2 of 2

ঈশ্বরের বাগান – ৬৩

।। তেষট্টি ॥

যাক, বাঁচা গেল। সবাই ছোট মেয়েটাকে নিয়ে এখন কি যে করবে ভেবে পাচ্ছে না। আবেদালি বলল, আয় মা, কোলে আয়। এবার আমরা তোর জন্য বেঁচে গেলাম। আমাদের আর ভয় থাকল না। ওদের নৌকো চেক করার সময় খানসেনারা দেখেছে একটা ছোট কচি বাচ্চা নিয়ে একজন বিবি ঘোমটা দিয়ে বসে আছে। দেশে গাঁয়ে বৌ বিটি নিয়ে মানুষ জন সহর ছেড়ে পালাচ্ছে। সুতরাং ছেড়ে দাও। ওরা মেয়েটার জন্য রক্ষা পেয়ে গেল।

বেশ বেগে নৌকা ছুটছে। সামনে আর কোন সন্ত্রাস নেই। চারপাশের যা কিছু গ্রাম মাঠ সব চুপচাপ। মানুষের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। ভয়ে এ অঞ্চলের মানুষেরা বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে বলে এমন মনে হচ্ছে। নদীর পাড়ে পাড়ে ওরা ভেবেছিল মানুষের মিছিল দেখতে পাবে। রাতে রাতে যারা পালাচ্ছে, তাদের দেখতে পাবে। ওরা কিছুই দেখতে পেল না। মিনু মেয়েটাকে আবার ঘুম পাড়াবার চেষ্টা করছে। আবুলের চোখে ঘুম আসছে না। আর বেশি দেরী নেই। ঘণ্টা দুই লাগবে। খুব বেশি হলে ঘণ্টা তিন। সকাল হতে বাকি থাকবে না। সুতরাং এ-সময়টা পাটাতনে মার পাশে চুপচাপ বসে থাকবে ভাবল। ভাবলেই তো হয় না, মনের ভিতর কত কথা এসে যে উঁকি দেয়! আবুল বলল, মা আমাদের কি হবে?

—তোমাদের কি হবে বাবা, তোমাদের ভাল হবে।

—মুজিবর সাহেব কোথায় আছে মা?

—কি করে বলব। কিছুই তো জানি না।

ফিরোজ বলল, আমরা জিতবই আবুল। এই বলে সে মিনুভাবির দিকে তাকাল, এর পর কি করবেন ভাবি?

—কি আবার করব!

—আমাদের সঙ্গে তো আপনার আর দেখা হবে না।

—কেন হবে না?

—কোথায় কার ঠিকানা থাকবে কেউ আমরা জানব না।

—নিশ্চয়ই দেখা হবে। আমরা যেখানেই থাকি বাংলাদেশেই থাকব। দেশে আমাদের ঠিকানা হারিয়ে যেতে পারে না।

আবুল বলল, আচ্ছা মা, আমরা ধরা পড়লে ওরা আমাদের মেরে ফেলত?

মিনু এমন কথার কি জবাব দেবে। সে ভাবতে পারে না, মানুষ সময়ে সময়ে কত নিষ্ঠুর হয়ে যেতে পারে।

আবুল ছোট। সুতরাং মাঝে মাঝে সে এমন প্রশ্ন করে যে জবাব দিতে অসুবিধা হয়। সে উত্তর না পেলে রেগে যায়। আমি ওকে জাগিয়ে দেব মা। বলে সে ছোট্ট মেয়েটার চুলে বিলি কেটে দিতে থাকল।

মিনু ধমক দিল, দুষ্টুমি করবে না. আবুল।

আবুল এবার বলল, আমার খিদে পেয়েছে মা।

—এই না খেলি?

—আবার খিদে লেগেছে।

—এখন এমন করতে নেই সোনা।

—খিদে লাগলে কি করব!

—সকাল হলে হাসিম সাহেবের বাড়ি উঠে যাব। সেখানে আমাদের খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। এটুকু সময় তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে। আবেদালি বলল, আবুল ঠিক বলেছে ভাবি, রাত জাগলে খিদে বেশি পায়। মেহের বলল, তোরও খিদে পেয়েছে?

—কিভাবে নৌকা বাইছি, খিদা লাগবে না, বল?

মিনু বলল, আমরা সবাই খেতে পাব। আর বেশি সময় নেই। আমিনুল সব জানে। আমিনুল এখন কি করছে!

আমিনুল সেই যে চুপচাপ বসেছিল আর কথা বলছে না। ওর স্কোয়াডের শেষ সম্বল সে আছে। নদীর জলে দুজন গেল, অবনীকে নামিয়ে দিতে হল মাঝেরচরে। ফলে ওর এসব কথাবার্তা ভাল লাগছে না। ওদের এই সংগ্রামে কোথায় যেন বড় একটা ত্রুটি থেকে গেছে। কেবল মার খাচ্ছে, একের পর এক। কপালে যে শেষে কি আছে কেউ জানে না। ছোট্ট মেয়েটা তাদের আশ্চর্যভাবে রক্ষা করল। খান সেনারা উঠে এলে সে যদি না কাঁদত, তবে দশটা নৌকার মত এই নৌকাকেও আটকে রাখত তারা। মিনুভাবির কোলে একজন ছোট্ট মেয়ে দেখে ওরা কেন যে কিছু বলল না! মেয়েটার মুখে টর্চ মেরে ওরা কি যে দেখেছিল কে জানে, ওরা কি বলতে বলতে উঠে গেল। ওদের ভাষা ওরা বুঝতে পারেনি। ফলে এই মেয়ে একমাত্র মেয়ে যে তাদের ত্রাণ করেছে, এমন একটা চিন্তা মনে আসতেই ওরা ফের বাচ্চাটাকে নিয়ে মেতে গেল। এখন যে ভাবে নৌকা এগিয়ে যাচ্ছে একেবারে ‘নাইয়র যাওনের’ মত। ওরা যেন বেড়াতে যাচ্ছে। যেমন ঈদের পার্বণে ওরা যায়, যেমন পূজা- পার্বণে তারা যায়, তেমনি যাচ্ছে। কোন বাধা নেই। সামনে কোনও বিপত্তি নেই। বেশ যাচ্ছে, এগিয়ে যাচ্ছে। আবুল কত কথা যে বলছে! যার কিছু অর্থ হয়, বাকি অর্থবিহীন। মেহের কি একটা দুঃখের গান গেয়ে নৌকা বাইছে। ছইয়ের উপর সাইকেল তিনটা। হাওয়ায় সাইকেলের চাকা ঘুরছে, হাওয়া লাগলে ঘুরে যাচ্ছে।

কিছুই শেষ হয়ে যায় না। মিনু আমিনুলকে এমন বলে সামান্য চাঙ্গা করতে চাইল। আমিনুলের হাতে এখন সব। অবনী নেই, আমিনুল ভেঙে পড়লে চলবে কি করে!

মিনু বলল, মেহের, তুমি একটা কাজ করবে ভাই?

—কি কাজ?

—তুমি খুকিকে নিয়ে হেঁটে চলে যাও। কাছেই। হেঁটে গেলে ঘণ্টা খানেক। নৌকায় গেলে ঘণ্টা তিনেক। নদীর বাউড় ভাঙতে সময় নেবে খুব।

হঠাৎ এ-কথা শুনে আবেদালির কেমন হুঁশ ফিরে এল। সে বলল, ভাবি, এক কাজ করলে হয় না?

—কি কাজ?

—আপনারা হেঁটে চলে যান। আমি ফিরোজ আমিনুল নৌকাটা ঠেলে নিয়ে যাচ্ছি। হাসিম সাহেবকে খবর দিন নৌকা আমরা খুব সকালে ঘাটে ভিড়িয়ে দিচ্ছি। লোকজন যেন ঠিক থাকে।

মিনু বলল, আমিনুল কি বলে?

আবেদালি বলল, আমিনুল কি বলে দ্যাখো।

—তা যাউক। তবে আমার মনে হয় গিয়া কাম কি? হাঁইটা যাইতে কষ্ট।

—তা ঠিক। এতটা পথ হেঁটে যাবে। যখন নিরিবিলি চলে যাওয়া যাচ্ছে, অনর্থক হেঁটে কি হবে?

শেষে ঠিক হল মিনু এবং বাচ্চা মেয়েটাকে মেহেরের সঙ্গে নামিয়ে দেবে। আনিমুল তাদের নামিয়ে দেবার আগে সব জেনে নেবার মত বলল, লাধুর চর যাইতে পারবি তো?

মেহের বলল, এদিকের পথ-ঘাট আমার চেনা আছে।

—তবে ভাল।

আর তখনই পাড়ে দাঁড়িয়ে মাঠ থেকে কে যেন হাঁকল, সজনে ফুল। নৌকা দেখা যাচ্ছে, অস্পষ্ট অন্ধকারে নৌকাটাকে দেখে সমসের চিনে ফেলল। সে হাঁকল সজনে ফুল।

যেমন হয়ে থাকে, নৌকার গতি সহসা থেমে গেল। কে হাঁকছে, এই অসময়ে কে হাঁকছে! ওরা কেউ কথা বলছে না। কেবল আবুল যেন বুঝতে পারছে, মিনুও বুঝতে পারছে, সেই মানুষ তার এসে গেছে। ওর তো আসার কথা নয়! সে ভেবে পেল না, কি করে এত সত্বর, অথবা মানুষটা কি জাদু জানে, নাকি পাড়ে পাড়ে মানুষটা সন্ধ্যারাত থেকে পাহারা দিয়ে দিয়ে আসছে। আমিনুল প্রথম কিছু বুঝতে না পেরে চুপ করে আছে। মিনু, আবুল পরিচিত গলার ডাক শুনেও কথা বলতে পারছে না। সাড়া দেবার অধিকার আমিনুলের। আমিনুলই সাড়া দেবে। বলবে তালপাতার পাখা। কিন্তু আমিনুল কোন সাড়া দিচ্ছে না বলে ওরাও চুপ করে আছে।

আবার পাড় থেকে সেই হাঁক। সজনে ফুল, তালপাতার পাখা

মিনু ভাবল, আমিনুল এখনও অন্যমনস্ক। সে বলল, শুনতে পাচ্ছ?

আমিনুল পাটাতনে বসে ভাবছিল, সমসের ভাই কেন আবার। কোনও কি দুর্ঘটনা আবার কোথাও ঘটেছে? সে কি যে করবে। ওর নানারকম চিন্তা ভাবনা, সে তাড়াতাড়ি হাঁক দিতে ভুলে গেছে। সে উঠে দাঁড়াল পাটাতনে। তারপর মুখে দুহাত রেখে হাঁক দিল, সজনে ফুল, তিন নম্বর কুটির, তালপাতার পাখা। কি অসীম দরাজ গলা, আর উচ্চস্বরে সেই শব্দ, ওপারে এক প্রাচীন হিন্দু জমিদারের পোড়ো বাড়িতে ধাক্কা খেয়ে বার বার প্রতিধ্বনি তুলে যাচ্ছে। কেঁপে কেঁপে আদিগন্ত মাঠ জুড়ে সেই সবল এবং স্বাধীনতার ডাক আগুনের মত উজ্জ্বল বহ্নিশিখা তৈরী করছে। যেখানে যত পাপ এবং ভীরুতা আছে সব যেন এবার আগুনে পুড়ে মরবে।

সমসের বলল, পাড়ে নৌকা ভিড়াও।

নৌকাটা পাড়ের দিকে এগিয়ে আসছে। সমসের সাইকেলের প্যাডেলে পা তুলে সামনের দিকে একটু ঝুঁকে আছে। সে খুব সন্তর্পণে লক্ষ্য রাখছে সব। কেমন যেন একটা অনুভূতির তরঙ্গ শরীরে মিশে গেছে তার। নতুবা এত দূর থেকেও সে চিনতে পারত না, এই নৌকাতেই মিনু, আবুল, অবনী আছে। তার ভিতর থেকে এক আশ্চর্য অনুভূতি এ ভাবে কাজ করলে, সে একা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকল।

ও খুব উঁচুতে দাঁড়িয়ে আছে। পাড় খাড়া। খাড়া পাড়ে সে চারপা টা দেখতে পাচ্ছে। বাঁ দিকে বড় অশ্বত্থ গাছটার ডালপালা একটা ছাতার মত আকাশ ঢেকে রেখেছে। কিছু জোনাকি পোকা জ্বলছে ঝোপে জঙ্গলে। পাশে শ্মশান। এখন এ অঞ্চলে হিন্দু গ্রাম প্রায় নেইই বলে, এখানে বোধ হয় আর চিতা জ্বলে না। তবু মনে হয় পুরানো ভাঙ্গা মঠের ভিতর কোনও সন্ন্যাসীর ডেরা আছে। সমসের চারপাশটা লক্ষ্য করতে গিয়ে ভাবল, সে এখন কি যে করে! যা খবর তাড়ে সবাই ভেঙে পড়ছে। অথচ সে জানে মানুষের এই ইচ্ছা কত কালের। স্বাধীনতার ইচ্ছা। এবং চারপাশের গাছপালার মতো ওটা নিরন্তর বাড়ছে। এই ইচ্ছে সে জানে কোনদিনও মানুষের মরে যেতে পারে না। এবং যা কিছু সাহস সে এখনও প্রাণে ধরে রেখেছে, সব এই বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে।

নৌকাটা পাড়ের কাছে এলে সমসের সাইকেলটা প্রথমে একটা গাছের সঙ্গে দাঁড় করিয়ে রাখল। তারপর সে ধীরে ধীরে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে যেতে থাকল। ওরা সজনে ফুল, তিন নম্বর কুটির বললেও, একটা ভয় যে না আছে, কত লোক ছদ্মবেশে, গলা নকল করে ধরার তালে থাকতে পারে এবং কাছে গেলে যখন মনে হল যথার্থই মিনু বসে রয়েছে, আবুল এক লাফে নিচে নেমে এসে তাকে জড়িয়ে ধরেছে তখন সে কেমন সহজ হয়ে গেল। সে বলল, মিনু তোমাকে তাড়াতাড়ি নামতে হবে। আবুল এখন বিরক্ত করবে না। আমিনুল, অবনীকে কোথায় পাঠিয়েছিস?

আবুল বলল, কাকার কাঁধে গুলি লেগেছে।

সমসেরের বুকটা কেঁপে উঠল।

আমিনুল বলল, অবনীকে নামিয়ে দিতে হল।

মিনু বলল বাকিটা। সে বলল, কাঁধের এ-পাশটায় গুলি লেগেছে। এবং সে বলতে থাকলে সমসের কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেল। নতুন একটা ফ্রন্ট খোলার জন্য সে মনে মনে যা ভেবে রেখেছিল, অর্থাৎ ওর ইচ্ছা ছিল সেই ফ্রণ্টে অবনীর ওপরে থাকবে কমাণ্ডের ভার এখন এইমাত্র এ-সব ঘটনায় তা কেমন নিরর্থক মনে হচ্ছে।

মিনু সমসেরের কপালে হাত রেখে দেখল তখন, ওর গায়ে জ্বর কতটা আছে। সমসের বলল, মিনু, আমরা যেখানে যাচ্ছি, যাবার কথা, তোমরা এত দূর যে জন্য এলে সবই গোলমাল হয়ে গেছে। সমসের ঠিক মতো যেন কথাগুলো এখন গুছিয়ে বলতে পারছে না পর্যন্ত। সে মিনুকে ফিরে পেয়ে আবুলকে কাছে পেয়ে কেমন সব গোলমাল করে ফেলছে। অথচ এমন এক সময়, এ-সময়ে মানুষের নিজস্ব কিছু থাকে না। অবনীর ঘটনায় সমসেরের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। মিনু এখন সেই শিশুটিকে বুকে জড়িয়ে রেখেছে। আবেদালি ফিরোজ আমিনুল আরও কিছু শুনতে চায়। কাঠের বাক্সটা পাটাতনের নিচে। সমসের আর কিছু বলছে না। কেমন চুপচাপ থেকে নিথর মানুষ হয়ে গেছে।

ওরা পরস্পর কেউ আর কথা বলতে পারছে না। ওরা এখন কেবল কিছু শুনতে চাইছে। কিভাবে ওরা পরবর্তী একসান শুরু করবে। ওরা এখন কোথায় যাবে, কারণ সমসেরের সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়ায় ওরই ওপর সবকিছু নির্ভর করছে।

অথচ সমসের কিছু বলছে না। যেন বলতে তার দ্বিধা হচ্ছে।

আমিনুল বলল, কোনও খারাপ খবর আছে?

সমসের বলল, অবনীকে তোরা কোথায় নামিয়ে দিলি?

—মাঝেরচরের কাছে।

—ওর সঙ্গে কে গেল?

—ও বলল একাই যেতে পারবে।

—ঠিক হয় নি।

আসলে অবনী হয়তো ইচ্ছে করেই মিনু আবুলের আত্মরক্ষার্থে নৌকা থেকে নেমে গেছে—ওর খুব ইচ্ছে ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার দিনে সে একটা বড় আমলকি গাছের নিচে বসে থাকবে। সমসের কাঁপা কাঁপা গলায় কথাগুলি বলল।

ওরা কেউ জবাবে কিছু বলছে না! যেন এখন সমসেরই বলবে, ওরা শুনবে। ওদের কাজ কেবল শোনা।

সে বলল, অবনী বলত, স্বাধীনতার দিনে শহরে সবাই যখন কুচকাওয়াজ দেখতে যাবে, আমি সেদিন একটা সাইকেলে নিরিবিলি নদীর পাড়ে নেমে যাব। কোন গাছের ছায়ায় বসে, পাখির ডাক শুনব, ফুল ফুটতে দেখব। আমি পাখির ডাক শুনলে, ফুল ফুটতে দেখলে ঠিক বাংলাদেশের মানেটা বুঝে ফেলতে পারি।

সমসের একে একে সব অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলে যাচ্ছে। অবনী মুঞ্জুদি সম্পর্কে সব কথাবার্তা। কবে অবনী যেন বলেছিল, স্বাধীনতার দিনে, তোমরা আমাকে কিছুতেই বড় বড় সভায় নিয়ে যেতে পারবে না।

সমসের বলত, তা সেদিন তুই জনতার সামনে কিছু বলবি না!

—কি বলব!

—আমরা কি-ভাবে মুক্তি সংগ্রামে নেমে পড়েছিলাম। আমাদের বীরত্বের কাহিনী।

—ওটা আবার বীরত্বের কি আছে রে! জননীর জন্য শাকপাতা তুলে আনাকে সংগ্রাম বলে না। সংগ্রাম হচ্ছে পরে, দেশকে গঠন করবার জন্য আসল সংগ্রাম। আমরা দুটো খান সেনা মেরে দেশ স্বাধীন করে ফেললাম এর আর দাম কি। দেশের মানুষ ওদের না চাইলে ওরা থাকবে কি করে! বেহায়া কিছু থাকে। তাদের ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে না দিলে যেতে চায় না। আমরা মা জননীর হয়ে সেই ধাক্কাটা কেবল দিয়েছি। বাপু তোমরা এতে বীরত্বের কি দ্যাখো বুঝি না।

সমসের বলল, অবনী সাদাসিধা মানুষ। তোরা তো মঞ্জুদিকে দেখিস নি। আমি বলেছি, মঞ্জুদি, আপনাদের সবাই তো ও-পারে চলে গেল, আপনি গেলেন না, থেকে গেলেন! সমসের এই বলে একটু চুপ করে গেল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, মঞ্জুদি আশ্চর্য একটা কথা বলেছিলেন। দেশের মাটিতে আমার পূর্বপুরুষ রয়েছেন। তাদের ছেড়ে আমি কোথায় যাব। আমার দেশ মাটি যা কিছু ঐ সব মানুষের সঙ্গে মিশে আছে।

সমসেরের ভিতর একটা আশ্চর্য সাহস আবার দানা বেঁধে উঠছে।

সমসের দেখতে পেল, চারপাশের তরুলতা নিঝুম। ওরা চারপাশে তাকে ঘিরে আছে। সে পর পর কি বলে যাচ্ছে ওরা মন দিয়ে শুনছে। সমসেরই পরবর্তী নির্দেশ দেবে এবং সেজন্য ওরা কোন কথা বলতে পারছে না।

সমসের বলল, হাসিম ধরা পড়েছে। কি করে যে খবর চলে গেছে খানেদের কাছে, একটা বাক্স আসছে হাসিম সাহেবের বাড়িতে। একসানের সব প্ল্যান এবং প্রোগ্রাম ওদের হাতে ধরা পড়ে গেছে। চরম বিশ্বাসঘাতকতা! কে যে করল! গ্রামের কে যে এতবড় দুশমনি করল!

শেষে সমসের বলল, আমাদের এখন আত্মগোপনের পালা। বলেই সে ফের তাকাল মিনুর দিকে। কিন্তু মিনুর চোখে মুখে কোনও ভীতির ছাপ আছে কিনা এই সকালের আলোতেও বুঝতে পারল না।

সমসের ফের বলল, মিনু তোমাকে এই বাচ্ছাটা নিয়ে সরে পড়তে হবে। কাল তোমাকে নানু- মিঞার কাছে চলে যেতে হবে। ওখানে আমাদের সেবা শুশ্রূষার জন্য লোকের দরকার। আবুল থাকবে আমাদের সঙ্গে। আমাদের নতুন ফ্রন্ট খোলার জন্যে আবুলকে দরকার হবে। আমিনুল বলল, আপনি কি করে জানলেন?

মঞ্জুদির বাড়ি থেকে বের হয়ে একুশ নম্বর কুটিরে খবর নিলাম, ময়নারা ঠিকমতো পথ চিনে যেতে পেরেছে কিনা? তখনই ওরা খবর দিল, গ্রামটা খান সৈন্যে ছেয়ে আছে। সেখানে খানেদের নতুন ছাউনি পড়েছে। ওরা যেতে পারে নি।

আমিনুল বলল, কাকে কাকে পাঠিয়েছিলেন?

—অরুণ, ময়না।

—এখন ওরা কোথায়?

—ওরা মজুমপুরে আছে।

—এখন তবে কি করবেন?

—এখন আমাদের নতুন ফ্রন্ট গড়তে হবে।

ফিরোজ বলল, আমাদের এখন ধরা পড়ার পালা।

সমসের সামান্য রুষ্ট হল। সে ধমক দিল, কী আজে বাজে বকছিস! থাম!

ফিরোজ বলল, আমি ঠিকই বলছি সমসের ভাই, আমাদের শুধু ধরা পড়ার ভয়। ধরা পড়লেই দেয়ালে দাঁড় করিয়ে গুলি, বলে কেমন দুঃখের হাসি হাসল ফিরোজ।

সমসের এবার ফিরোজের কাঁধে হাত রাখল। বলল, ধরা পড়ব কেন? একাউণ্টার হবে। আমরা সব সময় ঘাসের ভিতর মুখ লুকিয়ে বন্দুকের নল উঁচু করে রাখব। কেউ আমাদের আর হারাতে; পারবে না। তুমি এই গাছপালা মাটি মানুষের ইচ্ছার কথাটা শুনতে পাচ্ছ না? আমরা কখনও হারতে পারি! তারপর সে কি ভেবে বলল, বাজারের দিকেই আর একটা কুটির বানিয়ে ফেলতে হবে। এ অঞ্চলের এমন কে আছে যাকে বিশ্বাস করা চলে!

আমিনুল একটু ভেবে বলল, ও-পারের রায় মশাইরা যদি থাকে।

—থাকবে না কেন? আবেদালি প্রশ্ন করল।

—গ্রাম ছেড়ে সবাই পালাচ্ছে। ওরাও চলে যেতে পারে বর্ডারের দিকে।

সমসের, মিনু, মেহের, ফিরোজ, আবেদালি একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে এমন সব কথা ফিফিস্ করে বলছে।

সমসের বলল, এখন আপাতত মজুমপুরেই আমরা যাব।

আমিনুল বলল, নানুমিঞার কুটিরে ফিরে গেলে হয় না?

সে কাল হবে। তুমি মিনুকে নিয়ে চলে যাবে। আমার সঙ্গে থাকবে আবুল। আবুলকে আমাদের অনেক কাজে লাগবে। তাছাড়া আমরা এক সঙ্গে আর ফিরে যেতে পারি না। সব রুট ওদের জানা হয়ে গেছে। আমাদের সব কুটিরগুলোর খবর পেয়ে গেছে ওরা। নতুন নতুন কুটির তৈরি করতে না পারলে আমাদের আর রক্ষা নেই। আমাদের এখন শুধু তৈরি হওয়া। ওরা একটা নষ্ট করবে আমরা দশটা নতুন তৈরি করব। যত ওরা ভাঙবে তত আমরা মরিয়া হয়ে উঠব। আমাদের এ লড়াই দীর্ঘদিনের। সমসের ভাঙা গলায় কথা বলতে গিয়ে উপরের দিকে তাকাল। কিছু বোমারু বিমান উড়ছে। সে বলল, দেখছ, কেমন মহড়া দিচ্ছে! সকাল হলে এ-অঞ্চলটা কি যে হবে! সকাল হবার আগে আমাদের সবাইকে মজুমপুরে যেতে হবে। বরং আমিনুল তুই এক কাজ কর বলে সে কি ভাবল কিছুক্ষণ। বস্তুত এমন একটা সময় সে কি করবে ভেবে উঠতে পারছে না। – হাসিম ভাইয়ের আরও শক্ত হওয়া উচিত ছিল। কে কুটিরের সব খবর যে পৌঁছে দিয়েছে! সবটাই রহস্য মনে হয়। সে আর ভাবতে পারছে না। তবু এ-সময় মাথা ঠাণ্ডা রাখা দরকার। সে তারপর বলল, তুই আর মেহের নৌকা ঠেলে মজুমপুরে নিয়ে আয়। আমরা হেঁটে চলে যাচ্ছি।

আবুল বলল, আব্বা আমি ওদের সঙ্গে নৌকায় যাব?

তোর নৌকায় গিয়ে কি হবে?

মিনু বলল, তুমি বরং আমাদের সঙ্গে এস।

আবুল কেমন দুঃখী মানুষের মত মুখ করে রাখল। বলল, পায়ে আমার লাগছে। হাঁটতে পারছি না। পায়ে ফোসকা।

মিনু জানে ওরা অনেকখানি রাস্তা হেঁটেছে চষা জমির ওপর দিয়ে। সে সমসেরকে বলল, আবুল নৌকাতেই থাক।

—তবে যা।

আবেদালি বলল, আয় আমি তোকে কাঁধে নিচ্ছি।

সমসের বলল, কি দরকার কতটুকু আর পথ। ওরা নৌকায় গেলে হয়তো আমাদের আগে ঢলে যাবে।

এখন দুটো দল, দুভাগে যাচ্ছে। ক্লান্ত অবসন্ন ভগ্নপ্রায় মিছিলের মত ওরা হেঁটে যাচ্ছে।

চারপাশটা ফাঁকা, মাঠে চষা সব জমি। এবং পাশে নদীর জল, রুপোলি রেখার মতো। মাঠে ওরা দীর্ঘ যাত্রায় এসময় বের হয়ে পড়েছে। কবে ওরা বড় মাঠ পার হয়ে নির্দিষ্ট কুটিরে পৌঁছে যাবে জানে না।

এভাবে তারপর চারিদিকে গাছপালা পাখির ভিতর, শুধু দুঃখিনী বর্ণমালা মা আমার। গাছপালার ভিতর দিয়ে মায়ের জন্য ওরা ফের নতুন কুটির নির্মাণের ব্যবস্থা করছে। ওদের রাইফেলের বেয়নেটগুলো সূর্যের আলোতে চক চক করছিল। কি মহিমময় আকাশ, আর নক্ষত্র! দূরে হয়তো কোনও গাছের নিচে ময়না এখন পোশাক পাল্টে নিচ্ছে। গাছের উপর উঠে গেছে হামিদ। সে ডালে, শাখা-প্রশাখায় বৃহন্নলার মত সব তূণ তুলে রাখছে। সময় এলেই নামিয়ে দেবে।

ওরা তখনও হাঁটছিল। আশায় আশায় হাঁটছিল। ওরা এ-ভাবে আশায় আশায় হাঁটবে। ওরা এ- ভাবে হাঁটতে হাঁটতে একদিন ঠিক নদী পার হয়ে যাবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *