1 of 2

ঈশ্বরের বাগান – ২

।। দুই।।

রাতেই অতীশ ভেবেছিল, স্ত্রীকে চিঠি লিখবে। ওর ধারণা ছিল, নির্মলা তার এটাচিতে খাম রেখে দিয়েছে। কারণ কোথাও গেলে নির্মলার এটা স্বভাব। পৌঁছেই একটা চিঠি। সময়মত চিঠি না পেলে নির্মলা ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। কিন্তু এটাচিটা খুলে দেখল, খাম অথবা পোস্টকার্ড কিছুই দেয়নি। নির্মলার এত বড় ভুল হয় না। পরে মনে হল, নির্মলা ওকে ছেড়ে থাকতে হবে ভেবে খুব ভেঙে পড়েছিল। কারণ বিয়ের পর সে অতীশকে ছেড়ে বেশিদিন থাকেনি। কলকাতায় অতীশ যাচ্ছে। সেখানে কি কাজ কি মাইনে, কিছুই জানা নেই। সেখানে এমন মাইনে আশা করে না যাতে করে বাসা ভাড়া করে থাকতে পারে অতীশ। বাসার খরচ চালিয়ে এমন উদ্বৃত্ত আর অতীশের হবে না, যাতে করে বাবা-মা ভাই-বোনেদেরও ভরণপোষণ করতে পারে। ফলে নির্মলা ভেবেছিল, অতীশ প্রবাসী হযে গেল। তার সঙ্গে মাঝে মধ্যে এবার থেকে কখনও সখনও প্রবাসী মানুষের মতোই দেখা হবে। এই বিরহে সে ক’দিন থেকেই পীড়া বোধ করছিল এবং ভুলটাও তার সে জন্য হয়েছে।

চিঠিটা লেখা খুব জরুরী ভাবল। চিঠিটার জন্য নির্মলার অপেক্ষা কি গভীর সে এ-মুহূর্তে টের পাচ্ছে। নধরবাবু তাকে সাহায্য করতে পারে। সে নধরবাবুর কাছেই একটা খাম পেয়ে গেল। এবং ঘরে এসে প্রথমেই লিখল, কল্যাণীয়াসু—এখানে মঙ্গলমতো পৌঁছেছি। আজ থেকেই কাজে বহাল হলাম। মাইনে স্কুলে যা পেতাম আপাতত মনে হচ্ছে তার চেয়ে বেশিই হবে। মূল প্রাসাদ সংলগ্ন একটা দোতলা বাড়িতে এক কামরার ঘর দিয়েছে। সেখানে আছি। কোনও অসুবিধা নেই। তারপরই লেখার ইচ্ছে হল, কিছু কিছু ঘটনা চোখে খুব ঠেকে। কিন্তু এটা লেখা যুক্তিযুক্ত ভাবল না। নির্মলার স্বভাব একটুকুতেই ভেঙে পড়া। তখন ওর শরীর ভেঙে পড়ে। বিয়ের আগে নির্মলা ভারি সুন্দর ছিল দেখতে। চোখে মুখে বালিকাসুলভ হাসি লেগেই থাকত। কিন্তু একজন স্কুল শিক্ষকের পক্ষে আর্থিক নিরাপত্তা তত প্রবল ছিল না বলে তাকে প্রায়ই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে তুলত। আর বিয়ের বছর পার না হতেই পেটে মিণ্টু হাজির। তখন নির্মলার এমনও মনে হয়েছে অতীশ অবিবেচক। অতীশ বাইরের বারান্দায় অনেকদিন চুপচাপ সন্ধ্যায় নির্জনে বসে থেকেছে সেজন্য। বারান্দা থেকে গাছপালার ফাঁকে কিছু নক্ষত্র দেখা যেত আকাশে। অনেক দূরের নক্ষত্র দেখতে দেখতে সে এক রহস্যময় জগতে ডুবে যেত। সেই জগৎ স্বপ্নের মতো। কোনো দূরাতীত স্বপ্ন তাকে তাড়া করে বেড়ালে, নির্মলা বলত, এই অন্ধকারে চুপচাপ কেন। আমি তোমাকে কিছু বলেছি! তুমি রাগ করেছ?

অতীশ নির্মলার কথায় বলত, না না। এমনি বসে আছি।

নির্মলা বলত, তুমি মাঝে মাঝে এত কি ভাব বলত!

—কী ভাবি!

—বাবা কখন থেকে প্রসাদ নিতে ডাকছে।

—বৈকালি হয়ে গেছে?

—কখন! কাঁসিঘণ্টা বাজল শুনতে পাওনি। কোথায় চলে যাও বলত!

অতীশ বুঝত সে ধরা পড়ে গেছে। সে বলত, গল্পের একটা চরিত্র ভারি কূট খেলা খেলছে। ঠিক ধরতে পারছি না।

অতীশ সমুদ্র থেকে ফিরে আসার পর পত্রপত্রিকায় ছোট্ট একটা খবর বের হয়েছিল। সেই খবর থেকেই অতীশ কোনও কাগজের সম্পাদকের নজরে পড়ে গেছিল। একটা লেখা লিখেছিল, সুনাম পেয়েছে। দুটো একটা লেখা লিখলে সযত্নে ছাপা হয়ে যায় বলে বাড়তি কিছু পয়সা আসে। ফলে চর্চা করে লেখার। এমন কথায় নির্মলা আর কোন অভিযোগ তুলতে পারত না। সে বলত, এস খাবে। বাবা তোমার জন্য বসে আছেন।

তারপরই কেন জানি মনে হল অতীশের, অসীম অনন্ত আকাশের নিচে জীবন বয়ে যায়। তার জীবন বয়ে যাচ্ছে, ভাঙা হাল ছেঁড়া পাল নৌকায়। কখনও হাওয়া বয়, পালে হাওয়া লাগে। মনে হয় জীবন বড়ই মনোরম। কখনও হাওয়া থাকে না, পালে হাওয়া লাগে না—নিঝুম চারপাশ, বড়ই গুমোট। চাকরি ছেড়ে দেবার পর এমন মনে হয়েছিল তার। আবার পালে বাতাস লেগেছে—নিরুদ্দিষ্ট যাত্রা—কারণ সে জানে না, কোথায় কিভাবে সে শেষপর্যন্ত কোন ঘাটে নোঙর ফেলবে। সে এ- জন্য তার চিঠিতে চাকরি পাবার কথাটা খুব উৎসাহের সঙ্গে প্রকাশ করতে পারছে না। চাকরি সম্পর্কে দ্বিধা আছে এখনও। তারপর সেই মানুষটার ফিসফাস কথাবার্তা। তুমি খুন হয়ে যাবে নবীন যুবক– ঘরের চারপাশটা সে দেখল, বড়ই জীর্ণ আবাস। অনেকদিন এদিকটায় প্রাসাদের কোনও সংস্কার হয়নি। দেয়ালের কোথাও ইট বের হয়ে আছে। ছাদের কড়ি বরগা আলগা। চাপা পড়তে পারে—আসলে কি এই ঘরটায় তাকে থাকতে দিয়েছে বলেই মানুষটা তাকে এভাবে সতর্ক করে দিয়ে গেল। সে ভাবল, কালই কুমার বাহাদুরকে বলবে, একটা ভাল থাকার ঘর দিন। ভয় করে। যে কোনও সময় ধসে পড়তে পারে সব। এ-সব কিছুই চিঠিতে অবশ্য লেখা চলে না। আর কি লিখবে বুঝতে পারছে না। বাবা-মার খবর, ঠিকমত পত্রের জবাব, টুটুল এবং মিণ্টুর খবর নিতে পারে। সে ত শেষ লাইনে এগুলি লিখবেই। নির্মলাকে আরও কিছু লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে। আসলে এত ছোট চিঠি পেলে নির্মলা দুঃখ পাবে। সে লিখল, নির্মলা আমি ফেমিলি কোয়ার্টার পাব মনে হচ্ছে। পেলে, এখানকার কোনও স্কুলে যদি কোনরকমে তোমাকে ঢুকিয়ে দিতে পারি তবে খুব অসুবিধা হবে না। আমার টাকায় বাড়ির খরচ, তোমার টাকায় ওখানকার খরচ! তুমি নিজেও জান, তোমাকে ছেড়ে আমি থাকতে পারি না। এক রববারের ছুটিতে চলে যেতে পারি। কবে যাব লিখব না! গিয়ে অবাক করে দেব।

আর কি লিখবে! লিখতে পারে! প্রাসাদের কথা লিখলে চিঠিটা বেশ বড় হয়ে যাবে। সে লিখল সব ঘুরে ফিরে দেখলাম। কলকাতার ওপর এমন খোলামেলা জায়গা আশাই করা যায় না। একটা খুদে সাম্রাজ্য বলতে পার। প্রাসাদের চারপাশে বিরাট জেলখানার মতো পাঁচিল। বাইরে থেকে মনে হবে, কেউ থাকে না বাড়িটাতে। ভেতরে ঢুকলে টের পাওয়া যায় সব। বড় বড় দুটো পুকুর, খেলার মাঠ, গোয়ালবাড়ি, বেয়ারা, বাবুর্চি খানসামাদের থাকার জন্য একটা ছোটখাট পাড়া আছে। ছোট ছোট ঘর—বস্তির মতো কিছুটা। বাবুদের জন্য মাঝারি সাইজের ঘর। কিছুটা ছিমছাম। প্রাইভেট সেক্রেটারির জন্য আলাদা দোতলা বাড়ি। গাছপালা ফুলের বাগান সবই আছে। তুমি থাকলে আরও ভাল লাগত নির্মলা। তারপরই কেন যে লিখল, আমি সাঁতার কাটছি। পারে উঠব বলে সাঁতার কাটছি। কতদিন থেকে সাঁতার কাটছি। ঠিক একদিন তীর দেখতে পাব। আর তখনই মাথার মধ্যে ঠুক ঠুক করে কে যেন তার পেরেক পুঁতে দিচ্ছে।

—না ছোটবাবু,সামনে কিছু দেখা যাচ্ছে না।

—কিছু না?

—না।

—পাখিটা?

—এলবা এলবা! ছোটবাবু চিৎকার করে ডাকতে থাকল; হোয়েআর ইউ আর। নট ইন দা স্কাই, নট আপন দা সি—হোয়েআর ইউ আর? অতীশ চিঠি লেখা বন্ধ করে দিল। ছোটবাবু তুমি কে, তুমি কেন আবার আমার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছ! তোমাকে আমি কবে কোথায় রেখে এসেছি ঠিক মনে করতে পারছি না। আসলে মনে করতে পারছি না, না মনে করতে আর চাই না। তুমি মাঝে মাঝে এমন বিড়ম্বনায় ফেলে দাও কেন! কেমন আচ্ছন্ন বোধ করি। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, আমার একসময় একজন ছোটবাবুর জীবন ছিল। তারপরই কেমন অসহায় চোখে তার দিকে কে যেন তাকিয়ে থাকে। সেই চোখ দুটো কবেকার দেখা যেন—মাথার মধ্যে স্মৃতি কামড় বসালে সে অস্থির হয়ে ওঠে। এবং সে জানে, ছোটবাবু তার ভিতর ঢুকে গেলে তার আর সারারাত ঘুম হবে না। শুধু এ-পাশ ও- পাশ করবে। একা থাকলে এসব বেশি মনে হয়। পাশে নির্মলা থাকলে, মিণ্টু টুটুল থাকলে সেই স্মৃতি সহজেই সে ভুলে থাকতে পারে। এবং বিড়ম্বনার হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্যই অতীশের মনে হল, নির্মলাকে কাছে রাখা দরকার। তা না হলে সে পাগল হয়ে যেতে পারে। বংশে এটা আছে। এবং সেই শৈশবের কোনও পাগল মানুষের জীবন, তার জীবনে এসে ধীরে ধীরে ভর করার যেন একটা চক্রান্ত করছে।

কারণ কখনও মনে হয় কোন সমুদ্রগামী জাহাজের সে নাবিক, কখনও মনে হয়, গভীর অরণ্যের মধ্যে দিয়ে সে পথ হাঁটছে। আবার কখনও দেখতে পায় নীল আকাশ, বিশাল সমুদ্র, একটা অতিকায় পাখি, নিরিবিলি আকাশ, সব শেষে একটা সামান্য বোটে সে আর এক বালিকা। কখনও মরীচিকার মতো সমুদ্রের অপদেবতারা তার পিছু নেয়। সেইসব অপদেবতারা যেন এখনও তাড়া করে বেড়াচ্ছে। জলে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ, ছায়া ছায়া মূর্তি, সব কঙ্কালের মতো কী যেন হাওয়ায় ভাসমান। একে একে নেমে আসছে তারা। হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে চাইছে। আর এলবার ডাক, এলবা যেন সেই অপদেবতাদের প্রভাব থেকে রক্ষা করার জন্য মাঝে মাঝেই হাঁকছে—আমাকে অনুসরণ কর। একদিন না একদিন ডাঙ্গা দেখতে পাবে। ডাঙ্গা দেখতে পেলেই অপদেবতারা আর ভয় দেখাতে পারবে না।

অতীশ একসময় দেখল, খাম খোলা, চিঠি লেখা বন্ধ। অন্য এক যুবক এসে তাকে বলছে, কি কেমন আছ? সে কে? দেখতে পেল, সে আর কেউ নয়, সেই ছোটবাবু। তার আগেকার স্মৃতি।

ছোটবাবু বলল, আমি মরে গেছি ভেব না।

অতীশ বলল, জানি।

—তুমি পাপ কাজ করেছ।

অতীশ বলল, না না আমি কোনও পাপ কাজ করিনি।

—তুমি খুন করেছ। কেউ সাক্ষী নেই। কেবলমাত্র আমি এখনও সাক্ষী।

অতীশ বুঝল, আজ তাকে ছোটবাবু আবার জ্বালাবে। সে বাথরুমে ঢুকে চোখে মুখে জল দিল। ঘাড়ে জল দিল। ভাবল স্নান করলে ভাল হয়। সে তারপর স্নান করে নিল। এবং সে বাইরের দিকে তাকাল। গাড়ি-বারান্দার বড় আলোটা জ্বলছে। ঘরে ঘরে আলো। মানুষজন অনেক থাকে এ বাড়িতে। রাত খুব বেশি হয়নি। গাঁয়ের মতো ন’টা বাজলেই যে বেশি রাত ভাবা সেটা এখানে অচল। বরং যেন সারাদিন সব মানুষের খাটাখাটনির পর এখন একটু হৈ-চৈ করা। পাশের ঘরে কারা তাস খেলছিল। এদের কাউকে সে এখনও ভাল চেনে না। তাস খেলায় তার কোনও আকর্ষণ নেই। সে খেলাটা কখনও শেখার চেষ্টা করেনি। আজ কেন জানি তার মনে হল, সময় কাটাবার এমন একটা আকর্ষণ জীবনে তৈরি করা দরকার। এখন এই খেলাটা জানলে কত কাজে লাগত। আর যাই হোক ছোটবাবু অসময়ে এসে তাকে বিব্রত করতে পারত না।

সে তাড়াতাড়ি চিঠিটা নিয়ে আবার বসল। বুঝতে পারল জীবনে এমন অনেক সময় আসে যখন আর এক লাইন বেশি ভাবা যায় না। সে চিঠিটা সংক্ষিপ্ত করল। খুব ছোট চিঠি। এবং খামে ভরে ঠিকানা লিখে বের হয়ে গেল। এখন তার চারপাশে কিছু মানুষজন দরকার। অন্তত রাস্তায় বের হয়ে যদি হাঁটতে হাঁটতে দোকানপাট দেখতে দেখতে আবার স্বাভাবিক হয়ে আসে।

ছোটবাবু বলল, পালাচ্ছ কেন?

—কে পালাচ্ছি!

—পালাচ্ছ না! কিন্তু যাবে কোথায়?

—কোথাও না।

—খুব সাধুজন হয়ে গেছ না?

অতীশ বলল, দেখ ছোটবাবু আমি নিজেকে সাধুজন ভাবি না। তবে আমি খারাপ মানুষ না। ভাল থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছি। স্কুলে তুমি দেখলে ত কেমন চক্রান্ত করছিল তারা।

—তোমার জন্য ওদের অসুবিধা হচ্ছিল। ওরা তা সহ্য করবে কেন?

—তাই বলে মিছিমিছি আমাকে ভাউচার সই করে দিতে হবে। যা নয় তাই লিখতে হবে!

—লিখলেই পারতে। চাকরি ছাড়ার কি হল!

অতীশ বলল, ওদের সঙ্গে পেরে উঠছিলাম না।

—এখানেও পেরে উঠবে না, যতদূরেই যাও একজন আর্চি তোমাকে অনুসরণ করবেই।

—আমি মানি না।

সিঁড়িটা অন্ধকার। অতীশ পা টিপে টিপে নামছিল। সিঁড়িতে তবে কেউ আলো জ্বেলে দেয় না। হয়ত দেওয়া হয়, কেউ আলোর ডুম চুরি করে নিয়ে যায়। সে পা টিপে টিপে নামছিল। ছোটবাবু এখনও গা ঘেঁষাঘেঁষি করে আছে। প্রায় তার শরীরের সঙ্গে লেপ্টে থাকার মতো। যখনই কোনও অনিশ্চিত জীবনে সে পা দেয়, তখনই ছোটবাবুর যেন পোয়াবারো। ছোটবাবু না আর্চির! আবার পাওয়া গেছে। সে নামতে নামতে বলল, কতক্ষণ আমাকে অনুসরণ করবে! দেখি কতক্ষণ করতে পার! আমি গেলে তিনি খুব খুশী হবেন। জানো রাধিকাবাবুটি কুমারবাহাদুরের খুব বিশ্বাসীজন। এ- রাজ-বাড়িতে পাকশালায় প্রথম কাজ নিয়ে এসেছিল কুমারবাহাদুরের বাবার আমলে। সেই মানুষ এখন রাজবাড়ির অফিস সুপার। খুব প্রতাপ মানুষটির। তিনি নিজে এসে আমাকে ঠিকঠাক হয়ে না বসা পর্যন্ত বাসায় খেতে বলেছেন। খুব আপনজনের মতো ব্যবহার।

এ-সব ভাবতে ভাবতে সে নিচে নামল। সামনে সবুজ লন, সারি সারি কামিনীফুল এবং গন্ধরাজ ফুলের গাছ। কিছু ফুলের গন্ধ আসছিল। সে দাঁড়িয়ে গা ঝাড়া দিল। কাউকে ঝেড়ে ফেলতে চাইল। দেখলে কেউ ভাববে মানুষটার জামার মধ্যে পোকা ঢুকে গেছে। সে গোপনেই এসব করে থাকে। কারণ তার জানা আছে সবার সামনে সে এটা করলে তার মধ্যে কিছু অস্বাভাবিক ব্যাপার আছে টের পাবে। আর তখনই অন্ধকার ছায়া থেকে কে যেন উঠে এসে বলল, না না জামা ঝাড়বে না। ওখানে কিছু নেই।

আরে সেই লোকটা! যেন বিয়েবাড়ি থেকে নেমন্তন্ন খেয়ে ফিরছেন। পরনে আদ্দির পাঞ্জাবি পাটভাঙা ধুতি। হাতে বেলফুলের মালা। একা। সঙ্গের সেই লাঠিয়ালটিও নেই। পায়ে শু চকচক করছে। খুবই দিলদরিয়া মেজাজ। মুখ কামানো।

অতীশ বলল, আপনি!

এই ভ্রমণ সেরে এলাম।

—কোথায় গেছিলেন?

—রাজবাড়ি।

—এটাই তো রাজবাড়ি।

—ধুস। বলে, ছোটবাবুর হাত চেপে ধরল। বলল, নবীন যুবক, একা থাকতে ভয় পাচ্ছ!

—না না। রাধিকাবাবুর বাসায় যাব বলে বের হয়েছি।

অতীশের চোখমুখ রাস্তার আলোতে স্পষ্ট। সে ভাল করে অতীশের মুখটা দেখল। বলল, না না এভাবে ভয় পাওয়া ঠিক না। আমি এভাবে ভয় পাই না। আমার সঙ্গে এস। ভয় পেলে মানুষের জীবনে করার কিছু থাকে না। আমার মতো তোমাকে তখন ভূতে পেয়ে বসবে।

লোকটা তার হাত ধরেই আছে। যেন কত চেনাজানা মানুষ। নির্বান্ধব শহরে বড়ই বান্ধব। হাত ছাড়ছে না। গা থেকে আশ্চর্য সুবাস উঠছে। অতীশ কি করবে ভেবে পেল না। কি বলবে বুঝতে পারল না।

—দাঁড়িয়ে থাকলে কেন, এস।

—কোথায়?

—কেন, আমার ঘরে। তখন উঁকি দিয়েছিলে, এখন ভাল করে দেখে যাও।

—আপনার ওখানে যাওয়া বারণ।

—কে বারণ করেছে!

নাম বলতে অতীশ ইতস্তত করছিল। তারপর মনে হল, তখন সেই বাবুটি তো তাঁকে দেখেছে। তাঁর সামনেই সতর্ক করে দিয়ে গেছে অতীশকে। সে বলল, কেন দেখেননি!

—অ হ, নধর। সেই ইতর লোকটা। রাজার খায়, রাজার দাড়ি উপড়ায়। ওর কথা তোমাকে শুনতে কে বলেছে!

—না, উনি তো…..।

—আরে কিছু না। এ-বাড়িতে কার তেজ কত, কখন কতটা থাকে কেউ কিছু বলতে পারে না। অতীশ ভেবে পেল না এমন কেন হয়। দুপুরে এই লোকটাকেই আটকে রাখা হয়েছিল। এখন এই লোকটা ভীষণ তেজের সঙ্গে কথাবার্তা বলছে। মাথায় যেন কোনও গণ্ডগোল নেই! একেবারে সংসারী মানুষের মতো কথাবার্তা।

—আরে এস এস। নবীন যুবক, তুমি অত কি ভাবছ। সংসারে যত ভাববে তত মরবে। অতীশ অগত্যা লোকটাকে অনুসরণ করল। সিঁড়ি পার হয়ে দোতলায় উঠতেই দেখল, চুনট করা শান্তিপুরী ধুতি পরনে। যেন কেউ তাকে সাজিয়ে দিয়েছে।

লোকটির কি তবে কারাদন্ড হয়েছিল। রাজবাড়িতে গোপনে কি সেই আগেকার বিচারের বিধিব্যবস্থা আছে! নির্দোষ প্রমাণিত হবার পর পুরস্কার মিলেছে! স্বৈরাচারী রাজরাজড়াদের এমন খামখেয়ালীর কথা সে বইয়ে পড়েছে। কে জানে সে যে এখানে দুম করে চাকরিটা পেয়ে গেল, সেটাও কোনো খামখেয়াল কিনা। সে ভয়ে ভয়ে অগত্যা তাঁকেই অনুসরণ করতে থাকল। এই মানুষটাকেই এ-বাড়িতে স্বাধীন মনে হল তার। সে তাঁর খুশিমতো চলে। পছন্দ না হলে, তালা দিয়ে রাখে, পছন্দ হলে বেশভূষায় সাজিয়ে দেওয়া হয়। কোনো কিছুতেই তাঁর যায় আসে না। আজ এমন কি ঘটেছে যার জন্য মানুষটির কপাল খুলে গেল! অতীশের কিছুটা কৌতূহল, সেই দুপুর থেকে এই লোকটা তাকে অজস্র চিন্তা- ভাবনার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। তাকে বলে গেল কেন, তুমি খুন হয়ে যাবে নবীন যুবক।

ওরা যেতেই তাস খেলার কেউ একজন বলল, ঐ যায়। আর একজন বলল, ও মানসদা ছুটি মিলেছে বুঝি!

—তাস খেলছ খেল। বাজে কথা বল কেন?

লোকটার নাম তবে মানস। সে বলল, মানসদা আপনার ঘরে যাওয়া আমার ঠিক হবে?

—আমি তোমাকে খেয়ে ফেলব ভাবছ।

—না তা না….

ওরা তখন দরজার কাছে এসে গেছে। মানসদা দরজায় দাঁড়াতেই একজন নফর লোক তাকে কুর্নিশ করল। সে মানসদার ঘরদোর সব সাফ করে দিচ্ছে। ঝাড়পোঁচ করছে। ধুলো উড়ছিল। মানসদা অতীশকে বলল, নাকে রুমাল দাও। শহর আর গাঁয়ের ধুলো এক মনে কর না, এখানকার ধুলোতে সংক্রামক ব্যাধির জীবাণু খুব বেশি থাকে।

প্রায় বস্তাখানেক ছেঁড়া কাগজের টুকরোর একটা ডাঁই। এই ঘরে এত ছেঁড়া কাগজ আসে কি করে! অতীশ একটুকরো ছেঁড়া কাগজ তুলতেই দেখল ওতে গুঁড়ি গুঁড়ি লেখা। পিঁপড়ের মতো, আলোটা জোর নয় বলে সে পড়তে পারছে না। মানসদা কেমন ক্ষেপে গিয়ে ওর হাত থেকে টুকরো কাগজটা ছিনিয়ে নিল, তুমি বড়ই আহাম্মক দেখছি। এ-সব পড়তে হয় না। অনেক গূঢ় কথা লেখা আছে। এমনিতেই মাথা খারাপ করে ফেলেছ, এ-সব পড়ে আরও মাথা খারাপ হয়ে যাক আর কি! এই বেটা, বাঙ্গাল ভূত, কাগজগুলি নিচে নিয়ে পুড়িয়ে দিবি?

—তাই অর্ডার আছে হুজুর।

মানসদা কেমন ভূত দেখার মতো অতীশকে দেখল। ছোঁড়াটা মরবে। তারপর মুখ চেপে দিল হাতে। একটা কথা না আর। তোমাকে ঢুকতে দিয়েছি এ-ঘরে। মনে রাখবে, অনেক জন্মের পুণ্যফল এটা। তুমি জান না, কতটা তোমার অধিকার। তারপর পা টপকে শুচিবাই মানুষের মতো নিজের খাট পর্যন্ত গেলেন। সোফা আছে, সেন্টার টেবিল আছে, পাখা আছে, ঘরের ফাটলে কিছু লেখা গোপনে ঢুকে যাচ্ছিল, অতীশ সেই লেখা দেখতে গেলেও টেনে আনল। বলল, বোসো। ঠিক হয়ে বোসো। অন্যের গোপন লেখা দেখতে হয় না। অনেক দেশ-টেশ ঘুরেছ শুনেছি—এ আক্কেলটা হয়নি কেন?

তারপর সোফায় বসে ওপরের দিকে চাইলেন। গুনগুন করে গানের কলি ভাঁজলেন একটা—ও ফুলবনে যেও না ভোমরা। তোমার কেমন লাগছে সুরটা। খাওয়া হয়েছে? অসুবিধা হলে বলবে।

এতগুলো প্রশ্নের একসঙ্গে জবাব দেবে কিভাবে। সে বলল, বেশ ভাল ঘর। বড়। একজনের পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু অতীশ বিস্মিত, এই মানুষটি প্রায় তার সব জানে। সে বলল, বিদেশ-টিদেশ ঘুরেছি আপনাকে কে বলল?

এটা রাজার বাড়ি। নবীন যুবক, তোমার নাম অতীশ দীপঙ্কর ভৌমিক। স্কুলে মাস্টার ছিলে। পোষাল না। ছেড়ে দিলে। এখানে সব চাউর হয়ে যায়। এখানে কিছু গোপন থাকে না। কত পাপ এ-বাড়িতে, সবাই মনে করে বড়ই গোপন—কাকপক্ষীতেও টের পায় না! তারপর থেমে থেমে বললেন, নবীন যুবক, ঈশ্বরের বাগানের চেহারাটাই এই। এত ভাব কেন?

নফর লোকটা ছেঁড়া টুকরো কাগজগুলো এখন বারান্দায় বস্তাবন্দী করছে। পরনে খাকি হাফ- প্যান্ট হাফ শার্ট। ছেঁড়া। জায়গায় জায়গায় ছিট কাপড়ে তালি মারা। সে তারপর আবার ঘরে ঢুকে দেখল, কোথাও যদি ভুলক্রমে এক টুকরো থেকে যায়, না নেই। নিশ্চিন্তে সে সেই গন্ধমাদনটি মাথায় নিয়ে চলে গেল। মানসদা উঠে গিয়ে লোকটার নির্গমন দেখলেন। এবং বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকলেন। এ ঘরে অতীশ আছে যেন তাঁর আর মনেই নেই। সে এবার ভাল করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। দেয়ালে হিজিবিজি লেখা। কাঠ কয়লা পেনসিল, ইটের টুকরো যখন যা হাতের কাছে পাওয়া গেছে তাই দিয়ে লেখাগুলোর কাজ সারা হয়েছে। আর বিচিত্র সব জীব-জন্তুর মুখ। এসব যেন পৃথিবীর নয় অন্য কোন সৌরলোকের। প্রতিটি জীব-জন্তুর নিচে কিছু লেখা। উঠে না গেলে পড়া যাবে না। কিন্তু উঠতে সংকোচ হচ্ছে। অথবা বড় সংক্রামক ব্যাধির মতো সেই যে ভয় গ্রাস করেছে তাকে তা থেকে, সে কিছুতেই অব্যাহতি পাচ্ছে না। সে কারণে সে বসেই থাকল। জীব-জন্তুগুলো কাছে গিয়ে দেখতে পেল না। কিছুটা হাঁসজারু হাতিমি বকচ্ছপের মত এরা দেয়ালে উঁকি দিয়ে আছে। ছবিগুলো দেখে শিল্পীর নিখুঁত হাতের প্রশংসা করতেই হয়। চারপাশের দেয়ালে এমন সব হিজিবিজি অজস্র লেখা আর জীব-জন্তুরা একত্রে কতদিন থেকে যেন বাস করে আসছে।

তখনও মানসদা দাঁড়িয়ে আছেন রেলিং ভর করে। অতীশ দেখল, বিছানার চাদর বালিশের ওয়াড় পাট ভাঙা। এই মাত্র বদলে দিয়ে গেছে কেউ। সেন্টার টেবিলে ফুলদানি, ওতে রজনীগন্ধার গুচ্ছও রাখা হয়েছে। তাজা শিশির বিন্দুর মতো ফোঁটা ফোঁটা জল লেগে আছে গায়ে। সে হাত দিয়ে দেখল, হাতে জল লাগছে। এত তাজা আর নিটোল ফুলের পাপড়ি—আর দেয়ালে অস্বাভাবিক সব কথাবার্তা। অদৃশ্য গোপন ইচ্ছার এক প্রিয়তম খেলা। গানের কলি থেকে তার মনে তখনই কিছু প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। কিন্তু মানসদা রেলিঙে এখনও অনড়। কি দেখছেন! সে তখন দূর থেকেই দেখতে পেল, সেই বড় মাঠটায় অগ্নিশিখা। তারপর দাউদাউ করে কি জ্বলে উঠল। মানসদা আগুনে কাকে যেন জ্বলতে দেখলেন—তাঁর সর্বস্ব কেউ যেন জালিয়ে দিচ্ছে। তিনি ঘরে ফিরে বললেন, ঈশ্বরের বাগানে রোজ এমন কত ঘটনা ঘটছে, কে আমরা তার খবর রাখি।

অতীশ দেখল মানুষটির চোখ এখন ভারি বিষণ্ণ। তার সঙ্গে আর একটি কথা বলছেন না। বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েছেন। যেন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। কারণ মানুষটার শরীর কেঁপে কেঁপে যাচ্ছিল। খোলস বদলাবার সময় সরীসৃপদের যাতনার মত এক অতীব যাতনা সারা শরীরে তার কষ্টের সূচ ফোটাচ্ছে কেউ।

অতীশ এতে ভারী বিড়ম্বনা বোধ করল। কিছুই জানতে পারছে না। কাউকে কোনও প্রশ্ন করতে পারছে না। নতুন মুখ সব। এসে বুঝেছে—এখানে অদৃশ্য কিছু চক্রান্ত সব সময়েই চলছে। দৈবের মতো হঠাৎ তা কারো মাথার ওপর নেমে আসে। যখন টের পাওয়া যায় তখন আর করার কিছু থাকে না।

সে অগত্যা বলল, উঠছি মানসদা।

মানসদা কেমন সংবিং ফিরে আসার মতো বললেন, তোমার খাওয়া হয়ে গেছে?

—আজ্ঞে না।

—আমরা একসঙ্গে খাব। অনেক খাবার। অনেক। তুমি সঙ্গে থাকলে আমি খাওয়ায় স্বস্তি পাব।

আর তখনই অতীশ প্রশ্ন করল, আমি কেন খুন হয়ে যাব? খুন হয়ে গেলে কে একসঙ্গে বসে খেতে পারে বলুন?

—নবীন যুবক,—বলতে বলতে তিনি উঠে বসলেন। তোমার চোখ এত গভীর কেন। তুমি কি সুদূরের কিছু দেখতে পাও?

সে বলল, আমার কথার জবাব দিন।

—নবীন যুবক, অনেক দিন হয়ে গেল, মাঠঘাট পার হয়ে কোথাও যাবে বলে রওনা হয়েছিলে। শেষে এক রাজার বাড়িতে হাজির। রাজা তোমাকে নিয়ে এসেছেন তাঁর ভাঙা প্রাসাদের ফাঁক-ফোকর বন্ধ করার জন্য। কোন গর্তে তুমি হাত দেবে কে জানে। কোথায় কালসাপ ফণা তুলে আছে গর্তে বাইরে থেকে কি করে বুঝবে। মাথায় হাত পড়লে তোমায় তারা ছেড়ে দেবে ভাবছ?

অতীশ প্রতিটি কথা স্পষ্ট শুনতে পেল। সে বলল, একজন খাঁটি মানুষ কিন্তু আমাকে বলেছেন স্ট্রাগল ইজ দ্য প্লেজার।

—পারলে কোথায়। তা’হলে পালালে কেন? মাস্টারি ছেড়ে পালালে কেন?

অতীশ দেখল তখন দুজন বয় বাবুর্চি। দরজার পাশে দাড়িয়ে একজন খানসামা। লাইন বন্দী হয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে। হাতে তাদের নানা রকমের কারুকাজ করা প্লেট। প্লেটে রকমারী সুস্বাদু খাবার। সেন্টার টেবিল সরিয়ে বড় ভাঁজ করা টেবিলে খেতে দেওয়া হয়েছে। সাদা চাদর বিশাল। মাঝে একটা প্রজাপতি উড়ছে। দূরে একটা টিকটিকির ছবি। লেজ নাড়ছে টিকটিকিটা। প্রজাপতিটা জানেও না পেছনে একটা রাক্ষস। লোভে লালসায় লেজ নাড়ছে। যে কোন মুহূর্তে তাকে গিলে ফেলতে পারে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *