1 of 2

ঈশ্বরের বাগান – ৪১

।। একচল্লিশ ॥

কুম্ভ ভাবল সে ক্রমশ জয়লাভ করছে। শুয়োরের বাচ্চা ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির। দু-নম্বরী মাল দিবি না দ্যাখ কত ধানে কত চাল—পচা টাকার গন্ধ পাস, দ্যাখ কত পচা টাকা জমছে। রাজাকে পাইয়ে দিলাম।

সে সিগারেটের ছাই ঝাড়ল, বেশ তুড়ি মেরে। পে-বিলটা বন্ধ করে ঠেলে দিল। বাঁধানো সোনার দাঁতটা ক’দিন থেকে জ্বালাচ্ছে, ডেনটিস্ট দেখাতে হবে। একটা ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে—তা হোক, খেলা জমিয়ে তোলা গেছে। কোম্পানির দু লাখ টাকা আবার রাজার। ঘটিতে জল ঢেলে ঘটি খালি করে দেওয়া। রাজার কারখানা, তার যা খুশি করবে। তোর এত শুঁচিবাই কেন! তোকে দিয়ে সই করিয়ে দেখাব, তুই বেটা কতদিন বউরাণীর পেয়ারের থাকতে পারিস। আসলে অর্থ, অর্থ বড়ই মহাভুজঙ্গ —অর্থের অষ্ট-প্যাঁচ। বোর্ড-মিটিং হয়ে গেলেই চেকখানা ধরিয়ে দিতে হবে রাজাকে।

সে সুন্দর হস্তাক্ষরে লিখল, রায় এ্যান্ড রায়। ব্যাংকে রায় এ্যান্ড রায়ের নামে একাউন্ট খোলা হয়ে গেছে। প্যাড রাবার স্ট্যাম্প সব সে করে নিয়েছে। প্রাইভেট লিমিটেড—তার একজন ডিরেক্টর সে নিজে। টাকাটা তুলে গুণে রাজার হাতে দিতে পারলেই বিশ্বস্ত কে বোঝা যাবে! যে দেয়, না যে দেয় না! বউরাণী কতদিন রক্ষা করে তোকে দ্যাখ। দুনিয়ায় শালা কালোটাকা কে না চায়!

সে চেকটা লিখে অতীশবাবুর ঘরে ঢুকে গেল সই করানোর জন্য। চেয়ারে অতীশবাবু নেই। সে বেল টিপে দিলেই সুধীর হাজির। অতীশবাবু সই না করলে চেক সাদা কাগজ সমান।

—বড়বাবু কোথায়?

—জানি না তো।

বাথরুমে নেই ত! বের হয়ে গেলে সুধীর ঠিক দেখতে পেত। ভিতরেই আছে। ঘরে এটাচ্‌ড বাথ বাইরে থেকে বন্ধ।

কি ব্যাপার!

কুম্ভ বলল, –– কোথায় গেল জানিস না!

—দেখিনি বাবু।

—তুই ছিলি না এখানে?

সুধীর বোকার মত তাকিয়ে আছে। কথা বলছে না।

কুম্ভর মাথায় রক্ত উঠে গেল। বলল, উজবুক। কি করছিলি! বড়বাবু কোথায় গেল! বলতে বলতে কুম্ভ সোজা প্রিন্টিং রুমে ঢুকে গেল। মেশিনে প্লেট লাগানো হচ্ছে। ছুরি দিয়ে কৌটা থেকে রঙ বের করছে প্রিন্টার। তাকে দেখে কাজে খুব মনোযোগ।

সে প্রিন্টারকে কিছু বলল না। অতীশবাবু প্রিন্টিং রুমে নেই। থাকলে দেখতেই পেত। সে ফিরে যাবার সময় কি মনে করে ঘুরে দাঁড়াল। কেউ যদি দেখে থাকে। ব্লকম্যানকে বলল, বড়বাবুকে দেখেছ?

—ঘরেই তো ছিলেন।

—নেই।

বের হয়ে গেলে সেও দেখতে পেত। তার ঘরের পাশ দিয়ে শেড থেকে বের হবার রাস্তা। বস্তির দু’পাশে দুটো শেড। এদিকের শেডের সামনে লাল রোয়াক। দারোয়ান বসে থাকে রকে। সে বের হয়ে দারোয়ানকে বলল, বড়বাবু কি বের হয়ে গেল!

দারোয়ানও কিছু বলতে পারছে না। বেটারা সব উজবুক। কোথায় যাবে! ও-পাশের শেডে যেতে পারেন। অফিসে এসেই একবার দু’পাশের শেড ঘুরে দেখেন। পরে বিশেষ আর যান না। টিফিন টাইমের পর জরুরী কাজ না থাকলে কোনো কারণেই যান না। ঐ সকালবেলায় রাউন্ড। দরকারে সুপারভাইজার ছুটে আসে। হয় তার, না হয় অতীশবাবুর পরামর্শ নিয়ে যায়। বেলটিন পড়ে যাচ্ছে, মোটর চলছে না, ডাইস খারাপ, কামড়ি খুলে যাচ্ছে, কিংবা ঢাকনা লুজ—এসব সমস্যা দেখা দিলে তারই কাজ বিধিমত ব্যবস্থা নেওয়া। অতীশবাবু তাকে বিশ্বাস করে না। চোর ছ্যাঁচড় ভাবে। সে নিজের গুরুত্ব প্রমাণের জন্য অনেক সময় জেনেও চুপচাপ থাকে। ইচ্ছে করেই এড়িয়ে যায়। এ-লাইনে ভাল মিস্ত্রি পাওয়া খুব কঠিন। কুম্ভ আট-দশ বছর কাজ করে সব ধরে নিয়েছে। সে চায়, অতীশবাবু তার উপর নির্ভর করুক। ফলে ল্যাজে খেলানো তার স্বভাব। ঠিক এ সময় এমন কি দরকার পড়ে গেল যে তিনি পাশের শেডে ঢুকে যেতে পারেন। সে কিছু জানে না, অথচ অতীশবাবু অসময়ে দু-নম্বর শেডে!

অবাক! সেখানেও তিনি নেই। সে ঘড়িতে দেখল চারটে বাজে। বোর্ড-মিটিং সাড়ে পাঁচটায়। সনৎবাবুর আসার সময় হয়ে গেছে। এসেই বোর্ড-মিটিং-এর খাতাটা বের করে দিতে বলবেন। সব ভাউচার বের করে দিতে বলবেন। মিনিট বুক থাকে অতীশবাবুর লকারে। চাবি তার কাছে, অথচ আশ্চর্য সেই লোকটাই উধাও। দু-নম্বর শেডেও নেই।

ধুত্তোরি, আমার কি দায়! বলে কুম্ভ হাঁক ডাক শুরু করে দিল, আরে বড়বাবু কোথায় গেল! কোথাও নেই। দেখত বাজারের দিকে গেছে কি না! সনৎবাবু এসে তো লম্ফ-ঝম্ফ শুরু করে দেবে। ছিটেল লোককে মাথার উপর বসিয়ে রাখলে দ্যাখ কি হয়! বোর্ড-মিটিং, আসল মানুষটাই বেপাত্তা!

কুম্ভবাবুর ঘরে প্রিন্টার ঢুকে বলল, বড়বাবুকে পেলেন?

—না।

—কোথায় যাবে!

—কে জানে কোথায় গেছে! বোর্ড-মিটিং, তুই হাওয়া!

—আসবে। এসে যাবে। কোথাও গেছেন।

—গেলে কেউ দেখতে পাবে না। কখনও তো না বলে যান না। তুই ম্যানেজার, কত রকমের উৎপাত শুরু হয়েছে জান? ম্যানেজার খুন হচ্ছে। নকশালরা আগে পুলিশ খুন করত এখন ম্যানেজার খুন হচ্ছে। এই তো সেদিন দমদমে ম্যানেজার খুন হল প্রকাশ্য দিবালোকে। কেউ কিছু করতে পারল! আমার আগে গেলেও মরণ, পিছুলেও মরণ।

এমন বিপাকে পড়ে যাবে কুম্ভবাবু বুঝতেই পারে নি—সত্যি যদি ভয়ে পালিয়ে যায়, চেকে সই করবার ভয়ে পালিয়ে যায়—পালিয়ে যেতেই পারে—সে তো জানে, দু-নম্বর মাল নিয়ে লড়ালড়ি কম হয় নি—কিন্তু নোয়ানো গেল না। তার প্যাঁচ খেলা এবারেও ভোকাট্টা হলে মাটিতে পা রাখার জায়গা থাকবে না। রাজার বাপ-ঠাকুরদার আমল থেকেই কারখানা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে, উঠে যায়নি, তাপ্পি- তুপ্পি মেরে চলে যাচ্ছে, টাকা ঢাললেও যা, না ঢাললেও তাই। ইন্ডিয়ান অয়েলের বাতিল কেনেস্তারা মেশিন কিনে কোম্পানির অ্যাসেট বাড়ানো গেল। মেশিন দেখিয়ে ব্যাংক থেকেই পাঁচ সাত লাখ টাকা থোক পাওয়া যাবে। কুমারবাহাদুরের টাকা গচ্চা যাবে কেন, সে কত ভাবে! এবং রাজার জন্য এত দরদ যে সারারাত ভেবে ফন্দিটা বের করেছে—কুমারবাহাদুর একটা কথাই বলেছেন, তোমার ম্যানেজার রাজি হবে না।

রাজার মুখের উপর কে কথা বলতে পারে! কুম্ভ উঠে এসেছিল। তার অন্য সূত্র আছে। সেই সূত্রটিকে ক্ষেপিয়ে দেওয়া দরকার। সে চুপচাপ উঠে কাবুলের খোঁজাখুঁজি করছিল। সূত্রটি কাবুলবাবু সকলে নতুন বাড়িতে ঢুকে দরজা ঠেলে বলেছিল, মাইরি দিন দিন রাজবাড়িটা হচ্ছে কি? রাজার কি মতিগতি!

—কি হচ্ছে? বোস! এত ক্ষেপে আছিস কেন?

—আর ভাই ক্ষেপে আছি সাধে! এত করে ফন্দি বার করে দিলাম, বললাম, মেশিনটা ঘরে তুলতে পারলেই ব্যাংক লোন পাওয়া যাবে, ক্যানেস্তারা মেশিনটা ডিরেক্ট সিট মেটাল পারচেজ করছে না। ফিকটিসাস রায় এ্যান্ড রায় কোম্পানির নামে পারচেজ হচ্ছে ফালতু দু-আড়াই লাখ টাকা তোর দাদাকে কে দেয়! বলে কি না, তোমার ম্যানেজার রাজি হবে না। বল এরপর কিছু করতে ইচ্ছে করে! কে কার চাকর বুঝি না ভাই।

—করিস না।

—শোন শালা, বাবুটি খাবে। তোমাদের সব খাবে। যা খুশি তাই করে। রাজবাড়িতে জন্মেছি—এতটা বয়স হল, কবে কে দেখেছে, রাজার ঘরে জুতো পরে যেতে! তোর দাদা কিছু বলে না ঠিক আছে, বাবা বলেছিলেন, আমি বলে দেব, তোমার দাদার এক কথা, না বলবেন না। এখনকার ছেলে ছোকরা, এরা নাই মানতে পারে। তারপর থেমে বলল, নাই মানতে পারে মানে—কে কার চাকর! তোর দাদা পাঁঠা, বুঝলি শালা, তুমিও পাঁঠা। দ্যাখ তোদের কি হয়।

কাবুল, এমনিতেই অপ্রসন্ন অতীশবাবুর ওপর। অন্দরের লাগোয়া কোয়ার্টার, কোথাকার গুরুঠাকুর রে তুই, এত তোর র‍্যালা, আর তখন কুম্ভ বলে গেল, তোদের সব যাবে কত ঢালবি কারখানায় ঢাল, আমাদের কি, বলে কিনা, রাজার এত খাবে কে? আরে তোর তা দিয়ে কি দরকার! গোলাম রাজবাড়ির, গোলামের মতো থাকবি। তারপর কাবুল খেতে বসে উসকেছে কুমারবাহাদুরকে। কুমারবাহাদুর বলেছেন, কি হবে ঝামেলা বাড়িয়ে।

অফিস সুপার বলেছে, এ ভাবে তো হুজুর চলবে না। আপনার তো বিষয়-আশয় ধরে রাখতে হবে। অতীশ চেকে সই করবে না যদি বলেন, আজ্ঞে কিছু মনে করবেন না হুজুর—আমরা তো করছি। আমার কথা বলছি না, দেয়ালের কান আছে হুজুর। জানাজানি হয়ে গেলে বিষয়-আশয় বড় মন্দ ঘটনা হুজুর। কে কিভাবে নেবে, যদি আপনার হুকুমের মর্যাদা না থাকে, তবে লাট বেলাট যেই হোক—তার থাকা ঠিক না।

এবং এ-ভাবেই বিষয়-আশয় হুকুম এবং রাজার বাড়ির কবুতর উড়িয়ে দিয়ে কুমারবাহাদুর বউরাণীকে বলেছিল, তোমার দ্যাশের পোলাকে বল, সইটা যেন করে দেয়। এত ছুঁৎমার্গ থাকলে বাঁচবে কি করে! আরে তুই তবে শহরে এলি কেন? কোথায় নেই—কি বংশরে বাবা—কে তোর কারখানার দু-নম্বরী মাল নিয়ে ভেজাল তেল বাজারে ছাড়ে তাতে তোর কি! পুলিশ! সরকার! ও তো সব হাম্বাগ! পয়সা ছুঁড়ে দিলে জুতো কামড়ে তুলে নেয়। এদের তোর ভয়। আইনের ভয়! আইন! তারপরই হা হা করে হেসে উঠেছিলেন কুমারবাহাদুর! বউরাণীকে বলেছিলেন, মরবে, বুঝলে তোমার দ্যাশের পোলা মরবে। যে নিজে না বাঁচে তাকে কে বাঁচায়। তুই না সমুদ্রে ঘুরে বেড়িয়েছিস!

আর তখনই কেমন ক্রুদ্ধ এবং অপমানিত বউরাণী ফোনের কাছে উঠে গিয়ে বলেছিল, সিটমেটালে দিন।

কুমারবাহাদুর সিঁড়ি ধরে নিচে নামার সময় শঙ্খকে বললেন, সনৎবাবুকে বল আমি বের হচ্ছি। শঙ্খ ফাইলপত্র গাড়িতে রেখে এসেছে। কুমারবাহাদুর হেড অফিস হয়ে সিটমেটালে যাবেন। আর তখনই রাজার প্রাইভেট অফিসে ফোন। কুম্ভর ফোন। সনংবাবুকে চাইছে। নধরবাবু বলছে—স্যার আপনার ফোন।

সনৎবাবু রাজার বিষয়-সম্পত্তির মধ্যে ডুবে ছিল—

পার্কস্ট্রীটের বাড়ি নিয়ে গন্ডগোল, দলিল কপি করাচ্ছেন—টাইপ হচ্ছে, তিনি পাশে বসে কপির সঙ্গে দলিল মিলিয়ে দেখছেন, কোথাও এক বর্ণ ভুল হলে শিক্ষা-দীক্ষার অসম্মান। তা-ছাড়া বিশ্বাসী আমলা, কুমারবাহাদুর পড়ার ভান করবেন, উল্টে-পাল্টে দেখবেন, তারপর সই করে দেবেন। এত ব্যস্ততার মধ্যে ফোন করছে কেউ শুনলেই বিরক্ত হন। তার উপর কুম্ভ যদি করে, আরও বেশি।

—বল।

—স্যার অতীশবাবু কি রাজবাড়ি গেছেন?

—আমি জানব কি করে?

—না আজ্ঞে যদি রাজবাড়ি যান। এখানে তো নেই।

—এখানে নেই মানে! সনৎবাবু ঘড়ি দেখে কপাল কুচকালেন। সাড়ে চারটে বাজে। সাড়ে পাঁচটায় মিটিঙ। অতীশ নেই! হঠাৎ নধরবাবুকে বললেন, দুমবারকে পাঠিয়ে খোঁজ নিন তো বাসায় ফিরে এসেছে কি না?

বাসা থেকে দুমবার ফিরে এসে বলল, আজ্ঞে না আসেনি।

সনৎবাবু বললেন, রাজবাড়িতে আসে নি! গেটের দারোয়ান অতীশকে দেখেনি!

—তবে কোথায় গেল?

—কোথাও গেছে। আসবে।

আসলে আসুক না আসুক কুম্ভর কিছু আসে যায় না। বরং কোনো অঘটনের প্রত্যাশায় সে যেন অপেক্ষা করছে, সব কিছু সহ্য করছে। কিছু, কিছু একটা হবেই। আজই হবে, ভাবতে পারছে না। গাড়ি চাপা পড়েছে কোথাও গিয়ে—ভিতরে আহ্লাদ, হাসির গুরুঠাকুর গাড়ি চাপা, হাসি তুই না আমার সতীলক্ষী বৌ—কিন্তু সেই বৌকে তাতাতে হলে—অতীশবাবুর গপ্পো ফাঁদা চাই। অতীশবাবুর। হ্যাঁ অতীশবাবু নিখোঁজ। কাউকে শুয়োরের বাচ্চা কিছু বলে গেল না। চেকে সই করবে না, পলিয়েছে। পালিয়েছে—জুজুর ভয়।

সনৎবাবু বললেন, আমি যাচ্ছি।

কুম্ভ তাড়াতাড়ি ক্যাশবুক খুলে দেখল। কারণ সনৎবাবু এসেই ক্যাশবুক নিয়ে পড়বেন। রোজকার ভাউচার করা না থাকলে ক্ষেপে যান। সপ্তাহে দু-তিন দিন, কখনও একদিন, কোনো সপ্তাহে আসেনই না, ভাউচারে তিনি কাউন্টার সিগনেচার করেন—তিনি এসে ক্যাশ চেক করেন—ভাউচারে অনিয়ম দেখলে, কিংবা কুম্ভর হাত টান আছে এমন সংশয় দেখা দিলেই ভাউচার ফেলে ডাকবেন, কোথায় গেছিলে—তেতাল্লিশ টাকা তোমার ট্যাকসি বিল! কুম্ভ জানে সনৎবাবু খুবই ত্যাঁদড় লোক। ট্যাকসিতে কোথায় কত ভাড়া জানেন। সে যখন ভাউচার করিয়ে নেয়—তখন মোটামুটি হিসাব থাকে—পাঁচ- সাতদিন দেরি হয়ে গেলে—ভুলভাল হয়ে যায়। নিত্য হাতটানের স্বভাব থাকলে একদিন না একদিন গন্ডগোলে পড়ে যেতেই হয়। মনে হয় তাকে পাকড়াবার জন্যই যেন আসা। অতীশবাবুকে মিছে কথা বলে ভাউচার করিয়ে নিতে কোন অসুবিধা হয় না—যত আপদ সনৎবাবু। তার একটাই আতঙ্ক থাকে–তুমি কুম্ভ কি মনে কর বুঝি না। এটা ঠিক না। ঠিক বেঠিক! তুমি জান না রাজা সিটমেটাল থেকে দু-লাখ টাকা তুলে নিচ্ছে, ওটা কি বোঝাবুঝির বাইরে—শালা চোরের সাক্ষী গাঁটকাটা। কিন্তু এ-সময় কুম্ভ খুবই বিপাকে পড়ে গেছে। চেকটা সই হয় নি। বোর্ড-মিটিং-এ যেন তাকেই কৈফিয়ত তলব করা হবে—তুই কোথায় ছিলি! কুমারবাহাদুর তাকে ছোটবেলা থেকে দেখে আসছেন। তার উপর জোর খাটাতেই পারেন। তিন পুরুষ রাজার গোলামি করে দেশে বাপ ঠাকুর্দা দোল দুর্গোৎসব চালিয়ে গেছে। সবই এই কুমারদহ রাজ এস্টেটের কৃপায়। অতীশবাবু কেন নেই—এটাও প্রশ্ন উঠতে পারে। নেই যখন আর কি করা! আসলে কুম্ভকে দিয়ে হবে না, কোথায় গেল দেখবি না! না বলে না কয়ে চলে যায় না কখনও, আজ গেল! কেন গেল, তুই ছাড়া কে বেশি জানবে! রাজি হবে না, জানি, তবু জল ঘোলা করলি তুই—বউরাণী যদি ডেকে বলে—কুমারবাহাদুরকে কুপরামর্শ তুই কেন দিতে গেলি—কিংবা সনৎবাবুকে দিয়ে যদি বলায় কুম্ভকে দিয়ে হবে না। ভাল লোককে সে তাড়ায়। অতীশ পর্যন্ত টিকতে পারল না। নিঁখোজ হয়ে গেল। কুম্ভ ভেবেছে কি, ম্যানেজার হবে—কারখানা লাটে তুলে দেব, তবু চোর ছ্যাঁচোড়কে ম্যানেজার করব না।

কুম্ভর কেন যে মাঝে মাঝে চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে হয়! রাজবাড়িতে কে কোথা থেকে টাকা খায়, কার কি তহরি সব যেন বউরানী জেনে ফেলেছে। এমন প্রখর গুপ্তচরবৃত্তি এ-বাড়ির মধ্যেই চলে। কে যে কার শত্রু আর কে যে কার মিত্র বোঝা এত মুশকিল, শেষ পর্যন্ত অতীশবাবুর কিছু হলে- টলে তার কপালে কি লেখা থাকবে জানে না। অতি লোভে তাঁতি নষ্ট!

আর কুমারবাহাদুর সব শুনে অবাক!

–কোথায় গেল?

–আজ্ঞে কিছু বলে যায় নি।

–কেউ দেখে নি?

–আজ্ঞে না।

সনৎবাবু বললেন অত্যন্ত অন্যায়। অতীশ কি মনে করে জানি না। চেকে সই না করলে চলবে কেন। কোম্পানির তুই ম্যানেজার সেক্রেটারি!

বোর্ড-মিটিংঙের পর সামান্য ভালমন্দ খাওয়ার ব্যবস্থা থাকে। কর্তারা যা খায়, খায়। বাকিটা কুম্ভ তার বাসায় নিয়ে যায়। জলযোগ কাছেই। সেখানেই বরাত থাকে। কাগজের রঙিন প্যাকেট আজ খোলাই হল না।

গাড়িতে ওঠার সময় সনৎবাবুকে কুমারবাহাদুর বললেন, ওর বাসায় খোঁজ নেবেন। বোর্ড-মিটিং ফেলে চলে যেতে পারে—ওকে তো জানি, তারপরই কুম্ভর দিকে তাকাল। কুম্ভ যেন মহা অপরাধ করে ফেলেছে—যদি সত্যি কিছু হয় সে যে চক্রান্ত করছে না কে বিশ্বাস করবে? কয়েকবারই চক্রান্তের বিষয় সহজেই ফাঁস হয়ে গেছে—এমন কি কারখানায় গো-স্লো, কারখানার সঙ্গে বস্তির লোকদের সংঘর্ষ—সব কিছুর পেছনে সে। বউরাণী থেকে কুমারবাহাদুর এমন কি কাবুল পর্যন্ত মনে মনে বিশ্বাস করে সব কিছুর পেছনে সে! যদি কিছু হয়—একবার কি ভেবে সে নিজেই কফি-হাউসে চলে গেল। অফিস ফেরত কফি-হাউসে আড্ডা মারার স্বভাব আছে। কুম্ভ নিজেও অতীশবাবুর সঙ্গে এসেছে কয়েকবার। উঠতি লেখকদের সঙ্গে অতীশবাবু আলাপ করিয়ে দিয়েছে। কিন্তু দেখল, নেই। বুকটা ধড়াস করে উঠল। যদি কিছু করে বসে। বসতেই পারে—সে মানুষটার পেছনে কম লাগে নি। মানুষটাকে অপদস্ত করার কম চেষ্টা করে নি। শুধু ক্ষোভ, সে থাকতে তার মাথার উপর কোথা থেকে উটকো লোক এনে বসিয়ে দেওয়া হল! বেশ দিলে, কিন্তু সব কৈফিয়ত তার কাছে কেন! তুই তো জানিস অতীশকে। তুই থাকতে কেন এটা হল! কোনো ভুলত্রুটি, শ্রমিক অসন্তোষ, যখনই কিছু ঘটবে, কুমারবাহাদুরের এক কথা, তুই থাকতে এটা কেন হয়! এবং যেন, সে চোরের দায়ে ধরা পড়েছে। খারাপ কিছু হলেই পেছনে তার হাত আছে ভাবে। তার হাত থাকে না তা নয়, যে কেউ এটা করত, মানুষ মাত্রেই এটা করে থাকে, সে তো মানুষ

আজ তারও আতঙ্ক। অতীশবাবুকে দেখে মনে হয়েছে, সহজেই সব কিছু করে ফেলতে পারে। আবার নাও পারে। সে কতভাবে লোভে ফেলে দিতে চেয়েছে, পিয়ারিলালের রক্ষিতাকে ভাইঝি বলে এক কামরায় এক বেঞ্চিতে তুলে দিয়েছিল, রাতের গাড়ি—প্রথম শ্রেণী রিজার্ভ—লাইনে প্রথম শ্রেণীর যাত্রীই থাকে না—সেই চারু পর্যন্ত রা করে না। একসঙ্গে তুলে দিয়ে ভেবেছিল, অতীশবাবুকে বিপাকে ফেলবে, ডবকা ছুঁড়ি, দ্যাখ এবার খেলা কেমন জমে, যে দেবতা যাতে খুশি, তারে তাই দাও। টাকায় হয় না মেয়েছেলে ধরিয়ে দাও—আর শেষে ফিরে এসে অতীশবাবু তাকেই বিপাকে ফেলে দিয়েছিল। এক কথা, জানেন চারু উধাও। সারগাছি স্টেশনে দেখি চারু কামরায় নেই। কোথায় গেল! নেই তো নেই। কী আশ্চর্য, পুলিসে খবর দেওয়া দরকার। পিয়ারিলাল বলছে, ওর ভাইঝিই নেই। তবে আমার সঙ্গে কাকে তুলে দিল—বাবুজী আপ যাতা হ্যায়, মেরা ভাইঝি যাতা হ্যায়। একেলা। আপ হ্যায় তো কই চিন্তা নেহি হ্যায় বাবুজী। সেই পিয়ারী বলেছে, সে স্টেশনেই যায় নি। চারু বলে তার কোনো ভাইঝিও নেই। আসলে কুম্ভ বিপাকে পড়ে গেছিল—যা মানুষ বউরাণীকেও বলতে পারে, জানো—পিয়ারিলালের ভাইঝি সঙ্গে গেল, এখন বলছে পিয়ারিলালের কোনো ভাইঝি নেই। কুম্ভ জানে, বউরাণী ঠিক ধরে ফেলবে, কুম্ভর চক্রান্ত। কোনো মেয়েছেলেকে পেছনে লেলিয়ে দিয়েছে। তুই কুম্ভ শেষে ওর পেছনে একটা বেশ্যাকে লেলিয়ে দিলি! তুই সত্যি অমানুষ! তোকে আর রাখা যায় না।

মাথা থেকে বাবুর চারু নেমে গেছে। রক্ষে। ইদানিং চারুর কথা উঠতই না। একবার বউরাণী পর্যন্ত বাবুটিকে ডেকে ধমকেছে। বলেছে, তুই নাকি চারু চারু করে ক্ষেপে গেছিস? কে চারু? কিরে চুপ করে আছিস কেন!

বাবুটি ভয়ে মুখ খোলেনি। বাবুটি যে ঘোরে পড়ে যায়—সেই ঘোরে পড়ে যদি চারুকে দেখে থাকে, কারণ বলশালী এবং রমণপটু মানুষের স্ত্রী মাসের পর মাস অসুস্থ থাকলে অন্য নারীরা ঘোরাফেরা করতেই পারে। রাতের ট্রেনে চারু উঠে আসতেই পারে। একা গেলে বিড়ম্বনার শেষ নেই—ফাঁকা কামরা পেয়ে এক অদৃশ্য নারী উঠে এসে চারুর অভিনয় করে গেছে।

টাকা দিয়ে হল না, নারী দিয়ে হল না, কি দিলে হবে জানে না কুম্ভ। মাঝে মাঝে কুমতলব মাথায় কাজ করলে নানা বিভ্রাট সৃষ্টি করে ফেলে, গো-স্লো, লক আউট, সংঘর্ষ স্থানীয় লোকদের সঙ্গে—বাইরে থেকে লোক নেওয়া চলবে না—বস্তির মাতব্বরদের গোপনে কুম্ভই তাতিয়েছে কতবার—আমার কোনও হাত নেই, নতুন ম্যানেজারবাবু এসেছেন, তাঁর সঙ্গে কথা বলুন। তবে তিনি নেবেন না। তাঁর খুশিমতো কাজ হয়—আমরা কে বলুন। আপনাদের বুকে বসে খাবে, আপনাদের দাড়ি ওপড়াবে–কেন যে সহ্য করেন আপনারা!

আসলে কুম্ভ চেয়েছে বার বার লোকটার মগজে পেরেক পুঁতে দিতে। শালা হাড় এত শক্ত—কি দিয়ে গড়া সে জানে না। সেবারে তো ভেবেছিল হয়ে গেছে। মাধার ঝুপড়ি থেকে লাঠিসোটা, বোমা, রড, কি না বের করে তাড়া করেছিল কারখানার লোকদের—আর অতীশবাবু তার মধ্যে নির্বিকার দাঁড়িয়ে থাকলেন। থাকলেন না শুধু, মাধাকে প্রায় ঘাড় ধরে নিয়ে এলেন বলা চলে। লোকটা কি সত্যি কোনো জাদু জানে! কিংবা গুণ করতে পারে! কিংবা এমন কোনো সাংঘাতিক দৈবশক্তির অধিকারী, মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যেতে বিন্দুমাত্র বিচলিত বোধ করে না। অথচ সামান্য একটা সই, সই করে রাজার হাতে কালো টাকা তুলে দিতে ভয় পায়! এ বড়ই আজব ব্যাপার। গেল কোথায়! বোর্ড-মিটিং- এর মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে নির্বিকার চিত্তে নিখোঁজ হয়ে আছে। রাতে ফিরলে ভাবল, বাসায় গিয়ে ধরবে—দাদা হাওয়া হয়ে গেলেন? সাহস আপনার, চাকরি-বাকরির পরোয়া করলেন না।

অর্থাৎ এটা যে কত বড় গর্হিত কাজ করে ফেলেছেন অতীশবাবু ধরিয়ে দেওয়া দরকার। ছেলেখেলা—হ্যাঁ এটা বোর্ড-মিটিং—ছেলেখেলা! না বলে না কয়ে বের হয়ে গেলেন! বাসায় ফিরেই কুম্ভর এত্তেলা পড়ে গেল। বউরাণী ডেকে পাঠিয়েছেন।

হাসিকে ব্যাগটা এগিয়ে দেবার সময় বলল, অতীশবাবু ফেরেন নি!

—না।

সে ঘড়ি দেখল, রাত নটা বাজে। কোথায় গেল। সে হাত মুখ ধোবার সময় পেল না। হাসি বলছে, তাড়াতাড়ি যাও। দু-বার খোঁজ করে গেছে। বউরাণী কাবুলকে পাঠিয়ে খোঁজ নিয়েছেন।

আমি কি জানি! কুম্ভ বিড়বিড় করে বকছে। কোথায় গিয়ে পড়ে আছে আমি কি কবে বলব! সে রাজবাড়ির বিলিয়ার্ড ঘর পার হয়ে বাঁ-দিকের ঘরে ঢোকার আগে দেখল শঙ্খ দরজায়। বড় বড় তৈলচিত্র রাজার পূর্বপুরুষদের। মাথায় উষ্ণীষ কোমরে তরবারি নাগরাই জুতো। সব মহারাজারা পুরুষানুক্রমিক দাঁড়িয়ে আছেন ছবিতে। সে সোজা ভিতরে ঢুকে যেতে পারে না। কেউ তাকে নিয়ে যাবে—শঙ্খকে দেখেই বলল, আমার তলব হয়েছে—কোন ঘরে?

—আসুন।

বাঁ-দিকের ঘরটায় ঢুকে গেল। নরম গালিচা পাতা, সাদা সিল্কের কভার সোফা সেটের। পেছনে বড় বড় আলমারি সোনার জলে বাঁধানো সব বই। সে বসল না। আলমারির পাশে দাঁড়িয়ে থাকল। শঙ্খ উপরে খবর দিতে চলে গেছে। বউরাণী কথা বলবেন, না কুমারবাহাদুর কে বুঝতে পারছে না। আগেকার আমলে এ-সব ভাবাই যেত না। রাণীমার বাড়িতে এখনও পর্দা ঘেরা থাকে। সে এ-বাড়িতেই বড় হয়েছে, কোনোদিন রাণীমার মুখ দেখতে পায় নি। তার বাবা রাধিকাবাবুও দেখেছেন বলে মনে করতে পারে না। আর এখন কুমারবাহাদুর বাইরে গেলে, বউরাণী প্রাইভেট অফিস নিজেই সামলায়। আমলারা যে যার মতো তার কাছ থেকে জেনে নেয় সব।

সে দাঁড়িয়ে থাকল।

পাশের ঘরটা বউরাণীর বসার। ও-ঘরে সে ঢুকতে পারে না। নিয়ম নেই। অদৃশ্য গন্ডি আঁকা আছে। তাকে এখানেই অপেক্ষা করতে হবে। তার বুক ধড়াস ধড়াস করছে। কি জানতে চাইবে! যদি তার দিকে বউরাণী আঙুল তুলে বলে, তোর জন্য অতীশ নিখোঁজ। আসার পর থেকেই এর পেছনে লেগেছিস। তুই মনে করিস আমরা কিছু বুঝি না! সে কোথায় গেল! কেন গেল!

সিঁড়িতে পায়ের শব্দ। খুব শ্লথ পায়ে নেমে আসছে কেউ।

শঙ্খ পর্দা সরিয়ে দাঁড়ালে বউরাণী ঢুকে গেল। সঙ্গে কাবুল।

বউরাণী ওর দিকে তাকাল না। সেও তাকাচ্ছে না। শুধু হাত জোড় করে ঘাড় গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে।

বউরাণী বলল, বোস।

বউরাণীকে দেখলে স্বাভাবিক থাকা কঠিন। কত রকমের শঙ্কা, এবং একেবারে ভেজা বেড়ালের মতো স্বভাব হয়ে যায়। এত বেশী ব্যক্তিত্ব এই মহিলার, মহিলা না যুবতী, এবং এখনও মনে হয় যেন শরীরে আছে আশ্চর্য খুসবো, এবং সিল্কের শাড়ি পরনে, নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গে গোটা ঘরের ছবি পাল্টে যায়। বউরাণী তার সঙ্গে খোদ খুব কম কথা বলে, কবে বলেছে তাও মনে করতে পারে না। এত বেশি দাম্ভিক এবং শিখার চূড়ায় বসে থাকলে নারীর শরীরে আগুন প্রজ্বলিত হতে থাকে, শরীর মাখনের ডেলা মনে হয়, কেবল জ্বলছে। আবার মনে হয়, বহু পুরুষের যে আকাঙ্ক্ষিত নারী, বউরাণী তার শুধুমাত্র প্রতীক। আসলে এই মহিলার সামনে দাঁড়ালে কাপড়ে হলুদ ছোপ পড়ে যাবার কথা। সে তবু দাঁড়িয়ে আছে।

—কখন গেল?

—আজ্ঞে,ঠিক জানি না। কুম্ভ তোতলাতে থাকল।

—জানিস না মানে! ওকে অফিসে দেখিস নি?

—আজ্ঞে দেখেছি। সকাল থেকে কেবল কাগজ পড়ছিল। যখনই উঁকি দিয়েছি, দেখেছি কাগজে উবু হয়ে কি খুঁজছে।

একটা পাতি চোরের মতো সে দাঁড়িয়েই থাকল। বসল না। বউরাণীর সামনে চোখ তুলে কথা বলারও সাহস থাকে না তার। আর অতীশবাবু পাত্তাই দেয় না বউরাণীকে। কোন্ জোর থেকে! আগে তবু কিছুটা যেন সমীহ করত, অতীশবাবুর স্ত্রী মাস্টারনীর চাকরি নিয়ে বাইরে চলে যাবার পর সেটাও গেছে।

—সকাল থেকে শুধু কাগজ দেখেছে! বউরাণীর প্রশ্ন।

—আজ্ঞে চোখে তো তাই দেখলাম। গত এক পক্ষকালের কাগজ নিয়ে বসেছিল।

বউরাণী মনে মনে কি ভাবল কে জানে, উঠে পড়ল। মুখে বিষণ্নতার ছাপ। অতীশের যাবার জায়গা খুব একটা নেই, তার ফেরার সময়ও পার হয়ে যায় নি—কিন্তু সমস্যা অতীশের গোঁয়ারতুমি। চেকে সই করবে না, কিছুতেই করানো গেল না। সে বের হয়ে গেল। সকালে কৈফিয়ত চাইলে বলবে মনে ছিল না। তোমরা তো সবাই জেনে ফেলেছ আমি নাকি ঘোরে পড়ে যাই। কোনো ঘোর-টোর হবে। কালো টাকার চেক—এ ভাবা যায় না! কি করবে এত টাকা পচিয়ে। বউরাণী জোর করতে পারে, তাহলে এখন চেকে সই কর। বাবুটি তখন এমন নির্দোষ হাসিমুখে তাকাবে যে দেখলে আতঙ্কে গা কাঁটা দিয়ে ওঠে।—অমলা এত পচা টাকার গন্ধ—টের পাও না। ওফ তোমরা কী! বাইরে বের হলে খারাপ লাগে না! ফুটপাথের ঝুপড়ি দেখলে খারাপ লাগে না—প্লাবন দেখেছ, যখন আসে ধুয়ে মুছে নিয়ে যায়, নর্দমার জলে ভেসে গেলে রাজবাড়িতে ভূত নাচবে জান। আমি উঠি। এবং তখন এমন সাহস নেই অমলার ডেকে বলে, তুই নিজেকে কি ভাবিস? তোর ছেলেমেয়েদের জন্য ভাবনা হয় না। তাড়িয়ে দিলে উল্টে পড়বি, মুখ থুবড়ে পড়বি। বউ-এর চাকরি হয়েছে বলে এত সাহস তোর! নাকি তার নির্লজ্জ আকাঙ্খা অতীশকে আরও বেশি জেদী করে তুলেছে। একদিন তো অসহায়ের মতো তার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, অমলা তোমরা আমাকে নষ্ট করে দিও না। অজস্র পীড়ন আমার। আমি মাথা ঠিক রাখতে পারি না। টুটুল মিণ্টু আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে, তারা লণ্ঠন নিয়ে হেঁটে গেলে আমি হাঁটি! জীবনের প্রতি যেটুকু আগ্রহ অবশিষ্ট আছে—শিশুরা আছে বলে। নির্মলা আছে বলে।

বউরাণী কুম্ভকে বলল, খবর নিবি অতীশ কখন ফিরল। বলে পর্দার আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। কুম্ভর মুখে খিস্তি এসে গেছে। কিন্তু এত গড় হয়ে থেকেও খিস্তি হজম করার প্রক্রিয়া তার জানা। বাবুটি কখন ফিরবে সেই অপেক্ষাতে এখন বসে থাকা—ঘন্টায় ঘন্টায় খবর নেওয়া—এল?

সুখি জানালায় দাঁড়িয়ে যদি বলে, না আসে নি কাকা। তা-হলেই হয়ে গেছে। যদি ফিরে না আসে, কুম্ভ কেমন বিপাকে পড়ে গেল! খোঁজাখুঁজি তাকেই করতে হবে। কাবুল এবং সব আমলারা, কেউ বাদ যাবে না, তবে মূল দায়িত্ব তার। সে নতুন বাড়ি পার হয়ে সোজা তার বাসায় না ঢুকে অতীশবাবুর বাসার দিকে চলে গেল। কড়া নাড়ল। সে মনে প্রাণে চাইছে, ফিরে আসুক—নতুবা সারা রাত সে এক দন্ড ঘুমোতে পারবে না—কেন অন্দরমহলে জানানো হয় নি!

—অতীশবাবু ফেরে নি!

—না। সুখি বলল, এলে খবর দেব?

—হ্যাঁ। দিবি। তারপর ভাবল, এ আর এক নির্বোধ রমণী, কতটা নির্ভর করা যাবে কে জানে, তার চেয়ে গেটে দারোয়ানকে বলে রাখা ভাল, অতীশবাবু ফিরলে যেন তাকে খবর দেয়।

কিন্তু না ফিরলে! বউরাণী অতীশবাবুর ফেরার খবর নিতে বলেছে, না ফিরলে কাকে খবর দেবে! এত রাতে কে জেগে থাকবে! কাউকে জাগিয়ে দেওয়া ঠিক যদি না হয়, সে ভাবল দৌড়ে গিয়ে একবার শঙ্খকে বলবে—যদি না ফেরে কি করব! টেনিসকোর্টের উপর দিয়ে সে ছুটল। কিন্তু আশ্চর্য, দেখল রাজার প্রাসাদের সব দরজা বন্ধ। তার ঢোকার কোনো রাস্তা নেই।

.

অতীশ চারপাশে তাকিয়ে বুঝল, সে একটা লোকাল ট্রেনে উঠে পড়েছে। এক কোণায় চোখ বুজে বসে আছে।

অফিস থেকে সোজা স্টেশনে এসেছে মনে পড়ছে। ট্রেনে ভিড় এত কম কেন জানে না। আসলে অফিস ছুটির আগেই সে এসে গেছে বলে ফাঁকা ট্রেন পেয়ে গেছে। সে গিয়ে কি দেখবে জানে না। মাথার মধ্যে তার নিরন্তর এক ছবি ভেসে যায়। চালচিত্রের ছবি। এক দন্ড মগজ তাকে নিস্তার দেয় না। শীতের কুকুরের মতো সে কেমন এক কোণায় কুণ্ডলি পাকিয়ে চোখ বুজে বসে আছে—যদি গিয়ে দেখে তালা বন্ধ। যদি গিয়ে শোনে নির্মলা বাড়ি গেছে—যদি গিয়ে শোনে, আপনি, কি ব্যাপার, নিমুদি তো শুক্রবার সকালের বাসে গেছে। বাড়ি যায় নি? শুক্রবার না বুধবার – বুধবার যদি বলে, তখন সেই কালো ট্রাংকের বিভীষিকা। কালো ট্রাংকের ভিতর এক নারীর ছবি বার বার ভেসে উঠছে। নিখোঁজ নির্মলা! টুটুল মিণ্টুকে ফেলে নিমু এতদিন কোয়ার্টারে ছুটি কাটাতে পারে না।

সে কেমন অস্থির হয়ে পড়ছে। এ-ভাবে পীড়নের মধ্যে পড়ে গেলে মাথা ঠিক রাখতে পারবে না। কোথা থেকে কোথায় চলে যাবে—যেমন সে গাড়ি ছেড়ে দিলে টের পেয়েছে বাসায় বলে আসা হয় নি। অফিসেও কাউকে বলে নি। সে তো এক ফাঁকে ট্যাকসিতে স্টেশনে চলে এসেছে। টুটুল মিণ্টু কান্নাকাটি করবে। অবশ্য ওরা বুঝবে, বাবা ঠিক মার কাছে গেছে। কিংবা সুখি কোনো আপ্তবাক্য বললে, ওরা বিশ্বাস না করে পারবে না। তার বাবার এখন দুটো থাকার জায়গা, হয় রাজার বাড়ি না হয় স্কুলের কোয়ার্টার। একটা তো দিন, এই বিকেল, তারপর রাত, রাতটা কাবার করে দিতে পারলেই সকাল। সকালের বাসে উঠে গেলে দুপুরের মধ্যে পৌঁছে যাবে রাজবাড়িতে। টুটুল মিণ্টু জানে না, এর চেয়েও কত বড় সর্বনাশ তাদের জন্য অপেক্ষা করে থাকতে পারে। তিনদিন ছুটি, নিমু বাসায় আসে নি, সে ভাবতে পারে না। তি…ন…দি…ন। নিমুর তো পাগল হয়ে যাওয়ার কথা। কিংবা নিমুর যদি অন্য আগ্রহ তৈরি হয়! শরীর কেমন অবশ হয়ে যাচ্ছে। যদি সে ঘরে নিমুর সঙ্গে আর কাউকে আবিষ্কার করে ফেলে—কি ভাবছে! সে এত ভিতরে ছটফট করছে কেন—কেন টিকটিকি, কালো ট্রাংকের কথা ভাবলেই টিক টিক করছে। সত্য সত্য বলছে—দুশ্চিন্তার সময় যত রাজ্যের টিকটিকি ওৎ পেতে থাকে, খবর সত্য বলে জানান দেওয়ার মধ্যে ওরা কি ভাবে খুব মহৎ কাজ করে যাচ্ছে! তার চোখের ভিতর থেকে কোনও টিকটিকির লেজ ঝুলে পড়ছে না তো! হাত দিতেই বুঝল চোখ থেকে ল পড়ছে। চোখে পোকা পড়ে নি, অথবা কোনো আবেগে ভুগছে না—দুশ্চিন্তা এবং নিষ্ঠুর প্রতিক্রিয়া চলছে তার ভেতরে—তখন চোখ থেকে জলের ধারা নেমে আসছে কেন! সে তাড়াতাড়ি রুমাল দিয়ে দু-চোখ চেপে ধরল। সে বুঝতে পারছে না—তার ভিতর থেকে কেন এ-ভাবে আবেগ এবং আশ্চর্য এক নীলাভ অন্ধকারের মতো দুঃস্বপ্ন উঠে আসছে।

ট্রেন চলছে। গ্রাম মাঠ পার হয়ে ট্রেন চলে যাচ্ছে। দূরের মাঠ পার হয়ে কোনো গাঁয়ের গাছপালার মধ্যে সূর্য সহসা ডুবে গেল। বেশ রাত হয়ে যাবে। শেষ বাস কটায় বর্ধমান থেকে তাও সে জানে না। কেমন সে আর এক ঘোরের মধ্যে পড়ে গেছে। তিনদিন ছুটি নির্মলার। চৈত্র সংক্রান্তি, পয়লা বৈশাখ আর তার সঙ্গে রবিবার। তিনদিনের ছুটিতে নির্মলা না এসে কিছুতেই থাকতে পারে না। নির্মলা ছুটির নামে পাগল হয়ে থাকে—কতক্ষণে বাসায় ফিরবে। প্রথম দিকে তো শনিবার হলেই ছুটে আসত। পাঁচ ছ ঘন্টার পথ যেন তার কাছে কোনো দূরত্বই নয়। টুটুল মিণ্টুর জন্য মন কেমন করে – বিছানায়

শুয়ে এমন বলত।

শুধু কি টুটুল মিণ্টু!

শুধু কি তারাই তার আকর্ষণ!

আসলে যুবতী নারী প্রবাসে থাকলে মন বাড়ির জন্য পড়ে থাকতেই পারে। কারণ সব সময়, কিংবা স্কুল ছুটির পর একা কোয়ার্টারে ফিরে এলে তার বাড়ি ছাড়া আর কী ভাববার থাকতে পারে!

এবং সে বোঝে নির্মলার এই নিঃসঙ্গতা সে আর টুটুল মিণ্টু ছাড়া কেউ দূর করতে পারে না। অথচ তিনদিন ছুটি থাকা সত্ত্বেও সে আসে নি। উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ কী গভীর সে টের পাচ্ছে। সে যে কোনও খবর দিয়ে আসে নি, কেউ জানেই না, সে যাচ্ছে, তার প্রিয় নারীর খোঁজে—সে কেমন আছে কে জানে!

যদি কিছু হয়!

কালো ট্রাংকে যুবতীর লাশ হাওড়া স্টেশনে—সব মিলে কেমন তার মধ্যে গোলকধাঁধা সৃষ্টি করছে। কে সেই নারী! কাগজে গত সাতদিন ধরে যত দুর্ঘটনার খবর বের হয়েছে সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েছে। যত দুর্ঘটনার খবর সব। বাসায় আসার পথে বাসে কিংবা ট্রেনে, দুর্ঘটনা ঘটেই যেতে পারে। তাড়াতাড়ি ট্রেন ধরতে গিয়ে হতে পারে—দুর্ঘটনারও হাত পা থাকে এমন মনে হল অতীশের। সেই প্রেতাত্মা যদি চায় খুন করতে, করতেই পারে।

কালো ট্রাংকে যুবতীর লাশ। গত এক সপ্তাহের মধ্যে এটাই তার কাছে বড় দুর্ঘটনার খবর—অন্য খবরগুলির সঙ্গে কোনো মিল নেই, কারণ তারা যুবতীও না, কিংবা বর্ধমান লাইনেও আসে নি। কিংবা জলে ডুবে কিশোরের মৃত্যু, কিংবা বাস দুর্ঘটনায় সাতজন মারা গেছে। জলঙ্গী থেকে বাসটা বহরমপুরের দিকে আসছিল—এ-সব খবরের সঙ্গে নির্মলার না ফেরার কারণ মেলাতে পারে নি।

কেবল কালো ট্রাংকে যুবতীর লাশ তাকে তাড়া করছে।

নির্মলাকে কি কেউ গুম খুন করতে পারে!

কারণ নির্মলার কোয়ার্টার সড়কের মাথায়। লাইনবন্দী শিক্ষয়িত্রীদের কোয়ার্টার। তবে সেখানে নিখোঁজ হলে সে অদ্ভুত একটা খবর পেত। কেউ না কেউ খবর দিয়ে যেত—কিন্তু যদি নির্মলা বাসায় ফেরার নামে বের হয়!

নির্মলাকে অন্য কোনো পুরুষ প্রলোভনে ফেলে যদি নিয়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত রাজি না হলে গুম খুন করতেই পারে। এমন ছিমছাম যুবতীর উপর চোখ পড়তেই পারে। গাঁয়ে মাতব্বর মানুষদের মধ্যেও যে কোনো দুরভিসন্ধি নেই কে বলতে পারে! সরল বিশ্বাসে কিংবা কোনো কারণে যদি তাকে নিয়ে তারা কোথাও বেড়াতে যেতে চায়—কোনো আত্মীয়ের বাড়ি—কারণ নির্মলার ইদানীং গাঁয়ে গিয়ে বেশ মিশুকে স্বভাব হয়ে গেছে—সে অনুরোধ রক্ষার জন্য যেতেই পারে—কারণ সে তো জানে না, তাকে নিয়ে কুমতলব ভাঁজছে কেউ, নিজের লোক ভেবে যদি কোথাও যায় এবং অন্য কোথাও তুলে নিয়ে গিয়ে তাকে ধর্ষণ করে থাকে, তারপর সেই কালো ট্রাংক—ট্রাংকটা হাওড়া স্টেশনে পাওয়া গেছে। পুলিশ উদ্ধার করেছে—এ-সব আতঙ্কে তার চোখ মুখ গম্ভীর। তারপরই মনে হল, সে কেন যে এত আতঙ্কে পড়ে গেছে। নির্মলা খুবই ধীর স্থির স্বভাবের নারী। বুদ্ধিমতী।

তবু থেকে যায় কোনো অপহরণ।

তার মনে হয় জীবনের এই অপহরণ কখন কীভাবে শুরু হয় কেউ টেরই পায় না।

ছেলেদের স্কুলের প্রধান শিক্ষক জ্যোতিদা তার এবং নির্মলার সহপাঠী। সে নির্মলাকে কিছুটা তাঁরই ভরসায় সেখানে রেখে এসেছিল। গৌরবর্ণ সেই মানুষটি কি তার অনুপস্থিতিতে কোনো বড় গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে ফেলেছে। ফেলতেই পারে। বি টি কলেজে জ্যোতিদা কিছুটা বয়স্ক ছিলেন বলে, সবাই তাঁকে সমীহ করত। সেও। খদ্দর পরেন। আদর্শ রক্ষা করে চলেন। গাঁয়ে তার বেশ সুনাম আছে। মেয়েদের হাইস্কুল করবার পেছনেও তাঁর অনেক অবদান। এই মানুষটির ভরসায় সে যেন নির্মলাকে এতদূর রাখতে সাহস পেয়েছে। বিপদে আপদে তাদের সহপাঠী মানুষটির তো এগিয়ে আসারই কথা। জ্যোতিদা বিয়ে থা করেন নি।

জ্যোতিদাই একমাত্র পুরুষ যে অনায়াসে নির্মলার ঘরে ঢোকার ছাড়পত্র পেয়েছে। নির্মলাকে সে যখন সেই গ্রাম জায়গায় রাখতে যায়, তখন জানতই না পাশের ছেলেদের স্কুলের প্রধান শিক্ষক মানুষটি আসলে তাদের দুজনেরই সহপাঠী। কারখানায় যা অবস্থা, আর কুম্ভবাবু যেভাবে পেছনে লেগেছে এই যেমন চেকটা সই করিয়ে নেবার জন্য ফন্দি ফিকির—বউরাণী পর্যন্ত বার বার ফোনে অনুরোধ করেছিল, সই করে দিস, পাগলামি করিস না। লক্ষ্মী ছেলে। তোর কি দায় কার কত পচা টাকা আছে। তুই তো চাকরি করিস! এটা মনে থাকে না কেন! তোর এত জোর কিসে!

এবং এ-সব নানারকমের দুর্ভাবনায় অতীশ কেমন অতলে ডুবে যাচ্ছিল।

সে দেখতে পাচ্ছে, জ্যোতিদা আর নির্মলা পাশাপাশি বসে। নির্মলা যেন বলছে, না না। আমি পারব না। এমন সব দৃশ্য মাঝে মাঝেই তাকে তাড়া করছে কেন! নির্মলার এক নাগাড়ে তিন দিন ছুটি—সে বাসায় ফেরার জন্য পাগল হয়ে থাকে—আর তিন দিন বাদে সে যাচ্ছে। কোনো দুর্ঘটনা যদি সত্যি ঘটে থাকে। এবং এতসব উৎপাত এবং বিভ্রান্তিতে সে নির্মলার প্রতি কখনও সংশয় কখনও ক্ষোভ, কখনও দুর্ঘটনার কথা ভেবে এত কাতর। তার চিন্তাশক্তি পর্যন্ত কাজ করছে না।

কী হল ঢুলছ কেন?

কে?

সে চোখ মেলে তাকাল।

নির্মলার কন্ঠস্বর।

এটাই তার শরীরে বিষক্রিয়া শুরু করে দেয়। সত্যি কোনো অপঘাতে নির্মলার কি কিছু হয়েছে। না-হলে এই ট্রেনের কামরায় নির্মলার কন্ঠস্বর শোনে কী করে! সে দেখতে পায়, লাইনের ধারে যেন কেউ পড়ে আছে। মানুষজনের ভিড়। সব কি ঘোর থেকে!

সে দেখতে পায়, বাসে করে নির্মলা কোথাও যাচ্ছে, পাশে জ্যোতিদা। বাস-স্টপে নেমে নির্মলার জন্য সুগন্ধী পান কিনে আনছে। ঘোরে সব দেখতে পাচ্ছে। দেখতে পায়, নির্মলা শাড়ির আঁচল উড়িয়ে যাচ্ছে তাকে তাড়া করছে এক পুরুষ।

এ-সব ভাবতে ভাবতে তার ঝিমুনি আসছিল। নির্মলার কোয়ার্টারে গিয়ে যদি সত্যি দেখে সে নেই, তবে কী করবে!

এ-সময় যদি তার মাথার উপর ঈশ্বর হাত রাখতেন! ঈশ্বরবিশ্বাস কিংবা কোনো দৈব কাজ করে থাকে, এমন বিশ্বাস তার একেবারেই নেই। এ-সময় সাধারণত মানুষ সব কিছুই ভবিতব্য ভেবে ছেড়ে দিতে পারে। কিন্তু সে পারে না। সে যেন দু-হাত তুলে বলতে চায়, নির্মলার কিছু হলে টুটুল মিণ্টুর

হবে! আমি কী করব! আমার তো আর কেউ নেই। কিংবা বউরাণী যদি কোনো ষড়যন্ত্র করে থাকে। থাকতেই পারে। সে যদি নির্মলাকে পথের কাঁটা ভেবে সরিয়ে দিতে চায়! ইস্ সে ছাইপাঁশ এ-সব কি ভাবছে! মাথাটাই এখন তার খারাপ হয়ে যাবার যোগাড়। যতক্ষণ না সে নির্মলার কোয়ার্টারে পৌঁছাচ্ছে ততক্ষণ এই অধীরতার শেষ নেই সে জানে।

আসলে এ সময় তার দরকার মাথা ঠান্ডা রাখা। ট্রেন মগরা স্টেশন ছেড়ে চলে গেল। দু-পাশে শস্যক্ষেত্র, গাছপালা, পুকুর ডোবা, ক্যানেলের জল, পাখিদের উড়ে যাওয়া এবং নিরন্তর গ্রাম্য ছবি—গ্রাম্য মানুষের ছায়া লম্বা হয়ে পড়েছে শস্যক্ষেত্রে। বাড়ি ফেরার মুখে মানুষজন। বর্ধমান পৌঁছাতে বোধ হয় সাঁজ লেগে যাবে। বাস পাবে কিনা জানে না। পেলে কখন তাও জানে না। হুট করে বের হয়ে পড়া কতটা সমীচীন কাজ হয়েছে বুঝতে পারছে না। শুধু এটা কি কোনো আতঙ্কের তাড়া থেকে!

অথবা মনে হয় নির্মলা না আসায় কিংবা কোনো খবর না দেওয়ায় কোথাও জীবনের শেকড় আলগা না হয়ে যায়। সে তো তার শেকড় নানা জায়গায় রোপণ করতে করতে এখানে হাজির। এক জীবনে অমলা, ফতিমা, আর এক জীবনে বনি, চারু, নির্মলা। শেষে নির্মলাও কী নিখোঁজ! সবার মতো সেও হারিয়ে গেল!

অসুখ বিসুখও তো হতে পারে। এটা যে তার আগেও মনে হয় নি তা নয়। সাধারণ জ্বর-জ্বালা গ্রাহ্য করে না নির্মলা। বড় কোনো অসুখ। শয্যাশায়ী যদি থাকে—তবু তো খবর দেবার বিষয়টা থেকে যায়। চিঠিতে দিতে পারে। স্কুলের সেক্রেটারির বাড়ি কলকাতায়। সেখানে খবরটা পৌঁছে দিতে পারত। লোকজন প্রায়ই তো সে শুনেছে সেক্রেটারির কাছে আসে। শয্যাশায়ী হলে একটা টেলিগ্রাম পেতে পারত। কিন্তু তাও না।

অথবা নির্মলা কি নিজের এই অসুখের খবর গোপন রাখতে চায়! সে তার মানুষটাকে জানে। অসুস্থতার খবর পেলে সব ফেলে ছুটে চলে আসবে। কে টুটুল, কে মিণ্টু তখন মনে থাকবে না। এ-কারণে যদি তাকে না জানায়!

আসলে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক কখনও গভীর, কখনও সংশয় অবিশ্বাস এবং নিরাপত্তাবিহীন জীবনে কিছু ঘটেই যেতে পারে। এ-সব সে যত ভাবছে তত মাথাটা ঝিমঝিম করছে। কেন যে তিনদিন ছুটি পেয়েও এল না—রহস্যটা নির্মলার কোয়ার্টারে হাজির না হওয়া পর্যন্ত জানা যাবে না।

একবার ভাবল, যা হয় হবে। সে অন্যমনস্ক হবার চেষ্টা করল।

এ-সময় বাথরুমে গিয়ে চোখে মুখে জল দিয়ে এল। রুমালে মুখ মুছল। আর তখনই মনে হল, সে যে বের হয়ে এসেছে, টাকা পয়সা সঙ্গে কি আছে দেখেনি। যদি বর্ধমানে নেমে শোনে শেষ বাস ছেড়ে দিয়েছে, তবে তাকে কোথাও রাতের জন্য থাকতে হবে। তাড়াতাড়ি সে তার ব্যাগ খুলে টাকা পয়সা গুণতে থাকল।

আর তখনই মনে হল মানুষ নিজের নিরাপত্তা ছাড়া আর কিছু বোঝে না। নির্মলার কিছু হলে তার একটা বড় আয় বন্ধ হয়ে যাবে। এবং এই সংসার নামক যুদ্ধক্ষেত্রে, আসলে ঠিক যুদ্ধক্ষেত্র নয়, সাধারণ যুদ্ধক্ষেত্র এক রকমের, এ যুদ্ধক্ষেত্র কুরুক্ষেত্রের চেয়েও বেশি তার—বউরাণীর কথা মনে হল। বউরাণীর কোনো কথাই সে রাখে নি। অথচ সে জানে এই যে সহসা সে অজ্ঞাতবাসে চলে এল এ-জন্য বউরাণী সর্বত্র তোলপাড় করে ছাড়বে। গেল কোথায়!

সে বর্ধমানে নেমে অবাক, শেষ বাসটা ছাড়ে নি। ছাড়ব ছাড়ব করছে। সে স্টেশনে নেমে ছুটতে ছুটতে এসেছে। হোঁচট খেয়ে পড়তে পড়তে বেঁচে গেছে তারপর যখন শুনল, শেষ বাস ছাড়ছে, এবং সে উঠে দাঁড়াবার মতো সামান্য জায়গা পেয়ে গেল তখন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।

আর ঘন্টা দেড়েক কি জোর দু-ঘন্টা। তারপরই তার সব উদ্বেগ উত্তেজনা হয় শেষ নয় নতুন করে শুরু। সে শুধু ভাবল, বাসটা বলগনায় কটায় পৌঁছাবে।

যদি বলগণায় ঘন্টাখানেকের মধ্যে যেতে পারে, তবে আর আধ ঘন্টা। কারণ নির্মলাকে প্রথম রেখে যাবার সময় এটা টের পেয়েছিল। কোন কারণে যদি বলগনা পর্যন্ত যেতে পারে, তবে সে হেঁটে ও ইচ্ছে করলে বাকি পথটা যেতে পারবে। কারণ এখন যে আতঙ্ক তাকে গ্রাস করছে সেটা অদ্ভুত।

তার বার বারই মনে হচ্ছিল রাস্তায় বাসটা বিকল হয়ে যাবে।

এতটা নির্বিঘ্নে তাকে আর্চি এত সহজে সেখানে যেতে দেবে না।

এবং এটা তার হয়, মগজে কে যেন ঘন্টাধ্বনি করে আগাম জানিয়ে দেয়। কে যেন সেই অতীত থেকে তাকে তাড়া করছে।

সেই সমুদ্র, এবং জাহাজ তাকে তাড়া করে এবং তখনই মনে হল, আজই সকালে তার মনে পড়ে গেছিল বনিকে। বোটে বনি নেই। বালিয়াড়িতে সে যেন একটা ক্রসের নিচে বসে আছে।

বাসটা ঢিমেতালে চলছে। এত ভিড় যে সে গলগল করে ঘামছিল। দু-পাশের কিছু দেখতে হলে নুয়ে দেখতে হয়। অথচ এত ভিড় যে কিছুতেই নিচু হতে পারছে না। এমন কি সে ইচ্ছে করলে এখন সোজা কোনো অবলম্বন না রেখেও দাঁড়িয়ে থাকতে পারে।

চারপাশের মানুষজন তাকে সোজা দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য করছে। সে নিচু হলে হাই হাই করে উঠছে। কনুইয়ের ধাক্কা, কার পা এসে পা চেপে দিচ্ছে—এত ভিড় বাসে সে কোনোদিনই চাপে না। কিন্তু আজ তার কাছে কোনো কষ্টই কষ্ট না। শুধু জানতে চায়, স্কুলে তিনদিন ছুটি থাকা সত্ত্বেও সে কেন তার প্রিয় ঘরবাড়ি, স্বামী-সন্তানকে অস্বীকার করে থেকে যেতে পারল!

কোনো বিপদ কিংবা কিছু একটা না ঘটলে এটা হয় না।

একদিনের ছুটি পেলে যে মাঝে একদিন ক্যাজুয়েল নিয়ে তিন চারদিন তার সঙ্গে কাটিয়ে যায়, সে তিনদিনের ছুটি পাওয়া সত্ত্বেও বাসায় ফেরে নি! কেন?

এই ‘কেন’ তাকে মানসিকভাবে অস্থির করে তুলছে। এই ‘কেন’ তাকে আজ হয়তো পাহাড়ের মাথায় কোনো দূরাতীত দৃশ্য চোখের উপর ভাসিয়ে দিয়েছে। যা বার বার ভুলে যেতে চায়। যার হাত থেকে সে বার বার নিষ্কৃতি চায়, সেই আবার তাকে তাড়া করছে।

তুমি অতীশ খুন করেছ।

হ্যাঁ করেছি। এমন ঘটনার ফের যদি সম্মুখীন হই আবার খুন করব। সেবারে জাহাজের কেবিনে বনির মর্যাদা রক্ষার্থে আর্চিকে খুন করেছি। এবার হয়তো নিজের মর্যাদা রক্ষার্থে আবার খুন করতে হবে। যদি নির্মলার মর্যাদা কেউ ক্ষুণ্ণ করতে চায়, তাকে আমি কিছুতেই ক্ষমা করতে পারব না। তাতে আমি যত বড় সিনারই হই না কেন। কিছু গ্রাহ্য করি না। আসলে সে বিড়বিড় করে নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলছে। কেউ কেউ তাকে দেখছে। লক্ষ্য করছে। পাগল ভাবতে পারে। কখনও চোখ মুখ চোয়াল শক্ত হয়ে যাচ্ছে—আসলে সে আর নিজের মধ্যে নেই। তাকে কেউ বিদ্রূপ করছে, সে গায়ে মাখছে না।

এরা কেউ জানেই না, ঠিক পরমুহূর্তে কী ঘটতে পারে। বাসটা বিকল হয়ে যেতে পারে, কিংবা সেই প্রেতাত্মার প্রভাবে বাসটা কোনো খাদে গিয়ে পড়তে পারে। যেন আর্চি খুন হওয়ার পর থেকে বার বার প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে উঠেছে। এবং বার বার সে যে রক্ষা পেয়ে যাচ্ছে, কোনো এক শুভ প্রভাবে। সে আর কেউ নয়। অথচ বুঝতে পারছে না—কবে সুতো ছিঁড়ে যাবার মতো স্মৃতিভ্রম যা সে কিছুতেই জুড়ে দিতে পারছে না। ডাঙা যখন পেল, কী করে বোট একটা দ্বীপের বালিয়াড়িতে গিয়ে ঠেকেছিল, কে তার প্রিয় অ্যালবাট্রস পাখিটাকে খুন করল, বনি কোথায়—কিছুই সে মনে করতে পারছিল না তখন। সে শুধু দেখছে কাপ্তান যে ক্রস বোটে তুলে দিয়েছিলেন, তার নিচে সে বসে আছে। ক্রসটা কে পুঁতে দিয়েছে তাও সে মনে করতে পারে নি। আজও পারছে না। মাঝে মাঝে এই স্মৃতিভ্রমও তাকে তাড়া করে।

সহসা বাসটা লাফিয়ে উঠল। ভীষণ আওয়াজ। আরে তবে কি সত্যি বাসটা কোনো খাদে পড়ে যাচ্ছে। সে রড ধরে ঝুলে আছে। হাই হাই করে উঠেছে বাসযাত্রীরা। আচমকা ব্রেক কষায় এটা হয়েছে। সামনে একটা গরুর গাড়ি সহসা ভূতের মতো হাজির। অন্তত অতীশের তাই মনে হয়েছিল।

আর তখনই অতীশ বলল, বনি দেয়ার ইজ লাইট। আই বিলিভ, লাইট ইজ মোর পাওয়ারফুল দেন ডার্কনেস। তুমি সেই লাইট পাঠিয়ে ড্রাইভারের সম্বিত ফিরিয়ে এনেছ। দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা করেছ। তুমি কি বলতে পার, নির্মলা কোথায়, তুমি তো মাঝে মাঝে দূবরর্তী তারবার্তা আমাকে পাঠাও। আজ নীরব কেন। আজ কেন সেই নীহারিকাপুঞ্জ থেকে আমার জন্য শুভ বার্তা পাঠাচ্ছ না!

আর তখনই কনডাকটার চিৎকার করে উঠল, বলগনা, বলগনা।

এখানেই অধিকাংশ বাসযাত্রী নেমে গেল। বাসটা হালকা হয়ে গেল। অতীশ বসার জায়গা পেয়ে গেছে। সে বসে চারপাশটা দেখল। রাত খুব বেশি হয় নি। নটা বেজেছে ঘড়িতে দেখল। গঞ্জের মতো জায়গা। কিছু ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। লাইনবন্দী গরুর গাড়ি গাছের ছায়ায়। লণ্ঠন দুলছে গাড়ির নিচে।

চায়ের দোকান, ধাবা দু-চারটি, সেখানে বাসের যাত্রী কনডাকটার ড্রাইভার খাবার খাচ্ছে। সে বসে থাকল। বাসটা এবার বাঁ-দিকের রাস্তা ধরে গুসকরার সড়কে পড়বে। এই সড়কের মাঝামাঝি জায়গায় গোরস্থান স্টপ। সেখানে নেমে সামান্য হাঁটলে তার প্রিয় নারীর কোয়ার্টার। একা থাকে। যদি গিয়ে দেখে কেউ নেই, তালা বন্ধ! তবে সে কী করবে! বুকটা ধড়াস করে উঠল ফের।

পাশের লাইনবন্দী কোয়ার্টারগুলিতে থাকে আরও পাঁচজন শিক্ষয়িত্রী। তারা খবর দিতে পারবে। কিন্তু শনিবার আজ। মাঝে যে দু-দিন ছুটি গেছে, কেউ না থাকারই কথা। যে যার মতো ছুটিতে বাড়ি চলে যাবেই। কেবল নির্মলারই খবর নেই। সে আতঙ্কে কাঁপছিল। শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে।

সে বাসের জানালায় মাথা হেলিয়ে দিয়েছে। সে যেন তার সব জোর হারিয়ে ফেলেছে। শরীর অবশ। চোখ মেলে তাকাতে পারছে না। মনের উপর এত চাপ, ট্রেন এবং বাস যাত্রার ধকল—সে তার সব শক্তি হারিয়েছে। এমন কি কোনো কিছু চিন্তা করার ক্ষমতাও। সারা শরীরে আশ্চর্য অবসাদ নেমে এসেছে। চোখ মেলে তাকাতে পর্যন্ত ইচ্ছে করছে না। কেবল বলছে, আর্চি আমি সব কিছুর সম্মুখীন হতে প্রস্তুত। সে তার সেই নীহারিকাপুঞ্জে রেখে আসা বনিকে বলছে, আমার যা শুভাশুভ সব কিছু তোমার উপর অর্পণ করলাম। আর পারছি না। সত্যি পারছি না। জীবন মানুষের বড় কুরুক্ষেত্র। নিরন্তর যুদ্ধ জীবনে—জন্মের সঙ্গেই সে আমার সঙ্গ নিয়েছে—নানা পর্বে এই জীবন একদিন শেষ হয়ে যাবে—কিছুই থাকবে না। না নির্মলা, না আমি, না এই জীবজগতের কেউ। সে চোখ মেলে দেখার চেষ্টা করল, কিছুই দেখা যাচ্ছে না। শুধু অন্ধকার। শুধু জোনাকি পোকার মতো কোথাও কোনো গাঁয়ে লম্ফের আলো জ্বলছে। আর এ-সময়ই সহসা সে দেখতে পেল আল ধরে কে যেন রওনা হয়েছে নদীর পাড়ে যাবে বলে। হাতে লন্ঠন। এই লণ্ঠন এবং লণ্ঠনবাহী মানুষটিকে মনে হল কোনো রূপক যে শত বিঘ্ন, শত দুর্গম রাস্তা, শত শত বিপর্যয় দুর্ভোগ পার হয়ে যায়। তবু সে লন্ঠন হাতে রাখে। যাবার সময় এই লন্ঠন আবার কারো হাতে দিয়ে যায়। রিলে রেস চলছে। ভাবতে ভাবতে সে চোখ বুজে ফেলল। এবং কেমন অচৈতন্যপ্রায় শরীর।

হঠাৎ বাস কনডাকটর হেঁকে উঠল, গোরস্থান গোরস্থান!

অতীশ কোনোরকমে উঠে দাঁড়াল। সে দ্রুত নামতে গিয়ে পড়ে যাচ্ছিল। কনডাকটার ধরে ফেলেছে। সে বলল, সরি। এবং সে দেখল বাসটা চলে গেলে চারপাশে আবার অন্ধকার চেপে বসেছে। দোকানগুলি এত রাতেও খোলা। দূরে মাইক বাজছে। গান। নৃত্যনাট্য। চন্ডালিকা। চন্ডালিকা নৃত্যনাট্য। তার বুক কাঁপছে। কী দেখছে! স্কুল প্রাঙ্গণে হেজাক বাতি জ্বলছে। স্টেজ। ভিতর থেকে এক আশ্চর্য পরিচিত কন্ঠস্বর। মাইকে ঘোষণা করছে কেউ। চন্ডালিকা নৃত্যনাট্য—পরিচালনায় নির্মলা ভৌমিক। নির্মলা! অতীশ ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকল। তার অশ্রুপাত শুরু হয়েছে। নির্মলা জানে না তার প্রিয় পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে প্রিয় নারীর সমবেত সঙ্গীতে আলাদা কন্ঠস্বর শুনবে বলে। সে শুনতে পাচ্ছে। সব শুনতে পাচ্ছে। কী সুন্দর গম্ভীর মৃদু অথচ আশ্চর্য মিষ্ট স্বর।

স্কুলের সব বেঞ্চ চেয়ার পেতে দেওয়া হয়েছে পেছন দিকটাতে। সামনে সতরঞ্জ পাতা। কাগজের লাল নীল মালায় মন্ডপ সাজানো। আলো আর আলো। নক্ষত্রের মতো ঝুলে আছে সব চাঁদমালা। মানুষজনের ভিড়ে জায়গাটা মেলার মতো হয়ে গেছে।

অতীশ পাশের কাউকে বলল, একটু সরে বসবেন। লোকটি সরে বসলে, সেও এই ভিড়ের মধ্যে চন্ডালিকা নৃত্যনাট্য দেখার জন্য টুলে বসে পড়ল। একজন আগন্তুক অথবা দর্শনার্থী আর পাঁচজন গ্রামবাসীর মতো। গান ভেসে আসছে, নাচ, চন্ডালিনী এক গ্রাম্য বালিকা।

কেন তবু যে অশ্রুপাত ভিতরে।

নির্মলা না যাওয়ায়, তার যে পৃথিবী মরুভূমিপ্রায়। নির্মলা সেই মরুভূমিতে মরূদ্যান তৈরি করে ফেলেছে। নির্মলার সমবেত সঙ্গীত শুনতে শুনতে সে অধীর হয়ে পড়েছিল।

নির্মলা তুমি না যাওয়ায় আমি কী যে আতঙ্কে পড়ে গেছিলাম! জানব কী করে তোমার এখানে এত বড় ফাংশানের আয়োজন হবে মন্ত্রীমশায় আসবেন বলে।

সমবেত সঙ্গীতে নির্মলার কন্ঠস্বর স্পষ্ট। পর্দার আড়ালে সে। সঙ্গীত আশ্চর্য মধুর। ছুঁয়ো না ছুঁয়ো না ছিঃ সে যে চণ্ডালিনীর ঝি!

অতীশ সেই নৃত্যনাট্য এবং সঙ্গীতমালা শুনতে শুনতে মুগ্ধ। সব গ্লানি ধুয়ে মুছে গেছে। সব শেষে নির্মলা অভিবাদন গ্রহণ করছে স্টেজের ভিতরে ঢুকে। খোঁপায় গোলাপ ফুল গোঁজা। সাদা সিল্কের শাড়ি। এ-নারীকে সে যেন চেনে না। যেন অন্য কোন গ্রহ থেকে তার প্রিয় নারী নেমে এসেছে। সে বলল, নির্মলা তুমি এত সুন্দর!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *