1 of 2

ঈশ্বরের বাগান – ১৮

।। আঠার।।

সকালে দৈনিক কাগজের প্রথম পাতায় বর্ষণ এই শীর্ষক খবর এবং ঠিক প্রথম পাতার ওপরে বড় এক ছবি—যুবতী নারী জলের ফোঁটা মুখে চন্দনের মতো মেখে নিচ্ছে। পাশে ফোর্ট উইলিয়ামের ছবি, দুর্গের বুরুজে জালালী কবুতর উড়ছে। নিচে হরেক রকম পাঁচমেশালি খবর। কোথাও মন্ত্রিসভা ভেঙে দেওয়া হয়েছে। চাষাবাদ নিদারুণ মার খাচ্ছে। মাছ আনাজ অগ্নিমূল্য। কোথাও দমদম দাওয়াই চলছে—কাজের কাজ হচ্ছে না। খাদ্যে ভেজালের মতো শস্যদানায় স্বয়ম্ভরতা, কত রকমের হরেক ভোজবাজি—মিছিল, দাঙ্গা, রক্তপাত, মানুষ ঠিকঠাক বেঁচে নেই।

তারপর সারা রাত-দিন বৃষ্টি হয়েছে। কখনও টিপ টিপ, কখনও ঘোর বর্ষণ এবং জোরে জোরে হাওয়া বইছিল। ভোরের দিকে হাজির কর্পোরেশনের গাড়ি। গাড়ি থেকে টুপটাপ লোক নেমে গেল। ম্যানহোল খুলে দিল। ট্রামবাস বন্ধ। বৃষ্টির জন্য ছাতার পাখিরা কলকাতার মাঠ পার হয়ে গঙ্গার ওপারে। হুগলী নদীর পাড়ে চটকলের বাবুরা বাগানে তখন ফুলের চারা পুঁতে দিচ্ছে। বুড়ো ফকিরচাঁদ কলকাতার গলা জলে দাঁড়িয়ে তখন আকাশ দেখছে। পাশে চারু। তলপেটে হাত। মাঝে মাঝে কুঁকড়ে যাচ্ছে। পেটে তার ঈশ্বর ছানাপোনার মতো বড় হচ্ছিল। মেঘ গুড়গুড় করতেই সে নেমে আসার জন্য দাপাদাপি শুরু করে দিয়েছে।

চারুর পাতলা প্লাইউডের ঘর এখন জলের তলায়। মরা ইঁদুর বিড়াল জলে ভাসছে। জানলায় যুবতীর মুখ। বৃষ্টির ঘ্রাণে চোখ অলস। গর্ভবতী হবার বড় সুসময় এটা। বৃষ্টি এলেই মনের মধ্যে সে কথা কয়! শরীর অস্থির হয়ে পড়ে। যে কোন পুরুষই তার তখন কাম্য। ফুলি সকালে বাবা দাসবাবুকে বলেছে রাতে তার জ্বর আসে। তার ঘুম আসে না। দাসবাবু বলেছে, বৃষ্টি বন্ধ হলেই সেরে যাবে। সব সেরে যায় তখন। দাসবাবুর মনে হয়েছে, বৃষ্টির পরে তার পাত্রের খোঁজে বের হওয়া দরকার। মানুষ ত গাইবাছুর। সময়ে পোষা জীব না দেখালে মতিভ্রম ঘটতে পারে। ভারি দুশ্চিন্তা দাসবাবুর।

চারু এবং ফকিরচাঁদ সারারাত জলে ভিজেছে। রাস্তার দু’পাশে কত ঘরবাড়ি কত মানুষজন, তবু তারা এতবড় কলকাতা শহরে ডাঙা জমির খোঁজ পায় নি। শীতে কাঁপছিল। ডাঙার খোঁজে সারারাত চারু জল ভেঙেছে। অসীম সাহস বুকে নিয়ে সর্বত্র বিচরণ করতে করতে সামনের চার্চ এবং রাজাবাজারে ডিপোতে অথবা লোহার পাইপগুলো অতিক্রম করে অন্য কোথাও——চারু পরিচিত সব জায়গা খুঁজেও সামান্য আশ্রয়ের সংস্থান করতে পারে নি।

ওরা প্রায় সাঁতার কেটে রাস্তার ওপরে গিয়ে উঠতেই দেখল, বৃষ্টি ধরে আসছে। মাথার ওপর গুমোট অন্ধকারটা নেই, কিছু হালকা মেঘ বাতাসে ওড়াওড়ি করছে। এ-সময়ে হরিশ রাস্তায় পুরোপুরি নগ্ন। হাঁটু জলে দাঁড়িয়ে আছে। ভিজে জামা-কাপড় গায়ে নেই—সব হাতে। চারু নিজেও পাঁচিলের আড়ালে উলঙ্গ হয়ে শাড়ি থেকে জল নিংড়ে নিল। ফকিরচাঁদ শীর্তে খুবই কাবু, সাদাটে মুখ, হাতে পায়ে হাজা, কেবল চুলকাচ্ছে।

একটু ডাঙামতো জমিতে দুটো পাইপ। পাগলিটা আরামেই আছে। পাইপের মধ্যে মুখ বার করে বাসি হাড় মাংস চিবুচ্ছে। আর আকাশে মেঘ দেখছিল। হরিশের ল্যাজে গোবরে অবস্থা দেখছিল। আর হি হি করে হেসে মরছিল।

হরিশ কিছু ভেজা কাগজ তুলে নিয়েছিল জল থেকে। তাই দিয়ে তার সোনার অঙ্গ ঢাকা। সে মুন্ডমালার মতো তাই কোমরের ধারে ধারে ধারণ করে যেন কত আয়াসে লজ্জা নিবারণ। আকাশে হাল্কা মেঘ দেখে এবং আর বৃষ্টি হবে না ভেবে ঠিক টাকি হাউজের সামনে—তেরে কাটা ধিন এইসব বোলে শরীর গরম রাখার জন্য হামেশাই নাচছে আর চিৎকার করছে, শালো কলকাতা বিষ্টর জলে ডুইবে গেল। পাখি উড়ে গেল বাতাসে। দম মাধা দম পাগলা মাধা দম। শালো সব ভেইসে যাক, ডুইবে যাক জল উঠোক, পাঁচতালা সাততালা বাড়ির মাথায় জল উঠঠে যাক। কলকাতার সে সাক্ষী গোপাল।

তখনই চারু হরিশের পেছনে গিয়ে ঠেলা মারল, বলল, এই ল্যাংটা। হরিশ এই কথায় ভারি আশ্চর্য। একটু চিতিয়ে সে লাঠিটা মাথার ওপর তুলে দিল। কিছু নেই, সব ফক্কা ভোজবাজিওয়ালা সে, কত সহজেই ফুসমন্তরে এই কলকাতায় বানভাসি জল নিয়ে এল। এত গরিমা তার আর চারু কি যে বলে! সে অবিশ্বাসী চোখে মুখে চারুর সামনে কোমর দোলাতে থাকে। এই দ্যাখে চারু আর পারে না। লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে নেয়।

ফকিরচাঁদ রাজবাড়ির পাঁচিলের নিচে বসে আছে। সে উঠতে পারছে না। থেকে থেকে কাশি উঠছে এবং চোখ ক্রমশ ঘোলা দেখাচ্ছিল। জল কমলে ফের ট্রাম বাস চলতে শুরু করবে অথবা জল আরও হলে এইসব সারি সারি ট্রাম বাস উটের মতো মুখটি তুলে দীর্ঘ উ-টি আছে ঝুলে—ফকিরচাঁদ শীত তাড়াবার জন্য কাতরভাবে শৈশবের অয় অজগর আসছে তেড়ে ইঁদুরছানা ভয়ে মরে—যা শালা বিষ্টি। ইঁদুরের ছানাকে আর বেঁচে থাকতে হচ্ছে না। সেও শহরে একটা নেংটি ইঁদুর। এখন জলে মরে ভূত হয়ে থাকবে। কিন্তু তার তো মরে গেলে হবে না—কত কাজ বাকি, চারু আসন্নপ্রসবা। চারুর সন্তান না দেখে সে মরে কি করে! গাছেরও গাছ থাকে। তার গাছ না থাকুক ফল আছে ফলের বীজ থেকে অঙ্কুর। কত আশা তার। সে দেওয়ালে এ সময় কি লেখার চেষ্টা করল, কিন্তু বাতাসে আর্দ্রতা ঘন বলে কোন লেখা ফুটে উঠল না।

ক্রমশই মেঘ হাল্কা হয়ে উড়ে যাচ্ছে। কোথায় যে যায়। কোথা থেকেই বা আসে। ভগবানের লীলা খেলাতে রহস্যের অন্ত নাই। ফকিরচাঁদ এখন রোদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকল।—যা সরে যা, যা মেঘ উত্তরে। যা মেঘ দক্ষিণে, আকাশ হাল্কা করে দিয়ে যা।

ফুটপাথ থেকে জল নামতে শুরু করেছে। গবগব করে ম্যানহোল দিয়ে জল সেঁধাচ্ছে। ট্রাম বাস ফের চলতে থাকল। মানুষজন বাড়তে থাকল ফুটপাথে। পঙ্গপালের মতো গেছো মানুষের আটি সব এখন আবার রাস্তায়। মনে হচ্ছে আর বৃষ্টি হবে না। কেমন শরৎকালীন হাওয়া। বুড়ো এই সময় চারুকে পাশে নিয়ে বসল। চারু বসতে পারছে না। দু-পা বিছিয়ে বসেছে। বড়ই হেনস্তা করছে পেটটা। ভারি উঁচু। ভিতরে স্বর্ণসুধা। রোদ উঠবে ভেবে সে চারুকে কিছু কথা বলতে চাইল। কতদিন আর সে আছে কে বলতে পারে। সে:কিছু আশার কথা বলল। কার কপালে কিডা লেখা আছে কোন মনিষ্যি জানে। তুই যে রাজরানী হবি না অ্যাডাও কেউ হলপ করে বলতে পারে না। তারপর সে গোর্কি বলে একজন মানুষের গল্প করল। চারুর কতদিন পর মনে হল দেশে থাকতে বুড়ো মানুষটা ইস্কুলে মাস্টারি করত।

বুড়ো এবার কি ভেবে উঠে দাঁড়াল। চারুর চোখও ঘোলা ঘোলা দেখাচ্ছে। একটু চা খেলে শুকনো পরাণডা তাজা হবে। সে থিকথিক কাদা এবং আবর্জনা পার হয়ে এক মগ চা নিয়ে এল। দুজনে খুরিতে ভাগ করে খেল। বৃষ্টি আর আসছে না ভেবে বুড়ো অনেক দিন আগেকার কোন গ্রাম্যসংগীত মিনমিনে গলায় গাইল। তারপর সে তার স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির ভেতর থেকে একটা ভাঙা এনামেলের থালা বের করে নিল। বসে থাকলে চলে না। খেটে খেতে হয়। এই আপ্ত বাক্য সার করে ভিক্ষা করতে বের হয়ে গেল। হোটেলে রেস্তোরাঁয় তার জন্য উদ্বৃত্ত অন্ন থাকে। জীবনটা এভাবে কেটে যাচ্ছে। জীবনটা রাজবাড়ির সদরে ঝোলানো এক হাত গন্ডারের ছবির মতো—মাথা সব সময় উঁচিয়েই আছে।

কিন্তু কিসে কি হয় বলা যায় না। সমাজের সব ধূর্ত শেয়ালদের মতো মেঘে আকাশটা আবার কালো হয়ে গেল। ফের বৃষ্টি—বর্ষাকাল এসে গেল। বৃষ্টি ঘন নয় অথচ অবিরাম। ফকিরচাঁদের বসবাসের স্থানটুকু আবার ভিজে গেছে। হরিশ সতী কেউ নেই। বৃষ্টির ধান্দা দেখে ভয়ে ফের পালিয়েছে। যেমন পালায়, সময়ে অসময়ে ওদের আর দেখা যায় না। কোথায় যে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়! ফকিরচাঁদ উচ্ছিষ্ট অন্ন খেতে খেতে হাঁ করে থাকল—আকাশের পরিস্থিতি ভাল না। আজ সারাদিন আবার বৃষ্টি হবে। একটু উত্তাপের জন্যে ফের কান্না পাচ্ছিল। ঠান্ডায় মরে পড়ে থাকলে চারুর আর কেউ থাকবে না।

চারু পাঁচিলের পাশে ফকিরচাঁদকে টেনে তুলল। এই শেষ শুকনো ভাঙা জমি। আর কোথাও নড়বার জায়গা নেই। দুটো কুকুর একটা ভেজা বেড়ালও উঠে এসেছে। কলকাতার বানভাসি জলে বড়ই তারা কাতর। চারুর তলপেট কুঁকড়ে যাচ্ছে এবং ভেঙে যাচ্ছে। চারু নিজের কষ্টের কথা ভুলে গেল। কুকুর বেড়ালের মাঝখানে ফকিরচাঁদকে বসিয়ে রেখেছে। কুকুর বেড়ালের গায়ের ওমে যদি দাদুটা গরম থাকে। ফকিরচাঁদের ঠান্ডা তবু যায় না। কাতরায়। বলে, চারু আমারে নিয়ে যা কোথাও। গরম লেপ তোশক দে। আগুন জ্বাল। নালে আমি মরে যাব। তুরে দেখবেটা কে?

—কোথায় যাবরে! আমার শরীর দিচ্চে নারে। যুবতী চারু তলপেটে দু-হাত রেখে কথাগুলো বলল।

ফকিরচাঁদ ফের বলল, আমারে কোথাও নিয়ে চল চারু। ভারি ঠান্ডা—হি হি হি!

চারুর মনে হচ্ছিল তখন তলপেটের ভিতর গাঁইতি মারছে কেউ। সে কথা বলতে পারছে না।

বাস ট্রাম যাবার সময় কাদা জল উঠে আসছে ফুটপাতে। ফুটপাত থেকে ঘোলা জল নেমে গেলে প্রায় ঘন কাদায় থিকথিক করছে। ফকিরচাঁদের এখন উঠে দাঁড়াবার পর্যন্ত শক্তি নেই। সে ক্রমেই স্থবির হয়ে পড়ছে। নড়তে পারছে না, গা হাত পা ব্যথা করছে। ঠান্ডায় শরীর অবশ। হিমেল হাওয়ায় তিরতির করে গাছের পাতা নড়ছে।

থেকে থেকে ট্রাম বাস চলছিল এবং ছাতা মাথায় যারা যাচ্ছে তারা ছাতার জলে আরও ভয়াবহ করে তুলছে ফুটপাথ। ফকিরচাঁদ বুড়ো বলে তার রাগ হচ্ছে। অথচ কি সুন্দর ছিল তার হস্তাক্ষর, পন্ডিত ছিল ফকিরচাঁদ, প্রথমিক বিদ্যালয়ের পন্ডিত তারপর ফকিরচাঁদ পুত্র এবং পরিবারের সবাইকে হারিয়ে দীর্ঘসূত্রতার জন্য ফুটপাতের ফকিরচাঁদ হয়ে গেল।

এখন দিন নিঃশেষের দিকে। জল এখানেও উঠে আসছে। কুকুর বেড়ালগুলো সময় থাকতেই জলে ঝাঁপিয়ে পড়েছে সাঁতার কাটছে। তাদেরও চাই ডাঙা জমি। পাড়ে যেতে হবে। কুকুর বেড়াল যা বোঝে দাদুটা তাও বোঝে না। চারু ফের দাদুর হাত ধরে জল ভাঙতে থাকল। দাদুকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। কলার খোলার মত জলের ওপর দিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সর্বত্র মানুষের ভিড়। পোকার মত থিকথিক করছে। কোথাও সে এতটুকু জায়গা পাচ্ছে না। সামনে পোল, পোলের ওপরে যদি গিয়ে উঠতে পারে। আগে থেকেই সবাই সব টের পায়। গাড়িবারান্দা সব জলের তলায়। মাথার ওপর এক টুকরো ছাদের বড় দরকার। চারু বুঝতে পারছে জায়গা সব গেছে। অগত্যা চারু আর কি করে, টেনে-হিঁচড়ে সেই এক জায়গায় ফিরে আসে।

ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে। তখনই চোখে পড়ল একটা চালাঘর। কেউ নেই। কিছু খড়কুটো এবং উচ্ছিষ্ট ভাঙা প্রতিমা। জলে ভিজে জবজবে। তারই আড়ালে ফকির চাঁদকে নিয়ে ঠেলে তুলল। কি করে এমন একটা জায়গা ফাঁকা রয়ে গেছে বোঝা গেল না। রাস্তার আলো এখন ফকিরচাঁদের মুখে। দাড়িতে বিন্দু বিন্দু জল মুক্তোর অক্ষরের মত যেন লেখা, আমার নাম ফকিরচাঁদ শর্মা, নিবাস যশোহর। চোখ সেই ঘোলা ঘোলা। খিছু খেলে যদি শরীরে তাপ ওঠে। চারু ঠান্ডা অড়হরের ডাল রুটি ফকিরচাঁদের মুখে গুঁজে দিতে থাকল।

ফকিরচাঁদের চোয়াল শক্ত হয়ে যাচ্ছে। খাবার গিলতে পারছে না। সে সামান্য উত্তাপের জন্য চারুর উরুর মধ্যে হাত গুঁজে দিতে চাইল।

চারু বলল, দাদু তুই ইতর। সর। সর। কে শোনে কার কথা। চারু আর কি করে। ডাকতে থাকল দাদু। ফকিরচাঁদ ঈষৎ চোখ মেলে তাকাল। ভাল লাগছে? দাদু।

ফকিরচাঁদ বলল, হুঁ।

আর তখনই চালাটা ঝড়ো বাতাসে উড়িয়ে নিয়ে গেল। ফকিরচাঁদ যেন জোর পাচ্ছে। সে বলল, কি হবে চারু!

চারু তাড়াতড়ি একটু আশ্রয়ের জন্য হোক অথবা ভীতির জন্য হোক উঠে পড়ল। আশ্রয়ের জন্য সর্বত্র এমন কি গলিঘুঁজির সন্ধানে সে ছুটে বেড়াতে থাকল। চার পাশে শুধু জল, জলে থৈ- থৈ করছে। ট্রাম বাস সব আবার বন্ধ। কেমন একটা মৃত শহরে সে যেন একা। শুধু জলের আর হাওয়ার তীব্র শিস। ছলাৎ ছলাৎ-জঁলে ঢেউ খেলে যাচ্ছে। বাড়িঘরগুলো সব যেন দুলছে। চারু ইলিশ মাছ ভাজার গন্ধ পাচ্ছিল। ঠান্ডায় বাবুরা ঘরে আরামে বসে আছে। খিচুড়ি ইলিশ খাচ্ছে। চারুর বড় ক্ষুধার উদ্রেক হচ্ছে। হাঁটু জলে দাঁড়িয়ে সে ঢোক গিলল।

আর অধিক রাতে চারু ফিরল নিরাশ হয়ে। তখন তলপেটে ফের সেই ঈশ্বরের কামড়। শরীরটা নুয়ে পড়ছিল। ইতস্তত দূরে দূরে জলের মধ্যে কিছু ট্যাকসি কচ্ছপের মত ভেসে আছে। মানুষ-জন দেখা যাচ্ছে না। দু-পাশের ঘর-বাড়ির দরজা জানালা বন্ধ। চারুর এখন বড় ক্লিষ্ট চেহারা, বড় করুণ। সামনে অন্ধকার চার্চের সামনে হেমলক গাছ। লোহার রেলিং টপকে গেলে ছোট ঘর এবং সেখানে কাঠের কফিনটা মাচানের মত করে রাখা। ভেতরে কবরভূমি। পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু ডাঙা জমি।

চারু সন্তর্পণে ‘লোহার রেলিং’ টপকে কাঠের কফিনে ঢুকে সন্তান প্রসব করবে ভাবল। তখনই মনে হল ফকিরচাঁদ তার আশায় বসে আছে। না গেলে বুড়োটা আরও হতাশ হয়ে পড়বে। হতাশ হয়ে পড়লে মানুষের বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে না।

চারু ধীরে ধীরে রাজবাড়ির দরজায় ঝোলানো এক হাত গন্ডারের ছবির নিচে এসে দাঁড়াল। ওর বুক বেয়ে কান্না উঠে আসছে। কে বা কারা মায় ভগবান তার সব সুখ হরণ করে নিল। তবু সে আসছে। তাকে শক্ত হওয়া দরকার। জন্মের পর এই বুড়োটাই তার সম্বল। আর সেই মোষের মত মানুষটা যাকে সে তার সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েছিল, যে চুনগোলা জল ফেলে ঘুঘু পাখিদের উড়িয়ে দিয়ে গেছে অথচ আর ফিরে এল না। সদর দরজায় এক হাত গন্ডারের ছবির নিচে দাঁড়িয়ে চারু কাঁদতে লাগল। বৃষ্টির ঘন ফোঁটা, গাছ-গাছালির অস্পষ্ট ছায়া অথবা সাপ বাঘের ডাকের মত ব্যাঙের ডাক আর নগরীর দুর্ভেদ্য স্বার্থপরতা চারুর দুঃখকে অসহনীয় করে তুলেছে। চারুর শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। এমনকি কুকুর বেড়ালও এই বৃষ্টিতে বের হচ্ছে না। পুলিশ কোথাও পাহারায় নেই। চারু একা। এত বড় শহরের মধ্যে সে একা, এবং একমাত্র সন্তান যে মুখ বার করার জন্য ব্রহ্মান্ডের ভেতর দাপাদাপি করছে। আর তখনই চারু দেখতে পেল সেই পাগল, জনহীন নগরীতে হেঁকে যাচ্ছে দু ঘরের মাঝে অথৈ সমুদ্দুর। পেছনে পাগলিনী। গভীর রাতে আজ দুজনের হাতেই লাঠি। যেন শহরে সব দুষ্কৃতকারীদের খুঁজে বের করার জন্য জল ভেঙে হেঁটে যাচ্ছে। লাঠির মাথায় পালক। চারুর বুকে সাহস জমে গেল।

চারু তাড়াতাড়ি ফকিরচাঁদের হাত ধরে টানাটানি করতে থাকল। পেয়ে গেছি। —উঠ দাদু উঠ। যাবি। জায়গা

তারপর চারু ফকিরচাঁদের হাত ধরে টলতে টলতে দোকানগুলি পার হয়ে গেল। ওদের জামাকাপড় জলে ভিজে সপসপ। শীত আরও কনকনে, বাতাস আরও প্রবল। ওরা দুজনেই এবার ঠান্ডা থেকে বাঁচবার জন্য নগ্ন হয়ে গেল। রেলিং টপকে গেলেই মানুষের কফিন। তার মধ্যে ঢুকে বসে থাকলে হিমেল হাওয়া আর দাঁত বসাতে পারবে না। এখন ফকিরচাঁদই সব করছে। কত বড় কথা, তার গাছের গাছ সেই থেকে অঙ্কুর যেন সরলরেখার মত শীর্ণ একটা বরাবর রেখা টেনে যাওয়া। ভারি উত্তেজনা বোধ করছিল ফকির। বংশ রক্ষা হচ্ছে কত তার সুখ এখন। জল ঝড় হিমেল ঠান্ডায় সে আর কাবু হচ্ছে না। চারু পাশে একটা খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মাথার ওপরে দেবদারু গাছ, পাশে কবরভূমি, ডাঙা, মাচান এবং আড়ালে আবডালে চারুর সন্তান প্রসব

মাচানের নিচে চারু ঢুকে যেতেই শুনল কফিনের ভেতর কারা যেন কথা বলছে।

—কে? কে! এখানেও বেদখল! ফকিরচাঁদ যুবকের মত রুখে দাঁড়াল।

কফিনের ডালা খুলে একটা কিম্ভূতকিমাকার মুখ উঁকি মারল। সেই পাগলা হরিশ। লম্বা দাঁতটা হিমেল হাওয়ায় আরও লম্বা হয়ে গেছে। তার পাশে আর একটা মুখ। সতীবিবি যেন উঁকি দিয়ে মনুষ্যের অগোপন্ডদের দেখছে। তাজ্জব সে। এখানেও দখল নিয়ে কাড়াকাড়ি।

ফকিরচাঁদের মনে হল, মানুষই মানুষের সহায়। সে বলল, তোরা সবাই মিলে চারুকে ধর। চারুর বাচ্চা হবে।

সতী এ-কথায় কোন এক সুদূরের ছবি দেখতে পায়। চারু মা হবে। মা হবার মত মেয়েদের বড় কিছু নেই। ঝড় জলের রেতে মনেই থাকল না মানুষের হারামিপনায় অতিষ্ঠ হয়ে সে পাগল হয়ে গেছে। মস্তিষ্কে পোকা বাসা বেঁধেছে। সে বলল, সর সর। তোরা সরে যা। তোদের দেখলে আমার বমি আসে।

কি করে আর। ফকিরচাঁদ এবং হরিশ হেমলক গাছটার নিচে গিয়ে বসে থাকল। আর সতী চারুকে বগলদাবা করে তুলে নিল মাচানে। মায়ের মত. স্নেহ এবং করুণা দুচোখে। সে চুমো খেল চারুর ঊরুতে।

তারপর কফিনের ভেতর সন্তানের জন্ম হলে পাগলিনী গ্রাম্য প্রথায় তিনবার উলু দিল। সেই শব্দের ঝংকারে মনে হচ্ছিল সমুদ্র কোথাও না কোথাও সৃষ্টিকর্তার ভূমিকা পালন করে থাকে, মনে হচ্ছিল এই সংসার হাতি অথবা গন্ডারের ছবির মধ্যে লুকিয়ে থাকে। শুধু কোনও সং যুবকের সংগ্রামের প্রয়োজন। উলু শুনে পাগল শেষ রাতের অন্ধকারে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল, কে আসবি আয়, সংক্রান্তির মাদল বাজছে আয়। তখন ফকিরচাঁদ ধূসর অন্ধকারে সুন্দর হস্তাক্ষরে শিশুর নামকরণ করে অদৃশ্য এক জগতের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল।

.

ঠিক তার দুদিন বাদে এক বিকেলে অতীশের ফোনটা সহসা কেমন পাগলা ঘন্টির মত বেজে উঠল। সুধীর চা রেখে গেছে। একগাদা চালান সই বাকি। চা খেয়ে চালানগুলি সই করবে ভাবছিল তখনই ফোন। সে ফোন নিজে তুলল না। কারণ ঠিক এ সময়ে শেঠজী ফোন করে থাকে। ফোনে তাকে জ্বালায়। একবার ধরলে আর ছাড়তে চায় না। সে বেল টিপল এবং সুধীর এলে বলল, দেখ ত কে ফোন করছে। শেঠজী হলে বলবি, বাবু খাচ্ছেন। পরে করবেন।

সুধীর বলল, বাবু মেয়েছেলে কথা বলছে।

মেয়েছেলে কে হতে পারে! সে চাটা রেখে ফোন তুলে বলল, হ্যালো।

—তুই কোথায় ছিলি। ফোনটা কে ধরেছিল!

—বউরাণী!

—হ্যাঁ। তোমার মুণ্ডু।

—কি খবর? ফোন সুধীর ধরেছিল। চা খাচ্ছিলাম।

—সুধীরটা আবার কে? আমাকে মেয়েছেলে বলে কেন?

—বেয়ারা।

—তুমি আস্ত একটা বেয়াড়া মানুষ। তোমাকে নিয়ে অনেক ঝঞ্ঝাট। অতীশের মুখটা কেমন কাল হয়ে গেল। সে এত খাটছে, এত দৌড়ঝাঁপ করছে, কোটা ইম্পোর্ট লাইসেন্স বাড়াবার জন্য কারখানার উন্নতির জন্য, অথচ কিছু করতে পারছে না, সবাই আশা দেয়, আশা মত ভাবে, এবারে ঠিক লাইসেন্স আসবে, কিন্তু এত-কম কেন? যা দরকার তা পাওয়া যায় না কেন? কুম্ভ বলেছে, আমাকে ভার দিন, দেখুন সব হবে, আপনি পারবেন না! সোজা আঙ্গুলে ঘি ওঠে না দাদা।

—এই তুই কি কালা?

—না—মানে—-

—শোন কর্পোরেশনের লোকটাকে ফিরিয়ে দিস না। ওর পাওনাটা দিয়ে দিস।

সে বুঝতে পারছে, বউরাণী গোপনে তাকে জানিয়ে দিচ্ছে সব। হেলথ লাইসেন্স ট্রেড লাইসেন্সের বাবদ কোন ঘুষ সে দেয় নি। বলে দিয়েছিল, ঠিক আছে নতুন করে অ্যাসেসমেন্ট করুন। যা হবে তাই দেব। তারপরই বুঝতে পারল, কে যেন অলক্ষে বলছে, এটা তোমার বাপের টাকা, তুমি দেবার কে হে। নতুন করে অ্যাসেস করালে, হাজার দেড়ক টাকায় গিয়ে দাঁড়াবে। সেখানে আড়াইশ টাকার প্যাকেট দিলে ঝামেলা চুকে যায়।

সে বলল, দেখি।

—লক্ষ্মী ছেলে ওটা দিয়ে দে। সব কাজেই আজকাল ঘুষ দিতে হয়। তুই ত নিচ্ছিস না! কাজ উদ্ধারের জন্য দিচ্ছিস।

সে আবার বলল, আসুক তো ফের। তারপরই কেন জানি অত্যন্ত বিরক্ত বোধ করে। সে বুঝতে পারে তাকে দিতেই হবে। কিন্তু না দিলে কেমন হয়, দেখা যাক না, কত দূর গড়ায়। শেষ পর্যন্ত সে দেখবে। এবং তক্ষুনি এক নিদারুণ ছবি ভেসে ওঠে। এই কলকাতায় এসে এটা আরও বেশি দেখছে। রাস্তাঘাটে সে দেখছে অসংখ্য আশ্রয়হীন মানুষ। সন্তান-সন্তুতি নিয়ে প্লাইউডের বাক্সে তারা বাস করছে। ঠিক মিণ্টু টুটুলের মত শিশুরা হাত পা ছড়িয়ে বসে আছে। অন্নহীন হাহাকার মুখ। বাপেরা আসছে মুখ কালো করে, মায়েরা পচা দুর্গন্ধযুক্ত আঁশ জড় করে সেদ্ধ করছে। পচা আনাজপাতি সেদ্ধ করছে। যেতে যেতে সে কখনও দাঁড়িয়ে গেছে। ভেতরে এক কঠিন অপ্রত্যাশিত ভয় নাড়া দিয়েছে তখন। যেন শেষ পর্যন্ত কেউ তাকে একটা ফুটপাথের মানুষ বানিয়ে ছাড়বে।

আসলে অতীশ নিজেকে নিজে ভীষণ ভয় পায়। এবং ভয় পায় বলেই সে তখন খুব সংযত গলায় কথা বলে! সে তার নিজের জন্য ভাবে না। দিন যত যায় তত মনে হয়, দুই শিশু তার পায়ে পায়ে হাঁটছে বড় হচ্ছে। বাবা তাদের জন্য নিয়ে আসবে একটা এলিস-ইন-ওয়ান্ডার ল্যান্ড। সেখানে গাছ, গাছের নিচে প্লাইউডের সংসার, উষ্কখুষ্ক মুখে এক দীর্ঘকায় যুবক দাঁড়িয়ে আছে, ভাবলেই বুকে কি যেন নড়েচড়ে ওঠে।

—ফের আসুক না আসুক, তুই কুম্ভকে দিয়ে টাকাটা পাঠিয়ে দিস।

তার কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। তবু কেন যে বলল, আচ্ছা।

সঙ্গে সঙ্গে তার মগজের মধ্যে কে নৃত্য করতে থাকে। অট্টহাসি শুনতে পায়। এবং সেই দুৰ্গন্ধ। আজ আবার তাকে একগাদা ধূপকাঠি পোড়াতে হবে। সে তলিয়ে যাবে, তলিয়ে যাচ্ছে, এ-সব পারবে না বলেই ইস্কুল ছেড়ে পালিয়ে এসেছিল। অদৃশ্য দুরাত্মা তাকে দিয়ে ঠিক সেই কাজ করিয়ে নিচ্ছে। সে যেখানে দুরাত্মাও সেখানে।

বউ-রাণী ফের বলল, কদিন ছুটি নে।

সহসা এমন কথায় অতীশ শঙ্কা বোধ করল। চার্জ কি তবে বুঝিয়ে দিতে হবে। তারপর ছুটি, তারপর এসে দেখবে কুম্ভ তার চেয়ারে বসে কাজ করছে। কুম্ভ কি অত দূর যাবে—কি জানি, তার হাই উঠল। পরিচিত মানুষদের ছবি চোখে ভেসে উঠল কিছু। কার কাছে যাওয়া যায়।

বউরাণীর আবার গলা পাওয়া গেল। ভারি সরল মেয়ের মত বলছে, পার্ক স্ট্রীটের বাড়িতে আমার সঙ্গে কদিন থাকবি। কেমন।

অতীশ কথাটাতে খুব হতভম্ব হয়ে গেল। নির্মলার শরীর খারাপ যাচ্ছে। রোজই আশা করে রাতে নির্মলা ও-ঘর থেকে চলে আসবে। কিন্তু আসে না। শরীরের মধ্যে কি যে থাকে। চোখ জ্বালা করে। তেষ্টা পায়। জানালায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে শীত গ্রীষ্মের জোনাকি উড়তে দেখে। নির্মলার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। নির্মলার শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পায়। কত সহজে নির্মলা ঘুমিয়ে পড়তে পারে। সর্পণে হাত ধরতে চায়। কিন্তু কোথায় যেন বাধে। সে পারে না। অমলা কি বুঝতে পেরেছে, শরীরে তার হাহাকার জমেছে। সে কি জবাবে বলবে ভেবে পেল না। ফোন হাতে নিয়ে বসে থাকল।

—হ্যালো হ্যালো।

অতীশ শুকনো গলায় বলল, হ্যাঁ বল।

—ভয় পেয়ে গেলি বুঝি। আমি তোকে খেয়ে ফেলব ভাবছিস!

—না মানে, নির্মলার শরীরটা ভাল না অমল।

—ওকে নিয়ে কোথাও থেকে ঘুরে আয়। ডাল্টনগঞ্জ যাবি। ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। ওখানে আমাদের একটা বাংলো আছে, কোন অসুবিধা হবে না।

এত টাকা অতীশের নেই। সে বলল, এখন এত দূরে যাওয়া সম্ভব হবে না।

—তোর ছেলেটা খেতে ফড়িং ধরে বেড়াচ্ছিল। আমাকে দেখে কি হাসি। তোর ছেলেটাকে আমাকে দে না। কিরে দিবি?

অমলার আজ হয়েছে কি! এক কথা থেকে আরেক কথা। সে বলল, নিও।

—ঠিক কথা দিচ্ছিস?

অতীশ বলল, একদিনেই পাগল করে দেবে। যা ছেলে।

তারপরই খুব গম্ভীর গলা শুনতে পেল বউরাণীর! – শোন কমলা আসবে। কাল রাতে তুই খাবি আমাদের সঙ্গে। একা আসবি না কিন্তু। একা এলে ঢুকতে দেব না। তোর বৌকে আনবি। বাচ্চা দুটোকে আনবি। প্রাণ খুলে একটু আদর করব। আমার তো কেউ নেই। কমলা আছে আর তুই আছিস। রাজেনের আত্মীয়েরাও আমাকে ডাইনী ভাবে রে। শেষের দিকে অমলার কণ্ঠস্বর কেমন ধরে আসছে মনে হল অতীশের।

অতীশের কেন জানি ভারি কষ্ট হল অমলার জন্য। সেই বিরাট প্রাসাদোপম বাড়ি, সামনে দীঘি, ঝাউগাছ, নদীর চর এবং কাশফুলের কথা মনে হয়। জ্যোৎস্না রাত বিশাল ছাদ, কিছু বালিকার ছুটোছুটি লুকোচুরি খেলার মধ্যে তার এক সময় স্বপ্নময় দিন গেছে। নতুন জায়গা, অপরিচিত মানুষজনের মধ্যে দুই বালিকা অমল কমল তাকে ভারি আপন করে নিয়েছিল। সে তবু রাতে জ্যাঠামশাইয়ের পাশে শুয়ে মার জন্য কাঁদত। ছেলেবেলা মা বাদে মানুষের আর কিছুই থাকে না বুঝি। অথচ এক বছরের ওপর হয়ে গেল, সে বাড়ি যায়নি। মাকে ছাড়া কোথাও এক রাত থাকতে তার ছেলেবেলাতে কত কষ্ট হত। অথচ তারপর নিরুদ্দেশ, কেউ জানে না কোথায় সে। বনি এসে জীবনে আর এক নতুন রহস্য গড়ে দিল। তার মনে হয় এভাবে মানুষ এক জগৎ থেকে আর এক জগতে নিরন্তর সরে যায়। গাছের নিচে দাঁড়িয়ে কেউ কেবল ডাকে। সে কখনও জননী, কখনও জায়া, এক দিগম্ভ থেকে অন্য দিগন্তে। নতুন জগৎ, নতুন চমক, নতুন আকর্ষণ। মানুষ এক দন্ডের জন্য এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না।

অমলা বলল, কথা বলছিস না কেন?

—না ভাবছিলাম …

—কি এত ভাবিস! তুই নাকি রাতে কি সব করিস?

—কি করি আবার!

—মানস বলল, ধূপকাঠি জ্বালিয়ে বসে থাকিস!

—এটা আমার হয়।

—কেন হয়?

—কেন হয় জানি না।

—তোর জ্যাঠামশাইয়ের মতো কিন্তু হয়ে যাস না।

অতীশ সরল বালকের মতো হেসে দিল। বলল, তোমার ভয় করে!

—আমার ভয় কি! আমি তো কাউকে পরোয়া করি না। রাজেনকেও না। মানসকেও না। তারপরই কেমন দুম করে বলে দিল, আমি মা হতে চাই অতীশ। আমার কবে থেকে সেই ইচ্ছে। তুই তো জানিস।

অতীশের শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল। সেই শ্যাওলা ধরা ঘর এবং সেই অন্ধকার এক মরীচিকার মতো, যেন সে ভিতরে ডুবে গেলে প্রথম পাপবোধের কথা এখনও মনে করতে পারে। ঘর থেকে বের হয়ে তার মনে হয়েছিল, সে সাংঘাতিক একটা পাপ কাজ করে ফেলেছে। সেদিন সে একা একা নদীর চরে হেঁটে বেড়িয়েছিল। ওর মনে হয়েছিল, বাড়ি ফিরে গিয়ে যদি মাকে আর দেখতে না পায়। ঈশ্বর বিশ্বাস ছিল তার তখন খুব বেশি। তিনি রাগ করে যদি মাকে নিয়ে যান। যদি গিয়ে দেখতে পায় মার শরীর সাদা চাদরে ঢাকা। সারাদিন সে ভীতু বালকের মতো পালিয়ে বেড়িয়েছিল। অমলা কমলা ডেকে ডেকেও তার সাড়া পায়নি। সে পাগল জ্যাঠামশাইর হাত ধরে নদীর পাড়ে নেমে গেছিল। বার বার বলছিল, ভগবান আমি আর করব না। আমি ভাল হয়ে থাকব। তুমি আমার মাকে ভাল রেখ। এখন তার সেই ঈশ্বরও সম্বল নেই। বড় হয়ে উঠতে উঠতে পরলোক, দেবদেবী ধর্মশাস্ত্র সব মনে হয়েছে তার বানানো কথা। ভয় থেকে সব ঋষি মহাঋষিরা মানুষের জন্য নানারকমের শেষ আশ্রয় বানিয়ে রেখে গেছে। ঠিক তার লেখার মতো, মনে যা আসে, নানারকমের ছবি, অর্থাৎ সে ভিতরে ডুব দিয়ে যা দেখতে পায়, তার কথা লেখা হয়ে উঠে আসে। সেইসব দেবদেবীরাও মানুষের কল্পিত পৃথিবী। তাকে সে গ্রাহ্য করে কি করে!

অতীশের পলকেই এসব মনে চলে আসে। ভুলেই যায় সে কারও সঙ্গে কথা বলছে। আবার

হ্যালো, হ্যালো।

—হ্যাঁ আমি।

তুই কি মাঝে মাঝে মরে যাস?

—তাই বলতে পার।

—আমার মা হওয়ার ব্যাপারটা এত লঘু করে দেখছিস কেন?

অতীশ কি বলবে! ফোনে এসব কথা বেশি না বলাই ভাল। সে বলল, তুমি তো রোজই আমার বাড়ির পাশ দিয়ে দুমবার সিং-এর সঙ্গে গোয়ালবাড়ির দিকে যাও। কৈ একবারও তো এত বড় সমস্যার কথা তোমার চোখ মুখ দেখে আমার মনে হয় নি। একবারও ডেকে কথা বলনি।

—তুই রাজবাড়িতে একটা চাকর। একথা ভুলে যাস কেন? তোর বাসার দিকে তাকাব, কথা বলব এত সাহস হয় কি করে!

তখনই মনে হল, সত্যি সে একজন ক্রীতদাস প্রায়। তার বাড়ির পাশ দিয়ে বউরাণী, অথবা রাজেনদ্রা গেলে সে নিজেকে আড়াল করে রাখে। যেন সে বাড়িতে নেই। তারা ডাকেও না। বরং ওরই উচিত দেখতে পেলে ছুটে যাওয়া। অন্য আমলাদের মতো দেখা হলেই হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে থাকা। সে সেটা পারে না বলেই যতটা পারে এড়িয়ে চলে। একবার বাড়ি ফেরার সময় দেখেছিল, রাজার গাড়ি বের হয়ে যাচ্ছে। দু’পাশে যারাই রয়েছে হাত জোড় করে আছে। এমন কি ছোট ছোট শিশুরাও। সেখানে সে মিণ্টুকেও দেখেছিল। রাজার গাড়ি গেলে বাড়িতে এই নিয়ম। ছোট্ট মেয়ে মিণ্টু যার কচি কাঁচা দাঁত, যে ভাইয়ের হাত ধরে শুধু গাছপালার মধ্যে আমলকীর বনে ঘুরে বেড়াতে ভালবাসে, সেও সবার মতো হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে আছে। আর তাতেই ওর পায়ের রক্ত মাথায় উঠে যায়। ভারি অপমান বোধ করে সে।

সে মিণ্টুকে বলেছিল, এস। মিণ্টু বাবাকে দেখেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, বাবা, বাবা রাজার গাড়ি। পাশে টুটুল। মিণ্টু টুটুলের হাত ধরে হাত জোড় করা শেখাচ্ছিল। সব ওর চোখে পড়েছে। এবং সে অন্য দিনের মতো দু’জনের কাউকেই বুকে তুলে নিতে পারে নি। অপমান বোধে তার কান মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছিল। সে শুধু বলেছিল, এস। কথা আছে। কিছুই বোঝে না শিশুরা। তারা দেখতে পায় তাদের এমন সুন্দর বাবা কেমন গুম মেরে আছে। ভয়ে ভয়ে পায়ে পায়ে ওরা গুটি গুটি হেঁটে আসছে। তারপরই যা হয়ে থাকে, শিশুদের মায়া অতীশের বুকে কেমন ঝড় তুলে দেয়। শিশুরা তাকে ভয় পাচ্ছে। যেন এর চেয়ে বড় অপরাধ কিছু নেই। ঝাঁপিয়ে সে ওদের বুকে তুলে নিয়ে বাসায় ঢোকার সময় বলেছিল, যখন তখন এ-ভাবে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে থাকবে না। আমি এতে কষ্ট পাই।

টুটুল বাবার গালে চুমু খেয়ে বলেছিল, আর কব্ব না। শিশুরাও বোঝে বিষয়টা। অথচ সে বোঝে না, সে ভুলে যায় সব। সে বলল, আর কিছু বলবে অমলা!

—আমার খুশি বলব কি বলব না। তুই ফোন ধরে বসে থাক। যখন তখন আমি এবার থেকে তোর সঙ্গে কথা বলব। তারপরই হাসতে হাসতে বলল, তোর খুব অহংকার না রে?

—কিসের অহংকার অমল!

—আছে। আছে। আমি সব বুঝি। তুইও একটা স্বৈরাচারী। যা ভাবিস তাই করিস। এক চুল নড়তে চাস না। শোন, তারপর যেন উপদেশ দেবার মতো বলল, আমরা সবাই তারের খেলা দেখাচ্ছি। যে কোন মুহূর্তে পড়ে যেতে পারি। তবে এত ভেবে মরব কেন রে! আমরা সবাই তারের ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। তারপরই খুট শব্দ। অমল ফোন কেটে দিয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *