॥ পঞ্চান্ন ॥
সমসের হাঁটতে হাঁটতে অন্ধকারে মানুষটার সঙ্গে নানা প্রসঙ্গে কথা বলছিল। সে যে একজন মুক্তি- যোদ্ধা হয়ে গেছে এবং সজনে ফুল যে তার সমর্থনে এতটা পথ হেঁটে এসেছে এ-ছাড়া যে কোনও সময়ে মৃত্যুর মুখোমুখি পড়ে যেতে পারে, ওদের কথাবার্তা শুনলে তা আদৌ বোঝা যাচ্ছে না। মিনু এবং আবুলের মুখ ভুলে থাকার জন্য ভিন্ন ভিন্ন প্রসঙ্গ উত্থাপন করছে সমসের। সে বলল, সজনে ফুল, এ-অঞ্চলের নাম তো সোনার গাঁ? আমরা বোধ হয় আদমপুরে এসে গেছি।
—হাঁ সাহেব।
—তুমি আমাকে সাহেব বলছ কেন?
—তা হলে আপনি আমার ভাইজান।
—সজনে ফুল তুমি খুব ভালমানুষ। তুমি সাদি করেছ কোন সালে?
—সাদি করেছি যেবার নারায়ণগঞ্জে দাঙ্গা হইল সেবারে।
—তোমার ছেলে-পেলে?
—এক মাইয়া ভাইজান? বলেই সে বলল, আমরা সোনার গাঁ-র মানুষ। ঈশা খাঁ-র খবর জানেন ভাইজান? সোনাই বিবি? সোনাইর নামে সোনার গাঁ। মাইয়াডার নাম সোনাই রাখছি।
—একবার দেখালে না?
—দেখামু কি। ঘুম থাইকা উইঠা পড়লে কার রাখনের ক্ষমতা আছে। আমারে ছাড়তে চাইত না। বলতে বলতে ওরা মাঠ পার হয়ে একটা খালে নেমে গেল। গ্রীষ্মের সময় বলে জমিতে কোন ফসল নেই। জমি চাষ করা। মাটি উল্টে পাল্টে এখন শুধু রোদ খাওয়ানো। জল পড়লেই মাটি ভিজে যাবে। একবার চাষ দিলে সব আগাছা তখন নষ্ট। জমিতে পাটের চাষ অথবা আউশ ধানের চাষ। মাঝে মাঝে তিলের চাষ সঙ্গে। বৃষ্টি নামলেই এ-অঞ্চলের চেহারা পাল্টে যাবে। এই যে রুক্ষ মাঠ, শুকনো ঘাসপাতা, সব কোথায় যে উড়ে যাবে।
ওরা খালে নেমে দেখল জল নেই। গ্রামে আর এখন কোথাও ওরা আলো জ্বলতে দেখল না। সব অন্ধকার। সব অন্ধকার। কেবল মাঠে জোনাকি-পোকা উড়ছে। কিছু কুকুর অথবা শেয়ালের আর্তনাদ। আর মাথার উপর পবিত্র আকাশ। পরিচ্ছন্ন। গরমে ভীষণ ঘাম হচ্ছিল সমসেরের। নাকি ঘাম দিয়ে জ্বরটা সেরে যাচ্ছে—সে ঠিক বুঝতে পারছে না। সে সজনে ফুলকে বলল, এই রাস্তাটা কি তোমার কদমতলির দিকে গেছে?
—না, ভাইজান। রাস্তাটা উইঠা গেছে কিষ্টপুরার দিকে। আমরা গোয়ালদির রামকিষ্ট মিশনের পাশ কাটাইয়া যামু।
—উদ্ধবগঞ্জ থেকে একটা বড় রাস্তা পানামের দিকে গেছে না?
—গ্যাছে। আমরা তার আগেই পাইয়া যামু। অদ্দূরে যামু না।
অর্থাৎ তার আগেই তারা তিন নম্বর কুটির পেয়ে যাবে। এই রাস্তাটা এসেছে গাবতলি থেকে। পানাম স্কুলের কাছে একটা ব্রিজ আছে, সেটা পার হয়ে আমিনপুরের দিকে চলে গেছে রাস্তাটা। তারপর দু’দিকে দুমুখো হয়ে আছে রাস্তা, একটা গেছে দীঘির পারে পারে মাঠের দিকে, অন্য রাস্তাটি গেছে গোয়ালদির কালীবাড়ির পাশ দিয়ে। আর একটু গেলেই সেই তিন নম্বর কুটির। সেখানে তিন-চার জন সজনে ফুল থাকবে। এমনিতে সারাদিন ওটা চায়ের দোকান। মেহের দোকান চালায়। সন্ধ্যার পর আর লোকজনের কোন চলাচল থাকে না। তখন এটা সামনের দিকে চায়ের দোকান এবং পিছনে শেডের পাশে তিন নম্বর কুটির। সামনে লম্ফ জ্বলে। মাথার উপর বড় একটা দেবদারু গাছ। গাছের অন্ধকারে কুটিরটাকে বড় নিরীহ এবং মায়াবী দেখায়। মেহের সেখানে সব মানুষদের সকাল থেকে গালমন্দ করে। রাজনীতি বোঝে না এবং কি যে হচ্ছে এ সব দেশে, এমন একটা ভাব। আর রাত হলেই সে তিন নম্বর কুটিরের বাসিন্দা হয়ে যায়।
সমসের দূর থেকে দেবদারু গাছটা দেখতে পাচ্ছে। ঠিক হুবহু সেই ছবি। গাছটা সহসা যেন লম্বা হয়ে আকাশ ছুঁতে চাইছে। কি বড় আর লম্বা গাছ! গাছের ঘন ঝোপে-জঙ্গলে সব অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে। সামনে সড়ক, সড়ক পার হলে পুকুর এবং পুকুরের পাড়ে সেনেদের পরিত্যক্ত বাড়ি। কিছু খানসেনা এসে এ-অঞ্চলের সব পরিত্যক্ত বাড়ি খুঁজে গেছে। যদি সেখানে সজনে ফুলদের কোন আস্তানা থাকে। খুঁজে কিছু পায়নি। মেহেরের দোকানে বসে চা খেয়েছে। ওরা সংখ্যায় দশ জনের একটা দল। সে বোকার মত হাসতে হাসতে কথা বলেছে। সে এমন অভিনয় করেছে যে কে বলবে মেহের সজনে ফুল। যেন মেহের ওদের বান্দা। বান্দার মত উর্দু-বাংলা মিশিয়ে রসের কথাবার্তা, একেবারে সে জমিয়ে দিয়েছিল। তারপর ওরা যখন মাইল তিন পথ পার হয়ে যাবে, দেখতে পাবে, কি অদ্ভুত কায়দায় জাল পাতা আছে। তিন নম্বর কুটির থেকে ওরা কোন পথে ফিরে যাবে নির্দেশ যাচ্ছে। এবং জালের ভিতর পাখির মত দশটা মৃতদেহ কারা নদীর পাড়ে ফেলে রেখে গেছে। ওদের বুকে কোন ক্ষত-চিহ্ন নেই। শ্বাসবন্ধ করে মারা হয়েছে।
এ-সব ভাবতে ভাবতে সমসের কেমন করে যেন যথার্থই মিনু আর আবুলের মুখ ভুলে গেল। ওর এখন সব মানুষের জন্য মায়া হচ্ছে। এমন কি ময়না যে এখন ওদের একজন, এবং সজনে ফুলের গন্ধে সে যে আর ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের কথা একেবারেই ভাবতে পারছে না। ভাবলে কি মনে হবে সমসের তাও জানে।
সমসের গাছটার নিচে গিয়ে দাঁড়াল। বাইরে থেকে উঁকি দিলে কিছু দেখার উপায় নেই। পাটকাঠির বেড়া। পাটকাঠি গোবর দিয়ে লেপে শক্ত বেড়ার ভিতর এই তিন নং কুটির। বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে, ভাঙা চাল, গরীব মানুষের দিনযাপনের আস্তানা। ভিতরের দিকটায় একটা তক্তপোষ। তক্তপোষটা সারা দিনমান খালি পড়ে থাকে। উপরে একটা ছেঁড়া সতরঞ্চ। সতরঞ্চটা একপাশে লম্বা হয়ে পড়ে থাকে। দেখলে মনে হবে অগোছালো মেহের। টেনে কেউ ঠিকঠাক করতে গেলেই দেখতে পাবে, কিসের সঙ্গে ওটা এঁটে আছে। টানলেও উঠে আসবে না। একপাশে সতরঞ্চটা একটা আড়াল সৃষ্টি করে রেখেছে। দিনের বেলাতে যে সব সজনে ফুল আসে অথবা রাতে, এখানে একটা হল্ট স্টেশনের মত কাজ সেরে নেয়। এবং গ্রামের ভিতর ময়না, নানু, অরুণ, আবেদালি সবার বাড়ি দুর্গের মত। এখান থেকেই চারজন যাবে দন্দির ঘাটে, চারজন যাবে পঞ্চমীঘাটে। যেখানে বাক্সটা থাকবে সেখানে ওরা সারাদিন পাহারায় থাকবে। দেখলে মনে হবে ওদের তখন—ওরা গরীব মানুষ। কাজের জন্য এ-অঞ্চলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বগলে পুঁটলি, ছেঁড়া লুঙ্গি, একটা লম্বা বাক্স। বাক্সতে কাচি, পাচন এবং নিড়ানি। উপরে এসব, নিচে তিন নং কুটিরের নির্দেশ।
সমসের সজনে ফুল বলার আগে চারপাশটা ভাল করে দেখে নিল। অন্ধকারে কেউ ঘাপটি মেরে বসে থাকতে পারে। সে তার সঙ্গে সজনে ফুলকে, মুখে আঙুল রেখে, খুব সন্তর্পণে গাছের অন্ধকারে লুকিয়ে পড়তে নির্দেশ দিল। খালি বাড়িটা ভুতুড়ে মনে হচ্ছে, একটা চিল কি শকুন বাড়িটার ছাদে বসে আর্তনাদ করছে। এই বাড়ির খুব নাম-ডাক ছিল এক সময়। এখনও সদরে দেউড়ি। দেউড়িতে ফুলপরী। ভাঙা হাত-পা। ডানাকাটা পরী দেউড়িতে দাঁড়িয়ে আছে। পূজা-পার্বণের দিনে ঢাক বাজত। খুব কান পেতে শুনল যেন এখনও শোনা যাবে মহিম সেনের গলা ভেসে আসছে। অথবা ঘোড়ার ক্ষুরের ঠকঠক শব্দ। খুব রাত হয়ে যেত মহিম সেনের ফিরতে। সে নারাণগঞ্জের কাছারিতে কাজ সেরে ঘোড়ায় ফিরে আসত। এবং সমসের মেহেরের মুখে শুনেছে, মেহের এ-অঞ্চলের মানুষ, সে তার দেশের নানারকমের সংস্কৃতির ভিতর সেনেদের দুর্গাপূজার কথা প্রায়ই বলত। মেহেরের বাবা সেনবাড়ির খেয়ে মানুষ। সে ঘোড়া এবং পুকুরের মাছ পাহারা দিত।
সমসের চারপাশ তাকালে আরও দেখল, ডানদিকে ঘন বাঁশঝাড়। বাঁশ বনটা অনেকটা জায়গা নিয়ে। মাথার উপরে আকাশটা এখানে লম্বা হয়ে আছে। অন্ধকারে একটা প্রাণীর চোখ, বোধহয় বনবেড়াল হবে। চোখ দুটো জ্বলছে। সে ঢিল দিয়ে দেখল অন্য কিছু কিনা। তারপর খসখস পাতার শব্দ। জন্তুটা পাশের নালা পার হয়ে বাঁশবনে ঢুকে গেল। তখন সে সজনে ফুলকে সঙ্গে নিয়ে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ডাকল—সজনেফুল।
সমসের কোন সাড়া পেল না।
এবার সে বলল, সজনে ফুল—তিন নম্বর কুটির।
এবারও সে সাড়া পেল না। সে খুব বিস্মিত। ঘরের ভিতরটা অন্ধকার। এমন কি কারও কথাবার্তা পর্যন্ত শোনা যাচ্ছে না। ভিতরে কেউ আছে বলেই মনে হচ্ছে না।
সে ভাবল, ভুল করে সে অন্য জায়গায় চলে আসেনি তো! সজনে ফুল কি ওর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে! সে কি একটা ট্র্যাপের ভিতর পড়ে গেল! সঙ্গে সঙ্গে প্রায় ত্বরিতে এক পাশে সরে দাঁড়াল। এবং পকেট থেকে সে পিস্তল বের করার আগে শেষ বারের মত ডাকল, সজনে ফুল, তিন নম্বর কুটির, তালপাতার পাখা।
সঙ্গে সঙ্গে চিচিং ফাঁকের মত দরজা খুলে গেল। দরজা খোলার শব্দে অন্ধকারে কিছু বাদুড় উড়ে গেল। কড় কড় শব্দটা ওর কানেও ভীষণভাবে বেজেছে। প্রায় ওকে ঠেলে কারা ভিতরে ঢুকিয়ে নিল। তারপর দরজাটা বন্ধ করে দিল। সঙ্গের সজনে ফুলকে ওরা ভিতরে ঢুকতে দিল না। কি নির্দেশ আছে সে এখন বুঝতে পারছে না। এবং ঝোপ-জঙ্গলে কিছু পাখি কলরব করে উঠল। ভিতরে কেউ যে বসে আছে এবং দ্রুত নিশ্বাস ফেলছে, টের পাওয়া যাচ্ছে। সমসের ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে না পেরে হতভম্ব হয়ে গেছে এবং এ সময়েই দেখল ওর মুখে টর্চ মারছে কে। মুখ দেখার বোধহয় নিয়ম নেই। সে সেই টর্চের আলোতে দেখল ওর কেডস্ জুতো ছিঁড়ে গেছে। এবং বৃদ্ধাঙ্গুলটি বের হয়ে কচ্ছপের গলার মত দেখাচ্ছে। পা কেটে রক্ত পড়ছে। কখন হোঁচট খেয়ে নোখটা উঠে গেছে সমসের টের পায়নি।
ভিতরের দিকে তাকাতে গিয়ে টর্চ জ্বালতেই বুঝল মেহের তার পাশে বসে আছে। সে এবার শুনতে পেল, মেহের ফিসফিস গলায় বলছে, আমাদের তিন নম্বর কুটির ছেড়ে দিতে হচ্ছে ভাইসাব।
সমসের বলল, তার মানে?
—খবর এসেছে একটা বড় ইউনিট আসছে। তিন নম্বর কুটিরের খবর পৌঁছে গেছে। আমরা আপনার জন্যই শুধু বসে আছি।
—এখানকার সব কিছু কোথায় আছে?
—বাড়ি বাড়ি পাচার করে দিয়েছি।
—পঞ্চমীঘাটে কাদের পাঠালে?
—তিনজন গেছে। আমাদের গাবতলি স্কোয়াড বৈদ্যের বাজারে ধরা পড়েছে। ওদের থেকে পঞ্চমীঘাটের স্কোয়াডে একজন থাকার কথা ছিল। ফলে এখন চারজনের জায়গায় তিনজনকে পাঠাচ্ছি।
—ওরা এখনও রওনা হয়নি?
—রওনা হয়ে গেছে। নানুদের বাড়িতে খেয়ে নেবে। ময়না রেঁধে বেড়ে খাওয়াচ্ছে। কবে ফিরবে ঠিক কি? কিভাবে ফিরবে কে জানে! তাই দুটো খেয়ে নিতে বললাম।
—ভাল করেছ। তবে আর দেরি কেন? ছেড়ে যখন দিতে হবে, মায়া বাড়িয়ে লাভ নেই।
—কিছু নেবার এখনও বাকি আছে। বলে সে টান মেরে সতরঞ্চটা খুলে ফেলল। দেয়ালের কাছে ঠিক তিন হাত বাই দুইহাত এবং প্রায় সাত ফুটের মত গর্ত, গর্তের নিচে পাঁচটা রাইফেল এবং কার্তুজের একটা বাক্স। এটা নিয়ে নিতে পারলেই শেষ। মেহের বলল, যারা বসে আছে তারা আপনি এলে রওনা দেবে কথা আছে। এ-ক’টা হাত-ছাড়া করিনি। আপনি আসার আগে ওরা যদি চলে আসে, সেজন্য রেখে দিয়েছিলাম, লড়াইটা এখানেই আরম্ভ করে দেব ভেবেছিলাম।
ওরা এবার রাইফেলগুলি কাঁধে ফেলে নিল। কার্তুজের বাক্সটা মেহের বগলে নিয়ে বের হল। এবং সেই যে তিন হাত বাই দুই হাতের গর্ত, তক্তপোশের নিচে সতরঞ্চতে ঢাকা থাকত, তা ওরা কোদাল মেরে বিনষ্ট করে দিল। এবং ওরা নিরাপদ দূরত্বে চলে গেলে কথা থাকল আগুন লাগিয়ে দেওয়া হবে। আগুন লাগাবার জন্য ১১৯ নম্বর সজনে ফুলকে রেখে দেওয়া হল।
সমসের হাঁটছিল। সে অন্ধকারেই ঘড়ি দেখল। দশটা বেজে বাইশ মিনিট। যারা পঞ্চমীঘাটে যাবে, তাদের সাইকেলে যেতে অধিক সময় লাগলে ঘণ্টা দুই। আর অবনীর পঞ্চমীঘাটে পৌঁছতে রাত চারটা হয়ে যাবে। এমন কি বাধা পেলে রাত ফর্সা হয়ে যেতে পারে। সুতরাং সে এ ব্যাপারে তাড়াহুড়া করল না। দন্দি যারা যাবে তাদের রাত বারোটার পর রওনা হলেও হবে। পাকা রাস্তায় অবশ্য যাওয়া কঠিন। মোড়ে মোড়ে সৈন্যদের টহল আছে। ওরা যাবে খংসারদির পাশ কাটিয়ে। সোজা বারদী উঠে যাবে। তারপর নওগাঁ ডাইনে ফেলে একটা কাঠের সাঁকো, সে হিসাব করে দেখল কাঠের সাঁকো একটা নয়, দুটো। বারদীর পরে ছাগল বামনিনদীতে একটা সাঁকো আছে। ওরা দুটো কাঠের সাঁকো পার হয়ে যাবে। ওরা তারপর যেখানে লাধুরচর-দন্দি-মহজমপুরের ভিতর নদীর একটা চড়া আছে সেখানে অপেক্ষা করবে। দন্দির শ্মশানঘাটই সব চাইতে নিরাপদ জায়গা, রাতে ভয়ে কোন মনুষ্য সেখানে যায় না।
সে বুঝতে পারল এখন ওরা নানুদের বাড়ি যাচ্ছে, নানু মিঞা এ অঞ্চলের বড় গৃহস্থ। সে আওয়ামী লীগের হয়ে খুব খেটেছে। মজিবুর সাহেবের বান্দা লোক। এখন সে সব ছেড়ে দিয়ে আল্লার নামে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। জমি-জিরাতের চেয়ে বড় মনে হয়েছে দেশের কাজ। গোলার ধান সে সংরক্ষণ করছে। অসময়ে যেন কোনও সজনে ফুলের আহারের না অভাব হয়। সে উঠেই দেখল, নানু মিঞা দাওয়ায় বসে তামাক খাচ্ছে। কে বলবে নানু মিঞাকে দেখে বাড়ির ভিতর সে একটা বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। বাড়ির সামনে পুকুর। পুকুরের উত্তরে খাল। মরা একটা কড়ুই গাছ। পুকুরের পাড়ে পাড়ে করমচা গাছ। গাছে ফুল এসেছে। ওরা যেতে যেতে করমচা ফুলের গন্ধ পাচ্ছিল। ওদের দেখেই নানু মিঞা উঠে এল। গ্রাম থেকে আরও সব মানুষজন এসেছে। এই অঞ্চলের সব মানুষ জয় বাংলার হয়ে কাজ করছে। কোন ভয় নেই এমন ভাব সবার চোখে-মুখে। তবু যে সব বাড়িতে তারা দুর্গ তৈরী করছে, সেখানে কাউকে যেতে দিচ্ছে না। কারণ এরই ভিতর কেউ কেউ টাকার লোভে তাদের ধরিয়ে দেবার মতলবে আছে। কে যে ভিতর থেকে চরের কাজ করছে কেউ টের পাচ্ছে না। ধরা পড়লে গুলি করে হত্যা করছে। এবং সব মানুষেরা যারা বাংলাদেশের মানুষ—সবাই এসে মৃতদেহের উপর থুতু ফেলে যাচ্ছে। এবং ক্রমে এইভাব এই সব অঞ্চলে সব মানুষের ভিতর—এই যে বাংলাদেশ, এবং জননীর মত তার মাঠ ঘাট এবং ফসলের ক্ষেত সব অতীব প্রিয় বস্তু, মা জননী, তার উপর আর কিছু থাকতে নেই।
সমসের কাছে গেলেই নানু মিঞা বলল, সালেম আলাই কুম
সমসের বলল, আসছালাম আলাই কুম।
তারপর হাত ধরে পরস্পর ঝাঁকি দিল। এবং একে অপরকে আলিঙ্গন করলে সব কিছু দেখাতে হয় এমন একটা মুখ করে রাখল নানু মিঞা। গায়ে বোধহয় সমসেরের এখন জ্বর নেই। মাথাব্যথাটা কম। উত্তেজনায় সে অধীর হয়ে আছে বলে টেরও পাচ্ছে না শরীরের ভিতর যে কষ্ট তার রকম সকম কি। সে নানু মিঞার সঙ্গে হাঁটতে থাকল। পেঁয়াজ-রসুনের ঝাল গন্ধ আসছে। মাছের ছালোন রান্না করছে ময়না। চারপাশে এখন তার কত মানুষজন। খবরাখবর নিচ্ছে। ঢাকা নারায়ণগঞ্জে কি রকম মানুষ মরছে, গোলায় কত মানুষের প্রাণ গেছে—এসব খবরই বেশি দিতে হচ্ছিল সমসেরকে। কারণ কেউ এখানে সঠিক খবর পাচ্ছে না। নানারকম গুজা রটছে। কেউ বলছে মুজিব সাহেব ধানমণ্ডির বাড়িতেই আছেন, পাকিস্তানি সৈন্যরা পাহারা দিচ্ছে, কাউকে যেতে দিচ্ছে না। কেউ বলছে, না, তিনি পালিয়ে গেছেন। আবার কেউ বলছে তিনি এখানে নেই, মুলতানে তাকে পাচার করে দেওয়া হয়েছে। ঢাকার রেডিওর থেকে কিছু খবর পাওয়া যাচ্ছে না। বন্ধ। কলকাতার রেডিওতে খবর, মুজিব আছেন, বাংলাদেশের মানুষের ভিতরই আছেন।
সমসের যতটা পারছিল কম কথা বলছিল। সে নিজের চোখে যা দেখেছে শুধু তাই বলছে। কেন যে মনে হল, সেই খুদে বাচ্চাটাকে সে কোলে করে নিয়ে এলে পারত। ওদের কাছে বাচ্চাটা রেখে আসা ঠিক হয়নি। বাচ্চাটাকে নিয়ে মিনু আবুল অবনীর বিপদ হতে পারে। সে এমন একটা বোকামির কাজ কেন যে তখন করতে গেল! এখানে নিয়ে এলে ময়না বাচ্চাটা দেখা-শোনা করতে পারত।
ময়না খলখল করে হাসতে হাসতে বের হয়ে এল উঠোনে। বলল, ভাইসাব রান্না হয়ে গেল। দুটো আপনিও খেয়ে নেন।
—আমার জন্য তোমায় ভাবতে হবে না। বলে সে ময়নার চোখে কি দেখল, তারপর বলল, যাদের, পাঠাচ্ছি তাদের আগে খাইয়ে দাও।
মেহের ঘর থেকে বের হচ্ছিল। কার্তুজের বাক্সটা সে ভিতরে রেখে এসেছে। সে ভিতরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ডাকল, সমসের ভাই, একবার ভিতরে আসুন। ভিতরে সে ঢুকলে দেখল তক্তপোশের নিচে সেই গর্ত। এবং শান-বাঁধানো। উপরে কাঠের পাটাতন। দুজন লোক দাঁড়িয়ে রাইফেল চালাতে পারবে। ট্রেঞ্চের মত করে কাটা। সামনে বেড়া কাঠের। কাঠ তুলে দিলে সামনে মাঠ। ট্রেঞ্চ অদ্ভুত কায়দায় তৈরী।
মেহের বলল, সব কটা দেখতে আপনার অনেক সময় লাগবে। কাল সকালে দেখাব আপনাকে।
সমসের চারপাশটা ভাল করে দেখল। এখন উঠোনে কিছু গ্রামের লোক দাঁড়িয়ে আছে। ওরা সমসেরকে দেখতে এসেছে। সমসেরই এই অঞ্চলের উপরওয়ালা। ওর নির্দেশ মত মেহের, অরুণ সব কাজ চালাচ্ছে। এবং ময়নাকে সে এখানে এনে রেখেছে। কামালের সঙ্গে যোগাযোগ সে করতে পারছে না। কামাল ঠিক সবার খবর পেয়ে যাচ্ছে। কামাল খুব সন্তর্পণে সংগঠনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এই সব যত মনে হচ্ছিল, তত আবুলের চোখ ওকে কেন যে বার বার টানছে। বাপজান আমি পারব তো? তুমি ঠিক পারবে বাপজান। তোমার জননীর ইজ্জত এখন তোমার হাতে। সে জননী বলতে এখন মিনু এবং ধরিত্রী উভয়কে বোঝে।
ময়না এসে বার বার বায়নাক্কা করছে, সমসের ভাই, হাত-পা ধোবার পানি বদনাতে রাখছি। হাত- পা ধুয়ে দুটো খেয়ে নিন।
নানু মিঞার বৈঠকখানায় এখন একটা হ্যারিকেন জ্বলছে। পুকুরের পাড়ে মসজিদ। মসজিদের বারান্দায় মনে হল কেউ বসে রয়েছে। অথবা কেউ এসেছে মোমবাতি জ্বালতে। এত রাতে মোমবাতি জ্বালতে আসা কেন?
নানু মিঞা বলল, ওটা এক পাগলের কাণ্ড।
—কে সে পাগল?
—নাম হামিদ।
—কি করে?
—কিছু করে না। কেবল বাজারে গঞ্জে গান গায়। অর বিশ্বাস মোমবাতি জ্বালাইয়া রাখলে মুজিব সাহেবের কোনও ক্ষতি কেউ করতে পারব না।
সমসের বলল, বেশি আলো জ্বেলে রাখবেন না। সব সময় এখন অন্ধকারে থাকার চেষ্টা করবেন।
সমসের জানে এরা সমর-কৌশলে অজ্ঞ। এরা শুধু বললে, প্রাণ দিতে পারে। প্রথম প্রথম ক’দিন ওদের প্রাণ দেবার যেন শেষ ছিল না। আবেগে ওরা ভেসেছিল, হয় স্বাধীনতা না হয় মৃত্যু। ওরা সেই সব খান সেনাদের মানুষ ভেবেছিল। দুবার তিনবার চারবার। নিরস্ত্র মানুষ যখন মরবে তখন ওরাই হয়তো বন্দুকের নল ঘুরিয়ে ধরবে। কি যে আশা কুহকিনী? সমসেরের কুহকিনী শব্দটাই এ সময়ে ব্যবহার করতে ভাল লাগছে।
সে বলল, আমাদের এখন আবগের বশে কিছু করলে চলবে না নানু মিঞা। সে একটা চেয়ারে বসে নানু মিঞার ঘরের জানালা এবং পাটের পুরানো গাঁট দেখতে দেখতে এমন বলল। তারপর সহসা যেন কিছুই ঘটছে না বাংলাদেশে এমন চোখে বলল, পাটের কি দর যাচ্ছে?
—গণ্ডগোলের আগে পাঁচ্চল্লিশ টাকা দাম উঠেছিল।
—আসার সময় একটা জুটমিলে আগুন লেগেছে দেখলাম।
—আমাগো আর কিছু থাকব না।
সমসের চুপচাপ বসে থাকল। সে একটা ইংরেজী বই, বইটাতে রাশিয়ার প্রথম বিপ্লবের দিনগুলির কথা লেখা আছে, সে হ্যারিকেনটা উসকে বইয়ের পাতা মেলে ধরল। এবং সে জানে, একটু বাদেই অরুণ আসবে তার দলবল নিয়ে। মেহের, অরুণ, আবেদালি, ফিরোজ এই চারজনকেই সে দন্দি পাঠাবে ভাবল। মেহেরকে না পাঠালে হাসিমের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে না। মেহের ও-অঞ্চলের সব ভাল চেনে।
পাশের তক্তপোশটায় একটা বাচ্চা ছেলে এসে একটা মাদুর বিছিয়ে দিল। ওরা গোল হয়ে এখন খেতে বসবে। নানু মিঞার বিবি ঘরের বার হন না। ময়নাই সব এনে এনে এই বৈঠকখানায় রাখবে। ভাত, ডাল এবং চাপিলা মাছের ঝোল।
তখনই অরুণ এসে গেল। ওর সঙ্গে সাবির, মাতিন, কবিরুল। ওদের কাঁধে রাইফেল। অরুণ এলেই সমসের উঠে দাঁড়াল। এবং সবাইকে আলিঙ্গন করে বলল, তোরা ভাল আছিস?
অরুণ কাঁধের রাইফেলটা নামিয়ে রাখল। ওরা যেন সব সময় প্রস্তুত হয়েই আছে। ওদের মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। ওরা নদীর পাড়ে যে থানা আছে তা দখল করে নিয়েছে। এবং সেখানে সব সময় দশজনের একটা দল পাহারা দিচ্ছে। এ-অঞ্চলে কিছু অর্থাভাব দেখা দিয়েছে। এখন গ্রীষ্ম কাল বলে জল নেই, ঘাস মাটি শুকনো, চাষাবাদ হতে পারছে না। তবু যেখানে সামান্য জল আছে ওরা ছিঁচে বোরো ধান চাষ করছে। সব মানুষের ভিতর এক আশ্চর্য কঠিন প্রতিজ্ঞা। কেউ আর বসে থাকছে না। যে যার মত জননীর হয়ে খাটছে। এমন দৃঢ়তা সমসের যেন ইহকালে এই প্রথম দেখছে। সে বলল, হাত-পা ধুয়ে তোরা খেয়ে নে। অরুণ তোকে দন্দি যেতে হবে। মেহের তুই, আবেদালি, ফিরোজ যাবি। মেহের বলছিল ফিরোজকে যেতে হবে না। সে ময়নাকে নেবে। ময়না তাদের সঙ্গে যাবার জন্য পাগল হয়ে গেছে। তারপর কবিরুল, মাতিন, সাবিরকে ডেকে বাইরে নিয়ে গেল। এবং ওদের কি বলে সে ফের ঘরে চলে এল।
অরুণ কি ভেবে বলল, ময়না যাবে এমন তো কথা ছিল না।
—তবে ওর যাওয়া ঠিক না। ওকে ১৭ নং কুটিরে পাঠিয়ে দে।
—মেহেরকে ডাকি।
মেহের এলে বলল, ময়না ১৭ নং কুটিরে যাক? সেবা-শুশ্রূষার জন্য আরও লোকের দরকার। মেহের মনে মনে অন্য রকম চাইছে। কারণ তার কাছে শেষ খবর যা এসে পৌঁছেছে তাতে সে জানে দন্দি, মহজমপুর এবং আলিপুরার দিকটাও নিরাপদ নয়। মিনু-ভাবীর পক্ষে সম্ভব নয় হাতে পড়ে গেলে রক্ষা পাওয়া। একমাত্র ময়না পারে। ময়না ইতিমধ্যেই নানা কৌশল শিখে ফেলেছে। আর আশ্চর্য, সে বার বার পার পেয়েও যাচ্ছে। এবং এটা সম্ভব হচ্ছে একমাত্র ময়নার চোখের জন্য। চোখে সুর্মা দিলে বড় মায়াবিনী লাগে এবং সে পুরুষদের মত অনায়াসে সাইকেল চালাতে পারে। সে কাঁধে রাইফেল নিয়ে দীর্ঘপথ হাঁটতে পারে। হাঁটতে ওর কষ্ট হয় না। ময়না বলেছিল, আমি ওদের ভিতরে ঢুকে যদি সবাইকে মজিয়ে রাখতে পারি!
মেহেরের মনে হয়েছিল তার পরামর্শ মত গেলে ভালই হবে। সঙ্গে থাকলে সে ময়নাকে নানাভাবে কাজে লাগাতে পারবে। ময়না কথা বলে উর্দু ভাষায় এবং গানও গাইতে পারে—ওর ইচ্ছা সেই পাগল মানুষটাও সঙ্গে যায়, যে মোমবাতি জ্বালায়। তাকে নিতে পারলে খারাপ হবে না। সে ডুগডুগি বাজাবে। সে লাফিয়ে লাফিয়ে বাজাবে। আকাশ-বাতাস দুলে উঠবে, গমকে সে যদি পায়ের তালে বোল দিতে পারে, আর বোরখার নিচে সে যদি বিবি নিয়ে ঘুরে বেড়ায় তবে খানেদের জিবে লালসায় জল আসবে। এবং এ-ভাবে কিছু কৌশল করতে পারলে সহজে কাজ হয়ে যাবে; অথবা যেতে পারে।
মেহের জানে সমসেরের কথার উপর আর কথা নাই। তবু সে তার পরিকল্পনার কথা মোটামুটিভাবে খুলে বললে সমসের কেন জানি চুপ হয়ে গেল। গরম ভাত থেকে ভাপ উঠছে। কাঠের বারকোষে উঁচু করা ভাত। কাঠের হাতা। কলাই করা বাটিতে ডাল। সবই গরম। এবং যারা এখন হাত-পা ধুয়ে এসেছে তারা মাদুরে গোল হয়ে খেতে বসে গেল। সে ওদের দিকে তাকাল না। জানালা দিয়ে সে দেখতে পাচ্ছে, আকাশে কত নক্ষত্র। সবুজ নক্ষত্রটার নিচে হয়তো এখন মিনু আর আবুল আছে। ওদের জন্য কি যে মায়া! কিছুতেই সে আবুলের মুখ, মিনুর মুখ ভুলে থাকতে পারছে না। সে বলল, ঠিক আছে। যদি দরকার মনে করিস নিয়ে যা। তবে অযথা ওকে বিপদের মুখে ঠেলে দিস না।
খেতে বসে সমসের চুপচাপ খেতে লাগল। খুব একটা কিছু খেল না। খেতে ওর ভাল লাগছে না। তবু না খেলে সে যে তার স্ত্রী এবং সন্তানের জন্য খুব বেশি ভাবছে, ধরে ফেলবে সবাই। এখন এ সময়ে নিজের বলতে কিছু নেই। সবাই নিজের। সবাই আপনার। কোনও পরিবার-ভিত্তিক ভাবনা এখন ঠাই দিতে নেই। গোটা বাংলাদেশ এখন এক পরিবারের। এই সব, গ্রহ নক্ষত্র যা কিছু দেখা যায় সব যেন একই পরিবারের হয়ে দেখা। সে মুখ নিচু করে খেয়ে, পেট ভীষণ ভরে গেছে এমন ভান করল চোখে-মুখে।