1 of 2

ঈশ্বরের বাগান – ২৫

।। পঁচিশ।।

এই গাড়ি চড়ে কোথাও তবে যাওয়া যায়। গাড়ি ছাড়লে অতীশের এমন মনে হল। পাশাপাশি বসে আছে সে এবং চারু। কামরায় একটা ডিম আলো। ভারি নিস্তেজ—কেমন ম্রিয়মাণ এক সৌন্দৰ্য। চারুর পায়ে রুপোর চেলি। জরির জুতো। নোখে সবুজ নেল পালিশ। আর গায়ে আশ্চর্য সুঘ্রাণ। ঠিক অমলার মতো অথবা যে কোন সুন্দরী নারীর পাশে বসলেই এই আশ্চর্য ঘ্রাণ পায় অতীশ তার তখন নেশা বাড়ে। কলকাতায় আসার পরই এটা হয়েছে, না নির্মলার অসুখের পর সে বুঝতে পারছে না! আসলে কি নির্মলা তাকে আর ভালবাসে না। শুধু সম্পর্ক জিইয়ে রাখছে। অথবা পাঁচজন কি ভাববে, এত সখ করে যে মানুষকে বরমাল্য পরালে, পাঁচ সাত বছর পার না হতেই বাজারের সস্তা মাল হয়ে গেল। অথবা মনে মনে কি নির্মলা তাকে ঘৃণা করতে শুরু করেছে। অক্ষম মানুষের অত দায়-দায়িত্ব বোধ কেন! সে কিছুই বুঝতে পারছে না। শুধু বুঝতে পারছে, অমলা তাকে বাঘের থাবায় খেলাচ্ছে। ওর এ-সব ভাবতে ভাবতে হাই উঠছিল।

ইতিমধ্যে ট্রেনটা একটা ছোট স্টেশন অতিক্রম করে গেছে। সব স্টেশনে ট্রেনটা ধরছে না। বড় বড় স্টেশনে ধরবে সে এটা জানত। দু-একজন যাত্রী উঠলে অস্বস্তি থাকত না। চারুর সঙ্গে সহজেই ঘনিষ্ঠ হয়ে কথা বলতে পারত। চারু শুধু একবার বলেছিল, যখন চা খাবেন বলবেন। ফ্লাকসে চা আছে। যেন চারু জানিয়েই রাখল, দরকার মতো চাইলেই পাবেন। এবং যা হয়ে থাকে, সে এই নারীর ভেতরের শরীর স্পষ্ট দেখতে পেল। অথচ মুখে তার পরম সাধুভাব। মহান্ত গোছের মানুষ, যেন অন্ধকারে দু’পাশের গাছপালা মাঠ আবিষ্কার করা ছাড়া তার আর এখন কিছু করণীয় নেই।

চারু বাবুজীকে দেখল এবং দেখে মিষ্টি করে হাসল। বাবুজী লজ্জায় তার দিকে তাকিয়ে কথা বলছে না। চারুর ভাল লাগছে। সে খুবই সতর্ক, কারণ পিয়ারিলাল বলেছে, বাবুজী সাচ্চা আদমী। সেই বাবুজী এখন বাইরে তাকিয়ে আছে। সে বলল, বাইরে মুখ রাখবেন না। চোখে কিছু উড়ে এসে পড়তে পারে।

চারু ভারি আপনজনের মতো কথা বলছে। অতীশ এবার মুখ তুলে তাকাল। মেয়েদের সম্পর্কে তার একটা সম্ভ্রমবোধ আছে। আচার আচরণে সেটা আজ আরও বেশি ফুটে উঠেছে। তারা কাছে এলেই সে সংকুচিত হয়ে পড়ে। খুব খোলামেলা হতে পারে না। সে চারুর কাছেও খুব বেশি খোলামেলা হতে পারবে না। কারণ এটা তার স্বভাবে নেই। সে ভেতরে যতই খারাপ মানুষ হোক বাইরে একটা সম্ভ্রমবোধের সৌধ গড়ে তুলেছে। এবং কেন জানি কখনও মনে হয় এই মিছে আত্মতুষ্টি খুবই অর্থহীন। নিজেকে সে আসলে ঠকাচ্ছে।

তখন চারু বলল, ভোর হয়ে যাবে পৌঁছতে।

—ঠিক মতো গেলে হবে হয়ত।

আসলে কথার কেউ সূত্র খুঁজে পাচ্ছে না। কিন্তু চারু জানে তাকে সূত্র খুঁজে বের করতেই হবে। মাত্র পাঁচ ঘণ্টা সময়। সে মানুষটার সখ্যতা আদায় করতে এসেছে। তার এখন এটাই বড় দায়। গাড়ি লেট না করলে চারটে সাড়ে চারটায় পৌঁছানোর কথা। এই শ্রেণীগুলিতে যাত্রী ওঠে না। পিয়ারিলাল সব খবর নিয়েছে। এবং চারুর শরণাপন্ন হয়ে বলেছে, ব্যাওসা লাটে উঠল। বাঁচা।

চারু খুব একটা সেজে আসে নি। সে আসার আগে কুম্ভবাবুর কাছে মানুষটার সব খবরাখবর নিয়েছে। সব শুনে সে বুঝে ফেলেছে, আসলে মানুষটা রুচিবান। রুচিবান মানুষকে মজামো সহজ না। সে সেই বুঝে ঠোঁটে হাল্কা লিপস্টিক দিয়েছে। সেই ভেবে, চোখে হাল্কা কাজল দিয়েছে। সাদা সিল্ক পরেছে। ভূ প্লাক করাই থাকে। সেটা না থাকলে ভাল হত ভেবেছে। আসলে সে এসেছে মানুষটার কাছে প্রকৃতির জলজগন্ধ নিয়ে। কামুক হয়ে লাভ নেই। চোখে মোটা কাজল দিয়ে লাভ নেই। সব হাল্কার ওপর পছন্দ মানুষটার—চারু সব শুনে এমনই ভেবেছে।

তা-ছাড়া সব শুনে চারুর মনটা প্রথম বেশ দমে গিয়েছিল। সুতোর বলের মতো, কোথায় যে গড়িয়ে যায়, কিন্তু সুতোর গিট অন্য এক দেয়ালের পাশে কেউ ধরে থাকে, সেটা কে চারু কোনদিন জানতে পারবে না! চারু পিয়ারিলালকে বলেছিল, তুমি একটা ভাল মানুষকে প্যাঁচে ফেলছ কেন? পিয়ারিলাল হেসেছিল। কিছু বলে নি। চারু বুঝতে পেরেছিল, সে যে এতদূর উঠে এসেছে, এই মানুষটার করুণায়। ঘরে কেউ এলে’ সাজানো প্লেটে সে এখন মিষ্টি ধরে দিতে পারে।

ফলে পিয়ারিলালের জন্য চারুর কিছুই করতে আটকায় না। তবু কি যে হয়, মানুষের কি যে থাকে, কোথায় যেন এক আবহমানকালের সংস্কার রক্তের মধ্যে থেকে যায়—খুব নিচে নামতে আটকা চারুর। মানুষটাকে দেখে সে কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে তাকিয়েছিল। সব কিছুই দেখে, আবার কিছুই দেখে না মতো চোখ মুখ, যেন গত জন্মে কি হারিয়েছিল, এখনও তা খুঁজে বেড়াচ্ছে। চারু বলল, কুম্ভবাবু আপনার খুব সুখ্যাতি করে।

কথার একটা যা হোক খেই পাওয়া গেল। সে বলল, কুম্ভবাবুকে তুমি চেন?

—বারে চিনব না। আমাদের ঘরের মানুষ। কুম্ভবাবু না থাকলে চাচাজীর লোটা কম্বল সার হত।

মেয়েটা ত বেশ কথা বলে। ঠোঁটে কি সবুজ লিপস্টিক আলতো করে দিয়েছে! কথা বলতে বলতে ঠোঁট ভিজে যাচ্ছিল চারুর। এবং ভারি তীক্ষ্ণ চাউনি। চোখ তুলে যখন তাকায় অতীশের ভারি মোহ সৃষ্টি হয়

চারুই প্রায় কথা বলছিল—রাতের ট্রেন বেশ ভাল। আমার খুব ভাল লাগে।

অতীশ রাতের ট্রেনে যেতে ভয় পায়। বিশেষ করে নির্মলা বার বার বলেছিল, তুমি যাই কর রাতের ট্রেনে যাবে না। কত সব কান্ড হচ্ছে। ছিনতাহ, চুরি, ডাকাতি কি না! কিন্তু অতীশ জানে, ভিড়ের মধ্যে সে বসে থাকবে। কিছু টাকা পয়সা থাকবে এই পর্যন্ত। এমনকি সে হাতঘড়িও পরে না যে ছিনতাই হবে। জুতো জামা খুলে না নিলে তার যাবার কিছু নেই। যেটা সব চেয়ে অসুবিধা তার কাছে, রাতের ঘুম নষ্ট। রাতের ট্রেনে তার ঘুম হয় না। সে একটু ঘুমোবে বলেই বাসা ছেড়ে পালাচ্ছে। আর্চির তাড়া খেয়ে সে ছুটছে বাবা মার কাছে! দিনে দিনে গেলে হত, কিন্তু সব কাজ সামলে ট্রেন ধরা হয়ে উঠবে না ভেবেই, সে নির্মলাকে কথা দিয়েছিল, সাবধানে যাব। আর একটা রাতও একা বাসায় কাটানো তার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়। আর্চি তবে আরও বেশি মজা পেয়ে যাবে। সে প্রায় নির্মলাকে এসবও বলতে যাচ্ছিল।

অতীশ চারুর সান্নিধ্যে বেশ উষ্ণতা অনুভব করছে। একবার রাম সিং এসে খবর নিয়ে গেছে, কোন দরকারে সে যদি লাগে। চারু বলেছিল, দরকার পড়বে না। তুমি চা টা দরকার মতো খেয়ে নিও। বলে পার্স থেকে একটা টাকা বের করে রাম সিংকে দিলে, সে সেই যে চলে গেল আর এল না।

চারু নানাভাবে এখন কথা শুরু করে দিয়েছে। সে দু’ হাঁটুর ওপর মুখ ভাঁজ করে অতীশের সামনা-সামনি বসে আছে। বাবুজীর বহু কেমন দেখতে, খুব দেখতে ইচ্ছে করে জানাল চারু। অতীশ হেসে বলেছিল, এস না, কুম্ভবাবুর সঙ্গে আমার বাড়ি চলে এস। আলাপ হবে।

চারু ততোধিক চোখ ওপরে তুলে বলেছে, আরে বাপস, যাই আর যুদ্ধ লেগে যাক। কোথাকার কোন মেয়ে, ভাবিজীর পছন্দ নাও হতে পারে।

—কেন হবে না। তুমি তো খুব ভাল মেয়ে।

চারু কেমন গম্ভীর হয়ে গেল। জানালায় তাকিয়ে থাকল। অতীশ ভাবল, কোনও খারাপ কথা বলে ফেলেনি ত! যা সে অন্যমনস্ক, সে বার বার মনে করার চেষ্টা করল আসলে সে কি বলেছে!

হাতড়ে হাতড়ে পেয়েও গেল। সে বলেছে, তুমি তো খুব ভাল মেয়ে। এ কথায় রাগ হবে কেন! মুখ গম্ভীর হবে কেন। সে ডাকল, চারু

চারু মুখ ফেরাল না। বলল, আপনি ঘুমোবেন বাবুজী?

—এ-কথা কেন?

—ঘুমোন না। আমি জেগে বসে থাকব।

—ট্রেনে যে আমার ঘুম হয় না চারু।

—কোথায় হয়।

—তাও জানি না। তারপরই তার মনে হল বুকের মধ্যে এমন কথায় খুব সুদূরে কে যেন দাঁড়িয়ে যায়। বনির মুখ। বনির মতো চারুও তাকে ঘুমাতে বলছে। কারণ সেই ক্লান্তিকর সমুদ্রে, কখনও সে, কখনও বনি কত সব মরীচিকা দেখতে পেত। অতীশ মরীচিকা দেখতে দেখতে কখনও ভুল বকত, কে আছেন, কে আপনি, আপনি কি সেই বিধাতা, অব দ্য ফেট বনি বনি দেখ আৰ্চিটা মুখ ভেংচাচ্ছে!

বনি বলত, তুমি এত কষ্ট পাচ্ছ কেন ছোটবাবু? কোথাও কিছু নেই। আর্চি কোথায়! সব ত খাঁ খাঁ করছে।

প্রায় রাহুগ্রাসের শামিল। গিলছে। অতিকায় সমুদ্র দুই বিশাল থাবা মেলে বসে আছে। হাজার হাজার মাইল ব্যাপ্ত অকূল জলরাশি। বনি বুঝতে পারছে না অসীম সমুদ্রে ছোটবাবু তার সব হিসাব গণ্ডগোল করে ফেলেছে। পালে বাতাস নেই। পাখিটা নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। আর আগের মতো উড়তে সাহস পাচ্ছে না। পাখিটা ঝিম মেরে বসে থাকে। যে-সব পাত্রে খাবার মজুদ ছিল, তার দিকে তাকালে বুক হিম হয়ে আসে। জলের তলানিতে শ্যাওলা জমছে। সেই শ্যাওলাটুকু বনি তুলছে না। যা রোদের তাপ, শ্যাওলা তুলে ফেললেই সামান্য যে জলটুকু আছে তা শুকিয়ে যাবে। বনি প্রায় কিছুই খাচ্ছে না। এবং সব সময় ভান করছে, সে তার ভাগ মতো ঠিকই খেয়ে যাচ্ছে।

ছোটবাবু জানে আসলে সে নিজের আত্মরক্ষার উপায় কিছুটা পেয়ে গেছে। প্ল্যাংকাটন খেতে তার আর খুব বিস্বাদ লাগছে না। জলের দারুণ তেষ্টা মরে যায়। শরীর চাঙ্গা হয়ে ওঠে। জল, খাবার কিছু না থাকলেও তার ক্ষতি নেই। শুধু বোটটা জলের ওপর ভেসে থাকলেই সে বেঁচে থাকতে পারবে। কিন্তু বনি! সে তো প্ল্যাংকাটন মুখে দিতে পারছে না। সব সময় বমি বমি ভাব। চোখ ঘোলা ঘোলা। কঙ্কালসার হয়ে যাচ্ছে। সেই মুহ্যমান চোখ নেই। সজীবতা ক্রমে কেউ রক্তচোষা বাদুড়ের মতো চুষে নিচ্ছে। যেন এটা আর্চিরই অভিসন্ধি। সে ছোটবাবুকে এক ভয়াবহ বিভীষিকায় নিয়ে যেতে চায়। যুবতী নারীর কঙ্কালসার মৃতদেহ সামনে। যেন প্রশ্ন, ওকে?

—আমি চিনি না আর্চি।

—আরে এই ত সেই রহস্যময়ী নারী বনি।

—তা হতে পারে।

—একে নিয়ে আর ভেসে বেড়াচ্ছ কেন?

—কি করব?

—ফেলে দাও। সমুদ্রে নিক্ষেপ কর। হাঙ্গরেরা খাক। দেখি—কি মজা?

তখনই বীভৎস সেই ছবি আর্চির। আর্চির হাতের আঙুলগুলো সমুদ্র থেকে যেন সাপের মতো কিলবিল করে ভেসে উঠছে। মুখ আর মুখ নেই। নাক কান সব লম্বা হয়ে এক একটা অতিকায় অক্টোপাসের অজস্র শুঁড় হয়ে গেছে। আর সমুদ্রের জলে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। কখনও সেই ডোরাকাটা মুখ নিয়ে অন্ধকার সমুদ্রে ছায়ার মতো তাকে ছুঁতে চেষ্টা করছে। কিন্তু একটা অদ্ভুত বিষয় সে লক্ষ্য করছে। আর্চি বোটে পা দিতে পারছে না। ক্রসটা দেখলেই আঁতকে উঠছে আর্চি। তবু প্রতিহিংসাপরায়ণ হলে যা হয়, জলের ওপর দিয়েই সে হেঁটে যেতে পারে। মেঘের মতো ভেসে আসতে পারে। অন্ধকার যত গভীর হয়, যত শব্দহীন মৃত্যুহীন প্রাণ খেলা করে বেড়ায় চরাচরে তত তার আক্রোশ বাড়ে ছোটবাবু বার বার চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত আর সামলে উঠতে পারেনি, চিৎকার করে বলেছে, দেখ বনি আর্চিটা কেমন মুখ ভেংচাচ্ছে।

বনি কাত হয়ে শুয়েছিল। ছোটবাবুর চিৎকারে সে বুঝতে পেরেছে, কখন উঠে বের হয়ে গেছে পাটাতনে। ছোটবাবু ভয়ে চিৎকার করছে। সে কোনরকমে হামাগুড়ি দিয়ে বের হয়ে বলল, এদিকটায় এস। শিগগির। এলবা কোথায়?

—নেই।

বনির গলা ফ্যাসফ্যাসে হয়ে গেছে। ভারি ক্ষীণ গলায় বলল, আমাকে ধরে বস। দাঁড়িও না।

—কি হবে বসে!

—বস না।

ছোটবাবু দেখেছিল, বনি এক হাতে ক্রসটা ছুঁয়ে রেখেছে। আর এক হাতে তাকে ছুঁতে চাইছে। এবং বনির হাত ছুঁয়ে দেবার সঙ্গে সঙ্গে ভোজবাজির মতো কেমন সব অদৃশ্য হয়ে গেল। কিছু নেই। জলের মন্থর কলকল শব্দ। অন্ধকার আকাশের এক কোণায় করুণ বিষণ্ণ একফালি চাঁদ। ছায়া ছায়া হয়ে আছে—অথবা এক প্রগাঢ় নির্জনতা সমুদ্রের। কোথাও ঝুপ শব্দ। বড় মাছ-টাছ হবে। ভোঁস করে ভেসে উঠে ডুবে যাচ্ছে।

বনির গলা পাওয়া যাচ্ছে। বলছে, ছোটবাবু বাইবেলটা কি করলে।

—তোমার শিয়রে রেখে দিয়েছি।

—ওটা আমার আর লাগবে না। বলতে গিয়ে বনির কেমন বড় বড় শ্বাস উঠে আসছিল। বনি কি মরে যাচ্ছে! আসলে বনির গলা শুকিয়ে কি কাঠ কাঠ হয়ে গেছে। জল, খাবার শেষ হয়ে যাবে বলে আগে থেকেই বনি কেটে পড়তে চাইছে! অথবা ছোটবাবুর জীবন রক্ষার জন্য বনি অভিনয়ের আশ্রয় নেয় নি ত! কোন খাবারই মুখে দিতে পারছে না। বলছে, ওক উঠে আসছে। সে একটা আলুসেদ্ধ ভেঙে জোর করে মুখে পুরে দিয়েছিল দুপুরে। খাও, না খেলে বাঁচবে কি করে! বনি খায় নি। গলায় আটকে যাচ্ছে। বিষম খেয়ে কেমন নিস্তেজ হয়ে পড়েছিল পাটাতনে। উপুড় হয়ে পড়ে থাকতে থাকতেই বলেছিল, ছোটবাবু আমি পারছি না, সত্যি কিছু খেতে পারছি না।

অন্ধকারে ছোটবাবু বুঝতেও পারছে না। নাকের কাছে হাত নিয়ে দেখল, না, নিশ্বাস পড়ছে। বুকে হাত দিল। টিপ টিপ শব্দ। স্যালি হিগিনস আপনি কোথায়! এ কি করলেন! একটু আলো পর্যন্ত জ্বালতে পারছি না। আমাদের সব ফুরিয়ে আসছে। তারপর কি ভেবে বলল, আমাদের নয়। আমার বনি কিছুই খাচ্ছে না কেন! আপানি এত ধর্মবিশ্বাসী মানুষ ছিলেন, কোনও দৈববাণী করুন। কি করলে বনি আবার খেতে পারবে। বনির বমি পাবে না। বনি আর মরীচিকাও দেখছে না। এখন আমি শুধু মরীচিকা দেখছি।

ছোটবাবুর মনে হয়েছিল, মরীচিকা দেখলে বনি স্বাভাবিক আছে সে টের পেত। সে যেমন দেখছে। মৃত্যুভয় থেকেই সে এ-সব দেখছে। মৃত্যুভয় সব শিরা-উপশিরায় ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো কামড়ালেই সে মরীচিকা দেখতে পায়। তবে ঠিক মৃত্যুভয় কিনা জানে না, বোধহয় একা হয়ে যাবার ভয়, সমস্ত পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার ভয়—বনি না থাকলেই সে যেন তাই হয়ে যাবে। জীবনের এক. এক মুহূর্তে মানুষের জন্য অপার সব বিস্ময় অপেক্ষা করে থাকে। এই সেদিনও বনিকে সে চিনত না, জানত না। বনি এক সুদূর গ্রহের নারী সে বুঝতে পারত না। ছোটবাবু মরিয়া হয়ে কেবিনে ঢুকে তার সব খুলে না ফেললে সে বুঝতেই পারত না, আসলে কাপ্তানের ছোট ছেলেটা এক বালিকা তারপরই কি যে সেই গভীর এক গোপন পৃথিবীর আবিষ্কার। তখনই বনি বলছে, ছোটবাবু আমাকে নিয়ে শুইয়ে দাও। যে ক’দিন থাকি শিয়রে বসে থাক। মরে গেলে আমাকে সমুদ্রে ভাসিয়ে দিও। ক্রসটা জাহাজেই রেখ। তা না হলে আর্চি তোমাকে বিড়ম্বনায় ফেলে দেবে। বাইবেলটা সব সময় পকেটে রাখবে। ওটা তোমায় দিয়ে গেলাম।

চারু দেখল, বাবুজী জানলায় মুখ রেখে তাকিয়ে আছে। ট্রেনের ঝাঁকুনিতে মাথাটা অল্প দুলছে। দু হাঁটুর মধ্যে মাথা। একবার মনে হল ঝিমুচ্ছে। মাথা নিচু করা। মুখটা দেখতে হলে হাঁটু গেড়ে নিচে বসতে হবে। যদি না ঘুমোয়, তবে দেখবে, এক রমণী তাকে চুপি চুপি চুরি করে দেখছে। এত বেশি কৌতূহল বাবুজীর পছন্দ নাও হতে পারে। দু একটা কথা বলে দেখেছে জবাব নেই। সে তার ব্যাগ থেকে সাদা চাদর বের করে বাংকে বিছিয়ে দিল। একটা বালিশ। সে এখন ইচ্ছে করলে ডাকতে পারে। গায়ে ঝাঁকুনি দিয়ে বলতে পারে—আপনি বড্ড ঘুম কাতুরে। উঠুন। শোবেন।

সে ডাকল, বাবুজী!

অতীশ দেখতে পাচ্ছে, আকাশ ফুটো করে এক ঝলক বিদ্যুতের মতো শীর্ণ ফ্যাকাসে লম্বা একটা হাত ওর দিকে এগিয়ে আসছে। বলছে, নাও। তোমাকে দিলাম। রাখ। যত্ন করে রাখ। তবে আর কষ্ট পাবে না। হাতটা ওর জানলার কাছে বাড়িয়ে রেখেছে। সে যেন হাত পাতলেই টুপ করে কেউ কিছু তাকে দেবে বলে অপেক্ষা করছে।

—বাবুজী।

—হুঁ।

—উঠুন।

—কে? আচমকা ভূত দেখার মতো চারুর সজীবতা তাকে কাতর করে ফেলল। বলল, কিছু বলছ চারু?

—ঘুমোচ্ছেন যে!

—না ত!

—আপনি বড্ড মিছে কথা বলেন।

—আমি ঘুমোচ্ছিলাম!

—তা নয়ত কি?

হবে হয় ত! সে আর কিছু বলতে চাইল না। আবার কেমন নিজের মধ্যে নিমগ্ন হয়ে গেল। এবং এই হয় অতীশের। সে বাড়ি যাচ্ছে। কত দিন আগেকার সব ঘটনা মাথার মধ্যে এখনও করাত চালায়। সে কিছুতেই স্বাভাবিক থাকতে পারে না। এতদিন পর আবার বনি কেন বাইবেলটার কথা বলছে! জোরজার করে বনি যে বিশ্বাস তৈরি করতে চেয়েছিল, মৃত্যুভয় মরীচিকা শেষ পর্যন্ত যা তাকে বিশ্বাস করাতে পারেনি আজ আবার তা কেন বহু রূপে দেখা দিচ্ছে সামনে। হাতের শিরা- উপশিরাগুলো পর্যন্ত নীল রঙের। কঙ্কাল সদৃশ হাতের মধ্যে কেউ যেন একটা চামড়ার গ্লাস পরিয়ে রেখেছে।

কি ভেবে অতীশ বলল, আমি ঘুমোব না চারু।

—না ঘুমোলে চা খান। বলে ফ্লাক্সটা পেড়ে নিল। আঁচলটা গা থেকে বার বারই আলগা হয়ে যাচ্ছে। পড়ে যাচ্ছে।

সারাক্ষণ অতীশ দেখেছে, চারু ওর আঁচল সামলাতেই ব্যস্ত। যখনই পাশাপাশি বসে থেকেছে, পায়ের পাতা বার বার শাড়ি টেনে ঢেকে দিচ্ছে। এত সব দেখলে অতীশ কেমন বিভ্রমের মধ্যে পড়ে যায়। দেখবে না বলেই, জানলায় মুখ রেখে চুপচাপ আকাশ, নক্ষত্র এবং অন্ধকার দেখে যাচ্ছিল। দেখতে দেখতে সে হয়তো সত্যি ঘুমিয়ে পড়েছিল। নতুবা লম্বা শীর্ণ ফ্যাকাসে হাতটা এত স্পষ্ট এখনও সে দেখে কি করে!

সে বলল, চারু তোমার পরজন্মে বিশ্বাস আছে?

এ-ত আচ্ছা মানুষ। চারু বলল, চাটা ধরুন। ভেবে বলছি।

চারু ফ্লাসের ঢাকনাতে চা নিয়ে খেতে থাকল। বলল, পরজন্মে বিশ্বাস থাকা ভাল।

—এ-কথা বলছ কেন?

—কিছু না থাকলে আর একটা জন্ম আছে, সাধ আহ্লাদ সেখানে মিটবে এমন আশা নিয়ে বসে থাকা যায়।

—এ-জন্য বলছ অন্যজন্মে বিশ্বাস থাকা ভাল?

—আমাদের দেশের মানুষ তো খুব গরীব বাবুজী। এটুকু না থাকলে ওরা বাঁচবে কি নিয়ে?

—সে-কথা বলছি না। তুমি বিশ্বাস কর কি না বল?

—মুনি ঋষির কথা বিশ্বাস করতেই হয়।

—আবার করতেই হয়। সোজাসুজি হ্যাঁ বা না বল।

চারু কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেল এ-কথায়। বাবুজী কি টের পেয়ে গেছেন, ট্রেনে উঠেই সে বাবুজীকে লোভে ফেলে দেবার নানারকম ছলাকলা প্রয়োগ করে যাচ্ছে। পরজন্মের কথা মনে করিয়ে দিয়ে তাই ভয় ধরিয়ে দিচ্ছেন। তখনই ঘরের লক্ষ্মীর পট, এবং তেল সিঁদুর মাখা ঘট অথবা ছোট্ট জানালায় তার শিশু সন্তান বাড়ে দিনে দিনে এমন সব সাত পাঁচ চিন্তার জটিল গ্রন্থি মাকড়সার জালের মতো ঝুলতে থাকল সামনে। মাকড়সাটা জালের চারপাশে ছুটে বেড়াচ্ছে। কোথাও স্থির হয়ে এক দণ্ড দাঁড়াতে পারছে না।

অতীশ ফের বলল, তুমি বিশ্বাস কর না!

—করি। চারুর এবার সোজা সরল উত্তর।

—বিশ্বাস করলে এত দেরি হয় না জবাব দিতে। ভয়ে বলছ। তারপর চারুর মুখে গরীব মানুষ- টানুষের কথা মনে পড়তেই হা হা করে হেসে দিল অতীশ।

অতীশ তখনও হাসছে।

—বাবুজী!

অতীশ বলল, চারু আমি মার কাছে যাচ্ছি।

চারুর মুখ কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল।

—কতদিন থেকে মা বাবাকে দেখি না!

চারু বোধ হয় দু’হাতে মুখ ঢেকেই ফেলত। সে বলতে যাচ্ছিল, আপনার মাথায় গন্ডগোল আছে কথাটা তবে সত্যি বাবুজী। তারপরেই মায়ের কথা বলায় চারু ভেবেছিল, এই বুঝি সে ধরা পড়ে গেল। মার কাছে যাওয়ার অর্থই কোন তীর্থ দর্শনের মতো পবিত্র ব্যাপার-ট্যাপার। এ-সময়ে চারু তাকে অপবিত্র করার যতই চেষ্টা করুক, সে কিছুতেই কাবু হবে না। সব অভিসন্ধি জেনে ফেললে পিয়ারিলাল আর সিট মেটালে ঢুকতেই পারবে না। ওর দু-নম্বরী ব্যবসা লাটে উঠবে। সঙ্গে সঙ্গে সে আবার আগেকার চারু হয়ে যেতে পারে। সেটা ত তার গতজন্মের কথা! সে জন্মে সে কিছুতেই ফিরে যাবে না। পরলোক থাকুক না থাকুক, পরজন্মে বিশ্বাস করুক না করুক, গতজন্মে সে আর ফিরে যেতে পারে না। গতজন্মে ফিরে গেলে তাকে সব আবার হারাতে হবে। সে স্থির এবং বুদ্ধিদীপ্ত কথাবার্তা শুরু করে দিল। তাকে শৌখিন করে তোলায় পিয়ারিলালের যেমন আগ্রহ ছিল, তেমনি বিদুষী করে তোলারও আগ্রহ। কারণ এখন এমন একটা সময় যাচ্ছে, ব্যভিচারেও বিদুষীদের সুযোগ সুবিধা বেশি! চারু বলল, আপনি কথামৃত পড়েছেন?

—না।

—কিছুই পড়েন না?

—তুমি পড়েছ?

চারু না পড়েও হুঁ করল। বাবুজীর যখন পড়া নেই তখন সে অনায়াসে হুঁ বলতে পারে।

—রামায়ণ মহাভারত?

—পড়া আছে।

—দেবতাদের কথাবার্তায় বিশ্বাস তৈরি হয় নি আপনার?

—ওতো সব মানুষ, দেবতা সেজে অপকর্ম ধর্মকর্ম সব করছে।

—আপনি নাস্তিক আছেন বাবুজী।

অতীশ উঠে দাঁড়াল। চা খাওয়া হয়ে গেছে। চারুর কথার জবাব দিল না। সে যে নাস্তিক নয়, সে যে প্রেতাত্মার শিকার এ-সব বলা যেত। কিন্তু কাউকে সে বলতে পারে নি। বাবাকেও না। বাবা খুব জোরজার করলে বলেছিল, মানুষের দুর্গন্ধ পাই। মানসদাকে বলেছিল, আপনার ভূতে বিশ্বাস আছে? মানসদা বলেছে, সে আবার কি। সত্যি তার নিজেরও মনে হয়, সে আবার কি! তাহলে তার চারপাশে এত ভূতের উপদ্রব কেন! ঠাকুর দেবতার উপদ্রব কেন? ঠাকুর দেবতার প্রভাব যত দিন যাচ্ছে, বাড়ছে। আর্চি যেমন তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে, তেমনি সব মানুষকে বিদঘুটে ঠাকুর দেবতা অষ্টপ্রহর তাড়া করে বেড়াচ্ছে। যার পয়সা নেই, সেও তাড়া খাচ্ছে, যার পয়সা আছে সেও তাড়া খাচ্ছে। ঈশমদা থেকে সারেংসাব, সেলিহিগিন্‌স থেকে তার বাবা সবাই তাড়া খেতে খেতে নিজের অস্তিত্বকেই বিপন্ন করছে।—সবই তাঁর ইচ্ছে! ওর মনে পড়ছে, বাবার সে সব কথা।—আপনার পুত্র? বাবা হেসে বলতেন, আমার হবে কেন! ওঁর। অতীশের তখন ভারী রাগ হত। নিজের বললে, পাছে ঈশ্বর কুপিত হন, সেই ভয়ে বাবা তাকে নিজের পুত্র বলে স্বীকার করতেও ভয় পেত। সে ভাবত, মানুষের এর চেয়ে অবমাননা আর কি আছে। সে ভাবত, মানুষ যদি আত্মবল না পায় এবং স্বাধীন না হয়, তবে যে-ভাবেই হোক সে একজন ক্রীতদাস। তার নিজের আর কোন অস্তিত্ব নেই। যেটুকু আছে সবটাই ভূতের প্রভাব। তাহলেই সব যায়। থাকে কি। এই ভূতে পাওয়া বিষয়টাই তাকে আর্চির প্রেতাত্মার কাছাকাছি নিয়ে যাচ্ছে। আর্চিই তার এখন ঠাকুর দেবতা। সে ভাবছে, আর্চির একটা ডোরাকাটা বাঘের ছবি ঘরে রাখবে কি না। পূজা করবে কি না। ফুল বেলপাতা দিয়ে, এষ গন্ধপুষ্প করবে কিনা। তেত্রিশ কোটি দেবতার সংখ্যা বেড়ে গিয়ে তেত্রিশ কোটি এক হবে কি না। কুম্ভবাবুকে যদি বলা যায়, শুধু কুম্ভ কেন, পিয়ারিলাল, শেঠজীর মতো ব্যক্তিরাও মানত করতে পারে। বলা যায় না, তেমন সাক্ষাৎ সিদ্ধিদাতা গণেশ হয়ে গেলে প্রচুর অর্থাগমেরও সম্ভাবনা আছে। অনেক দিন পর নবর কথা মনে হল। নব পারত। নবর কোনও খোঁজখবর নেই। শনি ঠাকুরের পূজারী না হয়ে আর্চি ঠাকুরের হলে ল্যাং খেতে হত না। শনিঠাকুরের খদ্দের বেশি। আর্চি ঠাকুর একেবারে হাল আমলের। নতুন কিছু করা যেত—সঙ্গে ঢাকও বাজানো যেত। কমপিটিশনে নব তাহলে হেরে যেত না।

গাড়িটা বেশ দ্রুত ছুটছে। ঝমঝম রেলগাড়ি, দূরে অদূরে লাল নীল বাতি, ছায়া ছায়া অন্ধকার। গভীর আকাশের ছাদ ফুটো করে গাড়িটা এক অন্তহীন যাত্রায় যেন বের হয়ে পড়েছে। এ সময়ে অতীশ চুপচাপ—চারু নিজের বিছানা ঠিকঠাক করছে। ওর হাই উঠছিল। বাবুজীর ওপর সামান্য অভিমানও হয়েছে। কথা বললে জবাব দিচ্ছে না। বাইরের দিকে সেই যে তাকিয়ে আছে, কিছুতেই যেন আর চোখ ফেরাবে না। এত অহংকার তোমার বাবুজী! মনের মধ্যে কূট খেলা, সে নিজের ঠোঁট দাঁতে কামড়ে ধরল। আসলে প্রলোভনটা কি ভাবে তৈরি করা যায়, শুয়ে হাত পা বিছিয়ে, ঘুমের ভান করে এবং সামান্য সায়া শাড়ি শরীরে আলাগা করে দিলে ঠিক থাকে কি করে সে একবার বাজী লড়ে দেখতে চায়।

সে শুয়ে পড়ার সময় বলল, বাবুজী আমি ঘুমোচ্ছি। আবার সে একটা হাই তুলল। পায়ের ঠিক নিচটায় ওর অ্যাটাচি। পাশ ফিরে শুয়ে বলল, একটু দেখবেন। টাকা পয়সা গয়নাগাটি আছে।

অতীশ বলল, ওটা বাংকে তুলে রাখ না! আমি তো আছি!

—আপনি বাবুজী আপনার মধ্যে থাকেন না। আপনাকে বিশ্বাস নেই। পায়ের নিচেই থাকুক। আরামও হবে। পাহারা দেওয়াও হবে।

অতীশ বুঝতে পারল না, চারু কেন পায়ের কাছে রেখে দিল অ্যাটাচিটা! পিয়ারিলালের বাড়ি গাড়ি আছে। ধন-দৌলত আছে। চারু পিয়ারিলালের ভাইঝি। বলেছে বহরমপুরে পাটের বড় মহাজন চারুর বাবা। দামী অলঙ্কার অ্যাটাচিতে থাকতেই পারে। সে কিছুটা অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গেল। চারু ইচ্ছে করলে শিয়রে রাখতে পারত, তা পর্যন্ত রাখল না। সব চেয়ে আশ্চর্য অতীশ, চারু তার দিকে পা মেলে শুয়েছে। রুপোর চেলি পায়ে। এবং সামান্য পা তুলে দিলেই শাড়ি সরে গিয়ে ঊরুর ডিম দেখা যাচ্ছে। অতীশ একবার তাকিয়েই চোখে জ্বালা এবং শরীরে জ্বরজ্বর বোধ করতে থাকল। এমন কি চারুকে বলতে পারল না, দোহাই চারু তুমি ও-ভাবে পা তুলবে না। দোহাই চারু তুমি পা আমার দিকে ঠেলে দেবে না। তবে সে উঠে ওদিকের বাংকটায় গিয়ে বসতে পারে। কিন্তু চারুর অ্যাটাচিটা! ওদিকের বাংক থেকে অ্যাটাচি চোখে পড়ে না। কারণ চারু পা তুলে দিলে ঢাকা পড়ে যায়। ঘুমের মধ্যে সে তা করতেই পারে।

চারু বলল, ইস্টিশন এলে ডেকে দেবেন বাবুজী। তারপর সহসা মনে পড়ার মতো বলল, এই রে! বলেই দরজার দিকে ছুটে গেল। ফিরে এসে বলল, দরজা লক করে দিয়ে এলাম। কেউ পীড়াপীড়ি করলেও খুলবেন না। রাতের ট্রেন। মাঠের যে কোন জায়গায় থেমে যেতে পারে।

তারপর চারু অতীশকে আর কোন কথা বলতে না দিয়েই রাবারের বালিশটা আরও ফুলিয়ে সাদা চাদরে তা ঢেকে দিল। শেষে রাজরানীর মতো হাত পা বিছিয়ে সত্যি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ল। যেন সাড়া নেই। মাঝে মাঝে ঘুমের ঘোরে পাশ ফিরছে। আর পা, থেকে শাড়ি ক্রমেই উঠে যাচ্ছে। আঁচল পাশে লুটাচ্ছে। কি ঘন সবুজ চুল, নাকের বাঁশি ফুলে উঠছে। ট্রেন চলছে। গাড়ি দুলছে। চারুর শরীরও দুলছে। ঘুমের ঘোরে পা দুটো ভাঁজ করে দেবার সময়ই অতীশ বুঝতে পারল সে আর পারছে না। তার গায়ে সত্যি সত্যি জ্বর আসছে। উত্তেজনায় কাঁপছে। গরম নিশ্বাস পড়ছে। আর সামান্য তুলে ফেললেই সেই এক গভীর অন্তহীন সমুদ্র। সে পাগল হয়ে যাচ্ছিল, চারুকে সামান্য ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে। অথবা সারাক্ষণ অগ্নিদগ্ধ হওয়ার চেয়ে এক লাফে জায়গাটা পার হয়ে গেলে কেমন হয়।

অতীশ সব কিছুই এখন দেখতে পাচ্ছে। একবার সে ডেকে উঠল, চারু চারু।

চারু ঘুমের মধ্যেই জবাব দিল, হুঁ।

—ঠিক হয়ে শোও।

চারু শাড়ি ঠিক করতে গিয়ে পা তোলার সময় বাকি যা ছিল তাও দেখিয়ে দিল। অতীশ চিৎকার করে উঠল, চারু।

চারু উঠে বসল। বলল, ভয় পাচ্ছেন?

অতীশ কোনও কথা বলল না।

চারু এবার গা ঘেঁষে বসল। ভয় কি!

অতীশ কথা বলতে পারছে না। সে আর কিছুই পারছে না। একমাত্র চারুকে নিয়ে লম্বা হয়ে যাওয়া ছাড়া তার এ মুহূর্তে আর কিছু করণীয় নেই। সে জানে, এতে আর্চি আরও বেশি সুবিধা পেয়ে যাবে, সে জানে, এতে আর্চির ঘাঁটি আরও মাথার মধ্যে শক্ত হবে। তবু সব নস্যাৎ করে অতীশ দীপঙ্কর এক অপরূপ লাবণ্যময়ীর কাছে দু’হাত তুলে প্রায় যেন ভিক্ষা চাইল। শরীরের প্রজ্বলিত দাবদাহ প্রশমনে এর চেয়ে আর কোনও করুণ আধারের কথা তার জানা নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *