1 of 2

ঈশ্বরের বাগান – ৩৯

।। উনচল্লিশ।।

আর অতীশ বসে আছে বাসে। বাসটা ছুটছে।

বাসটা হঠাৎ ঝাঁকুনি দিয়ে থামতেই অতীশ বুঝতে পারছে, সে বিপন্নবোধ করছে। বিপন্নবোধ করলেই ভয়। সে অতীতের কোনো স্মৃতির মধ্যে তখন ডুবে যেতে চায়।

মানুষের কিছু হলে কি চরম খবর প্রিয়জনের কাছে পৌঁছে যায়! সে ঘামছিল। কিছু করারও নেই। বাসায় না ফেরা পর্যন্ত সে কিছু জানতে পারছে না। যদি সত্যি টুটুলের কিছু হয়ে গিয়ে থাকে। কে জানে সে তার বাবা-মার খোঁজে যদি রাজবাড়ি থেকে পালিয়ে বের হয়ে যায়। সাদেক আলি টুলে বসে মাঝে মাঝে গেটে ঝিমোয়। সেই ফাঁকে মিণ্টুর হাত ধরে বাবা মাকে তারা খুঁজতে বের হতেই পারে। কি হয়েছে সে জানে না। মাথাটা কেমন করছে! বাসের সিটে মাথা হেলান দিয়ে বসে আছে, তবু টের পায়, দপদপ করছে যেন মগজের শিরা উপশিরা।

সে তো কম সাহসী ছিল না!

কিন্তু ঐ যে দপ দপ করছে মগজের শিরা—তখনই সে দেখতে পায় গভীর সমুদ্রে সব অমানুষিক ঘটনা। কেউ বিশ্বাসই করবে না। না সে ভাবতে চায় না। সে ভুলে যেতে চায়। সে বার বার ভুলে যাবার চেষ্টা করে। আর কেন যে বিপন্ন বোধ থেকেই উঠে আসে ফের তারা। সে ভুলতে চাইলেও এক নিষ্ঠুর পরিহাসের মতো অজানা সমুদ্রে সেই সাদা বোট তাড়া করে। অ্যালবাট্রস পাখিটা তাকে তাড়া করে। দেখতে পায় শাঁ শাঁ করে নেমে আসছে পাখিটা। ধারালো নখ মেলে দিয়েছে। তার চোখ উপড়ে নিতে চায়, মাথার ঘিলু চুষে খেতে চায়। বলতে চায়, ছোটবাবু তুমি স্বার্থপর।

যখন আর কিছুই থাকবে না, ইউ ক্যান সাক হার ব্লাড। তেষ্টা নিবারণ হবে। শেষ অস্ত্র। খাবার, পানীয় জল শেষ। গলা শুকিয়ে উঠছে। ঠোঁট ফেটে যাচ্ছে। দু-কষে ধূসর মরুভূমির তৃষ্ণা। জিভ টেনে নিচ্ছে। আর কোনো উপায় নেই, দাঁড়াতে গিয়ে টলে পড়ছ। দু-হাত বাড়িয়ে দিয়েছ কোনো এক প্রাগৈতিহাসিক নিয়তির দিকে—ইউ ক্যান সাক হার ব্লাড। কাপ্তান স্যালি হিগিন যেন কানের কাছে বার বার বলছেন, ইউ ক্যান সাক হার ব্লাড। ইয়েট আই উইশ, ইয়ং ম্যান, লিসেন টু মি, অ্যাজ ইউ উড টু ইয়োর ফাদার। লিসেন, অ্যাণ্ড গ্রো ওয়াইজ, ফর আস স্পিক দ্য টুথ—ডোন্ট টার্ন এওয়ে। ফর আই, টু, ওয়াজ ওয়ানস এ সন, টেনডারলি লাভড মাই ফাদার। ইফ ইউ ফলো হার সি উইল প্রটেকট ইউ, লাভ হার—সি উইল গার্ড ইউ।

অতীশের মাথাটা ঝিমঝিম করছে।

সে কি বনিকে অনুসরণ করে নি। সে কি বনিকে ভালবাসে নি। বনিকে অনুসরণ করার কথা কেন বলেছিলেন। আসলে অনুসরণ করা কি বনির বিশ্বাসকে মর্যাদা দেওয়া। বনির মতো ঈশ্বরের কাছে কি আত্মসমর্পণ করতে চায় নি বলে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে! বনি প্ল্যাংকাটন খেতে না পারলে সে কি করতে পারে! সে তো কম চেষ্টা করে নি-বনি প্লিজ, তুমি না খেলে, আমিও না খেয়ে থাকব—বনি তুমি কেন খেলে না! তুমি কি আমার হয়ে প্রায়শ্চিত্ত করছিলে আর্চির প্রেতাত্মার কাছে। আমার সমস্ত পাপ কি তুমি নিজের মধ্যে আত্মসাৎ করতে চেয়েছিলে! কি বল, বল, চুপ করে আছ কেন! মাঠ বনজঙ্গল পার হয়ে কোনো দূরবর্তী নক্ষত্রের সঙ্গে অতীশ যেন কথা বলে যাচ্ছে।

অতীশ নিমগ্ন। কে বলবে সে বাসে বসে আছে। কে বলবে সে চোখ বুজে আছে পৃথিবীর অন্য প্রান্ত থেকে খবর শোনার জন্য। বনি কি বলে! যেমন সে মাঝে মাঝে ঘোরে পড়ে গেলে বনির সেই কথাবার্তা স্পষ্ট শুনতে পায়, আজও চেষ্টা করে দেখছে, তার গলার স্বর ভেসে আসে কি না। টুটুল মিণ্টুর কোনো খবর দেয় কি না!

এখন তার একটাই প্রশ্ন, টুটুল কেমন আছে। না না তোমার ঈশ্বর সম্পর্কে একটা কথা শুনতে চাই না। আমার ঈশ্বরের কথা বল। ওরা ভালভাবে বেঁচে থাকলে আমার ঈশ্বর ভাল থাকবেন। ওরা কোনো অমঙ্গলে পড়ে গেলে কাউকে ক্ষমা করব না।

সেই স্মিত হাসি বনির। সে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে হাসছে।

না না বনি, তুমি বল তারা কেমন আছে!

বনির ঠোঁট নড়ে উঠছে। বনি কথা বলছে, ছোটবাবু হোয়াই সুড ইউ ফাইট এগেইনস্ট হিম জাস্ট বিকজ হি ডু নট গিভ একাউণ্ট টু ইউ অফ হোয়াট হি ডাজ?

না না আমি তা বলছি না। ওরা কেমন আছে বল। আমার কাছে এ মুহূর্তে ঈশ্বরের চেয়েও বড় সত্য টুটুল মিণ্টু। রাতে নিমু দরজা খুলে বের হয়ে গেছিল। টুটুলের কিছু হয় নি তো! তারপরই সে যেন চিৎকার করে উঠতে যাচ্ছিল—বলতে যাচ্ছিল, হাউ লঙ আর্চি গোইং টু ট্রাবল মি।

বনি বলল, অ্যাজ লঙ অ্যাজ আই লিভ উইদ ইউ।

তার মানে!

মানে, উই বোথ লিভ বিয়ণ্ড দ্য লাইফ।

অতীশ আর কেন জানি সেই সুন্দর নিষ্পাপ মুখের ছবি চোখের উপর ভেসে উঠতে দেখছে না। সে কেমন কাতর গলায় প্রার্থনা করল, বনি, প্লিজ ইউ ডিক্লেয়ার আই অ্যাম এ সিনার। বনিকে দেখতে পেল না। শুধু নীল জল, নীল আকাশ।

বনি প্লিজ।

বাসটা আবার ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেলে সে চোখ মেলে তাকাল।

একজন অন্ধ হাত বাড়িয়ে ভিক্ষা চাইছে, বাবু দুটো পয়সা দিন। ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করবেন। এই অন্ধ লোকটাও ঈশ্বরের অস্তিত্ব টের পায়, সে পায় না কেন!

চারপাশে লোকজন। জায়গাটায় দোকানপাট আছে। গঞ্জের মতো জায়গা। খড়ের ঘরবাড়ির সঙ্গে কোঠাবাড়ি, চায়ের দোকান, মোটর গ্যারেজ, কোথাও সারের দোকানের বিজ্ঞাপন—পরিবার পরিকল্পনার বিজ্ঞাপন, এ-সব সে দেখছিল। সাঁওতাল মেজেনরা যাচ্ছে, বাঁকের ঝুড়িতে বসে আছে একটা বাচ্চা—হাতের আঙুল চুষছে বসে বসে। আনাজ তরকারির বাজার পার হয়ে বাসটা আবার মাঠের মধ্যে দিয়ে ছুটেছে।

অতীশ ভাবল, সে আসলে কাপুরুষ। সে দুর্বল। কিছুই তো সে ঠিক করে দিতে পারে না—যা হবার হবে। আর স্বপ্ন কবে সত্য হয়! নির্মলার হালকা ঘুমের মধ্যে টুটুল মিণ্টু সারারাত দাপাদাপি করে বেড়াতেই পারে। সে শুনতেই পারে টুটুল দরজায় এসে ডাকছে। নিজেকে ভারমুক্ত করার জন্য যখন এ-সব ভাবছিল, তখনই আবার সেই দৃশ্যটা, সেই বোট, সেই নীলাভ চোখে তার দিকে তাকিয়ে সে যেন বলছে, ছোটবাবু, তুমি ভারি ছেলেমানুষ! তোমার কিছু ঠিক নেই।

ঠিক নেই কেন!

বারে সেদিন যে তুমি সারেণ্ডার করলে।

কবে!

কিছু মনে থাকে না! বলছি তুমি ডাক্তারের কাছে যাও। মাস্তুল থেকে পড়ে গেছিলে মনে নেই। মাথায় সাংঘাতিক চোট পেয়েছিলে। সব ভুলে যাও কেন! এই সেদিন কুলুঙ্গির নিচে দাঁড়িয়ে বললে, বনি, আই উইল প্রেইজ হিম অ্যাজ লঙ অ্যাজ আই লিভ, ইভন উইথ মাই ডাইং ব্রেথ—আর আজ ভাবছ একজন অন্ধও যাকে টের পায় তুমি তাকে অনুভব করতে পার না! তাকে তুমি যদি টেরই না পাও প্রেইজ করবে কী করে!

বনি সত্যি আমি টের পাই না। তার অস্তিত্ব টের পাই না। আমি না থাকলে সে কে? বল সে কে? আর দুর্বল হয়ে গেলে কেন যে সারেণ্ডার না করে পারি না! তুমি ইচ্ছে করলে এ-মুহূর্তে যে কোনো শপথ আমাকে দিয়ে করিয়ে নিতে পার। কিন্তু আবার যদি দেখি সব আমার ঠিকঠাক আছে, আই মে নট প্রেইজ হিম। জরা ব্যাধি মৃত্যুর মতো ঈশ্বর চিন্তাও মানুষের একটা বড় অসুখ। প্রেতাত্মা যেমন তাড়া করে, ঈশ্বরও তাকে তাড়া করে। বার বার ঈশ্বর মানুষের কাছা খুলে দিচ্ছে। আমার তখন সত্যি বলছি হাসি পায়। ভালবাসা এবং ভগবান দুই-ই বড় কাছের। মাঝে মাঝে তাই তোমার কাছে হাত পাতি। কুলুঙ্গির নিচে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকি। তুমিই আমার সারা জীবনের সঙ্গী। তোমাকে ইচ্ছে করলেই কোথাও ফেলে চলে আসতে পারি না। আমি বুঝি ধূপবাতিদানটায় তুমি নেই যেমন সত্য, তেমনি তুমি আছ, এও বড় সত্য। তোমাকে বোঝার, তোমাকে দেখার এর চেয়ে সরল সত্য আর কিছু আবিষ্কার করতে পারি নি। তোমাকে অস্বীকার করারও না।

.

টিকিট কাটারও সবুর সইছে না অতীশের। সে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। যে কোনো ট্রেনে উঠে পড়লেই হাওড়া। একটা ট্রেন দাঁড়িয়েও আছে। সে টিকিট কেটে দৌড়ে স্টেশনের ভিতরে ঢুকে গেল। ট্রেনটা ছেড়ে দিচ্ছে। ফ্লাই-ওভারে সিঁড়ি ভাঙছে দ্রুত। লাফিয়ে উঠে যাচ্ছে। আবার দৌড়াচ্ছে। ভিড় ঠেলাঠেলি, সে একটা লোককে ধাক্কা দিয়ে প্রায় ফেলেই দিচ্ছিল। ট্রেনটা চলছে। সে আরও দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে দু-নম্বর প্ল্যাটফরমে নেমে যেতে থাকল। তারপরে দৌড়াতে থাকল ট্রেনটাকে ধরার জন্য।

নাগাল পাচ্ছে না রডের।

আরও জোরে। প্রাণপণ চেষ্টা।

লোকজনের আর্ত চিৎকার শুনতে পেল অতীশ। গেল গেল! না সে যায় নি। ধরে ফেলেছে রড। দরজায় দাঁড়ানো যাত্রীটি কোনোরকমে সাপটে ধরেছে।

সে যায় নি, যেতে পারত। এক দণ্ড কিংবা পলের ফারাক। কামরার যাত্রীরা ধিক্কার দিচ্ছে। জীবন হাতে করে কোনো মানুষই ট্রেনে ওঠে না। লোকটার কি মাথা খারাপ! অতীশ সব শুনছিল।

পরের গাড়িতে এলে কি হত মশাই!

সে কথা বলছে না।

মাথাটা তার টলছে। ভিড় নেই। একটা ফাঁকা জায়গায় সে বসে পড়ল। এতটা রিসক্ নিয়ে উঠে এসে ঠিক করে নি, সামান্য দণ্ড পলের ফারাক। সুতোর মতো সূক্ষ্ম এই ফারাক, বেঁচে যাওয়া কিংবা চাকার নিচে গড়িয়ে পড়া। সে দেখতে পেল, একটা ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত শরীর। মুণ্ডু এক জায়গায়। ধড় এক জায়গায়।

আর্চি কি তাকে তাড়া করেছিল। প্রেতাত্মা আর্চি কী আবার প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠছে!

হঠাৎ তার মনে হল কেন, এ ট্রেনটায় উঠতেই হবে! কে বাজি ধরেছিল! কে সে! টুটুল মিণ্টুর অপঘাতে যদি কিছু হয়, টুটুল কেন দরজায় দাঁড়িয়ে ডাকবে, মা দরজা খোল। এই নিরতিশয় উদ্বেগ তাকে তাড়া করেছে আসলে। সে যতই দুর্বলতা ভেবে উদ্বেগ পরিহার করার চেষ্টা করুক, শেষ পর্যন্ত পারছে না। আবার টুটুলের সেই ডাক, আমার বাবা, জান, আমার বাবা। সামান্য বাবা শব্দটি এত স্নেহ ঝরায় টুটুল মিণ্টু আসার আগে জানতই না। আশ্চর্য জাদু এক মানুষের বসবাসের পরিমণ্ডলে।

অতীশ খেপে যাচ্ছিল। ট্রেনের যাত্রীরা তাকে দেখছে। মাথা না তুলেও সে বুঝতে পারে তাকে দেখছে। কি আহাম্মক! না অবিবেচক! মানুষ পা হড়কে পড়ে যায়, ট্রেনে কাটা পড়েছে, এমন দুঃসংবাদ কাগজেই পড়েছে। একটা মানুষ ট্রেনে কাটা পড়েছে। এই দৃশ্যটা তাকে ক্রমশ কাবু করে ফেলছিল। সে নিজেই যেন শুয়ে আছে। কিংবা ট্রেনের চাকায় দুমড়ে মুচড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবার সময়, শারীরিক কষ্ট কতটা তীক্ষ্ণ অনুভব করার চেষ্টা করছিল। বাঁচার জন্য আপ্রাণ লড়তে লড়তে দেহটা কখন ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে অথবা ফুসফুসে ক্ষতের দাগ—এবং এই শেষ সময়ে মাথার মধ্যে পুত্র কন্যার ভাবনা এসে পড়ে কিনা সে জানে না। তবু সে কেন যে দেখছে পল দণ্ডের সামান্য হেরফের হলেই খবর—অজ্ঞাত যুবকের লাশ, মাছি ভনভন করছে। পুলিশের গাড়ি, মর্গ এবং অজ্ঞাত লাশ টেনে নিয়ে যাচ্ছে ডোমেরা। নির্মলা জানে, সে বাড়ি ফিরে গেছে, মিণ্টু জানে, বাবা মাকে রেখে আসতে গেছে, রাজবাড়ির সবাই জানে, অতীশবাবু স্ত্রীকে রেখে আসতে গেছেন। দু-পাঁচদিন দেরি হতেই পারে। সে যে মর্গে লাশ হয়ে পড়ে আছে কারো মাথাতেই আসবে না। সে কি তার অস্তিত্বের কোনো স্বাক্ষর এটাচিতে রাখে নি। নাম ঠিকানা! ঠিকানা থাকলে খবরটা পেয়ে যায় সবাই। কিন্তু অতীশ ত এটাচিতে জামা প্যান্ট তোয়ালে দাঁত মাজার ব্রাশ ছাড়া কিছু রাখে নি! জীবনের এই উদ্বেগ কী আসলে মানুষের প্রেতাত্মা! যে তাড়া করে শুধু। পরের ট্রেনে এলে এই ঝুঁকি নিতে হয় না। তবু কেন সে এতটা ঝুঁকি নিয়ে দৌড়েছিল। কে সে? যে তাকে এ-ভাবে তাড়া করছে।

সে উকি দিয়ে দেখছে। নিজের লাশ নিজে দেখছে। একটা কাঠের বাকসে লাশ। নিজের লাশ নিজে দেখার মধ্যে বেশ মজা আছে। মুণ্ডু বুকের উপর। কবন্ধ। হাত দুটো আলগা—আর কি যে হয় তখনই শুরু হয়ে যায় ড্যাং ড্যাং বাজনা, ঢাকের বাদ্য বাজছে। দশটা ঢাকি অনবরত মহাবলির বাজনা বাজিয়ে যাচ্ছে, ঘুরে ঘুরে বাজাচ্ছে। জ্বালালি কবুতর উড়ছে। চিকের আড়ালে অন্দরের সব গিন্নিমারা। মণ্ডপে, দশভুজা ত্রিনয়নী দুর্গার হাতে ত্রিশূল খড়্গগ—ঝলমল করছে তাঁর তরবারি। হলুদ রঙের দেবীর চোখ বিস্ফারিত। দেবী মহামায়া দাঁড়িয়ে আছেন, পশুরাজ সিংহ হাঁ করে আছে—এক অনন্ত গভীর অন্ধকার এবং নীরব ধ্বংসের প্রতীক—মোষটাকে টেনে আনা হচ্ছে, পুরোহিত উৎসর্গের মন্ত্র পাঠ করে চলেছেন। কে যেন বলছেন অনন্তর করজোড়ে পাঠ করিবে, ওঁ বলিরেষ ময়া দত্তঃ পশুনাঞ্চ পশুত্তম।

আবার কে যেন বলিল, অনন্তর খড়গ পূজা করিবে—খড়ের ধ্যান, ওম কৃষ্ণং পিনাক পাণিঞ্চ কালরাত্রি স্বরূপিণম্। উগ্রং রক্তাস্যনয়নং রক্তমাল্য অনুলেপনম্।

অনন্তর কে যেন বলিল, পশুর বন্ধনমোচন কর।

অনন্তর কে যেন বলিল, অতঃপর বলিচ্ছেদন করিয়া মহিষাসুর সমাংস রুধির ও শীর্ষ আনয়ন করিবে।

সে দেখতে পাচ্ছে, অগ্নিতে হোম এবং বিনাশ অনবরত এই মহাকুণ্ডে! পশুর আর্ত চিৎকার শোনা যাচ্ছে। কবন্ধের উপর মুণ্ডু। সেই যেন কোন জঙ্গলে কে কবে লুকিয়েছিল—এক মোষ যায়, কাটা মুণ্ডু বুকে নিয়ে মোষ যায়—চার পা বাঁধা। একটা বাঁশের দু-দিকে আটজন করে বলশালী মানুষ, বলির মোষ নিয়ে ফসলের মাঠ পার হয়ে ছুটে যাচ্ছে তারা।

অতীশ গলায় হাত বুলিয়ে কি এক কষ্ট যেন অনুভব করতে পারছে। আবার সেই দূরবর্তী দৃশ্য মাথার মধ্যে পাক খাচ্ছে। চোখ দুটো বের হয়ে পড়ছে—নিঃশ্বাস বন্ধ। পা দুটো কাটা পাঁঠার মত ছটফট করছে। তারপর স্থির। চোখ দুটো স্থির। ঠিক কাঠের বাক্সটায় লাশের চোখও স্থির। একটা মর্গে পড়ে আছে আর একটা জাহাজের কেবিনে। সে লাশটাকে কাঁধে ফেলতে গিয়ে বুঝল, খুবই কঠিন কাজ। প্রথমে পা দুটো পিঠের উপর টেনে তুলল, হাঁটু গেড়ে বসল। তারপর পা দুটো টেনে লাশটাকে কাঁধের উপর ফেলে টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল। সে জাহাজের সিঁড়ি ভাঙছে।

আর তখনই অতীশ যেন টের পেল মহাবলির বাজনা অনবরত বেজে চলেছে মানুষের পেছনে। প্রাণিজগৎ, এবং এই ভূখণ্ডে সেই বাদ্য কেউ শুনতে পায় কেউ পায় না। অথচ পেছনে বাজিয়ে যাচ্ছে। টেনে নিয়ে যাচ্ছে কেউ। প্রকৃতির অদৃশ্য হাত টেনে নিয়ে যাচ্ছে। ‘বন্ধন মোচন কর’ অন্তরীক্ষে এমন কেউ বলতে পারে। এই বন্ধন মোচনের জন্য টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সে দেখতে পেল, কোনো গেরস্থ ফসলের জমিতে দাঁড়িয়ে আছে তারও বন্ধন মোচন চলেছে, এই যে ট্রেনযাত্রীরা যাচ্ছে—তাদেরও বন্ধন মোচন চলছে। কেবল সেটা কবে শেষ হবে কেউ বলতে পারছে না। এমন কে আছে যার বন্ধন মোচন চলছে না—কেউ কি হেঁকে বলতে পারে, আমার বন্ধন মোচনের কোনো হেতু নেই। আমি অজর অমর!

তবে!

তবে এই লাশ হয়ে যাওয়ার মধ্যে এত ত্রাস লুকিয়ে থাকে কেন! কার পেছনে বিসর্জনের ঢাক বাজছে না!

সে নিজেকে স্বাভাবিক করে তুলতে চাইছে। ক্ষণিকের জন্য প্রাণে বেঁচে গেছে একথা সে ভুলে যেতে চায়। ইস্ অল্পের জন্য। তার ভিতরে ইস শব্দটি আশ্চর্য বিস্ময় সৃষ্টি করছে। এবং এই ‘ইস’ শব্দের সঙ্গেই মনে হল, অল্পের জন্য বেঁচে যাওয়ার মুলে আছে কোনো শুভ প্রভাবের ফল। সে হাত মেলে তার আঙুল দেখল, পিতৃদেব গ্রহের কোপের কথা বলে গেছেন, মৃত্যুযোগের কথা বলে গেছেন, পঞ্চতীর্থ কাকা রক্ষাকালীর পূজা করেছেন বাসায়। তিনটি আংটি ধারণ করিয়ে গেছেন। সে এখন হাত মেলে হাতের তিনটি আংটির দিকেই তাকিয়ে আছে।

একটি গোমেদ।

একটি পলা।

একটি মুনস্টোন।

তিনটির রঙ তিন রকমের। পলার রঙ রুধিরের মত, গোমেদের রঙ চোখের মণির মত, আর মুনস্টোনের রঙ জমা বরফের মত। তিনটি রঙের আশ্চর্য বিশেষত্ব। যেন সবকটা রঙ মিলে গেলেই আত্মার স্বরূপ ধরা পড়ে যায়। পঞ্চতীর্থকাকা আংটি ধারণের সময় এমন বলেছিলেন। অশুভ প্রভাব তাড়া করবে, আর পাথরের শুভ প্রভাব তোমাকে রক্ষা করবে। কার কত লড়ালড়ি আংটি ধারণ করলে টের পাবে।

নির্মলা এখন কি করছে কে জানে! ক্লাশে বসে থাকতে পারে, রুমে বসে থাকতে পারে—এই মাত্র যে সে অপঘাত থেকে রক্ষা পেয়ে গেল নির্মলা জানে না। একই ভাবে নির্মলাও কখন ঝুঁকি নিয়ে উঠে পড়ার চেষ্টা করবে, আর তারপর …. সে ভাবতে পারছে না।

কেমন অসহায় হয়ে পড়ছে দিন দিন। তার এই উৎকণ্ঠা নিজেরই সৃষ্টি। তার পরই আবার মনে হয় মহাকালের হাত থেকে সুরক্ষা কাউকে সে করতে পারে না। বাবার কথাই ঠিক, নিয়তি নির্দিষ্ট যাত্রা। তুমি শুধু কর্ম করে যেতে পার ফলভোগের আশা কর না। যা ঘটবার ঘটবেই। তাই যদি হয়, তবে বাবা গ্রহকোপ থেকে আত্মরক্ষার জন্য শাস্তিস্বস্ত্যয়ন করে গেলেন কেন! এটা কি শিশুর হাতের ঝুমঝুমি। কিংবা বলির আগে মেষ মোষের একটু বেশি বেশি আদরযত্নের মত, মোষটাকে স্নানে নিয়ে যাবার আগে কচি সুস্বাদু ঘাস ভক্ষণের চেষ্টা। সে কিছুই ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। মৃত্যু চিন্তায় সে কেমন যেন অস্থির হয়ে পড়েছে। চারপাশ থেকে অহরহ টের পাচ্ছে, কেউ অনুসরণ করছে তাকে। অদৃশ্য সেই অনুসরণ, এই কিছুক্ষণ আগে শেষ হয়ে যেতে পারত—অথবা কোনো বিনাশ সাধনের জন্য দু-হাতে ধারালো ছুরি উত্তোলনে রোদের রশ্মি ঝকমক করছে।

সে ভয়ে চোখ বুজে ফেলল।

দেখেছেন খবরটা?

কি খবর!

আরে দেশে কি চলছে। নকশালরা ম্যানেজার খুন করেছে। বেটারা নকশাল না কংশাল কে জানে। বদলা নেওয়া। ক্ষমতার লড়াই, বুঝলেন না দাদা!

সে বুঝতে না পেরে তাকিয়েছিল সেদিন।

সকালের কাগজ দেখেন নি?

না।

প্রকাশ্য দিবালোকে এই যেমন চারপাশে মানুষজন, স্কুল কলেজ অফিস কাছারি সব চলছে, বেচারা জানতই না। মাথার উপর তার অদৃশ্য অপঘাত ঝুলছে। খুন। ম্যানেজার খুন। জোতদার পুলিশের পর ম্যানেজারের পালা।

এগুলো যে কি হয় তার, সে কিছুতেই মন শান্ত করতে পারে না। মগজে অহরহ দুশ্চিন্তা বুড়াবুড়ি কাটছে। দুশ্চিন্তা বস্তুটি মারাত্মক। সকাল থেকে রাত, ঘুমের মধ্যে, একমাত্র সহবাসের সময় সে টের পায় এক আশ্চর্য অবিনাশ জীবন মহিমা। কিছুই মনে থাকে না। বৃষ্টিপাতের পর সবুজ ঘাসে জল লেগে থাকার মত উজ্জ্বল অনাবৃত মুখ। এবং সে বুঝতে পারছে, দুশ্চিন্তা তাকে সাঁড়াশি আক্রমণে ঘিরে ফেলছে। এই আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার উপায়—টেবিলে বসে পাতার পর পাতা লিখে যেতে পারা। সে তখন সাহস পায়। টুটুল মিণ্টু নির্মলা পাশে থাকলে সাহস পায়। বাবার চিঠির শেষে দুটোলাইন লেখা থাকে, ঈশ্বরের কৃপায় কুশলে থাক প্রার্থনা করি। এই লাইনটাও মারাত্মক। ঈশ্বরের কৃপায়। সে এই কৃপা অনেকবার চোখ বুজে টের পাবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু ঘণ্টা বাজছে না। কেউ বলছে না, আমি। আমি তোমার যাবতীয় আচরণ লক্ষ্য করছি। এমন কি বাড়ি গেলে গাছের ছায়ায় কিংবা দূরবর্তী মাঠে হেঁটে গিয়েও সে একা দাঁড়িয়ে থেকে তাকে অনুভব করার চেষ্টা করেছে। গভীর জঙ্গল পড়ে দেশের বাড়িতে যাবার রাস্তায়। সেই জঙ্গলের ভিতরও সে ঢুকে দেখেছে, খুঁজেছে। আবার কখনও কি যে মনে হয় এই পত্র পুষ্প পাখি, আকাশ, বাতাস, শ্বাসপ্রশ্বাসের ক্রিয়া-প্রক্রিয়া সবই প্রকৃতির হেতু। মাঝখানে ঈশ্বর সবটা দখল করে থাকেন কি করে! প্রকৃতিই যদি হেতু হয়, এবং জন্মমৃত্যু সেই হেতুর উপকরণ তখন ঈশ্বর নিয়ে মানুষের নির্মম মহামারী কেন! ভয় পাইয়ে দেওয়া কেন। ঈশ্বরের অস্তিত্বের চেয়ে প্রেতাত্মার অস্তিত্ব সে বেশি টের পায়। বাসাবাড়িটায় সে নিজে দেখেছিল, আর্চি কুয়াশার মত অবয়ব নিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসছিল। জিরো পাওয়ারের বাল্ব জ্বালা, বাসাবাড়ির বিশাল ঘরগুলো খাঁ খাঁ করছে। সে একা। সে স্পষ্ট দেখেছিল, কোণের দিকের দেয়ালে কুয়াশার মত একটা ছায়া নড়ছে। সে উঠে বসলে দেখেছিল, ছায়াটা দরজা দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। সে কেমন ঘোরে পড়ে কুয়াশার পেছনে করিডর ধরে ছুটছিল। আশ্চর্য সেই কুয়াশার অবয়ব বাইরে বের হয়ে পাতাবাহারের গাছগুলির মধ্যে মিশে গেল।

গভীর রাত। অন্ধকার। রাজবাড়ির অন্দরের দিকের গাড়ি-বারান্দায় শুধু আলো জ্বলছে। অদূরে ফুল-ফলের বাগান, পুকুরপাড়ে দেবদারু গাছ, দূরে ট্রেনের সান্টিংয়ের শব্দ। সে কাঁপছিল। সে এখনও চোখ বুজলে সেই দৃশ্যটা স্পষ্ট অনুভব করতে পারে! বিশাল সেই কুয়াশার অবয়ব পাতাবাহারের গাছগুলিতে মিশে যাচ্ছে। তার গলা বুক শুকিয়ে উঠছে। নিজেকে ধাতস্থ করার জন্য মনের ভুল ভেবে কেন যে পাতাবাহারের গাছগুলির মধ্যে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল! যদি সত্যি হয়। যদি সে অনুসরণ করে থাকে। যদি কাপ্তান স্যালি হিগিনসের কথাই সত্য হয়, সারাজীবন তোমাকে আর্চি তাড়া করবে। হাত দিতেই থরথর করে তার অস্তিত্ব নাড়া খেয়েছিল। পাতায় জল লেগে আছে। পাতাগুলি জলে ভিজে গেছে। শীতের রাত নয়, কুয়াশা পড়ে নি, বৃষ্টি হয় নি, নির্মেঘ আকাশ। তবু জলে সব গাছগুলি ভিজে গেছে। কে সে? কে কে? চিৎকার করতে গিয়ে মনে হয়েছিল, সবাই টের পেয়ে যাবে আসলে সে একজন খুনি। কোনো রকমে করিডরে উঠে লাইট জ্বেলে দিয়েছিল। করিডরের লাইট, চাতালের লাইট, দু-ঘরের লাইট—কোথাও কোনো অন্ধকার থাকুক সে চায় না। অন্ধকার এত বিপজ্জনক হতে পারে সে রাতে প্রথম সে টের পেয়েছিল। সব দরজা জানালা বন্ধ করে মাথা গোঁজ করে বসেছিল সারারাত।

সেই অনুসরণকারী যে আজ তাকে ট্রেনের নিচে ছুঁড়ে দিতে চায় নি, কে বলবে! গ্রহকোপ কি আসলে আর্চির তাড়া। দুষ্ট গ্রহ সমাবেশ ঘটেছে! দুষ্ট গ্রহ কি কুম্ভবাবু, পিয়ারিলাল, বউরাণী! দুষ্টগ্রহরা কী তাকে তবে সত্যি ঘিরে ফেলেছে! কিংবা কারখানার মনোরঞ্জন, ইউনিয়নের পাণ্ডা, সে কি তার দুষ্টগ্রহ! বার বার এগ্রিমেন্ট খেলাপ, চুক্তি অনুযায়ী কোনো উৎপাদন নেই, সারাদিনে তারা যে মাল তৈরি করে তিনঘণ্টা ওভারটাইম দিলে প্রায় সেই মালই অনায়াসে বানিয়ে দিয়ে যায়। কিন্তু পড়তায় আসছে না। পুরানো আমলের যন্ত্রপাতি, প্রতিযোগিতায় হটে যাচ্ছে। আবার এগ্রিমেন্ট, আবার খেলাপ, বার বার সে হেরে গেলে মাথা ঠিক রাখবে কি করে। এগ্রিমেন্ট না করলে গো স্লো, পরে লক আউট।

তার কেমন নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। জানালায় মুখ বাড়িয়ে দিয়েছে। সেই মাঠঘাট শস্যক্ষেত্র ফেলে ট্রেন ছুটছে। বাসায় ফিরে কি দেখবে কে জানে। কতকাল থেকে যেন এই বাসাবাড়িতে আর্চির উৎপাত কোনো দুষ্ট উপগ্রহের মতো সংকেত পাঠাচ্ছে। মিণ্টু পুকুরের জলে ডুবে গেছিল—যেন বলতে চাইছে, আমি আছি। নির্মলার জরায়ুতে রক্তপাত, হাসপাতাল, অপারেশন, যেন বলতে চাইছে আমি আছি, টুটুল টুল থেকে পড়ে গিয়ে অজ্ঞান, হাসপাতাল, ইনটেনসিভ কেয়ার—যেন বলতে চাইছে আমি আছি।

এবারে আর্চির জিঘাংসা কি রূপ নেবে কে জানে! যদি টুটুল সবার অজ্ঞাতে বাবা মাকে খুঁজতে বের হয়ে যায়। আমার বাবাকে দেখেছ, মাকে? আমার বাবা মা না কোথায় চলে গেছে।

সে চোখ বুজে অস্থির হয়ে উঠছে। মাথা দপদপ করছে। মগজে আর্চি পাথর হয়ে চেপে বসেছে। আর তখনই সে দেখল দূরাতীত গ্রহে সাদা বোট। একটা পাখি। অ্যালবাট্রস পাখিটা উড়ে যাচ্ছে।

সে বুঝতে পারে আপৎকালে এই দূরাতীত শুভ সংকেত তাকে স্বাভাবিক করে তোলে।

সে সেই দূরাতীত গ্রহে বিচরণ করলে, দুশ্চিন্তা তাকে তাড়া করে না।

অসীম সমুদ্র।

অনন্ত আকাশ।

বোটে এক নারী। নীল গাউন পরে নিবিষ্ট মনে ছোটবাবুর জামা রিপু করছে।

নোনা জলে সব পচে যায়। ঝড়ের দরিয়ায় সারাদিন পাল খাটিয়ে টালমাটাল অবস্থা। বনি বের হলে চিৎকার, কি করছ! মাথা খারাপ। ঢেউ ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। শিগগির বসে পড়। দাঁড়ালেই ঢেউ ভাসিয়ে নেবে। একদম কথা শুনছে না। কী দেখছে দাঁড়িয়ে। কথা শুনছে না। মেরেই ফেলব, নিজেও মরে থাকব। বলছি দাঁড়াবে না। দেখছ না সমুদ্র কেমন খেপে গেছে। দাঁড়াবার চেষ্টা করলে বলছি খুন করব। তারপর নিজের গলা টিপে ধরব। দুজনে পড়ে থাকব বোটে। পাশে ক্রস। জীবনের আড়কাঠি। যেন দুজনে সেই সাদা বোটে শুয়ে থাকবে—বোট যেদিকে চায় যাক। যেদিকে খুশি ঢেউ বোট ভাসিয়ে নিক। কোথায় কতদূর ডাঙা যখন জানে না, দিনের পর দিন যখন নিঃসঙ্গ ধাবমান সমুদ্র-রহস্য তাদের ঘিরে ধরেছে তখন ছোটবাবুর মাথা ঠিক থাকার কথা না। বনি ছোটবাবুর হুঁশিয়ারি অগ্রাহ্য করতে পারে। সে ছুটেছিল, বোটের সামনে যে অয়েল ব্যাগটা আছে তার দড়িদড়া বাঁধতে। ঝড়ের দরিয়ায় এই অয়েল ব্যাগটাই বোটটার একমাত্র আত্মরক্ষার উপায়। বোট উলটে যেতে পারে। জল আর অয়েলব্যাগ ঠিক থাকলে, ঢেউ যতই খ্যাপা ষাঁড়ের মতো ধেয়ে আসুক পালকের মতো ভেসে থাকবে। ঝড় বৃষ্টিতে বোটের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। বৃষ্টি হলে দু’জনের ঝাপসা ছবি। বৃষ্টির জলে তারা জামা প্যান্ট সব খুলে ধুয়ে নেয়। বৃষ্টি না থাকলে, শুধু ঝড় থাকলে জামা প্যান্ট চ্যাটচ্যাট করে নুনে। রোদ উঠলে ছোটবাবু শুনতে পায়, ও ছোটবাবু। খুলে দাও।

কী খুলে দেব!

পরে আছ। কি ছিরি হয়েছে!

বনি রুটি স্যাঁকার মতো রোদে জামা প্যান্ট উলটে পালটে শুকিয়ে নেয়।

কেমন তারা বুঝে ফেলেছিল, এই সমুদ্রেই তারা ভেসে বেড়াবে। বনি যেন ক্রমে জেনে ফেলেছিল, মৃত্যু আসন্ন। তবু গৃহস্বামী তীর্থে যাবার আগে যেমন ঘরদোর সব ঠিক রেখে যায়, বনি তেমনি, কোনো মহাতীর্থে রওনা হবার আগে চঞ্চল হয়ে উঠেছিল—ইস কি করেছ!

কি করেছি!

পেছনটা ফেটে গেছে।

যাক না।

দাও তো। কেবল কথা বাড়াবে।

বোটের এমন জায়গা নেই নোনা জল যেখানে ঢুকে না যাচ্ছে। বোটের রঙ চটে যাচ্ছে। ক্ষয়ে যাচ্ছে। র‍্যাফটের জল খাবার ফুরিয়ে আসছে। র‍্যাফট হালকা হয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে সব শেষ হয়ে যাবে। এক মাসের মতো খাবার ছিল—কিন্তু ছোটবাবু প্ল্যাংকাটন খেতে শিখে গেছে। তার শরীরে বিন্দুমাত্র ক্ষয় দেখা দেয় নি। এক মাস না আরও বেশি। দিন মাসের হিসেব গুলিয়ে যাচ্ছে। রোদ উঠেছে। ঝড় নেই। সমুদ্র নিপাট নিস্তরঙ্গ। হাওয়া নেই। স্যাঁকা রুটির মতোই রোদের তাপ। সকালের দিকটায় সামান্য ঠাণ্ডা থাকে। ছেটোবাবু বুঝতে পারছিল, নিরক্ষরেখার দিকে বোট ভেসে যাচ্ছে। গরম বাড়ছে। রোদে বের হলে, দুটো একটা ফোসকা দেখা দিচ্ছে বনির গায়ে। ফোঁড়ায় কষ্ট পাচ্ছে। নোনা জলে জ্বালা হয়, তবু কি যে অসীম সহ্যক্ষমতা তার। পারছে না, তবু ছোটবাবুর জামা প্যান্ট রোদে শুকিয়ে রাখে। সাদা নুন নীল জামা প্যান্টে সরের মতো ভেসে ওঠে। বড় নিবিষ্ট চিত্তে সেই নুন ব্রাশে ঝেড়ে ভাঁজ করে তুলে রাখে যখন, মনে হয় পৃথিবীতে দুই নরনারীর এই অবগাহনই ঈশ্বর-রহস্য। গন্ধমে তারা কেউ আর শরীরে কোনো পোশাক রাখতে পারছে না। ছোটবাবু পারলেও বনি পারছে না।

একেবারে তারা আদি মানব-মানবী। আর নীল গভীর নিরুপায় সমুদ্র জ্বলতে থাকে কাঠের চিতার মতো। যেন প্রজ্বলিত হচ্ছে, দুজনের দেহ। ঝলসে যাচ্ছে। তবু চাই অবগাহন। জ্যোৎস্না রাতে চুপচাপ পাটাতনে ফিসফাস কথাবার্তা, ছোটবাবু আমি মরে গেলে ক্রসটার সঙ্গে বেঁধে সমুদ্রে ভাসিয়ে দিও।

অ্যালব্রাটস্ পাখিটা গলুইয়ের মাথায় বসে থাকে।

ছোটবাবু!

বল।

পখিটা বোধহয় টের পেয়েছে।

কি টের পেয়েছে?

আমরা সমুদ্রেই ভেসে থাকব। আমরা ডাঙা পাব না। তার পরেই ধড়ফড় করে উঠে বসত। পাখিটাকে গিয়ে আদর করত। কেমন পোষ মেনে গেছে। অতিকায় অ্যালব্রাটস পাখিটাকে বুকে সাপটে ধরে আদর করত।

তিনটি প্রাণী মাত্র। নিচে সমুদ্রের গভীর জলে কোনদিন ডলফিনের ঝাঁক। তারা কি জানে বোটে তিনটি প্রাণী ডাঙা পাবার জন্য পাগলের মতো অপেক্ষা করছে।

বনির গভীর নীল চোখ, নীলাভ চুল আর সতেজ বাহুমণ্ডলে কি যে উষ্ণতা বিরাজ করত! দুজন তরুণ-তরুণী মৃত্যু আসন্ন জেনেও বিন্দুমাত্র বিচলিত হত না। বিচলিত হলে, বনি ছুটে এসে ছোটবাবুকে জড়িয়ে ধরত। ঘাড় গলায় চুমো খেত পাগলের মতো—আর তারপর বিরাজ করত অপার সুষমা শরীরে। হাত পা মেলে ডাকতো, এস। সাহস দিত। এই একমাত্র সুখ পৃথিবীর যা যাবতীয় দুশ্চিন্তা, দুঃখ এবং মৃত্যুভয়কে অবহেলায় সরিয়ে দিতে পারে। তুমি আমার শরীরে প্রবেশ কর, প্রবেশ কর। দু-হাতের মুদ্রায় সেই মহামায়া সৃষ্টির জন্য উন্মাদ। ঝড়, নৈঃশব্দ কোনো পাখির ডানার মতো তাদের আশ্রয় দিত। ছোটবাবু দু-হাতে সেই আশ্চর্য সুষমাকে ছিন্নভিন্ন করে দিত। পাখির পালকের মতো নরম শরীরে ছোটবাবু মিশে যেতে যেতে বলত, বনি লাগছে না তো।

বনি কিছু বলত না। আরও নিবিড় এবং নিবিষ্ট হয়ে যেত তাকে জড়িয়ে।

আকাশে তখন অজস্র সাদা মেঘ, কখনও নক্ষত্র সমুদ্রে প্রতিবিম্ব সৃষ্টি করত। অজানা সমুদ্রে কোনো ভয় থাকত না। নিমেষে সব আতঙ্ক থেকে আত্মরক্ষার এই ছিল বনির একমাত্র উপায়। বনি বলত, ছোটবাবু আমরা আর ডাঙা পাব না? ছোটবাবু বলত, সামনেই ডাঙা। নিশ্চয়ই পেয়ে যাব।

অতীশ ছোটবাবু হয়ে যাচ্ছিল।

আরে কী করছ!

না ছাড়।

শোনো কিচ্ছু হবে না।

না না, নোনা জামা-কাপড় পরে থাকলে ঘা হয়ে যাবে। ছাড় বলছি।

ছোটবাবু তখন একটা হাতুড়ি দিয়ে পেরেক বাঁকিয়ে বঁড়শি বানাবার চেষ্টা করছে। বনি জানে না, জল খাবার শেষ হয়ে গেলে নিষ্ঠুর সমুদ্রে মরীচিকা ছাড়া আর কিছু থাকবে না। আসলে প্রস্তুত থাকা। ঝড়ে কটা উড়োক্কো মাছ পাটাতনে এসে পড়েছে—তাই দিয়ে জ্যোৎস্নায় ভোজ। প্রায় ভোজই বলা যাবে। একটা মাছ ছোটবাবু পালিয়ে রেখে দিয়েছে। পচা গন্ধ উঠেছিল সকাল থেকে। বনি বলছে, ছোটবাবু ওফ্ কি গন্ধ!

ও কিছু না!

গন্ধটা কিসের!

চুপ কর তো। কেবল সকাল থেকে বকর বকর। বলছি ও কিছু না।

মাছটা নষ্ট করেছে, একটা উড়োক্কো মাছ ছোটবাবু না খেয়ে সরিয়ে রেখেছে, জানলেই বনি গজগজ করবে।—তোমার মাথা খারাপ ছোটবাবু! তুমি কি ভাবছ। মাছটা নষ্ট করলে! তোমার আর কবে বুদ্ধিসুদ্ধি হবে!

যত বুদ্ধি তোমার হয়ত সে এমন বলত। ঝগড়া শুরু হয়ে যেত। ছোটবাবু যে বড় একটা মতলবে আছে, বললেও বনি বিশ্বাস করবে না।

ছাড় বলছি। কী ছিরি হয়েছে প্যান্টের!

ছোটবাবু ফাইলে পেরেকের মাথাটা ঘষছিল। ছই-এর ভিতর ঢুকে পাটাতনের নিচ থেকে ছোট্ট টিনের বাক্স বের করে রেখেছে। ছোটবাবু কি করছে বনি বুঝতে পারছে না। যত দিন যাচ্ছে ছোটবাবু কম কথা বলছে। কেবল চারপাশে তাকাচ্ছে। না কিছু নেই। সেও বোটের মাথায় কত দিন রাতে পাহারায় থেকেছে। পালা করে কাজ চালিয়ে গেছে। দুজনেই পাগলের মতো, ওটা কি, ঐ দূরে দেখা যাচ্ছে, ঐ ঐ যে দেখছ না!

কিছু না।

এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকলে এমন হয়। ভয় পেলে হয়। আতঙ্ক থাকলে হয়। আতঙ্কে পড়ে গেছে বনি। আতঙ্কে পড়ে গেলেই মরীচিকা। কখনও মনে হয়, শহর আলো, মানুষজনের চলাফেরার শব্দ। কখনও মনে হয় রেসকু জাহাজ ছুটে আসছে। কখনও মনে হয়, দ্বীপ সামনে। সবুজ গাছপালা। মেঘের ছায়া যে ক্রমে বিলীন হয়ে গেলে দ্বীপ থাকে না, শুধু সমুদ্রের হাহাকার থাকে, ছোটবাবু বার বার বুঝিয়েছে। বলেছে, এলবা যখন আছে ঠিক আমাদের ডাঙায় পৌঁছে দেবে।

কী ছাড়বে না!

ঝামেলা করবে না তো!

ঝামেলা! বলেই বনি, টেনে তার প্যান্ট খুলে ফেলল। জামা খুলে ফেলল। তারপর রোদে দেবার সময় বলল, সকাল থেকে কী করছ!

দেখতেই পাচ্ছ কি করছি। তুমি রোদে আমার জামা প্যান্ট, তোমার গাউন শুকাচ্ছ, আমি পেরেকের মাথায় ধার তুলছি। দয়া করে দ্যাখ তো বঁড়শি মনে হচ্ছে না?

বঁড়শি দিয়ে কি হবে?

দেখ না কি হয়!

যেন ডাঙায় তারা কোনো গাছপালার ছায়ায় হেঁটে যাচ্ছিল। কথাবার্তা এত সরল সহজ। নিষ্করুণ সমুদ্র ওঁৎ পেতে আছে কখনও কখনও বনি কিংবা ছোটবাবুর আচরণে বোঝা যেত না। আসলে বোটে ভাসতে ভাসতে বোটের এই জীবনই সত্য হয়ে উঠেছে। গেরস্থ মানুষের মতো খড়কুটো হাতের কাছে যা পাওয়া যায় তারই ব্যবহার। ছোটবাবু বঁড়শিতে উড়ুক্কো মাছটা গেঁথে ফেলে দিল জলে। বনি তার প্যান্ট শার্ট খুলে নিয়েছে। প্রায়দিনই এই কাজ। জামা প্যান্ট আর আলাদা বলে কিছু নেই। সেই জাহাজ অচল হয়ে যাবার পর থেকেই জামা প্যান্ট ধোওয়ার পাট নেই। জামা প্যান্ট খসখসে হয়ে গেছে। পরেও থাকা যায় না। ঝড়ের সমুদ্রে এখন দুজনই উলঙ্গ হয়ে বোট সামলায়। এক আশ্চর্য সুষমা পৃথিবীর কোনো এক সুদূর সমুদ্রে, বোটে তারা দুজন। বোটে বাদাম তুলে দেওয়া হয়েছে। কম্পাস ঝড়ে ঝাপটায় অকেজো। পাটাতনের নিচে পড়ে আছে। একমাত্র ভরসা এলবা

গভীর অন্ধকার বলে সমুদ্রে কিছু থাকে না। অন্ধকারেরও এক গোপন আলো থাকে। সেই আলোতেও দেখতে পায় বোটের মাথায় বিশাল অ্যালব্রাটস পাখিটা বসে আছে। তাদের একমাত্র বিশ্বস্ত অনুচর। যতদিন অ্যালবাট্রস পাখিটা আছে, কেন জানি দুজনেরই মনে হয়, ঠিক তারা ডাঙায় পৌঁছে যাবে। যেন এই অ্যালবাট্রস পাখিটাই হাহাকার সমুদ্রে ঈশ্বরের করুণা হয়ে বিরাজ করছে। ছোটবাবুর প্রতি লেডি অ্যালবাট্রসের কোথাও কোনো কৃতজ্ঞতাবোধ থাকতে পারে। ছোটবাবু কত চেষ্টা করেছিল, ম্যান অ্যালবাট্রসটাকে বাঁচাবার। পারে নি। দুরাত্মা আর্চি তাকে খুন করেছে। আর্চি না ডেভিড। ডেভিড কোথায়! অন্য তিনটি বোটে যারা ভেসে গেল, তারা কি খবর দেয় নি! সামোয়া থেকে ভেসে যাবার প্রায় পক্ষকাল পরেই জাহাজটাকে এবানডান করে দিতে হয়েছে! জাহাজিরা বোট নিয়ে সমুদ্রে ভেসে পড়েছে!

ছোটবাবুকে ফেলে অ্যালবাট্রস পাখিটা কোথাও যাচ্ছে না। যেখানে ছোটবাবু, এলবাও সেখানে। কখনও বনির কেমন হিংসা হয় এলবাকে। তারা বোটে ঘুমিয়ে থাকলেও এলবা ঘুমায় না। মাথার কাছে বসে সে তাদের পাহাড়া দেয়। জেগে থাকে। এই এক মায়ায় পাখিটা জড়িয়ে রেখেছে তাদের। বনি বলছে, কী ছোটবাবু, তোমার ডার্লিং তো আজ উড়ে যাচ্ছে না। কোনো অসুখ-বিসুখ হয় নি তো!

কী সব অলুক্ষণে কথা বলছ বুঝি না। থাম তো

বারে, ডানায় ঠোঁট গুঁজে বসে আছে! উড়ছে না।

সত্যি তো! সকাল হলে পাখিটা বোট ছেড়ে চলে যায়। কোথায় যায় তারা যেন জানে। ডাঙা খুঁজতে যায়। উড়তে উড়তে দিগন্তে হারিয়ে যায়। আর দেখা যায় না। কেমন অদৃশ্য সব। সমুদ্র আর বোট, বোটে দুজন মানুষ। ডলফিন নেই এ সমুদ্রে। পাখিটা একদিন ঠিক ডাঙার খবর এনে দেবে।

কিছু সংকেত পাখিটার ইতিমধ্যেই তারা ধরে ফেলেছে।

পাখিটা বোট থেকে পাখা মেলে দেবার সময় গলা উঁচু করে দেবে। ঘাড় বাঁকিয়ে এ-দিক ও- দিক দেখবে। তাদের দুজনকে দেখবে। তারপর লাফিয়ে পাটাতনে নেমে আসবে। ছোটবাবু পেটে পিঠে হাত বুলিয়ে দিলেই উড়তে শুরু করবে। আদর ঠিক বোঝে।

উড়বে। সারাদিন উড়বে।

ঢেউ-এর উপর, দিগন্তের কাছাকাছি।

তারপর অদৃশ্য।

ঠিক সাঁজ লাগার সময় ছোটবাবু বসে থাকবে। বনি পাশে। পাখিটার ফিরে আসার অপেক্ষা। অ্যালবা এসে গেলেই যেন ঘরের সবাই ফিরে এল।

নিশ্চিন্তি।

যতক্ষণ না ফিরবে, কি এক আশঙ্কায় বুক কাঁপে। নিরুপায় সমুদ্রে তাদের ফেলে রেখে কোথায় গেল! কোনো কোনো দিন রাত হয়ে যায় বেশ। মনে হয় তখন, উড়তে উড়তে মনে থাকে না বোটের কথা, ছোটবাবুর কথা। সুখবরের আশায় ওড়ে। ডাঙার আশায় ওড়ে। পাখিটা আর উত্তপ্ত সমুদ্রের মধ্যে লড়ালড়ি শুরু হয়ে গেছে যেন। সমুদ্র চায়, বোট তার বুকে নিরন্তর ভেসে চলুক। অ্যালবাট্রস চায় ওদের দুজন ডাঙা পেয়ে যাক। ডাঙায় পৌঁছে দিতে পারলেই তার কাজ শেষ। ছোটবাবুর এমন এক বিশ্বাস বোটে ভাসতে ভাসতে গড়ে উঠেছে। পাখিটা যেন তার জীবনে কোনো শুভ প্রতীক।

সেই এলবা চুপচাপ বসে আছে। উড়ছে না। পাখিটা কি এই অজানা সমুদ্রের ষড়যন্ত্র টের পেয়ে গেছে। সেও কি তবে আর্চির প্রেতাত্মার শিকার!

আর্চির অশুভ প্রভাবে পড়ে যায় নি তো! আর্চির প্রভাব পাখিটাকে অসহায় করে দিতে পারে। সে তো সব পারে। প্রতিশোধের স্পৃহা কাজ করলে, সব পারে। শুধু প্রেতাত্মা কেন, মানুষও। এই প্রতিশোধ স্পৃহা থেকে পাখিটাকে ছোটবাবু রক্ষা করবে কী ভাবে!

ছোটবাবু দাঁড়িয়ে আছে। সমুদ্র নিথর। বোট ভাসছে। অনন্ত জলরাশি সামনে পেছনে। সূর্য সমুদ্রের দিগন্ত থেকে গোলার মতো ছুটে আসছে যেন। সে ডাকছিল, এলবা! এলবা! উড়ে যাচ্ছ না কেন! কী হয়েছে! একবার দেখে এস ডাঙা কতদূর!

পাখিটা ঘাড় গুঁজে রেখেছে ডানায়। কোনো অসুখ, হতেও পারে—সবই সেই প্রেতাত্মার কারসাজি। পাখিটাকে অচল করে দিতে পারলেই, আর্চির যেন ছুটি।

আবার ডাকছে’ ছোটবাবু, এলবা, এলবা। তুমি বল, এখন তুমি কে? তুমি আমাদের প্রিয় সেই লেডি অ্যালবাট্রস, না তুমি আর্চি! কে তুমি বল, বল! কারণ ছোটবাবু কবে যেন এই সমুদ্রে গভীর নিশীথে দেখেছে, পাটাতনে সে শুয়ে আছে। বনি তাকে জড়িয়ে শুয়ে আছে। আর পাখিটা তার বুকের উপর বসে আছে। গলা ঠুকরে শ্বাসনালীর ফুটো থেকে রক্ত চুষে খাচ্ছে। বনি এবং তার যেন এই শেষ পরিণতি।

পাখিটার চোখে দহন। ঘাড় বাঁকিয়ে দেখছে। এলবা রাতে কখনও কখনও কেমন অশুভ প্রভাবে পড়ে যায়। বনি আতঙ্কে পড়ে যাবে বলে ছোটবাবু বনিকে পাখিটার উপর আর্চির প্রভাবের কথা বলে নি। রাতে পাটাতনে জেগে গেলেই যেন দেখতে পায় এলবা ওর বুকের উপর দু-পাখা মেলে এসে বসেছে। যেন তার দুটো চোখ ঠুকরে খাবে। এটা কোনো ঘোর থেকে না স্মৃতিভ্রম থেকে সে টের পায় না।

ছোটবাবু আবার ডাকল, এলবা! আসলে ছোটবাবু চায় পাখিটা ঘাড় তুলে তাকে দেখুক। অন্যদিনের মতো উড়ে যাক। তারপরই ছোটবাবু কেমন পাগলের মতো দু-হাত উপরে তুলে হাঁকছে, তুমি কে? আর্চি কি তোমার উপর ভর করেছে। বল, বল তুমি রাতে এমন হয়ে যাও কেন! তুমি কি চাও?

কি হয়ে যাও ছোটবাবু! পাখিটার পেছনে কেন লাগছ! কি হয়েছে!

কিছু না। সব বলছি।

ছোটবাবু ছাড়ো, ছাড়ো বলছি। এলবার কি দোষ! সে কি করেছে! আমাকে জড়িয়ে ধরেছ কেন! কী হয়েছে! তুমি কেমন ঘোরে পড়ে যাচ্ছ। মাস্তুল থেকে পড়ে গেছিলে। মাথার ভেতর কী কোনো কষ্ট হচ্ছে!

ছোটবাবু কেমন পাগলের মতো পাখিটার দিকে তাকিয়ে বিড় বিড় করে বকছে, আমি জানি, তুমি আর্চির অনুসরণকারী, তুমি আমাদের অজানা সমুদ্রে এনে ছেড়ে দিয়েছ। আমার নিস্তার নেই।

বনি বুঝতে পারছে না, এমন সুন্দর সকালে ছোটবাবু পাখিটার পেছনে লেগেছে কেন! ছোটবাবুর মাঝে মাঝে কি যে হয়ে যায়! ভয়ে তাকে জড়িয়ে আছে। যেন পাখিটা আর পাখি নেই, কোনো অতিকায় সরীসৃপ—এগিয়ে আসছে তাদের গ্রাস করতে। ছোটবাবুর চোখ দেখে বনির এমনই মনে হচ্ছে। সে দেখল একসময় পাখিটাকে খুন করার জন্য যেন হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ছোটবাবু।

ছোটবাবু এটা কি করতে যাচ্ছ! বলে এক হ্যাঁচকায় ছোটবাবুকে টেনে এনে পাটাতনে দাঁড় করিয়ে দিল।

ছোটবাবুকে বনি দু-হাতে কোমরে জড়িয়ে ধরেছে। ছেড়ে দিলেই যেন পাখিটাকে খুন করতে ছুটবে।

কী হয়েছে বলবে তো! এলবা কী করেছে। ওর তো শরীর খারাপ হতে পারে। পারে না। তুমি এমন অবুঝ হলে কী করি বল তো! আমাদের আর কে আছে!

তখনই দেখল ছোটবাবুর ঘোলা ঘোলা চোখ। তার দিকে অসহায় করুণ চোখে তাকাচ্ছে। কে জানে, ছোটবাবু বনিকেও অবিশ্বাস করছে কি না! বনি আর এলবা দু’জনই শত্রুপক্ষ কিনা! বনি আবার বলল, কী হয়েছে বলবে তো!

আর্চি ভর করেছে!

আৰ্চি!

হ্যাঁ আর্চি। আর্চির প্রেতাত্মা!

কার উপর?

এলবার উপর। তোমার উপর।

মিছে কথা। মিছে কথা ছোটবাবু। তুমি আমাকে, এলবাকে বিশ্বাস কর, প্লিজ, বনি বুঝতে পারছে, সেই আতঙ্ক কখনও কখনও এমন গভীর প্রত্যয়ে ফেলে দেয় যে ছোটবাবু বিশ্বাসই করতে পারে না, এলবা কত নিরীহ, এলবা কত শাস্ত্র। এমন কি এই প্রত্যয় তাকেও অবিশ্বাসী করে তুলছে ছোটবাবুর কাছে। সে এবার আর পারল না। ছোটবাবুর বুকের উপর আছড়ে পড়ল। চিৎকার করে বলতে থাকল, দ্য লর্ড ইজ ওয়াচিং এভরি হোয়েয়ার অ্যাণ্ড কিপস হিজ আই অন বোথ দ্য ইভিল অ্যাণ্ড দ্য গুড। ছোটবাবু ভয় পেও না। বিশ্বাস হারিও না—প্লিজ ছোটবাবু।

ছোটবাবুর কাছে সহসা এক সকালে এলবা আর্টি হয়ে যাবে কে জানত! বনি আর্চি হয়ে যাবে কে জানত! সে দু-হাত উপরে তুলে যত জোরে সম্ভব চিৎকার করে উঠল—আই স্যাল কিল হিম। তুমি সর। তোমার কোনো কথা শুনব না।

বনি ধীরে ধীরে বলল, ছোটবাবু অ্যা ফুল থিংকস হি নিডস নো এডভাইস, বাট অ্যা ওয়াইজ ম্যান লিসেন টু আদারস। তুমি আমার কথা শোনো। আমাদের তুমি বিশ্বাস কর।

সরো বলছি। সরো

উড়ে উড়ে ক্লাক্ত হয়ে পড়েছে এলবা। প্লিজ।

মানি না। সকালে সে উড়ে না গেলে বোট কোনদিকে চালাব!

ছোটবাবুর আর কোনো অবলম্বন নেই। বোট ভেসে যাচ্ছে। জলে কলকল শব্দ। এলবা যেদিকে সকালে উড়ে যেতে থাকে সে বোট সেদিকে চালিয়ে নেয়। সেই এলবা সকাল থেকে জবুথবু হয়ে গেছে! আর্চি ছাড়া কে আছে দুরম্ভ এই পাখিকে আর্ত অসহায় করে তুলতে পারে। তার দুঃসময়ে পাখিটাই একমাত্র অবলম্বন ও বেঁচে থাকার সামান্য প্রেরণা, ডাঙা পাবার সামান্য ভরসা এই এলবা। আর্চি ছাড়া কে এমন দুরাত্মা থাকতে পারে তাকে জব্দ করার চেষ্টা করতে পারে। জাহাজে ওঠার পরই আর্চি তার পেছন নিয়েছিল। তাড়া করছিল। মরে গিয়েও প্রতিশোধ নেবার জন্য হন্যে হয়ে উঠেছে। এটা আর্চিরই কাজ। সে চিৎকার করে উঠল, অ্যালবা যদি তুমি এ মুহূর্তে উড়ে না যাও তবে মনে করব, ঠিক তুমি তার অশুভ প্রভাবে পড়ে গেছ। তুমি আমার মৃত্যু দেখতে চাও। চোখের উপর আমি বোটে মরে পড়ে থাকব, আর তোমরা সমুদ্রে ডানা মেলে আর্চির পোষা পাখি হয়ে থাকবে, কিছুতেই হতে দেব না।

বনিও ধস্তাধস্তি করছে। ছোটবাবুকে ধরে রাখতে পারছে না। চিৎকার করে বলছে, ইফ ইউ সার্চ ফর ব্লেসিং ইউ উইল ফাইনড গড’স ফেভার। ইফ ইয়ো সার্চ ফর ইভিল ইউ উইল ফাইণ্ড হিজ কার্স।

ছোটবাবুকে নিরস্ত করার জন্য বনি পাগলের মতো বলে যাচ্ছে, গড রেসকুজ গুড মেন ফ্রম ডেঞ্জার, হোয়াইল দ্য উইকেড ফল ইনটু ইট।

বনি বলেই যাচ্ছে, দ্য গুড সোল নেভার লুজ গড’স রেসিং, বাট দ্য উইকেড স্যাল লুজ এভরিথিং। ছোটবাবু বিশ্বাস কর, হোয়েন এন ইভিল ম্যান ডাইজ, হিজ হোপস অল পেরিস, ফর দেঁ আর বেসড আপন দিক্ত আদরলি লাইফ। প্লিজ আর্চিকে ভয় পেও না। হিজ হোপস অল পেরিস। দ্য উইকেড লুজ এভরিথিং। তুমি কেন মনে করছ ছোটবাবু আর্চি আমাদের তাড়া করছে। আর্চির প্রেতাত্মা তাড়া করছে!

বনি তুমি ঠিক বলছ, উইকেড লুজ এভরিথিং?

আমি ঠিকই বলছি। এগুলো তো আমার কথা নয়। ঈশ্বরের কথা। আমি কে বলবার।

অতীশ এবার বনিকে যেন সরাসরি প্রশ্ন করল, তবে ঈশ্বর তোমাকে রক্ষা করতে পারল না কেন! তুমি তো উইকেড নও। তুমি তো নিষ্পাপ, কেন দিনের পর দিন……।

—স্যার এটা আপনার ব্যাগ?

অতীশ চোখ তুলে ব্যাগটা দেখল। তারই মানিব্যাগ পকেট থেকে নিচে কখন পড়ে গেছিল। লোকটি সামনের সিটে বসে বলল, দেখুন সব ঠিক আছে কিনা।

অতীশ ব্যাগটা খুলে দেখল। না ঠিক আছে। টিকিটটা কোথায় রেখেছে! ব্যাগে, না পকেটে। এই রে! টিকিট তো ব্যাগে নেই! সে উঠে দাঁড়াল। পকেট হাতড়াল। কোথায় রাখল। মানিব্যাগে না অন্য কোথাও রেখেছে। তাড়াতাড়ি এটাচিটা নামিয়ে খুঁজতে থাকল। এইতো আছে! সে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। এবং তখনই মনে হল, ট্রেন ইন করছে। মনে পড়ল, টুটুল, মিণ্টু, রাজবাড়ি,—নির্মলাকে একা রেখে এসেছে। কারখানা, গো-স্লো, কুম্ভবাবু এই স্টেশন। মানুষজন, ভিড়; যেন আর এক গোলকধাঁধা। এতক্ষণ এক ঘোরে ছিল, এখন আবার আর এক ঘোরে পড়ে যাচ্ছে। টুটুল নির্মলার দরজায় রাতে ডেকে গেছে, মা, দরজা খোল। মা, মা, আমি টুটুল।

আবার তাড়া করেছে কেউ।

অতীশ প্রায় ছুটে বের হয়ে যাচ্ছে।

শুধু অতীশ কেন, স্টেশনের সবাইকে যেন কে তাড়া করছে। ভেড়ার পালের মতো ছুটছে সবাই। পেছনে কেউ তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সে কে? ধুস সে কেউ নয়। সেই আমি, আমি, আমার জন্মমৃত্যু বেঁচে থাকা। এর মধ্যে সে আবার আসে কেন! তার কোনো ইচ্ছেই পূরণ হয় না, আমার ইচ্ছে পূরণ করি আমি নিজে। আমার দুঃখ, আশঙ্কা আমার বেঁচে থাকার মধ্যে ভর করে থাকে। তুমি বুরবক ভাবছ ভয় দেখিয়ে কাবু করে রাখবে। রেখেছ কিছুটা। মজা লুটছ বেশ।

কার সঙ্গে সে কথা বলছে!

আরে সে যদি নাই থাকে, তবে এত লড়ালড়ি কার সঙ্গে হচ্ছে। কার ভয়ে সে ছুটে যাচ্ছে! কে জানে কি হয়েছে? মনের মধ্যে অসংখ্য কূট সংশয় কেন। জোর করে বলতেও পারছে না, তুমি একটা আস্ত ভূত। ছেলেবেলায় যেমন রাতে ভয় পেত একা বের হতে, সর্বত্র, অন্ধকারে, গাছের ডালে, পুকুড় পাড়ে কিংবা সোনালী বালির নদীতে—আর সেই ভূতটা, অতীশ মনে করতে পারছে, ঠাকুরদাকে পুকুরপাড়ে দাহ করার পর জ্যান্ত ভূত সে দেখেছে। সারা শরীর অদৃশ্য, অথচ মানুষের অবয়ব, চিতার মাঝখানে দাঁড়িয়ে নাচানাচি করছে, জোনাকি পোকার মতো জ্বলছে, উড়ছে, উড়ে যাচ্ছে। সে ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠেছিল। তারপর সংজ্ঞা হারিয়েছিল। জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকেছে। সে-সব কবেকার কথা!

শৈশব থেকেই কী তবে ভূতের তাড়ায় সে অস্থির! অথবা মাঝে মাঝে কেন মনে হয় তার কাঁধে কেউ ভর করে আছে। সে কাঁধে যেন সেই শৈশব থেকেই একটা বড় বোঝা চাপিয়ে নিয়েছে। ঘাড় ধরে গেছে, মাথা ঝিমঝিম করছে, ফেলে দিতে পারছে না। সে কী তবে আর্চির মৃতদেহ। সে ভেবেছিল, সমুদ্রের জলে ঠেলে ফেলে দিয়েছে, আসলে, ফেলতেই পারে নি। কাঁধে ঝুলে আছে। পেছনে মাথা ঝুলে আছে, সামনে পা। সে তাকে কোনো বেতালের মতো কেবল বহন করে চলেছে। কারখানায়, রাজার বাড়িতে, বাসে ট্রামে সর্বত্র সে একা উঠছে না। একা নামছে না। সঙ্গে আর কেউ উঠছে, নামছে। যত তাকে ফেলে দিয়ে নিস্তার পেতে চেয়েছে তত সে শক্ত করে জাপটে ধরেছে তাকে।

এ কী জ্বালা! জ্বালায় অস্থির।

একা হয়ে গেলে যেন শরীর আরও ভারি লাগে।

সে গিয়ে কী দেখবে জানে না।

বাসে সে দাঁড়িয়ে আছে। ঘামছিল। হাওয়া ঢুকছে না। পোকা মাকড়ের মতো সে বাসের মধ্যে ঘাপটি মেরে আছে। উঁকি দিয়ে দেখেছে কোথায় এল। দু-একবার। আর কটাস্টপ গেলেই, ইস আবার বাসটা জ্যামে পড়ে গেল! কী হবে! সাদেক মরচে পড়া বন্দুক হাতে রাজবাড়ি পাহারা দিচ্ছে। বউরাণী খোঁজ নিয়েছে ঠিক। সে নেই, নির্মলা নেই, নির্বোধ মেয়ের উপর এ-ভাবে বাচ্চা দুটোকে ফেলে রেখে কেউ যায়! অমানুষ। তা কি করব অমলা, তুমি চাও, নির্মলা দূরে কোথাও থাকুক। অন্দরে তুমি আছ, এবং আমি আছি। অন্দরের দিকের দরজায় বড় তালা ঝুলিয়ে দেব। কিছুতেই পাপ ঢুকতে দিচ্ছি না। তুমি কি জানো রাজবাড়ির সবাই জেনে গেছে।

কোথায় ওরা।

কে যেন বলল, জানি না।

দরজায় তালা। কেউ নেই। হাসু নেই। ওরা কোথায়।

কেউ বলতে পারছে না।

সবাই শুধু ওকে দেখছে।

এই লোকটা দুটো অবোধ শিশুকে রেখে বৌকে নিয়ে ফূর্তি লুটতে গেছিল। মনুষ্যত্ব নেই। তুই মা! তোর কষ্ট হল না! বাচ্চা দুটোকে ফেলে চাকরি করতে চলে গেলি! এত স্বার্থপর। যেন আঙুল তুলে সবাই তাকে দেখাচ্ছে, এই লোকটা বোঝলেন এই লোকটা দুটি শিশুর বাবা। কার ভরসায় রেখে গেলি। সুখি, ও আবার মানুষ! হাসু। ও তো ছেলেমানুষ। ওর দোষ কি! গেট খোলা পেয়ে মা বাবাকে খুঁজতে যেতেই পারে। কত ছেলেধরা শহরে ঘুরছে। কেউ তুলে নিয়ে গেছে!

অতীশ যত রাজবাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তত হাত-পা অবশ হয়ে আসছিল। ঐ তো দেবদারু গাছ, ঐ তো রাজবাড়ির গেট, আরে ঐ তো সাদেক। সে প্রায় ছুটে ঢুকে গিয়ে বলল, সাদেক, টুটুল মিণ্টু মানে…..

সাদেক উঠে সেলাম দেবার আগেই টুটুল গাড়িবারান্দার দিক থেকে ছুটে আসছে। অতীশ দেখছে, আসছে। আর সঙ্গে সঙ্গে যেন হাজার লক্ষ কবুতর উড়ে গেল মাথার উপর দিয়ে। যেন ঢাক বাজছে, ঢোল বাজছে—দশভুজার আরতি হচ্ছে, ধুনুচি মাথায় অতীশ নাচছে। প্রাণের ভিতর সাহস, এবং সমুদ্রের জোয়ার। সে দাঁড়াতে পারছিল না। শরীর অবশ, ক্লান্ত। তবু টুটুলকে বুকে তুলে নেবার জন্য ছুটে যেতেই দেখল, টুটুল ছুটে পালাচ্ছে। এবং চিৎকার করে ডাকছে, দিদি বাবা আসছে। যাকে দেখছে, খবর দিয়ে যাচ্ছে, বাবা আসছে। অতিথি ভবন, মেসবাড়ি পার হয়ে ছুটছে।

তার আর বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই। শরীর হালকা। সে এখন ইচ্ছে করলে শুধু আর্চি কেন এমন আরও দশটা অদৃশ্য আত্মার পীড়নকে হেলায় ছুঁড়ে দিতে পারে, লাল নীল বলের মতো খেলা দেখাতে পারে—কিংবা এক ট্রাপিজের খেলা, দুলছে, উড়ে গিয়ে ঝুলন্ত দড়ি ধরে ফেলতে পারছে।

নতুন বাড়ি পার হতেই দেখল ভাইবোন গলা জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে। হাসু দুরে দাঁড়িয়ে। দরজায় সুখি। দুপুরের রোদ মাথার উপর। আকাশ বড় বেশি নীল এবং ঝকমকে। ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। আশঙ্কা এবং আতঙ্ক দূর হয়ে গেলে সে হেসে দিল। যেন এক যুদ্ধ জয়ের মতো হাসি, কিংবা কোনো অশ্বারোহী পুরুষ অন্ধকারে রাস্তা হারিয়ে দিক বিদিক ছুটে গেছে। সকালের আলো ফুটতেই টের পেয়েছে, না রাস্তা সে হারায় নি, সে ঠিকই নদী পার হয়ে গন্তব্যস্থলের দিকে রওনা হয়েছে।

টুটুল ছুটে ঘরে ঢুকে গেল। কেমন ব্যাজার মুখ। মিণ্টু বাবার হাত থেকে এটাচিটা নিতে চাইল। হাঁটছে পাশে পাশে।

অতীশ মিণ্টুকে বুকে তুলে নিল। বলল, পারবি না মা।

আমি পারব। দাও না!

টুটুল কান্নাকাটি করে নি তো?

না। জান বাবা, টুটুল’ না সারাক্ষণ গেটে গিয়ে বসে থেকেছে। কিছুতেই আসবে না। কাকা কত বুঝিয়েছে জান! কিছুতেই নড়ল না!

ঘরে ঢুকে অতীশ আবার হাহাকারের মধ্যে পড়ে গেল। কেমন ফাঁকা ফাঁকা ঠেকছে সব। একজন না থাকলে ঘরবাড়ি এত ফাঁকা লাগে আগে যেন টের পায় নি। শ্রান্ত অবসন্ন অতীশ আর দাঁড়াতে পারল না। তক্তপোশে বসে পড়ল। এটাচিটা দেয়ালের দিকে রাখতে গিয়ে মনে হল, টুটুল ওঘরে কিছু করছে। টুটুল চুপচাপ থাকার ছেলে না। সে এত চুপচাপ! কী করছে! আর ভিতরে ঢুকে দেখল, বিছানায় উপুড় হয়ে টুটুল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। বাবা ফিরে এসেছে, মা কোথায়? যেন জেনে ফেলেছে, বাবা মাকে কোথাও রেখে ফিরে এসেছে। বাবা তার নিষ্ঠুর। বাবার সঙ্গে সে হয়তো কথাই আর বলবে না। অতীশ কোনোরকমে বলল, জল দে সুখি।

মিণ্টু ছুটে বাবার জন্য জল আনতে গেছে। সুখিদিকে সে কিছুতেই জল নিয়ে আসতে দেবে না।

কেবল বলছে, আমায় দাও। আমি পারব। বাবা যে তার ভাল নেই চোখ মুখ দেখেই বুঝেছে।

অতীশ জল খেল। উঠতে ইচ্ছে করছে না। কেবল ডাকছে, টুটুল কাঁদছিস কেন! তোর মা শনিবার আসবে। কী বোকা ছেলেরে! কত কিছু তোর জন্য নিয়ে আসবে দেখবি।

টুটুল নড়ছে না।

অতীশ এবার উঠে গিয়ে তার প্রিয় শিশুর মাথায় হাত রেখে বলল, কীরে কত বড় হয়ে গেছিস! তুই কী বোকারে। বড় হলে কেউ কাঁদে! কত সুন্দর জায়গা। আমরা মাঝে মাঝে বেড়াতে যাব। কী মজা হবে দেখবি। তোর মা বাস-স্ট্যাণ্ডে এসে দাঁড়িয়ে থাকবে। কেবল বলবে টুটুল কোথায়। আমার টুটুল। আয়। সকালে কী খেয়েছিস? স্নান হয়নি? কীরে তুই। মিণ্টুর স্নান হয়ে গেছে! হাসু তোর! আমরা একসঙ্গে খেতে বসব। কী মজা। এই সুখি টুটুলবাবুর জন্য কী রান্না করলি। টুটুলবাবু আজ আমার সঙ্গে খাবে। কী টুটুলবাবু খাবে তো? আমরা রেলগাড়িতে যাব। হুস করে গাড়ি ছেড়ে দেবে। রেলগাড়িতে খাব, বাস-স্ট্যাণ্ডে খাব, তোমার মা খাবে, আমি খাব, মিণ্টু খাবে।

না দিদি খাবে না। টুটুলের কান্না থেমে গেল।

আচ্ছা খাবে না। আর কে কে খাবে না বল এবার।

টুটুল আর কে কে খাবে না বলতে পারল না। কেবল বলল, তুমি বাবা রেলগাড়ি কিনে দেবে না আমায়?

ওটা তোমার মা দেবে।

আস্ত রেলগাড়ি!

আস্ত মানে, একেবারে গোটা রেলগাড়ি।

টুটুল এবার আরও খুশি হয়ে বলল, রাজার টুপি কিনে দেবে না?

রাজার টুপি!

বারে তুমি যে বলেছিলে, রেলগাড়ি, রাজার টুপি সব কিনে দেবে মা ভাল হয়ে গেলে! অতীশ টের পেল ঠিক মনে রেখেছে। হাসপাতাল থেকে ফিরে আসার সময় রাস্তায় বায়না ধরলে বলেছিল, তোমার মা ভাল হয়ে উঠুক সব কিনে দেব। রেলগাড়ি রাজার টুপি—আরও যেন কী চাই!

অতীশ বলল, সর্ব দেব। দেব বলেই তো, তোমার মাকে রেখে এলাম। দেব বলেই তো ফিরে এলাম। আমি না দিলে কে দেবে! তোমার মা না দিলে কে দেবে!

এবং এই রাজার টুপি চাই টুটুলের। সবারই চাই রাজার টুপি। অতীশের মনে হল কবে থেকেই সে রাজার টুপি খুঁজে বেড়াচ্ছে। কিন্তু কোথায় পাওয়া যায় সে জানে না। টুপিটার খোঁজেই সে বের হয়ে পড়েছে। সে খুঁজছে। শৈশবের তরমুজের জমিতে, ফতিমার নাকের নথে, আশ্বিনের কুকুরের সঙ্গে হেঁটে যেতে যেতে খুঁজেছে। ঈশমদাদার তরমুজের জমিতে বসে থাকার সময় সোনালি বালির নদীর চরে কে যেন হেঁটে যায় দেখতে পেত। সে আর এক পরম পুরুষ, তার পাগল জ্যাঠামশাই। একবার জ্যাঠামশাই হাতিতে চড়ে নিখোঁজ হয়ে গেছিলেন। তাঁরও কী চাই রাজার টুপি! কে জানে!

কতদিন পর আজ সে ফতিমার কথা মনে করতে পারল। দুরন্ত সেই মেয়েটা কত বড় হয়ে গেছে কে জানে। তারও টুটুল মিণ্টু থাকতে পারে। ফতিমা কোথায় আছে জানে না। ঈশমদাদার খবরও কিছু রাখে না। গোপাটে কে এখন ছুটে বেড়ায়, কিংবা কে দাঁড়িয়ে থাকে সেই অর্জুন গাছের নিচে! সেখানে কার শৈশব খেলা করে!

কেন জানি ইচ্ছে হয়, সেই শৈশবে যদি টুটুল মিণ্টুকে নিয়ে যেতে পারত। অর্জুন গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকত সে। সে আরও একজন। সে কে? নির্মলা, বনি, ফতিমা, যে কেউ হতে পারত। এরা তো কেউ তার পর নয়।

আশ্চর্য সেই ফতিমার মুখ আর সে মনে করতে পারছে না। যব গমের খেত থেকে যখন উঠে দাঁড়াত কিংবা গোপাটে ছাগল নিয়ে আসত, অথবা কতদিন পাগল জ্যাঠামশাই-এর হাত ধরে যাবার সময় ফতিমা পেছন থেকে সঙ্গ নিয়েছে। সোনাবাবুকে দেখলেই খুশি। সোনাবাবুকে ছুঁয়ে দিতে পারলেই খুশি।

না সে কিছুতেই ফতিমার মুখ মনে করতে পারল না। মিণ্টু এসে কাছে দাঁড়াতেই, কেন জানি মনে হল, আরে একেবারে হুবহু সেই মুখ না। সহসা সে যেন আবিষ্কার করল মিণ্টুর মুখের সঙ্গে ফতিমার মুখের আশ্চর্য মিল। তবে কি থাকে কোনো গোপন ইচ্ছে, রক্তে খেলা করে, শুধু খেলা করে, তারপর সেই ইচ্ছা কখনও টুপ করে তারা হয়ে খসে পড়ে। অতীশ মিণ্টুকে ডাকল, কাছে আয়। বলে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেল গালে।

টুটুল গাল বাড়িয়ে দিল, বাবা আমায় হাম দেবে না! মিণ্টু তখন ছাড়া পেয়ে পালাচ্ছে। বলছে, ইস বাবাটা না কি বোকা!

তখনই সুখির গলা পেল, তোমরা কাকাকে জ্বালাচ্ছ। কাকা স্নান করতে যাবে না!

আরে এও যে সেই অধিকারের ক্ষেত্র তৈরি করতে চায়! একদিনেই সুখি বাসাবাড়িটাকে ঝকঝকে করে তুলেছে। একজন নারী যেমন পুরুষের প্রতীক্ষায় বসে থাকে ঘর সাজিয়ে সুখিরও যেন তাই। এতটা অধিকার সে পছন্দ করে না। বাড়াবাড়ি, এবং কোনো ব্যভিচারের ঘ্রাণ পেলে বলল, এত বেলা হল এখনও তোর রান্না হয় নি! ওরা না খেয়ে আছে! স্নানটান পর্যন্ত করে নি। দেড়টা বাজে! সুখি দরজার ও-পাশ থেকে শুনছে। শুনে বেশ আহ্লাদি গলায় বলল, আমার কি দোষ! রান্না তো কখন হয়ে গেছে। টুটুলকে ধরে আনলে, মিণ্টু গিয়ে রাজাবাড়ির গাড়িবারান্দায় বসে থাকে। মিণ্টুকে ধরে আনলে টুটুল। আমি পারি নি —কেবল এক কথা বাবা আসবে। হাসুকাকাও পারে নি। কেবল এক কথা মা আসবে।

তা নাই পারতে পারে। অন্দর মহলের ভিতর দিয়ে সহজেই বিশাল প্রাসাদের সামনের দিকটায় চলে যাওয়া যায়। মিণ্টু টুটুল কখনও নতুন বাড়ি কিংবা বাগানের রাস্তা ধরে ছুটে যায় না। রাজবাড়ির অন্দরমহল থেকে সোজা একটা করিডর চলে গেছে প্রাইভেট অফিসের দিকে। হলঘরের মতো সব ঘর পার হয়ে গেলে নাটমঞ্চ। তারপরই প্রাইভেট অফিস। রাজার আমলারা পর্যন্ত কিছু বলে না। অতীশবাবু বউরাণীমার দেশের ছেলে। সবার চেয়ে যেন অধিকার একটু বেশি। টুটুল মিণ্টুর এই আবিষ্কারের রাস্তাটায় কেউ এসে দাঁড়ায় না। বাধা দেয় না। দারোয়ান, খানসামা, ঝি, চাকরবাকর সবাই তাদের বন্ধু। আর এ-সময়েই অতীশ দেখল, পুরানো খবরের কাগজের পাতায় ছবি—বন্যায় ঘরবাড়ি ভেসে গেছে। জলবন্দী। দুটি শিশু উলঙ্গ। নৌকায় তারা বের হয়েছে খাবারের খোঁজে। নিচে লেখা—চিলড্রেন অফ অ্যা ম্যারোনড ফেমিলি ইন সার্চ অফ ফুড ইন দ্য রায়গঞ্জ ব্লক।

ইন সার্চ অফ ফুড বড় মারাত্মক ব্যাধি মানুষের। সে নিজেও এমন এক নিরাপত্তাবোধের অভাবে ভুগতে ভুগতে শেযে এই রাজবাড়ি। তার সন্তান যদি কখনও উপবাসে থাকে—ভয়ে সে কেমন ছবিটা থেকে চোখ ফেরাতে পারল না। উপববাসের কী কষ্ট এক জীবনে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। সব সহ্য করতে পারে—কিন্তু তার দুই সন্তানের বেলায় এমন যদি কোনোদিন ঘটে, সে তবে নির্ঘাত মাথা ঠিক রাখতে পারবে না। নির্মলার চাকরিটা কত যে জরুরী কেউ যদি বুঝত! কত রকমের যে উদ্বেগ মানুষের! ঈশ্বর কিংবা প্রেতাত্মা শুধু তাকে তাড়া করছে না। স্নেহ মায়া মমতা, প্রেম এবং শরীরে থাকে যৌন বিলাস, যা থেকে কবে যে কার মুক্তি সে বুঝতে পারে না। মর্যাদাবোধ মানুষের আর এক তাড়া। সব নিয়ে সে কেমন মাঝে মাঝে ঝড় বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে যায়। ঘন বর্ষণ, দূরে মেঘের মধ্যে বিদ্যুতের উদ্দাম নৃত্য, কড়াত করে বাজ পড়লে সে হতবাক হয়। সবুজ শস্যক্ষেত্র কত দরকার টের পায়। দু-পাশে তার দুই শিশু। সে হেঁটে যায়। শিশুরা দৌড়ায়। কোথাও বাবা তাদের জন্য নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছে। শিশুরা এটা ঠিক টের পায়।

টুটুল হাত ধরে টানছে, বাবা চান করবে এস।

অতীশ উঠে দাঁড়াল।

তারপর সে হাসু, টুটুল খেতে বসল একসঙ্গে। অতীশই চান করিয়ে দিয়েছে টুটুলকে। বাবা চান না করিয়ে দিলে চান করতে পারে না, মিণ্টু বাবার সঙ্গে চান করতে লজ্জা পায়। এমন কি মিণ্টু বাবার সামনে প্যান্ট খুলতেও লজ্জা পায়।

অতীশ জানে, সবই বড় হবার লক্ষণ

মিণ্টু বলল, বাবা আমি পরে খাব।

কেন?

বারে কি লাগবে তোমার, আমি সব দেব।

তোর খিদে পায় নি! সুখি তো দিচ্ছে। না আমি দেব।

অধিকার। অতীশ হাসল।

পারবি?

দেখ না পারি কিনা?

মিণ্টুর এ-ধরনের পাকামি আগেও সে লক্ষ্য করেছে। ধমক দিয়েছে। বলছি পারবি না! ফেললে তো সব। মিণ্টুর তখন যে কী রাগ! বাবা তাকে বকেছে। সে কি ইচ্ছে করে ফেলেছে!

মিণ্টু বাবার থালা এনে দিল, জলের গ্লাস রাখল! টুটুলকে, হাসুকাকাকে দিল। অতীশ বলল, ঠিক আছে এবারে তুইও বসে পড়। কিন্তু মিণ্টু বসল না। সে তার মার ভূমিকা সহজে সুখির হাতে ছেড়ে দিতে রাজি না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *