1 of 2

ঈশ্বরের বাগান – ৩

।। তিন।।

রাজবাড়িতে কে জাগে। ছেদিলাল জাগে। সবার আগে ছেদিলাল সদর দিয়ে ঢোকে। আর বলে, কোন জাগে? ছেদিলাল জাগে। তার সঙ্গে বিবি থাকে। লেড়কি থাকে। আর সে মরদ ছেদিলাল। কখনও কখনও সে বলে, হামি জমাদার ছেদিলাল আছে। হামি রাজবাড়ির নোকর আছে। বাবু দেখলেই সে সেলাম করে। সকাল সকাল, তখন আসমানটা আনধার থাকে, সে ঢুকে যায়। রাজবাড়ির কাজ বলে কথা। সে না গেলে রাজার ঘুম ভাঙবে না। প্রথমেই অন্দরে ঢুকে গলা হাঁকড়াবে। সাড়া না পেলে, হাঁকবে, ছেদিলাল হাজির। অন্দর মহলের দরজা খুলে গেলেই ঝটপট জল মারা, ঝাঁট দেওয়া। সে থাকে রাজার মহল্লায়, বিবি যায় রাণীমার মহলায়। অন্দরের কাজ সারতে বেলা বাড়ে। সূর্য উঠে আসে। ছেদিলালের এটা এক নম্বর কাজ। তার পল্টন এক নম্বর কাজ সেরে জড় হয় বড় একটি পাতাবাহার গাছের নীচে। বালতি ঝাঁটা রেখে গোল হয়ে বসে বাসি রুটি শুকনো, জল দিয়ে গুড় দিয়ে খায়। গোঁফে গুড় লেগে থাকে। কাঁচা-পাকা গোঁফে গুড় লেগে যায় বলে মাঝে মাঝে খুব ক্ষেপে যায়। তখন ছেদিলালকে কেউ কিছু বলে না। মর্জি হলে দু-নম্বর কাজে হাত দেবে, নয় গাছের নিচে শুয়ে ঘুম যাবে। বিবি বেটি বসে থাকে না, তারা কাজ করে চলে। প্রাইভেট অফিসারের বাড়ি, নধরবাবু বেণীবাবু রজনীবাবু, সব বাবুরা থাকে ওদিকে—সেটা দু-নম্বর কাজের পালা।

সব শেষে বাবুর্চিপাড়া, সেটা সে বিকেলের দিকে করে। দুপুরের দিকে মেস বাড়ির নালা-নর্দমা সব সাফ করে। সূর্য না উঠতে ছেদিলালের কাজ আরম্ভ হয়, সূর্য হেলে গেলে সে পল্টন নিয়ে চলে যায় খালাসিবাগানের বস্তিতে। রাজার দেওয়া জায়গা, বিনা পয়সায় থাকতে পায়। বড় রাজার আমল থেকেই তার এই সুবিধাটুকু। সে এ-জন্য বাবুর্চিপাড়ার লোকদের একদম গ্রাহ্য করে না। মর ব্যাটারা নালা নর্দমায় পচে। শালে শূয়রকে বাচ্চে। কোনদিন সে যায়, কোনদিন যায় না।

কিছু বললে বলবে, শালা হামি রাজার জমাদার আছে। খুশি মাফিক কাজ-কাম হবে।

সুরেন বাজারে যাবার সময় দেখল ছেদি খুব মনোযোগ দিয়ে রুটি খাচ্ছে। পাশে তার ডবকা লেড়কি পাছা ভারি করে বসে আছে। রুপোর বিছে কোমরে। বৌটা ঠ্যাং ছড়িয়ে হাঁটুর ওপর কলাইর থালা নিয়ে বসে। যাকে যা লাগছে দিচ্ছে। পাশে বড় মগে চা। সুরেন বেশ নাগাল পেয়ে গেছে মত বলল, তুই কি আমাদের বেটা মারবি! গন্ধে টেকা যাচ্ছে না।

ছেদি গ্রাহ্য করছে না। সে গোঁফে গুড় লেগে না যায়, এ-সব কারণে তার এখন অমনোযোগী হওয়া একেবারে বারণ।

সুরেন বুঝতে পারল, ছেদিলাল নেশাখোর মাতাল। ওকে বলে লাভ নেই। সে তার বিবিকে বলল, এই কুমরি, একবার দেখে আয় কি হয়ে আছে।

কুমরি বোঝে এই বাড়ির সবাই রাজা-মহারাজা। কাউকে চটাতে নেই। ওরা সকালে কাজ করে। দুপুর হলে চলে যায়। রাতে কর্পোরেশনের কাজ আছে। দু-চারটা এমনিও আছে ঠিকা কাজ। এটাই তাদের আসল কাজ। এখান থেকে তাড়ালে তাদের কোন মোকাম থাকবে না। সে বলল, সুরেনবাবু, আজ যাবে।

সুরেন যেতে যেতে দেখল, মেসবাড়ির সামনের জানালায় কেউ উঁকি দিয়ে আছে। পাশে রাজার নতুন বাড়ি। বড় বড় জানলা—গাড়ি-বারান্দা। নতুন বাড়িতে রাজার মামাত ভাই কাবুলবাবু থাকে। জানলায় দাঁড়িয়ে দাঁত মাজে, সকাল পাঁচটা থেকে সাতটা পর্যন্ত। এই দু-ঘণ্টা একটা লোকের দাঁত মাজতে যায়। সে জানে কাবুলবাবু দাঁত মাজতে মাজতে মেসবাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে। ডান দিকের কোয়ার্টারে থাকে রাধিকাবাবু। তিনটে ঘর দখল করে আছে। বড় ছেলেকে বিয়ে দিয়ে এনে আরও একটা বাড়তি ঘর রাজার কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছে। সেই ঘরটায় বৌ হাসিরাণী থাকে। কাবুলবাবুর নজর পড়েছে বৌটার ওপর। সে দেখেছে, মাঝে মাঝেই দু-চোখে মিলন হয়। এরা রাজার খোদ লোক—

এই নিয়ে কোন কথা চলে না। ফলে গোপন আছে সব। সে যেতে যেতে হাই তুলল। তুড়ি দিল দু-আঙুলে।

ফটাফট শব্দ কে করে! বেটা সুরেনের কাজ। কাবুলবাবু বলল, সুরেন তোমার আঙ্গুলে এত জোর আসে কি করে!

সুরেন বুঝতে পারল কাজটা সে ভাল করে নি। সে গড় হল। তারপর কাঁচমাচু মুখে বলল, বড্ড হাই উঠছে।

—রাতে ঘুম হয় না?

সুরেন কি বলবে ভেবে পেল না। রাতে ঘুম না হলে দিনে পড়ে পড়ে ঘুমাবে। নির্ঘাত কাজে ফাঁকি। এই করে সব রসাতলে গেল। ঘুম হয়েছে বললেও ল্যাটা আছে। খুব কামাচ্ছ। শালা ফিকিরবাজ। এদিক-ওদিক পয়সা হচ্ছে। রাজার খাচ্ছ নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছ। আঙুলে জোর কেন? বাড়তি প্রোটিন। ওটা আসে কি করে! কে দেয়। এই লোকটার সঙ্গে বাড়ির আসল মনিবের লাইন। পুট করে লাগালেই হল। সুরেনটা তুড়ি মারতে শিখেছে। ভাল কথা নয়। গ্যারেজের ইনচার্জ এই বাবু। সব গাড়ির জিম্মাদার। কেউ কেউ গাড়িবাবু ডাকে। গাড়ি মেরামতের কাজ জানে বাবু। গাড়ি চালাতে জানে। ড্রাইভারদের ছুটি-ছাটায় সে বৌরাণীর গাড়ি চালায়। কুমারবাহাদুরের গাড়ি চালায়। কান ভাঙাতে কতক্ষণ। সে বলল, ঘুমের দোষ কি বাবু! মশা! মশা হয়েছে।

মশার প্রসঙ্গ ওঠায় ছেদিলালের প্রসঙ্গ এসে গেল। এত ফিনাইল যায় কোথায় প্রশ্ন করল কাবুলবাবু?

—সেই ত কথা। কে দেখে! যার যা খুশি চালিয়ে যাচ্ছে। মেরে দিচ্ছে সব। ছেদিলালের বিরুদ্ধে সুরেনের রাগটা এতক্ষণে ঝালা মেরে উঠল।—এই দেখুন না, দু-দিন হল আমাদের লাইন মাড়াচ্ছে‍ই না। বললে হম্বিতম্বি করে।

কাবুলবাবু জানলা থেকে সরে গেল। এই হা-ভাতে লোকটার সঙ্গে কথা বলতে বয়ে গেছে! সুরেনকে দেখেই জানলার সুন্দর ডাগর চোখ দুটো টুপ করে ডুব মেরেছে। রাতে কুম্ভটা করে কি! বৌটার বড়ই বালিকা বয়স। কুম্ভটা শালা কুম্ভকর্ণ। এখনও ঘোমাচ্ছে। বৌটা পালিয়ে বসার ঘরে চলে এসেছে। এখান থেকে সে রাজার বাড়ি দেখতে পায়। রাজার সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক একজন মানুষ তাকে জানলায় দেখতে ভালবাসে। কাবুলবাবু এটা টের পেয়ে গেছে।

সুরেন দেখল এখন দুটো জানলাই সুনসান। সে হাঁটতে থাকল। বড় মেয়েটা চার-পাঁচদিন হল বরের কাছ থেকে এখানে আবার চলে এসেছে। ফের ঠেঙিয়েছে। পিঠে দাগ, হাতে পায়ে দাগ। আর যাবে না বলেছে। রাতেই বায়না করছিল, চিংড়ি-মাছ দিয়ে কচুর শাক খাবে। এখন বাজারে সে চল্লিশ পয়সার চিংড়ির খদ্দের। গায়ে রাজবাড়ির ছাপ মারা কোট।

বাজারটা রাজার। কোটটা দেখলে গণ্যিমান্য করে। বাজারে যাবার সময় কোটটা আগে চাই। আর চাই পান-সুপারি, খয়ের। গলায় রক্ত কফ ওঠে। পান খায় সুরেন। রক্ত কফ কেউ টের পায় না। চবর চবর করে খায় আর পিক ফেলে। গায়ে তাত হলে সে বেশ মজা পায়। কেমন নেশা নেশা লাগে। নেশাখোরের মত চোখ লাল থাকে। খকর খকর কাশে। শরীরটা নাচে, টাল খায়—এই করে চালিয়ে দিচ্ছে। শালা দুনিয়ার কেউ টেরও পাচ্ছে না তার একটা বড় ব্যারাম আছে। সুপারিনটেন্ডেন্ট মাঝে মাঝে জ্বালায়।—আরে ডাক্তার দেখা। খুক খুক কাশি মানুষের ভাল নয়।

ডাক্তার দেখাই, আর তোমরা রক্ষা পেয়ে যাও। সেটি হচ্ছে না।

মেসবাড়ি পার হলেই দোতলা বাড়ির নিচে চার-চারটা ঘর। প্রথম ঘরটায় থাকে, কলকাতা অফিসের অ্যাকাউট্যান্টবাবু। একটা ঘর। আর বারান্দা। বারান্দায় মুলি বাঁশ দিয়ে ঘেরা। তক্তপোশ আছে একটা। ভোরে বাবুর মেয়েটা এখানে গরমে চিত হয়ে পড়ে থাকে। খুব ভোরে সে একবার যেতে গিয়ে ভারি সরমে পড়ে গিয়েছিল। শাড়ি উঠে আছে। সে দেখি দেখি করে সবটা দেখেও ফেলেছিল। সবাই ঘুমে অচেতন। এত বড় মেয়েকে কেন যে বারান্দায় শুতে দেওয়া। শহরে থাকলে মানুষের আক্কেল থাকে না। পরের ঘরটায় আছেন কেষ্টবাবু। অফিসের কালেকটরবাবু। ভাড়া আদায়, রাজার মামলা- মোকদ্দমার তদারকি করা, আদালত হাজিরা দেওয়া এ-সব কাজে মানুষটার দু-চার পয়সা উপরি তাই সকালে কেমন মৌজ করে হারমোনিয়াম নিয়ে বসে গেছে। গলা সাধছে। গলা সাধা শেষ হলেই গান ধরবে—আয়লো অলি কুসুম কলি। কলি পর্যন্ত আসতে সাতটা বাজবে। তারপর চুলে কলপ, গোঁফে কলপ, মসৃণ মুখ গাল নিয়ে আদ্দির পাঞ্জাবি, আর ধুতি পরে অফিসে হাজিরা। তারপর সারা . দিন কোথায় যে থাকে। রাজার টাকা বারো ভূতে লুটে খাচ্ছে খাক—তার সে-জন্যে হিংসে নেই। তাই বলে বেকার ছেলেটা ঘরে বসে তার দাড়ি গোঁফ উপড়াবে! কেউ দেখার লোক নেই! রাজার বাড়িতে সবাই গোঁফ রাখে—কুমারবাহাদুরের গোঁফ আগে বড়ই সরু ছিল, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মোটা হয়ে উঠেছে। রাজা খুশি হবেন ভেবে সব ব্যাটা ভয়ে গোঁফও রাখতে শুরু করেছে। কাজের উন্নতি চার কুড়ি দশ টাকায় সেই যে থেমে আছে, তার থেকে আর তার মুক্তি মেলে নি।

জানলা থেকে কেষ্টবাবু সুরেনকে দেখতে পেল। গুটি-সুটি যাচ্ছে। এত সকালে যাচ্ছে যখন, খবরটা দিয়ে যেতে পারবে। সে গলা বাড়িয়ে বলল, সুরেন নাকি রে!

—আজ্ঞে হ্যাঁ।

—মুক্তাকে বলে যাস, আজ ওর ওখানে খাব না।

মুক্তাকে সুরেন চেনে। বাজার যেতেই সুনীল ডাক্তারের ডিসপেন্সারি—তার লাগোয়া গলিতে মুক্তা থাকে। বিধবা মানুষ। সংসারে একা। আগে বাড়ি বাড়ি কাজ করত। এখন নিজেই হোটেল খুলেছে টাকা জমিয়ে, কেষ্টবাবু মেসের সঙ্গে ঝগড়া করে মুক্তার কাছে চলে গেছে। দুপুরে রাতে মুক্তার কাছে মিল নেয়। যেদিন খাবে না, সকালে বলে দিতে হয়। মেসে এই নিয়ে একদিন তুলকালাম। কেষ্টবাবু দেশ থেকে এসে দেখল, বিল পড়ে আছে। মেসে না খেলেও বিল দিতে হয়। দু-দিন খায় নি, বিল ঠিক এক মাসের। কেষ্টবাবু এই নিয়ে দরবার করেছিল। কিন্তু মেসের ম্যানেজার বলেছে, ওভাবে হয় না মশাই—কড়াক্রান্তির হিসাব রাখার সময় কার আছে! সাত দিন দশ দিন না থাকলে এক কথা। সেই থেকে কেষ্টবাবু খাওয়ার পাট মেসবাড়ির চুকিয়ে মুক্তার কাছে চলে গেছে। মানুষটার আবার যৎকিঞ্চিৎ মেয়েছেলের দোষ আছে। সম্বল এই গান। এবং কেউ কেউ গান শিখতে আসে। মেয়েদের ছেলেদের নিয়ে মাঝে মাঝে বেশ জলসা বসায়—ছলচাতুরি জানে লোকটা। আসলে লোকাটা স্ফূর্তিফার্তা করার কৌশল জানে। লোকটাকে দেখলেই সুরেনের মনে হয় খেপলা জাল নিয়ে পুকুরের পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে কেষ্ট চক্কবর্তি। পরনে গামছা। কুচ্ছিত লোমশ শরীর। মুখে মাছ ধরার ছলাকলা। লোকটাকে সে একদম সহ্য করতে পারে না। ধম্ম বলে মানুষের আর কিছু নেই! সোমত্ত মেয়ে আছে তিন-তিনটা। বৌ-এর দাঁত পড়ে গেছে। এই শহর থেকেই কেষ্টবাবু বৌ-এর জন্য দাঁত বাঁধিয়ে নিয়ে গেছে। ছেলেরা ছোট। স্কুল-কলেজে পড়ে। তোর এ-সব আর শোভা পায় কেষ্ট!

এইভাবে সকাল থেকেই সুরেনের মানুষের ওপর রাগ বাড়ে। বেলা যত বাড়ে রাগটা বাড়ে, যত পড়ে আসে রাগটা কমে আসে। বিকেলে আনাজের বাজারটা সস্তা। কচুর শাক কচুর লতা থেকে থানকুনি পাতা সবই তখন তার জন্য বাজারে অপেক্ষা করে থাকে। মাথা গরম রাখলে দরদাম করা যায় না। তা ছাড়া মাথা গরম রাখলে সংসারে কি-ই বা হয়! যত মাথা ঠাণ্ডা তত মানুষের উপকার আসলে তার এটাই নেই। সে যখন-তখন যা না তাই বলে বসে। এই যেমন সে এখন কেষ্ট চক্কবর্তিকে গাল দিতে দিতে যাচ্ছে। বোঝ বেটা আমি কত সোজা সাপটা লোক। রাজাগজা নস্যি। তুই ত কেষ্ট চক্কত্তি।

তখনই আবার জানলায় হাঁক—ওরে সুরেন, যাচ্ছিস যখন, পান আনবি।

সুরেন অনেকটা দূরে চলে গেছিল, প্রায় সদর দেউড়িতে। সেখান থেকে কেষ্ট চক্কত্তির গলা পেয়ে সে ছুটে আসতে লাগল—আজ্ঞে যাই বাবু। তারপর মনে মনে বলল, ও-বাবু ভেব না, তোমার হাঁক, পেয়ে ছুটছি। সুরেন তেমন লোকই নয়। তার ইজ্জত আছে। যাচ্ছি গরজে। পান না থাকলে পানটা সুপুরিটা তোমার কাছে হাত পাতলে পাই। তখন তোমাকে বড়ই গুণী মানুষ ভাবি হে। কেষ্ট চক্কত্তির গলা! ফান্দে পড়িয়া বগায় কান্দে, গাও ত এমন একখানা গান—বলি গানই বটে। গুণীজনকে ধন্যি ধন্যি করতে হয়। সুরেন জানলায় এসে দাঁড়ালে কেষ্টবাবু দশটা পয়সা দিয়ে বলল, একটা গোটা সুপুরি আনবি। তারপর সতর্ক গলায় বলল, নতুন বাবুকে দেখেছিস!

—আজ্ঞে হ্যাঁ।

—কেমন, কোথায় উঠেছে?

—আপনাদের ওপরে।

—কাল রাত হয়ে গেল। দেখা-সাক্ষাৎ হয় নি। আজ সবার আগে যাব। কোন ঘরে আছে?

সে বলল, ওপরেই আছে।

—ফুলি বলল, সাধু-সম্ভের মত মুখ নাকি!

—তা ভাল মানুষই মনে হল। বড় বড় চোখ। লম্বা গৌরবর্ণ। দশাসই মানুষ।

—পাগলাবাবুর মত।

—তাই বলতে পারেন।

—পাগল না হয়ে যায়! এ-বাড়িতে সাধুসজ্জন এলে ত শুনেছি পাগল হয়ে যায়।

কেষ্ট চক্কত্তির এই এক কু-কথা। মগজের মধ্যে যত কু-ভাবনা। ঠাকুরের নাম নে। গলা সাধছিলি সাধ। কে পাগল হবে দুনিয়ায় তার তুই কি জানিস! সে বলল, একটা গোটা সুপারী?

—ঐ একটাই। কোর্ট থেকে ফিরে আসার সময় আনব। ভাল ভাল গোটা গোটা। বড়বাজারে রাখুর দোকানে ভাল সুপারী রাখে। কাটলে সাদা। খেতে মিষ্টি মিষ্টি। কস্ একদম নেই। গলা সাধা শেষ। স্টোভে চা করবেন বোধ হয়। গলাটা কাঠ কাঠ ঠেকলে সুরেন বলল, বাবু চা বানাবেন বুঝি? কেষ্টবাবু বুঝতে পেরেই বলল, না। চা না। কাপটাপগুলি ধুয়ে রাখছি। চিনি নেই। আনতে হবে।

—দিন না এনে দিচ্ছি।

—না এখন থাক। তুই যা।

সে মনে মনে বলল, বাবু মিছে কথা বল না। ভগবান রাগ করবে। তোমার ঘিলু পরিষ্কার বাবু। তুমি নয় ছয় করতে পার। তুমি সুধাসাগর। তোমার এ-সকালে মিছে কথা বললে মুখ খসে পড়বে। সুরেন অগত্যা হাঁটা দিল। সকালবেলায় কোত্থেকে যে শয়ে শয়ে কাক এ-বাড়িটাতে উড়ে আসে! আসলে বুঝি পচা গন্ধ পায়। পচা গন্ধ মানুষের না টাকার। কাল থেকে দুর্গন্ধে ঘরে টেকা যাচ্ছে না। প্রথমে ভেবেছিল, কোন খুপড়িতে ইঁদুর মরে পচে আছে কিন্তু কোন ঘরেই কিছু পাওয়া যায়নি। এই গন্ধের মধ্যেই রাতে পুঁই চচ্চড়ি আর শুকনো রুটি খেয়েছে। নালা-নর্দমা সাফ হয় না, আজ কেন, ছেদিলাল কবে রোজ নালা-নর্দমা সাফ করে! কিন্তু গন্ধটা এখনও নাকে লেগে আছে কেন? আঁস্তাকুড় থেকে গন্ধটা উঠছে। ছাই, তরকারির খোসা, মাছের আঁশ, পচা মাছের ধোওয়া জলের একটা বোটকা গন্ধ থাকে—ডাঁই হয়ে আছে।—দু-দিন না নিলেই ডাঁই হয়ে যায়—তার ভেতরে মরা কুকুর বেড়াল কেউ সেধিয়ে রাখেনি ত। যদি ছেদিলালের সঙ্গে সক্কাল বেলায় ভাল করে কথা কয়ে হাতে পায়ে ধরে, তারপরই বামুনের আভিজাত্য সুরেনের মাথায় চাগিয়ে উঠল। তারা হল গে নবীনগড়ের গাঙ্গুলী বংশ। সে ছোট কাজ করে বলে বাপ-ঠাকুর্দার ইজ্জত নিতে পারে না।

কাকগুলি মাথার ওপর উড়ছে। বাবুপাড়ার দরজা জানলা খুলছে। বাবুদের একটা ছোট ছেলে ওর সামনেই নর্দমায় পেচ্ছাপ করতে থাকল। সুরেন বলল নুনুবাবু, চিনুদিদি ভাল আছে?

নুনু পেচ্ছাপ করতে করতেই মুখ তুলে তাকাল। সুরেন দাদা যেন তাকে কিছু বলছে। সে বলল, দিদি সকালে উঠে বসেছে।

তারপরই সুরেন জিভে কামড় দিয়ে ফেলল। কেউ তো জানে না নধরবাবুর মেয়ের অসুখ। শুয়ে থাকে। ঘর থেকে বের হয় না। বড়ই গোপন—এই বাড়িটাতে পুষ্যির শেষ নেই। যত যাও—ঘর- বাড়ি। কে কোথায় কিভাবে পড়ে আছে, পড়ে থাকে কারও জানার কথা নয়।

বাবুদের হেঁশেলের খবর না জানাই ভাল—কারণ সে বোঝে, দফাদারের আবার গোঁফ। তার চেয়ে এখন জোরে হাঁটা ভাল। এ সময়টা রাস্তায় গাড়ি ঘোড়া থাকে না। সে সোজা ট্রাম লাইনের ওপর দিয়ে হাঁটতে পারবে। সকালে ট্রামের পাতে কেমন ঠাণ্ডা ভাব। খালি পায়ে সে তখন বড়ই সুড়সুড়ি বোধ করে। এই সুড়-সুড়িটা তার আর কোথাও লাগে না। স্ত্রী সহবাসেও না। সুতরাং সে খুবই পা চালিয়ে হাঁটবে ভাবল। কিন্তু কিন্তু —কই, জানালায় কই!

ওপরের জানলা থেকে তখনই কে ডাকল, সুরেনদা বাজারে যাচ্ছ। সঙ্গে সঙ্গে সুরেনের মুখে হাসি খেলে গেল। ঐ ত দাঁড়িয়ে। সে ভাবল চোখে কম দেখছে না ত! কে মতি বোন বলছ! তা যাচ্ছি।

—সুখি নাকি চলে এসেছে!

—কি করবে বোন। স্বামীটা বড় জ্বালায়। খেতে দেয় না। পেটের ছাঁচ পাল্টাবে কি করে কও। কেবল মেয়ে হয়, চার-চারটা মেয়ে তাই বলে লাথি ঝাঁটা। এরাই ত সংসারে লক্ষ্মী।

—মেয়েগুলো সঙ্গে এসেছে।

—তা আনবে কেন? ছাঁচে ঢালবে তুমি খাওয়াব আমি। বলে দিয়েছি, আসবি ত একা আসবি। আমার ছাঁচ আমি ফেলতে পারি না। কি, ঠিক কি না!

কথাগুলো জোরে জোরে বলছিল সুরেনদা। সকালবেলায় কত সহজে খারাপ কথা বলতে পারে। মতির কান গরম হয়ে গেছিল। কিন্তু মার ঐ স্বভাব-তক্কে তক্কে থাকা—সুরেনটা দেখিস বাজারে যায় কিনা। সে রাজবাড়ির ছাপ দেখিয়ে ভাল জিনিস কিনতে পারে। দু’পয়সা সস্তাও হয়। কিছু মারার স্বভাব আছে। তা মেরেও বেশ তাজা সবজি টবজি চিনে আনতে পারে। মতি বাইরে বের না হলে কেবল খায় আর ঘুমায়। ছোট দুটো স্কুলে-কলেজে পড়ে। মতিরই সব চালাতে হয়। কাল বের হয় নি বলে, সে ঘুম থেকে সকাল সকাল উঠেছিল। শরীরটা ভাল ছিল না। শরীর ভাল না থাকলে বেহুঁশ হয়ে ঘরেই পড়ে থাকে। তার সকালে ওঠার অভ্যাস। আজও উঠে তার মনে হয়েছিল, মাথাটা ঝিমঝিম করছে। সে একটা চেয়ার নিয়ে জানলায় বসেছিল—মা এসে বলে গেছে, দেখিস ত সুরেনটা বাজারে যায় কিনা।

তখন সুরেন ভাবল, সিকিটা হয়ে যাবে। সে খুবই দ্রুত পায়ে হেঁটে এল, সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে থাকল। নিচের এখানটায় প্রায় বারো ঘর এক উঠোনোর মত। পাখির খাঁচার মত পুরানো স্যাঁতস্যাঁতে বাড়ির সব দরজা। রং ওঠা। মরচে পড়া জানলার সিক। নিচে একদম আলো বাতাস নেই। দোতলায় উঠলে, আলো বাতাস আসে। পারতপক্ষে সে এই বারোয়ারি বাড়িটাতে ঢোকে না। কে না থাকে। ট্রামের কন্ডাকটার থেকে, বড়বাজারের দালাল। মতি বোনেদের সে অন্য সময় হলে হাফ-গেরস্থ ভাবত। কিন্তু এখন মনে হল, মতিবোন দেখতে কি সুন্দর? চুল লম্বা। লম্বা থুতনি। চোখের নিচে কাজল লেপ্টে থাকে। ছোট একটা তিল আছে ঠোঁটের নিচে। ডুরে শাড়ি পরলে লক্ষ্মীমতী লাগে। মতি দরজায় দাঁড়িয়েই ছিল। একটা সাদা থানের ব্যাগ, তিন টাকা হাতে। এই তিন টাকায় বাজার। মাছ, আনাজপাতি, শাক, একটা ডিম। ডিমটা মতির জন্য আসে। শরীরে বড় ধকল তার। ডিম না খেলে জোর পাবে কি করে। শরীরের লাবণ্য থাকবে কি করে! একা ডিম খাওয়া কোন দোষের না। সুরেন বাজারে যাওয়ার সময়, এখানটায় এলেই খুব আস্তে হাঁটে। যেন জানলা থেকে কেউ তাকে দেখতে পায়। সিকিটা আধুলিটা থাকে বলে ইজ্জতের মাথা খেয়ে নিজে বলবে না, দিন বাজারে যখন যাচ্ছি, আপনাদেরটাও দিন। তালেই ধরে ফেলবে। ভারি গরজ। কেন গরজ, কিসের গরজ মানুষ টের পায় সব।

মতি বলল, আজ ডিম এনো না। খাব না। পেটটা গন্ডগোল করছে।

—তোমাকে বোন এত বলি, খাও দাও। শরীর ঠিক রাখ। তবে বেশি খেলে পেট ঠিক থাকে না। গতরে লড়ালড়িওতো কম যায় না। কোথায় কোথায় চলে যাও।

মতি বলল, কোথায় আর যাই!। বাড়িতেই ত পড়ে থাকি।

সুরেন বুঝতে পারল, সক্কালবেলায় তার সত্যি কথা বলা উচিত হয় নি। পাবলিক নিয়ে কারবার- তার ওপর মেয়েমানুষ, রাজার বাড়িতে ভাড়া থাকে ….. সব দিক বিবেচনা করে চলতে হয়। সে আহাম্মকের মতো সত্যি কথা বলে ফ্যাসাদে পড়ে গেছিল আর কি। সে বলল, আমি জানি না তুমি কোথায় যাও! দশজন কু-কথা বললেই আমি শুনব! এ-বাড়িতে তোমার মতো কটা সতী লক্ষ্মী মেয়ে আছে!

মতি বলল, ও কথা থাক সুরেনদা।

—না আমি বলবই। ভয় পাই ভাবছ। বাড়িতে থাকি, আমরা বুঝি কিছু টের পাই না।

সুরেনের নিজেরও এক গণ্ডা মেয়ে আছে। কেবল বড়টার বিয়ে হয়েছে। বাকি তিনটে দেখতে মন্দ না। সে জন্য নিজের ছাঁচ নিয়ে বড়াই আছে তার। তবে মেয়েগুলান বড়ই কাকলাশ। গায়ে মাংস লাগলেই অন্য চেহারা। কাকলাশ বলে মানুষের নজর কাড়ে না। সুরেন নাকে তেল দিয়ে ঘুমাতে পারে। সে যার তার নামে অকথা কু-কথা বলে ফেলতেও পারে। মেয়েরা বড় হচ্ছে তার সে নিয়ে ভয় নেই।

তারপর সুরেন হাঁটে। বেলা হয়ে গেল আজ। ট্রাম বাস বেশ চলছে। রোদ উঠে গেছে। আসলে সে আজ ঘুম থেকেই দেরি করে উঠেছে। যখন সে ছেদিলালের সঙ্গে কথা বলছিল, তখনই বোঝা উচিত ছিল, বেলা হয়ে গেছে। মেঘলা আকাশ, কখনও রোদ। আযাঢ় মাস হলে কি হয়, কখনও শরতের মত আকাশ। সে ঘুম থেকে উঠে মেঘলা আকাশ দেখে টেরই পায় নি, বেলা হয়েছে। সে ত সকাল সকাল ওঠে। তবে রাতে খুব কাশছিল। দুপুর রাতেও। শেষ রাতের দিকে তার ঘুমটা এসেছিল। আগ রাতেও সে ঘুমাতে পারে। কিন্তু কুম্ভবাবু ডেকে নিয়ে গেছিল। তাকে বলেছিল, সুরেনদা, বাতাসী কাল থেকে তোমার বৌমার সঙ্গে থাকবে।

—আপনি কোথায় থাকবেন?

—আমার অফিস আছে না। বাবার অফিস, ভাইরা কলেজ যায়, আড্ডা মারে, বাড়ি থাকে না। তোমাদের বৌমা বাসায় একা থাকতে বড়ই ভয় পায়। জামাইবাবু ছিল, সেও বাবার ওপর রাগ করে চলে গেল। সারাদিন থাকবে। অফিস থেকে ফিরে এলে বাতাসী তোমার বাসায় ফিরে যাবে।

—বৌদি বুঝি বলেছে ভয় পায়!

—বৌদি না বললে বুঝব কি করে।

ল্যাটা। ধর্মের বৌ নিয়েও শাস্তি নেই। কাগে বগে ঠোকরায়। তা বাবু সোমত্ত বয়সে এটা সবারই থাকে। কম বেশি থাকে। তখন ভরা যৌবন উথাল-পাথাল করে—টাল সামলাতে পারে না বাবু—এধার-ওধার নজর যায়। কিন্তু সে তো সুরেন। হাবা-গোবা না। লেখাপড়া জানে, ক্লাস এইট অব্দি বিদ্যা তার। অত সহজে কাবু হবে কেন। সে বলেছিল, ওর মাকে বলে দেখি। আপনার বৌদির তো শরীরটা ভাল না জানেন। বাতাসী এটা-ওটা এগিয়ে দেয়। রুটিটা করে দেয়। জলটা এনে দেয়। বাটনাটা বেটে দেয়। ঘরটা মুছে দেয়।

—টেবি কি করে?

সুরেন বুঝল আতান্তরে পড়েছে।

—টেবি বড় সোহাগী বাবু। মাকে ছেড়ে থাকতে পারে না।

কিন্তু ছোটটা নিতান্তই ছোট। ইচ্ছে হলে ইজের পরে ইচ্ছে হলে পরে না। পরে না বললেই হয়। পরতে চাইলেই দেবে কোত্থেকে। সুরেন অকপটে বলল, মানারে দিলে চলে না কুম্ভদা? কন্যে আমার চতুর হয়েছে।

কুম্ভ বুজল শালা ত্যাঁদড়। কিন্তু সে খুব সরল মানুষের মতো বলেছিল, মনা তো ভাল করে কথা বলতেই পারে না।

—তালে বলেন কথা বলার লোক চান। বৌদির একা খুব কষ্ট। আপনি চলে গেলে বৌদিরে টেবি নিয়ে যাবে এসে।

কুম্ভ বুঝতে পারছিল, পয়সা চায়। এখন আর কিছুই পয়সা ছাড়া হবার উপায় নেই। না হলে কেমন হাবা-গোবার মত বলে দিল সুরেনদা, নিয়ে যাবে। ইজ্জত বোঝে। জানে, ইজ্জতের ব্যাপার। বৌকে পাঠালে বাপ ঘর থেকে বের করে দেবে। তাছাড়া সেও এই বাড়িতে সম্প্রতি রাজার নজর কেড়ে নিতে পেরেছে। তারই প্ররোচনা, প্ররোচনা কথাটাই কুম্ভ ভেবেছিল—রাজা খুঁজে পেতে ঠিক তার মনমত হাবা-গোবা লোক ধরে এনেছে। সেই রাজাকে বলেছিল কুমার বাহাদুর এটা আপনার গোল্ড মাইন। চুরি করে ফাঁক করে দিচ্ছে। সেই থেকে রাজার নজর তার ওপর। পাঁচ-সাত বার কারখানায় রাজা ঘুরেও এসেছেন। তারপরই বুড়ো ম্যানেজারকে ছাড়পত্র দিয়ে বলেছেন, এখন তুই দ্যাখ। লোকের খোঁজে আছি। রাজার সেই মনের মতো লোকটা নাকি রাজবাড়িতে হাজির। সে যায় নি। বাপকে পাঠিয়েছে। বাপকে দিয়েই বাড়িতে খেতে বলেছে। প্রথম থেকেই কব্জা করা—নাহলে লাগানি-ভাঙানি আগে থেকেই হতে থাকলে হুঁশিয়ার হয়ে যাবে।

কুম্ভ সুরেনের দিকে তাকিয়েছিল। কথা বলছিল না।

—তালে কুম্ভদা ঐ কথা থাকল। সুরেন হাঁটা দিচ্ছিল।

—আরে না না। শোন সুরেনদা। তুমি বাতাসীকে সকালেই পাঠিয়ে দিও। মাসে ও কিছু হাত খরচ পাবে। কাল থেকে শিট মেটালের নতুন ম্যানেজার এখানে খাবে। একা তোমার বৌদি পেরে উঠবে না।

সুরেন সহসা হাতে আকাশ পাবার মতো বলেছিল, তালে নবর চাকরি হবে বাবু? এতদিন ত বলেছেন, ম্যানেজার বদমাইস আছে। আপনার লোক বলেই নিতে চায় না। এবারে নতুন ম্যানেজারকে বলে কয়ে নবটার হিল্লে করেন। পায়ে পড়ছি কুম্ভদা। শরীর আর টানছে না। বাতাসী সক্কালেই চলে যাবে।

কুম্ভ বুঝেছিল ছকের ঘুঁটি তার দিকে। সে হাই তুলতে তুলতে বলেছিল, হয়ে যাবে। সে বলেছিল, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি যখন আছি, তখন তোমার চিন্তা নেই সুরেনদা। এমন একটা কথা পেয়েই সুরেন নানা সুখের কথা বলছিল। ভাবতে ভাবতে নিজেই একটা রাজার বাড়ি বানিয়ে ফেলছিল। আজ রাতে সে জন্য ঘুম আসে নি। তাড়াতাড়ি, বড়ই তাড়াতাড়ি করা দরকার। আটটা বাজার আগে রাজার অফিসে হাজিরা। সে পা চালিয়ে বাজার থেকে প্রায় দৌড়ে ছুটে আসতে থাকল। বিকেলে নিশ্চিন্তে লম্বা টানা একটা ঘুম। নতুন ম্যানেজার—নবর চাকরি—ঘুম। আর বিকেলেই ছেদিলাল সুরেনদের বস্তির নালা নর্দমা সাফ করতে গিয়ে গোলমাল বাধিয়ে বসল। ঘুম দিল চটকে।—ই কিয়া বাবু! এ-কিয়া চীজ। মানুষ ভি নেহি। কুত্তাভি নেই। দেখিয়ে। বলে সে আঁস্তকুড় থেকে কি একটা মরা ছোট কুকুর বেড়ালের বাচ্চা টেনে বের করল। ফুলে ফেঁপে ঢাক। সে দোলাচ্ছে। লোকজন ছুটে আসছে। রাজবাড়ির লোকজন যে যেখানে ছিল ছুটে আসছে। একটা মানুষের লাশ। মানুষটা জন্মাবার সঙ্গেই কারা হত্যা করে এই আবর্জনার মধ্যে পুঁতে রেখে গেছে। তার খুপরির সামনে এই হত্যাকান্ড। ক্রোধে সুরেনের মাথা গরম হয়ে গেল। সে খুক খুক করে কাশছে। নিজেকে যজিয়েছে, এবার সবাইকে যজাবে। কেউ শালা রক্ষা পাবে না। দুটো খুপরি পার হলে আর একটা খুপরি। সেখানে তার বৌ মেয়েরা থাকে। নব থাকে। সে সেখানে দূর থেকে আনাজপাতি ছুঁড়ে দেয়। ভেতরে যায় না। সংসারে শুধু এই খুপরিটার জন্য তার এখনও কিছুটা মায়া আছে।

লাশটা দেখছিল আর থুতু ফেলছিল সুরেন। সবার গায়ে থুতু ছিটাচ্ছিল অলক্ষ্যে। চোখ দুটো দুর্বাসার মতো জ্বলছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *