1 of 2

ঈশ্বরের বাগান – ৩৭

॥ সাঁইত্রিশ ॥

গভীর রাতে মনে হল কেউ কাঁদছে।

অতীশ পাশ ফিরে শুল। তার ঘুম আসছিল না। সে মনের ভুল ভেবে আবার একশ থেকে গোনা শুরু করল। একশ, নিরানব্বই, আটনব্বই, সাতানব্বই—ঘুম না এলে সে চেষ্টা করে এভাবে গোনার। কোনো কোনোদিন সে টের পায় না কখন ঘুমিয়ে পড়েছে। মাঝে মাঝেই অনিদ্রার অসুখে সে ভোগে। রাজ্যের চিন্তা মাথায় জট পাকাতে থাকলে মানুষ বোধ হয় এভাবেই না ঘুমিয়ে থাকে। যত দিন যাচ্ছে তত টের পায় মানুষের নিরন্তর থাকে এক গভীর অ-সুখ। সে তারই শিকার।

বালিশটা শক্ত ঠেকছে। সে উঠে বসল। বালিশটা থাবড়া মেরে নরম করার চেষ্টা করল। আজকাল মাঝে মাঝেই সে এটা করে। যেন শক্ত বালিশের জন্য ঘুম আসছে না। তার ঘরে জিরো পাওয়ারের নীল রঙের বাল্ব জ্বালা থাকে। সে দেখল, হাসুর গঞ্জীর, ঘুম। তার কেমন হাসুকে এ সময় হিংসে হয়। হাসুর গায়ের লেপ সরে গেছে। সে লেপটা টেনে দিল। হাসু আসার পর সে আর হাসু কদিন হল এক বিছানায় শোয়। নির্মলা পাশের ঘরে টুটুল মিণ্টুকে নিয়ে শোয়। তার অভ্যাস নির্মলাকে পাশে নিয়ে শোবার। টুটুল মিণ্টু বড় হয়ে যাবার পর, নির্মলা তাদের নিয়ে শোয়। ওরা ঘুমিয়ে পড়লে খুব সতর্ক পায়ে এ-ঘরে চলে আসে।

হাসু আসার পর থেকে নির্মলার আর এ-ঘরে আসা হয় না। নির্মলা পাশে না থাকায় তার ঘুমের অসুখটা যেন আরও বেড়ে গেছে। আজ অবশ্য ঘুম না হবারই কথা। সকালে নির্মলা আর সে চলে যাবে। এ কদিন হাসু ভাইপো ভাইঝিকে আগলে রাখবে। সে ফিরে এলে হাসু বাড়ি চলে যাবে। কথা আছে, টুটুল মিণ্টু ঘুম থেকে জেগে ওঠার আগেই তাদের বের হয়ে পড়ার। ব্ল্যাকডায়মণ্ড ধরে না গেলে এগারোটার মধ্যে নির্মলা স্কুলে হাজিরা দিতে পারবে না। তার কালই কাজে জয়েন করার দিন।

প্রবাসে নির্মলার থাকার জন্য আজ সারাদিনই কেনাকাটায় ব্যস্ত ছিল। বিছানা, রান্নার স্টোভ, দু-হপ্তার মতো চাল ডাল আলু, একটা নতুন লেদার সুটকেস, আয়না চিরুনি সব মিলিয়ে নেওয়া হয়েছে। শুতে শুতে এগারোটা বেজে গেছিল—এখন কত রাত—রাজবাড়ির সদরে প্রহরে প্রহরে ঘণ্টা বাজে। রাত একটা সে টের পেল।

গভীর রাতে কেউ কাঁদে এমন মনে হল কেন তার! নির্মলা কি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। তার মনের ভুল নাও হতে পারে। সে ভিতরে অস্বস্তিবোধ করছিল। নাড়ির টান, নাড়ি ছিঁড়ে গেলে কি এই হয়! টুটুল মিণ্টুকে ছেড়ে নির্মলার থাকতে কষ্ট হবে আচরণে কখনও সে তা টের পায় নি। বরং সব সময় যেন নির্মলা কোনো বন্ধন থেকে মুক্তি পেয়ে গেছে এমনই ভেবেছে। নির্মলা যে মানসিক অবসাদে ভুগত চাকরির নিয়োগপত্র পাবার পর তা আর নেই। কেবল এক কথা তার, সকাল সকাল অফিস থেকে চলে এস। কফিহাউসে যেও না। ওখানে গেলে তোমার বাড়ির কথা মনে থাকে না। কদিন থেকে সুখিকে শিখিয়ে পড়িয়ে এ-সংসারের জন্য রপ্ত করে তুলেছে। সকালে কাকাকে ডিম ভেজে দিবি। টুটুলকে দুটো মিষ্টি দিস। বেশি দিবি না। ট্রাম রাস্তা দেখে শুনে পার হবি। যা দুরন্ত মেয়ে! টুটুলকে সঙ্গে নিস না। দারোয়ানের কাছে রেখে যাবি। দরজায় তালা লাগিয়ে টেনে দেখবি।

আজও সারাটা দিন এই করে গেছে।

টুটুলের এক কথা, মা আমি যাব।

হ্যাঁ যাবে। খাও তো। এক দণ্ড সুস্থির হয়ে বসতে শেখ নি। দ্যাখো কাকা ও-ঘরে কী করছে।

মিণ্টু বোঝে। সে টু-তে পড়ে। আজকালকার ছেলে মেয়েরা একটু বেশি তাড়াতাড়ি যেন সব বুঝতে পারে। এক কথা, মা তুমি কবে আসবে?

ছুটি পেলেই চলে আসব। তোমরা কিন্তু দুষ্টুমি করবে না। বাবাকে কষ্ট দিও না। বাবা যা বলে শুনবে। সুখিদির কথা শুনবে। পুকুরে যাবে না। ভাইকে দেখে রেখ।

মিণ্টুর আবার এক কথা—আমি সব পারব। জান মা আমি না বাবার জামা প্যান্ট কাচতে পারি। তুমি সব পার। লক্ষ্মী হয়ে থাকবে কেমন!

মিণ্টু ঘাড় কাত করে বলেছিল, আমরা বাবাকে নিয়ে তোমার কাছে বেড়াতে যাব, না মা?

নির্মলা কেন যে তখন তাড়াতাড়ি করিডর ধরে রান্নাঘরের দিকে ছুটে গেছিল। কোনো কাজে? না, সে নিজেকে সামলাতে পারে নি। অথচ মুহূর্তের জন্যও নির্মলার চোখে মুখে বিষাদের ছায়া দেখতে পায় নি। নির্মলা কি তবে গোপনে তার কষ্ট নিজের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে!

ঘড়িতে এলার্ম পর্যন্ত দেয় নি অতীশ। কারণ টুটুল মিণ্টু জেগে যেতে পারে। যাবার সময় ভাইবোন মিলে অস্থির হয়ে উঠলে কী হবে বলা মুশকিল! ট্যাকসিওয়ালাকে বলে রেখেছে। ব্ল্যাকডায়মণ্ড ধরিয়ে দেবে। এত সকালে টুটুল মিণ্টুর ঘুম ভাঙে না। কে জানে, মা চলে যাবে ভেবে ভিতরে ভিতরে মেয়েটা যদি অস্থির হয়ে থাকে, খুব সকালেও ঘুম ভেঙে যেতে পারে। নিরপত্তাবোধের অভাব থেকে কী হবে বলা যায় না। একজন নারী জীবনের যুদ্ধক্ষেত্রে পাশে থাকা কত দরকার অতীশ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। সে নিরুপায়। নির্মলার ভাল রেজাল্ট, বিটিতেও সেরা ছাত্রী, এত সব হওয়া সত্ত্বেও মুরুব্বির জোর নেই বলে গাঁয়ে মেয়েদের স্কুলে চাকরি নিয়ে চলে যাচ্ছে। চারপাশের লড়াই দেখে বুঝেছে, একজনের উপার্জনে দুটো সংসার চলে না। ভবিষ্যৎ বলে কথা।

ইদানীং অনিদ্রার রোগ তার আরও বেড়েছে। সে কাউকে বুঝতে দেয় না। সকালে প্রচণ্ড হাই ওঠে। নিজের মতো করে সে কিছু কিছু উপায় বের করে নিয়েছিল, যেমন সংখ্যা গুণে যাওয়া—আসলে দুশ্চিন্তার হাত থেকে নিস্তার পেতে হলে এগুলো দরকার—যেমন সে আরও সব উপায় উদ্ভাবন করেছে। কারখানার নাভিশ্বাস উঠেছে বলতে গেলে। সে ম্যানেজার বলেই দায়-দায়িত্ব তার বিছানায় গেলে সব কেমন মগজের মধ্যে পোকার মতো কামড়ায়। সে তখন তার শৈশবের ঘরবাড়ি গোপাট-এবং শস্যক্ষেত্রের মধ্যে লুকিয়ে পড়ে। যব গমের খেতে কখনও উবু হয়ে বসে থাকে। অথবা সোনালি বালির নদীর চরে সেই তরমুজের খেত, নদীর জল, পাখি এবং গাছপালার গভীর অরণ্যে ঢুকে গেলেও দেখেছে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ে। আবার সে যখন টের পায়, ওতেও কাজ হচ্ছে না, ঘুম আসছে না, দূরবর্তী কোনো নক্ষত্রের সন্ধানে থাকে। সমুদ্র এবং কোনো ভাসমান সাদা বোটে ভেসে যাচ্ছে সে, অনন্ত জলরাশি, অসীম আকাশ এবং বিন্দুবৎ সেই অ্যালবাট্রস পাখিটাকে দিগন্তে দেখতে পায়। এক নারী শুয়ে আছে পাটাতনে। সে দাঁড়িয়ে আছে বোটে প্রাচীন নাবিকের মতো। নোনা ঢেউ গা ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। উন্মাদের মতো খুঁজছে ডাঙা। যেন নিরবধি কাল এই যাত্রার সঙ্গী—যার শেষ নেই। যা অশেষ।

আবার শুনল, কেউ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। পাশে, একেবারে শিয়রের কাছে কেউ দাঁড়িয়ে কাঁদছে। চোখ তুলে দেখল—কেউ শিয়রে দাঁড়িয়ে নেই। ঘর ফাঁকা। নীল রঙের জিরো পাওয়ারের বাল্বটা শুধু জ্বলছে। সে উঠে বসল। পাশাপাশি ঘর। নির্মলা ও-ঘরে—ভিতরে অস্বস্তি হচ্ছে। যেতেও সাহস পাচ্ছে না। যদি যাবার আগে সত্যি ভেঙে পড়ে! সে কীভাবে বোঝ প্রবোধ দেবে এবং এইসব মনে হলেই নিরুপায় জীবনের কথা মনে হয়।

মানুষ কোথাও সঠিকভাবে দাঁড়িয়ে নেই। নির্মলাকে দেখে বোঝার উপায়ই ছিল না, যাবার আগে সে গোপনে কাঁদতে পারে। তার মনের ভুল, এটা কিছুতেই ভাবতে পারছে না। আস্তে করে সতর্ক পায়ে ও-ঘরে গিয়ে অবাক—অঘোরে ঘুমোচ্ছে নির্মলা।

সে বলেই রেখেছিল, আমি ঠিক জাগিয়ে দেব। রাত থাকতে উঠতে হবে ভেবে দুশ্চিন্তা কর না।

তার উপর নির্মলার পরম নির্ভর—সে জানে মানুষটা কথার খেলাপ জানে না। ঠিক সময় মতো জাগিয়ে দেবে। এবং একটু বেশিই যেন সে সতর্ক জীবনযাপনে—অন্তত নির্মলা এ-কবছরে এটা টের পেয়েছে। এই অতি সতর্কতার জন্যই যে সে পীড়নেও পড়ে যায় নির্মলা তাও জানে।

তবু থাকে কান্নার কোনো মানে। সে কি নিজেই তবে ঘোরের মধ্যে ছিল? তার যে ভিতরে রক্তপাত ঘটছে, আজ পর্যন্ত কাউকে টের পেতে দেয় নি। যেমন সংসারে দরকার মতো, কেউ কাছে থাকে কেউ দূরে চলে যায়, তেমনি এক আচরণ ছিল তার। আজ হয়তো ভিতরের কষ্টটা বেশি, তার ভিতরেই অদৃশ্য কোনো কষ্ট তাকে পাগল করে দিচ্ছে।

বাথরুমে ঢুকে ঘাড়ে গলায় জল দিল অতীশ। চোখে জলের ঝাপটা দিল। বাথরুমের বাইরের চাতালে অন্যমনস্ক এক মানুষ হেঁটে গেল। আস্তে আলো জ্বেলে ঘড়ি দেখে বুঝল রাত দেড়টা বেজে গেছে। এখন ঘুমাবার চেষ্টা বিড়ম্বনার শামিল। যদি সত্যি ঘুমিয়ে পড়ে, তবে উঠতে বেলা হয়ে যেতে পারে—এসব সাত পাঁচ চিন্তায় আর যে ঘুম হবে না বুঝেই দরজাটা আস্তে ভেজিয়ে টেবিলে বসে পড়ল।

টেবিলে সে বসেই আছে।

সে কেন টেবিলে বসে পড়ল জানে না। মাথায় কোনো লেখা নেই। সে দিনলিপি গোছের কিছু রাখছে। সাধারণত রাতে শোবার আগে লেখে। কিন্তু আজ এত ব্যস্ত ছিল যে লেখার কথা মনে হয় নি।

অন্তত দিনলিপির কাজটুকু সেরে রাখতে পারে। আসলে রাত কাবার করে দিতে হবে যা হোক একটা কিছু করে। দিনলিপি অবশ্য রোজ রাখা হয় না। বিশেষ বিশেষ দিনগুলি দিনলিপির পাতায় জায়গা পায়।

আজ তো তার সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য দিন। নির্মলা তাকে ছেড়ে প্রবাসে চাকরি নিয়ে যাচ্ছে।

সে তারিখ লিখল।

তারপর লিখল—সারাদিন কেনাকাটায় ব্যস্ত ছিলাম। কী লাগবে না লাগবে নির্মলা ঠিক বুঝতে পারছে না। গাঁয়ের স্কুলে চাকরি। সবুজ শস্যক্ষেত্রই যে শুধু নয়, রুখা মাঠও থাকে, বৃষ্টিপাতের সঙ্গে ঝড়ের তাণ্ডব থাকে—নির্মলা তা জানে না। যেন সে সেখানে কোনো ঋযির তপোবনে ফুল তুলতে যাচ্ছে। অতীশের মুখে হাসি ফুটে উঠল। বিষাদ এবং বিব্রত হাসি।

লিখল, নির্মলা চলে গেলে এই ঘরবাড়িতে আমি একা। টুটুল মিণ্টু অবলম্বন। সন্তান কি বাবা- মাকে বেঁধে রাখে? রাখতে নাও পারে। আসলে সে কি নির্মলাকে আজকাল সন্দেহ করছে? নির্মলার সেখানে একা ভাল লাগতে পারে না। তারপরই মনে হল, দিনলিপিতে এগুলো লেখা ঠিক না। সে ভাল করে কেটে দিল। নির্মলা দিনলিপি মাঝে মাঝে একলা থাকলে সময় কাটানোর জন্য পড়ে। সে যে একটা সংশয়ে পড়ে গেছে যদি দিনলিপিতে উল্লেখ থাকে নির্মলা কষ্ট পাবে। নির্মলা তো ছেলেমেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই বনবাসে যাচ্ছে।

জানালায় এবার চোখ রাখল। তার আজ কিছুতেই মন বসছে না। সে বার বার ঘড়ি দেখছে। চাতালে বের হয়ে আকাশ দেখছে। ভিতরে ঢুকে একবার কী ভেবে আলোটা নিভিয়ে দিল। ঠিক চারটা বাজলে নির্মলার চাদরের উপর হাত রেখে নাড়া দিল। যেন দুজনেই কোনো বড় রকমের অপরাধে লিপ্ত—ওদের কথাবার্তা ঈশারায়। পাশে মাকে জড়িয়ে টুটুল ঘুমোচ্ছে। নির্মলা খুব আস্তে হাতটা সরিয়ে মশারির বাইরে নেমে এল।

বারান্দায় ডেকে নিয়ে বলল, হাসুকে তুলে দাও। আমি বাথরুমে যাচ্ছি। কটা বাজে?

করিডর ধরে হাঁটার সময় কী মনে হতেই নির্মলা বলল, তুমি গিয়ে সুখিকে ডেকে আন।

সুখি ঠিক চলে আসবে। যাবার দরকার নেই।

বাথরুমে ঢোকার আগে ফের কী ভেবে বলল, স্টোভ জ্বেলে চা-টা বসিয়ে দাও।

অতীশ স্টোভ জ্বেলে দেবার আগে ঠিক আগের মতোই সতর্ক পায়ে নিজের ঘরে এল। মশারি তুলে নাড়া দিল হাসুকে। কেবল দুজনের যাতে ঘুম ভেঙে না যায় আজ তার জন্য এই ফিসফাস কথাবার্তা। তারা দুই ছোট্ট শিশু। টুটুল মা-ছাড়া থাকবে ভাবতেই সে কেমন ফের নাড়া খেল। সে স্টোভ জ্বেলে চা বসিয়ে আস্তে বলল, হাসু শোন। প্লেটগুলো নামা। আস্তে নামাস।

এখন যেন এই বাসাবাড়িতে কোনো রহস্যময় ছবির মতো সবার গতিবিধি।

সদর খুলে রেখেছে। একবার উঁকি দিয়ে অতীশ দেখে এল, সুখি দেরি করছে কেন! সুখি জলখাবার করে দেবে। সঙ্গে ভাল টিফিন না রাখলে, তারা রাস্তায় কষ্ট পাবে। কলা পাউরুটি ডিমসেদ্ধ আলুসেদ্ধ গোলমরিচ, এক প্যাকেট সন্দেশ। বর্ধমান থেকে নটায় বাস। বাস স্ট্যাণ্ডে গিয়ে আগে থেকে উঠে বসতে হবে। বসতে না পারলে সারাটা রাস্তা দাঁড়িয়ে—প্রায় এক দেড় ঘণ্টার পথ। বসতে না পারলে পরের বাস ছাড়া গতি নেই। সে-বাসটা পৌনে দশটায় ছাড়ে। এত সব আশঙ্কার তাড়া কদিন থেকে। যেন কোনো যুদ্ধক্ষেত্রে অতীশ হাজির। স্কুলে পৌঁছেই রিপোর্ট করা, তারপর কখন ছুটি, কখন রান্না, কখন দুজনে মুখোমুখি খিচুড়ি খেতে বসবে জানে না।

ফ্লাসকে চা নিতে হবে। রাস্তার জল নির্মলা খায় না। ওর অসুখ বিসুখের বড় ভয়। বোতলে জল। এগুলো সকালেই নিয়ে নেবার কথা। সকালের জন্য কী কী কাজ বাকি থাকল—তার একটা চার্ট সে মাথার মধ্যে রেখে দিয়েছে। আর এ-সময়ই দেখল সুখি দরজায় মুখ বাড়িয়েছে।

স্বামী পরিত্যক্তা এই যুবতী, দেখলে মনেই হয় না। কেন এই সরল সাদাসিধে মেয়েটাকে তার স্বামী তাড়িয়ে দিয়েছে বুঝে উঠতে পারে না। কথাবার্তায় এ-জন্য কোনো কষ্ট আছে মনে হয় না। সে তো নির্মলাকে ছেড়ে থাকবে ভাবতেই কতবার যে বিমর্ষ হয়ে যাচ্ছে। এক জায়গায় সে, এক জায়গায় নির্মলা। আসলে অভ্যাস।

তার সহসা কেন যে বাড়ির উপর চাপা অভিমানে চোখে জল এসে গেল। মা এসে সহজেই থাকতে পারত কটা দিন। মা যে কী ভাবে! মা কি আজকাল নির্মলাকে সহ্য করতে পারে না? ঝোঁকের মাথায় চাকরি ছেড়ে দিয়েছে—মা হয়তো বিশ্বাসই করে না। আসলে একসঙ্গে থাকবে কেন! শহরের মেয়ে ফুসলে ফাসলে কলকাতায় নিয়ে গেল। দিন যত যাচ্ছে, তত যেন এটা সে বেশি বুঝতে পারছে। সে নির্মলার জন্য সবার কাছ থেকে দূরে সরে গেল। একমাত্র নাতি, মায়া হবার কথা। কিন্তু মার এক বাহানা, বাড়ির সংসার কে দেখবে! অলকার পাত্র দেখা চলছে কিনা, এ-ছাড়া চিঠিতে আর কোনো কথা থাকে না। অলকাও এসে থাকতে পারে। থাকবে না। সেখানেও বাহানা, অলকা আবার পরীক্ষা দিচ্ছে। ওর পড়াশোনার ক্ষতি হবে। এসব লিখলে, সে আর লেখে কী করে, নির্মলা চলে গেলে ওরা সারাদিন কত একা মা তুমি বোঝ না! ওর পড়ার ক্ষতিটাই বেশি হল!

সুখি চা করে ডাকল, কাকা চা!

মেয়েটা এত নির্বোধ। সে দৌড়ে গিয়ে বলল, এত জোরে কথা বলছিস কেন?

সুখি ঠিক বুঝতে না পেরে বোকার মতো তাকিয়ে থাকল।

টুটুল মিণ্টু জেগে যাবে না!

ওরা উঠবে না? কাকিমা চলে যাবে!

এত কথা অতীশ শুনতে চায় না। মেয়েটা নিজের অধিকার সম্পর্কে এতটুকু সচেতন নয়। ওর বাবা রাজবাড়ির অফিসে সামান্য বেয়ারার চাকরি করে। সেই সূত্রে সে কাকা, নির্মলা কাকিমা। সম্পর্কটা সুখি নিজেই পাতিয়ে নিয়েছে। তার আপত্তিরও কারণ থাকতে পারে না। নির্মলার সমবয়সী, তবু কাকিমা ডাকলে কী করা!

নির্মলা প্রথম প্রথম বিরক্ত হত কাকিমা ডাকলে। অতীশ সেটা বুঝতে পারত। চাপা স্বভাবের মেয়ে। নিজের ক্ষোভ দুঃখ বিরক্তি সহজে সে প্রকাশ করে না। অতীশ নির্মলার মুখ দেখলে সব টের পায়। প্রসন্ন অপ্রসন্নতা সব। ক্ষোভ অভিমান কিংবা অবহেলা সব।

একদিন অতীশ বলেছিল, ওকে বলে দেব।

কী বলে দেবে?

কাকিমা ডাকলে খুশি হও না।

কে বলেছে?

মুখ দেখলে বুঝি।

তাই বলে বলতে যাবে! তুমি কী? তোমার কাণ্ডজ্ঞান নেই! বেচারা নিজের ছেলেপুলের মুখ পর্যন্ত দেখতে পায় না। কী আছে ওর! কতদিন দুপুরে এসে আমার কাচাকাচি করে দিয়ে গেছে। শুধু দুটো খেতে দেব এই আশায়। ও দুঃখ পেলে আমার মিণ্টু টুটুলের অমঙ্গল হবে না?

মানুষের পাপবোধ শেষ পর্যন্ত ছেলে মেয়েতে বর্তায়। মানুষ যে কোনো পাপ করে ভয় পায়—সন্তান-সন্তুতির অমঙ্গল ভেবে। এটা কি যে এত বড় পাপ কাজ সে বুঝতে পারে নি। আসলে তার কথায় যদি দুঃখ পায়, পেতেই পারে, আর সুখিও হয়েছে তেমনি, একটু কড়া গলায় কথা বললেই মাথা নিচু করে থাকে। কী কারণে একবেলা কামাই করায় অতীশ সকালে বলেছিল, তোকে দিয়ে হবে না। কেন আসিস নি। খবরও পাঠাস নি। খুব দূরে তো থাকিস না! এত দায়িত্বহীন হলে তোর উপর কোন ভরসায় ওদের রেখে যাব?

সুখি দরজার সিঁড়িতে দাঁড়িয়েছিল। অতীশের সকালে এক দণ্ড সময় থাকে না। সে ঘরের ভিতর এসে রেজার বের করে আয়না নিয়ে মেঝেতে দাড়ি কামাতে বসে গিয়েছিল। হঠাৎ সে শুনতে পেল, এই তুমি সুখিকে কী বলেছ?

কী বলব! তেমন কিছু তো বলি নি।

দেখ কী কাণ্ড, সিঁড়িতে বসে কাঁদছে। কেন কাঁদছে বলছে না। কিছু বললে, কেবল ফোঁপাচ্ছে।

অতীশ ফাঁপরে পড়ে গেছিল। রেজার আয়না টেবিলে তুলে রেখে ছুটে গেছিল।

এই কাঁদছিস কেন? কী হয়েছে? আমি তোকে কী বলেছি? বসে বসে কাঁদছিস?

নির্মলা বলেছিল, সকালবেলায় বল তো এমন করে কাঁদলে ভাল লাগে?

কী জানি, বুঝি না। আমি শুধু বলেছি, না বলে না কয়ে কামাই করলে চলবে না।

এটা একটা কথা! এ-জন্য কেউ কাঁদতে পারে। নির্মলার মনে হয়েছিল, যদি ওর বাসায় কিছু হয়ে থাকে। ওর বাবার ঘাড়ে এসে পড়েছে। বড় ভাইটা নিখোঁজ। ছোট দুই বোন যদি কথা শোনা কিংবা বাবা মা—এইসব সাত পাঁচ ভাবনায় নির্মলা কিছুটা যেন অস্বস্তিতে পড়ে গেছিল। সকালবেলায় বাসাবাড়িতে ঢোকার মুখে সিঁড়ির দরজায় বসে যদি কেউ কাঁদে তবে লোকেই বা কী ভাববে। নির্মলা না পেরে বলেছিল, এই ভিতরে আয়। সিঁড়ির উপর বসে তোমার মায়াকান্না কাঁদতে হবে না। কে তোকে কী বলেছে, বাড়িতে কেউ কিছু বলে থাকলে, আমরা কী করতে পারি! লোকে ভাববে আমরাই কিছু বলেছি।

বলেছে তো, কাকা বলেছে তো! বলেই আঁচল চাপা দিয়ে হাউহাউ করে কান্না।

জানি না, কী সিন ক্রিয়েট করছে দ্যাখো।

অতীশ আর নিজেকে সামলাতে পারে নি সেদিন। সে ছুটে গিয়ে ধমক লাগিয়েছিল, ওঠ বলছি, ওঠ। ভিতরে আয়।

সুখি এক কথায় ভিতরে ঢুকে গেলে নির্মলা দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল।

অতীশের স্নানে যাবার সময় হয়ে গেছে—এ কী ঝঞ্ঝাট সক্কাল বেলায়।

কী বলেছি! তারপরই মনে পড়ে গেল অতীশের সব। বলল, ঠিকই তো বলেছি, কোন ভরসায় টুটুল মিণ্টুকে তোর কাছে রেখে যাবে।

নির্মলা কী বুঝতে পেরেছিল কে জানে! ইশারায় অতীশকে ঘরের ভিতর ডেকে নিয়ে গেছিল। যাবার আগে সুখির দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ঠিক আছে আর বলবে না। নে যা।

ভিতরে এসে অতীশকে বলেছিল, এ-ভাবে বল না! কেন কেঁদেছে আমি বুঝি। তুমি পুরুষ মানুষ বলেই বুঝতে পারছ না।

অতীশের ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছিল।

সামান্য কারণে এ-ভাবে কেউ কাঁদতে পারে—আর সে অফিস থেকে ফিরে কোনোদিন মেজাজ ঠিক রাখতে না পারলে আরও কড়া কথা বলে দিতে পারে! তার কেন জানি একবার মনে হয়েছিল—চোখের জল দেখছি খুব সস্তা।

সে নির্মলাকে বলেছিল, মাথা খারাপ আছে।

কী বকছ আজে বাজে!

আজে বাজে বকছি?

তাই।

কী জানি, কী এমন অপরাধ করেছি জানি না।

নির্মলা আর কথা বাড়ায় নি।

আজ অতীশ বুঝতে পারছে, সেদিন সুখির কেন এত শোক উথলে উঠেছিল।

মিণ্টু টুটুলকে তার ভরসায় সত্যি তবে কাকিমা রেখে যাচ্ছে। যেন এক আশ্চর্য নারীর সম্মান কিংবা নারী মহিমার অধিকার তাকে কাকিমা দিয়ে চলে যাচ্ছে।

সুখি বলল, কাকিমা আলু সেদ্ধ হয়ে গেছে। ছুলে ভরে দিচ্ছি।

নির্মলা বাথরুম থেকে চান করে বের হয়েছে। শীত চলে যাবার মুখে। সে টেবিলের ছোট আয়নায় নুয়ে মুখে পাউডার মাখছে। আর মাঝে মাঝে মশারির নিচে তার চোখ চলে যাচ্ছে। নির্মলাও আজ খুব কম কথা বলছে। সবাই। অতীশ বাথরুম থেকে বের হয়ে পাজামা পাঞ্জাবি পরে জানালায় উঁকি দিতেই বাইরের পাতাবাহার গাছের ডালপালায় ঝড় বয়ে গেল। সে দেখছিল, হাসু ট্যাকসি নিয়ে ফিরছে কি না! গতকালই রাজবাড়ির সদর গেটের পাহারাদার সাদেক আলিকে বলে রেখেছিল, যেন ট্যাকসি ঢুকতে দেয়। সে তার স্ত্রীকে নিয়ে যে বাইরে যাচ্ছে, সাদেক জানে। সে যখন বাড়ি থাকে না, কিংবা নির্মলা যখন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ছিল, তখন রাজবাড়ির পাহারাদার সাদেক আলি, দুমবার সিং নজর রাখত ম্যানেজার বাবুর ফুটফুটে বাচ্চা দুটির উপর। কি খেলার মাঠে, কিংবা বাগানে যেখানেই অন্য আমলাদের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ওরা ঘুরে বেড়াত—ওদের কারো না কারো চোখ মিণ্টু টুটুলের উপর। যেন এই দুই শিশু খুবই অসহায়। মা রুগ্ন, বাবা অফিসে, কেউ দেখার ছিল না—তাদের ছিল কেমন নৈতিক দায়িত্ব। কত কাল ধরে ম্যানেজারবাবুর উপর দিয়ে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। একটার পর একটা অঘটন। বৌদিমণি হাসপাতালে গেল—পেটে কী হয়েছে, মিণ্টু পুকুরের জলে ডুবে গেল, অধীর তুলে এনেছিল, টুটুলবাবুর মাথা ফেটে গেল টুল থেকে পড়ে—কোনো এক অশুভ প্রভাব না থাকলে এমন একের পর এক বিপদ আসে না। সেই বৌদিমণি স্কুলে চাকরি নিয়ে বাইরে চলে যাচ্ছে—তাও তারা জানে।

তাদের এক কথা, মাকে ছেড়ে থাকতে পারবে ওরা?

অতীশ বলত, তোমরা তো আছ।

এত বড় ভরসা তাদের ওপর ম্যানেজারবাবুর। সুতরাং সাদেকও বোধ হয় জেগে ছিল শেষরাতের দিকে—এ-সময় টুলে বসে বসেই সে ঘুমায়। আজ তারও বোধ হয় ঘুম হয় নি। বাবুর ছোট ভাই ট্যাকসি ডাকতে যাবে, গেট খুলে দিতে হবে—কিন্তু পাতাবাহারের গাছগুলোর ডালপালায় এই ঝড় কেন? সে যে এই বাসাবাড়িতে উঠে আসার পর থেকেই নিরন্তর ভয়ে কাবু—আর্চির প্রেতাত্মা তার সঙ্গ ছাড়ছে না। তার ভিতরটা কেন যে কেঁপে গেল। মৃত্যু-যোগ ছিল তার কুষ্ঠিতে গ্রহের কোপে এসব হয়, বাবা এসে তাকে সেই গ্রহকোপ থেকে আত্মরক্ষার নিমিত্ত শাক্তি স্বস্ত্যয়ন করে গেছেন। শনির দশা ভাল না। বাবা নানাবিধ অনুষ্ঠান করে গ্রহদোষ খণ্ডন করে যাবার পরও এই পাতাবাহারের ডালপালায় অকারণ ঝড় বয়ে গেল কেন!

কোথাও এতটুকু হাওয়া বাতাস নেই, ডালপালাগুলি তবে কে ঝাঁকিয়ে দিল।

বিড়াল লাফ দিয়ে বের হয়ে যেতে পারে, কিংবা কোনো কুকুর বিড়ালকে তাড়া করলে এই ডালপালার মধ্যে ক্ষণিকের নড়া চড়া সম্ভব। চোখের উপর ঘটে গেল—নাকি, মনের ভুল! সে দেখেছে, কোনো কারণে মন দুর্বল হয়ে গেলে এ-সব অবাস্তব ঘটনা তাকে তাড়া করে। যুক্তি তর্কে সে হেরে যায়। সে তো বিশ্বাস করে ঈশ্বর নামক আদি গুজব মানুষের দুর্বলতার সুযোগেই। তবু এটা কেন মনে হয়, দূরাতীত থেকে কোনো অদৃশ্য শক্তি তার হয়ে লড়ছে। লড়ছে বলেই, নিশ্চিন্ত মৃত্যুর হাত থেকে মিণ্টু, টুটুল বেঁচে গেল। বাবা এলেন গ্রহদোষ খণ্ডনে, সঙ্গে পঞ্চতীর্থকাকা, সে কেন বলতে পারল না, আমি বিশ্বাস করি না। গ্রহের কোপ-টোপ বাজে ব্যাপার। সে তো বাবার সু-সন্তান হয়ে সব করে গেছে। পলা, গোমেদ, মুনস্টোন ধারণ করেছে। মাঝে মাঝে সে যখন নিজের মধ্যে থাকে, তখন মনে হয় বাবা তার পুত্রকে আর কিছু দিতে না পারুক, ঈশ্বর নামক বস্তুটি ঘাড়ে চাপিয়ে দেবার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। আর ঈশ্বরের সঙ্গেই বসবাস করেন প্রেতাত্মা। সব বুড়ো মানুষেরাই কেন ঈশ্বর নিয়ে এত ভাবেন! সংসারে বাঁচতে হলে তাঁকে ছাড়া মানুষ নিরুপায়—এই অস্বস্তির মধ্যেই সে ঘরে ফিরে এসে দেখল, নির্মলা, টুটুলের চাদর ঠিক করে দিচ্ছে। পাশ ফিরে শুইয়ে দিচ্ছে। তারপর তার দিকে তাকিয়ে বলছে, ট্যাকসি এসেছে?

আসবে।

অতীশের মুখ দেখলেই নির্মলা টের পায় কিছু। বিয়ের পর সাত আট বছরে, মুখের সব ভাঁজে নানা ছবি যে লুকিয়ে থাকে নির্মলা যত জানে, আর কেউ জানে না। আজ আবার মনে হচ্ছে, মানুষটা তার বুঝি ঘোরে পড়ে যাবে। সন্তান স্নেহ তাকে যে পীড়নের মধ্যে ফেলে দিয়েছিল, মুহূর্তে সেই পীড়ন অতিশয় কাতর করে ফেলল, নিজের মানুষটির জন্য।

কেমন শূন্য দৃষ্টি, যেন অতীশ কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। যেন অতীশ সেই আগেকার বিড়ম্বনার মধ্যে পড়ে গেছে। এ-সব হয়। নিশ্চিত নিরাপত্তার বোধ মানুষের থাকে না—এরই মধ্যে মানুষের জীবন যাপন। এরই মধ্যে স্ট্রাগল। তার মানুষটাই একদিন কী কারণে যেন বলেছিল, স্ট্রাগল ইজ দ্য প্লেজার। সেও বিশ্বাস করে, এই যে সংসার ফেলে তার এই যাত্রা সেই স্ট্রাগল ইজ দ্য প্লেজারকে অনুভব করার জন্য।

নির্মলা দেখল, অতীশ আস্তে আস্তে হেঁটে চলে যাচ্ছে। কোথায় যাবে তাও সে জানে। কুলুঙ্গির নিচে কিছুক্ষণ অতীশ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকবে। প্রার্থনার ভঙ্গি কিছুটা। দেব-দেবী বিশ্বাস করে না, ঈশ্বর মানে না, অথচ যেন এই কুলুঙ্গিতে সেই পাথরের নারীর কাছে গচ্ছিত আছে তার সব সুখশান্তি বৈভব। এখানে মাথা নিচু করে দাঁড়ালেই সে শাক্তি পায়। কতদিন সে অতীশের এমন আচরণে ভয় পেয়ে গেছে—এই সেদিনও কত কষ্ট করে কুলুঙ্গির নিচ থেকে তাকে হাত ধরে টেনে আনতে হয়েছে। তারপর স্বাভাবিক করে তোলার জন্য প্রচেষ্টার শেষ ছিল না। এখন যদি আবার সেই ঘোরে পড়ে যায়, তবে কেলেঙ্কারি। ট্যাকসি এসে দাঁড়িয়ে থাকবে, দেরি হলে ট্রেন মিস করবে। নির্মলা কেমন বিপাকে পড়ে ডাকল, এই!

হুঁ।

তুমি এত ভয় পাও কেন বল তো, আমি তো আছি।

অতীশের সহসা মনে হল, নির্মলাকে নিয়ে তার কোথাও আজ যাবার কথা। সে কেন যে সব ভুলে যায়।

সে বলল, ট্যাকসি এসেছে?

আসবে। এস।

আর কিছু বলতে পারল না। বলতে পারবেও না। শ্বশুরমশাই বলেছিলেন, বৌমা ভয় পাবে না। ঘোর কেটে যাবে। এখন তো অনেক ভাল। জাহাজ থেকে ফিরে এসে ঠিক মতো খেত না। কথা কম বলত, চুপচাপ বসে থাকত। কখনও বের হয়ে গেলে বাড়ির কথা মনে থাকত না। বড় সড়কে গিয়ে গাছের ছায়ায় বসে থাকত। দূরের আকাশ দেখত। মনে করিয়ে দিতে হত, তার বাড়িঘরের কথা। কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিত না। আরও যেন বেশি অতলে ডুবে যেত। বাবা বলেছিলেন, আমার বড় ভয়, জান, আমার বড় ভয়। বড়দার মতো শেষে নিখোঁজ হয়ে না যায়। আমাদের বংশে এটা আছে। আমার বড়দা পাগল হয়ে গেল। তারপর নিখোঁজ। আমার এক দাদু পৈতার ঘর থেকে সন্ন্যাস নিয়ে চলে গেল। তার আগের পুরুষে আমার পূর্বপুরুষ তীর্থ করতে গেলেন—বাড়ি আর ফিরে এলেন না। তুমিই পার তাকে নিরাময় করতে।

সেই থেকে নির্মলা এই দায় ঘাড়ে নিয়েছে। সে ভাল করে তুলেছেও। মাঝে মাঝে শুধু হঠাৎ হঠাৎ কেমন অস্বাভবিক আচরণ করতে থাকে।

ট্যাকসিতে নির্মলা বলল, একটা কথা বলব? অতীশ তাকাল।

আৰ্চিটা কে?

আর্চি!

বারে তুমি সেদিন চিৎকার করে উঠলে না, আমি জানতাম এমন হবে। আর্চিকে আমি খুন করেছি।

কবে?

টুটুল টুল থেকে পড়ে গেল। মনে নেই। হাসপাতালে ইনটেনসিভ কেয়ারে, অজ্ঞান হয়ে শুয়ে আছে, সুরুচিদি ফোন করলেন।

অঃ।

তুমি এমন করলে আমার দুর্ভাবনা হবে না। ওরা তোমার কাছে থাকল। ওখানে আমি একা। মন শক্ত না করলে চলবে কী করে! আমার বল ভরসা সব যে তুমি।

অতীশ দেখতে পেল, নির্মলার মুখ দুশ্চিন্তায় ছেয়ে গেছে। এটা সে ঠিক কাজ করে নি। সে এত চেষ্টা করে, প্রেতাত্মা বলে কিছু নেই, ঈশ্বর বলেও কিছু নেই, তবু বার বার তারাই আক্রমণ করছে। ঈশ্বর থাকলে প্রেতাত্মা থাকবে। সে দুজনের কাছ থেকেই মুক্তি চায়। ঈশ্বর প্রেতাত্মা দুজনের কাছ থেকেই। পারছে না।

সে বলল, এসে গেছি। নামো।

নির্মলাও পীড়াপীড়ি করল না। শ্বশুরমশাই তাকে বার বার সতর্ক করে দিয়েছেন, ওকেই ওরটা বুঝতে দাও। ওর কথাবার্তা শুনে অযথা পীড়ন চালিও না। আর্চির কথা ফের তুললে, মানুষটাকে পীড়ন করা হবে ভেবেই নির্মলা বলল, দেখ সব নামিয়েছ তো। এক দুই……সাতটা। ঠিক আছে। ওরা বোধহয় ঘুম থেকে উঠে গেছে।

অতীশ জবাব দিল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *