।। চব্বিশ।।
সকালেই অতীশ ছুটির কথা বলল সনৎবাবুকে
তিনি বললেন, হঠাৎ ছুটি?
অতীশ বলল, বাড়ি যাব। অনেকদিন বাবা মাকে দেখিনি।
—মা বাবাকে এখানে নিয়ে এস। ওদের কলোনিতে ফেলে রেখে কি হবে? সনৎবাবু খুব যত্নের সঙ্গে উপদেশ দিলেন।
—ওদের শহর পছন্দ নয়। এলে হাঁপিয়ে উঠবে।
আসলে অতীশ নিজের কথাই বলে যাচ্ছে। সে এখানে এই সময়ের মধ্যেই হাঁপিয়ে উঠেছে। নিরালম্ব মানুষের মতো, যেন কেউ নেই, আত্মীয়স্বজন অথবা আপনজন বলে আর কাউকে মনে হয় না। সেই নিরিবিলি প্রকতি তাকে টানে, সে কথা সনৎবাবুকে বলতে পারল না। সে চুপচাপ পাশের চেয়ারে বসে থাকল।
―তুমি বস। ছুটির দরখাস্ত?
অতীশ ওটা বাড়িয়ে দিল।
তিনি ওটা পড়লেন। তারপর না তাকিয়েই বললেন, একমাস ছুটি। এত লম্বা ছুটি নিয়ে কি করবে?
অতীশ বলতে পারত, আমার একা ভয় করে বাসাটায়। পর পর দু’রাত ঘুম হয় নি। সারা রাত দুঃস্বপ্নের মধ্যে কেটেছে। একা থাকলে ভয়েই মরে যাব। সে অবশ্য জানে সনৎবাবুর কাছে এ-সব যুক্তি একেবারে অর্থহীণ। এমন শক্ত সমর্থ যুবকের অন্তর্গত পাপ থাকতে পারে, শঙ্কা থাকতে পারে তিনি কিছুতেই বিশ্বাস করবেন না। সে এবারেও কোন কথা বলল না।
—বোসো, আসছি। বলে দরখাস্তটা হাতে নিয়ে ভিতরে চলে গেলেন। বউরাণীর কাছে যাচ্ছে। আসলে যে ছুটি দেবে, যাকে বলে অতীশের ছুটি করিয়ে নিতে হবে তার উদ্দেশে তিনি চলে যেতেই দেয়ালের চিত্রগুলি অতীশ দেখতে থাকল। কতকালের কে জানে! কার আঁকা তাও সে জানে না। কিছু কাজ না থাকলে এই সব তেল রঙের ছবির দিকে তাকিয়ে অনায়াসে সময় কাটিয়ে দেওয়া যায়। ঘরের ও-পাশে টাইপরাইটারের খটখট শব্দ কানে আসছে। মানুষটাকে দেখা যাচ্ছে না। ফাইলের পাহাড় টেবিলে। তার ও-পাশে যেন কোনও মানুষ নিরবধিকাল ধরে খটাখট শব্দ করে যাচ্ছে। শব্দটা মাথার মধ্যে টরেটক্কার মতো এসে বাজছে। সে যে এখানে বসে আছে কেউ দেখছে না। রাধিকাবাবু নেই। বোধহয় নিত্য হিসাবের খাতা নিয়ে বউরাণীর সঙ্গে দেখা করতে গেছে। এই ঘরে কেন যে কিছু উলঙ্গ রমণীর ছবি সে বুঝতে পারে না! এবং ছবিগুলি ঝাড়পোঁছ কে করে তাও সে জানে না। ছবিগুলি টাঙিয়ে রাখা কার জন্য! সব বুড়ো হাবড়া মানুষ। তারা বোধহয় ভুলেই গেছে, তাদের চোখের সামনে কিছু উলঙ্গ নারীর ছবি আছে। কেউ জলে সাঁতার কাটছে। জলের ভেতর থেকে স্বচ্ছ নিতম্ব পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যায়। শিল্পীর রসবোধের কথা সে এ-সময় তারিফ না করে পারল না।
সনৎবাবু ফিরে এসে টেবিলে বসলেন। বেল টিপতেই সুরেন হাজির। কি একটা ফাইল চাইলেন। ফাইলটা এনে দিলে, সেটা নিয়ে ছুটে গেলেন। আবার ফিরে এলেন, আরও দুটো ফাইল থেকে কি মিলিয়ে নিয়ে ছোট্ট একটা চিরকুটে নোট নিলেন। তারপর ফের অদৃশ্য। অতীশের ছুটি সম্পর্কে বিন্দুমাত্র উৎসাহ দেখাচ্ছেন না। যেন ভুলেই গেছেন, অতীশ ছুটির দরখাস্ত দিয়েছে। বউরাণীর মতামতের প্রশ্নের অপেক্ষায় আছে সেটা। আবার ফিরে আসতেই সে বলল, বউরাণী কিছু বললেন?
—বোসো বলছি।
অতীশের বুকটা কেঁপে উঠল। তার তো ছুটি পাওনা অনেক। এতদিন এসেছে, সে কোনও ছুটিছাটা নেয় নি। তালে কি এখানে তার কোনও ছুটিছাটা মিলবে না। এখন আর তার কাছে বউরাণী অমল নয়, যেন অন্য পৃথিবীর কোনও জার সম্রাজ্ঞী। দন্ডমুন্ডের অধিকারী। বইয়ে সম্রাজ্ঞীদের নানারকম কূট খেয়ালের কথা সে পড়েছে। এখন মনে হচ্ছে সেটা তাকে চাক্ষুস দেখতে হবে। যেন বলবে, ওকে বলে দিন, ছুটিছাটার বিষয়টা সে তার রাজেনদার কাছ থেকে চেয়ে নেবে। অথবা বলে দিন, অন্য কোথাও কাজ দেখে নিতে। ওকে দিয়ে আমাদের চলবে না। পরশু সে বউরাণীকে একা ফেল্ে চলে এসেছিল। সেই থেকে বউরাণীর মেজাজ যদি তিরিক্ষি হয়ে থাকে, দেখা করতেও ভয়। তা- ছাড়া ডেকে না পাঠালে তার এখনও যাবার নিয়ম নেই। কি বলেছে কে জানে, সে খুব অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে, সনৎবাবু এখন কি বলে!
কিন্তু সনৎবাবু খুবই ব্যস্ত মানুষ। এ বাড়ির নিয়মই এই যতক্ষণ রাজা খাতির করবে, ততক্ষণ তারও খাতির। খাতির গেলেই সবাই মুখ ফিরিয়ে নেবে। যেন কেউ চেনেই না। সে এ-বাড়ির আমলা তাও তাদের তখন মনে করিয়ে দিতে হবে। সে আর না পেরে বলল, বউরাণী কি……….।
—আরে বউরাণী কিছু না। যেন ইয়ার বন্ধুর মতো সনৎবাবুর কথাবার্তা। তিনি বললেন, যাও। তবে যাবার সময় কুম্ভকে চার্জ বুঝিয়ে দিও। কাল থেকে তোমার ছুটি।
ছুটি! অর্থাৎ তার আর দরকার নেই! কতদিন ছুটি জেনে নেওয়া দরকার। সে বলল, কতদিন?
—ঐ দরখাস্তে যা লেখা আছে।
অতীশের ভেতরটা কেমন হাল্কা বোধ হল। অমলা তবে কোনও আক্রোশ পুষে রাখেনি মনে। সে নিজের ওপরই কিঞ্চিৎ বিরক্ত হল। সর্বত্র সে আতঙ্কের ছায়া দেখতে পায়। এত আতঙ্ক নিয়ে সে বাঁচবে কি করে! তবু ছুটি পাওয়ায়, বেশ হাল্কা মেজাজ। অনেকদিন পর তার শিস দিতে ইচ্ছে হল। সে গাড়িবারান্দায় নেমে যাচ্ছে, কুম্ভবাবুকে এখন তার দরকার।
তারপরই কূট কামড়। সে ছুটিতে কেন যাচ্ছে অমলা একবার ডেকে জিজ্ঞেস করল না! সে অমলাকে ফেলে ফিরে এল একা, কি এত তাড়া ছিল তাও ডেকে জিজ্ঞেস করল না অথবা এমন অপমান অমলা হয়তো জীবনেও বোধ করেনি, তাকে ডেকে দু-চার কথা শোনাবে এ-সবই মনে মনে সে আশঙ্কা করেছিল, সে-সবের কিছুই না। বরং অমলার আজ তার সঙ্গে আর দশজন আমলার মতোই ব্যবহার। রাজেনদা না থাকলে সে অফিসে বসে। এত বড় এস্টেটের কত রকম সমস্যা। সে সনৎবাবুর পরামর্শ মতো সব সামলায়। অতীশ আশা করেছিল, অমলা তাকে ডেকে ভৎসনা করবে। তুই কিরে, আমাকে একা ফেলে চলে এলি! তুই এত নিষ্ঠুর!
সঙ্গে সঙ্গে তার কেমন সব বিস্বাদ ঠেকছিল। অন্যমনস্ক সে। সে-রাতে অমলাও ভাল ছিল না। মানসদা বলেছে, অমলা ক্ষেপে গেলে ঝমঝম করে অর্গান বাজায়। পাগলা ঝড় সে তার অর্গানে বইয়ে দেয়। তার ক্ষিপ্তভাব সে এ-ভাবে সামলায়। রাতে মাঝে মাঝে সেই ঝড়ের সংকেত তার কানে এসে বেজেছে। আজ দেখা হলে বুঝতে পারত ক্ষিপ্তভাবটা কতদূর গড়িয়েছে। এক মাসের লম্বা ছুটি। এত বড় ছুটি নিয়েই বা সে কি করবে! স্ত্রী পুত্র ছেড়ে একা সে বাড়িতেও বেশিদিন থাকতে পারবে না। নির্মলার উপর একটা চাপা অভিমান ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে। তার আর্থিক ক্ষমতা সীমিত। চেষ্টা করেও সে এর চেয়ে বেশি আর রোজগার করতে পারে না। বাবা মা ভাই বোনের দায় না থাকলে সে মোটামুটি সচ্ছল। কিন্তু এই দায়টা ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছে না। পারলে বোধহয় নির্মলার সব অসুখ সেরে যেত। নির্মলা কেন যে বোঝে না তার বাবা মা অনটনে থাকলে সে মানসিক কষ্ট পায়। কেন যে বোঝে না বাবার মাসহারা না পাঠাতে পারলে সে অস্বস্তি বোধ করে। এ-নিয়ে নির্মলা কোনও খোঁটা দেয় না। অথবা, ঝগড়াও করে না। যা কিছু ক্ষোভ মনের মধ্যে .চেপে রাখে। ফলে কেমন শীর্ণ হয়ে যায়। দুরারোগ্য ব্যাধির মতো চাপা বিষণ্ণতা সারা অবয়বে লেপ্টে থাকে। নির্মলা যে বাপের বাড়ি চলে গেল তার অনুমতি না নিয়ে, সেটাও খুব বড় হয়ে বাজছে। একটা কাজের মধ্যে ঢুকে গেলেও সাংসারিক সাশ্রয় ঘটতে পারে। সে চেষ্টাও করছে। হবে হবে করেও হচ্ছে না। এমন কি যদি দূরে চলে যায় নির্মলা দুই শিশুর দেখাশোনার ভার নিতে সে রাজি। মা যদি না আসে, ধীরেনের মাকে নিয়ে আসবে ভেবেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে কিছুই করে উঠতে পারছে না। এই অক্ষমতার জ্বালায় তার ভেতরে আগুনের ফুলকির মতো কিছু কাঁটা হয়ে বিঁধে আছে।
নিজের অফিসঘরে বসে বুঝল, সারাটা রাস্তায় সে কিছুই খেয়াল করে নি। খুবই অন্যমনস্ক ছিল। সারাটা রাস্তা সে শুধু ভেবেছে কি করবে। হাতের কাছে এত দু’নম্বরী সম্পদ, অথচ সে ছুঁতে ভয় পাচ্ছে। এই ভয়টা না থাকলে, তার বোধ হয় এতটা আর্থিক নির্যাতন থাকত না। লেখার ব্যাপারেও সে আর একটু কম্প্রমাইজ করলে, হাতে দু’পয়সা আসে। কিন্তু স্বভাবে যা নেই সে তা পারে কি করে!
কুম্ভবাবু তখন এসে বলল, মাধবটা কি করছে জানেন?
—মাধা আবার কি করছে!
—শিব মন্দিরের পাশে বসে রাতে তাড়ি গিলছে।
ঠিক এ-সময়েই দরজার ও-পাশে মনোরঞ্জনের মুখ দেখা গেল। সঙ্গে ফণী যাদব। এরা উঠতি শ্রমিক নেতা। এরাও যেন কুম্ভবাবুর সহকারী। কিছু একটা হয়েছে। কিছু দাবি দাওয়া। মাধাকে দিয়ে আরম্ভ শেষ হবে কি দিয়ে সে জানে না।
কুম্ভ বলল, তোমরা আবার কেন?
মনোরঞ্জন বলল, কি করলেন জানতে এলাম।
—তোমরা যাও, আমি দেখছি।
ওরা বিনীত বাধ্য ছাত্রের মতো চলে গেল। কুম্ভ জমপেশ করে বসল। হাতের আংটি জ্বলজ্বল করছে। সোনার তিনটি আংটি। তিনটেয় তিন রকমের পাথর। নসিবের ঘরে বদলা আছে এই আংটিগুলি তার প্রমাণ। সে ভাগ্য ফেরাবার জন্য একের পর এক পাথর ধারণ করছে। এই সব পাথরের গূঢ় কোন ক্ষমতা আছে কি না সে জানে না। দ্রব্যগুণ কথাটা সে শুনেছে। রাহু শনি প্রভৃতি গ্রহের কোপ প্রশমনে তার এই সব পাথর ধারণ। স্ত্রীর শরীর ভাল যাচ্ছে না বললে, একদিন কুম্ভবাবু বলেছিল, একটা ছ’রতির প্রবাল ধারণ করান বৌদিকে। দেখবেন সব ভাল হয়ে যাবে। সে যেহেতু এর পক্ষে কোন যুক্তি খুঁজে পায় না বরং মনে হয় মানসিক দুর্বলতার লক্ষণ সেই হেতু শুধু বলেছে, দেখি। এখন সে বুঝতে পারছে এই পাথরের কোনও গুণাগুণ না থাকুক, কুম্ভবাবুর পাথরের উপর প্রবল আত্মবিশ্বাস। যেমন ঈশ্বর, তেমনি এই পাথর। কেউ জীবনে তার কম যায় না। সহজেই সে সব কিছু করে ফেলতে পারে। তার জন্য কোনো অনুশোচনা থাকে না।
কুম্ভ বলল, আপনি কেন আর বাধা দিচ্ছেন?
অতীশ খুব অবাক হয়ে গেল। কিসের বাধা?
কেন জানেন না, ই এস আই অফিসে ঘুষ না দিলে কোনও বেডের ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না। অতীশ বুঝল, মাধার কেসটা ঘোরালো হয়ে উঠছে। মাধার জন্য সে সোজা পথে তার অফিসে আসতে পারে না। মাধা সেই পুরোনো বাড়ির রোয়াকে পড়ে আছে, চাঁদা করে তার সেবা শুশ্রূষা চলছে। ই এস আই ডাক্তার ওষুধ দিচ্ছে। মাধা চুরি করে তাও বিক্রি করে দিচ্ছে। এবং বস্তির কিছু বেয়াড়া ছোঁড়া রাতে সেই দিয়ে মাধার সঙ্গে জুয়া খেলছে। অতীশ একটা ফুটো কোম্পানির ম্যানেজার। তার কর্মীর এই জীর্ণ দশা। যেন সেই দায়ী মাধার জন্য। একদিন আসবার সময় দেখেছে, পাশের দোতালার রেলিং থেকে তার দিকে কিছু যুবতী তাকিয়ে আছে। রেলিং থেকে পুরানো বাড়ির রোয়াক দেখা যায়। ওর মনে হয়েছিল, ঐ যুবতী ক’জন তারই অক্ষমতা নিয়ে আলোচনা করছে। অথবা ভাবছে, ম্যানেজারটা কি অমানুষ। নিজে খাচ্ছে দাচ্ছে, এমন কি সে সহবাস করে থাকে, তার যে স্ত্রীপুত্র ঘরবাড়ি আছে তাও তারা জানতে পারে। একজন ম্যানেজারের পক্ষে এটা সত্যি বড় অসম্মানের বিষয়। তার সেই থেকে কেন জানি সোজা পথে আসতে সংকোচ বোধ হত। রাস্তার দু-পাশে যারা যাকিছু নিয়েই কথা বলুক মনে হত, তাকে নিয়েই বলছে। সে একজন অতি মনুষ্যত্বহীন মানুষ এমন তারা ইঙ্গিত করছে। তা ছাড়া বস্তি অঞ্চলে কানাঘুষা এমনও আলোচনা হচ্ছে আজকাল, এই নতুন ম্যানেজারই যত নষ্টের গোড়া। তার জন্যই হচ্ছে না। অক্ষম। কোনও চেষ্টা নেই হাসপাতালে পাঠাবার। অথবা মনে করতে পারে সে তার ক্ষমতার অপব্যবহার করছে। ঘুষ না দেওয়াটাই এ-সময় তার কাছে ক্ষমতার অপব্যবহার মনে হচ্ছিল। অতীশ বাধ্য হয়ে বলল, আমি ছুটি নিচ্ছি একমাস কুন্তবাবু।
—এই এক মাসে যাকে যা দিলে হয় দিন। মাধার কেসটা আটকে রাখবেন না। ওটাও করে ফেলবেন। কুম্ভ যে খুব খুশী সে-ভাবটা সম্পূর্ণ গোপন করে ফেলল। বরং মুখে বেশ দুশ্চিন্তার ছাপ
এই অকপট অভিনয় অতীশ ধরতে পারে। সে হাসল। বলল, একটা তো মাস!
—এত লম্বা ছুটি!
—কিছু নিজের কাজ করব।
কুম্ভ বলল, এই এক দোষ আপনার। সব কাজটাই পরের ভাবেন। কোম্পানির কাজ নিজের কাজ না।
অতীশ কেমন বেয়াড়া জবাব দিল।
—নিজের কাজ হলে ছুটি নেবার কথা উঠত না।
কুম্ভ বুঝতে পারছে, কর্পোরেশনের লোকটাকে ঘুষ দেবার পর থেকে খুব কাহিল হয়ে গেছে। সতীপনা গেছে। সে ভারি উৎফুল্ল বোধ করল। বলল, কোথাও যাবেন ভাবছেন!
—দেখি।
আর যখন ক্যাশ বুঝিয়ে দিচ্ছিল, তখনই আবার ফোন কারো। টেবিলটায় দু’দন্ড বসে এক নাগাড়ে কাজ করা যায় না। কেবল এর ওর ফোন আসে। কুম্ভই ফোন ধরে বলল, হেলো সিট মেটাল। আর সঙ্গে সঙ্গে অতীশ দেখল কুম্ভবাবু কেমন বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়ে বসে আছে। মুখে কথা ফুটছে না। তোতলাতে আরম্ভ করেছে। ফিসফিস করে বলছে, বউরাণীর ফোন।
অতীশ হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিয়ে বলল, বল।
—তোর ঘরে কে?
—কুম্ভবাবু।
—কি করছে?
—ক্যাশ বুঝিয়ে দিচ্ছি।
—ওকে ক্যাশ বোঝাতে তোকে কে বলেছে?
—সনৎবাবু।
—তোকে চার্জ বুঝিয়ে দিতে বলেছে, ক্যাশ বুঝিয়ে দিতে বলেনি। সবটা না জেনে কাজ করতে যাস কেন?
অতীশ জানে চার্জ বলতে এই ক্যাশ। তার ইচ্ছে ছিল না ক্যাশ রাখে। বড় ঝামেলা। মাথার মধ্যে সব সময় দুশ্চিন্তা। সে হয়তো হা হা করে হাসছে কফি হাউজে, আড্ডা দিতে দিতে, তখনই বুকে কামড়। চাবিটা পকেটে আছে ত! সঙ্গে সঙ্গে পকেটে হাত। কতদিন হয়েছে, টেবিলের ওপরই চাবি পড়ে আছে। কতদিন সে বাসায় ভুল করে চাবি ফেলে গেছে। ভুল করলে বাসায় সুধীরকে চিঠি দিয়ে পাঠাত। নিচে সই। অতীশ দীপঙ্কর ভৌমিক। কারণ যে কেউ চাইলেই ত আর চাবিটা নির্মলা দিতে পারে না। একটা চাবি মানুষকে এত উতলা করে রাখতে পারে সে আগে জানত না। সিট মেটালের ক্যাশ নিতে সে প্রথমে রাজি হয়নি। আসলে যা হয় ফুটোফাটা কোম্পানি, পারলে সব কাজ একা অতীশকে দিয়ে চালিয়ে নিলেই যেন ভাল হয়। সনৎবাবুই বলেছিলেন, ছ্যাঁচড়ামি বন্ধ করতে হলে ক্যাশটা তোমার কাছে রাখা দরকার। সে ভেবেছিল, দরকার। পরে বুঝেছে, অর্থহীন।
—কি রে তুই কি মরে গেছিস!
অতীশ আচমকা সোজা হয়ে বসল। সুদূর থেকে তাকে কেউ জাগিয়ে দিল যেন। সে বলল, বল।
—ক্যাশ সনৎবাবু বুঝে নেবে। একটু বাদেই যাচ্ছেন।
অতীশ কিছুটা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে উঠল। সে মোটামুটি হিসাব রাখে। পাই পয়সা মেলাতে হলে, অতীশ সেদিন কুম্ভবাবুকে নিয়ে বসে। এক আধ টাকা কম বেশি হলে টিফিন খরচে ধরে দেয়। কিন্তু সে জানে এই সনৎবাবু এমন কড়া ধাতের মানুষ, এক পয়সার গরমিলও পছন্দ করেন না। এই সামান্য এক পয়সা থেকেই বড় রকমের অভিযোগ সৃষ্টি হতে পারে। তক্ষুনি ফোন ছেড়ে ক্যাশটা আর একবার ভাল করে চেক করে রাখা দরকার ভাবল। সে জানে খুব একটা বেঠিকের কিছু নেই, তবু কোথায় যে কি ধরা পড়ে যায় শেষ পর্যন্ত।
অমলা ফোন কেটে দিয়েছে। একটু বাদেই রাজবাড়ির গাড়ির হর্ন শুনতে পেল অতীশ। কুম্ভ তার সামনে বসে আছে। রাফ-ক্যাশ বুকের সঙ্গে ভাউচার মিলিয়ে টিক মার্ক দিয়ে যাচ্ছিল কুম্ভ। আগেই যোগটা সেরে রেখেছে। সাত আট দিন এক নাগাড়ে ক্যাশ মেলানো হয় নি। একটু সময় লাগছিল। এটা অতীশবাবুর কুঁড়েমি। এটা এক দিকে ভাল। যখন ফ্যাসাদে পড়বে তখন বুঝবে ঠেলা। যোগ করতে গিয়ে পুরো এক হাজার তিনশ চোদ্দ টাকা সর্ট। সঙ্গে সঙ্গে জমার ঘরে দেখল এই অঙ্কের কোন চেক আছে কিনা। এবং পেয়েও গেল। জমা করেছে কিন্তু খরচের ঘরে ব্যাংকে জমার কথা লেখা নেই। এই ধরনের কিছু এন্ট্রির ভুল ঠিকঠাক করে ক্যাশ যখন মিলে গেছে তখনই গাড়ির শব্দ। রাজবাড়ির গাড়ি ঢুকলে বস্তিবাসীরাও খুব চঞ্চল হয়ে পড়ে। সবাই দাঁড়িয়ে যায়। রাজার গাড়ি বলতে। সনৎবাবু সোজা নেমে ঘরে ঢুকতেই কুম্ভ এবং অতীশও উঠে দাঁড়াল। কালো রঙের সুট, সাদা শার্ট, চকচকে সু, সাদা চুল কালো রঙের মানুষটি ভারি গম্ভীর। অতীশ ওকে রাজবাড়িতেও এমনই গম্ভীর দেখে থাকে। তবে তার সঙ্গে সনৎবাবু কথাবার্তায় খুব একটা গাম্ভীর্য বজায় রাখেন না। অতীশ অন্য দশজন থেকে আলাদা – এটা তার ব্যবহারেও প্রকাশ পায়। কারণ ছেলেটির একটা জায়গায় পায়ের নিচে মাটি বড়ই শক্ত। হেলায় সব ছেড়েছুড়ে দেবার ক্ষমতা রাখে। দুঃখ করে একদিন কথায় কথায় তিনি বলেছিলেন, এ-কাজটা নেওয়া তোমার ঠিক হয় নি। তোমার লেখার বিঘ্ন ঘটবে। বিঘ্ন কথাটাই ব্যবহার করেছিলেন সনৎবাবু।
সনৎবাবু আজ আর আয়াস ভঙ্গীতে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন না। বয়েস হয়েছে। অথচ খুবই কর্মঠ, এবং সব সময় নিজের এই কর্মঠ জীবন কত মূল্যবান তা রক্ষার্থে পটুত্বের কৌশলটাও তাঁর জানা। সব কিছুতেই ঠিক তিনি ভুল জায়গাটা ধরে ফেলেন। ফাঁকি কোন জায়গায় থাকে, যাকে বলে লুপহোল, তাঁর যেন সেটা আগেই জানা। ক্যাশ বুক নাড়াচাড়া করতে করতে দুটো একটা মাইনর ভুল ধরে ফেললেন। অতীশও সোজা হয়ে বলল, ফেয়ার ক্যাশবুকে তোলার সময় ঠিক করে নেওয়া হবে। তারপর অতীশ দেখল তিনি কুম্ভকেই চাবি বুঝিয়ে দিচ্ছেন। রাফ-ক্যাশ বুকের উপর তাঁর সই, অতীশের সই, এবং কুম্ভ নিজেও সই করল। অতীশের মুখটা লাল হয়ে উঠেছিল। সে বুঝতে পারছে বিষয়টা খুব সরল নয়।
তারপর তিনি টিনের স্টক কত দেখলেন। টিনের গুদামে ঢুকে স্টক ঠিক আছে কি না দেখলেন। কুম্ভকে বললেন, যা আছে সব বুঝে নাও। কোথাও গন্ডগোল থাকলে এক্ষুনি বলতে হবে। অতীশ এখন আর একটা কথাও বলছে না। কুম্ভবাবু কি বলে সেটা শোনার অপেক্ষায় থাকল। যদি বলে স্টক মিলছে না, যদি বলে কোথাও বড় রকমের গন্ডগোল আছে এই সব সাত পাঁচ তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। অমলার গুপ্ত নির্দেশেই এসব হচ্ছে। তাকে অমলা অবিশ্বাস করছে। তার চোখ ফেটে অভিমানে জল আসতে চাইল। এবং সনৎবাবু চলে গেলে সে ফোন তুলে বলল, বউরাণীকে দাও। এই প্রথম সরাসরি বউরাণীকে চাইল।
—কে?
—আমি। খুবই গম্ভীর গলা অতীশের। কিছু বলবি?
—এ-সব নাটকের অর্থ বুঝছি না অমলা।
—নাটক! নাটকের কি হল!
—তুমি ভাব, তুমিই সব বোঝ, আমরা কিছু বুঝি না।
—ঠিকভাবে কথা বল।
—ঠিকই বলছি।
—নাটক আমি করছি না তুই করছিস!
ঘরে একা অতীশ। সুধীরকে বলে দিয়েছে, কেউ দেখা করতে এলে যেন বাইরে বসিয়ে রাখে। সে রাগে দুঃখে থরথর করে কাঁপছিল। এত কিছু করার অর্থই তাকে অবিশ্বাস! সে জীবনে এই অবিশ্বাস চায়নি। সে নিতান্ত সরল সহজভাবে বেঁচে থাকতে চায়। সে বলল, তুমি সনৎবাবুকে কেন পাঠালে?
—তুই একটা মূর্খ।
—মূর্খ বলতে পার। নাহলে আমি এখানে মরতে আসব কেন?
—তোর আর কোথাও জায়গা হত না। এখানে এসে বেঁচে গেছিস।
—ভালই বলছ।
—ভাল বলছি না, মন্দ বলছি, মাথা ঠান্ডা রেখে ভাবলে বুঝতে পারবি।
অতীশ বলল তুমি আমার ভালর জন্য সনৎবাবুকে পাঠিয়েছ?
—তবে কার ভালর জন্য?
—তিনি এসে সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। যেন চোরের দায়ে ধরা পড়েছি।
—চুরিটা কোনদিক থেকে হয় তুই জানিস না। কি-ভাবে কাকে জড়ানো যায় তুই জানিস না। তুই মনে করিস সবাই তোর মতো, না!
—তা মনে করি না।
—সবাই তোর মতো আবেগে ভোগে না।
—তাও জানি না।
—তোকে নিয়ে আমার সব সময় ভয়। আগে ছিল মানস, এখন তুই।
অতীশ কি বলবে আর ভেবে পেল না। সে বেশিক্ষণ এক নাগাড়ে কথাও বলতে পারে না। মানসদার কথা বলায় সে আরও যেন তলিয়ে যাচ্ছিল। মানসদাকে নিয়ে আগে অমলার ভয় ছিল। সেটা কিসের!
সে যেন কিছুটা সুযোগ পেয়ে গেছে। এ-সময় সে মনসদার সম্পর্কে দুটো একটা প্রশ্ন করতে পারে। এতদিন সে অমলাকে বলবে বলবে করেও কথাটা বলতে পারে নি। কোন উপলক্ষ্য হয় নি। সে বলল, এখন মানসদার জন্য তোমার আর ভয় নেই। সে কি বাঘ। তার মুখে কি তুমি বাঘের ছবি দেখতে পেতে!
—কি বকছিস মাথামুন্ডু। বাঘের কথা আসে কি করে!
অতীশ ভারি সংযত হয়ে গেল। সত্যি ত বাঘের কথা আসে কি করে! আর্চির মুখে ডোরাকাটা বাঘের অবয়ব দেখলেই সে ভয় পেত।’ সে বার বার চেষ্টা করেছে, প্রার্থনা করেছে—আর্চি তুমি ভাল হয়ে যাও। বাঘের মুখোশটা সরিয়ে ফেল। মানুষের মুখ দেখতে দাও। তাহলে আমি তোমাকে খুন করতে সাহস পাব না।
সে নিজেকে সংশোধন করে বলল, না বাঘ মানে, এই বাঘই তো মানুষকে খায়। বাঘ নরখাদক হলে ভয়ের না।
অমলা কেমন আর্ত চিৎকার করে উঠল, অতীশ তুই কি পাগল। সত্যি বল তোর কি মাথা খারাপ আছে!
—সত্যি কথা বললেই বুঝি মাথা খারাপ হয়!
—মাথা খারাপ না হলে বাঘের কথা আসে কি করে। মাথা খারাপ না হলে তুই আমাকে ফেলে একটা নষ্ট মেয়ের সঙ্গে চলে যাস কি করে! মাথা খারাপ না হলে তুই তার সঙ্গে রাজবাড়িতে ফিরিস কি করে!
—মতি বোনের কথা বলছ!
—মতি বোন!
—হ্যাঁ সুরেন তো তাই বলে। সেই বলেছে, মতি বোন এ-বাড়ির এক নম্বর সতী।
—সুরেনটার অসুখ আছে। ও যা খুশি বলতে পারে।
—ওর অসুখ কেন অমলা!
সেই সুদূরে আর কোনও সংকেত নেই। বোধ হয় বিষম খেয়েছ কথাটাতে। এ-সময় সে বেশ মজা উপভোগ করছিল। তুমি অমলা প্রশ্নের জবাব দাও।
—কুম্ভ ঠিকই বলেছে তোর রাজেনদাকে।
কুম্ভর কথা আসতেই সে আর মজা করতে সাহস পেল না। সে কুম্ভর মুখেও ডোরাকাটা বাঘের ছবি দেখেছে। তার কাছে এটা যে কি সংকট, কি যে ভয়াবহ ত্রাস বলে বোঝাবে কি করে।
—কম্ভবাবু কি বলেছে!
—তুই নাকি বলেছিস ওর বৌকে লক্ষ্মীর পট কিনে দিবি!
—কিনে দিলে খারাপ হবে বলছ!
—কুম্ভ কি বলেছে তার বৌয়ের লক্ষ্মীর পট চাই?
না, তা বলে নি। তবে ওর বৌর সাজগোজ দেখে আমার এটা মনে হয়েছিল। লক্ষ্মীর পট কিনে দিলে হয়ত ঝাঁঝ মরে যাবে। তারপরই অতীশ বলল, তোমাদের বাড়িটায় কি আড়িপাতা থাকে। কিছু বললেই সব তোমরা জেনে যাও কি করে?
—খুব যে কথা ফুটেছে। সামনে বসে থাকলে কথা বলতে পারিস না কেন মেনিমুখো!
—আমাকে গালাগাল দিতে তোমার ভাল লাগে অমলা!
—খুব ভাল লাগে। তোর গায়ের চামড়া ভারি। নাহলে তুই কখনও মতির সঙ্গে ফিরতে পারতিস না।
অতীশের মনে হল সবটা খুলে বলে। সে ইচ্ছে করে আসে নি। সে বলল, তুমি পালিয়েছিলে কেন? তোমাকে আর খুঁজেই পাওয়া গেল না।
সুদূরে খুটখাট শব্দ কানে এল। কথা এল না। অমলা কি ফোন রেখে দিয়েছে। না অমলা ওর কথা শোনার জন্য বড় আগ্রহ নিয়ে বসে আছে। সে-ত অমলার সঙ্গে এখন খুব খোলামেলা কথা বলতে পারছে। সে বলতে চাইল, রহস্যময়ী নারী তুমি এখন কি পরে আছ। তোমার একার ঘর। যা কিছু এখন পরে থাকতে পার। তারপরই সহসা মনে হল তার আসল কথাটাই জানা হয় নি। সে বলল, মানসদাকে তুমি নাকি পাগল বানিয়ে রেখেছ।
—আমি রাখার কে?
—মানসদার ছবির একজিবিসন করব ভাবছি। কেমন হয়।
—ভাল হবে না এটুকু বলতে পারি। তোর রাজেনদা এসব পছন্দ করে না।
—তোমাকে একটা কথা বলি অমলা।
—কী কথা!
—এবারে ফোন ছেড়ে দেব।
—এই কথা! না।
—কতক্ষণ!
—যতক্ষণ আমার খুশি।
—আমার বৌ আছে, ছেলেমেয়ে আছে।
—তোর কিছুই নেই।
অতীশ এবার আর না বলে পারল না, ব্যাঙ্ক থেকে ইন্সপেক্টার আসছেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলা দরকার।
—কুম্ভ আছে কি করতে!
অতীশ বুঝল, হল না। আর এও বুঝল, আসলে পাগলটা কে! সে না হরিশ, না মানসদা, না এই বউরাণী। পাগলের সংজ্ঞা কি।
সে বলল, অমলা পাগলের সংজ্ঞা কি?
—কেন জানিস না?
—না, এটা আমাকে খুব ভাবাচ্ছে। কালই আমি বাড়ি যাব। কত কাজ বাকি। আর তুমি কিনা ফোন ছাড়বে না। তাহলে আমি যাব কি করে?
—ছুটি নিয়ে বাড়ি যাবি?
—বাড়ি। বাবার কাছে। বাবা মাকে কতদিন দেখি না।
—বৌ ছেলেমেয়ে যাচ্ছে?
—না।
—ফূর্তিটা একাই করবি।
—কাল রাতে তুমি অর্গান বাজিয়েছ!
—শুনেছিলি?
—সারারাত শুনেছি।
—সত্যি।
—সত্যি।
—তবে যাস না। ছুটিটা আয় তুই আর আমি এক সঙ্গে কাটাই। খুব আরাম পাবি। বলেই ফোনটা ছেড়ে দিল অমলা। তাকে কথা বলতে পর্যন্ত দিল না। সে কি আজ সকালে মনে মনে এই আশা করেছিল। মনে মনে ভেবেছিল, এমন এক গোপন পৃথিবী সৃষ্টি করা যায় না যেখানে এই রমণীকে নিয়ে কোন সারমেয়র মতো সহবাস করা যায়। আকন্ঠ। সমুদ্র যেমন ভরে থাকে তেমনি। অমলার আড়িপাতা তাহলে এতদূরেও এসে গেছে। সে বুঝে ফেলেছে এক গোপন আকাঙ্খা তাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করছে।
সঙ্গে সঙ্গে অতীশের ভেতরে এক ভয়ঙ্কর উত্তেজনা, আগুনের মতো গ্রাস, চোখ কান ঝাঁ ঝাঁ করছে, কেমন যেন অসাড় শরীর, সে ঠিক থাকতে পারছে না, এবং সেই ছবি, মানসদার আগুনে ছবি মাথার মধ্যে দাপাদাপি শুরু করে দিয়েছে। এক গোপন বধ্যভূমিতে সে দাঁড়িয়ে আছে। তার আর নিস্তার নেই।
তারপর সারাটা দিন সে হাতের বাকি কাজ করল ঠিকই; যেমন তারু ফোন করে জানিয়ে দেওয়া দরকার ছিল নির্মলাকে আমি বাড়ি যাচ্ছি। সেখান থেকে জেঠিমার কাছে। সেখানে আর এক লড়াই—প্রেতাত্মার সঙ্গে মানুষের। জ্যাঠামশাইর কুশপুত্তলিকা দাহ শেষ হলেই বড়দা এবং বৌদি এবং অন্য আত্মীয়স্বজন সবাই প্রেতাত্মার হাত থেকে মুক্তি পাবে। অতৃপ্ত আত্মা নাকি ঘোরাফেরা করছে—সংসারের অসুখ-বিসুখ ছাড়ছে না। বলা যায় না, কাজটা হয়ে গেলে সেও অশুভ আত্মার হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে পারে। ওর এখন সেখানে যাওয়া বড় জরুরী কাজ।
ফোনে কথা বলতেই নির্মলা বলল, বাসাটা খালি রেখে চলে যাবে?
সে বলল, তালা দেওয়া থাকবে। দুমবারকে বলব রাতে শুতে। তোমার শরীর কেমন? এ-কথা বলতেই মনে হল, শরীর নিয়ে প্রশ্ন করলেই যেন মনে হয়, কবে তুমি ভাল হবে নির্মলা। আমরা কবে আবার পাশাপাশি শুতে পারব। আমি আর পারছি না। সে বোধহয় ভয়ে পড়ে কিছুই বলতে পারল না। কিন্তু নির্মলাই বলল, ভাল। ডাক্তার দেখেছেন, আবার। বলেছেন, কিছু ইনজেকসান নিলে সেরে যাবে। না সারলে হাসপাতাল। মাইনর অপারেশন। জায়গাটা স্ক্র্যাপ করে দেবে।
—স্ক্র্যাপ কি তোমার মণিকাদিই করবেন!
—ঠিক হয় নি।
—সাবধানে থেক। টুটুল মিণ্টু যেন রাস্তায় নেমে না যায়।
নির্মলা এ-সব বোধহয় কিছুই শুনছে না। সে তার কথা বলে যাচ্ছে। যেমন সব সময়ই বলে থাকে, রাত জেগে লিখবে না। শরীর খারাপ হলে কে দেখবে। এটা অবশ্য একটা খোঁচা দেবার কৌশল। নির্মলা কলকাতায় আসার পরই কি-ভাবে যে বুঝতে শিখে গেছে, সংসারে বাবা মা ভাই বোন কেউ না। শুধু স্বামী স্ত্রী শুধু পুত্র কন্যা এই সম্বল মানুষের। কেউ কাউকে দেখে না। কিছু হলে কেউ পাশে এসে দাঁড়ায় না। মানুষেরা বড় একা।
নির্মলা আরও নানাভাবে সতর্ক করে দিল অতীশকে। এমন একটা জায়গায় যাচ্ছে, যেখানকার জল হাওয়া অতীশের আর সহ্য হবার কথা নয়। খাওয়া-দাওয়া সম্পর্কেও সাবধান করে দিল। বাড়িতে ঝাল-টাল বেশি হয়—আলাদা ঝোল করতে বলল। পুকুরে স্নান করতে বারণ করল। বেশি রাতে শহর থেকে ফিরে অসতে বারণ করল। টর্চ নিতে বলল সঙ্গে। এই গরমে সাপের উপদ্রব খুব। অতীশ কথাবার্তা শুনেই বুঝতে পারছে, নির্মলার কাছে এখন বাবার বাসভূমিটা ঠিক তার সেই গোপন বধ্যভূমির মতো। কেউ হাঁ করে বসে আছে। সেখানে গেলেই পূর্ণগ্রাস।
অতীশ নির্মলার সব কথাতেই সায় দিয়ে যাচ্ছে, আচ্ছা। হবে। ঠিক আছে। আসব।
তারপর স্টেশনে এসেই সে দেখল কাউন্টারের সামনে সিট মেটালের দু’নম্বরী খদ্দের পিয়ারিলাল। পাশে একটি শ্যামলা মেয়ে। ওকে দেখেই যেন লাইন ছেড়ে ছুটে এসে বলল, বাবুজী আপ!
—বাড়ি যাচ্ছি। অতীশ তার কাউন্টারের দিকে এগুতে থাকল। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে গেছে অতীশ। পিয়ারিলাল সব জানে। সে বাড়ি যাবে, রাতের গাড়িতে বাড়ি যাবে—এই স্টেশনে পিয়ারিলালের ভাইঝিও একই গাড়িতে সেই শহরে যাবে। বাবুজী যাবে জেনে পিয়ারিলালের সব দুর্ভবনা থেকে যেন রেহাই। পিয়ারিলালের দাদার অসুখ। তারই যাওয়া উচিত, কিন্তু কাজ কারবারে ফেঁসে আছে, যেতে পারছে না। এমন কি সে অতীশের জন্য টিকিটও কেটে ফেলেছে। অতীশ টিকিটের দাম দিতে গেলে বলল, সে দেবেন বাবুজী। বলেই ডাকল, চারু চারু। সুন্দর সতেজ এবং লক্ষ্মী-শ্রী দেখতে পবিত্র এক নারী এসে দাঁড়াল তার সামনে। পিয়ারিলাল বলল, ইনি বাবুজী। চারু হাত তুলে নমস্কার করল।
রাত এগারোটা দশে গাড়ি। পিয়ারিলালকে টাকা দিতে গেলে সে ফের জানাল টাকাটার জন্য এত ভাবনা কেন। সেও আছে অতীশও আছে। টিকিট চারুর কাছেই আছে। অতীশ কিছুটা সংকোচের মধ্যে পড়ে গেছে। কিন্তু চারু তখন বলল, বাবুজী চলুন। প্লাটফরমে গাড়ি দিয়েছে।
চারু রেলের খবরাখবর তার চেয়ে যেন বেশিই রাখে। চারু সঙ্গে যাচ্ছে। যাত্রীদের মধ্যেও একজন পরিচিত কেউ থাকল, ভাবতে ভালই লাগছে অতীশের। রাতের ট্রেন, কতটা ভিড় হবে সে জানে না। রাতের ট্রেনে তার ঘুমও হয় না। চারুর সঙ্গে কথা বলতে বলতে যাওয়া যাবে। কিন্তু একজন নারীর সঙ্গে সে কি নিয়ে কথা শুরু করবে বুঝতে পারছে না।
গাড়ি ছাড়ার সময় চারু বলল, আসুন বাবুজী। এবং চারুকে দেখল একটা প্রথম শ্রেণীর কামরায় উঠে যাচ্ছে। সে এখন আর বলতে পারছে না, চারু আমার এত টাকা নেই। পিয়ারিলাল ত জানে, আমার এত টাকা নেই। তবু সে চারুর পেছনে ঠিক কোনও সারমেয়র মতোই অনুসরণ করল। সে জানে কিছু একটা ঘটবে। ফাঁকা কামরা। সে আর চারু বাদে কামরায় কেউ নেই। এমন কি একটা কীটপতঙ্গও না। আর তখনই একটা যন্ডা মতো লোক উঠে এল।
চারু বলল, রাম সিং। তারপর অতীশের দিকে তাকিয়ে বলল, বাবুজী।
রাম সিং প্রায় কুর্নিশ করার ভঙ্গীতে অতীশের দিকে তাকাল।
চারু বলল, ও সঙ্গে যাচ্ছে। একটু হাবলা আছে।
গাড়ি ছাড়ার সময় দেখা গেল সে নেই। অতীশ জানালা দিয়ে দেখল, পাশের একটি তৃতীয় শ্রেণীর কামরায় সে উঠে যাচ্ছে।
চারু বলল, চাচাজীর বান্দা লোক আছে। রাতে যাচ্ছি। কোথায় কখন কি দরকার হবে!