1 of 2

ঈশ্বরের বাগান – ৮

।। আট।।

অতীশ অফিসে আজ ভাল করে কাজে মনোযোগ দিতে পারল না। ভারি অসম্মান এবং অপমানে সে কেমন প্রায় চুপচাপই ছিল। বিল ভাউচার এলে সই করে দিয়েছিল। পার্টির কাছে তাগাদার একটা লিস্ট পড়ে আছে। সে আজ টাকার জন্য কাউকে তাগাদা দেবার পর্যন্ত উৎসাহ পেল না। কুন্তবাবু বাইরের ঘরে বসে সেলট্যাকসের রিটার্ন করছে। সুপারভাইজার বলে গেছে বার্নিশ ভাল দেয়নি। ঢাকনার রং চটে যাচ্ছে। ডাইস খারাপ হতে পারে—এমন সব কথাবার্তা কিছু এবং জানালা দিয়ে তাকালেই চোখে পড়ে সেই শিউপূজনের ঘর। সে কলপাড়ে বসে গা ঘষছে। পাশ থেকে জল নিচ্ছে লাইনবন্দী লোকেরা। রাজবাড়িতে সে সুরেনকে কিছু বলেই আসেনি। নব হয়ত আসবে। নব আসবে এই ভয়ে সে খুবই বিমর্ষ বোধ করছিল। নব চাকরির আশায় কারখানায় চলেও আসতে পারে। এলে তাকে কি ভাবে ঠেকাবে বুঝে উঠতে পারছে না। দুবার কুম্ভবাবু তার ঘরে এসে একটু বসার তাল খুঁজছিল। কিন্তু চুপচাপ থাকায় বিল ভাউচার সই করিয়ে নিয়ে চলে গেছে।

আর সবকিছুই কেন জানি এখানে তার অস্বাভাবিক ঠেকছে। শহরের মানুষ সে নয় বলেই হয়ত তার এসব খুব অস্বাভাবিক ঠেকছে। অমলার সঙ্গে কথাবার্তা তার কিছুটা ভুতুড়ে ব্যাপার মনে হচ্ছে। আসলে কি তার ভেতর বৌরাণীকে দেখার পরই অমলা অবচেতন মনে এসে আশ্রয় করেছে। সে রাতে কি অমলাকে নিয়ে কোনও স্বপ্ন দেখেছিল! অমলার ব্যবহারও ভারি বিস্ময়ের মনে হয়েছে তার কাছে। এসব বনেদি বংশে ভাঙচুর হচ্ছে ঠিক, তাই বলে অন্দরে ডেকে নিয়ে যাওয়া! তার এখনও অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে ঘটনাটা। মানসদা, নব, সরেন এবং ভ্রূণ হত্যা সবই কেমন রহস্যজনক। নব নাকি সারাদিন সারারাত ভি আই পিতে গাড়ি গোলে। মানুষের এমন নিষ্ঠুর পরিণতি শহরে না এলে যেন সে বুঝতে পারত না। সেই পাখিটা তাকে হন্ট করছে। পাগলাটা আজও দেখেছে একটা পালক বেঁধে লাঠিতে রাজাবাজারের দিকে বীর দর্পে হেঁটে যাচ্ছে। সে এই নগরজীবনের একজন মস্ত ব্যস্ত মানুষ যেন। সব কিছু অগ্রাহ্য করে কেবল হাঁকছে, দু’ঘরের মাঝে অথৈ সমুদ্দুর। কখনও বলছে, দম মাধা দম, পাগলা মাধা দম। তার কত কাজ। এক মুহূর্ত তার বসে থাকার সময় নেই। যেন সে চুপচাপ থাকলে, বসে থাকলে পৃথিবীটা রসাতলে যাবে।

আর এ সময়ই বাড়ির জন্য মনটা কেমন হাহাকার করে উঠল। নির্মলা থাকলে আজ তাকে সব খুলে বলতে পারত। সব অপমান তাহলে সেই পাগলের মতো সেও অগ্রাহ্য করতে পারত। প্রায় মাস হতে চলল—কাজটাজ কিছটা বুঝে নিয়েছে। পার্টিরা আসছে। এবং সে এ কদিনেই টের পেয়েছে, এই পার্টিদের সঙ্গে কুম্ভবাবুর একটা গোপন লেনদেন আছে। কুম্ভবাবু সহজেই দশ-বিশ টাকা ট্যাকসি খরচা করতে পারে। বৌকে নিয়ে ট্যাকসি ছাড়া ঘোরে না। নামী রেস্তোরাঁয় বৌকে নিয়ে প্রায়ই রাতের খাওয়া-দাওয়া সারে। বৌকে প্রায়ই নতুন নতুন শাড়ি গয়না কিনে দেয়। এমন অভিযোগ তার কানে এসেছে। লোকটাকে চোখে চোখে রাখতে বলেছে কেউ। কুম্ভবাবু নিজেও ভারি ফিটফাট থাকে। সামান্য মাইনেতে এটা কি করে সম্ভব সে বুঝে উঠতে পারে না। কস্টিং দেখা দরকার। সবটা বুঝে না নিতে পারলে সে আপাতত কাজটা করতে পারছে না। তার জন্য প্রাণপণে সে কাজের মধ্যে ডুবে থাকতে চাইছে।

হলে কি হবে—সেই এক পাগল বার বার হাঁকছে—এবং এই হাঁক থেকেই সে বুঝতে পারে, লোকটা তার কোন গল্পের নায়ক হতে চলেছে। এ বাড়িতে ঢোকার দিন, যেন তাকে দেখেই পাগলটা হেঁকে উঠেছিল—অথচ তার মনে হয়েছিল অদৃশ্য কোন এক জগৎ থেকে সে হাঁকছে। এখন মনে হচ্ছে তার ভেতরে সব অপমানের জ্বালা এই পাগলটাই পারে নিঃশেষ করে দিতে। কারণ সে যখন লেখাতে দেখতে পায়, সেই মানুষ অবিকল উঠে এসেছে, তখন কেমন বিজয়ীর মতো তার উল্লাস- অহংকার অতীব এক তখন তাকে গ্রাস করে।

সে ক্যাশবুকের পাতা উল্টে যাচ্ছিল। কিছু ভাউচার এখনও ক্যাশবুকে রয়ে গেছে। ক্যাশবুকের সঙ্গে মিলিয়ে টিকমার্ক দিয়ে দিচ্ছে। ক্যাশ এখন থেকে তার কাছে আছে। কোম্পানির দায়িত্ব নেবার দ্বিতীয় দিনেই নির্দেশ এসেছে, ক্যাশ আগলানোর দায় তার। কারণ টিফিন এবং ট্র্যাভলিং-এ দেখা যাচ্ছে প্রতিদিন একটা বিরাট খরচের বহর। পার্টিদের ঘরে যাওয়া আসা কাটা, টাকা আদায়ের কাজটা কুম্ভবার টিফিনের পরে করে থাকে। ট্রামের মানথলি কাটা আছে। টিফিনের পর তাকে আর পাওয়া যায় না। সে তখন প্রায় মুক্ত। ট্র্যাভলিং অ্যালাউন্স বাবদ সে রোজই পাঁচ-সাত টাকা ক্যাস থেকে নেয়। সনংবাবু বলেছেন, এ দিকটা দেখতে। পার্টিদের নাম চাইবে। মাঝে মাঝে ফোনে যোগাযোগ করবে। অর্থাৎ আকারে ইঙ্গিতে বিষয়টা যাচাই করে নিতে তাকে নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু মুশকিল এটা যে অতীশের কাছে বড়ই ছোটমনের পরিচয়! সে আজ পর্যন্ত কোন কাস্টমারকেই ফোন করে বলতে পারেনি, কুম্ভ যথার্থই পার্টির ঘরে গিয়েছিল কিনা।

এতে মনে হয় সে নিজেই পার্টির কাছে ছোট হয়ে যাবে।

এবং এই এক মাসে সে বুঝতে পারছে, কাজটার পক্ষে সে খুবই অনুপযুক্ত। কাজটার সঙ্গে তার মনের কোন মিল নেই। সাধারণ সব কাজই মানুষের একদিন একঘেয়ে ঠেকে কিন্তু এখানে এসে মনে হয়েছে—সে জীবনে আর একটা বড় ভুল করেছে। আর তখনই কেন জানি ইচ্ছা হয় যদি কোথাও আবার শিক্ষকতার কাজ পায় চলে যাবে। কোনও দূর গাঁয়ে। সেখানে থাকবে আদিগন্ত মাঠ, নদী ফুল পাহাড় উপত্যকা, এমন একটা জায়গায় তার চলে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সে জানে, আপাতত যা মাইনে পাচ্ছে, শিক্ষকতা করে সেটা সে উপার্জন করতে পারবে না। তাছাড়া নিরাপত্তাবোধের অভাবেও সে বিশেষ উদ্বিগ্ন। একটা লজঝড়ে কোম্পানির প্রায় সব দায়িত্বভার তার ওপর। টাকা আদায়, কাঁচামাল সংগ্রহ, পার্টির পেমেন্ট, সেলট্যাকস, প্রভিডেন্ট ফান্ড কন্ট্রিবিউউশন সব জমা যথাসময়ে দেওয়ার দায়িত্ব তার। সে বুঝতে পারে এটা এখন তার জীবনের বড় ফ্রন্ট। আর একটা ফ্রন্ট সেই প্রেতাত্মা। স্যালি হিগিনস যার সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছিলেন, তৃতীয় ফ্রন্ট তার স্ত্রী-পুত্র এবং বাবা- না। আর চতুর্থ ফ্রন্ট সে নিজেই গলায় ফাঁসের মতো আটকে নিয়েছে—সেটা তার লেখা। সে বুঝতে পারে এখানে আজীবন তাকে চারটা ফ্রন্টে লড়তে হবে। আর তখনই আর একটা মুখ সুদূর থেকে ভেসে আসে সে আর কেউ নয়, বনি। সে একটা বোট দেখতে পায়। সেও এক গভীর গোপন ফ্রন্ট। বনি চঞ্চল বালিকার মতো পাটাতনে ছুটে বেড়াচ্ছে। কখনও হালে বসছে। কখনও চাপাটি তৈরি করছে। ছোটবাবুকে খেতে দিচ্ছে। আর চারপাশে খুঁজছে যদি কোথাও একটুকু ডাঙা চোখে পড়ে। শুধু হাহাকার সমুদ্র বাদে বনি কিছু আবিষ্কার করতে না পারলে বলছে, ছোটবাবু আমাদের কী হবে?

ছোটবাবুর তখন আশ্বাস, এই দেখ চার্ট। তিনি সব বুঝিয়ে দিয়েছেন। আমরা এর বরাবর গেলে, ঠিক সান্তাক্রুজ দ্বীপ পেয়ে যাব। কোরাল সীতে সবচেয়ে কাছের দ্বীপ ওটাই। কম্পাসের কাঁটার দিকে লক্ষ্য রাখবে, যেন সাউথইস্ট ইস্টে বোটের মুখ ঘুরে না যায়।

তাহলে কি হবে?

আমরা তবে অজানা এক সমুদ্রে গিয়ে পড়ব।

তাহলে আমরা মরে যাব ছোটবাবু?

সেই মুখ কি করুণ আর অপার্থিব। বালিকার চোখ সজল হয়ে ওঠে। কতদিন থেকে তারা সমুদ্রে ভেসেই বেড়াচ্ছে। সে কবে থেকে যেন। কোন দূর অতীতে মনে হয় বনি ডাঙার মানুষ ছিল। সেও। এখন সমুদ্রের সব রকমের হাহাকার দেখে বনি অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এখন শুধু ছোটবাবুর জন্য তার বেশি চিন্তা। ছোটবাবু এতটুকু মুখ ভার করে থাকলে, কাছে ছুটে এসে হাঁটু গেড়ে বসে।—এই ছোটবাবু বলে ছোটবাবুর থুতনি তুলে ধরে। বলে, বাবা সত্যি কি বলেছে বল! বাবা আমাদের সমুদ্রে ভাসিয়ে দিল কেন? সঙ্গে ক্রসটা দিয়েছে কেন? বাইবেল দিয়েছে কেন। আমরা কি কোনও পাপ কাজ করেছি? তিনি তো বনি আমাদের নামিয়ে দেবার আগে বললেন—সমুদ্রের অশুভ প্রভাবে পড়ে যেতে পারি। সেজন্য ক্রসটা বোটে তুলে দিলেন, বাইবেল দিলেন। আসলে ছোটবাবু বলতে পারল না, আমরা আর ডাঙা পাব না। এই বোটেই আমরা মরে পড়ে থাকব। মাথার কাছে বাইবেল থাকবে। ক্রসটা থাকবে। আমরা মরে গিয়ে আবার ভূত হয়ে না যাই—সেজন্য তিনি তাঁর ধর্মীয় কাজটুকু আগে থেকেই সেরে রেখেছেন। তারপরই ছোটবাবু দেখল সূর্য অস্ত যাচ্ছে। সমুদ্র শান্ত। পারপয়েজ মাছের ঝাঁক ভেসে উঠেছে। অতল নীল গভীর জল। যতদূর চোখ যায় শুধু অসীম জলরাশি। ছোটবাবুর মনে হয়, এখুনি সেখানে কোন অতিকায় প্রাণী ভেসে উঠবে। পাইলট মাছ দেখলেই বুঝতে হবে কোন নীল হাঙর সমুদ্রের অতলে ঘাপটি মেরে আছে।

বনি হাঁটু গেড়ে বসে আছে পাটাতনে। মাথার ওপরে বিশাল আকাশ। কোথাও এতটুকু মেঘ নেই। নক্ষত্রেরা সব ফুটে উঠছে একে একে। দূর থেকে ডানার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। লেডি অ্যালবাট্রস উড়ে গেছিল সকালে, সন্ধ্যায় ফিরে আসছে। ফিরে এসেই চুপচাপ হালটার মাথায় ঘাড় গুঁজে বসে থাকবে। আর অজস্র প্রশ্ন তখন বনির, এই এলবা ডাঙার খোঁজ পেলে! কতদূর গেছিলে? আমরা ঠিক যাচ্ছি তো। কোথাও জাহাজ, জেলে নৌকা কিছু দেখলে?

ছোটবাবু পালের দড়িদড়া খুলে ফেলছিল। বনির চিৎকার তখন পরিত্যক্ত জাহাজটা সম্পর্কে, তখন একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছে। ওরা কোথায়? কত দূরে।

ছোটবাবু পালের দড়িদড়া এক জায়গায় জড় করে রাখছে। সে পাটাতন তুলে দেখল অয়েল ব্যাগটা ঠিক আছে কিনা। সমুদ্র এমন শান্ত থাকলে ভয়ের কথা। সে যেন বাতাসের গন্ধে ঝড়ের আভাস পাচ্ছিল।

সে বলল, বনি জল, খাবার এখনও আমাদের মাসের মত মজুত আছে। দুই বুড়ো মনে হয় শেষদিকে নিজেরা কিছু খায় নি। অথবা বুড়োরা টের পেয়েছিল, জাহাজের পরিণতি এই হবে।

বনি বলল, তোমাকে আমি বিশ্বাস করি না। তুমি এখনও আমাকে সত্যি কথা বলছ না!

ছোটবাবুর ভারি অসহায় মুখ। তাঁর নির্দেশ আছে, বনি যেন জানতে না পারে এক অজানা সমুদ্রে ছোটবাবুর সঙ্গে বনিকে ভাসিয়ে দেওয়া হল। এখন একমাত্র যেন দৈবই তাদের রক্ষা করতে পারে।

ছোটবাবুর এই অসহায় মুখ দেখলেই আর্চির সেই দৌরাত্ম্যের কথা মনে হয়। সঙ্গে সঙ্গে বনি কেমন হয়ে যায়। গায়ে নীলাভ ফ্রক, মাথায় নীলাভ চুল, সামনেই ডাঙা পাবে বলে সে বোটে উঠে এসেছিল। সে তার দামী দামী পোশাক, পারফিউম সঙ্গে এনেছে। সন্ধ্যা নামার আগে সে একজন নারীর মতো সাজতে বসে গেল। ছোটবাবুকে কষ্ট দিলে সে নিজেই বড় বেশি ভেঙে পড়ে। তারপর প্লেটে খাবার, সামান্য জল। খাবার বলতে দুখানা চাপাটি, দুটো সারডিন মাছ, এক গ্লাস জল, দুটো আলু সেদ্ধ। নিজের জন্য বলতে গেলে বনি কিছুই রাখেনি।

ছোটবাবু পালটা ভাঁজ করে সব গিয়ারের সঙ্গে ফেলে রাখল। কম্পাসের কাঁটা দেখে সে বুঝেছিল উল্টো হাওয়া বইছে। কেমন এলোমেলো হাওয়া। যদি পাল তুলে রাখে যতটা তারা এগিয়েছে, ঠিক ততটা তারা পিছিয়ে যাবে। এই ভেবে পাল খুলে দড়িদড়া নিচে রেখে সমুদ্র থেকে জল তুলে হাতমুখ ধুয়ে নিল। লোনা জলে শরীর মুখ করকর করে। সেটা শুকিয়ে গেলে একরকমের প্রসন্নতা বোধ করে ছোটবাবু। দুপুরে ওরা দুজনেই দড়িদড়া ধরে সমুদ্রে ডুব দিয়ে উঠে এসেছিল। বেশি ঘাম হলে তেষ্টা পায়। ডুব দিয়ে বুঝেছিল, ঘাম হচ্ছে না, তেষ্টাও কম পাচ্ছে। গত রাতে মনে হয়েছিল অতিকায় কিছু মাছেরা পাশে ভেসে বেড়াচ্ছে। কিন্তু শেষ রাতে অন্ধকার ছিল বলে কিছুই টের পায়নি। আজ রাতে কি হবে কে জানে। একটা লম্প জ্বালা থাকে মাস্তুলে। কোন দূরবর্তী জাহাজের ওটাই সঙ্কেত। আর অজস্র প্রশ্ন তখন বনির, এই যদি দূর থেকে কোন জাহাজ অথবা জেলে নৌকা তাদের দেখতে পায়! সে বলল, আগে লম্পটা জ্বালিয়ে দাও। এত তাড়াতাড়ি খেতে দেবার কি হল! কত কাজ বাকি।

বনির চোখ ভারি বিহ্বল। ছোটবাবু বনির এই চোখ দেখলে আবিষ্ট হয়ে যায়। হাঁটু গেড়ে পাশে বসে দুহাতে জড়িয়ে ধরে চুলে মুখ ঘষতে থাকে। বনি ছোটবাবুর বুকে টুপ করে মুখ লুকিয়ে ফেলে। অতিকায় পাখিটা তখন হাওয়ায় পাখা ঝাপটায়।

.

কুম্ভ এসময় টেবিলে ঝুঁকে একবার উঁকি দিয়ে দেখল, মানুষটা ক্যাশবুকে ঝুঁকে আছে। সামনে ক্যাশবুক খোলা। বিরাট সেক্রেটারিয়েট টেবিল, চার-পাঁচটা চেয়ার সামনে। তার ভেতর দিয়ে মানুষটার মাথা মুখ হিজিবিজি মাকড়সার জালের মতো অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মাথা নিচু করে বসে আছে। কপালে অবিন্যস্ত চুল পাখার হাওয়ায় উড়ছে। বড়ই আবিষ্ট। বোধহয় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে সব। কিন্তু পরে মনে হল, না, কিছুই দেখছে না মানুষটা। নেশায় বুঁদ হয়ে মানুষ বসে থাকলে যেমনটা হয় অনেকটা সেরকমের। খুব কাহিল হয়ে গেছে। আজ যা বড় একখানা ল্যাং খেয়েছে তাতেই এই। সকাল থেকেই দেখছে খুব গম্ভীর। মুখে আশ্চর্য প্রসন্নতা থাকে সকাল থেকে, তা আর নেই। এই প্রসন্নতা সে সহ্য করতে পারে না। মুখে এমন একটা ধার্মিকভাব থাকে যে সাধুসন্ত ভাবতেও কষ্ট হয় না। এই ক্যামোফ্লেজ লোকটার না ভাঙতে পারলে তার শান্তি নেই। সে পুলকিত বোধ করল। সে ভাবল উঠে একবার যায় কাছে। একটু দরদ দিয়ে কথা বলে। এই ভেবে সে উঠে এল। তারপর চেয়ারে বসে বলল, কাবুল আসবে যাবেন নাকি?

অতীশ কেমন ধড়মড় করে উঠে বসার মতো মুখ তুলে তাকাল।—অঃ আপনি!

—তবে কি ভেবেছিলেন!

—না, ভাবলাম …..আসলে সে ভেবেছিল, নব বুঝি এসে গেছে।

—ঠিক প্লট ভাবছেন!

অতীশ বলল, ঐ আর কি!

—কাবুল আসবে। চাঙ্গোয়ায় যাব। যাবেন নাকি। কাবুল খাওয়াবে বলেছে।

কাবুলবাবু কুম্ভের ছেলেবেলার বন্ধু। একসঙ্গে রাজপ্রাসাদে বড় হয়েছে। কুম্ভের বাড়িতে কাবুলবাবুর যেতে কোন নোটিশ লাগে না। এই মানুষটা যখন তখন চলে আসে এবং কুম্ভকে সঙ্গে নিয়ে কোথায় যায়। সে কোনও প্রশ্ন করতে পারে না। কারণ কুম্ভবাবুই বলেছে, কাবুল থেকে সাবধান থাকবেন। ও রাজবাড়ির এজেন্ট। ওর কাছে কোন বেফাঁস কথা বলবেন না।

অতীশ বলল, বিকেলে কাজ আছে। একটু কলেজ স্ট্রীট পাড়ায় যাব ভাবছি।

—আপনার ঐ এক দোষ দাদা। জীবনটাকে বড় সিরিয়াসলি নিয়েছেন। সব ব্যাপারে অত সিরিয়াস

হওয়া ভাল না। সকাল থেকেই দেখছি মুখ গোমড়া করে বসে আছেন।

—কখন মুখ গোমড়া করলাম?

—মুখ গোমড়া না করেন, মনটা প্রসন্ন নয় এটা আপনাকে স্বীকার করতেই হবে।

অতীশ ক্যাশবুকটা বন্ধ করে সরিয়ে রাখল। বেল টিপে সুধীরকে ডাকল। সুধীর এলে বলল, চা কর। সে কেমন জড়তা কাটিয়ে ওঠার জন্য ফ্যানটা পুরো পাঁচে দিয়ে এসে আবার নিজের জায়গায় বসল।

দুটো ঘর থেকেই মেশিনের শব্দ কানে আসছে। তিন নম্বর শেডটা দূরে বলে তার মেশিনপত্রের আওয়াজ এখান থেকে পাওয়া যায় না। অতীশ শব্দ শুনেই টের পায় কোন মেশিনটা চলছে, কোনট’ বন্ধ আছে। জাহাজের এঞ্জিনরুমে কাজ করে তার ভেতরে এই সহজাত বোধ গড়ে উঠেছে। আর তার জানালা থেকে রাস্তার ও পাশের শেডের সবটাই প্রায় দেখা যায়। এই একমাসেই বুঝছে, কর্মীরা সারাদিনে যা কাজ করে, ওভারটাইমে তার ডবল কাজ দেয়। কিছুতেই সে বুঝিয়ে-সুজিয়ে কারখানার উৎপাদন বাড়াতে পারেনি। যেখানে আট দশ হাজার কনটেনার তৈরি হয় আট ঘণ্টায়, কাজের লোকগুলি সামান্যতম আন্তরিক হলে একই সময়ে দ্বিগুণ কাজ দিতে পারে। আসলে ঘুণ ধরেছে—এই কারখানার দেয়ালে, দরজায়, যন্ত্রপাতিতে সর্বত্র ঘুণ। কাজের লোকগুলির শরীরেও ঘুণ ধরেছে। এভাবে চালালে, দু-চার বছরে কারখানা লাটে উঠবে। এই থেকে নিষ্কৃতি পেতে হলে তাকে কিছু একটা করতেই হবে। এবং যেটা এখন তার মাথায় বেশি কাজ করছে, সেটা হচ্ছে এদের বেতন বৃদ্ধি দরকার। এই বেতনে কোনও মানুষের পক্ষে দুবেলা পেট ভরে খেয়ে বেঁচে থাকা সম্ভব না।

কুম্ভ বলল, সকালে কুমারবাহাদুর কি বলল?

অতীশ অকপটেই বলল, রাজি হলেন না।

—রাজি হলেন না মানে?

—নবর কাজের জন্য বলেছিলাম। কাল বললেন, নাও। যদি দরকার মনে কর নাও। আজ সকালে ডেকে একেবারে উল্টো কথা বললেন।

কুম্ভ মনে মনে বেশ মজা পাচ্ছে। বলল, উল্টো কথা বলাই এদের স্বভাব। এা বড়লোক দাদা। এরা টাকা ছাড়া কিছু বোঝে না।

সুধীর এসে বলল, চা নেই স্যার।

কুম্ভ ধমক লাগাল।

—চা নেই তো আগে বলতে পার না কেন! দেখ সুধীর তোকে বার বার বলছি, কাজ ঠিক মতো করবি। তুই আছিস কি জন্যে! এখন চা এনে তারপর জল গরম করবি! অতীশ ড্রয়ার খুলে টিফিন একাউন্টে দুটো টাকা বের করে দিল।—চা রাস্তা থেকে নিয়ে এস। এবার থেকে যেন ভুল না হয়।

সুপারভাইজার এসে দরজায় মুখ বাড়াল। দেখল কুম্ভবাবু ম্যানেজারের সঙ্গে গল্প করছেন। সে একজন কর্মীর অভিযোগ নিয়ে এসেছে। কর্মীটি হেল্পার, বিটের কাজ জানে, এখন জরুরী দরকার পড়ায় তাকে বিটে বসতে হবে। কিন্তু সে রাজি না। তাকে বিটম্যান না করলে সে কাজে বসবে না বলছে।

অতীশ অভিযোগটি মন দিয়ে শুনল। তারপর বলল, আজকের মতো চালিয়ে দিতে বলুন। কাল এ-নিয়ে কথা বলব।

—কথা অনেকদিন ধরেই হচ্ছে। কোন ফয়সালা হচ্ছে না।

—অতীশ বলল, আমি তো আজই শোনলাম। একটা দিন তো সময় দেবেন।

কুম্ভ তখন বেশ জাঁকিয়ে বসে গেল। বলল, দাদা আসকারা দেবেন না। কারখানা জায়গাটাই খারাপ। আপনি যেই একজনকে লিফট দেবেন, অমনি দেখবেন পাতাল থেকে দশটা মুখ বার হয়ে আসছে। আপনাকে খাব খাব করছে।

অতীশ আগে এই সব সমস্যায় একটুকুতেই নিজেকে বিপর্যস্ত বোধ করত। এখন কিছুটা সয়ে গেছে। সে কুম্ভকে বলল, আপনি একবার ভেতরে যান। দেখুন বুঝিয়ে কিছু করতে পারেন কিনা সঙ্গে সঙ্গে কুম্ভ উঠে চলে গেল এবং কিছুক্ষণের মধ্যে সব ঠিকঠাক করে চলে এল। অতীশ ভাবল কুম্ভবাবুর ক্ষমতা আছে। সে দেখেছে কিছু কিছু শ্রমিক ওর খুব বাধ্যের। চার-পাঁচ বছর কুম্ভবাবু আছে। মাঝখানে ম্যানেজার ছিল না কুম্ভবাবুই চালিয়েছে সব। এতেই প্রভাব প্রতিপত্তি তার বেড়েছে। সে বলল, দেখুন তো কি ঝামেলা। এখন নব আসলে কি বলি।

—কি বলবেন আবার। সোজাসুজি না করে দেবেন।

—কিন্তু ওর বাবাকে আমি কথা দিয়েছি। আর এটা তো আমার খুশি মতো করিনি। রাজার অনুমতি নিয়েই করেছি। এখন আমার সম্মানটা থাকে কোথায়।

কুম্ভ ভীষণ রেগে গেছে মতো বলল, এতে শুধু আপনার সম্মান, কোম্পানির সম্মান যায় না! কর্তৃপক্ষের সম্মান থাকে! কান টানলে মাথা আসে না!

অতীশ বলল, কারা নাকি আপত্তি জানিয়েছে?

—কার দায় পড়েছে দাদা। একটা বেকার ছেলের কাজ হবে, কেউ তাতে বাগড়া দিতে পারে। ধর্মের ভয় নেই! আসলে কি জানেন দাদা, এরা সব পছন্দ অপছন্দ অপরের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে খালাস। নিজেরা ধোওয়া তুলসীপাতা সেজে বসে থাকে। এদের আপনি একদম বিশ্বাস করবেন না। দেখছেন ত কাবুলটা এলে সব নিয়ে কথা হয়। বলতে কি খিস্তিখাস্তাও হয়। কিন্তু কারখানা নিয়ে একেবারে স্পিকটি নট।

কুম্ভর প্রতি অতীশের কেন জানি কৃতজ্ঞতায় মনটা ভরে গেল। যদিও মাঝে মাঝে আশ্চর্য এক নিশুতি গন্ধ পায়, কুম্ভবাবুর নিঃশ্বাস প্রশ্বাসে সেই নিশি পাওয়া ভূতের গন্ধটা কেন জানি লেগে থাকে। আর্চির সেই হাঁ করা মুখ—মুখের ওপর ছোটবাবু উপুড় হয়ে পড়ে দেখেছিল লোকটাকে সে যথার্থই খুন করতে পেরেছে কিনা, আর তখনই ভক করে গন্ধটা এসে লেগেছিল নাকে। হাঁ করা মুখ থেকে একটা পচা গন্ধ বের হচ্ছে। ওর মাথাফাতা গুলিয়ে উঠতেই সিঁড়ি ধরে নেমে আসছিল। আর চারপাশে তখন কি গভীর অন্ধকার। চারপাশে জাহাজীদের হল্লা চিৎকার। এলিওয়ে ধরে কারা বোট ডেকে ছুটে যাচ্ছে। এনজিনরুমে বিস্ফোরণ! বয়লার-ফয়লার সব ছত্রাকার। সারা জাহাজে এক অতিকায় দুর্যোগ—ছোটবাবু দুর্যোগে পড়ে গন্ধটার কথা ভুলে গেছিল। পরে কিছুদিন সে সুস্থ স্বাভাবিক। কিন্তু সমুদ্রে ভাসমান বোটে বনির লুকনো মুখের দিকে তাকাতেই সে শিউরে উঠল। একটা ভুরভুরে পচা গন্ধ আসছে কোত্থেকে! সে বনিকে শুঁকে দেখল না সেখান থেকে উঠছে না। অতিকায় একটা সুরমাই মাছ তুলে রেখেছিল, ওর ভেতর থেকে লালা চুষে খাবে বলে —সেটা পচে যেতে পারে, সে তাড়াতাড়ি মাছটার কাছে চলে গেল—না আঁযটে গন্ধ, কোনও পচাগন্ধা নেই। লেডি আলবাট্রসও বোটে নেই –তবে গন্ধটা আসছে কোত্থেকে। যেন চেনা চেনা গন্ধ। একবার এই গন্ধে তার মাথাফাতা গুলিয়ে উঠেছিল—সেটা কবে কখন, ঠিক সেই গন্ধ, ঠিক তক্ষুনি মাথায় ঘণ্টা ধ্বনি, যেন সেই অ্যাবট অফ অ্যাবট ব্রথক—নিরন্তর ঝড়ের রাতে ঘণ্টা ধ্বনি করে চলেছে, ছোটবাবু তুমি আর্চিকে খুন করেছ। সে তোমাকে ক্ষমা করবে না। তাহলে কি সেই প্রেতাত্মার নিশ্বাস-প্রশ্বাসের গন্ধ! সে কাছেই রয়েছে। সে তার প্রতিশোধ নেবে বলে এই বিশাল দিগন্ত প্রসারিত জলরাশির ওপর ভেসে বেড়াচ্ছে। ছোটবাবু চিৎকার করে উঠেছিল, গড সেভ আজ। সেভ আজ ফ্রম অল ট্রাবলস। বনি টের পেয়ে বলেছিল, ছোটবাবু ক্রসটা আমার মাথার কাছে এনে দাও। ওটা ছুঁয়ে বসে থাক। কোন অশুভ প্রভাবে আমরা তবে পড়ে যাব না। কুম্ভবাবু কাছে এলে মাঝে মাঝে সেই গন্ধটা কেন জানি আজকাল নাকে এসে লাগে।

কুম্ভবাবু বলল, চলুন ঘুরে আসি। মনটা ভাল হবে। কাবুল আমাদের খাওয়াবে বলেছে। ও গাড়ি নিয়ে আসবে।

অতীশ কোনও জবাব দিল না।

তারপর ভারি বিশ্বস্ত মানুষের মতো বলল, জাহাজে ত শুনেছি সবাই সব খায়। গরু বাছুর মেয়েছেলে মদ। আপনি খাননি?

অতীশ চেয়ারে মাথা এলিয়ে দিল। তারপর হাতটা মাথার ওপর ছড়িয়ে বলল, জাহাজে সবই চলে।

—তবে আপনি যেতে চাইছেন না কেন। আপনার তো প্রেজুডিস থাকা ঠিক না।

—তা অবশ্য নেই। তবে এখন ভুলে গেছি সব।

তখনই ফোনটা বেজে উঠল, হ্যালো হ্যালো। হাঁ মিঃ ভৌমিক। বলুন। কি খবর! মাল কাল যাবে না। তারপর অতীশ ক্যালেন্ডারের পাতা দেখে বলল, বুধবার পাবেন।

—বহুং ঝামেলা হো জায়গা বাবুজী। থোড়া জলদি করিয়ে।

—জলদিই করছি।

—বাবুজী সিজন টাইম আছে। থোড়া মেহেরবানী করিয়ে।

—আরে এতে মেহেরবানী করার কি আছে!

তখনই কুম্ভ বলল, রামলাল?

অতীশ ঘাড় কাত করল।

—হাজার তিনেক টাকা আরও অ্যাডভান্স চান।

অতীশ কোনও অ্যাডভান্সের কথা বলল না। সে ফোন ছেড়ে দিল। কুম্ভের ভেতরে তখন একটা জেদী চিতাবাঘ ওৎ পেতে থাকে। যেন অতীশ খুবই একটা ভুল করে ফেলেছে। তার কথার কোনও গুরুত্ব দেওয়া হল না। সে কি নিজের জন্য এটা করছে। ফোন নামাবার সঙ্গে সঙ্গে বলল, অ্যাডভান্সের কথা কিছু বললেন না?

—ওর তো অনেক টাকা অ্যাডভান্স পড়ে আছে। শোধ দেবো কি করে।

—আপনি কি মনে করেন, লোকটা এমনিতে লোটা কম্বল নিয়ে কলকাতায় এসেছে। ধানদা নেই। এমনিতেই দশ-বার হাজার টাকা ফেলে রেখেছে। কোন ধানদা নেই। মেহেরবানী করেন বলে, অথচ কোনও ধানদা নেই!

—আপনিই যে বলেছেন, লোকটা দুঃসময়ে কোম্পানিকে বাঁচিয়ে রেখেছে।

—বাঁচিয়ে রেখেছে কেন? আখের না থাকলে সে বাঁচাতে আসবে কেন! আর কারখানা নেই, আর মাল সাপ্লাই করার লোক নেই!

অতীশ এসব কথার জবাবে কি বলবে! এই মানুষটাই রামলালকে একদিন সঙ্গে নিয়ে এসে বলেছিল, রামলাল ছিল বলে আপনি কোম্পানির ম্যানেজার হয়ে আসতে পেরেছেন। না হলে কবে লাটে উঠে যেত। বিপদে আপদে শেঠজী আমাদের রক্ষা করে আসছে! সেই শেঠজীকেই কুম্ভবাবু এখন ধান্দাবাজ বলছে। লোকটার মতি-গতি অদ্ভুত রকমের। সে কুম্ভবাবুর হাত থেকে নিস্তার পাবার জন্য, বলল, পরে এক সময় বললেই হবে।

—দাদা, ঐতো মুশকিল। তপ্ত কড়াইয়ে তেল ঢালবেন না, ত কী হবে। ওর চাপ আছে আপনিও চাপান দেবেন। দেখবেন সুড়সুড় করে টাকা নিয়ে হাজির।

কিন্তু তার মাথায় এখন আর কুম্ভবাবুর কথা ঢুকছে না। সে সেই কুষ্ঠ রোগীর ঘরটার দিকে তাকিয়ে আছে। জানালা দিয়ে দেখা যায় শিউপূজণ রকে বসে পায়ে ন্যাকড়া জড়াচ্ছে। তারপরই একটা মেয়েছেলে এসে তাকে খাবার দিয়ে যায়। শিউপূজণ ঘরের মধ্যে আসন পেতে খাবে। ঘরটায় সে একবার উঁকি দিয়ে দেখেছিল। দেয়ালে রাজ্যের ক্যালেন্ডার। সবই রাম সীতার ছবি। এবং একপাশে আরও একটা ছবি—বৈজয়ন্তীমালা। প্রায় উলঙ্গ হয়ে আছে মতো। জলে নেমে সাঁতার কাটছে! ঘরের মধ্যে আসবাব বলতে কাঠের একটা বাক্স, কাঠের পাটাতনে বিছানা পাতা এবং ময়লা দুর্গন্ধযুক্ত কিছু কাঁথা বালিশ। সম্বল বলতে তিনটি রিকশা, কটা ঠেলা তার ভাড়া খাটে। বাইরে বিকেলে বসে থাকে। সামনে থাকে জলচৌকি, সেখানে ভাড়ার পয়সা কড়া ক্রান্তি গুনে নেয়। সন্ধ্যা হলে, সে রাস্তার আলোতে তুলসীদাসী রামায়ণ সুরে ধরে পাঠ করে। সকালের দিকে দেখেছে, সে প্রত্যেক ভিখারীকে দুটো করে পয়সা দেয়। কাউকে ফেরায় না। যে মেয়েটি রেঁধেবেড়ে খাওয়ায় কুম্ভবাবু বলেছে যুবতীকে সে রক্ষিতা রেখেছে। এসব ভাবতে গিয়ে অতীশের মনে হল, মানুষের বেঁচে থাকার মতো বড় কিছু নেই। আসলে সে ভালমানুষ না কাপুরুষ! সব তাতেই ভয়। কি যেন তার হারিয়ে যাবে বলে ভয়। সেই ভয় থেকেই যত গন্ধ নাকে এসে লাগে। নিজেকে অতীশ শক্ত করতে চাইল। বলল, কখন যাবেন?

কুম্ভ বলল, কোথায়?

—এই যে হোটেলে যাবেন বলছেন।

—আপনি যাবেন ত। গেলে কাবুল খুব খুশী হবে। ওর বৌদির আপনি খুব পিয়ারের লোক। এখন আপনাকে তেল দেবার জন্য রাজবাড়ির সব চোর ছ্যাঁচোড়েরা উঠে পড়ে লাগবে।

অতীশ এমন কথায় কিঞ্চিৎ বিরক্ত হল। এর ভিতর অমলাকে টেনে আনা কেন। তা ছাড়া অমলা সম্পর্কে তার শৈশব থেকেই একটা দুর্বলতা আছে। অমলাকে নিয়ে কেউ কিছু বললে সে অপমানিত বোধ করে। কুম্ভবাবু আরও দু একবার জানার চেষ্টা করেছে, কি কথা হল বৌরাণীর সঙ্গে। কিছু বলল?

অতীশ বলেছিল, কিছু বলেনি। এমনি কথাবার্তা হয়েছে। কেমন লাগছে এই শহর। কোন অসুবিধা হচ্ছে না ত। এই সব আর কি।

—আর কিছু না!

—না।

—তা এই কটা কথা বলতে এত সময় লাগে!

—আর কি কথা হতে পারে বলে আপনার ধারনা।

—কত কথা হতে পারে। আমরা বাইরের লোক কি করে জানব। তবে দাদা সাবধান থাকবেন। লক্ষণ ভাল বুঝছি না। যারাই রাজার পেয়ারের লোক হতে গেছে তারাই মরেছে।

অতীশ বুঝতে পারছে না এরা সবাই রাজবাড়িতে জন্মেছে বড় হয়েছে, এদের কারো কারো তিন পুরুষ চার পুরুষ এই বাড়ির খেয়েছে, পরেছে, কেউ কেউ চুরি চামারি করে নিজেরাও ছোটখাট রাজা বনে গেছে—এবং এই কুম্ভবাবু, এদের রক্তে এবাড়ির নিমকের গন্ধ শুঁকলেই পাওয়া যাবে। কিন্তু প্রথম থেকেই কুম্ভ কেমন বেপরোয়া। যেন সে পারলে গোটা রাজাবাড়িটাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। আসলে তার আসার জন্য এটা হয়েছে কিনা কে জানে। সে এজন্য কেন জানি এখন থেকেই কুম্ভবাবুকে সামান্য তোয়াজ করতে শুরু করেছে। তা না হলে অমলার সঙ্গে দেখা হবার পর তাকে সাহস পায় কি করে প্রশ্ন করার। সেই বা এ নিয়ে কথা বলে কেন! তার তো বলা উচিত ছিল বৌরাণীর সঙ্গে কি কথা হল, আপনার জানার কি দরকার। অথবা সে এড়িয়ে গেলেই পারত। তারপরই মনে হল, অফিসের কাজে কর্মে সে এই লোকটার ওপর নির্ভরশীল। এই মৌকায় লোকটা তাকে পেয়ে বসেছে। কাবুল-বাবু এলে সে সোজাসুজি বলল, আপনারা যান। আমার সময় হবে না।

কুম্ভ বলল, এই দাদা সাহস! আপনার বৌমা বলল, দাদাকে কিন্তু সঙ্গে নেবে। অতীশ আঁতকে উঠল। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ কুম্ভবাবু। মাস তিন-চার বাদে কুম্ভবাবুর স্ত্রী জননী হবে। সেই জননীও যাচ্ছে সঙ্গে। তার মুখ থেকে রা সরছিল না।

কাবুল বলল, রোজ তো হয় না। দাদা বৌদি রোটারি ক্লাবে গেছে। ওদের পার্টি আছে গ্র্যান্ডে। আমরাও তিনজনে মিলে ছোটখাট একটা পার্টির আয়োজন করেছি। আপনি আমাদের গেস্ট

অতীশ অগত্যা আর যেন কিছু বলতে পারছে না। সে ওদের পিছু পিছু উঠে গেল। কুম্ভবাবু সুপারভাইজারকে ডেকে বলল, কেউ যদি ফোন করে বলবেন কাজে বের হয়েছি। আমরা আর ফিরব না। ট্রাম রাস্তায় গাড়ি রেখে এসেছে কাবুলবাবু। গাড়ির পাশ থেকেই হাসিরাণী দরজা খুলে দিল। দারুণ সেজেছে। ঠোটে প্রচন্ড লাল লিপস্টিক নখে রুপোলি নেল পালিশ, দামী শিফনের শাড়ি হাতে মীনা করা বালা। বগল খালি করে হাত তুলে বলছে, আপনি এখানটায় বসুন দাদা।

অতীশের কেন জানি মনে হল হাসিরাণীকে আজ হোক কাল হোক একটা লক্ষ্মীর পট তার কিনে দেওয়া দরকার। শরীরে বড়ই কামুক গন্ধ

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *