।। বাইশ।।
ফুলির শরীর বেশ বাড় বাড়ন্ত। সব কিছুই একটু বেশি বেশি। বেশ নজর কেড়ে নেবার মতো শরীর। যে যায় সেই দেখে ফুলি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। এ-সময়টায় ফুলি আর কোথাও যায় না। কিছুদিন ফুলি ঘর থেকে বের হত না। কিছু একটা হয়েছিল সবাই আন্দাজে এমন ভেবে নিচ্ছিল। দাশুবাবু বলতেন, পেলেই শালাকে এক কোপে কাটব। সেটা কার উদ্দেশ্যে কেউ বুঝত না। মাঝে একবার কোথায় ফুলির কানের দুল ছিনতাই হয়েছিল সেই থেকে মেয়ে বড় সুশীলা বালিকা। দাশুবাবু রেগে-মেগে পড়া বন্ধ করে দিয়েছেন। ঐ একটা ধান্দা ছিল মেয়েটার। পড়ার নাম করে মেয়েটা হুটহাট বের হয়ে যেত। প্রেমও করেছিল, আগেও ছিল সব। কিন্তু চেখেচুখে রেখে যাওয়ার পর দাশুবাবু বাঙাল দেখলেই ক্ষেপে যান। নতুন ম্যানেজারকে দেখলেই বলবেন, নে শালারা লুটে খা তোদের সময় এখন, তোরা খাবি না তো কে খাবে। বউরাণীর সঙ্গে আজ নতুন ম্যানেজারকে দেখেই ক্ষেপে গিয়েছিল।
হামুবাবু ফিরছিল। সন্ধ্যা না হতেই ফিরে আসছে দেখে দাশুবাবু ডাকলেন, কি হামু, সকাল সকাল দেখছি। খবর রাখ?
হামুর এখন খবর শোনার সময় নয়। সে সকালেই খবরের কাগজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে। কথার জবাব না দিয়েই চলে যেত। কিন্তু সামনে কমলাসুন্দরী ফুলি উদাস চোখে তাকিয়ে আছে। বিকেলে গন্ধ সাবান মেখে চান করেছিল বুঝি। কাছে আসতেই গন্ধটা নাকে লাগছে। এবং ভাল লাগছে। সে দাঁড়াল। মেয়েটাকে দেখল। কাবুলের ঘরে আজকাল মাঝে মাঝে যায়। কেন যায় কে জানে। রাজার গায়ের গন্ধ নিতে সবাই বুঝি ভালবাসে। রাজাকে পাবে কোথায়। রাজার ল্যাজুড় ঐ কাবুলটা। ফুলির সঙ্গে এখন নতুন ভাবসাব। এটা হাসিরাণীকে দেখিয়েই করে। হাসিরাণীর বুকে জ্বালা ধরিয়ে দেবার এটা একটা মোক্ষম চাল। হামুরও কাবুলকে উসকে দিচ্ছে। লাগুক ভেল্কি। যত ভেল্কি তত তার আমোদ। সে বলল, না দাদা, সকালের কাগজে ত জুতসই কোন খবর দেখলাম না।
—আরে খবরের কাগজে কি সব থাকে। চোখের ওপর কি হচ্ছে দেখছ না?
—কোথায় আবার কি হল?
—তোমার বউরাণী নতুন ম্যানেজারকে নিয়ে বের হয়ে গেল।
—পিসি ভাইপো দাদা। মন্দ দেখছেন কেন?
পিসি ভাইপো কথাটাতে কেমন ভড়কে গেল দাশুবাবু। বলল, তার মানে?
—ফুলি জানিস না?
ফুলির কাছে বিষয়টা খুব পরিষ্কার। কাবুলের কাছে ফুলি যায়, ফুলি জানতেই পারে। দেশের পোলা। সম্পর্কে পিসি। বউরাণী ম্যানেজারের পিসিগ দাদা।
হামু ফুলির দিকে ত্যারচা চোখে তাকাল।
ফুলি বাবার দিকে তাকাল। কিছু বলল না।
দাশুবাবু কিছুটা দমে গেলেন। কাবুলকে জড়াচ্ছে। মেয়ে তার গোপনে কাবুলের ঘরে গিয়েছিল . ঠিক। সেত একটা টাইপ স্কুলের ভর্তির বিষয় নিয়ে। কাবুলের চেনা জানা জায়গা। আজায়গায় কুজায়গায় শহরটা ভরে গেছে। বাড়ির লোকের সঙ্গে জানা চেনা থাকলে যেখানে সেখানে যেতে সাহস পাবে না ফুলি। তাছাড়া কাবুলের চোখ দেখে বুঝেছে, ফুলিকে সে ইদানীং পছন্দ করছে। ফুলির সঙ্গে নির্দোষ ঠাট্টা ইয়ার্কি করছে। ফুলিও কাকা কাকা করে এমন নিজের করে ফেলেছে যে দু-একবার গেলে দোষের হয় সেটা দাশুবাবুর মাথায় আসে নি। সে বলল, ফুলি আমার অত বোঝে না হামু। তোমাদের চোখের সামনে বড় হয়েছে। বেচাল দেখেছ কখনও?
তা তোমার মেয়ে, তুমি বোঝবে বাবা! দাঁড়িয়ে আছ কেন? সেজেগুজে সাঁজ বেলায় দাঁড়িয়ে থাকে কেন। মাঠে ঘুরে বেড়ায় কেন? কাবুলের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করে কেন! রাজবাড়ির উঠতি ছোকরারা শিস দেয় কেন? তুমি চাঁদু বাপ বোঝ না সেটা। হামু ব্যাগটা হাত পাল্টে বলল, ফুলির মতো মেয়ে হয় না দাদা। যে ঘরে যাবে আলো হয়ে যাবে।
ফুলি বোধহয় এমন কথায় লজ্জা পাচ্ছিল! সে বারান্দা থেকে নেমে হাঁটা দিল। দুলাল শম্ভু ফিরবে। নধর জ্যাঠার ছেলে রমেন ফিরবে। ওরা দেখবে ফুলি ফুলপরি সেজে বাগানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে ওরা ফুলিকে দেখলে দাঁড়িয়ে যায়। দুটো একটা কথা বলে। ফুলির তখন শরীরে বড় আরাম হয়। কলেজের পড়াটা বন্ধ করে দিল বাবা। অভাব অনটনের কথা পেড়ে বন্ধ করে দিল। এখন টাইপ শিখে নিতে পারলেই ফুলির ধারণা সে সুনন্দর বিশ্বাসঘাতকতার উচিত জবাব দিতে পারবে। তার চোখ তখন জ্বলে। জ্বালা ধরে যায়। ব্যাঙ্কের কাজটা পেয়েই সুনন্দ তাকে ছেড়ে দিল।
হামু ফের বলল, যাই দাদা। আজ আবার একাদশী। একটু ফলমূল আহার করব ভেবে বসে আছি। দাশুবাবু তার বরান্দায় তক্তপোশে বসেছিলেন। অফিস ছুটির পর এই তক্তপোশটাই যেন তাঁর সম্বল। পানের বাটা পাশে। জাঁতা সঙ্গে। কটর কটর সুপারী কাটেন আর পান মুখে দেন। তা না হলে মাথা ঠিক রাখা যায় না। কেষ্ট পাশের ঘরে জোর হারমোনিয়াম বাজিয়ে গলা সাধছে। বেতার শিল্পী হতে এসেছিল কলকাতায়। রাজার কাজটা ছিল ফাউ। এখন এটাই মোক্ষ। ফাঁকে ফোকরে গলা থেকে অদৃশ্য সাপেরা উঁকি দিলে স্থির থাকতে পারে না। গলা বড় চুলকায়। শালা তোমার গলায় জংলি কচু মেজে দেব। বুঝবে একদিন ঠ্যালা। বুঝবে দাশু বাবাজী কারে কয়!
দাশুবাবু সারাক্ষণ ক্ষেপেই থাকে! অফিসে কাজ করতে করতে ক্ষেপে যায়। কেবল গজগজ করে। সারাটা বাড়ি জুড়ে চক্রান্ত। তার হাতে পেয়ারা বাগানের আদায় ছিল। দু’ পয়সা আসত। রাজার কান ভাঙিয়ে সেটাও কেড়ে নিল রাধিকাবাবু। ওরই কাজ। নধরবাবু তো কাজ করতে করতে মাজা খসিয়ে দিল। কেমন বেঁকে গেছে। থেকে থেকে ভয়ংকর উদগার। পেটে আলসার। সারাক্ষণ পেট ধরে বসে থাকে। আর কাজ করে যায়। সকাল আটটায় কাজ আরম্ভ রাত দশটায় শেষ। রমেনটা উঠতি ছোকরা। বাজারটাও করে না। রাজবাড়ির বাইরে বের হলেই দেখা যায় কলেজের সামনে ইয়ার বন্ধু নিয়ে দাঁড়িয়ে, আছে। কলেজের ছুকরিগুলোর পেছনে লাগে। রাজবাড়ির পরিবেশটাই নষ্ট। কাকে আর দোষ দেবে! শম্ভু দুলাল বাপকে মানে না। কবে একদিন ঠিক লাঠালাঠি হবে। এটা হলেই সে ভেবেছে ঠনঠনে গিয়ে পূজা দিয়ে আসবে। ফুলিকে নিয়ে তোমার মাথাব্যথা শুয়োর। ফুলির কম্ম ওটা। না চিনুর! মতি বাদ যাবে কেন! আর কিনা তাকে ডেকেই শেষপর্যন্ত রাজা শাসাল। ফুলিটাও কেমন হয়ে গেছে! কারো সঙ্গে মেশে না। কেউ ফুলির সঙ্গে কথা বলে না। তার এমন নিষ্পাপ মেয়েটাকে কলঙ্ক দিল রাধিকাবাবু। তোমার খবর রাখি না ভাব। দেব সব ফাঁস করে!
মাথা গরম হয়ে গেলে দাশুবাবু আরও বেশি পান খায়। লাগোয়া ঘরটায় সতীসাধ্বী শুয়ে আছে। তলপেটে কষ্ট। কান পাতলেই ঘরের মধ্যে গোঙানি শোনা যায়। কান পাতলেই মনে হয় কেবল ডাকছে। সন্দ আছে। মতির সঙ্গে একটু কথা বলাবলি আছে তার। সতীসাধ্বীর তাই সন্দ। একটু চা খাবে তাও উপায় নেই। নিজের হাতে কর। ফুলিটার এখন তো বয়েসকাল। সেজেগুজে না বেড়ালে শরীর ঠিক থাকবে কি করে। ফুলি এখন এই রাজবাড়ির মাঠেই ঘুরতে ফিরতে গেছে। তাকে ডেকে বিরক্ত করা ঠিক না। গলা বাড়িয়ে বলল, ও কেষ্টবাবু তোমার চা হচ্ছে নাকি!
কেষ্টবাবুর কাছে গান শেখার অছিলা করে আসে হাসপাতালের আইবুড়ো আয়া ময়না। কেষ্টদাদাকে দাদা দাদা করে। মেয়েটাকে দেখেই সে কথাটা বলল। কেষ্ট গলা আর সাধছে না। লুঙ্গি তুলে পরেছে। তোয়ালেটা কাঁধে ফেলে দরজাটা একটু ভেজিয়ে দিতেই দাশুর ডাক শুনতে পেল। শালা রাজার কান্ড। এমন কোয়াটার যে হাঁচি কাশি পর্যন্ত দেবার উপায় নেই। সদর রাস্তায় ঘরবাড়ি হলে যা হয়। তবু দাশুবাবুকে কেষ্ট ভয় পায়। নষ্টামির গন্ধটা পাশের ঘরে যায় সে বুঝতে পারে। অনেককালের প্রতিবেশী দু’জনে। চটাচটি হয় না। বরং দু’জনে সব-সময়ই আছে বেশ। বলল, চা বানাচ্ছে। ও ময়না, এক কাপ চা বেশি কর। তোমার দাশুদাদা খাবে।
ময়না চা দিয়ে গেলে দাশুবাবু বড়ই প্রসন্ন বোধে কেষ্টর দরজার কাছে এগিয়ে গেল।—শুনলে নাকি?
কেষ্টবাবু বিছানায় বেশ আসনপিঁড়ি করে এখন চা খাচ্ছে। দু-পাশে দুটো তক্তপোশ। একটায় কেষ্ট শোয়। পাশেরটায় কে শোয় এতদিন কাছে থেকেও দাশুবাবু টের পায় না। একটা আলনা। দুটো লুঙ্গি। দুটো কোঁচানো ধুতি। বাফতার পাঞ্জাবী ঝুলছে পাশে। নিচে ছোট র্যাকে কলপের শিশি। ক্রিম পাউডার। বয়স হয়ে গেলেও বড় শৌখিন। ময়না খাটে বসে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে চা খাচ্ছে।
দাশুবাবুর কথা কেষ্টবাবু গ্রাহ্য করে না। কিন্তু ময়নার সামনে ওর কেন জানি দাশুবাবুকে নিজের মানুষ প্রমাণ করার আগ্রহ বেড়ে গেল। ময়না এমনিতেই এখানে আসতে চায় না। কত রকমের লোক থাকে রাজবাড়িতে। কে কি ভাবতে পারে! ময়নাকে নিয়ে কেউ কিছু ভাবে না এইটাই এখন কেষ্টর প্রমাণ করার ইচ্ছে। ভাল করে কথা বললে, দাশু ময়নার সঙ্গেও দুটো একটা কথা বলবে। যেন কত আপনার জন সবাই। তাই কেষ্টবাবু বলল, রাজার কথা বলবে ত!
—রাজার কথা বলব! অধম্ম হবে না! বলে জিভ কাটল। ময়নার সামনে বলা ঠিক হবে কিনা দেখে একেবারে চৌকাঠ ডিঙিয়ে কেষ্টর কানের কাছে নুয়ে বলল, নতুন ম্যানেজার বউরাণীর ভাইপো।
—তা ভালই। আত্মীয় সম্পর্ক না থাকলে চলে! কিন্তু বলেই কেমন ময়নার দিকে তার চোখ পড়ে গেল।
দাশুবাবু বলল, পিসি ভাইপো কোথায় বের হয়ে গেল! বলেই হা হা করে হাসি।
আর রাত দশটায় আবার রাজবাড়ির মানুষগুলোর ঐ এক কাজ—কে কোথায় যায়। সর্বক্ষণ নজর রাখা। কুম্ভ বলল, বাবা আপনি রাজাকে সব খুলে বলুন।
—কি বলব?
—কী কান্ডকারখানা সব চলছে। আপনারা এ বাড়ির বিশ্বস্ত মানুষ। আপনাদের কথা ফেলতে পারবে না। বাড়ির ইজ্জত গেল।
রাধিকাবাবু ঠিক বুঝতে পারল না কুম্ভ কি বলতে চায়! খাবার পরে তিনি ইজিচেয়ারে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেন। তারপরে রাজবাড়িটা ঘুরে দেখেন। কোথাও কোনও ফাঁকে অনাচার ঢুকে গেল কিনা নজর রাখেন। সদর গেটের খাতা দেখেন। রাত দশটার পর কে কে ফিরল লেখা থাকে। দেখল দশটার পরে সত্যি মতি এবং অতীশ একই গাড়িতে গেট দিয়ে ঢুকেছে।
কুম্ভ বলল, অতীশবাবু মদে চুর হয়ে ছিল।
রাধিকাবাবুর সামনে লম্বা ফরাস। নল মুখে তিনি হাঁ হাঁ করছেন। রাজার পরেই এ-বাড়িতে স্যার সনৎবাবু, তারপরই তিনি। খুবই আত্মপ্রসাদে ভোগেন। অতীশের খবরে খুব একটা বিচলিত বোধ করলেন না। ঘাঁটাঘাঁটি করা কতটা ঠিক হবে বুঝতে পারছেন না। রাজার বাড়িতে মাতাল হয়ে কেউ কেউ ঢোকে। তবে সেটা ভারি গোপনে। বুঝতে পারলেই অশান্তি হয়। অতীশ মতির সঙ্গে ফিরেছে। গেছে বউরাণীর সঙ্গে। ভ্রষ্টা মেয়ের সঙ্গে অতীশ ফিরেছে। তা হবার কথা না। বউরাণীর মর্যাদাবোধ যেমন, অতীশেরও তাই, যে গাছে যে ফল ধরে। তারই নীতিসুধা পান করালেন কুম্ভকে। বললেন, নিজের কাজ করে যাও। কর্মই সব। মা ফলেসু কদাচন। মনে রাখবে আমার এ জায়গায় আসার পেছনে অনেক আত্মত্যাগ আছে। কে কি করছে তোমার দেখার কি। তারই ইচ্ছে। তিনি যে পাত্রে যেমন জল রাখেন।
কুম্ভ বড়ই পিতৃভক্ত মানুষ। শোবার আগে বাপের পদধূলি গ্রহণ করে থাকে। বাপের গচ্ছিত কত টাকা ব্যাঙ্কে আছে হিসেবটা সে এখন টের করতে পারছে না। শম্ভুটা জানতে পারে। কনিষ্ঠ সন্তান। মমতা বেশি। কিন্তু মুখে কুলুপ। তবে হাসিরাণী বড়ই চমকপ্রদ একখান খবর দিয়েছে। শম্ভুর মাথায় নাকি অতীশবাবুর মতো ফাঁকা মাঠ একখানা ঢুকে গেছে। ঈশ্বর মানে না। বলে সব ফালতু। কম্যুনিস্ট হবার উপসর্গ। এটাই সার বুঝে কুম্ভ মুখ বুজে আছে। এখন এ-সব বাপকে বলাও ঠিক হবে না। পাকা ফলটি পড়ুক। কপ করে ধরে ফেলবে একেবারে। বাবার একখানা সুমার লাথি পাছায়। বের হও অধার্মিক। রাজবাড়ির নুন খেয়ে শেষে এই। ঈশ্বর মানে না! এমন অধোগতি। ত্যাজ্যপুত্র করতেও পারে।
রাধিকাবাবু বললেন, শন্তুটা রাত করে ফেরে। বাইরে এত কি কাজ তার? ওকে ডাকত।
শম্ভু কালো ছিপছিপে তরুণ। সুন্দর নাক মুখ। দীর্ঘকায়। চোখে প্রখর দৃষ্টি। যেন কোথাও তার যাবার কথা থাকে সব সময়। বাপের সামনে এসেই বলল, আমাকে ডাকছেন?
—তুই আজকাল রাত করে ফিরছিস শুনছি।
—শুনবেন কেন। দেখতে পান না!
রাধিকাবাবু জানেন, শিশু বয়সে মাতৃহারা হলে একটু রগচটা হয়। শম্ভুর সব তিনি ক্ষমা করে দেন। বললেন, দিনকাল খুব খারাপ আসছে। বুঝে শুনে চলি।
শম্ভু বুঝতে পারে বাবা কি বলতে চায়। সে কলেজে ইউনিয়ান করছে। বাবার কানে বোধ হয় কথাটা উঠেছে। তা উঠুক। এটা তো আদর্শের লড়াই। এই যে বাড়িতে গোপন অনাচার সবই এই সমাজ ব্যবস্থার ফল। কাবুলবাবুকে বাবা কত আদর যত্ন করে। কাবুল যখন তখন আসে। যায়। কিছু বলে না। তারপরই হাসিরাণীর মুখ উঁকি দিতেই কেমন এক অসতী মুখের ছবি। দাদার ফূর্তিফার্তা এবং সংসারে নানাভাবে অপচয় দেখেই সে বোঝে গোপন টাকা এ-বাড়িতে সেই কবে থেকেই আসতে শুরু করেছে। পরিশ্রমে অর্জিত না হলে যা হয়। চুরি চামারি যেমন তার বাপ করে আসছে, তেমনি বড়দা হাত পাকাচ্ছে। এই বিষয়টি তাকে এখন ভীষণ গম্ভীর করে রাখে। মাঝে মাঝে সে শুনতে পায় বড়দা অতীশবাবুর বিরুদ্ধে নানারকম অভিযোগ তুলছে। অভিযোগ একটাই, একটা আধ পাগলা মানুষ। ছুতমার্গ। ঘুষ দেবে না। দু’নম্বরী মাল করবে না। কিন্তু আজ অন্য কথা। সে তার ঘরে বসে শুনছিল সব।
—বুঝলেন বাবা আজ দুপুরে সারা অপিস-ঘরে ধূপকাঠি জ্বালিয়েছে।
—কর্পোরেশনের লোকটিকে ফিরিয়ে দেয়নি ত!
—না।
—যাক্ বাঁচা গেল।
শম্ভুর মনে হয়েছিল বাবার মাথা থেকে যেন মস্ত বড় একটা বোঝা নেমে গেল। তারপর আরও কিছু কথাবার্তা শম্ভুর কানে আসছিল।
—হাত পাকানো দরকার। ছেলেটা অন্য জগতের মানুষ। তার যখন মতিগতি পাল্টেছে, সুবুদ্ধির উদয় হয়েছে তখন তর তর করে উন্নতি। মনে হয় তোদের মাইনেও বেড়ে যাবে।
কুম্ভ বলল, রাজা কিছু বলল?
তাইত বলল, খাটছে। অর্ডারপত্র ব্যালেন্সসীট দেখে রাজা খুশী। এখন তুমি আর অতীশের পেছনে লাগতে যেও না। কিছু করতে পারবে না।
শম্ভু এবার রাধিকাবাবুকে বলল, তোমার কি মনে হয় অতীশবাবু ঠিক কাজ করেছে? লোকটাকে তোমরা সবাই মিলে নষ্ট করে দিচ্ছ!
রাধিকাবাবু পুত্রের কথায় প্রথম একটু চমকে গেল। এমন কথা কেন! কি নিয়ে এই প্রশ্ন! রাধিকাবাবু মুখ থেকে নল নামিয়ে বলল, আমরা নষ্ট করার কে?
—তা ছাড়া কারা করছে। ঘুষ দিতে তাকে তোমরা বাধ্য করলে কেন?
—ঘুষ!
—এই যে খেতে বসে বললে, যাক বাঁচা গেল।
তা হলে তার পুত্রটি সব আড়াল থেকে শোনার চেষ্টা করে। কুম্ভের সঙ্গে এই নিয়ে কিছুক্ষণ আগে আলোচনা হয়েছে। সব মনে করতে পেরে বললেন, যেমন দিনকাল তাতে এটা দোষের না।
—দোষের না, গুণের! এটা ক্রাইম তাও বোঝেন না।
—ক্রাইম হবে কেন! ক্রাইম মনে করলেই ক্রাইম। না হলে কিছু না। এখন এটা ঈশ্বর বৃত্তি। সবাই পেয়ে থাকে।
—আমি জানি অতীশবাবু সারারাত ঘুমাতে পারবে না। তাকে তোমরা খুন করার মতলবে আছ।
—খুন! কি বলছিস!
—হ্যাঁ, খুন এটা। মানুষকে নষ্ট করে দিলে খুন করা হয়। বলেই চলে যাচ্ছিল। রাধিকাবাবু কি এক আশঙ্কায় ভয় পেয়ে গেলেন। আজকালকার ছেলে ছোকরারা কেমন অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে। তাদের এ-সব কে শেখায়! তিনি দেখতে পেলেন সুদূরে এক দীর্ঘকায় ব্যক্তি ফসলের মাঠ পার হয়ে যাচ্ছে। আর যেন বলছে ফসল ফলাও, খাট, কাজ কর। পরিশ্রমের বিনিময়ে খাদ্য এবং আশ্রয় সংগ্রহ কর। রাধিকাবাবু বলল, তুমি যাচ্ছ কোথায়?
—বাইরে।
—এত রাতে বাইরে কি আছে?
—অতীশবাবুকে দেখতে যাব।
—তাকে দেখার কি আছে?
—বলে আসব দাদা আপনি নষ্ট হয়ে যাবেন না। আপনি নষ্ট হলে আমরা দুর্বল হয়ে পড়ব।
—হুঁ। রাধিকাবাবু হুঁ শব্দটির সাহায্যে পুত্রের অবাচীন চিন্তা ভাবনার প্রতি শ্লেষ ছুঁড়ে দিল। বলল, এখন বের হতে হবে না। নিজের কাজ করগে। কোথাকার কে অতীশ সে মরে বাঁচে তোমার কি সংসারে এই হয়। এখন বুঝবে না, বড় হলে বিয়ে করলে বুঝবে। সব স্বপ্ন তখন মরুভূমি। পায়ের নিচে মানুষের মরুভূমি না থাকলে ঈশ্বর বৃত্তি কেউ দেয়ও না নেয়ও না। যেন বলতে চাইল রাধিকাবাবু, বাপের খেয়ে সবাই বনের মোষ তাড়াতে পারে।
কুম্ভ মজা পাচ্ছিল। সে এটাই চায়। হাসিরাণী বড়ই বুদ্ধিমতী। ঠিক টের পেয়ে গেছে। সে ঘরে ঢুকে বলল, আপনার বৌমা আমাকে আগেই সাবধান করে দিয়েছে। শম্ভুকে তোমরা দেখ। এখন বুঝছি মাথায় ফাঁকা মাঠ ঢুকেছে।
—ফাঁকা মাঠ!
—ঐ আর কি। অতীশবাবুর কথা এটা। ঘুষটুসের কথা শুনলেই কেমন মাথা নাকি তার ফাঁকা হয়ে যায়। আর কে এসে ওখানে উপদ্রব শুরু করে দেয়।
—ফাঁকা থাকলে হবে। মাথা ফাঁকা হতে দেবে না। মানসটারও তাই হয়। এখন ত ভাল আছে। কেবল ছবি আঁকছে। মাথা ফাঁকা রাখতে দিচ্ছে না।
বাপের সঙ্গে শম্ভুর কথা কাটাকাটি শুনে হাসিরাণী ছুটে এসে কুম্ভকে বলল, বাবা বলছে, তুমি আবার কেন? এস। হাসিরাণী কুম্ভের হাত ধরে টানতে থাকল।
কুম্ভ এতটা আহাম্মক হতে রাজি নয়। সে বলল, হাত ছাড়! তারপর বাপের দিকে তাকিয়ে বলল, কলেজের পান্ডাগিরি বাড়িতে যেন না ফলায়। ওকে বারণ করে দিন।
শম্ভু কলেজে সাতচল্লিশ ঘন্টা প্রিন্সিপালকে ঘেরাও করে রেখেছিল। এই নিয়ে কিছুদিন বাড়িতে একটা হৈচৈ গেছে। কুমারবাহাদুর রাধিকাবাবুকে ডেকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন, বড়ই মাথা গরম ছোকরা। শম্ভুকে বলে দেবেন। রাধিকাবাবু এক সকালে শুধু বলেছিলেন, তোর দিদির বাড়ি থেকে ঘুরে আয়। দেশ ভ্রমণে স্বাস্থ্য ভাল থাকে।
শম্ভু কোন দিকে না তাকিয়েই বলল, পান্ডাগিরি ফলালে এ-বাড়িতে তোমরা থাকতে পারতে না।
কুম্ভ ক্ষেপে গেল। বলল, তোর খাই। বাবার খাই। আমি রোজগার করি না! এক চড়ে সব কটা দাঁত খসিয়ে দেব।
কতদিন পর যেন কথাটা শুনতে পেল। শম্ভু দীর্ঘকাল এমন সোহাগের কথা শুনতে পায় না। আরও ছোট বয়সে পড়াশোনা না করলে দাদা এ-ভাবে শাসন করত। তখন ছিল ভারি নির্দোষ একটা জীবন। সব মানুষকেই মনে হত ভাল মানুষ। সবাইকে প্রিয় মনে হত। দিদি বেড়াতে এলে ছাড়তে চাইত না। দিদি চলে গেলে কান্নাকাটি করত। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে বুঝতে পারছে পৃথিবীটা বড় স্বার্থপর। দাদা এখন আর তার জন্য কোনও দুশ্চিন্তা করে না। একটা দেয়াল উঠে গেছে। বিয়ের পরই দাদা যেন আলাদা মানুষ। হাসিরাণী ছাড়া তার কোন সম্বল নেই। শম্ভু আর একটা কথা না বলে নিজের ঘরে ঢুকে গেল। তারপর কি মনে হতেই আবার উঠে এল। বলল, বাবা, কাবুল এ- বাড়িতে এলে কিন্তু খারাপ হবে। ওকে আসতে বারণ করে দেবেন।
এমন কথায় কুম্ভ রাধিকাবাবু দুজনেই হতবাক হয়ে গেল। অথচ শম্ভুকে কিছু বলতে পারল না। নাড়ির মধ্যে ঘুণপোকা কটকট করে কাটছে। কুম্ভ মাথা নিচু করে বাইরে বের হয়েই হাসিরাণীর মাজায় দুম করে লাথি কষিয়ে দিল। আর তখনই বিশ্রী একখানা কান্ড। হাসিরাণী চিৎকার করছে, বাবা আমাকে মেরে ফেলল। বাবা বাবা!
হামুবাবু উঠানের ওপাশে তখন নিজের ঘরে ফলমূল আহার করছে। মেস বাড়িতে ঠাকুর সবাইর খাওয়া শেষে আলুর দম মাংস ভাত নিয়ে খেতে বসেছে। সুরেন হামুবাবুর জানালার পাশে বসে খকখক করে কাশছে। মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে দেখছে বাতাসীটা কি করছে! অন্ধকার থেকে দেখা যায় না সুরেনকে। ওপাশে কাবুলবাবুর ঘরে রেকর্ডের গান, এই হাম দেওয়ানা গোছের কিছু উচ্চমার্গের সঙ্গীত। কাবুল একা বসে শুনছে সব। পেট্রল পাম্পের একটা দৈনিক হিসাব লম্বা হয়ে পড়ে আছে সামনে।
এত কোলাহলের মধ্যে হামু আহার শেষ করল। বাতাসীকে বলল, মনে হচ্ছে তোর বাপ অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ি যা। সে কাঠ এবং চাকুটা তক্তপোশে রেখে গামছায় হাত মুছল। এখন তার ঈশ্বর সেবা হবে। তার পরই তুরীয় মার্গ। এই মার্গে পৌঁছাতে পারলে সংসার বড় অর্থহীন। কুম্ভটা কাউকে পেটাচ্ছে। আগে দৌড়ে যেত। কোথায় কার কি কখন লাগে টের পাওয়া যায় না। বাড়ির নিত্যকর্মের মধ্যেই পড়ে যখন, কেউ আর এখন দৌড়ে যায় না। হামু খুব নির্বিকার চিত্তে ঈশ্বর সেবায় বসে গেল। এমন সুসময় তার খুব কম, মানুষের আরও কম। সবার দোষ ধরে ধরে যখন ক্লান্ত তখন একমাত্র ঈশ্বর সেবায় সান্ত্বনা পাওয়া যায়। কুম্ভটাকে তাই চেষ্টা করেছিল ধরাবার। উঠতি তরুণ। কিন্তু একদিন এক টান দিয়েই মাথা ব্যোম। সব ব্যোম দেখতে দেখতে মাথা ঘুরে পড়ে গেছিল। রাধিকাবাবু সেদিন খড়ম নিয়ে তাকে তেড়ে এসেছিল, হারামজাদা রাজার বাড়িতে তোমার নেশা ভাং। এখন মজা বোঝ। নেশা মানুষের কত রকমের। নতুন নেশায় কুম্ভ ফাঁক পেলেই বৌকে পেটায়। আর সকালবেলায় বৌকে সোহাগ করে ঘুম থেকে তুলে চা বানিয়ে খাওয়ায়। বাসি কাপড় ধুয়ে দেয়। বাচ্চাটাকে হাগায় মোতায়। সব কাজ তখন একা সামলায়। কে বলবে, এই কুম্ভই বৌকে ধরে রাতে পিটিয়েছে। তারপরই দে টান বলে একেবারে উপুড় হয়ে নাভির অতলে শ্বাস টেনে সব ধোঁয়া রক্ত মাংসে ছড়িয়ে দিল। নাভি থেকেই উদগার তুলে হাঁকাড় দিল ব্যোম কালী কলকাত্তাওয়ালী। শুকনো টিকটিকির মতো লম্বা শরীরটা সটান পদ্মাসনে। শেষমেস ঊর্ধ্বনেত্র হয়ে গেল সে।
বাতাসী কাছে গিয়ে বলল, যাই কাকা। সে বাকি ফলমূল যা কিছু ছিল কোঁচড়ে তুলে নিল। সুরেন অন্ধকারে দাঁড়িয়ে বাতাসীকে ইশারা করছে। জ্যাবে যদি কিছু পড়ে থাকে দেখতে বলছে। হাত ঢুকিয়ে ইশারাতেই ঠোঁট উল্টে দিল। নেই। তারপর আর কি নেওয়া যায়, না তেমন কিছু নিতে পারে না, ধরা পড়ে যাবে। রাস্তায় নেমে আসতেই সুরেন প্রায় হামলে এক আঁজলা কাটা শাক আলু তুলে কচকচ করে খেতে থাকল। মনে হচ্ছিল বুভুক্ষ মানুষের এই খাওয়া শেষ পর্যন্ত না পৃথিবীটাও গিলে খায়।
অতীশ তখন বাসার সব আলোগুলো জ্বেলে দিয়েছে। অন্ধকারকে তার বড় ভয়। খুটখাট আওয়াজে কেমন সতর্ক হয়ে যায়। সে একা। সারাটা দিন সে আজ ভাল ছিল না। ভাল না থাকলেই আতঙ্ক ভয় মনের মধ্যে সুরসুর করতে থাকে। বাথরুমের আলো নেভান ছিল। সে উঠে গিয়ে তাও জ্বেলে দিল। ঘর থেকে পাতাবাহারের গাছগুলো দেখা যায়। সে আসার পর থেকেই গাছগুলো কেমন সজীব হয়ে উঠেছে। লকলক করে বাড়ছে। ঘন হয়ে উঠছে গাছের ঝোপঝাড়। রাধিকাবাবুকে গাছগুলো কেটে ফেলার কথা বলেছিল। রাধিকাবাবু তার কথায় ভারি বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। দামী পাতাবাহারের গাছ, পরে কোথা থেকে এই গাছের কলম আনা হয়েছিল, গোটা রাজবাড়িটাকে বাগানবাড়ি বানাতে রাধিকাবাবুর কি স্যাক্রিফাইস তার একটা জ্যান্ত বর্ণনা। অতীশ অভিযোগ জানিয়ে বড়ই আহাম্মক। সত্যি তো তার বিবেকবুদ্ধি কম। মাথায় দোষ আছে ভাবতে পারে। প্রায় পালিয়ে বেঁচেছিল। গাছগুলো তো কোন অনিষ্ট করেনি তার। সে কেবল ভেবে থাকে, গাছগুলির এই পুষ্টিসাধন করছে আর্চির প্রেতাত্মা। তা না হলে, এত তাড়াতাড়ি বাড়ে কি করে! পাতাবাহারের গাছ বেশি বড় হয় না। গাছগুলো জানালার কত নিচে ছিল। তক্তপোশে বসলে একটা পাতা চোখে পড়ত না। জানালার কাছে গেলে দেখতে পেত নির্জীব গাছগুলো সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে। আর এখন সেই গাছ জানালার বুক সমান উঠে এসেছে। যেন হাত বাড়িয়ে তাকে ছুঁতে চায়। সে মাঝে মাঝে খুব গোপনে গাছের ডালপালা ভেঙে রাখে। কত বাড়তে পারে সে দেখবে। একবার একটা গাছের অনেকটা ভেঙে রেখেছিল। তখনই খবর রাজবাড়ির অন্দরে, এত সুন্দর পাতাবাহারের গাছ কেটে নষ্ট করে রেখেছে। রাজেনদা পর্যন্ত নিজে এসে দেখে গেছিলেন। দুমবারকে লক্ষ্য রাখতে বলেছিলেন। এই গাছগুলি বাড়ির সবার বড় প্রিয়। সে কেবল দেখলে ভয় পায়। যত বাড়ে দিনে দিনে তত তার ভয় বাড়ে। যেন স্বাভাবিকভাবে এ-বাড়া নয়। কোনও জল নেই সার নেই যত্ন নেই তবু হামলে উঠছে। অতীশ তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে বারান্দার সবকটা জানালা বন্ধ করে দিল। সদর বন্ধ করে দিল। তারপর নাক টেনে কি শুঁকল দু-বার। বারান্দায় হেঁটে গেল! নাক টানছে। সারা ঘরে হেঁটে গেল। শুকে যাচ্ছে। দরজার ফাঁক ফোকরে কোথাও কিছু যদি ঝুলে থাকে। কারণ তার মনে হচ্ছিল আজ কিছু একটা হবে।
এই হবে ভয়ে শেষ পর্যন্ত ট্যাকসিতে মতিবোনকে বলেছিল, আমি একটু বালীগঞ্জ হয়ে যাব।
মতিবোন ভারি সরল বালিকা। কত সহজে বলেছিল, তাতে কি আছে চলুন না। এই ভাই, মহানির্বাণ রোড চলিয়ে।
মতিবোন ট্যাক্সিতেই বসেছিল। সে গলির মধ্যে ঢুকে টুটুল মিণ্টুকে দেখে স্বস্তি বোধ করেছে, নির্মলা বলেছিল, একটু সময় ওদের না দেখে থাকতে পারে না! শ্যালিকারা ঠাট্টা করেছিল, কি দিদির টানে আসা না! আজ কিছুতেই থাকতে দিচ্ছি না।
সে ভারি লজ্জায় পড়ে গিয়েছিল। বলতে পারেনি, সে আজ আবার একটা লোককে অজগর সাপ গিলে ফেলতে দেখেছে। তখনই বাতাসে টুটুল মিণ্টুর গলা, বাবা বাবা!
সে প্রথম ফোন করেছিল। ফোনে কোন রঙ কানেকসান হয়নি। সোজাসুজি সে বিমলাকে পেয়েছে, তারপরই মাঠে অমলার সঙ্গে বেড়াবার সময় মনে সংশয় আসলে বিমলার গলা কিনা কে জানে। সে ঠিক শুনেছে ত। আবার ফোন করতেই নির্মলার গলা। টুটুল কথা বলেছে, টুটুল ফের বলেছে বাবা রাজার টুপি আনবে। খুব সতর্ক ছিল। না, গলা ঠিকই আছে। নকল গলা নয়, আর মতির ট্যাক্সিতে উঠতেই মনে হয়েছে, যদি আর্চি গলা নকল করে থাকে, বুঝতে না দেয়, আসলে আগেই শেষ হয়ে আছে, দুর্ঘটনা ঘটে গেছে, বদলা নিয়ে কিছুক্ষণ মজা দেখছে। ভুতুড়ে ফোন আশঙ্কাতেই সে সোজা নিজের চোখে দেখতে গিয়েছে সবই ঠিক ঠাক আছে কিনা, বাড়ির সিঁড়ি পর্যন্ত যেতেই তার পা ভেঙ্গে যাচ্ছিল! যদি কেউ বলে ফেলে, না ওরা কেউ আসেনি ত। সে কেমন অস্থির হয়ে পড়েছিল। চারপাশে সব ঠিকঠাক আছে, শুধু তারা নেই। দোতলায় উঠে প্রথমেই গলা পেল টুটুলের। দাদুর কোলে বসে ছড়া বলছে। তার ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ার মতো। কেমন স্থবির চোখে মুখে সোফায় বসে পড়েছিল। সে এসেছে শুনে সবাই ভিড় করলে, শুধু বলেছিল, এক গ্লাস জল। সারাটা দিন ভয়ঙ্কর ত্রাসের মধ্যে কেটেছে সেটা কেউ বুঝছে না।
সে চিৎপাত হয়ে এখন শুয়ে আছে নিজের ঘরে। ভিতরে অহরহ দ্বন্দ্ব। চোখ স্থির। বুকটা ভারি লাগছে। মাথার কাছে দক্ষিণের জানালা খোলা। জানালাটা অনেক উঁচু। কিছুটা গবাক্ষ পথের মতো, টেবিল চেয়ারে উঠে না দাঁড়ালে ও পাশে কি আছে দেখা যায় না। সে একবার উঠে দেখেছিল। ঠিক দেয়ালের নিচে অন্দরের বিশাল পুকুরে জল টলটল করছে। ও-পারে কিছু গাছপালা, পাঁচিল, পাঁচিলের মাথায় মাধবীলতার বেড়া, আর কিছু চোখে পড়ে না। সে জানে তারপর মাঠ, এবং পুরানো আস্তাবল লম্বা, এখন সেটা গ্যারেজ, গ্যারেজ পার হলে বাড়ির শেষ সীমানা, এবং সেখানেও এক অতিকায় জেলখানার পাঁচিল বাড়িটাকে সুরক্ষা করছে।
জানালা দিয়ে বাতাসে এক আশ্চর্য মিউজিক ভেসে আসছিল। রাজবাড়িতে অর্গান বাজাচ্ছে কেউ। ঝমঝম করে বাজছে, রাত গভীর। কেউ এই রাজবাড়ির হলঘরে পাগলের মত যেন, অর্গানে ঝড়- বইয়ে দিচ্ছে। শুয়ে শুয়ে বুঝতে পারছে এটা আমলারই কাজ। বুকটা আরও ভারি হয়ে ওঠে, নিঃশ্বাস নিতে পর্যন্ত কষ্ট বোধ করছিল অতীশ। কেউ যেন বুকে মুখে পাষাণ ভার চাপিয়ে দিচ্ছে। সেই আর্চির কষ্টের মতো। কিংবা অদৃশ্য কোনও হাতের কাজ কিনা কে জানে! সে দেখতে পাচ্ছে না অথচ কেউ তার গলা টিপে ধরেছে। সে ধড়ফড় করে উঠে বসল। গলায় হাত দিল। এমনকি ছোট্ট কাঠের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গলায় আঙুলের ছাপটাপ পড়েছে কিনা দেখল। না, কিছু নেই। আবার বিছানা আবার সেইরকম, কেউ তাকে যেন আজ কিছুতেই ঘুমাতে দেবে না। ভয়ে দরজা খুলে বের হয়ে যাবে ভাবল, তারপরই মনে হল সে খুব দুর্বল। দুর্বল হয়ে পড়লেই আর্চি তাকে পেয়ে বসবে, ঘুমিয়ে পড়লেই আর্চি তাকে খুন করবে। সারারাত জেগে থাকা ছাড়া উপায় নেই।
এই ভেবে সে চেয়ারটায় গিয়ে বসল। টেবিলে পা তুলে জেগে থাকার চেষ্টা করছে। শুধু একটা জানালা খোলা আর সব বন্ধ। ফুল স্পিডে পাখা চলছে। ডাইরিটা ব্যাগে আছে। ডাইরিতে বাবার দেওয়া ফুল বেলপাতা। সেটা এখন ছুঁয়ে বসে থাকলে কেমন হয়। তারপর হা হা করে হেসে উঠল। আসলে কিছুই হয় নি। সে নিজের বধ্যভুমি নিজেই তৈরি করছে। এমন কি প্রেতাত্মার ভয় থেকে মুক্তি পাবার জন্য কড়িবরগাতে সে ঝুলে পড়তেও পারে। এবার সাহসী হবার চেষ্টা করল। কোন দুর্গন্ধ নেই, তবু ভয় পাচ্ছে কেন! পাতাবাহারের গাছগুলো ভয় দেখাচ্ছে! কুয়াশার মতো এক অবয়ব সে এই ঘরে একদিন স্পষ্ট ঘুরে বেড়াতে দেখেছে। তারপর তা ভেসে গিয়ে গাছের পাতায় জল হয়ে গেছিল। এমন কিছু প্রেঅত্মার গল্প তার অবশ্য বইয়ে পড়া আছে। যেমন ঈশ্বরের কথা সে এভাবেই বইয়ে পড়েছে। একটা শেকড় গজিয়ে ফেলেছে শরীরের কোষে কোষে অন্যটা নিশ্বাসেও টের পাচ্ছে না। তার ভেতরে প্রচন্ড হাহাকার জেগে উঠল। এবং সে ঠিক দু-একবার বলেও ফেলল, ঈশ্বর আপনি যদি সত্যি থেকে থাকেন, তবে আমাকে এই প্রেতাত্মার কাছ থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যান। কিন্তু সে জানে বৃথা। সেই হাঁহাকার সমুদ্রে বনিকে রক্ষার জন্য ঠিক এমনি পাগলের মতো চিৎকার করত, ক্রসটা পাটাতনে দাঁড় করিয়ে দিত। তারপর সেখানে নতজানু হয়ে বসত দু’জনে। বালিকা বলত, আমাদের কোনও নীল ভূখন্ডে পৌঁছে দাও প্রভু। ঈশ্বর ছোটবাবুকে রক্ষা কর। ছোটবাবু চিৎকার করত, গড সেভ আজ ফ্রম অল ট্রাবলস। কিন্তু কোথাও তার কোনও করুণা পরিলক্ষিত হয় নি। সমুদ্র আরও রুদ্ররোষে নিরুপায় দুই তরুণ তরুণীকে শুধু গ্রাস করতে আসত! এ-সব দৃশ্য চোখে ভেসে উঠলে অতীশ স্থির থাকতে পারে না। স্যালি হিগিনসের সব কথাই শেষ পর্যন্ত মিলে গেছিল! সে এসে অগত্যা বিছানায় চিৎপাত হয়ে শুয়ে পড়ল।
আর তখনই খুট করে কিসের শব্দ। সে উঠে বসল হুড়মুড় করে। আর দেখছে চেয়ারটা তার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে আছে। চেয়ারটার মুখ ছিল দেয়ালের দিকে। বার বার সে মনে করার চেষ্টা করছে চেয়ারটা কি ভাবে ছিল। সে কি আগেই দেখেছে এ-ভাবে না খুট করে কেউ এখানটায় তার দিকে চেয়ার ঘুরিয়ে বসল। সে কেমন নিরুপায় চোখে চেয়ারটার দিকে তাকিয়ে আছে। সামান্য একটা চেয়ার এত বীভৎস হতে পারে! যেন কেউ বসে আছে, তাকে সে দেখতে পাচ্ছে না, অদৃশ্য এক মানুষ তার সঙ্গে এখনই কথাবার্তা শুরু করে দেবে। সে সাহসী হবার জন্য চেয়ারটার কাছে উঠে গেল। এবং সেটা দেয়ালের দিকে মুখ ঘুরিয়ে দেবার জন্য আরও বেশী সাহসী হবার চেষ্টা করছে। সে ঘামছিল। গলা শুকিয়ে উঠছে। মনে হবে এত ভারি চেয়ার যে তাকে সে কিছুতেই দেয়ালের দিকে মুখ ঘুরিয়ে দিতে পারবে না। সে থরথর করে কাঁপছিল তবু জোর করে চেয়ারটায় হামলে পড়ল। যেন সে কারো সঙ্গে ধস্তাধস্তি শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু তারপরই মনে হল চেয়ারটা ভীষণ হাল্কা। সে সহজেই চেয়ারটার মুখ ঘুরিয়ে দিতে পারল দেয়ালের দিকে। কেউ বসে নেই। ভারিও না। তারপরই সুদূর থেকে সেই মর্মান্তিক আর্তনাদ, ও ছোটবাবু, তুমি কি হয়ে যাচ্ছ। মুখে তোমার ডোরাকাটা বাঘের দাগ। তুমি আর্চি হয়ে যাচ্ছ।
প্লিজ বনি! তুমি এমন কর না। এখনও আমাদের খাবার ফুরোয় নি। এখনও আমরা কিছুদিন বেঁচে থাকব। নিথর সমুদ্র যতই হাহাকার করুক, এখনও আমরা আরো কিছুদিন বাঁচব। কিন্তু সে জানত বৃথা, স্যালি হিগিনসের সেই দৈববাণী সে শুনতে পাচ্ছে। হাহাকার সমুদ্রে মাথা ঠিক রাখা কঠিন। মরীচিকা ভাসতে দেখবে। দেয়ারফোর ইফ এ ঘোস্ট রাইজ বিফোর ইউ, ইউ হ্যাভ দা রাইট টু সে, সো, দেন, দ্য সুপারন্যাচারেল ইজ পসিবিল্। সুতরাং মনে রাখবে মাথা খারাপ হয়ে গেলেই সেই সব অতিপ্রাকৃত জীবেরা চোখের সামনে ভেসে উঠবে। দিস ইজ হ্যালুসিনেসান। মাথা ঠান্ডা রেখে সেই সব হ্যালুসিনেসানের হাত থেকে রক্ষা পাবার চেষ্টা করবে। সে বলল, বনি, তুমি অমন করলে আমি সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ব।
না না ছোটবাবু, বলে সে ছোটবাবুর দু’ হাঁটু জড়িয়ে ধরেছিল। আমাকে একা ফেলে যাবে না।
আমি তো আর্চি হয়ে যাচ্ছি।
ছোটবাবু মুখে তোমার কিসের দাগ ফুটে বের হচ্ছে। বলেই বনি পাগলের মতো ছইয়ের নিচে ছুটে গেল। তার প্রিয় আরশিটা নিয়ে এল। কিন্তু ছোটবাবু দেখল, মুখে কোন দাগ নেই। রোদে পুড়ে বিশ্রীভাবে কালো হয়ে গেছে মুখটা। ঝলসে গেছে মতো। সে সেই ছোটবাবু। দীর্ঘদিনের উত্তেজনায় চোখ কোটরাগত। শীর্ণকায় হয়ে গেছে কিছুটা। আর কিছু না। সে বলল, এই দ্যাখ, দ্যাখ না। কাছে এসে দেখ বনি, মুখে আমার কোনও দাগ নেই। তুমি ভুল দেখছ। রোদে পুড়ে আমরা শুধু ঝলসে গেছি।
তখন সমুদ্রে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। উত্তপ্ত অসীম জলরাশি নিথর। একটা ফড়িং উড়ে গেলে পর্যন্ত জলে ঢেউ উঠে যায় মতো আর নিরালম্ব সেই সীমাহীন আকাশ কেমন উত্তাপে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। বনি পাটাতনে উবু হয়ে বসে আছে। তার নীলাভ চুল উষ্কখুষ্ক। ক’দিন থেকে সে বিকেলে আর সাজতে বসে না। ছোটবাবুর মনে হয়েছিল, আগে থেকেই তার লক্ষ্য করা দরকার ছিল। সে তাকে সান্ত্বনা দেবার জন্য বলল, দেখবে আজকালের মধ্যেই কোন জাহাজ কিংবা জেলেডিঙি দেখতে পাব। বনিকে স্বাভাবিক করে তোলার জন্য বলেছিল, হ্যান্ড ফ্লাসটা ঠিক আছে ত! মনে রাখবে দেখা মাত্র সেটা জ্বালিয়ে দিতে হবে। মনে রাখবে হাওয়ার বিপরীত দিকে জ্বালতে হবে। বেলারটা কোথায় রেখেছ? ছোটবাবু, আমি সত্যি দেখলাম সহসা তোমার মুখটা আর্চির মুখের মতো ডোরাকাটা। আমি এটা কেন দেখলাম ছোটবাবু?
ছোটবাবু বলল, বিশ্বাস কর আমি জানি না। কেন দেখলে জানি না!
বাবা কিছু বলে দেন নি!
কি বলবেন?
এই অজানা সমুদ্রে মানুষ শয়তান হয়ে যায় কি না!
ছোটবাবু অনেক করেও শেষ পর্যন্ত কিছুই গোপন রাখতে পারছে না। বনি বুঝে ফেলেছে জাহাজ থেকে ওদের দুজনকে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। যত দিন যাচ্ছে বনি তত বেয়াড়া হয়ে উঠছে।
তুমি ছোটবাবু আর ছলনা কর না।
ছোটবাবু অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছিল। প্ল্যাংকাটন ধরার জন্য। নেট পেতে রেখেছে। বোটটা নড়ছে না। বোট না নড়লে, না চললে নেটে প্ল্যংকাটন আটকাবে না। সকালের দিকে সামান্য প্ল্যংকাটন প্লেটে নিয়ে বসেছিল। ছোটবাবু বনিকে চেষ্টা করেছে খাওয়াতে। নিজেও চেষ্টা করেছে খেতে। বনি মুখে দিয়েই বমি করে ফেলেছিল।
আরে করছ কি! বাঁ হাতটা নাকের কাছে ধর। ধর না! তাহলে বমি পাবে না।
বনি চুপচাপ ছোটবাবুর প্ল্যাংকাটন খাওয়া দেখছিল। সবুজ আঠা আঠা জলজ জীব জেলির মত বিস্বাদ এবং তিতকুটে। অথচ ছোটবাবু যে খুব রেলিশ করে খাচ্ছে!—খাও খাও না।
আমি পারব না। আঁষটে গন্ধ।
তোমরা সবই কাঁচা খাও। আর এটা খেতে আপত্তি কি!
খেলে কি হবে?
বাঁচবে।
কে বলেছে?
ছোটবাবু খুব স্থির গলায় বলল, স্যালি হিগিনস।
বাবা আর কি বলেছেন?
এতে খুব প্রোটিন আছে।
বাবা আমাদের ভাসিয়ে দিলেন কেন?
যদি কোনরকমে ডাঙা পাই।
তিনি এলেন না কেন?
ছোটবাবু কেমন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল।—তিনি না এলে আমি কি করব?
সারেংসাব?
আমি কিচ্ছু জানি না, কিচ্ছু জানি না বনি। তোমাকে যা বলছি তাই কর।
খাব না। সে প্লেট ঠেলে সরিয়ে দিল।
ছোটবাবু বলল, খাও, খেতে চেষ্টা কর। তোমার ভালর জন্যই বলছি। অসহায় ছোটবাবু আর কি বলবে বুঝতে পারল না। সকাল থেকে বনির মতো এলবারও কি যেন হয়েছে। সে আর সামনে উড়ে যাচ্ছে না। নিথর সমুদ্রে ঢুকেই সে কেমন আচমকা অন্যরকম হয়ে গেছে। সকালের দিকে দু’ একবার উড়ে গিয়েছিল, পাক খেয়ে আবার বোটে নেমে এসেছে। যেন কোন দিকে উড়ে যেতে হবে সে জানে না। ডাঙায় ফিরে যাবার শেষ আশা বলতে এই এলবা। হাওয়া নেই, পালে বাতাস লাগে না, উত্তপ্ত কাঁসার থালার মতো সমুদ্র আকাশ গনগনে হয়ে আছে। এক ভয়ংকর নৈঃশব্দ, আর বনির জেদ, এলবার চোখ কেমন অতিশয় বিভ্রান্তিকর। মৃত্যু খুবই কাছে সবাই যেন টের পেয়ে গেছে। আর তখনই বনি ছইয়ের নিচ থেকে ছুটে বের হয়ে আসছে।
কি হল বনি! কি করছ! বনি বনি!
ছোটবাবু বনিকে ঠেলেঠুলে আবার ছইয়ের মধ্যে নিয়ে গেল। গরমে বনির পিঠে বড় বড় ফোস্কা। দুটো একটা গলে ঘা হয়ে গেছে। একটা খাটো প্যান্ট ছাড়া বনি শরীরে কিছু রাখতে পারছে না। সে বলল, এমন করছ কেন?
হাওয়া নেই কেন ছোটবাবু?
বিকেলে হাওয়া দেবে। ছোটবাবুর যেন আর কিছু বলার নেই।
তোমাকে বাঁচাতে পারব না ছোটবাবু। সে এসে গেছে। তুমি টের পাচ্ছ না। কান্নায় ভেঙে পড়ল বনি।
কেউ আসে নি। তুমি যদি প্ল্যাংকাটন না খাও কাল থেকে আমি আর কিছু খাব না বলছি। বনি ছইয়ের ভিতর থেকেই সহসা আবার চিৎকার করে উঠল, এলবা আর্চির ছলনায় পড়ে গেছে। ওই আমাদের এই অজানা সমুদ্রে নিয়ে এসেছে। আমরা আর ডাঙা পাব না ছোটবাবু। লেট মি কিল হার। আই স্যাল কিল হার। পাগলের মতো বনি পাখিটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে গেলে ছোটবাবু টেনে আনল। তারপর দু-হাতে বুকে জড়িয়ে বলল, ওকে খুন করলে আমরা আরও একা হয়ে যাব। আমাদের সাহস দেবার মতো কেউ থাকবে না। না ঈশ্বর না শয়তান। এতসব ভাবতে ভাবতে তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল অতীশ জানে না।
আর সকালেই ঘুম থেকে উঠে অতীশ দেখল, মেঝেতে একটা চিঠি গড়াগড়ি যাচ্ছে। রাতে সে আর্চির ভয়ে কিছুই লক্ষ্য করেনি। আর্চি, বনি, ছোটবাবু সবাই মিলে তাকে জ্বালিয়েছে। চিঠিটার ওপর সে সারারাত পায়চারি করেছে অথচ টের পায় নি কোনও নীল খামের চিঠি কেউ তাকে আর পাঠাতে পারে। সে তাড়াতাড়ি খামটা ছিঁড়ে ফেলতেই দেখল, লেখা আছে কল্যাণবরেষু, বাবা অতীশ। বাবার চিঠি! কিন্তু না, হাতের লেখা বাবার না। নিচে দেখল, তোমার বড় জেঠিমা। বেশ দীর্ঘ চিঠি। চিঠি পড়ে সে হতবাক হয়ে গেল। বড় কাতর প্রার্থনা। তুমি অনুমতি দাও অতীশ! সবার অনুমতি নিয়েছি। তোমার জ্যাঠামশাইর পারলৌকিক কাজে শেষ অনুমতি তোমার। তুমি দিলে আমার না করে উপায় থাকবে না।
গোটা চিঠিটাই মার্মান্তিক। পড়তে পড়তে সে বিমূঢ় হয়ে পড়ল। সে বুঝতে পারছে, বড় জ্যাঠাইমার আর জীবনে কোন অবলম্বন থাকবে না। সকালে উঠেই জ্যাঠাইমা জানালায় দাঁড়ান, দূরের মাঠ দেখেন, যেন কোনও সুপুরুষ কৃতী মানুষ মাঠ পার হয়ে দীর্ঘদিন নিরুদ্দিষ্ট থাকার পর ফিরে আসছেন। হাতে রাজার চিঠি। হাতে নীল লন্ঠন। নিরুদ্দিষ্ট স্বামীর সেই মুখ এবং অবয়ব নিয়ে জ্যাঠাইমার জীবন কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু সংসারে ভারি বিপত্তি দেখা দিয়েছে। বড়দার গঞ্জনা বৌদির গঞ্জনা, বড় অনাচার। জ্যাঠামশাইর পারলৌকিক কাজ না করায় সংসারে অসুখ বিসুখ ছাড়ছে না। দু-যুগের ওপর যে মানুষ নিখোঁজ, তাঁর আত্মার সদগতি দরকার। পিন্ডদানে প্রেতাত্মা মুক্তি পায়। সংসারে তবে অশুভ প্রভাব থাকে না। বড়দা, জ্যাঠামশাই, বাবা, ছোটকাকার সবারই ইচ্ছে আর অপেক্ষা করা ঠিক না। সংসারে কখন কোন দিক থেকে সেই অতৃপ্ত আত্মা প্রভাব বিস্তার করবে কে জানে। তার কুশপুত্তলিকা দাহ, পিন্ডদান এবং পারলৌকিক কাজের জন্য জ্যাঠাইমার ওপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। জ্যাঠাইমা মনে করছেন, সেই শেষ মানুষ যে অনুমতি দিলে, তিনি মুখ বুজে জীবনে বৈধব্য মেনে নেবেন। চিঠিটা শেষ করেছেন, বাবা অতীশ, শৈশবে তুমি ছিলে তাঁর জীবনের প্রিয় সঙ্গী। কেন জানি মনে হয়েছে হাঁ বা না করার প্রকৃত উত্তরাধিকার তোমার। তুমি আমাকে বল, এখন আমি কি করব।
তারও যে বিশ্বাস পাগল জ্যাঠামশাই আবার ফিরে আসবেন। হাতে তাঁর নীল লন্ঠন। শুধু ঠিকানা হারিয়ে ফেলেছেন বলে ফিরতে পারছেন না। যেমন ছোটবাবু আর বনি একবার পৃথিবীর ঠিকানা হারিয়ে ফেলেছিল। মানুষের ঠিকানা না থাকলে কিছুই থাকে না। সে চিঠিটা সামনে নিয়ে বসে আছে। দূরের এক জগৎ, অর্জুন গাছ, তরমুজের খেত, সোনালী বালির নদী, ফতিমা এবং সেই সুপুরুষ মানুষের যাত্রা, কখনও হাতিতে চড়ে, যখন নীলনদ পার হয়ে কখনও কোন গভীর দ্বীপের মাঝে দাঁড়িয়ে আছেন। এখন সে দুজন পাশাপাশি মানুষ দেখছে। স্যালি হিগিনস আর পাগল জ্যাঠামশাই। তারা একই দ্বীপে দাঁড়িয়ে থেকে হাত তুলে যেন বলছেন, আমাদের সমুদ্র পার করে দাও।