2 of 2

ঈশ্বরের বাগান – ৭৫

।। পঁচাত্তর।।

মানুষ এ-ভাবে নানা সত্যাসত্যের মুখোমুখি হয়। অতীশ এসেই কি যে রহস্যের ভেতর পড়ে গেল। এক এক করে মঞ্জু ওকে অবাক করে দিচ্ছে। যেন মঞ্জু এখনও কিছু ভোলেনি, ভুলতে পারেনি। এমন কি সে দেখল, সেই চায়ের কাপটা পর্যন্ত হুবহু এক। সে কিছুক্ষণ কেবল মঞ্জুকে দেখছিল। চা যে ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে খেয়াল নেই।

আর মঞ্জুও ভারি উদাসীন মুখে অতীশকে দেখছে। ওরও মনে হচ্ছে না একবার মনে করিয়ে দেওয়া দরকার, অতীশ তোমার চা ঠান্ডা হচ্ছে। তুমি এ-ভাবে বসে থাকলে চা ঠান্ডা হয়ে যাবে। ঠান্ডা চা মানুষ খেতে পারে না।

ঘাটের কাঞ্চন ফুল গাছটার ফাঁক দিয়ে এলোমেলো সূর্যের আলো এসে পড়েছে বারান্দায়। বেশ দুটো একটা ডাহুক পাখির সাড়াশব্দ এখনও পাওয়া যাচ্ছে। বেলা হলেও ওরা ঝোপের ভেতর আশ্রয় নেয় না, বরং মনে হয় এখানে এরা নির্ভাবনায় আছে। কোন ভয় নেই এদের। মঞ্জু থাকলে বুঝি কারো কোনও ভয় থাকতে নেই। সেদিন রাতে কি যে একটা হয়েছিল, সে এখনও যেন বিশ্বাস করতে পারে না, দরজায় এমন শব্দ হয়! এবং মঞ্জুর মুখ দেখে এখন সাহসও হচ্ছে না, মঞ্জু তুমি সত্যি করে বলতো সে-রাতে ঠিক ঠিক কি হয়েছিল! কারণ মঞ্জুর মুখে ভারী আশ্চর্য কঠিন হাসি এখন, সে বুঝি আর কিছুক্ষণ এ-ভাবে চুপচাপ হাঁ করে তাকিয়ে থাকলে মঞ্জু হেসে দেবে জোরে।

সে তাড়াতাড়ি চায়ের কাপটা তুলে নিল। এবং দেখল, বেশ তাজা চা। সুন্দর গন্ধ। মঞ্জুর শাড়িতে এখনও বাসি গন্ধ জেগে থাকতে পারে, কিন্তু দেখেতো মনে হয় না, মঞ্জু শাড়ি না পাল্টে তার এত কাছে এসে দাঁড়াতে পারে। সে বরং এইসব ভাবনা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে চাইছে। মঞ্জু আরও কাছে এসে দাঁড়াল। কি দেখল যেন মাথায়, বলল, তোমার দুটো একটা চুল পেকেছে অতীশ।

—অতীশ বলল, তা পেকেছে। বয়স হয়েছে, চুলের কি দোষ বল।

—চুল পাকার তোমার বয়স হয়নি। আমার তো তুমি যতই খোঁজো একটাও পাকা চুল পাবে না।

—তোমার বয়সে মেয়েদের চুল পাকে না। মেয়েদের একটু বেশি বয়সে পাকে।

—কি যে বল! চাটা কেমন হয়েছে বললে নাতো?

—খুব ভাল। এখানেও তাজা চা পাওয়া যায় ভাবতে অবাক লাগে।

—চা ভালই পাবে। কিছুই তো বাইরে যাচ্ছে না। চা তো আমাদের ফরেন আর্নিঙস গুডস্। এখন তাও বন্ধ। আমরা খেয়ে ফুরোতে পারছি না।

অতীশ বলল, তোমার ছেলে কেমন আছে?

—ভাল। কাল ওর ভালো ঘুম হয়েছে।

—ওকে নিয়ে তুমি একবার কলকাতায় ঘুরে এলে পার! আমরাতো আছি।

—কি হবে?

—ওখানে ভাল ব্যবস্থা আছে। বড় ডাক্তার আছে।

—এখানে নেই তোমাকে এমন কে বলেছে!

—থাকতে পারে কিন্তু আমার ভরসা কম।

—তুমি চলে গেছ বলে এটা হয়েছে।

—চলে যাওয়ার কথা না মঞ্জু, তোমার কোনো কোনো ব্যাপারে আমার মনে হয় খুব একটা একগুঁয়েমি আছে। ওটা মেয়েদের থাকা খুব ভাল না। কলকাতা অনেক বড় শহর। অনেক সুযোগ- সুবিধা, ঢাকাতে এত সুযোগ-সুবিধা আছে বলে আমার ধারণা হয় না।

মঞ্জু হাসল।—তুমি দেখছি এসেই খুব অস্বস্তি ফিল করছ!

—অস্বস্তি কি এটা?

—অস্বস্তি না। আসলে তুমি ওর অসুখে কিছুটা কাতর হয়ে পড়েছ। আমার খুব কী ভাল লাগছে!

—এখানে তো অনেককে দেখালে, ওখানে অন্তত কেউ দেখুক।

এবার ভীষণ সিরিয়াস হয়ে গেল মঞ্জু। সে বলল, তুমি জান না এখানে বিদেশ থেকে ভিজিটিও ডাক্তার মাঝে মাঝে এসে থাকেন। বিখ্যাত হার্ট স্পেশালিস্ট ডাঃ রাইম এসেছিলেন। তিনি শুধু বলেছেন, ওটা পাল্টে না ফেললে কিছু করার নেই। আর একটা হার্টের দরকার। অবশ্য সেটা আমার আছে। বলে মঞ্জু থামল। কি বলতে গিয়ে সে থেমে গেল। যেন বাকিটা এই সকালে বলা কিছুটা বাড়াবাড়ি হবে। অতীশের দিকে সে মুখ না তুলে বলল, এসব কথা থাক। এটা আমার খুব ব্যক্তিগত চিন্তা এতে তোমাকে জড়াতে এখানে ডেকে আনিনি। অনেক কথা জমা হয়ে আছে। তোমাকে বাদে আর কাউকে বলা যাবে না। না বলতে পারলে আমার আফশোস থাকবে।

কি এমন কথা অতীশ বুঝতে পারে না। কখন যে ওর সময় হবে! তবু কিছু বলতে হবে বলে বলা, তুমি সকালে এখন চা খাও না মঞ্জু?

—খাব না কেন?

—আমাকে দিলে, অথচ তুমি নিলে না।

—আমারটা হচ্ছে। হলেই কেয়া নিয়ে আসবে।

—তোমারটা আবার আলাদা নাকি?

—তা একটু আলাদা বৈকি।

—সেটা খেয়ে দেখতে হয়।

—দেখতে দিলে তো! বলে প্রায় দৌড়ে ঘরে চলে যাবে এমন ভাবে তাকাল অতীশের দিকে। অতীশ বলল, তুমি আমাকে কেন জরুরী তলব পাঠালে বুঝতে পারছি না। আর খুব ভয় হচ্ছে। সেই লোকটার কথাও অতীশের বলতে ইচ্ছা হ’ল।

—ভয় পাবার মতো আমি তোমাকে কিছু বলব না।

—এখন তো ইচ্ছা করলে বলতে পার মঞ্জু। কেউ তো কাছে নেই।

—তোমার কি মাথা খারাপ। হাতে আমার এখন কত কাজ। দ্যাখো না, বলেই সে কাঞ্চন গাছটার ফাঁক দিয়ে কি দেখল, ঐ তো আসছে। জব্বার চাচা আসছে।

হঠাৎ এ-সকালে জব্বার চাচা আসছে, কি ব্যাপার। এখানে যেন মঞ্জু এতক্ষণ জব্বার চাচার জন্যই দাঁড়িয়ে আছে। জব্বার চাচা না ফিরলে সে ভেতরে যেতে পারে না ভেবে, অতীশ বলল, জব্বার চাচা বাদে চারপাশে আর কেউ নেই! বলে ঠাট্টার মতো জোরে হাসার চেষ্টা করল।

—থাকবে না কেন। আছে, থাকবে। কিন্তু জব্বার চাচা এলে ঠিক হবে সেটা। থাকবে কি যাবে।

—মানে।

—মানে ওকে আসতে দাও।

অতীশ দেখল জব্বার চাচা লগি মেরে নৌকা এদিকে নিয়ে আসছেন। এখন শরৎকাল, এবং এসময় এ-অঞ্চলে জল কমতে আরম্ভ করে। জলের একটা ঘাস-পচা গন্ধ ওঠে চারপাশে। জলের সব জলজ ঘাস জলের ওপর ভেসে ওঠার স্বভাব। জল বাড়লে যতটা সহজে নৌকা চালানো যায়, জল কমলে ঠিক ততটা সহজ হয় না, চারপাশের জলজ ঘাস ভেসে উঠলে নৌকা তাড়াতাড়ি চালানো যায় না।

জব্বার চাচা জলের ঘাস, শাপলা পাতা ঠেলে ঠেলে আসছেন। বুড়ো মানুষ। একটা গামছা পরেছেন। এবং সে, নৌকার গলুইতে কটা চাঁই পড়ে আছে দেখতে পেল। তাহলে জব্বার চাচা সকালে মাছের সন্ধানে বের হয়েছেন। গতকাল চাঁই পেতে রেখেছিলেন জলে, এখন সেগুলো তুলে আনছেন। মঞ্জু এবং একটু পর কেয়া এসে পর্যন্ত দাঁড়িয়ে গেছে বারান্দায়। জব্বার চাচা কি মাছ পেলেন সেটা খুব সকালে ওদের দেখার কৌতুহল। এমন কি সেই রুগ্‌ণ ছেলেটার পর্যন্ত। তাকে জানালায় মাছ তুলে দেখিয়ে আনতে হবে হয়তো।

অতীশ বলল, জব্বার চাচা মাছ না পেলে আমাকে বাজার পাঠাবে ভাবছ।

—দেখা যাক্। মঞ্জু ঠোটে বেশ সামান্য হাসি টেনে বলল।

অতীশ ভেবে পায় না, মেয়েটা এখনও এত বেঁচে থাকার প্রেরণা অথবা সব কিছু উপভোগ করার বাসনা জীবনের ভেতর টিকিয়ে রেখেছে কি করে! এতটা তছনছ জীবন, মেয়েদের যা কিছু দুঃখের, সব কিছুর সে হয়তো অংশীদার, অথচ মুখেচোখে এতটুকু সেজন্য হীনমন্যতার ছাপ নেই! সরল, অনাড়ম্বর, ঠিক সেই আগের মঞ্জুর মতো। কথায় কথায় হেসে ফেলতে পারে। অথচ সব সময় কেমন একটা উদাসীনভাব। অতীশ বলল, যাই বল, বাজারে আমি যেতে পারব না।

—জব্বার চাচা এলে সেটা ঠিক হবে।

আসলে জব্বার চাচা এলে কিছুই ঠিক হল না। অনেকদিন পর এত মাছ দেখে অতীশ কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না। বারান্দায় এসেই জব্বার চাচা চাঁইগুলো খুলে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে সব মাছ বের করে দিলেন। কত মাছ! বড় বড় গলদা চিংড়ি, বেলে মাছ, কটা আশ্চর্য লাল নীল রঙের কই এবং বড় ট্যাংরা, পাবদা। একটা মাছও মরেনি। এবং মাছগুলো সারা বারান্দায় যেন এখন ছড়িয়ে যাবে। কেয়া লাফিয়ে লাফিয়ে সব মাছ তুলছে। অতীশও দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। সে পর্যন্ত ছুটে গিয়ে একটা ছিড়ির মাথা চেপে ধরেছে। মঞ্জু দরজায় দাঁড়িয়ে আছে কিছুটা অভিজ্ঞ মানুষের মতো। কেয়া এবং অতীশের ছেলেমানুষী দেখে মনে মনে বোধ হয় মজা পাচ্ছে।

এবং এই সকালের সূর্য বেশ তখন হলুদ আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে গাছের মাথায়। বাঁ দিকে ডাকঘর, ডানদিকে ডিসপেনসারি, সামনে ঘাসের লন, লন পার হলে নানা-বর্ণের ফুল নিয়ে বাগান, এবং সকাল বলেই ঘাসে ঘাসে এখন কুয়াশার জল। শরতের বিন্দু বিন্দু আকাশ ধোয়া শিশির দানা মুক্তো হয়ে ছড়িয়ে আছে ঘাসে ঘাসে। দূরে কোথাও কোনও মোরগের ডাক। চারপাশের কলরবের ভেতর এমন একটা ছবি দেখতে বোধ হয় মঞ্জুর ভীষণ ভাল লাগছে। কি সুন্দর লাগছে সকালটা। ওর একমাত্র যে ছেলে, যে আজ কাল অথবা পরশু মরে যেতে পারে, মঞ্জুর চোখ দেখে তা মনেই হয় না। যেন

মঞ্জু এমন সকাল অনেকদিন পর, ঠিক অনেকদিন পর বললে ভুল হবে, যেন দীর্ঘদিন সে এমন একটা সকালের প্রতীক্ষায় সারাজীবন বসেছিল। সে এবং অতীশ। এক নির্জন মাঠে যেন দাঁড়িয়ে ঈশ্বরের অনন্ত রহস্য আবিষ্কার করে ফেলে অবাক হয়ে গেছে। যেন বলছে, যা, কি যে হয়ে গেল!

আসলে মঞ্জুর চোখদুটো দেখলে বোঝা যায় সে এখন খুব সুদূরে চলে গেছে। জব্বার চাচা এখন ওদের মাছ তুলে দিতে সাহায্য করছেন। মাছগুলো একটা ঝুড়িতে তুলে তিনি চাঁইগুলো পরিষ্কার করে ফেললেন। তারপর মুখ বেঁধে শেফালীগাছের নিচে রেখে দেখলেন বেলা কত হল। ডিসপেনসারির দরজা খুলে দিচ্ছে অলিমদ্দি। সকালের রোদ ঘাসের ছায়া পার হয়ে লম্বা হয়ে ঢুকে গেছে জানালায়। বড় বড় কাচের আলমারিতে রোদের ছায়া চিকমিক করছে। ওঁর নামাজের সময় চলে যায়। তাড়াতাড়ি অজু করে ডিসপেনসারি ঘরের লম্বা চকিতে ছোট একটা গামছা পেতে, তিনি সেই যে পৃথিবীর নিয়ামক অথবা আরও সব কি আছে, পৃথিবীর বাইরে বা সূর্যের মতো তেজী এবং অনেক দূরের সব গ্রহনক্ষত্র মিলে যে অনন্তলোক সেখানে যেন কোনও খবর পৌঁছে দেবার জন্য সামনে দু’হাত প্রসারিত করে দিতে চান।

কেয়া ভেতরে যাবার সময় ফিসফিস গলায় কানের কাছে মঞ্জুকে বলল, মুর্শেদ উঠে বসে আছে। জানালা দিয়ে দুবার মুখ বার করেছে।

—গলা শুকিয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি চা দিয়ে আয়।

কেয়া বলল, এখন তো সোনাবাবু এসেছে। ও সোনাবাবুর সঙ্গে এসেছে এমন চালিয়ে দিলে কেমন হয়।

—মন্দ হয় না।

—তবে মুর্শেদকে বলি বের হয়ে আসতে। দাদার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দি।

—এত তাড়াতাড়ি করিস না কেয়া। আগে যে মানুষটা এল তাকে দ্যাখ সে কোন জাতের। ওরা কথা বলতে বলতে, ও-পাশের উঠোনের দিকে চলে যাচ্ছে। ওরা ঘরের ভেতর দিয়ে বেশ হালকা পায়ে চলে গেল যেন। যাবার সময় না মঞ্জু, না কেয়া কোনও কথা বলে গেল! যেন ওরা কি গোপনে সলাপরামর্শ করতে চলে গেল। অতীশ ঠায় আবার বসে থাকল। কিন্তু হাতটা মাছের, হাতটা ধোয়া দরকার। না হলে আঁসটে গন্ধ উঠছে। সে উঠে দাঁড়াল। ভাবল একবার বাথরুমে যাবে। কিন্তু মনে হল, বাথরুমে না গিয়ে সে কেয়াকে বলবে একটু জল দিতে। আসলে ওর এখন এই বারান্দায় একা একা বসে থাকতে ভাল লাগছে না। সে ইচ্ছে করলে, একটু ঘুরে বেড়াতে পারত। এবং নরেণ দাসের বাড়ির পাশ দিয়ে অর্জুন গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়াতে পারত। বাড়ির জঙ্গলটায় ঢুকে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিংবা পুকুর পারের কয়েৎবেল গাছটার নিচে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে। ঠাকুরদার শ্মশানের উপর মন্দিরটা জরাজীর্ণ। ঝোপ জঙ্গলে পা দেওয়া যায় না।

সে এভাবে যখন কত কিছু ভাবতে ভাবতে ও-দিকের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল, তখন সে দেখে অবাক, কেয়া চা নিয়ে আবার সেই পুরোনো ঘরটার দিকে যাচ্ছে। এবং এ-সময় এ-দিকটায় অতীশ আসবে মঞ্জু যেন ভাবতে পারেনি। মঞ্জু তাড়াতাড়ি এলোমেলো কথা আরম্ভ করে দিল। বলল, কেমন লাগছে সকালটা।

—ভাল না।

—ভাল না কেন!

—ধ্যাৎ একেবারে কিচ্ছু নেই।

—কি থাকবে আবার!

—সব কেমন চুপচাপ। কোন লাইফ নেই।

—কেয়াকে নিয়ে একবার ঘুরে এস না!

—কোথা থেকে ঘুরে আসব?

—তোমাদের বাড়ি থেকে।

—অতীশ ঠাট্টা করে বলল, কেয়ার বুঝি খুব লাইফ আছে।

—দেখ না নিয়ে গিয়ে!

—কেয়া ও-দিকে বন জঙ্গলে ঢুকে গেল কেন?

—ও ওর অভ্যাস। ও চা বসে খেতে পারে না। কিছু শাক তুলতে বললাম, বলালম চা-টা খেয়ে যা, কিছুতেই খেয়ে গেল না। পুকুর পাড়ে খুব গিমাশাক হয়েছে। শাকও তুলবে, চাও খাবে। তুমি তো গিমাশাক খেতে খুব ভালবাসতে।

অতীশের আবার বলার ইচ্ছে হল, আচ্ছা মঞ্জু কাল রাতে দেখলাম কে যেন একজন মানুষ ঐ বন-জঙ্গলের দিকে………তোমাদের পুরোনো আমলের বেহারাদের ঘরটা আছে সেদিকে হেঁটে যাচ্ছে। বেশ লম্বা, তাজা মানুষ। এবং ওকে সুপুরুষই বলা যায়। বলতে গিয়েও সে থেমে গেল। কেমন যেন এই বাড়িতে সব কিছুই এখন রহস্যে ঘেরা। আসলে কেয়া যাচ্ছে সেই ঘরটার দিকে। সেই ঘরটায় যে মানুষটা থাকে তার জন্য কেয়া চা নিয়ে যাচ্ছে। সে এসব বলে দিতে পারত। বলে দিতে পারত, মঞ্জু তুমি আমার সঙ্গে মিছে কথা বলছ। তুমি মিছে কথা বললে ভীষণ খারাপ লাগে। সে বস্তুত মঞ্জুর মুখের দিকে তাকিয়ে সত্য কথাটা বলতে পারল না। মঞ্জুকে যেন অযথা নির্যাতনের ভেতর ফেলে দেওয়া হবে।

আর সে লক্ষ্য করছিল, মঞ্জু ভীষণ অস্বস্তিতে আছে। সে যেন এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে মঞ্জুর অস্বস্তি আরও বেড়ে যাবে। কারণ একটা মিথ্যাকে ঢাকতে গিয়ে আরও দশটা কথা বানিয়ে বলতে হবে। কারণ কেয়া এখনই ফিরে আসতে পারে। ওর হাতে চায়ের কাপ নাও থাকতে পারে। কোঁচড়ে গিমাশাক না থাকলে মঞ্জু বানিয়ে বানিয়ে আর কি বলতে পারে, এ-সব মনে হলে অতীশ আর দাঁড়াল না। সে সোজা করিডর দিয়ে ঢুকে রুগ্‌ণ ছেলেটার ঘরে এসে দাঁড়ালে দেখল, জানালা দিয়ে রোদ, পাশে কাঠমালতি গাছ, দুটো একটা ফুল, অসময়ের ফুল কিনা সে জানে না। কারণ কখন কোন গাছে কি ফুল ফোটে কলকাতায় থেকে তা প্রায় ভুলতে বসেছে। সে দেখল, সুন্দর দুটো পাখি, কি রঙ-বেরঙের পাখি, আহা, ছেলেটির চোখমুখ এখন একেবারে সাদা। এমন কি অতীশ যে এ-ঘরে এসেছে, ছোট্ট ছেলেটা চোখ মেলে যেন তাও দেখছে না। ওর বুকের ভেতরে ভীষণ কষ্ট পুরে রেখেছেন ঈশ্বর। বার বার টুটুলের মুখ ভেসে উঠছে। টুটুল, হাসপাতাল, ইমারজেনসি, রাতের ফোন এবং অবিকল সেই চিৎকার বাতিদানটা হাতে নিয়ে বনির মতো সেই প্রতিধ্বনি—আই উইল প্রেইজ দ্য লর্ড নো মেটার হোয়াট হেপেনস্! যখন চারপাশে সব গাছগাছালি, এমন সুন্দর শরতের রোদ, নীল আকাশ, এবং মাছেরা জলের নিচে ঘোরাফেরা করছে তখন এক রুগ্‌ণ বালক চুপচাপ শুয়ে থাকলে খুব খারাপ লাগার কথা। সে এ-ঘরে এলেই মঞ্জুর কষ্ট কি যে আসহনীয়, এবং কত সহজে মঞ্জু সব ভুলে থাকার চেষ্টা করছে নিজেকে দিয়ে বোঝার চেষ্টা করে। এবং তখনই মনে হল সে মঞ্জুকে কখনও সেই মানুষটার সম্পর্কে কোনও প্রশ্ন করতে পারবে না। মঞ্জু না বললে, সে নিজে জেনে নিতে পারবে না। সে নিজে বলতে চাইলে যেন মঞ্জুকে খুব খাটো করা হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *