2 of 2

ঈশ্বরের বাগান – ৮০

॥ আশি ।।

অতীশের মনে হয়েছিল এ-বাড়িতে কোথাও একটা ভীষণ গণ্ডগোল ঘটে গেছে। সে যখন কেয়াকে নিয়ে ফিরে এসেছিল, তখন থেকেই কেমন ফিস্‌ফিস্ গলায় কথাবার্তা। মঞ্জু একবার এমনও যেন বলেছিল, খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, একবার ইচ্ছে হল বলে, কিন্তু ওর সামনে মঞ্জু এত স্বাভাবিক যে, ওর কিছু হারিয়েছে কিছুতেই বিশ্বাস করা যায় না। সে যে রাতে কাউকে দেখেছিল, তা জিজ্ঞাসা করতেও কেমন অস্বস্তি লাগছে।

.

এ-ভাবে সে ফিরে এসেই দেখেছিল মঞ্জু ভীষণ ব্যস্ত। কেয়াও কেমন অস্বস্তিতে পড়ে গেছে। সামনে পড়লেই চোখ মুখ স্বাভাবিক করে ফেলছে। আপনি সোনাবাবু বসে আছেন কেন, স্নান করে ফেলুন। মঞ্জুদির রান্না শেষ। আপনাকে খাইয়ে, মঞ্জুদি ওর নিজের রান্না করবে।

অতীশের ভাল লাগছিল না। কি হারিয়েছে মঞ্জু। মঞ্জু জীবনে এমন কি পেয়েছে যা হারাতে পারে। একবার মনে হল, মঞ্জু সব হারিয়েছে। ওর শৈশব হারিয়েছে, ওর ঘোড়া হারিয়েছে, ওর চেনা জগতের সব মানুষ হারিয়েছে। আর এ-ভাবে মানুষই সব কিছু হারায়। কিন্তু মঞ্জু্র হারানো আলাদা ধরনের, যা কেউ হারায় না, কেবল মঞ্জুর মতো মেয়েরাই তা হারায়। সে ভেবে পেল না তেমন কি মঞ্জু হারিয়েছে যা ওর সামনে প্রকাশ করতে সংকোচ, অথবা দ্বিধা।

যাই হোক সে স্নান সেরে নিয়েছিল। মঞ্জু ওর জন্য বসে থাকবে এটা ঠিক না। ওকে না খাইয়ে মঞ্জু নিজের নিরামিষ ঘরে রান্না করতে যাবে না। অথচ মঞ্জু শাড়ি পরে না। রঙের। ঠিক নানা রঙের না হলেও কুমারী মেয়েরা যেমন সাধারণ শাড়ি সায়া পরতে ভালবাসে, সেও তেমনি। সে যেন পোশাকে তার ভাগ্যের কথা লিখে রাখতে চায় না। অথচ আহারে এত বেশি নিয়মকানুন অতীশের ভাল লাগল না।

ওর খাওয়া হলে সে আরও বেশি টের পেয়েছিল কিছু হয়েছে। এমন কি জব্বার চাচা ডিসপেনসারির দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। সব মানুষদের তিনি ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছিলেন। আগামী কাল আসতে বলেছেন। ফলে ঘাটে যে সব নৌকা লেগেছিল এক এক করে চলে গিয়েছিল। পোস্টাফিসের নীল ডাকবাকসে কেউ কেউ চিঠি ফেলতে এসেছিল, তারাও চলে গেল। একটা ভয়ঙ্কর দুপুর ওর জানালায় খাঁ খাঁ করতে থাকল। শুধু পোস্টাফিসের জানালা খোলা। সেখানে একটা মুখ, গালে সাদা দাড়ি, সে ঝপাঝপ খামে পোস্টকার্ডে বাংলাদেশের ছাপ মেরে চলেছে। এবং জানালায় একটা কাক বসেছিল, সেটা কা কা করে ডাকছিল।

তারপর মনে হয়েছিল, এ-বাড়িতে কেউ নেই। সে ডেকেছিল, কেয়া। কোনও জবাব পায়নি। সে দরজা অতিক্রম করে সামনের ঘরটায় ঢুকে গিয়েছিল। সেখানে বড় বড় হরিণের মাথা, বাঘের ছাল, এবং পাখির ছবি দেয়ালে সেঁটে আছে। অবিনাশদা খুব জাঁকজমকপ্রিয় মানুষ ছিলেন, এ-ঘরে এলে সেটা টের পাওয়া যায়। এবং সব ঘরের দেয়ালে মৃত হরিণের ছবি। সে রাতে এ-সব ছবি দেখলে ভীষণ আঁৎকে ওঠে।

অতীশ তারপর দরজা পার হয়ে নীলুর ঘরে এসে বসেছিল। এখানে শুধু একজন ছোট্ট মানুষ বিছানায় ক্রমে মিশে যাচ্ছে। কি সুন্দর চোখ! সাদা চাদরে সে শুয়ে পাশ ফিরতে পারে না, সব কিছু তাকে করিয়ে দিতে হয়। সে খুব দুর্বল। হাত নেড়ে কোনরকমে একটা দুটো কথা বলতে পারে। এমন সুন্দর ছেলেরা পৃথিবীতে মরে যায়, অথবা যাবে ভাবতে সে কেমন অসহায় বোধ করছিল তখন। অতীশ দেখল, নীলু চোখ বুজে আছে। সে ঘুমিয়ে নেই অতীশ এটা বুঝতে পারছে। সে ডাকল, নীলু।

নীলু চোখ মেলে তাকাল।

—তোমার ভাল লাগছে?

—ভাল লাগছে।

—কোন কষ্ট হচ্ছে না তো?

—না।

—তুমি খেয়েছ?

—খেয়েছি। মা যাবার আগে খাইয়ে দিয়ে গেছেন।

—কোথায় গেছে ওরা?

—ওরা মুর্শেদ চাচাকে খুঁজতে গেছে।

—মুর্শেদ চাচা। সে কে!

—সে একজন আর্মি ডেজার্টার।

—কোন্ আর্মি।

—পাকিস্তানী আর্মি।

—সে এখানে কেন?

—মা তাকে থাকতে বলেছে।

—বলছ কি!

—হ্যাঁ মুর্শেদ চাচা খুব ভাল মানুষ। সে আমাকে সকালে কেবল তার ছেলেবেলার গল্প বলে। সে বলেছে, আমাকে একটা উট কিনে দেবে! আমরা দুজনে উটের পিঠে চড়ে পৃথিবী দেখতে বের হব।

—কিন্তু……… বলে অতীশ পায়চারি করতে থাকল। এমন একটা সময়ে মঞ্জুর এই আগুন নিয়ে খেলা। তা ছাড়া সে বুঝতে পারল না আর্মি থেকে কি করে ডেজার্টার হয়। সব তো আত্মসমর্পণ করেছে। লোকটা তা না করে পালিয়েছে! পালিয়ে এখানে এসে উঠেছে। অতীশ কেমন অবাক হয়ে গেল।

অতীশ বলল, নীলু, মুর্শেদ চাচাকে ওরা কোথায় খুঁজতে গেছে?

—জানি না।

অতীশের মনে হল, এত কথা ছেলেটার সঙ্গে বলা উচিত হচ্ছে না। কথা বললেই নীলু হাঁপিয়ে ওঠে। এখন তো বিকেল। ডিসপেনসারি তেমনি বন্ধ। ডাকঘরে তালা মেরে সে মানুষটাও চলে গেল। এখন এত বড় বাড়িতে সে একা। সে ঠিক একা না, নীলু আছে। নীলুর জানালা খোলা। সেখানে কামিনী ফুলের গাছ, গাছে একটা হলুদ রঙের পাখি। তার মনে হল, এত বড় বাড়িতে কেউ একা থাকতে পারে না। এত বড় বাড়িতে একা থাকলে লোক পাগল হয়ে যায়। আসলে এত বড় গ্রামটাতে একটা লোক নেই, কেন যে এ গাঁয়ের সব বাড়িগুলো খাঁ খাঁ করছে, নতুন বসতি গড়ে ওঠেনি। কারণ এটা তো নিয়ম, জায়গা খালি পড়ে থাকে না, জমি খালি পড়ে থাকে না, ঠিক কেউ না কেউ আবাদ করতে চলে আসে।

নীলুকে এ-ভাবে একা রেখে সবার চলে যাওয়া অতীশের ভাল লাগল না। সে ইচ্ছে করলে নিজের ঘরে বসে থাকতে পারত, কিন্তু এমন একটা খাঁ খাঁ বিকেল, অর্থাৎ সে দুপুর থেকে এই বিকেল পর্যন্ত এ-ভাবে একা এখানে কাটিয়ে দিয়েছে, কেউ নেই, শুধু অর্জুন গাছের নিচে ঘোড়াটা ঘাস খাচ্ছে, শুধু জানালায় তাকিয়ে আছে নীলু, আর সে পায়চারি করছে। কেমন ভৌতিক অথবা রহস্যজনক, সে এ- গ্রামে ঢুকেই তার গন্ধ পেয়েছিল, কারণ সব মানুষেরা, মৃত অথবা জীবিত, যে যেখানে আছে, এ- গ্রামের দৃশ্যপট তাদের কাছে অলৌকিক মায়ার মতো ছড়িয়ে আছে। কেউ ভুলতে পারে না, একটা গ্রাম, বর্ষাকালে শাপলা ফুল, খালের জলে মাছ ভেসে আসে, কত পাখি উড়ে আসে, যায়, কচ্ছপেরা ভেসে থাকে জলে, লটকন গাছে থোকা থোকা ফল, আর মায়াবী ভালবাসা। এই গ্রামের ফুলে ফলে তারা এখনও যেন বেঁচে থাকতে চায়। এই যে কেয়া, জব্বার চাচা, অথবা ডাকঘর এবং মানুষজনের আসাযাওয়া সব যেন ভৌতিক। আসলে সে হয়ত কাল থেকেই এমন একটা রহস্যজনক ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু সকালে কেয়া এবং সে, কেয়ার আর্ত চোখ, এ-সব মিথ্যা হয় কি করে!

এটা মনে হওয়া স্বাভাবিক। যখন খান সেনারা গ্রামের পর গ্রাম লুটতরাজ করেছে, গাঁয়ের মানুষজন পালিয়ে গিয়েছে, মেয়েদের নিয়ে বনবাসে চলে গেছে, এবং এমন একটা ছিনিমিনি ব্যাপার যখন হয়ে গেল তখন কিছু খালি ঘর-বাড়িতে ভৌতিক কিছু থাকবে না, সে কি করে হয়! আর সঙ্গে সঙ্গে ওর চোখের ওপর, নীলু এবং অর্জুন গাছের নিচে ঘোড়াটা পর্যন্ত রহস্যময় ঠেকছে। সে ডাকল, নীলু তুমি ঘুমিয়ে আছ?

নীলু চোখ বুজেই বলল, না।

—আমি একটু বাইরে যাচ্ছি, তুমি ভয় পাবে না তো?

—না।

—এত বড় বাড়িতে তুমি ভয় পাও না?

নীলু বলল, না।

সে কি করবে বুঝতে পারল না। নীলুকে একা ফেলে যাওয়া ঠিক না। অথচ সে ভিতরে খুবই ঘাবড়ে গেছে। হয়তো সে বাইরে থেকে ঘুরে এসে দেখবে নীলু পর্যন্ত নেই। আবার যখন সে ঘোড়াটি খুঁজতে যাবে, তখন দেখবে ঘোড়াটাও নেই।

এমন নিরিবিলি গাঁয়ে এসে এটা ওর হয়েছে। আর কলকাতা শহর, এবং শহরে বড় হতে থাকলে, মনেই হয় না, পৃথিবীর কোথাও নির্জনতা বলে কিছু আছে। এত বেশি নির্জনতা যে, মাঝে মাঝে ওকে ভীষণ ভয় পাইয়ে দেয়। সে গত রাতের ঘটনা এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। সে স্পষ্ট শুনেছে ওর দরজায় কে কড়া নাড়ছে। সুতরাং ওর মনে হল, নীলুকে ফেলে এখন আর কোথাও যাওয়া চলে না। ওকে দুটো একটা প্রশ্ন করে, সে বুঝতে পারবে, সে বেঁচে আছে, নীলু বেঁচে আছে, ঘোড়াটা বেঁচে আছে, এবং ঠিক সময় হলে কেয়া মঞ্জু, মুর্শেদকে নিয়ে ফিরে আসবে।

সে আবার বলল, রাতে ওকে দেখলাম মনে হল।

—চাচা পালিয়ে থাকে। তারপরই নীলু এটা বলে ঠিক করেছে কিনা বুঝতে পারে না। সে বলল, আমি জানি না। তারপর বলল মুর্শেদ চাচার কথা কাউকে কিন্তু বল না।

অতীশ আর ভৌতিক কিছু ভাবতে পারে না। নীলুর চোখমুখ ভয়ার্ত দেখাচ্ছে। সে বুঝল, নীলু মুর্শেদের কোন অনিষ্ট করে ফেলেছে এমন ভাবছে। সে বলল, আমি কাউকে বলব না। আসলে ঘোর। সেই নির্জন দ্বীপের মতো সে ঘোরে পড়ে যাচ্ছে। একটা ক্রস—তার নিচে সে বসে আছে। শেষে এই একটাই সম্বল মানুষের। তবে সে ভয় পাবে কেন। দেখাই যাক না।

—কাউকে না কিন্তু।

অতীশ আর ভৌতিক কিছু ভাবতে পারে না। নীলুর চোখমুখ ভয়ার্ত দেখাচ্ছে। সে বুঝল, নীলু মুর্শেদের কোন অনিষ্ট করে ফেলেছে এমন ভাবছে। সে বলল, আমি কাউকে বলব না। আসলে ঘোর। সেই নির্জন দ্বীপের মতো সে ঘোরে পড়ে যাচ্ছে। একটা ক্রস—তার নিচে সে বসে আছে। শেষে এই একটাই সম্বল মানুষের। তবে সে ভয় পাবে কেন। দেখাই যাক না।

—কাউকে না কিন্তু।

—কাউকে না।

—মাকেও না।

—মাকেও না।

—মা যদি জানে আমি বলেছি, তবে কষ্ট পাবে।

—মাকে কিছু বলব না নীলু।

আর তখনই ওর ইচ্ছা হল, সবাইকে সেও খুঁজতে বের হয়। লোকটা কোথায় গেল! বাড়ি থেকে চলে যাবার কারণ কি। সে পালাবে কি ভাবে! সে যাবে কি করে! ওর যদি পয়সা না থাকে, সে এখন একা মানুষ, ডেজার্টার হওয়ার কি দরকার ছিল। আত্মসমর্পণ অপেক্ষা ডেজার্টার হওয়া ভাল, কিন্তু কোথায় যাবে এবং ওর কেন জানি এ-ভাবে কোনো শৈশবে ফিরে গেলে ঠিক সেই এক ডেজার্টার মানুষের মতো বাবার চোখমুখ দেখতে পায়। দেশ ভাগের পরে ওর মনে হয়েছিল, মানুষেরা নিজের দেশ গাঁ ছেড়ে এমনি চোখেমুখে হয়তো ভারতবর্ষের মাটিতে একটু আশ্রয়ের জন্য ঘুরেছে। তখন তারাও সবাই ডেজার্টার ছিল।

অতীশ আপন মনে না হেসে পারল না। সে বুঝতে পারল, নীলু একা এ-ঘরে। নীলুকে দেখে আর কোনও কষ্ট পাবে না। ওর সব সহ্য হয়ে গেছে। সে এখন ইচ্ছামতো সামনের মাঠ পার হয়ে, এবং নানাবিধ ফুল ফলের গাছ পার হয়ে ঠিক অর্জুন গাছটার নিচে গিয়ে দাঁড়াতে পারে। সে সেখানে দাঁড়ালেই দেখতে পাবে, বিশ বাইশ বছর আগের মানুষেরা চারপাশে ওর ঘোরাফেরা করছে। ভূঁইয়া বাড়ি, ঘোষেদের বাড়ি, দত্ত পাড়া, পশ্চিম পাড়া এবং পালপাড়ার সব মানুষদের একটা মিছিল যাচ্ছে। ওদের মাথায় বাক্স পেটরা। ছোট ছোট শিশুরা হাঁটছে। হাতে ওদের কাঠের পুতুল। ওরা কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে, কেউ জানে না। ধর্ম মানুষকে ভিটে মাটি থেকে উচ্ছেদ করেছে। ধর্ম আজ মুর্শেদকে ডেজার্টার করেছে।

তার ইচ্ছা যেন, মুর্শেদকে দেখা হলেই বলে, মিঞা সাহেব আপনি এবারে নতুন ডেজার্টার। আমরা বিশ বাইশ সাল আগের। তা কেমন আছেন! ডেজার্টার হলে কেমন লাগে। বাংলা বুঝতে পারেন। আপনি তো পাকিস্তানী। উর্দুভাষা আপনার মাতৃভাষা। আপনি পাঞ্জাবী নন তো। আপনার গাঁয়ের পাশে যদি নদী থাকে, তার কি নাম বলবেন তো। এত ভাগাভাগি কেন মিঞা সাব! ভাগের শেষ আছে! যত ভাগ করবেন শরীর তত পঙ্গু হয়ে যাবে না?

অথচ দেখুন স্বভাব মানুষের এই, নিজের জন্য, নিজের পরিবারের জন্য একসময় সে তার সঠিক হিস্যা বুঝে নেয়। এত হত্যা, রাহাজানি ধর্ষণ ঘটিয়ে শেষপর্যন্ত তা বন্ধ করতে পারলেন! হয় তো বলবেন বড় হিস্যা হাত না লাগালে দেখা যেত।

তারপরই মনে হল সে বোকার মতো বড় বড় কথা ভাবছে। সে রাজনীতি করে না, সে তলিয়ে ভাবে না। এমন একটা জায়গার জন্য তার তেমন মায়াও নেই, কেবল মাঝে মাঝে যখন একটা ঘোড়া, তার ওপরে কোন বালিকার ছবি মনে হয় সে ভাবে ওটা একটা স্বপ্নের দেশ, সেখানে সে আর যেতে পারবে না, সেখানে কেউ ফিরে যেতে পারে না। এবং ওটা আছে বলেই মানুষ বেঁচে থাকতে ভালবাসে।

এবং মঞ্জুকে দেখলে এমন দুঃখী মনে হয়! অথচ সে সঠিক জানে না, কি হয়েছে! কেয়া কিছুটা বলেছে, সবটা বলেনি, চিঠি কেন কেয়া, অথবা মুর্শেদের কথা এভাবে গোপন রেখেছে কেন, সে তো ভেবেছিল সরাসরি জিজ্ঞাসা করবে মুর্শেদ কে? কিন্তু নীলুর মুখ দেখে এখন আর সরাসরি সে কিছু বলতে পারে না। না বলা পর্যন্ত তাকে মুর্শেদ সম্পর্কে চুপচাপ থাকতে হবে। সে ভিতরে ভিতরে অস্বস্তি বোধ করছে। মঞ্জুকে দেখে মনেই হয় না, সে তাকে চিঠি লিখে আনিয়েছে। যেন তার এমনি কোথায় যান, বলে যান না কেন?

—কাকে বলে যাব?

—কেন আমাদের।

কেয়া কাজ করছ্লি বলে, এক জায়গায় সে চুপচাপ বসছিল না। সে জানালায় দাঁড়িয়ে আছে। ওকে দেখলে মনে হবে, সে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। ঘরের ভিতর কি হচ্ছে বুঝতে পারছে না। কেয়া যে কাজ করতে করতে ওকে দেখছে সে টের পাচ্ছে না। সে দেখছে, জব্বার চাচা ঘোড়াটা এনে আস্তাবলের পাশে বেঁধে রাখছে। যে কাজ করে, সে আজ আসেনি। কিছু হয়তো তার হয়েছে। জব্বার চাচা তারপর বারান্দায় বড় একটা হাম্বল দিস্তা টেনে আনলেন। তিনি হরিতকি জায়ফল অথবা অন্য কিছু মূল, গাছের কান্ড সব মিলে ঠুং-ঠাং আওয়াজ তুললে যেন এ গাঁয়ের নির্জনতা আরও বেড়ে যায় অথবা মনে হয় জব্বার চাচা সেই প্রবাহমানতা ধরে রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। কেয়া তখন শুনল, সোনাবাবু বলছে, তোমরা তো কেউ ছিলে না। কোথায় গেছিলে!

কেয়া বুঝতে পারল মানুষটা তবে ঘুমায় নি। ওরা যখন যায় তখন যেন মনে হয়েছিল মানুষটা ঘুমিয়ে পড়েছে। দিবা নিদ্রা। সে বলল, ঘুম থেকে উঠে আমাদের দেখেন নি। ঠিক ভয় পেয়ে গেছিলেন।

—ভয় পাবারই তো কথা।

—মঞ্জুদি বলেছে ওর তো শহরে থেকে অভ্যাস। উঠে যখন দেখবে কেবল নীলু আর ঘোড়াটা আছে তখন ভয় পাবে।

সে বলল, তোমরা কোথায় গেছিলে?

কেয়া খুব বুদ্ধিমতীর মতো বলল, চন্দন বীচি তুলতে।

—চন্দন বীচি মানে?

—গাছে চন্দন গোটা হয় না। বনেজঙ্গলে পড়ে থাকে। ওগুলো তুলে না আনলে, চুরি হয়ে যায়। অতীশ বলল, তাই বন। চন্দন গোটা। চন্দন বিচি বুঝি না।

—কারা চুরি করতে আসে?

—যারা ডাকবাক্সে চিঠি ফেলতে আসে।

—ওগুলো দিয়ে তোমরা কি কর?

—কত কাজে আসে। বা’জান কি যেন করে। ওর ওষুধে লাগে, চন্দন গোটা ভিজিয়ে রাখা হয়। বড় বড় জালায় জল পুরে পচিয়ে রাখা হয়।

—চন্দন গোটা এক সময় আমরাও চুরি করতাম কেয়া। তখন কিন্তু ওটা অবিনাশদার ওষুধে লাগত না। ওর ছাল, পাতা, ডাল শুনেছি কবিরাজী ওষুধে লাগে। মঞ্জু আমাদের সঙ্গে তখন ভীষণ ঝগড়া করত। কাউকে সে চন্দন গোটা চুরি করতে দিত না।

কেয়া বলতে পারছে না, মুর্শেদকে খুঁজতে গিয়েছিল। গ্রিন সিগনাল না পেলে সে কিছুই বলতে পারে না। সোনাবাবু এখন ভারতবর্ষের মানুষ। সহসা একটা ঝামেলার কথা বললে কিভাবে নেবে ওরা জানে না। তার জন্য সময় এবং সুযোগ দরকার। মঞ্জুদি এখনও ভাবছে, সোনাবাবুর দুর্বল জায়গাগুলো তেমনি আছে। প্রশ্ন করলে টের পাওয়া যাবে, মানুষটা যেন এখনও তাদের মতো নারীদের সঙ্গে জ্যোৎস্নায় ঘুরে বেড়াতে ভালবাসে। বোধ হয় মঞ্জুদি এ-সব ভেবেই দেরি করছে। কিন্তু কেয়া যেন মানুষটাকে মঞ্জুদির চেয়ে বেশি চিনে ফেলেছে। সে দেখেছে সোনাবাবু লাজুক, ঝামেলায় থাকতে চায় না। সে তবু চালাকি করতে ছাড়ল না, বলল, সোনাবাবু আপনাদের যা ছিল, তা এখনও থাকবে ভাবছেন কেন।

—তা ঠিক। তবে, খুব পাল্টায় না। যতই বয়স বাড়ে, সময় পার হয়, মনে হয় অনেক কিছু পাল্টে যায়, আসলে তুমি জান না কেয়া আমরা বেশি কিছু পাল্টাতে পারি না। ভিতরে ভিতরে অসুখটা থেকেই যায়।

—কেউ কেউ তো আসে সব পাল্টে দিতে।

—কেউ কেউ আসে, তারা ভাবে পাল্টে দিয়েছে, মানুষও ভাবে, কিন্তু তুমি তো জান না কেয়া মানুষের অসুখটা আরও গভীরে। তা না হলে ভেবে দ্যাখোনা, আমাদের কথাই। আমরা এখানে ছিলাম, উৎখাত হলাম এখান থেকে, তবুও স্বপ্নটা থেকে গেল। উৎখাত বললাম এ-জন্য, ধর্ম আমাদের দু’তরফকেই বড় বেশি দূরে সরিয়ে রেখেছে।

—কৈ এখানে তো তা নেই।

—কেয়া তুমি ছেলেমানুষ। তুমি অত বুঝবে না। আবেগে আমরা অনেক কিছু করতে পারি। আবেগ থিতিয়ে গেলে, সব কেমন মরে যায়, তখন আবার মানুষের অসুখটা দেখা দেয়।

—অসুখটা থেকে নিরাময়ের কোন পথ নেই?

—আছে, তোমার মতো মানুষেরা যত বেশি নিরাময় হতে পারবে, তত বেশি আমরা কাছাকাছি আসতে পারব। মঞ্জুর মত মেয়ে আমরা কোথায় পাব বল। তারপরই সে কেমন ছেলেমানুষের মতো হা হা করে হেসে উঠল, খুব পাকা পাকা কথা হচ্ছে কেয়া। আমরা কেউ এসব বলার উপযুক্ত নই। যেন অতীশের বলার ইচ্ছে উৎখাত হবার মূলে কম বেশি আমরা সবাই দায়ী। সংশয় মানুষকে কতটা ঘোরের মধ্যে ফেলে দেয়, বনি, নির্মলা, অমলা, ফতিমাকে দিয়ে বুঝেছি। মঞ্জুর কথা ভুলেই গেছিলাম। সেও আমার আর এক ঘোর। একজীবনে ফতিমা, মঞ্জু, এক জীবনে বনি-নির্মলা। কেউ আমার কাছে ছোট নয় বড় নয়। আমার জীবনে তারা সবাই বড় দূরের নক্ষত্র। আমি তাদের কাউকেই ঠিক যেন চিনি না। সবাই নিজের মতো একটা পৃথিবী চায়। কেউ পায় কেউ পায় না।

কেয়া বলল, সোনাবাবু আপনাকে দেখলে আমার কিন্তু বড় বড় কথাই মনে আসে।

সে বলল, আমারও।

মঞ্জু তখন হেসে বলল, বড় বড় কথা বলতে সবারই ভাল লাগে। আমিও কম যাই না। এখানে আর একজনকে হাজির করছি, দেখবে সে আরও বেশি বড় বড় কথা বলবে। সে ডাকল, মুর্শেদ। মুর্শেদ এলে মঞ্জু বলল, ডেজার্টার। এরা তোমাদের ডেজার্টার করেছিল, আমরা এদের ডেজার্টার করেছি! বলেই হাসতে লাগল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *