।। তিরাশি ।।
মঞ্জু এসে দেখল কেয়া পাশ ফিরে শুয়ে আছে। সামনের জানালা খোলা। সাদা জ্যোৎস্না গাছ- পালায়। কেয়া শুয়ে শুয়ে জ্যোৎস্না দেখছে।
নীলু ঘুমিয়ে নেই। মঞ্জু মুখ দেখেই টের পেয়েছে, নীলু ওষুধের ঘোরে আছে। সে নীলুর দিকে তাকালে এটা বুঝতে পারে। খুব বেশী সময় সে তাকাতে পারে না। মুখশ্রীতে নীলু কোথায় যেন সোনার কিছুটা পেয়েছে। কেউ টের না পেলেও সে টের পায়। এটা কেন হয় বুঝতে পারে না। সোনার সঙ্গে সে শৈশবের সম্পর্ক! তারপর ওর সঙ্গে দেখা নেই। অবনী ওর দুর্বলতার সুযোগে যা কিছু করে যেত, যেমন পরে মনে হত পাপ। জানালায় মাথা রেখে সে বসে থাকত তখন, তার মনে হত, এক বালক স্কুল থেকে ফিরছে, ওর হাতে সোনালী চায়ের প্যাকেট, মুখ শীর্ণ, পায়ে ধুলো, তখন ঘোড়াটা মাঠে চি-হি-চি-হি করে ডাকত।
মঞ্জু কেয়াকে বলল, মশারি টানালি না?
—টানাচ্ছি।
—নীলুকে তো কখন থেকে মশায় খাচ্ছে।
বেয়ার মনে হল সত্যি, ওর আজ কি-যে হয়েছে, এমন ভুল তার হয় না। একটু রাত হলেই সে নীলুর মশারি টানিয়ে দেয়। মঞ্জুদির বিছানা করে রাখে। মশারি টানিয়ে রাখে। আজকে তার কেন যে সব ভুল হয়ে যাচ্ছে।
সে তাড়াতাড়ি লাফ দিয়ে উঠে পড়ল। অনেক রাত হয়ে গেছে। ইদানীং ওরা অনেকদিন এত রাত করে শোয়নি। চোখ জ্বলছে কেয়ার। সে নীলুর মশারি টানিয়ে দেবার সময় বলল, তুমি একটু বোস। আমি সব করে দিচ্ছি।
এবং কেয়ার খুব তাড়াতাড়ি কাজ করার স্বভাব। এই যে বসে একটু হরিতকি মুখে দেবে ওতেই মঞ্জু, দেখবে, কেয়া সব কাজ সেরে ফেলেছে। কিন্তু কখনও কখনও এ-জন্য কেয়ার কাজে ভীষণ খুত থেকে যায়। হয়তো বিছানা না ঝেড়েই সব পেতে রাখল, মঞ্জু শুতে গিয়ে বলবে, তোকে আর আমার কাজ করতে হবে না কেয়া, এবারে তোকে বিয়ে দিতে হবে। কাজ করার সময় তোর মন কোথায় থাকে!
মঞ্জু এক গ্লাস জল নিয়ে অতীশের ঘরে ঢুকে গেল। মশারি ফেলা। নীল রঙের নাইট ল্যাম্প জ্বালানো। মশারির ভিতরে কিছু দেখা যায় না। অতীশ ঘুমিয়ে আছে কী জেগে আছে সে বুঝতে পারল না। গত রাতে সে দরজা বন্ধ করে শুয়েছিল, আজও দরজা বন্ধ করে শোবার কথা, কিন্তু সে তা করেনি। অবশ্য মঞ্জু জল না রেখে গেলে সে দরজা বন্ধও করতে পারে না। এবং দেখল, পাশে বেশ তাজা গোলাপ। বড় বড়, লাল সাদা গোলাপ। সবগুলো ওর মাথার কাছে। এত কাছে কেয়া কেন যে গোলাপের গুচ্ছগুলো রেখে গেল।
মঞ্জু শিয়রের কাছে জল রেখে বলল, সোনা তোমার জল।
অতীশ বলল, ঠিক আছে।
অতীশ তবে ঘুমোয়নি। কি কথা বলে সে এ-ঘরে আর একটু সময় কাটাবে বুঝতে পারে না। মঞ্জু কি ভেবে বলল, দরজাটা বন্ধ করে দাও?
—না, থাক। হাওয়া দিলে নড়ে। আমার তখন ঘুম আসে না। খোলা থাকলে দরজা নড়ে না।
মঞ্জু চারপাশে দেখে বলল, দ্যাখো মশারি ঠিক মত গোঁজা আছে কিনা, সে একদিকে আর একটু গুঁজে বলল, কেয়ার সব কাজ তাড়াহুড়ো করে করার স্বভাব। এটা কেন যে হয়েছে বুঝি না। যা বড় বড় মশা!
অতীশ মশারির ভিতর পাশ ফিরে শুল।—এত যত্নে ঘুম আসে না মঞ্জু।
—কলকাতায় শো কেমন?
—মশা নেই। এবার যাও। ঘুমোও গে। সকালে উঠে অনেক পরামর্শ আছে। অনেক রাত হয়েছে।
মঞ্জু আর কেন যেন এ-ঘরে থাকতে সাহস পায় না। অতীশকে সে কিছু বলবে বলে যেন জলের গ্লাস নিয়ে এসেছিল। কিন্তু অতীশ যে-ভাবে ওকে যেতে বলছে, ওর আর কিছু বলতে সাহস হচ্ছে না। তবু বলল, সোনা তুমি হয়তো আমার ওপর ভীষণ রাগ করেছ।
—রাগ করব কেন?
—তোমাকে অহেতুক একটা এমন বিপদে টেনে আনলাম।
—আমি এটা আদৌ ভাবছি না।
—না ভাবলেও, আমার সব খুলে বলা উচিত।
—তুমি কি বলবে জানি।
—না জান না।
অতীশ এবার উঠে বসল। বলল, কি জানি না বল?
—তুমি জান না নীলু আমাদের বিয়ের আগের সন্তান।
অতীশ মাথা নিচু করে রাখল। বলল, তা আমি জানি না।
—তুমি জান না, ভাবনী আমাকে ভালবাসত না।
—সে তুমি বোধ হয় একবার কি প্রসঙ্গে বলেছিলে।
—তুমি অবনীকে আমার কিছু শৈশবের কথা বলেছিলে!
অতীশের গলা কেমন শুকিয়ে কাঠ। সে এ-সব কিছুক্ষণ আগে ভেবেছে। এখন ঠিক সেই সব জেরা। অতীশ বলল, আমাদের তিনজনের একটা গোপন প্রতিযোগিতা ছিল মঞ্জু। কাকে তুমি বেশি ভালবাসো এই নিয়ে। আমি নানাভবে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছি তুমি আমাকে বেশি ভালবাসো। তুমি আমাকে যে-সব শেখাতে, তা কিছু কিছু অবনীর কাছে জয়ী হবার জন্য বলেছি।
মঞ্জু বলল, অবনী খুব ধূর্ত ছিল।
—অবনীকে একগুঁয়ে জানতাম।
—না, সে একগুঁয়ে নয়। ওর মনে ছিল, আমাকে সে যে-কোন ভাবে অধিকার করবে। বাবা আমাকে চন্দননগরে পাঠিয়ে দিলেন। দেশ ভাগের পর তোমরা গেলে, তার তিন চার বছর পরেই। অবনী সেখানে হাজির। ওর বাবার পয়সা ছিল, অবনী কাজের নামে আমার মামার বাসায় গিয়ে উঠে। আমার মামারা এটা পছন্দ করতেন না। আমাকে আবার বাবার কাছে পাঠিয়ে দিলেন।
অতীশ বলল, আমি জানি তুমি পরে কি লবে। কিন্তু তুমি বিশ্বাস কর মঞ্জু, তোমার কোন অনিষ্ট করতে চাই নি।
—অবনী ভেবে ফেলল, খারাপ মেয়ে আমি। সুতরাং সে খারাপ মেয়েকে অতি সহজে শিকার করার আশায় বাবার কাছে কবিরাজী শিখতে লেগে গেল।
—তুমি অবিনাশদাকে সব খুলে বলতে পারতে।
—সে আমাকে তোমার ভয় দেখিয়েছিল। সেই বয়সে, ওটা আমাদের বয়স বাড়ার সময়, চারপাশের সব কিছু থেকে কি করে যে জেনে ফেলেছি সব, অথচ ভিতরে প্রবেশ করার সামর্থ্য নেই—সেইসব ছেলেমানুষী ঘটনা নিয়ে সে আমাকে কলঙ্কের ভয় দেখাতো।
—অবনীর ব্ল্যাকমেল করার স্বভাব ছিল বলছ!
—তা ছাড়া এটা কি বলবে! সে বাবার কাছে কি যে ভাল মানুষ, এবং তুমি তো জানো আমি সব পারি, কিন্তু তোমাকে ছোট করতে পারি না। কারণ তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমি তোমার সব জেনে ফেলেছিলাম।
অতীশের কেমন সংকোচ হচ্ছিল এ-প্রসঙ্গে কথাবার্তা বলতে। কিন্তু মঞ্জু অনায়াসে বলে যাচ্ছে। ওর মুখে আটকাচ্ছে না। ওর যে বলার ইচ্ছা ছিল, মঞ্জু আমারও ভীষণ ইচ্ছা হত। কি যে রোমাঞ্চ সেই বয়সে, তোমার ভেতরে তখন কি আশ্চর্য রহস্যময়তা! এখন আমি সব মনে করতে পারি। আমারও ভীষণ ইচ্ছা করত। মুখ ফুটে বলতে পারতাম না।
অতীশ চুপ করে থাকল। কোন কথা বলল না। মশারির পাশে দু’জন মুখোমুখি বসে রয়েছে। মঞ্জু আরও যেন কত কথা বলবে। মঞ্জু কি ভেবেছে, সারা রাত ঘুমোতে দেবে না। সে বুঝতে পারছে না, আসলে মঞ্জু কি বলতে চায়। ওর এমন কি কথা যা আজ না বললে ওর সব মিথ্যা হয়ে যাবে। মঞ্জু পরেছে চওড়া হলুদ পাড়ের শাড়ি। চোখে চশমা পরার সঙ্গে সঙ্গে যেন ভারী হয়ে উঠছে তার গাম্ভীর্য। ওর চুল ঘাড়ে ছড়ানো। এবং পাখার হাওয়ায় সহজে শুকিয়ে নিয়েছে। গলায় সরু হার, হাতে একগাছা করে সোনার চুড়ি। সবই একরকমের, কেবল দেখতে পাচ্ছে, চোখ বড় বড়, কতদিন অবনী মারা গেছে, কতদিন তার এ-ভাবে একা রাত-যাপন! যে একবার অভ্যাসের ভেতর পড়ে যায়, অভ্যাস বন্ধ হয়ে গেলে তার বোধ হয় খুবই কষ্ট। অতীশের কাছে কি মঞ্জু সেই কষ্ট লাঘবের জন্য এসেছে!
কিন্তু আশ্চর্য মঞ্জু বলল, জানো মুর্শেদকে সেই নিয়ে এসেছিল।
অতীশ ভাবল, মুর্শেদ কি মঞ্জুর তবে ভালবাসার মানুষ না। সে তো কিছু জানে না। অতীশ তাকিয়ে থাকল।
—মুর্শেদ এসেছিল ওষুধ নিতে। ওটা ওর বোধ হয় ছলনা। সে আমাকে একদিন স্কুল ফেরত রাস্তায় দেখেছিল। এবং তখন থেকেই খোঁজ-খবর! কে এই মেয়ে! তারপর খোঁজ-খবর, অবনীর সঙ্গে বন্ধুত্ব, সে আমার কাছে এলে তার স্ত্রীর কথা ভুলে থাকতে পারত। মুর্শেদ ঠিক তোমার মতো, সে বেশি দূর যেতে পারে না।
অতীশ বলল, ওকে দেখে আমারও এমন মনে হয়েছে।
মঞ্জু একটু হাসল এবার। অতীশ কথার পৃষ্টে কথা বলে যাচ্ছে। সে আর অধিক কিছু বুঝি এখন করতে পারে না।
মঞ্জু বলল, তুমি ওকে ঠিকমতো পৌঁছে দিও। তারপর বলল, সোনা তোমাকে আমার হয়ে আর একটা কাজ করতে হবে। মুর্শেদকে নিয়ে যাওয়া যতটা দরকার তার চেয়ে বেশী জরুরী একটা পান্ডুলিপি তুমি তো শুনেছি ওপারে লিখে টিখে বেশ নাম করেছ। পান্ডুলিপিটার কোনও একটা গতি যদি করতে পার। সমসেরকে কথা দেওয়া আছে। সমসের বেঁচে থাকলে কত বড় লেখক হত। তারপর ফের থেমে বলল, মানুষের কাছ থেকে, আমি চিরদিন অবহেলা পেয়েছি, সব মানুষের কাছ থেকে, একমাত্র মুর্শেদ আমাকে ভাবত, আমার কিছু আছে। মানুষ মানুষকে মূল্য না দিলে এ-সব হয়।
এ-সব বলে মঞ্জু কি বোঝাতে চাইছে বুঝতে পারছে না।
—এই এট্রসিটিজ! পাকিস্তানের মানুষেরা আমাদের কোন মূল্য দিতে শিখল না। না ভাষার, না জাতির। সেই এক ট্রেডিশান আমরাও দেশ ভাগের আগে বোধ হয় ওদের দিই নি। কেয়াকে দেখলে এখন এটা বেশি করে বোঝা যায়।
অতীশ ভেবে পেল না, মঞ্জু তাকে এমন কথায় কি বোঝাতে চাইছে। মঞ্জু কি গুছিয়ে বলতে পারছে না! সে কি বলতে চায়, আসলে জন্মেই মানুষ যুদ্ধক্ষেত্রে বড় হয়। প্রত্যেকের একটা ঘোড়া থাকে জীবনে। সে তার ওপর চড়ে বেড়ায়। সে সবসময় রাজা হয়ে বাঁচতে চায়। কিছু সে ছাড়তে রাজি না।
মঞ্জু তখন বলল, মুর্শেদকে ঠিক মতো পৌঁছে দিলে আমার আর কোন দুঃখ থাকবে না। পান্ডুলিপিটার গতি হলে আমার আর কোনও দুঃখ থাকবে না। মুর্শেদ নিজের জীবন পণ করে আমার জীবন রক্ষা করেছে।
অতীশ বলল, কথা দিলাম মঞ্জু। আমার অনেক বন্ধুবান্ধব আছে। আমার মুশ্লিম বন্ধুও আছে। যে- ভাবেই হোক ওকে বর্ডার পার করে দেবার ব্যবস্থা করব। অন্তত পাকিস্তানের একটা লোক তো জানবে আমরা ওদের শত্রু নই। তাই বা কম কি
মঞ্জু উঠে দাঁড়ালো। যেন চলে যাবে। সে বলল, পাখাটা একটু বাড়িয়ে দেব?
অতীশ বলল, না।
মঞ্জু যেতে যেতে বলল, তুমি তো জানো আমার মা আত্মহত্যা করেছিল। কেন করেছিল তখন জানতাম না। এখন মনে হয় আমার মা কোনও কারণে আমার চেয়ে বেশি দুঃখী ছিল। না হলে এ- ভাবে কেউ জলে ডুবে আত্মহত্যা করে না।
অতীশ পাশে পাশে হাঁটতে থাকল। কেমন মৃদু সৌরভ ওর শরীরে। বোধ হয় সে চুলে গন্ধ তেল মাখে। শরীরের সবকিছু এত বেশি মহিমময় যে সে পাশে হাঁটতে ভয় পেল। মঞ্জুর পোশাক, ওর আলগাভাব কেন যে ওকে লোভী করে তোলে।
মঞ্জু বলল, কাল তোমরা থেকে যাও। পরশু যাবে। সব চল ঘুরে ফিরে দেখি। আবার কবে দেখা হবে কে জানে!
অতীশ বলল, ঠিক আছে।
মঞ্জু বলল, তুমি কিন্তু এতটুকু বদলাও নি।
অতীশ বলল, বদলেছি, তুমি টের পাচ্ছ না। ফতিমা কিছুটা জানে। তারপর যেন বলার ইচ্ছে হল ফতিমার সঙ্গে দেখা না হলে আমার বোধ হয় আরোগ্য লাভও সম্ভব হত না।
—তা হলে অভিনয় করছ, যা না তুমি, তাই ব্যবহারে দেখাচ্ছ।
—তা ছাড়া কি!
মঞ্জু বলল, তবে ওদের দোষ দিয়ে কি লাভ। যুদ্ধ ব্যাপারটাই খারাপ। বিশ্বাস না হারালে যুদ্ধ বাধে না। মানুষ বিশ্বাস হারালে সব হারায়। আমি এ-জন্য কিছু মনে করি না।
অতীশ বলল, এ-সব বড় বড় কথা। তবে বুঝি, এ-সব যোদ্ধারা বীরের মতো কাজ করে নি। ওরা বিবর ঘাঁটিতে মেয়েদের রেখে নানাভাবে ভোগ করত শুনেছি।
মঞ্জু ঘুরে দাঁড়ালো। পরাজয়ের মুখে মানুষ অনেক কিছু করে ফেলতে পারে। আমরা নানাভাবে এই সংসারেই এমন কত হীন কাজ করে বেড়াচ্ছি। আর এতো যুদ্ধক্ষেত্র। তুমি অবনীর কথা ভাবো।
আসলে মঞ্জু মুর্শেদের জন্য ওকালতি করতে এসেছে। অতীশের যদি কোনও কারণে বিদ্বেষ থাকে, সে যদি কোনও কারণে ওকে ধরিয়ে দেয়, মানুষের স্বভাব তো, বিশ্বাস কি, সেজন্য সে বারবার ওদের হয়ে যেন মাপ চেয়ে নিচ্ছে। বলছে, মুর্শেদের মতো মানুষেরাও আছে। এরা কেন সাজা পাবে! এরা তো কোন দোষ করেনি!
অতীশ এবার ফিরে এল। মঞ্জু কথা বলতে বলতে অন্ধকার ঘরটায়, সেই যে বাঘ হরিণ সব দেয়ালে রয়েছে, সে ঘরটায় মঞ্জু হারিয়ে গেলে শুধু অন্ধকার থাকে। এই যে একটা ঘর মাঝখানে, মঞ্জু কেন যে এখানে আলো জ্বালে না, সে বুঝতে পারে না। দু’ঘরের মাঝখানে সে একটা বিরাট শূন্যতা রাখতে বোধ হয় ভালবাসে। এবং এ-ঘরটায় অন্ধকারে ঢুকতে অতীশ ভয় পায়। আর মনে হয় মঞ্জু অনেকক্ষণ ঘরটায় অন্ধকারে এক দাঁড়িয়ে থাকতে ভালবাসে। সে ফিরে এসে এবার ঘুমোবে ভাবল। মঞ্জুর রাখা জল সে ঢক ঢক করে খেয়ে নিল। তারপর সোজা শুয়ে বুকের ওপর হাত রেখে চোখ বুজল।
সে পরেছিল পাজামা পাঞ্জাবী। সাদা পাজ্ঞাবী। ডোরাকাটা পাজামা। ওর চশমাটি ঢিপয়ে। অন্যদিন রাতে সে বই পড়তে পড়তে ঘুমায়। এখন এত রাত যে, সে বই পড়তে আর সাহস পায় না। ঘুমোবার জন্য চোখ বুজলে দেখল, কেমন আবছা মতো সব শৈশবের ঘটনা, উৎসব, দুর্গাপূজা, চোখের ওপর ভেসে বেড়াতে থাকল।
আসলে মঞ্জুর শৈশব থেকেই একটু বেশী শরীরের প্রতি আকর্ষণ। সবারই থাকে, তবে ওর যেন বেশী এবং মঞ্জুর শৈশবের শরীর চোখের উপর নাচতে থাকলে সে কেমন ভিতরে ভিতরে পাগল হয়ে গেল। তার নির্মলা আছে। তবু বিবর ঘাঁটিতে একজন সৈনিকের যা ইচ্ছা থাকে, যুবতী মেয়ের দৃশ্য পাশাপাশি ঝুলে না থাকলে জীবনধারণে যেমন একঘেয়েমি থাকে, সেও তেমনি জীবনে নানাভাবে ভন্ডামীর আড়ালে সরল সহজ থেকেছে। সে তার ইচ্ছার কথা কোনও দিন খুলে বলতে পারে নি। সে যা ভাবে, পৃথিবীর যে কোন পয়লা নম্বরের লম্পট তার চেয়ে বেশি ভাবতে পারে না। সে নিজের ভিতরে কোনো যুদ্ধক্ষেত্র আবিষ্কার করে ফেলে তখন। সে একা। যুদ্ধক্ষেত্র, সাদা ঘোড়া, কোন রমণীর পোশাক, বার বার সে পোশাক খুলে রমণীকে উলঙ্গ দেখতে চায়। সে এবার উঠে বসল। মাথা কেমন গরম হয়ে যাচ্ছে। এবং মনে হয় এখন সে নিজেই চুরি করে কেয়া অথবা মঞ্জুর ঘরে চলে যাবে। ওর শরীর কাঁপছে। কেয়া অথবা মঞ্জু কি চায় সে জানে! সে তার চোরা স্বভাবে সকালে ভাল মানুষের ব্যবহার, আর অন্ধকারে সে নিজের চুল নিজে ছিঁড়তে চায়। বিবর ঘাঁটিতে একজন লম্পট সৈনিকের চেয়ে সে কোনো অংশে কম ইতর নয়।
এবং এ-ভাবে সে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল জানে না। ঘুম ভাঙল কেয়ার চিৎকারে। কেয়ার আকাশ ফাটা আর্তনাদ। মঞ্জুদি নিলু নেই। নীলুর ছুটি হয়ে গেছে।
অতীশের বুকটা কাঁপছিল। ওর শরীরে ঠিক যেন শক্তি নেই। জানালায় ফাঁকা মাঠ। সকাল এবার হবে হয়তো। আর কেউ কাঁদছে না, ছেলেমানুষের মতো কেয়ার কান্না, নীলুর ছুটি হয়ে গেছে মঞ্জু দি। শিগগির এস।
কোনও প্লাটফরমে ঘুম ভেঙ্গে গেলে, সব অচেনা লাগে, কিছু মাথায় আসে না, কোথায় কি আছে বোঝা যায় না, নিজেকে বোকা বোকা লাগে, তেমনি সে এখন জেগে গেলে ভাবল, কেয়া কাঁদছে কাঁদুক, তার সাহসে কুলাচ্ছে না, সে আরও ভীতু হয়ে পড়েছে, সে মশারির নিচে দু’হাটুর ভিতর মাথা গুঁজে বসে রয়েছে, সব কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।
সে এ-ভাবে কতক্ষণ বসে ছিল জানে না। মুর্শেদ এসে ডাকল, সোনাবাবু, আসুন।
সে যেন মুর্শেদকে অনুসরণ করছে। নীলুর একটা কিছু করতে হয়।
অতীশ বলল, হ্যাঁ তা দরকার।
অতীশ দেখল, মঞ্জু নীলুর শিয়রে বসে রয়েছে। কেমন নির্বিকার। দীর্ঘদিনের প্রস্তুতি তাকে কিছুটা যেন নির্বোধ করে রেখেছে। কাঁদছে না। কেবল কেয়া নীলুর বুকের ওপর পড়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আসলে মঞ্জু বোধ হয় জানত, এত বড় আঘাত সে সহ্য করতে পারবে না। কিছুটা সে সে-জন্য কেয়াকে ভাগ দিয়ে দিয়েছে। শেষদিকে কেয়ার কাছেই নীলু থাকত। মাঝে মাঝে মঞ্জু এসে বসত মাত্ৰ।
এই ঘরটা তুলনায় ছোট। নীলুর খাট আরও ছোট, নীলুর মুখ সাদা চাদরে ঢাকা। কে ঢেকে দিল অতীশ জানে না। মঞ্জু না কেয়া! নীলুর সাদা পা দেখা যাচ্ছে। চাদরে মুখ ঢেকে দিলে পা বের হয়ে যায়।
অতীশের মনে হল, এ-ভাবে মঞ্জু পাথরের মতো বসে থাকলে খারাপ হতে পারে। ওর কাঁদা উচিত। এও হতে পারে, মঞ্জু সব বিলাপ আগেই সেরে রেখেছে। কারণ সে তার ভবিতব্য জানে। প্রতিদিন সে শোকের ভিতর থেকে আজ বোধ হয় ভাবছে ছুটি পেয়ে গেল। তার মোটামুটি যা দায়িত্ব ছিল সব শেষ। তার কিছু আর দায় পড়ে থাকল না। সে শৈশব থেকে যা কিছু নিয়ে বড় হয়েছিল, এই যেমন গাছ বড় হলে ডালপালা মেলে বড় হয়ে যায়, ঋতুতে ফুল ফল আসে আবার ঝরে যায়, তেমনি মঞ্জুর এখন সব ঝরে গেছে। যেন সে শৈশবের মঞ্জুর মতো। বলে উঠতে পারে সে, যাবে সোনা ঘোড়ায় চড়ে আমরা হাসান পীরের দরগা পার হয়ে যাব।
অতীশ নীলুর মুখের চাদর খুলে দেখল। ঠিক ঘুমিয়ে আছে যেন। সে বুকে হাত দিল। বুকে সামান্য উষ্ণতা জেগে রয়েছে। হাত-পা শক্ত হয় নি। ভোর রাতের দিকেই নীলু ছুটি নিয়েছে। খুব একটা দেরি হয় নি কেয়ার জাগতে। হাত-পা শক্ত হতে সময় নেবে। ফুলের মতো ছেলেটা নির্বিঘ্নে ঘুমিয়ে আছে। বোধ হয় ফুলের মতো ছেলেরা মরে গেলে মুখে কোন কষ্টের চিহ্ন থাকে না। অতীশ নীলুর মুখে এতটুকু কষ্টের ছাপ দেখল না। চোখ দুটো বোজা। মুখের এক কোণে সামান্য দুষ্টু হাসি। যেন বলছে, বুঝলে হে এই হচ্ছে ঈশ্বরের বাগান।
গোপনে অতীশের ক’ফোঁটা চোখের জল পড়ে গেল। কেউ দেখল না হয়ত।
ওদিকে মুর্শেদ, সেও দেখছে নীলুকে। সে চাদরের নিচে হাত দিয়ে দেখছে পা কতটা ঠান্ডা। সে কি এখন তেমনি খেলা দেখাবে, সেই তাজিয়া নিয়ে সে যেমন ইন্টালির দরগা থেকে রাজাবাজারের মসজিদে আসত ছুটে ছুটে। সে কি ভেবেছে, এখন যদি এই করে আল্লা ফু ইত্তা ফু অথবা অন্য একরকমের দ্রুত ধাবমান অশ্বের গতি নিয়ে হাতে তাজিয়া নিয়ে মেতে যায় তবে নীলু কি ফিক করে হেসে দেবে। সে কি বিশ্বাস করতে পারছে না, নীলু মরে গেছে!
অতীশ বলল, এস ধরি আমরা। বাইরের বারান্দায় বের করে নিতে হবে।
কেয়া যে-ভাবে পড়ে আছে নীলুর বুকে মুখ রেখে, কিছুতেই তাকে সরানো যাবে না। কেয়া এ- ভাবে পড়ে থাকতে পারে, এবং কেয়া কি বিশ্বাস করতে পারছে না এখনও, সে কি বুকে কান রেখে মৃদু সেই শব্দ, দূরাগত শব্দ, শুনতে চায়! আর জব্বার চাচা এখন এই বাড়ির চারপাশে সবচেয়ে সবুজ গাছটি খুঁজে বেড়াচ্ছেন, যার কাঠে এই সুন্দর শিশুকে দাহ করা হবে।
অতীশ ডাকল, কেয়া।
কোনও সাড়া নেই।
—কেয়া ওঠো। ওকে আমারা বের করে নেব।
কোনো সাড়া দিল না।
মঞ্জু বলল, কেয়া ওঠ। ওকে আমাদের বের করে নিতে হবে।
এত শক্ত মঞ্জু! সে যেন এবার বেশ সাহস পেয়ে গেল। বলল, তুমি কেয়াকে তুলে নাও। ও ছাড়বে না নীলুকে।
মঞ্জু পাশে বসল কেয়ার। ওর মাথায় হাত বুলাল। নীলু যেন মঞ্জুর কেউ হয় না। অথবা দূর সম্পর্কে কোনও আত্মীয়তা আছে, নীলুর যা কিছু সম্পর্ক এই মেয়ে কেয়ার সঙ্গে। অতীশ ক্রমে বিস্মিত না হয়ে পারছে না। মঞ্জু এত নিষ্ঠুর হতে পরে কি করে! মঞ্জু কেয়াকে এক সময় প্রায় বুকে নিয়ে জড়িয়ে বসল। এবং মুর্শেদ পায়ের দিকটা, সে মাথার দিকটা ধরে ক্রমে ঘর পার হয়ে, সেই বাঘ ভালুক অথবা হরিণের ছবির পাশ দিয়ে ওকে বারান্দায় এনে রাখল।