।। আটান্ন ॥
ওর নাম হামিদ, কেউ বলে নবীন। আবার শোনা যায় সে ইয়াকুব মিঞার ডেরায় ছিল বলে সঠিক কি নাম কেউ জানে না। পাগল মানুষ। এ অঞ্চলে সে আছে অনেকদিন থেকে। সে ভাল পীর মুর্শিদের গান গায়। ওর গলার স্বর খুব তাজা। এবং সবাই দেখেছে সে মসজিদে যেমন মোমবাতি দেয়, সে আবার কখনও কখনও কালীবাড়িতে রাঙাজবা রেখে আসে। তা পাগলের কাণ্ড না হলে এমন হবে কেন! সে কিছু দিন ধরে নানুমিঞার বাড়িতে আছে। সে সতেরো নম্বর কুটির থেকে সাতাস নম্বর কুটির পর্যন্ত যত পানি লাগে দিয়ে আসে। ওকে নিয়ে একবার মেহের বৈদ্যেরবাজারে হরিপদ সাহার দোকানে গিয়েছিল। কিছু মশলা আসবে। গোটা পথটা সে মশলার বাক্স কাঁধে করে এনেছে। মেহেরের কাঁধে রাইফেল। সে পাহারায় ছিল সব সময়। যখন ওরা নানুমিঞার বাড়ি পৌঁছাল তখন হামিদের কাঁধে ভারি বস্তুটা এত বেশি দেবে গেছিল যে প্রায় কাটা ঘায়ের মত। খুব বলশালী মানুষ হামিদ। সে বসেছে মেহেরের ক্যারিয়ারে। মেহেরের বেশ কষ্ট হচ্ছিল টানতে।
এতক্ষণ ওরা গান গাইছিল। সমস্বরে গান। ময়নার গানের গলা খুব ভাল। সাইকেলে ময়না আছে ঠিক মাঝখানে। ওর রাইফেলটা আকারে ছোট। অন্য রাইফেলগুলো সব পুরানো এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে হয়তো কেউ কেউ ব্যবহার করেছে। সব পি-ফোরটিন রাইফেল। ভীষণ ভারি। কেবল ময়নার রাইফেলটা হাল্কা এবং আধুনিক। এটা মেহেরই ঠিক করেছে। কারণ যে ফ্রন্টে ওরা লড়তে যাচ্ছে ময়নার উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে বলে যা কিছু ভাল, যেমন পোশাক, কারণ যে পোশাক ময়না পরে আছে কে বলবে ময়না যুবতী মেয়ে, ময়না এক রূপসী। ওকে দেখলে এখন মনে হবে সুন্দর এক তরুণ যুদ্ধে যাচ্ছে। সে তার লম্বা চুল বেনী করে খুব কায়দার সঙ্গে মাথার উপর হেলমেটের ভিতর ঢেকে নিয়েছে।
অরুণ সবার পিছনে। ফিরোজ ময়নার আগে। ময়নার পিছনে আবেদালি। সবার আগে মেহের। মেহেরের ক্যারিয়ারে হামিদ। হামিদ চুপচাপ বসে অন্ধকার রাতে বাতাসে জমির চষা মাটির গন্ধ পাচ্ছে। অথবা মনে হচ্ছিল ওরা জাম জামরুলের গাছের নিচ দিয়ে যাচ্ছে। এ গ্রামের নাম পানাম। দুধারে সব পুরানো ভাঙা বাড়ি। পোদ্দারদের বড় প্রতিপত্তি ছিল একসময় এখানে। ওরা কেউ কেউ আছে কেউ কেউ চলে গেছে ওপারে। রাতে ওরা কোন আলো জ্বলতে দেখল না। নিশুতি রাত এবং মাঝে মাঝে কুকুরের আর্তনাদ। পাঁচটা সাইকেল যাচ্ছে। ওরা এই পুরানো গঞ্জের মত জায়গায় ঢুকেই আর গান গাইছে না। ওরা নিঃশব্দে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে। এমন কি ওরা চাইছে না, ওরা যে যাচ্ছে কেউ টের পাক। সামনের গ্রামগুলিতে মুসলিম লীগের কিছু মানুষ আছে। তারা পাকিস্তানি চরের কাজ করছে।
ওরা নিঃশব্দে পার হবার সময়ই দেখল, পোদ্দারদের বড় বাড়িতে ধোঁয়া উঠছে। ওদের রাধা- গোবিন্দের মন্দির থেকে ধোঁয়া উঠছে। ওরা যাচ্ছে এখন পাঁচিল-ঘেরা গাবতলির খাল ধরে। পোদ্দারদের প্রাসাদের সদর দেখা যাচ্ছে। ডানদিকে একটা পাঁচিল-ঘেরা ফুলের বাগান। মনে হল অন্ধকারে কেউ বাগানে লুকিয়ে আছে, অথবা আত্মগোপন করে আছে। চারপাশে ধোঁয়া, আগুন। মেহের কতদিন রাবণ- বধের পালা শুনতে এসেছে ঝুলনের যাত্রায়। কত লোক, ঝুলনের সময় কত রকমের মিছিল। এবং নান রকমের পুতুল, অথবা খেলনার রেলগাড়ি, ছোট ছোট মাটির ঢিবি দিয়ে পাহাড়। আর কত লোক আসত তখন। পানামের ঝুলন ছিল এ-অঞ্চলে বিখ্যাত। বর্ষাকাল বলে, মেহের অরুণ আর কিরণমালা আসত নৌকায়। কিরণমালা ছিল মেহেরের বোন। ঝুলনে যাত্রাগান শোনার জন্য বাড়িতে প্রায় না বলে কয়ে চলে আসত। কিরণমালা কত ছোট ছিল তখন। কিরণমালার ভাল নাম ছিল হাসিনা বেগম, কিরণমালা নামটা দিয়েছিল গোবিন্দ সাহার বৌ। বলেছিল, ওর নাক দেখে, চোখ দেখে, আর নাকের নোলক দেখে, কেবল আমার গল্পের কিরণমালার কথা মনে হয়। সেই থেকে কি করে যে ওর নাম কিরণমালা হয়ে গেল। এবং সবাই ডাকত কিরণমালা বলে। আদরের বোনটা, বড় ছোট সে, পায়ে মল বাজত, এবং ছাগলের দড়ি ধরে মাঠে গিয়ে দাঁড়ালে মেয়েটাকে একটা ছোট শালিকপাখি মনে হত। অরুণের সঙ্গে সে আর কিরণমালা একবার পালিয়ে এসেছিল, সবাই ঘুমিয়ে পড়লে ঘাটের নৌকা নিয়ে যাত্রা দেখতে চলে এসেছিল। এমন নেশা যাত্রাগান শোনার। যাত্রাগান শেষে ভোররাতের দিকে খালের ধারে এসে দাঁড়ালে অবাক। কেউ প্রথমে কোন কথা বলতে পারে নি।
ওরা এসে গাবতলির খালের পাড়ে দাঁড়াতেই দেখেছিল অজস্র নৌকার ভেতর ওদের নৌকাটা নেই। নৌকাটা কোষা নৌকা। গুঁড়ার সঙ্গে সে শেকল দিয়ে একটা রসুনগোটা গাছের কাণ্ডে তালা মেরে রেখেছিল। আশ্চর্য শেকলটা পড়েছিল, তালা খোলা ছিল না, গুঁড়া করাত দিয়ে কেটে চুরি করে নিয়ে গেছে। ওরা সাঁতার কেটে খুব সকালে নিজেদের গ্রামে উঠে গেছিল। কেউ জানতেই পারেনি মেহেরদের বাড়িতে, মেহের নৌকা নিয়ে গিয়েছিল এবং নৌকাটা আর ফিরে আসেনি। মেহেরের বাজান সকালে উঠে দেখল ঘাটে নৌকা নেই। কারা চুরি করে নিয়ে গেছে নৌকাটা।
মেহের এভাবে নৌকা চুরির দায় থেকে রেহাই পেয়েছিল। বেশ মজা করে সে বলল, হ্যাঁ রে অরুণ, তোর মনে আছে যাত্রাগান শুনতে এসে আমাদের নৌকা চুরি গেল?
অরুণ সবার পিছন বলে কথাটা শুনতে পায়নি। সে বলল, কি বলছিস বুঝতে পারছি না। মেহের বেশি কথা বলতে গেলে হাঁপিয়ে যাচ্ছে। কারণ পিছনের ক্যারিয়ারে হামিদ, বলশালী মানুষ হামিদকে সে বেশিদূর বুঝি টানতে পারবে না। মেহের জোরে শ্বাস নিল। তারপর চিৎকার করে বলল, আরে ঐ যে তুমি আমি কিরণ একসঙ্গে এসেছিলাম রাবণ-বধের পালা দেখতে। মনে নেই? ভোররাতে গিয়ে দেখি নৌকা চুরি।
—খুব মনে আছে।
—কী দিন ছিলরে আমাদের! সব কেমন গোলমাল হয়ে গেল।
—সব ঠিক হয়ে যাবে। বলে অরুণ একটু তাড়াতাড়ি সাইকেল চালিয়ে মেহেরের পাশে পাশে চলতে থাকল। পাকা রাস্তা বলে বেশি কষ্ট হচ্ছে না। আর কিছু দূর গিয়েই তারা মাঠে পড়বে। এবং আলে আলে ওদের সাইকেল চলবে। তখন হামিদকে বদলা বদলি করে নিতে হবে। অরুণ বলল, কি রে ময়না, তুই যাত্রাগান শুনিসনি?
ময়না বলল, গুনাই বিবির গান আমাদের দিকে খুব হত। যাত্রাগান শুনিনি অরুণদা।
ফিরোজ বলল, তোর ভাগ্যটা খারাপ।
—খুব খারাপ।
ফিরোজ যেন কথাটা বলে কেমন অপরাধ করে ফেলল ভাব। তারপর চুপচাপ থাকলে ময়না ধরতে পারে—এমন কথা বলে ফিরোজ মনে কষ্ট পাচ্ছে। ও চুপচাপ থাকলে ময়না ধরতে পারে—ফিরোজ মনে মনে এ-কথাটা আবেগের বশে বলে ফেলেছে। ময়না সেজন্য মনে কিছু করে না। স্বামী বিহনে জীবন-যাপন কি যে কষ্টের! সে তবু জানে, তার সব কিছু এই যেমন জামা খুলে ফেললে পিঠ, এবং পিঠে যারা লিখে রেখে গেছে, বেয়নেটে লিখে রেখে গেছে, ‘পাকিস্তান’ এই সব ওকে যেন কুরে কুরে খায়। নৃশংস ঘটনা। স্বামীর নৃশংস মৃত্যুর ছবি চোখে ভাসলে ময়নার চোখ যেন প্ৰতিশোধে পাগলের মতো হয়ে যায়। একটা গাছের নিচে নিয়ে বেঁধে রাখা সারাদিন। গাছটার ডালে দুটো হাত তুলে বেঁধে রাখা। তারপর এখানে সেখানে খোঁচা দিয়ে রক্তপাত, আর সেই কঠিন মুখ কি যে দৃঢ় ছিল, তবু কবুল করাতে পারেনি, এদেশ বাংলাদেশ নয়, এ দেশের নাম পাকিস্তান, সে কেবল বলেছিল, দুঃখিনী বর্ণমালা মা আমার। যতবার খোঁচা খেয়েছে ততবার রক্ত ওগলাতে ওগলাতে বলেছে, দুঃখিনী বর্ণমালা মা আমার, মা মাগো, এবং এই সব কথার ভিতরই বেয়নেট দিয়ে পেট চিরে দিয়েছিল খান সৈন্যরা। তবু তার মুখ থেকে প্রায় এক আমোঘ বাণী, ঈশ্বর প্রেরিত দেবদূতের মত শপথ, দুঃখিনী বর্ণমালা মা আমার, সামনে তার ময়না ভালবাসার স্ত্রী, ধর্ষণে বার বার চোখের মণি সাদা হয়ে যাচ্ছে ময়নার, ময়নাও বলেছিল, দুঃখিনী বর্ণমালা মা আমার। কী করে যে এমন সাহস, যেন সেই মসজিদের গম্বুজে সোনালী সবুজ নিশান উড়ছে! সেখানে লাল সূর্যের ভিতর বাংলাদেশ। হাজার হাজার মানুষ নাকের নোলক দেখে, কেবল আমার গল্পের কিরণমালার কথা মনে হয়। সেই থেকে কি করে যে ওর নাম কিরণমালা হয়ে গেল। এবং সবাই ডাকত কিরণমালা বলে। আদরের বোনটা, বড় ছোট সে, পায়ে মল বাজত, এবং ছাগলের দড়ি ধরে মাঠে গিয়ে দাঁড়ালে মেয়েটাকে একটা ছোট শালিকপাখি মনে হত। অরুণের সঙ্গে সে আর কিরণমালা একবার পালিয়ে এসেছিল, সবাই ঘুমিয়ে পড়লে ঘাটের নৌকা নিয়ে যাত্রা দেখতে চলে এসেছিল। এমন নেশা যাত্রাগান শোনার। যাত্রাগান শেষে ভোররাতের দিকে খালের ধারে এসে দাঁড়ালে অবাক। কেউ প্রথমে কোন কথা বলতে পারে নি।
ওরা এসে গাবতলির খালের পাড়ে দাঁড়াতেই দেখেছিল অজস্র নৌকার ভেতর ওদের নৌকাটা নেই। নৌকাটা কোষা নৌকা। গুঁড়ার সঙ্গে সে শেকল দিয়ে একটা রসুনগোটা গাছের কাণ্ডে তালা মেরে রেখেছিল। আশ্চর্য শেকলটা পড়েছিল, তালা খোলা ছিল না, গুঁড়া করাত দিয়ে কেটে চুরি করে নিয়ে গেছে। ওরা সাঁতার কেটে খুব সকালে নিজেদের গ্রামে উঠে গেছিল। কেউ জানতেই পারেনি মেহেরদের বাড়িতে, মেহের নৌকা নিয়ে গিয়েছিল এবং নৌকাটা আর ফিরে আসেনি। মেহেরের বাজান সকালে উঠে দেখল ঘাটে নৌকা নেই। কারা চুরি করে নিয়ে গেছে নৌকাটা।
মেহের এভাবে নৌকা চুরির দায় থেকে রেহাই পেয়েছিল। বেশ মজা করে সে বলল, হ্যাঁ রে অরুণ, তোর মনে আছে যাত্রাগান শুনতে এসে আমাদের নৌকা চুরি গেল?
অরুণ সবার পিছন বলে কথাটা শুনতে পায়নি। সে বলল, কি বলছিস বুঝতে পারছি না। মেহের বেশি কথা বলতে গেলে হাঁপিয়ে যাচ্ছে। কারণ পিছনের ক্যারিয়ারে হামিদ, বলশালী মানুষ হ।মিদকে সে বেশিদূর বুঝি টানতে পারবে না। মেহের জোরে শ্বাস নিল। তারপর চিৎকার করে বলল, আরে ঐ যে তুমি আমি কিরণ একসঙ্গে এসেছিলাম রাবণ-বধের পালা দেখতে। মনে নেই? ভোররাতে গিয়ে দেখি নৌকা চুরি।
—খুব মনে আছে।
—কী দিন ছিলরে আমাদের! সব কেমন গোলমাল হয়ে গেল।
—সব ঠিক হয়ে যাবে। বলে অরুণ একটু তাড়াতাড়ি সাইকেল চালিয়ে মেহেরের পাশে পাশে চলতে থাকল। পাকা রাস্তা বলে বেশি কষ্ট হচ্ছে না। আর কিছু দূর গিয়েই তারা মাঠে পড়বে। এবং আলে আলে ওদের সাইকেল চলবে। তখন হামিদকে বদলা বদলি করে নিতে হবে। অরুণ বলল, কি রে ময়না, তুই যাত্রাগান শুনিসনি?
ময়না বলল, গুনাই বিবির গান আমাদের দিকে খুব হত। যাত্রাগান শুনিনি অরুণদা।
ফিরোজ বলল, তোর ভাগ্যটা খারাপ।
—খুব খারাপ।
ফিরোজ যেন কথাটা বলে কেমন অপরাধ করে ফেলল ভাব। তারপর চুপচাপ থাকলে ময়না ধরতে পারে—এমন কথা বলে ফিরোজ মনে কষ্ট পাচ্ছে। ও চুপচাপ থাকলে ময়না ধরতে পারে—ফিরোজ মনে মনে এ-কথাটা আবেগের বশে বলে ফেলেছে। ময়না সেজন্য মনে কিছু করে না। স্বামী বিহনে জীবন-যাপন কি যে কষ্টের! সে তবু জানে, তার সব কিছু এই যেমন জামা খুলে ফেললে পিঠ, এবং পিঠে যারা লিখে রেখে গেছে, বেয়নেটে লিখে রেখে গেছে, ‘পাকিস্তান’ এই সব ওকে যেন কুরে কুরে খায়। নৃশংস ঘটনা। স্বামীর নৃশংস মৃত্যুর ছবি চোখে ভাসলে ময়নার চোখ যেন প্রতিশোধে পাগলের মতো হয়ে যায়। একটা গাছের নিচে নিয়ে বেঁধে রাখা সারাদিন। গাছটার ডালে দুটো হাত তুলে বেঁধে রাখা। তারপর এখানে সেখানে খোঁচা দিয়ে রক্তপাত, আর সেই কঠিন মুখ কি যে দৃঢ় ছিল, তবু কবুল করাতে পারেনি, এদেশ বাংলাদেশ নয়, এ দেশের নাম পাকিস্তান, সে কেবল বলেছিল, দুঃখিনী বর্ণমালা মা আমার। যতবার খোঁচা খেয়েছে ততবার রক্ত ওগলাতে ওগলাতে বলেছে, দুঃখিনী বর্ণমালা মা আমার, মা মাগো, এবং এই সব কথার ভিতরই বেয়নেট দিয়ে পেট চিরে দিয়েছিল খান সৈন্যরা। তবু তার মুখ থেকে প্রায় এক আমোঘ বাণী, ঈশ্বর প্রেরিত দেবদূতের মত শপথ, দুঃখিনী বর্ণমালা মা আমার, সামনে তার ময়না ভালবাসার স্ত্রী, ধর্ষণে বার বার চোখের মণি সাদা হয়ে যাচ্ছে ময়নার, ময়নাও বলেছিল, দুঃখিনী বর্ণমালা মা আমার। কী করে যে এমন সাহস, যেন সেই মসজিদের গম্বুজে সোনালী সবুজ নিশান উড়ছে! সেখানে লাল সূর্যের ভিতর বাংলাদেশ। হাজার হাজার মানুষ ভাবে যেতে যেতে ওরা নানা স্মৃতিভারে যখন ডুবে যাচ্ছিল, তখন হাঁকল, মেহের, গান গাও, হুঁশিয়ার।
যেন সেই গান, তুমি নীরব কেন কবি ফুলেরই জালিসায়। আজ আমরা কাণ্ডারি হুঁশিয়ার শুধু গাইব না, বলে ময়না একটু বেঁকে সাইকেলটা দ্রুত চালিয়ে অরুণের পাশ কাটিয়ে একেবারে মেহেরের পাশে পাশে চলতে থাকল। মেহেরের ক্যারিয়ারে হামিদ। কেমন লজ্জায় মুখ নিচু করে রেখেছে হামিদ। সে ফ্রন্টে গোলক ধাঁধা বানাবে। সে মরদ সাজবে, আর ময়না দরকার পড়লে বিবি, মিঞা-বিবি যায়, গান গেয়ে, যেন আউল-বাউলের মত মিঞা-বিবির পথ সঠিক জানা নেই। যেদিকে দুচোখ যায় সেদিকে চলে যাওয়া। ময়না হামিদকে মুখ নুয়ে থাকতে দেখে বলল, কি গো মিঞা আমার মরদ হতে পারবে তো? আমরা ছদ্মবেশে দেশের জন্য কাজ করে বেড়াব।
বাধ্য ছেলের মত মাথা নিচু করে দিল হামিদ। হামিদের অদ্ভুত মুখ। বোকা ধরনের। চোখদুটো আশ্চর্য রকমের নিঃস্ব। প্রথমে দেখলে মনে হবে সে স্বাভাবিক মানুষ নয়। দেখলে মনে হবে, জড়বুদ্ধি তার চোখে মুখে খেলা করে বেড়ায়। হাবার মত সে চেয়ে থাকে। এবং যখন যার যেমন খুশি তার পেছনে লাগে। এখন এই যে যাওয়া, চারপাশের সব গাছপালার ভিতর দিয়ে এঁকে বেঁকে যাওয়া, এবং কাল কি ঘটবে কেউ জানে না, ওরা কেউ বেঁচে থাকবে কিনা তাও জানে না, যখন যে-কোনও অঞ্চলে ওরা ধরা পড়ে যেতে পারে খান সেনাদের হাতে, সুতরাং যে-ভাবে হোক একটু সময় মসগুলে বেঁচে থাকা এবং আমোদ করা, ময়না হামিদকে দুটো একটা কথা বলে আমোদ করতে চাইলেই মেহের গান ধরে দিল, কাণ্ডারি হুঁশিয়ার।
আশ্চর্য রকমের ফাঁকা মাঠ। দু’পাশের কোথাও আর গ্রাম চোখে পড়ছে না। এ-ভাবে মেঘনার পাড়ে পাড়ে অনেক দূর গেলে বারদী গ্রাম। এবং পুল পার হলে, খালের পাড়ে পাড়ে বানেরসরদি অথবা নওগাঁ গ্রাম, এবং কদমফুলের গাছ। এমন ফাঁকা মাঠ পেলে, কার গান গাইতে ইচ্ছা না করে? অরুণ বলল, আমি তোমাদের এখ্লাসউদ্দিনের সেই কবিতাটা আবৃত্তি করে শোনাচ্ছি, বলে গলা ভীষণ তুলে বলল,
কই গেল তোর কথার ফানুস,
লোভ দেখানো লালটু লাটিম।
তা ছেড়ে সব কই পালালো,
শিং উঁচা তোর হাট্টিমা টিম।।
কই গেল তোর ঢাল তলোয়ার,
খই ফুটানো বেতার ভাষণ।
কই গেলো তোর শাস্ত্রী সেপাই,
কই খোয়ালি সাধের আসন।।
রাত নিশুতে কই পালালি,
কই গেলো তোর দালান কোঠা।
সব খুইয়ে দাদার এখন
বেবাক পুঁজি গামছা লোটা।।
আবৃত্তি শেষ হলে সবাই একসঙ্গে হেসে উঠল। বলল, বেশ একখানা মজার কবিতা লিখেছিলেন তিনি।
তা ঠিক, এই ভাবেই যেন নিরুপণ হয় প্রত্যেক দেশের জাতির একটা আলাদা স্বাদ আছে। মাটি মানুষের আলাদা গন্ধ। এবং এই নিশুতি রাতে ওরা যখন সেই কাঠের বাক্স নিরাপদ জায়গায় তুলে নিয়ে যাবে বলে সাইকেলে গান গাইতে গাইতে অথবা আবৃত্তি করতে করতে যাচ্ছিল, তখন অজস্র তারা আকাশে একটা আশ্চর্য বর্ষার কদমফুলের গাছ হয়ে গেছে। রাইফেলের নলে বেয়নেট এই অন্ধকারেও লকাচ্ছিল। ধারালো নক্ষত্রের মত ওরা প্রত্যেকে পিঠে সেই বেয়নেট উঁচিয়ে যাচ্ছে। মেঘনার পানি কি শান্ত। চরের পাশে যে ইতস্তত জলাভূমি, সেখান থেকে কেউ ছপ্ ছপ্ করে উঠে আসছে মনে হল। ওরা সাবধান হয়ে গেল। ওরা সাইকেল থেকে নেমে পড়ল।
ওরা যেহেতু পাড়ে দাঁড়িয়েছিল, কেউ ওদের দেখতে পায়নি। সোজা পথে ওরা যাচ্ছে না। ওরা যাচ্ছে নিরাপদ স্থান কোথায় কোনদিকে কতটা আছে তা দেখে দেখে। ওরা ঘুরে ঘুরে যাচ্ছে। আর তখন নিশুতি রাতে ছায়ার মত কারা উঠে আসছে। গাছের অন্ধকারে ওরা। একটা মানুষ নয়, একে একে প্রায় পাঁচ-সাত করে দশ-পনেরো জনের ছায়া হয়ে যাচ্ছে। এবং টলতে টলতে ওরা উঠে আসছে। খান সেনারা মাঝে মাঝে আটকা পড়লে এমন হয়। পথ ঠিক করতে পারে না। নদীর ওপার থেকে একটা দল যদি ওদের এদিকে তাড়া করে নিয়ে আসে। ওরা আর দেরি করতে পারল না। যে যার মত সাইকেলগুলো ঝোপে-জঙ্গলে লুকিয়ে পোজিসান নিতে গিয়ে দেখল ওরা আর উঠে আসছে না। ওরা কেমন নদীর চরে ছায়ার মত সারি সারি অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।
অরুণ বলল, গ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছে।
মেহের বলল, তাই মনে হচ্ছে। অন্ধকারে অন্ধকারে যে যতটা পারছে সীমান্তের দিকে পালাচ্ছে।
—এখান থেকে সীমান্ত কত মাইল ওরা বলতে পারবে না।
আবেদালি বলল, তবু ওরা চলে যাবে। আমরা কেউ ওদের রাখতে পারব না।
অরুণ কি বলতে গিয়ে থেমে গেল। ওরা কারা সে জানে। ওরা ওপারের হিন্দু গ্রামগুলো থেকে নেমে এসেছে। একটা ভয় ছড়ানো হচ্ছে, যে কোন সময় চরের গ্রামগুলোতে আক্রমণ হতে পারে। কিছু অমানুষ ভয় ভীতি এমন প্রবল ভাবে ছড়াচ্ছে যে মানুষ আর চুপচাপ থাকতে পারছে না। অন্ধকারে ওরা যতটা পারছে এগিয়ে থাকছে। এখন এমন কেউ নেই ওদের সাহস দেয়। চারপাশ থেকে কেবল দুঃসংবাদ আসছে। ওদের বড় স্কোয়াড ছিল, গোপালদি নসিন্দিতে, ওরা মার খেয়ে একেবারে নাস্তানাবুদ কি যে হবে! তবু শেষ পর্যন্ত যতটা করা যায়। যতটা পারা যায় সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া।
এ ভাবে ধীরে ধীরে অন্ধকারে ছপছপ নদীর জলে অথবা ডাঙায়, যে-কোন জায়গায় ঠিক নয়, যেখানে গ্রাম মাঠ কম, বন বেশি, তার অন্তরালে দুঃখী মানুষের অনন্ত মিছিল। দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে। দুঃখিনী বর্ণমালা মা-র কথা তারা মনে রাখছে না।
ময়না আর পারছে না। যেন সে এই মিছিলে মিলে গিয়ে সবার আস্থা আবার ফিরিয়ে আনতে চায়। আপনারা এটা কি করছেন? ঘরবাড়ি জ্বলে যাচ্ছে, সব পুড়ে যাচ্ছে, আমরা পুড়ে যাচ্ছি না, আমার স্বামী, সেই যে জয়দেবপুরে ওকে খানেরা খুন করল, আমাকে অত্যাচার করল, কোথায় পালাচ্ছি আমরা, পালালে প্রতিশোধ নেওয়া হবে কি করে? সেই প্রথম থেকে কি যে পালানোর হিড়িক পড়ে গেল দেশটাতে! কেবল যাচ্ছে আর যাচ্ছে। কেবল দেশটা ক্রমে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে আর যাচ্ছে।
অরুণ বুঝতে পারল ময়নার চোখ চকচক করছে। অন্ধকারে কিছু বোঝা যায় না। কেবল বোঝা যায় ওর স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থাকা দেখে। ওর চোখ সেই জলাভূমির পরে, যেখানে মানুষের মিছিল অন্ধকারে উঠে এসে আবার অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে।
অরুণ বলল, ময়না ওরা চলে গেছে। আমরা অনেক পিছনে। দেরি করিস না। দেরি করলে আমাদের বিপদ হবে।
এখানেই ওরা দুটো ভাগ হয়ে গেল। ফিরোজ মেহের এবং আবেদালি চলে গেল আলিপুরার দিকে আর অরুণ ময়না হামিদ বাবুর হাটের দিকে।