1 of 2

ঈশ্বরের বাগান – ৪৭

।। সাতচল্লিশ।।

গহর রাজবাড়ির দিকে গাড়িটা ঘুরিয়ে দিল। সামনে বিশাল লোহার দরজা।

গাড়ি ঢুকতে চায়, কার গাড়ী সাদেক চেনে না, তবু গাড়ি প্যাঁক প্যাঁক করলে সে বন্দুকের নলে হাত রেখে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। বাঁহাতে বন্দুক বগলে করে ডান হাতে দরজা খুলে দিতে ছোটে। গাড়ি ভিতরে ঢুকে গেলেই স্যালুট।

ফতিমা গাড়ি থেকে নেমে সোজা কিছুটা হেঁটে গেল। সে রাজবাড়ির আদব-কায়দা কিছু জেনে গেছে। গাড়ি নিয়ে অন্দরে যাওয়া যাবে না। একমাত্র বউরাণীর গাড়ি ছাড়া অন্য গাড়ি অন্দরে ঢোকার নিয়ম নেই। টেনিস কোর্টের পাশে গাড়ি পার্ক করার জায়গা—পাশে মাধবীলতার একটা কুঞ্জ আছে। তারপর দু-তলা লম্বা টানা মেসবাড়ি—নিচে এক প্রস্ত লোক থাকে, উপরে এক প্রস্ত। নিচে কয়লার উনুনে আঁচ দিচ্ছে কেউ। নতুন বাড়ির জানালায় দেখল, তাকে কেউ দেখছে। আসলে ফতিমা এত লম্বা আর এমন চোখ-মুখ এবং লাবণ্যভরা যে সে রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে মশামাছি পর্যন্ত উড়ে যেতে চায় না। বসে থাকে—অদ্ভুত জানালায় বাবুটির মুখ দেখে এমনই মনে হলো। ঠোঁট চেপে হাসল। লোকটা কে? কালো-ডুসমা, মোটা গোঁফ, বয়স ত্রিশ-বত্রিশ হতে পারে—সে ঘাড় ফিরিয়ে দেখল। লোকটা এক জানলা থেকে অন্য জানালায় এসে দাঁড়িয়েছে। সে কোথায় যায় লক্ষ্য রাখছে। এটা অবশ্য এখানে নয়, সর্বত্র। হঠাৎ মনে হলো ফতিমার, অযথা রাগ করছে—তার মার্জিত রুচিবোধই পুরুষ মানুষকে সম্ভবত আকর্ষণীয় করে তোলে। তার হাঁটার ছন্দ আছে কিংবা শরীরে পদ্মপাতার মতো সুযমা—এটা সে রাস্তায় বের হলেই টের পায়, দেশে বিদেশে সব জায়গায়। যাই হোক, জানলাটা পার হলেই পাতাবাহারের গাছ—অহ, সোনাবাবু, টুটুল মিণ্টু।

সে সিঁড়িতে উঠে দরজায় কড়া নাড়ল।

সঙ্গে সঙ্গে দুপদাপ, এটা পড়ছে, ওটা ভাঙছে—কে আগে এসে দরজা খুলবে—এবং মিণ্টু যেন কাকে বলছে, তুমি না আমি। দরজা খুলে দেখো! তারপরই ঝপাং শব্দ। মিণ্টু দরজায় ঠেস দিয়ে বোধহয় দাঁড়িয়েছে। ফতিমা বাইরে থেকে কিছু বুঝতে পারছে না।

কে? মিণ্টুর গলার স্বর ফতিমা বুঝতে পারছে।

পাকিস্তানের পিসি। দরজা খোল।

সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে গেল না। দরজায় তালা দেওয়া ভিতর থেকে। দরজা খুলতে মিণ্টুর দেরি হচ্ছে।

কিরে দরজা খোল। ফতিমার যেন তর সইছে না। সুখিদি কোথায়?

দাঁড়াও, খুলছি। সুখিদি যে তালা দিয়ে রাখতে বলল।

সুখিদি কোথায়? তালা দিয়ে রাখতে বলেছে কেন?

মালিপাড়ায় গেছে। আমাকে বলল, মিণ্টু তালা দিয়ে দে। টুটুলকে সামলাতে পারবি না। আবার পালাবে!

টুটুল দিদির পিঠে দুমদাম করে কিল বসাচ্ছে।—আমি পালাই। তুই পাকিস্তানের পিসিকে বলেছিস আমি পালাই। না পিসি, আমি পালাই না। দিদি মিছে কথা বলছে।

মিণ্টু তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে চাবি গুলিয়ে ফেলছে। সে খুলতে পারছে না।

ফতিমার কেন যে মনে হলো, টুটুল মিণ্টু সত্যি যেন অনাথ। অনাথ শিশুদের জন্য তার মায়া হয়। এই দুই শিশু যেন সোনাবাবু আর সে। সেই শৈশব ছেড়ে এসে, খোলামেলা আকাশ, ঘাস, কীটপতঙ্গ ফেলে এসে এই এক অন্ধকার পুরানো ভাঙ্গা নোনাধরা ইট বালি খসা বাড়িতে ঢুকে গিয়ে বন্দী হয়ে আছে তারা। দুই শিশুকে বন্দী রেখে নিজের শৈশবের উপর প্রতিশোধ নিচ্ছেন সোনাবাবু এরা জানেই না, সেই গভীর গম্ভীর প্রকৃতির ভিতর, হাসান-পীরের দরগা কিংবা আরও দুরে গোপেরবাগ গেলে, বিশাল এক অরণ্য কিংবা কবিরাজবাড়ির মঞ্জুদের সেই পুকুর এবং তার চারপাশে কত গাছ, কবিরাজি ওষুধে লাগে—কিংবা কাছারি বাড়িতে জাম্বুরা কমপিটিশন, ফতিমার কাজ ছিল, জাম্বুরার খবর দেওয়া। মতির মা কোথায়, বাড়ি না মাঝিবাড়ি গেছে তার খবর দেওয়া সোনাবাবুকে। অথবা ঘোড়দৌড়ের মাঠে, কিংবা মেলায় বান্নিতে বাবুটিকে সঙ্গে নিয়ে তার নিখোঁজ হয়ে যেতে ভাল লাগত ঈশম চাচা খুঁজে বেড়াচ্ছেন, মেলায়। খুঁজে বেড়াচ্ছেন মন্দিরের পেছনে করবী গোটার জঙ্গলে।

সোনাবাবু গেলেন কই? ঈশম হাঁকছে।

আর তখনই তালা খুলে দুজনেই ঝাঁপিয়ে পড়ল। টুটুলের নাকে সর্দির পোঁটা। গায়ে জামা নেই। শীত পড়তে শুরু করেছে। কী আক্কেল রে বাবা! সুখিদির কি মায়াদয়া নেই! বাচ্চা দুটোকে এ-ভাবে কেউ ফেলে রেখে যায়! খালি গা টুটুলের। সর্দিতে ভড় ভড় করছে। ঋতু পরিবর্তনের সময়। সোনাবাবুই বা কেমন! যাবার সময় বলে যাবে না! সারা বাসাটা কেমন শুনশান। অন্দরমহলের এদিকটা একেবারে নির্জন। কিছু হলে শত ডাকাডাকিতেও সাড়া পাবে না কেউ। ভিতরে ক্ষোভ-জ্বালা এবং অতিশয় এক উষ্ণতায় নিজেকে স্থির রাখতে পারল না। টুটুলকে কোলে তুলে নিয়ে বলল, নাকে পোঁটা—এ্যাঁ —ঘেন্নাপিত্তি নেই। আজ আর আপনি আপনি করতে পারল না ফতিমা। বলে বাঁ হাতে নাকের পোঁটা ঝেড়ে সামনের বাথরুমে ঢুকে গেল। হাত ধুল তারপর আঁচল দিয়ে মুখ মুছিয়ে দিল। টুটুলও কী বোঝে আশ্চর্য উষ্ণতা রয়েছে পিসির শরীরে! সে একেবারে শরীরের সঙ্গে মিশে গেছে। বুকের ভিতর মাথা গুঁজে দিয়েছে।

ফতিমা বলল, মিণ্টু, তুই ভাইকে জামা পরিয়ে দিতে পারিস না। কাশছে।

ফতিমা করিডরে ঢুকেছে, বাথরুমে ঢুকেছে—আর বেশি ভিতরে ঢোকা কতটা ঠিক হবে বুঝতে পারছে না। যেন আজও তার সিঁড়িতে বসে থাকাই উচিত ছিল। সে ভেবেছিল, সিঁড়িতে বসেই বলবে, সুখিদি চলো। তোমাদের নিয়ে একটু ঘুরে আসি। সুখি যে এ-বাড়ির কাজের মেয়ে সে টের পেয়েছে। কিন্তু সুখিদির আচরণে নিজের আত্মীয় গোছের ভাব। সেটা সে ভাঙতে চায় না। এতে আহত হতে পারে সুখিদি। সে টুটুলকে খালি গায়ে দেখেই স্থির থাকতে পারেনি। মেজাজ গরম। টুটুল কথা বলছিল, আর কাশছিল। নাকের পোঁটা ঝুলছে।

করিডরে দাঁড়িয়েই বলল, টুটুলের জামা দে তো মিণ্টু।

মিণ্টু পিসির হাত ধরে বলছে, ভিতরে এসো না পিসি।

তুই নিয়ে আয় না।

না, ভিতরে এসো!

তোর বাবা এসে আর একটা কান্ড বাধাক! নিয়ে আয় না। বড়রা বললে কথা শুনতে হয় জানিস।

টুটুল কোল থেকে কিছুতেই নামবে না। সে আঁকড়ে ধরে আছে পিসিকে।

বাবা কী বলেছে জানো? মিণ্টু না বলে থাকতে পারল না।

কি বলেছে?

হাত ধরে ভিতরে টেনে আনতে পারলি না পিসিকে, বাইরে বসিয়ে রাখলি! ভিতরে না এলে জানো, বাবা খুব রাগ করবে!

করিডরের দরজা থেকেই ফতিমা উঁকি দিল। রাজার কারখানার ম্যানেজার, তার এই হাল! খালি তক্তপোশ। তোযক চাদর উল্টে রাখা। দাপাদাপি করলেও তোষক চাদর নোংরা হবে না। সারা দিনমানের জন্য দুই শিশুর কারাগারটির বন্দোবস্তু বেশ। ঘর পার হলে সামনে দরজা। পরের ঘরটার আংশিক চোখে পড়ে। ও-ঘরের শেষ দেয়ালে একটা ছোট জানালা। তাও আবার অনেক উঁচুতে। একটা টুলের উপর দাঁড়ালে জানালার ও-পাশে কী আছে দেখা যেতে পারে। শেষ ঘরটায়ও একটা তক্তপোশ আছে। দুটো কালো রঙের ট্রাঙ্ক এ-ঘরের তক্তপোশের নিচে। একপাশে আলনা। কিছু জামাকাপড়। মেঝে চটাঠা। সিলিং এত উঁচুতে যে ফ্যানের রড বেশ লম্বা। ঝুলকালি লেগে ব্লেড নোংরা হয়ে আছে। বাবু বিবি আছেন তবে বেশ মেজাজে।

মিণ্টু হাত ধরে টানছে।

—এসো না। দাঁড়িয়ে থাকলে কেন!

তোকে তো বললাম, টুটুলের জামা দিতে। বলেই কপালে হাত রেখে দেখল, যদি জ্বর-জ্বালা হয়! না, টুটুলের গা বরফের মতো ঠান্ডা। সে আঁচল দিয়ে টুটুলের গা ঢেকে দিল। ঘরে ঢুকতে সংকোচ হচ্ছে।

স্বভাব। সে তো আর বিদেশে নেই—তার সেই অহঙ্কারও যেন নেই। সে কেন যে ভিতরে ঢুকতে সাহস পাচ্ছে না। সোনাবাবু তাকে রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছিলেন। সোনাবাবু চান না এতদিনের সংস্কার ফতিমা এক লহমায় চুরমার করে দিক। কিন্তু মিণ্টু যে বলল, ভিতরে না ঢুকলে সোনাবাবু রাগ করবেন। তবে সেদিন নিয়ে এলেন না কেন! সোনাবাবুর মর্জি সে ঠিক তখনও বুঝে উঠতে পারত না। বিশ-বাইশ বছর বাদে দেখা হবার পরও বুঝতে পারছে না।

ফতিমা টুটুলকে কোল থেকে নামিয়ে হাঁটু গেড়ে বসল। চুল এলোমেলো। মনে হয় স্নানটান হয়নি। চুল আঁচড়ে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে।

—ফতিমার কেন যে এত প্রশ্ন উঠে আসছে—

—সকালে কি খেয়েছিস?

—রুটি খেয়েছি। দুধ খেয়েছি।

—দুপুরে কি খাবি?

—দুপুরে কি খাবে মিণ্টু ঠিক বলতে পারল না।

—তোর বাবা কখন বের হয়েছে?

—আটটায়।

—বাজার কে করে?

—বাবা সকালে উঠেই তো বাজারে যায়।

—তোর মা কবে আসবে?

—বড়দিনের ছুটিতে মা আসবে। মা লিখেছে জানো, আমরা যেন ভাল হয়ে থাকি। বাবার কথা শুনি। মিণ্টু বলল।

—আর কিছু লেখে না?

—লেখে তো! জানো মা-র চিঠি না পেলে বাবা কেমন হয়ে যায়। একবার জানো বাবা না আমাদের না বলে কয়ে মা-র কাছে চলে গেছিল। আমরা সারারাত ঘুমাইনি। রাজবাড়ির সবাই ছুটে এসেছিল। হাসি কাকিমা আমাদের নিয়ে গেল।

না, আর কিছু শুনতে তার ভাল লাগছে না। সোনাবাবু এ দেশে এসে অথৈ জলে পড়ে গেছেন। মতি স্থির নেই। ঠিক হয়েছে! বোঝো, এখন কেমন লাগে। বেহেসতে চলে এলেন। এই দশা এখন। ঠিক হয়েছে! ফতিমা নিজের সঙ্গেই চোপা শুরু করেছে। তারপর সে কী ভেবে বলল, যা তো সুখিদিকে ডেকে আন। মিণ্টু ছুটে গেল। করিডর পার হয়ে ছুটে গেল দু-লাফে। টুটুলও বলল, আমি যাব দিদি। ফতিমা কিছুতেই কোলে ধরে রাখতে পারল না। করিডরের সদর দরজা খুলে ছুট।

ফতিমা একা। চোরের মতো গোপনে ঘরে ঢুকে দেখল, সামনের ঘরটায় এক কোণে টেবিল চেয়ারও আছে। কিছু বই। পাশে র‍্যাক। র‍্যাকের উপর একটা বই। ছাপার অক্ষরে বইটার উপর সোনাবাবুর নাম—অতীশ দীপঙ্কর ভৌমিক! সোনাবাবু লেখেন। গল্প উপন্যাস লেখেন! সে জানেই না খবরটা। উপন্যাসের নাম, ‘রক্তাক্ত দিনকাল’। সে বইটা খুলে দু-চার লাইন পড়ে রেখে দিল। একটা সাপ্তাহিক কাগজ—তাতেও সোনাবাবুর গুরুগম্ভীর গল্প। সে বই পত্রিকা জায়গারটা জায়গায় রেখে, করিডরে ফিরে এল।

এ-যেন কোনো দিনরাতের বহির্ভূত ছবি—অনড় অচল এক গহ্বর এবং অন্ধকার ব্যতীত আর কিছুই নেই এই বাসা-বাড়িটায়। শুধু চঞ্চল বালক-বালিকা থাকে—আপনমনে —খেলা করে বেড়ায়। তারাও নেই। গেল কোথায়! মুহূর্তে ফতিমা কেমন ঘোরে পড়ে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। কেমন ভুতুড়ে বাড়ি মনে হচ্ছে। টুটুল মিণ্টুকে একা রেখে যায় কোন সাহসে! কেমন দমবন্ধ ভাব। এত বড় দরজা জানালা, সামনে পাতাবাহারের গাছ, বাইরে নতুন বাড়ি, সব সবুজ বৃক্ষ, শুধু আমলাদের জন্য জরাজীর্ণ পুরোনো নোনাধরা বাড়িঘর। তারস্বরে কয়েকটা কাক ডেকে গেল। নিঝুম অন্তহীন নৈঃশব্দ তারপর। ফতিমা দেখল টুটুল ঢুকে গেছে একলাফে। পিসিকে জড়িয়ে ধরতেই ফতিমা বলল, মিণ্টু কোথায়?

সুখিদি না বাড়ি নেই!

কোথায় গেল!

সুখিদির মা বলল, কুম্ভ কাকার বাড়ি গ্যাছে।

কুম্ভ কাকা কে তোর?

বাবার সঙ্গে অফিসে যায়।

আর তোরা বাড়িতে থাকিস! তোদের কেউ নেই দেখছি! জামা আন। কোথায় জামা? কখন থেকে বলছি! জ্বরজ্বালা হলে কে দেখবে তোদের!

টুটুল তার জামা এনে দিলে ফতিমা পরিয়ে দিল। জামায় বোতাম নেই!

ফতিমার যত রাগ এখন সোনাবাবুর উপর। সত্যি অমানুষ! দেবদূতের মতো ছোট শিশুটির বুকে কান পেতে কি শুনল। ধুকপুক। এই এক একঘেয়ে শব্দ এবং প্রাণ তাজা থাকে, উষ্ণ রাখে শরীর। সে তার ব্লাউজের সেফিটিপিন খুলে, জামায় পরিয়ে দিল। হাঁটু মুড়ে প্যান্ট পরিয়ে জুতো বের করে আনল। সে যেন এই শিশুকে নিয়ে সত্যি কোথাও চলে যাবে অথবা তার মধ্যে গানের স্বরলিপি উঠে আসছে—অয়ি ভুবনমনোমোহিনী।

আর তখনই মিণ্টু হাজির। সুখিদি হাজির। তাকে দেখে কিছুটা বিব্রত। পাকিস্তানের পিসির এ-সময় আসাটা সুখি ভাল চোখে দেখছে না। সেদিনও অসময়ে এসেছিল। কাকার জন্য বসে থাকেনি। যাবার সময় বলে গেছে, আবার আসব। কাকার সঙ্গে সত্যিকারের কি সম্পর্ক তাও জানে না। মিণ্টু তার পাকিস্তানের পিসির গাড়ি আছে সবাইকে বলে এসেছে। পিসি, টুটুলকে মিণ্টুকে নিয়ে চিড়িয়াখানায় যাবে তাও বলে এসেছে।

সুখি বলল, দিদি, ওরা যাবে কী করে, কাকা তো বাড়ি নেই!

আপনে যাবেন সঙ্গে। ওদের ভাল লাগবে। আমি থাকব। গাড়িতে আর কতক্ষণ। বাবু আসার অনেক আগেই ফিরে আসতে পারব। কোথাও খেয়ে নেওয়া যাবে। মন মানছিল না, চলে এলাম।

কিন্তু দিদি, কাকা এসে বকাঝকা করবেন!

মিণ্টু বলল, হ্যাঁ করবে! বাবা কিছু বলবে না পিসি। বাবা তো বলে, তোদের কেউ নেই। তোরা দেখলিই না, আমরা কি দেখিনি পিসি?

তোদের বাবা যা দেখেছেন।

বাবা কি দেখেছে?

তোদের বাবা তো জানতেনই না, একা এভাবে ঘরে তালাবন্ধ করে থাকতে হয়।

সুখি বুঝল, ঠিক ধরে ফেলেছে। কাকিমা বার বার বলে গেছেন, ওদের একা ফেলে কোথাও যাবি না। কাঁহাতক ভাল লাগে। স্কুল থাকলে, ওদের স্কুলে দিয়ে এলেই তার ছুটি। সে তখন স্বাধীন। এর ওর বাসায় হয় গল্প, নয় কাবুলবাবুর ঘরে ঢুকে ফষ্টিনষ্টি করা—কাবুলবাবু কী চায় সে জানে—তবে সে যদি কিছু করে ফেলে, কাবুলবাবুর দোষ হবে না—কিন্তু আকর্ষণ বলে কথা! এবং শরীর বড় জ্বালায়। মাঝে মাঝে চুরি করে সে কাকাকেও দেখতে ভালবাসে। আসলে তার সাহস নেই, সে ভীত হয়ে পড়ে। তার এই ভীরু স্বভাবই তাকে আত্মরক্ষা করতে শিখিয়েছে। সে তো জানে—রাজবাড়িতে তবে ঢি ঢি পড়ে যাবে। রাজবাড়ি থেকে বের করে দিলে কাগে-রগে ঠোকরাবে।

সুখি বলল, আদা ছিল না দিদি, আদা আনতে গেছিলাম।

সুখি মিছে কথা বলল। এটা যে কত বড় অপরাধ সে বুঝতে পারছে।

সুখি তাদের ফেলে রেখে গেলে মিণ্টু খুশিই হয়। তখন ভাইয়ের উপর তার যত শাসন। ভাইকে শাসন করার এমন সুযোগ সে ছাড়তে রাজি না। বাবা এলে কখনও সে নালিশ দেয় না, সুখিদি বাড়ি ছিল না। তাদের ফেলে চলে গেছিল।

ফতিমা বলল, আপনি রেডি হয়ে নিন। সে ঘড়ি দেখে বুঝল, দশটা বাজে। এ-সময় রাস্তায় বেশ জ্যাম হয়। তবু চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় লাগতে পারে। ঘন্টাখানেকও লাগতে পারে। বেশিও লাগতে পারে। যাই লাগুক, দুই শিশুকে পাশে বসিয়ে, রেড রোড ধরে যাবার আগ্রহ তাকে পাগল করে দিচ্ছে।

গাড়ি রেড রোডে পড়তেই ফতিমা বলল, তোরা গান গাইতে পারিস?

যেন গাড়িতে তুলে আর দূরে সরিয়ে রাখা যায় না। আপনি না, তুমি না, একেবারে নিজের সন্তানের মতো দুপাশে দুজনকে বসিয়ে রেখেছে। স্নো, পাউডার মাখিয়ে, রিবন বেঁধে দিয়েছে মিণ্টুর। চুল আঁচড়ে ক্লিপ এঁটে দিয়েছে। টুটুলকে জুতো মোজা পরিয়ে ফিটফাট বাবু—এবং সর্দি মোছার জন্য রুমাল বের করে সহসা ফতিমা কেন যে বলল, এই, তোরা গান গাইতে পারিস!

মিণ্টু তক্ষণাৎ লাফিয়ে উঠেছিল, হ্যাঁ পারি।

টুটুল আরও বেশি জোরে বলে উঠল, আমিও পারি।

গা দেখি।

কী গাইব?

কেন গান?

গাইব পিসি?

গাইতে বললাম তো।

ধনধান্যে পুষ্পে ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা। তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা। গাইব? ঘাড় কাত করে ফতিমার দিকে সম্মতির অপেক্ষায় তাকিয়ে আছে মিণ্টু।

ফতিমা ওদের সঙ্গে গলা মেলাবার সময় বলল, না, ঠিক হচ্ছে না। আমি গাইছি, শোন। ফতিমা সত্যি আজ এক গভীর আনন্দময় জীবনের স্পর্শে সঞ্জীবিত হয়ে উঠেছে—সে হাত তুলে নামিয়ে বলল, এ-ভাবে কেমন। শুরু কর। আমি ধরিয়ে দেব।

এই শুরু—ধনধান্যে—বলে বেশ টেনে গানের সুরে অবিকল কোনো যাদুর মতো তন্ময়তায় ডুবে গিয়ে বলল, আচ্ছা, এবারে আমার গান—কেমন—

কী গান পিসি?

আমি বলছি, মন দিয়ে শুনবি। যেন ছাত্রদের পাঠ দিচ্ছে। মন দিয়ে মুখস্থ করবে।

ফতিমা চোখ বুজে ফেলল। করতলে তুলে নিল দুই শিশুর হাত। তারপর গাইল—অয়ি ভুবনমনোমোহিনী, অয়ি নির্মল সূর্যকরোজ্জ্বল ধরণী, জগতজননী…।

টুটুল দেখছে, মিণ্টু দেখছে। অবাক তারা। পিসি অঝোড়ে কাঁদছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *