2 of 2

ঈশ্বরের বাগান – ৫১

॥ একান্ন ॥

ইস্ কি যে ঝামেলায় ফেলে দিল ফতিমাকে! অতীশ সেই থেকে টের পাচ্ছিল। অথচ কিছু বলতে পারছিল না।

মনে আছে মাথাটা কেমন ঘুরে গেল—তারপর সব অন্ধকার। কতটা সময় অন্ধকারে ডুবেছিল সে জানে না। ফতিমা টুটুল মিণ্টু সবাই কেমন ফাঁপরে পড়ে গেছিল। সুখি ছোটাছুটি করছে।

ফতিমা ডাকছে সোনাবাবু, সোনাবাবু—সে সাড়া দিতে পারছে না। চোখ খুলতে পারছে না। তার শরীর কেমন স্থবির হয়ে আছে। চোখে মুখে জলের ঝাপটা তবু সে চোখ খুলতে পারছিল না। অথচ সে সব বুঝতে পারছে। আলম সাবের গলা পেয়েছে। এমন কি বউরাণীও এসে দাঁড়িয়েছিল পাশে। বেশ লোকজনের ভিড়—তাও টের পাচ্ছিল। কেমন এক ঘোর এবং সেখানে আর্চির প্রেতাত্মা নাচানাচি করে গেছে। মাথার মধ্যে কি যে হয়! সে এও শুনেছে, সাদা চাদর, সাদা ওয়াড় চাই। ফুলদানি চাই। ফতিমা সব এক এক করে বলে দিচ্ছে। কেউ না থাকলেও তার কেন যে মনে হয়েছে ফতিমা আছে। সে সব করবে। ডাক্তার থেকে ওষুধ ইনজেকশান সব সে ব্যবস্থা করবে। ঘোরের মধ্যে সে পড়ে যায়, এটা তার আরও হয়েছে—কিন্তু এবার যেন তার কোনও হুঁশ ছিল না। কতক্ষণ হুঁশ ছিল না সে এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। এত ডাকাডাকি সত্ত্বেও সে সাড়া দিতে পারে নি। তার নিজেরই সংকোচ হচ্ছিল। সে যদি কথা বলতে পারত, ইচ্ছা করলে যে পারত না, তা মনে হয় না। আসলে সে চায়নি, কেউ টের পাক সে ভাল আছে। যেন ঘাপটি মেরে পড়ে থাকা। ডাক্তার দেখেছেন, চোখ টেনে দেখেছেন, তিনি বুঝতেই পারেন, কোনও ঘোর থেকে বাবুটির এমন হয়েছে। মানসিক অবসাদের কথাও সে শুনেছে। সে তবে কি সত্যি মানসিক রোগে আক্রান্ত। নতুবা দেখবে কেন, একটা ক্রসের নিচে সে বসে আছে। সে কেন ডাকছিল, বনি, বনি—সেই এক আশ্চর্য কোমল অধীর অপেক্ষা কখনও মানুষকে এ-ভাবে নিতান্ত নিরুপায় করে তোলে! নির্মলার কাছে খবর পাঠান যায় নি, কেউ তো জানে না, বর্ধমান থেকে বাসে বলগনা হয়ে গুসকরা—তারই মাঝামাঝি গোরস্থান বাস-স্টপ। সেখানে নেমে গেলে নির্মলার ইস্কুল বাড়ি। কোয়ার্টারস। নির্মলা গভীর রাতেও একা থাকে কোয়ার্টারে—নৈশব্দ ছাড়া তার আর কোন অবলম্বন নেই। ঘোরের মধ্যে টের পেয়েছে, ফতিমা তাকে তুলে বিছানার চাদর পাল্টে দিয়েছে। কাজের মেয়ে সুখিকে বলেছে, দিদি পায়ের দিকটা ধরুন। তারপর ফতিমা যেন শিশুর মতো তাকে তুলে ধরতে চেয়েছিল। পারে নি। সে বুঝতে পেরেছে ফতিমা কেমন একসময় অসহায় বালিকার মত ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছে। টুটুল মিণ্টু কাঁদছিল। কান্না বড় সংক্রামক ব্যাধি।

সে একজন নির্বান্ধব মানুষ ফতিমা টের পেয়েছে।

ফতিমা টের পেয়েছে, তার সেই শৈশবের সোনাবাবু এই মহানগরীর গলিগুঁজিতে ঢুকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। তার কে কোথায় থাকে কেউ জানে না। টুটুলের দিকে তাকাতে পারছিল না বোধহয়। ছেলেটা কখন না জানি ঘুমিয়ে পড়েছে।

—কী হয়েছে পিসি। বাবার কী হয়েছে? পিসি ও পিসি!

—কিছু হয়নি।

—বাবা কথা বলছে না কেন! বাবা চুপ করে শুয়ে আছে কেন! আমাকে আদর করছে না কেন। বাবা বাবা!

যেন সুদূর থেকে কেউ ডাকছে, বাবা বাবা!

—বাবা তোমার শরীর ভাল নেই!

—সে টের পাচ্ছিল টুটুল মিণ্টু তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে অজস্র প্রশ্ন করছে। ফতিমা টুটুলকে কোলে তুলে চাতালে বের হয়ে গিয়ে বলছে, ঘুমোতে দাও। বাবা ঘুমোচ্ছে।

—বাবা কতক্ষণ ঘুমোবে!

—লক্ষ্মী আমার! দুষ্টুমি করে না।

—মা আসছে না কেন!

—আসবে। সবাই আসবে। খবর পেলেই চলে আসবে। অতীশ সবই শুনতে পাচ্ছিল।

বউরাণী বলে গেছেন, ওর মা বাবাকে খবর পাঠানো হয়েছে। ওরা নির্মলার খবর ঠিক রাখবে। কোথায় আছে ঠিক বলতে পারবে। এত মুখচোরা হলে চলে! নির্মলা চাকরি করছে—কোথায় করছে, কাউকে বলেনি। কেবল এক কথা। বর্ধমান থেকে বাসে যেতে হয়। দেড় দু-ঘন্টা লাগে। আপনার সোনাবাবু এত চাপা স্বভাবের! ফতিমা বলেছে, ওতো ও-রকমেরই। চিরটা কাল নিজের সঙ্গে কথা। যেন বাকিটা সবই গাছপালা পাখি-একটা পাখিও যা, আমরাও তাই। মায়া দয়া নেই। স্বার্থপর।

অতীশ সব শুনতে পাচ্ছিল। কিন্তু কেমন আচ্ছন্ন। চোখ মেলতে পারছে না।

বাবা বলতেন, বড় শহরে গেলে মানুষের শেকড় আলগা হয়ে যায়। তার মনে পড়ছে। সে নিজেকে ছাড়া আর কিছুই ভাবে না। তবে তাকে আর্চির এই তাড়া কি নিজের মধ্যে কোন ক্ষতস্থান তৈরি করেছে! নিজেই খুঁচিয়ে ঘা করছে।

তাকে চামচ দিয়ে ফতিমা মাঝে মাঝে গ্লুকোজ খাওয়াচ্ছে। মুসলমানের মাইয়া তুই, আস্পর্ধা তো কম না।

তারপরই মনে হয়েছে, সে স্বার্থপর না হলে এতটা ভাবতে পারত না। যে স্বর্বস্ব পণ করে লড়ছে, যাকে সে নিরাময় করে তোলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে, তার ক্ষেত্রে এ-সব পরিহাসও মানায় না। সে ইচ্ছা করলে উঠে বসতে পারে। কিন্তু সংকোচ। সত্যি এটা তার মুহূর্তে কী হয়ে গেল। মুহূর্তে! না শৈশব থেকে এক বিষণ্ণতার শিকার সে। তার ভেতরে চাপা দুঃখই কি ক্রমে –যেমন দেশভাগ, সোনালি বালির নদী, নদীর চর, তরমুজের জমি, অর্জুন গাছ, তার পাগল জ্যাঠামশাই এবং এ-দেশে আসার পর আর্থিক অনটন—সংসারে তাকে শুধু ক্ষোভের জন্ম দিয়ে গেছে! সেই ক্ষোভ থেকে ধীরে ধীরে সে খুনি!

আঁতকে উঠল। তার মনে পড়ছে সব। ঘোর থাকলে একরকম, উঁচু পাহাড়, বালিয়াড়ি, পাহাড়ের মাথায় অতিকায় এক দৈত্যের ছায়া, নিচে ক্রস এবং বালিয়াড়িতে অলৌকিক পায়ের ছাপ। অথবা গভীর সমুদ্রে সাদা বোট—দিন যায়, সে আর এক নারী। তারা পাটাতনে, তারা ডাঙ্গা পাবার জন্য পাল তুলে দিয়েছে। নিস্তরঙ্গ সমুদ্রের অন্তহীন খাঁ খাঁ রোদ্দুর পাক খায় অজস্র সমুজ্জ্বল তরঙ্গমালা –সেই এক গভীর নৈঃশব্দ্য। হাজার হাজার মাইল ব্যাপ্ত সমুদ্রে একটি মাত্র সাদা বোট—সে আর বনি। সঙ্গী বলতে অ্যালবাট্রস পাখি আর আর্চির প্রেতাত্মা।

কখনও মনে হয় স্বপ্নের মতো—সেই কবেকার পাপ তাকে হনন করার মতলবে আছে।

এবং একদিন সে দেখল বনি, পুরুষের পোশাক পরে প্রায় আততায়ীর মত তাকে প্রশ্ন করছে, তুমি আমাকে আর্চির চেয়ে কি বেশি দিয়েছ! দিতে পেরেছ। তুমি ঠগ, জোচ্চোর। তুমি প্রলোভনে ফেলে আমাকে বোটে তুলে এনেছ। তুমি ঠিক বাবাকে বলেছ, ডাঙায় পৌঁছে দেবে। কী কথা বনির! বনি এমন অসহিষ্ণু হয়ে উঠতে পারে তার বিশ্বাসের বাইরে। কেন যে মনে হল বনির উপর ঠিক আর্চির প্রেতাত্মা ভর করেছে। এমন কি হাঁটা চলা সব সেই নিষ্ঠুর আততায়ীর মতো। আতঙ্কে সে ছুরিটা সব সময় কাছে রাখত। সংশয় কী ভাবে মানুষকে অবলিলাক্রমে অমানুষ করে তুলতে পারে অকুল সমুদ্রে বনি তার প্রমাণ। তার বাবার ভালোমানুষীর সুযোগ সে নিয়েছে—ভাবতে গিয়ে ছোটবাবু এত কাতর হয়ে পড়েছিল যে একটা কথা বলতে পারে নি। সে জানে, তৃষ্ণায় গলাবুক শুকিয়ে উঠেছে বনির। চামড়া ফেটে যাচ্ছে। কথা বলতে পারছে না। হাত পা ছড়িয়ে বনি বোটে পড়ে আছে। আর কেবল তার দিকে অসহিষ্ণু দৃষ্টি। আগুন জ্বলছে চোখে। সে তবু জোর করে প্লাঙ্কাটন মুখে ঢুকিয়ে দিতে গেলে ছিটকে গিয়েছিল বনি।—আমাকে তুমি আর্চির মত খুন করতে চাও! আমি বুঝি।

এমন অসহিষ্ণু আচরণ দিনের পর দিন—আর আশ্চর্য মাথার উপর সেই নিঃসঙ্গ অ্যালবাট্রস পাখিটা কক কক করে ডাকছে। অস্থির হয়ে উঠেছে পাখিটা। সে উড়ছে আকাশের নিচে। মাথার উপর। তখন বনি কেমন আচ্ছন্ন। চোখ বুঝে আছে। কথা বলতে পারছে না। মুখ হা করে প্লাঙ্কাটন খাইয়ে দিচ্ছে সে। সমুদ্রে নিরন্তর বেঁচে থাকার একমাত্র সঞ্জীবনী সুধা। আঁশটে গন্ধ—জল এবং প্রোটিন দুই এই সমুদ্রের জীবাণুর মধ্যে সঞ্চারিত আছে কাপ্তান হিগিনস্ই বলে দিয়েছিলেন। একমাত্র সে জানে ডাঙ্গা পেলে বনি আবার স্বাভাবিক হয়ে যেতে পারে। একমাত্র জল এবং নির্জন দ্বীপ, গাছের মূল, কিংবা যা কিছু পাওয়া যাবে ডাঙায় বনি আর সে ভাগ করে খেলে বনি সুস্থ হয়ে উঠবে। পাতার ঘরে কোন জলাশয়ের পাশে। এবং এক নিঁখোজ নাবিক নির্জন দ্বীপে কাঁকড়া, কচ্ছপের ডিম পুড়িয়ে খেলে বেঁচে যাবে। এত সব স্বপ্ন ছিল তার মধ্যে।

সে অকুল সমুদ্রে বেঁচে থাকার শেষ চেষ্টা করে যাচ্ছিল। প্লাংকাটন খেয়ে বেঁচে আছে। সে দুর্বল বোধ করছে না। পাটাতনে আচ্ছন্ন অবস্থায় পড়ে না থাকলে বনিকে প্ল্যাংকাটন খাওয়ানো যাচ্ছে না। বমি হয়ে যাচ্ছে। আর কখনও বনি চিৎকার করে উঠত, কেন তুমি আমাকে খুন করতে চাও ছোটবাবু! অক অক বমি—জল যা অবশিষ্ট শরীরের সব বের হয়ে এলে তার আচরণে পাগলামি দ্রুত বৃদ্ধি পেত। সে খুঁজত কিছু। হাতুড়ি বাটালি যা কিছু এমন কি লম্ফ থাকলেও। আগুন থাকলে সে নিজে এবং ছোটবাবুকে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করতে পারে। পারে না কারণ সব শেষ। তেল নেই, জ্বালানি শেষ, লম্ফ ঝড়ে ভেঙে চুরমার। বার বার উজ্জ্বীবিত করার চেষ্টা—মনে হয় ডাঙ্গা কাছেই। দ্যাখ মরা কাঠ। দ্যাখ পাখির পালক—জলে ভেসে যাচ্ছে। কোথাও চোরাস্রোত আছে সমুদ্রে। দ্বীপের কাঠকুঠো ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। মুহূর্তে স্বাভাবিক হয়ে যেত বনি—তার পায়ের কাছে বসে থাকত। কিংবা তার পিঠে পিঠ দিয়ে বসে থাকতে থাকতে বলত, আমার ঘুম পাচ্ছে ছোটবাবু।

কী আশ্চর্য নিরীহ চোখ মুখ! অসাড় শরীর। জ্বালা যন্ত্রণায়, ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর, বনির আশ্চর্য সুন্দর সেই বর্ণমালার দিনগুলি মনে পড়লে পাশে হাঁটু গেড়ে বসত সে। চুমু খেত। বলত তুমি আমাকে বিশ্বাস কর বনি। তিনি আমাদের বোটে ভাসিয়ে দিয়েছেন। নিজে পরিত্যক্ত জাহাজে থেকে গেলেন। পরিত্যক্ত জাহাজে তিনি তোমার নিষ্ঠুর মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতর মুখ দেখতে সাহস পাননি। তুমি তো বলতে, ঈশ্বর ছাড়া আমাদের আর কোন অবলম্বন নেই। তুমি কেন ভুলে যাচ্ছ সব।

ইস করছ কি! খালি গায়ে আরও কষ্ট হবে। আরও ফোস্কা পড়বে। বোটের ত্রিপল ছিন্নভিন্ন, ছই উড়ে গেছে ঝড়ে। ঝড় বৃষ্টিতে আত্মরক্ষার উপায় থাকে না। তবু নোনা সমুদ্রে বৃষ্টির জল তৃষ্ণা নিবারণে সাহায্য করত। কিন্তু তারপর ফের গোটা সমুদ্রে আকাশ বাতাস নিষ্ঠুর হয়ে উঠত। এক ফোঁটা মেঘ নেই আকাশে। গনগনে আঁচে পুড়ছে সমুদ্র। আর ক্রমে সেই অতি দ্রুত পাহাড় সব ভেসে গেল, পাথর ভেসে উঠল। কিলবিল করতে থাকল সহস্ৰ অক্টোপাস। সারা বোটে ছুটে বেড়াচ্ছে বনি। একটা বিষাক্ত অক্টোপাসের পাল্লায় পড়ে গেছে যেন! কেবল বলত, দেখতে পাচ্ছ না, হাতির শুঁড়ের মতো লম্বা ঠ্যাং! আমাকে খাবে! তোমাকে খাবে!

বিষাক্ত নীল জল, কখনও সারা সমুদ্রে নিশীথে অগ্নি বর্ষণ। যেন ধারা বাহিক বৃষ্টিপাতের মত সব জ্বলন্ত মশাল কারা ছুঁড়ে মারছে। অথবা সমুদ্রে নাচতে নাচতে মশালের মিছিল চলে যাচ্ছে—এইসব মরীচিকা কি আতঙ্কের! এবং গীর্জার ঘন্টা শুনতে পাচ্ছে বনি। মাথা নিচু করে বসে আছে। বলছে, হে প্রভু আর পারছি না। আমাদের রক্ষা করুন।

সে বনিকে বলত, তুমি স্বাভাবিক হও। নিরাময় হও। মরীচিকা তোমার চোখ থেকে অবলুপ্ত হোক। আমার দিকে তাকাও। নাও ওঠো।

কিন্তু উঠতে পারছে না। তার পায়ের কাছে পড়ে ছটফট করছে। নিজের গলা টিপে ধরছে। তারপর মনে হচ্ছে বনি নিস্তেজ। তার সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। নিরিবিলি কত নক্ষত্র আকাশে অথচ কি অবিরাম নিষ্ঠুর অবিচার দুই নরনারীর প্রতি। ডাঙার জন্য অপেক্ষা। পাল নেই, হাওয়া নেই, জলে ঢেউ নেই, নিথর নিঃসঙ্গতা গ্রাস করতে করতে তার চোখে ভেসে উঠত একটা ছায়া। সেই প্রেতাত্মা হাজির। বনির মধ্যে সে আশ্রয় নিচ্ছে। এবং বোটে সে আর আর্চি। পাখিটাও তাকে ঠুকরে খেতে আসছে। চোখ জ্বলছে পাখিটার। সেও কেমন ধীরে ধীরে হিংস্র হ’য়ে উঠছে। তারপর সেই উদ্যত ছুরির ফলা আর সে। অ্যালবাট্রস তার বুকে এসে আছড়ে পড়ছে। খামচে দিচ্ছে যেন। সে ক্রমে স্মৃতিভ্রম থেকে উদ্ধার করতে পারছে সেই নারীর গোবেচারা আত্মহননের পালা। বনির আর সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।

সে প্রবল আতঙ্কে বনির অসাড় শরীর জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদছে। শেষ চেষ্টা। অ্যালবাট্রস পাখি বসে আছে বোটের কিনারে। শেষ চেষ্টা। সেই অমোঘ শব্দমালা, ইউ ক্যান সাক হার ব্লাড। সে পাগলের মত ধ্বস্তাধস্তি শুরু করে দিয়েছে। পাখিটাকে জাপটে ধরছে। এবং তারপর ছুরির প্রত্যন্ত অঞ্চলে ধার তুলে ওটা নিমেষে চালিয়ে দিতেই ফোঁটা ফোঁটা রক্ত, তারপর তীরবেগে গলার নালি বেয়ে রক্ত, দু-হাতে সেই রক্ত, বনির মুখে এবং শেষ চেষ্টা—না বনির কোন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। সে ধীরে ধীরে হাঁটু মুড়ে বসল। অন্ধকার হয়ে গেছে সব। অন্ধকারে হাতড়াচ্ছে। হাত পা আতঙ্কে অবশ হয়ে আসছে। সে স্থবির হয়ে গেল। তার চৈতন্য লুপ্ত। তারপর জানে না, সেই অমোঘ নিয়তির ভিতর তার বোট কিভাবে ডাঙ্গায় হাজির। সে কখন একটা ক্রসের নিচে বসে আছে।

একটা ক্রস বোটের অদুরে দাঁড়িয়ে আছে। বনি নেই। আছে সেই মৃত পাখি—পাখা ছড়িয়ে পড়ে আছে। রক্তের দাগ। এবং ক্ষুরধার এক ক্ষত সৃষ্টি করে পাখিটা চেয়ে আছে স্থির চোখে।

—কে ডাকছে!

—সোনাবাবু!

সে চোখ মেলে তাকাল।

ফতিমা শিয়রে বসে। ফতিমার গলায় উদ্বেগ!

—কেমন আছেন! কেমন আছেন সোনাবাবু!

অতীশ হাত তোলার চেষ্টা করল। পারল না। তার চোখ বুজে আসছে। ঘোরের মধ্যে সে এ- সব কি দেখল! যেন সত্যি সে এতক্ষণ সমুদ্রে এক ভাসমান বোটে নিখোঁজ আসামী। সে আজ ধরা পড়ে গেছে। তার আচ্ছন্নতা কাটছে না।

ফতিমা বলছে, আপনি ভাল হয়ে গেছেন।

এ-ভাবে কেউ যেন কোনদিন কথা বলেনি। তার কি হয়েছিল, সে বুঝতে পারছে। অফিসে তারা এসেছিল। অদৃশ্য হয়ে থাকতে পারে এই ঘরেও। অতীশবাবু কখন আসেন কখন যান। ম্যানেজার খতম হচ্ছে। খুনের বদলা খুন। বনিও বলেছে, আমাকে কেন ছোটবাবু আর্চির গোপন ধর্ষণ থেকে বাঁচাবার চেষ্টা করলে। কেন খুন করলে আর্চিকে! কেন তাকে ঝড়ের সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলে!

ফতিমা বলছে, আপনি বিড়বিড় করে বকছেন কেন! অতীশ তাকিয়ে আছে।

—আপনার কি হয়েছে! বার বার মূৰ্চ্ছা যাচ্ছেন!

সে ঠিক মনে করতে পারছে না এবং তবু মনে আছে বাড়ি ফিরে কেন যে মনে হয়েছিল, টুটুল মিণ্টুকে কারা হরণ করে নিয়ে গেছে। ওরা কোথায়!

সে ঠিক মনে করতে পারছে!

কুলুঙ্গির দিকে তাকিয়ে আছে সামনে, সেই ধূপবাতিদান—সেখানে বনি তার শুভ প্রভাবের সাথী। প্রেতাত্মার অশুভ প্রভাব থেকে এই বাতিদানটা যে তাকে সাহস যুগিয়ে আসছে কেউ জানে না।

ফতিমা বলল, উঠে বসবেন?

সে হাত তুলে ইশারায় না করল। তারপর কেমন বোকার মত বলল, তুই কি করতে এখানে! ফতিমা বলল, যা দেখালেন! এখন আর কথা না।

—তুই জেগে আছিস!

—কেন আমি জেগে না থাকলে খুশি হবেন!

—আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।

অতীশ যেন কি খুঁজছে।

—ওরা ঘুমাচ্ছে। টুটুলকে কোলে তুলে এনে দেখাল। সে যে সোনাবাবুকে মিছে কথা বলছে না, টুটুলকে বুকে জড়িয়ে পাশে এনে শুইয়ে দিল।

—আমি কেন এমন হয়ে গেলাম! কিছু মনে করতে পারি না। হারিয়ে যায় সব।

—কি হয়েছে! সত্যি করে বলুন। কেন এত অবসাদে ভেঙ্গে পড়েছেন। যেন ফতিমা জানতে চায় কি কষ্ট ভিতরে। মনে মনে সে প্রশ্ন করেছে। সে জেনেছে—মাঝে মাঝে সোনাবাবুর কি হয়! ধূপকাঠি জ্বালিয়ে বসে থাকেন। পচা টাকার গন্ধ পান। সে এও জেনেছে, তার কারখানায় গন্ডগোল চলছে। কারা এসেছিল খোঁজ নিতে। অতীশবাবু কখন আসেন! কোন রাস্তায় আসেন। কতক্ষণ থাকেন। নকশালদের বড় বড় পোষ্টার। সত্তর দশক মুক্তির দশক। চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান। যেখানে সেখানে লাশ পড়ে থাকছে। এই নগরীও এখন বিভীষিকাময় মানুষের কাছে। কত দীর্ঘকাল পর সোনাবাবুকে আবিষ্কার! সপ্নের মানুষ, দেশভাগ হয়ে যেতেই নিখোঁজ হয়ে গেছিলেন। আবার খুঁজে পেয়েছে। লন্ডভন্ড জীবন। স্ত্রী কাছে থাকে না। বাচ্চা দুটো মাকে ছেড়ে থাকে। ভাবতে গেলেই কেন যে ফতিমার চোখ জলে ভার হ’য়ে যায়।

—কিছু বলবেন।

—জল দে। খুব তেষ্টা পাচ্ছে।

ফতিমা কাচের গ্লাসে জল দিলে অতীশ বসার চেষ্টা করল। ফতিমা বুঝতে পারছে ভিতরে মানুষটা খুবই দুর্বল হয়ে গেছেন।

মানসিক অবসাদে ভুগলে নানা গন্ডগোল সৃষ্টি হয়। অথচ সকালেও আজ অফিসে যাবার কথা ছিল—যাননি। রাজবাড়ির অফিসে ডেকে তাঁকে সাবধানে থাকতে বলেছে। তখনও কোনও অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ্য করেনি ফতিমা। সে টুটুল মিণ্টুকে স্কুলে দিতে গিয়ে ফিরে এসেছিল। সুখি আজ মালিপাড়ায় আর যায়নি। সে পাশের ঘরে মাদুর পেতে শুয়ে আছে।

ফতিমাই বলেছে, যেয়ে কাজ নেই।

সুখির এক কথা, কাকা শুনলে রাগ করবেন। রাতে ছিলাম টের পেলে ক্ষেপে যাবেন।

ফতিমাই বলেছিল, আমি বুঝব। সোনাবাবুকে বললে বুঝবেন। অতীশ জল খেয়ে কেমন অনেকটা হাল্কা বোধ করল। তার কি হয়েছিল ভুলে যাচ্ছে! আচ্ছন্নতা কেটে যেতে থাকলে এটা তার হয়। কেন ফতিমা এখানে, আলম সাব তাকে এ-বাড়িতে রেখে গেল কেন ঠিক যেন মনে করতে পারছে না। সে বোঝে এটাই তার নিরাময়ের নমুনা। যতক্ষণ ঘোর থাকে সব টের পায়। ঘোর কেটে গেলে ভুলে যায়—তার চরিত্রে কোনও অস্বাভাবিক লক্ষণ ক্রিয়া করে গেছে।

ফতিমা বাবুটিকে খুঁজে পাবার পরই জেনেছে সব। বাবুটি দেশভাগের পর সমুদ্রে চলে গেছিলেন। সমুদ্রে নিখোঁজ হয়ে গেছিলেন। জাহাজের কোন খবর নেই। বাড়ির সবাই ধরেই নিয়েছিল, সোনাবাবু সমুদ্রে হারিয়ে গেছে।

এর বেশি সে কিছু জানে না। টুটুলের মা-র সঙ্গে আলাপ হয়নি। ছুটি শুরু না হলে আসতে পারছে না। কেবল টটুল মিণ্টুই তাদের মা-র কথা বলে।

সোনাবাবু জাহাজ থেকে ফিরে এসেছিলেন অন্য মানুষ হয়ে। সুখিদি অনেক খবর রাখে। সুখদিই বলেছিল—বলবেন না কিন্তু কাকিমা যদি জানতে পারে আমাকে ছাড়িয়ে দেবে। মানুষটা যে জাহাজ থেকে ফিরে স্বাভাবিক ছিলেন না, এবং যখন তখন ঘর থেকে বের হয়ে মাঠে ঘুরে বেড়াতেন, গাছের নিচে চুপচাপ বসে থাকতেন, তারপর কেউ ডেকে নিয়ে গেলে বাড়ি ফিরতেন, স্নান করতেন, খেতেন। চুপচাপ থাকতে ভালবাসতেন।

অতীশ বলল, আমার কিছু হয়েছিল! জলের গ্লাসটা ফতিমার হাতে দেবার সময় প্রশ্ন করল।

ফতিমা গ্লাসটা তুলে নিয়ে টেবিলে রেখে দিল। ফিরে এসে বলল, কেন বুঝতে পারছেন না।

-–না, আমার কিছু মনে থাকে না।

—ঠিক আছে মনে করার দরকার নেই।

ফতিমা চাইছে সোনাবাবু আবার শুয়ে পড়ুক। তার উদ্বেগ গেছে ভীষণ। সকাল থেকে যা চলছিল। সকালে উঠেই তার কাজ অনেক। অথচ এখন মনে হচ্ছে ওঁর দেশের বাড়িতে খবর না পাঠালেই ভাল হ’ত। সবাই এসে ভিড় করবে। এও হতে পারে বাড়ির মানুষ তাঁর এমন আচরণের খবর রাখেন। সে যতটা ঘাবড়ে গেছিল, তাঁরা থাকলে হয়ত বলতেন ও এমন হয়, আবার ঠিক হয়ে যাবে।

ও এমন হয় আবার ঠিক হয়ে যাবে! যেন একজন বাড়তি মানুষ সোনাবাবু—এমন হয়, কেন হয়, এতদিন ধরে যদি এমন চলতে থাকে তবে সোনাবাবু যে শেষে তাঁর পাগল জ্যাঠামশাইর মত হয়ে যাবেন না কে বলতে পারে! এর তো চিকিৎসা আছে। এতদিন ধরে চলছে, অথচ কোনও ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া হয় নি—অদ্ভুত সুখিদির কথামত তো তাই মনে হয়। কাকা এ রকমেরই। সেই থেকে তো দেখছি। সেই থেকে মানে, পাঁচ-সাত বছর ধরে—এমন সুপুরুষ মানুষটি কখনও কখনও অস্বাভাবিক আচরণ করে থাকেন, ধূপবাতি জ্বালিয়ে বসে থাকেন, ইদানীং নাকি সুখিদিদি দেখেছে—কুলুঙ্গির ধূপবাতিদানটায় সোনাবাবু ফুল বেলপাতা পর্যন্ত দেন। কে জানে বাবুটি এ-ঘরে ঢোকায় আবার ক্ষেপে না যায়।—তুই মাইয়া, আমার ঠাকুরঘরে ঢুকলি! সোনাবাবু এমন বলতেই পারেন।

সোনাবাবুর আচ্ছন্ন অবস্থায় ফতিমা কুলুঙ্গির সেই ধূপবাতিদানটা নামিয়ে দেখেছে। কষ্টি পাথরের এবং বেশ কারুকাজ করা। সে আবার সন্তর্পণে তুলেও রেখেছে। শুকনো ফুল বেলপাতাও দেখেছে—দুটো পোড়া ধূপ কাঠি ছিল—সে তা সরিয়ে কুলুঙ্গি সাফ সোফ করে ধূপবাতিদানটা আঁচলে মুছে আবার তুলে রেখেছে। এবং ধূপকাঠি জ্বালিয়ে দিয়েছে। এর পায়ে সোনাবাবু বেঘোরে পড়ে গেলে মাথা ঠোকেন!

তবু মানুষের বিশ্বাসকে তার কোনও অপমান করার অধিকার নেই। যদি সামান্য ধূপবাতিদানের মধ্যে কেউ আশ্রয় খুঁজে পায়, পেতেই পারে, কারণ কেউ অবিনশ্বর নয় এবং মৃত্যুর পরে মানুষের পরিণতি কি, নানা ধর্মে নানা কথা লেখা আছে। সে ধর্মভীরু বলেই একবার মনে হয়েছিল, কুলুঙ্গিটা সাফ সোফ না করলেই পারত। ছেলেবেলাতে ছুঁয়ে দিলে জাত যেত সোনাবাবুর। আর আজ সে তার ঘরে, এবং তার সেবাশুশ্রূযা পর্যন্ত করতে পারছে। সোনাবাবু তাতে ক্ষুব্ধ হননি। এবং তিনি যে বেঘোরে পড়ে গেছিলেন বলেই তাকে রাতে থেকে যেতে হয়েছে এটা বুঝতেও অসুবিধা হয়নি। বরং সে না থাকলে—তাঁর এই অবস্থায় টুটুল মিণ্টুকে কে দেখত! সুখির পক্ষে সম্ভব না। সুখি নিজেই নির্বোধ, সে ঠিক জানেও না, কখন কোন কাজে গুরুত্ব দিতে হয়। কাজেই সোনাবাবু যে তার দিকে অপলক তাকিয়ে আছেন, কোন গভীর কৃতজ্ঞতাবোধ থেকেই যেন।

সোনাবাবুর দৃষ্টিতে সে কেমন সংকোচ বোধ করতে থাকল। শাড়ির আঁচল দিয়ে গা ঢেকে দিল। সে এই ঘরে একা। সোনাবাবু পাশ ফিরে শুয়ে আছেন। এবং মনে হয় তিনি একেবারে স্বাভাবিক হয়ে গেছেন। এতক্ষণ যে মানুষটি ছিল শিশুর মত অসহায়, এখন সেই মানুষটি যেন সহসা পরিণত যুবকের মত তাকে দেখছে। তার ভাল লাগছে না মন্দ লাগছে, বুঝতে পারছে না। সে সামান্য হেসে বলল, কি যে ভয়ে ফেলে দিয়েছিলেন!

অতীশ বলল, আমার কি হয়েছিল! আমি কিছু বুঝতে পারছি না। কিছু একটা হয়েছিল বুঝি! তবে….. —তবে কিছু না। ঘুমান! আর এখন কথা না।

—এত রাতে আমার ঘুম আসবে না।

—ওমা সে কি কথা!

—আলম সাব তোকে রেখে যেতে পারল!

–পারবে না কেন!

—ওঁর অসুবিধা হবে না!

—সোনাবাবু, মারব।

সোনা বুঝল, ফতিমা অন্য অর্থে কথাটা ব্যবহার করছে। তাকে ভুল বুঝছে।

ফতিমার এত কি দায়।। সে বলল, তুই এত সুন্দর। তুই ফতিমা না প্রতিমা আমি বুঝতে পারছি না। এখনও বুঝতে পারি না।

—বুঝতে হবে না! যা আছি তাই। বলে ঘর থেকে চলে যাচ্ছিল।

কিন্তু সোনা বলল, শোন।

—ফতিমা ভিতরে কাঁপছে।

সে সোনাবাবুর এই আহ্বান কেন যে অবহেলা করতে পারছে না। সে জানে না, সোনাবাবু বড় হয়ে কেমন হয়ে গেছে! কিছু যদি করে বসেন। তবু সে জানে, কারণ তার ব্যক্তিত্বকে সোনাবাবু যমের মত ভয় পান। শুধু সে কেন, সব নারীর প্রতিই তাঁর এই তীব্র সন্মানবোধ টের পেয়েছিল কলকাতায় প্রথম দেখা হবার দিনটাতেই। সোনাবাবুকে গাড়ি করে বাড়ি পৌঁছে দেবার প্রলোভন সামলাতে পারে নি। আসলে তার আগ্রহ ছিল সোনাবাবুর স্ত্রীকে দেখবার। কেমন দেখতে, যাঁর খোঁজে কলকাতায় আসা, সেই মানুষের তিনি কেমন না জানি–এই আগ্রহ কেন যে তাকে তাড়া করছিল।

সোনাবাবুর শিয়রে দাঁড়িয়ে ফতিমা বলল, বলেন।

—বোস না।

অতীশ একটু ঘাড় উঁচু করে ফতিমার মুখ দেখার চেষ্টা করল। তারপর অতীশ বলল, আমি ভাল আছি। তুই বোস। এটা আমার আরও হয়েছে। কেউ কিছু বলতে চায় না। কি হয়েছিল, বলতে চায় না। আমি ঠিক বুঝি না, কেন এমন মাঝে মাঝে হয়। এবার একটু বোধহয় ডোজ বেশি হয়ে গেছে!

ফতিমা বুঝল বাবুটির সেই সরল অকপট কথা—কোথাও কোনো গন্ডগোল নেই। কে বলবে সারাদিন বাবুটিকে নিয়ে বেশ ধস্তাধস্তি গেছে। মাঝে মাঝে চোখ মেলে তাকাচ্ছিল। তাকে দেখতে পেলেই আবার চোখ বুজে ফেলেছে। সে যে এই ঘর সাফসোফ করে, কুরুশ কাঁটার কাজ করা লেসের ঢাকনায় টেবিল ঢেকে রেখেছে, সাদা মারবেল পাথরের কারুকাজ করা ফুলদানিতে লাল সাদা গোলাপ এবং সাদা ধপধপে বিছানায় পাট ভাঙা পাজামা পাঞ্জাবি পরা একজন অতিকায় পতুল নিয়ে চুপচাপ বসেছিল, বাবুটি টের পাননি।

কিন্তু এখন কেন যে ফতিমার মনে হচ্ছে, এ-ভাবে একজন পুরুষের সঙ্গে রাত কাটানো কতটা শোভন কতটা স্বাভাবিক —সাহেব কিছু মনে না করলেও আর দশজন কিছু ভাবতে পারে। ফতিমা শিয়রে দাঁড়িয়ে আছে। নড়ছে না। তার বসে থাকতে ইচ্ছে করছে।

সোনাবাবুর কেমন বালকের মতো আব্দার—তুই বোস না। দাঁড়িয়ে থাকলি কেন! তোরা খেয়েছিস?

—খেয়েছি, আপনি ঘুমোন। সকালে কথা হবে।

—না। না। সকালে আমি তোকে এত কথা বলতে পারব না। তুই সময় পাবি না।

ফতিমার ইচ্ছে হচ্ছে সারারাত বসে বসে গল্প করে। কিন্তু ও-ঘরে সুখি শুয়ে আছে। দরজা খোলা। টুটুল মিণ্টুর পাশে সে গিয়ে শুয়ে থাকতে পারে। ভেবেছিল, বাবুটি ঘুমালে সে তাদের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়বে। ঘুমের ওষুধও দেওয়া হয়েছিল। আবার দেবে কি না ভাবছে। কিন্তু সোনাবাবু তাকে কি বলতে চান। কেন এত অধীর আগ্রহ—কেন এই অস্বাভাবিক আচরণ মাঝে মাঝে—মানসিক অবসাদ সমুদ্র থেকে ফিরে আসার পর থেকেই। কেমন কৌতূহল বোধ করল ফতিমা। তা-ছাড়া সে বোধ হয় এতটা নিরিবিলিতে সোনাবাবুকে আর জীবনেও কাছে পাবে না।

সে পায়ের কাছে টিনের চেয়ার টেনে বসল। সারা শরীর শাড়ি দিয়ে ঢাকা। সামান্য শীতের হাওয়া এখনও আছে। চাদরটা তুলে সোনাবাবুর শরীর ঢেকে বলল, সোনাবাবু আপনার কিছু হয়নি।

—কিছু না হলে, মাথার কাছে কেউ সারাক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। বসে থাকে! রাত জাগে। আলম সাব তোকে এখানে রেখে যান!

অতীশ ফতিমার দিকে তাকিয়ে আছে অপলক। চোখ ফেরাচ্ছে না।

—কিছু বলবেন?

—খেয়েছিস কিছু? ফের এক কথা।

ফতিমা কিছুই খায়নি। খেতে ইচ্ছে হয়নি। সে মাঝে মাঝে চা খেয়েছে। খাওয়ার কোনও স্পৃহা বোধ করেনি। সে ফের বলল, খেয়েছি।

—কি খেলি?

কি যে করে! কি খেয়েছে! সুখি বার বার বলেছে, দিদি কিছু মুখে দিন। কিন্তু সুখিও টের পেয়েছে সে মুসলমান। সুখি নিজে বামুনের মেয়ে—একজন মুসলমানের মেয়ের কবলে কাকা পড়ে গেছেন ভাবতে পারে। তার সম্পর্কে এটা জানার পর সুখির মধ্যেও কেমন সুচিবাই লক্ষ্য করেছে। রান্নাঘরে কোন অজুহাতেই ঢুকতে দেয়নি।

—জল দিন।

সুখি দৌড়ে ঘরে ঢুকে জল এনে দিয়েছে।

—টুটুল মিণ্টু তোরা খেয়ে নে। চল খেতে দিচ্ছি।

সুখি দৌড়ে রান্নাঘরে ছুটে গেছে। ভাত ডাল সব থালায় এনে শোবার ঘরে সাজিয়ে দিয়েছে। এমন কি টুটুল ঢুলছিল বলে তাকে খাইয়ে দেওয়া দরকার। ফতিমা হাত ধুয়ে এসে ভেবেছে, টুটুলকে কোলে নিয়ে খাওয়াবে। অবাক। দেখছে টুটুলকে নিয়ে মিণ্টু আর সুখির মধ্যে ঝগড়া।

—না তুমি খাওয়াবে না। পিসি খাওয়াবে।

ফতিমা কিছুটা ফাঁপরে পড়ে গেছিল। সে যে কি করে! বলেছিল, কেন দিদি খাওয়ালে খেতে নেই বুঝি!

সুখি টুটুলকে কোলে বসিয়ে খাওয়াবার চেষ্টা করছে। মিণ্টু পাশে একটা ফুল তোলা আসনে বসে খেতে খেতে ঝগড়া করছে।

—বলছি, তুমি দিলে খাবো না।

ফতিমা ধমক না দিয়ে পারে নি—আঃ কি হচ্ছে মিণ্টু। খাবে, খাবে না কেন। টুটুল খাও! এ কি, হাত সরিয়ে দিচ্ছ কেন।

—খাও। দিদি তোমাকে কত আদর করে খাইয়ে দিচ্ছে। খাও বলছি। না খেলে আমি চলে যাব।

মনে মনে সুখির প্রভুত্বকে ফতিমা পছন্দ করছে না—কিন্তু সে জানে, এ-বাড়িতে একজন আগন্তুকের এর চেয়ে বেশি কিছু বলা শোভন নয়। তা ছাড়া অধিকার সম্পর্কেও সে সচেতন।

সোনাবাবু অসুস্থ—তার উপর সামান্য খাওয়া নিয়ে কোনও ক্ষোভের সৃষ্টি হয় সে চায় না।

কিন্তু টুটুল নাছোড়বান্দা। খাবে না। সুখিদির হাতে সে খাবে না। সুখিদিও কেমন অবুঝ হয়ে উঠেছিল। সে জোর জার করে যাচ্ছে।

খেল না। শেষ পর্যন্ত খেল না। অগত্যা ফতিমা আর পারে নি। সে পাশে বসে খাইয়ে দিতে গেলে সুখি বিদ্যুৎবেগে উঠে গেল। জাত মারা হচ্ছে। এমন একটা দৃষ্টি হেনে গেল।

কাজেই এ-ঘরে সোনাবাবুর পায়ের কাছে বসে যদি গল্প করে, কারণ সোনাবাবুর মধ্যে আবার স্বাভাবিকতা ফুটে উঠছে, সোনাবাবু চায় ফতিমা পাশে বসে থাকুক—চাইলেই তো হয় না। পাশের ঘরে সেই আজ সুখিকে নিচে শুতে বলেছে। সুখির তো চলে যাবার কথা মালিপাড়াতে। তার তো থাকার কথা নয়। সে না বললে, থাকতেও সাহস পেত না—অথচ এখন সেই সুখিই কাঁটা। তাকে সতর্ক থাকতে হবে! এবং সে বলল, এসে দেখলাম তক্তপোশে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে আছেন।

কি যেন মনে হল অতীশের। সে তাড়াতাড়ি গলার কাছে হাত নিয়ে কি যেন খুঁজল। এই হয়, একটু ধরিয়ে দিলেই সে কিছুটা ধরতে পারে। তার মনে পড়ছে। সে আতঙ্কে অস্থির হয়ে উঠেছিল। আর্চির প্রেতাত্মা তাকে ফের অনুসরণ করছে—গলায় ক্ষুরের পোঁচ দিয়ে সে বুঝতে চেষ্টা করছিল, কতটা লাগে। কতটা গভীর ক্ষত সৃষ্টি করতে পারলে প্রেতাত্মার নির্যাতন থেকে সে চিরদিনের জন্য রক্ষা পাবে।

অতীশ গলা থেকে হাত তুলে আনতেই ফতিমা বলল, সোনাবাবু আপনার কি হয়েছে। এত ভেঙ্গে পড়েছিলেন কেন। টুটুল মিণ্টুর কথা একবার ভাবলেন না। বৌদির কথা ভাবলেন না। কে আপনার পেছন নিয়েছে, আপনি কার কি ক্ষতি করতে পারেন! গলায় হাত দিয়ে কি দেখছেন!

অতীশ তার কোন কথারই জবাব দিল না। সে কিছুক্ষণ সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে থাকল। যেন কিছু মনে করার চেষ্টা করছে। ফতিমা ক্ষুরটা লুকিয়ে ফেলেছে। কিন্তু সে বুঝতে পারছে না, পায়ের কাছে ক্ষুরটা পড়ে ছিল কেন। এমন কি কাউকে সে বলেও নি, তাঁর পায়ের কাছে একটা ক্ষুর পড়েছিল। এমনকি ডাক্তারবাবুকেও নয়। এ-সব বলার যেন অনেক সময় পাওয়া যাবে। বৌদি এলে তাকেই প্রথম বলা দরকার। অবশ্য সে কিছুটা দিশেহারাও হয়ে গেছিল। ক্ষুরটা সরিয়ে রেখেছে। ক্ষুরটার সঙ্গে সোনাবাবুর ঘোর লাগার কোনও সম্পর্ক থাকতে পারে এমন কিছু মনে হয় নি! পরে ধীরে ধীরে কেন যে মনের মধ্যে আ-কথা কু-কথা ভেসে উঠতে থাকলে, ক্ষুরটা গুরুত্ব পেয়ে গেছে। আত্মবিনাশ। নিজেকে এভাবে বিনাশ করতে কেউ পারে! যত রাত বাড়ছিল, তত মাথার মধ্যে বাবুটির বিষণ্ণতা তাকে গ্রাস করছে। কেন যে মনে হচ্ছিল, যত বাধাই আসুক, বাবুটির মধ্যে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনার জন্য সে সব করতে রাজি।

তারপরই কেন যে মনে হয়, আসলে কারো কিছু করার নেই। সব তাঁরই মেহেরবানী। সে কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে আল্লার কাছে মোনাজাত করল। আমাকে সাহস দিন। আপনি ছাড়া আমার আর কোনও উপাস্য নেই। আপনি সোনাবাবুকে নিরাময় করে তুলুন। আমাকে পথ বাতলে দিন। সোনাবাবু যেন আর ঘোরে পড়ে না যায়।

অতীশ ফতিমার দিকে তাকাতে গিয়ে অবাক। সে উঠে বসল। ফতিমা দু’হাত মুখের সামনে রেখে হাঁটু গেড়ে মেঝেতে বসে আছে। নতজানু। সে যে উঠে বসেছে—সে যে তাকে দেখছে একদম খেয়াল করছে না। তাকে ডাকতেও পারছে না। কে জানে ফতিমার মধ্যেও তার মত কোন দুরারোগ্য ব্যাধি সংগোপনে লুকিয়ে আছে কিনা।

আর তখনই দেখল ফতিমা ভারি প্রসন্ন চোখে তাকে দেখছে।

—কি হল উঠে বসতে কে বলল!

—তুই কি করছিলি?

—ও কিছু না।

—খুব ঘাবড়ে গেছিস। অতীশ হাসল।

একদম না।

তারপরই কেমন ফতিমা ক্ষেপে গেল। ঘাবড়ে গেছি তো বেশ করছি। নাটক করতে পারবেন, আর আমি ঘাবড়ে গেলে দোষ—বলেন, কি করতে চেয়েছিলেন! কেন জাহাজ থেকে ফিরে এসে আপনি একা একা দূরে হেঁটে যেতেন। কেন, ধূপবাতি জ্বালিয়ে বসে থাকেন! কেন পচা টাকার গন্ধ পান। বলেন, চুপ করে আছেন কেন! কেন ক্ষুরটা পায়ের কাছে পড়েছিল!

—ফতিমা!

বড় ধীরে কথাটা বলল অতীশ।

বড় ধীরে সে বলল, ফতিমা, ছবিটার কোনও অর্থই আমার মাথায় পরিষ্কার হচ্ছে না। অ আজার বালথাজার।

—হ্যাঁ অ আজার বালথাজার।

—ছবিটার মাথামুণ্ডু আমিও বুঝিনি ঠিক সোনাবাবু। তবে এটা বুঝেছি, ছেলেগুলো গাধাটার কানে কি যেন ফিসফিস করে বলত।

—মেয়েটা বলত না!

—হ্যাঁ মেয়েটাও বলত। সাহেব ছবিটা আগে দেখেছেন প্যারিসে। তিনি ভাল ফরাসী জানেন। তিনি যা বলেছেন তাই বলতে পারি।

—কি বলেছেন!

—ওরা কনফেস করত। ওরা যা কু-কাজ করত সব গাধাটার কানে কানে বলে দিলে ভাবত, আর কোন পাপ নেই।

—গাধাটার কানে কিছু বললে সব পাপ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। গাধাটা কি ঈশ্বর!

—হয়ত ঈশ্বর। গাধার আস্তাবলেই তো যীশু জন্মেছিলেন। তাই না। মানুষের বিশ্বাস—যে-যেভাবে বিশ্বাস গড়ে তোলে। হয়ত ঈশ্বর। ঈশ্বর ভাবলেই ঈশ্বর। মানুষের তো একজন ঈশ্বরের খুবই দরকার।

—আমার যদি এমন একটা গাধা থাকত।

—কি হত তাহলে?

—বোধ হয় নিরাময় হয়ে যেতাম।

—কেন আপনার ধূপদানিটা, তাকে তো শুনেছি সব বলেন। আপাতত একজন ঈশ্বর তো আপনার হাতের কাছেই রয়েছে।

—সেতো শুনতে পায় না। তার তো কান নেই। গাধার তো কান আছে।

—তাকে তবে কি বলেন! আপনি মাঝে মাঝে কুলুঙ্গির নিচে গভীর রাতে দাঁড়িয়ে থাকেন কেন!

—আমি তাকে খুঁজি।

—কাকে!

—তাকে তুই চিনিস না। কেউ তাকে চেনে না। সে না থাকলে আমি বোধহয় ফিরে আসতেও পারতাম না। মাঝে মাঝে মনে হয়, সে আমারই জন্য নিজেকে সমুদ্রে সঁপে দিয়েছে। মাঝে মাঝে কেন যে মনে হয় সে-ই আমার উপাস্য দেবী।

—কে সে সোনাবাবু? কার কথা বলছেন, কিছু বুঝতে পারছি না। তিনি আপনার দেবী, তিনি কি কোন অলৌকিক শক্তির আধার? কে তিনি! যাঁর কথা ভেবে আপনি মাঝে মাঝে ঘোরে পড়ে যান। তিনি কি আপনার ঈশ্বর?

—তিনি ঈশ্বরও হতে পারেন, প্রেতাত্মাও হতে পারেন। ঈশ্বর প্রেতাত্মা কেউ আমার কাছে কম ক্ষতিকারক নয়। জীবন দিয়ে বুঝেছি, দু’জনেই মানুষের ক্ষতি করছে। আমি আসলে তাঁদের কথা বলছি না। তিনি যথার্থই দেবী। ঠিক তোর মতো, সরল নিষ্পাপ। সে জানত আমার পাপের কথা। আবার সেই বলত আমি ইনোসেন্ট। অতীশ কেমন ব্যাজার মুখে তাকিয়ে আছে ফতিমার দিকে তারপর বলছে, তোর মতো নিষ্পাপ সে।

—আমি নিষ্পাপ আপনাকে কে বলেছে?

–কেন যে মনে হয়। তোর চোখ মুখ দেখলে আমার তার কথাই মনে হয়। তোর সঙ্গে ছবিটা দেখতে গিয়ে দেখা না হলেই যে ভাল ছিল। এখন দেখছি, আরও বেশি ঘোরে পড়ে যাচ্ছি।

—ভেবেছিলেন, দেখা হতই না!

—না হলে মন্দ কি ছিল! বল, তোর এই বিড়ম্বনা, ছবিটা না দেখতে গেলে বিশ-বাইশ বছর পর তোর সোনাবাবুকে আবিষ্কার করতে পারতিস না। তুই জানিস না, সে কত খারাপ।

—বিশ্বাস করি না। আপনি খারাপ বিশ্বাস করি না।

—বিশ্বাস করিস না?

—আপনি কোনো খারাপ কাজ করতে পারেন না সোনাবাবু!

—পারি।

—পারেন না।

—ফতিমা!

—হ্যাঁ বলছি, পারেন না।

কেমন উত্তেজিত হয়ে পড়েছে অতীশ। বলছে, পারি আমি পারি। আমি খুন করতে পারি—ধর্ষণ করতে পারি।

—না পারেন না।

তবে কি সব কোনো অলৌকিক ছবির মতো মগজে তার নানা প্রসঙ্গ ঢুকে গেছে! যা থেকে সে নিস্তার পাচ্ছে না, আর্চিকে সে খুন করেছে, না তাও তার কোনো অবসাদ থেকে তৈরি। কেমন সব গোলমাল পাকিয়ে যাচ্ছে।

—আমি সমুদ্রে গেছি জানিস?

—জানি।

—জাহাজ আমাদের এবানডান করে দিতে হয়, জানিস?

—না, তা জানি না।

—তবে তুই যে বলছিস আমি খারাপ কাজ করতে পারি না!

—জাহাজ পরিত্যক্ত হলে কাউকে পাপ কাজ করতে হয় কে এসব বলেছে।

—পাপ কাজ করেছি বলেই তো জাহাজটা মাঝ দরিয়ায় বিকল হয়ে গেল।

—আপনি জাহাজে কি একা ছিলেন?

—না। আমরা অনেকে ছিলাম।

—আপনার একার পাপে জাহাজ যদি বিকল হয়ে যায় অন্যরা কি দোষ করল। জাহাজ বিকল হয়ে যাওয়ায় তাদেরও তো রক্ষা পাবার কথা না।

—কিন্তু আমি যে আমার পাপের কথা জানি। আমি জানি বলেই, বিশ্বাস করি।

—সবারই কোন না কোন পাপ থাকে।

—তোর আছে?

ফতিমা মুখ ঢাকল আঁচলে। কিছু বলল না।

—কি চুপ করে আছিস কেন!

ফতিমার খোঁপা খুলে গেছিল। চুলে কোমর ঢেকে গেছে। সে চুল সামলাচ্ছিল। খোঁপা বাঁধছিল। ও-ঘরের দরজা ভেজানো। যদি সুখি জেগে যায়। টুটুল মিণ্টুও জেগে যেতে পারে। যাকে নিয়ে সারাদিন এত ধস্তাধস্তি গেছে তিনি এখন যদি ফতিমার সঙ্গে বচসায় মত্ত হয় তবে সংশয় দেখা দিতেই পারে।

সে বলল, সোনাবাবু আস্তে। প্লিজ আস্তে। আমি আর পারছি না! অতীশ বুঝল, এত রাতে সে চেঁচামেচি করলে রাজবাড়িটা ফের জেগে যেতে পারে। অন্দর মহলে তার বাসা। পুকুরের দিকটায় একটা গবাক্ষপথের মতো ছোট জানালা আছে। তার নিচ দিয়ে রান্নাবাড়ির দিকে কাজের লোক যেতে আসতে টের পেতে পারে—অতীশবাবু কাকে তিরস্কার করছে। চেঁচাচ্ছে।

সে কেমন ম্রিয়মান গলায় বলল, তোর কি পাপ!

ফতিমা আর পারল না।

—ওটা আপনাকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে। অত পারব না। পাপ না থাকলে, সারা জীবন কেউ কাউকে খুঁজে বেড়ায়। আমার ধর্ম আছে, সংসার আছে, তবু কেন আপনাকে খুঁজে বের করার জন্য সাহেবকে কলকাতায় পোস্টিং নিতে বলেছি। বলুন! চুপ করে আছেন কেন। পাপ সবারই থাকে। পাপ তো সংসার থেকে জন্মায়। আমরা পাপকে ড্রাই না। আমি তো জানি মানুষ হয় আগুনের দিকে হাঁটছে নয় খাদের দিকে। কেউ কাঠে পুড়বে, কাউকে মাটি দেওয়া হবে। আমায় জবাবদিহি দিতে হবে, কেয়ামতের দিন সবাইকে দিতে হয়। তাও আমি দেখুন সোজা আছি। কোনো ঘোরে পড়ে যাচ্ছি না। পাপের তাড়নায় ক্ষুর হাতে নিই না!

অতীশ আবার শুয়ে পড়েছে। সে পাশ ফিরে বলল, যাই বলিস, আমার কনফেস করা দরকার। গাধার কাছে ছেলেগুলোর মত আমার কনফেস করা দরকার। তোর এটা পাপ না। আসলে মানুষের জন্য টান থাকারই কথা। এটা তোর পাপ হতে যাবে কেন। কিন্তু আমি যে খুন করেছি।

ফতিমা দ্রুত উঠে গেল। দরজা টেনে দিল। হাওয়ায় ভেতরের দিকের দরজাটা খুলে যাচ্ছিল। টুটুল মিণ্টুর তক্তপোশ দেখা যাচ্ছিল। তারপর করিডর। ভেতর দিকের জানালা খোলা। বড় বড় পাতাবাহারের গাছ। বাতাসে ডালপালা দুলছে। করিডরে মাদুর পেতে শুয়ে আছে সুখি। বাইরে রাজবাড়ির অন্দরের আলো এসে পড়ছে। নতুন বাড়ির দরজা জানালা বন্ধ। তবু যেন সতর্ক থাকতে গিয়ে দরজা বন্ধ না করে উপায় ছিল না। ফতিমা বুঝতে পারছে সোনাবাবু তার গোপন কোনো খবর ফতিমাকে দিতে চায়।

সোনাবাবু বলল, অ আজার বালথাজার।

ফতিমা এবার শিয়রে বসে মাথার চুলে বিলিকেটে বলল, আপনি খুন করতে পারেন কিছুতেই যে বিশ্বাস হয় না সোনাবাবু।

অতীশ ফের বলল, অ আজার বালথাজার। আমি তোর সোনাবাবু, আর একজনের কাছে ছোটবাবু।

—সে কে?

—বনি! কাপ্তান স্যালি হিগিনসের বালিকা কন্যা। প্রথমে কিছু বুঝতে পারিনি। সারেঙ সাব জাহাজে উঠেই সতর্ক করে দিয়েছিলেন।

—কাপ্তানের পুত্র এবারও উঠে এসেছেন জাহাজে। বজ্জাত। এড়িয়ে চলবি। কখন কোন বিপদে পড়ে যাবি—তুই ছেলেমানুষ, তোকে নিয়ে ভয়। অ আজার বালথাজার। আসলে অ আজার বালথাজার। বলে যেন সেই এক কথা বলতে চায়—ছবিটার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝলাম না। জীবনেরও না।

এই বলেছেন কন্যা, এই বলছেন পুত্র।

—তাই। আমারও বিশ্বাস হয়নি, জ্যাক আসলে জাহাজে ছদ্মবেশী। সে নারী। বালিকা যদি পুরুষের পোষাক পরে থাকে, বালিকা যদি মাথার চুল ছোট করে ছাঁটে আমি বুঝব কি করে! কেউ জানত না সে আসলে মেয়ে। সেই বালিকা বিশ বাইশ মাসে কিশোরী হয়ে গেল। ধরা দিল—তার নির্যাতন কেন আমার প্রতি সেদিন টের পেলাম, তুই বিশ্বাস কর, ভূত টুত ভেবে কেবিন থেকে পালাতে চেয়েছিলাম। অ আজার বালথাজার।

—ধরা দিল। আর আপনি ভূতটত ভেবে পালাতে চাইলেন!

—বুঝবি না। তুই জানিস না। সেই সমুদ্র সফর আমার মাথার উপর কত বড় বোঝা চাপিয়ে দিয়ে গেছে। জাহাজে শুধু নাবিক, অফিসার কাপ্তান। সমুদ্রে জাহাজ, দিন নেই রাত নেই শুধু চলছে। গভীর সমুদ্রে কোনো নাবিক যদি দেখে তার কেবিনে ডানা কাটা পরী দাঁড়িয়ে, ভয় হবে না। কোত্থেকে উড়ে এল। আমি পাগলের মত চিৎকার করে উঠেছিলাম। তুমি কে! জ্যাক যে নারী বুঝব কি করে! সে আভাসে ইঙ্গিতে কতবার বোঝাতে চেয়েছে, আমি বুঝতে পারিনি। যত বুঝতে পারিনি তত সে ধৈর্য হারিয়েছে। তত সে উৎপাত শুরু করে দিত। কখনও হুকুম, যাও ওঠো মাস্তুলে। দড়ি ধরে উঠে যাও। কেমন পাগলের মতো যা খুশি আমাকে করতে বলতো। একবার তো মাস্তুল থেকে পড়ে গেলাম ওর হুকুম তামিল করতে গিয়ে—কত ঘটনা—আমি সব মনে করতে পারছি না। গুলিয়ে যাচ্ছে সব আর কখনও জ্যাককে দেখেছি বিমর্ষ। সে বন্দরে বন্দরে নেমে গেছে আমাকে নিয়ে। ডাক্তার দেখিয়েছে। একরে করিয়েছে। কোনো ঘোর হয়তো সেখান থেকেই শুরু।

অতীশ থামল। আর কিছু বলছে না। যেন নিস্তেজ হয়ে পড়েছে বলতে বলতে। ফতিমা ভাবল, যদি ঘুমায় ঘুমোক। সে ডাকল না। সে চাদরটা গলা পর্যন্ত ঢেকে দিলে, আবার তাকাল অতীশ।

—আপনি ঘুমান। আমি পরে শুনব।

অতীশের মুখে করুণ সব ছবি যেন ভেসে উঠছে। মায়া মানুষকে তীব্রতর করে দেয় আকর্ষণের বীজ। ফতিমা বুঝল, সেও সব না জানতে পারলে বুঝতে পারবে না—কাঁটা কোন জায়গায় বিঁধে আছে। মানসিক অবসাদের চিকিৎসা আছে। সব জানতে চাইবে। সোনাবাবু তখন সব বলতে নাও পারেন।

—বৌদি জানে?

—কি জানে?

—এই জ্যাকের কথা। বনির কথা।

—না। সে কিছু জানে না। একবার শুধু বলেছিলাম। টুল থেকে পড়ে গিয়ে টুটুলের মাথায় রক্তপাত। ইমারজেন্সিতে ভর্তি করে ফিরে এসেছি।

আবার চুপ।

—তারপর!

—কেন যে মনে হয়, কোনো দুর্ভোগ দেখা দিলেই কেন যে মনে হয় আর্চির প্রেতাত্মার কাজ। সেই করাচ্ছে।

—টুটুলের কথা বলুন

—ডাক্তার বললেন, আটচল্লিশ ঘন্টা পার না হলে কিছু বলা যাবে না। ঈশ্বরকে ডাকুন। সেই রাতেই ফোন। আমরা দুজনেই টেনস হয়ে আছি। আমার কেন যে মনে হয়েছিল, সব শেষ। আর্টি যেন আমার সারা বাড়িতে হা হা করে হাসছে। সে প্রতিশোধপরায়ণ জানি। মিণ্টুকে জলে ডুবিয়ে মারতে চেয়েছিল, পারেনি। দু’জনই লড়ছে।

—দু’জন মানে!

—বনি আর আর্চি। বনির শুভ প্রভাবের সঙ্গে আর্চির অশুভ প্রভাব পেরে উঠছে না।

—আপনি এ সব বিশ্বাস করেন! কেন করেন বলুন। আর্চি কে?

—আর্টি!

সে ঢোক গিলল।—আর্চি কে বলছিস!

—জাহাজে আর্চি আমার আগেই টের পেয়েছিল, কাপ্তানের ছদ্মবেশী পুত্রটি আসলে নারী। কাপ্তান তার জেদি একগুঁয়ে মেয়েকে কারো কাছে রেখে আসতেও ভরসা পেতেন না। ওর বাবা ছাড়া আর কেউ ছিল না। আর্চি জাহাজের সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার। কাপ্তানের পুত্রটি আমার সঙ্গ পাবার জন্য অধীর হয়ে থাকত। আর্চি টের পেয়েই ক্ষেপে গেল! আমাকে যখন তখন বিজে ঢুকিয়ে দিত। সে কি নরক যন্ত্রণা বুঝবি না! মাথার উপর তিনটে বয়লার। গনগনে আঁচ আর নিচে কতদিনের জমে থাকা কয়লার ছাই। সে আমাকে দিয়ে বিল্জ সাফ করাত। সামান্য কোলবয় আমি। এতটা বিরক্তি আর্চির চোখে মুখে কেউ কিছু বলতেও সাহস পেত না। মুখ বুজে আর্চির অত্যাচার সহ্য করতে হত।

—টুটুলের কথা বলুন! টুল থেকে পড়ে গেল কি করে!

—জানি না। আর্চির কাজ।

—কেবল আর্চি, আর্চি। আপনি সব কিছুতেই আর্চিকে দেখতে পান কেন। সে কোথায়?

—তাকে আমি খুন করেছি।

—কেন, কেন খুন করলেন?

—বনির কেবিনের চারপাশে সে ফাঁক পেলেই ঘোরাফেরা করত। ইস তুই যদি তখন দেখতিস! দেখতাম চুপচাপ বনি পুরুষের ছদ্মবেশে বসে আছে। কোথাও বসে চিপিং করছে। আসলে কিছুই করছে না। সে টের পেয়ে গেছে আর্চি সুযোগের অপেক্ষায় আছে। আমাকে বলতেও পারছে না। যেন সে আর পরছিল না! যা হয় হবে। কেবিনে ঢুকে দেখি জ্যাকের ছদ্মবেশ নেই। সে যে বনি। আমি তো জানি, জাহাজের সবাই জানে, সে জ্যাক কাপ্তানের জেদি একগুঁয়ে দুর্বিনীত দাম্ভিক পুত্র। কি করে বিশ্বাস করি বল। আমার তখন খারাপ অবস্থা। এত জ্বালাচ্ছে! নরম সিল্কের গাউন পরে দাঁড়িয়ে আছে লকারের পাশে। ভূত দেখার মতো আঁৎকে উঠলে সে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বলল, বিশ্বাস কর, আমি বনি, আমি জ্যাক নই। আমি মেয়ে বিশ্বাস কর, ছোটবাবু আমি মেয়ে।

কেমন আবার গুলিয়ে যাচ্ছে অতীশ।

সে ধীরে ধীরে ফের বলল, কেমন গোলমাল পাকিয়ে ফেলছি। মনে করতে পারছি না। সবটাই কেন যে মরীচিকা মনে হয়। অতীশ চোখ বুজে কি মনে করার চেষ্টা করল, তারপর তাকাল। কষ্ট হচ্ছে বলতে, তবু বলল—আমার চিৎকারে সে আরও অধৈর্য হয়ে উঠল। আমি ততোধিক। সে সত্যি নারী। না এও আর এক শয়তানের ভূমিকা! বুঝতে না পেরে, তার গাউন দু-হাতে ছিড়ে দিতেই মাথাটা কেমন করতে থাকল। আমি তো নারীর কোনো খবরই রাখি না। বনি সত্যি যে নারী—এ ছাড়া তার যেন প্রমাণ দেবার অন্য কোনো উপায় ছিল না।

অতীশ আবার কেমন তলিয়ে যাচ্ছে।

সোনাবাবু, সোনাবাবু কি হল! আবার এমন করছেন কেন! মাথায় কোন কষ্ট বোধ করছেন। মাথায় মুখে হাত বোলাচ্ছেন কেন? কোন অস্বস্তি হচ্ছে। বলুন। সোনাবাবু সোনাবাবু!

—আমাকে ডাকছিস?

সোনাবাবু অবোধ বালকের মতো তাকিয়ে আছে তার দিকে।

—টুটুলের কি হল বললেন নাতো!

—টুটুলের কিছু হয়েছে? অতীশের ব্যাকুল প্রশ্ন।

—এই যে! ফতিমা বুঝল টুটুলের কথা বলে ভাল করেনি।

—না না, টুটুলের কিছু হয়নি। ওরা তো ঘুমিয়ে আছে। আপনি বললেন না, ওকে একবার হাসপাতালের ইমারজেন্সি ওয়ার্ডে ভর্তি করেছিলেন!

—অঃ। হ্যাঁ মনে করতে পারছি। রাতে ফোন। আমার বিশ্বাস, বনি ধূপবাতিদানটায় আশ্রয় নিয়ে আছে। কিন্তু এত রাতে হাসপাতাল থেকে ফোন করবে কে? কেন যে মনে হয়েছিল, সব শেষ। ছুটে এসে বাতিদানটা তুলে আছড়ে ভাঙতে গিয়েছিলাম। টুটুলের মা এসে কেড়ে নিল। তখনই বলেছিলাম, আর্চির কাজ। আমার ক্ষমা নেই। আমার সাফারিঙ শুরু হয়ে গেছে। আর্চিকে আমি খুন করেছি।

কথা কিছু অসংলগ্ন। তবু ফতিমা বোঝার চেষ্টা করছে।

—কিসের সাফারিঙ।

—বারে খুন করলাম, সে আমাকে ছেড়ে দেবে কেন?

–সে কে সোনাবাবু?

—আর্চি। কতবার বলব!

—সে তো মরে গেছে। সে আপনার নাগাল পাবে কেন!

—মরে গেছে বলেই তো সোজা তার পক্ষে লড়া। বেঁচে থাকলে আমি তাকে বিন্দুমাত্র ভয় পেতাম না। তার অদৃশ্য অশুভ প্রভাবে সব হচ্ছে টের পাচ্ছিলাম। কিন্তু বনি আমার ভরসা। ভয় পাই না।

—ভয় না পেলে তো ভাল। তিনি আপনার দেবী। ভয় পাবেন কেন?

—ঠিক বলেছিস! কিন্তু বিশ্বাস রাখতে পারি না। তখনই ঘোরে পড়ে যাই। ঘোরে পড়েই চিৎকার করেছিলাম, আর্চিকে খুন করেছি। সে আমাকে ছাড়বে কেন!

একই কথা বলছেন। পরে কি ঘটেছিল মনে করতে পারছে না হয়ত—ফতিমা এমন ভাবল।

—ঠিক আছে পরে আবার শুনব। পাশ ফিরে শোন। মাথার কোনো কষ্ট হচ্ছে না তো?

—না।

তোর বৌদি বিশ্বাস করে না। আর্চিকে খুন করেছি বললে, মাথায় গোলমাল আছে ভাবে। কিন্তু ফতিমা তুই বিশ্বাস কর, আমি আর্চিকে খুন করেছি।

—বৌদি বনির কথা জানে? বনি কোথায়?

—না। জানে না। বনি নিঁখোজ। দ্বীপে একটা ক্রসের নিচে বসেছিলাম।

ফতিমা বার বার বৌদি জানে কি না জানতে চাইছে। বৌদি জানে না, সত্যি জানে না! বনি নিখোঁজ। একটা ক্রসের নিচে সোনাবাবু বসেছিলেন। সে নিজেও কেমন সব তালগোল পাকিয়ে ফেলছে।

—আপনার বাবা মা জানে?

—না, কেউ জানে না। আমি তো বুঝতে পারি না বনির কি হল! আমি ক্রসের নিচে বসে আছি। বোট বালিয়াড়িতে পড়ে আছে। বনি নিখোঁজ।

অবাক ফতিমা। সোনাবাবু আবার তাকে ডাকছে।

—এই তো আমি।

—কোথায় তুই!

—আপনার শিয়রে বসে আছি।

—আমি মিছে কথা বলছি না। তুই বিশ্বাস কর।

—মিছে কথা বলবেন কেন!

—কাউকে বলতে পারিনি। অন্তত তোকে বলতে পারলে হয়তো আমার অপরাধবোধ কেটে যাবে। তুই সব শুনে সত্যি করে বলবি, আমার গা ছুঁয়ে বলবি, আমি পাপী কিনা।

—কোথায় পাপ করলেন!

—পাপ না! আমি খুন করেছি। পাপ না! কাপ্তান টের পেয়ে বলেছিলেন, তোমার ভোগাক্তি আছে ছোটবাবু। তোমাকে আজীবন এই ক্রস পিঠে বহন করে নিয়ে যেতে হবে। ভাবলেই মাথা আমার কেমন গোলমাল করতে থাকে।

—পাপ কার নেই ছোটবাবু। আপনি অবুঝ হবেন না। কবে কি করেছিলেন, তার বোঝা সারাজীবন বইতে হবে কেন! আপনি স্থির হোন। শান্ত হোন। আপনার টুটুল মিণ্টু আছে—তাদের ভবিষ্যৎ আছে, মাথা গোলমাল করে ফেললে, ওদের কি হবে?

—আর্চিকে খুন করেছি, তুই বিশ্বাস করছিস কিনা বল?

—করতেই পারেন। অকারণ কেউ কাউকে খুন করে না।

—ঠিক বলেছিস। আর্চিকে আমি ক্ষুধার্ত হিংস্র জন্তু ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারতাম না। মাঝে মাঝে মনে হত একটা ক্ষিপ্ত বাঘ। সে আমাকে আক্রমণ করবে, কিংবা থাবায় ঘাড় মটকে দেবে। বনিকে গোপনে ধর্ষণের জন্য সে কেবিনে ঢুকে গেছিল। উন্মত্ত আর্চিকে খুন করা ছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিল না। তুই বিশ্বাস কর। তবু কাপ্তান কেন যে সতর্ক করে দিলেন, ইয়ো স্যাল হ্যাভ টু সাফার। ম্যান ক্যারিঙ দ্য ক্রস। এই তোমার নিয়তি।

—ওটা সবার বেলাতে, খুন করলেও, না করলেও—ম্যান ক্যারিং দ্য ক্রস। জন্ম থেকে জন্মান্তরে পিঠে ক্রস বহন করে চলেছে।

—সবার বেলাতেই বলছিস!

—তাইতো। আমরা তো কেউ অবিনশ্বর নই।

—বাবাও তাই বলতেন।

—কি বলতেন?

–বলতেন সোনা, তুমি মাথা খারাপ ক’র না। যদি তোমার কোনো অজ্ঞাত, কিংবা জ্ঞাতসারে পাপ থেকে থাকে, তবে মনে করবে তাঁরই ইচ্ছে। তিনি ইচ্ছে না করলে তুমি কিছু করতে পার না। সেই অবিনাশী বীজের হেতু তুমি। তিনিই সব করাচ্ছেন। করিয়েছেন।

—ঠিকই বলেছেন।

—ঠিকই বলেছেন!

—হ্যাঁ। আপনি কেন যে এত ভেঙে পড়েছেন বুঝি না। আপনি কে?

—আমি কে? তার মানে!

—আল্লার মর্জিতে সব কিছু হয় জানেন।

—আল্লার মর্জিতে! আমি তবে কেউ না। আমাকে তবে পিঠে ক্রস নিয়ে আজীবন বধ্য ভুমির দিকে হেঁটে যেতে হবে না!

—ও হো! বললাম না ওটা সবার বেলাতে। পাপ করলেও, না করলেও। শাস্তি কোথায় বলুন। আপনি কি চান অবিনশ্বর থাকতে। আপনি কি মনে করেন জরা, ব্যাধি, মৃত্যু আপনার সংসারে ঢুকবে না। সে হয়! কারও হয়েছে। যদি কিছু হয়েই যায়, তাও তাঁর মর্জি।

—যারা আমাকে খুঁজে গেল! কখন অফিস যাই আসি খোঁজ নিয়ে গেল, তারা কারা! কে করাচ্ছে। প্রেতাত্মা না ঈশ্বর!

আমি জানি না। কিচ্ছু জানি না। কেউ যদি খোঁজ খবর নিয়ে থাকে, তার বিহিত করতে হবে।

—তুই জানিস না। ওদের খতম তালিকায় নাম উঠে গেলে কেউ রক্ষা পায় না।

—আপনি ওদের কি ক্ষতি করেছেন, কি করেছেন আপনি—ওরা আপনার নাম খতম তালিকায় ভুলে রেখেছে!

—ওরা তো শোষণহীন সমাজ গড়তে চায়। ওরা বলে আমাদের চেয়ারম্যান চীনের চেয়ারম্যান। আমি ম্যানেজার কারখানার। আমার নাম তো ওদের খাতায় তোলা থাকবেই।

ফতিমা আর পারছিল না। সোনাবাবু ধরেই নিয়েছেন, তিনি খুন হবেন। অজ্ঞাত কিছু লোক তাঁর অফিসে ঢুকে ভয় দেখিয়ে গেছে। ঠিক ভয় না, খোঁজ খবর নিয়ে গেছে। কলকাতা শহরে যেখানে সেখানে লাশ পড়ে থাকছে। পুলিশের গুলিতে মরছে। মাস কিলিং। নকশালদের সঙ্গে পুলিশের এনকাউন্টার। চারপাশে অরাজকতা। মানুষ যে কি চায়। তার শৈশবে সে মঞ্জু আর সোনাবাবু ছিল এক আশ্চর্য জগতের বাসিন্দা। মঞ্জুর কথা তুললে কেমন হয়!

সে বলল, সোনাবাবু, কনফেস করলে পাপ থাকে না। আপনি তো ছবিটা দেখেছেন। ছেলেগুলো কনফেস করত। কেন বলুন। আসলে মনে জোর ফিরে পাবার জন্য। অথচ দেখুন তারাই তাদের সঙ্গিনীকে ধর্ষণ করল ফের। তারা জানে কনফেস করলে পাপ থাকে না। এটা এক বয়সে সত্য। আর এক বয়সে অন্য সত্য—ওরা তো বড় হবে। ওদের পুত্র কন্যা হবে। সেই পুত্র কন্যার জন্য এই দুর্গতি থাকতে পারে। আপনার মনে আছে জব্বার চাচার কথা। মালতী পিসিকে টাকার লোভে অপহরণ করেছিল। নৌকায় তুলে নিয়ে গেছিল।

মালতী পিসির কথা অতীশের আবছা মনে পড়ছে। সে বলল, মালতী পিসি তো রঞ্জিত মামার সঙ্গে পালিয়ে গেল! কেন যে গেল! ফতিমা বলল, এ বয়সে বুঝতে পারেন না কেন গেল! একটা

কথা বলব?

—কি কথা!

আসলে সোনাবাবুকে সে চায় অন্যমনস্ক করে দিতে। কারণ এটা সে বুঝেছে, এই রোগের আসল লক্ষণ মাথায় কিছু ঢুকে গেলে, তা আর নড়তে চায় না। সোনাবাবুকে সব রকমের উদ্বেগ থেকে মুক্ত না করতে পারলে, তাঁকে স্বাভাবিক করে তোলা যাবে না। কি দিয়ে কি ভাবে করবে বুঝতে পারছে না। চিকিৎসায় এমন মানসিক চাপ থেকে উদ্ধার পাওয়া যায় কি না সেও জানে না। আসলে, চাই আনন্দ। জীবন অনিত্য এই ভেবে থাকলে সৃষ্টি বাঁচে না। সৃষ্টি তো আনন্দের উৎস।

তার যে কত কথা মনে হচ্ছে।

—কি বলবি বললি যে!

—ও! হ্যাঁ, আচ্ছা আপনি তো লেখেন। আপনার লেখাতে বড় বিষন্নতা! কেন এটা! আচ্ছা মঞ্জুর কথাতো কোথাও লেখেন নি।

—কার কথা লিখেছি! তোর কথা আছে!

—আছে। তবে নামে নেই, কামে আছে।

—ও-রকম সবাই আছে।

—জানি না। হয়তো ধরতে পারিনি। গাঁয়ের কথা তো অনেক জায়গায় লিখেছেন। বর্ষাকাল, নদী নালা কিছুই বাদ দেননি। তিল ফুলের জমির কথাও পড়েছি। আরও সব বন জঙ্গল, নরেন দাসের বাড়ির বর্ণনা তো হুবহু মিলে যায়। গোপাট কথাটা লিখেছেন। এ-দেশের লোক বুঝবে, গোপাট কারে কয়! আপনি যে লেখেন সেদিন জানতে পারলাম। আপনার কিছু বই কিনে ফেলেছি, কিছু পড়েও ফেলেছি।

—জানি না।

—মঞ্জু আপনাকে এত ভালবাসত!

বড় হবার মুখে কখন যে কার কোথায় আকর্ষণ গড়ে ওঠে! সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল, ভালবাসত বুঝি! বলে চুপ করে গেল। আবার কি বিষণ্নতার শিকার হবেন! মঞ্জুর কথা যেন না তুললেই ভাল ছিল।

সে বলল, আকালু মিঞার কথা মনে আছে?

—আকালু!

—আরে ফেলু শেখের বিবিকে নিয়ে যে পালাল।

—না মনে নেই।

—ভুলে গেলেন!

—আমি ভুলতে চেয়েছি। দেশের কথা ভাবলেই ক্ষোভে জ্বলে উঠতাম। তোরা আলাদা দেশ দাবি করলি! আমাদের মানুষ মনে করলি না। আমরা কোথায় যাব, কোথায় গিয়ে উঠব ভাবলি না। লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান। বাংলাদেশ, এমন সোনার বাংলা, তাকে পূর্ব-পাকিস্তান বানিয়ে ছাড়লি। ক্ষোভ হবে না! কেন আমাদের চলে আসতে হল। আমরা তোদের পর হয়ে গেলাম। একই জল মাটিতে নিশ্বাস ফেলেছি—বড় হয়ে উঠেছি, দেশাত্তরী করে ছাড়লি!

ফতিমা অনেক কথা বলতে পারে। আর্থিক সামাজিক এবং শোষনের কথাও তুলতে পারে। সোনাবাবু তলিয়ে দেখছেন না। গরীব মানুষ তো মনে করে, তারা শোষণ থেকে মুক্ত হবে। হিন্দু সাম্রাজ্যবাদ থেকে মুক্তির পথ খুঁজে পাবার চেষ্টায় দেশটার ভাগ। কিন্তু যে যেমন ছিল, এক পা নড়তে পারে নি। আগে ছিল একরকমের শোষণ—এখন অন্যরকমের। পশ্চিম পাকিস্তান শোষণের উপনিবেশ গড়ে তুলেছে। ধূর্ত লোকেরা চিরদিনই জয়ী হয়—কখনও সেটা ধর্মের নামে কখনও শোষণের নামে—যে যে-ভাবে পারে। তার আরও বলতে ইচ্ছে হয়েছিল, কেউ তো আপনাদের ভিটেমাটি ফেলে চলে আসতে বলে নি। আপনারাও কম হুজুকে মাতলেন না। এ-পারে আপনাদের স্বর্গবাস। নরকে কে থাকে। অধিকার তো আদায় করে নিতে হয় সোনাবাবু। কেউ অধিকার সহজে ছেড়ে দেয় না। আপনারা চলে না এলে দেশটার কত জোর থাকত বলুন! স্বায়ত্বশাসনের দাবি উঠেছে—পূর্ব-পাকিস্তানে জালিম ইয়াহিয়া, বুলডুজার চালাচ্ছে। আমার জাতভাইরা বড় ফাঁপরে পড়ে গেছে। দেখেন কি হয়।

অতঃপর ফতিমার কেন যে হাসি পেল, যেন দেশভাগ না হলে সোনাবাবুরা উৎখাত হতেন না! কে থাকে এক জায়গায়। শিকড় থাকে, তবে মানুষ তো চিরকালটাই যাযাবর। সে গাছের ছায়ায় বড় হয়, গাছ বড় হয়, সেও বড় হয়, গাছের ছায়া নড়ে। সেও নড়ে। এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায়। তার জীবনেই কি আর সেই শৈশবের পৃথিবীটা এক আছে। শহরে চলে আসার পর নানীর ইন্তেকালের পর সবই তো ছেড়েছুড়ে দিতে হল। শৈশব তো ছিল সোনাবাবুর স্বপ্নে বিভোর। সেই বালক দেশ ছেড়ে চলে গেলে, ফতিমার জীবন কত অর্থহীন হয়ে গেছিল, বোঝায় কি করে! সে নিজেও তো দেশবাড়ির খবর বিশেষ রাখে না।

সে সোনাবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি শুয়ে আছেন—সেই মহাভারতের ভীষ্মের শরশয্যার মতো।

তার বিষয় ছিল হিন্দু মিথলজি। সে সংস্কৃতের কৃতি ছাত্রী। তার পড়াশোনা সব এই হিন্দুদের আচার নিয়ম, ধর্মবোধ, এবং উপনিষদের শ্লোক সমূহ। তার মনে আছে, সব মিথ্যা ব্রহ্ম সত্য। একই কথা—আল্লা ছাড়া তাদের উপাস্য কেউ নেই। একই রকমভাবে সব ধর্মের কিছু কথা মানুষের জীবনে বর্তে আছে। তবু বিসর্জন—যেটা আচারে এবং কোরান হাদিসের কিছু নির্দেশে। অথচ এই মানুষটার সঙ্গে জীবনের এক আশ্চর্য পয়ার গাঁথা হ’য়ে থাকল। কখনও মনে হয় এটাই তার পাপ। এবং এই পাপ তাকে নিঃসন্তান করে রেখেছে—কে জানে এই পাপ থেকেই সে তার সাহেবের জীবন থেকে কখনও বিছিন্ন হয়ে যাবে কি না। তার বড় আতঙ্ক। কিন্তু সে তো সোনাবাবুর মতো নিজেকে অষ্টপ্রহর কষ্ট দিচ্ছে না। সে যদি এত বড় আতঙ্ক নিয়ে হাসিমুখে থাকতে পারে—সোনাবাবু কেন বুঝছে না কটা তো দিন, মানুষ তো ঘর বাড়ি বানায় উত্তরপুরুষকে থিতু করে দিয়ে যাবার জন্য। তারপর যে যার মতো আবার হাওয়ায় উড়তে থাকে। গাছ হয়, বাড়ে। ডালপালা মেলে দেয়। ফুল হয়। ফল হয়। ফল থেকে বীজ। তারপর বীজ উড়ে যায়। তার ফুল ফুটল না। ফল হল না, বীজের উন্মেষ নেই। কোনো অনিয়ম থাকলে এক কথা ছিল। সাহেবেরও কোনো খুঁত নেই। আসলে জন্ম এবং জন্মের মধ্যে থাকে নিরন্তর কোন সুষমা। ফুল ফোটার কথাও সেই নিয়ম থেকে। তার ক্ষেত্রে নিয়মটাই ভেঙে গেছে। তার সহবাসে স্যমার কোনো সংকেত ভেসে ওঠে না। এটা যে কোনো নিখোঁজ বালকের জন্য হয়নি কে বলবে! এবং এসব ভাবতে গিয়ে সে চোখের জলে ভেসে যাচ্ছিল। সোনাবাবু দেখতে পাচ্ছে না, সে আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছে।

সোনাবাবু বলল, কিরে তোর সর্দি হয়েছে? ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করছিস।

—না। সে উঠে দাঁড়াল।

–কোথায় যাচ্ছিস! আকালুর কথা বলছিলি?

ফতিমা সাড়া দিতে পারছে না। কারণ কথা বললেই ধরা পড়ে যাবে।

সে সোজা বাথরুমে ঢুকে চোখে মুখে জল দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। চাতালটা খোলা। চাতালের একপাশে বাথরুম। উপরে কোন ছাউনি নেই। আকাশ দেখা যায়। বাথরুমে জ্যোৎস্না। আলো জ্বালার দরকার হয়নি। সে কেমন কিছুটা বিমূঢ়। তার এমন ভাবনা হচ্ছে কেন—কোনো সুষমার অভাব থেকে গেছে জীবনে! যুক্তি দিয়ে সে বোঝার চেষ্টা করছে না। টুটুলকে দেখার পর তার ভিতরে মাতৃস্নেহ প্রবল। সে তো টুটুল মিণ্টুর টানেই চলে আসত। ও-সব ছাইপাঁশ ভেবে তার চোখে জল কেন! এত কান্না কেন!

নিজের এই বোকামির কোনো অর্থ হয় না। এটাও এক ধরনের প্রবোধ। সে তো সোনাবাবুকে আজীবন স্বপ্নের মানুষ বলেই জেনেছে। সবার জীবনে এই এক স্বপ্নের মানুষ বেঁচে থাকে। বেঁচে থাকে বলেই দুঃখকে জয় করা সহজ। যার থাকে না; সেই বোধ হয় শেষকালে সোনাবাবু হয়ে যায়।

সহসা মনে হল, চাতালে কে এসে দাঁড়িয়েছে।

—আপনি!

–তোকে খুঁজছি। ঘরে নেই। টুটুলের ঘরে নেই—গেলি কোথায়।

–চলুন। ফতিমা সোনাকে হাত ধরে ঘরে নিয়ে যেতে চাইল।

–এখানে বসি।

সোনাবাবু চাতালের মোড়ায় বসে পড়ল।

ফতিমা বলল, অনেক রাত হয়েছে। কী যে করছেন না! ঘুমাবেন না!

–আকালুর কথা কি বলছিলি যেন!

সোনাবাবু কি এ-ভাবে যারা এক জীবনে এক ভাবে বাঁচে, অন্যজীবনে তারা কে কিভাবে বেঁচেছিল জানার জন্য উদগ্রীব। নতুবা আকালুর কথা মাথায় ধরে রাখবে কেন। যেমন কোনো অসুখী মানুষ অন্য অনেক অসুখী মানুষের খবরে তৃপ্তি পায়, এও কি তেমনি! এর মধ্যে কি কোনও নিরাময়ের হেতু খুঁজে পান তিনি!

অগত্যা আর কি করা!

তার তো ভালই লাগছে। জীবনে সোনাবাবুর সঙ্গে কখনও দেখা হবে আশা করেনি। শুধু দেখাই না, জীবনের জটিল পরিস্থিতিতে সে সোনাবাবুর এখন বলতে গেলে প্রহরী।

সে একটা মোড়া এনে বসল। শাড়ি দিয়ে ভাল করে গা ঢেকে বসল। এই চাতালের পর টিনের বেড়া—তারপর মাঠ, এবং রাজবাড়ির বিশাল এলাকার ভিতর যে গাছপালা, ফুল ফলের বাগান আছে সে বসে থেকে টের পায়। কিছু পাখির কলরব পর্যন্ত শুনতে পাচ্ছে। কীট-পতঙ্গের আওয়াজ। রেলের হুইসেল এবং কোনো রাতের গাড়ি চলে যাচ্ছে টের পায়।

সে বলল, আকালুর ছেলে সমসের। সে তো এখন আওয়ামি লিগের বড় ছাত্র নেতা জানেন!

সমসের কে, সমসেরের কথা তুলছে কেন, কিংবা আকালু যে ফেলুর বিবিকে নিয়ে নিখোঁজ হয়ে গেছিল, তেমন প্রসঙ্গই বা ফতিমা ভুলল কেন অতীশ বুঝতে পারছে না।

সে বলল, আওয়ামি লিগের বড় ছাত্রনেতা তো কি হয়েছে।

–ফেলুর বিবি সমসেরের মা।

–হতেই পারে।

–সমসেরকে দেখলে বুঝতে পারবেন না। সে আকালুর বেটা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্র। সব ছেড়ে ছুড়ে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে জেল খাটছে। শেখ মুজিবের খুবই প্রিয়জন।

–কি বলতে চাস বুঝতে পারছি না।

–পাপ তাপের কথা বলতে চাই সোনাবাবু। আকালু খুন রাহাজানি কম করেনি। তার ব্যাটা সমসের। আকালু জীবনে কোনও তাড়ায় ভুগেছে বলে জানি না। সেও হজ করে এসেছে। পাপ তাপ তাকে আর স্পর্শ করতে পারেনি। আপনি কবে কি করেছেন, তাই ধুয়ে বসে বসে জল খাচ্ছেন। পারেনও আপনি।

সোনা শুধু বলল, অ আজার বালথাজার।

কেমন ছন্দ আছে অর্থ থাকে না। কেমন লিরিক আছে ছবিটাতে, অথচ মাথামুণ্ডু কিছু বোঝা যায় না, যত ফতিমা কথা বলে তত ছবিটার কথাই মনে হয়। পাঁচিলের পাশে নগ্ন বালিকা উবু হয়ে বসে আছে—এবং তার তখন আর একটা প্রশ্ন মাথায়, সে ক্রসের নিচে বসেছিল কেন।

ফতিমা বনি সম্পর্কে কোনো আগ্রহ প্রকাশ করছে না। কিংবা জানতে চাইছে না বনির কি হল! ফতিমা সূত্রটা ধরিয়ে দিতে পারে।

সে ফের বলল, কোনো নির্জন দ্বীপ কেবল চোখে ভেসে ওঠে জানিস!

–সমুদ্রে ঘুরেছেন, ভাসতেই পারে।

–একটা ক্রসের নিচে বসে আছি। কাঠের ক্রস। বোটে ভাসিয়ে দেবার সময় কাপ্তান বোটে একটা ক্রস তুলে দিয়েছিলেন। একটা বাইবেল। কাপ্তান স্যালি হিগিসের সংশয় ছিল, আমরা আদৌ ডাঙ্গায় পৌঁছাতে পারব কিনা। যদি মরি, ক্রস আঁকড়ে যেন মরি। যদি মরি বাইবেল যেন দু’জনের শিয়রে থাকে।

ফতিমা মাথা নিচু করে বলল, তিনি তাঁর বিশ্বাস মত কাজ করেছিলেন।

–কিন্তু থাকল তো একটা ক্রস। তার নিচে আমি বসে। ডাঙ্গা পেলাম। একটা মরা পাখি বোটে। অ্যালব্রাট্রস পাখিটাকে কে মেরে ফেলেছে! বনির খোঁজ নেই।

–আপনি দেশে ফিরলেন কি করে!

–আমার ফেরাটা কোনো প্রশ্ন হল! একটা ক্রস দাঁড়িয়ে আছে, আমি তার নিচে বসে আছি- বনি নিখোঁজ কত খুঁজেছি দ্বীপে। কোন সাড়া পেতাম না। কত ডাকতাম, বনি ডোন্ট টাৰ্ন ফ্রম মি ইন দিস টাইম অফ ডিস্ট্রেস। বেন্ট ডাউন ইউর ইয়ার অ্যান্ড গিভ মি স্পিডি অ্যানসার।

ফতিমা বলল, তার সাড়া পেলেন!

–না। কেবল পাহাড়ে প্রতিধ্বনি উঠত—স্পিডি অ্যানসার! স্পিডি অ্যানসার।

–গেল কোথায়?

–সেই তো! সুখে দুঃখে সে আমার সব ছিল। মা বাবার কথা মনে করতে পারতাম না। সে রাত জাগত বোটে। আমি ঘুমাতাম। জলের ঝাপটায় জামা প্যান্ট ভিজে যেত। রোদ উঠলে খসখস করত। গা চুলকাত। সে আমার জামা প্যান্ট রিপু করত। বৃষ্টির জলে জামা প্যান্ট ধুয়ে রোদে শুকাত। শেষদিকে আমাদের তো কিছুই ছিল না। ঝড়ে না ঢেউয়ে ভাসিয়ে নিয়েছে সব। গরমে জামা প্যান্ট গায়ে রাখতে পারতাম না। সব খুলে ফেলতাম। বনি আমি দুই নরনারী আদম ইভের মতো পাটাতনে শুয়ে থাকতাম। সে স্বাভাবিক থাকলে বলত, ভেঙে পড়বে না। আমি কোনো পাপ করিনি। ডাঙা আমরা পাবই।

–ঠিক বলেছে। ডাঙা তো পেয়েছেন।

আমি তো একা ডাঙা পেতে চাইনি। দু’জনের মতো সামান্য একটু আশ্রয় ছিল আমার কাম্য। কি করে যে হল বুঝি না। আমার মনে আছে, বনি উঠতে পারত না। ওর চামড়া ফেটে যাচ্ছিল। চামড়া ফেটে রক্ত পড়ছে। আমি চুষে খেতাম। সে কিছুই খেতে পারত না। প্ল্যাংকাটন খেতে গেলে বমি হত।

–আপনি ওর রক্ত চেটে খেতেন!

অতীশ সহসা মাথা নিচু করে বলল, কি করব! না খেলে রাগ করত। প্লাংকাটন ছাড়া আর তো কিছু নেই। তাও সব সমুদ্রে মিলত না। সে তো কিছুই খাবে না। সে শুধু চেয়েছিল বোট আমাকে ডাঙায় পৌঁছে দিক। আমি ওর মতো নিস্তেজ হয়ে পড়িনি। আমার গা ফেটে রক্ত গড়াত না। বার বার ধারাল ছুরি বের করে আঙুল কেটে রক্ত বের করেছি—সে কিছুতেই খেতে পারত না। তার কেবল ওক উঠে আসত। কত বলেছি, বনি আমার দিকে তাকিয়ে অন্তত খাওয়ার চেষ্টা কর। এই দ্যাখ আমি কেমন খাচ্ছি। বলে জেলির মতো সবুজ প্ল্যাংকাটনের ডেলা মুখে তুলে দিতাম। তিক্ত বিস্বাদ—অথচ প্রোটিন জল সব আছে ওতে। সমুদ্রে বেঁচে থাকার একমাত্র উপায়।

—প্ল্যাংকাটন কি বস্তু?

–সমুদ্রে পাওয়া যায়। ছোট একটা জালির মতো ভাসিয়ে রাখতাম। তাতে জমত। তুলে নিয়ে আহার।

সোনাবাবু যেন কিছু খুঁজছে।

–কি খুঁজছেন!

–না কিছু না। আমার যে কি হয়! বনি যেন এইমাত্র পাশে এসে দাঁড়াল। ছায়ার মত। তুই দেখিসনি!

বিস্বাদ—অথচ প্রোটিন জল সব আছে ওতে। সমুদ্রে বেঁচে থাকার একমাত্র উপায়।

–প্ল্যাংকাটন কি বস্তু?

–সমুদ্রে পাওয়া যায়। ছোট একটা জালির মতো ভাসিয়ে রাখতাম। তাতে জমত। তুলে নিয়ে আহার।

সোনাবাবু যেন কিছু খুঁজছে।

–দেখিসনি!

—কি খুঁজছেন!

–না কিছু না। আমার যে কি হয়! বনি যেন এইমাত্র পাশে এসে দাঁড়াল। ছায়ার মত। তুই

–না তো!

–কেউ দেখতে পায় না।

–সোনাবাবু প্লিজ আপনি সব ভুলে যান।

–ভুলে যেতে বলছিস!

–যত ভাববেন, তত আপনি ঘোরে পড়ে যাবেন। আমি আর কিছু শুনতে চাই না। উঠুন। চলুন ঘরে। ঘুমাবেন।

–তুই যে বললি, কনফেস করলে পাপ থাকে না।

ফতিমা কি যে করে।

তাকে ধৈর্য ধরতেই হবে। অধৈর্য হলে চলবে না। কেউ জানে না, কেউ না। বনির সঙ্গে ছোটবাবুর এক পরম উষ্ণতা গড়ে উঠেছিল। বনির মর্যাদা রক্ষা করতে আর্চি নামে কোন এক শয়তানকে তিনি খুন করেছেন। এমন ভীতু স্বভাবের মানুষের পক্ষে এত বড় পাপ হজম করা কঠিন। তাই ঘোরে পড়ে যান। দুর্বলচিত্ত মানুষ, ভীরু প্রকৃতির। সোনাবাবুর ক্লিষ্ট মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। চাতালের উজ্জ্বল আলোতে সোনাবাবু কেমন বিমর্ষ হয়ে যাচ্ছেন।

–আসলে কি জানিস, আমি বিশ্বাসই করতে পারি না, বনি এ-ভাবে আমাকে ফেলে চলে যেতে পারে। কত ডেকেছি, দ্বীপের গাছপালার ভিতর, পাহাড়ের ঢালুতে, জলাশয়ের ধারে ধারে খুঁজেছি—বনি প্লিজ সাড়া দাও। বলতাম, ফর মাই ডেইজ ডিজএপিয়ার লাইক স্মোক, মাই হেলথ ইজ ব্রোকেন, অ্যান্ড মাই হার্ট ইজ সিক, গিভ মি স্পিডি অ্যানসার। তুমি কোথায়?

–সাড়া দেয় নি?

–না সাড়া দেয় নি। বোটটা যেন কেউ ডাঙায় টেনে তুলে এনেছে। সমুদ্রের ঢেউ-এ ভাসিয়ে এনে ডাঙায় কে যে বোটটার এত সুরক্ষার চেষ্টা করেছে! গ্যারাফি দিয়ে কেউ খোঁড়াখুঁড়ি করেছে। কে খোঁড়াখুঁড়ি করল। গ্যারাফির সূচলো ডগায় কাদামাটি লেগে আছে।

তারপর খানিক দম নিয়ে সোনাবাবু বলল, কী করে যে কাদামাটি লাগল! বালির গভীরে কাদামাটি থাকে; আমি কিছু বুঝতে পারছি না! কত চেষ্টা করেছি, বোঝার। পারিনি। কোথায় গেল। দ্বীপে যদি লুকিয়ে থাকে, সেই বা হবে কি করে! শেষ বেলাতে বনির নড়াচড়ার ক্ষমতা ছিল না। সে আমাকে ফেলে যাবে কি করে! কোথায় যাবে, কার কাছে যাবে। শরীরে পচা গন্ধ টের পাচ্ছিলাম। শেষ চেষ্টা।

–শেষ চেষ্টাটা কি!

–মনে করতে পারছি না। বার বার চেষ্টা করছি—দেশে ফিরে আসার পর বার বার চেষ্টা করছি—পারিনি। শেষ চেষ্টা, সূত্রটা আবিষ্কার করতে হবে—পারিনি।

বলতে বলতে সোনাবাবু কেমন হতাশ হয়ে পড়ল।

ফতিমা বলল, অ্যালব্রাটস পাখিটা মরে গেল কি করে! বোটে সে উড়ে আসত কেন!

–সে অনেক কথা ফতিমা। আমি গুছিয়ে বলতে পারব না। পাখিটা আমাদের কম্পাসের কাজ করত। যেদিকে উড়ে যেত, আমরা বোট সেদিকে নিয়ে গেছি। পাখিটার পিছু পিছু বোট ভেসে গেছে। কিন্তু কপাল মন্দ—সেও বোধহয় সমুদ্রে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিল। হতাশ হয়ে ফিরে আসত। বোটের মাথায় বসে থাকত। নিশীতে ঝিমোতো। কখনও আমরা তাকে আদর করতাম বুকে হাত বুলিয়ে। যদি শেষ হয়ে যায়, যদি তেষ্টা পায়, সমুদ্রে ডুবে স্নান করবে। তেষ্টা নিবারণ হয় ওতে। যদি দেখ খাবার ফুরিয়ে আসছে, ছাকনিটা জলে ফেলে রাখবে। প্ল্যাংকাটন জড় হবে ছাঁকনিতে। যদি সব শেষ হয়ে যায়, প্ল্যাংকাটন খাবে। খেতে পারলে সমুদ্রে ক্ষুধা তেষ্টায় মরার ভয় থাকবে না। সব সমুদ্রে প্ল্যাংকাটন নাও পেতে পার। তখন, তখন, তিনি কেমন ভেঙে পড়লেন বলতে বলতে, ইউ ক্যান সাক হার ব্লাড।

–আপনি কি ঘোরে পড়ে তাই করেছিলেন?

–আমি জানি না। আমি কিছু মনে করতে পারছি না। তবে বনির চামড়া ফেটে যেত। ফোসকা পড়ত। ঘা হত। রক্ত পড়ত। বনি বলত, চেটে দাও। আমি আরাম পাব।

–তাই করতেন!

–ও যে বলত।

–ও বললেই করবেন!

–না করলে কথা বলত না। মুখ ফিরিয়ে রাখত। জলে ঝাঁপিয়ে আত্মহত্যা করবে ভয় দেখাত। আর, যে কি হয়েছিল—কাঁচা মাছের চেয়ে—সুস্বাদু ঠেকত রক্ত পুঁজ। ঘা। প্ল্যাংকাটনের চেয়ে সুস্বাদু মনে হত।

সহসা ফতিমা আর্তনাদ করার মতো বলতে যাচ্ছিল, আপনি তো আর একটা খুন করেছেন সোনাবাবু। কিন্তু সে জানে, এতে টুটুল-মিণ্টুর আরও বড় সর্বনাশ হয়ে যাবে। আর মনে করিয়ে দরকার নেই।

সে বলল, যা হারিয়ে গেছে, যা অতীত তাকে খুঁজে আর দেখতে হবে না। ভুলে যান সোনাবাবু। সব ভুলে যাবার চেষ্টা করুন। দেশ ভাগ, সমুদ্র যাত্রা, শয়তান আর্চি, বনির কথা সব ভুলে যান।

সোনাবাবু বলল, আমাকে ধর।

ফতিমা তাকে ধরলে সে উঠে দাঁড়াল। ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকল। ফতিমার শরীরে ভর করে বসল। বলল, খুবই স্তিমিত গলা, আমি তাকে দ্বীপে সারাদিন খুঁজে বেড়িয়েছি। রাতে এসে ক্রসটার নিচে বসে থাকতাম। আমার সব শেষ। চিৎকার করতাম, বনি মাই ফুড ইজ টেস্টলেস অ্যান্ড আই হ্যাভ লস্ট মাই এপিটাইট। বেন্ট ডাউন ইয়োর ইয়ার অ্যান্ড গিভ মি স্পিডি অ্যানসার।

–সারা পেলেন? ফতিমা অতীশকে শুইয়ে দিল।

–না সাড়া পেলাম না। কোথায় যে চলে গেল! যাবেই বা কি করে! বুঝছি না কিছু। আর্চির প্রেতাত্মা যদি তাকে নিয়ে চলে যায়। যেতেই পারে। আর্চি যদি তার ভিতরে ঢুকে যায়—তবে সে হেঁটেই চলে যেতে পারে। কিন্তু আমি জানি আর্চির প্রেতাত্মা তাকে বশ করার চেষ্টা করলেও সে রাজি হয়নি। যতবার দুর্যোগ এসেছে, বার বার শুনেছি, সে হাঁকছে, ইয়ো আর ইনোসেন্ট। গড সেভস দ্য ফাদারলেস অ্যান্ড দ্য পুত্তর ফ্রম দ্য গ্র্যাসপ অফ দিজ অপ্রেসার।

–অপ্রেসার কারা? ফতিমা চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে প্রশ্ন করল।

–অপ্রেসার!

–হ্যাঁ কারা অপ্রেসার?

–চারপাশেই তো তারা আছে ফতিমা।

–তারা আপনার ক্ষতি করতে পেরেছে?

–না।

–কেন পারে নি?

–বনির শুভ প্রভাব।

–তাহলে আপনি এত ভয়ে মরছেন কেন?

–সেই তো! বনি থাকতে আমার ভয় কি! কিন্তু আমি তো জানি না, বনি কোথায় গেল! কেন ক্রসটার নিচে বসে থাকতাম। বিশ্বস্ত পাখিটাকেই বা খুন করল কে?

–আপনি ঘোরে পড়ে গেছিলেন।

–ঘোরে!

–হ্যাঁ। ঘোরের মধ্যে কিছু করেছেন। বনির নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার বিবরণটা আপনাকে ত্রাসে ফেলে দেয়। আপনি তারই শিকার। আর্চির প্রেতাত্মা তখন তাড়া করে আপনাকে। আপনি যাই করে থাকুন, তা কোনো অজ্ঞাত পাপ থেকে করেছেন। আপনাদের তো কত বিধান আছে জানি। অজ্ঞাত পাপের জন্য প্রয়শ্চিত্ত করলে, রোগ থেকে নিরাময় হওয়া যায় শুনেছি।

–আমার অজ্ঞাত পাপটা কি?

ফতিমা বুঝতে পারল না, বলা ঠিক হবে কিনা। সে চুপচাপ বসে থাকল শিয়রে। বলল, আপনি ঘুমোন। যদি ঘুমাতে পারেন, যদি আপনার গাঢ় নিদ্রা হয়, তবেই আপনি ভাল হয়ে উঠবেন। কেন অযথা নিজেকে কষ্ট দিচ্ছেন। বনি তো বলেছে, আপনি ইনোসেন্ট। আর্চি বলেছে, ইয়ো আর এ সিনার। কার কথা সত্য ধরবেন। একজন প্রতিশোধপরায়ণ, অন্যজন ভালবাসার কাঙাল। কাকে আপনি বেশী প্রশ্রয় দেবেন বলুন। কাকে দেওয়া উচিত। আপনার জীবনে কোনো পাপ নেই সোনাবাবু।

—কি করে বুঝলি! আমি তো ক্রসটার নিচে রাতে শুয়ে থাকতাম। কখনও বসে থাকতাম ক্রসটায় হেলান দিয়ে। ক্রসটা ছেড়ে কোথাও উঠে যেতে ইচ্ছে হত না। ভেঙ্গে পড়লে আর্তনাদ করতাম—আই অ্যাম লাইক অ্যা ভালচার ইন এ ফার-অফ-ওয়াইলডারনেস অর লাইক অ্যান আউন্স ইন দ্য ডেজার্ট। আই লাই আওয়েক, লোনলি আজ অ্যা সলিটারি স্প্যারো অন দ্য রুফ। গিভ মি স্পিডি অ্যানসার।

ফতিমা বলল, দুশ্চিন্তা করবেন না। সে আর সাড়া দেবে না। সে মাঝে মাঝে আপনার কাছে আসতে পারে। মানসিক দুর্বলতায় যত বেশি আক্রান্ত হবেন, তত সে আপনার পাশে এসে সাহস দেবে।

–সে সাড়া দেবে না কেন? তার কি হয়েছে।

–সোনাবাবু প্লিজ চুপ করুন। তার কিছু হয়নি। আপনি ঘুমান। দোহাই সোনাবাবু আর বিভ্রান্তিতে ভোগাবেন না। আমার দিকে তাকান—অতীশ উঠে বসল। ঘরে অল্প আলো জ্বালা। রহস্যময়ী নারীর সে কি ক্ষুরধার দৃষ্টি। সে বলল, ফতিমা আমার শৈশব কেন এত মোহাচ্ছন্ন। তুই কেন বনির মতো দেবী হ’য়ে যাচ্ছিস।

ফতিমা বলল, আমি যদি দেবী হই তবে দেখুন যা যা বলছি ঠিক কি না। আপনি হাতড়ে বেড়াচ্ছেন আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি—বনিকে শেষ চেষ্টা করেছিলেন বাঁচাতে। মানুষের রক্ত তার কাছে বিস্বাদ ঠেকতে পারে ভেবেছিলেন। দেখলেন, আপনার ক্ষতস্থান থেকে যে রক্ত পড়ছে, তা সে চুষে খাচ্ছে না—বনি ছটফট করছে। মুখ থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। কি ঠিক বলছি তো!

—ফতিমা আমার সব মনে পড়ছে। তারপর সে শিশুর মতো কুঁকড়ে গেল। বলল, আমি ভেবেছিলাম মানুষের রক্তের চেয়ে পাখির রক্ত বেশি সুস্বাদু বনির কাছে। আমার অসহায় চোখ পাখিটার উপর গিয়ে পড়ল। জাপটে ধরলাম।

–বলুন, থামলেন কেন।

—কী হল বলছেন না কেন? কনফেস করবেন বলেছেন! অ আজার বালথাজার! ফতিমা আবার স্মরণ করিয়ে দিল ছবিটার কিছু দৃশ্য।

অতীশ থেমে থেমে বলল, পাখিটাকে বললাম, আমার ক্ষতস্থান থেকে বনি রক্ত শুষে নিচ্ছে না। সে চায় না—সে আমাকে ঘৃণা করে। আমি খুন করেছি। তুমি তো খুন করনি—তুমি তো আমাদের শেষ আশ্রয়। অথচ দেখ কতবার ভেবেছি—তোমার উপর আর্চির প্রেতাত্মা ভর করেছে। সমুদ্রের আসল শয়তান তুমি। বুঝি সংশয় মানুষকে পীড়ন করলে এটা হয় ফতিমা। কখনও মনে হয়েছে, পাখিটাও সমুদ্রের শয়তান। এক অজানা সমুদ্রে এনে ফেলেছে আমাদের। বনি বিশ্বাস হারায়নি। বনিকে পার না, তোমার রক্ত দিয়ে অদ্ভুত ক্ষণকালের জন্য জীবন ফিরিয়ে দিতে। তারপর চেষ্টা শুরু হবে। যদি ডাঙা না পাই তাহলে প্ল্যাংকাটন ঠেসে দেব মুখে। অদ্ভূত একবারের জন্য বনিকে চোখ মেলতে দাও। আমার মাথায় যে কি খেলে গেল। পাখিটার গলার নালি কেটে ঠেসে ধরলাম বনির মুখে। বনি কিছুই গ্রহণ করল না। ফতিমা দেখল সোনাবাবু আবার চুপ। কি যেন ভাবছেন। না পেরে বলল, তারপর?

–তারপর জানি না।

–জানেন। সেই রাতেই আপনি সম্ভবত দ্বীপের গাছপালা দেখতে পেলেন। কি মনে করতে পারছেন।

–না।

–আবার ভাবুন। আবার ভাবুন, বোটে আপনি একা। পাখিটা পড়ে আছে পাখা ছড়িয়ে। বনি অসাড়। মৃত। জীবিত বলতে আপনি একা। আমার তো মনে হয় ঘোরে পড়ে বনিকে সমাধিস্থ করেছেন। গ্যারাফি দিয়ে মাটি খুঁড়েছেন। সূর্য অস্ত গেলে তাকে শুইয়ে দিয়েছেন মাটির গভীরে। মাটি দিয়ে ঢেকে দিয়েছেন তাকে। তারপর ক্রসটা পুঁতে দিয়েছেন। শেষে আপনি আজ যেমন আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন, সেই আচ্ছন্নতায় ডুবে গেলে, সব ভুলে গেলেন।

ফতিমা বলছে, কি ঠিক বলছি কি না!

কোনো সাড়া নেই।

ফতিমা চুপচাপ বসে।

আর কোনো প্রশ্ন না। এখন শুধু বসে থাকা।

ঘড়িতে ঘন্টা বাজছে।

ফতিমা আন্দাজে ঢিল ছুঁড়েছে। কারণ তার কিছু আর করণীয় নেই। সব শুনে তার যা মনে হয়েছে—ক্রস, ক্রসের নিচে বসে থাকা, অথবা দ্বীপের গাছপালার মধ্যে বনির সাড়া পাবার জন্য সেই আর্ত চিৎকার- কিংবা গ্যারাফির মুখে কাদামাটি—সে যেন কোথায় কোন গল্পে এমন আচ্ছন্নতার কথা পড়েছে। গল্পের নায়ক যা করত ঘোরের মধ্যে করত। খুন করত। পরে মনে করতে পারত না। সে কতটা ঠিক বলেছে জানে না। কিন্তু দেখছে, সোনাবাবু পাশ ফিরে শুয়েছেন।

সে খুব আস্তে ডাকল, সোনাবাবু।

ঘুমে জড়ানো কণ্ঠ। হুঁ।

সে ফের ডাকল, সোনাবাবু।

গলা আরও বুজে আসছে। ঘুমে তলিয়ে গেলে যেমন হয়। তার ভিতর থেকেই বলছেন, অ আজার বালথাক্তার। টেনে টেনে বলছেন। বলতে কষ্ট হচ্ছে যেন। ঘুম জড়িয়ে আসছে চোখে। ফতিমার কেমন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। তারপর সে পায়ের কাছে এসে দাঁড়াল। সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে স্বর্গীয় সুষমা সোনাবাবুর চোখে মুখে। পরিতৃপ্ত। যেন তার এই বিভীষিকাময় সমুদ্র জীবনের কথা কাউকে বলতে না পেরে এতদিন ছটফট করছিলেন। কাউকে বলতে চাননি। কিংবা বললে যদি মনে করে, মাথার গোলমাল, কিংবা অবিশ্বাস্য বলে উড়িয়ে দেয়—অথবা এমনও হতে পারে সোনাবাবু একজন খুনি ভেবে যদি ঘৃণা করে তাকে—তার তো এমন হওয়ার কথা ছিল না। এত বড় দুর্যোগ এত বড় দুঃসাহসিক সমুদ্র অভিযান, বনির মতো গভীর প্রেম এবং নৈঃশব্দমালা, মানুষটিকে আরও মহিমাময় করে দিয়েছে। সোনাবাবুর পক্ষেই সম্ভব এত বড় ক্ষত নিয়ে এতদিন বেঁচে থাকা। তার নিজেরও সেই সব দৃশ্যমালা মনে হলে কেমন শরীর অবশ হয়ে আসে। অজানা সমুদ্রে একটা বোট, ঝড়জলে তছনছ করে দিয়েছে সব—বোট ভাসছে। কখনও জ্যোৎস্নায়, কখনও রোদ্দুরে। এক কিশোরী সোনাবাবুকে সাহস দিয়ে যাচ্ছে।

সে দেখতে পায়, বোটে হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছে সোনাবাবু। সে দেখতে পায় পালের দড়িদড়া ঠিক করছে সোনাবাবু। সে দেখতে পায় সাঁজবেলায় লণ্ঠন জ্বেলে সোনাবাবু আর বনি, দুটো আলুসেদ্ধ কিছু মটরশুঁটি সিদ্ধ খাচ্ছে। মুখোমুখি বসে জীবনের নিবিড় রহস্যময়তা টের পাচ্ছে। টের পেতে পেতে বিশাল সমুদ্রের মাঝে দুই নরনারী উপগত হচ্ছে। সে যত ভাবছিল, তত মনে হচ্ছিল, এমন পোড় খাওয়া মানুষের মনে এতবড় বিভ্রমের সৃষ্টি হয় কি করে! কিংবা এও কি এক কুহক, কখনও কুহক সৃষ্টি হয়ে যায় মগজে, পেরেক পুঁতে দেয় কেউ আর দেখতে পায় আর্চির প্রেতাত্মার ছলনার তিনি শিকার। কিছুতেই মেলাতে পারে না সমুদ্রের বাবুটির সঙ্গে এই রাজবাড়ির বাবুর।

সে নিথর হয়ে যাচ্ছে ভাবতে ভাবতে।

তারপর মনে হল, সোনাবাবু সত্যি গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছেন। সত্যি এতদিন তাঁর মধ্যে যে নরকযন্ত্রণা ছিল তার থেকে যেন তিনি মুক্তি পেয়েছেন।

.

কিছু মটরশুটি সিদ্ধ খাচ্ছে। মুখোমুখি বসে জীবনের নিবিড় রহস্যময়তা টের পাচ্ছে। টের পেতে পেতে বিশাল সমুদ্রের মাঝে দুই নরনারী উপগত হচ্ছে। সে যত ভাবছিল, তত মনে হচ্ছিল, এমন পোড় খাওয়া মানুষের মনে এতবড় বিভ্রমের সৃষ্টি হয় কি করে! কিংবা এও কি এক কুহক, কখনও কুহক সৃষ্টি হয়ে যায় মগজে, পেরেক পুঁতে দেয় কেউ আর দেখতে পায় আর্চির প্রেতাত্মার ছলনার তিনি শিকার। কিছুতেই মেলাতে পারে না সমুদ্রের বাবুটির সঙ্গে এই রাজবাড়ির বাবুর।

সে নিথর হয়ে যাচ্ছে ভাবতে ভাবতে।

তারপর মনে হল, সোনাবাবু সত্যি গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছেন। সত্যি এতদিন তাঁর মধ্যে যে নরকযন্ত্রণা ছিল তার থেকে যেন তিনি মুক্তি পেয়েছেন।

ঘুমের মধ্যেই অতীশ আশ্চর্য এক স্বপ্নে ডুবে গেল—সেই হাইতিতি, সেই ম্যান্ডেলা আকাশের নীচ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। স্বপ্নের ভিতর কতকাল আগেকার কত কথা, কত ঘটনা যেন ভেসে আসছে। মাথায় পালক ম্যান্ডেলার। সে তার নিখোঁজ বাবাকে খুঁজতে বের হয়েছে। কবেকার সব কথা

তারা দু’জনই এখন একটা জলার ধারে বসে আছে। জলার ধারে ঝোপ জঙ্গলে আশ্চর্য সব ধেড়ে ইঁদুর ঘোরাফেরা করছে। ইঁদুরগুলোও উড়তে পারে। লোমওয়ালা ব্যাঙগুলো জল থেকে থপ থপ করে পাড়ে উঠে আসছে। তারপর রোদ পোহাতে থাকল। পালকের টুপি পরে বের হলেই কত সব মজার জীবজন্তু দেখতে পায় ম্যান্ডেলা।

লোমওয়ালা ব্যাঙের গল্প বললেই মা তেড়ে আসবে, আবার আজগুবি কথা শুরু করলি! তোর দেখছি দিন দিন মাথাটা পাখির বাসা হয়ে যাচ্ছে!

মাকেও দোষ দেওয়া যায় না। এমনিতেই তার প্রতিবেশীরা ম্যান্ডেলাকে ভুতুড়ে মেয়ে বলে ভাবে। তাঁরা বিশ্বাসই করে না যাদুকরের দেওয়া পালকের টুপি পরলে বাতাসে ভেসে যাওয়া যায়—যাদুকর বসন্তনিবাস তাকে পালকের টুপি আর হাইতিতিকে যে রুপোর ঘণ্টা দিয়ে গেছে।

নিখোঁজ বাবাকে খুঁজতে গেলে সবারই যে চাই পালকের টুপি, রুপোর ঘণ্টা। বাবা সেই কবে সাদা জাহাজের নাবিক হয়ে যে সফরে গেল আর ফিরে এল না। কেউ বলে জাহাজডুবি, কেউ বলে ঝড়ে পড়ে জাহাজ রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে, আবার কেউ তো আরও বাজে কথা বলে, জলে ডুবে গেলে আর ফেরা যায় না।

ম্যান্ডেলা তখন তো আরও ছোট—কেন যে মনে হত, বাবা তার কোনও দ্বীপে আটকা পড়েছে। কাঠের ভেলা বানাচ্ছে। কাঠের ভেলায় করে ঠিক একদিন ফিরে আসবে।

নিখোঁজ বাবার জন্য সব মেয়েরাই কান্নাকাটি করে—করে না এমন কে আছে! সে তাই কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিল বুঝি, মনেও নেই সব। যাদুকর বসন্তনিবাস তাঁকে পালকের টুপি দিয়ে বলেছিল, যেখানে খুশি ঘুরে আসতে পারে সে।

হাইতিতির কী হবে! হাইতিতি যে একটা ক্যাঙারুর ছোট্ট বাচ্চা।

হ্যাঁ তাইতো! এই নাও রুপোর ঘণ্টা।

মাও খুব চিন্তা করত, তুই কোথায় যাস, কোথায় থাকিস, লোকে কী সব অকথা কুকথা বলে, আমার চিন্তা হয়না! তবে আজকাল মাও মনে করে, সে একটা কিছু পেয়েছে। সে তার নিখোঁজ বাবাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। একবার বাড়ি থেকে দু-তিন দিন, একবার তো এক হপ্তা নিখোঁজ হয়েছিল—আগে মা কান্নাকাটি করত—এখন আর করে না। এখন ম্যান্ডেলা স্বাধীন। কারণ বেয়াড়া স্বভাবের ম্যান্ডেলার একটাই জবাব। হ্যাঁ গেছিলাম, বাবাকে খুঁজতে গেছিলাম। জানো মা, বাবা না থাকলে কেউ থাকে না। তুমি আমার জন্য চিন্তা করো না—হাইতিতি সঙ্গে থাকে, ভয়ের কী আছে বলো!

সত্যি তো—হাইতিতি থাকলে ম্যান্ডেলা একা, কখনও কেউ ভাবতে পারে না। ম্যান্ডেলার মা জানে, হাইতিতির সঙ্গে ম্যান্ডেলার খুব ভাব। সেই যেবারে গম বোঝাই করে জিলঙ থেকে ম্যান্ডেলার বাবা জাহাজ নিয়ে ফিরেছিলেন, তখনই তিনি ম্যান্ডেলার জন্য ক্যাঙ্গারুর একটা বাচ্চা নিয়ে এসেছিলেন। মেয়ের কত রকমের যে আবদার! বাবা তার জাহাজের কাপ্তান, জাহাজের সর্বময় কর্তা, মেয়ের এই সামান্য আবদার রক্ষা না করেও পারেননি। তিনি বাড়ি না থাকলে, মেয়েটা কান্নাকাটি করে—তা করতেই পারে, মা আর মেয়ে, আর ওয়াকা বলে একজন শহরের যে কোনও জায়গায় চলে যাওয়া যায়—তেমন একটা সুন্দর বাড়িকে ভুতুড়ে বাড়ি বললে কার না রাগ হয়।

কিন্তু লোকে যে বলে।

লোকেরও দোষ দেওয়া যায় না। এমন কি বুচার মামা পর্যন্ত বিকেলে বেড়াতে এসে খোঁজ করবেন—সকালের দিকে আকাশে সেই ঘণ্টা বাজছিল, তখনই তার সব রুগীরা—কারণ তিনি ডাক্তার মানুষ, তারা ঘরের বাইরে বের হয়ে আকাশে কী খুঁজছিল।

আর বলছিল, ঠিক ম্যান্ডেলার কাণ্ড।

বুচার রেগে যেতেন।

কী আবোল তাবোল বকছো?

আজও ওই দেখুন, দেখছেন না, অনেক উঁচুতে ভেসে চলে যাচ্ছে দেখছেন না, কাটা ঘুড়ির মতো লাট খেতে খেতে চলে যাচ্ছে, সেই ভুতুড়ে মেয়েটা না হয়ে যায় না। শুনতে পাচ্ছেন না, ঘণ্টাধ্বনি হচ্ছে।

একদিন কে যেন বলছিল। স্যার আপনি জানেন না, ওতো আপনার ভাগ্নি, ম্যান্ডেলা।

তখন আর মাথা ঠিক থাকে কী করে—

সোজা পাইনের জঙ্গলের ভিতর দিয়ে হাঁটা দেন—ভগ্নিপতি মরিস বাড়ি থাকেন না, জাহাজ নিয়ে বের হয়ে যান—দু’তিন মাস, আবার পাঁচ সাত মাসও লেগে যায়! তখন মেয়েটার মধ্যে যে শয়তানের পালক গজাবে না, কে বলতে পারে! এমন সুন্দর জলছবির মতো ফুটফুটে মেয়েটা যে বাপের জন্য ছটফট করতেই পারে—তারপরতো সেই জাহাজডুবি, ঝড়ে পড়ে জাহাজ ডুবিরও খবর আছে—কোম্পানি থেকে জানিয়েও দেওয়া হয়েছে, নাবিকদের কোনও খোঁজ নেই—ক’দিন বুচার বোনের বাড়িতেই তখন রাত কাটিয়েছেন—সেই ম্যান্ডেলা প্রকৃতই কোন আধিভৌতিক ঘটনার শিকার হবে বেশি কি!—বড় পাগল পাগল লাগে ভাবতে।

বাড়িতে ওঠার মুখে একটা সিলভার ওকের গাছ। ক্যাঙ্গারুর বাচ্চাটা নেই।

বুক ধক করে ওঠে।

ম্যান্ডেলা, ম্যান্ডেলা!

ম্যান্ডেলার মার গলা পাওয়া যায়—দাদা তুমি!

ম্যান্ডেলা কোথায়!

আছে কোথাও।

ডাক।

কিন্তু ম্যান্ডেলার মা তো জানে, শত ডাকাডাকি করেও খোঁজ পাওয়া যাবে না, ম্যান্ডেলা যে বাপের খোঁজে উড়ে গেছে—দাদাকে এমন ভুতুড়ে কথা কী করে যে বলে!

বুচার বলেছিলেন, কী হল, দাঁড়িয়ে থাকলে কেন? জবাব দিচ্ছ না কেন?

ম্যান্ডেলার মা সেদিন ভ্যাক করে কেঁদে ফেলেছিলেন।

আমি কিচ্ছু জানি না দাদা। সত্যি জানি না। তুমি বরং ম্যান্ডেলা ফিরে এলে জিজ্ঞেস করো। ও তো কেবল বলে যাদুকর বসন্তনিবাস। আর কিছু বলে না।

যাদুকর!

হ্যাঁ তাইতো।

পাজিটা শেষে একটা বদমাস লোকের পাল্লায় পড়ে গেল! টিনি, আমি তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি, কোনও ছেলে ধরার পাল্লায় না পড়ে যায়।

তখনই ওয়াকা ফিরছিল বাজার করে।

আরে বুচার মামা যে!

ওয়াকা, তুই তো বাড়িটায় থাকিস?

আজ্ঞে।

ম্যান্ডেলা কোথায় যায়, কোথায় লুকিয়ে থাকে জানিস?

হ্যাঁ তাইতো।

পাজিটা শেষে একটা বদমাস লোকের পাল্লায় পড়ে গেল! টিনি, আমি তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি, কোনও ছেলে ধরার পাল্লায় না পড়ে যায়।

তখনই ওয়াকা ফিরছিল বাজার করে।

আরে বুচার মামা যে!

ওয়াকা, তুই তো বাড়িটায় থাকিস?

আজ্ঞে।

ম্যান্ডেলা কোথায় যায়, কোথায় লুকিয়ে থাকে জানিস? ও কিছু না।

ম্যান্ডেলাকে ডাক! সে নাকি বাতাসে উড়ে যায়।

সত্যি! মাথা থেকে ঝুড়ি নামিয়ে বারান্দায় রেখে দিল ওয়াকা।—তুমি তাও জানো না। যাদুকর বসন্তনিবাস যে পালক দিয়ে গেছে। তোমার বয়স হয়েছে—তুমি ঠিক বুঝবে না।

এ যে পাগলের প্রলাপ!

ওয়াকা বলল, সেই লোকটা, মনে নেই জাহাজঘাটা থেকে সোজা তোমার চেম্বারে—লম্বা উঁচু- লোকটার বিশ্রী জাহাজী অসুখ, তুমি তাকে সারিয়ে তুললে! মনে নেই ছোটবাবু বলে একজন বাচ্চা নাবিক তাকে নিয়ে এসেছিল। ম্যান্ডেলাদির সঙ্গে তার খুব ভাব হয়ে গেল। মনে নেই, সেই জাহাজি লোকটা শহরে কালো জোবরা পরে ঘুরে বেড়াত—সেপটিপিনে আটকানো থাকত প্লাস্টিকের খেলনা—জাভাদ্বীপের উদবেড়াল, পকেটে থাকত একটা বিড়ালের বাচ্চা, ও যখন যাদু দেখাত, ওর কান ফর ফর করে নাচত, আর সঙ্গে সঙ্গে পকেটের বেড়ালের বাচ্চাটা লাফ দিয়ে মাটিতে পড়ার আগেই বাঘ হয়ে যেত—তাঁর সেই যাদুর খেলা বন্দরের মানুষজন সবাই দেখেছে। মনে নেই তোমার!

থাম। কথা শুরু করলে আর থামতে চায় না।

বুচারের সবই মনে পড়ছিল। কিন্তু ওয়াকা এত ফরফর করে যে তার কথা অনুসরণ করাই কঠিন।

থাম বললেই কি ওয়াকা থামে!

তোমার মনে নেই মামা, ছোটবাবু রাত বিরেতে খুঁজতে বের হত। পাতার বাঁশি বাজাতে বাজাতে বসন্ত নিবাস উড়ে যেত শহরে—কখনও পিকাকোরা পার্কের গভীর জঙ্গলে লুকিয়ে থাকত। আমি, ছোটবাবু, জ্যাক, ম্যান্ডেলা আরও সব বাচ্চারা তাকে খুঁজে বের করতাম, তাকে জাহাজে তুলে দিয়ে আসতাম, আচ্ছা তুমি বলো বুচার মামা, এত বড় যাদুকর সে, যে ইচ্ছে করলে বিড়ালের বাচ্চাকে ফুস মন্তরে বাঘ, বানিয়ে ফেলতে পারে, সে ম্যান্ডেলা দিদিকে একটা পালকের টপি দিতে পারে না! যত্তসব আজগুবি কথা। ছোটবাবু কখনই বলেনি লোকটা একজন যাদুকর। আসলে খারাপ অসুখটার জন্য তার মাথা ঠিক ছিল না। লোকটা পাগল হয়ে যাচ্ছিল।

ওয়াকা কেন মানবে!

মাথা খারাপ হলে এমন সুন্দর পাতার বাঁশি বাজাতে পারে কেউ? তুমিই বলো, মাথা খারাপ হলে, কেক চকলেট যখন যে যা চাইত, জেব্বার পকেট থেকে বের করে দিতে পারত! শহরের বাচ্চারা তার পাতার বাঁশির সুর শুনলে কেউ ঘরে থাকতে পারত না, মনে নেই আমাদের পাইন ফেস্টিভ্যালে, সে সবার আগে পাতার বাঁশি বাজিয়ে বাচ্চাদের নিয়ে চার্চের দিকে হেঁটে গেছিল- বুচার মামা, সব ভুলে গেলে তুমি! তাকে তুমি পাগল বলছ! সে তো কেবল বলত, আমি যাদুকর, বসন্তনিবাস, এই দ্যাখো লাঠি, ঠিক আছে, সবাই হাতে নিয়ে দ্যাখো—এটা লাঠি কিনা। আমরা দেখতাম। একটা বাঁকানো বেতের লাঠি, যাদুকর তারপর লাঠি হাতে নিয়ে কী যে ফুসমন্তর করল, ওটা একটা সাপ হয়ে গেল। আমাদের দ্বীপটায় কি সাপ আছে বলো! যে পকেটে লুকিয়ে সাপ নিয়ে ঘুরে বেড়াবে! যে এত পারে—আর ছোটবাবু তো বলত, সে ইন্ডিয়ান। যাদুকর বসন্তনিবাস ইন্ডিয়ান। অবশ্য ছোটবাবু কখনই তাকে যাদুকর বলে ডাকত না, মৈত্রদা বলে ডাকত।

বুচার তাঁর থুতনির দাড়ি চুলকে বলতেন, সবই না হয় ঠিক হল, কিন্তু ম্যান্ডেলা যায় কোথায়, থাকে কোথায়, খায় কী! এই যে বের হয়ে গেল, কী যে কেলেঙ্কারি হচ্ছে! এত বড় সমুদ্রে কোথায় জাহাজ ডুবি হয়েছে, সে তো কবেকার কথা, তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়!

দ্যাখো, ম্যান্ডেলা দিদি ঠিক খুঁজে পাবে।

.

ম্যান্ডেলা কখনও উড়ছিল, কখনও হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছিল—হাইতিতি হাওয়ায় ডিগবাজি খাচ্ছে। দূর থেকেই তারা দেখতে পাচ্ছে, একটা আজব জীব সমুদ্রে ভেসে যাচ্ছে। তারা দু’জনে খুশিমতো উড়তে পারে, হাওয়ায় ভেসে যেতে পারে বলেই আজ লরেঞ্জো, কাল কিলিমানজারু, পরশু এভিতায়—তবে তারা দু’জনেই সমুদ্রেই বেশি খুঁজে বেড়ায়, অথবা কোনও নদীর মোহনায় কিংবা বন্দরজেটিতে আবার দ্বীপটিপও তাদের কম ঘোরা হল না, কিন্তু ম্যান্ডেলা দেখতে পায় সবই ঠিকঠাক আছে, কেবল সে তার বাবার কোনও খোঁজ পায় না।

খোঁজ পেলেও দ্যাখে, লোকটি তার বাবা নয়—অন্য মানুষ, দাড়ি গজিয়ে গেছে, চুল বড় হয়ে গেছে, বড় বড় নোখ—কোনও দ্বীপে আটকা পড়ে গেছে। লোকটার আর বাড়ি ফেরা হয়নি। নানা কারণেই এমন সব ঘটনা ঘটে থাকে—সমুদ্রে জাহাজডুবি হয়, কেউ বাঁচে, কেউ বাঁচে না। লাইফ বোট নামিয়ে দেবার পর দেখা যায় সবার জায়গাও হয় না। তখন যে যার প্রাণ রক্ষার্থে সমুদ্রে ঝাঁপ দেয়। যদি সমুদ্রে জাহাজডুবি হয়, তবে ত্রাণের জন্য যে সব জাহাজ পাশাপাশি ভেসে আসতে শুরু করে—ত্রাণ কার্যও শুরু করে দেয়, হলে হবে কী, সমুদ্রের চোরা স্রোতে কে কোথায় যে তলিয়ে যায়, আবার কাঠ অথবা লাইফ বেল্টের দৌলতে একসময় তারা কিনারাও দেখতে পায়।

কিন্তু মুশকিল কিনারা ভেবে উঠে যায় ঠিক, বনজঙ্গলও পেয়ে যায়, এমন কি টিলাও থাকে, মিষ্টি জলের হ্রদও থাকে, তবে মানুষের কোনও বসতি খুঁজে পাওয়া যায় না। সারাদিন শুধু বড় বড় সমুদ্রপাখির ওড়াউড়ি—তারা হয়তো পাহাড়ের খাঁজে ডিম পাড়ে, ডিমে তা দেয়—সবই আছে, কেবল মানুষের কোনও বসতির খোঁজ নেই। প্রাণ রক্ষা পেল ঠিক, তবে অচেনা দ্বীপে, বেঁচে থাকাই কঠিন। অবশ্য মানুষ পারে না, হেন কাজ নেই।

এক সময় নির্জন দ্বীপে সে নিজের মতো আস্তানা গড়ে নেয়।

গাছের ডালে পাতার ঝোপে সে তার ঘরবাড়ি বানিয়ে থাকে। আর সারাদিন দ্বীপের কোথায় কী আছে খুঁজে বেড়ায়। কচ্ছপের ডিম পুড়িয়ে খায়, পাখির ডিম পুড়িয়ে খায়, কোনও ঝর্ণার জলে স্নান করে, একেবারে স্বাধীন, এবং দিন যায়, তার জামাকাপড় নোনা জলের হাওয়ায় পচে যায়, তখন সে পাতার পোশাক বানিয়ে পরে। মানুষ তো, উলঙ্গ হয়ে ঘুরে বেড়ালে তার লজ্জা তো হবেই।

অবশ্য যদি মানুষটার আর দেশে ফেরার কোন ব্যবস্থা না হয়, এই যেমন রুমাল উড়িয়ে কিংবা তার গায়ের জামা উড়িয়ে কোনও জাহাজের কিংবা জেলে ডিঙ্গির যদি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে না পারে, অগত্যা তাকে থেকে যেতেই হয়। মানুষের কাছে সংকেত পাঠাবার আর কোনও যে উপায় নেই তার।

ম্যান্ডেলা ভাবে তার বাবাও যদি সমুদ্রের ফাঁদে পড়ে গিয়ে কোনও দ্বীপে আটকা পড়ে যায়—

যদি দ্বীপে থাকতে থাকতে কোনও বন্য মানুষের মতো বাঁচে। যদি দ্বীপের ঘোরে পড়ে, তার বাবা, মেয়ে ম্যান্ডেলার কথাই ভুলে যায়, এমন নির্জন দ্বীপে, হাজার হাজার মাইল ব্যাপ্ত সমুদ্রের মাঝে কত অসংখ্য দ্বীপ—যদি বাবা সেই সব দ্বীপের কোনও একটায় বেঁচে থাকে, ভাগ্যিস যাদুকর বসন্তনিবাস তাকে পালকের টুপি আর হাইতিতিকে রুপোর ঘণ্টা দিয়ে গেছে, আর যাদুকর তো শত হলেও মানুষ—একটা বাচ্চা মেয়ে সমুদ্রের পারে, কিংবা পাহাড়ের টিলায় মায়ের হাত ধরে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর বাবার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকলে তখন তো যাদুকরের মায়া হবেই।

একবার তো সে একটা দ্বীপে তেমন একজন মানুষকে খুঁজেও পেয়েছিল। লোকটা তার নাম বলেনি, কোথায় কোন দেশে বাড়ি তাও বলেনি—কিংবা বলতেও পারে, তার ঠিক খেয়াল নেই, কতদিনকার কথা, সব কি কারও ঠিকঠাক মনে থাকে। নাম বললেও তার মনে হয়েছে আসলে লোকটা ম্যান্ডেলাকে নিজের পরিচয় দিতে কুণ্ঠা বোধ করছে। তার লম্বা দাড়ি। পাতার পোশাক পরে থাকত, পায়ের নোখ, হাতের নোখ লম্বা হয়ে গেলে, তার সাহেবসুবো বাবাকে সনাক্ত করাও

হাওয়ায় ভেসে যেতে যেতে ম্যান্ডেলার কত কথা মনে হয়—কত দিন পর হানস ওটোর কথা মনে পড়ে গেল তার। তারপর দূরে ভাসমান একটি অদ্ভুত জীব দেখে উড়ে যেতে যেতে ম্যান্ডেলা বুঝতে পারল, ওটা একটা ভাসমান জাহাজ। যত কাছে যেতে থাকল—তত স্পষ্ট হয়ে উঠছে সব কিছু।

আরে জাহাজটার সামনের মাস্তুল ভাঙা।

জাহাজের চার্টরুম যেন উড়ে গেছে। জাহাজের ব্রিজ দুমড়ে মুচড়ে গেছে। কোনও ঝড় বিক্ষুব্ধ সমুদ্রের কাজ।

হাইতিতি কিচ কিচ করছে। জাহাজটার কাছে যাওয়া ঠিক হবে না, হাইতিতি আভাসে ইঙ্গিতে যে তাই বোঝাতে চায়।

কিন্তু ম্যান্ডেলা তো জানে তার বাবার জাহাজটাও কোথাও ঝড়ে পড়ে গেছিল। যদি তার বাবার সেই জাহাজটা হয়!

হতেই পারে।

ম্যান্ডেলার বুক ধুকধুক করছে। সত্যি বুঝি এবার সে তার বাবাকে খুঁজে পাবে। নীচে নেমে গেলে আরও স্পষ্ট হবে সব কিছু।

ওমা, একি, এ যে একটা পরিত্যক্ত জাহাজ। জাহাজিদের কোনও সাড়া নেই।

তখন আকাশ নীল। অসীম অনন্ত সমুদ্রে কিংবা বলা যায় হাজার হাজার মাইল ব্যাপ্ত সমুদ্রে সূর্য মাথার ওপর ম্যান্ডেলার সঙ্গে ভেসে যাচ্ছে।

সে চিৎকার করে বলল, কে আছেন জাহাজে? কেউ কি আছেন। থাকলে সাড়া দিন।

সে আপার ডেকে দাঁড়িয়ে হাঁকছে—কেউ কি আছেন!

এমন কিম্ভুতকিমাকার জাহাজের পাল্লায় সে জীবনেও পড়েনি। সিঁড়ি ধরে ইঞ্জিনরুমে নামতে গিয়ে বাধা পেল। ইঞ্জিনের স্টিমপাইপ উড়ে গেছে। বয়লার বসে গেছে। অন্ধকার ইঞ্জিনরুমে যেন ভূতের বাসা। জাহাজটা হাওয়ায় অথবা সমুদ্র স্রোতে ভেসে যাচ্ছে। ইঞ্জিনের এত বড় যন্ত্রদাবনটা একেবারে কাবু। অন্ধকারে নীচে নামা ঠিক হবে না ভেবেই সে ফের ডেকে উঠে এল। হাইতিতি লাফিয়ে লাফিয়ে ম্যান্ডেলাদিদিকে অনুসরণ করছে।

আফট-পিকে এসে দেখল ভাণ্ডারির গ্যালিতেও কেউ নেই। সিঁড়ি ধরে কিছুটা নামলে স্টিয়ারিং ইঞ্জিনেরও শব্দ পেল না। জাহাজটা যে মরা বুঝতে কষ্ট হল না। ডেকে পোড়া কয়লা, পোড়া কাঠে ভর্তি—একটা ডেরিক ঝুলে আছে, যে কোনও সময় মাথায় যেন ভেঙে পড়তে পারে। ফল্কায় কোনও মালপত্র নেই। হ্যাচগুলি সব ফাঁকা। এতক্ষণে বুঝতে পারল, জাহাজটি পরিত্যক্ত। কোনও কারণে জাহাজিরা বোট নিয়ে ভেসে গেছে। কারণ একটাও লাইফবোট নেই জাহাজে। একটাও লাইফ-জ্যাকেট নেই—গেল কোথায় সব!

সে তো তার বাবার জাহাজ দেখেছে। পাঁচ সাত মাস কি বছর পার করে বাবা তার জাহাজ নিয়ে জাহাজঘাটায় ফিরে এলেই লাফিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যেত। এবং বোটডেকে উঠে বাবাকে জাপটে ধরত। তারপর যতক্ষণ না জাহাজের বাধা ছাদার কাজ শেষ হত, এজেন্ট অফিস থেকে লোক উঠে না আসত, সে সারা জাহাজে দাপিয়ে বেড়াত। জাহাজের খালাসি থেকে চিফ কুক, এমন কি রেডিও অফিসার তাঁকে দেখলে ছুটে আসত। সবাই তাকে আদর করত। তার নীল রঙের চুল বাতাসে উড়ত। কেবিনে কেবিনে ঢুকে সবার সঙ্গে আড্ডা দিতেও কম ওস্তাদ ছিল না। জাহাজ ঘাটে ফিরলেও বাবার যে মেলা কাজ বাকি থাকে—বাবা যে তখন খুবই ব্যস্ত থাকে, সে বোঝে বাবার কাছে থাকলেই, বাবার জাহাজ থেকে নামতে দেরি হয়ে যাবে।

আর সে তো এমনিতেই দুরন্ত বালিকা, সে তো একদণ্ড চুপ করে বসে থাকতে পারে না। বাবা তার সেকেন্ড অফিসারকে ডেকে বলতেন, ওকে নিয়ে যাও। জাহাজটা ঘুরিয়ে দেখাও।

জাহাজে কি থাকে, কি থাকে না সে সবই জানে। লাইফবোট থাকে, ঘরে ঘরে সব জাহাজিদের একটা করে লাইফজ্যাকেট থাকে—– পোর্ট হোল দিয়ে কেবিনের ভিতর আলো ঢোকে, সে তো একবার ছোটবাবুর জাহাজেও উঠে গিয়েছিল। ছোটবাবু, মৈত্রদা, ওই যে লোকটা যার দুরারোগ্য ব্যাধি, ছোটবাবুই তাকে নিয়ে তার ডাক্তার মামা বুচারের কাছে গিয়েছিল—

জাহাজটায় উঠে আজ ছোটবাবুর কথা খুব মনে পড়ছে। ওয়াকার সঙ্গে জাহাজঘাটায় ছোটবাবুর ভারি বন্ধুত্ব হয়ে গেছিল, আর সেই যে মৈত্রদা, যার দুরারোগ্য ব্যাধি, এবং যে পরে আরোগ্যলাভ করতেই, যাদুকর বসন্তনিবাস হয়ে গেছিল। যতদিন জাহাজ বন্দরে ছিল, রোজ সে বের হয়ে যেত একটা কালো জোব্বা গায়ে দিয়ে—ম্যান্ডেলাকে দেখে সে কি খুশি, সে তো তখন বুঝতে পারেনি, আসলে মানুষটি আরোগ্যলাভ করেনি, মানুষটা দুরারোগ্য ব্যাধির হেতুতে উন্মাদ হয়ে যাচ্ছে। ছোটবাবু তাকে বার বার বুঝিয়েছে, সে কিছুতেই বিশ্বাস করেনি।

হয়, কখনও হয়, মানুষটা এত ভাল, এমন সুন্দর কথা বলে, সারাদিন ঘুরে বেড়ায়, বাচ্চারা দেখলেই তাকে ঘিরে ধরে—পকেট থেকে সে লজেন্স বের করে সবার হাতে হাতে দেয়, আর বলে, মি মেজিশিয়ান। ইন্ডিয়ান ম্যাজিশিয়ান। ভারতীয় না হলে এত বড় যাদুকর আর কোথায় পাওয়া যাবে। জোব্বার সেফটিপিনে সে হরেকরকমের প্লাস্টিকের পুতুল, জাভা দ্বীপের কাঠের হাতি এবং একটা আস্ত মেনি বিড়ালের বাচ্চা লুকিয়ে রাখত। বাচ্চারা বেশি উৎপাত শুরু করলেই পকেট থেকে মেনি বিড়ালের বাচ্চাটা লাফিয়ে পড়ত—

তারপর সুন্দরবনের বাঘ হয়ে যেত। তার সব মনে পড়ছে।

সবাই ভয়ে পালাতো, শুধু সে পালাতো না। তার বাবাও জাহাজি, তার বাবা জাহাজডুবিতে নিখোঁজ, নিখোঁজ জাহাজির মেয়ে, বসন্তনিবাস তার দিকে কেমন করুণ চোখে তাকাতো। তারপর যাদুকর বসন্তনিবাস তাকে আর সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার নিয়ে পাহাড়ের আড়ালে বালিয়াড়িতে চুপচাপ বসে থাকত। কোনও কথা বলত না, যত কথা তার—তার বাবা, মা হাইতিতি আর ওয়াকা। বাবা না ফেরায় মা দিন দিন আরও রোগা হয়ে যাচ্ছিল—তারপর তো সে জোরজার করে বাড়িতেও মাঝে মাঝে ধরে নিয়ে যেত, মাঝে মাঝে ওয়াকার সঙ্গেও যেত, সে বলত জানো বসন্তনিবাস, মা আমার কেমন হয়ে গেছে। কথা বলে না, খেতে চায় না—তুমি পার না মাকে দেখাতে তোমার যাদু—বাঘ যদি বিড়াল হয়ে যায়। আবার বিড়াল যদি বাঘ হয়ে যায়, তুমি পার না মাকে স্বাভাবিক করে তুলতে। তখনই তার মনে হল ছোটবাবুকে ওয়াকা ধরে এনেছিল। তাদের বাড়িতে উঠতে গেলে পাহাড়ের সিঁড়ি ভাঙতে হয়, ওয়াকা ছোটবাবুকে টানতে টানতে নিয়ে আসছে। ছোটবাবু ডাকছিল, মৈত্রদা তুমি এখানে, সেই সকাল থেকে খুঁজছি। আর তাকে দেখেও চিনে ফেলল। আরে একে তো ডাঃ বুচারের বাড়িতে সে দেখেছে। সিলভার ওকের নিচে একটা ক্যাঙ্গারুর বাচ্চা বাঁধা। সামনে লন, তারপর গোলাপের বাগিচা—তার বাবা পৃথিবীর সব দুর্লভ গোলাপ এই বাগানে এনে হাজির করেছিল। তার তো তখন একটাই কাজ, বাবার প্রিয় গোলাপের বাগান যাতে নষ্ট না হয়ে যায়—–সে আর ওয়াকা সারা বিকেল, গাছে জল দেয়—পাতায় পোকা হলে বেছে দেয়। ছোটবাবু শেষের দিকে রোজ বিকেলে চলে আসত, যাদুকর বসন্তনিবাসও আসত—এবং এভাবে এক সকালে মা তার ভালও হয়ে গেল।

এই ছোটবাবু আর একটু পরিজ নাও।

ওই ওয়াকা, দেখিস তো বাজারে ভাল সারডিন মাছ যদি পাওয়া যায়। ভাল কমলালেবু আপেল আঙুর নিয়ে আসতে বলত ওয়াকাকে। ডিনার টেবিলে মা যেন আগেকার মা। চিনামাটির প্লেটে সব সাজিয়ে দিত।

ডিনার টেবিলেই একদিন কেন যে মা বলল, মিঃ মৈত্র, মেয়েটার জন্য আপনার কষ্ট হয় না!

মৈত্র বলল, হয়

বাবার জন্য রাত হলেই ফুঁপিয়ে কাঁদে।

কী যে করি। আপনি তো ইন্ডিয়া থেকে এসেছেন। একটা বইয়ে আপনাদের মন্ত্রশক্তি আমাকে বড়ই বিহ্বল করেছিল। পারেন না কিছু একটা করতে। মেয়েটা একদণ্ড বাড়ি থাকে না। সারাদিন পাইনের জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায় হাইতিতিকে নিয়ে। তার বিশ্বাস বাবা তার ঠিক ফিরে এসেছে, জঙ্গলে লুকিয়ে আছে।

সেই কালো জোব্বা গায়ে এবং সেপটিপিন ঝোলানো সব প্লাস্টিকের পুতুল—মুখে দাড়ি, কেমন সম্ভ মানুষের মতো দেখতে কিছুটা—

মেয়েটা বড় একরোখা হয়ে যাচ্ছে।

ম্যান্ডেলার যে তখন কি রাগ। মা যাদুকর বসন্তনিবাসকে মিঃ মৈত্র বলে সম্বোধন করছে। রাগ তো তার হবেই।

সম্ভ মানুষটি কিছুক্ষণ মাথা নীচু করে রেখেছিল। তারপর ম্যান্ডেলার মার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, হবে।

কী হবে!

হবে তো বললাম। আপনি ম্যান্ডেলার জন্য চিন্তা করবেন না। ঠিক সে একদিন তার বাবাকে খুঁজে পাবে।

তারপর কী হয়েছিল তার এখন ঠিকঠাক মনে পড়ে না।

যেমন মনে হয়, বসন্তনিবাস একদিন তাকে যেন একলা পেয়ে বলল, তুমি জঙ্গলে ঘুরবে না। তোমাকে একটা পালকের টুপি দিয়ে যাচ্ছি। মাঝে মাঝে আমি ওটা নিজেও মাথায় দিই। সহজেই উড়ে যেতে পারি। সে তার থলে থেকে পালকের টুপি বের করে যেন দেখিয়েছিল—

তারপর কিছু মনে পড়ছে না।

টুপিটা সে চুরি করেছিল, না, কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়লে মনে হয়েছিল, পালকের টুপিটা বালিশের পাশে যাদুকর বসন্তনিবাস রেখে গেছে।

সবই আজব কাণ্ড। অথচ তার মনে আছে সে বলেছিল, হাইতিতির কি হবে।

ওকে একটা রুপোর ঘণ্টা দিলেই হবে। তবে এ-সব কথা দু-কান যেন না হয়।

না না। আমাকে কি তুমি খুব বোকা মেয়ে ভাবছ। আমি তো জানি, দু-কান হলে মন্ত্রশক্তি নষ্ট হয়ে যায়।

তা হলে এই কথাই থাকল। যখনই মন খারাপ করবে, পালকের টুপিটা পরে উড়ে যাবে। যতদূর ইচ্ছা। একটা পালকের টুপি থাকলে বাবাকে খোঁজার আর কোনও অসুবিধা থাকবে না।

সঙ্গে হাইতিতি, তাই না, তাকে তো তুমি রুপোর ঘণ্টা দিয়েছ, তাই না? ম্যান্ডেলা না বলে থাকতে পারেনি।

সেই ম্যান্ডেলা এখন ভাঙা পরিত্যক্ত জাহাজে খুঁজে বেড়াচ্ছে—কেউ যদি থেকে যায়।

সে সিঁড়ি ধরে উপরে উঠে গেল। আফট-পিকে উঠেই দেখল মেসরুমের দরজা খোলা। খাবার টেবিলে সব বাসনপত্র পড়ে আছে। গ্যালিতে উঁকি দিয়ে দেখল, তামার ডেকচি, কড়াই, ফ্রাই প্যান, কয়লা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বাথরুমের দরজা খুলে দেখল। না কেউ নেই। তারপর সে কি ভেবে সিঁড়ি ধরে নীচে নামতে থাকল।

দু-পাশের ফোকসালের সব দরজাই বাইরে থেকে বন্ধ। ডেক বোসান, ইনজিন সারেঙের পেতলের নেমপ্লেট মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।

গেল কোথায় সব!

তা ঝড়ে জাহাজের মাথা উপড়ে নিলে কি আর থাকে! অচল জাহাজে থাকবেই বা কেন জাহাজিরা। কাপ্তান জাহাজ এবেনডান করে সব ক্রু আর অফিসারদের নিয়ে ঠিক নেমে গেছেন। তবু তার মনে হয় কেউ যদি থেকে যায়—সবার জন্য লাইফবোটে জায়গা নাও হতে পারে। কাপ্তান নিজেও থেকে যেতে পারেন। তিনি তো কাউকে ফেলে জাহাজ ছেড়ে যেতে পারেন না। সঙ্গে দুই সারেঙ যদি থেকে যায়। এই সংশয় থেকেই পর পর সব কেবিনে দরজা খুলে দেখা। সব ফোকসালের দরজা খুলে দেখছে। আরে এই তো, হ্যাঁ ঠিক, সে দেখছে, একটা ছবি—এই ছবিটা তো ছোটবাবু তার শিয়রে সব সময় ঝুলিয়ে রাখত। বাচ্চা নাবিকের যা হয়। জাহাজে উঠে তার বোধহয় মনে হয়েছিল, মায়ের ছবিটা শিয়রে ঝুলিয়ে রাখলে আপদ বিপদের সম্ভাবনা কম

এবং সে কতবার যে যাদুকর বসন্তনিবাসের সঙ্গে এই জাহাজটায় সিঁড়ি ধরে লাফিয়ে উঠে এসেছে—ছোটবাবু থাকত উপরের বাংকে, আর যাদুকর থাকত নিচের বাংকে। পাশের বাংক দুটোয় আরও দু’জন থাকত। সে পড়িমরি করে লকার টেনে খুলে ফেলল। সেখানে কিছু জামাকাপড়, এবং সে ঠিক চিনতে পারল নীল জামা আর নীল প্যান্ট—এটা যে ছোটবাবুর লকার তাও চিনে ফেলল। বিছানাপত্র সব পড়ে আছে—সব এলোমেলো এবং লন্ডভন্ড অবস্থা। যাদুকর এভাবে খেপে গিয়ে কি জাহাজটা অচল করে দিয়ে উধাও। তারপরই সে ভাবল, জাহাজটায় কি কেউ নেই, একজনও দরজা খুলে দেখছে। আরে এই তো, হ্যাঁ ঠিক, সে দেখছে, একটা ছবি—এই ছবিটা তো ছোটবাবু তার শিয়রে সব সময় ঝুলিয়ে রাখত। বাচ্চা নাবিকের যা হয়। জাহাজে উঠে তার বোধহয় মনে হয়েছিল, মায়ের ছবিটা শিয়রে ঝুলিয়ে রাখলে আপদ বিপদের সম্ভাবনা কম

এবং সে কতবার যে যাদুকর বসন্তনিবাসের সঙ্গে এই জাহাজটায় সিঁড়ি ধরে লাফিয়ে উঠে এসেছে—ছোটবাবু থাকত উপরের বাংকে, আর যাদুকর থাকত নিচের বাংকে। পাশের বাংক দুটোয় আরও দু’জন থাকত। সে পড়িমরি করে লকার টেনে খুলে ফেলল। সেখানে কিছু জামাকাপড়, এবং সে ঠিক চিনতে পারল নীল জামা আর নীল প্যান্ট—এটা যে ছোটবাবুর লকার তাও চিনে ফেলল। বিছানাপত্র সব পড়ে আছে—সব এলোমেলো এবং লন্ডভন্ড অবস্থা। যাদুকর এভাবে খেপে গিয়ে কি জাহাজটা অচল করে দিয়ে উধাও। তারপরই সে ভাবল, জাহাজটায় কি কেউ নেই, একজনও কি বেঁচে নেই—একজনও বেঁচে থাকলে সে তাকে উদ্ধার করতে পারে। হানস ওটোর মতো সে একটা আস্ত জাহাজ পরিত্যক্ত জাহাজটার পাশে ইচ্ছে করলে ভিড়িয়ে দিতে পারে। এই আছে, এই নেই, তা ছাড়া এমন একজন সুন্দর ছোট্ট মেয়েকে কোনও কাপ্তান গভীর সমুদ্রে দেখতে পেলে আতঙ্কে ভিরমি তো খাবেই।

জাহাজে নানা কারণেই সমুদ্রের অপদেবতাদের ভয় থাকে –সে যে ম্যান্ডেলা, তার বাবা কাপ্তান মরিস, নিউপ্লিমাউথের ছোট জাহাজঘাটা পার হলেই, জেটির শেষদিকটায় সিম্যান মিশান, শহরের ট্রামলাইন মিশান চত্বরে ঘুরে আবার শহরে ঢুকে গেছে—ধাপে ধাপে পাহাড়, জঙ্গল, কোরিপাইনের বনভূমি, আর সুন্দর সুন্দর সব উপত্যকা, কাঠের লাল নীল রঙের ঘরবাড়ি, ঠিক সমুদ্রের দিকে মুখ করে শহরটা দাঁড়িয়ে আছে, তারই একটা টিলায় তার মা থাকে, ওয়াকা থাকে—সে ভূত নয়, ভূতের কি ঘরবাড়ি থাকে! ভূতের কি মা বাবা থাকে! আসলে পালকের গুণে সে পলকে দেশ থেকে দেশান্তরে চলে যেতে পারে—পলকে হাজার হাজার মাইল ব্যাপ্ত সমুদ্র পার হয়ে যেতে পারে—কিন্তু সে তো বলতে পারে না, আমি ভূত নই, এই দেখো আমার পালকের টুপি, এই দেখো আমার পোষা জীব হাইতিতি হাইতিতিটা ভারি দুষ্টু। কিছুতে একদণ্ড স্থির হয়ে বসতে পারে না।

তা ঠিক।

কারণ হাইতিতির লম্ফঝম্ফ, সে যেখানে হাইতিতি সেখানে।

আর তখনই কেন যে মনে হল কিসের যেন কোথাও শব্দ হচ্ছে। সে তখন লোয়ার ডেকে কোথা থেকে এই শব্দ আসছে—একটা কাঠ দিয়ে কাঠে বাড়ি মারলে যেমন শব্দ হয়, ঠিক সেরকম শব্দ।

কোথায় কোথায়!

সে আপার-ডেক লোয়ার ডেক কোনও জায়গা বাদ দিচ্ছে না। কেউ আছে। ঠিক কেউ আছে। কোথাও আড়ালে বসে তাকে ভয় দেখাচ্ছে। সে তো ভয় পাবার পাত্রী নয়। আফ্রিকার জঙ্গলে সে ঘুরে বেড়িয়েছে। উপজাতিদের মধ্যে কতরকমের বিশ্বাস—যে সর্দার নির্বাচিত হবে, তাকে একটা সিংহ মেরে আনতে হবে, সর্দার হলে সে দেবতার নামে পাহাড়ের মাথায় আগুন জ্বালবে, আর সেই আগুনে উপজাতিদের মধ্যে সবচেয়ে তরুণ এবং সবল যুবককে পুড়িয়ে মারা হবে—তারপর তার মাংস প্রসাদ হিসাবে সবার হাতে দেবে। আসলে সেই তরুণ যুবককে খতম করার হেতু, সে আবার কোনও সিংহ মেরে এনে যদি বলে, আমিই সর্দার। এমন সব কত ফন্দি জালে সেও জড়িয়ে পড়েছিল, কেউ তার ক্ষতি করতে পারেনি, ওদের সর্দারদের তো ফণ বলা হয়। ফণদের ধূর্ততার শেষ থাকে না।

সে জানে চতুর লোকেরাই রাজা উজির হয়, মন্ত্রী হয় শোষণের নামে মানুষ ঠকিয়ে একদল ধূর্ত মানুষ আখের গুছিয়ে নেয়। কিন্তু এখন তো সে সব ভাবলে হবে না।

কোথা থেকে উঠছে শব্দটা!

সে লাফিয়ে পার হয়ে গেল আপার-ডেক। এলিওয়ে ধরে ঢুকে গেল। সব অফিসারদের কেবিন, কত কিসিমের সব জিনিসপত্র লণ্ডভণ্ড হয়ে পড়ে আছে—কেউ নেই কেবিনে—সে সিঁড়ি ধরে উপরে উঠে গেল।

.

চিতা ছুটে এলে তারা পালায়। দিনের পর দিন এই আহার পর্ব সে দেখেছে। শকুনরাও কাছে দূরে বসে থাকে এবং তারাও উড়ে এসে চিতার খাবারে ভাগ বসাবার চেষ্টা করে। এই সব দৃশ্য মানুষের জঙ্গলেও ঘটে থাকে – সে জানে। গরীব দেশগুলিতেই যেন বেশি।

ম্যান্ডেলার এই হয়েছে মুশকিল—তার মাথায় নানা প্রকারের দৃশ্য পোকার মতো গিজগিজ করে কী দরকার এখন এইসব দৃশ্য মনে করার। তবু কেন যে মনে পড়ে যায়। আসলে হাওয়ায় খোলা দরজাটা বাড়ি খাচ্ছে চৌকাঠের সঙ্গে। বোটডেকে উঠেই সে এটা টের পেল। ভুতুড়ে শব্দ যে নয় তাও সে বুঝে ফেলল।

আর দরজাটা বন্ধ করতে গিয়েই সে এবারে যথার্থই ভয় পেয়ে গেল। দরজা খোলা পেয়ে হাওয়ায় উড়ে এল একটা চাদর—আর দেখল চাদরের নীচে একটা মরা মানুষ পড়ে আছে।

মরা মানুষকে সে ভয় পায় না। ওয়াকার বাবা যেভাবে মারা গেল—ওয়াকারের সঙ্গে সেও হাসপাতালে গিয়েছিল। সব মানুষই একদিন মরে যায়। তার দাদু, ঠাকুমার সে কত আদরের ধন ছিল—তারাও তার চোখের সামনে মরে গেছে। বাবা তখন জাহাজে, বাবা ফিরে না এলে সমাধিস্থ করা যাবে না।

প্রেস ব্যাটেরিয়ান চার্চের লাগোয়া বরফঘরে কারুকার্যময় এক সুন্দর কফিনে দাদুকে রাখার সময় সে স্থির থাকতে পারেনি। কিছুতেই ঢাকনা লাগাতে দেবে না। ঢাকনার পেরেক পুঁততে দেবে না। চার্চের ফাদার বাইবেল থেকে কী সব পড়ে যাচ্ছিলেন। মানুষ যে মৃত্যুর পর এক স্বর্গীয় সুষমায় আবৃত হয়, এমন সব কথা শুনে দাদুর জন্য তার আর শোক থাকল না।

কাজেই এই মানুষটা কে?

এই কৌতূহল থেকে চাদর তুলে নিলে দেখল, লম্বা সাদা দাড়ি, সোনালি চুল, কেমন হাত পা শরীর শুকিয়ে গেছে মৃতের। পাশের টেবিলে কাচের গ্লাসে জল, মিনা করা পেতলের ঢাকনা ওপরে পাশেই চিনে মাটির প্লেটে এক টুকরো রুটি।

পলকে তার চোখে সবই দৃশ্যমান হল।

দেয়ালে একটা ছবি।

ওই তো ছোটবাবু। তার পাশে সুন্দর মতো পুরুষের পোশাকে এক বালিকা। পাশে সেই বুড়ো কাপ্তান। তা হলে কি শেষে বুড়ো কাপ্তানের এই পরিণাম!

আরে সে তো তাকে চেনে।

পাইন ফেস্টিভ্যালের দিন, ওই যে যাদুকর বসন্তনিবাসকে নিয়ে তারা, তারা মানে শহরের সব কচি কাচারা একটা মিছিল বের করেছিল, সবার মাথাতেই লম্বা পাইনপাতার টুপি, সবারই মুখে বিচিত্র রঙ, শত হলেও ফেস্টিভ্যাল, বুড়োরা একভাবে মজা করছে, মাঝারি বয়েসীরা একভাবে, বাড়ি বাড়ি সব সুগন্ধ খাবার তৈরি হচ্ছে, তখন তারা বের হয়ে পড়েছিল পাইনপাতার মিছিলে। ওয়াকারেরই কাজ। সবাইকে ডেকে নিয়ে এসেছিল। কেউ ড্রাম বাজাচ্ছে, কেউ ব্যাগপাইপ—সবার আগে যাদুকর বসন্তনিবাস। সেও পরেছে জোকারের মতো লম্বা পাইন পাতার টুপি, পাইন পাতার একটি লম্বা পোশাক ওয়াকাই পরিয়ে দিয়েছিল বসন্তনিবাসকে —সবার আগে বসন্তনিবাস, সেই পরিচালনা করেছিল মিছিল। পাতার বাঁশি, খুব লম্বা বাঁশি, প্রায় ফুটের মতো মনে হচ্ছিল, কখনও উত্তেজনায় নুয়ে, কখনও দাঁড়িয়ে ব্যাণ্ডপার্টিটাকে পরিচালনা করেছিল—একেবারে আত্মহারা, সে ভুলেই গিয়েছিল ছোটবাবু আর জ্যাক তাকে খুঁজতে বের হবে।

ছোটবাবুরও দোষ দেওয়া যায় না। ছোটবাবু তো জানে না লোকটা কত বড় যাদুকর! ছোটবাবুর এক কথা মৈত্রদা জাহাজি অসুখে ভুগছে। তোমরা ওর সঙ্গে বেশি মাখামাখি করবে না।

একই ফোকসালে থাকে, সে আর যাদুকর—ছোটবাবু তো তাকে কতবার সতর্ক করে দিয়েছে, ম্যান্ডেলা ওকে নিয়ে তোমরা বেশিদূর যাবে না। মাথার গোলমাল আছে—দূরে নিয়ে গেলে জাহাজঘাটায় সে একা ফিরে আসতে পারবে না। জানোই তো তোমার ডাক্তার মামা তাকে খুব সাবধানে রাখতে বলেছেন।

কিন্তু শহরের কচিকাচারা কেন শুনবে। এমন মজার মানুষ, গায়ে জোব্বা, যার যা চাই, পকেট থেকে বের করে দিচ্ছে।

তোমার কি চাই খুকি?

আমার চাই ঝুমঝুমি।

তোমার কি চাই?

আমার চাই একটা মোয়া।

তোমার?

আমার! আমার!

থতমত খেয়ে গেলে যাদুকরই মনে করিয়ে দিত। তোমার চাই ময়ূরের পালক।

হ্যাঁ হ্যাঁ। ভুলেই গেছিলাম

যে যা চাইত পকেট থেকে নিমেষে বের করে দিত যাদুকর।

সেই যাদুকর আশ্চর্য এক সুরে এবং সহসা মনে হয় আর্তনাদের মতো, আবার মনে হয় মনোরম মেলোডি—যখন জমে উঠেছে মহা মিছিল, রাত যে খুব একটা বেশি হয়েছিল তাও না, একেবারে ভূতের মতো হাজির ছোটবাবু। সঙ্গে সেই পুরুষের পোশাকে মেয়ের মতো দেখতে ছেলেটা।

আর তখন যে কী হত, এত বড় যাদুকর ভয়ে গুটিয়ে যেত।

ছোটবাবু ধমক দিত, তুমি এখানে! সারা শহর খুঁজে বেড়াচ্ছি, না বলে না কয়ে কখন জাহাজ থেকে নেমে এসেছ টেরই পাইনি।

এই ম্যান্ডেলা।

খুব রাশভারি গলা ছোটবাবুর।

তোমার কি আক্কেল! তুমি জানো না—জাহাজে মৈত্রদাকে নিয়ে আমরা কি বিপদের মধ্যে আছি। কখন কোথায় হারিয়ে যায়—ফেরার রাস্তা মনে করতে পারে না, তাকে দিয়ে একটা ব্যাণ্ডপার্টি লিড করাচ্ছো!

ম্যান্ডেলা তখন ঘাবড়ে যেত। বলতো, কখন এসে হাজির! তুমি ছোটবাবু চিন্তা করো না, আমরা ঠিক তাকে জাহাজে পৌঁছে দেব।

দেয়ালের ছবিটা দেখে সবই মনে পড়ছিল ম্যান্ডেলার।

ছোটবাবুদের জাহাজ তবে কি দুর্ঘটনায় পড়েছিল। সাইক্লোন কিংবা অতিকায় কোনও জলস্তম্ভ জাহাজের সবাইকে ধুয়ে মুছে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে।

ম্যান্ডেলা খুবই মনমরা হয়ে গেছে। যাদুকর কি তবে আর বেঁচে নেই। জাহাজের সর্বত্র কেমন এক ধ্বংসলীলার চিহ্ন।

তবু যা হয়, সে বুঝতে পারে এটা তার বাবার জাহাজ নয়। এবং যখন জাহাজের চিমনিটা চোখে পড়ল সে আর স্থির থাকতে পারল না। ব্যাংক লাইনের জাহাজ। চিমনির হলুদ রঙ আর কালো বর্ডার দেখেই তার দু’চোখে জল এসে গেল। জাহাজের কেউ বেঁচে নেই। থাকতেও পারে আবার। বোটগুলি ভেসে গেছে যখন, একবার খোঁজাখুঁজি করলে হয়। ছোটবাবু, কোথাকার ছোটবাবু সে জানে না। জাহাজের কাজকর্ম সারা হলে বিকেলে ওয়াকাই গিয়ে নিয়ে আসত। মা ভালমন্দ খাওয়াতো ছোটবাবুকে। মা’র তো কষ্ট হবেই। একজন ছেলেমানুষ নাবিকের জন্য কার না কষ্ট হয়—কত দূর দেশ থেকে এসেছে, কত সমুদ্র পার হয়ে তার জাহাজ, তাদের জাহাজঘাটায় নোঙর ফেলেছে—সেই কবে দেশ থেকে বের হয়েছে, মা ছোটবাবুকে যে কত কথা জিজ্ঞেস করতেন। ছোটবাবু বেশি কথা বলতো না। চুপচাপ থাকত। যাদুকরই ছোটবাবুর হয়ে জবাব দিত—আর ওর কথা বলবেন না। জাহাজ কবে ফিরবে আমরাও জানি না। কত বলি আরে মন খারাপ করিস না, আমরা ঠিক একদিন আবার দেশে ফিরে যাব। মাঝ সমুদ্রে মধ্য রাতে হঠাৎ হঠাৎ দেখি, ছোটবাবু বাংকে নেই।

কোথায় ছোটবাবু?

উপরে উঠে যাই—দেখি মাস্তুলের নিচে চুপচাপ বসে আছে ছোটবাবু।

ম্যান্ডেলা জানে তার মা ছোটবাবুর প্রতি কিছুটা পুত্রস্নেহে কাতর, সেও কেমন ছোটবাবুর জাহাজ ছাড়ার দিন কেঁদে ফেলেছিল—ছোটবাবু, যাদুকর বসন্তনিবাস, সারেঙ, কাপ্তান সবাই রেলিং ধরে দাঁড়িয়েছিল, শহরের কচিকাচারাও যাদুকরকে বিদায় জানাতে জাহাজঘাটায় হাজির, তারা অজস্র লাল সাদা নীল রঙের বেলুন উড়িয়ে দিয়েছিল, জাহাজ যত দূর যায় বেলুনগুলিও উড়তে থাকে একসময়, জাহাজ এবং বেলুন সবই অদৃশ্য হয়ে গেলে ম্যান্ডেলার মুখ ভারি ব্যাজার হয়ে যায়। ছুটে সে বাড়ি এসে সেই যে বিছানা নিল, আর সারাদিন উঠল না। কিছু খেলওনা। যাদুকরের সঙ্গে ছোটবাবুর জন্যও তার আশ্চর্য এক মায়া গড়ে উঠেছিল। মা বার বার এতবার সাধাসাদি করেও খাওয়াতে পারল না। তার তখন এক কথা, আমার খেতে ইচ্ছে করছে না মা। আমার কিছু ভাল লাগছে না মা।

তা ভাল না লাগারই কথা। সোজা সরল ছোটবাবুকে দেখলে মনেই হত না সে ইন্ডিয়ান। আশ্চর্য গায়ের রঙ, চোখ বড় বড় আর নীলাভ দাড়ির আভাস গালে। মাসাধিককাল একটা জাহাজ নোঙর ফেলে থাকলে জাহাজিদের তো হাতে তেমন কাজ থাকে না। ছোটবাবু সেজেগুজে যখন তাদের পাহাড় সিঁড়ি ভেঙে উঠে আসত, দু-পাশে সব পাইনের বন থেকে উড়ে আসত যেন সব পাখি প্রজাপতি –ছোটবাবুকে দেখার লোভ গাছেরও কম না, সেই ছোটবাবুর জাহাজ কোনও এক তাণ্ডবে সমুদ্রে পরিত্যক্ত। হাওয়ায় অথবা সমুদ্রস্রোতে ভেসে যাচ্ছে।

সে আর মুহূর্ত দেরি করতে পারেনি। কাছাকাছি কোনও বোটের যদি খোঁজ পায়, কিংবা কোনও লাইফবয়ার—সে উড়ছে। হাইতিতি উড়ছে। অজানা সমুদ্র, ম্যাণ্ডেলার কিছু ভাল জানা নেই,, কোথায় সে আছে তাও ঠিক জানে না—তবে তার তো পালকের টুপি আছে, ইচ্ছে করলেই পলকে পাইনের জঙ্গলে পাহাড়ের ঢিবিটায় মিকি মাউসের মতো তার প্রিয় বাড়িতে ফের উড়ে যেতে পারবে। যাদুকরের মন্ত্রপূত পালক তার মাথায়। ভয় কী!

সে খুঁজছে।

হাইতিতির গলায় ঘন্টা বাজছে।

সেই ঘন্টার শব্দে তাদের দেখেও ফেলতে পারে বোটের জাহাজিরা।

না সামনে পেছনে কিছুই দেখা যাচ্ছে না।

তিমির ঝাঁক সহসা সে দেখতে পেল। সারা সমুদ্র তোলপাড় করে বেড়াচ্ছে। জায়গাটা সামোয়া দ্বীপের কাছাকাছি—পাঁচ সাতশ মাইল অতিক্রম করে গেলেই সামোয়া দ্বীপ, সেখানে শহর আছে, অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার মুখে জাহাজগুলি বন্দর থেকে রসদ তুলে নেয়। তার মনে পড়ে গেল ছোটবাবুই যেন বলেছিল, আমাদের জাহাজ সামোয়া থেকে রসদ নেবে, তারপর ফিজি, কাকাতিয়া দ্বীপে যাবে, ফসফেট বোঝাই করে অস্ট্রেলিয়ার উপকূলে উপকূলে ঘুরে বেড়াবে। মাল খালাস করবে—ছোটবাবুর এমন সরল সহজ কথাতেও সে খুশি হতে পারেনি। মুখ ব্যাজার করে রেখেছিল—যদি ছোটবাবু কোনও ডাইনির পাল্লায় পড়ে যায়। কী যে হবে ছোটবাবুর!

হাইতিতি কিচ কিচ করছে। কোথাও নামা যাচ্ছে না—হাইতিতির খিদে পেতে পারে, তারপরই যেন সে দেখল ওই তো অনেক দূরে মেঘের মতো দিগন্তে কি ভেসে রয়েছে। সমুদ্রের বিশাল অন্তহীন শব্দমালা নিরাশ হয়ে মাথা কুটে মরছে।

আরও কিছুটা ভেসে গেলে সে বুঝতে পারল ওটা একটা দ্বীপ। খোঁজাখুজির সময় কিছুই বাদ দেওয়া ঠিক না। বলা যায় না কোনও সূত্র পেয়ে যেতে পারে। তাছাড়া দ্বীপটায় যদি মিষ্টিজলের হ্রদ থাকে, স্নান করে নেওয়া যাবে। এইসব দ্বীপে, মৃত আগ্নেয়গিরির মাথায় হ্রদের মতো জলাশয় সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়—জলে সাঁতার কাটা যাবে, স্বচ্ছ স্ফটিক জলে সাঁতার কাটাও কম মজার না। আর ফলপাকুড় তো থাকেই, তাছাড়া পাখির ডিম, কিংবা কচ্ছপের ডিমও পাওয়া যেতে পারে- তা ছাড়া লেবুর জঙ্গল, কাগজি লেবু, গন্ধরাজ লেবু, বাতাবি লেবুর গাছও থাকে মেলা। সারি সারি নারকেল গাছও দেখা যায়। সমুদ্র থেকে ওঠা এই সব মৃত আগ্নেয়গিরি হাজার হাজার বছরে দ্বীপ হয়ে যেতেই পারে। আগ্নেয়গিরির লাভা থেকে বিশাল বিশাল পাহাড়েরও জন্ম হয়।

দ্বীপে নেমে পাখির ডিম পুড়িয়ে খেলে এতো সুস্বাদু লাগে, অথবা বুনো আনারসও পাওয়া যেতে পারে। হাইতিতির আনারস খুবই প্রিয়।

দ্বীপটার কাছে যেতেই ম্যাণ্ডেলা কেমন হকচকিয়ে গেল।

হাইতিতি কথা শুনছে না।

হাইতিতি দ্বীপের বালিয়াড়িতে নেমে যাচ্ছে। ম্যাণ্ডেলা এমন একটা নির্জন দ্বীপে পরিত্যক্ত জাহাজের মাত্র একটা লাইফবোট দেখে ভাবল দ্বীপে ঠিক জাহাজের কারও খোঁজ পাওয়া যাবে।

বালিয়াড়িতে সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ছে।

সমুদ্রে যে জোয়ার এসে গেছে ম্যাণ্ডেলার বুঝতে আদৌ কষ্ট হল না। বালিয়াড়ি ডুবে গেছে।

বোট যে নোঙর করা, কাছে গেলে তাও বোঝা গেল। সমুদ্রের ঢেউ-এ উথাল পাতাল হচ্ছে।

বোটে একটা ত্রিপলের ছইও আছে।

কেউ আছে ঠিক এ দ্বীপে।

বোটের পাটাতনে দেখল, পাখির ডিম, কাজু বাদাম, আনারস, বাতাবি লেবু ডাই করা। কবে থেকে জড়ো করা হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে না।

অধিকাংশ আনারস লেবু শুকিয়ে গেছে। পাখি অথবা কচ্ছপের ডিমগুলিও কিছু কিছু নষ্ট হয়ে গেছে। বোট ফেলে কেউ কি চলে গেছে। সে তো দ্বীপটার উপরে ওড়ার সময় দেখেছে—কোনও ঘরবাড়ি নেই। সে চিৎকার করে যেভাবে ডেকে বেড়ায় তেমনি, ডেকে বেড়াতে থাকল—

কেউ কি আছেন! সাড়া দিন।

তার বাবা যদি হয়। সে কেমন মরিয়া হয়ে জঙ্গলের ভিতর ঢুকে যেতে থাকল।

জঙ্গলে ঢোকার সময় দেখল অদূরে একটা ক্রশ পোঁতা। সমুদ্রে জোয়ার এসে যাওয়ায় ক্রশের কিছুটা অংশ জলে ডুবে গেছে। এ দ্বীপে মানুষের চিহ্ন পাওয়া যাবে। তা না হলে এ-ভাবে একটা ক্রশ দাঁড়িয়ে থাকবে কেন! কাউকে এই দ্বীপে নিশ্চয়ই সমাধিস্থ করা হয়েছে এমনও মনে হল তার। যদি কোনও পর্যটকের দল এসে থাকে, কত কিছুই হতে পারে।

জঙ্গলের ভিতর কিছুটা ঢোকা গেল। তারপরই ছোট ছোট পিরামিডের মতো সারি সারি একের পর এক পাহাড়। আর সামনে এগোনো যাচ্ছে না। আর দেখল, সেই পাথরের গায়ে কে যেন সুন্দর হস্তাক্ষরে খোদাই করে রেখেছে, স্ট্রাগল ইজ দ্য প্লেজার।

এখন তার পক্ষে পাহাড়টা অতিক্রম করাই মুশকিল। তারপরই মনে হল তার পালকের টুপি আছে—উড়ে গেলে, ভেসে গেলে বাতাসে, সে সব দেখতে পাবে দ্বীপটার। সে নীচু দিয়ে উড়ে যাবে।

হাইতিতি তার পেছনে উড়ে আসছে।

দ্বীপটা খুবই বড়। এক পাক খেয়ে ম্যাণ্ডেলা সহজেই টের পেল। কেউ নেই, কোনও মানুষের চিহ্ন নেই। বোট কে নিয়ে এল? ঝড়ে পড়ে জাহাজের বোট যদি ভেসে যায়। কিন্তু আনারস, ডিম, কাজুবাদাম কে জড়ো করে রেখেছে বোটের পাটাতনে!

আর ঠিক নিচে নামার সময় সে দেখল আর একটা পাহাড়ের গায়ে সুন্দর হস্তাক্ষরে আবার কেউ লিখে রেখে গেছে—বনি, ডোন্ট টার্ন ফ্রম মি ইন দিস টাইম অফ ডিস্ট্রেস। বেন্ট ডাউন ইয়োর ইয়ার অ্যান্ড গিভ মি স্পিডি আনসার।

ম্যাণ্ডেলা ভারি রহস্যের মধ্যে পড়ে গেল। বনি কে? বনি তো নারী। কেউ একজন পুরুষ মানুষ, এই মানুষ এই দ্বীপে যে বনিকে খুঁজে বেড়াচ্ছে তার বুঝতে কষ্ট হল না।

লোকটাকে যে করেই হোক খুঁজে বের করতে হবে। তার বাবা কি তবে কোনও ডাইনির পাল্লায় পড়ে গেছেন! তার বাবা হবে, এমনই বা ভাবছে কেন! আসলে প্রিয়জনের কথা মাথায় থাকলে সংশয় দেখা দিতেই পারে। তার বাবা জাহাজ ছেড়ে বোটে ভাসতেই পারেন। কিন্তু বাবার জাহাজে কোনও নারী থাকবে কেন! বাবা তো মালবাহী জাহাজের কাপ্তান ছিলেন। আর সে তো সেই যুদ্ধ অপরাধী লোকটাকে প্রথম দেখে ভেবেছিল, তার বাবাই হবে। চুলদাড়ি গজিয়ে একজন বন্যমানুষের মতো ঘোরাফেরা করছে—মাঝে মাঝে সে তার বাবার মুখও মনে করতে পারে না।

গাছে লোকটা নিজের নাম, নদীর নাম না লিখে রাখলে তার প্রতি সংশয় থেকেই যেত। চুলদাড়ি গজিয়ে গেলে মানুষকে চেনাও কঠিন।

কিন্তু এই দ্বীপে লোকটা তার নিজের নাম লেখেনি। তারপরই দেখল, পায়ের কাছে আর একটা বড় পাথর পড়ে আছে। তার উপরও সুন্দর হস্তাক্ষরে লেখা—ফর মাই ডেইজ ডিজএপিয়ার লাইক স্মোক, মাই হেলথ ইজ ব্রোকেন অ্যান্ড মাই হার্ট ইজ সিক, বনি, গিভ মি স্পিডি আনসার।

বনি কি এই দ্বীপের জঙ্গলে পালিয়ে আছে।

সে এ সময় হঠাৎ কেন জানি ভাবল, ছোটবাবু নয় তো—ছেলের পোশাকে দেখতে মেয়ের মতো, আসলে সে কোনও তরুণী হতে পারে—কেমন একটা সংশয় দেখা দিতেই সে হাইতিতিকে ডাকল। তার খিদে পেয়েছে। সে সমুদ্রে সাঁতার কাটতে থাকল। আর সে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে, যেই হোক সাঁজ লাগলে লোকটা ঠিক বোটে ফিরে আসবে। সে সেখানে ঝড়বৃষ্টি থেকে আত্মরক্ষার জন্য ছইটা যে তৈরি করেছে, তাও বুঝতে তার কষ্ট হল না।

সে নিজে খেল।

প্রচণ্ড রোদ। সমুদ্রে সাঁতার কাটতে ভালই লাগছিল, আর ডুবে ডুবে ঝিনুক তুলে তার শাঁস লেবুর রস দিয়ে খাওয়ার মজাই আলাদা। কোন বুনো আনারসের খোঁজে হাইতিতি চলে গেছে। সে সমুদ্রের ধারে দেখল নারকেল গাছের ফাঁকে ফাঁকে কাজু বাদামের গাছ। গুচ্ছ গুচ্ছ কাজুবাদাম তুলেও খেল। তারপর একটা গাছের নীচে শুয়ে থাকল।

ম্যাণ্ডেলা যেখানটায় শুয়ে তার কিছুটা দূরেই বোট ভাসমান। জোয়ারের জল নেমে যাচ্ছে। সূর্যাস্ত হলে বোট বালিয়াড়িতে পড়ে থাকবে।

তাকে দেখতেই হবে, সে কে।

লোকটা তার বোট নিতে আসবেই। ছোটবাবু যদি হয়, আর তাকে যদি দ্যাখে, সে গাছের নীচে বসে আছে ভয় পেতে পারে। এমন একটা অজানা সমুদ্রে ম্যাণ্ডেলার মতো ছোট্ট মেয়ে হাজির হয় কি করে! ভূত টুত ভেবে সে পালাতেও পারে। কোনও ঘোরে পড়ে গেছে ভাবতে পারে। ঘোরে না পড়ে গেলে একটা নির্জন দ্বীপে একজন বালিকাকে দেখা যায় না। ছোটবাবু তো জানে না যাদুকর তাকে পালকের টুপি দিয়ে গেছে। সে এখন পৃথিবীর সর্বত্রগামী—পলকে যেখানে খুশি, যে দেশে খুশি হাজির হতে পারে। তবে হাইতিতি সঙ্গে আছে বলে রক্ষা। হাইতিতিকে ছোটবাবু কিছুতেই ভুতুড়ে কাণ্ড বলে ভাবতে পারবে না। হাইতিতিকে ছোটবাবু ভালই চেনে।

হাইতিতি তো বন্যপ্রাণী। বন্যপ্রাণী কি ভূত সেজে বেড়াতে পারে!

সে ভাবছিল একটু ঘুমিয়ে নিলে মন্দ হয় না। সে এ-পাশ ও-পাশ করছে। ঘাসের নরম বিছানা, তার কোনও অসুবিধাই হচ্ছে না। তবু কেন যে ঘুম এল না। ঘুমিয়ে পড়লে সত্যি সে যে ম্যাণ্ডেলা, কাপ্তান মরিসের আদুরে মেয়ে,—তখন তার কোনও ভোজবাজি দেখাবার শক্তি থাকে না। পালকের টুপি খুলে ফেললে সে দৃশ্যমান হয়, পালকের টুপি পরলে সে অদৃশ্য হয়ে যায়। কিন্তু ঘুমিয়ে পড়লে, পালকের টুপি মাথায় থাকলেও কোনও কাজে আসে না। আসলে তার ভাবনার সঙ্গে টুপির গুণাগুণ শুরু হয়।

কোনও দুষ্টু লোক তাকে দেখে ফেললে জাপটে ধরতেই পারে। ঘুমিয়ে পড়লে তো মানুষ মরা।

এই সব চিন্তা ভাবনায় সে বুঝতে পারল, লোকটাকে খুঁজে বের না করা পর্যন্ত তার স্বস্তি নেই। সে উঠে বসল, সমুদ্রের জল ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছে। আসলে সমুদ্রে ভাটা শুরু হয়েছে। দেশ বিদেশ ঘুরলে কত অভিজ্ঞতা যে হয়। মধ্য রাতে যে আবার জোয়ার আসবে তাও সে বোঝে।

কি আর করা।

কিছুটা হেঁটেই দেখা যাক।

ডানদিকে এগিয়ে যেতেই মনে হল একটা সরু রাস্তা—রাস্তাটা দেখেই মনে হল, জঙ্গলে মানুষের পায়ে হাঁটা পথ এরকমের হয়ে থাকে, জীবজন্তু থাকলেও হতে পারে। তবে এই দ্বীপে কোনও যে জীবজন্তু আছে এখনও তা টের পাওয়া যায়নি।

দ্বীপের কিছুটা ভিতরে ঢুকে যেতেই আবার সেই পাথরের গম্বুজ। প্রায় পিরামিডের মতো দেখতে। ছোট ছোট এই সব ত্রিকোণ পাথরের গায়ে কেউ যে কিছু লিখে রাখছে এ বিষয়ে তার আর কোনও সংশয় থাকল না। হাতুড়ি বাটালি না হলে লেখাও কঠিন।

যেমন এখানে সে দেখতে পেল সেই লিপি—পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা সেই লিপি—ইউ স্ট্রং অ্যাজ গড অ্যান্ড ক্যান ইউ ফাইট অ্যাজ লাউডলি অ্যাজ হি! ক্যান ইউ সাউট টু দ্য ক্লাউডস অ্যান্ড মেক ইট রেন।

পরের পাথরটায় লেখা আছে—ইউ আর ক্যারিং দ্য ক্রশ। ইট ইজ দ্য সাফারিং অফ হিউম্যান ম্যানকাইন্ড।

এই সব লিপির মধ্যে ঈশ্বর বিশ্বাসের যে কথা থাকে—লোকটা দেশে ফিরতে পারছে না বলে কি এইসব প্রকৃতির প্রস্তর খণ্ডে, তার ঈশ্বর বিশ্বাসের কথা লিখে রেখেছে। না ম্যাণ্ডেলা কিছুই বুঝতে পারছে না। বনিই কি, সেই মানুষটার ঈশ্বর। কী যে রহস্যময় সব লেখা।

বাতাসে ভেসে বেড়াক, আর উড়েই বেড়াক শরীরে ক্লান্তির বোঝা কখনও না কখনও নেমে আসবেই। সকাল থেকে ওড়ার পালা চলছে, তবে সে যেখানে সেখানে নেমে গাছের নীচে শুয়ে বিশ্রাম নিতে পারে না। তবে যেখানেই সে তার ক্লান্তি দূর করার জন্য শুয়ে পড়ুক না, হাইতিতি পাহারায় থাকবে। তার ঘ্রাণশক্তি প্রবল। বিপদ টের পেলেই ম্যাণ্ডেলাকে সতর্ক করে দেয়।

হাইতিতি ফিরে এলে সে বলল, কোথাও যাস না, এই যে দেখছিস ঝোপের মতো কাজু বাদামের গাছটা তার নীচে শুয়ে পড়ছি। বলেই আর কোনও কথা নয়। সাদা ফ্রক নীল রঙের প্যান্ট পরেই ঘুরে বেড়ায় বেশি। সমুদ্রে ডুবে ডুবে ঝিনুক তুলে শাঁস খেয়েছিল বলে ফ্রক প্যান্ট দুই ভিজে। হাঁটুর কাছে ফ্রক টেনে পা গুটিয়ে শুয়ে পড়ার সময় বলল, ওই যে দেখছিস বোট নোঙর করা আছে—লক্ষ্য রাখবি—কেউ এসে যদি বোটে উঠে যায় আমাকে ডেকে তুলবি।

ম্যালোর পোষা ওই জীবটি তার সব কথাই বুঝতে পারে।

তবু সে বলল, কী মনে থাকবে তো!

ক্যাঙ্গারুর বাচ্চাটা দু পায়ে ভর করে বসে আছে। এভাবে বসে থাকলে সামনের পা দুটো বুকের কাছে থাকে—অনেক সময় মনে হয় হাইতিতি তার সামনে হাত জোড় করে বসে আছে। তার তখন বিন্দুমাত্র দুষ্টুমি করার বাসনা থাকে না। ম্যাণ্ডেলার তখন বড়ই মায়া হয়।

সূর্য তখন দিগন্তে নেমে যাচ্ছে।

ভাটার টানে সামনে যতদূর চোখ যায় প্রশস্ত বালিয়াড়ি। জ্যান্ত শঙ্খ, স্টার ফিস, মরার মতো পড়ে আছে যেন

অবশ্য ম্যাণ্ডেলা জানে, এরা সবাই জীবিত—ধীরে ধীরে বালিয়াড়িতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঝাঁকে ঝাঁকে সব পাখি উড়ে এসে বসছে। ঠুকরে শঙ্খের ভেতরের শাঁস টেনে বের করছে। অসংখ্য শঙ্খের খোল এমনিতেই দেখতে পাওয়া যায়, দ্বীপের জীবজন্তুরা মাংস টেনে খাবার লোভে ঠিক নেমেও আসে। কিন্তু আশ্চর্য এখানে না একটা খেঁকশেয়াল, এমন কি ইঁদুর পর্যন্ত দেখা গেল না। কেবল সমুদ্র পাখিদের ওড়াউড়ি—আর ভোজনের উল্লাস। আসলে পাখিদের কলরবেই ম্যাণ্ডেলার ঘুম চটকে গেল। সে ধড়ফড় করে উঠে বসল। কোথায় সে এসেছে, ভুলেই গেছিল, কেন যে এই দ্বীপে শুয়ে ঘুমোচ্ছে তাও ভুলে গেছে। ধীরে ধীরে আবার সব মনে পড়তেই আগেকার ম্যাণ্ডেলা হয়ে গেল সে।

সূর্য দিগন্তে নেমে গেল।

তার বেশ ভয়ও করছে। ইচ্ছে করলে পলকে সে বাতাসে ভেসে বাড়ি চলে যেতে পারে। ঘোরাঘুরিও তার কম হল না। অভিজ্ঞতায় সে বুঝেছে, মন খারাপ হলে তার যে মার কাছে চলে যেতে ইচ্ছে হয়। মাঝে মাঝে বাড়ি ফেরার সময় মনে হয় বাবা হয়তো ফিরে এসেছেন। বাবার

হয়তো কোনও খবর পাওয়া গেছে। কত কিছুই তো মনে হয়।

তখনই দেখল এক বিশাল চাঁদ উঠে আসছে সমুদ্রে।

আজ পুর্ণিমা!

হতেও পারে।

হাইতিতি একইভাবে বসে আছে।

কিরে কিছু দেখেছিস?

না।

কোনও জীবজন্তু নেমে এসেছিল?

না।

বোটে কেউ উঠে আসেনি?

আজ্ঞে না।

আশ্চর্য, তবে কি বৃথাই তার অপেক্ষা। তার তো একটাই কাজ, মানুষটার পরিচয় জানা। দিনের বেলায় জঙ্গলে সে যতই ঘোরাঘুরি করুক না, রাতে তাকে বোটে ফিরে আসতেই হয়।

মানুষটা কে?

আর তখনই দেখা গেল একজন মানুষ, লম্বা এবং তিমি শিকারীদের মতো হাতে একটা কাঠের বল্লম। অবশ্য জ্যোৎস্নায় ঠিক স্পষ্ট নয়।

মনে হচ্ছে, হাতে একটা ব্যাগও আছে।

মানুষটা কি চোরা তিমি শিকারী?

বোটে উঠেই লম্ফ জ্বেলে ডেকের উপর কি সব পাটাতনের নীচ থেকে টেনে বের করছে!

ম্যাণ্ডেলা দৌড়তে থাকল। মানুষকে তার ভয় নেই। বরং মানুষটা তাকে দেখলেই ভয় পাবে। এমন একজন সুন্দর বালিকা ত্রিসন্ধ্যায় কোত্থেকে হাজির। ভূত টুত ভেবে ভয়ে পালাতেও পারে। সে তাকে যে সহজে ছাড়ছে না—সে কাছে যেতেই, একেবারে বোটের উপর উপুড় হয়ে দেখল, থালা, বাসন, একটা উনুন এবং একটা তেলের ডিবে—লোকটা হয়তো রাতের খাবারের বন্দোবস্ত করার জন্য পাটাতনের নীচ থেকে সব তুলছে।

এই। বলেই ম্যাণ্ডেলা বোট ঝাঁকিয়ে দিল।

সঙ্গে সঙ্গে লম্ফের আলোতে মুখ দেখেই টের পেল জাহাজের সেই ছোটবাবু! কি চেহারা করেছে। গায়ে পাতার। পোষাক রোদে রোদে ঘুরে রঙ তামাটে করে ফেলেছে। ছোটবাবুকে চিনতে তার বিন্দুমাত্র কষ্ট হবার কথা না—কী তার মায়াবী চোখ—এই চোখ দেখলে কখনও কেউ ভুলতে পারে না।

ছোটবাবু তাকে দেখছে। কিছু বলছে না। তারপর সহসা আর্তনাদ করে উঠল এবং ছুটে এসে তাকে জাপটে ধরল।

বনি, বনি এতকাল কোথায় ছিলে। আমি তোমাকে পাগলের মতো খুঁজছি। তারপরই বোকার মতো কেঁদে ফেলল।

ম্যাণ্ডেলা বুঝতে পারছে, ছোটবাবু তাকে চিনতে পারছে না। আবছা অস্পষ্ট আলোয় তাকে বনি ভেবে জাপটে ধরেছে।

ম্যাণ্ডেলা ছোটবাবুর বুকের উষ্ণতা টের পাচ্ছে—তার বলতেও কষ্ট হচ্ছে, আমি বনি নই ছোটবাবু, আমি ম্যাণ্ডেলা, নিউপ্লিমাউথ বন্দরের ম্যাণ্ডেলা। বনি ভেবে ভুল করছ। কিন্তু বলতে পারছে না। পুরুষের ছদ্মবেশে যে ছেলেটা ছোটবাবুর সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিল সে যে তারই বয়সী। একা দ্বীপে থাকতে থাকতে সেই ছদ্মবেশীর মুখও ভুলে যেতে পারে। বিশ্বাসই করছে না, নির্জন দ্বীপে ছদ্মবেশী বনি ছাড়া আর কেউ থাকতে পারে।

ছোটবাবুর কোনও দোষ নেই। তারও যে—ছোটবাবুকে খুব ভাল লাগত। যতক্ষণ জাপ্টে থাকে—ততক্ষণই যেন আশ্চর্য এক মায়া। তার চোখেও জল, ছোটবাবুকে যে বলতেই হবে, সে বনি নয়, সে ম্যাণ্ডেলা। দ্বীপ থেকে ছোটবাবুকে যেভাইে হোক উদ্ধার করতে হবে—ছোটবাবুরও যে মা বাবা আছে। ভাই বোন আছে দেশে! কত রহস্য এই দ্বীপে।

ক্রশটা কোথা থেকে এল! ছোটবাবু নিশ্চয়ই সব জানে। সে প্রশ্নও করতে পারছে না ক্রশটা এই দ্বীপে কেন, ওখানে কার সমাধি! ছোটবাবু কবে এই দ্বীপে এসেছে, সঙ্গে কি বনি ছিল! পাথরের লিপি থেকে তা বোঝা যায় না। তাকে নিষ্ঠুর হতেই হবে। আসলে ছোটবাবু মানসিক অবসাদে ভুগে ভুগে ক্ষীণকায় হয়ে গেছে এও টের পেল সে—চোখে কমও দেখতে পারে। তা-ছাড়া বাইবেল থেকে অমোঘ সব বাণী ছোট ছোট সব পাহাড় গাত্রে কে খোদাই করেছে? ছোটবাবু না অন্য কেউ। তাকে ধরা দিতেই হবে। সে যে বনি নয়, সে ম্যাণ্ডেলা বলতেই হবে। প্রাথমিকভাবে ভেঙে পড়লেও পরে ঠিক হয়ে যাবে। হাতের বল্লমই বা কোথায় পেল। বল্লম নিয়ে কোথায় ঘোরাঘুরি করে। নিশ্চয়ই এই দ্বীপে তার কোনও শত্রুপক্ষ আছে।

সে বোটে উঠে গেল।

আমাকে দ্যাখো ছোটবাবু।

ছোটবাবু কথা বলছে না। সে কাঠকুটো দিয়ে উনুনে আগুন জ্বালছে।

আমাকে দ্যাখো ছোটবাবু, আমি বনি নই, আমি ম্যাণ্ডেলা। লন্ঠন তুলে ভাল করে দ্যাখো। তুমি কোনও ঘোরে পড়ে গেছ। আমাকে চিনতে পারছ না!

ছোটবাবু কথা বলছে না। চোখ না তুলেই ছোটবাবু বলল, অঃ দারুণ, আমি জানতাম তুমি ঠিক ফিরে আসবে। আর্চির প্রেতাত্মা তোমার উপর কিছুতেই ভর করতে পারে না।

আর্চিই বা কে? তার প্রেতাত্মা! অদ্ভুত সব অসংলগ্ন কথা বলছে ছোটবাবু।

ম্যাণ্ডেলা বলল, আমার দিকে তাকাও। বলছি দ্যাখো। কাঠকুটোতে আগুন জ্বেলে আমিই না হয় তোমার কাজে সাহায্য করব। তোমার শরীরের কী অবস্থা হয়েছে। তুমি কি মরে যেতে চাও ছোটবাবু?

না—না, বনি। আমি মরে যেতে চাই না।

আমি ম্যাণ্ডেলা। আমাকে বনি বললে খারাপ লাগে না বলো!

তোমাদের পরিত্যক্ত জাহাজটা দেখে এলাম। কাপ্তান শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। শিয়রে যীশুর ছবি, দেয়ালে লিখে রেখেছে, হ্যালেলুজা আই অ্যাম অন মাই ওয়ে। তোমার কেবিনে, তোমার লকারে তোমার মায়ের ছবিও দেখে এসেছি। মা বাবার কথা তোমার মনে পড়ছে না!

কী হল কে জানে। সে ম্যাণ্ডেলার দিকে তেড়ে গেল। নামো আমার বোট থেকে, দূর হও। আমি এতটা পাগল হইনি, তোমাকে আমি ম্যাণ্ডেলা ভাবব। এমন একটা অজানা সমুদ্রে ম্যাণ্ডেলার মতো বাচ্চা মেয়ে কখনও আসতে পারে!

যাদুকরের কথা বলা কি ঠিক হবে!

পালকের টুপির কথা!

কিংবা হাইতিতির গলায় রুপোর ঘন্টার কথা!

সে আবছা আলোয় যদি বনি হয়ে রাতটা কাটিয়ে দেয় মন্দ কী!

সে বলল, সরো আমি করছি। আমি কিন্তু খাব।

আমি তো রোজ তোমার জন্য খাবার সংগ্রহ করে রাখি। তুমি যা জেদি মেয়ে, জেদ কতক্ষণ থাকে মানুষের বলো!

সে ফের না বলে পারল না, যাদুকর বসন্তনিবাসের কথা মনে আছে!

আরে আমাদের মৈত্রদা! সে তো সামুয়ার সমুদ্রে জলে ডুবে মারা গেছে। শেষদিকে জাহাজে ঘুরতে ঘুরতে পাগল হয়ে গেছিল।

ম্যাণ্ডেলা সঙ্গে সঙ্গে বুকে ক্রশ টানল। বলল, তাই হবে। জানো সে রাতেই তবে যাদুকর মারা যায়। সেদিনই আমাদের বন্দর শহরে মধ্যরাতে সব চার্চের ঘন্টা বাজতে থাকল, কচিকাচারা রাতে স্বপ্ন দেখল, যাদুকর বসন্তনিবাস দুঃখী রাজপুত্র হয়ে আবার জাহাজঘাটায় ফিরে এসেছে। তারিখটা মনে আছে তোমার?

ছোটবাবু আবার চুপ। এবং কিছুক্ষণ পর কেন যে তারিখটা ঠিক ঠিক বলে ফেলল। ম্যাণ্ডেলা হিসাব করে দেখল সেই রাতে সমুদ্রের বালুবেলায় জলে ডাঙায় শ্বেতপাথরের রাজপুত্র হয়ে পড়েছিল যাদুকর বসন্তনিবাস। কচিকাচারা সকাল বেলাতেই ছুটল বালুকাবেলায়, পায়ে নাগড়াই জুতো, পরনে মিনা করা রাজবেশ এবং মাথায় মুকুট। মুকুটে আশ্চর্য নীল রঙের পাখির পালক। মহা সমারোহে সেই সুন্দর রাজপুত্রটিকে শহরের চৌমাথায় বসিয়েও দেওয়া হল।

এ-সব কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে তখনই কেন যে ছোটবাবু টের পেল, এ মেয়ে অন্য মেয়ে। দেখতে একরমের হতেই পারে। তখন তো জ্যাক পুরুষের পোশাক পরেই তার সঙ্গে ঘুরত। জ্যাক মেয়েদের পোশাক পরলে হয়তো ম্যান্ডেলার সঙ্গে কতটা তফাৎ মুখের বুঝতে কষ্ট হত না। ছদ্মবেশী জ্যাক যে আসলে বনি। কাপ্তানের একমাত্র কন্যা, ম্যান্ডেলা জানবে কী করে!

কখনও কখনও যে ছোটবাবু খুবই স্বাভাবিক হয়ে যায়। তুমি যদি ম্যাণ্ডেলা হও, তবে বুঝতে হবে, এই দ্বীপে আরও একজন ভূতের উপদ্রব বাড়ল। তুমি ম্যান্ডেলার ভূত বলেই ভয় পাব না। ও তো ভারি সুন্দর আর সরল সহজ মেয়ে ছিল। তাই না!

এখন তো আমরা সবাই ভূত হয়ে গেছি। আর্চি, বনি, আমি কবেই ভূত, যাক শেষে তুমিও এসে জুটলে। ভালই হল দ্বীপটা একটা ভুতুড়ে দ্বীপ হয়ে গেল।

ম্যান্ডেলা রেগে মেগে বলল, কচু হয়ে গেল। সূরো—কি করতে হবে বলো!

ছোটবাবু অবাক। একেবারে বনির মতো কথাবার্তা। মেয়েরা বোধহয় এ-রকমেরই হয়। বনি ক্ষুধায় কাতর, তৃষ্ণায় কাতর, তবু বোটে যতটুকু যা খাবার ছিল, জল ছিল পালিয়ে তাকে খাইয়েছে। বনি খাবার ভান করেছে শুধু।

ম্যান্ডেলা বলল, খবরদার, আমরা কেউ ভূত নই। তুমি আমাকে ভূত ভাবলে চলে যাব। না না। তুমি চলে যাবে কেন।

আমাকে ভূত ভাববে না। পালকের গুণে এখন আমার অসীম ক্ষমতা। সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াতে পারি। আমাকে একদম বাচ্চা ভাববে না। আমি কত বড় হয়ে গেছি, দ্যাখো না।

এবার ছোটবাবু ভাল করে দেখল। সত্যি ম্যান্ডেলা।

ছোটবাবু বলল, তোমার বাবার খোঁজ পেয়েছ?

না।

তিনি ফিরে আসেননি?

না।

খুঁজতে বের হয়েছো?

হুম।

বোট তোমাকে এখানে নামিয়ে দিয়ে গেছে?

ম্যাণ্ডেলা কী বলবে বুঝতে পারল না। যাদুকরের মন্ত্রশক্তি ছোটবাবু বিশ্বাস নাই করতে পারে। আজগুবি কথা সে বিশ্বাসই বা করে কি করে। এমনিতেই মাঝে মাঝে ভারি অস্বাভাবিক আচরণ করছে। ছোটবাবুকে যতটা পারা যায় নিরাময় করে তুলতে হবে। সে বলল, হ্যাঁ, বোট নামিয়ে দিয়ে গেছে। দেখি দ্বীপে বাবাকে খুঁজে পাই কি না। সে তার পালকের টুপি কিংবা হাইতিতি সম্পর্কে আর কোনও কথাই বলল না।

পাবে না।

কেন?

কতদিন আছি। এই দ্বীপে আমি আর্চি বনি ছাড়া আর কেউ নেই।

ক্রশটা কে পুঁতে রেখেছে?

জানি না। কাপ্তান বোট নামিয়ে দেবার আগে ক্রশটা নিজে হাতে র‍্যাদা মেরে বানিয়েছিলেন, আমি আর সারেঙসাব কাপ্তানকে সাহায্য করেছিলাম।

বোটে তোমরা ভেসে যাবে, কোথায় ডাঙা আছে তার খোঁজে, ক্রশ দিয়ে কী হবে!

কাপ্তানের ভয় ছিল আমরা অশুভ আত্মার প্রভাবে পড়ে যেতে পারি। ক্রশটা ধরাধরি করে আমরা বোটে তুলে নিয়েছিলাম। তিনি একখানা বাইবেলও দিয়েছিলেন। বোট নামানো তো সহজ কথা না। কাপ্তান আমি সারেঙ মিলে বোট সমুদ্রে নামিয়ে দিলাম। বনি কিছুতেই তার বাবাকে ফেলে বোটে উঠতে চাইছে না। কেবল বলছে, বাবা আমাদের ভাসিয়ে দিচ্ছো কেন? আমরা কোথায় যাচ্ছি। তোমরা যাচ্ছ না কেন। আমার ভয় করছে বাবা। কাপ্তান বললেন, কোনও ভয় নেই—হ্যালেলুজা আই অ্যাম অন মাই ওয়ে। তোমরা নিশ্চিন্তে চলে যাও। কাছে কোথাও ডাঙা ঠিক পেয়ে যাবে। ছোটবাবুকে সব বলে দিয়েছি। ছোটবাবু যা বলবে শুনবে। কাপ্তান ক্রশ আর বাইবেল দিয়ে আমাদের দৈবের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন। সবাই আগেই চলে গেছে। তাঁর বিশ্বাস জাহাজ ঠিক ডাঙা পেয়ে যাবে। আমি আর বনি তাঁকে ছেড়ে যাব না, কিন্তু তাঁর বিশ্বাসে চিড় ধরে গেল। তিনি আমাদের লাস্ট বোটে নামিয়ে একেবারে হাল্কা হয়ে গেলেন। অজানা সমুদ্রে বোটে পাল তুলে দিলে ডাঙা পেয়েও যেতে পারি—কী বলো!

ম্যাণ্ডেলা সীমদানার মতো কিছু ভেজানো শস্যদানা তুলে বলল, এগুলো দিয়ে রুটি করবে ছোটবাবু! কিন্তু পেষাই করো কি করে!

হাতে কচলে নাও। ময়দার মতো হয়ে যাবে। শংকর মাছের চর্বি আছে, ফ্রাইপ্যানে ছেড়ে দাও। ছোটবাবু যা যা দরকার পাটাতন তুলে এগিয়ে দিচ্ছে। দু’জনের মতো হলেই হয়ে যায়, কিন্তু যা দিচ্ছে তা প্রায় চারজনের মতো।

অত কে খাবে?

কেন বনি, আর্চি। ওরা তো দ্বীপটায় আছে। ওরা খাবে না!

রহস্য। আর্চি বনি আছে!

সে কি বলতে যাচ্ছিল, তখনই ছোটবাবু ধমকে উঠল, এত বকবক করবে না। যা বলছি তাই করো। না পারলে সরে এসো। আমি করছি।

ম্যাণ্ডেলা আর কোনও কথা বলছে না, কাঠ কুটোর আগুনে ওর মুখ কখনও উজ্জ্বল হয়ে উঠছে কখনও ভারি নিস্প্রভ। ছোটবাবুকে কোনও প্রশ্ন করলেই খেপে যাচ্ছে।

তারপর এক সময় দেখা গেল, চারটা পাতায় ভাগ ভাগ করে, ঠিক সমানভাবে কারও কম বেশি না—সারডিন মাছ ভাজা, বন আলু সেদ্ধ এবং গুনে গুনে তিনখানা রুটি।

ছোটবাবু বলল, আমি আসছি।

ম্যাণ্ডেলা কিছু বলতে পারছে না। ছোটবাবুর অদ্ভুত আচরণে সে তার পালকের টুপির কথা ও ভুলে গেছে। কেমন বোকার মতো দেখল, জ্যোৎস্নায় ছোটবাবু জল ভেঙে পাড়ের দিকে উঠতে উঠতে অদৃশ্য হয়ে গেল। ম্যাণ্ডেলা বুঝতে পারছে না কিছু, ছোটবাবুরা কি অর্থাৎ জাহাজের সবাই কি মরে ভূত হয়ে গেছে—তারপর যার যেমন ক্ষমতা, ডাঙায় উঠে ভূত হয়ে বেঁচে আছে। না এখানে থাকা আর ঠিক হবে না—সে পালাবে ভাবল—আর তখনই মনে হল জলে ছপছপ শব্দ। ছোটবাবু ফিরে আসছে। বনিকে খাবার পৌঁছে দিয়ে কি খুশি। কী তুমি আবার একা বসে থাকতে ভয় পাওনি তো!

ম্যান্ডেলা মাথা নীচু করে বলল, না।

নাও, আর দেরি করো না। এবারে শুরু করো। আমার খুব খিদে পেয়েছে।

মন্ডেলা বসেই আছে।

কী হল, খাচ্ছ না কেন? তুমি না খেলে আমি খেতে পারি!

ম্যান্ডেলা কোনও কথা বলল না। মাথা নীচু করে বসেই আছে।

কী হল! তোমাদের মেয়েদের জাতটার এই এক স্বভাব। জেদ। কখন যে কেন খেপে যাও বুঝতে পারা যায় না।

জেদ, জেদ! বলে মুখ তুললেই ছোটবাবু দেখল, ম্যান্ডেলার দু গাল জলে ভেসে যাচ্ছে।

তুমি ছোটবাবু এ-ভাবে কতদিন বাঁচবে? তোমার দেশে ফিরতে ইচ্ছে হয় না! মা বাবার কাছে ফিরে যেতে ইচ্ছে হয় না। তুমিও তো তোমার পরিবারে নিখোঁজ। বলো, নিখোঁজ কি না!

অঃ আচ্ছা মুশকিল, তার জন্য না খাওয়ার কি আছে বলো! তুমি না খেলে আমি খেতে পারি? বলো, খেতে পারি!

বড়ই মায়াবী চোখে ম্যান্ডেলা তার দিকে তাকিয়ে আছে।

যেতে তো ইচ্ছে করে। কিন্তু বনিকে ফেলে যাই কি করে! আর্চিটা এত খারাপ, জাহাজেই, বুঝলে জাহাজে প্রথম টের পেয়েছিল, জ্যাক আসলে ছদ্মবেশী। বনি আমার সঙ্গে মিশলেই খেপে যেত—আমাকে বিলজে নামিয়ে টরচার করত।

আৰ্চিটা কে?

জাহাজের সেকেন্ড ইনজিনিয়ার।

সে কি তোমার ওপরয়ালা?

আমার ওপরয়ালা সারেঙ। সারেঙের ওপরয়ালা আর্চি। ইনজিন ক্রুরা কে কোথায় কাজ করবে, ইনজিন সারেঙকে ডেকে সেই নির্দেশ দিত। জাহাজে আর্চি টের পেয়েছিল, আমিও টের পেয়েছি। আর্চি, বাবা কাকার বয়সী, বনি তাকে একদম পছন্দ করত না। জাহাজে বনি আমাকে ছাড়া কিছু বুঝত না—আমরা তো প্রায় সমবয়সী। কাপ্তান বালিকা কন্যাকে তুলে এনেও স্থির থাকতে পারেননি। বনি কাপ্তানের দ্বিতীয় পক্ষের। দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী কাপ্তানকে ছেড়ে যাবার পর তিনি আর কি করেন। সঙ্গে নিয়েই উঠেছিলেন। কিন্তু বিশ বাইশ মাস সফরে নাবালিকা যে সাবালিকা হয়ে যাবে, কাপ্তান স্বপ্নেও বোধহয় ভাবতে পারেননি। বনি দ্বীপটায় না থাকলে কবেই ফিরে যেতাম দেশে।

সে কি এই দ্বীপে আছে?

থাকবেই। সে তো আমাকে ছেড়ে থাকতে পারত না। ছোটবাবু বলল তবে আমার মনে হয় আছে। আর্চিকে তো আমি খুন করেছি। আর্চি খুনের বদলা নিচ্ছে। বনিকে লুকিয়ে রেখেছে। কি করব বলো খুন না করেও উপায় ছিল না। বড় খারাপ লোক। খুব খারাপ স্বভাব। জানাজানি হয়ে গেলে কাপ্তান বনিকে যে দেশে পাঠিয়ে দেবেন। দেশে পাঠিয়ে দিলে আমাকে ছেড়ে থাকতে তার কষ্ট হবে না! শেষদিকে তো বনি কিছুই খেত না। শেষদিকে বোটে কিছুই ছিল না। দিনের পর দিন মাসের পর মাস বোট ভেসে চলেছে। বোটে আমি আর বনি, আর কেউ না।

তোমরা কি মরে গেছিলে? ম্যান্ডেলা কাতর গলায় বলল।

না না, মরব কেন। আমি তো প্ল্যাংকাটিন খেতে শিখে গেছিলাম। কাপ্তান আমাদের বোটে তুলে দেবার আগে আমাকে একলা ডেকে নিয়ে সমুদ্রে জল এবং খাবার না থাকলেও কি করে বেঁচে থাকা যায় তার কৌশল, খুলে বলেছিলেন। তৃষ্ণায় বুক ফেটে গেলে সমুদ্রে ডুবে স্নান করতে বলেছেন। একটা ছাকনি দিয়েছিলেন, প্ল্যাংকাটিন জমা হত ছাকনিতে—ক্ষুধা তৃষ্ণায় তাই খেতাম। বনি খেতে পারত না। খেতে গেলেই ওয়াক উঠে আসত তার। বলত, তিতো, বিষ, বিজলি বিজলি – সবুজ শ্যাওলা বলতে পারো। শেষে কাপ্তান বলেছিলেন, কোনও কোনও সমুদ্রে প্ল্যাংকাটিন থাকে না। তখন প্রয়োজনে ইউ ক্যান সাক হার ব্লাড। তুমি বেঁচে যাবে ছোটবাবু।

কাপ্তান সারেঙ জাহাজে থেকে গেলেন কেন?

কাপ্তানের যে মান যায়। কত দীর্ঘকাল তিন এস/এস সিওলব্যাংকের কাপ্তান। জাহাজটা পুরানো, লজঝরে—পৃথিবীর একমাত্র কাপ্তান স্যালি হিগিনসকেই জাহাজটা মান্য করত। তিনি ছাড়া এমন একটা লজঝরে ভাঙা জাহাজ নিয়ে সমুদ্রে সফর দিতে কেউ সাহসই পেত না। এত দীর্ঘকালের বিশ্বস্ত জাহাজকে সমুদ্রে একা ফেলে তিনিই বা যান কী করে! কাপ্তান বুড়ো মানুষ, সারেং বুড়ো মানুষ, তাদের কেন জানি বিশ্বাস ছিল, এই জাহাজ একদিন না একদিন তাদের কোনও ডাঙায় পৌঁছে দেবে। ভাসতে ভাসতে কোনও ডাঙায় গিয়ে আটকে যেতেই পারে।

বেশ মানুষ, মেয়েটাকে তোমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিলেন। তিনি নিজে, মেয়ের দিনের পর দিন মৃত্যু বিভীষিকা দেখার সাহস পেলেন না। তুমি সত্যি বোকা আছ ছোটবাবু।

সে তো মরে যায়নি!

শোনো ছোটবাবু, তুমি ঘোরে পড়ে গেছো। ঘোর থেকে মুক্ত হও।

ছোটবাবু সহসা বলল, এটা কি আমরা তো কেউ কিছুই খাচ্ছি না। খাও, সবই তো বললাম। তুমি না খেলে আমি খেতে পারি! আজ আমার বোটে থেকে যাবে তো।

সে দেখা যাবে। আগে বলো, পাথরের গায়ে বাইবেলের অমোঘ সব বাণী তুমি লিখেছো, না অন্য কেউ।

আরে খাও না। ইস, সব ঠান্ডা হয়ে গেল।

হোক। কে লিখেছে?

আমি।

কেন?

পাথরের ভিতর বনিকে আর্চির প্রেতাত্মা যদি লুকিয়ে রাখে। রাখতেই পারে। প্রেতাত্মার অসাধ্য কোনও কাজ আছে বলো?

অত কথা শুনতে চাই না। একটা বাজে লোককে খুন করেছ, বেশ করেছ। তুমি বাইবেলের অমোঘ বাণী কেন লিখলে?

প্রেতাত্মা একমাত্র ঈশ্বরকেই ভয় পায়। ভয়ে যদি বনিকে নিয়ে পাথরের ভিতর থেকে বের হয়ে আসে।

রোজ খাবার রেখে আস কেন তবে!

মেয়েটা না খেয়ে থাকবে?

সে কী খায়। কখনও দেখেছ তাকে খেতে?

জানি না।

ছোটবাবু জানি না বললে চলবে না। সত্যি করে বলো, কেন খাবার রেখে আসো। কেন তোমার এই পাপবোধ!

আমি জানি না। ম্যান্ডেলা আমি সিনার, আমি পাপী-বনিই বলেছে, তোমার পাপভোগ আছে। কেন আর্চিকে খুন করতে গেলে। আমি একা থাকি। একটা মানুষের পক্ষে একা থাকা যে কি কঠিন, তুমি বুঝবে না। পাখিরা উড়ে আসে। জোয়ারের জলে মাছ, মাছ খায়। হাঙ্গরেরও উপদ্রব আছে। চোখের সামনে কত পাখি গিলে ফেলে। যতটুকু পারি বল্লম চালিয়ে তাদের তাড়াবার চেষ্টা করি। নিজেকে ব্যস্ত রাখি বলতে পারো। পাপ থেকে মুক্ত হতে চাই।

আমি তোমার কোনও কথাই শুনতে চাই না। তুমি কবে ফিরবে বলো। বোট আসবে। পালাবে না। বনি নেই, আর্চিও নেই। বনি আর আর্চি এই দ্বীপে কেউ প্রেতাত্মা হয়েও নেই। বনি মরে গেছে।

কী করে জানলে।

বনি বেঁচে থাকলে, একজন প্রেতাত্মার চেয়ে তুমি তার অনেক বড় সম্বল। তার পক্ষে প্রেতাত্মার সঙ্গে দিন কাটানো কঠিন। এটা বুঝতে পারো না!

কিন্তু, কিন্তু।

কিন্তু না। যা বলছি শোনো। তুমি তোমার মা বাবার কথা মনে করো, ভাই বোনের কথা ভাবো। তোমার দেশের নাম নদীর নাম মনে করার চেষ্টা করো। বনিকে তুমিই সমাধিস্থ করেছ। ক্রশটা তার সাক্ষী।

না না, মিছে কথা। বনি নিস্তেজ ছিল, কিছু খেতে পারত না, গলা শুকিয়ে কাঠ, যদি ব্লাড সাক করতে পারে—আঙুল কেটে মুখে রক্তের ফোঁটা দিতে থাকলাম—দু’গাল বেয়ে রক্ত পড়ে গেল। জল নেই, খাবার নেই কতদিন, বনির শরীর গরমে ফেটে যাচ্ছে, রক্ত পুঁজ বের হচ্ছে—সে শুধু বলত, তুমি বেঁচে থাকো ছোটবাবু। আমি আর কিছু চাই না।

থেমে বলল, তখনই দূরে সমুদ্রের ঢেউ-এর আড়ালে দ্বীপের গাছপালা চোখে পড়ল।

ফের ছোটবাবু ভারি ম্রিয়মাণ গলায় বলল, চিৎকার করে উঠলাম, বনি দ্বীপ সামনে। আমরা ডাঙা পেয়ে গেছে। বনি, বনি।

বনির চোখ স্থির।

কোনও সাড়া পেলাম না।

পাগলের মতো ছোটাছুটি, বনি, জল খাবার সব পাবো। আমাকে আর একটু সময় দাও। বনির চোখ খোলা। আমার দিকে তাকিয়ে আছে শুধু। সাড়া দিচ্ছে না। বোট উথাল পাতাল করে বনিকে বুকে টেনে, বললাম, আর ভয় নেই। আমরা ডাঙা পেয়ে গেছি।

সাদা চোখে বনি আমার দিকে শুধু তাকিয়ে থাকল। তারপর কি হয়েছিল, মনে করতে পারি না। কতদিন পর নিজেকে ফের খুঁজে পেলাম। একটা ক্রশের নীচে শুয়ে আছি। বাতাসে সারা শরীর বালিতে ঢেকে গেছে। অদূরে বোট। নোঙরটা আমার পায়ের কাছে পড়ে আছে। বনি নেই। বনি হারিয়ে গেছে।

তারপর?

না আর কিছু মনে করতে পারি না। বলে হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকল ছোটবাবু। ম্যান্ডেলা বলল, খাও ছোটবাবু। তুমি না খেলে আমি কি করে খাই। সাদা রঙের বোট আসবে।

বোটে তুমি দেশে ফিরে যাবে। আমাকে কথা দাও।

ফিরে যাব।

বোট দেখে পালাবে না।

পালাব না।

দেশে ফিরে গেলে ভালো হয়ে যাবে। প্রেতাত্মার ভয় আর থাকবে না।

তারপর দু’জনেই খেয়ে দেয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। সমুদ্রের ঢেউ-এ বোট দুলছে। কতকাল পর গাঢ় ঘুমে ছোটবাবু তলিয়ে গেল।

আর সকালে উঠেই ডাকল ম্যান্ডেলা ওঠো। অনেক বেলা হয়েছে।

কোথায় ম্যান্ডেলা, কেউ নেই।

জোরে চিৎকার করে উঠল, ম্যান্ডেলা, তুমি কোথায়!

কোনও সাড়া নেই! পাহাড়ে প্রতিধ্বনি—তুমি কোথায়! শুধু দেখল অদূরে একটি জাহাজ নোঙর করা। একটি সাদা রঙের বোট জাহাজ থেকে এদিকে ভেসে আসছে।

সকালে ঘুম ভেঙ্গে গেলে অতীশ স্বপ্নটার কথা ভুলে গেল। সাদা বোটের কথাও ভুলে গেল। স্বপ্নে দেখা সব ছবি কি সবসময় মনে থাকে! অ আজার বালথাজার।

সকালে অতীশের চেঁচামেচিতে ফতিমার ঘুম ভেঙে গেল। কি খুঁজছেন তিনি!

–কে যে কোথায় কি রাখে! এই ফতিমা, আমার পেস্ট কোথায়! ব্রাস কোথায়। কত বেলা হয়ে গেল। এখনও ঘুমাচ্ছিস। ওঠ। কত কাজ। তোর ঘুম বটে। কখন কি করবি!

যেন বাড়ির মানুষের সঙ্গে কথা বলছে।

ফতিমার জড়তা ভাঙছিল না। তার হাই উঠছে। মুখের কাছে হাত রেখে হাই সামলাচ্ছে। তারপর এক হাতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল। মাদুর বিছানা তোলার সময় বলল, দাঁড়ান দেখছি।

কখন দেখবি। বাজার যেতে হবে না। কি খাবি! কি বাজার করতে হবে। টুটুল মিণ্টু স্কুল যাবে না! আরে তোরা এখনও উঠছিস না। এই ফতিমা, না বাবা, আর পারছি না।

ফতিমা ব্রাসে পেস্ট লাগিয়ে দিলে বালকের মতো খুশি হয়ে উঠল অতীশ। বলল, জানিস হাতের কাছে না পেলে খুব রাগ হয়। ফতিমা বুঝল, বাবুটি জানেই না, কি ধস্তাধস্তি গেছে! অথবা ভুলে থাকতে চান। কী আতঙ্কে পড়ে গেছিলেন। যেন ঘুম থেকে জেগে উঠে এখন অন্য এক বালিয়াড়িতে হেঁটে যাচ্ছেন। এখানে কোনো ক্রস দাঁড়িয়ে নেই। সমুদ্রের গর্জনও শোনা যায় না।

সে ও-ঘরে চলে গেল। টুটুল মিণ্টু কেউ ওঠেনি। এমন কি করিডরে সুখি ঘুমাচ্ছে, শাড়ি সায়া ঠিক নেই। সে শাড়ি সায়া টেনে দিয়ে ডাকল, ও সুখিদি ওঠো। কত বেলা হয়েছে। এত সকালে উঠে পড়তে পারেন সোনাবাবু সে ভাবতেই পারেনি। একজন প্রকৃত সংসারী মানুষ যা যা বলে থাকে তাই তিনি বলেছেন! এতে সে সাহস পায়। সে ডাকল, টুটুল ওঠো বাবা। এই মিণ্টু ওঠ। সে ওদের নাড়া দিল। টুটুলকে কোলে তুলে নিল। দরজা খুলে বাইরে এসে বুঝল, বেলা বেশ হয়েছে। দরজা জানালায় রোদ আসেনি, কিন্তু সকালের রোদে পাতাবাহারের গাছগুলি ঝলমল করছে। ঘুমের ঘোরে বুঝতে পারেনি। ঘরদোর সব লন্ডভন্ড হয়ে আছে। সকালে উঠেই যে এক কাপ চা খান সোনাবাবু সে জানবে কি করে! হাত মুখ ধুয়ে এসে কেমন ক্ষেপে গেলেন—বা বেশ, চা এখনও হয়নি! ফতিমা বুঝল, সুখির উপর ভরসা করলে চলবে না। সে নিজেই স্টোভ জ্বেলে বলল, সুখিদি শিগগির চা বসিয়ে দাও। বলে সে দ্রুত ঘরে এসে টুটুল মিণ্টুকে বলল, যা বাবা হাত মুখ ধুয়ে নে। সে বালিশ চাদর ঝেড়ে বিছানা ঠিকঠাক করে রাখল। ঝাঁট দিল ঘরে। টেবিলের ঢাকনা টেনে ঠিক করল। বইগুলি ভাঁজ করে রাখল। যেন এক্ষুনি সবাই চলে আসবে। জানতে চাইবে, সোনাবাবু কেমন আছেন। সোনাবাবু যদি তাতে মনে করে এত লোকজন কেন! তিনি এমন ভাবতেই পারেন। সে তো জানে না, মানসিক গন্ডগোলে কার কার কি আচরণে ক্ষোভ জন্মায়। সবাইকে নিরস্ত করা দরকার। এমন কি বাড়িতে লোক পাঠানোর দরকার নেই। এবং তার মনে হ’ল কেমন হয়, যদি সবাইকে নিয়ে আজ সে বের হ’য়ে যায়। সোনাবাবু তো চেনে জায়গাটা। আর কেউ না চিনুক, সোনাবাবু জানেন, তার প্রিয়জন কোথায়।

সে বলল, টুটুল মিণ্টু স্কুলে যাবে না।

অতীশ চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, কেন?

–না যাবে না। অত শত বুঝিয়ে বলতে পারব না। যাবে না বলেছি, যাবে না।

শেষে দরজায় উঁকি দিয়ে ফতিমা বলল, বাজার করতে হবে না। যা আছে এ-বেলা হ’য়ে যাবে। ফতিমা দ্রুত কাজ করছিল। আলম সাব এখুনি চলে আসবেন। তিনি খুবই যে অস্বস্তিতে পড়েছেন সোনাবাবুকে নিয়ে বুঝতে তার অসুবিধা হয়নি। আসলে সে অস্বস্তিতে পড়ে গেলে আলম সাবও ভাল থাকেন না। সোনাবাবুকে নিরাময় করে তুলতে না পারলে বিবির মুখের বিষণ্ণতা কাটবে না। ভালই জানেন। সোনাবাবুর খোঁজ কেউ নিতে না এলেও তিনি আসবেন। কাজেই ঘরদোর ফিটফাট করে রাখতে না পারলে যে তারই ত্রুটি।

অতীশ কিছুটা অবাকই হয়ে গেছে। ফতিমা কেন বুঝছে না—তার খবর নিতে সবাই আসতে পারে। সে যে ভাল ছিল না—অসুস্থ হয়ে পড়ায় গোটা রাজবাড়িতে যে খবরটা চাউর হয়ে গেছে সে জানে। সে কেমন আছে দেখতে সবাই আসতেই পারে। সে কিছুটা যেন বিরক্ত হয়ে বলল, জানি না, যা ভাল বুঝিস কর। ঘরে কিছু নেই। কেউ এলে দিবি কি?

—কেউ আসবে কেন? ফতিমা বেশ অপ্রসন্ন গলায় কথাটা বলল। আসলে নকল গলা এটা তার। আপনি কি জানেন, কাল কি হয়েছে! –এমন বলতে চাইল। কিন্তু বলতে পারছে না। অতীশই বলল, খবর নিতে আসবে না—কেমন আছি জানতে আসবে না!

–তা হলে আপনি বুঝতে পারছেন একা হয়ে যাননি।

–এ কথা উঠছে কেন!

–উঠবে না! কেবল তো ভাবতেন, আপনার বুঝি কেউ নেই!

–কেন থাকবে না। টুটুল মিণ্টু আছে। বাবা মা ভাই বোন কি নেই আমার।

–যাক, তবু ভাল। আর কিছু যে নেই।

–কেন তুইও তো আছিস।

ফতিমা বলল, আছি যদি মনে করেন, এখন বাজারে যেতে হবে না। সুখিদিকে দিয়ে সকালের খাবার আনিয়ে রাখছি। আলম সাব এলে আমরা বের হ’য়ে পড়ব।

–কোথায়?

–দেখি কোথায়। টুটুল মিণ্টু আমি আলম সাব।

অতীশ বলল, আমাকে নিবি না?

–না।

কিছুক্ষণের মধ্যেই বাসায় ভিড়। সবাই এসে অতীশকে দেখে অবাক। একেবারে আলাদা মানুষ। বলছে, খুব ফ্রেস লাগছে আপনাকে, কেউ বলছে, অতীশবাবুর কি সত্যি ঘুম ভাঙল।

ফতিমা সবাইকে মিষ্টি কচুরি দিচ্ছে। এবং বউরাণী এলে বলল ফতিমা, ওঁর বাড়িতে লোক পাঠিয়ে কি হবে! ভালই তো আছেন।

বউরাণী অতীশকে দেখল।

আসলে বউরাণী অর্থাৎ অমলা এই নারী সোনাবাবুর জীবনে প্রথম শব ব্যবচ্ছেদ। এই নারী এখন রাজবাড়ির মহিমা—কেউ জানেই না, এই বউরাণী, অর্থাৎ শৈশবের অমলা তাকে প্রথমে পাপের মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। ফতিমাও না।

বউরাণী বলল, কারখানা থেকে থানায় ডাইরী করা হবে।

অতীশ বলল, ডাইরী কেন?

কারা নাকি এসেছিল। দেখতে হবে কারা! আতঙ্কে তুই ভিরমি গেলি!

অতীশের সেই আতঙ্ক আবার মগজে কেমন হুল ফোটাতে থাকল।

ফতিমা বলল, ও কিছু না। কেউ আসতেই পারে। তারা আপনার অনিষ্ট করবে কেন? আপনি তো তাদের কোনো অনিষ্ট করেন নি।

অতীশ কেমন জোর পেয়ে গেল, সব বাজে কথা। আমি ওদের কোনো অনিষ্ট করিনি। ওরা কেন আমার অনিষ্ট করবে! অমলা তুমি বারণ করে দাও ডাইরি ফাইরি যেন না করে।

–কি বলছিস!

–ঠিকই বলছি।

আলম সাব এলেন, এসে তিনি দেখলেন সোনাবাবু হাতে প্লেট নিয়ে কচুরি মিষ্টি খাচ্ছে আর ফতিমাকে অর্ডার করে যাচ্ছে, এই ফতিমা দেখ কুম্ভবাবু বুঝি এল। ওকে চা-টা দিস। উনি কারখানার সহকারী ম্যানেজার, দেখতো আবার কে এল—আমি বাবু। ওটা কে আসছে—দরজা খুলে দে। অত কথা আলম সাব করিডর থেকে শুনতে পেয়ে চমকে গেলেন। বিবির কেরামতিতে তিনি খুশিই হলেন। ফতিমা না থাকলে, এত সহজে বাবুটিকে স্বাভাবিক করে তোলা যেত না ভেবেই বললেন, কি সোনাবাবু চিনতে পারছেন?

অতীশ উঠে গিয়ে চেয়ার এগিয়ে দিল। বলল, বসুন। বলে নিজের অনিচ্ছাকৃত অসুস্থতার জন্য কেমন সংকোচ বোধ করতে থাকল।

সবাই চলে গেলে, ফতিমা বলল, আমরা বের হব সাহেব।

–কোথায়?

–আপনি এখানেই নাস্তা করে নেন।

আলম সাব কিছুই বুঝতে পারছে না।

অতীশও না।

কেবল টুটুল মিণ্টু লাফাচ্ছে। তা তারা জানে পিসি বের হব বললে, হয় চিড়িয়াখানা, নয় জাদুঘর, নয় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলে তাদের নিয়ে যায়। আইসক্রিম খাওয়ায়। মাঠে দৌড়াদৌড়ি ক’রে পিসি। পিসি সত্যি তখন তাদের বন্ধু হ’য়ে যায়।

টুটুল মিণ্টু লাফাচ্ছিল, কি মজা কি মজা। এবং ফতিমা সুখিকে বলল, খিচুড়ি করে ফেলুন। আলু ভাজা ডিম ভাজা। আলম সাবের ড্রাইভারকে ডেকে পাঠাল। বলল, সাবের লুঙ্গি, পাঞ্জাবি আনবে। আরও ফিরিস্তি দিল। বড় হোটেল থেকে পাঁচ প্যাকেট খাবার।

সাহেব বললেন, কিছু বুঝছি না।

অতীশও বলল, কিছু বুঝছি না। চিরকাল এক থেকে গেল! এক বিন্দু বদলাল না।

ফতিমা দরজায় গলা বাড়িয়ে বলল, বেশ করেছি। তাড়াতাড়ি চান করে নেবেন। বারোটার মধ্যে বের হয়ে পড়ব। না হলে দেরি হয়ে যাবে।

–সেটা কোথায়?

–অনেক দূরে, আবার অনেক কাছে।

–আলম সাব অতীশের দিকে তাকিয়ে বলল, বুঝুন। এখন ঠ্যালা সামলান!

–কোথায় নিয়ে যাবি আমাদের!

ফতিমা হেসে দিল।

–ভয় নেই, গলা কাটতে নিয়ে যাব না। আমরা বৌ-দির কাছে যাব। টুটুল মিণ্টু তার মার কাছে যাবে। আর আপনি জাহান্নামে যাবেন। বলে হাসতে হাসতে অদৃশ্য হয়ে গেল। নির্মলা সেই সুদূর স্কুল কোয়ার্টারে একা আছে ভাবতে গিয়ে চোখ ঝাপসা হয়ে উঠল অতীশের। ওটা নরক না স্বর্গ সে জানে না। সে সেখানে যাচ্ছে। গাড়িতে চার-পাঁচ ঘন্টা পথ অথচ তার কাছে সে জায়গাটা কত যোজন দূরে যেন। অ আজার বালথাজার। জীবন বড় দুর্বোধ্য।

তখনই আলম সাহেব বললেন, আমি যেতে পারছি না। খুবই দুঃসংবাদ, আবার সুসংবাদও বলতে পারেন সোনাবাবু, পূর্ব পাকিস্তানে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। মানুষজন শহর ছেড়ে সব পালাচ্ছে। আমি যেতে পারছি না। স্টেশন লিভ করায় অনুমতি নেই। আপনারা যান। গহর ঠিক চিনে নিয়ে যেতে পারবে। কোনও অসুবিধা হবে না। মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনে ফতিমা সহসা ঘরে ঢুকে লাফাতে থাকল—কি মজা, কি মজা। দারুণ দারুণ কেমন সে পাগলের মতো মিণ্টু টুটুলের গালে জোর করে হাম খেতে থাকল অ আজার বালথাজার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *