1 of 2

ঈশ্বরের বাগান – ৪০

।। চল্লিশ।।

প্রহ্লাদের জ্বর। হাসু বাড়ি নেই। চন্দ্রনাথ পড়েছেন মহাফাঁপরে। গরু বাছুর বের করা, দুধ দোওয়ানো, গরু মাঠে দিয়ে আসা সবই ছোট পুত্র ভানু করছে। জমিতে হাল দিয়ে রাখতে পারলে এ-সময় ভাল হয়। মাটি ভিজা আছে। শীত চলে যাবার মুখে। সকালের দিকে বেশ কুয়াশা ছিল ক’দিন। আকাশ মেঘলা ছিল। ছিটে ফোঁটা বৃষ্টিও হয়েছে। প্রহ্লাদ ঠিক থাকলে চিন্তা ছিল না। দুদিন ধরে ভানুকে অর্জুনপুরে পাঠাচ্ছে সকালের দিকে। সে খবর দিয়ে আসার পরও কেউ আসছে না। একজোড়া হাল বলদ থাকলে চিন্তা ছিল না। কিন্তু জমির যা অবস্থা আর মেজপুত্রটিরও যা মতিগতি, এক জোড়া বলদের দাম সংগ্রহ করাই কঠিন। তবু যে করে হোক, চাযের ব্যবস্থা না করে রাখলে জমি উরাট পড়ে থাকবে। জমি উরাট ফেলে রাখা অনুচিত কাজ এমন ভেবে থাকেন চন্দ্রনাথ। এখন হাল নামাতে পারলে, কত সুবিধা ছিল! ভোরে জমির আল থেকে ফেরার সময় এমন ভাবছিলেন। খালি পায়ে ভোরে হাঁটার স্বভাব। এই বয়সে তিনি যে কিছুটা বাতিকগ্রস্ত, এটা কিছুতেই তাঁকে বিশ্বাস করানো যায় না। সকালে সূর্যোদয়ের আগে তাঁর নানাবিধ কবচ পাঠ খুবই গম্ভীর শোনায়। ভোর-রাতে তাঁর ঘুম ভেঙে যায়, অথবা তারও আগে। আসলে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সবার মঙ্গল কামনায় অধীর। যেন ঠিকঠাক রেখে যেতে পারবেন কিনা শেষ পর্যন্ত এই একটা সংশয় উপস্থিত হয়েছে। মেজপুত্রটি যে তাঁর স্বাভাবিক না, ঘোরে পড়ে যায়, সেই ঘোর শেষ পর্যন্ত এক পরীতে এসে ঠেকেছে—তেত্রিশ কোটি দেবতা আছে তাই তিনি জানেন, কিন্তু কোনও পরীতে এসে দেবী আবির্ভূতা হন—হতেও পারে—কত লোক, দেবলোক গন্ধর্বলোক, নাগলোক—লোকের কি শেষ আছে। দেব-দেবীরা তো নানালোকে বিচরণ করাই শ্রেয় মনে করে থাকেন। কোন লোক থেকে কে এসে হাজির হবেন অতীশের কাছে কে জানে! তিনি গ্রহদোষ খণ্ডন করে ফেরার সময় কেন যে বলতে গেলেন, এ আবার কোন দেবী! ডানা আছে, উড়ে যায়—এমন দেবীর বর্ণনা ধর্মশাস্ত্রে পাঠ করেন নি।

সহসা চন্দ্রনাথের কেন যে মনে হল, কল্যাদি পঞ্চদশ শক্তির কেউ হতে পারেন তিনি। এখনও সকাল হয় নি। আজ বোধ হয় একটু বেশি আগে প্রাতঃভ্রমণে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন। এখনও আকাশ ফরসা হয় নি সে-ভাবে। পাখিরা উড়ে যাচ্ছে দেখতে পাচ্ছেন। মাঠের উত্তর দিয়ে হেঁটে ফিরছেন! খালি পায়ে কুয়াশার জল লাগলে এবং মাটির স্পর্শে দীর্ঘায়ু হওয়া যায়। অথচ এখনও আকাশ ফরসা হচ্ছে না। তবে কি তিনি আজ রাত থাকতেই বের হয়ে পড়েছিলেন। উচাটনে ঘুম আসে নি। হাসু ফিরে আসে নি, চিঠিও দেয় নি অতীশ। বৌমার অসুখবিসুখ, কিংবা কারো দুর্ভোগ—এ-সব কুচিন্তা তাঁকে বায়ুগ্রস্ত করে তুলতে পারে—এবং কল্যাদি পঞ্চদশ শক্তির কেউ হতে পারেন, অবহেলা করা ঠিক না—কেমন যেন মনে হল, যেন শ্যামা অসিকরা, মুণ্ডমালা-বিভূষিতা তার সামনে, কিছুটা আগে অন্ধকারে হেঁটে যাচ্ছেন! কুয়াশার মধ্যে তিনি হারিয়ে গেলেন। মতিভ্রম ভাবলে পাপ। চন্দ্রনাথ নতজানু হয়ে মাথা ঠেকালেন। ব্রাহ্মী আদি অষ্টশক্তির কেউ হতে পারেন তিনি। তিনি যেই হোন, অতীশের ঘোর থেকে আত্মরক্ষার যদি একটা অবলম্বন হয়, হোক না। তিনি এবারে দ্রুত হাঁটতে থাকলেন—কোনো দূরবর্তী ঘটনা প্রত্যক্ষ করবার যে শক্তি তাঁর মধ্যে গোপনে নিমজ্জিত আছে আজ আবার তা প্রতক্ষ করার বাসনায়, হাত মুখ ধুয়ে খুব সকাল সকাল ঠাকুরঘরে ঢুকে আসন পেতে বসলেন। এবং চোখ বুজে থাকলেন কিছুক্ষণ। তারপর তিনি পর পর ব্রাহ্মী, নারায়ণী, মহেশ্বরী, চামুণ্ডা, কৌমারী, অপরাজিতা, নারসিংহী সহ অষ্ট ভৈরবের উপাসনায় বসে মন্ত্রসকল পাঠ করে যেতে থাকলেন—ঐং ক্রীং অং অসিতাঙ্গায় ভৈরবায় নম, ঐ হ্রীং ইং রুরং ভৈরবায় নম, ঐঃ হ্রীং উং চণ্ডায় ভৈরবায় নম।

এ-ভাবে বলে চললেন, ওঁ ডাকিনীভ্যো নমঃ, ওঁ যোগিনীভ্যো নম, ওঁ যাং যমায় কৃষ্ণবর্ণায় প্ৰেতাধিপতয়ে নম—এবং এই সব মন্ত্র উচ্চারণের মধ্যে তাঁর কিছুটা বাহ্যজ্ঞান লোপ প্রাপ্ত হতে থাকলে, অতীশের বাড়িঘরের ছবি কেমন ভাসতে ভাসতে কোন এক চলচ্চিত্রের মতো দেখলেন, বাড়িতে অতীশ নেই, বৌমা নেই। টুটুল মিণ্টু হাসুকে জড়িয়ে শুয়ে আছে—গভীর অন্ধকারে মনে হচ্ছে, আরও কেউ। কে সেই নারী, তাকে তিনি চিনতে পারলেন না। সে কোন শক্তি? তিনিই কি সেই পঞ্চদশ শক্তির কেউ!

আর ঠিক তখনই চন্দ্রনাথ হাসুর গলা পেলেন। এত সকালে! কোন ট্রেনে এল। রাত দশটার! দশটার ট্রেনে এলে গাড়িটা ভোররাতে পৌঁছায়। রাতের ট্রেনে আসার যে কী দরকার। দিনকাল ভাল যাচ্ছে না। চুরি, রাহাজানি, খুন, ছিনতাই ছাড়া খবর নেই কাগজে। তার উপর নতুন উৎপাত নকশাল। গাঁয়ে গঞ্জে শহরে লাশ পড়ে থাকছে।

চন্দ্রনাথ তাড়াতাড়ি আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। বাইরে বের হয়ে দরজার শেকল তুলে দিলেন। খড়ম পায়ে হাঁটাচলার অভ্যাস। দেখলেন বারান্দার জলচৌকিতে হাসু বসে। ধনবৌ নাতিনাতনীর খোঁজখবর নিচ্ছে।

এত সকালে ঠাকুরঘরে চন্দ্রনাথ ঢোকেন না। কোনো দুর্বিপাকে পড়ে গেলে ঠাকুর ভরসা। ধনবৌ অলকা হাসু সবাই চন্দ্রনাথকে যে লক্ষ্য করছে, চন্দ্রনাথ যে ভাল নেই, এত সকালে গরু বাছুর গোয়াল থেকে বের না করে সোজা গৃহদেবতার পায়ের কাছে চুপচাপ বসে থাকার কী অর্থ তারা বুঝতে পারছে না। এমন কী উদ্বেগ মানুষটার মধ্যে, তারা ভাবতেই পারে। কোনো উদ্বেগে পড়ে গেলেই চন্দ্ৰনাথ যে অসময়ে ঠাকুর ঘরে ঢুকে যান তারা জানে। উদ্বেগ যে ছিল না তা তো নয়। অতীশের গ্রহসমাবেশ খারাপ, মৃত্যুযোগ এমন এক উচাটনে বাড়ির সবাই ভেঙে পড়েছিল। পঞ্চতীর্থকে নিয়ে গিয়ে গ্রহদোষ খণ্ডন করিয়ে আসার পর আবার কোন উচাটনে পড়ে গেল! মানুষের তো সরল বিশ্বাসের শেষ নেই। নানাবিধ সরল বিশ্বাসই মানুষকে বিপদআপদের শংকা থেকে রক্ষা করে। তিনি কিছুটা গম্ভীর গলায় বললেন, রাতের ট্রেনে এলে কেন? তোমাদের কি আর কোনো ট্রেন নেই!

হাসু উঠে এসে বাবাকে প্রণাম করল। মাসখানেক পর সে ফিরছে। প্রায় প্রবাস থেকে ফেরার মতোই। প্রণাম না করলে বাবা মনে কষ্ট পাবেন হাসু জানে। সে কিছুটা কৈফিয়ত দেবার মতোই বলল, মেজদা যে বলল বৌদিকে খবরটা দিয়ে আসার জন্য।

কী খবর! কিসের খবর!

টুটুল মিণ্টু ভাল আছে। খবরটা বৌদিকে দিয়ে আসতে বলল।

টুটুল মিণ্টু ভাল আছে! আমি তোমাদের কথা ঠিক বুঝতে পারছি না। ওদের কি কোনো অসুখবিসুখ? বৌমা কবে গেল? অতদূরে একা থাকতে পারবে! ওরাই বা থাকবে কেন? একটা চিঠি পর্যন্ত দেয় না। ভেবেছে কী! সেই গুসকরার কাছে কোথায় যেন জায়গাটা। ওখানেই গেল শেষ পর্যন্ত!

এত প্রশ্ন এক সঙ্গে বাবার, হাসু গোলমালে পড়ে যাচ্ছে। দাদা বৌদি যে দিন দিন একরোখা হয়ে উঠছে, বাবা বুঝতে পারছেন না। সে মাসখানেক থেকে টের পেয়েছে, বাবার মতো দাদার জীবন সরল সাদাসিধে নেই। বৌদি ভাগ্যের উপর নিজেকে ছেড়ে দিতে রাজি না। বাবা জীবনে অন্নবস্ত্র এবং আশ্রয় ছাড়া কিছু বোঝেন না। মানুষের জীবনে এটাই শেষ কথা নয় বৌদিকে দেখে, বৌদির বাপের বাড়ির লোকদের দেখে বুঝেছে। খটাখটি দু’জনে লেগেই আছে। দাদাও ভাল নেই। দিন দিন কেমন হয়ে যাচ্ছে। হাসুকে বলেছে, তোরা পড়াশোনা করলি না, খাবি কী করে! একা কতদিক সামলাব! আমার সংসার আছে না! অবশ্য বাবাকে সে এ-সব কথা বলতে পারবে না। বাবা কষ্ট পাবেন। তবে কী সত্যি শেকড় আলগা হয়ে গেল! বড়দার মতো সম্পর্কহীন মানুষ হয়ে যাচ্ছে মেজদাও। সংসারের প্রতি কর্তব্য—সেখানে আমার তোমার আসে কী করে! বাবার আমলে একান্নবর্তী সংসারে—এক- দুজনের আয়ে গোটা সংসার চলেছে। বাড়ির কেউ বাড়তি নয়। সবাইকে নিয়ে জীবন। মেজ জ্যাঠামশাই আর বাবার উপর ছিল সব ভার। ছোট কাকা বাড়িতে থাকতেন। ঠাকুরদা ঠাকুমা পাগল জ্যাঠামশায়, বড় জেঠিমা—কত লোক সংসারে। এ-দেশে এসে সবাই আলগা হয়ে গেল। বাবার কি আক্ষেপ। সবাইকে নিয়ে জড়িয়ে থাকার মধ্যে আলাদা আনন্দ আছে, এখনকার ছেলেমেয়েরা তা বোঝে না।

হাসু জামা খুলে অলকার হাতে দিয়ে বলল, ওখানেই গেল। আসার পথে খবরটা বৌদিকে দিয়ে এলাম।

আসার পথে?

ঐ আর কি। হাসু উঠে বসল। সারা রাত খাগড়া স্টেশনে বসে ছিল। সে বর্ধমানে নেমে বাসে গেছে। বৌদিকে খবর দিয়ে ঘণ্টাখানেকও ছিল না সেখানে। দুটো মুখে গুঁজে আবার বাস ধরেছে। বাসে কাটোয়া। আজিমগঞ্জের ট্রেনে উঠে খাগড়া স্টেশন। ট্রেন চার পাঁচ ঘণ্টা লেট। এত রাতে আর কোথায় যায়। প্ল্যাটফরমের বেঞ্চে শুয়ে রাত কাবার করে দিয়েছিল। কথা বলতে আর ভাল লাগছে না। তাড়াতাড়ি স্নানটান সেরে কিছু খেয়ে শুয়ে পড়বে—আর তখনই কি না বাবার অজস্র প্রশ্ন।

কবে গেল!

কবে অতীশ ফিরল!

তুমি কবে গেলে!

কান্নাকাটি করে নি তো!

তোমার মা যাবে কি করে! তার সংসার আছে না! ছেলে তো চিঠি লিখেই খালাস। আরে নিজের ঘরবাড়ি ফেলে কে কোথায় কতদিন পড়ে থাকতে পারে!

আসলে চন্দ্রনাথ বিপন্ন বোধ করছেন। স্ত্রীকে ছেড়ে প্রবাসে থাকার কষ্ট কী তিনি তা জানেন। ছলছুতোয় জমিদারের আদায়ে বের হয়ে বাড়ি ঘুরে যেতেন। স্ত্রীর প্রতীক্ষা কী গভীর এবং এই বার বার ফিরে আসার মধ্যে জীবনে অন্য এক মাধুর্য আছে তিনি তা জানেন। তবু কতদিন পর বৌমা তাঁর ফিরতে পারবে—বেশিদিন, দু’জন দু-মেরুর বাসিন্দা হয়ে থাকলে, কোনো আলগা স্বভাবের তাড়ায় সে সম্পর্ক শিথিল হয়ে যাবে না কে বলতে পারে! বিশেষ করে বৌমা চাকরি করবে এটাই তাঁর পছন্দ না। বাড়ির মর্যাদা এতে ক্ষুণ্ন হয়, এমন এক ধারণার বশবর্তী তিনি। তাঁর মেজপুত্রটির কপালে যে দুর্ভোগ আছে, এটা কেন জানি বার বার মনে হচ্ছে তাঁর। তিনি কেমন অসহায়ের মতো বললেন, যাকগে যা ভাল বোঝে করবে। শেষে কী ভেবে বললেন, টাকা পয়সা কিছু দিয়েছে?

হাসু দাদার দেওয়া টাকা বের করে দিল। চন্দ্রনাথ টাকাটা গুণে দেখলেন না। মাসোহারা যা দেবার তাই হয়তো দিয়েছে। ধনবৌ এতক্ষণ একটা কথা বলে নি। টাকাটা চন্দ্রনাথ ধনবৌকে দিলে বলল, কত পাঠিয়েছে?

হাসু বলল, দাদা পরে আবার পাঠাবে বলেছে। হাতে টাকা পয়সা নেই। দাদার কারখানার অবস্থা ভাল না। কিছু কম দিয়েছে। ধনবৌ রুষ্ট গলায় বলল, এত টান যখন না দিলেই পারত। আমরা কে? এত অবুঝ মা, হাসু কি বলবে বুঝতে পারছে না। সে কিছুদিন থেকে বুঝেছে দাদার এক দণ্ড বিশ্রাম নেই। সকাল আটটা না বাজতেই, রাজবাড়ির অফিস, তারপর কারখানায়। ফিরতে রাত হয়ে যায়। টুটুল মিণ্টুর পড়াশোনা, বৌদি দেখত। এখন তাও দাদাকে দেখতে হবে। সবাই যখন শুয়ে পড়ে তখন তার দাদা রাত জেগে লেখে। অনেকদিন দেখেছে, গভীর রাত, দাদা টেবিলেই ঘুমিয়ে পড়েছে। এ-সব দেখে তার মনে হয়েছে, জীবনে দাদার বড় রকমের তাণ্ডব শুরু হয়েছে। এখন তারা যদি বসে খায়, বসে খায় কথাটা হাসুকে কিছুটা দ্বিধায় ফেলে দিল। পড়াশোনা করতে ভালই লাগে না। মাথায় কিছু ঢুকতে চায় না। কিন্তু দাদার এই বিড়ম্বনার মূলে তারাও যেন কম দায়ী নয়। সে কেমন খেপে গিয়ে বলল, এতেই চলবে। চলে তো যাচ্ছে। না পারলে কী করবে!

আমার বেলায় যত অভাব সবার! কে দিতে বলে! যেমন অক্ষম মানুষের হাতে পড়েছি, দ্যাখ তোদের কত দুর্গতি হয়। সবে শুরু।

হাসু বলল, আচ্ছা মা, দাদা না’ পারলে কী করবে! চেষ্টা তো করছে। কবে কম দেয় বল! তোমরা দাদার দিকটা একদম বোঝ না।

অলকা বলল, রাখ, বৌদির বুদ্ধিতে দাদা চলে। আমি যাই নি বলে রাগ। টাকা কম দিয়েছে।

চন্দ্রনাথ গোয়ালের দিকে যাচ্ছিলেন। টাকা নিয়ে তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছে। তাঁর পুত্র কি রোজগার করে আজ পর্যন্ত সেটাই তিনি জানলেন না। কোথায় যেন পুত্রটির মধ্যে গোপন করে যাবার স্বভাব গড়ে উঠেছে। তুই কারখানার ম্যানেজার বলে কথা! কটা টাকা আমাদের দিস! এতে এত বড় সংসার চলে! তোমার পিতৃদেবের গলায় কত বড় কাঁটা ফুটে আছে দেখছ না। অলকার দিকে তাকালে তাঁর এটাই শুধু মনে হয়। দরকারে, দু-চার বিঘা ধানি জমি না হয় বিক্রি করে দেবার কথাও যে না ভাবছেন তা নয়!

তারপরই চন্দ্রনাথের মনে হল, তিনি কোথাও, তিনি কেন সবাই, এক স্বার্থপর মানুষের ভূমিকায় নেমে পড়েছেন। বৌমা চলে গেল। কে দেখবে ওদের। অতীশ তো সকালে বের হয়ে যায়। কাকে রেখে বৌমা নিশ্চিন্তে যেতে পারল! চন্দ্রনাথের মধ্যে অধীরতার সৃষ্টি হতেই ফিরে এসে বললেন, বৌমা যে চলে গেল, ওরা থাকবে কার কাছে?

হাসু ঘরে প্যান্ট ছাড়ছে। বারান্দায় ধনবৌ বসে আছে। অলকার মুখ গম্ভীর। এত বড় উপার্জনশীল দাদা মাথার উপর থাকতে সংসারে টানাটানি। কেন যে তার সব ক্ষোভ বৌদির উপর গিয়ে পড়ে শেষ পর্যন্ত সে বুঝতে পারে না। দাদার বিয়ের আগে কী সুন্দর জীবন ছিল তাদের! উপার্জনের সব কটা টাকা দাদা বাবার হাতে তুলে দিত। তারা ছাড়া দাদার অন্য অস্তিত্ব ছিল না। দাদার কি মায়া। সেই দাদা দিন দিন এত স্বার্থপর হয়ে উঠছে ভাবতেই ক্ষোভে জ্বালায় বলে ফেলল, তোমরা বলে ভিক্ষা নাও। আমি না খেয়ে থাকলেও নিতাম না। হাত পাততাম না।

চন্দ্রনাথ টের পান, অলকা দিন দিন কেমন মুখরা হয়ে উঠছে। মেয়েদের মধ্যে এক বয়সে যে সুষমা থাকে, অলকার তা নেই। দিন দিন রূঢ় বদমেজাজী হয়ে উঠছে। ইচ্ছে করলে, অতীশের কাছে গিয়ে থাকতে পারত। তোর ভাইপো ভাইঝি না! কার কাছে আছে, এই নিয়ে কোনো চিন্তা আছে? শুধু টাকাটাই দেখছিস! সেই নারী কে? কে এল! কেমন জলে পড়ে যাবার মতো বললেন তিনি, বৌমা কাকে রেখে গেল? কে দেখবে ওদের!

সুখিদি আছে।

সুখিদিটা কে?

হাসু বলল, রাজবাড়ির পিওনের মেয়ে। স্বামী নেয় না। দাদার কাছে এসে উঠেছে।

চন্দ্রনাথের ক্ষোভ বাড়ছে। বড় পুত্র সম্পর্কহীন। মেজ পুত্রটি অবিবেচক। ছোট দুটি মর্জিমতো চলে। সংসারের দায় সবার, দিন দিন তিনিও এটা বুঝতে পারেন। কিন্তু এমন একটা বয়সে তিনি এদেশে এসেছিলেন, যখন তাঁর পক্ষে নতুন করে জীবন আরম্ভ করা অসম্ভব। তাঁর ব্রাহ্মণী বড় অবুঝ। আড়তে খাতা লেখার একটা কাজ পেয়েছিলেন। দ্বড়কা দাসের দু-নম্বরি খাতা আছে জেনেই, তিনি কাজটা ছেড়ে দিলেন। এই নয় যে পাপবোধ তাঁকে তাড়া করছে বলে ছেড়ে দিয়েছেন—আসলে তাঁর থানা পুলিশের ভয়, মর্যাদার ভয়, না খেয়ে থাকা শ্রেয় ভেবে তিনি বাড়ির চারপাশে গাছপালা লাগাবার প্রতি বেশি মনোনিবেশ করে ফেললেন। আর দু-চার ঘরে যজন যাজন—বাড়তে বাড়তে, তাও কম ঘর হয়নি। মেজপুত্রটি জাহাজে, মাসে মাসে কলকাতার এজেণ্ট অফিস থেকে টাকা আসে। বাড়ির অভাব অনটন নেজপুত্রটিকে দেশান্তরী করেছে। মেজপুত্র সেই যে সংসারের দায় ঘাড়ে তুলে নিল, তারপর থেকে টেনেই যাচ্ছে। জাহাজ থেকে ফিরে সব টাকা তাঁর হাতেই তুলে দিয়েছিল। খালপাড়ের ধানিজমি তখন জঙ্গল। সেই জমি তিনি কিনে নিলেন। এখন সেই জমি তাঁর কাছে যমের মতো। চাষ আবাদে নেশা জন্মে গেছে বলেই জমির প্রতি তাঁর মায়া। হাল দিতে পারছেন না, যা টাকা পাঠিয়েছে, দোকান বাকি দিলেই শেষ। প্রহ্লাদের গত মাসের মাইনে বাকি, জ্বর জ্বালায় ভুগছে—ওর টাকাটা যে করে হোক দিতে হবে। দু-মাসের টাকা! কেমন মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। এ-সব সময়ে ঈশ্বরের শরণাপন্ন হওয়ার স্বভাব তাঁর। তিনি তামাক সাজছিলেন কলকেয়। তামাক টিপে টিপে ভরছেন, এবং ক্রোধ থেকে আত্মরক্ষার জন্য—আসলে তিনি জানেন না, এই ক্রোধ নিজের অলসতার জন্যই কিনা, অথচ কেন যে এখন বাড়ির সবাই কেউ না, তাঁর এমন মনে হচ্ছে, এবং এইসব চিন্তার ক্লেশ থেকে আত্মরক্ষার নিমিত্ত দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে—ব্রহ্মময়ী তারা শব্দ দুটি মুখ থেকে বের হয়ে এল।

তারপরই তিনি বললেন, প্রহ্লাদকে ছাড়িয়ে দেব ভাবছি।

অলকা ধনবৌ বারান্দার খুঁটিতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বেলা বাড়ছে। যেন কারো খেয়াল নেই, কবুতর ছেড়ে দিতে হবে খাঁচা থেকে। অতীশ কোনো মাসে বাড়িতে টাকা কম দিলে, মনে করে তারা, ইচ্ছে করেই দিচ্ছে। পারে না, এটা বিশ্বাস করতে রাজি না। রাজার কারখানায় ম্যানেজার, বাড়ি ভাড়া লাগে না, কী এত খরচ যে তুই যা দিস, তাও দিতে পারিস না সব সময়। অজুহাত সৃষ্টি করিস। এবং তখনই কড়া চিঠি লিখবে ধনবৌ, তোমাকে টাকা না পাঠালেও চলবে। যাদের তোমার মত পুত্র নেই, তাদের চলে না? দশ দুয়ার আছে। ভিক্ষা করে খাব।

অলকা বলল, কাকে ছাড়িয়ে দেবে বললে!

প্রহ্লাদকে।

কেন? কাকা কি করেছে।

কি আবার করবে! সামলাব কোনদিকে।

চন্দ্রনাথের সকালের দিকে অনেক কাজ থাকে। বড় কাজ, মানুষের শুভ দিনক্ষণ এবং আপদবিপদে আশ্বাস বাক্য। এ জন্য সকালের দিকটায়, চারপাশের আবাস থেকে যেমন মানুষজন দৈব দুর্বিপাকে পড়ে আসে তেমনি তাঁকে তাদের আশ্রয়ের কথা বলতে হয়, আশ্বাস দিতে হয়, জীবনে পোকামাকড়ের উপদ্রবের কথা বলতে হয়—এবং এই আশ্বাস ও শুভবার্তা মানুষের দরকার—কিছুটা সময় চন্দ্ৰনাথ এ-জন্যে তাদের দেন। তার উপর অগাধ বিশ্বাস, এই বিশ্বাসকে কিছুতেই নষ্ট হতে দেন না। তাঁর পাঁজি এবং পুরাণ অথবা গীতার শ্লোক সব সময় মানুষকে অহরহ গভীর নদীর জলে ফেলে দেয়, আবার ডাঙায় তুলে আনে। এখন আকাশ ফর্সা, প্রকৃতির ঘাস ফুল পাখির নিরিবিলি ছবি। চন্দ্ৰনাথ তাদের কিছুটা সময়, কিছুটা কেন, কোনো কোনো দিন বেশ বেলা হয়ে যায়—তখনই খেপে যায় ধনবৌ।

রান্নাঘরে তখন হাঁড়ি পাতিলে ঠোকাঠুকি লাগে বেশি। মানুষজন বারান্দায় বসে আছে—খুব বেশি কিছু বলাও যায় না। বললে মাঠাকরুণের অপযশ। অথচ বেলা বাড়ে। কখন ঠাকুরঘরে ঢুকবে, ঢুকলে তো বের হতে চান না, এ হেন মানুষ যদি এতটা বেলা বারান্দায় বসে থাকে, আর মানুষের শুভাশুভের খবর দিতে থাকে—কখন পূজা হবে, কখন খাওয়া হবে, গাই বাছুর কে সামলাবে, এ-জন্য হাত থেকে কাঁসার গ্লাস পড়ে—হুড়মুড় শব্দ হয়, বুঝতে পারেন চন্দ্রনাথ ব্রাহ্মণীর ব্রহ্মতালু জ্বলছে। আর দেরি করা ভাল না। সংসার তাপে ভাপে অহরহ পুড়ছে টের পেলেই দুর্গা দুর্গা বলে তিনি উঠে পড়েন।

সহসা মনে হল, অলকা খেয়ে বের হয়ে যাচ্ছে।

বলা নেই কওয়া নেই, কিরে কোথায় যাবি?

সৌরভদার কাছে যাব।

সৌরভ অতীশের বন্ধু। শহরে থাকে। সরকারি অফিসে কাজ করে। মাঝে মাঝে শহর থেকে এসে খবর নেয় তাদের। অতীশ থাকতে খুবই আসত। এখন বছরে দু-চারবার আসে। লালবাগ যাবার রাস্তায় বাস পেতে দেরি হয়ে গেলে, চলে আসে।

সকাল থেকে একটা কাক তারস্বরে ডাকছে। সকাল থেকে চন্দ্রনাথ এবং ধনবৌ কাকটাকে হুস করেছে। যায় না। কেমন অমঙ্গলের চিহ্ন, গলার স্বরে অস্বাভাবিক তাড়না। চন্দ্রনাথ কিংবা হাসু ভানু কেউ এর তারস্বরে ডাকটা পছন্দ করছে না। লাফিয়ে লাফিয়ে কাকটা ডাল থেকে রান্নাঘরের চালে এসে বসল। আর এ সময় অলকা যাচ্ছে।

চন্দ্রনাথ কেন যে বললেন, আজ বের হবে না!

কেন কি হয়েছে?

সৌরভের কাছে এত কি দরকার বুঝি না।

সৌরভদা বলেছে কোনো স্কুলে ঢুকিয়ে দেবে। একটা দরখাস্ত দিতে বলেছিল।

ঠিক আছে, কাল যাবে। বলে তিনি কাকটাকে লগা হাতে নিয়ে তেড়ে গেলেন।

কিন্তু কোন ফাঁকে যে অলকা বের হয়ে গেছে, বড় রাস্তায় গিয়ে বাসে শহরে গেছে—তিনি জানেন না। বিকেলে ফিরে এলে বললেন, তোকে বারণ করলাম, শুনলি না!

অলকা ঘরের ভিতর ঢুকে জামাকাপড় ছাড়ছে। বাবার কথা শুনছে। সংসারে যে যার মতো আলাদা হলেই বাঁচে।

চেষ্টা করলে সৌরভদা কাজটা করে দিতে পারবে।

স্কুলে ঢোকা কঠিন, তবে সে এবার ঠিক পাস করবেই। সৌরভদা বলেছে, আগে পাস-টাস কর। চাকরি করতে দেবে! মেসোমশাই তো কিছু বলছেন না। কেবল পাত্র খুঁজতে বলছেন। আর তুই এসেছিস চাকরির জন্য!

অলকা বলেছিল, না সৌরভদা, আপনি যে করেই হোক করে দিন। আমি, বাবা মা দাদার গলার কাঁটা। একটা কাজ-টাজ পেলে কিছু নিয়ে থাকা যাবে। কাজটার দরকারও খুব। দাদা কি টাকা দেয়, ওতে চলে বলুন! বাবা তো আমার কিছু বোঝে না। সব ভাগ্য। কপালে থাকলে হয়, কপালে যা লেখা আছে তার বাইরে কিছু হবার নয়। বেশি আশা করলেই কে দেয়। আসলে সে বলতে চেয়েছিল এমন যার বাবা ভাগ্য তার কপাল আর কত ভাল হবে! এত কথা হয়েছে, কিন্তু দরখাস্ত দিতে বলেন নি। আসলে সৌরভদা কি টের পেয়েছে সংসারে কোনো কারণে মাথা গরম হয়ে যাওয়ায় সে ছুটে গেছে—কিংবা তার বৌদি স্কুলে শিক্ষকতা নেওয়ায় কী মনে হয়েছে, সবারই চেষ্টা পায়ের নিচে মাটি ঠিক রাখা, সে কি কোনো হিংসা পোষণ করে থাকে কিংবা ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে ছুটে গেছে। বাবাকে বলেছে, দরখাস্ত দিতে বলেছে, আসলে কোনো কথাই হয় নি—তাকে আগে পাস করা দরকার এবং আজ সকালেই কেন জানি স্থির করে ফেলল তাকে কিছু একটা করতে হবে। যেমন বাবার কন্যা, ভাই-এর বোন, তাতে পাত্র দেখা বিলাসিতা ছাড়া কিছু না। পিওনের কাজ করে। পাঁচ হাজার টাকা নগদ, হাতের গলার এবং কানের। সাইকেল রেডিও ঘড়ি। ভাবলেই চোখ মুখ জ্বালা করত। বৌদি শেষ পর্যন্ত চাকরি নেওয়ায় তার মধ্যে সংসারে কেউ কারো কথা রাখে না মনে হয়েছে। বাচ্চা দুটোকে ফেলে চলে গেছে। মন বলে কিছু নেই! টাকাটাই বড়। এত টাকা রোজগার করে কি হবে! কার জন্য টাকা রোজগার। এত দূরে দাদাই বা ছেড়ে দিল কি করে! মেয়েদের ভো দাদা চেনে না। তারা পারে না হেন কাজ নেই এবং ভয় কিংবা আশংকা, সেই থেকে, দাদাকে ফেলে বৌদি যেন যে-কোন দিন চলে যেতে পারে। এত বড়ঘরের মেয়ে কখনও থাকে! সাত আট বছর পরও মনে হয়েছে, দাদাকে বৌদি গ্রাহ্য করে না। নিজের খুশিমতো চলে। যা খুশি করে বসতে পারে।

এটাও ক্ষুব্ধ হবার কারণ থাকতে পারে। তার মনে হয় দাদাটা তার বেশি ভালমানুষ। মেয়েদের কূটবুদ্ধির কাছে খুবই অসহায়। দাদাকে পর করে দিয়েছে। তারাও যে সংসারে দাদার বোন ভাই, অধিকার তাদেরও যে কম নয়, আজ কেন যেন সেই ধারণা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।

সে বাবার কথার জবাব দিল না।

এ-সময়ে মা তার পক্ষে থাকে।

সে কাপড় ছেড়ে রান্নাঘরে ঢুকে গেছে। মার খেতে বেলা পড়ে যায়। রান্নাঘরে ঢুকে এক গ্লাস জল ভরে দাঁড়িয়ে আলগা করে খেল জলটা। মা বলল, কিছু খাবি না? সৌরভ কিছু বলল?

সৌরভদা কী বলবে! ছাই বলেছে। এমন বলতে ইচ্ছে হল। আসলে সে মাথা ঠিক রাখতে পারে নি, সে-জন্যই ছুটে গেছে। স্কুল ফাইনাল পাস করতে না পারলে, কোনো স্কুলেই কাজ হবে না। প্রাইমারি স্কুলে ঢুকতে হলে মাদার টিচারের পোস্ট আছে, ওতে একমাত্র ঢুকতে পারে—কিন্তু প্রমাণপত্রে তাকে বিধবা অসহায় নারী হতে হবে। সে তো তা নয়। মাকে বুঝিয়ে লাভ নেই। তার মাথা গরম হয়েছে আসলে বৌদি চাকরি নিয়ে দূরে চলে যাওয়ায়—তুমি পার, আমরা পারি না!

মা ফের বলল, হঠাৎ তোর মাথায় পোকা উঠল কেন শহরে যাবার জন্য?

এতক্ষণে সে কিছুটা শান্ত হয়েছে। যা হবার হবে। দাদার কপালে দুঃখ আছে। সকাল থেকে দাদার দুর্ভাগ্য ভেবে আসলে ছোটাছুটি করেছে, এখন ভাবছে—যা হবার হবে। সে বলল, পাস করলে স্কুলে ঢুকিয়ে দেবে বলেছে। মাথা ঠাণ্ডা করে পড়াশোনা করতে বলল।

তাই কর। খাই না খাই যুগিয়ে যাব।

এই যুগিয়ে যাওয়ার অর্থ, যে তিনবারেও স্কুল ফাইনাল পাস করতে পারে না, সে আর পারতে পারে মনে হয় না—তবু যুগিয়ে যেতে হবে। টিউশানের টাকা যে করেই হোক দিয়ে যেতে হবে। হাসু ভানু লেখাপড়া ছেড়েই দিল। তবু মেয়েটা যদি তার পাসটাস করে। চাকরি পায়। এবং এক এক করে বড় পুত্র মেজ পুত্র দূরে সরে গেলে—এরাই তার এখন সব। এই বাড়িঘরের প্রতি যে মায়া, কোথাও গিয়ে দু-দণ্ড স্থির হয়ে বসার উপায় থাকে না—তার একমাত্র কারণ, এরা চারপাশে আছে বলে।

তখনই ভানু দৌড়ে আসছে।

এত দ্রুত সে ছুঁটে আসে না। কী আবার ঘটল কে জানে! চন্দ্রনাথ পুকুরের দিকটায় বেড়া দিচ্ছিলেন। শাবল নিয়ে গর্ত করছিলেন। তখনই ভানু বলল, বাবা মেজ জ্যাঠামশাই আসছেন।

মেজদা! কতদিন মেজদাকে দেখেন নি চন্দ্রনাথ। তিনি নিজে এসেছেন। মেজদা ইদানীং কোথাও আর যান না। সংসারের তিনিই এখন প্রবীণ মানুষ। বুদ্ধি পরামর্শ তাঁর কাছেই নিতে হয়। কখনও কখনও অসহায় বোধ করলে, মেজদার কাছে ছুটেও যান চন্দ্রনাথ। মাথার উপর গাছের ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে আছেন। প্রাজ্ঞ মানুষ। সংসারের ভালমন্দ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। যে যার মতো চলবে—কোনো উৎপাতের শামিল যেন তিনি না হন, সেই ভেবে কিছুটা নির্বিকার হয়ে গেছেন। সারা সকাল বারান্দায় বসে থাকেন চেয়ারে। কালী কালী করেন। শ্যামা সংগীত গান। শ্যামা মা আমার। কিংবা বসন পর, ভূষণ পর—এই গানের মধ্যে, তলিয়ে গেলে, মনেই হয় না মানুষটার বেঁচে থাকার জন্য আর কিছুর দরকার আছে। বিকাল হলে বেড়াতে বের হন। বাড়ির সামনে গঙ্গা। নদীর চর। নদীর চর ধরে হেঁটে কখনও অন্ধকারে মিশে যান। রাত হলে বাড়ি ফেরেন। তাঁর জন্য একমাত্র বড়বৌ অপেক্ষায় থাকে। পল্টু বাড়ি থাকলে রাস্তায় লণ্ঠন নিয়ে এগিয়ে যাবে। বয়স হয়ে গেছে, চোখেও ভাল ঠিকঠাক দেখতে পান না, ফিরতে দেরি হলে চিন্তা হবারই কথা।

মেজদা সংসারে কেমন বাড়তি মানুষ হয়ে গেলেন! বৌমা মনে করে গলগ্রহ। অথচ এরা বোঝে না—এই মানুষটাই ছিল সব। তিনি ছিলেন বলেই, এ-দেশে চলে আসা গেছে। তাঁর দূরদৃষ্টিতেই আজ যে যেখানে পেরেছে গাছ পুঁতে দিতে পেরেছে।

চন্দ্রনাথ দেখলেন, মেজদা রিকশা থেকে নামছেন। হাসু দাদাকে হাত ধরে নামাচ্ছে।

রিকশা থেকে নামলে হাসু প্রণাম করল।

তিনি দু-হাত উপরে তুলে উচ্চারণ করলেন, কালী কালী।

চন্দ্রনাথ প্রণাম করল।

কালী কালী।

এই এক উচ্চারণ, আশীর্বাদ নয়, ঈশ্বরের নাম করে তিনি যেন বলতে চান—সব মায়ার বন্ধন- ইহ-সংসারে, কিংবা এই যে গাছপালা, নদী মাঠ, নক্ষত্র—কিংবা কোনো তারবার্তায় সাংকেতিক ধ্বনি, যা কিছু বিজ্ঞান অথবা জড় এবং জড়তা সবার মূলে সেই দেবী—যা দেবী সর্বভূতেষু হয়ে আছেন।

বাড়ির উঠোনে এলে ধনবৌ গলবস্ত্র হয়ে প্রণাম করল।

কালী কালী।

ধনবৌ বিশাল ঘোমটা টেনে দিয়েছে।

কারো তিনি কুশল নেন না। প্রশ্ন করলেন না, তোমরা কে কেমন আছ। কারণ তিনি মনে করেন, এই প্রশ্ন করার যথার্থ অধিকার তাঁকে কে দিয়েছে? কাউকে ভালমন্দ রাখার তিনি কেউ নন। যিনি রাখার রাখেন। প্রশ্ন করলে যেন খোদার উপর খোদগারি হয়ে যায়। তিনি চেয়ারে বসলে, চন্দ্ৰনাথ জলচৌকিতে বসে পড়লেন।

চন্দ্রনাথই প্রশ্ন করলেন, বড়দার কাজ কবে ঠিক করলেন?

সেজন্যই এসেছি। বিধান কী হবে, তুমি একবার পঞ্চতীর্থকে ডেকে জেনে নাও। আর তোমার

সঙ্গে একটা পরামর্শ আছে।

চন্দ্রনাথ তামাক সাজাচ্ছেন।

হাত পা ধোবার জল দিয়ে গেছে অলকা।

পকেট থেকে কিছু কাগজপত্র বের করে দেখছেন ভূপেন্দ্রনাথ। গরম পড়ে গেছে। বিকেলের দিকে ঠাণ্ডা পড়ে। কিন্তু আজ যেন তাও পড়ে নি। শরীরে ঘাম হচ্ছে। কপালে ঘাম। ভূপেন্দ্রনাথ কোঁচার খোঁটে মুখ মুছে বললেন—আমার এটাই শেষ কাজ বুঝলে, ভাবছি সবাইকে খবর দেওয়া দরকার। সবাই এলে, তাঁর আত্মা মুক্তি পাবে।

তাঁর আত্মা!

চন্দ্রনাথ বুঝতে পারলেন, মেজদা বড়দার আত্মা সম্পর্কে চিন্তিত।

বড়দার আত্মা ঘোরাঘুরি করছে, অশুভ প্রভাব থেকেই পল্টুর ছেলেমেয়েরা ভুগছে, বৌমার পেটে ঘা—সব অশুভ প্রভাবে হচ্ছে, এমন বিশ্বাস জন্মে গেছে বড়দার পুত্র এবং পুত্রবধূর। কবে থেকেই তাড়া খাচ্ছেন বড়বৌ, তবে রাজি করানো যাচ্ছিল না, ইদানীং রাজি হয়েছেন, রাজি হলেই কাজ হবে, এমন কথা থাকে না। কারণ পল্টুর ছুটি পাওনা আছে কিনা, ছুটি না পেলে আসবে কি করে—সব ঠিকঠাক করে তবে কাজে নামা, টাকা পয়সা সংগ্রহ করার বিষয়টাও রয়েছে—সবাইকে লেখা হবে, যেমন, সোনাকে লিখলে সে যদি কিছু দেয়—পল্টুকেও লেখা হবে, এমন কী চন্দ্রনাথকেও কিছু বোধ হয় দিতে হবে, কারণ বড়দার পুত্র পল্টু কোনোরকমে একটা ভুজ্যি দিয়ে কাজটা সারতে চাইছে। বৌমার বিরক্ত মুখ দেখে বুঝেছে, শ্রাদ্ধ এবং মন্ত্রপাঠ, যত কম খরচে সম্ভব—অথচ এরা বোঝে না, বাড়ির সব চেয়ে মেধাবী এবং সুপুরুষ মানুষটির শ্রাদ্ধ হেলাফেলায় সারলে তাঁর মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হবে। তাছাড়া তিনি যখন বেঁচে আছেন, তিনি অর্থাৎ ভূপেন্দ্রনাথ বেঁচে থাকতে তাঁর দাদার শেষ কাজে কোনো সমারোহ থাকবে না বিশ্বাস করতে রাজি না। বিয়ে থা করলেন না—একা মানুষ—তাঁর আর কি দায়! এই শেষ দায় থেকে অব্যাহতি পাবার জন্যই যে ছুটে এসেছেন মেজদা, বুঝতে কষ্ট হল না চন্দ্রনাথের।

নিন। বলে চন্দ্রনাথ হুঁকা এগিয়ে দিলে—দু-বার হুকায় ফুঁ দিলেন। আবার সেই এক প্রসন্ন মেজাজে উচ্চারণ—কালী, কালী—যেন সবই তাঁর ইচ্ছেতেই হচ্ছে, হুঁকায় টান দেবার মুহূর্তটিও তাঁর কাছে নিশ্চিত মুহূর্ত নয়—কারণ তিনি কি ভেবে বললেন, তোমার মনে আছে গগন পণ্ডিতের কথা।

চন্দ্রনাথ বললেন, মুড়াপাড়া ইস্কুলের গগন পণ্ডিত

হ্যাঁ।

মনে আছে।

তিনি গত হয়েছেন। তামাক খাবেন বলে হুঁকাতে টান দেবেন, আর তখনই সন্ন্যাস রোগের আক্রমণ। দু-দণ্ড সময় পাওয়া গেল না। আমি গেছিলাম। তাঁর ছেলেরা ধুবুলিয়ায় বাড়ি করেছে। চার ছেলে। পৃথক অন্ন। তিনি বড় ছেলের সঙ্গেই ছিলেন। ছেলেরা বলল, বাবা খুব ভাল গেছেন। কাউকে ভোগান নি।

তারপর হুঁকায় দু-বার টান দিয়ে মনে হল, হাওয়া ঠিক টানছে না। কলকে খুলে দু-বার নলচেতে ফুঁ দিলেন, কলকে বসিয়ে আবার টান দিয়ে বললেন, তুমি সোনাকে লিখে দাও, সে যেন আসে। অতি অবশ্য যেন আসে। আর কিছু অর্থেরও যেন সংস্থান রাখে। বাড়ির নিখোঁজ মানুষের কাজ। সবারই উচিত সামর্থ্য অনুযায়ী দেওয়া। এতে সংসারে মঙ্গল হয় জানবে। তারপরই বললেন, বৌমা কি সব অসুখ-বিসুখে ভুগছে?

ভাল আছে। চন্দ্রনাথ তারপর কি ভেবে থেমে গেলেন, বৌমা যে গুসকরার দিকে কোথায় কাজ নিয়ে চলে গেছে বলতে দ্বিধা হচ্ছিল। তিনি এমন খবরে আঁতকে উঠতে পারেন। তাঁর জীবন এক রকমের—আর তাঁর ভাইপোদের জীবন অন্যরকমের জানতে পারলে দুঃখ পেতে পারেন। এই সব অস্বস্তি যখন চন্দ্রনাথকে পীড়া দিচ্ছিল, তখনই মনে হল, তাঁকে খবরটা না দিলেও দুঃখ পেতে পারেন। চন্দ্রনাথ অন্যন্যোপায় হয়ে যেন বললেন, বৌমা তো মাস্টারি নিয়ে গাঁয়ে চলে গেছে।

ভূপেন্দ্রনাথ হুঁকা থেকে মুখ তুলে বিস্ময়ের সঙ্গে চন্দ্রনাথকে দেখছিলেন।

চন্দ্রনাথ মাথা গোঁজ করে বসে আছেন।

দুটো শিশুকে ফেলে রেখে চলে যাওয়ায় যেন কী এক অশুভ ইংগিত বহন করছে। দুই প্রবীণ মানুষ—জীবনের এই আঘাটায় শেষে এসে পড়তে হবে এ-জন্য কেউ যেন প্রস্তুত ছিলেন না। নিজের সংসার ফেলে এ-ভাবে কোনো বাড়ির বৌ চাকরি সূত্রে সরে পড়তে পারে ভাবতে গিয়ে ভূপেন্দ্রনাথ সহসা চিৎকার করে উঠলেন, যেন নাভীমূল থেকে গম্ভীর আওয়াজ উঠে এল, কে জানে শব্দই ব্ৰহ্ম কথাটির ভেতর গভীর কোনো বনবাসের ছবি ফুটে উঠছে কিনা। কালী কালী! যেন এক করালবদনাং ঘোরাং মুক্তকেশী সামনে দাঁড়িয়ে—মহাকালের বাদ্য বাজছে চারপাশে। সৃষ্টি স্থিতি বিনাশ সর্বক্ষণ তাড়া করলে যা হয়—তিনি শুধু বললেন, নিয়তি।

নিয়তি ছাড়া আর কি বলুন!

এ-সব খবরে কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়ার সময় ভূপেন্দ্রনাথ বললেন, বাচ্চা দুটো কার কাছে আছে? ওর তো অফিস। কে দেখবে ওদের!

লোক রেখেছে।

একটা লোকের খাওয়া খরচা তো কম নয়। জামা-কাপড় মাইনে অসুখ-বিসুখ … এ সব বলার সময়ই ভূপেন্দ্রনাথ সহসা হা হা করে হাসতে থাকলেন। কিছু করার নেই, বুঝলি চন্দ্র, আমাদের হাত পা বাঁধা। মনে কষ্ট পাস না। আমারও যে হঠাৎ কী ভীমরতিতে ধরেছে, এই নিয়ে ভাবছিলাম। সব ঠিকই চলে। বলে হাত মুখ প্রক্ষালন করার জন্য বারান্দার ঢালু অংশে গিয়ে বসলেন।

এখানে এলে এক দু দিন থাকেন। সকালে পঞ্চতীর্থকে ডেকে আনতে হবে।

এবং পরদিন সকালেই পঞ্চতীর্থ এলে ফর্দ তৈরি হল।

দুই ভাই মিলে পরামর্শ করলেন কিছুক্ষণ। বারান্দায় মাদুর পাতা, তার উপর কম্বল পাতা—ভূপেন্দ্রনাথ উবু হয়ে লিখছেন। চন্দ্রনাথ বলে যাচ্ছেন—কারণ চন্দ্রনাথের কাছে একটি আত্মীয়-স্বজনের তালিকা আছে। ভূপেন্দ্রনাথের কাছেও আছে। মিলিয়ে দেখা হচ্ছে, কেউ বাদ যাচ্ছে কিনা। বাদ গেলে টুকে নিচ্ছেন ভূপেন্দ্রনাথ

এভাবে এক বিকালে অতীশ বাসায় ফিরে একটি চিঠি পেল। খামের উপরে লেখা—অতীশ দীপঙ্কর ভৌমিক। মেজ জ্যাঠামশাই লিখেছেন, তাঁর হাতের লেখা।

পরমকল্যাণ বরেষু,

আশা করি তোমরা মহামায়ার কৃপায় কুশলে আছ। বৌমা এখানে না কর্মস্থলে? আগামী ১৮ বৈশাখ তোমার পাগল জ্যাঠামশাই-র পারলৌকিক কাজ সম্পন্ন হইবে। তুমি সকলকে লইয়া অতি অবশ্য আসিবে। আর তোমার পাগল জ্যাঠামশাইকে দেবমণ্ডলে যাত্রা করাইবার জন্য আব্রহ্ম-ভুবনালোকে সতিল জলাঞ্জলীর ব্যবস্থায় অর্থের দরকার। আশা করি তাঁর আত্মার সদগতিতে তোমার এই অর্থ প্রদান বৃথা যাইবে না। কারণ তাঁর অশুভ আত্মার প্রকোপের কথা নিশ্চয়ই তোমার কর্ণগোচর হইয়াছে। তোমাদের সবার জীবনেই নানা সংকট হাজির-এমত অবস্থায় সেই অশুভ আত্মার প্রকোপ থেকে নিষ্কণ্টক হইতে হয়। তোমার অর্থ প্রদান উহাতে কিঞ্চিৎ জল সিঞ্চন করিবে।

ইতি
আশীর্বাদক
ভূপেন্দ্রনাথ ভৌমিক

অতীশ চিঠিটা বার বার পড়ছে।

দেবলোকে যাত্ৰা!

প্রহসন! তারপরই মনে হয় তার দুই শিশুর উপর কেউ যেন প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠছে। সে ভয় পায় প্রহসন ভাবা ঠিক হয় নি। প্রহসন ভাবা মানে জ্যাঠামশাইয়ের মহামায়াকে অস্বীকার করা, দেবতা এবং ঋষিদের উপেক্ষা করা—আব্রহ্মণ ভুবনালোককে অস্বীকার করা অর্থাৎ নিজের এই অস্তিত্বকে অস্বীকার করা—এতে মঙ্গল কার্য সিদ্ধ হয় না। সন্তানের অমঙ্গল ডেকে আনার কোনো অর্থ হয় না। প্রহসন শব্দটি মাথায় তার কেন যে দংশন করল বুঝতে পারছে না। যেমন সে অনেক কিছুরই অর্থ বোঝে না। বাবা তাকে নানাভাবে ঈশ্বরের প্রীতির কথা বুঝিয়েছেন—অথচ সে ঈশ্বরের প্রতি কোনো প্রীতিই বোধ করে না—শুধু সে ভয় পায়, আতঙ্কে থাকে ঈশ্বরের নামে—এই যে জ্যাঠামশাইর পারলৌকিক কাজে আর্থিক সাহায্য চাই—তা সে যতই অসুবিধার মধ্যে থাকুক—কিছু অর্থ সংগ্রহ করে নিয়ে যেতেই হবে—জ্যাঠামশাইকে সে ভালবাসত, কিন্তু সেই ভালবাসা কিংবা মায়ার কথা এখন ভাবতেই পারছে না। যেন অর্থ সংগ্রহ করে না নিয়ে গেলে, বড়ই গর্হিত কাজ করে ফেলবে। এই অর্থদণ্ড তার সংসারের শান্তি বিধানের জন্য। সে না করতে পারে না। হঠাৎ বাবার মুখ ভেসে উঠলে অতীশ দেখতে পেল, তিনি যেমন বলে থাকেন, বলে যাচ্ছেন—মুখে রহস্যময় হাসি। তিনি বলছেন, ধর্মায় নম, অধর্মনায় নম। জ্ঞানায় নম অজ্ঞানায় নম।

অর্থাৎ ধর্ম অধর্ম, জ্ঞান অজ্ঞান সবই ঈশ্বর। সবই এই অস্তিত্বের দংশন। তুমি কাউকে অবহেলা করতে পার না। জীবন রহস্যের এক অগাধ সলিলে সাঁতার কাটছ বাছা। মনের শান্তির প্রয়োজনে সব কিছু মেনে নিতে হয়। তাঁকে স্বীকার করলে জ্ঞান-অজ্ঞান, ধর্ম-অধর্ম সব প্রদীপন্তে প্রযচ্ছামি প্রসীদ পুরুষোত্তম

কে সেই পুরুষোত্তম!

যোহন! ক্রুশবিদ্ধ মানুষ!

বনির সেই যোহন কী পুরুষোত্তম! কিংবা কোনো গভীর সৃষ্টির সেই আদি অন্তহীন ব্যাপ্ত মহাকালের বিকাশ! সে কেন যে বিশ্বাসও করতে পারে না আবার অবিশ্বাসও করতে পারে না।

সে ক্যালেণ্ডারের পাতা উলটে দেখল, কি বার। ইংরাজি মাসের কত তারিখ। বাংলা মাসের হিসাব মিলিয়ে বুঝল, নির্মলার গরমের বন্ধ পড়তে দেরি হবে। তার আগেই কাজ। টুটুল মিণ্টুকে সঙ্গেই নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু মুশকিল, নির্মলা কখনও কখনও শনিবারে চলে আসে, রবিবার থেকে, সোমবার ভোরে ব্ল্যাক-ডায়মণ্ড ধরে চলে যায় নির্মলা। সে এতদূর থেকে ঠেঙিয়ে এসে বাসা ফাঁকা দেখলে মাথা ঠিক রাখতে পারবে না। নির্মলাকে চিঠি লেখার দরকার। সে যদি ওখান থেকে সোজা বাড়ি চলে যায়, তা হলে ঝামেলা থাকে না।

এ-ছাড়া নির্মলার যাওয়া উচিত। না গেলে গোলমেলে প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে। অপছন্দ। তার বাড়ির মানুষজনদের অপছন্দ—তাই এল না। অতীশ চায় না নির্মলার কোনো অপযশ হোক। অপযশ হলে সে কেমন ছোট হয়ে যায়—এবং চিঠিতে সব খুলে লিখল—কেন যাওয়া দরকার! দু-এক দিনের ছুটি নিয়ে বাসে কাটোয়া, ট্রেনে খাগড়া ঘাট—এবং নদী পার হবার কথা লিখতে গিয়ে কেমন থেমে গেল। নির্মলা সাঁতার জানে না।

আসলে সে কী সব সময় কেবল বিনাশের কথা ভেবে থাকে! প্রিয়জনকে হারাবার উদ্বেগ কী তার প্রবল। আর দশজনের মত সে হতে পারে না কেন? না কী মানুষ মাত্রেই উদ্বেগের শিকার। কারো কম, কারো বেশি। এই উদ্বেগ মানুষকে কত দুর্বল করে ফেলতে পারে—চিঠিটা তার প্রমাণ। খেয়াঘাটের বর্ণনা দিল। ও রাস্তায় নির্মলা কখনও ফেরে নি। যেমন নদীর জল এ-সময় নেমে যাবে, পাড় খাড়া, পা স্লিপ করার আশংকা, নৌকায় কি কখনও উঠেছে নির্মলা, নৌকা টালমাটাল হয়ে যায় উঠলে, নির্মলা কী,জানে! তারপরই কী ভেবে সে চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলল।

দরকার নেই।

সে মিণ্টু টুটুলকে নিয়ে যাবে। শুধু নির্মলাকে খবরটা জানিয়ে দিতে হবে। অযথা ঠেঙিয়ে এসে যেন ফিরে না যায়। সে বাড়ি যাচ্ছে তার পাগল-জ্যাঠামশাইর পারলৌকিক কাজ—না গেলে কথা হবে।

চিঠি ছিঁড়ে জানালা দিয়ে পাতাবাহারের গাছের নিচে ফেলে দেবার সময় দেখল, টুটুল মিণ্টু ছুটে বাড়ি আসছে। মাঠে খেলছিল, খবর পেয়েছে, বাবা এসে গেছে। সুখিকে দিয়ে সেই খবর পাঠিয়েছিল। টুটুল ছুটতে গিয়ে পড়ে গেল। মিণ্টু ওকে ফেলেই সিঁড়ি ধরে লাফিয়ে উঠে আসছে। অতীশ দৌড়ে বাইরে বের হয়ে গেল। হাত ধরে তুলে বলল, লাগে নি ত!

টুটুল বলল, পাগলটা না রাজবাড়িতে ঢুকে গেছে।

হরিশ পাগলার উপদ্রব মাঝে মাঝে বাড়ে। গেটের দারোয়ান সাদেক আলি ওকে ঢুকতে দেয় না। সাদেকের উপরও তার ক্ষোভ অতিশয় বাড়াবাড়ি হলে হরিশ গেটের মুখে দাঁড়িয়ে সবার সামনে পেচ্ছাব করে। সাদেক তাকায় না। যেন দেখছে না হরিশের ক্রিয়াকাণ্ড। কারণ এই হরিশের ভয় কম বেশি সবার। তাকে প্রহার করলে কারো নিস্তার নেই। যারা জানে, তারা মান্য করে হরিশকে—যারা জানে না, তারা তাকে পেটায়। যেহেতু হরিশের বসবাস এই রাজবাড়ির চারপাশটায়—হালসি বাগান থেকে জোড়া গির্জা—সেইহেতু সবাই হরিশের ক্ষমতার কিছু খবর রাখে। হরিশকে ঘাঁটায় না। আজ হরিশ নাকি গাড়িবারান্দায় উঠে শুয়ে আছে। সে বাড়ি ছেড়ে যাবে না বলছে। না পেটালে যাবে না বলছে, এমনই হরিশ তবে এই রাজবাড়ির মধ্যেও উদয়। কে এখন পেটায়! যে পেটাবে সেই অপঘাতে যায়—এই সব বিশ্বাস আছে। সাদেক কিংবা অন্য লেঠেল, অথবা পাহারাদাররা তাকে ঘিরে বসে আছে। সে বায়না ধরেছে, অন্দরে যাবে। চলে যেতেও পারে—পিটিয়ে ভাগাবে তারও উপায় নেই—কেউ সাহসই পাচ্ছে না—তার একটাই ইচ্ছে সে অন্দরে ঢুকে বউরাণীকে গড় হবে। বউরাণীকে দর্শন দিতে চায়।

গড় হবে না, ছাই। যা কিছু খুশি করতে পারে। জেনেশুনে কে পাগলকে ছাড়পত্র দেয়। কিছু একটা হলে, সবার চাকরি নিয়ে টানাটানি। অতীশ বুঝতে পারছিল রাজবাড়ির গেটের সামনে বেশ জটলা জমে গেছে।–কি করা যায় হরিশকে নিয়ে!

রাজবাড়ির প্রাইভেট অফিসের বাবুরা বিপাকে পড়ে গেছে তবে।

টুটুল মিণ্টুর মুখ থেকেই সে শুনে বুঝতে পারছে হরিশ যখন ঢুকে গেছে, সে আজ ছেড়ে যাবার পাত্র নয়। তাকে চ্যাংদোলা করে রাস্তায় ফেলে আসা যায়। কিন্তু কিছু করতে গেলেই সে কামড়ে দেবে। পাগলা কুকুরের চেয়েও সে অধম। চারপাশ থেকে ঘিরে ধরলে কাকে সে কামড়ে দেবে কেউ বলতে পারে না। থানায় খবর দিতেও ভয়। কেউ যেতে রাজি না। মানে মানে তাকে বউরাণী দর্শন করিয়ে দিতে পারলে সে চলেও যেতে পারে।

এবং অতীশ টের পায় এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করার জন্য অফিস সুপার রাধিকাবাবু তার শরণাপন্ন হতে পারে। রাধিকাবাবুর নিজের সাহস হবে না বউরাণীমাকে গিয়ে বলে, হরিশ আপনাকে আজ্ঞে কুর্নিশ করতে চায়।

হরিশ!

ঐ আমাদের পাগলাটা। দেবদারু গাছের নিচে শুয়ে থাকে না! সে!

অতীশের বেশ মজা লাগছিল সব শুনে। রাধিকাবাবু এসে বলতে পারেন, তুমি একবার গিয়ে যদি বল, কারণ বউরাণীমা তার দেশের মেয়ে অমলা, এই সময় বউরাণীমাকে নিয়ে তার সঙ্গে কিছু উড়ো কেচ্ছার কথা কেউ মনে রাখবে না। যে যার চাকরি বাঁচাবার জন্য ব্যস্ত। অতীশ গিয়ে বলতেই পারে, অমলা, তুমি একবার যদি নিচে নামো! শঙ্খ খাস বেয়ারাকে দিয়ে সে খবর পাঠাতেই পারে উপরে, অমলা, হরিশ তোমাকে দেখেই চলে যাবে। হরিশ দেখে চলে যাবে—এমন কথা বলা যে ঠিক হবে না অতীশ বোঝে কোন আহাম্মক হরিশের কথা বিশ্বাস করবে! সে যদি কিছু করে বসে—সে চুপি দিয়ে সেই মধ্যগগনের সূর্য যদি দেখতে চায়, তখন সামলাবে কে? মানে মানে বের হয়ে পড়া দরকার। কিন্তু রাজবাড়ির গেট দিয়ে বের হতে গেলেই সে ধরা পড়ে যাবে—কে অতীশ, দেখছ কি হুজ্জোতি! যাবে না বলছে, রাণীমা দর্শন করবে বলছে। বলছে আমাকে ধরে পেটান। খুশিমতো পেটান। আগাপাশতলা পেটান!

দর্শন করতে চায় তো করিয়ে দিন! আমি কী করব! অতীশ ভাবল।

না তুমি যদি শঙ্খকে উপরে পাঠাতে।

আমি ত কলেজস্ট্রীট যাচ্ছি। কফি-হাউসে।

আসলে অতীশ এ-সব ভেবেও মজা পায়। রাধিকাবাবুর পুত্র কুম্ভ তার কারখানার অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার। একটা আখাম্বা বাঁশের ডগা নিয়ে তাড়া করছে তাকে। এমনিতে বিনীত বাধ্যের সহকারী পাওয়া কঠিন, কিন্তু ঐ এক রোগ, পচা টাকার পিছু ছুটছে।

দু-নম্বরী মাল নিয়ে কম হুজ্জোতি গেল না। তারই জের কারখানায় গো-স্লো কিনা কে জানে। অতীশ ভাবল, ওদিকে মাড়াবেই না। বরং টুটুল মিণ্টুকে নিয়ে বাসাতেই বিকেলটা কাটিয়ে দেবে। টুটুলের ভর্তির বিষয়টা মাথার মধ্যে ঘুণপোকা ঢুকিয়ে রেখেছে। আগামী বছর স্কুলে দিতেই হবে। মিণ্টুকেও ভাল স্কুলে দেওয়া দরকার। সে ছোটাছুটি কম করছে না। এদের ভাল ইস্কুলে না পড়াতে পারলে যেন ইজ্জত নিয়ে টানাটানি। এই এক প্রশ্নে তার মাথা খারাপ।

হরিশকে মনে হল, আসলে ও ব্যাটা সব চেয়ে বেশি ধুরন্ধর। সে জানে সব ছেঁড়া নেকড়া- যেমন বিরাট পুঁটলি মাথায় নিয়ে হাঁটে, হাতে লাঠি—মুখে এক বাক্য উচ্চারণ—দম মাধা দম, পাগলা মাধা দম! সে হাঁটে, লাঠি ঘুরায়। নাচে, এক পা সামনে এক পা পেছনে, কিংবা মাথায় পুঁটলি নিয়ে আঙুলের ডগায় লাঠি রেখে ব্যালেনসের খেলা দেখাতে দেখাতে রাস্তা পার হবার সময় অবাক মানুষজন—যানবাহন চলাচল মুহূর্তে স্তব্ধ—সে লাঠি আঙুলের ডগায় নিয়ে কত নির্বিঘ্নে রাস্তা পার হয়ে যায়। সে ভূপেক্ষই করে না, শহরে সে ছাড়া আর কেউ আছে। তার পুঁটুলিতে হরেকরকম ভাঙা খুরি আধপোড়া বিড়ি সিগারেট, হেমামালিনীর ছবি এবং সূর্যোদয়ের আগে কিংবা পরে রাস্তায় জনগণের মধ্যেই কুকর্মটি সেরে ফেলে—সবাই তখন অন্যদিকে তাকিয়ে হাঁটে। পুলিশ মানুষজন যুবতীমেয়েরা নাকে রুমাল দিয়ে রাস্তা পার হয়ে যায়।

সেই পাগলা হরিশ এখন প্রাসাদের সামনের দিকে উদয়। হয় পেটান, না হয় দর্শন দিতে বলুন।

গন্ধ। শরীরে গন্ধ। কাছে যাওয়া দায়।

বউরাণীমা টের পেলে সবার গর্দান নেবে। কি করে ঢুকল! সাদেক আলি কি করছিল!

অতীশ দেখল সুখি দরজায় দাঁড়িয়ে।

কাকা চা দেব?

দাঁড়া। বাথরুম থেকে আসছি। পাজামা পাঞ্জাবি দে।

মিণ্টু ওঘরে আলো জ্বেলে দিয়েছে। এরা আগের মত আর কেন জানি চঞ্চল নয়। কেমন শান্ত শিষ্ট হয়ে গেছে। সে অফিসে যাবার আগে মিণ্টুকে স্কুলে দিয়ে যায়। সুখির কাছে টুটুল থাকে। টুটুলই মাঝে মাঝে যা একটু অতিষ্ঠ করে তোলে সুখিকে। সে ফিরে আসার পর টুটুল কিংবা মিণ্টু তার ঘরেই আসে নি। ভাই-বোন মিলে বাথরুমে গেছে। হাত মুখ ধুয়েছে। মিণ্টু ভাই-এর মাথা আঁচড়ে দিয়েছে। এমন কি সে দেখেছে, বিকেলে ভাই বোন যখন রাজবাড়ির মাঠে খেলতে বের হয় মিণ্টুই টুটুলকে জামা পরিয়ে দেয়। মুখে পাউডার মাখিয়ে দেয়। সুখিদিকে কোনো কারণেই সে পাত্তা দিতে চায় না।

সুখি যেন কিছু বুঝতে পারে।

অতীশও।

এবং সতর্কতা বাড়ে।

তখনই দেখল মিণ্টু তার পাজামা পাঞ্জাবি বাথরুমের হুকে রেখে এসেছে।

চাতালের দরজা দিয়ে ঢোকার সময় মেয়েটার মুখের উপর ষাট পাওয়ারের আলো। এত বড় ঘরে এই আলো যথেষ্ট নয়। আবছা মত মুখ মিণ্টুর। বয়সের তুলনায় মেয়েটা যেন বেশি বোঝে। কিংবা বয়সের তুলনায় মেয়েটা যেন হাতে পায়ে বেশি লম্বা হয়ে গেছে। কিশোরী হবার মুখে মেয়েদের যে ধরনের সতর্কতা থাকে হাঁটা চলায়, সে বাড়ি ফিরলে মিণ্টুর মধ্যে তা জেগে ওঠে।

অতীশ এতে মাঝে মাঝে বিরক্তবোধ করে। তোমার মা ত জানে আমি কি! সে ত নির্ভাবনায় রেখে গেছে।

স্বামী পরিত্যক্তা বলে অতীশের কিছু করুণা আছে সুখির উপর। বিশেষ করে খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে। তারা যা খাবে, সুখিও তাই খাবে। স্বামী পরিত্যক্তা বলে ঠিক না, আসলে ওর স্বভাবই এ- রকমের। দেশভাগের পর, তাদের অবস্থাও এক সময় অত্যন্ত নড়বড়ে ছিল। না খেতে পাওয়ার দুঃখটা সে জানে। অসহায় মানুষ এবং নিরাপত্তা বোধের অভাবে মানুষ কতটা জলে পড়ে যায় সে এখনও তা হাড়ে হাড়ে টের পায়। আর তখনই সে কেন যে ঠিক করে ফেলল, পাগল জ্যাঠামশায়ের পারলৌকিক কাজে তাকে যে-ভাবেই হোক টাকা সংগ্রহ করে দিতে হবে। মেজ জ্যাঠামশাই ঠিকই লিখেছেন, এমন পুণ্য কর্মের অংশীদার হওয়ার সুযোগ সে যেন জীবনেও পাবে না।

সুখি টেবিলে চা রেখে গেছে। তিনটে চেয়ার তিন দিকে। দেয়ালের দিকে ভাইবোনের বইখাতা, পেনসিল, টিনের বাক্স। এবং ক্যালেণ্ডার নীল রঙের। সে বলল, অঙ্কগুলি করে রেখেছিস?

হ্যাঁ বাবা।

টুটুল খাতা বের করে দেখাল। এরা সত্যি এত বাধ্যের হয়ে গেছে ভাবতেই মনে হল, আসলে তাদের মা চলে যাওয়ায়, বাবা কত অসহায় এটা যেন তারা আরও বেশি টের পেয়ে গেছে। বাবা তাদের জন্য কোনো কারণে অস্বস্তিতে পড়ে যাক চায় না।

তুমি পুকুরে যাও না ত?

না বাবা। সুখিদি, আমি একা পুকুরে যাই?

যাবে না। শোনো কাল আমরা সাঁতার শিখব। কেমন? মিণ্টু তুইও।

বাবা তাদের কাল পুকুরে স্নান করাবে শুনেই লাফিয়ে উঠল দু’জনে। কাল বাবার ঠিক অফিস ছুটি। বাবা অফিসে যাবে না। সারাদিন তারা বাবাকে কাছে পাবে।

মিণ্টু বলল, আমি স্কুলে যাব না বাবা।

কেন।

কাল তোমার সঙ্গে থাকব।

আমার সঙ্গেই ত থাকিস? কথাটাতে অতীশ কিছুটা অবাক হল।

অবশ্য অবাক হবার মত কিছু ঘটনা নয়। সত্যি ত সে তাদের সময় দিতে পারে না। একটা ভাল স্কুলে মিণ্টুকে ভর্তি করে দেওয়া কত যে জরুরি এ মুহূর্তে সে তা টের পেল। আয়ের অতিরিক্ত টাকা সংস্থানের জন্য সে লেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। ফাঁকে ফাঁকে সে তাদের পড়াশোনা দেখে। এতে হয় না। আরও বেশি নজর দেওয়া দরকার। ওদের কাছে থাকলে তাকে এই দুশ্চিন্তা বহন করতে হয় না। যেমন সাঁতার শেখানোর দায়িত্ব দিয়ে গেছে তাকে। সে একদিনও পুকুরে যায় নি টুটুলকে নিয়ে। অথচ যাওয়া খুব জরুরী দরকার। কারণ ভিতরে তার আর এক আতঙ্ক—বাবা বলে গেছেন, মৃত্যুযোগ ত শুধু তার একার নয়। তার সন্তানের ক্ষেত্রও ভাল নয়। জাতকের আঠারো বয়স পার করা কঠিন। জাতক পার পেলে পিতা অথবা পিতৃব্য সে দায় বহন করবে। পুকুরে একবার মিণ্টু জলে ডুবে যাওয়ায় টুটুল সম্পর্কেও ভয়টা থেকে গেছে। কে যে টেনে নিয়ে যায়—এখন যাচ্ছে না, যে কোনো দিন টেনে নিয়ে যাবে—সে ঠিক করল, ক’দিন অফিস কামাই করে সাঁতার শেখানোর কাজটা সেরে ফেলবে। নির্মলা মাঝে দু-একদিনের জন্য এলে এত ব্যস্ত থাকে, সংসারের ভালমন্দ খাওয়ার সঙ্গে কেনাকাটা, টুটুল মিণ্টুর জামাপ্যান্ট কাচাকাচি—ইস্তিরি, এক দণ্ড সময় থাকে না, এবং রাতে দু’জনের এক আশ্চর্য মায়াবী মোহ পৃথিবীর সব আতঙ্ক নিমেষে ভুলিয়ে দেয়—নির্মলার মনেই থাকে না, টুটুলের সাঁতার শেখানোর ব্যাপারটা কতদূর এগোল। আর আশ্চর্য, গিয়েই চিঠি টুটুলকে সাঁতার শেখাচ্ছ ত! ও যেন পুকুরে না যায়। দুপুরে সুখি যেন দরজায় তালা দিয়ে রাখে।

কিরে এখানে শূন্য কোথায় পেলি।

টুটুল বাবার সামনে টেবিলে উবু হয়ে কী দেখল। তারপর খাতা টেনে বলল, দাঁড়াও। যেন সে চায় না দিদি তার ভুল ঠিক করে দিক। এখানে দিদির মাতব্বরি সে একদম পছন্দ করে না। সে যোগ করতে করতে বলল জান বাবা, সুখিদি না রাগ করে দুপুরে খায় নি।

অতীশ বলল, খায় নি কেন? সে মিণ্টুর দিকে তাকাল। মিণ্টু ঠোঁট উলটে নাক টেনে পড়ায় ব্যস্ত, যেন বাবার কথা তার শোনার কোনো আগ্রহ নেই। সে দুলে দুলে পড়ছে। বাবাকে চুরি করে দেখতে গিয়ে ঘাবড়ে গেল।—কেন খায় নি, তার আমি কি জানি! সব দোষ আমার।

অতীশ ভেবে পেল না, না খাবার কী কারণ থাকতে পারে। সে তো কোনো মন্দ আচরণ করে নি। মিণ্টু কিংবা টুটুলের উপর রাগ করে না খেলে ছেলেমানুষী হবে। টুটুল মিণ্টু মাঝে মাঝে ক্ষেপে গেলে অত্যাচার যে না করে তা না। দু-একবার নালিশও করেছে। সে তখন বলেছে, কি হাত তুলেছ টুটুল! তুমি মেরেছ সুখিদিকে।

না বাবা আমি মারি নি, সুখিদি মিছে কথা বলছে।

অফিস থেকে ফিরে এলে সুখি নালিশ করে, কিন্তু শাসন করতে গেলে বলেছে, ছেলে মানুষ, মারবেন না। বরং শাসন করতে গেলে সেই টুটুলকে তুলে নিয়ে যায়, আড়াল দিয়েছে—যাতে করে আঘাত না লাগে।

অতীশ কেমন গম্ভীর হয়ে গেল। ডাকল, সুখি।

যাই কাকা।

সুখি আসছে। মিণ্টু হঠাৎ পড়া বন্ধ করে উঠে চলে গেল।

তুই খাস নি কেন?

কে বলল খাই নি!

টুটুল।

আমি খাই নি তুমি দেখেছ! না কাকা আমি খেয়েছি।

সহসা মিণ্টু ও-ঘর থেকে দৌড়ে এসে বলল, তুমি খাও নি তো! কখন খেলে?

সুখি কেমন গুম মেরে গেল।

অতীশ দেখল সুখি মাথা নিচু করে চলে যাচ্ছে।

এই শোন, খাস নি কেন?

সুখি চলে যাচ্ছে। দরজার আড়ালে পড়ে গেল। তার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে চলে গেল। কেমন দিন দিন বেয়াড়া হয়ে উঠছে। সে কি এ বাড়িতে আরও বেশি কিছু প্রত্যাশা করে! একটা ভাল শাড়ি চেয়েছে। তাও নিজে চায় নি। টুটুলকে দিয়ে বলিয়েছে। বাবা সুখিদি না বলেছে, হঠাৎ সুখিদি তার তখন কোত্থেকে উদয়—কী বলেছে!—বারে তুমি বল নি, তোমার বাবাকে বল আমাকে যেন একটা ভাল শাড়ি দেয়। কোথাও বেড়াতে যাবার শাড়ি নেই। তুমি বল নি!

অতীশ বলেছে, দেবে। কিন্তু তা দেওয়া হয় নি। মাস মাইনে সে যা পায়, তাতে শাড়ি কিনতে পারে—তবে ভাল শাড়ি হয় না। সে লক্ষ্য করেছে—তার বাসায় কাজ নেবার পর সুখি বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে। আগে এখানে সেখানে পড়ে থাকত। শাড়ি সায়া নোংরা। কাজ দেবার সময়ই অতীশ বলেছিল, নোংরা থাকলে চলবে না। তুই তো বোধ হয় সকালে উঠে মুখও ধুস না।

এখন দাঁত মাজে। পেস্ট কিনেছে, ব্রাশ কিনেছে। তার সব আলাদা। সাবান চাই। এতে অতীশ প্রীতই হয়েছে। নোংরা থাকলে খেতে যে ঘেন্না করে, ইনফেকশানের ভয় যাকে। নির্মলা বার বার বলে গেছে, খাবার দেবার সময়, ভাল করে হাত সাবান দিয়ে ধুয়ে নিতে। সে নেয়ও

কিন্তু দুপুরে খায় নি রাতেও কি খাবে না ঠিক করেছে! অতীশের আর এক বিড়ম্বনা।

সে এবার উঠে করিডরে গিয়ে দেখল, সুখি স্টোভ জ্বেলে ভাত বসিয়েছে। দুপুরের খাবার গরম করে নেবে। সে সত্যি খেয়েছে কি না খেয়ে আছে বোঝবার জন্য বলল, সসপেনের ঢাকনা তোল দেখি। সে দেখল, আলাদা ভাত বাড়তি। এত ভাত থাকার কথা না। সে কেমন ক্ষেপে গিয়ে বলল, না খেলে আমার বাড়িতে থাকা চলবে না। সাফ বলে দিলাম। কি এমন হয়েছে, তুই খেলি না! সুখি এতটা ভাবে নি। কাকা নিজে এসে হাঁড়িকড়াই উলটে দেখবে, সে এতটা ভাবে নি। মিণ্টু বলেছে, সে খায় নি, সে বলেছে, খেয়েছে—কার কথা ঠিক দেখার জন্য নিজেই উঠে এসেছে।

দু’জনই এত লেগে থাকে কেন অতীশ বোঝে না। আর না খেয়ে থাকার কারণটা কি তাও সে জানে না। কোনো খোঁটা দিয়ে কথা বলেছে মিণ্টু। বলতেই পারে। মিণ্টু তার মা চলে যাবার পর বড় বেশি যেন তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যাচ্ছে। সংসারের পোকামাকড়ের উপদ্রব থেকে আত্মরক্ষার উপায় কি একটু বেশি তাড়াতাড়ি বুঝে ফেলে মেয়েরা!

তোকে মিণ্টু কিছু বলেছে?

না।

কে বলেছে, টুটুল! টুটুল কিছু বলেছে?

না।

তবে খেলি না কেন? কি ভেবেছিস! যা খুশি তাই করবি!

মনে হল মিণ্টু পাশেই আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে। সব শুনছে। মিণ্টুর ছায়া দরজায় লম্বা হয়ে পড়েছে। আবছা মতো।

বারান্দায় ষাট পাওয়ারের বালব জ্বালা। ঘরের বালর্ একশ পাওয়ারের। রকমফের আলোর মাঝে নড়ে চড়ে বেড়ায় মিণ্টু তা টের পায় নি।

সাঁজ লাগার আগে সুখি আজকাল সামান্য প্রসাধনও করে থাকে। এটা অতীশ টের পেয়েছে। খুব সতর্ক প্রসাধন। এবং ফিটফাট থাকে। চুলের খোঁপা বেশ ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে রাখে। এক মাথা চুল। শরীরে মাংস লেগেছে। এক গোপন সৌন্দর্য থাকে নারীর। অফিস থেকে ফিরলে, রাতে তাদের যখন খেতে দেয়, অতীশ টের পায়, কোথাও সুঘ্রাণ—আজ কেমন সামান্য শ্রীহীন। সুখির পরিপাটি জীবনে কোনো ঘুণপোকার উপদ্রব।

আগুনে মুখ জ্বলছে নারীর। সহসা এমন মনে হল অতীশের।

মিণ্টু আড়ি পেতে শুনছে। বাবা কিছু আর বলছে না।

মিণ্টু কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। সুখিদি না খেয়ে থাকায়, বাবা যে খুব ক্ষেপে গেছে বুঝতে পারছে। সে বড় হয়ে যাওয়ায় বাবা তার উপর রেগে গেলে ক্ষোভ প্রকাশ করে। মারধোর করে না। আগে দুষ্টুমি করলে, হ্যাঙ্গার দিয়ে পেটাত। মা চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে সে যে বড় হয়ে গেছে বাবা বোধ হয় টের পেয়েছে। সুখিদি কেন পাউডার মাখে মুখে, কেউ বোঝে না মনে করছে! সবাইকে, নিজের মতো হাবা মনে করে। সাঁজ লাগলেই চুরি করে মার আয়নায় মুখ দেখে। কি সাহস! ধরা পড়ে গিয়ে সুখিদির মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল।

তুমি আমার মা-র আয়না ধরেছ। আসুক বাবা বলছি।

কোথায় ধরলাম।

তোমার হাতে ওটা কি ছিল?

মিছে কথা বলবে না মিণ্টু!

কী মিথ্যুক সুখিদি তুমি। মুখ দেখছিলে না! দাঁত দেখছিলে না!

কখন দেখলাম! আয়নাটা তুলে রেখেছি। পড়ে ছিল নীচে। কিছু ভাঙলে আমার দোষ। তোমরা ভাঙবে, দোষ হবে আমার।

মিণ্টু আরও ক্ষেপে গেছিল।

কী ভেঙেছি আমরা! তুমি লুকিয়ে আয়নায় মুখ দেখবে, আর দোষ আমাদের।

তারপর থেকেই মিণ্টু আয়নাটা লুকিয়ে ফেলেছিল। একটা কাঠের আয়না, এই আয়না যেন বাড়িটার মধ্যে, রেষারেষির জন্ম দিচ্ছে। সকালে অতীশ আয়না খুঁজলে, মিণ্টু কোত্থেকে এনে দেয়। স্কুলে গেলে একদিন অতীশ আয়নাটা পেলই না! কোথায় যায়। সংসার কেমন অগোছালো হয়ে উঠছে। অবশ্য অতীশের আয়না লাগে না। সে চুল উলটে আঁচড়ায় আয়না না হলেও চলে।

এই আয়নার বিড়ম্বনা থেকে সুখি আত্মরক্ষার জন্য, নিজেই একটা ছোট আয়না কিনে নিয়েছিল।

সে এই বাসাবাড়িতে রান্নাঘরটাতেই নিজের মতো জায়গা করে নিয়েছে। একটা তাকে সিঁদুরের কৌটা রাখে। স্নান সেরে ছোট আয়নায় কপালে সিঁদুর পরে। মাথা আঁচড়ায়। কিন্তু বড় আয়নায় মুখ দেখতে কার না সখ যায়। তার আয়নার কাচটাও ভাল না। মুখ কেমন বেঁকাতেড়া দেখায়। কাকীমার আয়নায় যে কী আছে সে জানে না। সে দেখতে কেমন এটা যেন কাকীমার আয়না না হলে ভাল দেখা যায় না। তার আয়নাটা এতই ছোট যে কোনরকমে মুখ দেখা যায়। কাকীমার আয়নায় সে নিজেকে শুধু দেখে না, আরও কিছু বোধ হয় দেখতে পায়

মিণ্টুকে দেখে সে আয়নাটা লুকিয়ে ফেলতে গিয়ে ধরা পড়ে গেছিল। কোনদিন না কাকাকে বলে দেয়। কিন্তু সে ঠিকই করে রেখেছে, স্বীকার করবে না। মিণ্টুকে সে বলেছিল, বলবে, বললে কী হবে। আমি দেখলে ত!

এ-সব ক্ষেত্রে মিছে কথা কে বলে অতীশ বুঝতে পারে না। প্রায় সাপে নেউলে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে দিন দিন। সুখি খায় নি ভাবতেই অতীশ অপরাধবোধে আক্রান্ত হচ্ছে।

অতীশ বার বার প্রশ্ন করেও কোনো জবাব পেল না। মাথা গোঁজ করে বসেই আছে সুখি।

সে ডাকল, মিণ্টু এদিকে এস।

মিণ্টু পা টিপে টিপে কাছে গেল। তুমি সুখিদিকে কিছু বলেছ?

না বাবা।

তবে ও খায়নি কেন!

টুটুল চেয়ার থেকে লাফ দিয়ে নামল। দিদি বাবার কাছে জব্দ হলে সে ভীষণ মজা পায়। বাবার গম্ভীর গলা শুনে বুঝতে পেরেছে, দিদির আজ আছে। সুযোগ পেলেই দিদি সুখিদির পাউডারের কৌটা লুকিয়ে ফেলে। সারা বিকেল সুখিদি তার পাউডারের কৌটা খুঁজে বেড়ায়—তারপর পেয়েও যায়। সুখিদি ক’দিন থেকে পাউডারের কৌটা কোথায় লুকিয়ে রেখেছে মিণ্টুদি খুঁজে পায় নি। আজ আবার আলতা কিনে এনেছিল—দিদির এক কথা, এই দেখে আয় তো।

সুখি টুটুলকে সন্দেহ করে না। সে গিয়ে দেখেছিল, সুখিদি তাক থেকে টিনের সুটকেস নামাচ্ছে। আলতার শিশি বের করে দেখছে। পাউডারের কৌটা বের করে দেখছে। টুটুলকে দেখেই লুকিয়ে ফেলতে গিয়ে ধরা পড়েছে। কী করবে ভেবে না পেয়ে সুটকেস বন্ধ করার সময় বলেছে, আমার বাবা কিনে দিয়েছে। রাঙ্গা পিসি আলতা।

মিণ্টুকে ডেকে টুটুল বলেছে, দিদি শিগগির আয়। দেখে যা সুখিদি না আলতা কিনেছে!

এতে কি বিস্ময় আছে কে জানে—সুখিদি যেন আলতা পরলে পাউডার মাখলে, পরিবারের কেউ হয়ে যাবে। টুটুলকে মিণ্টু যে কি শেখায় কে জানে মিণ্টু দৌড়ে হয়তো গিয়ে বলেছে, তুমি পাউডার মাখ কেন? হ্যাঁ, মা আসুক বলে দেব।

এই একটা কথাই সুখিকে ভীষণ বিপদে ফেলে দিয়েছে। মাকে বলে দেবে। কাকীমা কি বুঝবে এতে কে জানে! তার তো সত্যি পাউডার মুখে মাখার কথা নয়। কাকীমা রাখতেই চাইছিল না। কাকাও না। কেবল কুম্ভকাকা বলেছে, কোথায় যাবে, আপনারও তো লোকের দরকার। বৌদি চলে গেলে ওদের কে দেখবে। কিন্তু তার যে কী মরণ হল, সে আশ্রয় পেয়ে আরও কী লোভে নিজের মধ্যে গোপন শত্ৰুতা তৈরি করছে। কেন এই গোপন শত্রুতা—সে নিজেও টের পায়। তাঁর নিজের মধ্যেও যেন এক ডাহুক পাখি ডাকে। এ সংসারে সবার আগে এটা টের পেয়ে গেছে ছোট্ট একটা মেয়ে। কাকীমা জানতে পারলে তাকে খারাপ ভাববে। স্বামী নেয় না, অভাগী তুই, তোর এত সাজগোজের কি দরকার। তোর মনে কী আছে!

মা আসুক বলে দেব, সুখিকে আতঙ্কে ফেলে দিয়েছে! সারা বিকাল চুপচাপ জানালায় বসে ছিল। এটা তার দুরাশা, সে সত্যি ভারি অপরাধ করে ফেলেছে মনে হয়েছে। তার উপর কাকীমা বিশ্বাস- করে সব ছেড়ে দিয়ে গেছে। যেন ভিতরের দৈন্য বড় বেশি তাকে পীড়া দিচ্ছিল। সব জানাজানি হয়ে গেলে মুখ দেখাবে কী করে। কাকা জানতে পারলেই বা কী ভাববে। সে যে অধিকার চায় এবং অধিকার অর্জনের জন্য নিজেকে তৈরি করছিল—এতে যেন তার ষড়যন্ত্র ধরা পড়ে গেছে। আজ ভেবেছিল, সবার খাওয়া হলে, সে গোপনে পায়ে আলতা পরবে। এবং সে নিজেকে সাজিয়ে তুলতে চায়। কাকা করিডরের দিকে দরজা বন্ধ করে রাখে। সে রান্নাঘরে শোয়। এবং সে জানে তার শাড়ি সায়া ঠিক থাকে না। তবু তাকে তার দরজা খুলে শুতে হয়। ঘরটায় কোনো জানালা নেই। করিডর পার হয়ে সদর বন্ধ থাকে। করিডরের আলো জ্বালা থাকে না। কেউ যদি রাতে বের হয়ে করিডরের দরজা খুলে এদিকে হেঁটে আসে, তবে তার ঘুমের মধ্যে আলগা সায়া শাড়ি দেখে ফেলতে পারে—সে এমন একটা আশা গোপনে লালন করছে। মুখে পাউডার, পায়ে আলতা। আজ ধরা পড়ে গিয়ে যেন সে কেমন অথৈ জলে পড়ে গেছে। কথা বলতে পারছে না। খেল না কেন, বলছে না। সব বলতে গেলেই মিণ্টু যে চুপচাপ থাকবে না সে জানে।

শুধু সে বলল, খাব। আপনাদের খাওয়া হলেই খাব।

অতীশ যেন কিছুটা হালকা বোধ করছে। বলল, মিণ্টুর কথা ধরিস না। ছেলেমানুষ, কিছু বললে ধরতে নেই। মা কাছে না থাকায় কেমন বেয়াড়া হয়ে উঠছে দিন দিন। ওদের কষ্ট বুঝলে দেখবি আর পেছনে লাগছে না।

এই বাসাবাড়িতে অতীশকে ভারি সতর্ক থাকতে হয়। আচরণে সব সময় দূরত্ব রাখার চেষ্টা করে। কোনো কারণে কেউ সংশয়ে পড়ে যাক সে চায় না। সে নিজেও যে সাধুপুরুষ না বোঝে। দুর্বলতা কখন ধস নামিয়ে দেবে সে ভয়ও তার আছে। সুখি সুশ্রী—চোখ বড় এবং শ্যামলা রঙ। ওর স্তন এবং পাছা ভারি। সে হেঁটে গেলে, কিংবা হেসে কথা বললে, কখনও মনে হয়েছে, নীলবাতি জ্বালাই আছে। শুধু গাড়ি ছেড়ে দিতে যা দেরি।। গভীর বনভূমির রহস্য নিয়ে বুনো হরিণের দাপাদাপি সে শুনতে পায়। তাছাড়া সংসারের শুভাশুভ তাকে উদ্বেগের মধ্যে রাখে। সে সংসারী মানুষ, তার মা বাবা ভাই বোন আছে, পুত্র কন্যা স্ত্রী সব আছে—ইজ্জতের প্রশ্ন। কোনো কারণে সে ছোট হয়ে গেলে মুখ দেখাবে কী করে। তার তো জীবনে শয়তানের তাড়া কম না। সুখিকে সে যতটা পারে এড়িয়ে চলে। কপট গাম্ভীর্য সে নিজের মধ্যে তৈরি করে নিয়েছে। এতে সুখি তাকে সমীহ করে—এটা যদি কোনোদিন নষ্ট হয়ে যায় তবে তার যেন দাঁড়াবার জায়গা থাকবে না। সংসারে সুখি যতটা জায়গা দখল করে আছে, তার চেয়ে বেশি এক ইঞ্চি জায়গা দিতে সে রাজি না। অন্তত, জীবন যাপনে সুখি এ-ক’মাসে সেটা বুঝে ফেলেছে।

তবু মানুষের পদস্খলনের ভয় থেকেই যায়। সে ভয়টা অতীশকে কম কাবু করে রাখে নি। এমন এক স্বভাব সুখির, কিছুতেই বুঝতে দেয় না, সে কাজের মেয়ে। আত্মীয়সূত্রে সে যেন উঠে এসেছে। তার অধিকারও এ সংসারে কম না। এ হেন অবস্থায় অতীশ কিছুটা বিচলিত বোধ করে বলেই, সুখি না খাওয়ায় সে বিভ্রাটে পড়ে গেছে। মান অভিমান। কার উপর এই অভিমান। এত সাহসই বা কেন, সে না খেলে কেউ দুঃখ পাবে এটা সুখি ভাবল কি আশায়!

সুখির এই অনুচিত কাজকে বুঝিয়ে দেবার জন্যই বলল, তুই না খেলে কার কি এসে যায়। সংসারের মঙ্গল অমঙ্গল আছে বলেই বলছি, আর কখনও যেন শুনতে না পাই, না খেয়ে আছিস!

সুখি এতে কিঞ্চিৎ সাহস পেয়ে যায়।

সে বলল, মিণ্টু আমার পাউডারের কৌটা আলতার শিশি কোথায় লুকিয়ে রেখেছে। দিচ্ছে না।

অতীশ এমন কথায় ঘাবড়ে গেল। সে সরে গেল। সে সরে এসে দরজায় দাঁড়াল। সুখি উবু হয়ে বসে আছে। দেয়ালে ডুম জ্বলছে। সুখি উবু হয়ে বসে থাকায় হাঁটুর ভাঁজে স্তন ফেটে ব্লাউজ থেকে যেন বের হয়ে আসতে চাইছে। আংশিক সে দেখতেও পাচ্ছিল। সে যে পেছনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে, সুখির বোঝা উচিত, সব দেখা যায়। সে তার পিঠ আঁচল দিয়ে ঢেকে দিতে পারত। কিন্তু দেয় নি। সে কী তবে এই আকর্ষণেই এতক্ষণ পেছনে দাঁড়িয়ে সব দেখার লোভে সরে যেতে পারছে না। মিণ্টু দরজার আড়ালে এসে ফের দাঁড়িয়ে গেছে কি এ জন্য—সুখিদির মতলব ভাল নয়।

এ-সময় স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে অতীশ। এখন সে বুঝতে পারছে না, কে ঠিক, মিণ্টু না সুখি! এমন উভয় সংকটে সে পড়েনি। একজন সাজগোজ করতে চায়, প্রসাধন করলে সে যে নির্মলার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে মিণ্টু যেন ধরে ফেলেছে। নারী প্রসাধন না করলেই অস্বাভাবিক, বরং প্রসাধনের মধ্যেই নারীর সুষমা—সেই সুষমা থেকে সুখিকে সে বঞ্চিত করতে পারে না—বঞ্চিত করলে সুখির অধিকারে হস্তক্ষপ করা হয়—এবং সুখি বঞ্চনার শিকার—আবার মিণ্টুও তার অধিকারের জায়গা ছাড়তে রাজি না। এতটুকুন মেয়ে—কত বা বয়েস, এই সবে আট পার করে ন-এ পড়েছে এর মধ্যেই সে নারী পুরুষের জটিল সম্পর্ক টের পায় কি করে! এত কম বয়সে মিণ্টু পেকে গেল কি করে! না কি মিণ্টু এ সব না বুঝেই পাউডার লুকিয়ে রেখেছে!

সে বাইরে এসে বলল, কোথায় রেখেছিস ওর পাউডার আলতার শিশি! দিয়ে দে। কখনও ধরবি না। বাঁদরামি দেখছি দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। পাউডার মাখলে কি হয়! তুই মাখিস না।

টুটুল মিণ্টু পায়ে পায়ে আসছে। সে টের পাচ্ছিল। করিডর ধরে দরজা পার হয়ে সামনের ঘরটায় সে বসল। তার কিছু ভাল লাগছে না। সুখির বন্য শরীর, উঁচু লম্বা এবং পিঠ এত প্রশস্ত যে সে যে কোনো মুহূর্তে অশ্বারোহী হয়ে যেতে পারে। সে কেমন নিজেকে এই প্রথম ভয় পেল। যেন সুখি না খেয়ে থাকার চেয়ে এই চিন্তা সংসারের পক্ষে আরও অমঙ্গলজনক। কারণ বউরাণী অর্থাৎ রাজবাড়ির ঘণ্টা যার হাতে যে ইচ্ছে করলে বাজাতে পারে, ইচ্ছে করলে ঘণ্টা নাও বাজতে পারে—সেই রমণী তাকে কম লোভে ফেলে দেবার চেষ্টা করে নি। টুটুল হাসপাতাল থেকে ফিরে আসার পর কী হয়েছে কে জানে, সে আর সিঁড়িতে ক্লিওপেট্রা সেজে কেউ দাঁড়িয়ে আছে দেখতে পায় না। এবং এই সব সাজ তাকে বিভ্রমে ফেলে দিলেই জীবনে আর্চির উৎপাত বাড়ে।

তবে কি আর্চি আবার নতুন করে উৎপাত শুরু করতে চায়!

এই রাতে নির্মলা কি করছে কে জানে।

নির্মলা একা। সে দরজা খুলে যদি বসে থাকে। কেমন মাথাটা ঝিমঝিম করছে। দু-শনিবার আসে নি। কেন আসে নি!

না আসলে দোষ দিতে পারে না। সেই তো বলে দেয়, না এ ভাবে রিস্ক নিয়ে আসবে না। সাড়ে এগারটায় হাজির। ইস, সে লাফিয়ে উঠেছিল। ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দিয়েছে। আসার কথা নয়। তবু চলে এসেছে। থাকতে পারে নি। সে যেমন পারে না, কিন্তু সে না পারলেও থাকতে হয়, যেন গেলেই তার বান্ধবীরা মুচকি হাসবে। ঠাট্টা রসিকতা এবং এমনভাবে তাকাবে, যেন নারী রহস্য কত গভীর বোঝো এবার। এক দু-হপ্তা পার করে দিতে পার না। ছুটে চলে আস!

কিন্তু সকালে উঠেই মনে হয়েছে, বাস পায় নি বলে ট্যাকসিতে আসা ঠিক হয় নি।—এত রাতে কেউ একা অচেনা ট্যাকসিতে আসে? তোমার কি মাথা খারাপ?

নির্মলা গুম মেরে উঠে গেছিল, মাথা খারাপ না হলে এ ভাবে কে বার বার মরতে আসে?

নির্মলা সহসা চলে এলে অতীশ এক আশ্চর্য জীবনে ঢুকে যায়। আশার অতিরিক্ত এই পাওনা অতীশকে মাঝে মাঝেই অসময়ে বাড়িমুখো করে তোলে। যেন ফিরে এসেই দেখতে পাবে, নিমু দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। কিংবা নিমু চঞ্চল বালিকা, ছেলেমেয়েকে নিয়ে হুটোপুটি শুরু করে দিয়েছে। এই দ্যাখ তোদের বাবা এসেছে, এই দ্যাখ পুডিং করে নিয়ে এসেছি, এই দ্যাখ কী সুন্দর খেলনা—যেন এই ফিরে আসার মধ্যে আছে এক জাদুকরের রহস্যময় আকর্ষণ—পৃথিবীর সব মজা একদিকে, আর তার জাদুর বাক্স একদিকে। বাক্সটি খুলে দেখবার জন্য যেন সে পাগল হয়ে উঠলেই ছুটে চলে আসে। টুটুল মিণ্টুর চেয়েও এই বাক্স রহস্য তাকে সারাটা রাস্তায় মাতাল করে রাখে। কখনও সে সারারাত বোধ হয় না ঘুমিয়ে থাকে। তার রাতে ঘুম না আসার কি কারণ টের পেলে অতীশ স্থির থাকতে পারে না।

অথচ এত রাতে অসময়ে ট্যাকসিতে—তখন মনে রাখতে পারে না। সকাল হলে মনে হয় নিমু অবিবেচকের মতো ট্যাকসি করে চলে এসেছে। আসলে অতীশ বোঝে, নিমুকে কাছে পাবার আকাঙ্ক্ষায় কেমন দু’জনই হিতাহিত জ্ঞানশূন্য। সব হয়ে যাবার পর শরীরের উষ্ণতা মরে গেলে অতীশের মাথায় কোনো আশংকা পাক খেতে থাকে। এই আশংকা যতক্ষণ শরীর আবার উষ্ণ হয়ে না ওঠে ততক্ষণ তাকে তাড়া করে।

এই সব জীবনের অজস্র ফ্যাকড়া তাকে কখন কিভাবে রাখবে নিজেও জানে না। তা না হলে সে লোভে পড়ে যাবে কেন। মিণ্টু এ-ঘরে নেই, কোথায় আবার লুকিয়েছে। সে ডাকল, শোন মিণ্টু। মিণ্টু এলে বলল, পাউডার লুকিয়ে রেখেছিস কেন। দিয়ে দে। তুই পাউডার মাখিস্ না!

মিণ্টু মাথা নিচু করে বলল, আমি কি কাজের মেয়ে! আমি কি ঘর মুছি!

ঘর মুছলে পাউডার মাখতে পারে না কে বলল তোকে। এ সব কে শেখায় তোকে!

নিরু দি।

আর তখনই অতীশের মনে হল, নিরুদি সনৎবাবুর ছোট ময়ে। ইংরাজি মিডিয়ামে পড়ে। লরেটোর ছাত্রী। সুন্দর ছিমছাম, ফ্রক গায়ে দেয়, যদিও ফ্রক গায়ে দেবার বয়স নেই—কিছুটা বনির মতো যেন, অজ্ঞাতে স্তন এবং গভীর বনরাজিনীলা ঢেকে দিয়েছে কোনো এক হেমন্তের শেষে। এবং সে যেহেতু বনির মধ্যে সেই বয়সে কোথায় কি আছে, এবং বনি তো বালিকা, বালিকা যে নারী হয়ে গেছে বনিকে দেখার আগে সে বুঝত না, বালিকারা দীর্ঘদিন বালিকা সেজে থাকে শুধু—অনেক আগেই সে নারী হয়ে যায়। নিরু এ বাড়িতে আসে। তার লেখা দু-একটা উপন্যাস পড়ে ফেলেছে, এবং সিনেমার পোকা, সিনেমার কাগজে একবার এক সাক্ষাৎকারে তার একটা ছবি বের হয়েছিল, সেটা নিরু দেখেছে—নিরু কখনও বউরাণীর বাগানে ফুল তুলতে আসে, কারণ এই রাজবাড়িতে নিরু কুমারবাহাদুরের ব্যক্তিগত সচিবের ছোট মেয়ে। তাকে দেখলেই মনে হয়, সকালের সূর্যমুখী ফুল। এবং এত সব হাল ফ্যাসানের ফ্রক গায়ে দেয় যাতে করে ঊরু হাতির দাঁতের মতো বন্য উপমা হয়ে দেখা দেয়। সেই বালিকা মিণ্টুর বান্ধবী। নারী পুরষের সম্পর্কের কথা মেয়েটা ঠিক বুঝে ফেলেছে। অভ্যন্তরে সেই ডাকপিওনের খেলা শুরু হয়ে গেছে। সে প্রকৃতির হেতু, জন্মরহস্য এবং সুখির পাউডারে যৌন ঘ্রাণ পায় সহজেই।

অতীশ মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। বব করা চুল এক রাশ, নরম এবং উজ্জ্বল সাদা কবুতরের মতো সকালের পবিত্রতা তার শরীরে। কিন্তু সূর্য ক্রমে উপরে উঠে আসছে। তেজ বাড়বে। এই তেজ ধীরে ধীরে কোনো ফুল ফোটাবার রহস্য জাগিয়ে দেবে মিণ্টুর ভিতর। মিণ্টু কথা বলছে না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েই আছে।

অতীশ বলতে পারত নিরুর সঙ্গে মিশবে না। কারণ নিরুই তাকে শিখিয়েছে তবে, সে কি রে, কাজের মেয়ে পাউডার মাখে মুখে! ভাল না। খুব খারাপ। আমাদের বাড়িতে মা টের পেলে তখুনি ছাড়িয়ে দিত। বড়ই বিপন্ন বোধ করছে অতীশ।

করিডরে আলো জ্বলছে। জানালা খোলা—আলো পাতাবাহারের গাছগুলির মধ্যে কুয়াশার মতো জমে আছে। পাতাবাহারের গাছগুলি ক্রমেই তার জানালা ঢেকে দিতে চাইছে—এবং যতদিন যাচ্ছে, তত এই শহর আততায়ীর মতো তার পিছু নিয়েছে।

এই শহরে না এলে নির্মলা কাজের খোঁজে বোধ হয় বের হয়ে পড়ত না। সে নিজে কত নির্বান্ধব এই শহরে এসে টের পেয়েছে। নির্মলা ইচ্ছে করলে স্বাধীন হয়ে যেতে পারে, বোধ হয় গেছেও, না হলে দু-শনিবার চলে গেল, আসার নাম নেই। চিঠিপত্র নেই। চিঠিপত্রও লিখলে দু’জনের হাহাকার ছাড়া কিছু থাকে না। এই হাহাকারের গ্রাস থেকে তার যেমন আত্মরক্ষার দরকার আছে, তেমনি নির্মলারও। কারণ দু’জনই একা রাত কাটায়। এই বয়সে একা রাত কাটানো যে কোনো যুবক কিংবা যুবতীর পক্ষে সমুদ্রে বালিয়াড়িতে দাঁড়িয়ে থাকার মতো।

নিঃসঙ্গতা মাঝে মাঝে এমন অধীর করে তোলে যে সে মাঝে মাঝে নিরুকে পর্যন্ত হাওয়ায় ভাসতে দেখে। নিরু গোপনে নারী হয়ে গেছে কেউ জানে না। জানে না, এই নারীর এখন দরজা জানালা খোলা। যতই ফ্রক গায়ে দিক, স্তনের ভাঁজে প্যাড গুঁজে বুক সমান্তরাল রাখার চেষ্টা করুক, আসলে কোনো কামুক গন্ধে মেয়েটা পাগল। সে অফিস যাবার মুখে কিংবা মিণ্টুর সঙ্গে যেতে নিরুকে যত দেখেছে, তত মনে হয়েছে, বড় লাজবতী, চোখ তুলে তার দিকে তাকাতে পর্যন্ত পারে না।

তার সঙ্গে বয়সের ফারাক বিশ বাইশের কম হবে না, অথচ তাকে চুরি করে দেখে, এবং চোখে চোখ পড়ে গেলে কেমন মেয়েটার মুখ লাল হয়ে যায়। কোনো সিনেমা ম্যাগাজিনে তার লেখায় নারীর সংগোপনে খেলার দৃশ্য সে বর্ণনা করেছে কোথাও~~নিরু কি নিজের জীবনে এটা টের পেয়ে ধরা পড়ে গেছে ভাবে! এই লোকটা তবে সব জানে, বালিকা গোপনে নারী হয়ে গেলে কি কি করে সব জানে। তার কাছ থেকে সিনেমা ম্যাগাজিন সংগ্রহ করার তাই এত আগ্রহ।

মিণ্টুকে কি কখনও বলে তোর বাবাটা খারাপ। কী সব লেখে জানিস! অথচ সে তো এক নির্মল আকাশে নারীর বিচরণের কথা লিখে থাকে, যেন এক খামারে বীজ বপনের জন্য নারী পুরুষের এই পৃথিবী। এবং বালিকা যখন যুবতী হয়, যেন দূরে কোনো মেষপালক পাহাড় গাত্রে ছবি আবিষ্কার করে হতবাক হয়ে যায়—সে নিজেকে কখনও মেষপালক ভেবে থাকে—তাছাড়া নির্মলা না থাকায় সে এই নিরুকেও কতবার দেখে কামার্ত হয়ে উঠেছে, কামার্ত হবার কারণ বালিকার দুই ঊরু। যেন ঊরুর গভীর ভাঁজে সে হরিশ পাগলার মতো মধ্য গগনে সূর্য আবিষ্কারের আশায় উঁকি দিয়ে দেখতে চায়, উত্তাপে কতটা অধীর বালিকা। চেপে চুপে উত্তাপ আড়াল করে রেখেছে, এবং কোনো মৈথুন ক্রিয়ার ছবি চোখে ভেসে উঠলে সে পাগলের মতো হাঁটে। অন্যমনস্ক।

আর সুখির এই ফেটে পড়া স্তন দেখার পর কতটা নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে—কারণ সে এখন কি করবে জানে, তার হাতে মোক্ষম আয়ুধ রয়েছে—সে তাই কাজে লাগাবে। সে না পারলে যা করে থাকে, কারণ এ সময় সংসারকে অগৌরবের হাত থেকে রক্ষার জন্যই বাথরুম এক প্রশস্ত জায়গা। সেখানে সে চুপচাপ গিয়ে দাঁড়াবে। শরীর কাঁপে।

সে শুধু মিণ্টুকে বলল, যাও পড়তে বস। আর কিছু বলল না। সে এত গম্ভীর কেন সুখি একরকম ভাবে বুঝছে—মিণ্টু একরকম ভাবে। নির্মলা থাকলে বুঝতে পারত, এই মুহূর্তে বাবুটি কি চায়।

সে দেখল মিণ্টু পড়ার জন্য পাশের ঘরে চলে যাচ্ছে। ভাই বোন চুপচাপ টেবিলে বসে থাকবে এখন।

সে এ-সময় বাথরুমে ঢুকে গেল। এ-ছাড়া তার অন্য কোনো নিষ্কৃতি নেই।

মানুষ তার অহরহ পীড়নের মধ্যে ডুবে থাকে। মানুষের এই পীড়নের শেষ নেই। বাথরুম এত প্রশস্ত জায়গা, সে যেন আজ আবার আবিষ্কারের মত নতুন করে উপলব্ধি করল। সে ভাবল, কত কিছু ভাবল—অরুচিকর চিন্তা ভাবনা, সেখানে নারীরা শুধু হাত পা বিস্তার করে রাখে। গভীর কোনো বনভূমির সবুজ ঘ্রাণে সে মেতে থাকল। নিজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যে নেশা ধরিয়ে দিল। মগজে এমন সব ছবি ফুটিয়ে তুলল, যেন আকাশ বাতাস নিক্ষেপ করে অলস নাভিমূলে সে মুখ রেখেছে। এই অলস নাভিমূল নির্দিষ্ট কোনো নারীর নয়, সেখানে নির্মলা নেই, বনি নেই, এমন কি রাতের ট্রেনের চারুও নেই। সে আছে অতি মহামায়ার মত।

সে দরজা বন্ধ করে দেয়ালে হেলান দিয়ে সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছে। কেমন হুঁশ নেই। সব নির্গত হচ্ছে। অজস্র আকস্মিকতায় জন্ম তার। অজস্র আকস্মিতায় সহসা টুটুল, সহসা মিণ্টু- সব কিছুর সঙ্গে এই জীবন মহিমা। তার ঘুম পাচ্ছে। দেয়াল থেকে শরীর তুলতে পারছে না। অবশ। কেমন আর এক ঘোর। ঘোর কেটে গেলে শরীর হালকা বোধ করল। শরীরে জল ঢালল। পরিচ্ছন্ন হয়ে বের হবার মুখে দেখল টুটুল বড় ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে।

টুটুলের কাছে বুঝি সে ধরা পড়ে যাবে। সামনের দরজা দিয়ে নিজের ঘরটায় ঢুকে গেল। ধরা পড়ে যাবে ভাবতে গেল কেন! সে গোপনে কত কাল পর তার নিজস্ব আয়ুধটি আবার ফিরে পেয়েছে। কারো জন্য অপেক্ষা করার আর দরকার হবে না। সে ভুলেই গেছিল—যৌবনের সন্ধিক্ষণে এই অস্ত্রটি বার বার তাকে রক্ষা করেছে। নষ্ট হতে দেয় নি। সে সবার কাছে ভালমানুষ, বাবা মার সুপুত্র। এবং নির্মলার অনুপস্থিতিতে জীবনে কোনো আর অধঃপতনের সম্মুখীন হতে হবে না। বউরাণী, চারু, কিংবা সুখি কেউ আর তাকে নষ্ট করতে পারবে না। কেউ না। সে নিজেই নিজের কাছে আবার নতুন করে গোপনে নষ্ট হয়ে গেল।

তখন সুখি এসে ডাকল, কাকা খাবেন।

টুটুল মিণ্টু ঢুলছে টেবিলে। অতীশ উবু হয়ে শুয়ে আছে। নির্মলা পর পর তিন হপ্তা কেন এল না, এ জন্য সে অধীর। শরীর হালকা হয়ে গেলে অন্য পোকামাকড়ের উপদ্রব।

খেতে বসে টুটুলের মাছ বেছে দেবার সময় বলল, মিণ্টু তোকে কিছু বলে গেছে?

কে বাবা! মিণ্টু বড় বড় চোখে তার বাবার দিকে তাকাল।

অতীশ মেয়ের দিকে তাকাতে পারছে না। নিজের অপকর্মের গ্লানি তাকে যেন অশুচি করে রেখেছে। সে চোখ সরিয়ে নিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকল। যেন মিণ্টুকে বলছে না, অন্য কারো সঙ্গে কথা বলছে।

তোর মা কিছু বলে যায় নি?

মিণ্টু মনে করার চেষ্টা করল কিছু বলে গেছে কিনা। কিন্তু কি বলে যাবার কথা মা-র—সে বুঝতে পারছে না।

টুটুল হাঁ করে আছে।

অতীশ এক গ্রাস ভাত ছেলের মুখে দিয়ে বলল, তোর মা কবে আসবে বলে যায় নি?

না তো।

টুটুল বলল, আমাকে বলেছে।

কি বলেছে।

মা আবার আসবে বলেছে।

নির্মলা যাবার দিন খুব সকাল সকাল ওঠে। এবারেই প্রথম, নির্মলা তাকে ডাকে নি। রাত থাকতে নির্মলা উঠে পড়ে। সুখিও। রাস্তার খাবার করে নেয়। গিয়েই পড়িমরি করে স্কুলে ছুটতে হয়। খাবার বেশি বেশি নিতে হয়। খেতে খেতে রাত। সকাল পাঁচটায় বাসা থেকে না বের হলে ব্ল্যাক ডায়মণ্ড ধরা যায় না। যাওয়া আসার অভ্যাস গড়ে ওঠায়, নির্মলা ইচ্ছে করেই ডাকে নি। রাতে একবার মনেও করিয়ে দিয়েছিল যেন, তোমাকে উঠতে হবে না। এত রাত করে শোও, এত সকালে উঠলে শরীর খারাপ করবে। টুটুলটা মা আবার আসবে বলেছে, এতেই খুশি। মা এবারে আসার সময় তার জন্য কি আনবে তারও খবর দিল—কিন্তু কবে আসবে জানে না। মা এলেই খুশি।

কোনো কোনোদিন টুটুল মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে রাজবাড়ির সদরে। রাস্তার ট্রাম বাস দেখে। বিশাল লোহার গেট পার হয়ে রাস্তায় যাবার হুকুম নেই। সাদেকের কড়া পাহারা পার হয়ে যাওয়া কঠিন। অতীশ ফিরে দেখেছে ভাই বোন বিশাল গেটের গরাদে মুখ রেখে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন কোনো কারাগারে তাদের বন্দী করে রাখা হয়েছে। কখনও অতীশের দেখতে দেখতে এমন মনে হয়। প্রত্যাশা চোখে—কেউ ফিরবে, মা কিংবা বাবা। বাবা এলে, সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে আসে। একজন এসে গেছে। একজনই তাদের এখন অবলম্বন। কত রকমের প্রশ্ন, বলত বাবা মা কি করছে।

তোমার মা?

হ্যাঁ।

তোমার মা এখন সুয়েটার বুনছে।

কি করছে?

টবে জল দিচ্ছে।

কি করছে?

তোমাদের কথা ভাবছে।

কি করছে।

চুপচাপ শুয়ে আছে

কি করছে।

রাস্তায় বাস যাচ্ছে। দাঁড়িয়ে দেখছে। বাসটা বর্ধমান যাবে। ট্রেনে বাসযাত্রীরা হাওড়ায়। ট্রামে বাসায়। বাসটা দেখতে দেখতে তোমাদের মা ভাবছে, খুব দূরে থাকে না। বাসটা দেখতে দেখতে তোমাদের মা কলকাতায় চলে আসছে।

অতীশ বলতে পারত, আসলে তোমার মা গাড়ি দেখলেই ভাবে—কলকাতায় যাচ্ছে—যে কোনো গাড়ি, তোমাদের মধ্যে সহজেই চলে আসতে পারে। কিন্তু যখন মনে হয়, সে কলকাতায় নেই, এই বাসাবাড়িতেও না, সে দাঁড়িয়ে আছে স্কুলের নির্জন মাঠে তখন তোমাদের জন্য তার মন হুহু করে ওঠে। গোপনে অশ্রু বিসর্জন করে।

সুখি দরজার ও-পাশে দাঁড়িয়ে অতীশকে লুকিয়ে দেখছে। মনে হবে সে দাঁড়িয়ে আছে কখন কি লাগবে এই আশায়। কাকা নিজে প্রায় কিছুই খাচ্ছে না। হঠাৎ হঠাৎ এমন মনমরা হয়ে যায় কেন বোঝে না।

সে বলল, কাকা আর একটু ঝোল দি। ভাত কটা মেখে খান। কিছুই তো খেলেন না।

অতীশ কেন যে সুখির কোনো কথাই সহ্য করতে পারে না—তোর এত কি অধিকার, আমি আর খাব কি খাব না সেটা তুই বলবি—আর একটু ঝোল দিলে তবে খাব—তুই কি ভাবিস! সে মাথা না তুলেই ভাত সরিয়ে রাখল। বলল, নিয়ে যা।

সুখি আর একটা কথা বলতে সাহস পেল না। এমনিতেই ভাটার মত বড় বড় চোখ—ভয় লাগে। তাকালে বুক কেঁপে ওঠে ধড়াস করে। চোখে চোখ পড়ে না। যেন সে মানুষ না, আগুন। তার দিকে তাকিয়ে কথা বললে ভস্ম হয়ে যাবে। আর তাকালে, সে কিছুতেই সোজা তাকিয়ে থাকতে পারে না। কাজ নেবার আগে এতটা ভয় ছিল না। কাকীমা চলে যাবার পরই কেমন একটা আতঙ্ক তাকে গ্রাস করছে। অথচ এই আতঙ্ক ভিতরে কোনো অধীরতা সৃষ্টি করে সুখি টের পায়।

সে একটা থালায় ভাত কটা তুলে নিয়ে যাবার সময় অতীশ বলল, তোর কাকীমা কিছু বলে গেছে, কবে আসবে কিছু বলে গেছে?

সুখি যেতে যেতে থেমে গেল। ঠোঁটে গোপন মজার হাসি। আড়ালে মুখ, দেখতে পাবে না। যখন চুপচাপ উবু হয়ে শুয়ে থাকে, তখনই টের পায়—কাকা কাকীমার কথা ভাবছে। কাকীমাকে নিয়ে কি ভাবছে তাও যেন সে জানে। গোপন মজার হাসি সামলে, ঠোঁট কামড়ে বলল, কবে আসবে কিছু বলে যায় নি।

আর কেন জানি অতীশ এখন ঠিক মনেও করতে পারছে না নির্মলা কবে গেছে। মনে হচ্ছে কত দীর্ঘকাল সে তার প্রিয় নারীকে দেখতে পায় না। ভাবল, নির্মলা খুব রাত করে আসায় চোটপাট করা ঠিক হয় নি। সেই অভিমানে নাও আসতে পারে।

টুটুল খেতে বসেও ঘুমে ঢুলছে।

এই। খা।

টুটুল হাত সরিয়ে দিচ্ছে। খাবে না। মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে।

খাবি না! তা হলে ওঠ। মিণ্টু যা ত মা, ভাই-এর মুখ ধুয়ে দে।

সুখি বলল, আমি দিচ্ছি কাকা।

কিন্তু অতীশ জানে, মিণ্টু পছন্দ করে না। সে তার ভাই-এর কাজ নিজেই করতে চায়। মিণ্টুকে না বললে রাগ করত। মিণ্টু মহাখুশি। সে ভাইকে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে মুখ ধুয়ে দিল। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছিয়ে দিল, টুটুল যে বড় হয়ে গেছে মিণ্টু স্বীকার করে না। সে টুটুলকে কোলে নিতে চাইলে এক দৌড়ে বিছানায় উঠে গেল।

মিণ্টু দৌড়ে এসে বলল, ইস নোংরা পায়ে বিছানায় উঠলি! বাবা বাবা!

অতীশ চাতালে দাঁড়িয়ে আছে। সিগারেট খাচ্ছে। বলল, কি হল!

ভাই পা মুছতে দিচ্ছে না।

পায়ে জল লেগে আছে। মিণ্টু তোয়ালে দিয়ে পা মুছে দিতে গেলে টুটুল বিছানার শেষ প্রান্তে চলে গেছে। নাগাল পাচ্ছে না। একদম কথা শোনে না!

সে চাতালে দাঁড়িয়েই বলল, টুটুল কি হচ্ছে! দিদির কথা শুনছ না কেন?

আসলে তার এখন ঘরে যেতেই ইচ্ছে করছে না। চাতালে দাঁড়ালে কেমন মুক্ত হাওয়া রাজবাড়ির পাঁচিল ডিঙিয়ে চলে আসে। শরীরে এক আশ্চর্য শান্তি অনুভব করে। মাথার উপর বিশাল আকাশ, চাতালের ও-পাশে বউরাণীর ফুলের বাগান, জলাশয়, এবং দেশী বিদেশী ফুলের কতরকমের বাহার। সেখানে শ্বেতপাথরের নগ্ন নারীমূর্তি বেদিতে বসানো। কেন যে ইচ্ছে করছে, সেই নগ্ন নারীমূর্তির বেদিতে গিয়ে এখন চুপচাপ বসে থাকতে। ওটা রাজবাড়ির অন্দরমহলের বাগান। সে ইচ্ছে করলেই যেতে পারে না। কেউ পারে না। একদিন অমলাই বাগানটা তাকে ঘুরিয়ে দেখিয়েছে। উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। সকাল বিকাল দুজন মালি কাজ করে। লাল নীল বেতের চেয়ার। তার চাতালের পাঁচিল পার হলেই বাগানটার শুরু।

যদি কখনও ম্যাগনোলিয়া ফোটে, চাতালে দাঁড়ালে তার সুবাস পর্যন্ত পায়।

আসলে সে যে পীড়নের মধ্যে আবার পড়ে যাচ্ছে বুঝতে পারছে না।

সে এখন চুপচাপ বসে থাকবে চাতালে। মোড়ার উপর বসে থাকবে। একজন নিঃসঙ্গ মানুষ যেভাবে কোনো গাছতলায় বসে থাকে এও যেন তেমনি। যে কেউ দেখলে মায়া হবে।

আজ শনিবার। যদি আজ আসে।

এই একটা আকাঙ্ক্ষা কাজ করছে।

তারপরই মনে হল, আজ শনিবার নিয়ে কি চার শনিবার হল! সে কিছুই ঠিকঠাক মনে রাখতে পারে না কেন! সব কেমন গোলমাল হয়ে যায়।

ঘরে ঢুকে দেয়ালে ক্যালেণ্ডারের পাতা দেখল। বাংলা ইংরাজি তারিখ—লাল নীল বর্ণমালা সব নেমে গেছে নিচে। চৈত্রমাস। সংক্রান্তি শুক্রবার। গতকাল নির্মলার স্কুল বন্ধ গেছে। শুক্র শনি দু- দিন বন্ধ। সঙ্গে রবিবার। পর পর তিনদিন ছুটি—অথচ এটা ত তার আগেই দেখা উচিত ছিল—নির্মলা কি জানে না, তার ছুটি থাকবে। মুখ ফুটে ত একবারও বলে নি, সামনে পর পর তিনদিন ছুটি—সে ভুল দেখছে না ত! এ-দিন যদি স্কুলে কোনো অনুষ্ঠান থাকে—থাকতেই পারে। কিন্তু পর পর তিন দিন ছুটি, অথচ নির্মলা এল না! আর সঙ্গে সঙ্গে বুকটা ধড়াস করে উঠল। স্কুল ছুটি তার কবে সব বলে যায়, কবে আসবে বলে যায়, আবার কিছু না বলে গেলেও চলে আসে—অথচ পর পর তিনদিন ছুটি—নির্মলা না পাঠিয়েছে কোনো চিঠি লিখলেই পারত, যেতে পারছি না। কিংবা অসুখবিসুখ হয় নি ত!

এমনও ত হতে পারে, সে রওনা হয়ে গেছে—কিন্তু বাসায় এসে পৌঁছায় নি। এত করে বলেছে, সঙ্গে আইডেনটিটি কার্ড কিংবা ঠিকানা, নাম ধাম সব—কিছুই রাখার অভ্যাস গড়ে ওঠে নি।

সে বার বার সতর্ক করে দিত, কোথাও বের হলেই সঙ্গে ঠিকানা রাখতে হয়। ডাইরিতে নিজের নাম, স্কুলের নাম, বাসার ঠিকানা রাখবে। রেখেছিল কি! যদি না রাখে!

এত অবিবেচক হলে চলে! পাত্তাই দিতে চায় না। কী হবে রেখে! আরে কী হবে রেখে বোঝ না! যদি কিছু হয়!

হলে আটকাবে কে? কেবল তর্ক করতে শিখেছে। সে বলতেও পারে না। কোনো দুর্ঘটনা হলে খবর পাব কি করে। তা হলে ভাববে, আমার দুর্ঘটনা নিয়ে এত ভাবলে, স্কুলে চাকরি করতে পাঠালে কেন! দুর্ঘটনা কি কেবল বাইরেই ঘটে। বাড়িতে ঘটতে পারে না। কপালে থাকলে ঘরেও হতে পারে বাইরেও হতে পারে। এ জন্য এত ভাবলে চলে!

তবু যেন একবার বলেছিল, ডাইরিতে ঠিকানা লিখে রেখেছি। স্কুলের, বাসার সব জায়গার। সে নিজেই ডাইরিতে রাজবাড়ির ফোন নম্বরও লিখে দিয়েছে। এই সব সতর্ক চিন্তাভাবনা সত্ত্বেও মনে হল, ভুল করে ব্যাগে যদি ডাইরি নিতে ভুলে যায়। বাসায় ফেরার সময় কেমন নির্মলাও ঘোরে পড়ে যায়। কিসের ঘোর অতীশ টের পায় নির্মলা বাসায় ফিরলে। টুটুল মিণ্টুর চেয়েও যেন এই ঘোর আরও মারাত্মক। কতক্ষণে সব গুছিয়ে দরজা জানালা বন্ধ করে বাস ধরবে সেই আশায় সে উতলা হয়ে থাকে। তুমি দু-সন্তানের মা। এত উতলা হওয়া তোমার সাজে!

সে কি যে করবে বুঝতে পারছে না। কাল সকালে উঠে কি চলে যাবে! এমন ত কখনও করে না। কিন্তু যাবে কি করে! বোর্ড মিটিং-এর নোটিশ দেওয়া আছে। কাল বোর্ড মিটিং। সে না থাকলে চলবে না। হঠাৎ সে চলে যেতে পারে না।

কারখানার নিত্য ঝামেলায় সে অস্থির। কর্মীদের বেতন হবে কি করে, এই দুর্ভাবনা শুরু হয় মাসের শেষের দিকে। দুশ্চিন্তায় ঘুম আসে না। ধার বাকিতে কতদিন কারখানা চালাতে পারবে বুঝতে পারছে না। দিন দিন কারখানার ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে। শেয়ার ফ্লোট করা হয়েছে—কে কেনে শেয়ার! কুমারবাহাদুর টাকা ঢালছে। তিনিই বেনামে শেয়ার কিনে টাকা ঢালছেন। তাঁর আমলার সংখ্যা এখনও এত যে তাদের পরিবার কিংবা আত্মীয়স্বজনের নামে অসংখ্য শেয়ার কেনা হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে শেয়ার ট্রানসফার সার্টিফিকেটে সই করিয়ে নেওয়া হচ্ছে। কোনো ফাঁক রাখা হচ্ছে না। ঝামেলা বছরকার রেভিনিউ স্ট্যাম্প নিয়ে। সে জানে এই রাজবাড়ির অফিসে গত পঁচিশ বছরের বাড়তি রেভিনিউ স্ট্যাম্প জমা রাখা আছে। দরকারে সে-সব ব্যবহার করা হয়। যখন যেমন দরকার। আইনের ফাঁক খুঁজে বের করার জন্যই লিগেল অ্যাডভাইসারের এত দাপট। তার মাথার উপর তিনি বসে আছেন। অফিসটা তার কাছে মারাত্মক জুজু। সে তার চেয়ারে গিয়ে বসলেই ঝনঝন করে কেবল টেলিফোন—মালের কি হল! ঢাকনা লুজ। রঙ চটে গেছে। মাল ডেসপাচে গণ্ডগোল। এমপ্লয়িজ স্টেট ইনস্যুরেন্স থেকে তাগাদা। কন্ট্রিবিউশান জমা পড়ে নি। শ্রমিকরা অসুখে বিসুখে ই এস আই-র সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে না। ইউনিয়ন থেকে হামলা। স্লোগান। কান ঝালাপালা। যেন বাঘের মুখে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

এত দুশ্চিন্তা মাথায় থাকলে সে লিখবে কি করে! ইস কেন যে সে এখানে মরতে এল! নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে।

সুখি মশারি টাঙিয়ে দিচ্ছে। দু-ঘরে দুই তক্তপোশে আলাদা বিছানা। এই সেদিনও সে টুটুল মিণ্টুকে নিয়ে এক বিছানায় শুত। কিন্তু নির্মলা এলে নানা কারণে অসুবিধা। এক ঘরে আর শোওয়া ঠিক না। মিণ্টু বড় হয়ে গেছে।

করিডরের লাগোয়া ঘরটায় টুটুল মিণ্টু, শোয় এখন। শেষের দিকের ঘরটায় শোয় সে। করিডরে যেতে হলে মিণ্টু টুটুলের ঘর পার হয়ে যেতে হয়। বাবাকে ছাড়া টুটুল শুতে চায় না। এই নিয়ে বেশ প্রথম দিকে ধস্তাধস্তি গেছে। অতীশকে ছলনার আশ্রয় নিতে হয়েছে।—তুমি ঘুমাও। আমি তোমার সঙ্গে শোব। আর একটু লেখা বাকি আছে। হলেই যাচ্ছি।

প্রথমদিকে, টুটুল জেগে থাকত।—এস বাবা।

তুমি ঘুমাও না।

না এস।

তাকে তখন বালিশ নিয়ে টুটুলের পাশে শুতে হত। মিণ্টু টুটুলকে বোঝাত, তুই কি রে, বাবা লিখবে না! বলে ভাইকে বুকে জড়িয়ে নিতে চাইলে টুটুল হাত পা ছুঁড়ত। কাঁদত। অতীশ পাশে না শুলে ঘুমাত না। এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। আলাদা শোওয়ার ব্যবস্থা ধীরে ধীরে টুটুল মেনে নিয়েছে। এমন কি তাদের মা এলেও। যেন ভাই বোন বুঝে ফেলেছে—এক সঙ্গে শোওয়া মা বাবা আর পছন্দ করছে না। মা বাবা তাদের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।

এই এক অন্তর্গত জ্বালা, অতীশ চোখ বুজলেই টের পায়। একা শোয় ঠিক, কিন্তু কেমন মনে হয় সমুদ্রের মত নিসঙ্গতায় সে আক্রান্ত। ইচ্ছে করলেই টুটুল মিণ্টুর পাশে গিয়ে শুতে পারে না। তক্তপোশ ছোট, দুজন কোনোরকমে শুতে পারে। তার লেখালিখির শেষে টুটুলকে যেমন হিসি করানোর কাজ থাকে, তেমনি ঘুম ভেঙে গেলে সন্তর্পণে হেঁটে আসে এবং ঠিক দেখতে পায় মশারির বাইরে টুটুলের হাত না হয় পা বের হয়ে আছে। মশার কামড়ে অস্থির হওয়ার কথা। ঘুমের ঘোরে তাও টের পায় না। সে ঠিকঠাক করে মশারি গুঁজে দেয়। বালিশে মাথা থাকে না। যেন এদের দেখার সত্যি কেউ নেই।

কত রাতে আলো জ্বালিয়ে টুটুল মিণ্টুর দিকে চুপচাপ তাকিয়ে থাকে—দেখলে মনে হবে সন্তানের মায়া বড় গভীর। তার মৃত্যুযোগ—এরা জানে না, সে না থাকলে এই দুই শিশু অনাথ। নির্মলা না থাকলে—কেন যে এল না, চিঠি নেই!

দুশ্চিন্তা তাকে পীড়নের মধ্যে ফেলে দেয়—নির্মলা যদি অন্য প্রলোভনে পড়ে যায়—যেতেই পারে—যদি সন্তানের কিংবা তার আকর্ষণের চেয়েও বড় আকর্ষণের জায়গা তৈরি হয়ে যায়। একা থাকে।

মাথা খারাপ না হলে ছুটে আসি মরতে—এই মাথা খারাপ বিষয়টা যদি অন্য কোনো ক্ষেত্র তৈরি করে ফেলে। সে আজকাল কেন যে মাঝে মাঝে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে। গভীর রাতে কেউ যদি জেগে থাকে, দরজায় সন্তর্পণে এসে যদি দাঁড়ায়—নির্মলা ত রক্তমাংসের মানুষ—তার মাথার মধ্যে অজস্র পোকার কামড়।

তবে কি শরীরই সব—সন্দেহবাতিক হয়ে উঠছে কেন! জ্যোতিদা কি…. না সে আর ভাবতে পারছে না। নারীর সঙ্গে পুরুষের আর কি সম্পর্ক থাকতে পারে—যদি দুর্বলতা সৃষ্টি হয়, তার প্রিয় নারী সহসা বিবস্ত্র দৃশ্য মেলে দিলে চোখ জ্বলতে থাকে। এ-সব সে কি ভাবছে! সে কি সত্যি পাগল হয়ে যাবে। অথবা তার কাছে ছুটে আসার জন্য পাগল যে নারী—সে এ-ভাবে এতদিন সম্পর্কশূন্য হয়ে বাঁচে কি করে!

তার চোখ জ্বালা করছে। কু-চিন্তার আক্রমণ থেকে রেহাই পাবার জন্য বাথরুমে ঢুকে হাতে মুখে ঘাড়ে জল দিল। তারপর ফ্যান ফুল স্পিডে চালিয়ে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ার সময় কি এক গভীর দুঃখে হুহু করে কেঁদে ফেলল।

তার ঘুম আসছে না। বেড ল্যাম্প জ্বেলে দিল। টেবিল থেকে একটা ম্যাগাজিন তুলে যা হয় কিছু পড়া, আসলে অন্যমনস্ক না হতে পারলে পীড়ন তাকে পাগলা ঘোড়ার মত ছুটিয়ে মারবে। সে পাতা উলটে যেতে থাকল, কবিতার দু—এক লাইন পড়ে দেখল, না অন্যমনস্ক হওয়া কঠিন। সে মন দিতে পারছে না।

কেবল অতিকায় ডাইনোসোরাসের মত ক্রমে দুশ্চিন্তার পাহাড় মগজ ভারি করে দিচ্ছে। কোনো দুর্ঘটনা, হতেই পারে। কাগজ খুঁটিয়ে দেখা দরকার। কাগজে দুর্ঘটনার খবর থাকে, আবার সব দুর্ঘটনার খবর থাকেও না। তবু যদি থেকে থাকে, তার যেন কাল একটাই কাজ—এবং সকালে সে যখন বের হবে, কুম্ভবাবু হাজির। রাজবাড়ির অফিসে দেখা করার হুকুম। কুমারবাহাদুর অফিস যাবার আগে দেখা করতে বলেছেন।

সে সকাল সকাল বের হয়ে গেল। বের হয়ে যাবার সময় যেমন প্রতিদিন সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে যায়, এই যেমন, রাস্তা দেখে পার হবি সুখি। টুটুলকে সাদেকের কাছে রেখে যাবি। টুটুলকে নিয়ে রাস্তা পার হতে যাস না। টুটুল শোনো, তুমি কিন্তু দিদির সঙ্গে যাবে বলে বায়না ধরবে না। তোমাকে দেখবে কত বড় ইস্কুলে ভর্তি করে দি। তুমি কিন্তু পড়া সব মুখস্থ করে রাখবে। অঙ্ক সব করে রাখবে। তোমাকে কফি হাউসে নিয়ে যাব। পৌকড়া খাওয়াব। কেমন, লক্ষ্মী সোনা, বলে গালে চুমু খেয়ে বের হয়ে যাবার সময় মনে হল তাকে কেউ পেছন থেকে তাড়া করছে। সে কে! সে একজনই—তার নাম আর্চি। সে প্রাইভেট অফিসে ঢুকে দেখল খাস বেয়ারা শঙ্খ বিলিয়ার্ড ঘরে দাঁড়িয়ে আছে। সে বলল, কুমারবাহাদুর নেমেছেন। ভিতরে আছেন। যান।

সে ভিতরে ঢুকে বলল, আমাকে ডেকেছেন?

তাকে একবার দেখে ইশারায় বসতে বলেছেন। সে চুপচাপ বসে আছে। কেন ডেকেছেন, কি হুকুম হবে সে জানে না। তার সঙ্গে সম্পর্ক খুব ভাল যাচ্ছে না। বউরাণী অমলার দাপটে কিছু হেস্তনেস্ত করতে পারছেন না। অথচ আগে আশ্চর্য মধুর সম্পর্ক ছিল—বউরাণী, সঙ্গে কিছু কেচ্ছা এই রাজবাড়িতে ওড়াওড়ি করছিল—কুমারবাহাদুর বিদেশ থেকে ফিরে কি তা টের পেয়েছেন—

সে জানে অমলা হয়ত এখন তার দোতলার বিশাল হলঘরে বসে আছে কিংবা একা ব্যালকনিতে পায়চারি করছে। কুমারবাহাদুরের অনুপস্থিতে অমলাই অফিস সামলায়। অমলার সঙ্গে তার যেন দীর্ঘদিন কোনো সম্পর্ক নেই। মাঝে মাঝে অমলা তার বাসার পাশ দিয়ে সকালে যায়—গোয়ালে বড় বড় জার্সি গরু—এত বিশাল এলাকা যে অমলাকে বেশ অনেকটা হেঁটে যেতে হয়। জানালায় দাঁড়িয়ে সে দেখে। অমলা কোনো কারণেই চোখ তুলে তার বাসার দিকে তাকায় না। খাস বেয়ারা শঙ্খ থাকে সঙ্গে।

বল ভাইয়া কি খবর!

আপনি ডেকেছেন?

তুমি একবার সনৎবাবুর সঙ্গে দেখা করে যাবে।

অতীশ বুঝল না, সনৎবাবুর সঙ্গে ত দেখা করেই যায়। সনৎবাবু রেজলিউশান করে রাখবেন—কি কি রেজলিউশান বোর্ড-মিটিং-এ পাশ হবে, তিনিই ঠিক করেন। এ-জন্য তাকে তবে খোদ কুমার- বাহাদুরের ডেকে পাঠানোর কি অর্থ বুঝতে পারছে না।

সে উঠতে যাচ্ছিল। তিনি ফের বললেন, বোস।

এ-সময় কুম্ভবাবু সঙ্গে থাকলে যেন ভাল হত। তাকে বসিয়ে রাখার এত কি গুরুত্ব সে বুঝতে পারছে না। কুম্ভবাবু কি জানে, এবারে বোঝো, পচা টাকার গন্ধ পাও, পচা টাকা জমা হয় কি করে বোঝো!

এ-সময় অফিস সুপার রাধিকাবাবু ঘরে ঢুকে কিছু কাগজপত্র সই করিয়ে নিলেন। সে বসে আছে। তাকে কেন বসিয়ে রেখেছে সে বুঝতে পারছে না। সে বেয়াড়া প্রকৃতির, সনৎবাবু কি এমন কিছু অভিযোগ করেছেন। কিংবা দু-নম্বরী মালের খদ্দের পিয়ারিলালরা কি শেষ পর্যন্ত রাজার কাছে নিজেরাই দরবার করে গেছে! কারখানায় ঢুকেই সে দু-নম্বরী মাল বন্ধ করে দিয়েছিল। তার এক কথা, পারব না। মিনারেল অয়েল ভরে নারকেলের তেলের সেন্ট মিশিয়ে বাজারে ছাড়া! এক নম্বর নারকেলতেল বলে বিজ্ঞাপন দেওয়া—সে সহ্য করে নি।.

পিয়ারিলালরা কি বলেছে, তারা মাল নিলে কোম্পানির অবস্থা ফিরে যাবে। কোম্পানি লোকসানে চলবে না। দাম বাড়িয়ে দিতে রাজি হয়ে থাকে যদি। কিন্তু যত অসময়ই আসুক—নকল কন্টেনার বানাতে সে রাজি না। কারখানায় যখন প্রথম আসে তখনই ত নাভিশ্বাস ওঠার উপক্রম। পিয়ারিলালরা শুষে নিয়েছে কারখানাকে। কোথা থেকে লোটা-কম্বল সম্বল করে বড়বাজারে উঠেছিল, এখন গাড়ি বাড়ি এমন কি রক্ষিতাও রেখেছে।

ভাইয়া চোখ কান খোলা রেখে না চললে বাঁচবে কি করে?

এ-কথা কেন। সে তাকিয়ে আছে।

তিনি চেয়ারে হেলান দিয়ে ঘরের ছাদ দেখছেন, না মাথার উপর বিশাল ঝাড়লণ্ঠনের রঙিন কাচে কি রং এ-মুহূর্তে খেলা করছে দেখছেন সে বুঝতে পারল না।

সনৎবাবু বললেন, তোমাকে দিয়ে নাকি সই করানো যাবে না।

সে কিছুই জানে না। কারখানার কিছু গোপন খবর এখন কুম্ভবাবু রাখে। যেমন সে স্ক্র্যাপ বিক্রির টাকা ক্যাসবুকে জমা করত। ইদানীং রাজার ইচ্ছে নয়, স্ক্র্যাপ বিক্রির টাকা ক্যাসবুকে জমা পড়ুক। স্ক্র্যাপ বিক্রির ভার তিনি কুম্ভকে দিয়ে দিয়েছেন। সেই যা হয় করবে। স্ক্র্যাপ বিক্রির ভার তার হাত থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। সামান্য কিছু টাকা জমা পড়ে। কত স্ক্র্যাপ, কত দামে বিক্রি তার জানার অধিকার নেই। সে কিছুদিন গুম মেরে ছিল। কিছু বলতে পারে নি। ভিতরে তার অগ্নিকাণ্ড ঘটে যাচ্ছে, কেউ টের পাচ্ছে না। কবে না বলে দেন, দু-নম্বরী মাল নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। অর্ডারবুক তুমি কুম্ভকে দিয়ে দাও।

অর্ডারবুক কুম্ভবাবুর দপ্তরেই থাকে। সে শুধু বলে দিয়েছে, দু-নম্বরী মালের অর্ডার নেবেন না। অর্ডারবুকে, কি কন্টেনার, পাউডারের না নারকেল তেলের, ভেকুয়াম মাল, না স্কোয়ার মাল, তার সাইজ, নাম, ক-রঙের ছাপা লিখে বইটি তার কাছে পাঠিয়ে দেবার নিয়ম। সে সই করে ছেড়ে দেয়। এখন তাকে দিয়ে সই না করিয়ে যদি কুম্ভবাবু সই করার অধিকার পেয়ে যায়!

সে কিসে সই করবে না বুঝতে পারছে না। ব্যাগ থেকে একটা চিঠি বের করে কুমারবাহাদুরকে বলল, ব্যাংক থেকে চিঠি এসেছে।

তিনি চিঠি দেখার আগ্রহ বোধ করলেন না। কিসের চিঠি জানতে চাইলেন না। ব্যাংক লোন শোধ করা যাচ্ছে না, বছরের পর বছর কিস্তি বাকি পড়ে যাচ্ছে—এবারে কড়া চিঠি, ব্যাংকের সদর দপ্তর থেকে কড়া নোটিশ, লোন শোধ না করলে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হতে পারে। চিঠির ভিতর এমন একটা গোপন আতঙ্ক আভাসে রেখে দিয়েছে। অবশ্য সে জানে, দু-এক কিস্তি দিতে পারলেই কিছুদিনের জন্য আবার চিঠি আসা বন্ধ থাকবে। কিন্তু দেবে কোত্থেকে!

কুমারবাহাদুর চিঠিপত্র দেখছেন। যেন অতীশের এখন উঠে যাওয়া উচিত। কিন্তু কেন ডাকা, সে বুঝতে পারল না, সনৎবাবু কেন বললেন, তাকে দিয়ে সই করানো যাবে না—কি সই করানো যাবে না, সে একবার কোম্পানির হেল্থ লাইসেন্স ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে ঝামেলা পাকিয়েছিল—কর্পোরেশনের বাবুরা পেয়ে থাকেন, কেন পাবেন এমন প্রশ্ন করতেই সে অজগরের লেজ ধরে টান দিয়েছিল। সে তখন নতুন। সনংবাবু বলেছিলেন, পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি—দুশ পাঁচশ টাকা ধরিয়ে দিলে যদি দু-আড়াই হাজার টাকা বেঁচে যায়, কোম্পানির স্বার্থেই করা উচিত। এসেসমেন্ট আটকে রেখে বাবুটি কোম্পানির স্বার্থ দেখছে—আর তুমি বলছ ঘুষ দেবে না! তোমার কি সত্যি মাথা খারাপ!

অফিসে এসে বসতে না বসতেই ফোন। ফোনে কে বলছে, তোর সত্যি মাথা খারাপ।

কে?

আমি রে আমি। কি ভাবছিলি?

অমলা?

অমলা না, বউরাণী। তোর বেয়াদপির শেষ নেই। মাথা খারাপ।

আমার মাথা খারাপ?

হাঁ মাথা খারাপ। তোর সত্যি মাথা খারাপ। সই করে দিবি।

কিসে?

চেকে।

তার মানে!

তার মানে বুঝিস না, কচি খোকা।

না আমি বুঝি না, অমলা তোমাদের অবিচার আমাকে সত্যি পাগল করে দেবে। সই করব কি করব না পরে হবে। ফোনে তোমার সঙ্গে আর কোনো কথা না। বলেই সে ফোন কেটে ডাকল সুধীর। সুধীর।

সুইংডোর ঠেলে হাজির। বশংবদ। এক পায়ে খাড়া——প্রিন্টিং মেশিন বন্ধ কেন? ডাক প্রিন্টারকে। কটা বাজে।

প্রিন্টার হাজির।

আজ্ঞে ডেকেছেন।

কটা বাজে!

স্যার রুল খারাপ।

রুল সেদিন মেরামত হয়ে এল! খারাপ হয়ে গেল!

কি শিরিষ দিচ্ছে স্যার কে জানে, রুল ফেটে যাচ্ছে।

নতুন কেনা হল যে!

কুম্ভবাবু তুলে রেখেছে।

আসে নি!

না।

আবার ফোন।

কে?

ফোন কেটে দিলি কেন?

খুশি।

খুশি! খুশি তোমার বের করছি।

অতীশ আর পারল না। কেমন অসহায়ের মত বলল, দেখ অমলা আমাকে জ্বালাবে না। প্লিজ। আমি তোকে জ্বালাচ্ছি? তোর ভালর জন্য বলছি। শোন, শেয়ার ফ্লোট করা হয়েছে, তোর মুখের দিকে তাকিয়ে নয়। কোম্পানি থেকে এক পয়সা আসে না মনে রাখবি। শেয়ার ফ্লোট করা হয়েছে, সবটাই ফিরিয়ে নেওয়া হবে বলে।

তার মানে!

ক্যানেস্তারা মেশিন কত দিয়ে কিনছিস?

আশি হাজার।

ওটা আশি হাজার হবে না। দু-লাখ আশি হাজার হবে।

আমি কিছু বুঝতে পারছি না অমলা।

তোকে বুঝতে হবে না। কুম্ভ, সনৎবাবুরা করছে। তুই কোম্পানির সেক্রেটারি ম্যানেজার। দু-ই। তোর সই না হলে চলবে না।

টাকা তুলে নিলে মেশিন বসবে কি করে?

সেটা তোর দেখার কথা না।

কে দেখবে?

শোন, রেজলিউশান হয়ে গেছে। এখন আর মাথা খারাপ করতে যাস না। আমি তোকে জানি, তোর রাজেনদা, তারপরই সংশোধন করে বলল, কুমারবাহাদুর বলেছেন, তোমার দ্যাশের পোলা, বোঝাও। এত এক বল্গা গাড়ি—বোর্ড-মিটিংয়ে আবার না কিছু বলে বসে! আরো ডিরেকটাররা থাকবে। তুই সব করতে পারিস—তোকে দিয়ে বিশ্বাস নেই। কুমারবাহাদুর তোর মুখ দেখে নাকি, কিছু বলতে পারে নি। তুই নাকি খুব চটে আছিস! তুই যা মানুষ, ব্যাগ ছুঁড়ে মারাও তোর পক্ষে অসম্ভব নয়। তুই বোর্ড-মিটিংয়ে ঝামেলা পাকাস না। যা করছে করুক। তোর কি। কোম্পানি ত তোর না। তুই চাকর। এটা কেন যে তুই ভুলে যাস বুঝি না। লক্ষ্মী ছেলে আমাকে ছোট করিস না।

সে তার শৈশবের অমলাকে যেন চিনতে পারছে না। এই নারীর ছত্রচ্ছায়ায় আছে বলেই, রাজবাড়ির সব আমলা তাকে সমীহ করে। এমন কি তার উপরওয়ালা সনৎবাবু পর্যন্ত। শুধু সনৎবাবু হবে কেন, কুমারবাহাদুর ওরফে রাজেনদা নিজেও। যেন কুমারবাহাদুর জানেন, সে যত অনাসৃষ্টির কারণই হোক না বউরাণীর মর্জি না হলে কিছু করার নেই।

মাথা দপদপ করছে। যেন শিরা-উপশিরা ফেটে রক্তপাত ঘটবে তার। সে বুঝতেই পারছে না তাকে চেকে সই করতে বলা হচ্ছে কেন। সনৎবাবু কুম্ভবাবু কি ঠিক করে রেখেছে! তাকে বলির পাঁঠা করা হচ্ছে কেন। এ ত জালিয়াতি! সে শেষপর্যন্ত এ কি পাপচক্রে পড়ে যাচ্ছে। অথচ সে নিরুপায় হয়ে এসেছিল, সামান্য একটি শিক্ষকতার কাজের জন্য। কুমারবাহাদুর তার লেখার অনুরাগী। তিনি নিশ্চয়ই তার হয়ে এ কাজটুকু করবেন। দেশে শিক্ষকতার চাকরি ছেড়ে দিয়ে সে আসলে ভুল করেছে। ম্যানেজিং কমিটি দু-পাঁচটা ফল্স ভাউচার করত, কটুবাবু আর সেক্রেটারি মিলে টাকা লুটছে, সে সহ্য করতে পারে নি। ঠোকাঠুকি শুরু হয়ে গেল। আর তারপর কি হল কে জানে যেন এক পাপচক্র স্কুলজীবন, সে রেহাই পেতে চেয়েছিল—সে ছুটে এসেছিল তার সুহৃদ রাজেনদার কাছে, তিনি তাকে লুফে নিলেন। বলেছিলেন, আমার কারখানায় লেগে যাও। গাঁয়ে থেকে জীবন নষ্ট করার মানে হয় না। গোল্ড মাইন বলতে পার। চুরিচামারি করে সব শেষ করে দিচ্ছে।

সে বলেছিল, কারখানার কিছু বুঝি না।

বুঝতে হবে না। আমার লোক আছে, তুমি শুধু চুরিচামারি আটকাবে। তোমার মত একজন সৎ মানুষ আমার দরকার।

এই তবে সেই গোল্ড মাইন! যত দিন যাচ্ছে, মনে হচ্ছে তাপ্পি মেরে আর কতদিন চালানো যাবে। তার উপর হঠাৎ এই ফরমান। সে বুঝতে পারছে না কি করবে!

রাজার পচা টাকা শেয়ার কিনে ধোওয়া তুলসী পাতা করে নিচ্ছে।

কিরে চুপ করে আছিস কেন?

কি বলব বল! আমি কিছু বুঝতে পারছি না বললাম ত। কেন এত টাকার চেক কাটা হবে, কে নেবে—কার নামে—আমি বুঝতে পারছি না।

মেশিন তোরা কিনছিস না।

কে কিনছে তবে?

রায় অ্যাণ্ড রায়।

তার মানে!

ঐ আর কি। রায় অ্যাণ্ড রায় কিনবে। তাদের কাছ থেকে তোর সিট মেটাল কিনবে।

ফিকটিসাস!

তোর মুণ্ডু। ফিকটিসাস বলে কিছু নেই।

ধুস।

ফের অতীশ আর কোনো কথা শোনার আগ্রহ বোধ করল না। ফোন কেটে দিল।

সুধীর সুধীর!

আজ্ঞে যাই।

এ হপ্তার কাগজগুলি দে।

খবরের কাগজ?

হ্যাঁ।

সে কাগজগুলো এনে বলল, কোথায় রাখব স্যার?

নিচে রাখ। আর শোন—ফোনে যেই আমাকে চাক—বলবি, ব্যস্ত আছেন।

আচ্ছা।

কি বলবি বল ত?

স্যার ব্যস্ত আছেন।

সে কাগজের উপর এবার হুমড়ি খেয়ে পড়ল। বৃহস্পতিবার রওনা হলে শুক্রবারের কাগজে দুর্গটনার খবর থাকবে। তার আর কোনো খবর দেখার নেই। বড় বড় হেড-লাইনে খবর তার কাছে অর্থহীন। সে ছোট খবর দেখছে। কোনো ছোট খবর যে কত বড় খবর হতে পারে অতীশের হামলে পড়া দেখলে, বোঝা যায়—দু-জায়গায় আত্মহত্যার ঘটনা, সশস্ত্র সংগ্রামের ক্ষেত্র প্রস্তুত—নকশাল নেতার গোপন ডায়েরি ফাঁস। মহাকরণে ছাত্র বিক্ষোভ। পথ দুর্ঘটনায় অজ্ঞাত ব্যক্তির মৃত্যু। সে খুঁটিয়ে পড়ল। পুরুষ। মেয়ে নয়। কালকা মেলে যুবতীর লাশ। বুকটা ধড়াস করে উঠল। হাওড়া স্টেশনে গত বুধবার কালকা মেলের কামরা থেকে ট্রাঙ্কের মধ্যে এক যুবতীর লাশ….

স্যার বউরাণী! ফোনের মুখ চেপে সুধীর অতীশের দিকে তাকিয়ে আছে। অতীশ না তাকিয়েই বলল, ব্যস্ত আছে বলে দে।

বউরাণী স্যার।

তোকে যা বলছি বল।

অতীশ শুধু পড়ে যাচ্ছে।

কেমন এক ঘোর। এ-মুহূর্তে সে এক নিঃশ্বাসে পড়ে শেষ করে ফেলল—ট্রাঙ্কের মধ্যে এক যুবতীর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। রেল-পুলিশ জানায়, যুবতীকে খুন করার আগে তাকে উপভোগ করেছে খুনীরা। শ্বাসরোধ করে হত্যার পর তাকে সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায় চটে জড়িয়ে নীল রঙের একটি ট্রাঙ্কের মধ্যে পুরে ট্রেনের কামরায় তুলে দেয়। ফর্সা, গোলগাল গড়নের ওই মহিলাকে দেখে বোঝা গেছে তিনি অবাঙালি এবং বিবাহিতা। বয়স বছর পঁয়ত্রিশ। একদিন আগে খুন করা হয়েছে। ময়না তদন্তের জন্য দেহটি মর্গে পাঠানো হয়েছে। একটি খুনের মামলা শুরু হয়েছে।

সবটা পড়ে অতীশ কেমন ঘাবড়ে গেছে। ঝড় উঠে গেছে ভিতরে। অবাঙালি—কি করে বুঝবে বাঙালি অবাঙালি—যা খুশি লিখলেই হল। কালকা মেল, কালকা মেল কি বর্ধমান হয়ে আসে! লোভে যদি কেউ কোথাও চলে যায়, লোভে ফেলে দিলে কত কিছু করতে পারে—এমন আতঙ্কে সে কেন পড়ে যাচ্ছে! গোলগাল চেহারা—ফর্সা। না মিলছে না। গোলগাল নয়। ফর্সাও নয়। বয়স বছর পঁয়ত্রিশ। বেশি ফারাক না। যেগুলি মিলে যাচ্ছে, তা যেন সত্য খবর, যেগুলি মিলে যাচ্ছে না, খবরদাতা সম্পর্কে সন্দেহের উদ্রেক হচ্ছে। সে কি করবে! ফোন করবে, কোথায়? কার কাছে।

স্যার ফোন।

নামিয়ে রাখ।

অতীশ উঠে দাঁড়াল। পায়চারি করল।—কিন্তু বুধবারের খবর। লাশ তার আগের দিনের বলা হয়েছে। নির্মলা বের হলে বৃহস্পতিবার বের হতে পারে। সমাজ-বিরোধীদের পাল্লায় পড়লে বৃহস্পতিবার রাতে পড়তে পারে। শুক্র শনি বন্ধ হলে বৃহস্পতিবার রওনা হতে পারে। যেখানে নিয়ে গিয়েই হত্যা করা হোক, বৃহস্পতিবারের আগে ঘটতে পারে না। তার আগে মরতে নির্মলা বের হবে কেন!

দেখ ত কুম্ভবাবু এয়েছে কিনা?

এসেছেন। দু-বার উঁকি দিয়ে গেছেন। ব্যস্ত আছেন বলে ঢোকেন নি।

ডাক।

কুম্ভবার ভিতরে ঢুকে ভাবল, আজকের বোর্ড-মিটিং নিয়ে হয়ত কথা বলবেন! কিন্তু এটা কি শুনছে?

কালকা মেল খড়্গাপুর না বর্ধমান স্টেশন হয়ে আসে?

বর্ধমান। কেন বলুন ত? কেউ আসবে!

ঠিক জানেন না! আমিও জানি না।

কালকা মেলে কে আসবে।

কেউ আসবে না।

এত কাগজ নিয়ে বসেছেন!

কালকা মেল কোন লাইনে আসে জানেন না?

কুম্ভও কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। বাবুটির মাথায় পোকা যে আছে সেই প্রথম টের পেয়েছিল।

কিন্তু অতীশবাবু এমন বিহ্বল চোখে তাকিয়ে আছে যে কালকা মেল কোন লাইনে সঠিক বলতে না পারলে দু-জনেরই এবার মাথা খারাপ হয়ে যাবে। সেও যেন সঠিক জানে না, কালকা মেল বর্ধমান লাইনে আসে, না খড়্গপুর লাইনে আসে। তারও খুব ভাল ধারণা নেই। মনে হয়েছে খড়্গপুর লাইনে আসে, আবার মনে হয়েছে, বর্ধমান লাইনেও আসতে পারে। ইস্টার্ন না সাউথ-ইস্টার্ন! সেও কেমন সব গুলিয়ে ফেলছে।

সে বলল, কি দরকার বলবেন ত!

হঠাৎ অতীশের মনে হল, সে বাড়াবাড়ি করছে—যদি কিছু ঘটে গিয়ে থাকে, সে কিছু করতে পারে না। সে বাড়াবাড়ি করছে। কালকা মেল নিয়ে কেন যে এত বিপন্নবোধ করছে! বর্ধমান লাইনে হলেই বা কি, বর্ধমান লাইনে হলে বৃহস্পতিবার রাতে ঘটলে তবু কথা ছিল—মঙ্গলবার ঘটেছে।

সে বলল, ঠিক আছে যান। ও এমনি।

কুম্ভবাবু বলল, চেকবুকটা দিন।

কি করবেন?

টাকার অঙ্কটা লিখে রাখি।

পরে দেব।

স্যার ফোন। বউরাণীর।

ব্যস্ত আছে বলে দিতে পারছিস না!

কুম্ভ, বাবুটির আস্পর্ধায় এতই ঘাবড়ে গেল যে কাছে থাকলেও তার চাকরি যাবে—সে ছুটে বের হয়ে গেল। যেন এমন কথা কানে শোনাও পাপ। বলছে কি? বউরাণীর ফোন, কথা বলছে না। ব্যস্ত আছেন! তোর কি এত ব্যস্ততা! সব ত আমরা করে দিই বলে চলে যাচ্ছে। ইস কি যে হবে! সে প্রিন্টিং রুমের দিকে যাবার সময় চিৎকার করে বলল, এই প্রিন্টারকে ডাক। মেশিন বন্ধ কেন।

অতীশ শুনতে পাচ্ছে সব। ফোন তোলা। আসলে জুজু। বউরাণী যেন এই ফোনে সব টের পেয়ে যাবেন—কে কোথায় কি করছে, যেন এই ফোনের মধ্যে আছে খবরাখবরের এক লম্বা সাঁকো। সাঁকো পার হয়ে যেতে চায়। সে ফের ডাকল, কুম্ভবাবু শুনে যাবেন।

সুধীরের দিকে তাকিয়ে অতীশ বলল, ফোন হাতে রেখেছিস কেন! নামিয়ে রাখ। বেউরাণীর ফোন।

দে।

সে বলল, বল।

অন্যপ্রান্ত নীরব।

কুম্ভবাবু হাজির।

আমাকে কিছু বলছেন?

রুলগুলি তুলে রেখেছেন কেন? ওগুলো দিয়ে দিন। কাজ বন্ধ

বল। সে এবার ফোনে কথা বলল।

শুয়োরের বাচ্চা। কুম্ভবাবুর দৃষ্টিতে আগুন ঝরছে। সে ভুলে রুলগুলি তুলে রেখে গেছিল। তার অপিস-ঘরের চাবি আলাদা। অফিস ঘর এখনও তার খোলা হয় নি। হরিচরণ ছুটি নিয়ে দেশে গেছে। একা কাজ সব সামলাতে হচ্ছে। এই ত দু-দিন থেকে পে-বিল নিয়ে পড়েছে। তৃণটুকু এগিয়ে দেবার কেউ নেই—কেবল ছড়ি ঘুরানো। শুয়োরের বাচ্চা তুমি অনেক জল ঘোলা করেছ। চার-পাঁচ বছরে তুমি আমার কম সর্বনাশ কর নি। সুখা মাইনে—আর ফিকটিসাস ট্র্যাভেলিং এলাউন্স—এই নিয়ে হাসির দাপট সহ্য করছি। আর তুমি বলছ কিনা, রুলগুলি তুলে রেখেছেন কেন। রেখেছি, ইচ্ছে। ফোনে শুনিয়ে দিচ্ছে, প্রিন্টিং মেশিন বন্ধ।

কি হল চুপ করে আছ কেন?

তোর এত জোর কোথা থেকে আসে?

কিসের জোর! এখন আজেবাজে কথা বলার সময় নেই। কি বলবে বল!

আমি কিছু বলব না। তুই ফোন নামিয়ে দ্যাখ!

তোমার কি সময় অসময় নেই অমলা! তুমি রাজবাড়ি থাকলে একরকম, বাইরে আর একরকম। কৈ কোনোদিন ত দেখ না, রোজ ত পাতাবাহারের গাছগুলির পাশ দিয়ে যাও। আমার জানালা পড়ে কই একবারও ত চোখ তুলে তাকাও না। এখন বলছ, আমি কিছু বলব না। কিছু না বললে, ফোন ধরে আছ কেন!

শোন, যেন গম্ভীর এক অন্তর্গত শব্দ উচ্চারণ, তুই রাজবাড়ির নফর। আমি যে কত চেষ্টা করেছি দৃশ্যটা ভুলতে, পারছি না। তুই তার দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছিস। তুই বেইমান। তোকে তোর দাদা বিপদের সময় আশ্রয় দিয়েছে। আর তুই এত অকৃতজ্ঞ—তার তুই ভালমন্দ দেখবি না।

প্লিজ অমলা, তুমি বুঝবে না, আমার কি চলছে। পরে তোমার সব শুনব। সুধীরের দিকে তাকিয়ে বলল, গত শুক্রবারের কাগজটা দে।

গত শুক্রবারের কাগজ দিয়ে তোর কি হবে? কোথাও দরখাস্ত করছিস।

হ্যাঁ। আর কিছু তোমার বলার আছে?

তোকে ছাড়লে ত।

ছাড়বে না মানে?

না ছাড়ব না। তুই যাস কি করে দেখব।

শোনো অমলা, যদি অন্যত্র ক্রীতদাসের চাকরিও পাই চলে যাব। তোমরা আমাকে রাখতে পারবে না। কিন্তু আমাকে চাকরি দেবে কে? কে দেবে বল! আর তোমরা ত ভালই জান। তোমরা আমাকে এমন কিছু সুবিধাজনক অবস্থায় রেখেছ, ইচ্ছে করলেও ছেড়ে যেতে পারব না। অথচ জান, অহরহ তোমাদের হাত থেকে আমি নিষ্কৃতি চাইছি। আমার আর কিছু চাইবার নেই।

সুধীর বলল, এটা স্যার?

অতীশ কাগজটা বাঁ-হাতে টেনে ডেটলাইন দেখল। বলল, ঠিক আছে।

খটাস করে সে ফোনটা রেখে দিল।

কলেজ বারান্দা থেকে ছাত্র আত্মঘাতী। অতীশ ঝুঁকে খুঁজছে। আত্মঘাতী কেন যে হয়। কি দরকার ছিল, এমন কি দরকার পড়ে গেল আত্মঘাতী হবার! খুনের দায়ে গ্রেপ্তার। কাকে খুন—আসানসোলের গোয়েন্দা পুলিশ শনিবার সকালে বালুয়াতলা থেকে মহম্মদ নায়েককে গ্রেপ্তার করে। অতীশ খুঁজছে—সে পাতা উলটে গেল—বাস-জিপ সংঘর্ষ—নিহত সাত। রাজস্থানের শ্রীগঙ্গানগর ….. বাস, পার্টিতে আগুন বর-কনে নিহত—অল্পের জন্য রক্ষা —বিমানবন্দরের সংবাদদাতা …… এখনও বহু নিখোঁজ —গঙ্গাবক্ষে নৌকাডুবি দুই লোকালে ধাক্কা—হত এক। কে সে! হাওড়া স্টেশনের কাছে মঙ্গলবার ভোরে দুই ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষে রেলের খালাসি সোলেমান সিং মারা যান।

খালাসি, সোলেমান সিং, সোলেমান সিং …. খালাসি। বাউড়িয়ায় আরও পাঁচ মৃত দেহ …. বাউড়িয়ার নৌকাডুবিতে আরও পাঁচজনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে মঙ্গলবার। জেলা পুলিশ জানায় ডুবুরি নেমেছে। নৌবাহিনী থেকে ডুবুরি চাওয়া হয়েছে। পোর্ট-পুলিশও ডুবুরি নামিয়েছে। জেলা প্রশাসন থেকে জানানো হয় গঙ্গায় বাউড়িয়া থেকে মোহনা পর্যন্ত তল্লাসি চালানো হবে ডুবুরি দিয়ে। এদিন পাওয়া গেছে জীবন ব্যানার্জি, সুধাংশু দাস, শ্রীমতী মুরালি বারিক ও বিভাস রায়। আর একজনের পরিচয় জানা যায় নি।

সে কে?

নির্মলা অতদূরে যাবে কেন? বাউড়িয়া কোথায় তাই ত জানে না। যদি আর কেউ জানে

তারপরই মনে হল অতীশের, তার কি সত্যি মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। বাউড়িয়া, নৌকাডুবি এতদূর মরতে যাবে কেন। এমন কেন ভাবছে! যেন সব অপমৃত্যু, খুন, এবং দুর্ঘটনা তার জন্য ওৎ পেতে আছে। কোথায় কিভাবে কার মৃত্যু হয়, তাই কে বলতে পারে। নিয়তি মানুষকে কোথায় না টেনে নিয়ে যেতে পারে?

এই বাউড়িয়া কোথায় জানিস?

না স্যার।

কত জায়গা কত নাম, সে বাইরে বের হয়ে কুম্ভকে বলল, বাউড়িয়া কোথায় জানেন?

বজবজের কাছে, কেন বলুন ত?

না এমনি। আচ্ছা ঠিক আছে।

সে ফিরে এল।—বজবজ, না সেখানে নির্মলার কে আছে! তা-ছাড়া পুরুষ না মহিলা তাও লেখে নি। ধন্দ কিভাবে যে একজন মানুষকে পাগলা হাতির মত উন্মত্ত করে তুলতে পারে, অতীশকে দেখলে বোঝা যায়। দুশ্চিন্তা চেপে বসেছে। না পীড়ন শুরু হয়েছে।

আবার ফোন বাজছে।

কাগজগুলো সরিয়ে নিতে বলল অতীশ।

সে ফোন তুলে বলল, মিঃ ভৌমিক বলছি।

বার্নিশের বিল পাঠাচ্ছি।

পাঠাবেন না।

কেন?

চিঠি গেছে। দেখুন।

চিঠি!

হ্যাঁ। কমপ্লেন আছে।

কমপ্লেন!

রং চটে যাচ্ছে। মিস্ত্রিরা বলছে, বার্নিশের দোষ।

ডাইস খারাপ হতে পারে। বার্নিশের দোষ দিচ্ছেন কেন বুঝি না স্যার।

আমি নিজে দেখেছি।

একটু বেশি করে তারপিন দিতে বলবেন। বেটার কোয়ালিটি।

অতীশের এত কথা বলতে ভাল লাগছিল না। সে বলল, ঠিক আছে পাঠিয়ে দিন।

এই সুধীর, সুকুমারকে ডেকে দে।

আজ্ঞে যাই।

তোকে ডেকে দিতে বলছি। সুকুমারকে। বুঝতে পারছ। তোর মাথায় কি আছে বল ত! কিছু

বুঝিস না। তুই এসে কি উদ্ধার করবি।

সুকুমার এলে বলল, কে বার্নিশ করছে?

নলিনী।

ওকে বলবি তারপিন যেন সামান্য বেশি দেয়।

বেশি দিলে কিন্তু স্যার গ্লেজ উঠবে না।

দিয়ে দেখ কি হয়।

আসলে অতীশের চোখে একটি কালো ট্র্যাঙ্ক এবং কালকা মেল অন্ধকারে লাইনের উপর গড়িয়ে চলে যাচ্ছে। এ-ছাড়া চোখে সে কিছু দেখতে পাচ্ছে না।

কালো ট্র্যাঙ্ক রেলগাড়ি, পুলিশ মর্গ—ভাবতে ভাবতে অতীশের চোখ ঘোলা হয়ে যাচ্ছে। কি যে করবে ভেবে পাচ্ছে না। আর ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। কখন আবার বেজে উঠবে। সে জানে, অমলা ছটফট করছে। রাগে গা রি রি করছে তার। অপদার্থ ভাবছে তাকে। এত সুযোগ সুবিধা, সে কিছুই আমল দিচ্ছে না। সব ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, কত সহজ পয়সা কামানো! টিন পারচেজে কমিশন, মালে কমিশন, যে যা দেয়। সবাই তাকে খুশি করতে পারলে ধন্য হয়ে যায়। তার গোঁ—একবার হাত নোংরা করেছে—সে দু-হাতের পাতা সামনে বিছিয়ে পৃথিবীর মানচিত্র দেখার চেষ্টা করছে। তারপরই মনে হল, সময় কম, সে ভাউচারে সই করছে। বিল চালান সই করছে। সে আর যেন কোরো সঙ্গে কথা বলতে চায় না।

আবার ফোন।

ভৌমিক বলছি।

ব্যানার্জী। কাল ইন্সপেকসান।

আসবেন।

জানিয়ে দেওয়া। কে করছে এ-সব! র-মেটেরিয়েলস বলতে কোটার টিন, ইমপোরটেড টিন, কালি, বার্নিশ—সব কিছু বন্ধক দেওয়া। ব্যাংক ঋণের টাকায় কাজ চলছে যেন এক অনন্ত হুতাশন, সব গিলছে।

সে ডাকল, সুধীর।

আজ্ঞে যাই।

কুম্ভবাবুকে ডাক।

কুম্ভবাবু এলে বলল, কাল ইন্সপেকসানে আসবে। সব ঠিক রাখবেন।

কোত্থেকে রাখব। পাঁচ টন মাল পাব কোথায়, যা পড়ে আছে দেড় দু-টন হতে পারে।

তাই দেখাবেন।

কি বলছেন! তাই দেখাব।

না থাকলে কি করবেন!

কুম্ভর মাঝে মাঝে চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে হয়। জল কতটা গড়াতে পারে—সে জানে, ইচ্ছে করলে ম্যানেজ দেওয়া যায়। দেয়ও। কিন্তু বিপাকে ফেলতে গেলে ম্যানেজ দিয়ে কি লাভ। সে ত আর ম্যানেজার সেক্রেটারি নয়। সে অধস্তন। কিন্তু মুশকিল, ঐ এক কথা। তুই ত ছিলি। তোকে ত বলেছে—তুই ত জানিস। তুই ম্যানেজ দিতে পারলি না!

সে পারবে না কেন। টিন ত গো-ডাউনে থাকে। সব ত ওজন হয় না। কিছু হয়, বাকিটা চোখের আন্দাজে দেখে ব্যাংক ইন্সপেক্টার চলে যায়। কিছু দিতে হয়। বাস। ও কে! কিন্তু সেই দেওয়াটাও স্ক্র্যাপের টাকা থেকে। যখন দেখছিস পছন্দ করে না ঘুষ-ঘাস, তখন যে দেবতা যাতে তুষ্ট। অতীশ না জানলেই হল। স্ক্র্যাপে কত হয়, যে সারা মাস এ-সব ফাঁকফোকর বোজাবে!

কুম্ভ কি ভেবে বলল, সে হবে। শুনুন, আপনার মাধা অনাসৃষ্টি শুরু করেছে।

আমার মাধা!

মাধব। বেটা হাসপাতাল থেকে আসতে চাইছে না। বেড ছেড়ে দিতে বলছে। ছাড়ছে না। ই এস আই থেকে জানিয়েছে। লোক পাঠিয়ে নিয়ে আসতে বলেছে।

আসতে চাইছে না কেন?

কি জানি! আসলে বোঝলেন সুখ। বেটার টিবি ভাল হয়ে গেছে। সাবধানে থাকতে বলেছে। রোজ আয়নায় মুখ দেখে। একটা ঘর আলাদা পেয়ে বেটা রাজত্ব পেয়ে গেছে ভেবেছে। সকালে ডিম, পাউরুটি এক গ্লাস দুধ। দুপুরে মাংস ভাত, বিকালে এক গ্লাস দুধ, রাতে রুটি মাংস! নার্স সকালে আসে, সন্ধ্যায় আসে। হাসপাতালের পোশাক—ওটা ত হাসপাতাল নয়, কিছুটা আশ্রমের মত ছ-মাস থেকে ভেবেছে, এই তার ঘর-বাড়ি। আসতে চাইবে কেন বলুন। বান্ধব ভাণ্ডারের বাড়ি- ঘরও খুব ভাল। রোদ হাওয়া, সামনে ফুলের বাগান। ঝকঝকে তকতকে। প্রাইভেট বলে এতটা আছে। সরকারের হাতে গেলেই হয়ে যেত। এখন সামলান। মনোরঞ্জন গেছিল আনতে—–নিচে ওর পোঁটলা নিয়ে এলে দেখে সে দোতলায় উঠে গিয়ে বসে আছে, ওকে আনতে গেলে দেখে পোঁটলা চলে গেছে উপরে। এই চলছে। এখন কি করবেন বলুন।

একশ তেইশ টাকা মাইনের হেলপার মাধব রোগাক্রান্ত হয়ে গেল। রাস্তায় ফুটপাথে থাকে, জুয়াসাট্টা খেলে, নেশাভাঙ করে। কোনোদিন খেত, কোনোদিন খাওয়া জুটত না। অফিসের রোয়াকে শুয়ে থাকত।

তার পক্ষে এই সুখ ছেড়ে আসা সত্যি কঠিন। এমন নির্বান্ধব শহরে, মাধব কেন অতীশ নিজেও যেন এমন সুখ ছেড়ে এসে কোনো অনিশ্চয়তার মধ্যে যেতে চাইত না।

সে বলল, আপনি যান। না হয় সুপারভাইজারকে পাঠিয়ে দিন।

কুম্ভ কেমন ক্ষেপে গেল—কি বলছেন! আমাদের কি দায়। আসে আসবে, না আসে আসবে না। দারোয়ান দিয়ে বের করে দিলে টের পাবে। শুধু দিচ্ছে না, সনৎবাবু ওখানকার অ্যাডমিনিস্ট্রেশানের কিছুটা দেখে থাকেন। সনংবাবু বললেন, মাধব ঝামেলা করছে। ঘর ছাড়তে চাইছে না।

অতীশ নিজেও জানে সব। সে যখন খবরটা পেয়েছিল, তার বেশ মজাই লেগেছে। তার কারখানার মাধব সেই প্রাইভেট হাসপাতালটিতে খবর হয়ে গেছে। অনেকে এসে দেখেও গেছে। হাসপাতালের কর্তাব্যক্তিরাও। সে নাকি কাউকে গ্রাহ্য করছে না। করতে নাই পারে। কেউ জায়গা না দিলে কি করবে! রোগটা ধরা পড়তেই বস্তি থেকে তাকে উৎখাত করে দিল বাড়িয়ালা। সে এসে আশ্রয় চাইল—ই এস আই-এর বেডের চেষ্টা চলছে, বেউ পাওয়া যে কত কঠিন মাধার বেলায় অতীশ টের পেয়েছে। সে তার কারখানার একটা খালি ঘর ছেড়ে দিতে চেয়েছিল, বাড়িয়ালা বের করে দিয়েছে, যাবেটা কোথায়! লোহা-লক্কড়, ভাঙা মেশিন বাতিল টিন পড়ে থাকে ঘরটায়। ওটা খালি করে দিলেই হয়ে যায়। কিন্তু সনৎবাবু, কুম্ভবাবুর এক কথা, ব্যাড প্রিসিডেন্ট হয়ে থাকবে। আপনি ইচ্ছে করলেই দিতে পারেন না। বোর্ড-মিটিংয়ে রেজিলিউশন নিতে হবে। পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি বলে কথা। আপনি দেবার কে? মাধা অগত্যা তেলকলের ভাঙা পরিত্যক্ত মন্দিরের পাশে গাছতলায় উঠে গেল।

কৌটা ঝাঁকিয়ে ভিক্ষা করতে থাকল। চাঁদা করে তার ওষুধ পথ্য চলে, চাঁদা কে কত দেয়—সে সেখানেও বেশ জমিয়ে ফেলেছিল। রাস্তার এক পাগলি ঢুকে গেল তার ঝুপড়িতে। খালপাড় হয়ে গেলে, অজস্র ওয়াগনের ঝনঝন শব্দ আসে। তার ডেরায় বেশ মায়ফেল শুরু হতেই অতীশ জোরজার করে তুলে এনে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছে, এখন মাধব হাসপাতাল ছাড়তে চাইছে না।

আবার ফোন।

হ্যালো।

ফোন নামিয়ে রাখলি কেন?

মাথা আবার গরম হয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা তুমি কি বলতে চাও বল ত!

তুই কি ভেবেছিস?

কি ভাবব!

তোর এত সাহস!

আরে তুমি বলবে ত! কিছু বলছ না!

আমি কি বলি না বলি, তোকে ধরে থাকতে বলেছি। তুই কোন সাহসে কেটে দিলি!

সে চুপ করে থাকল—কালো ট্রাঙ্ক, রেলের কামরা, নগ্ন রমণী—উপভোগ্য এই সব শব্দমালা আবার ধেয়ে আসছে। সে এবার আর ফোন ছাড়ল না।

বল।

যদি ভাল চাস ত করবি।

কি করব।

সই করে দিবি।

আচ্ছা অমলা, তুমি বল, কারখানায় টাকা ঢেলে আবার কেউ তুলে নেয়! কি হবে এত টাকা দিয়ে। তোমার কে আছে! বিপুল সম্পত্তি—এত দিয়ে কি হবে! সামান্য কটা টাকা! এতে কতগুলি মানুষের প্রাণ বাঁচবে বুঝতে পারছ না। নতুন বিল্ডিং, কেনেস্তারা মেশিন কিনে একবার না হয় দেখাই, যেত—কিন্তু সব টাকাই যদি হাতছাড়া হয়ে যায় চলবে কি করে! কে বলেছিল, শেয়ার ফ্লোট করতে। যখন করাই হল, বেনামে আবার তা নিয়ে নিচ্ছ কেন! আমার মাথায় কিছু আসছে না।

শোন সোনা আমার। লক্ষ্মী ছেলে—তোর বুদ্ধিসুদ্ধি কবে হবে বল ত! যখন টাকাটা ফেরৎ চাইছে, দিয়ে দে না।

আমার টাকা?

সেই ত। তোর নয় বলেই ত, মাথাব্যথার কোনো কারণ থাকতে পারে না।

পাবলিক লিমিটেডের টাকা—আমি জেনেশুনে দিই কি করে। মেশিন ত আমরা ডাইরেক্ট পারচেজ করছি। রায় অ্যাণ্ড রায় আসে কোত্থেকে। আমি আগে জানলাম না কেন? তোমরা যা খুশি আমাকে দিয়ে করিয়ে নিতে চাও?

পাগলামি করিস না। তোর ভালর জন্য বলছি। কি করবি বল, রাজেন নিজেও কেন যে জেদ ধরেছে বুঝি না! আমিও জানি কি হবে এত টাকা দিয়ে, কে খাবে। আমার আর কে আছে। তুই কিছুতেই রাজি হচ্ছিস না!—

অমলা, ফোনে কি সব বলছ তুমি। তোমার মাথা খারাপ আছে।

মাথা খারাপ আমাদের সবার। দোষ শুধু তোর না। কুন্তটা বুদ্ধি দিয়েছে। যত নষ্ট বুদ্ধি! সে কুমারবাহাদুরের প্রিয়পাত্র হতে চাইছে। সে লেজুড় হয়ে থাকতে চায়। তুই সই করে দিবি। বোর্ড- মিটিং-এর পর গোপালবাবু, তারকবাবু চলে গেলে চেকটা কুমারবাহাদুরের হাতে দিয়ে দিস।

মাথার মধ্যে তপ্ত কড়াইয়ে খৈ ফুটছে। কারখানা দিন দিন বসে যাচ্ছে। সে যে কি করবে! নির্মলা আসে নি। সে স্থির থাকতে পারছে না। কি হয়েছে কে জানে! সে বিচলিত বোধ করছে। গোলকধাঁধা থেকে তার বুঝি রেহাই নেই। তবু মানুষের যে কি থাকে। সে বলল, ঠিক আছে। ছাড়ছি।

না, শোন তোকে একটা কথা বলছি। এত কথা ফোনে হয় না, তবু আমার সময় নেই, তোকে ডেকে বললেও জানাজানি হবে—আবার বউরাণী অতীশবাবুকে ডেকে পাঠিয়েছেন। আমি কেন যে সেই স্মৃতি ভুলতে পারছি না, তোর মনে আছে, আমাদের সামনের দীঘির ঘাটলায় তোর পাগল জ্যাঠামশাই বসেছিলেন—বর্ষার জল সাঁতরে চলে এসেছিলেন, গায়ে শাপলা-শালুকের লতা জড়িয়েছিল, মনে আছে। আঁজলা করে তুই ঘাট থেকে জল তুলে নিচ্ছিস—আমি প্রাসাদের জানালায় দাড়িয়ে দেখছি, সেই দেখাই কাল হল। তুই কাছে এলেই কেমন এক বর্ষাকাল আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। সেই অবোধ মুখের কথা ভেবে, তোর সব বেয়াদবি সহ্য করছি। মনে আছে ল্যাণ্ডোতে তুই আমি কমলা জসীম নদীর চরে নেমে গেছিলাম। স্টিমারের আলো এসে পাড়ের জঙ্গলে পড়েছে। এক অশ্চর্য মায়াবী জ্যোৎস্না মনে হয়েছিল, পাখিরা ওড়াউড়ি করছে। আমি তুই কাশফুলে ঢেকে যাচ্ছিলাম। আমায় সেই দৃশ্য এখনও তাড়া করে।

সেই ফ্রক পরা বালিকার কথা মনে পড়ছে অতীশের—এবং এক প্রায়শ পিচ্ছিল অন্ধকার শ্যাওলা ধরা স্যাতস্যাতে জায়গা, সে ভিতরে কেমন অস্থির হয়ে উঠল—গত রাতে সে কি সব করেছে, কেউ জানে না—সে, কত খারাপ, সে ত ইচ্ছে করলেই অন্দরের দরজা দিয়ে সিঁড়ির নিচে গিয়ে দাঁড়াতে পারে। মৃদু পায়ের শব্দে টের পায়, কেউ ধীরে ধীরে স্লিপিং গাউন পরে নেমে আসছে। নারীর সেই পাতলা সিল্কের ভিতর প্রজ্বলিত অগ্নিকুণ্ডে হাত দিয়ে তাপ নিতেই পারে—তবু কেন যে আছে অজস্র পোকার দংশন, কেমন এক আধিভৌতিক চেতনা তাকে গ্রাস করছে, আবার সাদা বোট, নীল জলরাশি এগিয়ে আসছে। সে সহজে মনে করতে চায় না। ভুলে থাকতে চায়—আর কেন জানি মনে হয়—–একটা সরলরেখা কিছুদূর গিয়ে হারিয়ে গেছে। নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। সে কিছুতেই সেই দূরবর্তী সরলরেখা কিভাবে অদৃশ্য হয়ে গেল মনে করতে পারছে না। আশ্চর্য এক বিস্মৃতি —তারপর কি হয়েছিল! সে কতটা ঘোরের মধ্যে পড়ে গিয়ে ভেবেছিল, সে একা! সমুদ্রে আর্চির অশুভ প্রভাব বনি এবং এলবাকে কতটা গ্রাস করেছিল। সংশয়ে ভুগতে ভুগতে সে কেন মনে করেছিল বনি আর্চির অনুসরণকারী। বনি এলবা দু’জনেই তাকে সমুদ্রে ডুবিয়ে মারতে চায়। তারপর তারপর কত করে চেষ্টা করেছে মনে করার, তার সংশয় শেষ পর্যন্ত বোটে কতটা তাড়া করেছিল। কেবল তখন দেখতে পায় বালুকারাশির মধ্যে সে বসে আছে। কাঠের একটা ক্রস পোঁতা। কে পুঁতল এই ক্রস। আসলে কি বার বার সেই বিস্মৃতিকে সে আবিষ্কার করতে গিয়ে মাথা ঠিক রাখতে পারছে না। এমন স্মৃতিভ্রম ত হবার কথা না। সে নিজেও ক্রসটার নিচে হেলান দিয়ে বসেছিল। কে পুঁতেছে ক্রসটা সে জানে না। সে কেন বসেছিল জানে না। বোট বালিয়াড়িতে টেনে কে তুলেছে? এলবা কোথায়? বনি কোথায়!

বনি, বনি বলে চিৎকার করে উঠতে গিয়ে মনে হল—সে সিটমেটালের ম্যানেজার। সে বসে পড়ল। ভিতরে দামামা বাজিয়ে স্মৃতিরা চলে যাচ্ছে—কিন্তু সেই স্মৃতির সরলরেখা যেতে যেতে ছিন্ন হয়ে গেল। কিছুটা গিয়েই সোজা সরলরেখা কাঁপছে, ভেঙে যাচ্ছে, তারপর কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে। সে বার বার একই দৃশ্য দেখে আসছে। জাহাজ থেকে ফেরার পর যতবার সে চেষ্টা করেছে, সেই অমোঘ গোপন স্মৃতি কখনও উদ্ভাসিত হচ্ছে না। নির্বাপিত আকাশ, এবং সেই কোনো নভোমণ্ডলে এক অলীক ইতিহাস যেন জন্ম নিতে থাকে। সত্য না কোনো ঘোরে পড়ে সে দেখতে পায়—স্মৃতির সরল রেখাটা সমুদ্রে দিনের পর দিন এগিয়ে গিয়ে সহসা কাঁপতে শুরু করে। কেন? কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে যায় কেন। ছোটবাবু তুমি কোথায় ছিলে! বোট কোনো অজ্ঞাত ভূখণ্ডে-হাজির! কে নিয়ে এল! কে সে? কিভাবে ডাঙা পেলে!

ক্রসটার নিচে বসে ছিলে কেন?

সে বলল, ছোটবাবু, ক্রসটার নিচে বসেছিলে কেন! তুমি কি দেখছ! তোমার ঘোর কি এখনও কাটে নি! তুমি দাঁড়ালে! কোনোরকমে টলতে টলতে হাঁটছ। কি ঠিক বলছি ত! কী দেখলে!

বোটে এলবা পাখা ছড়িয়ে মরে পড়ে আছে!

তুমি চিৎকার করে উঠেছিলে, এলবা!

তারপর পাখিটাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলে।

বনি কোথায়?

তুমি বোট থেকে মরা পাখিটা বুকে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলে। কেমন বেহুঁশ। কি খুঁজছ! কাকে খুঁজছিলে। বোটের খোলা নোঙর দূরে পড়ে আছে। গোটা বোটে লণ্ডভণ্ড অবস্থা। অথচ কিছু খোয়া যায় নি দেখলে। কোথাও রক্তের দাগ। কার? তুমি উন্মত্তের মত চিৎকার করে ডাকছ —বনি, বনি।

কেউ সাড়া দিচ্ছে না।

সমুদ্রের তরঙ্গ তীরে এসে আছড়ে পড়ছে।

আর জোর বাতাস বইছিল। তোমার চুল উড়ছে। তোমার প্যান্ট ছিন্নভিন্ন। গায়ে জামা নেই। সমুদ্রের উত্তাপে তোমার রং পুড়ে গেছে। তুমি পাগলের মত আচরণ করছিলে!

অতীশকে ধীরে ধীরে সেই বিশাল সমুদ্র, সাদা বোট, মৃত অ্যালবাট্রস, খাড়া পাহাড় এবং নানাবিধ উপকরণে সজ্জিত এক জীবন গ্রাস করতে থাকল। এইসব উপকরণে আছে, জীবনের কোনো গূঢ় অর্থ। সেটা কি?

সেটা কে?

সেই কি নিয়তি কিংবা অবধারিত খাড়া পাহাড়ের নিচে বেলাভূমি। ক্রসটা দাঁড়িয়ে আছে দ্বীপে। কিছু জলপায়রা উড়ছে। গাছপালা পাহাড়ের মাথায়। নির্জন। সকালের রোদ পাহাড়ের আড়ালে।

ছোটবাবু হেঁটে যাচ্ছিল। বালিতে পায়ের ছাপ পড়ছে। ক্ষুধা তৃষ্ণা নেই, একটা গাছের গুঁড়ির মত যেন বসে ছিল সেই কখন থেকে।

এখানে কেন বসে?

এই ক্রসটা কে পুঁতল।

তার হুঁশ ফিরে আসছে। কিন্তু কিছুই মনে করতে পারছে না। বাড়ি-ঘর, সমুদ্রযাত্রা, সাদা বোট, কাঠের ক্রস, এলবা বনি—না কিছু মনে করতে পারছে না। ফাঁকা মাথা। কেমন ঘোর থেকে উঠে দাঁড়াতেই দেখল, দূরে কাত হয়ে পড়ে আছে একটা সাদা বোট। বোট কেন? কে এসেছে। সে কে? কোনো মানুষ গভীর ঘুমের পর জেগে গেলে যেমন কিছুক্ষণ স্থবির হয়ে থাকে, ছোটবাবু, তুমি তেমনি এক ফাঁকা মাঠের নির্জন প্রহরী।

তার হাই উঠছিল। বোট, কাঠের ক্রস। সে মাঝখানে দাঁড়িয়ে বোট এবং কাঠের ক্রস—কিংবা বালিতে পায়ের ছাপ, বালিতে কিছু টেনে আনার দাগ, বালিতে এত পায়ের ছাপ যে এলোমেলো সব ছাপের মধ্যে মনে হচ্ছে, এক মুহূর্ত আগে অনেক মানুষের জটলা ছিল—এখন, তারা নেই, কোনো অশুভ প্রভাবে সবাই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। তারা কারা? অথবা দিশেহারা হয়ে কেউ ছোটাছুটি করলেও এ-ভাবে বালিয়াড়িতে অজস্র পায়ের ছাপ পড়তে পারে। হঠাৎ সে চিৎকার করে উঠেছিল, আমি কে? এবং তখনই প্রথম কে যেন চিৎকার করে বলেছিল, ইউ আর এ সিনার। তুমি আর্চিকে খুন করেছ।

খাড়া পাহাড়ের মাথায় কেউ দাঁড়িয়ে। ছায়ার মত।

আরে সেই লোকটা!

কি নাম যেন।

ডোরাকাটা বাঘের মুখ—হুবহু এক মুখ, আরে আর্চি—সে চিৎকার করে উঠেছিল, হেই! তুমি এখানে এসে উঠেছ।

আর তখনই অদৃশ্য, না রোদের ছায়া খেলা করে গেল পাহাড়ের মাথায় কে জানে—কেমন মিলিয়ে যেতে যেতে প্রতিধ্বনি পাহাড়ে—আই ডিক্লেয়ার ইউ আর এ সিনার! আই ডিক্লেয়ার….

ছোটবাবু বলল হু আর ইউ! দেয়ার বিফোর সি লাইজ দ্য মাইটি ওসান, টিমিং উইদ লাইফ অফ এভরি কাইণ্ড, বোথ গ্রেট অ্যাণ্ড স্মল। তুমি কে? আর্চি কে? আর্চিকে আমি খুন করব কেন? আমি কিছু বুঝতে পারছি না।

ছোটবাবু সব গুলিয়ে ফেলছে। সহসা মগজের কোষে আর্চির মুখ ভেসে উঠে মিলিয়ে যেতেই ভুলে গেছে, কে আর্চি সে টের পাচ্ছে না, কেন সে দেখল, পাহাড়ের মাথায় কেউ দাঁড়িয়ে। লোকটাকে যেন সে চেনে, সেই মুখ কিন্তু আবার অদৃশ্য। সে বসে পড়ল হাঁটু গেড়ে। বালিতে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল।

তখনই যেন কোনো সকালবেলার স্তোত্র পাঠের মত কে বলে যাচ্ছে—প্রেইজ গড ফর এভার। হাউ হি মাস্ট রিজয়েস ইন অল হিজ ওয়ার্ক! দ্য আর্থ ট্রেমবল্স এট হিজ গ্ল্যান্স, দি মাউন্টেন্স বারস্ট্ ইনটু ফ্লেম এট হিজ টাচ।

ছোটবাবু কোনোরকমে বলল, থ্যাঙ্ক ইউ। তারপরই মনে হল কেমন অন্ধকার হয়ে আসছে সব—সে কিছু দেখতে পাচ্ছে না। সে কি তার সংজ্ঞা ফের হারাচ্ছে? ওরা কারা? হু আর দিজ, হু সিট ইন ডার্কনেস, ইন দ্যা স্যাডো অফ ডেথ, কার্সড্ বাই মিজারি অ্যাণ্ড স্লেভারি?

আবার সেই স্তোত্রপাঠ—এবং সমুদ্র সংগীতের মত ভেসে আসছে। কেউ বলছে, দে রেবেলড এগেইনস্ট দ্য লর্ড, স্করনিং হিম হু ইজ দ্য গড এবাভ অল গডস।

বড় পরিচিত কণ্ঠস্বর। অথচ কিছু মনে করতে পারছে না। অতীত, না বর্তমান। কেবল সেই সুমধুর পরিচিত কণ্ঠ, ইউ আর ওয়াণ্ডারিং হোমলেস ইন দ্যা ডেজার্ট—হাংরি অ্যাণ্ড থার্স্ট অ্যাণ্ড ফেইণ্ট। লর্ড হেলপ ইউ।

আর সঙ্গে সঙ্গে ছোটবাবুর চিৎকার, বনি!

সেই অসহায় আর্তনাদ পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হতে থাকল। সে টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল। বোট। ক্রস, বনি, এলবাট্রস। জাহাজ বোটে ভেসে পড়া সব মনে পড়ছে। সে দু-হাত তুলে সেই নির্জন দ্বীপে চিৎকার করে উঠল—আমি বেঁচে গেছি! ডাঙা! বনি আমরা ডাঙায় উঠে এসেছি। সে পাগলের মত দু-হাত জড়ো করে আকাশের দিকে উত্থিত করে দিল, বেঁচে আছি। ডাঙা ডাঙা। বনি তুমি কোথায়। বনি, বনি—সে বোটের দিকে টলতে টলতে ছুটছে—অ্যালব্রাট্রস ডানা মেলে পড়ে আছে।

সে হাঁটু গেড়ে বসল। খুব আলতো করে দেখল সত্যি মরে গেছে, না বেঁচে আছে। বুকে কান পেতে পাখিটার উষ্ণতা দেখল। সে বুঝতে পারছে না। ঘোরে পড়ে গেছিল কেমন! সেই প্রথম ঘোর। কিছু মনে করতে পারছে না। সরলরেখাটা সোজা যেতে যেতে কাঁপছে। তারপর কুয়াশাচ্ছন্ন। এই মাত্র সে ক্রসটার নিচ থেকে উঠতে গিয়ে বালিতে মুখ থুবড়ে পড়ে গেছিল। এইমাত্র সে তাকে বলে গেল লর্ড হেলপ ইউ। বনি। বনি ছাড়া তাকে এ-ভাবে কেউ কোনোদিন কথা বলে না। সে চারপাশে তাকাল। পাখিটা মরে পড়ে আছে। কতদিনের সঙ্গী। সেই কবে যেন সে তাদের জাহাজের পেছনে উড়তে উড়তে ভাসমান বোটে তাদের সঙ্গী হয়ে গেল। কতকাল, কত দীর্ঘকালের সঙ্গী, নীল চোখ, গভীর মমতা পাখির দু-চোখে সে টের পাচ্ছে, ছোটবাবু তুমি ভাল থেকো। তোমাকে ডাঙায় পৌঁছে দিলাম। প্রাণের বিনিময়ে—এই প্রাণ, এমন সরল, অপ্রাণের লীলায় সহসা সে বুকে পাখিটাকে সাপটে ধরল। তারপর কান্নায় ভেঙে পড়ল—বনি, বনি দেখ, কোথায় বনি, পাহাড়ের ওদিকটায় কিংবা তারা কি কোনো ঝড়ের মধ্যে পড়ে গেছিল—বনি কি সমুদ্রের জলে ভেসে গেছে। যেন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখেছে, বালিয়াড়িতে একটা কাঠের ক্রসের নিচে সে বসে আছে। আর কিছু মনে করতে পারছে না।

বোট ঝড়ে পড়লে সে কেন মনে করতে পারবে না! সে দেখল বনির জুতোজোড়া বালিয়াড়িতে পড়ে আছে। দেখেই সে উল্লসিত, বনি আছে, কোথাও গেছে। বনি তাকে ফেলে কোথাও যেতে পারে না। আবার কেমন পাগলের মত আচরণ করছে। কাঁদছে। পাখিটা বুকে জড়িয়ে কাঁদছে। বোট থেকে নেমে হেঁটে যাচ্ছে।

সে উপরের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। পাখিটাকে বালিয়াড়িতে রেখে সে হেঁটে যাচ্ছে। ক্রসটার নিচে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। পাহাড়ের মাথায় রোদ। আর ঝাঁক ঝাঁক জলপায়রা। কোথাও কোনো মানুষের চিহ্ন নেই। সে কখন এই ডাঙায় এল, কখন! দেখে ত মনে হয়, যেন এই বালিয়াড়িতে রাতের বেলা দক্ষযজ্ঞ হয়েছে। সে কোথায় ছিল! সে ক্রসটার নিচে মাথা গুঁজে বসেছিল কেন। আবার উন্মাদের আচরণ। সে সামনের দিকে ছুটে যাচ্ছে। পাহাড় না থাকলে বোধহয় সে কেবল ছুটতই। যতক্ষণ হুঁশ থাকত, ছুটে যেত। যেন তার প্রিয় নারীকে কেউ হরণ করে নিয়ে গেছে। তারপরই অসাড় লাগে শরীর। সে ক্রসটার নিচে গিয়ে বসে থাকে। কার সঙ্গে কথা বলতে চায়, সাড়া পায় না। সে কে? আবার উন্মাদের মত ছুটতে থাকে—বোটের পাটাতন তুলে খোঁজে—কি খোঁজে সে জানে না। বনির পোশাক, তার অন্তর্বাস, স্কার্ট জ্যাকেট সব কি সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে। সে কেমন পাগলের মত সব হাটকাবার সময় কান্নায় ভেঙে পড়ল।

কেন কাঁদছে জানে না।

একদিন সকালে সে পাহাড়ের রাস্তা ধরে উঠে গেল। দেখল সুমিষ্ট জলের হ্রদ। সে তার পকেট থেকে ছুরি বের করে ঘাসের নরম মূল তুলে খাবার সময় খোঁজে বনিকে —বনির পায়ের শব্দ শুনতে পায়। যেন বনি এই সমুদ্রবেলায় তার সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে। নে ছুটতে থাকে—বনি ডোণ্ট টার্ন এওয়ে ফ্রম মি ইন দিস টাইম অফ ডিস্ট্রেস। বেণ্ড ডাউন ইউর ইয়ার অ্যাণ্ড গিভ মি স্পিডি এনসার।

সে পাহাড়ের মাথায় উঠে যায়। কোথায় যে গেল! আবার মনে হয়, বিদ্যুৎ ঝলকের মত মগজের কোষে জোনাকি পোকা জ্বলে ওঠে—যেন এই নির্জন দ্বীপের কোথাও বনিকে সে সংগোপনে লুকিয়ে রেখেছে। সেটা কোথায় দেখতে পায় নিচে, অনেক নিচে ক্রসের মাথায় বসে আছে কোনো রঙিন জলপায়রা। তারা এই পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে বাসা বানিয়ে রেখেছে। সে ডিম সংগ্রহ করে আনে। খায়। কখনও সমুদ্র থেকে কচ্ছপেরা উঠে এসে ডিম পেড়ে যায়। সে সংগ্রহ করে রাখে। সব খায় না। বনি খাবে বলে, বোটের পাটাতনের নিচে রেখে দেয়।

কখনও চুপচাপ শুয়ে থাকে পাথরের বুকে। নিচে হেঁটে গেলেই কিছু নারকেল গাছ, খুবই ছোট্ট দ্বীপ, এমন তার গাছপালা সবুজ, যে কোনো নির্জন অরণ্য মনে হয়। সে কেবল খুঁজছে। সে কোথায় গোপন করে রেখেছে বনিকে। ক্রসটার নিচে বসে থাকলে টের পায় আলগা মাটি জোয়ারের জল এসে সমতল করে রেখে গেছে। অদূরে গেরাফি পড়ে আছে। গেরাফিটা দিয়ে কেউ মাটি খুঁড়েছিল। মাটি লেগে আছে গেরাফির সূচলো জায়গাগুলিতে। সে নুয়ে দেখে আর ভাবে। প্রখর উত্তাপের সময় কোনো গাছের নিচে শুয়ে থাকে। সে ঘুমিয়ে পড়লেই মনে হয় তার শিয়রে এসে কেউ বসে থাকে। সে ধড়ফড় করে উঠে বসে—আবার ছুটতে থাকে, যেন সে কাউকে দেখে ফেলেছে—আর কিছুদূর হেঁটে গেলেই পেয়ে যাবে—না পেলে তার ভয়ঙ্কর আর্তনাদে পাহাড় চিরে শুধু প্রতিধ্বনি—ফর মাই ডেইজ ডিজএপিয়ার লাইক স্মোক। মাই হেলথ ইজ ব্রোকেন অ্যাণ্ড মাই হার্ট ইজ সিক, গিভ মি স্পিডি এনসার। তুমি কোথায়?

না কেউ সাড়া দেয় না। সে গেরাফিটা কাঁধে নিয়ে হাঁটতে থাকে। সে মাটি খুঁড়ে পাখিটার সমাধি দিয়েছে। ছোট্ট একটা বুনো ফুলের গাছ সেখানে লাগিয়ে দেখছে বাঁচে কিনা। গাছটা লেগে গেছে। কিন্তু সে এত একা নিঃসঙ্গ, সবাই তাকে দ্বীপে তুলে দিয়ে নিখোঁজ। বোটে গিয়ে কোনোদিন পাটাতনে চুপচাপ বসে থাকে—অপলক তাকিয়ে থাকে সমুদ্রের দিকে। সে কিছুই দেখতে পায় না। সেই অন্তহীন সমুদ্রের নীল জলরাশি ছাড়া তার চোখে আর কিছু দৃশ্যমান নয়। সে কেন যে তখন হাউহাউ করে কাঁদে। কেন। এবং মনে হয় মরীচিকা প্রায় কোনো সুবেশা রমণী সবুজ অরণ্যের ভিতর দিয়ে হেঁটে যায়—সে ডাকে—বনি মাই হার্ট ইজ সিক—ইট ইজ ট্র্যামপ্লেড লাইক গ্রাস অ্যাণ্ড ইজ উইদারড।

জলে দাঁড়িয়ে থাকে ক্রস। সে ঘোড়ে পড়ে ক্ষুধায় তৃষ্ণায় বাঁচার জন্য পাখিটার রক্ত শুষে খেয়েছে—সাক হার ব্লাড কে যেন বলেছিল! নিরুপায় ছোটবাবু কি বঁচার জন্য বনির রক্ত শুষে খেয়েছে! সে কিছুই মনে করতে পারছে না।

জোয়ারের সময় ক্রসের নিচে জল উঠে আসে। ভাটার সময় জল নেমে যায়। বালি সরিয়ে নিয়ে যায় জোয়ারের জল। সে রাতে শুয়ে থাকে ঠিক ক্রসটা থেকে অদূরে। রাতে নক্ষত্র দেখতে দেখতে তার মনে হয় সে বোটে ভেসে যাচ্ছে, আসলে সে সমুদ্রেই ভেসে বেড়াচ্ছে—মরীচিকা হতে পারে- এমন মরীচিকা সে কতবার দেখেছে, যেন তারা এসে গেছে কোনো দ্বীপে। কিংবা কোনো বন্দরে। বন্দরের কোলাহল পর্যন্ত কানে আসত। কে জানে মরীচিকা না সত্যি সে ডাঙা পেয়ে গেছে। গায়ে চিমটি কেটে সে দেখতে চায়, আদৌ সে প্রকৃতিস্থ আছে কিনা—যখন মনে হয় প্রকৃতিস্থ, সে ছুটতে থাকে –চিৎকার, আর্তনাদ, বনি—বনি, মাই ফুড ইজ টেস্টলেস অ্যাণ্ড আই হ্যাভ লস্ট মাই এপিটাইট। বেণ্ড ডাউন ইয়োর ইয়ার অ্যাণ্ড গিভ মি স্পিডি এনসার। আই অ্যাম রিডিউসড টু স্কিন অ্যাণ্ড বোনস বিকজ অফ অল মাই গ্রোনিং অ্যাণ্ড ডেসপেয়ার।

আবার সে কখনও পাহাড়ের নিচে দাঁড়িয়ে হাঁকত—আই অ্যাম লাইক এ ভালচার ইন এ ফার- অফ-ওয়াইলডারনেস অর লাইক অ্যান আউল অ্যালোন ইন দ্য ডেজার্ট। আই লাই আওয়েক, লোনলি অ্যাজ এ সলিটারি স্প্যারো অন দ্য রুফ। গিভ মি স্পিডি অ্যানসার।

না কেউ সাড়া দিচ্ছে না। কেউ না। কেবল দুরন্ত মেঘেরা ধেয়ে আসছে আকাশ কালো করে। সারা পৃথিবী যেন গভীর অন্ধকারে ডুবে যাবে এবার। সে ডাকত, বনি তুমি কোথায়! কোনো পাথরের বুকে কান পেতে রাখত—যেন সে কখনও হয়ে যায় জাদুকর কিংবা ফকির কিংবা ঈশ্বরের মত ক্ষমতার অধিকারী, সে তার প্রিয় নারীকে পাথরের ভিতর বন্দি করে রেখেছে। কেউ তাকে খুঁজে পাবে না। শয়তান আর্চির হাত থেকে এ-ছাড়া তাকে রক্ষা করার কোনো উপায় নেই। নিরুপায় আর্চি এবারে মাথা কুটে মরুক।

ছোটবাবু ভাবল, এ-সব কি ভাবছে! সে কেন রাখতে যাবে তাকে গুপ্তধনের শামিল করে। সহসা মগজে জোনাকি জ্বলে উঠলে তার মনে হয় এটা—তারপর সব গুলিয়ে যায়। সারা দ্বীপে বনিকে খুঁজে বেড়ায়।

ঝড়ে বৃষ্টিতে খুঁজে বেড়ায়।

নিশীথে খুঁজে বেড়ায়।

জ্যোৎস্না রাতে হেঁটে যায়।

তারপর নির্জনে বসে কাঁদে, বনি আই অ্যাম লোনলি অ্যাজ এ সলিটারি স্প্যারো অন দ্য রুফ। আর্চি ডে আফটার ডে আমাকে মুখ ভ্যাংচাচ্ছে—অ্যাণ্ড কার্স অ্যাট মি। আই নো দ্যাট ইউ উইল কাম অ্যাণ্ড হ্যাভ মার্সি অন মি। অ্যাণ্ড নাউ ইজ দ্য টাইম টু পিটি মি—দ্য টাইম ইউ প্রমিজড হেলপ

সে আবার ক্রসটার নিচে গিয়ে শুয়ে থাকে। জোয়ারের জল নেমে গেছে। ঝুরঝুর করে বালি উড়ছে। সকালে সে, যখন গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে ঝুরঝুর করে বালি ঝরে পড়ে। কখনও বালিতে ঢেকে গেলে বোঝাই যায় না, কেউ নির্জন বেলাভূমিতে কাঠের একটা ক্রসের নিচে শুয়ে থাকে। ক্ষুধার্ত পাখিরা বালির নিচে পোকা খুঁজতে গিয়ে ঠুকরে দিলে সে জেগে যায়। বালির পাহাড় ভেঙে সে উঠে দাঁড়ায়। তারপর বের হয়ে পড়ে জল এবং খাবারের খোঁজে। অর্ধেকটা খায়, অর্ধেকটা রেখে দেয় বনির জন্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *