॥ পয়ষট্টি ॥
গভীর রাতে, মঞ্জু পাণ্ডুলিপিটা পড়ে। ক’দিন ধরেই পড়ছে। শেষের কয়েক পৃষ্ঠা থেকে সে কিছু উদ্ধার করতে পারে নি। মনে হয় শেষ দিকে সমসেরের হাত-পা অসাড় হয়ে আসছিল, তবু লিখে যাবার চেষ্টা করেছে। নাম ধামেও নানারকম বিভ্রান্তি। লেখা দেখেই মনে হয়েছে বাংলাদেশ বলতে সে যা বোঝে তাই লিখে যেতে চেয়েছে। কিছুটা খাপছাড়া, যখন যেখানে যেমন ছবি দেখেছে সে তার লেখায় ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছে। কোথাও ঘটনা আশ্চর্য নিটোল গল্পের রূপ নিয়েছে। কোথাও বিবরণ। অথচ এ-সব নিষ্ঠুর সত্য ঘটনাগুলি আগামী প্রজন্ম হয়ত ভুলে যাবে। ইতিহাসের পাতায় শুধু সাল তারিখ লেখা থাকবে। মুক্তিযুদ্ধের কথা লেখা থাকবে, এই পর্যন্ত। আবার ধান্দাবাজ মানুষেরা আসবে এবং স্বার্থসিদ্ধির উপায় হিসাবে ধর্মের জিগিরও তুলতে পারে। ভবিষ্যতে যাই হোক মঞ্জু জানে, বাংলাদেশের আসল রূপ এটাই। সে যে পাণ্ডুলিপিটা কোথায় রাখে!
অবনী একদিন বলেছিল, আগুনে দিয়া দ্যাও।
মঞ্জু অবাক হয়ে গেছিল অবনীর কথায়। বলেছিল, বলছ কি, এটা নষ্ট করা যায়!
—নষ্ট করবা না, পরে বোঝবা।
মঞ্জুর মুখটা কালো হয়ে উঠেছিল। সে জানে, ঘরে রাখা ঠিক হবে না। কোথায় যে রাখে। অথচ সমসের বড় আশা নিয়ে পাঠিয়েছে। সে বুঝেছে একমাত্র মঞ্জুই তার এই লেখাগুলির মর্যাদা দেবে। একটা গতি করবে। সে যে কি করে!
প্রথমে ভেবেছিল এগুলি গোপন কোনও জায়গায় আপাতত রেখে দেয়। কারণ সারা পৃথিবীতে এখন এই নির্যাতন নিয়ে যা হৈ চৈ হচ্ছে, পরে এই পাণ্ডুলিপি দলিলের মতো কাজে আসবে—কলকাতার রেডিও খুললে সেটা বোঝা যায়। একটা কিছু হবেই। মাঝে মাঝে সেই কণ্ঠস্বর শোনা যায়—রমনার মাঠের যে কণ্ঠস্বর সারা দেশের মাটে ঘাটে ভেসে গিয়েছিল। সেই কণ্ঠস্বর কলকাতার রেডিওতে এখনও শুনলে গাঁয়ে কাঁটা দেয়। মঞ্জুর সাহস ফিরে আসে। যদিও মঞ্জুর মধ্যে রয়েছে মানুষ সম্পর্কে প্রবল অবিশ্বাস—কারণ সে বড় হতে হতে সেটা বুঝেছে। ফলে কখনও কখনও তাকে ভারী নির্লিপ্ত মনে হয়। আজ মঞ্জু অন্যরকম। অবনীর দিকে সে কিছুক্ষণ চুপচাপ চেয়ে থাকল। তারপর সেই রহস্যময় হাসি। অবনীর বুক কেঁপে ওঠে! মঞ্জু তাকে আজ অন্যকিছু বলতে চায়।
সে বলল, আগুনে দিলেই সব শেষ হয়ে যায় না।
অবনী কিছু বলল না।
মঞ্জু জানে, যে-কোন সময় এ-বাড়িতে তল্লাসী হতে পারে। শান্তি কমিটির কিছু মানুষজন অবনীর ওপর খাপ্পা। সে এ-তল্লাটে আওয়ামী লীগের হয়ে কাজ করেছে। সে মুজিবের লোক। মুজিবের লোক হলেই গলা কাটা যাচ্ছে। তারপর নেশায় পেয়ে গেছিল মানুষটাকে—সমসের কামাল তাকে আহ্বান জানিয়েছিল, সে উপেক্ষা করতে পারে নি। ছলে ছুতায় মাঝে মাঝে দু-এক দিনের জন্য নিরুদ্দেশ হয়ে যেত। কিন্তু এবারে ফিরে এসে কিছুটা ভেঙে পড়েছে। বুঝতে পারছে হয়ত, শেষ পর্যন্ত কিছুই হবে না। সবাই ছত্রখান। সব ব্যর্থ। ওপারে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণের দায়ে ছুটছে, বিশ বাইশ বছর ধরে যা হয়ে আসছে।
ক’দিন ধরেই অবনী কথা কম বলছে। ছাউনি থেকে মুর্শেদ এলেও সে আর তেমন মনে জোর পায় না কথাবার্তায়। সব সময় মনে হয় কিছু একটা হয়ে যাবে। মাঝে মাঝে শুধু ক্ষোভে দুঃখে চিৎকার শোনা যায় জব্বার চাচার, বড় মিঞা তোমার ক্ষমা নাই। নিজের জালে নিজে জড়াইয়া মরবা। এ- পরিস্থিতিতে কি করা দরকার মঞ্জু নিজেও বুঝতে পারছে না। পাণ্ডুলিপিটা খুবই তাকে অসুবিধায় ফেলে দিয়েছে।
মঞ্জু এবার বলল, পড়ে দেখেছ? সমসের কি সুন্দর লিখেছে!
—না।
—পড়ে দেখ! এ আর যাই করা যায় আগুনে দেয়া যায় না।
অনেক রাত হয়ে গেছে। অবনী ইজিচেয়ারে শুয়েছিল। মঞ্জু বিছানা করে দিতে গিয়ে বুঝল অবনী আজ একা শোবে না। কারণ অবনী বলছে, আমার ঘরে শোও। নীলু বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছে। মঞ্জুরও ক’দিন থেকেই ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু মানুষটার শরীরের দিকে তাকিয়ে সাহস পাচ্ছিল না। বলল, দাঁড়াও দেখে আসছি। সে এবার সব দরজা বন্ধ আছে কিনা দেখে নিল। নীলুর ঘরের জানালাটার একটা পাট বন্ধ ছিল, সেটা খুলে দিল। রান্নাঘরে টুকিটাকি কাজ থাকে শোবার আগে—যেমন মঞ্জু অবশিষ্ট দুধটুকু দিয়ে রোজ দই পেতে রাখে। অবনীর দুপুরে শেষ পাতে একটু দই না হলে খাওয়াতে তেমন তৃপ্তি পায় না। অবনীর জন্য তাকে রোজ এটা করতেই হয়।
এই সন্ত্রাসের রাজত্বেও মানুষ তার ইচ্ছা থেকে দূরে সরে যায় না। মঞ্জু গভীর রাতে অবনীর পাশে শুয়ে সেটা বুঝল। দু’জনেরই ঘুম আসছিল না। সমসের সেই জঙ্গলের মধ্যে একটা রাইফেল, কিছু তাজা কার্তুজ রেখে গেছিল। অবনীকে আজ প্রথম মঞ্জু সে কথাটা বলল।
অবনী বলল, কী বলছ!
মঞ্জুর কাছ থেকে কোন সাড়া পাওয়া গেল না। কামাল সমসের চলে যেতেই মঞ্জু বুঝতে পারছে অবনী সব জোর হারিয়ে ফেলছে। অবনী উঠে বসল। তারপর লণ্ঠন হাতে দরজা খুলতেই মঞ্জু বলল, কোথায় যাচ্ছ?
—দেখি।
মঞ্জু জানে লোকটা এখন তার কোথায় যাবে। সে শংকাতে নিজেও উঠে বসল।—কাল যা হয় করো।
অবনী থামল না। মঞ্জু সব জানে না। মুর্শেদ কিছু গোপন খবর দেয়। সে জানে আজ হোক কাল হোক একটা জিপ গাড়িতে তারা আসবে। এবং তাকে ডেকে নিয়ে যাবে। জেরা করবে। তারপর মর্জি হলে ফিরতে দিতে পারে, নাও পারে। এ-সব কথা মঞ্জুকে বলে লাভ নেই। গোটা সংসারে তবে বিভীষিকা দেখা দেবে। সুতরাং সবদিক থেকে সাবধান থাকা ভাল।
বারান্দায় এসে মনে হল লণ্ঠন হাতে জঙ্গলের দিকে যাওয়া ঠিক হবে না। কে কোথা থেকে দেখে ফেলবে। চর সবত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে। বরং টর্চটা হাতে নিয়ে বের হওয়ার সময় বলল, কোনখানে আছে?
মঞ্জু সামনে দাঁড়িয়ে বলল, যদি দল বেঁধে লুটপাট করতে আসে! হাতে কিছু থাকবে না!
অবনীর ইচ্ছা হল চীৎকার করে উঠতে। মঞ্জু তুমি পাগল। আমাকে ওরা এমনিতেই কলাবরেটর বলে ইদানীং মনে করছে। এখন যদি কিছু পায় তবে মোওকা। অবনী সোজা হাঁটতে থাকল। মঞ্জু পাশে পাশে।
—ওটা তুমি খুঁজে পাবে না।
অবনী তবু হাঁটতে থাকল।
—আমি এনে দিচ্ছি।
অবনী হাঁটছে।
বাধ্য হয়ে মঞ্জু ওটা যেখানে রেখেছিল টেনে বের করল। অবনী ওটা মঞ্জুর হাত থেকে নিয়ে অন্ধকারে আবার হাঁটতে থাকল। বাড়ির ত্রিসীমানায় এটা রাখা চলবে না। মাঝি বাড়ি পার হয়ে গেল। কেউ নেই—মাঝি বাড়ির সবাই অনেক দিন হল দেশ ছেড়ে চলে গেছে। হাসান পীরের দরগার পথটা ধরে গেলে হয়। সেখানেও যাওয়া নিরাপদ নয়। কাছারি বাড়ির পেছনে বড় একটা জলা আছে। অবনীর মনে হল জলটাই সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা। স্বামী-স্ত্রী অন্ধকারে আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে আজ উভয়ে কেন জানি এবারের মতো প্রাণ ভিক্ষা চাইল। বলল, ঈশ্বর আপনি আমাদের শেষ আশ্রয়।
মঞ্জু তারপর আগে, অবনী পেছনে হাঁটতে থাকল। আর ফেরার সময় পাকা সড়ক দিয়ে দূরে দেখা গেল একটা গাড়ি আসছে। এ-রাস্তায় এত রাতে গাড়ি যায় না। একমাত্র মাঝে মাঝে মিলিটারী গাড়ি যায়। ওরা তাড়িতাড়ি ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে জানালায় দাঁড়িয়ে দেখতে থাকল—গাড়িটা পাশের সড়ক দিয়ে চলে গেল। আবার কিছুক্ষণ পর ফিরে এল গাড়িটা। তিন চারজন ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে। ঠাকুর বাড়ির অর্জুন গাছটার নীচে গাড়িটাকে দাঁড় করিয়ে কিছু যেন সলাপরামর্শ করছে। অবনীর বুক কাঁপছিল। মঞ্জু স্থির তাকিয়ে আছে।
অবনী বলল, পাণ্ডুলিপিটা সরাও।
মঞ্জু তাড়াতাড়ি ওটা নিয়ে ভিতরের দিকে চলে গেল। এবং রান্নাঘর পার হয়ে একটা ছিটকিলার ঝোপে পাণ্ডুলিপিটা ফেলে দিয়ে এসে দেখল, গাড়িটা নেই। কেউ নেই। সব আবার আগের মত অন্ধকার।
মঞ্জু ফিসফিস গলায় বলল, গাড়িটা?
—চলে গেল।
—কেউ নেই?
—না।
—ওরা কারা?
—জানি না। অবনী সে রাতে ঘুমাতে পারল না। মঞ্জুও না।
সকালে দেখা গেল গোপেরবাগের ছাউনি থেকে চারজন মিলিটারি একটা জীপে সেই পুকুর পাড়ের অর্জুন গাছটার নীচে হাজির। এরা অবনী কবিরাজের খোঁজে এসেছে। ডিসপেনসারিতে উঠে যেতেই জব্বার চাচার হাঁক, মিঞা কিডা চান?
ওরা একটা কি কাগজ দেখাল তাকে। সে বুঝল না কিছু। অবনী বের হয়ে আসছে। সে বুঝতে পারছে তার শমন। সে কাছে যেতেই জেব থেকে কি বের করে মিলিয়ে দেখল। তারপরে হাত দুটো বেঁধে টানতে টানতে জিপে তুলল। অবশ্য প্রাণের দায়ে প্রথমে জোর জার করলেও পরে নিয়তি ভেবে সোজা হেঁটে গেল অবনী। বলল, লাগছে। ওর হাতের দড়ি সামান্য আল্গা করে দেওয়া হল।
মঞ্জু জানালায় নিথর। নীলু দেখছে বাবাকে চোরের মতো পেছনে হাত বেঁধে মিলিটারির লোকেরা নিয়ে যাচ্ছে। কেউ কোনও প্রতিবাদ করছে না। মা মূর্ছা গেছে। কেয়া পিসি হাহাকার করে কাঁদছে। কেবল জব্বর চাচা চীৎকার করছে—পার পাইবা না বড় মিঞা, হুমোন্দির পুতেগ চিন না, নিজের জালে জড়াইয়া মরবা। খোদা তোমাগ কসুর ক্ষমা করব না। এবং এই বলতে বলতে সে কেমন পাগলের মতো জিপগাড়িটার পিছনে দৌড়াতে থাকল। কেউ তাকে থামাতে পারল না। বিড়বিড় করে বকছে আর জিপ গাড়িটার সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে বুড়ো মানুষটা। ছুটতে ছুটতে মানুষটা মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। হাত দুটো বিছিয়ে দিল সামনে। হাউহাউ করে কাঁদতে থাকল—মায়রে গিয়া মুখ দেখামু কি কইরা।