।। সতের।।
তখন দম মাধা দম, পাগলা মাধা হরিশ নাচছে। ফুটপাথে লাঠি বগলে নাচছে; পালক বাঁধা দম মাধা দমের লাঠি নিয়ে গাজনের মতো শিবের নাচন নাচছে। এক পা সামনে, আবার এক পা পেছনে। ঘুরে-ফিরে নাচ। জনগণের মধ্যে তার এই কিম্ভূতকিমাকার নাচ প্রবল হাসির খোরাক জোগাচ্ছিল। সে হাঁকছে দম মাধা দম, পাগলা মাধা দম। নাচতে নাচতে নুয়ে পড়ছে। আবার উঠে দাঁড়াচ্ছে। পাশে গৌরী সতীবিবি, শিব গৌরীর নাচ দেখাচ্ছিল জনগনকে। এভাবে এই শহরে গ্রীষ্মকাল পার হয়ে যায়। সে তবু নাচে। এই শহরে বর্ষাকাল পার হয়ে যায়, সে তবু নাচে। শরৎ, হেমন্ত আসে সে নেচে যায়। মাথায় পাগড়ি, পায়ে কাগজের বেড়ি, হাতে বাঁশি, ফুলের মালা, সে নেচে যায়। শহরের গাড়ি যায়, ট্রাম যায়, বাস যায় সে নাচে। রাজার বাড়িতে ঘণ্টা পেটায় কেউ, সে নাচে। গোলাপ বাগানে বউরাণী ইজিচেয়ারে শুয়ে থাকে, চোখে-মুখে চাপা হতাশা কেউ টের পায় না। কি এক গোপন দুঃখ বুকে নিয়ে বসে আছে কেউ জানে না। সে নাচে।
ফুলির প্রেমিক আসে না। ফুলি, বারান্দার থামে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সুনন্দ খোঁজ-খবর নেয় না। সুনন্দ কোথায় অন্য হীরে-মানিক পেয়ে গেছে। ফুলি সকালে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। রাতে কাঁদে। কেউ জানে না ফুলি সুনন্দর জন্য কাঁদে।
দাসবাবু ফুঁসছে। বেটা বাঙ্গাল, নেমকহারাম। ব্যাংকে কাজ পেলি, আর এবাড়ি আসা ভুলে গেলি। এটাও একটা গোপন দুঃখ। সে জোরে বলতে পারে না তার মেয়েটা শুকিয়ে যাচ্ছে। চোখ-মুখ বসে যাচ্ছে। রাজাকে ধরে কিছু টাকা ধার চাইবে তারও উপায় নেই। আগের দেনা শোধ দিতে পারেনি, আবার তাকে দেবে কেন? সে শাপ-শাপান্ত করছিল রাজাকে, বেজম্মার বাচ্চা বলছিল। সবাই জানে, তুমি কে! তোমার শরীর পোকায় খাবে। এত পাপ সহ্য হবে কেন? সুনন্দ থেকে রাজা, তারপর বউ-বেটা সবার প্রতি বড় বিদ্বেষ তার। সবাই মিলে তাকে কানা করে দিল! কোন সুখ নেই, স্বস্তি নেই। অভাব থাকলে মানুষের সুখ স্বস্তি কিছুই থাকে না। সে একসময় একজন বড় খেলোয়াড় ছিল, দেখলে কে বলবে!
নধরবাবুর মেয়ে চিনু আবার সেজে গুজে কলেজে যায়। খোঁপায় বেল ফুলের মালা গুঁজে রাখে। ভ্রূণের খবরটা জানাজানি হয়নি। সে এই পৃথিবীতে কুমারী মেয়ে ফের। বরং রাজা মতিকেই সন্দেহ করেছিল। সুরেনও জানে মতির ওপর রাজার রাগ আছে। কিন্তু বউরাণী মতিকে খুব পছন্দ করে। যতই সন্দ করুক রাজা বউরাণী না বিগড়লে কারো হিম্মত নেই কিছু করে। তাই নির্বিবাদে মতি সন্ধায় বের হয়ে যায়, সবার শেষে রাত বারোটায় ফেরে। কোনদিন ফেরে কোনদিন ফেরে না। সকাল হয়ে যায়। কখনও কখনও চার-পাঁচ দিন এমন কি এক মাসের জন্য দেখা যায় মতি উধাও। রাজবাড়ির গেটের খাতায় রাত বারোটায় মতি ঢুকছে, নাম তোলা থাকে না। তখনই দারোয়ান থেকে রাজা জেনে যায় মতি পর্যটনে গেছে।
সুরেন টের পায় আগে। মতি বোন না থাকলে, বাজারের থলে হাতে ছোড়দি নেমে আসবে। ফ্রক গায় দেয়। ফ্রক গায়ে না দিলেই ভাল। বড় ফুলেফেঁপে থাকে। দশজন অকথা কুকথা বলে! এই সংসারটার জন্য তার মায়া হয়। দ্বিজেনবাবু অকালে মারা না গেলে এত হেনস্থা হত না মতি বোনের। মানুষের কপালে কার কি লেখা থাকে জানে না। দ্বিজেনবাবুর মনটা সব সময় বড় প্রসন্ন থাকত। টাকাটা সিকিটা বখশিস সে কতবার পেয়েছে। ভাল মন্দ হলে সুরেনকে ডেকে খাওয়াত। এত বড় রাজবাড়িতে দিল বলতে দ্বিজেনবাবুর ছিল। সেই মানুষটা নিশ্চিন্তে স্বর্গ সুখে আছে। একবার ওপর থেকে উঁকি দিয়ে দেখেও না। খুড়িমার চলে কি করে! তখনই সুরেন বোঝে এতে কোন পাপ নেই। বরং মতি বোনকে দেখলেই সে এবাড়িতে বেঁচে থাকতে সাহস পায়। নবর খোঁজ নেই, নব মরেছে কি বেঁচে আছে তার জন্যও সে আর বিচলিত বোধ করে না। বরং সে বুঝেছে অঙ্কের হিসেবটা গোলমেলে। সময় মতো ধরতে না পারলে এই হয়। এ জন্মটা তো চলেই গেল, আগামী জন্মে সে আর বোকামি করবে না।
সে বাজারে যাবার সময় প্রথম কফটা ফেলল, রাধিকাবাবুর দরজায়। পায়ে পায়ে ঘরে যাক। বিছানায় উঠুক। তারপর মুখে বুকে। পরের পালা, হামুবাবুর জানালার পাশে। বাতাসে ছড়াক। বড়ই সংক্রামক ব্যাধি। সে মরেছে, সবাই মরুক। কাশছে আর কফ ফেলে যাচ্ছে। তার বড়ই আরাম। কফ ফেলতে পারলেই প্রসন্ন বোধ করে। এবারে কেষ্ট চক্কত্তির দরজায়। এই করে সে রাজার ঘরে পর্যন্ত গোপনে কফ ফেলে রাখে। সে কাউকে নিস্তার দেবে না। দুটো ঘর বাকি, নতুন ম্যানেজার আর দ্বিজেনবাবুর ঘর। সেখানে সে ফেলে না। ওর মনে হয় কোথাও যদি এতটুকু পুণ্য বেঁচে থাকে তবে ঐ ঘর দুটোয় এখনও আছে। সে সেখানে কফ ফেলতে এখনও কেন জানি সাহস পায় না। বড় অধর্ম হবে ভাবে।
তখনও পাগল হরিশ নাচছিল দম মাধা দম, পাগলা মাধা দম! সুরেন দেখল সক্কাল বেলায় রোদের তাপে আজ পাগলটা, পাশে পাগলিকে নিয়ে নাচছে। শিব গৌরীর নাচ। এই নাচ দেখে সেও কেমন ভেতরে পুলক বোধ করল। এত তাপের সংসার থেকে বের হয়ে এখানে একটু নেচে গেলে কেমন হয়। বাজনা বাজলে, সেও বোধ হয় এক পা সামনে, এক পা পেছনে রেখে ঘুরে ফিরে নাচত। মনে মনে বলল, বড়ই সুখ। আহারের ভাবনা নেই, মৈথুনের ভাবনা নেই, শোওয়ার ভাবনা নেই, ধর্মের ভাবনা নেই। বড় সুখ হে হরিশ তোমার। তোমার এ সুখের কাঙাল আমি। তার চোখ ফেটে জল বের হয়ে এল।
সুরেন একদিন বলেছিল, বেটা পাগল, শুধু নেচেই গেলি!
হরিশ কেমন বোকার মতো, তাকিয়েছিল তার দিকে!
—এত নাচে কি সুখ!
—সুখ আছে হে। দেখ না এসে। এই বলে যেন সে করতালি বাজাতে চেয়েছিল।
—বেটা মরবি ফুটপাথে।
মানুষের মরণ গাছে লেখা থাকে না। পাতায়ও লেখা থাকে না। মানুষ ম’রে ম’রে বাঁচে। রাজার বাড়িতে সে যায়। লিখে দিয়ে আসে—কিছুই থাকে না হে। গাছ থাকে না, পাখি থাকে না। সব মরে যায়। মরে ভূত হয়ে যায়। তুমিও মরে ভূত হয়ে যাবে একদিন। হরিশ যেন নেচে নেচে এই কথাগুলি বলতে চায়। সুরেন তখন বড়ই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। সে পাগলটার কাছে গিয়ে বলতে পারে না, মাঝে মাঝে তোর মতো হতে ইচ্ছা যায়। পারি না। সংসার বড় টানে। মরণে বড় ভয়।
তখন বউরাণীর ঘরে মানস।—তোমাকে এখানে না রাখলে কেমন হয়?
মানস বলে, তোমার ইচ্ছে!
বউরাণী হা-হা করে হাসে।
—ভয় পাব কেন?
—ভয় পেলে না তো?
—কিন্তু কিছু যে বলতে পারছি না। সব খুঁজছি। পাচ্ছি না।
—কি খুঁজছ?
—বারে মনে করতে পারছি না?
—না অমলা।
—সেই চিঠিটা!
মানস সহসা টের পায়, অনেকদিন আগে, যেন জন্ম-জন্মান্তরের আগের কথা। সে বলে, আমি কে?
—তুমি রাজা। তুমিই সব আমার।
—সব ভুলে গেছি অমলা!
—ভুললে চলবে কেন? এতখানি এগিয়ে আর ফিরে যেতে পারি না!
—আমার কিছু আর লাগবে না। রাজেনের স্ত্রী হয়ে আছ তাই থাক।
—অমলা বলল, না সে হয় না।
—কেন হয় না অমলা?
—রাজেন তোমাকে ঠকিয়েছে। আমি রাজেনকে ঠকাতে চাই।
—ওর কি দোষ!
—তবে কার?
—মানুষেরই এটা হয় অমলা। রাজেন ত মানুষ।
অমলা কিঞ্চিৎ মুখ তুলে মানসের দিকে তাকাল। রাজবাড়ির সদরে ঘণ্টা পড়ছে। ডালহৌসি পাড়ায় রাজেন ঠাণ্ডা ঘরে বসে এখনও বোধহয় কাগজপত্র দেখছে।
—তাহলে মাঝে মাঝে পাগল হয়ে যাও কেন?
—মানুষ হয়ে যাই বলে।
—এটা আবার কেমন কথা হল?
ঠিক কথাই অমলা। যা দেখছি তাতে সত্যিকারের মানুষ ভাল থাকতে পারে না। মাথা ঠিক রাখার কথা না। চারপাশে কেবল দুঃখ।
—চারপাশে দুঃখ দেখ কেন?
—চোখ না থাকলে হত?
—তোমার চোখ দুটো যদি গেলে দি!
—সেটা পারলে খুবই ভাল হত অমলা!
—তুমি জান আমি পারি না। তাই এত সাহস তোমার।
—সাহসের কথা নয়। ইচ্ছের কথা। কোথাও মানুষ স্বাভাবিক আছে বল? মানুষ নরকে ডুবে থাকলে, দুটো একটা মানুয আর ভাল থাকে কি করে?
—দেখার দোষ।
—তা হবে।
সে চোখ তুলে দেখল। সেই বিশাল লাইব্রেরী ঘর। বাপ ঠাকুর্দা করে গেছে। বিকেলে তার ডাক পড়েছে আবার এখানে। চারপাশে কোন কাক পক্ষী সাক্ষী নেই। চুলদাড়ি কামায় না মানস খবর এলেই এই ঘরে তার ডাক পড়ে। স্বাভাবিক কথাবার্তা বলে, আবার ভয় দেখিয়ে ভাল করে তোলে। অতীশ আসার পর বলতে গেলে সে ভালই আছে। কোথায় যেন এই ভাল হওয়ার সঙ্গে অতীশের সম্পর্ক আছে। বউরাণী বলল, তুমি এভাবে ভাল হয়ে গেলে আমার ভয়।
—ভাল হয়ে যাচ্ছি?
—তাই ত! সবদিন দেখি না। আগের মতো রেলিঙে দাঁড়িয়ে থাক না কেন? আমার কথা ভেবে কষ্ট হয় না?
—না।
—কিন্তু আমি যে চাই চিঠিটা বের করতে।
—রাজেন চিঠি রাখবে কেন?
—দুমবার সিং বলেছে, চিঠিটা আছে। রাজেন চিঠিটার কথা জানে না।
দুমবার? কতদিন পর যেন সেই বিশাল এক প্রাসাদের পাশে আবার এক ঘোড়সওয়ার, পাশে দুমবার, দুপাশে ঝাউ গাছ, বড় নদী, জলে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ, এবং নদীর বালিয়াড়ি থেকে ফেরার সময় দুই অশ্বারোহী। তার একজন রাজেন। দুমবার ছায়ার মতো দীঘির পারে অপেক্ষা করছে।
মানস উঠে দাঁড়াল।—যাই
—আর একটু বোসো।
তখনই অমলা বলল, অতীশকে তুমি কি বলেছ?
—কৈ কিছু না ত।
—ছবি এঁকে দেখিয়েছ?
—আমি দেখাইনি, ওই তুলে তুলে দেখল!
—এই ছবিটা আঁকলে কেন?
—সেই ছবিটা, আগুনে ছবি, দাউদাউ করে রমণী জ্বলছে। উবু হয়ে বসে আছে।—ওঃ সেই ছবিটা কেমন হয়েছে বলত!
—আমি ছবি এখন বুঝি না!
—তুমি এত বুঝতে, একসঙ্গে এত ছবি আঁকলাম। তোমার এত বাহবা ছিল। এখন বলছ কিছু বোঝ না। তারপরই অমলার চোখ দেখে সে কেমন হিম হয়ে যায়। বড় করুণ চোখ। বড় অপার্থিব।
এই চোখ দেখলেও মানুষ পাগল হয়ে যেতে পারে। সে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকল।
—তোমরা কি মনে কর আমি সত্যি খুব খারাপ?
মানস বলল, জানি না।
—তুমি ভাল হয়ে গেলে কেন? তুমি ভাল থাকলে তোমার মাথা সাফ থাকে। কি করতে কী করে বসবে। কে তোমাকে এমন স্বাভাবিক করে তুলল?
—জানি না।
অমলার পাশে সেই বড় মারবেল পাথরের দেয়াল। দেয়ালে তার শ্বশুরের তৈল চিত্র। তার নিচে আর দুজন। অতীশ কেন এ বাড়িতে এল! অমলা কেমন ক্রমেই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে। যে মানুষটাকে তার পাগল করে রাখার ইচ্ছা ছিল, না হলে মানুষটা আত্মহতা পর্যন্ত করতে পারে, কারণ বিষয়- আশয়ের লোভ মানুষের মধ্যে নরক সৃষ্টি করে থাকে, সেই মানুষটা ভাল হয়ে গেলে ভয়, হয়ত একদিন শুনতে পাবে দরজা বন্ধ। বাইরে থেকে দরজা খোলা যাচ্ছে না। সেই ভয়ে ভেতরে সিলিং ফ্যান রাখা হয়নি। কড়ি বরগা নেই ঘরের। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করার ব্যবস্থা নেই। বাইরে থেকে তালা দেওয়া থাকে। সকালে কেউ খুলে দিয়ে আসে। রেলিং উঁচু করা, ছাদে ওঠার সিঁড়ি নেই। সেই মানুষটা একেবারে নিরাময় হয়ে গেলে যথার্থই ভয়। মানস সুস্থ হয়ে উঠেছে অমলার এটা বিশ্বাস হয়নি। আজ ডেকে স্বচক্ষে দেখতে গিয়ে বুঝতে পেরেছে, দুমবার মিছে কথা বলেনি। ওর বুকটা কেমন হিম হয়ে গেল। সে বলল, অতীশ তোমাকে কি বলেছে?
—কিছু বলেনি তো।
—কোন কথা না?
—না।
—তাহলে এত স্বাভাবিক হলে কি করে? না আসলে তোমার এটাও এক ধরনের পাগলামি!
.
প্রশ্নের পর প্রশ্ন। সত্যি মানসও জানে না, এটা হল কেন? অতীশকে দেখার পর স্বাভাবিক হয়ে গেল কেন! সে কি কোনও দৈববাণী শুনেছে। অতীশ কি তার হয়ে কোনও দৈববাণী করেছিল, না রাস্তায় সেই পাগলটাকে দেখে ভেবেছে, ঘাটতে গেলে তার চেয়ে ভয়ংকর জীবনের সাক্ষী লোকটা। সে কি বলবে বুঝতে পারছে না। সে কি ইচ্ছে করেই পাগল সেজে বসে থাকে!
বউরাণী ফের বলল, অতীশকে তুমি সাধু-সন্তু ভেবে থাক?
—না।
—মহাপুরুষ!
—না।
—অতীশ তবে তোমাকে নিরাময় করে দেয় কি করে?
সেটা সেও ভেবে দেখেনি। তারপর অতীশের দুটো চোখের ছবি ভাসতে ভাসতে এগিয়ে এল। কেমন মোহাচ্ছন্ন। ভেতরে বেদনাবোধ বড় তীব্র। এই চোখই মানুষকে পাগল করে দেয়। ওর কেন জানি মনে হয়েছিল, অতীশ পাগল হয়ে যেতে পারে। এই চোখ নিয়ে নিষ্ঠুর পৃথিবীতে স্বাভাবিক থাকা সম্ভব না। কেমন একটা মায়া তার জন্মে গেছে অতীশের জন্য। অতীশকে স্বাভাবিক রাখার জন্য সে এখন উঠে পড়ে লেগেছে। এটা যেন তার দায়। সে আজকাল খুব বেশি করে ফুল-ফলের ছবি আঁকছে। শিশুর এবং মানুষের শুভ বোধের ছবি আঁকছে। অতীশ ছবিগুলি দেখলে ছেলেমানুযের মতো উল্লাসে ফেটে পড়ে।
অতীশের জন্য সুন্দর সব ফুল ফলের ছবি আঁকতে গিয়ে নিজের সব ক্ষোভ দুঃখ জ্বালার কথা ভুলে গেছে মানস। অতীশই একমাত্র বলতে পারে, যে মানুষ এত সুন্দর ছবি আঁকেন পৃথিবীতে তাঁর আর কি লাগে। আমি মানসদা মানুষের এমন ছবি আঁকতে চাই। আপনি আমাকে আশীর্বাদ করবেন। এত কথার পর সে আর পাগল থাকে কি করে! সে তার যে সত্য থেকে সরে গেছিল, তা আবার অতীশ ফিরিয়ে দিয়েছে।
—কি কথা বলছ না কেন?
—কি বলব?
—তুমি এই যে ভাল হয়ে গেলে, সব সহ্য করতে পারবে? মনে পড়বে না!
—না।
—তাহলে আমি কেন এত জলে নামলুম। বলেই মানসের জামা খামচে ধরল বউরাণী। আমাকে তুমি এত নিচে নামালে কেন?
—আমি নামালাম?
—কার জন্য তবে?
—সেটা আমি ভাবিনি!
অমলা হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকল। আমার শরীর পেলে রাজেন পাগল হয়ে যায় আর তুমি বলছ, তুমি কি বলছ! তুমি যদি কিছুই না চাও কালই আমি চলে যাব।
—কোথায়?
—যে দিকে দু’চোখ যায়। আমার কি দরকার এই বৈভবের।
মানস ঠিক গা থেকে পোকা ঝাড়ার মতো অমলার হাত দুটো ছাড়িয়ে নিল। বলল, পাগলামি কর না।
—অতীশকে কালই আমি চাকরি থেকে বরখাস্ত করব।
—কেন?
—তাহলে আবার তুমি ভুলে থাকতে পারবে সব।
—আর পারব না। কারণ আমি জানি, আমার চেয়েও বড় দুঃখ কোথাও অতীশের আছে! কি জানি না, জানি না বুঝি না অথচ চোখ দেখে তাই মনে হয় আমার। এবাড়িতে এসে অতীশটা না আবার পাগল হয়ে যায়। ওর চোখে সেটা আছে। ওর বড় সেবা শুশ্রূষার দরকার।
অমলারও মনে হল কথাটা—মানস ঠিকই বলেছে। অতীশ সব কিছু ভেঙে চুরে দিতে চায়। রাজেনের মুখের ওপর কথা বলে। বাড়ির আদব-কায়দা মানে না। এতদিন ব্যবসাপত্র যে ভাবে চলেছে সে তা নাড়া দিতে চায়। পাগল ছাড়া এটা কে ভাবে। এত বড় জগদ্দল পাথর টানাটানি পাগল ছাড়া কে করে?
বউরাণী যেন আর পারছে না। বিরাট কাঁচে মোড়া টেবিল, বাতিদান, লাল নীল রঙের কাঁচের বল, পুরানো বইয়ের গন্ধ সব সরিয়ে দিয়ে সে এবার তার অন্য এক সাম্রাজ্যে পৌঁছে যায়। কাশফুল নদীর চর বড় সাদা ঘোড়া, ল্যাণ্ডোর সেই কোচোয়ান তারপরই এক বিশাল পুরুষের ছবি চোখের ওপর ভাসতে থাকে। সে বলল, তুমি জান, অতীশের জ্যাঠামশাই পাগল ছিল।
—তবে বংশে আছে। মানস চুপ করে কিছুক্ষণ কি ভাবল। শেষে বলল, সোনায় সোহাগা।
—ওর লেখা পড়েছ?
—মানস বলল, না।
—ওর লেখাতে পাগলের আধিক্য।
মানস এটা শুনে চোখ বুজে ফেলল। সে ইজিচেয়ারে মাথা এলিয়ে দিয়েছে এখন। বউরাণীর মর্জি না হলে সে এখান থেকে ছাড়া পাবে না। নতুন বাড়ির এদিকটায় দুমবার সিং থাকে। কাবুল থাকে। করিডর দিয়ে ঢুকলে দু-দিকে দুটো বড় বারান্দা। এবং যেটা দিয়ে ঢোকা যায় সেটা আর একটা। কুমারদহ থেকে আনা কিছু ছবি এই বাড়ির দেয়ালেও আজকাল সে দেখতে পায়। কোন ছবিটা কোন ঘরে ছিল সে যেন এখনও চোখ বুজলে মনে করতে পারে। রাজেন বিক্রি করেও শেষ করতে পারছে না। একটা দুটো নয়, যেমন যেখানে যত বাগানবাড়ি ছিল, দেওঘর, রাঁচি, পুরী, দেরাদুন, দার্জিলিং, বৃন্দাবন, সব জায়গা থেকে আনা ছবিগুলি ডাঁই মারা, কিছু কিছু বিক্রি করেছে, কিছু কিছু যেখানে ফাঁকা দেয়াল আছে ঝুলিয়ে রেখেছে। এ-বাড়ির রাজারা ছবির সমজদার ছিলেন, গানের সমজদার ছিলেন। এখন সব গেছে। আগে ফূর্তিফার্তা ছিল, সঙ্গে শিল্পবোধ ছিল। এখন রাজেনের শুধু ফূর্তিফাতাই আছে। বাইরে থেকে ধরা যায় না। অমলার চোখ দেখলে টের পাওয়া যায়। সে বলল, আধিক্য কেন?
বউ-রাণী বলল, ওকে জিজ্ঞেস কর না।
মানস এবার সহসা কি মনে পড়ার মতো বলল, তাহলে আমি যাই। কাজ আছে।
বউরাণী হাসল। খুব কাজের লোক। নিজের জায়গাটুকু ঠিকঠাক রাখতে পারলে না, এত কাজ করে আর কি হবে! বউরাণী আর আটকে রাখল না। বলল, যাও। তারপরই লাল আলো জ্বলে উঠল, দুমবার প্রায় গড়িয়ে গড়িয়ে ছুটতে থাকল। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে সেলাম দিল।—বাবুকে দিয়ে এস।
মানস বলল, আমি তো ভাল হয়ে গেছি, আর দুমবার কেন?
.
প্রখর উত্তাপের জন্য এখন পথ জনবিরল। ট্রাম-বাস চলছে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে। মসজিদে মোল্লার আজান। এই আজান শুনলেই ফকিরচাঁদ তটস্থ হয়ে ওঠে—চারুটা গেল কোথায়! সকালে বের হয়, স্নানের আগে চলে আসে। আজ আসেনি। ফকিরচাঁদ উঠে দাঁড়াল। খুঁজতে হয়। কপালে হাত রেখে দেখল ট্রাম ডিপোর সামনে ডাস্টবিন-সেখানে অনেকের সঙ্গে চারু উপুড় হয়ে এখনও কি খুঁজছে। খুঁজে খুঁজে কিছু পাচ্ছে না। শুধু কিছু পোড়া কয়লা বাদে কিছু পাচ্ছে না। তবু খোঁজে। অবিরাম এই খুঁজে খুঁজে শহরের গভীরে ঢুকতে চায়। ফকিরচাঁদ বলেছে, বড় শক্ত। কঠিন। কিছু হবে না। চারু তবু শোনে না। ফকিরচাঁদের রাগ বাড়ে। সে মনে মনে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। খেতে দেয়নি। না খেলে মানুষের মেজাজ ঠিক থাকে কি করে!
ক্ষোভে দুঃখে বড় বড় সুন্দর হস্তাক্ষরে ফকিরচাঁদ ফের ফুটপাথ ভরিয়ে তুলল। প্রখর উত্তাপের জন্য সামনের বড় বড় বাড়িগুলির দরজা জানালা বন্ধ। ট্রাম ফাঁকা এবং বাসযাত্রী উত্তাপের জন্য কম। সুন্দর হস্তাক্ষরের জন্য কেউ দু-দশ পয়সা ছুঁড়ে দিচ্ছে না। রাগটা আরও বাড়ছে। চোখে আগুন। সে তার হস্তাক্ষরের ওপর থুতু ফেলল। তারপর রাগে দুঃখে মাদুরে শুয়ে পড়ল।
চারু আসছে না। ওর গলার আওয়াজ প্রখর নয়। ফকিরচাঁদের মিনমিনে গলার ডাক চারু শুনতে পায়নি। সে নিজেকে খুবই অসহায় ভাবল—এই দুঃসময়ে সে যেন আরও স্থবির হয়ে যাচ্ছে। চলৎশক্তি হারিয়ে ফেলছে। এত বেলা হল, এখনও পেট নিরন্ন—সামনের হোটেলটাতে গিয়ে দাঁড়ালে চারু কিছু ঠিক পেত। কারণ, সে বুঝতে পারে, শেষ খদ্দেরটা চলে যাচ্ছে। এখন না গেলে আর মিলবে না।
ফকিরচাঁদ অভিমানে শুয়ে শুয়ে কাঁদল। তারপর উঠে দাঁড়াল। খিদে পেলে তার এখন শুধু কান্না পায়। কিন্তু উঠে দাঁড়াতে গিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গেল। ফের চেষ্টা, তারপর লাঠিতে প্রায় ভর দিয়ে হাঁটা। পরে হেঁটে হেঁটে রেস্তোরাঁর সামনে যখন উপাসনার ভঙ্গিতে মাথা হেঁট করে দাঁড়াল, যখন করুণাই একমাত্র জীবনধারণের সম্বল এবং আর কিছু করণীয় নেই এই ভাব—তখন সে দেখল সব সোনা-রুপোর পাহাড় আকাশে। আকাশ গুড়গুড় করে উঠল। মেঘে মেঘে ছেয়ে যাচ্ছে আর বাতাস পড়ে গেল। দরজা-জানালা খুলে গেল ফের। এবং গ্রীষ্মের প্রখর উত্তাপের পর বৃষ্টির জন্য সর্বত্র কোলাহল উঠেছে।
আর তখনই চার্চের দরজাতে শববাহী এক শকট। মাঠের মসৃণ ঘাস মাড়িয়ে সে ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। তুলে নেওয়া হচ্ছে মানুষের ইচ্ছার শেষ বাসনাটুকু। অথচ মানুষ যায় মানুষ আসে। বহুদুর থেকে তারা যেন আসে আবার সুদূর এক পরলোকে হারিয়ে যায়। ফকিরচাঁদ মৃত্যুর গাড়ি দেখে, আকাশে সোনা-রুপোর পাহাড় দেখে তার অন্নকষ্ট ভুলে যায়। তার ইচ্ছে হয় ভাবতে মানুষের যাওয়া- আসা বড় মধুর। ইচ্ছে হয়, বসে বসে অনন্তকাল সে মানুষের মিছিল গুণে যায়! মনে হয় নিজেই একজন প্রহরী। তখনই দু-এক ফোঁটা বৃষ্টি ওর মুখে মাথায়! প্রচন্ড দাবদাহের পর শহরের এই বৃষ্টি তাকে কাতর করছিল।
বাসস্ট্যান্ডে যারা দাঁড়িয়েছিল তারা পর্যন্ত কয়েক ফোঁটা বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করল। কারণ, দীর্ঘ সময় ধরে খরা চলছে। ঘাস মাঠ শুকনো। আকাশ গনগনে। পিচ গলে কাদা। সারা শহরটা গরম তাপে সেদ্ধ। তখন বৃষ্টির ফোঁটা অমৃতের স্বাদ বহন করে। সব মানুষজন ঘরবাড়ি সর্বত্র এক আকাঙ্ক্ষা। আয় বৃষ্টি ঝেঁপে—সবাই যে-যার দরজা-জানালা খুলে অপেক্ষা করছে। ফকিরচাঁদও বৃষ্টিতে ভেজার জন্য আকাশের নিচে উবু হয়ে বসল।
এবং পাগল যে শুধু হাঁকছিল, ‘দম মাধা দম পাগলা মাধা দম’ শুধু হাঁকছিল কে আসবি আয়, সংক্রান্তির মাদল বাজছে আয়—সে এখন কিছু না হেঁকে শান্ত নিরীহ বালকের মত অথবা কোনও কৈশোর স্মৃতি স্মরণ করে আকাশে মেঘের খেলা দেখছিল। বড়ই পবিত্র—বড়ই সুখ ভেসে যায়। সে অপলক মেঘের খেলা দেখতে দেখতে বড়ই নিমগ্ন। কোথা থেকে এল ঝড়ো হাওয়া, পাখির পালক নিয়ে উধাও। তার কিছু আসে যায় না। সে কোথাও যেন দূর অতীতের মধ্যে সোনার খনির সন্ধান পেয়ে যায়। ভারি পাগল করে দেছে তারে। লাঠিতে পালক নেই। সে জানেও না প্রকৃতি এই মুহূর্তের জন্য তারে বড় নিঃস্ব করে দেছে।
তখনই কে যেন হাঁকল, যায় উড়ে যায়!
কি উড়ে যায়! পাগল চারপাশে তাকায়।
পালক উড়ে যায়। সে দেখল, সত্যি একটা পাখি মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। পালক তার পাখি হয়ে গেছে।—সে কোন্ পাখি তুমি! সংবিৎ ফিরে আসার মতো পাগল পাখির পেছনে ছোটে। পাগলিনী নিভৃতে ট্রাম ডিপোর বাইরে লোহার পাইপের মধ্যে বসে আকাশে মেঘের ওড়াওড়ি দেখছিল। উথাল-পাতাল হচ্ছে মেঘ। সে দেখছে আর বসে বসে দাঁতে নখ খুঁটছে। কেউ চিৎকার করছে, পাখি উড়ে গেল।
সতীবিবি দু-হাতে খপ করে হরিশের এক পা চেপে ধরল। বলল, দ্যাখ, জল আসছে। ছুটছিস কোথায়?
সে কিছুই শুনছে না। তার যে কখন কি চলে যায়! নিয়ে যায় কে সব! তার এভাবে কতকাল থেকে হরণ করে নিচ্ছে কারা। তার পাখিটাও মেঘ দেখে আকাশে উড়ে গেল। সে পা ছাড়িয়ে আবার ছুটতে থাকল।
বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি হচ্ছিল। চারু আবর্জনা ঠেলে ছুটে আসছে। ফকিরচাঁদের কাছে এসে বলল, সব উড়িয়ে দেবে, ভাসিয়ে দেবে। তাড়াতাড়ি কর। সে প্লাস্টিকের চাদর টেনে তার অমূল্য হাঁড়ি- এনামেলের কড়াই, কাঁথা বালিশ ঢেকে দিতে থাকল। বৃষ্টির ছাটে সব ভিজে যায়।
বৃষ্টির ফোঁটা বরফের কুচির মতো কালো পাথরে যেন ভেঙে ছিটিয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে। পথের যাত্রীরা কেউ পথে নেই। সবাই বাস স্টপের শেডে এবং দোকানে দোকানে সাময়িক আশ্রয়ের জন্য ঢুকে গেল।
.
সুধীর তখন জানালাটা বন্ধ করে দিতে এলে অতীশ বলল, না, খোলা থাক।
—ছাট আসবে স্যার।
আসুক।
সে সব কাজ ফেলে দূরের আকাশ দেখার চেষ্টা করল। মনের মধ্যে বৃষ্টির সহসা আবির্ভাবে আশ্চর্য সুষমা খেলা করে বেড়ায়। তার মনে হয়, এই বৃষ্টি পৃথিবীর জন্য সবুজ শস্য কণা বয়ে আনে।
কুম্ভবাবু উঠে এসে বলল, দাদা, ভিজে যাচ্ছেন ত।
—একটু ভিজি।
—কি দেখছেন? কাগজপত্র সব ভিজে যাচ্ছে।
অতীশ একটা পাট ভেজিয়ে দিয়ে বলল, ক’দিনের ছুটি নেব।
—কোথাও যাবেন?
—বাড়িতে যাব ভাবছি।
—বউদির কাজ ঠিক হয়েছে শোনলাম।
নির্মলা কাটোয়ার কাছে একটা স্কুলে কাজ পাবে কথা আছে। এখনও সে ঠিক করতে পারছে না কি করবে। টাকার খুব দরকার। গত মাসে বাবাকে সে টাকা পাঠাতে পারেনি। অক্ষমতা। বাবা কি না জানি ভাবছেন! বাবাকে এই নিয়ে চিঠি লিখতেও সাহস পায়নি। ইচ্ছে আছে, যদি লেখা থেকে কিছু টাকা পায় আগামী মাসে দু-মাসেরটা একসঙ্গে পাঠিয়ে দেবে!
সে শুধু বলল, বেশ জোরে বৃষ্টি নেমেছে।
—বৌদি একা যাবে?
অতীশ বলল, এখনও কিছু ঠিক হয়নি। দেরি আছে।
—এখানে হল না। রাজার চিঠি নিয়ে যেন কোথায় গেলেন?
—না হল না!
—অতদূরে চলে যাবে, আপনার কষ্ট হবে না?
কুম্ভর কথাবার্তাই এই রকমের। সহজেই সে মানুষকে আপন করে নিতে পারে। সহজেই সে মানুষকে শত্রু করতে পারে। কিন্তু সে তা পারে না। সে বলল, আপনার বউদির শরীরটা ভাল যাচ্ছে না।
বৃষ্টিতে পথঘাট ভেসে যাচ্ছে। আর একটু হলেই জল জমে যাবে। কড়কড় শব্দ করে কোথাও একটা বাজ পড়ল। অতীশ ভয়ে ভয়ে কাঠের ওপর পা তুলে দিয়েছে। সব সময় আশঙ্কা, তার কিছু কেউ কেড়ে নেবে। টুটুল মিণ্টু অত বড় বাড়িটায় এখন কি করছে কে জানে। নির্মলার শরীর দিচ্ছে না আর। একটা লোকের খুব দরকার। নির্মলা ফাঁক পেলেই শুয়ে থাকে। সে বাড়ি থাকলে বুঝতেই দেয় না, নির্মলার মধ্যে কোনও অস্বস্তি আছে। ডাক্তার দেখছে। পিরিয়ডের গন্ডগোল, তলপেটে প্রচন্ড ব্যথা—এবং রক্তপাত গভীর। ওর দিদিও দেখে গেছে একদিন। বলেছে, শীত এলে নিয়ে যাবে হাসপাতালে। মাইনর অপারেশন। ভয়ের কিছু নেই।
বিচ্ছু দুটো আবার না বৃষ্টিতে ভিজে বেড়ায়। দুটোই হয়েছে হাড়ে হাড়ে বজ্জাত। ফাঁক পেলেই টুক করে নেমে যাবে। পাতাবাহারের গাছগুলো পার হয়ে বউরাণীর সখের ভুট্টার জমিটার দিকে চলে যাবে। ক’বিঘে জমিতে লাঙ্গল লাগিয়ে চাষ। গম আর ভুট্টার খেত। বড় বড় পাতা, আর হলুদ রঙের ভুট্টা—বড়ই লোভ। এবং তারপরই পুকুর! পুকুরের জলে গভীর একটা অন্ধকার। এই অন্ধকারটা বাইরে গেলেই তাকে তাড়া করে! রাতে সে টের পায়, ঘরের অন্ধকারে সেই কোনও ছায়া! যে দেখা দেয় না, তবু পাশে পাশে থাকে। ছায়ার মতো, কিংবা কুয়াশার মতো। তার কি ইচ্ছে কে জানে। অতীশ বলল, কাল আসতে দেরি হবে।
—তা আসবেন।
পরদিন রাজবাড়ির কেউ কেউ দেখল, অতীশ পুকুরে চান করতে যাচ্ছে। হাত ধরে আছে মিণ্টু। মিণ্টুকে অতীশ সাঁতার শেখাতে নিয়ে যাচ্ছে। পায়ে পায়ে আসছে টুটুল। সে সবাইকে গর্ব করে বলছে, আমার বাবা। আমার দিদি।
সুরেন বারান্দায় উবু হয়ে সব শুনছিল। ও বসে বসে কাশছে। সকালের দিকে কাশিটার প্রকোপ বাড়ে। ভোর রাতে ঘাম দিয়ে জ্বরটা ছেড়ে যায়। হালকা লাগে শরীর। এই সময়টাতে সে বড় দুর্বল বোধ করে। উঠতে ইচ্ছে হয় না। নড়তে ইচ্ছে হয় না। সংসার রসাতলে গেলেও সে চোখ বুজে পড়ে থাকতে ভালবাসে। কাশি এবং জ্বর প্রবল হওয়ায় আজ অফিস যেতে পারেনি। নতুন ম্যানেজার তার দরজার পাশ দিয়ে কোথায় যাচ্ছে। পাজামা পরনে, গায়ে গেঞ্জি এবং কাঁধে তোয়ালে! খালি পা। এদিকটায় কোনও দিন তাকে এভাবে দেখা যায় না। আজ কেন? সে গলাটা লম্বা করে দিল। আর তখনই শুনতে পেল, সেই সুন্দর শিশুটি বলছে, আমার বাবা।
সুরেন উঁকি মেরে বলল, না আমার বাবা।
টুটুল ঘাবড়ে গেল। সে দৌড়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমার বাবা।
পাশাপাশি ঘরগুলি থেকে সবাই তখন টুটুলকে ক্ষেপাচ্ছে, আমার বাবা।
যত সবাই বলছে, তত ত্রাহি চিৎকার টুটুলের, না আমার বাবা। কিন্তু এতগুলি মানুষের সঙ্গে সে পারবে কেন। যদি সত্যি তাদের বাবা হয়ে যায়। সে বাবাকে ছেড়ে দিয়ে দু-চোখ হাতে চেপে ধরল। অতীশ বুঝতে পারল, টুটুল তার কান্না সামলাচ্ছে। সে তাড়াতাড়ি ওকে বুকে তুলে নিয়ে বলল, না না, আমি তোমারই বাবা।
শিশু কি বোঝে কে জানে। মুখে চোখে বাপকে জয় করতে পেরে দিগ্বিজয়ের হাসি। তারপরই প্রশ্ন, বাবা ওটা কি?
—ওটা গাছ।
—কি গাছ বাবা?
—কদম ফুলের গাছ।
—আমাকে ফুল দেবে?
—দেব।
ঘাটলায় এসে অতীশ বলল, তুমি এখানে বস। নামবে না কিন্তু। জলে শেকল আছে। বড় একটা শেকল। নামলেই পায়ে এসে জাপটে ধরবে। জলের তলায় নিয়ে যাবে। আমরা তোমাকে আর তবে পাব না।
টুটুল ঘাটলার সিঁড়িতে চুপচাপ বসে থাকল। কালো জল, পদ্মপাতা, দুটো-একটা পাখি, ওপারে কেউ ছিপ ফেলে বসে আছে, ঘাটলায় মানুষজন চান করছে। জলের ওপর শেকলের শুঁড় ভেসে ওঠে যদি—টুটুল চারপাশে বড় বড় চোখে এমন ভেবে তাকাল। যদি ওটা এগিয়ে এসে সত্যি পা জড়িয়ে ধরে। সে ভয়ে তার দু-পা চেপে ধরে বসে আছে।
তারপরও আশ্বস্ত হতে না পেরে বলল, বাবা ভয় করে।
—ভয় নেই। বোস ওখানে।
মিণ্টু ভাইকে বলল, তুই হাঁদা, বাবা থাকলে শেকল কিছু করে না, না বাবা?
অতীশ মিণ্টুকে ধীরে ধীরে জলে নামাচ্ছে। জলে নামতে তারও ভয়। কোন ফাঁকে তার পায়ে না সাপটে ধরে। অতীশ দেখল, সহসা মিণ্টুর চোখ-মুখ ভারি গম্ভীর হয়ে গেছে। সে বলল, কি হল নামো, নামো। আমি ত ধরে রেখেছি। ভয় কি। সাঁতার না শিখলে চলে!
টুটুলের ভারি মজা। সে বলল, দিদি আমাকে মারে বাবা।
—কবে মারলাম, মিথ্যুক
অতীশ বলল, ঠিক আছে, এবারে পা-দুটো নামিয়ে দাও। পা-দুটো নাড়। জলে না নামিলে কেহ শিখে না সাঁতার। এই প্রবচনটি অতীশের মাথায় খেলে গেল। সে বলল, কি হল, তুমি পা নাড়ছ না কেন? হাতে জল টান। এই দ্যাখ জল, সে কিছুটা জলে নেমে তার দুই সন্তানকে সাঁতার বস্তুটি কি তার একটা নমুনা দেখাল। আর তখনই দেখল, মিণ্টু জল থেকে উঠে ঊর্ধ্বশ্বাসে বাড়ির দিকে ছুটছে। পেছনে টুটুল।
অতীশ হাঁ হয়ে গেল। বাসায় ফিরে দেখল, ওরা কোথাও নেই। নির্মলা রান্নাঘরের মোড়ায় বসে আছে। সে বলল, দেখলে ত কান্ড। জল দেখেই পালিয়েছে।
—দেখতে হবে কার ছেলে।
অতীশ বুঝল, নির্মলা ওকে ঠেস দিয়ে কথা বলছে। সে বলল, ওরা কোথায়?
—বাথরুমে ঢুকে আছে ভয়ে।
—এত ভয়!
—নির্মলা বলল, তুমি থাকলেই ভয়। ওদিকে ত তুমি জান না, মিণ্টু ফাঁক পেলেই ভাইয়ের হাত ধরে পুকুরপাড়ে চলে যায়। দুমবার বলেছে, ওখানে নাকি রাজবাড়ির পরীরা থাকে। ওরা পরী দেখার জন্য ঘাসের মধ্যে উবু হয়ে বসে থাকে।
পরীরা তবে রাজবাড়িতেও ঘোরাফেরা করে। পরীরা আকাশে বাতাসে সমুদ্রে সর্বত্র উড়ে বেড়ায় বুঝি, মাথার মধ্যে, রক্তে নিরন্তর খেলা করে পরীরা। ওদের মতো সেও এক পরীর ঘোরে পড়ে গেছে। কতদূর টেনে নিয়ে যাবে কে জানে।