লোকটাকে সে কিছুদিন থেকেই খুব সন্দেহ করছে। কোত্থেকে এসে তার জায়গাটা দখল করে বসে গেল। সঙ্গে পুরুষ্ট মাইয়া আছে একখান। নাম কয় চারু।

কিছুদিন থেকে হরিশ এই লোকটাকে সন্দ করছে। সঙ্গের ডবকা ছুঁড়িটা উদোম গায়ে পড়ে থাকে। গা আল্লা করে রাখে। এরাই দমমাধাদমের লাঠিটা গায়েব করতে পারে। লাঠিটার জাদুটোনা টের পেয়ে গেছে বুড়োটা। তন্ন তন্ন করে খুঁজেও যখন পেল না তখনই বুড়োটার সামনে এসে ঊর্ধ্ববাহু হয়ে গেল। এটা তার একটা প্রশ্নের তরিকা। ঊর্ধ্ববাহু হলেই বুঝতে হবে সে কিছু ফেরত চায়।

বুড়োটা বলল, আমার কাছে কিছু নেই।

হরিশ কোমর দোলাল। অর্থাৎ আছে।

বুড়োটা বলল, নেই, কিছু নেই।

হরিশ আরো জোরে ডাইনে বাঁয়ে কোমর দোলাল। অর্থাৎ আছে, আছে। দাও। না দিলে অমঙ্গল হবে। মনুষ্য জাতি বিলোপ পাবে। ওটা বড়ই প্রয়োজনীয় দ্রব্যবস্তু।

তখন বুড়োটা বিরক্তিতে অতিকায় বৃদ্ধ হয়ে যেতে থাকল। গায়ে কি পচা দুর্গন্ধ।—সরে দাঁড়া। বলে একটা ঠ্যাঙা নিয়ে তেড়ে গেল।

হরিশ ঊর্ধ্ববাহু হয়েই দাঁড়িয়ে থাকল। নড়ল না।

.

ফুলি বলল, কি সুন্দর দিন। আমার এই ঘাসে এখন ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে। ফুলি রাজবাড়ি থেকে বের হয়ে এখানে একটু প্রেম করতে চলে এসেছে।

সত্যি সুন্দর দিন। বর্ষাকাল, অথচ কি নির্মল আকাশ। ঠিক শরতের আকশের মতো। ফুলি মাঠের ঘাস মাড়িয়ে যাচ্ছিল। পাশে তার সুন্দর যুবক সুনন্দ। সে তার হাত ধরে হাঁটছে। এ-সময়ে পৃথিবীটা মানুষের কাছে কত পবিত্র হয়ে যায়। ওদের হাঁটা চলা কথাবার্তা থেকেই ধরা যাচ্ছিল, এরা এখন পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। ওরা ঘাসের ওপর বসে পড়ল। তারপর দু’জন দুজনের মুখ দেখল।

ফুলি সারাটা বিকেল শুধু আজ আয়নায় মুখ দেখেছে। বাথরুমে সুগন্ধ সাবানে চান করেছে। মা বলেছে, অত সময় ধরে চান করছিস কেন ফুলি। ফুলি মুখে জল নিয়ে ফুং করে উড়িয়ে দিয়ে বলেছে, ঠাণ্ডা জলে চানে কি আরাম। আহা সেই মানুষ আজ আবার তার জন্য কোনও গাছের নিচে অপেক্ষা করবে বলেছে। কতদিন থেকে সে এমন আশা করতে করতে বড় হচ্ছিল। তার থাকবে একজন সুন্দর প্রেমিক। যে সহজেই বলবে ফুলি তুমি কি সুন্দর। চল না কোন জ্যোৎস্না রাতে আমরা কোন গভীর অরণ্যে চলে যাই।

ফুলি তারপর কার কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছিল, সেই লতাপাতা আঁকা সিল্কের শাড়িটা। তার এক মাথা চুল। চুলে শ্যাম্পু দিয়েছে। ওর ফাঁকা চুল ঘন নীল রঙের হয়ে যায় তখন। প্রতিটি লোমকূপ থেকে চুলের গভীর সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। সে এটা টের পেলেই লা লা করে গান গায়। তার অহংকার বলতে এই ঘন নীল রঙের চুল’। ছেড়ে দিলে একেবারে হাঁটু অব্দি নেমে যায়। সুনন্দ ফুলির সারা মাথা ভরা চুল দেখতে দেখতে সবুজ বাবুইর বাসাটার দিকে হাত দিতে গিয়ে কেমন চঞ্চল হয়ে উঠল।

ফুলি বলল, এই কি হচ্ছে!

—একটু দেখি না।

—না এখন না।

সুনন্দ বলল, একদিন দ্যাখো ঠিক আমি মরে যাব। আমি তোমার কিছুই পাব না।

সুনন্দর এই বোকা বোকা কথা ফুলির বুকে কেমন আগুন ধরিয়ে দেয়। সে বলে, দাদা তোমাকে আমাদের বাসায় আসতে বারণ করেছে?

—কৈ না তো!

—তবে তুমি যে সেদিন এলে না?

—সেদিন মানে?

—সব ভুলে যাও কেন। তুমি বললে না, রোববার বিকেলে যাব।

—ও সেই কথা। যাব ভাবলাম, কিন্তু পরে মনে হলো গিয়ে কি হবে। সবাই বাড়ি থাকলে গিয়ে কি লাভ।

—ঐ একটাই বোঝ। আর কিছু বোঝ না। আর আসছি না দ্যাখো।

সুনন্দ পায়ের শাড়ি সামান্য তুলে দেখল ফুলির। কি সাদা আর মাখনের মতো নরম ঊরু। ফুলি শাড়িটা নামিয়ে দিল জোর করে। তুমি কি! মানুষ জন আছে না।

—অতদূর থেকে কেউ বুঝতে পারবে না।

—ঐ দেখ, একটা ঘোড়সওয়ার পুলিশ।

সুনন্দ দেখল, দূরেই ঘোড়সওয়ার পুলিস। ঘোড়ার মুখটা তাদের দিকে কদম দিচ্ছে। সে একটু সরে বসে বলল, কি বলে বাড়ি থেকে বের হলে?

—যা বলে বের হই।

—কিন্তু যদি ধরা পড়।

—কি হবে তবে? বলব, সুনন্দার কাছে গেছিলাম। তারপরই বলল, রাজবাড়িতে জানো একটা মানুষের অ্যামব্রায়ো পাওয়া গেছে। আঁস্তাকুড়ে পড়েছিল।

ফুলির উচ্চ মাধ্যমিকে বায়োলজি আছে সেই সুবাদে ভ্রূণ-টুণ না বলে অ্যামব্রায়ো বলল। যেন ফুলি কত অভিজ্ঞ—এবং বলল, জানো আমার আর পড়াশোনা করতে ভাল লাগে না। তোমাদের বাড়ি থেকে কিছু অমত হবে?

সুনন্দ বলল, এখনও আমার দুই দিদির বিয়ে বাকি—তুমি তো সব জান।

—তা হলে আমরা কতদিন এ-ভাবে থাকব?

—দিদিদের বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত।

—কবে ওরা করবে?

—করবে মনে হয়। কারণ ওরাও তো তোমার মতো অধীর।

এ-সব কথা হামেশাই এ-শহরের উঠতি যুবকদের যুবতীদের এবং নিম্ন-মধ্যবিত্ত ঘরের যারা, তাদের এই পার্ক, সিনেমা, থিয়েটার এবং মাঠটা সম্বল। দূরে দূরে যতদূর চোখ যায়, কোথাও তরুণ যুবকেরা খেলা করছে—কোথাও ঘোড় দৌড় হচ্ছে, কোথাও জোড়ায় জোড়ায় ঘুরছে। মহারাণীর স্মৃতিসৌধটির পাশে এমন সব কত যুবক যুবতী গাছের নিচে বসে উত্তেজনায় অধীর হচ্ছে। চোখ মুখ জ্বলছে। এই বয়সে তাদের আর কি করণীয়। কিন্তু তারা জানে তাদের অনেকেরই এক স্বপ্ন-সমুদ্রে শুধু ভেসে বেড়াতে হয়। ইচ্ছেমত তারা গভীরে প্রবেশ করতে পারে না। তাদের জন্য সব সুন্দরী যুবতীরা বড় হয়ে ঘুরে বেড়ায়, তারা শুধু দেখে যায়। সুনন্দ দেখল নদীর পাড়ে সূর্যাস্ত হচ্ছে। অসংখ্য পাখি উড়ে যাচ্ছে মাথার ওপর দিয়ে। চারপাশে নগরীর কোলাহল, বাস ট্রাম এবং স্কাইস্ক্যাপার। সে রেড রোডের গোলমোহর গাছগুলি পার হয়ে আরও গভীর মাঠের মধ্যে ফুলিকে নিয়ে ঢুকে যেতে থাকল। ফুলির শরীরে আশ্চর্য লাবণ্য। ওর জঙ্ঘায় না জানি কোন মহাসমুদ্র খেলা করে বেড়াচ্ছে। সে এখনও সেখানটায় হাত দিতে পারেনি। এই একটা ভীষণ ইচ্ছেয় ফুলির কাছে এলেই তার শরীরে কেমন জ্বর এসে যায়। ইচ্ছে হয় কত কথা বলবে, কিন্তু কেমন মূক বধিরের মতো সে শুধু তাকিয়ে থাকে। শরীরকে ক্ষতবিক্ষত করে তাকে ফিরে যেতে হয়—কারণ মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর মধ্যে মা বাবা, ভাই বোন সব মিলে এক প্রাচীর তৈরি হয়ে আছে। সেই প্রাচীর ভাঙার জন্য একটু এগোলেই সংসারে কোথায় কিছু যেন হারিয়ে যায়।

ফুলি বলল, এই, আমি ফিরব। সন্ধ্যা হয়ে গেছে।

—আর একটু চল না হাঁটি।

ফুলির মধ্যেও মানুষের সঙ্গ পেলে যা হয়—এক জলোচ্ছ্বাস ঘটছে। সেটা সে টের পাচ্ছিল। সে হাঁটতে পারছিল না। শরীরে আশ্চর্য জড়তা নেমে আসছিল এবং সে নিজেকে নিজেই ভয় পাচ্ছিল। শেষে তো সেই এমব্রায়ো। এটার জন্য সে জানে খুব ভাববার নেই। কিন্তু অস্পষ্ট অন্ধকারেও সে বুঝল কোথাও এই শহরে একটু নিরিবিলি জায়গা নেই—যেখানে সে এবং সুনন্দ মুহূর্তের জন্য এক হয়ে যেতে পারে। ফুলি অন্যমনস্ক হবার জন্য বলল, এই প্রিয় শহরে আমরা একদিন বুড়ো হয়ে যাব। ভাবতেও কেমন লাগে।

সুনন্দ বলল, বুড়ো হতে দিচ্ছি না।

—তুমি না দেবার কে! জান আমার মা এখন কেমন হয়ে গেছে! কি সুন্দর না ছিল দেখতে! একেবারে মধুবালার মতো। সেই মা কেমন হয়ে গেছে। জান আমার কেবল ভয় করে—আমিও একদিন ঠিক মার মতো হয়ে যাব।

সুনন্দ দেখল এখন ওরা অনেকটা মাঠের গভীরে ঢুকে গেছে। বলল, এস আমরা পাশাপাশি এখানে শুয়ে থাকি।

—পুলিশ ধরুক আর কি।

সুনন্দ বলল, বড়ই সুসময় চলে যাচ্ছে। এই সুসময় আমরা শুধু পালিয়ে ভালবাসছি। জানো রাতে তোমার কথা ভাবতে ভাবতে কেমন অস্থির হয়ে যাই, মা বাবা দিদি সব কেমন দূরের মনে হয়। যেন এতদিন যে বড় হওয়া সে শুধু তোমার জন্য।

ভালবাসার কথা সাধারণত এই রকমেরই হয়ে থাকে। কাজেই নতুনত্ব কিছু নেই। সুনন্দদের সময়ে এই কথা, তার বাপের আমলেও এই কথা, তার পিতামহের আমলেও এই কথা। আগামী জন্ম জন্মান্তরেও এই কথা। এইভাবেই মানুষ বালক থেকে যুবক হয়, যুবক থেকে প্রবীণ, তারপর বুড়ো। তখন ঈশ্বর দরকার হয়। মানুষের কোথাও না কোথাও শেষ আশ্রয় এই ঈশ্বর। এখন সুনন্দর আশ্রয় এই ফুলি

—সুনন্দ পাশে বসে দাঁতে ঘাস কাটতে কাটতে এ-সব ভাবছিল। ফুলির দাদা ওর সঙ্গে পড়ত সুরেন্দ্রনাথে। ওর দাদা ভাল কবিতা আবৃত্তি করতে পারত। নাটক করতে পারত ভাল। একবার একটা কবিতাও লিখেছিল কলেজ ম্যাগাজিনে। সে কবিতাটা পড়ে ফুলির দাদার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। আলাপ, ভাব, তারপর বন্ধুত্ব। ওর দাদা যা কিছু লিখত প্রথমেই তাকে সেগুলো দেখাত। সুনন্দর মনে হত, ফুলির দাদা রবিঠাকুর না হয়ে যায় না। অশেষ গুণ আছে তার। কিন্তু এখন সে সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে একটা অর্ডার সাপ্লাইয়ের ব্যবসা করছে। আর সুনন্দ এই নিয়ে আঠারবার ইন্টারভিউ এবং প্রথম প্রেম। ফুলির সঙ্গে তার প্রেম চলছে। সে ভেবেছে মরে যাবে ফুলির জন্য। একটা কিছু করে ফেলবেই। প্রেম নিয়ে সে ছেলেখেলা করতে ভরসা পাচ্ছে না।

—এই শোনো। ফুলি সুনন্দর হাত ধরে বলল।

—কী?

—বাবা সেদিন তোমার কথা দাদাকে বলছিল। সুনন্দর খবর কিরে! দু-তিন হপ্তা হল আসছে না।

—সুধীন কি বলল?

—বোধহয় কাজে আটকে পড়েছে।

একবার খোঁজ-নিলে হয় না। ওরা তো বেলঘরিয়ায় থাকে। রিফুজী কলোনিতে ওর বাবা বাড়ি করেছে।

ফুলিদের পরিবারে রিফুজি জল চল নয়। প্রথম প্রথম সুনন্দকে বাঙাল বলে বাড়ির সবাই ঠাট্টা তামাশাও করেছে। এবং জল চল নেই বলেই ফুলির বাবা প্রথম দিকে সুনন্দর আসা যাওয়া খুব পছন্দ করত না। কিন্তু বছরখানেক ধরে অন্যরকম। অফিসে তার বস বাঙাল। সিট মেটালে নতুন ম্যানেজার এসেছে সেও বাঙাল। একেবারে দেশটা ক্রমেই বাঙালে বাঙালে ছয়লাপ হয়ে যাচ্ছে। যেখানে যাও, অফিসে, ব্যাঙ্কে, ট্রামে বাসে শুধু বাঙাল ছাড়া মুখ দেখা যায় না। আত্মীয়-স্বজনদের মেয়েরাও এখন বাঙাল বিয়ে করতে ব্যস্ত। তার দিদির দুই মেয়েই ভালবাসাবাসি করে অফিসের দুই বাঙালকে তুলে এনেছে। তার বোনের নন্দাই মেয়ের বিয়েই দিয়েছে বাঙাল দেখে। বাঙালরা নাকি খুব করিতকর্মা হয়। মেয়েদের বিয়ে দাও তো বাঙাল খোঁজ। ছেলেদের বিয়ে দাও তো স্বজাতি দেখে দাও।

এইসব কারণে সুনন্দর ওপর ফুলির বাবার বেশ স্নেহ ভালবাসা জন্মাচ্ছিল। এ-জন্য অভাবের সংসারে দুবার নিমন্ত্রণ করেও খাইয়েছে। সুনন্দ একটা চাকরিও করছে লজঝরে প্রাইভেট ফার্মে। তবে সে ব্যাঙ্কে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ওর আশা ব্যাঙ্কে সে একটা কাজ পেয়ে যাবে। ফুলির বাবা আজকাল ঠনঠনে দিয়ে আসার সময় শরীর ভাল থাকা নিয়ে যখন মা ঠাকরুণকে মাথা ঠোকে তখন সঙ্গে সুনন্দর ব্যাঙ্কের চাকরিটার কথা মাকে মনে মনে স্মরণ করিয়ে দেয়।—তোমার তো মা সবাই সন্তান। সন্তানের শখ-আহ্লাদ তুমি না মেটালে কে মেটাবে। মা মাগো। তোরই ইচ্ছা সব। তারপরেই মনে হয়, মুখটা খালি, দোক্তাপান খাওয়ার ভারি বদভ্যাস। পাশের পানের দোকান থেকে একটা পান হাতে কিছু জর্দা নিয়ে হাঁটা দেয়। এ-সব অবশ্য ফুলিই বলেছে সুনন্দকে।—মনে হয় বাবা তোমাকে এখন পছন্দ করছে। সেই সুবাদে সব ঝেঁটিয়ে সেদিন ফুলির বাবা পরিবারবর্গ নিয়ে দক্ষিণেশ্বরে চলে গেল। ফুলি বাড়ি পড়ে থাকল একা। সুনন্দর সেদিন আসার কথা। ফুলির মনে হয়েছিল, বাবা ভুলে গেছেন। মাও। দাদারা তো রাত দশটার আগে বাড়ি ঢোকে না। কেবল সুনন্দ ওকে জড়িয়ে আদর করার সময় বলেছে, তুমি একা। ওফ্ কি যে ভাল লাগছে না।

সেই থেকেই ফুলির কাছ থেকে সুনন্দ এটা ওটা চেয়ে নেয়। সব চাইলেই অবশ্য পাওয়া যায় না। কুমারী মেয়ের নিরাপত্তার বিঘ্ন ঘটতে পারে। নিরাপত্তার বিঘ্ন না ঘটিয়ে যতটা দেওয়া যায়, ফুলি সুনন্দ কিছু চাইলে সেইটুকু দেয়। তার বেশি না। সেজন্য সুনন্দ যে ছবি উঠে যাচ্ছে তার শেষ শো দেখে। হল ফাঁকা। অনেক কিছু তখন চাওয়া যায়। সেজন্য সুনন্দ কখনও অপরিচিত রেস্তোরাঁতে ফুলিকে নিয়ে বসে। পর্দা টেনে দেয়। তারপর জড়িয়ে ধরে চুমু খায়। ফুলি তখন শরীরের সঙ্গে একেবারে আঠা হয়ে থাকতে ভালবাসে। এখন ব্যাঙ্কে শুধু একটা চাকরি। ওটা হয়ে গেলেই সে নদীর পাড় ধরে আর হেঁটে যাবে না। নদীটা সোজাসুজি অতিক্রম করবে। এবং সেখানেই সে প্রথম এক গভীর অরণ্য দেখতে পাবে। ফুল লতাপাতা, ঝড় বিদ্যুৎপ্রবাহ, শ্বাপদসংকুল এক অরণ্য। নিয়তি মানুষকে শেষ পর্যন্ত সেখানেই টেনে নিয়ে যায়। সুনন্দ দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলতে চাইল, তুমি মা হয়ে যাবে, আমি বাবা হয়ে যাব। দাঁত নড়বড়ে হবে—তবু ফুলি আমরা যুবকেরা যুবতীরা কি এক তাড়নায় সেখানেই শেষ পর্যন্ত গিয়ে হাজির হই। এইটুকু ভেবে সুনন্দ ঘাসের উপর সত্যি শুয়ে পড়ল। সে যেন বলতে চাইল এইভাবে নিয়তি আমাদের কবরের দিকে নিয়ে যায়।

ফুলি মাথার কাছে বসে বলল, এই শুলে কেন?

সুনন্দ বলল, কত নক্ষত্র না আকাশে!

ফুলি বলল, লক্ষীটি ওঠো।

সুনন্দ বলল, তুমি যাও।

ফুলি তখনই বলল, দ্যাখ কারা আসছে। দু-তিনটা যন্ডামার্কা ছেলে।

সুনন্দ দেখল ছেলেগুলি তাদের ঘিরে ফেলেছে। একজন বলল, দাদা কি করছিলেন বেশ মজা, না বেশ টিপে টুপে দেখা হচ্ছে। তারপরই ধাঁই করে মুখে ঘুষি।

সুনন্দ বলল, আমাকে মারছেন কেন?

—প্রেম। শালা প্রেম চুটিয়ে দিচ্ছি। এই ক্যাবা দুটোকেই ন্যাংটো করে ছেড়ে দে ত।

—দেখুন আমরা বেড়াতে এসেছি।

—আর জায়গা পাও নি চাঁদু। কি আছে দেখি!

—কিচ্ছু নেই।

একজন বলল, মার না আর একটা টুসকি। বাছাধন হড়হড় করে সব বের করে দেবে।

ফুলি ভয়ে কাঁপছিল। গলা শুকিয়ে আসছে। চিৎকার করতে গিয়েও পারল না। পুলিশ পুলিশ। কিন্তু কোথাও কেউ নেই। গাছের ও-পাশ দিয়ে মানুষজন হেঁটে যাচ্ছে। ফুলি দৌড়ে খবর দেবে ভাবল। আর তখনই তিন নম্বর যণ্ডামার্কা ছেলেটা ওর হাত ধরে ফেলেছে। দেখি রানী। কাছে এস। কি আছে? কিছু নেই। আহারে! বলে কানের দুল খসিয়ে নিল। সুনন্দ ঘড়ি খুলে দিচ্ছে। ফুলির হাতে আর আছে কাঁচের চুড়ি।

—পকেট দ্যাখ ক্যাবা।

পকেট হাতড়ে দেখা হল।

তখন সেই দস্যু সর্দারটি বলল, তোরা একে একে চুমু খা।

তখন সুনন্দর কি হয়ে যায়। সে ক্ষেপে গিয়ে এলোপাথাড়ি লাথি ছুঁড়তে থাকে। এবং প্রায় পাগলের মতো সে লাফিয়ে পড়ল একটার ঘাড়ে তারপর জোর হিন্দি সিনেমার মতো রদ্দা চালাল। ওর মাথার মধ্যে কেউ কিছু চালিয়েছে। সে রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছিল। ফুলি চিৎকার করছে, মেরে ফেলল, মেরে ফেলল। সেই আর্ত চিৎকারে মানুষজন ছুটে আসছে। তারপরই দেখল সব ফাঁকা। ফুলি অপরিচিত মানুষজনের মধ্যে বোবা হয়ে গেছে। একটা কথা বলতে পারছে না। সুনন্দ পায়ের কাছে পড়ে আছে। মানুষজন দেখে ওঠার চেষ্টা করছে।

তখন জনতা ওদের ওপরই ক্ষেপে গেল। কেন আসেন—ঠিক হয়েছে বেশ হয়েছে। সুনন্দ তখন হাত ধরে টানল ফুলির, এই এস। মানুষজন তামাশা দেখার জন্য ভিড় করতেই ফুলি বলল—তোমার রক্ত পড়ছে।

—ঠিক হয়ে যাবে। এস।

—কৃতকর্মের ফল। জনতা থেকে কেউ একজন বলল। যেন এরা জীবনে মেয়েমানুষ ছুঁয়েও দেখেনি।

—বাড়ির লোকও বলি, এমন একটা ধিঙ্গি মেয়েকে ছেড়ে দেয়! তারপর ওরা মানুষের মূল্যবোধ নিয়ে কথা বলতে বলতে চলে গেল। সব ভেঙে পড়ছে। জীবনে সততা নেই। কি হল দেশটা!

সুনন্দ রুমাল দিয়ে ক্ষত স্থানটা চাপা দিয়ে হাঁটতে লাগল।

ফুলি বলল, আমরা এখন কোথায় যাব সুনন্দ? আর্ত অসহায় মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে সুনন্দ কেমন বিভ্রমে পড়ে গেল।

.

তখন বিশাল কাঁচের দরজা ঠেলে মতি ভিতরে ঢুকছে। সুবিশাল করিডোরের পাশে কাঁচের কাউন্টার। পাঁচ সাতটা ফোন নিয়ে ঘোষবাবু দাঁড়িয়ে আছেন। একটা তুলছেন, একটা নামাচ্ছেন। মসৃণ গোলগাল মুখ। মাছির মতো দুটুকরো গোঁফ নাকের নিচে। গলায় বো টাই। চেক কাটা টেরিকটনের স্যুট পরে ফোনের রিসিভারে ঝুঁকে আছেন। কাউন্টারে বসে মিস কাপুর গোলাপী রঙের ভেলভেটের শাড়িতে আগুন হয়ে বসে আছে। এখনও বোধহয় ঘোষবাবু ক্লায়েন্ট ধরতে পারে নি। মতিকে দেখে মিস কাপুর সামান্য মাথা নত করল। হাসল সামান্য। দেরিতে আসায়, পরে সে ক্লায়েন্ট পাবে। তার নিজেরও আজ দেরি হয়েছে। ঘোষ মতিকে দেখেই, ইশারায় কাউন্টারের ভেতরে চলে আসতে বলল।

এখানে এলেই মতি যেন অন্য এক জগতে চলে আসে। কত সুন্দর পৃথিবী মানুষ নিজের জন্য তৈরি করে নিতে পারে এখানে না এলে বিশ্বাস করা যায় না। লাল কার্পেট পাতা করিডোর। সব অদৃশ্য লাল নীল আলো দেয়াল থেকে যেন চুইয়ে পড়ছে। সব ছিমছাম নারী পুরুষ হল্লা করতে করতে ডানদিকের সিঁড়ি ধরে উঠে যাচ্ছে। বয় বেয়ারারা সাদা উর্দি পরে ভারি ব্যস্ত। কাঁচের দরজার ওপাশে উর্দিপরা ইকবাল অনবরত সেলাম ঠুকে যাচ্ছে। তাকে দেখেও সেলাম ঠুকতে যাচ্ছিল—যেই দেখল মতি বোন, আর অমনি হেসে বলল, ক’দিন এদিকে আর মাড়ান নি বুঝি?

কথাটার মধ্যে কেমন একটা নগ্নতা টের পেয়ে মতি প্রথম ভ্রু কুঁচকে ছিল। তারপর বুঝল, ইকবাল সে ধরনের মানুষ নয়। সে ইতর কথাবার্ত প্রায় জানেই না। মিস কাপুরের পাশে দাঁড়িয়ে মতি রিসেপসনিস্টদের মতো হাবভাব করতে থাকল। মতি এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছে। সিগারেটের কেস থেকে একটা সিগারেট তুলে নিল। কোনও পুরুষ একা উঠে গেলেই মিষ্টি করে হাসতে হচ্ছে। কাউন্টারে দাঁড়ালেই এটা করতে হয়। কোথায় কোনটা কাজে লেগে যাবে—এই হাসির মধ্যে শরীরের এক বিশেষ ইচ্ছের ইশারা ফুটে উঠলে হয়ত সিঁড়ি ধরে ওঠার মুখেই বুক করে ফেলতে পারে।

মতি আজ হাল্কা লিপস্টিক ঠোঁটে দিয়ে এসেছিল। ইদানীং সে বুঝেছে খাপ খোলা পুরুষেরা খুব উগ্র সাজ পছন্দ করে না। সে জন্য সে তার স্বভাবে চরিত্রে নারী মহিমময়ী এমন একটা ভাব ফুটিয়ে রাখে। লাজুক, চোখ নামিয়ে নেওয়া, আস্তে আস্তে কথা বলা, কথা বলতে বলতে অন্যমনস্ক হয়ে যাওয়া, একটু উদাস হয়ে যাওয়া এ-সব অভিনয় রপ্ত করতে না পারলে বেলাইনের পুরুষেরা আরাম পায় না। প্রথম দিকে তার স্বভাবেই ছিল এগুলো। পরে লাইনের মেয়ে হয়ে যাবার পর, তার সে-সব হারিয়ে গিয়েছিল। ঘোষবাবু একদিন বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, ক্লায়েন্টদের সঙ্গে কি কর! ফিরতি বার আর তোমার নাম করে না। আসলে মতি বুঝেছিল, সে পাকা বেশ্যা হতে গিয়েই ভুল করেছে। পাকা বেশ্যাদের বাবুরা ঠিক চিনে ফেলে। সেই থেকে সে এখন যেটা তার স্বভাবে ছিল, সেটা অভিনয়ে দাঁড় করিয়েছে।

ঘোষবাবু ফোন রেখে একটা চিরকুট এগিয়ে দিলেন। চলে যাও।

মিস কাপুর ভীষণ উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল। পরে এসে আগে। আসলে বাঙালী বলেই এই স্বজাতি প্রীতি। কিন্তু লোকটা জানে না, এর আসল মালিক একজন পাঞ্জাবী। যদি এই প্রাদেশিকতার কথা কানে তুলতে পারে তবে নাকানি-চোবানি খেতে হবে খুব। তবু মিস কাপুর এই ঘোষবাবুকে সমীহ করে। কারণ তিনি ইচ্ছে করলে বলতে পারেন, আপনার চাহিদা কমে গেছে। বাজারে আর চলছে না। সেটা যে কত বড় অপমানের বিষয়! সে-জন্য সে খুব করুণ গলায় বলল, বাবুজী ইট ওয়াজ মাই টার্ন।

ঘোষবাবু স্মিত হাসলেন। মাথার ওপরে কাঁচের বোর্ডে নীল অক্ষরে লেখা ওয়েল-কাম। তার নিচে ঘোষবাবুর মাছির মতো গোঁফের ফাঁকে স্মিত হাসি বড়ই কূটগন্ধ ছড়াচ্ছিল। বললেন, ক্লায়েন্ট প্রেফারস মতি। হোয়াট কেন আই ডু।

এর পর মিস কাপুর অগত্যা চাবির রিং ঘোরাতে থাকল। মতি সিঁড়ি ধরে উঠে যাচ্ছে। প্রায় যেন একটা স্বর্গরাজ্য পার হয়ে আর একটা স্বর্গরাজ্যে সে চলে যাচ্ছে। নীল রঙের কার্পেট পাতা সিঁড়িতে পা ডুবে যাচ্ছিল। ৩০৮ নম্বর ঘর। তার এখন, কোন দিকে কোন ঘরের সিরিয়েল আরম্ভ সব মুখস্থ। একতলা, দোতলা, তিন-চার-পাঁচ তলা। দোতলায় সব লাউঞ্জ, ব্যাংকোয়েট হল পাঁচটা। সে এখন গ্রীন ভেলির পাশ দিয়ে যাচ্ছে। কাঁচের ঘরে ভেলভেটের তাকে নানান রকম ইংরাজী হিন্দি বই। দু’জন যুবক একজন যুবতীকে নিয়ে বইগুলি দেখছে। পাশে একটা রকমারী শাড়ির শো-রুম। তারপরই ম্যাডভিলা—সেখানে মিউজিক বাজছে। কাঠের সুইংডোর ঠেললেই সব নানা রকমের আবছা আলো আঁধারে শোনা যাবে মিউজিক বাজছে। আর দূরে অদূরে সব হিজিবিজি মানুষের মুখ—কেমন ভুতুড়ে ছায়া—অবিকল এক নকল নরকের ভয়ের মতো জায়গাটা। নারী পুরুষ লাল নীল গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে—কি যেন গোপন ব্যথায় মুষড়ে যাচ্ছে—অথবা সুরা যা মানুষকে অতীব এক সরলতা এনে দেয়—একটা লোককে সে উঠে যেতে দেখল, দাঁড়িয়ে হাঁকছে এনি মোর ফ্লাওয়ার? মতি পাশের বিরাট কাঁচের ফুলদানি থেকে যেতে যেতে দুটো ফুল তুলে নিয়ে লোকটার হাতে দিতেই কেমন চকমক করে তাকাচ্ছে। নেশায় লোকটা বড়ই টলছিল। ফুল পেয়েই মুখে পুরে দিল এবং চিবুতে থাকল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *