।। উনত্রিশ।।
অতীশ রাজবাড়ির গেটে ট্যাকসি দাঁড় করাল। মিণ্টুকে বলল, নামো। টুটুলকে কোলে নিয়ে সে বাইরে বেরিয়ে এল। বেশ রাত হয়ে গেছে। খেয়ে আসার জন্যই এই দেরি। মিণ্টুর মামার বাড়ির • লোকদের রাজার বাড়ির নিয়মকানুন জানা না থাকারই কথা। সে নেমে দেখল, বড় লোহার গেটে তালা লাগানো হয়ে গেছে। ছোট গেটটা খোলা।
নির্মলা আসেনি। অসুস্থ। অতীশ মাসখানেক ছুটি নিয়ে দেশে গিয়েছিল, ফিরে বাসাবাড়িতে একা। সে বিকালেই চলে গিয়েছিল নির্মলাকে আনতে। নির্মলা আসেনি। সিঁড়ি ধরে নেমে আসার মুখে তার সঙ্গে নির্মলার মেজদির দেখা। চেম্বার থেকে ফিরছেন। তাকে দেখেই বলেছিল, তুমি!
সিঁড়ি ধরে টুটুল মিণ্টু লাফিয়ে নামছিল, আর তাদের বাবার সঙ্গে অজস্র কথা বলছিল। মেজমাসিকে দেখেই একেবারে কাবু। বাবার পেছনে আড়াল খোঁজার চেষ্টা করছিল।
তখনই মেজদির ক্ষোভের গলা, ওদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?
অতীশ নির্মলার মেজদিকে এমনিতেই সমীহ করে। ডাক্তার, তার উপর গাইনি। সে কাচুমাচু মুখে বলেছিল ওরা কিছতেই থাকতে চাইছে না। আমার সঙ্গে যাবেই—বায়না।
—এখন গিয়ে তুমি ওদের জন্য বাসায় রান্নাবান্না করবে! সত্যি দেখছি তোমাদের দুজনেরই মাথা খারাপ। কাজেই শেষ পর্যন্ত রাতের খাওয়া সেরে তাদের ফিরতে হয়েছে। টুটুল মিণ্টুকে জোরজার করেও শেষ পর্যন্ত মামাবাড়িতে রাখা যায়নি।
গেটের মুখে ট্যাকসি ছেড়ে দিতেই টুটুল মিণ্টু লাফিয়ে রাজবাড়ির ভিতর ঢুকে গেল—যেন এরা এতদিন কোনও জেলখানায় আটক ছিল—আবার নিজের জায়গায় তারা ফিরে এসেছে। দু-বছরে এই রাজবাড়ির গাছপালা, মাঠ, পুকুর এবং মানুষজন তাদের বড় কাছের। সামনে সেই বাসাবাড়ি—পাতাবাহারের গাছ। টুটুল বলছে, আমাদের বাড়ি। মিণ্টু বলছে, আমাদের পাতাবাহারের গাছ।
রাস্তায় আলো। মেসবাড়ির দরজায় রান্নার ঠাকুর বসে ভাঙা পাখায় হাওয়া খাচ্ছে। কুম্ভবাবুর বাড়িতে আলো জ্বলছে। সদর বন্ধ। ভিতরে কার সঙ্গে বচসা হচ্ছে। এখানে এলেই নতুন বাড়ির পাশ দিয়ে অন্দরমহলে তার বাসাবাড়ির রাস্তা। দু’পাশে গন্ধরাজ, রক্তকরবী ফুলের গাছ। ঢোকার মুখে বাঁ-দিকে স্থলপদ্ম, জবা, ঝুমকোলতা এবং অপরাজিতার বাগান। বউরাণী খুব সকালে, খাস বেয়ারা শঙ্খকে নিয়ে বাগানে ফুল তুলতে আসে। অতীশ তখন কেমন নিজেকে আড়ালে রাখতে ভালবাসে। যতটা এবং যতক্ষণ আড়ালে থাকা যায়। যেন দেখা হলেই বলবে, কীরে তুই এত ভীতু!
তার বাসার দরজার মুখে আবছা মতো অন্ধকার। অন্দরমহলের গাড়িবারান্দার আলোটা বোধ হয় আজ কেউ জ্বালিয়ে রাখতে ভুলে গেছে। আবছা অন্ধকারেই দেখল, টুটুল, মিণ্টু দৌড়ে সিঁড়িতে উঠে দাঁড়িয়ে আছে। বাবার জন্য অপেক্ষা। টুটুল ডাকছে, বাবা এস। মিণ্টু বলছে, বাবা দরজা খুলে দাও।
সে দরজায় তালা খুলে বলল, এস। ওরা ঢুকেই অন্ধকারে ছুটবে বলে বলল, দাঁড়াও আলোটা জ্বালি। অন্ধকারে আলো জ্বেলে দেখলে দুই শিশু ততক্ষণে সামনের ঘরটিতে লাফিয়ে ঢুকে গেছে। একেবারে নিজের পৃথিবীতে ফিরে এসে মিণ্টু টুটুল কী করবে স্থির করতে পারছিল না। লাফ দিয়ে করিডরের জানালায় উঠছে, লাফ দিয়ে চাতালে বেরিয়ে অন্য দরজা দিয়ে ঢুকছে। দু’জনের মধ্যে কে কাকে ছুঁতে পারে এমন এক প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। মামাবাড়িতে তা হলে তারা ভাল ছিল না!
অতীশ বলল, তোরা কি হাতপা ভাঙবি: আয় জামাপ্যান্ট ছাড়িয়ে দিচ্ছি। মাসখানেক বাদে বাবাকে ফিরে পেয়ে কী যে করবে ভেবে পাচ্ছে না। গরম পড়েছে। অতীশের কথায় দু’জনের একজনও সাড়া দিচ্ছে না। অতীশ নির্মলার ঘরে। বাক্স খুলে মিণ্টুর বাড়িতে পরার ফ্রক প্যান্ট, টুটুলের জামা বের করছে। বাথরুমে নিয়ে গিয়ে হাতমুখ ধুইয়ে জামাপ্যান্ট পরিয়ে দিতে হবে। বিছানা করে ফেলতে হবে। অনেক কাজ। সে আবার ডাকল, কি রে তোরা কোথায়!
কোনো সাড়া নেই। কী ব্যাপার! সে দরজায় উঁকি দিতেই অবাক! ভাইবোন কী নিয়ে টানাটানি করছে। কী সেটা! কাছে গিয়ে আরও অবাক। সেই ধূপবাতিদানটা, যা তার কাছে কোনো দেবীমূর্তির মতো। সহসা অতীশ কেমন পাগলের মতো দু’জনের কাছ থেকে মূর্তিটা কেড়ে নিল।
—না না, এটা তোমরা ধরবে না। এটা আমার। কখনও ধরবে না।
বাবার অদ্ভুত আচরণে ওরা দু’জনেই ঘাবড়ে গেল। বাবাকে বড় চঞ্চল দেখাচ্ছে। বাবার চোখ কেমন হয়ে গেছে। গোল গোল। ওরা যেন এ-বাবাকে চেনে না।
ওরা সোজা দাঁড়িয়ে থাকল। বাবা পুতুলটা নিয়ে কী করে দেখবে! ওরা দু’জনেই বড় সংলগ্ন। যেন ওরা বাবার কেউ না। ওরা ভাইবোন। মিণ্টু টুটুলের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
বাবা ওটা তুলে নিয়ে অনেক উপরে একটা কুলুঙ্গিতে রেখে দিল। ঠিক ঠাকুর দেবতা যেমন রাখা হয় তেমনি।
টুটুলের ভারি অভিমান। বাবা পুতুলটা তার হাত থেকে কেড়ে নিয়েছে। এটা সে সহ্য করতে পারছে না। সে ঠোঁট বাঁকিয়ে দিয়েছে। চোখ দিয়ে তার জল পড়ছে।
অতীশ মূর্তিটা কুলুঙ্গিতে রেখে ফিরে এসে বলল, কান্নার কী হল!
টুটুলকে কাঁদতে দেখলে মিণ্টুর কান্না পায়। মিণ্টু মুখ শক্ত করে রেখেছে।
অনেক রাত হয়েছে। সকালে উঠে রান্নাবান্না আছে। ওরা ঘুমিয়ে পড়লে বাড়িতে চিঠি লিখবে ভাবছে—কারণ বাবাকে পৌঁছানোর সংবাদ না দিলে চিন্তায় থাকবেন।
অথবা ভাববেন শেকড় আলগা হয়ে যাচ্ছে। বাড়িঘরের কথা মনে থাকে না। স্ত্রী-পুত্র-কন্যাই সব। বাবা মা বাড়তি। কত কাজ। সে ওদের প্রায় জোর করেই বাথরুমে নিয়ে গেল। মিণ্টুর ফ্রক খুলে, প্যান্ট খুলতে গেলে দেখল, সে বাবার হাত সরিয়ে দিচ্ছে। প্যান্ট খুলতে দিচ্ছে না।
—কীরে লজ্জা করছে! বাবাকে লজ্জা কি! খুলে দিচ্ছি।
মিণ্টু দু-হাতে প্যান্ট ধরে রেখেছে। অগত্যা অতীশ কী করে! একমাসে মেয়েটা মামাবাড়ি থেকে এত সব বুঝে গেছে। মামাবাড়ি গিয়ে কী বুঝেছে, মেয়েদের পুরুষের সামনে উলঙ্গ হয়ে ঘুরে বেড়াতে নেই। তার লজ্জার উদ্রেক হয়েছে। অতীশ হেসে ফেলল! পাকামি! তবু মিণ্টু কেমন মুখ শক্ত করে দু-হাতে প্যান্ট চেপে রেখেছে। অতীশ আর জোরজার করল না। হাতমুখ ধুইয়ে দিল। বলল, যাও ও-ঘরে গিয়ে ছাড়। বলে প্যান্টটা মিণ্টুর হাতে দিয়ে দিল। এটি দিতেই মিণ্টু এক দৌড়।
এই প্রথম অতীশ বুঝল, মিণ্টু বুঝে গেছে সে মেয়ে। বুঝে গেছে বাবা পুরুষ! কেমন বিচলিত বোধ করল অতীশ।
টুটুল সেই থেকে গুম মেরে আছে। সে দরজার পাশে লুকিয়ে আছে। যেন বাবা তাকে খুঁজে না পায়। অতীশ বাথরুম থেকেই ডাকল, টুটুল আয় বাবা। হাত পা ধুইয়ে দিচ্ছি। জামাপ্যান্ট ছেড়ে ফেল বাবা। তোর মা একটু ভাল হলেই নিয়ে আসব।
কেউ সাড়া দিচ্ছে না।
সে ঘরে গিয়ে দেখল, মিণ্টু টুটুলের হাত ধরে বাথরুমে টেনে আনার চেষ্টা করছে। সে আসবে ফেল বাবা। তোর মা একটু ভাল হলেই নিয়ে আসব।
কেউ সাড়া দিচ্ছে না।
সে ঘরে গিয়ে দেখল, মিণ্টু টুটুলের হাত ধরে বাথরুমে টেনে আনার চেষ্টা করছে। সে আসবে না বলে বেশ গোঁ ধরে আছে।
অতীশ বলল, আয়।
—ওটা আমাকে দেবে বল?
—কি দেব?
—পুতুলটা।
—ওটা পুতুল তোদের কে বলল!
মিণ্টু টুটুলের সঙ্গে সমস্বরে বলল, ওটা তো পুতুলই।
—না না। ওটা পুতুল না। তোমরা ধরো না! তা হলে মূর্তিটা রাগ করবে! আসলে এই দুই শিশু বুঝবে কি করে মানুষ জলে পড়ে গেলে খড়কুটো অবলম্বন করে বেঁচে থাকতে চায়। শহরের নিষ্ঠুর নিরাপত্তাহীন জীবনে পুতুলটা কখন তাদের বাবার কাছে দেবী হয়ে গেছে তারা জানেই না
—রাগ করবে কেন?
—বারে ওটা তোমরা ভেঙে ফেলতে পার।
—ভাঙব না বলছি তো!
অতীশ বুঝল, এখন এদের সঙ্গে অভিনয় করা ছাড়া উপায় নেই। সে বলল, আচ্ছা দেব। এখন হাত মুখ ধুয়ে শুয়ে পড়। কাল দেব। কেমন! আমার লক্ষ্মী সোনা। সকালে উঠে কত কাজ আমাদের। মিণ্টু তো বড় হয়ে গেছিস—পারবি না জলটল এনে দিতে। আটা মেখে দিতে!
—হ্যাঁ পারব।
—টুটুল বলল, হ্যাঁ আমিও পারব বাবা।
—বা সুন্দর। অতীশের চোখে কেন জানি জল চলে আসে। এই দুই শিশু বড় একা। মা তাদের অসুস্থ। অথচ বাবাকে ফেলে তারা থাকতে পারে না। মাসিরা কিছুতেই আটকে রাখেতে পারেনি।
অতীশ বড় যত্নে তার দুই শিশুর হাতমুখ ধুইয়ে দিয়ে বিছানা করে দিল। মশারি টাঙিয়ে দিল। এক পাশে সে, তারপর টুটুল, শেষে মিণ্টু।
কিন্তু মিণ্টু রাজি না। –বাবা আমি তোমার কাছে শোব।
—ঠিক আছে তুমি আমার পাশে শোবে।
—না আমি শোব। টুটুলের জেদ।
এ সব কথা মানুষের সংসারে মায়া জড়িয়ে দেয়। সে বলল, যাও, মশারির নিচে ঢুকে যাও। একি টুটুল। পা খালি কেন?
—আমার চটি কোথায়!
মিণ্টু নিজেরটা বের করে নিয়েছিল। টুটুল নেয়নি। খালি পায়ে হেঁটে বেড়াতে পারলে তার বেশি সুখ। অতীশ বলল, মশারির নিচে ঢুকে যাও। সে একটা তোয়ালে দিয়ে টুটুলের পায়ের পাতা সাফ করে দিল। আর নামবে না। কেমন?
মিণ্টু মশারির নিচে ঢুকে বাবার বালিশ দুটো মাঝখানে রেখে দিল। টুটুলকে বলল, তুই ওপাশে। আমি এপাশে। বাবা আমাদের মাঝখানে শোবে।
অতীশ হাসল। বলল, তোরা মামাবাড়িতে এই করে মাকে জ্বালিয়েছিস খুব। না?
মিণ্টু বলল, জান বাবা, মেজমাসি মার সঙ্গে আমাদের শুতে দিত না।
অতীশ কেমন ঘাবড়ে গেল কথাটায়। নির্মলার শরীর ভেঙে গেছে। মাঝে মাঝে নির্মলা যে ডিপ্রেশনে ভোগে তা সে টের পেয়েছিল প্রথম মিণ্টু পেটে এলে। প্রথম কিছু খেতে পারত না। গর্ভবতী হলে যা হয়। পরে দেখেছে সেটা কিছুতেই যায় নি। ডিপ্রেশন দেখা দিলেই, নির্মলার আহারের রুচি কমে যায়। কিছু খেতে চায় না। শরীর ভেঙে যেতে থাকে। বাবা বুঝতেন সব। নিজেই নানারকমের ছালবাকল সেদ্ধ করে খাওয়াতেন। এবং সংসারে অভাব-অনটন থাকবে—মানুষ যতই স্বাবলম্বী হোক, অর্থ মানুষকে সুস্থির থাকতে দেয় না। নিরাপত্তা যিনি দেবার তিনি তো মাথার উপরে-আছেন। তুমি আমি ভাববার কে? সংসারে পোকামাকড় বাসা বানাবে—তোমার কাজ শুধু তাদের হাত থেকে সবাইকে রক্ষা করা। বাবার এ-সব কথাবার্তায় নির্মলা বোধহয় জীবনে আস্থা ফিরে পেত। রক্তে আবার ঢেউ উঠত। দু- এক হপ্তা পরে নির্মলা গুনগুন করে গান গাইত। সহসা ডিপ্রেশন কেটে গিয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করত গাছপালার ছায়ায়। এখানে বাবা নেই যে নির্মলাকে সাহস যোগাবে। মাথার উপর সংসারে কেউ না থাকলে সবাই বড় একা।
অতীশ বলল, শুতে দিত না কেন? কার কাছে থাকতিস?
মিণ্টু বোধহয় সব বোঝে। সে বলল, মার তো শরীর ভাল না। অসুখ। আমরা পাশে শুলে মার কষ্ট হবে না!
—কষ্ট হবে কেন?
—বারে রাতে আমরা নাকি মাকে জড়িয়ে থাকি। টুটুল ঘুমের মধ্যে পা ছোঁড়ে! মার পেটে তবে লাগবে না!
—অঃ। যাক, অতীশের ভিতরে যে আশঙ্কা উঁকি দিয়েছিল মিণ্টুর কথায় সেটা কেমন উবে গেল। মিণ্টু বালিশে মুখ গুঁজে বলল, আমি আর কখনও মামার বাড়ি যাব না। দিদিমা কেবল বকে।
—দুষ্টুমি করলে বকবে না।
—জান বাবা টুটুলটা না হাঁদা। কিছু বোঝে না। দিদিমার বিছানায় হিসি করে দিয়েছে।
—কি রে তুই হিসি করে দিয়েছিলি?
—না বাবা। দিদি মিছে কথা বলছে। বলেই সে উঠে দিদিকে খামচে ধরল।
—বাবা টুটুল আমাকে মারছে।
—ইস্, তোরা এমন করলে আমি যাবটা কোথায়। টুটুল কী হচ্ছে! তোরা ঘুমোবি না!
—দিদি কেবল মিছে কথা বলে।
টুটুল বিছানায় পেচ্ছাব করে দিতেই পারে। মাঝে মাঝে দেয়ও। অতীশ তাই রাতে উঠে টুটুলকে বাথরুমে নিয়ে হিসি করায়। ঘুমের ঘোরে টুটুল কিছু বোঝে না। অতীশ প্যান্টের ফাঁক দিয়ে নুনুটা অজান্তেই রের করে দিয়ে শিস দেয়। শিস শুনে শুনে কখন যে টুটুল অজান্তেই হিসি করে—হিসি হয়ে গেলে সে তাকে ঘাড়ে ফেলে আবার নির্মলার বিছানায় শুইয়ে দিত। এটা তার নিত্যকার কাজ ছিল। রাতে টেবিল থেকে লেখালেখি সেরে ওঠার পর কখনও লিখতে লিখতে বেশ রাত হয়ে গেছে বুঝলে, শোবার আগে টুটুলকে তুলে নিয়ে হিসি করিয়ে সে ঘুমাতে যেত। টুটুলের জন্য সংসারে এ-কাজটা করা হয়ে থাকে মামাবাড়ির লোকেরা জানবে কী করে! নির্মলা হয়তো কিছুই বলেনি।
মিণ্টু বলে, জান বাবা, দিদিমা না সারা সকাল কেবল গজগজ করে। মাকে বকে! বাবা তুমি মাকে নিয়ে আসবে না?
—সেরে উঠলেই নিয়ে আসব। তোমার মা শিগগিরই ভাল হয়ে যাবে। কিন্তু কেন জানি অতীশের আঁতে ঘা লাগে। নির্মলা তবে সেখানেও শান্তিতে নেই! না থাকারই কথা। তার মতো একটা গরিব মাস্টারকে বিয়ে করে নির্মলা ভুল করেছে! নির্মলাকে সে বার বার বলেছে, ভেবে দেখ, আমরা খুব গরিব। বাবার যজন যাজন, কিছু জমি, আর আমার মাস্টারি। এই মিলে তিনচারটি ভাইবোন মা বাবা মিলে আমাদের সংসার। ভেবে দেখ, তুমি কোনো ভুল করছ না তো, তোমাদের গাড়ি-বাড়ি, অর্থ-প্রতিপত্তি তোমাকে পরে পীড়া দিতে পারে।
নির্মলার তখন এক কথা, আমি নাবালিকা নই।
হঠাৎ মিণ্টু কেমন কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, মামাবাড়িতে থাকলে মা আমার মরে যাবে। মাকে না ওরা কেউ ভালবাসে না। বলেই মিণ্টু হাউ-হাউ করে কাঁদতে থাকল।
অতীশ কেমন হয়ে যাচ্ছে সব শুনে। ভিতরে অপমানের জ্বালা, নির্মলার প্রতি বাপের বাড়ির মানুষজনের অবহেলা, নিজের সীমিত আর্থিক ক্ষমতা, বাবার প্রতি কর্তব্যবোধ সব মিলে তাকে অসহায় করে রেখেছে। সে জানে তার অফিসের সহকারীকে একটু আশকারা দিলে সেই তার হয়ে অজস্র অর্থের সংস্থান করে দিতে পারে। সে জানে, দু-নম্বরী মাল সরবরাহ করলে কুম্ভ নিজে থেকেই বলবে কানের কাছে কথাটা কেউ যেন বলে যাচ্ছে। সে কোনোরকমে দু-কান চেপে ধরতেই দেখল মিণ্টু বালিশে মুখ গুঁজে তখনও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। কান্না তার থামছে না।
সে বলল, আমি তোমার মাকে নিয়ে আসব। কাঁদবে না। ঘুমাও। অনেক রাত হয়েছে। না ঘুমালে উঠতে বেলা হয়ে যাবে।
টুটুল ঘুমিয়ে পড়েছে। মিণ্টুও একসময় ঘুমিয়ে পড়ল। ঘরে আলো জ্বলছে।
মাথাটা হঠাৎ কেন ধরে গেল বুঝতে পারল না। সে জানে, এ মুহূর্তে যদি সে চেয়ারটায় চুপচাপ বসে থাকে তবে সেই অশুভ প্রভাব আরও তাকে পেয়ে বসবে। আজকাল এও দেখেছে, যখন আর্চির প্রেতাত্মার প্রভাব তার উপর কাজ করতে থাকে তখন একমাত্র মুক্তির উপায় নিজের লেখার মধ্যে ডুবে যাওয়া। ভাঙা ঝরঝরে কারখানার ম্যানেজার হয়ে যেন তার নরকবাস শুরু।
সে, টেবিল ল্যাম্পটা তাড়াতাড়ি জ্বালিয়ে নিল। ঘরের অন্য সব আলো নিভিয়ে দিল। করিডরের দরজা বন্ধ আছে কি না দেখতে গেল। সে এসেই যে দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিল মনে রাখতে পারেনি।
সে দেখল, না সবই বন্ধ আছে। সে এবারে সাদা পাতার উপরে জীবনের কিছু কথা লিখে রাখার জন্য টানা লিখে যেতে থাকল।
লিখতে বসলেই কত সব স্মৃতি ভেসে আসতে থাকে। আসলে সে যেন কোনোও ছায়াছবি দেখতে পায়। মনের পর্দায় ছবিগুলো স্মৃতি হয়ে ভাসছে। তার মনে পড়ে সমুদ্র কি অসীম অনন্ত—বর্ণময় দ্বীপমালা—বন্দরে কত সব রহস্যময় মানুষ—কি বিচিত্র তাদের সুখ দুঃখ! যেমন বন্দরের সেই যুবতী, যে এসে তাদের নিয়ে গিয়েছিল, খৃস্টের উৎসবে খাওয়াবে বলে।
যুবতী এবং তার ঠাকুমা, হাতে লন্ঠন, অন্ধকার বন্দরে তারা ভারতীয় নাবিকের সন্ধানে ছিল। কবে কোন কালে সেই বুড়ি মহিলা, তার স্বামী-পুত্রকে ভারতের মাটিতে রেখে গেছেন—ভুলতে পারেননি। সুদূর নিউ-প্লাই-মাউথ বন্দরে অদ্ভুত একটি দিনের জন্য স্বামীপুত্রের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবার সুযোগ খোঁজেন। দু-একজন ভারতীয়কে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ান।
অতীশ তার নাবিক জীবনের স্মৃতি হাতড়ে বেড়াতে থাকল। যুবতী তাকে বলেছিল, ঠাকুমা আমার তৃপ্তি পান। তৃপ্তি কথাটাই বলেছিল। গাড়ি করে নিয়ে যাওয়া, গান গাওয়া—বিশাল খামারবাড়ি, অ্যাগমন্ট হিলের পাশ দিয়ে যাবার সময়, বৃদ্ধার কী আনন্দ, সে সাত রাজার ধন এক মানিক পেয়ে গেছে যেন। দু’পাশের কৌরি-পাইনের ছায়ায় যুবতী গাড়ি চালিয়ে তাদের নিয়ে যাচ্ছে।
যুবতী তাকে বলেছিল, যেবারে বন্দরে কোনোও ইণ্ডিয়ার জাহাজ থাকে না, জাহাজে কোনও ভারতীয় থাকে না, ঠাকুমা গীর্জায় যান না, শুধু ঘরে বসে থাকেন একটা ডেক চেয়ারে। আর কিছু বললেই দরদর করে চোখের জল নেমে আসে। আমরা তখন কিছু বলি না। মেয়েটি বলত, আমাদের সাত পুরুষ তোমার দেশে কাটিয়েছে। মারাও গেছেন তারা সেখানে। তোমার দেশের মাটিতেই তারা আছেন। তোমাদের দেশ স্বাধীন হবার সঙ্গে সঙ্গে আমরা এখানে চলে এলাম। আমার ফাদার, গ্রান্ডফাদার ভারতবর্ষের কোনো গাছের ছায়ায় শুয়ে আছেন, সেখানে কবরভূমির উপরে ক্রস। ঠাকুমা সারাটা বছর যেন বেঁচে থাকেন, কখন আবার তাঁরা আসবেন। তাঁদের উৎসবে আমন্ত্রণ করবেন। তোমরা এলে ঠাকুমা যেন তাঁর পূর্বপুরুষদের হাতের কাছে পেয়ে যান।
এ সব কাহিনী মনে পড়লে অতীশের মনে হয়, মানুষের জন্য অপেক্ষা করে থাকে শুধু অতীত। কেন এই জন্ম, কেন এই মৃত্যু? সে সেই জিজ্ঞাসার উত্তর খোঁজে বার বার। গম্ভীর অতলে ডুবে গেলে দেখতে পায়, সাদা পাতাগুলি হিজিবিজি লেখায় ভরে উঠেছে। ভিতরের অপমান প্রশমিত হয়। আর্চির প্রেতাত্মা ঘোরাফেরা করতে সাহস পায় না, কিংবা বনি, সহসা এসে সামনে দাঁড়িয়ে বলে না, ইউ আর ক্যারিং দ্য ক্রশ। ইট ইজ দ্য সাফারিং অব হিউম্যান ম্যানকাইন্ড।
যীশু কী তবে সেই ক্রশ বহন করে নিয়ে গিয়েছিলেন বধ্যভূমিতে—তিনি কী জানতেন, মানুষকে জন্মালেই পিঠে ক্রশ বহন করতে হয়—যীশু সে জন্যই নিজের ক্রশ পিঠে নিয়ে বধ্যমূমিতে যেতে কোনো কুণ্ঠা বোধ করেননি!
সেও কি তবে সেই ক্রশ বহন করে চলেছে। সব অপমান, নির্যাতন জ্বালা-বোধ কি যীশুর ক্রুশের প্রতীক। সে তার বধ্যভূমির দিকে যত এগিয়ে যাচ্ছে—তত উৎকণ্ঠা, পীড়ন, দুর্ভাবনা। সে কেমন আর তখন লিখতে পারে না। অসার বোধ হয়। জানালা দিয়ে দূরের আকাশ চোখে ভেসে ওঠে। সে উঠে গিয়ে দাঁড়ায়। একটা বড় নক্ষত্র জ্বলজ্বল করছে। শুনতে পায়, ডোন্ট বি পালড। স্ট্রাগল ইজ দ্য প্লেজার। যেন কাপ্তান স্যালি হিগিনস দু-হাত তুলে তার ভিতর সাহস সঞ্চার করে দিচ্ছেন। সে আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়। সকালে উঠে কত কাজ। টুটুল মিণ্টুর জলখাবার, মিণ্টুকে খাইয়ে স্কুলে দিয়ে আসা। টুটুলকে আর কার কাছে রেখে যায়। ভেবে দেখল, সঙ্গে করে তাকে অফিসে নিয়ে যাওয়াই ভাল। সে এবারে মশারির কাছে গেল। গিয়ে দেখল দুই ভাইবোন গলা জড়াজড়ি করে ঘুমিয়ে আছে। সে কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে থাকার সময়ই মনে করতে পারল বাবাকে চিঠি লেখা দরকার। কেউ বাড়ি থেকে না এলে এদের দেখাশোনা কে করবে!
আবার টেবিলে এসে বসল।
লিখল, শ্রীচরণেষু বাবা।
লিখল, আমি মঙ্গল মতই বাসায় এসে পৌঁছেছি। নির্মলার শরীর ভাল না। ও বাপের বাড়িতেই আছে। টুটুল মিণ্টু ওকে খুব জ্বালায়। এজন্য ওদের আমার কাছে নিয়ে এসেছি। অফিসের ভাত করে দেবারও লোক নেই। যদি এ-সময় মা এসে কয়েকটা দিন থাকেন ভাল হয়। প্রহ্লাদকাকে দিয়ে পাঠিয়ে দেবেন। আমরা এক প্রকার।
সে চিঠিটা অফিস ব্যাগে ভরে ভাবল সকালে যাবার পথে ডাক বাক্সে ফেলে দিয়ে যাবে। মা এলে টুটুলকে অফিসে সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে না। কেমন দুশ্চিন্তা মুক্ত হয়ে শুতে গেলে শুনতে পেল, রাজবাড়ির দেউড়িতে ঘন্টা বাজছে রাত বারোটা। অনেক রাত, ঘুম আসতে একটা বেজে যাবে। সে সেই কবে থেকে অনিদ্রার শিকার। বোধহয় নির্মলাকে বিয়ে করার পর থেকেই। নির্মলাকে বিয়ে করার পরই কেবল মনে হয়েছে, এও আর এক অলৌকিক জলযান। এখন আর তার জাহাজের কাপ্তান স্যালি হিগিনস নয়। সে নিজে।
তাকেই শেষ পর্যন্ত এই জাহাজ নির্দিষ্ট বন্দরে পৌঁছে দেবার কথা। সেটা কোথায় কতদূর সঠিক জানে না। সে পাশ ফিরে শুল।
টুটুল এক পাশে, অন্যপাশে মিণ্টু। সে মাঝখানে। তখনই মনে হল টুটুলকে হিসি করানো হয় নি। সে বিছানা ভাসিয়ে দিতে পারে। টুটুলকে বুকে তুলে দরজা খুলে বাথরুমে ঢুকে গেল। তারপর দাঁড় করিয়ে বলল, এই টুটুল, এই টুটুল।
টুটুলের ঘুম জড়ানো চোখ। সে বাবার ঘাড়ে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছে।
তাকে নাড়া দিল অতীশ। তারপর শিষ দিতে থাকল।
টুটুলের ঘুম ভাঙছে না।
সে আবার নাড়া দিল, এই টুটুল। লক্ষ্মী বাবা। হিসি করে নে। সে ফের শিস দিতে লাগল।
এই করে কখনও জাগিয়ে, কখনও মনে করিয়ে দিয়ে শিস দিতে দিতে সে দেখল টুটুল হিসি করছে। সে আবার তাকে বুকে তুলে নিতেই আশ্চর্য উষ্ণতা টের পেল টুটুলের শরীরে। ঘুমের ঘোরে নরম কাদা হয়ে আছে। তাদের একমাত্র ভরসা সে। টুটুল মিণ্টুর একমাত্র অবলম্বন। পাশ ফিরে শুইয়ে দেবার সময় মনে হল, তার যে কোনোও পাপ এদের মধ্যে সংক্রামিত হতে পারে।
সে দু-হাতে দু’পাশ থেকে টুটুল মিণ্টুকে বুকের কাছে তুলে এনে ঘুমোবার চেষ্টা করল। চিত হয়ে শুয়ে আছে অতীশ। একটা জিরো পাওয়ারের আলো জ্বলছে। মাথার উপর কুলুঙ্গিতে সেই দেবী। ঘুমে তার চোখ জড়িয়ে আসতে থাকল। তার মনে হচ্ছিল সে নিজেই এক অলৌকিক জলযান। অনিশ্চিত জীবন নিয়ে কোনো দারুচিনি দ্বীপের দিকে ভেসে চলেছে। যেন এক নিরুপম যাত্রা। সে কেমন এলোমেলো ভাবনায় ক্রমে তলিয়ে যেতে থাকল। মনে হল তার, পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকে কিংবা প্রাণপ্রবাহের প্রাথমিক দিনগুলি থেকেই এই যাত্রা। সে বের হয়ে পড়েছে। অতীশ মুহূর্তে সেই প্রাগ- ঐতিহাসিক জীবনের মধ্যে ঢুকে গেল। দাঁড়িয়ে আছে এক ঢিবিতে। সে লম্বা বড় বৃক্ষের ডাল মটমট করে ভেঙে খাচ্ছে। পাতা শেকড়বাকড় এবং সবুজ অরণ্যের মধ্য দিয়ে সে হেঁটে যাচ্ছে। তার অতিকায় লেজটা ক্রুদ্ধ ফণার মতো দুলছে। গায়ে বড় বড় আঁশ। ও-পাশে এক নারী প্রাগ-ঐতিহাসিক জীব তার অপেক্ষায় আছে রমণের জন্য। সেও অপার আনন্দে লেজ নাড়ছে। অতীশকে দেখে তার কী করুণ চোখ! গভীর মমতা—সে সহসা ছুটে আসছে। এসেই লেজ তুলে দিয়ে সে স্থির থাকতে পারছে না। প্রাণের এই অলৌকিক প্রবাহ চলছেই তো চলছে। সেই প্রবাহসমূহ কীট-পতঙ্গ, গাছ, লতাপাতা প্রাণিজগতের সৃষ্টির মূলে। সে তারই কোটি ভগ্নাংশের কোনো ছোট পরমাণু। আবার সে নিজেই এক মহাবিশ্ব। চঞ্চল অস্থির মহাবিশ্বের লাভা, অথবা বাবা যাকে বলেন; মহামায়া, তারই নিরন্তর নিরুপম যাত্রা। সে এক জটিল গ্রহ। যেমন এই মহাবিশ্বে অনন্তলীলা চলছে, অতীশ নামক এক ক্ষুদ্র প্রাণের মধ্যেও সেই লীলা। যার ব্যাখ্যা সে খুঁজে পায় না। কে টুটুল, মিণ্টু, নির্মলা, অথচ এদের জন্যই যত তার দুর্ভাবনা। সে জানে ঈশ্বর বলে কেউ নেই—তিনি সব গ্রহনক্ষত্রের সুতো ধরে বসে নেই, তবু ধূপদানিটাকে কোনো দেবীমূর্তি ভেবে সে কেন যে ওটা কুলুঙ্গিতে রেখে দিল! সবাই বলে তিনি আছেন! ঈশম দাদা বলেন, তিনি আছেন, তাঁরই মেহেরবানিতে আমরা বাঁচি। শস্য ফলে। স্যালি হিগিনস বলেন, আর ইউ স্ট্রং অ্যাজ গড অ্যান্ড ক্যান ইউ সাউট অ্যাজ লাউডলি অ্যাজ হি! ক্যান ইউ সাউট টু দ্য ক্লাউডস অ্যান্ড মেক ইট রেন! আর বাবা বলেন, অতীশ তুমি কিছুই পার না। তোমার যা কিছু সব তাঁর। বিধি নির্দিষ্ট মানুষ। তাঁকে অতিক্রম করে তোমার এক পা এগোবার ক্ষমতা নেই। তিনিই তোমার জন্মমৃত্যু, তিনিই তোমার ইহকাল পরকাল।
কিন্তু অতীশের মনে হয় কোনও দৈব কারণে এই প্রাণপ্রবাহের জন্ম। সে কোটি কোটি বছর ধরে নিরুপম যাত্রায় বের হয়ে পড়েছে। ভেসে চলেছে। এক অন্ধকার থেকে সহসা এই গভীর আলোকমণ্ডলে প্রবেশ, কোনো গুহা থেকে নির্ঝরিণীর মতো, বের হয়ে এসে আবার নদী উপনদী শাখানদী বেয়ে সেই অসীম জলকল্লোলে মিশে যাওয়া। ঈশ্বর নামক বস্তুটির কাছে সে কিছুতেই সারেন্ডার করতে পারছে না। করতে পারলে, সে জানে মুক্তি পেত। কিন্তু তার ক্ষুদ্র বুদ্ধি বলে, ঈশ্বরের সৃষ্টিকর্তা মানুষ। মানুষ না থাকলে ঈশ্বরও থাকত না। একটা পিঁপড়ের ঈশ্বর আছে কিনা সে জানে না। কিংবা গাছপালা এবং প্রাণিজগতে তার আধিপত্য কী রকম সে তাও জানে না।
আসলে বনির কথাই ঠিক—প্লিজ ইউ সারেন্ডার। যে কারো কাছে। ইট, পাথর, গাছ, মহাবৃক্ষ, নক্ষত্র, আকাশ, বাতাস, সমুদ্র—যেখানে খুশি। যেহেতু তোমার বধ্যভূমি তৈরি, যেহেতু তোমার অবস্থান ক্ষণকাল, যেহেতু তুমি জান না মৃত্যু কি ও কেন, জান না—তিনি অন্ধকারাচ্ছন্ন, না আলোকময়, না তিনি কোনো যথার্থই স্বর্গীয় সুখ, যখন কিছুই জান না তখন সারেন্ডার করতে আপত্তি কেন।
অতীশ বলেছিল, সেই জন্যই আপত্তি। আমি তার কিছুই জানি না। তাকে আমি চিনি না, বনি। তোমার বাবা কাপ্তান স্যালি হিগিনস হয়তো তোমাকে এমনই শিখিয়েছেন, আমার বাবাও বলেন তুমি নিমিত্ত মাত্র। বুঝি না, কেন এক অদৃশ্য শক্তির অধীনে আমাদের ক্রীতদাসের মতো বাঁচতে বলছ!
বনি তাকে প্রবোধ দিয়েছিল, তিনি অজ্ঞাত হবেন কেন? তিনিই সব চেয়ে বেশি জ্ঞাত। সব সময় টের পাই তিনি আছেন। ঘুমে, জাগরণে, এই মহাসমুদ্রে তুমি আমি আর এই পাখি ছাড়া আর কে আছে? তাকাও চারপাশে শুধু অনন্ত জলরাশি। স্থির। আকাশ ধূসর। গভীর রাতে দেখ অজস্র নক্ষত্র সমুদ্রে কেমন জোনাকি পোকার মতো ছায়া ফেলে যাচ্ছে। দেখ, কি শান্ত আর নিস্তব্ধ সব কিছু। দ্যাখ আমাদের, প্রিয় পাখি এলবা কেমন মাথা গুঁজে গলুইয়ে বসে আছে। দ্যাখ সে আবার সামনে উড়ে যাচ্ছে—আমি জানি, সেই খবর দেবে আমাদের ডাঙা কোনদিকে। সে যেভাবে সারাদিন যেদিকে উড়ছে, আমরা বোট সেদিকেই নিয়ে যাব। ঈশ্বর না থাকলে, ঈশ্বরে বিশ্বাস না থাকলে ছোটবাবু আমি তোমাকে বাঁচাতে পারব না। প্লিজ তুমি গোঁয়ার্তুমি করো না। তাকে তুমি অস্বীকার করো না। বলে দু-হাটুর মধ্যে মুখ রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল বনি
সমুদ্রজীবনের এক একটা দৃশ্য ভেসে এলেই সে কেমন বিপাকে পড়ে যায়।
গভীর রাতে সেই এক বিপাকে সে কেমন অস্থির হয়ে উঠছে। পাথরের ধূপদানিটা তার কাছে আর নিছক ধূপদানি নয়। কষ্টিপাথরের মূর্তির মাথায় মুকুট, অজস্র ফোকর ধূপকাঠি গুঁজে দেবার জন্য। কেন যে মাঝে মাঝে তার মনে হয় বনির আত্মা এই মূর্তির ভেতর আশ্রয় নিয়েছে। তার চরম ক্ষতির আশঙ্কার সময় কেমন দৈববাণী হয়—এটা তার মাথার বিকার কিনা সে জানে না। টুটুল মিণ্টুকে কিছুতেই ওটা আর দেওয়া যাবে না।
ঘুমটা লেগে এসেছিল—সহসা সমুদ্রের সেই সব দৃশ্য তাকে কেমন নাড়া দিয়ে গেল।
সে উঠে বসল। মশারি তুলে বাইরে বের হয়ে অনুজ্জ্বল আলোয় মূর্তিটার সামনে দাঁড়াল। মূর্তিটা কুলুঙ্গির ভেতর নীরব নিথর হয়ে আছে। চোখে কেমন সরল হাসি। সে বলল, বনি তুমি কী সত্যি এখানে আছ। এই মূর্তির ভেতর যদি থাক আমি তোমাকে স্পর্শ করলে টের পাব। যদি থাক, আমি সাহস পাব—আর নিছক মূর্তি হলে এখনি আছড়ে ভেঙে ফেলব। বলে যেই না সে ভেঙে ফেলার জন্য তুলতে গেছে, কেমন এক বিদ্যুৎ প্রবাহ তার সারা শরীরে খেলে গেল। সারা শরীরে সেই প্রবাহ তাকে লোমহর্ষক কোনো ঘটনার সাক্ষী রেখে, নিদারুণ স্তব্ধতায় ডুবে গেল—সে কাঁপতে কাঁপতে বলল বনি, আমার সন্তানেরা কোনো অপরাধ করেনি—তাদের তুমি দেখ। তুমি এই ঘরে আছ, থাকবে। তুমি থাকলে আর্চির প্রেতাত্মা আমাকে তাড়া করবে না। আর্চির প্রেতাত্মার সঙ্গে আমি লড়ে যাব।
আর তখনই মিণ্টু টুটুল জেগে গিয়ে আর্তনাদ করে উঠল, বাবা। বাবা।
অতীশের সম্বিৎ ফিরে আসছে। সে তার দুই শিশুকে জড়িয়ে শুয়ে পড়ার সময় বলল, তোমাদের মা ভাল হয়ে গেলেই নিয়ে আসব। তোমরা ঘুমোও।
ওরা ঘুমিয়ে পড়লে অতীশ ভাবল—তার নিরুপম যাত্রা এদের মধ্যেই শুরু, এদের মধ্যেই শেষ। অন্তত তার জন্য না হলেও, তার সন্তানের জন্য কোনো এক ঈশ্বরের বড় দরকার।