।। একাত্তর।
মঞ্জু এসে বলল, সোনাবাবু ঘুমিয়েছে। তুই এবার ওকে ডেকে খাইয়ে দে। অনেক রাত হয়েছে। কেয়া সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। এদিকটা সব সময় অন্ধকার থাকে। এখানে কোনও আলো নেই। কেয়া জানে সব। কারণ চোখ বুজে সে এ-বাড়িতে সব জায়গায় চলে যেতে পারে। কোথায় কতটা অন্ধকার থাকবে সে জানে। বাড়িটার একটু দূরে এক কোঠা-ঘর। ঘরটা সেনবাবুর বাবা করে গেছিলেন। ঘরটার ব্যবহার কবে থেকে যে বন্ধ হয়ে গেছিল সে কেন মঞ্জুদিও বলতে পারবে না। চারপাশে গভীর জঙ্গলের মতো। এখন এখানে একটা সরু পথ আবিষ্কার করা যায়। মনে হয় সকাল বিকেল কেউ সন্তর্পণে হেঁটে যায়। কেউ যেন টের না পায় কে বা কারা পথটায় হাঁটে।
কেয়া কিছু লতাপাতা ডিঙ্গিয়ে লাফ দিয়ে সিঁড়িটার ওপর উঠে দরজায় টোকা মারল। খুব আস্তে। যেন কেউ টের না পায়।
দরজা খুলে গেলে বলল, যান খেয়ে আসুন।
মানুষটার চোখ মুখ যেন শান্ত। সে সিঁড়ি ধরে নেমে যাবার সময় বলল, তোমাদের খাওয়া হয়েছে?
—না। আপনি খেলে আমরা খাব।
—কে যেন এসেছে দেখলাম।
—সোনাবাবু এসেছেন।
—সেই যাকে আসতে লেখা হয়েছিল?
—হ্যাঁ।
মানুষটার মুখ ভীষণ গম্ভীর হয়ে গেল। সে ধীরে ধীরে নেমে এল। সে সেই সরুপথে ঝোপ- জঙ্গল ফাঁক করে চলে যাচ্ছে। কিছুটা এলেই আলো পাওয়া যায়। সে আলোতে এসে স্বস্তি পায়। অন্ধকার রাস্তাটুকু পার হতে তার ভীষণ ভয় লাগে। ভয়ে সে টর্চ পর্যন্ত ব্যবহার করতে পারে না। আসলে এখন তার কিছুই ব্যবহার করবার সামর্থ্য নেই। সে এখন একা অন্ধকারে নানাভাবে পালানোর জন্য দিন গুনছে। তার চোখমুখ দেখলে মানুষের মায়া হবার কথা।
কেয়ার এখন অনেক কাজ। বিছানা তুলে ঝেড়ে আবার পেতে দেওয়া। পুরোনো নোনা ধরা ইঁটের ছোট্ট এক-কামরা ঘর। দেয়ালের খসা চুণ বালি সব সময় ঝুর ঝুর করে ঝরছে। সকালে এ-ঘরে বসে থাকলে বিকেলে চেনা যাবে না। কেমন বিবর্ণ এক ছবি। এ-ঘরটাকে কেয়া সারাদিন খেটে বাসযোগ্য করে তোলার যে কতদিন থেকে চেষ্টা করছে। মানুষটার যাতে কোনও অসুবিধা না হয়, সে নানাভাবে তা চেষ্টা করে যাচ্ছে।
কেয়া প্রথমে ঘরটা ঝাঁট দিল। জানালাগুলো সব খুলে দিল। ঘরটার একটা দিকের জানালা খোলা রাখা হয়। বর্ষাকাল বলে তেমন ভয় নেই। কারণ চারপাশে এখন এইসব গাছপালা বন-জঙ্গল নিয়ে বাড়িঘর দ্বীপের মতো। একটা জানালা খোলা রাখতেই মঞ্জুদি ভয় পায়। এখন যেহেতু সে এ-ঘরে নেই, সব জানালা খুলে দেওয়া যায়। একটু মুক্ত বাতাস খেলে বেড়াক এমন ভাব কেয়ার চোখেমুখে। সে হ্যারিকেনের আলোটা আর একটু উসকে দিল। ওর বালিশ ঠিক করে দিল। সে ফিরে এসে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়বে। কিন্তু সকালে কেউ যদি সহসা সেই জঙ্গলের ভেতর ঢুকে যায় তবে দেখতে পাবে একটা মরচে ধরা তালা ঝুলছে দরজায়। এই পুরোনো কোঠাবাড়িটার সঙ্গে মরচে পড়া তালাটাও যেন দীর্ঘকালের। দেখলে মনে হবে, সেই কবে এই ঘরে তালা পড়েছে আর খোলা হয়নি।
ঘরে ঢুকলেই কেয়ার হাসি পায়। খুব মজা লাগে, যখন কেয়া খুব সকালে এসে ডাকে কমান্ডার মুর্শেদ এবার আপনার ঘরে তালা পড়বে। বাইরের কাজ কিছু বাকি থাকলে সেরে ফেলুন। বন- জঙ্গল ফুঁড়ে আসমানের আলো এসে নামছে। আপনি তখন বের হতে ভয় পাবেন।
তখন কমান্ডারের গলা পাওয় যায়। সে বেশ ধীরে ধীরে মীর্জা গালিবের কোন শায়ের আবৃত্তি করছে। আবৃত্তি করে আবার বাংলায় কেয়াকে বুঝিয়ে দিচ্ছে।
—ও সব পরে বোঝাবেন। উঠুন। তাড়াতাড়ি। আব্বা আর একটু বাদেই ডাকঘরের তালা খুলে দেবে।
সে কেমন আলস্য নিয়ে উঠত। দেখলে মনে হত সে কেমন ধীরে ধীরে নির্জীব হয়ে আসছে। তবু মাঝে মাঝে সাহস পাবার জন্য যেন সে গালিবের কোন শায়ের আবৃত্তি করে থাকে। আর কিছু না। সে কেমন অধীর আগ্রহে মাঝে মাঝে মঞ্জুর ঘরে ঢুকে যায়।—মঞ্জু কিছু হল!
—এখনও কিছু করতে পারিনি সাহেব।
মুর্শেদ মাথা নিচু করে আবার সেই বন-জঙ্গলের পথে ঢুকে ছোট্ট ঘরটায় গিয়ে দরজা জানালা বন্ধ করে বসে থাকত। কেমন একটা ভয়, আতঙ্ক। মঞ্জু তাকে নানাভাবে সাহস দিচ্ছে। মঞ্জুর দিকে তাকালে বোঝে কেউ তার ক্ষতি করতে পারবে না।
কেয়া তাকে নিয়ে বেশ মজা করে থাকে। ভালো মানুষ, বিনয়ী, সরল, সহজ। অথচ সেই দিনগুলোতে সাহেবের সেই কঠিন গলা, এবং নানাভাবে তাদের পৌঁছে দেওয়ার কথা ভাবলে গা কাঁটা দিয়ে ওঠে এখনও। এবং ভেতরে ভেতরে এক ঘৃণা অথবা প্রতিশোধের স্পৃহা জেগে উঠলে কেয়া কেমন অধীর হয়ে পড়ে। কিন্তু মঞ্জুদির দিকে তাকালে সে সাহস পায় না। সমস্ত ঘৃণা নিমেষে কেমন উবে যায়। মঞ্জুদির চোখে কোনও বেদনার ছাপ লেগে নেই। মঞ্জুদি কত সহজে যে মানুষকে ক্ষমা করার কথা ভেবে থাকে।
কেয়া তাড়াতাড়ি সব হাতের কাজ সেরে ফেলল। মশারি টানানোর সময় ওর মনে হল একটা জোনাকি পোকা ঘরে ঢুকে গেছে। সে তাড়াতাড়ি সেটা বের করতে গিয়ে দেখল ভাঙ্গা ইটের ফাঁকে সে বেশ আশ্রয় নিয়ে বসে গেছে। এত উঁচুতে নাগাল পাবার কথা না। জোনাকি পোকা জ্বললে সাহেব ভয়ে ঘুমোতে নাও পারে। সুতরাং যে-ভাবেই হোক ওটাকে বের করার দরকার আছে। না বের করলে সকালে মঞ্জুদির কাছে নালিশ, একটা জোনাকি পোকার জন্য রাতে ঘুম হয়নি মঞ্জু। তখন মঞ্জুদির সামনে দাঁড়াবার সাহস থাকে না কেয়ার। মঞ্জুদি খুব বকে।
কেয়ার আরও হাসি পায় ভেবে—এমন জোয়ান মানুষ, আর ভীষণ সুপুরুষ মানুষ, কলকাতার রাজাবাজারে যার শৈশব কেটেছে, দেশভাগের পর যার বাবা করাচির বন্দরে জাহাজীর কাজ নিয়ে চলে গেল এবং যে একদা দাড়িতে মেহেদি রাঙাতো, তারপর বড় হতে হতে সুবাদার মেজর তারপর আরও কি যেন এবং এখন এখানে শিশুর মতো সরল, মঞ্জুদির কথার ওপর যার কথা বলার সাহস নেই কখনও কখনও সরল বালকের মতো অভিমান এসব সাহেবকে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। আসলে মানুষ সব সময়ই ভাল থাকার চেষ্টা করে থাকে। কিন্তু কখনও কখনও এক রক্তের নদী বয়ে যায়। মানুষের ছায়া নড়ে ওঠে। এবং বন-জঙ্গলের ভেতর সাপের মতো তার শরীরে শয়তানেরা বাসা বেঁধে ফেলে।
সবই মঞ্জুদির কথা। মঞ্জুদি এখন হয়তো ওকে খেতে দিচ্ছে।
খুব যত্নের সঙ্গে মঞ্জুদি ওকে খাওয়ায়। সে পেঁয়াজ রসুন খেতে ভালবাসে বলে, মাছে অথবা রুটির তরকারিতে মঞ্জুদি পেঁয়াজ রসুন বেশি দেয়। রাজাবাজারে যার শৈশব কাটে, যে এক বস্তিবাড়িতে মানুষ, যার নসিব দেশভাগের পর পাল্টে যায়, সে এখন এখানে মঞ্জুদির কাছে প্রায় সরল বালকের মতো।
—তোমার পেট ভরল সাহেব?
—খুব।
ফিসফিস গলায় মুর্শেদ বলল, কেউ এসেছে?
—এসেছে।
—সে বিশ্বাসী মানুষ তো!
—মনে তো হয়।
—আমাকে আবার ধরিয়ে দেবেন না তো?
—না। সে তেমন মানুষ নয়। তোমাকে দেখলে তারও মায়া পড়ে যাবে।
সাহেব এমন কথায় ভীষণ লজ্জা পেল। তার চোখ দুটো সহসা জলে ভরে গেল।
—তুমি তোমার ছেলে বউর কাছে ফিরে যেতে পারবে আশা করছি।
সাহেব মাথা নিচু করে খাচ্ছে। সে মঞ্জুকে আর একটা কথাও বলছে না। চারপাশে সংশয়, সন্দেহ খুট করে আওয়াজ উঠলেই ওর বুক কেঁপে ওঠে! আর এই মেয়ে মঞ্জু এবং কেয়া ওর হয়ে কতভাবে কি যে করছে! সে কৃতজ্ঞতায় এখন আর চোখ তুলে মঞ্জুর দিকে তাকাতে পারছে না।
—নাও ওঠো। আমরা এবার খেতে বসব।
সাহেব উঠে পড়ল। বাইরে এল। এখানে আবার আলো জ্বেলে ওঠায় ও খুব শংকিত। এতদিন সে যেন বেশ ছিল। চারপাশে অন্ধকার, বেত ঝোপ, কুচলতা এবং আশশ্যাওড়ার জঙ্গল। সে যে- দিকটা খোলা রাখে –সেখানে অজস্র গাছ, এবং বন এত গভীর যে কেউ উঠে আসতে পারে না। বন পার হলে হাজামজা পুকুর। পুকুরে বেনা ঘাস। এসব পার হয়ে কেউ ওর পশ্চিমের জানালায় উঠে আসবে না। সুতরাং দিনের বেলাতেও সে জানালা খুলে ঘুমিয়ে থাকতে পারে।
আসলে সে এখন আর ঘুমোতেই পারে না। কেবল মনে হয় হৈ হৈ করে আল্লা-হু-আকবর বলে ছুটে আসছে কারা –ওকে হত্যা করতে চায়। সে ভেবে পায় না আল্লা এমন ভয়াবহ ভাবে মানুষকে তাড়া করে কেন!
সে ধীরে ধীরে নেমে যাবার সময় দেখল কেয়া হ্যারিকেন হাতে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। সে দরজা বন্ধ না করলে কেয়া ফিরবে না। কেয়ার তারপর অনেক কাজ থাকে হাতে। কেয়া তার থালা গ্লাস মেজে রাখবে। সে এখানে কিছুটা হিন্দু মতেও খাওয়া-দাওয়া করছে। ঠিক খানা খেতে পারছে না। একদিন সে মঞ্জুকে আপশোস করে বলেছিল, আসন পেতে খেতে ভাল লাগে না।
—তোমার জন্য মাদুর বিছিয়ে দেব?
সাহেব জানে এটা মঞ্জুর ওপর ভীষণ টরচার হবে। ধুয়ে মুছে নিতে বেলা পড়ে আসবে। সে- জন্য সে বলেছে, না থাক।
তবু একদিন মঞ্জু ওর খুশিমত একটা মাদুরে সাদা চাদর পেতে দিয়েছিল। তারপর চিনে মাটির বাসনে ভাত ডাল, বেশি বেশি মাছ মাংস সামনে সাজিয়ে দিয়ে বলেছিল, খাও সাহেব। খাও।
সাহেব ভীষণ সরমের ভেতর পড়ে গিয়েছিল। খেতে বসে খুব সংকোচের সঙ্গে বলেছিল, আসলে মঞ্জু তোমাদের সঙ্গে থাকতে থাকতে আমার অদ্ভুত সব বদভ্যাস গড়ে উঠেছে। এই যেমন নিজের বাড়িতে হম্বি তম্বি করার স্বভাব ছিল, এখানেও তেমনি মাঝে মাঝে করতে ইচ্ছে হয়।
মঞ্জু বলেছিল, সাহেব তুমি সব সময় করতে পার, তোমাকে কে বারণ করেছে।
সাহেব হা হা করে হাসতে গিয়েও পারেনি। মঞ্জুর স্বামীকে সে চোখের ওপর মরতে দেখেছে। সে দাঁড়িয়েছিল। একজন নিরীহ মানুষকে কি ভাবে অহেতুক হত্যা করা যায় তার দৃশ্য সে চোখের ওপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছে। তবু ভাগ্য বলতে হবে, মেজর তাকে গুলি করতে নির্দেশ দেয়নি। সে তবে কি যে করত! সে তবে কিভাবে যে মঞ্জুর স্বামীকে দাঁড় করিয়ে হত্যা করত! ভাবতে গেলেই তার নিঃশ্বাস নিতে পর্যন্ত কেমন কষ্ট হয়। সে মঞ্জুর দিকে সোজা তাকিয়ে কথা বলতে পর্যন্ত সাহস পায় না।
সে দুটো পেয়ারা গাছের ছায়া পার হয়ে গেল। দুটো বড় রসুন গোটার গাছ পার হয়ে গেল। কেয়া টের পেয়েছে সে আসছে। নানা রকম গাছ লতাপাতার ভিতর দিয়েও দেখা যায় সব। সবুর মিঞা অঞ্চলের এমন একজন ধন্বন্তরির জন্য ভারি সুব্যবস্থা করে দিয়ে গেছেন। সাহেব তার ভেতর নড়ে-চড়ে বেড়ালে, কেয়া টের পায়, বুঝি সাহেবের খাওয়া জোর হয়েছে। এটুকু পথ হেঁটে আসতে পর্যন্ত কষ্ট। খুব আস্তে আস্তে সে হাঁটছে।
কাছে গেলে কেয়া বলল, কি সাহেব খুব খেয়েছ!
—খুব।
—মঞ্জুদির হাতে রান্না!
—খুব ভাল।
—মনে থাকবে?
—থাকবে।
—ভাবিকে গিয়ে বলবে, মঞ্জুদির মতো এমন সুন্দর মেয়ে হয় না।
—বলবে।
—সে বিশ্বাস করবে?
—কাহে করবে না কেয়া?
—তোমাদের দেশের লোক বিশ্বাস করবে এসব কথা!
সাহেব সবিস্ময়ে বলল, হঠাৎ তুম এ-বাত কেন বলছে!
—তুমি তো চলে যাবে। আর তো নাগাল পাব না। তাই মনের ঝাল বেশ করে ঝেড়ে নিচ্ছি। সাহেব হাসল। কেয়া তুমভি বহুত খুবসুরত লেড়কি আছে। তোমার কথাও বলবে।
আমার কথা বলতে হবে না। আমরা তো এখন তোমাদের দুশমন।
—সাহেব বলল, মঞ্জু তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। যাও।
কেয়া বুঝল, সাহেব ওর সঙ্গে আর এখন কথা বলতে চায় না। সে নিচে নেমে বলল, দরজা বন্ধ কর।
সাহেব দরজা বন্ধ করে ভাবল, চোখের সামনে মানুষের যে লাঞ্ছনা দেখেছি কেয়া আল্লার দুনিয়ায় কখনও যেন এমন না ঘটে। তুমি কেয়া নতুন করে সব মনে করে দিও না। দিলে আমি রাতে ঘুমোতে পারব না। অনর্থক আমাকে কষ্ট দিয়ে তোমার কি লাভ?