1 of 2

ঈশ্বরের বাগান – ৩৫

।। পঁয়ত্রিশ ॥

রাত্রে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। বাবা, পঞ্চতীর্থকাকা এক ঘরে। এসেই বাবা তার হাতে আর একটা ফর্দ ধরিয়ে দিয়েছেন। টুটুলের নাকি গ্রহ অবস্থান এত খারাপ যে তার পিতার মৃত্যুযোগ আছে। বাবা রক্ষাকালীর পুজো করবেন। পাথর ধারণ করার জন্য মুনস্টোন, গোমেদ আর পলা লাগবে। টুটুলের গ্রহ শান্তির জন্য কাল থেকেই বাবা আর পঞ্চতীর্থকাকা আর কি কি করণীয় কুষ্ঠি থেকে সব খুঁজে বের করবেন।

তার মৃত্যুযোগ আছে শুনে অতীশ ঘুমোতে পারছে না। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। সে উঠে বসল। কুলুঙ্গির নিচে গিয়ে আজ তাকে যেন সারেন্ডার না করে উপায় নেই। সে মাথা নিচু করে বিড়বিড় করে বলল, বনি, আই উইল প্রেইজ হিম অ্যাজ লং অ্যাজ আই লিভ, ইভন উইথ মাই ডাইং ব্রেথ

নির্মলা পাশ ফিরে শুয়েছিল।

ঘরে জিরো পাওয়ারের আলো জ্বলছে। খাট থেকে কেউ নেমে গেল। সে তাকাল। কে নামল! টুটুল মিণ্টু মাঝখানে। দুটো তক্তপোশ জড়ো করে লম্বা বিছানা। বাবার ঘরের দিকে দরজা বন্ধ।

সে দেখল অতীশ খুব সর্তক পায়ে হেঁটে যাচ্ছে। এবং কুলুঙ্গির সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছে।

আর স্পষ্ট শুনতে পেল, বনি, আই উইল প্রেইজ হিম, অ্যাজ লং অ্যাজ আই লিভ ইন উইথ মাই ডাইং ব্রেথ। বনি কে?

কাকে সে প্রেইজ করবে বলে এই গভীর রাতে প্রমিজ করছে। তবে এতদিন কি সে তাকে প্রেইজ করত না। সে কে?

নির্মলা কি করবে বুঝতে পারছে না।

মানুষটা তার মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সারাদিন বাবা আর পঞ্চতীর্থকাকা তার কর-কোষ্ঠী বিচার করেছেন। এতদিন এই কোষ্ঠী তার একটা ট্রাঙ্কে পড়েছিল। বাবা একটা ছক রেখে কলকাতায় আসার সময় কোষ্ঠী সঙ্গে দিয়ে বলেছিলেন, জীবনের সবই নিয়তি নির্দিষ্ট। আমরা তার একচুল বাইরে নড়তে পারি না। যত্ন করে রাখবে।

কলকাতায় আসার পর বলতে গেলে মানুষটার ওপর দিয়ে ঝড় যাচ্ছে। এমনিতেই কম কথা বলে, হাসে না, দুশ্চিন্তা বয়ে বেড়ালে মানুষের যা হয়। টুটুল মিণ্টু যত বড় হচ্ছে তত আরও গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে। তারও শরীর ভেঙে যাচ্ছিল, জরায়ুর অসুখে ভুগছিল সেই কতদিন থেকে, হাসপাতাল, অপারেশন—বাবাকে চিঠি দিলে, এক কথা, গ্রহ সমাবেশ খারাপ, সাবধানে চলাফেরা করবে। বার বার সতর্ক করে দিচ্ছিলেন। কিন্তু আজ এসে যা বললেন, তাতে সেও কম উচাটনে পড়ে যায় নি পিতা পুত্রের মৃত্যুযোগ, এবং বাবা এসেই বলেছেন, অল্পের ওপর দিয়ে টুটুলের ফাঁড়া কেটে গেল। টুটুল টুল থেকে পড়ে গিয়ে যে রক্তপাত ঘটিয়েছিল, সংজ্ঞা হারিয়েছিল—সেটা অল্পের ওপর দিয়ে, কিন্তু তিনি তো জানেন না এই সেদিন—কারখানায় বড় রকমের উৎপাত গেল একজন কর্মীকে নিয়ে। অতীশকে ঘিরে ধরেছিল, সে ম্যানেজার কারখানার, সব ক্ষোভ তার ওপর।

বাবাকে সে সকালে ভাবল সব খুলে বলবে, টুটুলের যদি অল্পের ওপর দিয়ে ফাঁড়া কেটে যায়, অতীশেরও তেমনি কেটে গেছে কিনা। সেও তো প্রায় আগুনের হল্কা থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পাওয়া। ধরে গেলে দাউদাউ করে যে জ্বলে উঠত না তার ঠিক কি!

নির্মলা আর পারছে না।

কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছে! গোপনে গভীর রাতে এ-ভাবে একজন মানুষ কার কাছে প্রার্থনা জানাচ্ছে!

ঈশ্বরের কাছে!

তবে বনি কে। বনিকে কেন প্রমিজ করছে, আমি রাজি। এতদিন তবে রাজি হয়নি কেন! বাবার চিঠি এলেই এক কথা, যত সব কুসংস্কার। গ্রহ অবস্থান খারাপ। মানুষ কি মানুষের ফেট বলতে পারে! বাবার কি যে বিশ্বাস বুঝি না। গ্রহাচার্যকে ফলদান, বস্ত্রদান পর্যন্ত হয়ে গেছে। এতে নাকি গ্রহের কোপ কমে। বাবার চিঠিতে সংসার খরচের সঙ্গে বস্ত্রদানের কথাও উল্লেখ থাকত। এ মাসে ক’টা টাকা বেশি পাঠাবে। ঠাকুরকে ভোগ দেব ভাবছি। এক’শ একটা তুসসীপত্র সহ এমন ফিরিস্তি আসত যে অতীশ কেমন বিচলিত বোধ করত। বলত কোত্থেকে পাঠাব! এত টানাটানির মধ্যে বাবার কি দরকার বস্ত্রদানের বুঝি না। বাবা কি জানে না, কি টাকা পাই! লেখা থেকে টাকা না এলে রেশন তুলতে পর্যন্ত পারি না। বাবাকে এখন গ্রহাচার্যে পেয়েছে।

বাবার বিধান যে অতীশকে ঘাবড়ে দিয়েছে এই দাঁড়িয়ে থাকা থেকে টের পেল নির্মলা। মৃত্যুযোগ হতেই পারে, একের পর এক এই মৃত্যুযোগ জাদুকরের লাল নীল বলের মতো ওড়াওড়ি করলে, মানুষটার শেষ কোথায়। একা হয়ে গেলে এই হয়। সে না থাকলে তারা যে ফুটপাথের মানুষ হয়ে যাবে! নিরুপায় না ভাবলে অতীশ যে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না, তাও নির্মলা টের পাচ্ছে। তার কেন জানি মানুষটার জন্য চোখে জল এসে গেল! বাবা-মা ভাই-বোন কেউ তার পর নয়। সবার সুখ সে নিজের সুখের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছে। অলকার সম্বন্ধ, হাসু ভানুর চাকরি, এগুলি তার এখন যে প্রাথমিক দায়। মাঝে মাঝে এমন বিমর্ষ হয়ে বাড়ি ফেরে, যে দেখলে কষ্ট হয়। সে কিছু জিজ্ঞেস করতেও সাহস পায় না।

এক এক সময় মনে হয়, বংশের অভিশাপ তার ওপর এসে বর্তায়নি তো। ওর বড় জ্যাঠামশাই দীর্ঘকায় পুরুষ ছিলেন। সেকালের জলপানি পাওয়া মানুষ। বিশাল চাকরি, এই কলকাতায় এসেই তিনি পাগল হয়ে গেছিলেন। বংশের প্রত্যেক পুরুষে এটা কারো না কারোর ওপর বর্তায়। ওঁর ঠাকুর্দার এক ভাই সন্ন্যাস নিয়ে গৃহত্যাগ করেছিলেন, তার আগের পুরুষে, কে চলে গেলেন কোথায়—আর খোঁজ পাওয়া গেল না। অতীশ নাকি তার পাগল জ্যাঠামশাইর মতো হুবহু এক দেখতে।

নির্মলা পাশ ফিরছে না। পাছে টের পায় অতীশ, তার গোপন আত্মসমর্পণ টের পেয়ে গেছে সে। কিন্তু এভাবে কাঁহাতক পারা যায়? যেন তার মানুষটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমোচ্ছে।

সে উঠে বসল। ভেতরে ক্ষোভ জ্বালা, কিংবা কোনো এক অমোঘ নিয়তি, এই সংসারে নেমে আসছে, মানুষটা তার ভেতরে ভেতরে তা টের পেয়ে স্থির থাকতে পারছে না। কারখানার জটিলতার মধ্যে কোনো অশুভ ইঙ্গিত পেয়েছে কিনা জানে না। মানুষটার নিজের দেব-দেবীর প্রতি এতটুকু আগ্রহ নেই। সে একটা কালীঘাটের পট দেয়ালে কাঠের তাকে রেখে দিয়েছে। দুপুরে স্নান সেরে ফুল জল দেয়। কত করে বলেছে, তোমরা বাসি কাপড়ে ছোঁবে না, জুতো পরে ঘরে ঢুকবে না, কিছুই গ্রাহ্য করে না। সেই মানুষ সামান্য একটা ধূপবাতিদানের মধ্যে জীবনের এতবড় আশ্রয় খুঁজে পায় কি করে!

না সম্বিত নেই। এও কি আর এক ঘোর তার!

নির্মলা এবার নেমে গেল বিছানা থেকে।

অতীশ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কেমন বাহ্যজ্ঞানশূন্য।

নির্মলা এবারে আর পারল না। কাছে গিয়ে সহসা চিৎকার করে ডাকতে গিয়ে মনে হল, পাশের ঘরে বাবা পঞ্চতীর্থকাকা ঘুমোচ্ছে।

সে নাড়া দিল।

এই! এই! দাঁড়িয়ে আছ কেন! কি হয়েছে! আমি কি করব! বলে অতীশের বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, যেন অতীশ স্বপ্ন দেখছিল, নীল জলরাশি, সাদা বোট, এক নিঃসঙ্গ পাখি আর সেই নারী। তার নীলাভ চুল, নীল জলরাশির মত গভীর চোখ, এবং কোনো এক অতীত জীবনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অনুভূতি তাকে এতটা নিমগ্ন করে রাখতে পারে ভাবতেই বিস্মিত গলায় বলল, ও তুমি। না কিছু হয়নি!

একেবারে স্বাভাবিক।

তুমি শোও, টুটুলকে দেখি। বিছানা ভেজায়নি তো। বলে সে টুটুলের পায়ের দিকটা হাত দিয়ে দেখল। না ভেজায়নি। টুটুলকে ঘাড়ে তুলে দরজা খুলে বের হয়ে গেল। সে টুটুলের এ দায়িত্বটা কবে থেকেই যেন নিয়েছে। তুলে একবার হিসি না করালে বিছানা নির্ঘাত ভেজাবেই। নির্মলা ঘুমোলে তার হুঁশ থাকে না। দু’একবার দায়িত্ব নিয়ে ফেল মেরেছে। সেই থেকে এ কাজটা যে তার, নির্মলাকে দিয়ে হবে না, সে জানে।

নির্মলা ভাবল, অনেক সহ্য করেছে, আর না। ভেতরে তার অশান্তির আগুন জ্বলে উঠছে। কিন্তু এটা যে তার কতবার হয়েছে, কতবার সে জানতে চেয়েছে, জাহাজ তোমার নিখোঁজ হয়ে গেলে কোথায় উঠেছিলে! কিভাবে ফিরে এলে!

কিছু বলে না। কেমন শীতল চোখে তখন শুধু নির্মলাকে দেখতে থাকে।

বাবা বলতেন, যা হবার হয়েছে, এই নিয়ে আর ঘাঁটিও না। দেখছ তো কেমন হয়ে যায়।

কিন্তু বনি কে? আজ সে এসপার ওসপার না করে ছাড়ছে না।

এই প্রথম সে শুনতে পেল, বনি বলে কেউ তার আছে। বনিকে সে আজ কথা দিয়েছে। যেন দীর্ঘদিন থেকে বনি তার মধ্যে সুমতি ফিরে আসুক চাইছে। সে মাথা পাতছে না। আজ বাবার কর- কুষ্ঠি বিচারে মৃত্যুযোগের খবর পেয়েই ভেঙে পড়েছে। খবরটা পাবার পর সেও বিমর্ষ হয়ে গেছিল। তবে বাবা বলেছেন, রোগ যেমন আছে তার প্রতিষেধকও আছে। পঞ্চতীর্থ সব জানেন। গ্রহাচার্যই তাঁকে পাঠিয়েছেন সঙ্গে। তাঁর বিধান মত কাজ করলে সব দোষ কেটে যাবে।

বাবার এটা কোন আত্মবিশ্বাস থেকে সে জানে না। যেমন বাবা মনে করেন, তিনি জীবনে কোনো পাপ কাজ করেননি। তাঁর ছেলের কোনো অমঙ্গল হতে পারে না। সমুদ্রে অতীশের জাহাজ নিখোঁজ হয়ে যাবার পর কোম্পানি থেকে খবরটা পাঠালে এবং কাগজে সব খবর দেখেও তিনি নাকি সেদিন বিচলিত হননি। বাড়িতে হুলুস্থুল কান্ড, লোকজন আসছে, আত্মীয়-স্বজনরা আসছেন, জাহাজ নিখোঁজ হয়েছে, কত রকমের প্রশ্ন তাকে নিয়ে। বাবার তখন এক কথা, সামোয়া থেকে ওর শেষ চিঠি পেয়েছি। এর আগে নিউ প্লাইমাউথ থেকে দিয়েছে। লিখেছিল, ওরা জাহাজ নিয়ে অস্ট্রেলিয়া উপকূলে মাটি টানার কাজে যাচ্ছে।

জাহাজ মাটি টানে, সে আবার কি কথা! তাইতো লিখেছে, এর বেশি কিছু আমি জানি না। খবরের কাগজে দেখছি, হঠাৎ জাহাজটার আর খবর পাওয়া যাচ্ছে না। কোথায় গেল! কাগজে তো খুব লেখালেখি হচ্ছে। তবে আমি তো এতবড় পাপ করিনি, আমার ছেলে সমুদ্রে ডুবে মারা যাবে, এবং তখন সেইসব সমুদ্রের বিচিত্র প্রাণী, হাঙর থেকে তিমিমাছেরা যে ঘুরে বেড়ায়, হাজার হাজার মাইল ব্যাপ্ত সমুদ্রে জাহাজ নিখোঁজ হলে সমুদ্রের রুদ্ররোষ কতটা প্রখর হয়ে ওঠে বাবা টের পাননি। নির্মলা বাড়িতে শুনেছে, বাবা সারাদিন প্রায় ঠাকুরঘরেই পড়ে থাকতেন। বাড়ির মেজ পুত্রটি বাবা মা ভাই বোন অনাথ হয়ে না যায় এই ভেবেই সমুদ্রে ভেসে পড়েছিল। মাসোহারা আসত, কলকাতার এজেন্ট অফিস থেকে। সেই একমাত্র উপার্জনক্ষম। মেজ পুত্রের জাহাজ নিখোঁজ। বড় পুত্র তাঁর খোঁজখবর নেয় না, মেজ পুত্রটির মধ্যে মায়া দয়া বেশি, সেই যদি হারিয়ে যায় তবে সংসারে কত বড় বিপর্যয়, সেই বিপর্যয়ের মুখেও বাবাই একমাত্র স্থির ছিলেন। মাকে প্রবোধ দিয়েছিলেন, ও ভালই আছে। গ্রহাচার্য বলেছে, ওর কিছু হয়নি। সময় হলেই ফিরে আসবে।

সেই নিখোঁজ মানুষ ফিরে এসেছে, কাগজেই খবরটা বের হয়েছিল। মেজ-জ্যাঠামশাই ছুটে এসেছিলেন, বড় জেঠিমা, বড়দা সবাই। অতীশ ফিরে এসেছে, কাগজে অ্যাংকার করা খবর। সেই নিরুদ্দিষ্ট জাহাজ এস. এস. সিওলব্যাংকের নাবিক অতীশ দীপঙ্কর ভৌমিকের ছবিও কাগজে বের হয়েছে। এবং জাহাজের প্রপেলার স্যাফট ভেঙে যাওয়ায় বয়লার চক বসে যাওয়ায় সব জাহাঙ্গিরা বোট নিয়ে নেমে গিয়েছিল। সে সারেং আর বুড়ো কাপ্তান জাহাজে, তারপর সবটাই গল্পের মত, অতীশ বলেছে দুই বুড়ো সারেং কাপ্তান জাহাজেই থেকে যায়। সেও থেকে যায়। কাপ্তান জাহাজ এবানডান স্বীকার করতে চাননি, জাহাজেরই নাকি আছে এক অলৌকিক শক্তি যে আজ হোক কাল হোক বন্দরে ভিড়িয়ে দেবে। হাল না থাকুক, বয়লার চক বসে যাক, ট্র্যান্সমিটার রুম ঝড়ে উড়ে গেলেও জাহাজ কখনও তাঁর বিশ্বাসঘাতকতা করবে না। এই বিশ্বাস নিয়ে তিনি সব নাবিকদের মাত্র একটি প্রশ্ন করেছিলেন, আমার এবং আমার এই জাহাজের প্রতি যাঁদের বিশ্বাস আছে তাঁরা থেকে যেতে পারেন, যাঁদের নেই, তাঁরা লাইফবোট নিয়ে ভেসে পড়তে পারেন। পাঁচ সাতশো মাইলের মধ্যে দ্বীপটিপ পেয়ে যাবেন। সঙ্গে একটা করে র‍্যাফ্ট নিন। এমন সব খবরে তোলপাড় যখন, তখনও অতীশের কোনও খবরই ছিল না। তার কতকাল পর অতীশ রাত্রে বাড়ি ফিরে এলে, যেন পুত্র প্রবাস থেকে ফিরে এসেছে। পুত্র তাঁর কোনো দিনই নিখোঁজ ছিল না। গ্রহাচার্য যখন বলেছেন, ভাল আছে, তখন ভাল না থেকে অতীশের বুঝি উপায় ছিল না। সমুদ্র বোধহয় মানুষকে গম্ভীর করে দেয়। ধীর স্থির। অতীশের আশ্চর্য সুন্দর মুখে চোখে গভীর নীল সমুদ্রের মহিমা বিরাজ করছে টের পেয়েছিলেন বাবা।

এই মহিমাই বোধহয় বাবাকে আশ্বস্ত করেছিল, পুত্র তাঁর আর শৈশবের সোনা নেই। অতীশ দীপঙ্কর হয়ে গেছে। সোনা তার খোলস পাল্টে ফেলেছে। কথাবার্তা কম বলে। বাড়িতে থাকতে চায় না। বাড়ির চেয়ে মাঠ এবং ফসলের জমি তার প্রিয়। মাঝে মাঝে বড় বিমর্ষ থাকে। বাবা নাকি তখন তাকে জীবনের প্রতি আগ্রহ সঞ্চারের জন্য গাছ লাগাতে বলতেন। বাবা আম জামের কলম কি করে করতে হয় বলতেন। ফলবান বৃক্ষ এবং কর্মক্ষম পুত্র সংসারে বড় প্রয়োজন।

অতীশ টুটুলকে কাঁধে ফেলে ঘরে ঢুকছে। নির্মলা দাঁড়িয়ে আছে। সে ঘরে ঢুকে মশারিটা তুলে ধরতে বলল নির্মলাকে। মশার উপদ্রব আছে। ফাঁক ফোঁকরে না গলে যায়। নির্মলা যেন শুনতে পায়নি। এভাবে গুম মেরে আছে দেখে সে কিছুটা ফাঁপরে পড়ে গেল। নির্মলাও যে কম জেদি নয়, পাঁচ সাত বছরে সে টের পেয়েছে। যদি কোনো কারণে আবার ডিপ্রেসান শুরু হয় তবে তার কপালে দুঃখ আছে। ডিপ্রেসান দেখা দিলেই নির্মলার আহারে অরুচি। খেতে পারে না, কিংবা খেতে চায় না, যেন নীরবে বুঝিয়ে দেয় আমি ভাল নেই। এবং সাংঘাতিক আচরণ শুরু হয়ে যায়, তার আত্মীয়স্বজনের নাম শুনলে ক্ষেপে যায়, তারা বাসায় এলে কথা বলে না। কেমন সে তখন শীতের বুড়ি, এই ভোগান্তির ভয়ে কখনও সে নির্মলাকে রূঢ় কথা বলতে পারে না।

সে আর কি করে!

মুর্তিটা সে কোথায় পেল, এ-ধরনের প্রশ্ন দু-একবার যে তাকে না করছে তা নয়। ঠিক মুর্তি নয়, আবার ধূপবাতিদানও নয়, তাই নির্মলার ভারি অবজ্ঞা ছিল। বাবার খেলনাটা ধরনা। তোমার বাবা এখন শিং ভেঙে বাছুর হয়েছেন। তোমরা ওটা ধরলেই মাথা খারাপ।

মূর্তিটা নিয়ে কথা উঠলেই, অতীশের তাড়া শুরু হয়ে যেত। এই মিণ্টু দেখত হল কি না। আমাকে একটু আগে বের হতে হবে। রাজবাড়ির অফিস হয়ে যেতে হবে। তোমার টিফিন দিয়েছে? চল, আর দেরি কর না! এই কি, ফ্রকটা ছিঁড়লি কি করে! এটা পরে যাবি! ঠিক আছে, আয় আয় দেরি করিস না। ইস কত বেলা হয়ে গেছে।

নির্মলা ঠোঁট চেপে আড়াল থেকে দেখে, মানুষটা তার যেন মূর্তিটার কথায় জলে পড়ে গেছে। আর তখনই সে বুঝি টের পায় এক আশ্চর্য মায়া মানুষটার জন্য বহন করে বেড়াচ্ছে। মূর্তিটার কথা বলে আর বিব্রত করতে ভাল লাগে না তার।

নিজেই তখন ছুটে আসবে। কৈ দেখি কোথায় আবার ছিঁড়ল! কি দস্যি মেয়ে রে বাবা। নিৰ্মলা ছুটে গিয়ে সুঁচ সুতো এনে হাঁটু মুড়ে বসবে, এবং সামান্য ছেঁড়া জায়গাটা দু ফোঁড় দিয়ে রিপু করে দেবার সময় মেয়ে এবং তার মুখের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হাসবে। মেয়ে দস্যি হবে না! যেমন বাপ, তেমনি তার মেয়ে। আসলে সহবাসে অতীশের দস্যিপনার কথা ইঙ্গিতে ছুঁড়ে দিতে ভালবাসে নিৰ্মলা।

কিন্তু সে আজ ধরা পড়ে গেছে।

এতটা গোলমাল করে ফেলবে বুঝতে পারেনি। সে যে কুলুঙ্গির নিচে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিল লক্ষ্য করেছে নির্মলা। কখন সে খাট থেকে নেমে গেছে, কখন দাঁড়িয়েছে, কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল কিছুই যেন মনে করতে পারছে না। এই ঘোর তার কবে কাটবে! আর্চির খুনের কথাও সে ফাঁস করে দিয়েছে! আর আশ্চর্য এই খুনের কথা ফাঁস করে দেবার পরই সে যেন হাল্কা হয়ে গেছে। নিৰ্মলা বিশ্বাসই করতে পারেনি, কে আর্চি, কোথাকার সে, কখন কবে তার সঙ্গে দেখা, কেন এই খুন, কত প্রশ্নই সেদিন নির্মলা করতে পারত! কিন্তু নির্মলা বিশ্বাস করেনি। ঘোরে পড়ে আবোল-তাবোল বকছে, কুলুঙ্গি থেকে ধূপবাতিদানটা তুলে আছড়ে ভেঙে ফেলতে গেলে, কোন এক অদৃশ্য শক্তির প্রভাব কাজ করছে জানে না, আর সেই উক্তি, আমি খুন করেছি, আমার এমন হবে জানতাম। হাসপাতালে টুটুল সংজ্ঞাহীন, রাজবাড়ির অফিসে ফোন, গভীর রাত, দূরে ইস্টিশানে রেলের সান্টিংয়ের শব্দ, সব মিলে এক অন্য পৃথিবীর বাসিন্দা তখন তারা, নির্মলা কথাটার গুরুত্ব দেয়নি। বলেছে, খুন করেছ, বেশ করেছ, এস যা হবার হবে। তারপরই সাহস দেবার জন্য যেন বলেছে, তুমি কাউকে খুন করতে পার না, আমি বিশ্বাস করি না।

আজ যা পরিস্থিতি নির্মলা যেন শেষ ফয়সালা করার জন্য দাঁড়িয়ে আছে।

সে বলল, শোও, দাঁড়িয়ে থাকলে কেন। টুটুল জান একদম জ্বালায়নি। দাঁড় করিয়ে দিতেই হিসি করে দিল।

সে টুটুলকে শুইয়ে দিয়েছে। লেপ টেনে দিয়েছে। মিণ্টুর পা বের হয়েছিল, তাও ঢেকে দিয়েছে। বালিস থাবড়ে ঠিক করে মাথায় রেখেছে। আর অপরাধীর মত লুকিয়ে লক্ষ্য করছে নির্মলাকে।

কি হল!

কোনো সাড়া নেই।

তুমি কি শোবে না?

কোনো সাড়া নেই।

অতীশ অস্বস্তিতে পড়ে গেছে। বাবা ও-ঘরে শুয়ে। জোরে কথা বলতে পারছে না। জিরো পাওয়ারের আলোতে অস্পষ্ট এক নারী ও-পাশে দাঁড়িয়ে। কিছুই দেখছে না মত, কিছুই শুনছে না মত। যেন ধীর স্থির, মানুষ আত্মহত্যা করার আগেও বোধহয় এতটা কাঠ হয়ে যায় না। এক গভীর নিঃসঙ্গ আত্মার তাড়না থেকে যেন নির্মলা উঠে এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার কেমন ভয় ধরে গেল।

কাছে গেল সে। তারপর পাশে দাঁড়িয়ে হাত ধরল। বলল, এস।

নির্মলা তেমনি কাঠ—নড়ছে না।

এস প্লিজ। আমার অমন হয়। কি করব বল। আগে একা ছিলাম, কত দুঃসাহসিক কাজ অবহেলায় করতে পেরেছি। এখন পারি না। ভয় হয় কেবল, কে কখন জীবন থেকে আমার হারিয়ে যাবে। তুমি বিশ্বাস কর, তার কাছে দেখছি এখন সারেন্ডার করা ছাড়া উপায় নেই। ঈশ্বর প্রেতাত্মা দুই আমাকে তাড়া করছে।

নির্মলা তার কথা শুনছে কিনা, তাও বুঝতে পারছে না। অপলক তাকিয়ে আছে তার দিকে।

তুমি বিশ্বাস কর, ভেতরে দুর্বল হয়ে গেলে ওটা হয়। কে যেন বলে দেয়, কারো কাছে সারেন্ডার করা ছাড়া তোমার উদ্ধার নেই। হি ইজ গড অফ অল গডস।

কে সে? বল কে?

অতীশ বলল, সে কে আমি জানি না।

তুমি মিছে কথা বলছ।

আমার গত জন্মের কথা, আমার নিজেরও এখন বিশ্বাস হয় না, আমি ভাবতে পারি না কি করে বলি সে কে?

বনি কে?

বনি! বনি মানে, সে স্বপ্নে দেখা এক মেয়ে। মাঝে মাঝে আমাকে ডাকে। আমি জেগে উঠি! আমি সাহস ফিরে পাই। সে আমাকে ভেঙে পড়তে দেয় না।

সে আমার সর্বনাশ। সহসা ভেঙে পড়তে পড়তে আবার শক্ত হয়ে গেল নির্মলা।

না না, ও-কথা বল না। সে আমার কখনও ক্ষতি করতে পারে না। তুমি প্লিজ বনিকে অবিশ্বাস কর না।

বনি তোমার মাথাটি খেয়েছে। তুমি তারই জন্য ঘোরে পড়ে যাও। কোথায় সে! তার ঠিকানা আমি চাই। আমি দেখতে চাই। কপালে যা আছে হবে, আমার সব সে কেড়ে নেবে, আমি মানব না।

নির্মলা থরথর করে কাঁপছিল বলতে বলতে।

অতীশ বলল, ইস্ কি হচ্ছে, তুমি কি পাগল হয়ে গেলে! ওঘরে বাবা ঘুমোচ্ছে।

হ্যাঁ আমি পাগল। অনেক সহ্য করেছি, আর না। আর আমি তোমার ওই ঘোরে পড়া সহ্য করব না। আমাকে ভাল না লাগে বলে দাও। আমি চলে যাব।

কি ছেলেমানুষী শুরু করলে বলতো! বলছি, বনি বলে কেউ নেই।

নেই তো তোমার মাথাটি এ-ভাবে চিবিয়ে খায় কি করে!

আমার মাথা চিবিয়ে খেয়েছে! কি বলছ! ও ও-রকম মেয়েই নয়।

নির্মলা ঠিক বুঝতে পারছে না, একবার বলছে, বনি বলে কেউ নেই, আবার বলছে, ও ও-রকম মেয়েই নয়, সে কুহেলিকায় পড়ে যাচ্ছে। সে অতীশকে জানে, অতীশ কোনো কারণে তাকে ছেড়ে একদন্ড থাকতে পারে না। তার জরায়ুর অসুখের জন্য মেজদি বাড়িতে নিয়ে গেলে, কি যে কষ্টের মধ্যে ছিল, তাও সে বোঝে। বাসায় ফিরে, তাকে না দেখলেই, কেমন জলে পড়ে যায়, এই টুটুল, তোর মা কোথায়! এই মিণ্টু তোর মা কোথায় গেল!

মা বাথরুমে।

আর সঙ্গে সঙ্গে অতীশ হাতের কাছে স্বর্গ পেয়ে যায়। জামা ছেড়ে নিজেই স্টোভে চায়ের জল বসিয়ে দেয়, যেটুকু সাহায্য হয় নির্মলার। বাথরুমে তখন একদন্ড দেরি করতে পারে না, বের হয়ে হয়তো দেখবে, চা জলখাবার রেডি করে সবার জন্য সে অপেক্ষা করছে। এমন মানুষকে সে অবিশ্বাসও করতে পারে না।

আসলে, বনি যে আছে এক গোপন সত্যের গভীরে।

বনিকে কি সে তবে কোনো বন্দরে রেখে এসেছে। নির্মলা ভাবছে। দীর্ঘ সফরে অতীশ কত বন্দরে গেছে শুনেছে। জাহাজী জীবনে কোনো এক তরুণীর কুহেলিকায় সে কি ডুবে আছে। অথবা কোনো ছলনা? প্রত্যাখ্যান থেকে বিষাদ। এমন নিপাট ভালমানুষটির মাথা খেয়ে সরে পড়েছে!

যত আক্রোশ এখন তার কুলুঙ্গির মূর্তিটির ওপর। এটাই বা পেল কোত্থেকে। বাপের বাড়ি থেকে ফিরে দেখেছে, ওটা কেউ ধরলেই রাগ করে অতীশ। এমনকি সে নিজেও একবার ওটা সরিয়ে কুলুঙ্গি পরিষ্কার করতে গিয়ে নিচে ফেলে রেখেছিল। তার খেয়ালই হয়নি, অতীশ এটা কাউকে ধরতে দেয় না, আসলে ভাবছিল, সৌখিন ধূপবাতিদান, দামী, কিনে এনেছে। ঘোরে পড়ে গেলে ধূপকাঠি জ্বালিয়ে বসে থাকার রোগটা থেকে এই সৌখিন ধূপবাতিদান কেনার আগ্রহ। সে বাসায় না থাকলে, আরও নিরুপায় হয়ে যায়, কিনেই আনতে পারে। অতীশের এত আগ্রহ এমন বিশ্রীভাবে পড়ে থাকবে ভাবতে পারে না। দেখেই ক্ষেপে গিয়েছিল। এই কি, কে এখানে রেখেছে! মুখ থমথম করছে রাগে। নির্মলা ভয় পেয়ে মিছে কথা বলেছিল, তোমার ছেলেমেয়ের কারো কান্ড হবে।

অত ওপরে হাত যাবে কি করে!

নির্মলা ধরা পড়ে গেছে। কি করে! অগত্যা বলেছিল, কুলুঙ্গিটা ঝুল-কালিতে ঢেকে ছিল। পরিষ্কার করে আর রাখতে মনে নেই।

তা থাকবে কেন? বলে সে নিজেই উঠে গিয়ে আবার ওটা যথাস্থানে রেখে গজগজ করছিল। কিচ্ছু ঠিকঠাক রাখার উপায় নেই। বাড়ির এক একজন এক এক রকম। যেমন মা, তেমনি তার পুত্র কন্যা।

ঠেস দিয়ে অতীশ সহজে কথা বলে না। কতটা ভিতরে উত্তপ্ত হয়ে উঠলে এমন বলতে পারে নির্মলা বোঝে। সেদিনই সে শুধু প্রশ্ন করেছিল, কত দিয়ে কিনলে?

কিনব কেন?

কে দিল!

অতীশ উঠে চাতালে চলে গেছিল। জবাব দেয় নি।

ওই এড়িয়ে যাওয়া আর সে সহ্য করতে পারছে না।

সে এবারে আরও শক্ত হয়ে গেল। বলল, তোমার পাগলামি অনেক সহ্য করেছি। আর করব না। বনি কে? পাথরের মূর্তিটা কোথায় পেলে!

পাগলামি কথাটা বলেই সে দাঁতে ঠোঁট চেপে ধরল, এটা কি বলে ফেলল! না, না, সে এমন বলতে চায় নি, সে দেখতে পাচ্ছে, অতীশ ধীরে ধীরে তার লেখার টেবিলের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। জানালা খুলে সেখানে সে দাঁড়িয়ে গেল। সে দূরবর্তী কোনো যেন নক্ষত্র দেখছে। একটা কথা বলল না। রাগ করল না। গুম মেরে গেল।

নির্মলা নিজের ভেতরে অসহ্য দাহ অনুভব করছে। স্নেহ মমতা ভালবাসা সে এই মানুষটাকে উজাড় করে দিয়েছে। কোনোদিন তার এই ঘোরে পড়ে যাওয়া নিয়ে বাপের বাড়িতে মুখ খোলেনি। যেন বিদ্রূপের ছটায় সে তবে জ্বলে যাবে। শুধু ছন্নছাড়া নয়, মাথারও দোষ আছে তবে! মেজদি আগেই টের পেয়ে বলেছিল—তোদের মাথা খারাপ আছে। চাল নেই চুলো নেই, একটা গরীব মাস্টারকে শেষপর্যন্ত বিয়ে করলি। মাথা খারাপ না হলে সেই বা সাহস পায় কি করে!

অতীশের বাড়ির লোকেরা টের পেয়েছিল, কুম্ভবাবু রাজবাড়ির সবাই এবং কারখানার লোকেরাও জানে। বাবু মাঝে মাঝে ধূপকাঠি জ্বালিয়ে বসে থাকেন, পচা টাকার গন্ধ পান। অথবা কেউ তাকে তাড়া করে, পচা গন্ধ মানুষের হয়, জীবজন্তুর হয়, মানুষ মরে পচে গেলে, পচা গন্ধ ওঠে—কিন্তু পচা টাকার গন্ধ সে নাকি প্রথমে এই রাজবাড়িতে ঢুকেই পেয়েছিল! এ আবার কি রোগ! অথচ খুবই সাময়িক, তারপর এমন মানুষ অতীশ যে ঘোর সংসারী, বাবার টাকা পাঠানো হয় নি, পত্রিকা অফিস কিংবা কলেজস্ট্রীটের বই পাড়ায় ছোটাছুটির শেষ থাকে না। টুটুল মিণ্টুকে নিয়ে হেঁটে যায়, যেন এই দুই শিশু তাকে এক মহা ত্রাস থেকে তখন আত্মরক্ষার সুযোগ করে দেয়।

নির্মলা মনে মনে ভেবেছে, একবার বাবাকে বললে হয়, কোনো সাইকিয়াট্রিস্ট…..পরে মনে হয়েছে, এতে ভালোর চেয়ে খারাপ হতে পারে বেশি। নিজের দুশ্চিন্তা গোপন করে গেছে। কাউকে মুখ ফুটে বলেনি। দুশ্চিন্তা দুর্ভাবনায় সহসা সে বিষাদগ্রস্ত হয়ে যায়।

আজ সে এটা কি করল! সে নিজেই মানুষটাকে পাগল বলে ফেলল?

অতীশ জানালার সামনে। আবছা আলোয় অতীশ কেমন এক রহস্যময় পৃথিবীর মানুষ হয়ে যাচ্ছে।

নির্মলার সঙ্গে অতীশের যেন যোজন দূরত্ব।

এমন স্থির নিষ্কম্প সে, যে নির্মলার ভয় ধরে গেল। কোনো সকালে যদি সত্যি বের হয়ে যায়, কারণ নির্মলা বুঝতে পারছে এই মুহূর্তে অতীশের যেন তারা কেউ নয়। অন্য কোনও গ্রহের বাসিন্দা, অথবা কোনো অভিমান এবং অপমান মানুষকে এতো আলগা করে দিতে পারে সে টের পায়নি। আজ যেন সে অতীশকে শেষ অস্ত্র প্রয়োগ করেছে। এতদিন সে সহ্য করেছে আজ আর পারেনি। সেতো তাকে অপমান করতে চায়নি। যদি মানুষটা টেরই পেয়ে যায়, সংসারে সবাই একরকমের তার আশ্রয় নেই কোথাও, সে ভেসে যাচ্ছে, যেমন সে জাহাজে ভেসে পড়েছিল, কোথায় তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সে জানত না, সে জাহাজের কলকব্জার মত কোনো নাট বল্টু, তার কাজ এই জাহাজ নিয়ে শুধু ভেসে যাওয়া—তার শেষ কোথায়, কেন সে ভেসে চলেছে এর কোন জবাব সে পায়নি। এই জবাবের আশাতেই কি সে ঘোরে পড়ে যায়! অহেতুক সব জীবনের বাড়তি খড়কুটো ঝেড়ে ফেললে কী তার মুক্তি!

নির্মলা আর পারছে না।

সে তাকিয়েই আছে।

জোরে কথা বলতে পারছে না। ও-ঘরে বাবা আর পঞ্চতীর্থকাকা না থাকলে আজ কি ঘটত সে জানে না।

নিজের জোর হারিয়ে ফেলছিল নির্মলা।

যেন এক মানুষ হেঁটে চলে যাচ্ছে, সামনে, দু’চোখ যেদিকে যায় চলে যাচ্ছে। ফসলের মাঠ পার হয়ে, নদী অতিক্রম করে কোনো বনভূমিতে মানুষটা তার হারিয়ে যাচ্ছে।

সে এবার নিজেকে কি বলে প্রবোধ দেবে বুঝতে পারছে না। অতীশের পাগল জ্যাঠামশাইও এই এক অপমানের হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্য গৃহত্যাগ করেছিলেন কি না কে জানে! বড় জেঠিমার মুখ চোখ দেখে টের পেয়েছে, জীবনে এতবড় শূন্যতা শত্রুরও যেন না হয়! নিখোঁজ স্বামীর প্রত্যাশায় জেঠিমা এখনও জানালায় বসে থাকেন।

সে কাছে গিয়ে ডাকল, এই।

অতীশ দূরের আকাশে কি দেখছে!

এই শুনছ! কি দেখছ এতো! কি আছে ওখানটায়! এই, তুমি কথা বলছ না কেন! কথা বল, প্লিজ। আমার ভয় লাগছে। তুমি এমন করলে আমরা যাব কোথায়, এই। আমি বুঝে বলিনি। মাথা ঠিক ছিল না। বল এতো রাতে কেউ উঠে একটা ধূপবাতিদানের নিচে দাঁড়িয়ে থাকলে ভয় লাগে না! আমার কি দোষ বল! জান তো রাগলে মাথা ঠিক থাকে না।

নির্মলা অতীশের হাত ধরে টানছে। এস শোবে।

কী ঠান্ডা হাত! যেন বরফে জমে যাচ্ছে মানুষটা। সহসা কি মনে হল কে জানে, নির্মলা পাগলের মত ওর কপালে, মুখে বুকে চুমু খেতে থাকল। এই শীতলতা থেকে আত্মরক্ষা করার এছাড়া আর কি উপায় আছে সে জানে না। পুরুষ নারীর এই ভালবাসার কাছেই শেষ পর্যন্ত নিজেকে সমর্পণ করতে চায়। শুধু ঈশ্বরের কাছেই নয়, নারীর কাছেও। সে এর জোরেই যেন আজ বাজি লড়ছে, কে সেই অদৃশ্য শক্তি, কোন সে দেবতা, কার প্রভাবে এই আত্মবিস্মৃতি ক্ষণিকের জন্য……

না, কিছুতেই সে হার মানবে না। পুরুষ নারীর উত্তাপে গলবে না এটা সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারে না। সে এবার জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। আড়াল দিল নিজেকে দিয়ে। পৃথিবীর সব আলো থেকে সে তার মানুষটাকে নিজের আলোয় ফিরিয়ে আনার জন্য বুকে মুখে গাল ঘষতে লাগল। আঁচল তার খসে পড়েছে। সে মানুষটাকে আবার নিজের মধ্যে ফিরিয়ে আনতে চায়। আসলে নির্মলা জানে না, এ বড় বিপজ্জনক খেলা। হেরে গেলে সে আজীবন নারী মহিমা হারাবে তার পুরুষের কাছে। এই অপমান কোনো রুক্ষমাঠের মত তাকে তাড়া করবে।

সে যেন তার জোর সব হারিয়ে ফেলবে মানুষটার কাছে।

সে পারছে না কেন! সে কি হেরে যাচ্ছে, সে এভাবে কতদিন তার মানুষটার ঘোর কাটিয়ে দিয়েছে, অতীশ সচেতন হয়ে উঠেছে এবং এক সুশৃঙ্খল জীবন আবার। এই সংসারে সে ফিরে এসেছে।

ভেবেছে কি মানুষটা!

এই শীতের মধ্যে সে আর কি করতে পারে!

সে হেরে যাচ্ছে।

তার বুক বেয়ে সহসা দুঃখ কোনো সুতোর মত অতৃপ্ত আকাঙ্খায় ডুবে গেল।

সে বুকে মুখ রেখে কেঁদে ফেলল।

আর তখনই দেখল সস্নেহ দুটো হাত নির্মলাকে জড়িয়ে ধরেছে।

এই ফেরা কতকাল পর যেন, কোনো নতুন দ্বীপ আবিষ্কারের মত খেলা শুরু হয়ে গেলে যেন এ জীবনে আবার সত্যি ফিরে আসা যায়।

এই এস। নির্মলা বসল।

দুই শিশু ঘুমিয়ে আছে।

জায়া এবং জননী। এই রাতে মানুষটা তার মধ্যে সহসা গভীর উত্তাপের সঞ্চার করলে, সে বুঝতে পারল বড় অমোঘ নিয়তি মানুষের। সে এখন লেপের নিচে ঢুকে পড়তে চায়। টেনে নিচ্ছে তাকে।

আর অতীশ সে সময়ই বলল, জান আমাদের জাহাজ অজানা সমুদ্রে হারিয়ে গিয়েছিল!

নির্মলা বলল, জানি। আসলে নির্মলা কিছুই জানে না, কিন্তু এমন চরম মুহূর্তে সে কোনো কথাই শুনতে আগ্রহ বোধ করছে না।

অতীশ বলল, জানো বনি ছিল তখন আমার একমাত্র সঙ্গী।

জানি। আবার ঘোরে পড়ে যাচ্ছে না তো!

সব জান!

আমি কিচ্ছু শুনতে চাইনে। বনি থাক আর তোমার ধূপবাতিদানই থাক, ঈশ্বর হলেও তাকে আমি এখন ক্ষমা করব না। এস তো। ইস্ কি ঠান্ডা! হাত পা টাল মেরে গেছে। জোরে জড়িয়ে ধরো—প্লিজ। নির্মলা লেপ দিয়ে অতীশের শরীর ঢেকে দিচ্ছে। কিছুটা শরীরে টেনে দিয়ে অতীশকে পাশে নিয়ে শুয়ে পড়ল।

অতীশ তখনও জানালার দিকে তাকিয়ে আছে।

ঠান্ডা হাওয়া ঢুকছিল।

নির্মলা ধড়ফড় করে উঠে বসল।

জানালার পাট বন্ধ করে দিয়ে আবার এসে পাশে শুল নির্মলা।

জানো পাখিটা ছিল আমাদের সঙ্গী!

নির্মলা উত্তেজনায় অস্থির হয়ে উঠছে। এই মুহূর্তে সব ভেঙে-চুরে ধসে গেলেও তার কান্ডজ্ঞান ফিরবে না। সে অতীশের কোনো কথাই শুনছে না। পাখি, ঈশ্বর, প্রেতাত্মা এ মুহূর্তে একেবারে অর্থহীন।

জান আমরা কতদিন বোটে শুধু ভেসে গেছি। কখনও ঝড়, কখনও শান্ত সমুদ্র। আর চারপাশে ব্যাপ্ত হাহাকার। বোট কোথায় কোনদিকে ভেসে যাচ্ছে জানি না। কাপ্তান চোখের সামনে এমন সজীব তরুণীর মৃত্যু দেখতে বোধহয় রাজি ছিলেন না। তোমাকে বলিনি, কাউকে বলিনি, এমন এক আশ্চর্য অভিযানের কথা ভুলতে চেয়েছিলাম।

নির্মলা পাগলের মত ওকে নিয়ে খেলা করছে।

অতীশ বলল, এখন শুধু ভাবি, আমি মরে গেলে তোমাদের কি হবে? টুটুল মিণ্টু কাকে বাবা বলে ডাকবে। তোমাদের নিয়ে আমি যে নতুন বোটে উঠে এসেছি নির্মলা। সেখানেও প্রতি মুহূর্তে ভাবি আর বুঝি ডাঙা পাব না। সে সামান্য থেমে বলল, ভাবতাম আর বুঝি দেশে ফেরা হবে না, বাবা মা জানবেই না, তাদের মেজ পুত্রটি এক অজানা সমুদ্রে শুধু ঘোরপাক খাচ্ছে। তখন কিন্তু বনিই সাহস দিয়েছে। বলেছে, আমাদের কিছু করার নেই। তাঁর কাছে সারেন্ডার করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। রাগে দুঃখে চিৎকার করে উঠতাম, বনি প্লিজ চুপ কর! আমি বিশ্বাস করি না, আমি মানি না। প্লিজ বনি প্লাংকাটন খেতে শেখ। প্লাংকাটন খেতে শিখলে, সমুদ্রের নিষ্ঠুরতা আমাদের গ্রাস করতে পারবে না। একদিন না একদিন আমরা ঠিক ডাঙা পেয়ে যাব!

তুমি কি আবার ঘোরে পড়ে যাচ্ছ! শরীর তোমার ঠান্ডা মেরে যাচ্ছে কেন! চুপ করবে কিনা বল। আমি তোমার অতীত জানতে চাই না।

নির্মলা ক্ষোভে ফেটে পড়ছে—বাবার যে কি স্বভাব কে জানে, একটু কিছু ছুতো পেলেই দুর্বল হয়ে পড়ে, তার উপর মৃত্যুযোগের কথা কেন যে বলতে গেল। কারখানার অবস্থা দিনকে দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। অতীশ একটা ডামি মাত্র। বউরাণীর ইচ্ছেই শেষ কথা। কুম্ভবাবু কাবুলবাবুরা কি যে সলাপরামর্শ দিচ্ছে, মানুষটা অফিস থেকে ফিরে কেবল গুম মেরে থাকে। মাঝে মাঝে একটাই কথা, কি যে হবে বুঝছি না! কোথায় গিয়ে উঠব।

অতীশ পাশ ফিরে শুল। যেন তার এখন এসব ভাল লাগছে না।

নারীর এর চেয়ে আর বড় অপমান কি আছে জানে না নির্মলা। সে ভেতরে জ্বলছে। অস্থির এবং উন্মত্ত আচরণ করাও অস্বাভাবিক নয়।

ঠিক এ সময়েই অতীশের হাই উঠছে। অতীশ যেন ঘুমিয়ে পড়ার আগে জানতে চাইল, কোনো চিঠি এল।

অতীশ কি চিঠির প্রত্যাশায় আছে নির্মলা জানে। মাঝে মাঝে বলছে, না, হবে না। এখন স্কুলের চাকরি পাওয়াও কঠিন।

গাঁয়ে চেষ্টা করলে তাও পাচ্ছে না! নিজের লোক না থাকলে হয় না। এবং হবে না ভেবেই সে লেখালিখিতে বেশি জোর দিয়েছে। কোনো রকমে এই আয়টা যদি বাড়িয়ে তুলতে পারে।

নির্মলা হারতে রাজি নয়। রাজি নয় বলেই গাঁয়ে, গাঁয়েই সই। সে সুবোধদাকে বলেছে, ওকে আমি রাজী করাব। আপনি চেষ্টা করলে হবে। চাকরির খুবই দরকার। দিন দিন কেমন হয়ে যাচ্ছে। বলল, জান ওরা চিঠি দিয়েছে।

কারা!

ঐ যে বলগনার কাছে মেয়েদের স্কুল।

সত্যি?

সত্যি।

আর কি হল কে জানে, অতীশ নির্মলাকে বুকে টেনে নিয়ে পাগলের মতোই তোলপাড় করে দিতে থাকল।

নির্মলা শুধু বলল, এই আস্তে। ওরা জেগে যাবে। সব দুমড়ে মুচড়ে কি করছ? কি দস্যিরে বাবা! লাগে না!

সকালে উঠেই অতীশ কুম্ভবাবুর বাসায় চলে গেল। সে দু’দিন অফিস যেতে পারছে না। খবরটা দেওয়া দরকার।

দরজা হাসিই খুলে দিল! এতো সকালে সে কখনও আসে না। রাধিকাদার অফিস আটটায়। তিনিও ঘুম থেকে ওঠেননি। শীতের সকাল। সহজেই বেলা বেড়ে যায়। অতীশকে দেখে তিনি বিস্মিত হলেন। এতো সকালে অতীশ!

হাসিও কম বিস্মিত নয়।

সে বলল, আপনি!

কুম্ভবাবুকে বলবে, দুদিন অফিস যেতে পারছি না।

আপনার বাবা এসেছেন? টুটুলের হাতেখড়ি?

অতীশ বলতে পারত, হ্যাঁ হাতেখড়ি। বলতে পারত, বাবা শুধু হাতেখড়ি দেবার জন্য আসেননি। পুত্রের মৃত্যুযোগ আছে টের পেয়েও এসেছেন। বিচলিত। এখন ঝড় সামলাতে হবে। এটা তার কাছে আর এক ঝড়ের শামিল। আর্থিক সঙ্গতি কতটা বাবা ঠিক বুঝতে চান না। রাজবাড়ির কারখানার ম্যানেজার, বিশাল বাসাবাড়ি, খোলামেলা জায়গা, এমন কি বাগান, পুকুর সব মিলে কলকাতা শহরে এতবড় ফাঁকা জায়গা পতিত পড়ে থাকতে পারে তিনি বিশ্বাসই করতে পারেন না। যেন এখানে আলাদা এক সাম্রাজ্য বানিয়ে অধীশ্বর সেজে আছেন কুমারবাহাদুর। বাবা বিকেলেই বাড়িটা ঘুরে দেখেছেন। পঞ্চতীর্থকাকাণ্ড।

বাবার অদ্ভুত প্রশ্ন, ক’বিঘা জমি।

অতীশ যা জানে বলেছে, বিঘে চল্লিশেক হবে।

বাবুর্চি পাড়ার দিকে একটা নিমগাছ আছে দেখলাম।

অতীশ তিন চার বছর থেকেও কোথায় নিমগাছ আছে জানে না। বাবার এটা স্বভাব, গাছপালার প্রতি তাঁর মোহ আছে। তবে বাবা মানুষের চেয়ে গাছ বেশি চেনেন। দরকারি অদরকারি গাছ, এমন দুটো ভাগ আছে তার। সব বাড়ি খুঁজে একটাই দরকারি গাছ খুঁজে পেয়েছেন। বিশাল এলাকা জুড়ে ফুলের বাগান, একটা স্থলপদ্ম গাছ নেই, আম জাম জামরুল নেই, কেবল পাতাবাহার বোগেনভেলিয়া, মেগনোলিয়া, এতো জায়গা থাকতে শ্বেতজবার গাছ নেই, পঞ্চজবা, ঝুমকোলতা নেই, আছে রক্তকরবী, মালঞ্চফুল, কিন্তু দেবদেবীর পুজোয় লাগে এমন একটাও ফুলের গাছ খুঁজে না পেয়ে হতাশ হয়েছেন। তিনি বাবুপাড়া, খেলার মাঠের দিকেও ঘুরে এসেছেন, না, নিমগাছ ছাড়া উল্লেখ করার মত তাঁর আর কোনো গাছ নেই।

বাবা বলেছিলেন, তোমার এদিকটায় তো কিছু জায়গা আছে দেখছি। আর কিছু না কর, একটা তুলসী গাছ লাগিয়ে দিও।

বাবা যখন শুরু করেন, তখন সহজে ছেড়ে দেন না।

বাবার বয়েস হয়েছে, এ-দেশে এসে বাবার বিশ্বাস অবিশ্বাস নিয়ে একসময় সে ক্ষোভ প্রকাশ করত, কিন্তু জাহাজ থেকে ফিরে এসে বাবার কথার কোনও বিশেষ প্রতিবাদ করত না। জলে পড়ে গিয়েছিলেন, এখন মেজ পুত্রটির দৌলতে অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটাতে হয় না। জাহাজ থেকে ফিরে আসার সময় বেশ কিছু টাকা হাতে এসেছিল। সবটাই সে বাবার হাতে তুলে দিয়েছিল, সেই টাকায় কিছু আবাদের জমি কিনে রেখেছিলেন। এখন অবশ্য বাবার আবাদ সম্পর্কে আগ্রহ থাকলেও জমি সম্পর্কে খুব ভাল ধারণা নেই। বাবার চিঠিতে এক কথা, জমি না যম। পতিতও ফেলে রাখা যায় না, আবাদ করলেও লোকসান। চাযের খরচ ওঠে না।

হাসি বলল, ভেতরে আসুন। দাঁড়িয়ে থাকলেন কেন। চা হচ্ছে।

এখন আর চা না। অনেক কাজ।

আর তখনই কুম্ভবাবু দাঁতে ব্রাস দিয়ে হাজির।

দাঁড়িয়ে থাকলেন কেন, এই হাসি, আর এক কাপ জল দিয়ে দাও।

কুম্ভ জানে হাসিকে দেখলে বাবুটির মাথা খারাপ হয়ে যায়। কেবল হাসির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। হাসিও এমন দেবদূত মার্কা ভগবানকে দেখলে নড়তে চায় না। যেন হাসিকে দরজা থেকে সরিয়ে দেবার জন্যই তাকে আড়াল করে দাঁড়াল। হাসিকে রাতে, অতীশবাবুর কথা বলে কতদিন যে গরম করে দিয়েছে, হাসি রাজি না, হাসির শরীর ভাল না, কিন্তু পাশে রমণী শুয়ে আছে, সে পুরুষ মানুষ হয়ে ঠিক থাকে কি করে! হাসির গরম ধরে উত্তমকুমারের ছবি দেখলে, আর বাবুটির কথা তুললে।

এই এক মজা আছে হাসির শরীরে। এই মজাটা টের পেয়েই সে বাবুটিকে তোষামোদ করে। বাবুটি বিপাকে না পড়লে আসেন না। আজ আবার কোন বিপাকে পড়েছেন কে জানে!

সে বলল, আসুন। চা হয়ে গেছে। বেশি দেরি হবে না।

অতীশ ভেতরে ঢুকে বারান্দায় উঠতেই হাসি মোড়া বের করে দিল।

তাড়াতাড়ি কর। কোনদিকে যে সামলাব। কুম্ভবাবু আপনি অফিস থেকে একটু সকাল সকাল ফিরলে ভাল হয়। এক জায়গায় আপনাকে নিয়ে যাব।

কোথায় যাবেন?

বউবাজারে। আপনি তো স্টোন চেনেন। মুন স্টোন গোমেদ পলা সব কিনতে হবে।

আমাকে যে ঠাট্টা করতেন, এখন।

অতীশ বলল, কি করি, টুটুলের জন্য দরকার। তার বাবাকেও পরতে হবে। আমার নাকি সময় খারাপ যাচ্ছে, আরে এই হাসি তোমার হল! দাও।

বসুন না দাদা! হাসি তো পুজোর দিন সকাল থেকেই চলে যাবে বলেছে।—দিদি একা পেরে উঠবে না। দিদির চেয়ে হাসির চিন্তা বেশি, বলে কান্নি মেরে হাসিকে দেখল কুম্ভ। শত হলেও অতীশ উপরওয়ালা, বউরাণীর পেয়ারের লোক। একটু দেখলে হাসির কিছু খসে পড়বে না।

সে কি মনে পড়ে যেতেই বলল, আচ্ছা দাদা আপনার বড় জ্যাঠামশাই নাকি পাগল ছিলেন? অতীশ তাকাল কুম্ভর দিকে।

বউরাণীর কি কথা! জানেন, আপনি নাকি আপনার পাগল জ্যাঠার মত দেখতে। আপনাদের বংশের সবাই লম্বা খুব না দাদা?

বউরাণী বলতেই পারে। কিন্তু এতদিন পরও বউরাণী মনে রেখেছে তার জ্যাঠামশাই পাগল ছিলেন, বংশে তবে পাগলের উৎপাত আছে। বংশে থাকলে রোগ ছড়ায়। নির্মলা তবে সত্যি জেনে ফেলেছে তার মাথার দোষ আছে। জাহাজেও সে একবার বনিকে চিৎকার করে বলেছিল, বনি আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি না তো। মাস্তুল থেকে সে একবার পড়ে গিয়েছিল। কাপ্তান-বনি মিলে তাকে হাসপাতালে রেখে এসেছিল। মাথায় চোট লেগেছিল খুব। নিরাময় হবার পর বন্দরে বন্দরে কাপ্তান আর বনি মিলে তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেত। কি বলতেন ডাক্তার সে জানে না। কি পরামর্শ দিয়েছিলেন তাদের সে তাও জানে না। বনি মাঝে মাঝে ভেঙে পড়ত, ছোটবাবু তুমি অন্ধকার দেখছ না তো। তোমার স্মৃতিশক্তি ঠিক আছে তো? তোমার মা বাবার কথা মনে পড়ে?

রাতে জানালায় আকাশ দেখতে দেখতে সে কি সব ভাবছিল। এমন কি আচরণ যা ভয় পাবার মতো অথবা তার মাথায় কোথাও গন্ডগোল আছে, নির্মলা কতটা অসহায় হলে এমন বলতে পারে তাও সে বোঝে। সাত আট বছরে নির্মলা তার কম উৎপাত সহ্য করেনি। ঘুণাক্ষরেও তাকে ভাবতে দেয়নি তার মধ্যে কখনও অস্বাভাবিক আচরণ জেগে ওঠে। সে চা খেতে খেতে মনে করার চেষ্টা করল, ঠিক মনে আসছে না, তবে সেখানে একটি সাদা রঙের বোট এবং সমুদ্রের নীল জলরাশি দেখতে পেল। আজকাল এটা তার হয়েছে, সে যখন গুম মেরে যায়, তখন কে যেন তাকে তাড়া করে। বাসাবাড়িটাতে সে একা থাকতে পর্যন্ত ভয় পায়। নির্মলা জানেই না, এক রাতে আর্চির প্রেতাত্মার উপদ্রব তাকে সহ্য করতে হয়েছে। জানেই না জানালার বাইরে যে পাতাবাহারের গাছগুলি আছে সেখানে কুয়াশা জল হয়ে সেই অবয়ব মিশে গেছে। তার বড় ভয় এই গাছগুলিকে। আর্চির প্রেতাত্মা গাছগুলির মধ্যে আশ্রয় পেতেই কেমন সব তারা ডালপালা মেলে জানালা ঢেকে দিল।

সেই প্রেতাত্মা এখন শান্ত। স্ত্রীর কাছেও সে পাগল ছাড়া কিছু না।

সেই প্রেতাত্মার প্রথম চেষ্টা ছিল নির্মলাকে সরিয়ে দেওয়ার, সেই দূরাতীত গ্রহ থেকে বনি’র প্রভাবে তা পারেনি, মিণ্টুকে জলে ডুবিয়ে শ্বাস বন্ধ করে মারারও চক্রান্ত করেছিল, পারেনি। টুটুলকে টুল থেকে ফেলার চেষ্টা করেছে, চেষ্টার কসুর নেই, এবার কি তবে তার পালা। সেই অশুভ প্রভাব বার বার হেরে যাচ্ছে, কোনো শুভ প্রভাবের কাছে, সে আর কেউ নয়, বনি। অশুভ প্রভাব শেষ পর্যন্ত হেরে গেলে কি ছেড়ে দেয়! নাকি সে ঠিকই আছে। আর এবার বাবা টের পেয়ে পঞ্চতীর্থকাকাকে নিয়ে এসেছেন, গ্রহ দোষ কাটাবার জন্য!

সে আর আগের মত বাবার সব কুসংস্কার ভেবে উড়িয়ে দিতে পারে না। জীবনে নির্মলা না এলে, টুটুল মিণ্টু না এলে আজও হয়তো বাবার নির্দেশ অগ্রাহ্য করতে পারত। এখন তার কিছু হলে ওরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে!

সে নিজেই আজ কুম্ভবাবুর কাছে এসেছে। বাজারে দু’নম্বরী মালে ছেয়ে গেছে। কুম্ভবাবু কোষ্ঠীচর্চা করে, সে জানতে পারে—সে নিজেও কোনো আঙুল বাদ রাখেনি, অনেক ভরসা এখন এই মানুষটার ওপর। কুম্ভবাবু যে দু’-নম্বরি কাজ অবহেলায় করতে পারে, সেও এই পাথরের প্রভাব। সত্য অসত্য বিবেক তার কাছে কুহেলিকা ছাড়া কিছু না।

সে বলল, উঠি।

কুম্ভ হা-হা করে উঠল, বসুন না। বসিয়ে রাখলে তার লাভ, হাসি মানুষটার প্রভাবে পড়ে যায়। হাড়ে মজ্জায় মানুষটা এমন আশ্চর্য সুষমা বয়ে বেড়ায়—যা নারীকে প্রজ্বলিত করে। প্রজ্বলিত কথাটা ভাবতেই তার ভাল লাগল।

আপনার জ্যেঠা পাগল হলেন কেন দাদা?

সে আমি কি করে বলব!

তিনি কিরকম পাগল ছিলেন?

কুম্ভ কি বাজিয়ে নিচ্ছে, তিনি কি তার মতো মাথার গন্ডগোলে ভুগতেন। অতীশের হাসি পেল। বলল, তিনি আর যাই করুন ধূপকাঠি জ্বালিয়ে বসে থাকতেন না।

এটা দাদা আপনার রাগের কথা! বলেছি, আপনি ধূপকাঠি জ্বালিয়ে বসে থাকেন বলে কোনো গন্ডগোল আছে, বলেছি।

কথা বাড়ছে দেখে অতীশ বলল, এমনি বললাম, উঠি হাসি।

আপনার বাবা এসেছেন বউরাণী জানে?

ঠিক জানি না।

জানে।

জানতে পারে।

এ-বাড়িতে কাকপাক্ষি ঢুকলেও বউরাণী টের পায়। সব রিপোর্ট করতে হয়। কে এল, কে গেল—যা দিনকাল পড়েছে। শুনেছেন তো নবর খোঁজ পাওয়া গেছে?

নব?

বারে সুরেনের বেটা। ভুলে গেলেন?

বাড়ি ফিরেছে?

না। জামাকাপড় দেখে সুরেন সনাক্ত করতে গেছে। রাতে পুলিশ এসেছিল।

অতীশ কেমন ত্রাসে পড়ে গেল।

নব কি খুন হয়েছে!

তাতো জানি না।

রাজবাড়িতে পুলিস, নবকে সনাক্ত করতে যাওয়া—রাতের এতসব ঘটনার কোনো খবরই রাখে না অতীশ। বাসাবাড়িটা তার অন্দরের দিকে বলে, কোন পাড়ায় কি ঘটে সঙ্গে সঙ্গে জানতে পারে না। সুরেনের সঙ্গে দেখা করা দরকার। এতবড় বিপদ সুরেনের। হোক রাজবাড়ির অফিস-পিওন, নবকে তো সেও চেনে।

সুরেন ফিরেছে?

বারান্দার সিঁড়ি ভেঙে রাধিকাপ্রসাদ নামার সময় অতীশকে বললেন, রাতেই ফিরে এসেছে সুরেন। কুম্ভ তার বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। রাজবাড়ির সুপার সবার আগে খবর পায়। সুরেন জানে কাকে এসে প্রথম খবর দিতে হবে। অফিস থেকে সাহায্য, লোকজন দিয়ে সাহায্য একমাত্র বাবাই

করতে পারে।

সে ডাকল, বাবা।

রাধিকাপ্রসাদের হাতে গাড়ু।

টাক মাথা, ঘাড়ের কাছে কিছুটা সাদা চুল, বাঁধানো দাঁত ঝকঝক করছে। অতীশবাবু এসেছেন, তাই হাত-মুখ না ধুয়েই দাঁতের পাটি দুটো মুখে বসিয়ে দিয়েছেন। শিয়রের টেবিলে জপের মালার মতো রাতে পড়ে থাকে। একটা চিনেমাটির রেকাবে দু-পাটি দাঁত জলে ভেজানো থাকে। সকালে বাথরুম সেরে হাত-মুখ ধুয়ে নিজের ঘরে খাটের ওপর বসলে প্রথম কাজ হাসির, দাঁতের পাটি দুটো হাতে তুলে দেওয়া। দ্বিতীয় কাজ ধুতি পাঞ্জাবি বের করে দেওয়া। তৃতীয় কাজ, এক গ্লাস শরবত এবং দুটো সন্দেশ। স্বল্পাহারি। বাবা যে দু’হাতে রাজার ভান্ডার লুটছে, দেখলে কে বলবে!

কুম্ভ বাবাকে গড় হয়ে বলল, সুরেন কখন এসেছিল!

রাত একটা হবে। সঙ্গে কালীবাবু। নধর গেছে। নধরের বেটা নুনুও গেছিল।

কুম্ভর বড়ই যেন দুশ্চিন্তা। লাশ মর্গে?

কোথায় লাশ! লাশ পাওয়া যায় নি, প্যান্ট শার্ট পাওয়া গেছে। পকেটে রাজবাড়ির ঠিকানা। রাধিকাবাবুর সোজা জবাব।

লাশ গায়েব!

লাশ সিউরির সদর হাসপাতালে।

অতীশের চা খাওয়া হয়ে গেছে। কাপটা নামিয়ে সে উঠব উঠব করছিল, উঠতে পারছে না। নব খুন। ভাবতে পারে না। আসলে সেও যে আচিঁকে খুন করেছে। দুর্বত্ত আর্চির হাত বনির মর্যদা নিয়ে টানাটানি করছিল, সে স্থির থাকতে পারেনি। কেবিনের ভিতর ধস্তাধস্তি, দরজা লাথি মেরে খুলতেই বীভৎস দৃশ্য। উলঙ্গ বনির ওপর আর্চি চেপে বসেছে, বনি দু-হাতে বাধা দিচ্ছে, পারছে না। সামান্য বালিকার পক্ষে পারা সম্ভবও না। তাকে দেখেই ছুটে পালাবার চেষ্টা, আর কি হয়ে যায়, মানুষের মধ্যে থাকে নিরন্তর এক মহিমা, বয়স কম থাকলে আরও বেশি, এক তরুণ তার শেষ থাবা প্রসার করে দিয়েছিল। আসলে সে কি হয়ে গেছিল জানে না। সরল সাদাসিদে, ভীরু অতীশ মুহূর্তে প্রতিশোধপরায়ণ যুবক, দীর্ঘকায় বলশালী অতীশের থাবার মধ্যে জবাই করা মুরগীর মত ছটপট করছিল। তার সেই আসুরিক লীলায় বনিও ভয় পেয়ে ছুটে জামা-প্যান্ট নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেছিল। বাধা দিতে পারেনি।

নব খুন হয়েছে।

খুন কেন হয়!

নব কি আর্চি হয়ে গেছিল।

সে বলল, রাধিকাদা নবকে কে খুন করেছে?

কে খুন করবে। কেউ না। নব কিনা তারই বা ঠিক কি! কথায় কথায় খুন বুঝলে না। তবে কি জান, যে খুন করে সেও খুন হয়।

অতীশ ভেতরে কেঁপে উঠল।

তাহলে বাবা ঠিকই বলেছেন, টুটুলের কোষ্ঠীতে তার পিতার মৃত্যুযোগ আছে, সাত বছরের মাথায় টুটুল পিতৃহারা হবে। অতীশ নাড়া খেল ভেতরে। দু’এক বছর আর সে আছে। এই গাছপালা মাঠ, টুটুল মিণ্টু নির্মলা কিংবা শস্যক্ষেত্র সব অর্থহীন। সে কেমন চুপচাপ ভীতু বালকের মত কিছুক্ষণ বসে থাকার সময় শুনল, কি যে হল দেশে! যেখানে সেখানে লাশ পড়ে থাকছে। নকশালরা সব খারাপ লোককে সরিয়ে দেবে বলে গাঁয়ে গঞ্জে শহরে নেমে পড়েছে।

অতীশ সহসা বলল, কুম্ভবাবু কাগজটা আছে?

কোন কাগজ!

গতকালের।

কি করবেন?

একটু দরকার আছে।

গতকালের কাগজেই ম্যানেজার খুন হবার খবর ছাপা হয়েছে। মাঝে একদিন সে অফিসই যেতে পারল না। রাস্তাঘাট কখন কি চেহারা নেবে কেউ বলতে পারে না। কেশব সেন স্ট্রীটের মোড়ে এসে জ্যাম। রাস্তা বন্ধ। রাস্তায় যুবকের লাশ। যেন গোটা এলাকাটা থমকে দাঁড়িয়েছে। দরজা জানালা বন্ধ। বোমার আওয়াজ। আর মানুষের এলোপাথাড়ি ছুটোছুটি। আকছার এটা হচ্ছে বলে, সে ফেরা না পর্যন্ত নির্মলা জানালায় দাঁড়িয়ে থাকে। দেরি হলে ছটফট করে। দুশ্চিন্তায় মুখ কালো হয়ে যায়। যেন এই যে বের হয়ে গেল আর ফিরবে কিনা ঠিক নেই। ফিরলেই সেদিনের মত ফেরা হল। আবার পরদিন একই ফেরার অপেক্ষায়।

কাগজটা এনে দিলে অতীশ বলল, আমি উঠি। কাগজটা নিয়ে যাচ্ছি।

নিন না!

কাগজটার কি এতো গুরুত্ব, কুম্ভ টের পেয়ে গেছে। এই তার মজা।

ঠিক ম্যানেজার খুনের খবরটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়বে। তালিকায় শুধু জোতদার নেই, বিদ্যাসাগর নেই, ম্যানেজারও আছে।

ওঠার মুখে অতীশ বলল, নব কি তবে নকশাল হয়ে গেছিল!

নব না কে?

নবর বাবাকে কি পুলিস তুলে নিয়ে গেল?

তুলে নিয়ে যায়নি। জামা প্যান্ট দেখাতে নিয়ে গেছে।

রাধিকাবাবু বাথরুমে, জলসৌচের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। সকালে এলে হাসিও বাথরুমে যায়। খোলা উঠোন পার হয়ে হাসি বাথরুমে কি করছে অতীশ সব টের পায়। বাথরুমের টিনের দরজা। তলায় ইঞ্চি দু’এক ফাঁক। ওপরে টিনের চাল। হাসি গায়ে জল ঢাললেও টের পায়, উদোম গায়ে জল ঢালছে, আর প্রাকৃতিক ক্রিয়ারও শব্দ ভেসে আসে। তখনই সে বোঝে হাসির শরীরে সে ডুবে যাচ্ছে। আর্চির চেয়ে সে কোনো অংশে কম বড় লম্পট না। খুন হওয়া খুবই স্বাভাবিক।

অতীশ চলে গেলেই কুম্ভ মোড়ায় উঠে গিয়ে বসল। খবরটা সে নিজেই দিয়ে এসেছে। সে জানে বাবু ভয়ে কাগজ পড়া ছেড়ে দিয়েছেন। খুন-খারাপির খবরে বাবুর মাথা ধরে। আরে খবরের কাগজের আসল মজাটাই এখানে বুঝিস না! বালিকা ধর্ষণ হলেই প্রথম পাতায় খবর। যে ধর্ষণ করে, আর যারা ধর্ষণের খবর পড়ে তাদের ফারাক মাত্র এক চুল। খুনের খবরেও কম মজা নেই, দুর্ঘটনার খবর খেলার খবর সব তাতেই মজা। এতো মজা থাকতে বাবুটি কাগজ পড়া ছেড়ে দিয়েছে!

বাবুটি আতঙ্কের মধ্যে পড়ে গেছে কুম্ভ মুখ দেখেই টের পেয়েছে। এই বারান্দায় বসেছিল, কিন্তু মনের মধ্যে রাজ্যের অকথা কুকথা।

উঁচু বারান্দা, সামনে নিচু উঠোন। বারান্দায় টানা টিনের চাল। ইঁট গেঁথে একদিকে দেয়াল তোলা। কলকাতা শহরে চারটে ঘর, একটা বারান্দা, উঠোন বাথরুম বিনা ভাড়ায় সেই কবে থেকে ভোগ করে আসছে। কুম্ভর মনেই হয় না, রাজার মেস বাড়ি এটা। আগেকার রাজার আমলে দান-ধ্যান ছিল, জেলার কৃতী ছাত্রদের বৃত্তি দেওয়া হতো, খেতে পরতে পেত। উচ্চ শিক্ষার সুবন্দোবস্ত। সেই মেস- বাড়িটা হাফ হাফ করে একদিকে বাবার রাজত্ব, আর একদিকে রাম ঠাকুরের রাজত্ব। এখন এটা হাফ মেস-বাড়ি। হাফ বাসাবাড়ি। কৃতী ছাত্ররা থাকে, তবে রাজাকে ভাড়া দিতে হয়। মেসে খায়, খাওয়ার খরচ দিতে হয়। কুম্ভর মনে হয় আসলে এগুলো এক সময় আস্তাবল ছিল, লম্বা প্ল্যাটফরমের মত চলে গেছে, ঘরে দুটো চৌকি পড়তে পারে, এই পর্যন্ত।

ছ্যাঁক করে সম্বারের শব্দে তাকাতেই কুম্ভ দেখল হাসি আলুর ছেঁচকি বসিয়েছে। সে দেখল, বাবা ভেতরের দিকে। হাসি গোলগাল, মিষ্টি মুখ, এক সন্তানের জননী, পাছার দিকটা বড় ভারি। চার বছরেও নারী রমণী হয়নি। চুরি করে ভোগ করার মধ্যে কী যে আকর্ষণ! কেউ নেই। সে পাশে গিয়ে বসল, হাতে বিড়ি, একটুকরো কাগজ। যেন বিড়িটা ধরাবার জন্যই উনুনের পাড়ে এসে বসেছে। কিন্তু হাসি টের পায়। সে দাঁড়িয়ে গেল।

হাসি কাল থেকেই গুম মেরে আছে। কেন যে গুম মেরে যায় মাঝে মাঝে বোঝে না, কোনো তস্করের ভূমিকায় কুম্ভ তখন বসে থাকে—তোর এত পরিপাটি করে চুল বাঁধা, গয়নাগাটি পরে নটীর মত সেজে বসে থাকা, সব চৌপাট হয়ে যেত এ-শর্মা বাবুটিকে ঠিক না খেলালে। তা পিয়ারিকে ঘরের ভেতর নিয়ে গেছি সাধে! পিয়ারি, চবনলাল ছিল বলেই এত রোজগার। দু-নম্বরী মালের কারবার, দু-নম্বরী মালের কৌটো সিটমেটাল না দেয় অন্যে দেবে। দাম দরে বনবে না জানি, ফিরে আসবে, বেটা পিয়ারি তো ফের ঘুর ঘুর করছে। কিন্তু বাবুটিকে মাথার ওপর বসিয়ে দিয়ে আমার সব রোজগার লাটে তুলেছে। তোর অলঙ্কারের বাস্ক আর ভরছে না। আর ঠিক এ সময়েই হাতে খুনতি নিয়ে হাসি গোমড়া মুখে বলল, আচ্ছা বলত, তোমরা সবাই মিলে অতীশবাবুর পেছনে কেন লেগেছ?

আমরা লেগেছি! বিড়িটায় ফুঁ দিয়ে আগুন ধরাতে গেল। সিগারেটে সাটায় না, বাড়িতে সে বিড়ি খেয়ে সারাদিন সিগারেট ফোঁকার জের তুলে নেয়, বিড়িতে মৌতাত বড় বেশি। মুখে বিড়ির গন্ধ থাকলে অবশ্য হাসি রাগ করে। শোবার আগে পেস্ট দিয়ে ভাল করে দাঁত না মাজলে পাশ ফিরে শোবেই না। ঠ্যাং তোলা তো দূরের কথা!

লাগনি? চারু কে?

এই রে খেয়েছে! চারু কে হাসিও জানতে চায়। পিয়ারির সঙ্গে যখন কথোপকথন হয়, খুবই নিরিবিলি, পিয়ারির ফিসফিস কথা, যেন বেটার গলায় কর্কট রোগ, ফ্যাসফ্যাসে গলায় দুজনের আলোচনার মধ্যে চারু ঘোমটা ফেলে খ্যামটা নেচে গেছে, আর তার সতী-সাধ্বী বউ সেটা শুনে মুখ ব্যাজার করে সারারাত নানা কিসিমে গরম করার চেষ্টা করেও কেন ব্যর্থ এতক্ষণে টের পেয়ে বলল, চারু একটা খারাপ মেয়েছেলে।

এই যে সেদিন অতীশবাবুকে বললে চারু বলে কেউ নেই!

এবারে কুম্ভ কেমন ক্ষেপে গেল, দেখ অফিসের লোকজনের সঙ্গে কি কথা বলি, কি করি তা তোমার জানার কথা নয়। চারু থাকলে আছে, না থাকলে নেই।

তার মানে?

যখন দরকার, থাকবে, যখন দরকার হবে না থাকবে না। টাকা রোজগার মুফতে হয় না। গায়ের অলঙ্কার কে দেয়!

তুমি দেখছি বেশ মজার কথা বলছ। চারুকে ট্রেনে তুলে দিলে কেন?

ট্রেনে তুলে দিয়েছি? আমি চারুর কে? কেউ না। সে নিজেই ট্রেনে চড়তে জানে।

জানবে না বলিনি তো! চারু পিয়ারির ভাইঝি?

ধুস তুমি না কি! চারু পিয়ারির রক্ষিতা।

আলাপ আছে?

কারখানায় যাই। পিয়ারির পাউডারের কারখানা, গেলে দেখা হয়।

তবে যে বললে, চারু বলে কেউ নেই, চারুকে তুমি চেন না, পিয়ারি চেনে না, ঘোরে পড়ে গেছে অতীশবাবু, ঘোরে কত কিছু দেখা যায়, এমন পাষন্ডের মত চেহারা চারুকে ছেড়ে কথা কয়েছে বলে মনে হয় না। ঘোরে পড়ে পাষন্ড ঠিক সহবাস করেছে। ঘোরে সবই করা যায়। বুঝলে না!

চারু কিছু বলে না?

না।

কেন বলে না?

কি জানি!

কুম্ভ প্যাঁচে পড়ে গেছে, মেয়েছেলে খাবি আমার, ভাববি বাবুর কথা, কে সহ্য করে! চারুকে দিয়ে বাবুটিকে সে যে হাত করতে চেয়েছিল, ঘুণাক্ষরে প্রকাশ করল না। শুধু বলল, দেখ, পিয়ারি ব্যবসা করে। ব্যবসার জন্য যাই করুক, পাপ মনে করে না। পিয়ারি দু-নম্বরী মালের ব্যবসা করে গাড়ি বাড়ি দেবতা সব হাতের মুঠোয়। অথচ কি দুর্ভাগ্য বল, বাবুটিকে এত লোভ দেখিয়েও হাত করতে পারল না। শেষে ভেবেছিল, যে দেবতা যাতে তুষ্ট, হয়তো মেয়েছেলেতে কাজ হবে সেই ভেবে এক ট্রেনে এক কামরায় তুলে দেওয়া। যাক না যতটা রাস্তা এক সঙ্গে যেতে পারে যাক।

যাক, গেলেই হল! তার বউ বাচ্চা আছে না!

থাকুক না। বউ বাচ্চাও থাকুক, চারুও থাকুক। হারামজাদি বউরাণী পর্যন্ত ক্ষেপে আছে। খেলাটা কেমন জমে দেখ না!

হাসি জানে, অতীশবাবু আর বউরাণীকে নিয়ে আড়ালে কথা ওড়াওড়ি হয়। ডাঁহাবাজ। ডাকসাইটে সুন্দরী। বউরাণী অতীশবাবুর দেশের মেয়ে। কুমারবাহাদুর, এখানে সেখানে চলে যান, বিলেত আমেরিকা করেন, খালি মাঠ পড়ে থাকলে উরাট হবারই কথা। বৃষ্টি বাদলায় ভিজলে, আবাদ চাই। যেমন জমি তেমন তার চাষ। বাবুটিই বউরাণীর জমিতে চাষবাসের যোগ্য লোক। এবং এমন ভাবলেই এক সুপুরষকে সে নিজেও দেখতে পায় শুয়ে আছে আবাদের জমিতে। জমি যে তার, এবং জমি ভিজে গেলে সে ঠিক থাকে কি করে!

বাবুটির কথা ভাবলেই হাসি ঠিক থাকতে পারে না। কেমন রেগে গিয়ে বলল, সর। আমার কাজ আছে।

কুম্ভর বেঢপ চেহারা। সাদা ফ্যাকাসে, গোলগাল লাউয়ের মত। মুখে চর্বি জমে গাল ফোলা। চোখ ছোট। চুল সজারুর মত খাড়া। ছ্যাঁচড়া স্বভাবের মানুষ। গোঁয়ার। তাকে মারধোর পর্যন্ত করে, তখন সে জানে লোকটা কাবু এক জায়গায়। কাল থেকেই কাবু করে রেখেছে। একদম ছুঁতে দেয়নি, উঠতে দেওয়া তো দূরের কথা। সকালে অফিসের ভাত, কলেজের ভাত। তাও রেহাই নেই। যেন পারলে পর্দা ঠেলে ভেতরে নিয়ে ফেলতে পারলেই হল, বাবুটি যখন ঘুরে গেছে, শরীরে গরম ধরতে কতক্ষণ। আর তখনই কি না বলল, সর, আমার কাজ আছে।

কাজ থাকবে না, কাজ তো থাকবেই, ঠিক আছে, সে ঘরে ঢুকে যাবার সময় বলল, কথায় কান দিবি না। চারু যে আছে ঘুণাক্ষরে বলবি না।

হাসি টের পায়, লেগেছে। লাগলেই তুই তুকারি শুরু করে দেয়।

হাসি আমল দিল না। গা সওয়া। সে নিজেও দু-হাতে টাকা পয়সা খরচ করতে না পারলে ব্যাজার থাকে। গরীবের মেয়ে, শ্বশুরঠাকুর বালিকা বধূ ঘরে এনেছিলেন, রাজার কারখানায় অফিসার পোস্টে কাজ। শরীর ছাড়া লোকটা কিছু বোঝে না। বিয়ের রাতেই লোকটার ক্ষ্যাপা মুখ চোখ দেখে কেমন আঁতকে উঠেছিল হাসি।

ঘরের ভিতর থেকেই কুম্ভ বলল, আমার ফিরতে দেরি হবে।

কোনদিন দেরি হয় না!

কুম্ভ বাইরে বের হয়ে বলল, গরম জল দেখি।

হাসি কেতলি থেকে বাটিতে গরম জল ঢেলে ভাত ডাল বসিয়ে দিল।

কুম্ভ নিজের ঘরে আয়নার সামনে। তার সুন্দরী বৌকে নিয়ে বড় অহঙ্কার। রাজার কারখানায় চাকরি, এবং অতীশবাবু ওপরয়ালা হয়ে আসার পর কাবুলেরও যেন কেমন গা-ছাড়া ভাব। এদিকে এখন সহজে মাড়ায় না। অথচ ওরা এই রাজবাড়িতে একসঙ্গে জন্মেছে, বড় হয়েছে। কাবুল কুমারবাহাদুরের নিকট আত্মীয়। রাজবাড়ির বাসিন্দা, শরীরে রাজার গন্ধ। এই কাবুলই তার হটলাইন, অন্দরে কি সলাপরামর্শ হচ্ছে, হট-লাইন মারফত খবর পেয়ে যেত। বৌকে চাগিয়ে দিয়ে এতদিন হট-লাইন বজায় রেখেছে। সে তার অফিসে, বাবা রাজার অফিসে, শম্ভু দুলাল স্কুলে, কলেজে—বাসাবাড়ি খালি, কাবুলের অবাধ প্রবেশ, শরীরে রাজার গন্ধ পেলে কোন সুন্দরী ঠিক থাকে, তবে রাশ খুব আলগা হতে দেয়নি, শরীর দেখিয়ে যতটা। অবশ্য সে নারীকে অবলা মনে করে না, বরং ঘরে তোলার পর মনে হয়েছে, ধূর্ত আত্মপর, নিজেকে ছাড়া কিছু বোঝে না। খুশি না রাখতে পারলে রাতে অনিদ্রা, একবার ক্ষেপে গিয়ে চুল ধরে শুইয়ে দিয়ে সায়া শাড়ি আল্ল্গা করে দিলে, উলঙ্গ হয়েই দরজা খুলে ছুটছিল আর কি, কার মাথা তখন ঠিক থাকে, তুই বেশ্যা মাগীর অধম! আরে, একজোড়া পাথর সেট করা বালা যখন বলেছি দেব, কোনো শালা বলতে পারবে না, কুম্ভ কথার খেলাপ করে, তুই ঠিকই পাবি। দু-চালান মাল গেছে মাত্র, আর পাঁচটা চালান গেলেই, কারখানার দু-নম্বরী টাকা হাতে আসবে। তর সইল না। পাশ ফিরে শুয়ে থাকল!—ঘুম পাচ্ছে, হাত দেবে না। আমি হাত দেবো না তো কে দেবে, কার হাত তোর ও-খানটায় লাগে, বাবুটি তোর মাথা খাচ্ছে। কি সাহস, বলে কি-না, হাসি তোমাকে একটা লক্ষ্মীর পট কিনে দেব! বাবুটিকে হাতে আনার জন্য সে বৌকে সঙ্গে করে কাবুলকে নিয়ে চাঙোয়ায় গিয়েছিল। হাসি সেজেছিল মাইরি। বগলকাটা ব্লাউজ একেবারে ডবকা ছুঁড়ি। ঠোঁটে হাসিকে নীল রঙ দিতে বলেছিল। বাবুটির নীল রঙ ভারি পছন্দ। কিন্তু হাসির তখন এক কথা, না আমার ঠোঁট লাল রঙেই মানায়। তা লাল রঙের দেখরে বাহার। সব ব্যর্থ।

হাসি, হাসি। জবাব নেই।

আরে শুনতে পাচ্ছ না!

কেউ শুনতে পাচ্ছে না। সাড়া দিচ্ছে না।

কি হল। ডাকছি, ইস গাল কেটে গেছে! আরে ডেটলের শিশি কোথায়?

তবু সাড়া দিচ্ছে না। গাল কেটে রক্ত পড়ছে, সে রক্ত পড়তে দিচ্ছে। রক্ত বড় আতঙ্কের উদ্রেক করে। হাসির ছুটে আসার কথা। আসছে না। চারু তবে এতটা তাতিয়ে রেখেছে! বাবুটির জন্য তোর মাথা খারাপ! রাতের গাড়ি, ফাঁকা। এক কামরায় বাবু, তা ফার্স্ট ক্লাস কামরায় কে কবে কাছাকাছি শহরে যায়! বাবুটি আর চারু। কিছু হয়নি, চারুর এক কথা, কিছু জানি না।

কিছু জানি না বললেই হবে! পিয়ারির খাস, পরিস, ফুটপাথ থেকে তুলে তোকে কোথায় বসিয়েছি, যে কম্মে গেলি, তারই হদিস নেই।

এই হাসি, তুমি মরেছ!

হ্যাঁ, মরেছি।

ডেটলের শিশি কোথায়?

জানি না!

জানি না বললেই হবে। বাথরুমে ঠিক পাচার হয়ে গেছে। ডেটল এত কিসে দিস! আবার জ্বলে উঠেছে হাসি।

ইতর।

আমি ইতর! গাল কেটে রক্ত পড়ছে, আমি ইতর। তোর হুঁশ নেই। মরে গেলে কাগে বগে ঠুকরে খাবে জানিস।

খাক।

খাক! এত সাহস কোত্থেকে আসে! কে দেয়। তুই মনে করিস আমি কিছু বুঝি না।

আবার চুপ। সাড়া নেই। এবার আর কুম্ভ পারল না। হাতে রেজার নিয়ে বারান্দায় বের হয়ে গেল। দর দর করে রক্ত পড়ছে—দৃশ্যটা দেখুক, কিন্তু এ-কি, ফিরেও তাকাচ্ছে না। ডাল সেদ্ধ হচ্ছে কিনা হাতায় তুলে দেখছে।

পাশের ঘর ফাঁকা। বাবা বের হয়ে গেছে। শম্ভু দুলালও নেই। ফাঁকা বাসায় লন্ড-ভন্ড কান্ড, এবং এ-সময়েই তার মধ্যে অতিকায় বিষাদের ছায়া নেমে আসে, কার জন্য এত করছে! তা মাথা ঠিক না থাকলে তুই তুকারি এসে যায়, কারখানার প্যাঁচে তো পড়িস নি, এক হাতে সব সামলাই, দেখ না বাবুটিকে কি করি, ইউনিয়নের পান্ডা মনোরঞ্জনের বাঞ্ছা পূরণ করে বাবুটিকে আবার ন্যাজে খেলাব। গো-স্লো দিয়ে শুরু কারখানার তালা মেরে শেষ। বাবুটি তখন দেখবি কি করে! আমার কি, বাপ মাথার ওপর আছে, দু-চার মাস তালা মারা থাকলে এ-শর্মা ভাতে মরবে না। কিন্তু তোর কি হবে। হ্যাঁ, ও-গো বাবুমশাই হাসিকে তোমার লক্ষ্মীর পট কেনা বের করে ছাড়ব।

হাসি ফিরেও তাকাচ্ছে না।

সে সোজা বাথরুমে ঢুকে গেল। গন্ধতেল, গন্ধ সাবানের পাশে ডেটলের শিশি। সে কাঁচা ডেটলাই ক্ষতস্থানে ঢেলে দিল। হাত-মুখ ধুল। স্নান করল। ঘরে এসে জামা প্যান্ট পরে বের হবার মুখে দেখল হাসি ভাত বেড়ে বসে আছে। সে চুপচাপ খেয়ে নিল। না খেয়ে গেলে, ফিরে এসে কি রুদ্রমূর্তি দেখবে কে জানে। আসলে হাসিকে সে যে ভয় পায় এই প্রথম টের পেল। হাসি তাকে গোলাম বানিয়ে ফেলেছে। রাতের হাসি সকালের হাসি বুঝি মানুষের একরকমের হয় না। সে খেতে খেতে বলল, ভাবছি আজই পাথর সেট কিনে আনব।

হাসি রা করল না।

রাতে কুম্ভ ফিরে এসে বালা জোড়া তুলে দিতেই হাসির চোখ মুখ ঝকমক করে উঠল। দরজা বন্ধ করে দেবার সময় বলল, কত নিল?

তা দিয়ে কি কাম? পছন্দ হয়েছে কি না বল?

খু-উ-ব।

ভাবলাম, সঙ্গে নেব তোমাকে। বাবা আবার কি ভাববে। তাঁর অসুবিধার কথা ভেবেই নিলাম না। সব দিক না সামলে চললে, সংসারে বেঁচে থাকা দায় বুঝলে। আজ আর কিন্তু শুনছি না। শরীর খারাপ কদিন থাকে?

হাসির মুখ নিমিষে বিষণ্ণ হয়ে গেল।

এই কি হল!

না কিছু না।

কপালে নীল রঙের টিপ পরছ কেন?

হাসি শাড়ি পাল্টে নীল রঙের পাটভাঙা শাড়ি পরছে। নীল রঙ কেউ ভালবাসে, কেউ বাসে না। নীল রঙের টিপ পরতে তার ভাল লাগছে কেন জানে না হাসি। সকাল থেকেই তার শরীর তেতে আছে। হাসি উঠি বলে, এমন এক দূরাতীত রহস্য নিয়ে অতীশ তাকিয়েছিল যে স্থির থাকতে পারে নি। মানুষটা কাছে এলেই সে সহবাসের ঘ্রাণ পায়। মানুষটা সহবাসে কত পটু জানে না, তার কর্তা নানা কিসিমে তাকে উল্টে পাল্টে দেখতে ভালবাসে। রঙিন সহবাসের অ্যালবাম দেরাজে গোপনে লুকিয়ে রাখে। কত রকম ভঙ্গী, সব ভঙ্গীগুলো ব্যবহার করেও কুম্ভর আকাঙ্খা মরে না।

হাসি আজ প্রথম অ্যালবামের পাতা উল্টে বলল, দুটো লোক দেখছ! মেয়েটা কি নির্লজ্জ। আচ্ছা ছবি কারা তোলে! মেয়েটা কি, লাজ লজ্জা নেই! একই জায়গায় দেখ দু’জন তাকিয়ে আছে?

কুম্ভ কেমন নিস্তেজ হয়ে পড়ছে।

কোন লোকটার বেশি ভালবাসা বল?

কুম্ভর গা গোলাচ্ছিল। আজ প্রথম মনে হল, পুরুষ নারী উভয়েই বিপজ্জনক খেলায় পড়ে যায়। আজ সে আর হাসিকে সাপটে ধরতে পারল না। চারু হাসির মাথা খারাপ করে দিয়েছে। রাতের ট্রেনে সে আসলে যড়যন্ত্র করে চারুকে তুলে দেয়নি—সেই গোপন অভিসারে আসলে বাবুটির সঙ্গী ছিল যেন হাসি। লোকটাকে সরিয়ে দেওয়া দরকার, দু-নম্বরী মালের জন্য না যতটা হাসির দুটো লোকের ছবির জন্য তার চেয়ে বেশি।

রাঙিয়ে দিয়ে যাও—যাও যাও গো এবার, যাবার আগে। গুন গুন করে হাসি গান গাইছে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই কুম্ভ শুনল, হাসি গান গাইছে। হাসি খুব সকালে আজ শীতের মধ্যে স্নান করছে দেখে অবাক হয়ে গেল। রাতে হাসি দিয়েছে, এত দিতে পারে সে যেন কখনও টের পায়নি। একেবারে পাগলের মত হাসি, সামনে পিছনে—কত রকমের মুদ্রায় তাকে কাঁপিয়ে তুলেছিল। এই না না, এত তাড়াতাড়ি না, এই শোনো, দাঁড়াও না, আমি ওপরে উঠে বসছি।

কে সেই মানুষ পাগলপারা করে দিয়েছে হাসিকে—এত সুমধুর রসাধার কে বয়ে আনে জীবনে?

কুম্ভ জানে বোঝে। কিন্তু এই গোপন খেলা না থাকলে নারী রমণী হয়ে যায়। সে চুপচাপ মোড়ায় বসে চা খেতে খেতে অন্যমনস্ক হয়ে গেল। কখন ভিজে শাড়ি পাল্টে তোয়ালে পেঁচিয়ে হাসি ঘরে ঢুকে গেল দেখল না। ঘরের ভিতর হাসি কি করছে! হাসি লকার খুলে দাঁড়িয়ে আছে। শাড়ি নামাচ্ছে। কোনও শাড়ি পছন্দ হচ্ছে না। তারপরই নীল জর্জেট পেয়ে সে কেমন খুশি হয়ে গেল। আজ টুটুলের বিদ্যারম্ভ। শ্রীপঞ্চমীতিথি। হাসি সকাল থেকে অতীশবাবুর বাড়িতে যাবে বলে তবে স্নান সেরে ফেলেছে! হাসির রান্নার হাত ভাল। অতীশ যতবার কুম্ভর বাড়িতে খেয়েছে, কুম্ভর বাবা ততবার আত্মপ্রসাদ লাভ করেছেন। খেতে রাজি করানোই মুশকিল। অন্তত বউরাণী বুঝবে অতীশকে রাধিকাবাবু স্নেহ করেন। অতীশকে স্নেহ করলে, সমাদর করলে বউরাণীর খুশির শেষ থাকে না। খেয়েই অতীশ বলেছে, হাসি গ্র্যান্ড। মুগের ডালে কপি দিয়ে—ও ভাবা যায় না। তোমার দিদিকে শিখিয়ে দিও না। কিসে কি দিলে, খাবার সুস্বাদু হয়, তোমার দিদি ঠিক বোঝে না।

এই অহংকার থেকেই আজ হাসি অতীশবাবুর হেঁশেলের ভার পেয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *