1 of 2

ঈশ্বরের বাগান – ২১

।। একুশ।।

ওরা দু’জন পাশাপাশি বসেছিল। দুমবার গাড়ি চালাচ্ছে আজ। শহরের পাশেই গঙ্গা, গঙ্গার ওপারে চটকল, জেটি, চিমনি এবং পাখিদের উড়ে যাওয়া। আকাশে কোন মেঘমালা নেই। মেঘের ভাসাভাসি নেই। মানুষজন গাড়ি ট্রাম বাস নিত্যদিনের মতো চলাফেরা করছে। অমলা তাকে কোথাও নিয়ে যাচ্ছে। সে অমলাকে প্রশ্ন করেছিল, আমায় কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? অমলা আড়চোখে তাকিয়ে বলেছিল, ভয় পাচ্ছিস! মেরে ফেলব না। অমলা আরও কত কথা বলেছিল। যেন অতীশ এক সুবোধ বালক, কিছু বোঝে না। কলকাতার কিছুই চেনে না। যেন বলার ইচ্ছে এই হর্মমালার মধ্যে কত বিচিত্র মানুষ, বিচিত্র জীবন, চোখ খুলে দ্যাখ। জাদুঘর, হাওড়ার পুল, লাট ভবন, গড়ের মাঠ, এবং রেড রোড তারপর এই ফোর্ট উইলিয়ামের দুর্গ—সবটাই এক মায়াবী জগৎ।

জাহাজে যাবার আগে এই রাস্তায় তার মনে হয়েছিল একবার, অমলা কমলা কত বড় হয়েছে কে জানে! অমলা কমলা এই শহরেই থাকে। এমনও সে ভেবেছিল। এই একটা কারণেই কলকাতাকে অতীশের নিজের শহর মনে হয়েছিল সেদিন। না হলে, পৃথিবীর সব শহরের মতোই কলকাতা তার কাছে দূরের নগরী। সহজেই নামগোত্রহীন হয়ে যাওয়া যায় এখানে এলে। সে সেদিন নামগোত্রহীন এক তরুণ, তবু শহরটা অমলার কথা ভেবে ভারি মায়াবী লেগেছিল।

বিড়লা প্ল্যানেটরিয়ামের পাশ দিয়ে গাড়ি বাঁক নিল। অমলা বলল, চিত্রাঙ্গদা নাটক দেখতে যাচ্ছি। একা ভাল লাগছিল না।

—রাজেনদা?

—তোর দাদার তো কত কাজ। একদম সময় পায় না। বিকেলের ট্রেনে মাইনসে গেছে। অতীশ জানে, এদের এখনও কিছু খনি এলাকা আছে। ভাল আয়। তবে বিহার সরকারের সঙ্গে লিজ নিয়ে কি খটমট চলছে। ক’দিন বাদে বাদেই হেড অফিসের বাবুরা দৌড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে রাজেনদা যায়। রাজেনদার, সেক্রেটারি দেবেনবাবু সঙ্গে থাকেন। সেখানে গেস্টহাউস আছে। একবার তাকেও সঙ্গে নিতে চেয়েছিল। জমিদারি যাওয়ার পরও কত বড় অধীশ্বর তিনি তাকে যেন তাই দেখাতে চেয়েছিল। অতীশ বলেছিল, আপনি ত প্রায়ই যান, একবার গেলেই হবে। এবং অদ্ভুত সব কথা কখনও রাজেনদার, তখন মনেই হয় না এই মানুষটা তার অধীশ্বর, এই মানুষটা আগামীকাল তাকে ভিখারি বানিয়ে দিতে পারে। বুঝলে ভাইয়া, চোখ কান খোলা রাখো। তোমার কিছুটা গ্রাম্যতা আছে। শহরে ঘুরে ফিরে সব দেখ। আমার সঙ্গে চল। সাঁওতাল এলাকায় নিয়ে তোমাকে ঘুরব। রসদ পাবে। কলকাতা নিয়ে লেখার কিছু নেই। এখানকার মানুষ বড় অন্তঃসারশূন্য। তার স্ত্রী এই অমলা। মেজাজ মর্জি বোঝা ভার। অফিসে সারাটাক্ষণ সে যে দুর্ভাবনার মধ্যে ছিল, অমলার গাড়িতে উঠতেই তা হাওয়া। অমলা আজ বড় হাসিখুশি। ওর নাক ঘামছিল। নাক ঘামলে মেয়েদের বড় সুন্দর লাগে দেখতে। নাকে মুক্তোর নাকছাবি জ্বলজ্বল করছে। হাতে দুগাছা সোনার চুড়ি আর সেই হীরের আংটি এবং মুখে কেমন নীলাভ রঙ। তার হাত ধরে বলেছিল আয়। যেন এমন ডাক কতকাল সে শোনেনি। এমন অন্তরঙ্গ আপ্যায়ন থেকে সে কতকাল বঞ্চিত।

অতীশ বলল, আমার নাটক দেখতে ভাল লাগে না অমলা!

—তবে কোথায় যাবি?

—কোথায় যাব জানি না। আমি ভেবেছিলাম, কোন জরুরী কথাবার্তা আছে, তাই ডেকেছ।

—সব সময় জরুরী কথাবার্তা থাকতেই হবে তার কি মানে আছে! আমার সঙ্গে একবেলা ঘুরতেও তোর কষ্ট। তা-ছাড়া কথাবার্তা তোর সঙ্গে আমার কী হতে পারে!

অতীশ চুপ করে থাকল।

অতীশ সামান্য আলাগা হয়ে বসেছে। রাজবাড়ির গাড়িতে বউরানীর সঙ্গে অন্য কেউ যাচ্ছে ভাবাই যায় না। এটা বাড়ির মর্যাদার প্রশ্ন। কিন্তু অমলা রাজবাড়িতে তাকে দুমবারের পাশে বসিয়ে নিয়েছিল। রাজবাড়ি পার হয়ে যখন গাড়ি এয়ার ইন্ডিয়া অফিসের কাছাকাছি এল, তখনই অমলা বলল, গাড়ি থামাও দুমবার। তারপর দুমবারকে পেছনে পাঠিয়ে অমলা নিজেই স্টিয়ারিং ধরল। এদিক ওদিক ঘুরল শহরের। একটা হোটেলে রিসিপসানিস্ট মহিলার কাছে গিয়ে কি বলে এল। তারপর রবীন্দ্রসদনের সামনে আসতেই আবার গাড়ি থামিয়ে দুমবারের হাতে স্টিয়ারিং দিল। কিন্তু তারপর অতীশের কথাবার্তা শুনে কি ভাবল কে জানে, সে কিছুটা গিয়েই ফের বলল, দুমবার তুমি বাড়ি চলে যাও। অতীশকে নিয়ে তোমার কমলা বহিনজির কাছে যাচ্ছি। শঙ্খকে বলে দিও, আমরা ওখানেই খাব। নধরবাবুকে বলে দিও, আমার ফোন এলে যেন বলে কমলার বাড়ি গেছি।

অতীশ সব শুনছিল। অমলা এত সুন্দর কথা বলতে পারে, অমলা এত রূপবতী যুবতী যেন হাত দিলেই কোনও মিউজিকের মতো বেজে উঠবে সে। নির্মলার জন্য ভারি কষ্ট হতে থাকল। নির্মলা তাকে ফেলে চলে গেছে।

রেসকোর্সের পাশে এসেই অমলা বলল, গাড়ি চালানোটা শিখে নে না!

—কে শেখাবে?

—কেন আমি।

—তাহলেই হয়েছে।

—তুই কি ভাবিস বলত! গাড়ি কি ঠিক চালাচ্ছি না!

—গাড়ির আমি কিছু বুঝি না অমলা।

—ক’দিন চালালেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

—তোমার ড্রাইভার অনেক। কাবুলবাবু আছে। তাছাড়া বাড়তি আবার আমাকে কেন!

—এই মারব। তুই আমার ড্রাইভার হবি বলেছি!

অতীশ বলল, আমি এখন সব কিছু হতে রাজি অমলা। যেন সেই পাপ থেকে আরও বড় পাপে ডুব দেবে বলে সে কঠিন মুখ করে রাখল।

—একদম মুখ গম্ভীর করবি না। আয় এখানটায় হাঁটি। বলে দরজা খুলে বাইরে বের হয়ে এল। খোলা আকাশের নিচে বালিকার মতো আচরণ করছে অমলা। এই আয় না। দৌড়াই।

—লোকজন আছে। তুমি রাজবাড়ির বৌ!

—কেউ চেনে না। বাড়ির পাশের লোকই খবর রাখে না আর এখানে। এই আয়। তোর বৌ চলে গেছে বলে মন খারাপ!

—ওতো বাপের বাড়ি গেছে!

—ওর কি অসুখ রে!

অতীশ এ কথার জবাবে বলতে পারত অনটনের অসুখ। আমার চলে যায়। কিন্তু ওর চলে যায় না। মিণ্টুকে ভাল ইস্কুলে দিতে না পারায় ক্ষোভ রয়ে গেছে ভেতরে। নীল রঙের গাড়ি আসবে, গাড়িতে মিণ্টু ইস্কুলে যাবে, আবার নীলরঙের গাড়ি আসবে, গাড়ি মিণ্টুকে দিয়ে যাবে—নিৰ্মলা তাই চেয়েছিল। আমার ক্ষমতার বাইরে। নির্মলা হাত ধরে নিয়ে যায়, আবার হাত ধরে নিয়ে আসে। নির্মলা এটা চায় না। নির্মলার ভেতরে কষ্ট। সে বলল, অসুখটা কি জানি না। মাইনর অপারেশন দরকার। তবে এখনও নাকি সময় হয়নি।

—অপারেশন কোথায়?

অতীশ সোজাসুজি বলল, জরায়ুতে।

অমলা বলল, তোর খুব কষ্ট?

—আমার কষ্ট হবে কেন!

—তুই পুরুষমানুষ না?

—অমলা!

—চল হাঁটি।

খোলা মাঠ সামনে। সবুজ ঘাস। দূরে দূরে গাছপালা। টাটা সেন্টারের অতিকায় বাড়ি। কাচের ঘর, সারি সারি সব অট্টালিকা রঙ-বেরঙের এবং মাথার ওপরে নিরন্তর আকাশ। সূর্য অস্ত যাচ্ছে, লাল আভা, অদূরে কোথাও জাহাজের মাস্তুলের মাথায় লম্ফ জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। নামাজ পড়ছে কেউ ডেকে। পুরানো এক জীবন, নীল জলরাশি, অমলা হেঁটে যাচ্ছে বালিকার মতো। কার্পেটের চটি পায়। নরম সবুজ ঘাসে ওর পায়ের ছাপ। সুদূরের শ্যাওলা ধরা ঘরের বালিকার এখন শরীরে অনন্ত যৌবন। গোপন অন্তর্যামীর মতো সে কোনও পোকার আশ্রয়ে অমলার ঊরু বেয়ে এখন ওপরে উঠে যাচ্ছিল। যত যাচ্ছিল, তত শীত শীত করছে। হাত-পা ঠান্ডা। জ্বর আসছে মতো। যত ঊরু থেকে জঙ্ঘার নিকটবর্তী হচ্ছে পোকাটা, তত সে কেমন ভিতরে ভিতরে কাঁপছিল। অমলা তুমি আমাকে মেরে ফেলতে পার। মিহি নরম রাবারের মতো যা কিছু আমায় ছুঁতে দিয়েছিলে, সে এখন কেমন আছে অমলা। সে অমলার সঙ্গে যেন হেঁটে পারছে না! তার পা স্থবির হয়ে আসছে কেন। সে এখানেই মাথা-ফাতা ঘুরে পড়ে যেতে পারে। পোকাটা গম্ভীর চালে এগিয়েই যাচ্ছে। সে সহসা ডেকে উঠল, অমলা।

অমলা পিছন ফিরে দেখল। এবং ওর আঁচল শ্লথ। সুন্দর বর্ণমালার মতো সে অধীর চোখে তাকিয়ে বলল, তোর শরীর খারাপ।

—আমার শীত করছে অমলা।

অমলা কাছে এসে ওর কপালে হাত দিল। কিছু বুঝতে পারল না। ভেতরে কিছু হচ্ছে অতীশের। সে এবার আরও সংলগ্ন হয়ে গাল ঠেকাল অতীশের গলায়। উষ্ণতার রকমফের টের পেতে গিয়ে বুঝল, অতীশের তাপ উঠেছে! বড় সুসময়।

অমলা বলল, তা বোস।

অতীশ বসল না। বলল, আমি যাব।

—কোথায়!

—আমার কাজ আছে।

—আজকের মতো কাজটা থাক। তোর মন ভাল নেই। অফিসে ধূপকাঠি জ্বালিয়ে বসেছিলি! তোর কেন এটা হয়। প্রেতাত্মা তোকে নাকি তাড়া করে?

—প্রেতাত্মা?

—নির্মলা যে বলল!

—কি বলেছে নির্মলা?

এখন অমলা বুঝতে পারল, তার কথাটা বলা ঠিক হয়নি। সে বলল, তুই এত কষ্ট পাস কেন?

—কষ্ট পাই? কোথায়!

—আমি সব বুঝি। সংসারটা সরল নয় এও বুঝি। ছেলেপেলে হয়েছে, বুঝে চলতে শেখ। তোর কিছু হলে ওরা তো ভেসে যাবে।

অমলা প্রায় এবার অতীশের হাত ধরে জোর করে বসিয়ে দিল। শোন, আমার কথা ভেবে দেখ। আমিও ভাল নেই। কই আমি তো তোর মতো মুখ গোমড়া করে রাখি না। মাথা খারাপ করি না।

অমলা ভাল নেই কথাটা শুনে অতীশের কেমন হাসি পেল। শরীর জ্বলছে অমলার। সারা শরীরে আগুন। যে কেউ এই যুবতীকে একা গোপনে পেলে এখনই ধর্ষণ করতে পারে। সে যত সাধু-সন্ত হোক, ভাল মানুষ হোক, তার উপায় নেই। পতঙ্গের মতো উড়ে এসে পড়বেই এবং অগ্নিকুণ্ডের কাছে সে এখন পতঙ্গের শামিল। নির্মলা যদি জরায়ুতে অসুখ না বাধাত! আসলে মানুষের রক্তে গোপন এক জন্ম রহস্যের মন্থন চলছে। সে বার বার প্রকাশ পেতে চায়। বারবার তার অধীর আক্রমণ। আক্রমণ করতে না পারলে ভেতরের রক্ত কণিকা মরিয়া হয়ে ওঠে। ক্ষেপে থাকে। যে-কোন দুর্গম পথই সুগম করে তোলে। সে এ-মুহূর্তে আর্চির চেয়ে কম দুরাত্মা নয়। আসলে এটাই বোধহয় অমলার কাছে ভাল না থাকা।

সে বলল, আমি ভাল আছি অমলা। তুমি আমাকে ছেড়ে দাও।

—আৰ্চিটা কে বল? না বললে ছাড়ছি না।

—তুমি চিনবে না ওকে। বললেও বুঝতে পারবে না!

—তোর মনে আছে? বলেই অমলা কেমন মাথা নিচু করে দিল।

—কার কথা বলছ?

—যেদিন শ্যাওলা ধরা ঘরটায় তোকে নিয়ে গেছিলাম?

—মনে আছে। এক কথা কতবার বলবে! অতীশও মাথা নিচু করে দিল।

—সে-রাতে তুই দুঃস্বপ্ন দেখেছিলি?

—বোধ হয়।

—সকালে নদীর পাড়ে হেঁটে গেছিলি।

—মনে আছে।

—কেন গেছিলি বল?

—তখন একটা বিশ্বাস ছিল। তখন বড়দের সব কথাই মনে হত সত্যি কথা। মা বলতেন, দুঃস্বপ্ন দেখলে জলের কাছে নদীর কাছে, সব বলে দিস। কোনো অমঙ্গল হবে না। দুঃস্বপ্ন সত্য হবে না।

—এখনও তাই। যা দেখিস, প্রিয়জনকে বল। আমি যদি না হই, নির্মলা, নির্মলা না হলে ভুইঞা দাদু। বাড়িতে এত সব পুণ্যবান মানুষ থাকতে তুই আহাম্মকের মতো কষ্ট পাচ্ছিস কেন?

অতীশ কিছু বলল না। সে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। অমলার ভ্রু প্লাক করা। মিহি নরম ডিমের কুসুমের মতো ভূতে লাবণ্য। সারা মুখে শরীরে এই আগুনে রঙ এবং মুখশ্রীর সুষমা তার শরীরে কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়েছে। কতদিন যেন সে নদী পার হয়ে বড় মাঠে যায় নি। কতকাল যেন সে একা বসে আছে কোন নির্জন গাছের নিচে। অমলা সেই গাছের নিচে এসে হাত-পা মেলে দিয়েছে। কোনও ব্যালেরিনার মতো নেচে নেচে যাচ্ছে। হাত তুলে, পা তুলে কি করছে। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে কোন বসন নেই, ভূযণ নেই। নারীর নগ্ন রূপ তাকে বড় কাতর করে। চোখ বুজলেই সে সব হুবহু দেখতে পায়। শীত আরও বাড়ে। আর তখনই শুনতে পায় কেউ ডাকে, বাবা। বাবা তোমার শীত করছে! বাবা আমি বুকে তোমার মুখ রাখব। তুমি উষ্ণতা টের পাবে। শীত করবে না। কার গলা! অবিকল মিণ্টু, সরল শিশু বাবাকে ছাড়া থাকতে পারে না। কষ্ট হয়। বাবার ফিরতে দেরি হলে জানালায় ওরা উঠে দাঁড়িয়ে থাকে। বাবাকে দূর থেকে দেখতে পেলেই নাচতে শুরু করে দেয়। আমার বাবা, আমার বাবা।

আর অমলা তখনই দুম করে বলে ফেলল, অতীশ, তুমি আমার বাল্যসখা। ভেবে দেখ, সেই বয়সে তেমন কিছু বুঝতাম না। তোকে দেখে আমি কেমন হয়ে গেছিলাম। তোকে দেখতে না পেলে কষ্ট হত। গোপনে সারা বাড়িতে তখন তোকে খুঁজে বেড়াতাম। কাছারি বাড়ি থেকে কমল তোকে ধরে আনত।

অতীশের সবই মনে পড়ছে। সেই গোপন গভীরে তারপর কেমন ভয় সংকোচ, পাপবোধ, সন্ধ্যায় একা একা নদীর পাড়ে দীঘির ধারে বসে থাকা। পিলখানায় পাগল জ্যাঠামশাইর হাত ধরে চলে যাওয়া। মনে বড় শঙ্কা। কিছু একটা ঘটবে। মাকে ছেড়ে দূরবর্তী এক জমিদার প্রাসাদ তখন বনবাসের মতো। কেবল ভয় তার পাপে মার যদি কিছু হয়। সে হয়ত গিয়ে মাকে আর দেখতে পাবে না। ঈশ্বর রাগ করেন যদি। মা বাদে সে পৃথিবীতে তখন আর কিছু বুঝত না। এবং রাতে সেই দুঃস্বপ্ন। সাদা চাদরে ঢাকা মার শরীর। শীতকাল। কুয়াশা উঠোনে। মাকে বের করে রাখা হয়েছে উঠোনে। সে কাঁদছে না। যেন মা বলছে সোনা তুমি এটা কি করেছ। তুমি খারাপ হয়ে গেলে কেন! আমি চলে যাচ্ছি। সাদা চাদরে মার পা ঢাকা নেই। শীত করছে। পায়ে ঠান্ডা লাগছে। সে মার পা দুটো চাদর টেনে ঢেকে দেবার সময় মুখটা বের হয়ে এল। স্থির চোখ। ঘুমিয়ে নেই। আকাশ দেখছে মতো তাকিয়ে আছে। এবং তখনই ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। জ্যাঠামশাই ডাকছে, ওঠ সোনা। হাত-মুখ ধুয়ে নে। সে উঠেই কাঁদতে বসেছিল। তারপরও কি কান্না।

জ্যাঠামশাই বলেছিলেন, বাড়ির জন্য মন খারাপ করছে। কাল দশমী। তারপরই চলে যাবি। অলিমদ্দি নৌকা নিয়ে আসবে।

কমল এসে বলেছিল, ও মা তুই কি ছেলেরে? মার জন্য কাঁদছিস। আমরা মাকে ছেড়ে এসে থাকছি না। মাকে ছেড়ে থাকতে আমার, দিদির কষ্ট হয় না! আমরাও তো বাবার ছুটি শেষ হলে চলে যাব। তারপরই সেই ঘটনা। অতীশের সব মনে পড়ছে। দশমীর রাতে হাতিতে দশহরা দেখতে যাবার কথা। বিসর্জনের বাজনা বাজছিল। প্রতিমা বিসর্জন যাবে। হাতির পিঠে চড়ে ওরা যাবে দশহরা দেখতে। কিন্তু কিসে কি হয়ে গেল। হাতি আর এল না। অমলা কমলাকে সে আর দেখতে পেল না। কোথাও একটা কিছু হয়েছে। পরে সে জেনেছিল, সে-রাতেই অমলার মা মারা যায়।

অতীশ মুখ তুলে এবার বলল, সকালেই শুনলাম তোমরা চলে গেছ ভোর রাতের স্টিমারে। মাকে তুমি হারিয়েছ।

মার কথা আসতেই অমলার চোখ ছলছল করে উঠল। বলল, ওটা কি আমার পাপে?

—ঠিক জানি না অমল। কোন পাপে কি হয় জানি না।

অমল বলল, মার একটা প্রিয় হেমলক গাছ ছিল। ফাঁক পেলেই তার নিচে চুপচাপ বসে থাকতেন। কার জন্য যেন তাঁর নিশিদিন অপেক্ষা। সে আসবে। সেটা কে আমরা জানতে পারি না। বাবাও জানতেন না। বোধ হয় মার কাছে সেই ছিল ঈশ্বর। শেষ দিকে বুঝি বুঝতে পেরেছিলেন, সে আর আসবে না। মা বিছানা নিলেন। আমরা কলকাতায় ফিরে মাকে আর দেখতে পেলাম না। আমার পাপে হয়েছে আমি বিশ্বাস করি না! পাপ পুণ্য আবার কি। সব মিছে কথা।

অতীশ বলল, কত ছেলেমানুষ ছিলাম। এখন বুঝতে শিখেছি তিনি কেউ নন। তিনিও মানুষের সৃষ্ট আর এক প্রেতাত্মা। আমি তাকে ভয় পাব কেন?

—কার কথা বলছিস রে?

—এই ঈশ্বর নামক জুজুর ভয়ের কথা। তাকে আমি আজীবন অগ্রাহ্য করে যাব।

—কেন কেন?

গলায় ভারি আগ্রহ অমলের।—মানুষের এত বড় আশ্রয়কে তুই অগ্রাহ্য করবি। তুই কি কম্যুনিস্ট। কাবুল বলছিল ওর দাদাকে, তোমরা শেষ পর্যন্ত একটা পাঁড় কম্যুনিস্টকে ধরে এনেছ!

—আমি কম্যুনিস্ট!

—কাবুল কুম্ভ রাজবাড়ির সবাই তাই ভাবছে। তোর রাজেনদা এটাকে বড় ভয় পায়। আমাকে বলল, দ্যাশের পোলার খবর রাখ!

অতীশ বলল, অমল, জীবনে সে-সময় পাইনি। ঈশ্বর বিশ্বাস না থাকলেই কম্যুনিস্ট হওয়া যায় জানতাম না।

—ওরা তাই বলছে। তুই এসেই শ্রমিকদের পক্ষে ওকালতি করছিস। ঘুষ দিতে চাস না। দু নম্বরী মাল বন্ধ করেছিস। এ-সব করলে চলবে কি করে! রাজেনের ত আর জমিদারী নেই, বছর বছর লোকসান দিয়ে যাবে। কোটা বের করতে হলে ঘুষ দিতে হবে, ইমপোর্ট লাইসেন্স পেতে হলে ঘুষ দিতে হবে। না দিলে খোলা বাজার থেকে বেশি দামে মাল কিনতে হবে। তুই ভেবে দেখেছিস সব এমনিতেই রাজেনের ভয় যা দিনকাল তাতে সে কমনার হয়ে যাবে। রাতে ভয়ে ঘুমায় না। ব্যবসায় যদি কিছু হয় এই ভেবে তোকে আনা।

অতীশ বুঝতে পারছে এটা কুম্ভর কাজ। কম্যুনিস্ট বলে চালিয়ে দিতে পারলে তার আখের তাড়াতাড়ি খুলবে। দিন রাত ফেউয়ের মতো লেগে থাকলে সে যে কি করে! এ-সময় তার মেজাজ রুক্ষ হয়ে উঠল। সে বলল, এই তোমার বলার ছিল!

—আরে না না।

অতীশ উঠে পড়ল। অমলা তাকে ধরার জন্য যেন নিজেও উঠে পড়ল। প্রায় ছুটে ছুটে যাচ্ছে। আকাশে জ্যোৎস্না সামান্য। ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে। জোর হাওয়ায় অমলার বব করা চুল স্বর্ণলতার মতো দুলছে। এবং স্তন ভারি মজবুত। জ্যোৎস্নায় তা আরও রোমহর্ষক হয়ে উঠছে। এই সব দেখলেই শুনতে পায় কেউ ডাকে, বাবা বাবা। সে বলল, অমল তুমি যাই কর, আমাকে এক পাপ থেকে আর এক পাপে নিয়ে যেও না। তাহলে আমার শিশুরা বড় অসহায় হয়ে পড়বে।

সে বুঝতে পারছে যত দিন যায় মা বাবা দূরে সরে যায়। দূর থেকে আবার কারা হেঁটে আসে। কাছে দাঁড়ায়। দু’হাত বাড়িয়ে দেয়, এই যে বাবা আমরা। মানুষ বুঝি একা বেঁচে থাকতে পারে না। এদের ফেলে সে আর কোথাও যেতে পারবে না! অমলের শরীরে যতই আকর্ষণ থাকুক সে বুঝতে পারে শুধু কাতর হওয়া ছাড়া তার অন্য উপায় নেই। সে অমলাকে বলল, তুমি জান না অমল, একজন সাচ্চা কম্যুনিস্ট তোমাদের ঈশ্বরের চেয়েও বড়। ঈশ্বর তার দাসানুদাস। মানুষ সেখানেই যেতে চায়। কিন্তু পারে না। শরীরের রক্ত মাংসে নানাবিধ পোকা ঘুরে বেড়ায়। পোকার কামড় বড় কামড়।

অতীশ এমন কথা বলতে পারে। নানাবিধ কথাটা গুরুগম্ভীর। এই নানাবিধ বলে সে যেন অনেক কিছু বোঝাতে চাইছে। এই নানাবিধ কথার মধ্যেই আছে, ব্যক্তিগত সুখ, লোভ মোহ ইন্দ্রিয়পরায়ণ হওয়া। নিজ এলাকার মধ্যে এক বড় উঁচু পাঁচিল দাঁড় করিয়ে দেওয়া। এক দৈত্য সদর দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে। তার মুখ হাঁ করা। শুধু খাব খাব করে। সব খাব। সব হরণ করব। শোষণ করব। রাজেন এখন গুপ্ত লকারে অজস্র কালো টাকা ভরে ফেলছে। যেখানেই হাত দেয় সেখানে ভুযো কালির মতো পাহাড় হ’য়ে যাচ্ছে গুচ্ছ গুচ্ছ বান্ডিল। বিদেশে এজেন্ট নিয়োগ, টাকা সংগ্রহ, ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স এ- সবের জন্য তার ছোটাছুটির অন্ত নেই। তার ধারণা তাকে কমনার করে দেবার জন্য সবাই উঠে পড়ে লেগেছে। তার বৈভব যত হরণ করে নিতে চাইছে তত সে মরিয়া হয়ে উঠছে। বিদেশ যাচ্ছে কথায় কথায়। যারা এ-দেশে টাকা পাঠিয়েছে, তাদের সে তালিকা তৈরী করছে। এখানে রাধিকাবাবুর কাছে থাকে আর একটা তালিকা। তালিকা অনুযায়ী বাড়ি বাড়ি সে টাকা পৌঁছে দেয়। এই গুপ্ত লেন-দেনে বড় অঙ্কের একটা টাকা বিদেশের ব্যাঙ্কগুলিতে ফেঁপে উঠছে। যে-কোন সময় তাকে যেন দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে। অমলের তখন হাসি পায়। এখনও রাজেন নিজেকে রাজপুরুষ ভাবে। কুমারবাহাদুর না বললে মনে মনে চটে যায়। রাজেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর চেয়ে কুমারবাহাদুর নামটা স্বভাবে বেশি আটকে আছে। অতীশ এসেই জারিজুরি সব ভেঙে দেবার চেষ্টা করছে। মানসও করেছিল। পারেনি! পাগল হয়ে গেল। অতীশ কতটা আর পারবে। সে অতীশের পাশে পাশে চুপচাপ হেঁটে যাচ্ছিল আর এমন সব আকাশ পাতাল ভাবছিল।

গাড়ির দরজা খুলে অমলা বলল, বোস। তারপর ঘড়ি দেখল। –আমরা এক সঙ্গে খেয়ে বাড়ি ফিরব।

কমলের বাড়ি যাচ্ছ?

—না।

—তবে কোথায়?

—চল না।

অমলার পাশে দু’হাত ছড়িয়ে বসেছিল অতীশ। সেই থেকে বাবা বাবা ডাকটা শুনে আসছে। ঘুষ দেবার সময় থেকে। এখনও ডাকটা শুনতে পাচ্ছে। সে বলল, কোথাও ফোন করা যাবে অমল।

অমলা কেমন চুপ করে থাকল।

আলোর মালা পরে আছে শহরটা। অমল গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে। দু-পাশে অজস্র গাড়ি ট্রাম বাস। সুখী মানুষজন। ফুটপাথে অজস্র নাম গোত্রহীন মানুষ। আকাশের দিকে মুখ করে শুয়ে আছে। কিছুই • করার নেই। শুধু হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে থাকা। হাঅন্নের জন্য বসে থাকা। কোথাও খরা চলছে লোকজন গাঁ গঞ্জ থেকে চলে আসছে দু-মুঠো ভাতের আশায়। যেন ঠিক সেই বাবার প্রথম ছিন্নমূল হওয়ার সময়, সেই বাড়ি ঘর বানানোর সময়, এবং অন্ন মানুষের বড়ই প্রিয় বিষয়। খাপছাড়া অসংলগ্ন কিছু চিন্তা অতীশের মাথায় ঘুরছে। তার ইচ্ছা হচ্ছিল অমলকে অপমান করে। যেন তাকে অপমান করেই সব শোধ তুলতে চায়। মানসদার সেই নাক টানা, ওফ কি পচা গন্ধ! পচা টাকার গন্ধ। সুখী লোকজন গাড়ি প্রাসাদ বিলাস এবং অপচয় দেখলেই তারও গন্ধটা নাকে লাগছে। আর্চির চেয়ে সেটা কম দুর্গন্ধযুক্ত নয়। কিন্তু কি যে আছে মনে! অমলের প্রতি তার এত দুর্বলতা এতদিন কোথায় ছিল! অমলকে ত সে প্রথমে ঠিক চিনতেই পারেনি। তার শরীরের যৌন আকাঙ্খা অমলের সেই অংকুরউদগমের সময় থেকে, আজ তা মহীরুহ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু মাঝের এক বিরাট ফাঁকা প্রান্তরে বৃক্ষহীন হয়ে সে বেঁচে ছিল। বৃক্ষহীন কথাটা ভাবতেই তার কেমন কাঁটা দিয়ে উঠল ভিতরটা। দু’হাত তুলে দূর থেকে আসছে এক বালিকা, ফ্রক গায়ে, সেই কেবিন। কেবিনের দরজা খুলেই ছোটবাবু ভূত দেখছে। সেই শয়তান ছেলেটা কেবিনে বালিকা সেজে বসে আছে। ছোটবাবু চিৎকার করে উঠেছিল, আবার তুমি জ্যাক! এবং সেই ঘন্টাধ্বনি মাথায়, যেন অসীম অজ্ঞাত অনন্তকালের ঘন্টাধ্বনি মাথায়। সারা সমুদ্র সফর জ্যাক তাকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। সেই জ্যাক, কেবিনে বালিকা সেজে বসে আছে। সে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠতে থাকল। জ্যাক, তুমি আবার বালিকা, চাতুর্যে মনোহারিণী, তুমি আমায় আর কত নির্যাতন করবে! তারপর কেমন পাগল পাগল লাগছিল তার। সে উন্মাদের মতো বালিকার গাউন ছিন্নভিন্ন করে দিলে, জ্যাক কেঁদে ফেলেছিল। বলেছিল, আমি বনি ছোটবাবু আমি মেয়ে, তুমি বিশ্বাস কর আমি মেয়ে।

আর ছোটবাবুর মাথায় তেমনি ঘন্টাধ্বনি। পাহাড়ের উৎরাই পার হয়ে সে কোনও জলদস্যুর মতো উঠে যাচ্ছে। হুঁশ নেই। সে দেখতেও পাচ্ছে না ঠিক হাতের নিচে অসংখ্য তরঙ্গমালা সমুদ্রের, ছিঁড়ে ফেললেই প্রলয়ংকর ঘটনা ঘটে যাবে পৃথিবীতে। দু’হাতে সুন্দর গাউন ফালা ফালা করে ছিড়ে ফেলতে চাইছে—ছোটবাবুর সঙ্গে বনি কিছুতেই পেরে উঠছে না। দু’হাতে বনি তার পোশাক সামলাচ্ছে। আর কখন যে ছেঁড়া পোশাকের ভেতর নীলাভ বর্ণমালা অবিকল যুবতীর শরীর হয়ে গেল ছোটবাবু বুঝতে পারছে না! জ্যাক—সেই ছেলেটা, সেই ছেলেটা, জ্যাক তুমি এটা কি হয়ে যাচ্ছ! সে পাগল হয়ে যাচ্ছে না ত! অযথা অতিরিক্ত মদ্যপানে চোখে যদি বিভ্রমের সৃষ্টি হয়। ভাল করে আবার চোখ রগড়াল ছোটবাবু। সে এ-সব কি দেখছে! ছেঁড়া পাল খাটানো জাহাজের অভ্যন্তরে সাগরের তাজা মুক্তোর মতো জ্বলজ্বল করছে সব কিছু! জ্যাক নড়ছে না। তাকে ছিঁড়ে ছুঁড়ে উলঙ্গ করে দিয়েছে ছোটবাবু। যেন জ্যাকের কিছু করণীয় নেই। জ্যাক কোনরকমে দু’হাতে তার রত্নরাজি বিছানার চাদর টেনে শুধু ঢেকে ফেলল। শেষে অসহায় বালিকার মতো- কান্নায় ভেঙে পড়ল।—ছোটবাবু তুমি এত নিষ্ঠুর। ছোটবাবু!

ছোটবাবু চিৎকার করে উঠেছিল, আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি জ্যাক! তুমি কে! তোমার এমন কেন হয়! কি দেখছি এ-সব!

বনি দেখছে, ছোটবাবুর চোখে বিভ্রম! চোখে মুখে হতাশা। কেমন মায়া বেড়ে যায়। বলার ইচ্ছে, তুমি পাগল হয়ে যাওনি, তুমি ছুঁয়ে ছুঁয়ে দ্যাখো আমি বনি। আমি মেয়ে। আমার সব কিছুর ভেতর আমি বনি। তুমি ঠিকই দেখছ। ঈশ্বর সাক্ষী রেখে আমি বলছি আমি এই। কিন্তু কিছুই বলতে পারল না। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেবল কাঁদছে। ছোটবাবু যদি সত্যি পাগল হয়ে যায়। ওর চোখের দিকে কিছুতেই তাকানো যাচ্ছে না। চোখে কেমন বিভীষিকা। ছোটবাবুর কি আবার সেই মাথার আঘাত….অথবা তার মাথার ভেতর তার আঘাতের প্রতিক্রিয়া হচ্ছে! মাস্তুল থেকে পড়ে গিয়ে মাথা ফেটে গেলে যা হয়। ছোটবাবুর কি সত্যি আর ভাল হওয়ার আশা নেই! বনি বার বার প্রশ্ন করেও বাবার কাছ থেকে জানতে পারেনি, ডাক্তার কি বলেছে। ছোটবাবুর চোখ পাথরের মতো। শক্ত কঠিন। বনি কি করবে ভেবে পাচ্ছে না।

ছোটবাবুর পাথরের মতো চোখ দেখতে দেখতে সব লাঞ্ছনার কথা বনি একেবারে ভুলে গেল। ছোটবাবুকে নিরাময় করে তুলতে না পারলে সে মরে যাবে। ছোটবাবু পাগল হয়ে গেলে সে হাহাকারে পড়ে যাবে। সে কোনরকমে তার ছেঁড়াপোশাক সামলে-সুমলে ছোটবাবুর কাছে এগিয়ে গেল। ধীরে ধীরে বলল, তুমি এস। ফিসফিস গলায় বলল, আমি মেয়ে ছোটবাবু। আমি বনি। বাবা ভয়ে জাহাজে আমাকে ছেলে সাজিয়ে রেখেছে…।

তখনই অমল গাড়ি থামিয়ে দিল। অতীশকে বলল, নাম। বাইরে বের হয়ে গাড়ি লক করল। তারপর বড় কাচের দরজা পার হয়ে সেই নীলাভ এক ভূখন্ডের মুখেই কাকে দেখে আঁৎকে উঠল।

অতীশ দেখল, রাজবাড়ির মতি বোন দাঁড়িয়ে। সে কোনদিনই মতির সঙ্গে কথা বলেনি। মতি সম্পর্কে অকথা কুকথা কিছু শুনেছে। তার কি হল কে জানে, সে বলল, মতি বোন আপনি এখানে?

মতি কিছুটা হকচকিয়ে গেছে। অতীশবাবুকে এখানে দেখবে আশাই করতে পারেনি। মানুষটাকে সে সমীহ করে। রাজবাড়ির গেটে যেতে আসতে মাঝে মাঝে দেখতে পায়। কেমন অন্যমনস্ক। কথা কম বলে। মনে হয় অনেক গভীরে দেখতে পায়। সে কি বলবে ভেবে পেল না। এবং ধরা পড়ে গেছে মতো অপরাধী মুখে তাকিয়ে বলল, ঘোষবাবু আমার আত্মীয়। ওর কাছে একটু কাজে এসেছি।

অতীশ ঘোষবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, মতি বোন আমি এক রাজবাড়িতে থাকি।

সিঁড়ি ধরে ওঠার মুখে মতিকে দেখেই অমলা নিজেকে আড়াল করে রেখেছে। অমলা অতীশের কান্ডজ্ঞানের অভাব দেখে জ্বলে যাচ্ছে। মতির সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলছে! রিসেপসানে আরও সব মেয়েরা অতীশকে দেখছিল। হাবলা একটা। তুই ওখানে কি করছিস! তোর এত কি কথা! তোর মান সম্মান বোধ পর্যন্ত নেই।

অতীশ খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে বলল, মতি বোন আমি একটা ফোন করব।

মতি অতীশের অনুরোধ শুনে খুব খুশি। সে ঘোষবাবুকে বলল, ফোন। অতীশ ফোন নম্বর দিলে ডায়াল ঘোরাতে থাকল ঘোষবাবু।

ফোনটা পেয়ে অতীশ একবার মতির দিকে তাকাল। তারপর বেশ জোরেই বলল, নির্মলা আছে?

—দিচ্ছি।

—নিৰ্মলা?—হ্যাঁ।

—টুটুল মিণ্টু কান্নাকাটি করছে না ত!

—কান্নকাটি করবে কেন?

—না মানে…অর্থাৎ অতীশের মনে হয়েছিল, এই যে সারাদিন ধরে বাবা বাবা ডাক শুনে আসছে, সেটা মিণ্টু টুটুল বাবাকে ছেড়ে থাকতে পারে না, কান্নাকাটি করতে-টরতে পারে এবং সেইজন্যই সে বার বার শুনতে পাচ্ছে এমন একটা আর্ত ডাক।

সে বলল, ঠিক আছে। ছেড়ে দিচ্ছি।

—টুটুল তোমার সঙ্গে কথা বলবে।

—বাবা! অতীশের বুকটা ভারি তোলপাড় করতে থাকে।

—হ্যাঁ বাবা বলছি।

—কাল তুমি আসবে।

—যাব।

—আমার টুপি! রাজার টুপি।

—হ্যাঁ হ্যাঁ ভুলে গেছি। নিয়ে যাব।

—মা বলছে, মেস থেকে খাবার আনাবে।

—তা আনাব।

—মিণ্টু বলল, বাবা আমি।

—অতীশ বলল, হ্যাঁ মা তুমি।

তারপরই আবার নির্মলার গলা।—চাবি দারোয়ানের কাছে আছে। সকালে সুখী সব করে দিয়ে যাবে। তোমার কলমটা ড্রয়ারে আছে।

—আচ্ছা।

আর কিছু বোধহয় কথা নেই। সে ফোনটা ছেড়ে দেবার সময়ই দেখল অমলা কাছে কোথাও নেই। কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে সবই চোখে পড়ছিল। মতি বোনকে কেউ কিছু তার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছে। ফোন ছেড়ে দিতেই মতি বলল, রিজিয়া, কাউর, লতা। সে সবাইকে হাত তুলে নমস্কার করল। প্রায় ঘিরে ধরেছে মেয়েরা। স্বর্গ থেকে সব দেবযানীরা নেমে এসেছে যেন। আশ্চর্য ঘ্রাণ শরীরে। ভুরু কালো। চোখ টানা টানা। এই সব দেবযানীদের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই সে কাকে যেন খুঁজছিল। তার কেউ যেন হারিয়ে গেছে।

মতি বোন বলল, কারো আসার কথা?

অতীশ বলল, হ্যাঁ মানে। সে ইতস্তত করছিল।

—বাড়ি ফিরবেন?

—দেখি।

কি করবে অতীশ বুঝতে পারছে না। অমলা তাকে ফেলে কোথায় গেল। সিঁড়ির ও-পাশে অমলা অধৈর্য হয়ে পড়ছে। উঁকি দিতেও সাহস পাচ্ছে না। মতি তাকে দেখতে পায় নি। দেখতে পেলে সব জানাজানি হয়ে যাবে। কেলেঙ্কারি। মান সম্ভ্রমের প্রশ্ন। মতি এত বড় হোটেলে আসে সে জানতই না। তার কাছে কাবুল এত খবর পৌঁছে দেয়, আর এটা পারে না! কেউ কোনও কম্মের না। ভিতরে সে আজ বড়ই জ্বালা বোধ করল। এবং শেষে সব তুচ্ছ করে যখন রিসেপসানে ফিরে এল, দেখল অতীশ নেই। মতিও নেই। সে ক্ষোভে দুঃখে জ্বালায় চোখের জল চাপতে পারল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *