1 of 2

ঈশ্বরের বাগান – ৪২

॥ বিয়াল্লিশ ॥

না, বইটার মাথামুণ্ডু কিছু বোঝা গেল না। শুধু কিছু দৃশ্য অতীশকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে। এটাই লাভ। ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের কার্ড পেলে সে সব বই দেখে না। আসলে দেখার সময় করে উঠতে পারে না। পোলিশ কিংবা চেক ছবি হলে তার গরজ আরও কমে যায়। ইংরাজি হলে তবু কোনরকমে বুঝে নিতে পারে, বাদবাকি খরচের খাতায়। বন্ধুরা বলেছে মিস করিস না। দারুণ বই। কারখানা থেকে বের হয়ে দারুণ বইটি দেখার জন্য তিনটেতে ঢুকেছিল। কার্ডখানা পকেটে আছে। বইয়ের নাম মনে রাখাও কঠিন। উচ্চারণ বিদঘুটে—তবু সে তার নিজের মতো নামকরণ করে নিয়েছে—অ আজার বালথাজার’।

বইটা শুরু হয়ে গেছিল। অন্ধকারে সে হলে ঢুকেছে। টর্চ হাতে কেউ তাকে বসার জায়গাটি দেখিয়ে চলে গেছিল।

নির্জনমতো জায়গা, খামারবাড়ির দৃশ্য—তারপর সেলুলয়েডে ভাসমান চিত্রাবলী এবং এক বালিকার মুখ। সাব-টাইটেল দেখে কাহিনী বোঝার মতো ধৈর্য্য তার নেই। মুশকিল, সাব-টাইটেল ভেসে উঠল, অর্ধেক পড়তে না পড়তেই মুছে গেল। আবার ভেসে উঠল। পড়তে না পড়তেই শেষ। সবটা পড়ে ওঠা যায় না। ফলে ছবিও দেখা হয় না। সাব-টাইটেলও পড়া হয় না। এ-সব কারণে সে সোজা ছবিটাই দেখে। যতটা উদ্ধার করতে পারে। এবং ছবিটার মধ্যে আশ্চর্য লিরিক আছে টের পায়। বিশেষ করে বালিকার মুখ যখন উঁকি দেয়, সেই ছেলেগুলি আসে, তারপর তাদের সঙ্গে কী করতে যে বের হয়ে যায়—কিংবা তাঁবু পড়েছে, একটা গাধাকে টেনে আনা হচ্ছে কেন বোঝে না। গাধা মঞ্চে উঠে পায়ে কী সব নাচ দেখাচ্ছিল। কেউ বলছিল অঙ্ক কষছিল। এসব শোনার কিংবা দেখার চেয়ে সেই বালিকা এবং প্রকৃতির সুষমার জন্য তার বেশি অপেক্ষা। বালিকার ফ্রক, নরম সরল সাদাসিধে চোখ এবং কখনও গভীর তরল হাসি—এসব তাকে টানছে।

বোধ হয় কোনো পরিত্যক্ত বাড়িতে ঢুকে গেল—কেন ঢুকল সে কিছু বুঝছে না। তারপরই সেই অমোঘ দৃশ্য—তার গা শিউরে উঠেছিল। লং সটে ছবিটা ক্রমে এগিয়ে এসে ঝপাস করে চোখে ভেসে উঠল—বালিকা না নারী উবু হয়ে পিছন ফিরে দেয়ালের পাশে বসে আছে। সম্পূর্ণ উলঙ্গ। দু-হাঁটুর ভিতরে মাথা গোঁজ করে মুখ লুকিয়ে রেখেছে। তার পিঠ, শিরদাঁড়া এবং হাপরের মতো শ্বাস প্রশ্বাসে পিঠের ওঠা নামা থেকে নিতম্বের গুরুগম্ভীর ভাঁজ স্পষ্ট। সঙ্গে রক্তের দাগ বোধহয় নাভিমূলে। বোধ হয় তাকে ধর্ষণ করে গেছে কারা। কিংবা কী কারণে এমন দৃশ্য সে ঠিক মগজে আনতে পারছে না। ওর ফ্রক প্যান্ট নিয়েও পালিয়ে যেতে পারে। বালিকা লজ্জায় মুখ দেখাতে পারছে না বলেই, কিংবা উলঙ্গ অবস্থায় তো আর ছুটে যাওয়া যায় না—অসহায় আর্ত অনিশ্চিত আশঙ্কায় পাঁচিলের আড়ালে বসে আছে।

হল থেকে বের হবার মুখে শুধু এই দৃশ্যটাই তাকে তাড়া করেছিল। অন্যমনস্ক। বালিকার নিতম্ব এত সাদা এবং পুষ্ট হয়! মানুষের প্রলোভন আকস্মিক কোনও দস্যুবৃত্তি থেকে কি! এরা তো বালিকার পরিচিত। কিংবা অপরিচিত এমনও হতে পারে—সে যাই হোক গল্পের মাথামুন্ডু নিয়ে তার কোনো ভাবনাই নেই—শুধু কষ্ট হচ্ছিল নারীর এই উলঙ্গ ছবি দেখানোর কী অর্থ থাকতে পারে।

আর তখনই মনে হল, কেউ সিঁড়ির মুখে ডাকছে। ভিড়। গুঞ্জন। সবাই ম্রিয়মান ছবি দেখার পর। এরা হয়ত সব বুঝতে পেরেছে। সে পারে না। তার নিজের এ জন্য বেশ অস্বস্তি আছে। তাড়াতাড়ি বের হয়ে যাওয়া দরকার—কিন্তু কে ডাকছে—সোনাবাবু। কে ডাকে! সোনাবাবু, সে তো নামটা গতজন্মে ফেলে এসেছে কোনো নদীর পারে। কে ডাকে!

—সোনাবাবু চিনতে পারেছেন না!

ঝকমকে এক যুবতী ত্রিশ পঁয়ত্রিশের। তার বয়সী। সে ঠিক বুঝতে পারল না। হাতে সোনার বালা। পরনে কটকি শাড়ি।

—আপনি সোনাবাবু না?

যুবতীর গলায় দ্বিধা, আশঙ্কা। সে ভুল করে ডাকেনি তো! যুবতীর কপালে নীল রঙের কাচের টিপ।

সে কেমন জলে ডুবে যাচ্ছিল।

সোনাবাবু, ধানের জমি, পাটের জমি, আতাফল, নদীর চর এবং তিলফুলের চাষ-আবাদ পার হয়ে নথ পরা এক বালিকা চোখে ভেসে উঠতেই সে বলল, তুই ফতিমা না?

—হ। যাউক ভুইলা যান নাই। ইস কী কমু আমার না বুকটা কেমন করতেছিল! কখন থাইকা দ্যাখছি। হলে ঢুইকা গ্যালাম। সাহসে কুলাইল না। যদি ভুল কইরা ফ্যালি।

সে কেমন চঞ্চল হয়ে উঠেছিল। অথচ সব আত্মগোপন করে বলল, তুই! আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, তুই ফতিমা, এখানে তুই, তোর সঙ্গে দেখা, না না… বলে সে তাড়াতাড়ি সিঁড়ি ধরে নেমে গেলে ফতিমাও নেমে এল। সামনে দাঁড়িয়ে বলল, কৈ যাইবেন। খাড়ন দেখি। ভাল কইরা দেখি।

সে মনে মনে বলল, অ আজার বালথাজার। কিছু বুঝছি না।

লোকজন ভিড়। ফতিমা সব ভুলে গেছে। ফতিমার যেন কোনো লাজ-লজ্জা নেই। সোনাবাবু তার সামনে দাঁড়িয়ে। ইচ্ছে হচ্ছিল, সেই তো! সারা গায়ে তার হাতের স্পর্শে টের পেতে চাইছে। দু-হাতে মুখের নাগাল পাবার চেষ্টা করছে। কী দীর্ঘকায়। সেদিনের খোকাবাবুটি, এত ছিমছাম! চোখ বড় বড় করে তাকে শুধু দেখছে। তারপরই হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে থাকল। বাইরে এসে গাড়ির দরজা খুলে বলল, বসেন।

অতীশ কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। একেবারে সব কিছু ঝকঝকে। বিদেশী গাড়ি, সোফার সাদা পোশাক পরে, মাথায় ফেজ টুপি। ভেলভেটের কাপড়ে মোড়া আসন। রিনরিন করে ভিতরে রবীন্দ্র- সঙ্গীত বাজছে।

অচানক ঘটনায় অতীশ কিছু বলতে পারছিল না। হতভম্ব। যেন ফতিমার হাতের খেলনাটি কেউ গোপনে চুরি করেছিল, তা আবার ফিরে পেয়ে সব কিছু ভুলতে রাজি। বাবুটিকে নিয়ে কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। কত কথা বলছে, বড় ঠাকুরের খোঁজ পাওয়া গ্যাছেনি! ধনমামা বাঁইচা আছেনি! রিনরিন করে বাজছে, কী বাজছে সে শুনতে পাচ্ছে না। কেবল সেই শব্দমালা ভেসে আসছে- অ আজার বালথাজার। অতীশ বোকার মতো পাশে বসে আছে। সেই ফতিমা—নাকে নথ, বাপের জমিতে ছাগল দিতে আসত। তাকে নিয়ে গোপাটে দৌড়ে যেত। ছুঁত না। ছুঁয়ে দিলে সোনাবাবুকে স্নান করতে হবে।

এই সেই ফতিমা, কত রঙের কাঁচপোকা সে সংগ্রহ করে রাখত। তারপর কলাপাতায় কাঁচপোকা বিছিয়ে গাছের ছায়ায় পাশাপাশি বসে বলত, কোনটা পছন্দ। দ্যাখ। রোদে বৃষ্টিতে তোর জন্য ধইরা আনছি।

—আরে ঠিক হইয়া বসেন। আমারে ছুঁইলে জাত যাইব না। পেঁয়াজ রসুনের গন্ধ নাই। দ্যাখেন! বলে ফতিমা হাত বাড়িয়ে দিতেই অতীশ বলল, তর চোপাখান দ্যাখছি কমে নাই।

—আমার চোপা! না আপনের! চিনতেই পারলেন না চাইয়া থাকলেন! ভূত দ্যাখলেন!

—ভূত ছাড়া কী! তুই আমারে কোনখানে নিয়া যাবি! তুই এখানে আইলি কবে! কোনখানে উঠছস!

—যামু যেখানে খুশি। ডর নাই। কি, পেঁয়াজ রসুনের গন্ধ আছে! কন কথা কন।

—তুই যে কইতি নিমপাতার গন্ধ, তখন বুঝি দোষ হয় না!

—ফতিমা হাতখানা বাড়িয়েই রেখেছে।

—আরে ঠিক হইয়া বসেন। পা দু-খান সামনে ঠেলে দেন। কিছু মনে রাখতে পারেন না। নিমপাতার গন্ধ কইতাম, না তুলসিপাতার গন্ধ!

—যাউকগা, আইজ আর কাইজা না। বলে আঁচলে মুখ মুছল। হাল্কা প্রসাধন—গাড়ির ভিতর বিদেশী আতরের ঘ্রাণ। ফতিমার শরীরেও। কত বছর পর। বিশ বাইশ বছর।

সে বলল, নাকে নথ না থাকলে চিনতে পারতাম না।

—আমি-অ।

—তুই আবার কী!

—তুলসিপাতার গন্ধ।

—ধুস তুই কি না। কোনখানে নিয়া যাবি! আমার গায়ে কী আর তুলসিপাতার গন্ধ আছে? অতীশের অজস্র প্রশ্ন। ফতিমার কথা আজকাল প্রায় মনেই পড়ত না। অথচ দেশ ছেড়ে এসে, ফতিমার কথা ভাবলেই চোখে জল চলে আসত। ফতিমা বলল, আছে। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। আমি জানতাম। ফতিমা জানতাম বলেই কী যেন ভুল করে ফেলল। যেন সোনাবাবুর সঙ্গে এ-ভাবে কথা বললে তাকে ঠিক চেনা যাবে না। সেই গোপাট, সেই অশ্বত্থ গাছ, বাস্তুপূজার প্রসাদ, কিংবা কাঁচালঙ্কার জমিতে হামাগুড়ি দিয়ে যাওয়া। বাপজান ডাকছে, ফতিমা তুই কোথায়! সোনাবাবু বলছে, এই, বাড়ি যা। তোর বাপজান মারবে। ফতিমা চুপি চুপি বলত, থামেন। কেবল কথা কয়। তাইন আমার কর্তা হইছ্যান।

সে বইটা জেমসে দেখতে এসেছিল। ফতিমা তাকে নিয়ে পার্কসার্কাসের দিকে যাচ্ছে। হাত বাড়ানোই আছে। প্রায় নাকের কাছে।

সে বলল, এই কী হচ্ছে! নামা হাত!

সোনাবাবু কথা না। আমাগ সোনাবাবু এ-ভাবে কথা কয় না। ফতিমা ভাবল। হাতে গন্ধ নাই ত!

আসলে দুজনেই দুজনকে আবিষ্কার করে এত অভিভূত—এত মুগ্ধ এবং এক অনাবিল রহস্যময়তায় ডুবে গিয়ে এমন এক প্রতিমা নিরঞ্জনের বাজনা বেজে উঠেছে যে, কেউ কিছুক্ষণ প্রথমে কোনো কথাই বলতে পারেনি। কথা শুরু হল একেবারে সেই শৈশবের আগ্রহ নিয়ে। ‘এই কী হচ্ছে’ এমন বললে যেন সোনাবাবু সত্যি যব-গমের খেতে আবার অদৃশ্য হয়ে যাবে।

অতীশ বলল, গাঁয়ে গেলে আমাদের বাড়িতে যাস? ফতিমা কথা বলল না। কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেছে। কোনোদিন আর সোনাবাবুকে খুঁজে পাবে সে স্বপ্নেও ভাবতে পারত না। সেই সোনাবাবুকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে। কত বছর পর পাশাপাশি দুজনে। তার দামী গাড়ির নীলচে গভীর অন্ধকারে সে অপলক সোনাবাবুর দিকে তাকিয়েছিল। গাড়ি ঢুকছে—গেটে দুজন পুলিশ। তারা দেখল আলম সাবের গাড়ি। ভিতরে তার বিবি আছে।

ফতিমা ঢুকেই দৌড়ে সিঁড়ি ভাঙছিল—অতীশ গাড়িতেই। অতীশ শুনতে পাচ্ছে, শুনছেন, আপনি কোথায়? কাকে যেন বলল, সাব কোথায়, তারপর দ্রুত আবার নেমে আসছে। সাঁজ লেগে গেছে আলো জ্বলে উঠছে। ফতিমা এখানে এমন একটা পশ এলাকায় থাকে! কলকাতায় আট দশ বছর হয়ে গেল অতীশ এসেছে, তবে এদিকটা সে এখনও ভাল চেনে না। থাকে রাজাবাজারের কাছে এক রাজবাড়িতে। অফিস, বাসা, নয়, কফি হাউসে আড্ডা। পাকিস্তানের পতাকা উড়ছিল। কেউ সেটা নামিয়ে নিচ্ছে। সামনে দেবদারু গাছ, আকাশে দুটো একটা নক্ষত্র।

সে নেমেই দরজা খুলে দিল। বলল, ডর নাই! ধইরা রাখুম না। উপরে উঠতে আইজ্ঞা হউক। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে দেখল তার বয়সী ছিমছাম মানুষ, পাজামা-পাঞ্জাবি পরনে। সদ্য রাথরুম থেকে স্নান-টান সেরে গলায় পিঠে পাউডার বুলিয়ে বের হয়ে আসছে।

ফতিমা বলল, বলুন কে!

ভদ্রলোক তার দিকে তাকিয়ে আছে। হাসছে। যেন এমন বোকার মতো প্রশ্ন করলে বুঝবে কী করে! কাকে সে সঙ্গে নিয়ে এসেছে! যেন এটা দাবি, চিনতে হবে। এত যার কথা শুনেছেন, তাকে দেখে চিনতে না পারলে ফতিমার যেন সম্মান রক্ষা হবে না। ভদ্রলোক মাথা চুলকে বললেন, জি আপনার সেই সোনাবাবু! গালে তিল আছে বলেছিলেন!

ফতিমা কেমন সুখে তলিয়ে যাচ্ছিল। চিনতে পেরেছে। তারই বয়সের যুবক মুখে তিল এবং চোখ মুখ শান্ত স্বভাবের—বর্ণনা যেন মুখস্থ হয়ে গেছিল আলম সাবের।

এ এক আপ্রাণ খেলা জীবনের। কখন যে কী হয়। ফতিমা ভুলেই গেছিল সেই ঠাকুরবাড়ি কিংবা বটবৃক্ষের কথা—কিংবা ছোঁয়াছুঁয়ি নিয়ে শৈশবে বাবুটির কত নাকানি-চোবানি! মঞ্জু ছিল তার শত্রুপক্ষ।

—আপনে ছুঁইয়া দিলেন আমারে!

—মিছা কথা কইস না ফতিমা।

—কমু একশ বার কমু। আসেন আমার লগে।

—না যামু না। সাঁজ লাইগা গ্যাছে, বাড়ি গেলে বকব।

—আইবেন না! এত কাছে। এক দৌড়ে যামু। এক দৌড়ে ফিরা আইবেন। আমারে দিয়া আসেন।

—তুই যা না! খাড়াইয়া আছি।

কথা কাটাকাটি কত অকারণ। ফতিমা চাইত বাবুটি তার সঙ্গে মাঠে নেমে আসুক, কিংবা গোপাটে। অথবা শীতের দিনে মটরশুঁটির জমিতে। গ্রীষ্মের তরমুজের জমিতে। নদীর চরায় আঁচল উড়িয়ে বাবুটির সঙ্গে তার ঘুরে বেড়াতে কী যে ভাল লাগত! সে তার জামগাছতলায় দাঁড়িয়ে দেখত বাবুটি মাঠ পার হয়ে খেজুরতলায় নেমে এসেছে কিনা! কিংবা জমিতে মাথায় কলাই করা থালায় ভাত নিয়ে যাবার সময়ও দেখত, বাবুটি কোথায়! সারাক্ষণ এই বাবুটির পোকার কামড়ে অস্থির থাকত। কখনও মাঠ পার হয়ে ঢুকে যেত টেবার জঙ্গলে। বুনো ফল তুলত। বাবুর হাতে দিয়ে বলত, খান। অক্লেশে খেত। তারপরই মুখে এক অসহায় ছবি।

—এই ফতিমা!

—কন।

—বাড়িতে কইস না কিন্তু

—কী কমু না।

—তুই আমারে ছুঁইয়া দিলি!

—ঠিক আছে কমু না। আমি যা কমু করবেন কিন্তু।

—ঠিক আছে করমু।

এই ‘করমু’ কখনও অগ্রাহ্য করতে চাইলেই ফতিমার এক কথা। খাড়ন মজা বুঝাইতাছি। বড়মামী, সোনাবাবু আমারে ছুঁইয়া দিছে।

হায় হায়, তুই ফতিমারে ছুঁইয়া দিছস! তরে লইয়া কী করমু। যা যা ঘাটে যা। ডুব দিয়া আয়। শীতের উত্তুরে হাওয়ায় সোনা কাঁপছে। হিমঠান্ডা জলে স্নান, সে কেন ফতিমাকে ছুঁয়ে দিলে ক্ষণিকের জন্য অচ্ছুৎ হয়ে যেত বুঝতে পারত না। তার কান্না পেত। তারপরই ফতিমাকে দেখলে পালাত। কখন যে ফতিমা রুষ্ট হবে বুঝতে পারত না।

কখনও লটকন ফল নিয়ে আসত কোঁচড়ে। বামুনের বাড়ি। তার নানী সঙ্গে আসত। আলগা থাকত সব সময়। বড়জেঠি পিঁড়ি বের করে দিত। কাফিলা গাছের নিচে বসে কত কথা বলত। বড়ঠাকুর কেমন আছে! দুইখান কুমড়ার লতা দিয়া গেলাম! জমির নতুন উচ্ছে উঠলে দিয়ে যেত। বাড়ির আতাফল হলে দিয়ে যেত। বড়ঠাকুর গিমাশাক খেতে ভালবাসে, নদীর চরা থেকে খুঁটে খুঁটে তুলে আনত গিমাশাক। ফতিমা থাকত সঙ্গে। তখন কী ভাল মেয়ে। কোঁচড়ে লটকন ফল। ভাঙছে আর খাচ্ছে। সোনাবাবু দেখছে, আর জিভে জল এসে যাচ্ছে। কিছু বলতে পারছে না। ফতিমার কাছে গেলেই ভয়। সোনা আবার তুই ফতিমার পিছনে লাগছস! কিন্তু কে বোঝায়, ফতিমা লটকন ফল নিয়ে এসেছে লোভে ফেলে দেবার জন্য।

কখনও বেথুন ফল। মেয়েটা ঝোপে জঙ্গলের কত খবর রাখে! চোখ টিপে দিলেই হয়ে গেল। সোনা ছুটে খেজুরতলায় চলে যায়। ঝোপে জঙ্গলে লুকিয়ে থাকে। ফতিমা পা টিপে টিপে হাঁটে। তারপরই সহসা জঙ্গল থেকে ভেসে উঠলে এক দৌড়। বাঁশ বাগানের ভিতর পড়ে গেলেই আড়াল।

—নেন ধরেন।

বলে লটকনের থোকা দু-হাতে তুলে জেব ভর্তি করে দিয়ে ছুট।

সোনাও ছুটছে।

প্রকৃতির মধ্যে তারা তো এভাবেই বড় হয়ে উঠেছিল।

নানী উঠে এলে ফতিমা জানে বড়মামী তুলসিপাতার জল ছিটিয়ে দেবে পিঁড়িতে। বড়ঘরের বারান্দার এক কোণে আলগা করে রেখে দেবে পিঁড়িটা। নানীও জানে ওটা তার পিঁড়ি। অন্য পিঁড়ি দিলে বলবে, আমার খান নাই! কোনো মানসম্মানের প্রশ্ন ছিল না। যার যেমন নিয়ম, ফতিমা দেখেছে, বাবা ঢাকা থেকে এলে খোঁজখবর নেবার সময় আগে ঠাকুরবাড়ির কুশল জানা চাই। বাপজান তো মাইজা কর্তার পরামর্শ ছাড়া এক-পা নড়তেন না।

অতীশ অবাক হয়ে গেছে ভিতরে ঢুকে। আশ্চর্য রুচিবোধ গড়ে উঠেছে মেয়েটার মধ্যে। সাজানো ড্রইংরুম। সেলফে কত বাংলা বই। বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র, নজরুল, জীবনানন্দ, রবীন্দ্রনাথ। সোনার জলে বাঁধানো সব বই, এত যত্ন এত স্নেহ মমতা। সাদা মোমের মতো আশ্চর্য পবিত্রতা ঘরের মধ্যে। ফতিমা রেকর্ড প্লেয়ার খুলে দিল। অতুলপ্রসাদের গান। ফতিমা বলছে, মূসলমানের বাড়ি কিন্তু। জাত যাইব না তো! লইয়া তো আইলাম। তারপর আলম সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল, বাবুকে একটু ঘুরে দেখান, গা ধুয়ে আসছি।

আশ্চর্য, অতীশ দেখছে, তার সঙ্গে কথা বলার সময় দেশের কথা, আর আলম সাহেবের সঙ্গে কথা বলার সময় কী সুন্দর মার্জিত ভাষা! বিশ বাইশ বছরে এত পরিবর্তন, সে কেমন বোকার মতো প্রশ্ন করে বসল, আপনি ঢাকার লোক?

আলম সাহেব বললেন, জি না? ঢাকার হতে যাব কোন দুঃখে। বীরভূমের লোক আমি।

—এখানে কতদিন!

—এই তো এলাম। বাইরে ছিলাম। কিছুতেই আসা হচ্ছিল না। আপনার দুষ্টু মাইয়াটার জেদ কলকাতায় পোস্টিং নিন। বললেই তো আর হয় না। সরকার চায় না, কলকাতার অফিসে বাঙালী বেশি থাকুক। তবে জানেন তো মাইয়াখানা চিজ বিশেষ। মাঝে মাঝে বাঙাল ভাষা ব্যবহার করে যেন বোঝাতে চাইছে—ফারাক নাই কোনো মিঞা। যেন বলতে চাইছে, এতদিনে ভাইসাব, কার খোঁজে তিনি কলকাতায় আইছেন আইজ সেটা টের পাইলাম।

ফতিমা গা ধুয়ে কলকা পাড়ের শাড়ি পরে বের হয়েছে। চুল উঁচু করে বাঁধা। সযত্নে আঁচলে গা ঢেকে রেখেছে। আলম সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলছে, জানেন, চিনতে পারে না। ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে আছে। বলছি, আমি ফতিমা, চিনতে পারে না। নিমকহারাম।

অ আজার বালথাজার।

অতীশ নিমকহারাম কথাটাতে কিছুটা বিব্রত বোধ করল। সে মাথামুণ্ডু কিছু বুঝছে না! বিশ বাইশ বছর পর বালিকা যুবতী হলে কে কবে চিনতে পারে! কত পরিবর্তন। মুসলমানের বাড়ি তা তার মনে আছে? মোরগা-মুরগি উড়ে যেত। গাঁয়ে ঢোকার মুখে মানুষের বিষ্ঠা। মোরগ-মুরগি পায়ের নখে খামচাখামচি করত। তারপর কী সব ঠুকরে ঠুকরে খেত। তাড়া খেলে সেই নোংরা পায়ে মোরগা মুরগি উড়ে গিয়ে চালে বসত। ঘরে ঢুকে যেত। ওর মনে হত, ইস ফতিমার ঘেন্না-পিত্তি নেই। কোলে মোরগ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেই সে আর কাছে যেত না। দৌড়ে পালাত। ছুঁয়ে দিলে যেন সত্যি জাত যাবে।

এমন একটা সাজানো গোছানো ফ্ল্যাটে ঢুকে অতীশ কিছুটা অস্বস্তি বোধ করছিল। তার বাসায় তিনখানা ঘর। সামনে করিডর। করিডর ধরে রান্নাঘরের ভিতরে ঢুকতে হয়। তারপর ও-পাশের দরজা দিয়ে গেলে বসার ঘর। শোবার ঘর। ঠিক বসার ঘর নয়—মা বাবা কিংবা কলোনি থেকে আত্মীয়স্বজনরা এলে ঘরটায় থাকে। দু-ঘরে দুটো তক্তপোশ। একখানা চেয়ার, একখানা টেবিল। দুটো ট্রাঙ্ক তক্তপোশের নিচে। স্ত্রী একটা স্কুলে কাজ করেন। কায়ক্লেশে চলে যায় তাদের। মা মাঝে মাঝে এসে থাকেন। কাজের মেয়ে সুখি সব সামলায়। না হলে বাচ্চা সামলানোর দায় তার।

আলম সাব সব ঘরগুলোই দেখিয়েছেন। বসার ঘর। ডাইনিং স্পেস। সানমাইকার বিশাল ডাইনিং টেবিল। সাদা চাদরে ঢাকা। সাদা প্লেট, সাদা রুমাল গ্লাসে গোঁজা। জলের রুপোর জগ মিনা করা। কারুকাজ করা ঢাকনা। যেদিকে চোখ যাচ্ছে পরিপাটি জীবন। আলম সাব বললেন, যাই বলুন, ঘটি বাঙালে মিশ খায় না। আমার বিবিজান বড্ড এলোমেলো স্বভাবের। বাঙাল আর কাকে বলে। এত ছিমছাম তার পছন্দ না। তবে ঘটি বানিয়ে ফেলেছি। এখন নিজেই সব দেখেশুনে ঠিক রাখে। আর জানেন তো, কী দজ্জাল স্বভাব! যা ভাবে তাই করতে হবে। এসেই এখানে বলেছিল, ঠিক খোঁজ পাব। কোথায় লুকিয়ে থাকবে! বের করল! ঠিক বের করল খুঁজে। ও নাকি কোঁচড়ে লটকন ফল নিয়ে ঘুরত!

—আরে না। ও তো হঠাৎ দেখা হয়ে গেল! অতীশ হেলান দিয়ে বসার সময় বলল। একটা গেস্ট কার্ড পেয়েছিলাম সেখানেই দেখা।

—দেখা না হলেও খুঁজে বের করত। ওকে আপনি তো ভালই চেনেন। দেশভাগের পরই নাকি আপনারা চলে এসেছিলেন। ও নাকি তখন ঢাকায় পড়ছে। ওর বাবা তো জানেন, সুরাবর্দি সাবের চেলা ছিলেন।

সোনার মনে হল, সে ফতিমার কোনো খোঁজখবরই নেয়নি। এটা ঠিক না! সে কিছুটা বিস্ময়ের গলায় বলল, সামুকাকা বেঁচে নেই!

ফতিমা হাজির। বলল, আসেন। সোনাকে নিয়ে টেবিলে বসাল। বলল, মুসলমানের ঘরে নাস্তা করলে জাত যাইব না তো!

অতীশ কিছুটা বিব্রত বোধ করছে।

—কিছু না। মিষ্টি শুধু। পানি হিন্দু মাইয়া জ্যোৎস্নারে দিয়া আনাইছি। অরে কইছি সব ধুইয়া মুইছা যেন দেয়। গঙ্গাজল লাগব নাকি! বৌদি জানলে গোসা করব না তো!

—খুব মজা করছিস না! অতীশ হেসে দিল। তারপর কেন যে মনে হল ফতিমার এই ক্ষোভ কিংবা আক্রোশ যেন স্বাভাবিক। সে বলল, আলম সাহেব ঠিক বলেছে। ঘটি বাঙালে মিশ খায় না। ফতিমার দিকে তাকিয়ে বলল, তর ভাবীরে দিয়া হাড়ে হাড়ে টের পাইতাছি।

ফতিমার আঁচল উড়ে যাচ্ছিল পাখার হাওয়ায়। সে তার আঁচল সামলে যেন কিছুটা আলগা হয়ে দাঁড়াল। বলল, ঘটিদের কথা ছাড়ান দ্যান। তাইন থাকে বাঙ্গালগ লগে। ঘটির গন্ধ কিছুতেই মুছতে দিবেন না। যদি কন বাড়ি কোনখানে—কইব বীরভূম। আরে বীরভূমে তোমার আছেড়া কে! কেবল চৈত্র মাসের বিশ্বভারতীর ছবি তেনার চক্ষে ভাইসা ওঠে। সোনার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনে বোঝান তাঁরে—দেশ একখানাই আছে—সেডা পদ্মা মেঘনার দেশ। মন জুড়াইয়া যায়। ঠাণ্ডায় পানি হইয়া যায়।

আলম সাব হাসছিলেন। বললেন, ভাইসাব সামলান। একবার শুরু হলে থামতে চায় না। অতীশ বলল, আমি কিছু খাব না। তুই কেন এত আনিয়েছিস সব বুঝি না। এ-সময় আমি কিছু খাই না।

—অ মুসলমানের বাড়ি। পেঁয়াজ রসুনের গন্ধ। আইচ্ছা কিছু খাইতে হইব না। বলে পাগলের মতো সব প্লেট তুলে নিতে গেলে সোনা ফতিমার হাত ধরে ফেলল। –তর মাথার ছিট গেল না! দে, জল দে। তুই দিবি। বাড়াবাড়ি করিস না। কবে আমার বাপ ঠাকুরদা কী করে গেছে, তার জন্য—! সে চোঁ করে জল এক গ্লাস খেয়ে বলল, আলম সাব, হাত লাগান। ও আমাকে আগের মতোই রাক্ষস ভেবেছে!

আলম সাব, ফতিমা, সোনা তিনজনেই খেয়ে নিল—ফতিমার চোখমুখ এখন কী শান্ত স্বভাবের। নিরীহ। আলম সাব মুখ মুছে বললেন, আপনারা গল্প করেন। আমি বের হচ্ছি।

ফতিমা বলল, না। বের হবেন না। আপনি থাকেন। আমি সোনাবাবুরে বাড়ি দিয়ে আসি। ভাবীর সঙ্গে আমার কথা আছে।

অতীশ বলল, আরে না না। তোর যেতে হবে না। আমি বাসে চলে যেতে পারব। আলম সাব ব্যস্ত মানুষ। তাঁকে আটকাচ্ছিস কেন!

ফতিমা কথা শোনার মেয়েই না। শুধু বলল, খুশি। ফতিমা নিজে গাড়ি চালাচ্ছে। সে পাশে বসে আছে। সোনার মুখে কথা নেই। কেমন কালো হয়ে গেছে! ফতিমা তার বাসার রান্নাঘরের ভিতর দিয়ে ঢুকলে, মা বলবেন, কেডারে। মাইয়াখানা কার? চিনা চিনা মনে লয়। সে কি জবাব দেবে! মাকে কী বলবে, ফতিমা, না প্রতিমা! কী বলবে সে!

কেন প্রতিমা, কেন ফতিমা নয়! জীবনের মাথামুন্ডুও সে কিছু বুঝছে না।

সেই সরল বালিকা বসে আছে পাঁচিলের পাশে মুখ গুঁজে। পিঠ দেখা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে উলঙ্গ শরীর। মুখ দেখা যাচ্ছে না। যাবতীয় পাপ থেকে মানুষের—মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে।

সে বলল, ফতিমা ভুল হয়ে গেল!

—কী ভুল সোনাবাবু!

—আমি তো বাসায় যাব না। কেউ নেই। তালা দেওয়া। তুই বরং আমাকে কফি-হাউসে নামিয়ে দে।

সহসা সারা মুখ ফতিমার তিক্ততায় ভরে গেল। গাড়ি ঘ্যাচ করে থামিয়ে দিয়ে বলল, নামেন। নামেন গাড়ি থাইকা। নাইলে লোক ডাকাডাকি করমু।

ধর্ষণের ছবিও এ-ভাবে নারীর মুখে ফুটে ওঠে না! ঘৃণা—এবং আকস্মিকতাই মানুষকে কখনও খন্ড-বিখন্ড করে দেয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *