1 of 2

ঈশ্বরের বাগান – ১৬

।। ষোল।।

জানালা থেকে রোদ নেমে গেলেই কাবুলের চঞ্চলতা বাড়ে। বড় সুসময় বয়ে যাচ্ছে। বাবুর্চিপাড়া, বাবুপাড়া, কেরানি পাড়ার ঘরগুলিতে এখন পুরুষদের সংখ্যা কম। কাজ কম্মের ধান্দায় দশটার আগেই পাড়া খালি করে তারা বের হয়ে যায়। তখন কাবুল উঁকি দিয়ে দেখে। গ্যারেজের চাবি নিয়ে আঙুলে রিঙ ঘোরায়। আর একটু সময়—কারণ হাসিরাণীর বাড়িতে এখনও কিছুটা স্নান আহারের তাড়া আছে। কুম্ভর ভাই দুলাল, শম্ভু, কলেজে গেলেই বাড়িটা ফাঁকা। সুরেনের মেয়েটাকে কুম্ভ পাহারায় রেখে যায়। ওতে তার সুবিধাই হয়েছে। ফাইফরমাস দিয়ে বাইরে পাঠিয়ে দিলেই সব সুনসান। অবশ্য ইদানীং হাসিরাণীর সতীপনা বেড়েছে। মেয়েটা হয়ে যাওয়ার পরেই আর গায়ে ফায়ে বেশী হাত দিতে দেয় না। তবু কি যে হয়, হাসিরাণীর গোলগাল টোবলা মুখ, চোখের সামনে ভাসে! মাথা ঝিম মেরে থাকে। কেবল জানলায় চোখ রেখে বসে থাকে। এই রাধিকাবাবু গেল, এই কুম্ভ গেল। শম্ভু দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। সেও বের হয়ে যাচ্ছে। বাকি থাকল এক। কাবুল বেশ অস্থির হয়ে পড়েছে। ঘরে পায়চারি করছে। কান চোখ মুখ কেমন গরম, জ্বর আসার মতো। সে এক দণ্ড বসে থাকতে পারছে না। হাসিরাণী বোঝে না কত সে করে। কুম্ভর ছ্যাঁচড়া স্বভাব। বউরানী সব জানে, টের পায়। তার তখন এক কথা, ছ্যাঁচড়া লোকটা তোমাদের আছে বলেই সিট মেটাল টিকে আছে। সব অভিযোগ সব সময় খণ্ডন করে দেয়। এবং কুম্ভ যদি কখনও এসে দেখতে পায়, রাধিকাবাবু যদি দেখতে পায় কাবুল বারান্দায় বসে হাসিরাণীর সঙ্গে গল্প করছে—সহজেই হজম করে নেয়।

এক গেরো। কাবুল তখন বেশ সরল মানুষের মতো হেসে দেয়। আরে কুম্ভ যে। তোমার শালা বড় খারাপ স্বভাব। বউকে ছেড়ে থাকতে পার না। চা খাচ্ছি। এ বাড়ির চা না খেলে দিনটাই খারাপ যায়। এই হাসি এত কিপ্টে কেন বাবা! এক কাপ চাও দেবে না! অথবা নানা রকমের কথা, ইষ্টবেঙ্গল মোহনবাগানের কথা। সিনেমার নায়ক-নায়িকার কথা। কোথাও যদি দুর্ঘটনা ঘটে থাকে তার কথা। কেবল কথা।

রাধিকাবাবু জানে, কুম্ভর চাকরি কাবুল করে দিয়েছে। রাধিকাবাবু জানে তিনি যে বিশ্বাসী মানুষ, এটা কাবুলই বলে বলে এখনও বউরাণীর কাছে ঠিক রেখেছে। অর্থাৎ এ-বাড়িতে কি খাওয়া হয়, কি বৈভব আছে, তা বউরাণীর কানে যায় না কাবুল হাতে আছে বলেই। যা মাইনে তাতে পেট চালানো দায়। অথচ রাধিকাবাবু এখনও দেশের বাড়িতে দুর্গা পুজো করেন। মেয়েদের মাসোহারা পাঠান। ছেলেদের সবার নামে ব্যাংকে একাউণ্ট করে দিয়েছেন। একটা আমবাগান, নারকেল বাগান, দশ বিঘের ওপর নীলগঞ্জের কুঠিবাড়ি বেনামে কিনে নিয়েছেন রাজার কাছ থেকে। এত সব করছেন, অথচ বিশ্বাসী হতে আটকাচ্ছে না। মূলে আছে কাবুল। হাত ছাড়া হলেই সব দাপট যাবে।

কাবুল না থাকলে কুম্ভকে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াত হত। চাকরি করে দেবার পরই কুম্ভ এসে বাপকে একদিন বলল, সব চুরি হয়ে যাচ্ছে বাবা। স্ক্র্যাপ বিক্রি করছে, টাকা জমা পড়ছে না। বুড়ো ম্যানেজার মেরে দিচ্ছে।

রাধিকাবাবু বলেছিলেন, তার আমি কি করব?

—রাজার কানে কথাটা তোলেন!

—শুনবেন কেন? আমার ত ওতে কথা বলার এক্তিয়ার নেই। আসলে নিজের পাছায় ঐ যে কি লেগে থাকে না, তাই না হয়েছে রাধিকাবাবুর! সব সময় সতর্ক থাকতে হয়। তার ওপর পুত্রের ঝামেলা তিনি কাঁধে নিতে রাজি না। যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ। দোষের কিছু না।

সুতরাং কাবুলকেই ধরতে হয়। কুম্ভর কাবুলই ভরসা। এক সঙ্গে বড় হয়েছে। এক সঙ্গে পড়েছে, ফুটবল খেলেছে। বেশ্যালয়ে গেছে কাবুলের টাকায়। এস্টেট থেকে মাসহারা পায় কাবুল। সে অনেক টাকা। যত ফূর্তি-ফার্তা কাবুলই তাকে করিয়েছে। এখনও কাবুল সহায়। কাবুলকেই সে কান ভারি করেছিল। তারপর কি সুসময় কুম্ভর। রাজা ডেকে পাঠিয়েছিলেন। রাজা সব খবর নিতে থাকলেন। সনৎবাবুকে ডেকে বলেছিলেন, সিট মেটালের ম্যানেজার সব ত ফাঁক করে দিচ্ছে। খবরটা রাখেন। সনৎবাবু বলেছিলেন না জানি না। আমার বিশ্বাস হয় না। আমি তাকে খুবই ধার্মিক মানুষ জানি। তখন লাগে সনৎবাবুর পেছনে। এই করে এত দুরে আসা কুম্ভর। কুম্ভ তখন হাসিরাণীকে বলত, কাবুল এলে আদরযত্ন কর। কুম্ভ জানত হাসিরাণীর প্রতি কাবুলের দুর্বলতা আছে। কুম্ভ বাড়ি না থাকলেও সে আসত ঠিক বাড়ির ছেলের মতো। এখন যত দিন যাচ্ছে কাবুলের আকাঙ্খা বাড়ছে। আর দশজনও দেখছে, কিন্তু রাধিকাবাবু চুপ, কুম্ভ কখনও ফিরে এসে দেখলেও চুপ। ভিতরটা গুম মেরে গেলেও ওপরে ঠাট্টা তামাশা। এখন ও আর তত সহজে বলতে পারে না, কাবুল আমার জন্য যা করেছে! কাবুল না থাকলে হাসিরাণীর মুখে হাসি ফুটত না।

কাবুল এবার নিঃশ্বাস ছেড়ে বাঁচল। যাক দুলালটাও চলে গেল। এখন কোয়ার্টারে শুধু হাসিরাণী আর সুরেনের মেয়েটা। এই দুজন। হাসিরাণী ঠিক এখন মেয়েকে নিয়ে মজেছে। সে পেছন থেকে গিয়ে একটা হুঁম করবে। হাসিকে ভয় পাইয়ে দেবে। তারপর মোড়া টেনে সুরেনের মেয়েটাকে বলবে, এই যা, রবির দোকান থেকে গরম সিঙাড়া কচুরি আন। হাসি চা লাগাও। যেন এই চায়ের জন্য ফন্দি ফিকির করে গোপনে ঢুকে যাওয়া। বলে রাখা, এখনও সময় হয়নি, কুম্ভকে বলো, সবটাই খেলিয়ে তুলতে হয়।

.

তখন কুম্ভ বলল, দাদা শরীরটা ভাল লাগছে না। অফিস যাচ্ছি না। আপনি যান। সাধারণত অতীশ এবং কুম্ভ একই সঙ্গে কারখানায় যায়। কোনদিন কারুলের সঙ্গে রাজবাড়ির আলগা কাজ থাকলে কুম্ভর যেতে দেরি হয়। সেদিন অতীশ একা যায়। আজও হয়ত কোন কাজ-টাজ পড়ে গেছে! সে বলল, কাবুলবাবুর সঙ্গে কোথাও বের হবেন!

কুম্ভ বারান্দায় গোল টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে কিছু যেন ভাবছে, অতীশের কথা শুনতে পায় নি কালও রাজার সঙ্গে কথাবার্তা প্রায় ঠিক। আগে মাইনে বাড়ান, মাল বাড়ান, ওভারটাইম বন্ধ করুন, সব ঠিক আছে। কিন্তু অর্ডারপত্র কম। বেশি অর্ডারপত্র নিতে হলেই রামলাল পিয়ারিলালের দরকার। এত বছর এই করে চলে আসছে আজ হঠাৎ রামায়ণ গাইলেই হবে কেন! রাজাও কথা দিয়েছিল—কিন্তু তারপর সব কেমন ওলটপালট হয়ে গেছে। কে সেটা করে! তবে সে অতীশকে যতটা বোকা ভেবে থাকে, সে ততটা নয়। বোকা ঠিক নয়, যতটা ভাল মানুষ ভাবে ততটা ভালমানুষ নয়। বউরাণীর সঙ্গে কি কোনও গোপন সম্পর্ক আছে! কে জানে! কুম্ভ মনে মনে ভীষণ জেদি হয়ে উঠেছে। চোখ মুখ লাল। অতীশ ফের কোনও কথা বলতে সাহস পেল না। সে এই সব মুখে কি ধরা পড়ে, জানে। এবং কুচক্রীকে সে ভয় পায়, আর কুম্ভর মুখে বাঘের মুখ দেখে ফেলে বলেই ভয়। এখন আর সে মানুষের মুখে বাঘের মুখ দেখতে চায় না। টুটুল মিণ্টু আছে। মিণ্টুর জন্য সে ভেবেছে একবার নিবেদিতায় যাবে। নির্মলার শরীর ভাল যাচ্ছে না। এখানে এসে রোগা হয়ে গেছে। নির্মলার দাদা এসে একবার কিছুদিন নিয়ে রাখতে চেয়েছিল, অতীশের অসুবিধা হবে ভেবে যায় নি। আসলে নির্মলার এখন একার হাতে সংসার। সে টানতে পারছে না। অভাব বাড়ছে। এই সব সাত-পাঁচ চিন্তা ভাবনায় সে যখন ট্রাম রাস্তা পার হচ্ছিল তখন কুম্ভ ঘরের দিকে হাঁটছে।

আসলে উচ্চাকাঙ্খা মানুষকে কখনও কখনও ভারি গোলমালে ফেলে দেয়। এবং এই আকাঙ্খা মানুষকে কখনও কখনও বড় রক্তাক্ত করে। মেজাজ-মর্জি ঠিক রাখা যায় না। কুম্ভ বাড়ি ঢুকেই মেজাজ- মর্জি ঠিক রাখতে পারছে না। দাঁত চেপে হজম করে যাচ্ছে। সুরেনের মেয়েটা নেই। সে ঢুকেই বলল, ও গেল কোথায়?

কাবুলের ভেতরটা কেঁপে উঠল। কুম্ভ অসময়ে! অবশ্য অসময়ে কুম্ভ আরও এসে দেখেছে, খোস মেজাজে হাসির সঙ্গে নানা রকমের সে গুল ঝেড়ে যাচ্ছে। কাবুল জানে দায়টা কুম্ভর কোথায়। সে সহজেই খুব সরল মানুষ হয়ে যেতে পারে। কুম্ভকে দেখেই বলল, কি বে খুব জোর ল্যাং খেলি তো!

কুম্ভ হাসির দিকে তাকিয়ে বলল, একটু গরম জল বসাও। দাঁত ব্যথা করছে। হাসি বলল, বসাও না, আমি কি বসে আছি। কুম্ভ কিছু বলল না। ব্যাগটা ঘরের ভিতর রেখে নিজেই কেটলিতে জল ঢালতে থাকল। হাসি যেন পাত্তা দিচ্ছে না। সে ত কাবুলকে নিয়ে কিছু করছে না, মেয়েটার গায়ে তেল মাখাচ্ছে। কাবুল পাশে মোড়ায় বসে আছে। কে আসে কে যায় হাসির যেন মাথাব্যথা নেই।

কুম্ভ জলটা ঢেলে স্টোভে কেটলিটা নিজেই বসিয়ে দিল। খুব গম্ভীর। কাবুল লক্ষ্য করছে সব কাবুল এটা টের পায়, কুম্ভর যতই মেজাজ বিগড়ে যাক, যতই দাঁত ব্যথা করুক এখন উঠতে চাইলেই ধরে রাখবে। বসিয়ে রাখবে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে রাজবাড়ির ভেতরের খবর নেবার জন্য দাঁত ব্যথা সত্ত্বেও অনর্গল বকবে। সে বলল, কুম্ভ জলটা বেশি করে দে। তোর বউকে ত বলে পারলাম না। একটু চা পর্যন্ত করে দেয় না এলে। আমার মূল্য ধরে দেখছে না।

—বাদ দে ভাই আমাদের কথা। সে ঘরে গিয়ে সব খুলে একটা লুঙ্গি পরে এল। তারপর কারো দিকে তাকাল না। কারণ তাকালেই হাসিকে সে নষ্ট মেয়ে ভাবছে। হাসির মুখ দেখলেই ধরে পেটাতে ইচ্ছে করছে। শরীরে তার এত কি জ্বালা! গতরের জ্বালা, সে আমারও কম নেই।

হাসি বেশ খুশি। কুম্ভর দাঁত ব্যথার জন্য এতটুকু কোন সহৃদয়তা নেই। সে মেয়েটার টুবলা গালে চুমু খাচ্ছে। দু-হাত দু-পা মুঠো করে ছেড়ে দিয়ে বলছে, ফুক্কা। মেয়েটা খিলখিল করে হেসে উঠছে। একবার কুম্ভর দিকে টেরচা করে চেয়েছে। তারপরই ভেবেছে, তুমি একটা ম্যাঙ্গো। আমাকে ধষ্টাবে। লোকটাকে . ত কিছু বলতে পার না। ভাল লাগলে কি করব! রাজবাড়ির গন্ধ লোকটার গায়ে। সে একবার এটা বলেও ফেলেছিল, সন্দ যখন বারণ করে দাও না। তুমি না করলে আমিই করব।

কুম্ভ জলে পড়ে যাবার মতো চিৎকার করে উঠেছিল, আরে না, না! চটাতে যেও না। বন্ধু-বান্ধব লোক। এক সঙ্গে মানুষ হয়েছি, মা বাবা কেউ নেই, পিসতুতো ভাইয়ের কাছে আছে। আছে বলেই যে কুম্ভর রক্ষা সেটা আর বলে না। সুতরাং হাসি ভয় পায় না। বরং মজা পায়। দুজন পুরুষকে নিয়ে খেলতে মজা পায়। মেয়েটা হবার পর পুরো একমাস সিনেমা না দেখে ছিল। সাত পাকে বাঁধা বইটা হাসি চারবার দেখেছে। আবার এলে দেখবে। এসেও ছিল। চলেও গেছে। এক মাসে হাসির জীবনে অনেক ক্ষতি হয়েছে। মেয়েটা হওয়ায় এই ক্ষতি। তারপর টেবির কাছে রেখে সেটা বাকি তিন মাসে পুষিয়ে নিয়েছে। এখন তার আকাশ বড় ঝকমক করেছে। সে একা কাটায় কি করে! আর পুরুষ মানুষের ক্ষমতা কতদূর সে জানে। ওদের দৌড় বিছানা পর্যন্ত। যতই লম্ফঝম্ফ হোক রাতে সব কাত। না, শরীর ভাল্লাগছে না। আমাকে ঘুমোতে দাও। আর যায় কোথায়। সোহাগে সোহাগে তখন পাগল করে ছাড়বে। কি চাই, শাড়ি—দেব। অলংকার—দেব। অলংকার―দেব। সিনেমা—দেখাব। তখন আর পৃথিবীতে কিছু বাদ থাকে না—সব এনে শ্রীচরণ পদ্মে হাজির। সুতরাং হাসি কুম্ভর দাঁতের ব্যথায় গা করল না। রাত এলেই সব সেরে যাবে। ব্যথা-টেথা সব পগার পার। হালুম হুলুম তখন। খাব খাব তখন।

কাবুল বলল, হাসি তুমিও পার। দাঁত ব্যথা বলতে! জলটা বসিয়ে দিতে কি তোমার ক্ষতি ছিল বুঝি না!

হাসি কাবুলের কথাও গ্রাহ্যি করল না। সে মেয়েকে চান করাতে থাকল। রোদে জল দিয়ে রেখেছিল, সেটা দিয়ে চান করাচ্ছে। দুগাছা দূর্বা দেওয়া জলে। জলে কোন সংক্রামক বীজাণু থাকতে পারে ভেবে এই দিয়ে রাখা; পুজো-আর্চায় যা লাগে শিশুর স্নানে তা দিলে সংসারে পাপ থাকে না। অথচ শরীরে কি যে থাকে! শিশু বড় হয়, বালিকা হয়, যুবতী হয়। কুম্ভ হয়, হাসি হয়, কাবুল হয়। আর এ সময়ই মনে হল অতীশ হয়। সবই হয় পৃথিবীতে। লোকটা তাকে বলেছিল, লক্ষ্মীর পট কিনে দেবে। এখন যেন সেটাই বেশি তাকে কামড়াচ্ছে। কন্যেটির শরীর মুছিয়ে দিতে গিয়ে বিড়বিড় করছিল, কেউ কথা রাখে না। যে যার মতো মিছে কথা বলে। লক্ষ্মীর পট কিনে দেব একটা। তার আর নামগন্ধ নেই।

কুম্ভ আর পারল না। সেই লোকটা এই বাড়িতেও ঢুকে গেছে। রাজবাড়িতে ঢুকেছে ঢুকুক। এ- বাড়িতে কেন। সে কালীঘাটের কালীর মানসপুত্র। তার ঘরে লক্ষ্মীর পট কেন আবার। সরল সুধা। সে সহসা চীৎকার করে উঠল, আর কিছু চাই না!

—চাইলেই দেয় কে?

কাবুলের দিকে তাকিয়ে কুম্ভ বলল, দেখছিস, দেখছিস হারামজাদী মাগী কি বলছে!

কাবুল খুব মান্যিগণ্যি মানুষের মতো বিচারে বসে যায়। অযথা মাথা গরম করছিস কেন তোরা?

—আমি করছি। বল, আমি করছি!

—কেউ করছিস না। নে, চুপ কর।

হাসি মেয়ের জন্য দুধ গরম করবে! জল গরম এখনও হয়নি। ঠাস করে কেতলি নামিয়ে দুধটা বসিয়ে দিল। মেয়েটা এক হাতে ঝুলছে।

—দেখলি ত। আমি কি তোর মাগী গোলাম!

—ছোটলোকের মতো কথা বলবে না বলে দিচ্ছি। হাসির চোখ গরম হয়ে গেল।

কুম্ভ বলল, একশবার বলব। নষ্টামির আর জায়গা পাস না!

হাসি মেয়েটাকে খাটে শুইয়ে দিয়ে এসে বলল, একশবার করব। মুরদ থাকে ত সামলিও।

কুম্ভ কেমন বিচলিতবোধ করে। কাবুলের দিকে তাকিয়ে বলল, সব যাবে। তুই জানিস লক্ষ্মীর পট কিনে দিয়ে সে কি করতে চায়?

—সে তুমি বোঝগে। আমার সময় নেই বোঝার কে কি করতে চায়।

কাবুল বুঝতে পারছে বিষয়টা তাকে নিয়ে নয়। নতুন ম্যানেজারবাবুকে নিয়ে। অতীশ হাসিকে লক্ষ্মীর পট কিনে দেবে বলেছিল। সেদিন গাড়িতেই যেন কথাটা হয়েছে। অতীশকে হাত করার জন্য সঙ্গে হাসিকেও নিয়েছিল কুম্ভ। কাবুল কিছুটা রেগে গিয়েই বলল, তা কিনে দিলেই পারিস। হাসি একটা ঘরে লক্ষ্মীর পট বসাতে চায়, তা করে দিচ্ছিস না কেন? ঠাকুর দেবতা বলে কথা।

ঠাকুর দেবতাই সম্বল কুম্ভর। তার এতে সায় যে নেই তা নয়। কিন্তু যে মানুষটা তার উপার্জনে বাগড়া দিয়ে যাচ্ছে, তার অমঙ্গল কামনা করছে, সেই মানুষের পরামর্শমত লক্ষ্মীর পট কেন আসবে বাড়িতে।

কুম্ভ বলল, আরে তুই মেয়েছেলে, লোকটা তোর কোন উপকারে লাগে বুঝিস না! কেবল কেড়ে নিতে এসেছে। গয়নাগাটি পরে খ্যামটা নাচ এবারে তোর বের করে দেবে! এতবড় সুযোগ নাহলে হাতছাড়া হয়। সময় খারাপ যাচ্ছে কাবুল। তুই যে বলছিলি, আমার হাতটা কাকে দিয়ে দেখাবি। পাথর-টাথর ধারণ করলে গ্রহের কোপ কমে যায়। সব গ্রহের দোষে হচ্ছে বুঝি। কিন্তু কি করব বল। তুমিও তো শালা কোন কম্মের নও। তোমার দাদাটি আর এক নপুংসক।

কাবুল এতক্ষণে কুম্ভর জ্বালাটা কোথায় বুঝতে পারছিল। দাদাকে টেনে আনায় সে কিছুটা অস্বস্তি বোধ করছে। আজ কিছু একটা হয়েছে। কি হয়েছে সেটা সে আন্দাজ করতে পারল। ভেবেছিল কুম্ভ বাপকে দিয়ে কাজ উদ্ধার করবে। রাতে খাবার টেবিলেই দাদা তাকে বলেছিল, বুঝছিস ভায়া দুটো দু’রকমের; একটা চোর ছ্যাঁচড়া, অন্যটা গোঁয়ার। কোনটাকে যে সামলাই। সে শুধু ফুট কেটে বলেছিল, অতীশবাবু যদি পারে করুক না। দু’নম্বরী মাল বানিয়ে কতদিন চলবে!

আর সেই কথায় বউদিরও সায় ছিল। বলেছিল, অতীশকে নিয়ে আসাই ভুল হয়েছে। ওর বাপ জ্যাঠাকে আমি জানি। রক্তে দোষ আছে। তাকে দিয়ে তুমি পারবে না।

কাবুল বলেছিল, সব হবে বউদি। ঠেলার নাম বাবাজী। এখন হচ্ছে না, পরে হবে।

এইসব কথাবার্তা রাতে হয়েছে। সে কুম্ভর পক্ষে একটা কথাও বলেনি। কুম্ভ যে চোর ছ্যাঁচোড় সেই খবরও কাবুলই দাদার কানে পৌঁছে দিয়েছিল। আর তার কাজই এখন এটা। সে সব কনসার্নে ঘুরে বেড়ায়। নিচু মহলের লোকদের সঙ্গে মিলে মিশে যেতে পারে। এবং রাজার ভাই বলে সবাই কারখানার খবর তার মারফত সঠিক জায়গায় পৌঁছে দিতে চায়। বাপকে দিয়ে উদ্ধার পেতে চাইছে কুম্ভ। সেয়ানা হয়ে উঠেছে। ভেবেছে তার আর দরকার নেই। এখন বোঝ, কত ধানে কত চাল। কাবুল বলল, আমাকে আগে থাকতে বলবি ত। কি হয়েছে বলবি ত!

কুম্ভ কি ভেবে বলল, না কিছু হয়নি।

—হয়নি ত শালা অফিস যাসনি কেন! এসেই বউ-এর ওপর হম্বি-তম্বি করছিস কেন?

—মানুষের শরীর খারাপ হতে পারে না!

—তোমার শরীর খারাপ! তালেই হয়েছে।

—কেবল রাজ-রাজড়ার বুঝি শরীর খারাপ হয়!

কাবুল বুঝতে পারল, আবার শালা দাদাকে টেনে আনবে। পরে বউদিকে। বউদির সঙ্গে অতীশের বাল্যপ্রণয় ছিল কিনা, তাও কুম্ভ অনায়াসে বলে যেতে পারে। মুখে ওর কিছু আটকায় না। মর্জি মতো কাজ না হলেই সব মানুষ ওর কাছে খারাপ। কাজ উদ্ধারের জন্য সবকিছু করতে পারে। না পারলে দুনিয়া শুদ্ধু লোক তার কাছে ইতর এবং ধান্দাবাজ। সেই লোক এখন বারান্দার এক কোনায় গুম মেরে বসে আছে।

টেবি তখনই এল একঠোঙা সিঙাড়া নিয়ে। কাবুল হাসির দিকে তাকিয়ে বলল, কুম্ভকে দাও।

কুম্ভ টেবির দিকে শুকিয়ে বলল, নারে আমি খাব না। তোরা খা। দাঁতে ব্যথা।

—আরে খা খা। মাথা গরম করিস না। মাথা গরম করলে কাজ হয় না। এই হাসি, দাও না। তোমাকে দিতে বলছি না। খেলেই দাঁত ব্যথা সেরে যাবে।

কুম্ভ দেখল, হাসি দুটো প্লেটে দুটো করে কচুরি একটা করে সিঙিড়া রাখছে। একটা কুম্ভর দিকে ঠেলে এগিয়ে দিল। এত অবহেলা। কুম্ভর মাথার রক্ত উঠে গেল। বদমায়েশ মেয়েমানুষ, তুই আমার বউ, না কাবুলের। তার কথায় আমাকে ঠেলা মেরে প্লেট এগিয়ে দিস। প্রায় লাথি মেরে প্লেটটা ছিটকে ফেলে দিত। কিন্তু তখনই কাবুল প্রায় দৈব বাণীর মতো বলল, আমি ত আছি। আমাকে বললি না কেন। দু-নম্বরী মাল করাতে চাস, কোম্পানি বসে যাবে, তোর ভয়, সব বলবি ত।

কুম্ভ আর পারল না। ক্ষোভে দুঃখে চোখে জল এসে গেছিল প্রায়। সর্বত্র সে মার খাচ্ছে। ঘরে বাইরে। কাবুল যদি পারে। সে বলল, রাজার বাপের সাধ্যি নেই কারখানাকে বাঁচাতে পারে। ওটাতে কি আছে। ছাপা বার্নিশ কত সেকেলে। দু’নম্বর মাল লোকে করাবে না’ত, এক নম্বরী করাতে যাবে! তোমার দাদা জানে না, যা ছাপা বার্নিশ তাতে এক নম্বরী মালও দু-নম্বরী হয়ে যায়। খদ্দেররা দায়ে পড়ে এখানে আসে। সস্তায় মাল পাবে বলে আসে। এদিকে গোড়া কেটে আগায় জল ঢালছে শুয়োরের বাচ্চা।

শুয়োরের বাচ্চা কথাটা অতীশকে উপলক্ষ করে। তার দাদাকে নয়। এতেই কাবুল কিঞ্চিৎ খুশি। যাক সুমতি হয়েছে কুম্ভর। সে বলল, নে এবার খাত। হাসি তোমার জন্য রেখেছ ত!

—রেখেছি।

কুম্ভর এটাও জ্বালা। কোনও মান অপমান নেই। ঠিক নিজের জন্য রেখে দিয়েছে। কেবল খাব খাব করে। স্নানটান করে দুপুরের খাবার খাবি কোথায়, তা না কাবুলকে দিয়ে এক ঠোঙা গরম কচুরি সিঙাড়া আনিয়েছে। আমি কি তোকে কিছু খেতে দি না। তোর এত রস!

কাবুল বলল, কিরে খা। তুই না খেলে খাই কি করে। ও টেবি নে, তুই একটা নে। কাবুল নিজের প্লেট থেকে টেবিকে একটা তুলে দিল।

কুম্ভ এখন খাচ্ছে। কচুরিতে কামড় বসিয়ে বলল, তোর দাদাকে বুঝিয়ে বলিস। খুবই ভুল করল। বলিস এগ্রিমেন্ট আমাকে দিয়েছে ফয়সালা করার জন্য। নতুন বাবুর সেই মুরদটিও নেই। কারখানার লোকেরা সব ক্ষেপে আছে। মাইনে বাড়িয়ে ওভারটাইম বন্ধ করার তালে আছে, ওরা তো নেকু নয় যে ম্যানেজারের ফন্দি ফিকির বুঝবে না।

কাবুলের বলতে ইচ্ছে হল, তুই একটা পয়মাল! কিন্তু বলল না। রাগ করবে। রাগ পড়ে আসছে। পড়ে আসবেই। কুম্ভ আরও সব গড় গড় করে বলার জন্য জল খাচ্ছে। দাঁতে ব্যথা-ফেতা কিছু নেই। কাবুল এগিয়ে বসল। বলল এগ্রিমেন্ট তোকে দিল কেন!

এই দেখ না। বলে কুম্ভ উঠে গিয়ে ব্যাগ থেকে এগ্রিমেন্টের দু-কপি বের করল। দেখল কিছু তারপর বাইরে এসে বলল, আমাকে দিয়েছে। পারে নি। ভেবেছিল একাই করবে। দু-চারবার কথা বলে বেপাত্তা। কি করি, এই দেখ না। তবে ভাই আমি চেষ্টা করব। সাধ্যমত করব। সে বলতে গেছিল, এটা নিয়ে ল্যাজে খেলাব, কিন্তু কি ভেবে বলল না। ভেতরের কথা সে কাউকে আর বলবে না। বউটা যার বিশ্বাসঘাতক, সে আর অন্যকে বিশ্বাস করে কি করে! সবাইকে আপন ভেবে সে ঠকেছে।

কাবুল বলল, তুই পারবি। সেটা দাদা জানে। বোঝে।

—এইত মুশকিল, কাজ করব আমি বাগড়া দেবে তুমি। আমি ত’ মানুষ।

কাবুল চা সিঙাড়া সব খেয়ে ফেলেছে ততক্ষণে! হাসি মেয়েটাকে কাবুলের কোলে দিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল। কুম্ভ গুম মেরে গেল ফের। ওর কোলে দিতে পারত হাসি! সে তোর কে রে!

কাবুল উঠে এসে মেয়েটাকে কুম্ভর কোলে ফেলে দিল, নে ধর। বাপ হবি তুই, সামলাব আমি। বেশ মজা।

মেয়েটাকে কোলে নিতেই কি যে হয়ে যায় কুম্ভর। কারো ওপর আর কোন যেন অভিমান থাকে না। সে মিথ্যে সংশয়ে ভুগছে। হাসিরাণী পায়ে ধরে একদিন বলেছিল, তোমাকে ছাড়া আমি কিছু জানি না। আমার আর কে আছে! বলতে বলতে কেঁদে ফেলেছিল। গরীব ঘরের মেয়ে বলেই এই হেনস্থা। এবং তখন কুম্ভ হাসিরাণীর মাথা কোলে নিয়ে বার বার চুমু খেয়েছে, অভিমান ভাঙিয়ে বলেছে—তুমি ত বোঝ হাসি, তোমাকে বাদে আমি সর্বহারা। তুমি ছাড়া আমারও কেউ নেই। তারপর দু’জনেই ফিক করে হেসে দিয়েছিল। আলো জ্বেলে হাসি যাত্রার সখির মতো সাজতে বসেছিল। যখন সব হয়ে যায়, নিশুতি রাত, ঘুম, নাক ডাকিয়ে লম্বা ঘুম। কুম্ভর পাশে হাসিরাণী। একেবারে খালি গা হাত পা, শরীর ভাঁজ করে পড়ে আছে। সন্তানের জনকজননী হতে গেলে এ সবই লাগে। কুম্ভ সকালে ওঠার সময় চাদরটা শরীরে টেনে দেয়। বড় ভয়ংকর লাগছিল তখন হাসিকে। মেয়েমানুষ সব পারে সুতরাং কুম্ভ নিশীথে একরকম, সকালে একরকম, সকালে তার কালীকবচ পাঠ, প্ৰাতঃস্নান, কালী কলকাত্তাওয়ালির ফটোর সামনে বসে অসুর নাশিনীর ধ্যান। তারপর, দিগ্বিজয়। আজ তার বাধা পড়েছে। সে যেন হত্যা দিতে এসেছে অসুর নাশিনীর কাছে। সেটা কে? হাসি না বউরাণী! সে কেন জানি বুঝতে পারল, হাসি হলেও নিস্তার নেই, বউরাণী হলেও নেই। কিন্তু সে জানে, কত ধানে কত চাল। সেটাই তার সম্বল।

সেই সম্বল নিয়েই কুম্ভ কথা শুরু করল কারখানার কর্মীদের সঙ্গে। কথাবার্তার সময় সে আর মনোরঞ্জন! সে বলেছে, বেশি লোকের দরকার নেই। কোম্পানির পক্ষে সে, কর্মীদের পক্ষে মনোরঞ্জন। কথাবার্তা শুরু হল এইভাবে—

—আরে মনোরঞ্জন! এস এস। খবর কি! তোমার বড় ছেলে এখন কি করছে?

—কিছু তো করছে না।

—কিছু না করলে চলবে কেন?

—কোথায় পাবে বলুন।

কুম্ভর ঘরে মনোরঞ্জন বাদে এখন কেউ নেই। অতীশবাবুর ঘরে দুজন কাস্টমার। পাশের ঘরে দুজন অ্যাসিস্ট্যান্ট কাজ করছে। মেশিনপত্র চললে, এমনিতেই কিছু শোনা যায় না। তাদের কথা অন্য কেউ শোনার চেষ্টা করলেও শুনতে পাবে না। কারণ কুন্তু প্রত্যেক ঘর থেকে তার ঘরের দূরত্ব এবং ধ্বনিতরঙ্গ কখন কতটা তারতম্য হয় সব মাপজোক করে বসে আছে। কোথা থেকে কতটা শোনা যায় সে জানে। তাকে এজন্য সবসময় সতর্ক থাকতে হয়। সে বলল, রাজার কাছে বলব তোমার ছেলের কথা।

—কুন্তবাবু!

—কুম্ভ চোখ তুলে চাইল।

—আপনি’ত অ্যাগ্রিমেন্টে রাজি হতে বারণ করেছেন!

—করেছি। দরকার বুঝেছিলাম বলে করেছি। তারপরই কুম্ভ কি বলবে ভেবে পেল না। মনোরঞ্জন মুখের ওপর স্পষ্ট কথাটা শুনিয়ে দেবে সে আন্দাজ করতে পারেনি। সে মনে মনে বলল, আমি কুম্ভকুমার আমার ডরালে চলবে কেন! ঘাবড়ে গেলে চলবে কেন! সে একটা ফস করে পকেট থেকে সিগারেট বের করে মনোরঞ্জনকে দিয়ে বলল, ধরাও। মনোরঞ্জন তার চেয়ে বয়সে বড়, লম্বা ঢ্যাঙা। শুধু হাড় ক’খানা সম্বল করে কাজ করছে। কুম্ভর হাড় মাস দুই আছে। কুম্ভ-ই প্রবল প্রতিপক্ষ। সুতরাং সেভাবেই বলল, রাজার মেজাজ ভাল না। বড়বাবুর কানে কি ফুসমন্তর দিয়েছে, কে জানে। রাজা বলেছেন, মাল না বাড়ালে কোম্পানি ক্লোজ করে দেবে। আমি চাইছি আপাতত সেটা বন্ধ করতে। তোমরা মেনে নাও। পরে কত অজুহাত পাবে। যদি দেখ ওভারটাইম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তখন সুযোগ বুঝে কোপ বসাবে।

—দেখুন কুম্ভবাবু, একজন বিবেচক মানুষের মতো সে বলল, ওভারটাইম আছে বলে ছেলে মাগ নিয়ে বেঁচে আছি। না থাকলে শুকিয়ে মরব।

—কেন মাইনে বাড়ছে!

—সেটা আর কত! ওতে হেলপারদের পোষাতে পারে, আমাদের পোষাবে না। আমাদের দিকটা আর একটু দেখুন।

কুম্ভ বলল, এখন আর তা হবে না। তোমাদের কথা দিচ্ছি পরে হবে। অ্যাগ্রিমেন্ট দু-বছরের। দেখই না কি দাঁড়ায়।

মনোরঞ্জন জানে, হেলপাররা একপায়ে খাড়া। আরও যারা বেশি সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে তারাও রাজি। কেবল তার মত মোল্লারা বাধ সাধবে। কিন্তু যদি ছেলেটার কিছু হয়ে যায়, যদি পরে অজুহাত সৃষ্টি করা যায়। কুম্ভবাবু তো বলেই দিয়েছেন, তোমাদের অজুহাতের শেষ নেই। দরকার মনে করলে এটা ওটা খারাপ দেখিয়ে যেমন খুশি মাল দিতে পার। বড়বাবুরও বলার কিছু থাকবে না। রাজাকেও কচু দেখানো গেল।

মনোরঞ্জন বলল, একটা দিন আমাদের ভাবতে দিন।

পরদিন কুম্ভবাবু এসে অতীশের ঘরে ঢুকে বলল, ওরা রাজি। সুতরাং মিঞাবিবি যখন রাজি তখন শুভদিন দেখে সেরে ফেলা ভাল।

অতীশের মনে হল লোকটা ভোজবাজি জানে! কুম্ভর মনে হল সে দিগ্বিজয়ী। সে তার মতো করে সই করিয়ে নিচ্ছে। কোম্পানির কি থাকল সেটা বড় নয়, আসল কথা সে এই কোম্পানির কত অপরিহার্য মানুষ রাজা এবার ভেবে দেখুক।

অতীশকে খুবই তখন ম্রিয়মান দেখাচ্ছিল। সে ভাবছিল, তার মতো অপদার্থ লোক কতদিন এভাবে কাজ চালিয়ে যাবে। কারখানায় এলে নরকে ডুব দিতে হয়, সেটা যদি সে আগে জানত। শীত পার হয়ে গ্রীষ্ম আসতেই সেটা আরও টের পেল অতীশ। কুম্ভ একদিন মুখের ওপরই এসে বলল, দাদা, আপনাকে নিয়ে আর পারা যাবে না। কত মাইনে পাই খদ্দেররা জানবে কেন? আপনি নিজের সম্পর্কে কি ভাবেন! সত্যি কথার ভাত আছে। মর্যাদা আছে। এত কম মাইনে পাই, সেটা বলার দরকার কি! লোকে শুনলে কি ভাববে!

অতীশ কি কথায় কথায় যেন সেদিন একজন খদ্দেরকে কথাটা বলে ফেলেছিল। সে ত জানে না, কুম্ভবাবু অন্যরকম বলেছে। সে বলল, যা পাই তাইত বলব!

এতে আপনার সম্মান বাড়ল! আপনি এই পেলে আমরা কি পাব, ওরা টের পাবে না। তিনগুণ বাড়িয়ে বলি, সেটা আপনার দিকে চেয়ে, কারখানার কথা ভেবে, রাজার মানসম্মান যায় বলে। আপনি সেটাও বোঝেন না!

অতীশের মনে হল, সে ঠিক পৃথিবীর মানুষ না। সে যে পরিমণ্ডল থেকে এসেছে, সেখানে এইসব তাকে শেখানো হয়নি। মাইনের সঙ্গে একটা মানুষের মর্যাদার প্রশ্ন থাকে সেটাও সে ভাল করে ভেবে দেখেনি। চারপাশটা সেই অজানা সমুদ্রের চেয়েও ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছে তার। সেখানে জীবনমৃত্যু অহরহ সামনাসামনি হাজির। এখানে জীবনমৃত্যুর চেয়ে আরও বেশি কিছু কঠিন সত্য হাজির। দিন যত যায় আচ্ছন্নতা তার তত বাড়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *