1 of 2

ঈশ্বরের বাগান – ৪৯

॥ ঊনপঞ্চাশ ॥

বেগমসাহেবার মুখ গোমড়া। কাল থেকে আলম সাবেরও মনমেজাজ ভালো নেই। পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র আন্দোলন ক্রমেই মারমুখী। দেশের বাণিজ্য মূলত পশ্চিম পাকিস্তানের হাতে। সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিম পাস্তিানের শোষণের ক্ষেত্র পূর্ব পাকিস্তান। এই নিয়ে কাল রাতে তর্কবিতর্ক। শেখ মুজিবর রহমন আমাদের বাঁচার দাবী ও ছ-দফা কর্মসূচীর নাম দিয়ে একটি ঐতিহাসিক পুস্তক রচনা করেছেন। ঘরে ঘরে এই পুস্তকখানির কদর বাড়ছে। কেন বাড়ছে?

ছ-দফা জিন্দাবাদ। ছাত্রদের স্লোগান।

৭ই জুন অমর হোক।

স্বায়ত্তশাসন আমাদের প্রাণের দাবী, জানের দাবী।

এইসব স্লোগানে স্লোগানে সারা পূর্ব পাকিস্তান উত্তাল। আলম সাব যত ভাবেন, তত পীড়াবোধ করেন। বাঙালির নিজস্ব সত্তা আবিষ্কারে সেই যে ভাষা আন্দোলন শুরু হয়েছিল—আজও তা দুর্বার।

একজন উচ্চপদস্থ আমলার পক্ষে চুপচাপ থাকা ছাড়া অথবা এ-সবের বিরোধিতা করা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। কাল রাতে বেগমসাহেবা কেন যে এত উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল তিনি বুঝতে পারছেন না। সোনাবাবুর বাসায় গেছে তাতেও তিনি আপত্তি করেননি, কিন্তু মুশকিল, বেগমসাহেবা বোঝেনা, হিন্দু ঘেযা ব্যাপারটাই পশ্চিম পাকিস্তানীদের কাছে ঘোরতর দেশদ্রোহিতার শামিল।

এসেই ঘরে ঢুকে হঠাৎ আলম সাবের দিকে আঙুল তুলে বলেছিল, জানেন সাহেব, নিস্তার নাই। আপনার মিঞাগ নিস্তার নাই। এই মিঞাগ বলে ফতিমা আসল কী বলতে চায় আলম সাব বোঝেন। তিনি কেবল বলেছিলেন, শোনেন, মাথা গরম করে লাভ নাই। কী হয়েছে বলবেন ত।

—কিচ্ছু হয়নি।

তারপরই গজগজ করছিল, আমাদের সহজ, ন্যায্য দাবী যখনই উঠেছে, জিগির, ইসলাম বিপন্ন। কোন ইসলাম, কে সে ইসলাম, মানুষের চেয়ে বড় ইসলামে এমন কোনো কথা নেই।

—ফতিমা! আলম সাব গর্জে উঠেছিলেন।

—ফতিমার মেজাজ ভাল ছিল না। দুটো বাচ্চা শিশু ঘরবন্দী—মা কাছে নেই, বাপটা তো চিরকাল ভীতু স্বভাবের। পালিয়ে এসেছিলেন, বাপ-জ্যাঠার সঙ্গে। এখন কী, এখন কোন বেহস্তে আছেন! তারপরই আলম সাবের প্রতি জেদী বাঙাল স্বভাবের হয়ে গেল। পূর্ব পাকিস্তানের মজলুম জনগণের পক্ষে কথা বললেই দেশদ্রোহী। শেরে বাংলা ফজলুল হককে পর্যন্ত আপনের সাধের মিঞারা দেশদ্রোহী বলেছে। পাকিস্তানের জাতীয় নেতা সোহরাবর্দীকে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে কারাবরণ করতে হয়। কী কসুর কন! দাবীর কথা বলতে গেলে দেশদ্রোহিতার বদনাম, জেল-জুলুমের ঝুঁকি!

আলম সব বুঝতে পারছিলেন না, কী হয়েছে তাঁর বেগমসাহেবার। এত চটে গেছে কেন! সবাইকে যেতে হবে বলে দিলাম। জনাব ভুট্টোর গদি গ্যাছে—হিন্দুস্থানের বিরুদ্ধে হাজার বছরের জেহাদ—আমাদের কী আসে যায়! বলেন, আয়ুবশাহী কী করেছেন, দুর্নীতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে। তিনি কোথায়? ইয়াহিয়া চক্রান্ত করছে। মাসুল দিতে হবে। আমি জানি, রেহাই নাই। এই সেদিন মজলুম জনতা জালেম আয়ুবশাহীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে হিন্দু-মুসলমান একসঙ্গে লড়েছিলেন। হাজার হাজার মানুষকে নির্বিচারে আটক। কত দিন চলবে। বলেন! চুপ করে থাকলেন কেন! ধর্মের দোহাই—আহা রে ধর্ম আমার। ছাত্রলীগ সম্পাদক ফেরদৌশী কোরেশীরে কেন আটক করল, তোলারাম কলেজের ছাত্রনেতা মনিরুল ইসলামের কী অপরাধ—আটক হলেন তিনি। ধর্মের দোহাই! মতিয়া চৌধুরী—এঁরা মুসলমান না! বলেন আমি কী মিছা কথা বলছি। ৭ই-এর ঐতিহাসিক পূর্ব পাকিস্তান বন্ধ সফল হয়েছিল কার জোরে! আয়ুবের রুদ্র রোযের বলি কুড়িটি তাজা প্রাণ। এরা আবার ধর্মের দোহাই দেয়। বলে কিনা ইসলাম বিপন্ন।

আলম সাব সব জানেন, বোঝেন – দেশটা না আবার ভেঙে যায়! এই সেদিন প্রদেশব্যাপী জুলুম প্রতিরোধ দিবস পালন – সারা পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে ব্যাপক গণ আন্দোলন—পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের মুখ্য সমর্থক ইতেকাফ গোষ্ঠী ও তার নির্ভীক সম্পাদক মানিক মিঞার কারাবরণ—কী যে হবে! আলম জানেন, এখনও বৈদেশিক সাহায্যের শতকরা ৮০ ভাগ পশ্চিম পাকিস্তানে খরচ করা হয়। সামরিক খাতে ৯০ শতাংশ। তিনি বোঝেন, বিপুল হারে এই শোষণের একদিকে পূর্ব বাংলার শিল্পোন্নয়ন মার খেয়েছে, বেকারের হার ক্রমশ পাহাড়প্রমাণ, মাথাপিছু, আয় তুলনামূলকভাবে অনেক কম—উচ্চ শিক্ষিতের হার ভয়াবহ ভাবে হ্রাস পাচ্ছে। অথচ পাকিস্তানের রপ্তানির শতকরা ৭০ ভাগ আয় পূর্ব পাকিস্তানের পণ্য থেকে। তবু আলম যুক্তি খাড়া করার চেষ্টা করেন। আর সেই যুক্তিতে ফতিমা নিমেষে জল ঢেলে দেয়।

রাখেন ধর্ম। ধর্ম দিয়া পানি খামু। আপনের মিঞা ভাইগ লগে কিসের ঐক্য আছে কন। ধর্মের ঐক্য। হায়রে পোড়া কপাল মালয় মরক্কোর সঙ্গে ধর্মের ঐক্য কম আছে! কন! তারা ধর্মের দোহাই দিলে কী করবেন কন? ও মিঞাভাইরা আমরা আপনেগ কলিজার মানুষ—আমরা এক দেশ! আমরা এক রাষ্ট্র—মানবেন।

আলম বোঝেন কোনো যুক্তিই তাঁর ধারে কাটে না। তাঁরও মনে হয়, বেগমসাহেবার কথায় যথেষ্ট গুরুত্ব আছে। তিনি নিজেই আর সাহস পান না—কে কখন কী শুনে ফেলবে—ফতিমার মাথায় কেড়া উঠলে সে একগুঁয়ে হয়ে পড়ে। যা মুখে আসে বলে দেয়। কোনো কিছুর ধার ধারে না।

এই হলো গে বিপন্ন স্বভাব তার। তখন সে নিজেই একখানা রেকর্ড চালায়। আমরা হলামগে পাকিস্তানের বান্দা—এত সব ভেবে কী হবে! আপনে খারাপ আছেন! বলুন পরী-হুরীর মতো ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশ-বিদেশে—কার দৌলতে, মিঞাগ দৌলতে!

—একদম বাজে বকবেন না জী। আমি কারো বান্দা না। মনে রাখবেন। আপনে বান্দা হইতে পারেন, আমি কোন দুঃখে বান্দা হইতে যামু। আল্লা ছাড়া আমি কার-অ বান্দা না।

গহর উপরে উঠে দেখছে, বেগমসাহেবা দু-পিস পাঁউরুটি চা-এ ডুবিয়ে খাচ্ছে। আর কিছু না। কার উপর এই অভিমান সে বোঝে না। আলম সাহেব গহরকে চোখ টিপে বাইরে নিয়ে গেলেন। বললেন, মেজাজ গরম। মর্জি বোঝা ভার। কাল থেকেই চলছে। কিছু খাচ্ছে না। রাতেও ফিরে এসে খায়নি। কেবল চোখের জলে ভেসে গেছে। কিছু তো বলে না। সকালে বের হতে চাইলে নিয়ে যাবি। যা বলবে করবি।

কুদ্দুস একবার উঁকি দিয়ে দেখে গেল। সকালের নাস্তা কিছুই মুখে দেয়নি মেমসাব। চা-পানি খেতে হয় খেয়েছে—তারপর উঠে গেছে শোবার ঘরে। দড়াম করে দেরাজ খুলল, বন্ধ করল। গোসল ঘরে ঢুকল, বের হলো। সাফসুতরো হয়ে এই সাতসকালে কোথাও যেন বের হবে—প্যানট্রিতে ঢুকে বলল, টাকা থাকল। সাব কী নাস্তা করবেন জেনে নিও। আমি বের হচ্ছি।

মেমসাবের খোঁপা উঁচু করে বাঁধা। কপালে নীল রঙের টিপ। খুশ মেজাজে থাকলে গানের কলি ঠোঁটে নড়ে। গুনগুন করে গান গায়—কিছু গান সেওঁ শুনে মুখস্থ করে ফেলেছে। কাফেরদের গান—গা জ্বলে যায় কুদ্দুসের। তা আজ স্নানের ঘরে কিংবা সাজগোজ করবার সময়ও চুপচাপ। রাতে মিঞা বিবির তা চলেছে সে জানে। মিঞা বলছেন, এটাতো ঠিক ফতিমা বিবি, পাকিস্তান সৃষ্টির সময় পর্যন্ত পূর্ববঙ্গবাসীরা প্রকৃত স্বাধীনতা বা সার্বভৌমত্ব কী জানত না!

কুদ্দুসের ঘর থেকে শোবার ঘরটি আলগা —কিন্তু করিডর লম্বা—করিডর ধরে নিঃশব্দে হেঁটে গেলে সব শোনা যায়। দরজা বন্ধ থাকলেও। আলম সাব নিরীহ ভদ্রগোছের মানুষ। চিল্লাতে জানেন না। আস্তে কথা বলেন, জোরে হাসেন না। বেগমসাহেবা একেবারে বিপরীত। বাঙালদের এটা নাকি স্বভাব। তারা তো জারজ সন্তান না, মিনমিনে গলায় কথা বলবে! বেগমসাহেবা প্রায় চিৎকার করে বলেছিল, ঝুট কথা।

সাহেব বলছিলেন, বর্ণ হিন্দুদের দাস ছিলাম আমরা!

—মিছে কথা! বিবি মানতে রাজি না। কে এক সোনাবাবুকে বাড়িতে নিয়ে আসার পরই তেনার রুদ্রমূর্তি

কুদ্দুস এত সব বোঝে না—ভাষা সংস্কৃতি নিয়েও যেন সাব কী বলছিলেন—আর তক্ষুনি জালিম আয়ুবশাহীর বিরুদ্ধে গালাগাল, কী কইলেন, আমাদের কোনো ভাষা নাই, হিন্দুগ ভাষায় কথা বলি! কি কইলেন, আমাদের কোনো সংস্কৃতি নাই! কবিগুরু, নজরুল, জসীমউদ্দিন, জীবনানন্দ ভাইসা আইছে—তেনারা খেজুর গাছের নিচে বইসা মদিরায় আসক্ত হইয়া কবিতা লেখেন নাই—কসুর হইছে! কন—তেনারা কারা! তেনারা উর্দু ভাষার কবি না বাংলা ভাষার? আমাদের সংস্কৃতি নাই, মিঞাগ আছে। শরম লাগে না আপনের জী, আপনে অগো চিন্তায় বুঁদ হইয়া আছেন।

আলম সাহেবের আর মুখে রা নাই। তেজ মরেনি। বাঙালিকে অপমান করলেই বেগম সাহেবা মাথা ঠিক রাখতে পারে না। কুদ্দুস এটা টের পেয়েছে। সে নিজেও কখন যে বেগমসাহেবার কথা শুনে ঘাড় নাড়তে থাকে –ঠিক, ঠিক কথা। ইমানের কথা। কখনও এমন সব সরল শব্দমালা তাকে তাড়না করতে থাকে যে নিজেও গুনগুন করে গান গাইতে থাকে আড়ালে—কেমন যুশ পেয়ে যায়—বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুণ্য হউক পুণ্য হউক পুণ্য হউক হে ভগবান।

বেগম সাহেবা মাঝে মাঝে রেকর্ড চালায়, জোরে জোরে কবিতা আবৃত্তি করে—বিধর্মী ব্যাপার স্যাপার সব—তবু কখন সে নিজেও চুপচাপ দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে শুনতে ভালোবাসে। তার স্মৃতিশক্তি প্রখর—সে বোঝে এইসব সুর এবং শব্দমালার মধ্যে বেগম সাহেবার এক গভীর আনন্দ কেন যে সে গান গাইতে গেলে কাঁদে—সে বোঝে না—ইদানীং এটা আরও বেড়েছে—ও আমার দেশের মাটি তোমার পায়ে ঠেকাই মাথা

ফতিমা সিঁড়ি ধরে নেমে যাচ্ছে। যাবার সময় বসার ঘরে আলম সাবকে বলে গেল, জীবের হচ্ছি। সোনাবাবুর বাসায় যাচ্ছি। বাসে চলে যাব।

—বাসে যাবেন কেন?

—না, আপনার অসুবিধা হবে।

—হবে না তো বলছি।

রাজবাড়ির গেটে নেমে গেল ফতিমা। ঘড়িতে দেখল আটটা বেজে গেছে। সোনাবাবু বাড়ি থাকবেন না। সোনাবাবু না থাকলেই ভাল। মানুষটাকে তো সে ভালই চেনে। সে অন্তত বাসার ভিতরে ঢুকে টুটুল মিণ্টুর স্কুলের পোশাক পরিয়ে দিতে পারবে। তার কেন যে এই কাজগুলির মধ্যে অনন্ত এক আগ্রহ সৃষ্টি হচ্ছে! কে দেখে! কাল যা দেখে গেল, সুখিকে কাজের মেয়ে বুঝতে অসুবিধা হয়নি। এতটুকু দুটো দেবশিশুকে ফেলে রেখে কেউ যেতে পারে!

কিন্তু বাড়িতে ঢুকে অবাক। সোনাবাবু অফিস যাননি। তাকে দেখেই কেমন শিশুর মতো বলে ফেললেন, তুই! কী ব্যাপার। আজ আবার ওদের নিয়ে বের হবি বুঝি!

—অফিস গেলেন না! বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথাটা বলল। ভিতরে ঢুকতে সাহস পাচ্ছে না। টুটুল মিণ্টু ছুটে গিয়ে ফতিমাকে জড়িয়ে ধরেছে। ব্যাগ থেকে কী সব বের করে টুটুলের হাতে দিল। রঙের বাক্স। লম্বা ড্রইং খাতা। মিণ্টুকে দিল একটা লাল রিবন।

সোনাবাবু মুখ ব্যাজার করে বসে আছেন। চোখে মুখে অনিদ্রার ছাপ। ক্লিষ্ট দেখাচ্ছে খুব। যেন একটা বড় ঝড়ের মুখে পড়ে গেছেন। অন্য সময় হলে, এতটা যেন নিষ্প্রাণ তাঁকে কিছুতেই মনে হতো না।

মিণ্টু বলল, জানো, বাবা না অফিসে যাবে না। অফিসে গেলে বাবা আর ফিরে আসবে না। বউরাণী বারণ করে দিয়েছে। রাজবাড়ির অফিসে বাবাকে ডেকে পাঠিয়েছিল। কারা বাবার খোঁজখবর নিচ্ছে। বাবা তো ম্যানেজার।

সোনাবাবুর কোনো সাড়া নেই। সে ঢুকে যাওয়ায় কি বামুনের সংসারে কোনো অনাচার ঢুকে গেল! সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না। সোনাবাবু না বললে, সে ভিতরেও যেতে পারে না। কাল তাকে হাত ধরে ভিতরে টেনে নিয়ে না এলে সে এতটা ঢুকতেও আজ সাহস পেত না। ধনমামা যদি জানতে পারেন, ফতিমা তাদের পুত্রের আবাসে জলচল হয়ে গেছে তবে খুবই নিন্দার ব্যাপার হতে পারে।

অতীশ এবার উঠে দাঁড়াল। ব্যাগটা তার নিজের ঘরে রেখে এসে ডাকল, সুখি শোন। সুখি এলে বললো, চা করে দে। ফতিমা চা খাবি তো!

—খাব।

—খাবার কিছু করে দিস। তোর দেখছি ছেলেমানুষী যায়নি। আমার জন্য কোত্থেকে কামরাঙ্গা আনলি! এখন কী আর কামরাঙ্গা খাবার বয়েস আছে? দুজনেই নদীর দুপারের মানুষ হয়ে গেছি বুঝিস না!

—খুব বুঝি! আমি তো আপনের কাছে আসি না। টুটুল মিণ্টুর কাছে আসি। আপনি বাসায় থাকবেন জানলে আসতাম না। দূর-দূর ছাই-ছাই অনেক করেছেন। এই মিণ্টু কী হলো! তোরা দাঁড়িয়ে থাকলি কেন! আয় আমার সঙ্গে। তোদের স্কুলের জামা-প্যান্ট বের কর। কোথায় আছে?

—বাবা যে স্কুলে যেতে দিচ্ছে না! কেবল বলছে, সাবধানে থাকবে। কোথাও বের হবে না। দরজা খোলা রাখবে না।

—দরজা খোলা রাখলে কী ভূত ঢুকে পড়বে! যত্ত সব।

অতীশ বলল, আলম সাবের খবর কী!

—ভাল!

—তুই চলে আসিস, ওর অসুবিধা হবে না!

—ওটা আপনাকে ভাবতে হবে না। আপনি কেমন হয়ে যাচ্ছেন! কী হয়েছে বলুন তো!

—তুই নাকি খুব সুন্দর নাচতে পারিস?

—নাচলে দোষ হয়?

–না, তা বলছি না। তোদের তো নাচ-গান নিষিদ্ধ। আলম সাব নির্ভেজাল ভালমানুষ—যা খুশি করতে পারছিস!

–দেখুন সোনাবাবু, কী নিষিদ্ধ, কি নিষিদ্ধ নয় আপনার কাছে জানতে আসিনি। আগে বলুন, বাসায় আমি এলে কোনো অনাচারে পড়ে যাবেন কিনা! আপনার নিন্দা হবে কিনা!

–কলকাতায় এ-সব আছে নাকি!

–থাকতেও পারে। কলকাতায় না থাক ধনমামা বেঁচে আছেন। তিনি জানতে পারলে আর আপনার বাসায় আসবেন! বলুন, ঠিক করে বলুন।

—যদি নাই আসেন তাতে আমার কী!

—আপনের তো কিছু নয়। নানীর কথা ভুলে যাচ্ছেন কেন! নানী বলত না, তোমার আচরণে কারো ধর্মে আঘাত লাগলে তাও গুণাহ। মনে আছে?

—আরে ওনারা সেকেলে মানুষ! যাঁর যা প্রাপ্য তাঁরা মেনে নিতেন। তিনি ছিলেন সরল সোজা মানুষ। আমরা কী আর তা আছি! তুই বল! তুই জানিস আমি জাহাজে ছিলাম। জাহাজে আমার সহকর্মীরা সব তোর জাতভাই।

—জাহাজে কী করতেন!

–কাজ করতাম। জাহাজী। এক ঝটকা খেয়েছিলাম—ভদ্রা জাহাজের সেকেন্ড অফিসার এক থাপ্পড় মেরেছিলেন, বিফ খানে সাকতা কী নেই! আমি বলেছিলাম, নেই, ব্যাস, ঝটকা। কান বনবন করে উঠলে বলেছিলাম, সাকতা। বিফ খানে সাকতা। জাহাজী হবে আর বিফ খেতে রাজি থাকবে না, হয়! সেকেন্ড অফিসার জাতে বামুন। বামুন হয়ে বামুনকে বিফ নিয়ে নাজেহাল। বোঝ এবার! জানিস, হা-অন্ন মানুষের কোনো ধর্ম থাকে না। তুই ভিতরে আসতে পারিস। তুই বাইরে সেদিন বসে থাকলি, খারাপ লাগল না বসে থাকতে! আমি কী ছোটলোক! ছোটলোকের বাসায় ঢুকলে জাত যাবে!

—আমার জাত না আপনার জাত!

—জানি না যা। তারপরই সোনাবাবু হঠাৎ ক্ষেপে গিয়ে বললেন, তোরা আমাকে আর কত অপমান করবি! তোরা আমাকে আর কত জ্বালাবি! ঠিক এই মুহূর্তে ‘তোরা’ বলতে ফতিমা জানেই না, সোনাবাবু কি বোঝাতে চাইছেন। তোরা মানে, বনি, নির্মলা, চারু, বউরাণী। তিনি যেন বারবার এক আঘাটায় উঠে আসছেন। কেউ তাঁকে নিস্তার দিচ্ছে না।

—বৌদি যদি কিছু মনে করেন!

—কে! নির্মলার কথা বলছিস! বেচারা! তার সবকিছু পছন্দ অপছন্দ আমাকে ঘিরে। সে যে চাকরি করছে, তাও। কারণ সে তো জানে, তার উপার্জন আমার সংসারে বড় খুঁটি। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছেলেমেয়েকে ফেলে এত দূরে পড়ে আছে। তার কষ্ট আমি বুঝি। এখন যা হাল শেষ পর্যন্ত সেই থাকবে। আমি আর কত দিন আছি জানি না।

—সোনাবাবু!

ফতিমা কেমন আঁতকে ওঠার মতো কথাটা বলল।

অতীশ তক্তপোশে শুয়ে পড়ল। প্যান্ট খুলল না। পায়ে মোজা। বোধহয় আর বসে থাকারও শক্তি পাচ্ছে না। কী হয়েছে! সুখিদির সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। আর তখনই দরজায় কেউ কড়া নাড়ছে। মিণ্টু দৌড়ে যাচ্ছিল দরজা খুলতে তড়াক করে লাফিয়ে উঠল অতীশ। সে হাঁ হাঁ করে ছুটে যাচ্ছে—আর বলছে, খুলবি না। না দেখে দরজা খুলবি না। মিণ্টু দাঁড়া।

ফতিমা এতেও অবাক হয়ে গেল। দরজা খোলার নামে কেউ এমন ত্রাসে পড়ে যেতে পারে সে ভাবতে পারে না। দরজা খুললে কী হবে! চেনাজানা মানুষ না হলে দরজায় কড়া নাড়বে কেন! ফতিমা দেখল, দরজার ফাঁক দিয়ে তিনি দেখছেন, বাইরে কে দাঁড়িয়ে।

—অ কুম্ভবাবু! আসুন।

বেঁটেখাটো, চুল খাড়া, হোঁৎকামতো একজন লোককে নিয়ে সোনাবাবু ভিতরে ঢুকতে গেলে ফতিমা একপাশে সরে দাঁড়াল। লোকটা কিছু ফাইলপত্র নিয়ে এসেছে—সোনাবাবু পাতা উল্টে সই করে গেলেন। কারখানার কেউ হবে। বাড়িতে এসে সই করিয়ে নিচ্ছে। কারখানায় কী কোনো বড় উৎপাত শুরু হয়েছে! যে মানুষটি অফিস যাবে বলে বের হয়েছিল, তাকে যেতে দেওয়া হয়নি। দরজা খুলতে গেলে ত্রাসের সৃষ্টি হচ্ছে। এমন সুরক্ষিত রাজবাড়িতে সোনাবাবুর এত ত্রাসের কী কারণ থাকতে পারে সে বুঝতে পারছে না।

লোকটা সইসাবুদ করিয়ে নিয়ে বের হবার মুখে ত্যারছা চোখে তাকাল। ফতিমা এক পলকে দেখল, চোখ নামিয়ে নিল। টুটুলের হাত ধরে বাথরুমের দিকে চলে গেল।

কুম্ভবাবু ফিরে এসে বলল, দাদা চিনলাম না তো!

কুম্ভ অতীশের আত্মীয়-স্বজন সবাইকে মোটামুটি চেনে। এবং রাজবাড়িতে চাউর হয়ে গেছে, সোনাবাবুর বাড়িতে তার স্ত্রীর অনুপস্থিতিতে একজন নারী যাওয়া-আসা শুরু করেছে। সুখি চাউর করে দিয়েছে সব। তবু কুম্ভ অতীশের দিকে তাকিয়ে জানার আগ্রহবোধ করলে, সে বলল, আমার আত্মীয়া। ঠিক আত্মীয়া কথাটাতেও যেন ছোট করা হলো ফতিমাকে। ফতিমা ব্যাগের মধ্যে আর কী এনেছে জানেনা। যা সব হুটোপুটি শুরু করেছে বাথরুমে, ফতিমার সায়া, শাড়ি জলে ভিজে যেতেই পারে।

কুম্ভ চলে গেলে, সে কী করবে ভেবে পেল না। বিদেশী আতরের ঘ্রাণ এই ঘরে উড়ছে। এক আশ্চর্য ফুলের সুঘ্রাণ শরীরে মেখে রাখে ফতিমা। সে ভেবেই পেল না সব ফেলে এই নারী কোন আকর্ষণে তার কাছে হাজির। সে খুব উৎসাহ পাচ্ছে না। ফতিমা জানেই না তার মাথার উপর খাঁড়া ঝুলছে। বলতেও পারছে না। বললেই যেন হা হা করে হেসে উঠবে। জানের আশঙ্কায়, ইজ্জতের ভয়ে, জাত যাবে বলে দেশ ছেড়ে বিলকুল সব পাড়ি দিলেন। এখানে আপনার খাঁড়া ঝুলবে কেন মাথায়! এখানে ফরাস পাতা আছে, গোলাপ ফুলের পাপড়ি ছড়ানো আছে, তার উপর দিয়ে হেঁটে যাবেন বলেই তো সব জলের দামে বেচে দিয়ে বাপ-জ্যাঠারা আপনার চলে এসেছেন। জাত থাকল কোথায়! জাহাজে গেলেন, বিফ খেলেন কী খেলেন না বড় কথা না, বড় কথা আতঙ্কটা এখানেও তাড়া করল—আর ভাবলেন, হা-অন্ন মানুষের কোনো ধর্ম নাই। বুঝুন ঠ্যালা।

ফতিমা বের হয়ে বলল, আমি ওদের স্কুলে দিয়ে আসছি। ফিরছি না। স্কুল থেকে ফের ওদের পৌঁছে দেব। ওদের গায়ে কে হাত দেয় দেখব।

অতীশ কেমন বিমূঢ় হয়ে যাচ্ছে। সে বলল, তুই যাবি! কিছু হবে না তো!

—যাব। কিছু হবে না। আমি তো আছি।

–না, না ভাবছিলাম।

—কী ভাবছিলেন বলুন। সোনাবাবু, আপনি কেমন হয়ে গেছেন! জোরে হাসতে পারেন না, জোরে কথা বলতে পারেন না, আপনার মুখ এ-ভাবে কে বন্ধ করে দিয়েছে! আপনাকে আমার ভয় করে। আপনি চুপচাপ থাকলে আমি ভয় পাই—অ আজার বালথাজার!

—সঙ্গে সঙ্গে অতীশ বলল, ছবিটার কিছু বুঝেছিস!

ফতিমা বলল, সব বুঝিনি। তবে বুঝেছি, দরকারে গাধাটাকেও ঈশ্বর মনে করা যায়। তা না হলে পাপ কাজ করেই তিন কিশোর আর কিশোরী গাধার কানে কানে বলবে কেন! কনফেস করবে কেন!

—কনফেস! কিসের কনফেস!

—ওরা যা পাপকাজ করত।

—কনফেস করলে, পাপ থাকে না বলছিস!

—না, থাকে না। আপনি স্বাভাবিক নেই সোনাবাবু। সব শুনে আমার ভাই মনে হয়েছে। আমার তো কোনো পাপ নেই। আপনি নিজের ভিতর গুমরে মরছেন। আপনার বাতিদানটায় কে ভর করে আছে বলুন! আপনি তাঁকে কনফেস না করে আমার কাছে করুন।

অতীশ ভেবে পেল না, ধূপবাতিদানের কথা ফতিমা জানল কী করে! টুটুল মিণ্টু তবে সব বলে দিয়েছে। অতীশ বুঝল, কাউকে কনফেস করা সত্যি দরকার। অন্তত ধূপবাতিদানটায় যে বনি আশ্রয় নিয়েছে, সে খুলে বললে বুঝতে পারবে, তার স্মৃতিভ্রংশ কেন। কেন সে মনে করতে পারে না, কোনো দ্বীপে সে কেন মাঝে মাঝে একা বসে থাকে। সে তখন জাহাজের ছোটবাবু হয়ে যায়।

চা এনে দিলে বড় বেশি দ্রুত ফতিমা চা খেল। সুখি ওদের খাইয়ে দিয়েছে। ওরা লাফাতে লাফাতে বের হয়ে গেল। সে একা। এবং আশ্চর্য সে যেন দেখতে পাচ্ছে, সেই সমুদ্রে, সে বোটে ভেসে যাচ্ছে… বণির কাতর অনুরোধ, ছোটবাবু তুমি তাঁর স্মরণ নাও।

সেই স্মরণ এখন তার নিজের জীবনের কাছে—একা থাকলেই অস্বস্তি বাড়ে। সে কেমন নিস্তেজ হয়ে পড়ছিল—মৃত্যুর বীভৎস ছবি তার চোখে ভাসছে। যারা এসেছিল—তারা যে-ভাবেই হোক তাকে খতম করবে। এই রাজবাড়িও সুরক্ষিত নয়। যেন কেউ সেই অনুসরণকারীদের ভূমিকা নিতে এই মূহুর্তে প্রস্তুত। তার কেমন দমবন্ধ হয়ে আসছিল। কুলুঙ্গির নিচে গিয়েও সে স্বস্তিবোধ করতে পারল না—তবু সে বলল, আমি শেষ হয়ে যাব বনি। আর্চির অশুভ প্রভাবই শেষ পর্যন্ত জয়লাভ করেছে।

এবং এ-সব নিষ্ঠুর ক্রিয়াকলাপ, যেন গলার কাছে সে ক্ষুরের ধার টের পাচ্ছে। সে গলায় হাত দিল। তার গলার কাছে ক্ষুর তুলে ঠিক কণ্ঠনালী চেপে ধরেছে কেউ—সে দম নিতে পারছে না। তার চোখ বড় হয়ে যাচ্ছে। ঘোলা হয়ে যাচ্ছে। সে কী নিজেই তার গলা টিপে ধরেছে। গলা না বুক। বুকে এত যন্ত্রণা কেন। কেমন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। আততায়ীরা তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। গাছে বেঁধে ফেলছে—এবং মুহূর্তে চারপাশ তার অন্ধকার হয়ে যেতে থাকল। সে কোনো রকমে তক্তপোশ ধরার চেষ্টা করছে, পারছে না। সে পড়ে যাচ্ছে। গভীর অতল গুহার মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। পড়ে যাচ্ছে। চিৎকার করে উঠল, পারল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *