।। পনের।।
দিন ছোট হয়ে আসছিল। রাজবাড়ির ছাদের কার্নিসে সূর্য হেলে গেলে মিণ্টু টুটুল জানালায় এসে দাঁড়ায়। সামনে পাতাবাহারের গাছ, তারপর পথ, দু’পাশে রাজবাড়ির বাগান। নতুন বাড়ির পাশে রক্তকরবী গাছটায় টুটুল একটা ফড়িং আবিষ্কার করেছিল। সেই থেকে সে বিকেল হলেই, মাকে বলে, আমি দাব। ফড়িং ধরব। দুটো একটা কথা ফুটেছে। মা শুয়ে আছে। মিণ্টু টুটুল ফাঁক বুঝে নেমে এসেছে তক্তপোশ থেকে। দুবার দরজায় ছুটে গেছে। দরজা টেনেছে—মাকে ডাকতে সাহস পাচ্ছে না; পালিয়ে দুজন ফড়িংটা ধরার মতলবে ছিল। দরজা বন্ধ দেখে ওরা কি ভাবল কে জানে, দরজা ফাঁক করে উবু হয়ে কি দেখল। একটা লোক আসছে—সেই মোটা মতো লোকটা। টুটুল ওর সঙ্গে কথা বলার জন্য জানালায় উঠে দাঁড়াল। ডাকল, অ্যাঁ অ্যাঁ। সঙ্গে সঙ্গে দুমবার সিং বলল, খোকনবাবু ভাল?
টুটুল বলল, দুমবা ভাল।
—হ্যাঁ ভাল খোকনবাবু।
মিণ্টুর সঙ্গে কথা বলেছে না বলে বড় অভিমান। সে বলল, ভাই আমার খাতা খেয়ে ফেলেছে।
—তাই নাকি! খুব খারাপ।
—ভাইটা না প্যান্ট পরতে চায় না। ভাইটা সারাদিন ন্যাংটা থাকে।
দুমবার বলল, ব্যাং ধরে নুনুতে ঝুলিয়ে দেব।
টুটুল অত সব কিছুই বোঝে না। তার সঙ্গে যে কথা বলে সেই তার বন্ধু। সারাক্ষণ তার কথা বলা চাই। না বললে দু’ঠ্যাং ছড়িয়ে কাঁদতে বসে। এই যে লোকটা দিদির সঙ্গে কথা বলছে টুটুলের ভাল লাগছে খুব। সেও অজস্র কথা বলছে। হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। মিণ্টু বলল, টুটুল প্যান্ট পরে আয়। ব্যাং বেধেঁ দেবে।
টুটুল মুখ নাক গলিয়ে দিয়েছে শিকের ফাঁকে। সে কথাবার্তার বিষয়টা ঠিক বুঝে উঠতে পারে। দুমবার সত্যি কোথা থেকে একটা ব্যাং ধরে নিয়ে এল। টুটুল ভয়ে জানালা থেকে নেমে সোজা এক দৌড়। মার বিছানায় উঠে গেল লাফ দিয়ে। তারপর দুহাতে খামচে ধরল মাকে।
নির্মলার ঘুম ভেঙে গেলে দেখল টুটুল বড় বড় চোখে বলছে—মা’ ব্যাঙো। ব্যাঙো আসছে। নির্মলা টুটুলের সব কথা বুঝতে পারে না। সে বলল, হ্যাঁ ব্যাঙো আছে ঘুমাতে পর্যন্ত দিস না। চোখে তোদের একফোটা ঘুম নেই! দিদি কোথায়? নির্মলা বিছানায় উঠে বসল।
টুটুল তাড়াতাড়ি মায়ের কোলে উঠে বসল, ব্যাঙো আসছে। খাবে। আমি ভাল। দিদি ভাল না। মিণ্টু তখন ভাইয়ের হয়ে দুমবার সিংকে সামলাচ্ছে। ভাই আর ল্যাংটো থাকবে না। প্যান্ট পরে থাকবে। ভাই ভাই। বলে সে তখন চেঁচাচ্ছে। মিণ্টু কার সঙ্গে কথা বলছে! তক্তপোশ থেকে নির্মলা নেমে গেল। সারা শরীরে শাড়ি জড়িয়ে বারান্দায় আসতেই দেখল, দুমবার মিণ্টুর সঙ্গে কথা বলছে। হাতে একটা জ্যান্ত ব্যাঙ। দুমবার মিণ্টুর কাছে এগিয়ে বলছে, ভাই কোথা। ভাইকে ঝুলিয়ে দেব। এবং তখনই বারান্দায় নির্মলাকে দেখে বলল, নমস্কার মাইজি, খোকাবাবু পালিয়েছে। সে হাসতে থাকল।
—আর বল না। সারাটাক্ষণ ভাইবোনে মারামারি। একটু যদি ঘুমোয়। তোমার ভয়ে তক্তপোশে বসে আছে। নামছে না। নির্মলা পেছনে তাকিয়ে দেখল, টুটুল উঁকি দিয়ে সেই দুমবার জানালায় আছে কিনা দেখছে। নির্মলা বলল, ভাল হয়েছে। কিছুতেই জামা প্যান্ট পরবে না। সব খুলে বসে থাকে। তুমি রোজ আসবে।
দুমবার সঙ্গে মার এত কি কথা হচ্ছে! উঁকি দিয়েই টুটুল কেমন ঘাবড়ে গেল। সেই ব্যাঙটা হাতে ধরে রেখেছে। তক্তপোশ থেকেই টুটুল বলল, জামা কৈ। আমার জামা কৈ!
মিণ্টু এবার ভাইকে সাহস দেবার জন্য বলল, দুমবার, ব্যাঙো চলে গেছে।
টুটুল দিদির কথা বিশ্বাস করল না। জামা কৈ জামা কৈ করছে। নির্মলা জামা প্যান্ট পরিয়ে দিতেই টুটুল কি করবে বুঝতে পারছে না, কিন্তু লোকটি যে ভারি রহস্যময় জগতের বাসিন্দা টুটুলের কাছে। কিম্ভূতকিমাকার পাগড়ি মাথায়। পায়ে নাগরাই জুতো, সাদা ফতুয়া গায়ে। আর লম্বা সাদা প্যান্ট। সবচেয়ে বিরাট তার বপু আর গোঁফ। টুটুলকে একদিন দুমবার গোঁফ ধরতে দিয়েছিল। সেই থেকেই দুজনে ভারি বন্ধুত্ব। মিণ্টু বের হলেই টুটুল বলবে, দুমবার যাব। দুমবারই একদিন কাঁধে নিয়ে মিণ্টু টুটুলকে রাজবাড়ি ঘুরিয়ে দেখিয়েছে। পুকুর পাড়ের শান বাঁধান ঘাটে দুমবার এক বিকেলে ওকে নিয়ে বসেছিল। ছোট ছোট বেলে মাছ স্ফটিক জলে দেখেছে টুটুল। গোলঘরে দুটো খরগোস থাকে। টুটুল তাও দেখেছে। আর হেমন্ত চলে যাচ্ছে, বেলা ছোট হয়ে আসছে, পূবের মাঠ অথবা শস্যক্ষেত্র থেকে উড়ে আসছে অজস্র ফড়িং প্রজাপতি। এই গাছপালা প্রজাপতি এবং পাখির ডাক শোনার জন্য বিকেল হলেই টুটুল ছটফট করে। মিণ্টুর হাত ধরে ঘুরে বেড়ায়। খুব বেশি দূর যাবার নিয়ম নেই। ঐ রক্তকরবী গাছটা পর্যন্ত। সেখানে গিয়েই ভাই বোন দাঁড়িয়ে থাকে। বাবা তার এই পথ দিয়ে ফিরে আসে।
দুমবার নির্মলাকে বলল, আমার সাথে খুব ভাব হয়ে গেছে মাইজি। গেল কোথায় খোকাবাবু। হাতে কিছু নেই। দুহাত ওপরে তুলে ভারি ছেলেমানুষের মত দেখাল, হাত খালি। ব্যাঙ্গো নেই। খোকনবাবুর মুখ কোথায়!
নির্মলা দুমবারের সব খবরই রাখে। সেই কবে বালক বয়সে দেশ ছেড়ে রাজ-বাড়িতে হাজির হয়েছিল মানুষটা। তারপর থেকেই গেল। কুমারবাহাদুর আর মানসবাবুকে ছেলেবেলা কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে। মানসবাবু কুমারবাহাদুরের সম্পর্কে কিছু একটা হয়। সেটা কি নির্মলা জানে না। টুটুলের বাবাই বলেছে, সম্পর্কে একটা বড় রহস্য আছে। তবে সেটা কি রহস্য টুটুলের বাবাও জানে না। দুমবারও কিছু বলে না। সে অনেক কথা বলে, সম্পর্কের প্রসঙ্গ উঠলে দুমবার চুপ করে থাকে। আর সেই থেকে দুমবার রাজবাড়ি ছেড়ে যায় না যখন মানসদা পাগল হয়ে যায়, দুমবার ওপর ভার পড়ে তাকে সামলানোর। সে পাগড়ি মাথায় নাগরা জুতো পরে মানসদার কাছে লাঠি হাতে হাজির হয়। তারপরই মানসদা নাকি প্রকৃতিস্থ হয়ে যায়। এ-বাড়িতে বউরাণীর নিজস্ব কিছু জার্সি গরু আছে। সকালে-বিকেলে দুমবার এক বালতি দুধ নিয়ে যায় এই জানালার পাশ দিয়ে। এইটুকু কাজ করতে দেখে। আর কখনও দেখে—ভারি পরিপাটি, মাথায় পাগড়ি, পায়ে নাগরাই জুতো। এ দিকটায় এলেই হাঁক দেবে, খোকনবাবু পরী ধরে আনতে যাব। যাবে নাকি।
দমবার মাতৃভাষাও বুঝি ভুলে গেছে। মাঝে মাঝে কথায় কিছুটা পশ্চিমা টান থাকে। বয়স জিজ্ঞেস করলে বলে প্রথম যুদ্ধের কথা। সেই যুদ্ধে নাম লেখাতে বাড়ি থেকে পালিয়ে বের হয়ে এসেছিল। কম বয়স দেখে পল্টনে নেওয়া হয় নি। তারপরই দুমবার আর কি করে। দেশে ফিরে গেলে বাপ গাছ পেটা করবে—ভয়ে আর যায়ই নি। দুমবার মা নেই। সে হবার পরই মা-জননী চলে গেছে এমন বলে। সবচেয়ে বিস্ময়, পৃথিবীতে লোকটার আপন বলতে কেউ নেই। কিন্তু তার জন্য তার এতটুকু আপশোস নেই। দুমবারকে নির্মলা সব সময় দেখেছে ভারি প্রসন্ন চিত্ত। মিণ্টুকে বলেছে, পরী ধরে এনে দেবে। দুমবারকে দেখলেই দুই ভাই-বোন পরীর কথা জিজ্ঞেস করতে ভোলে না। দুমবারকে দেখলেই দুই ভাই-বোন জানলায় লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। পরীটা ধরা পড়েছে কিনা মিণ্টু জিজ্ঞেস করলে বলবে, ও ধরা পড়ে যাবে। শীতকাল আসুক না। তখন কুয়াশা হয়। খুব কুয়াশা, ভারি চাদরের মত। পরীরা রাজবাড়িতে নেমে আসে। ছাদে ঘুমিয়ে থাকে। ছোট্ট পরীটা সে ধরবে ঠিক করেছে। দু-একবার ধরেওছিল। তবে বড় কান্নাকাটি করে। মা মা রে। সে ছেড়ে দিয়েছে। শীতের কুয়াশায় পরীরা আটকে থাকে। শীত না এলে হবে না।
মিণ্টু বলেছিল, উড়ে যাবে না।
—তা কি উড়তে পারে। কুয়াশায় পাখা ভিজে যায় না মিণ্টুদিদি। উড়তে পারে না। খপ করে তখন…
মিণ্টুর ভারি কান্না পায়।
—কতটুকু দেখতে?
এই তোমার মত। ঠিক তোমার মত দেখতে। দুটো ডানা জুড়ে দিলে মিণ্টুদিদি পরী হয়ে যাবে।
—ব্যাং আমি পরী হব কেন? পরীদের মা-বাবা থাকে?
দুমবার এমন কথায় কিছুটা বিভ্রমে পড়ে গেল। পরীদের মা- বাবা থাকে কিনা তারও জানা নেই। মা-বাবা বড়ই প্রিয় মানুষের। তার কিছুই নেই। শুধু রাজবাড়ির সব কাচ্চা-বাচ্চা তার এখন বন্ধু। তার নাগরাই জুতো মাথার পাগড়ি দেখে ভারি মজা পায় সবাই। সে বলল, তোমার মা-কোথায়?
—ঐ তো আমার মা।
দুমবার বলল, না না। ওতো আমার মা। জিজ্ঞেস করে দেখ না।
—হ্যাঁ বলেছে। আমার মা।
টুটুল বলল, আমার মা। বলেই মাকে জড়িয়ে ধরল। যেন দুমবার সত্যি অধিকার করতে আসছে তার মাকে। সঙ্গে সঙ্গে মিণ্টু নেমে গেল জানালা থেকে। মাকে পিছন থেকে ধরে বলল, তোমার মা না। আমাদের মা।
নির্মলার এখন কাজ অনেক। বেলা পড়ে আসছে। ঘর ঝাঁট দেওয়া, ঘর মোছা, কলপাড়ে বাসন মাজা সব পড়ে আছে। এগুলো তাকে বেলা থাকতেই সেরে রাখতে হয়। হাতের কাজ শেষ না করে ফেললে, সন্ধ্যার পর মিণ্টুকে নিয়ে বসতে পারে না। ওকে এ বছরই স্কুলে দেওয়া দরকার। রাস্তা পার হলে নিবেদিতা কিন্ডার গার্টেনে ভর্তির কথাবার্তা বলে এসেছে। খুব কড়াকড়ি। মানুষটা ত অফিস থেকে ফিরেই দু-দণ্ড বসতে পারছে না। হাত মুখ ধুয়ে বের হয়ে যায়। নির্মলার কাজের জন্য ছুটাছুটি করছে। কিছুই হচ্ছে না। নিত্য অভাব বাড়ছে।
নির্মলা ওদের ছেড়েও যেতে পারছে না। সংসারে কি যে হয়! চার পাঁচ বছর আগে এরা তার কেউ ছিল না। সে জানতও না অতীশ বলে এক যুবক তার জন্য কোথাও বড় হচ্ছে। কোথাকার কে, সে এসে এই জীবনে সবটা জায়গা জুড়ে বসে গেছে। যত মিণ্টু টুটুল তাকে দুমবার নিয়ে যাবে ভেবে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিল, তত সে অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল।
পাতাবাহারের গাছগুলির ও-পাশে দুমবারও কেমন চঞ্চল হয়ে ওঠে শিশুদের মত।—মাকে আমি নিয়ে যাব। তোমাদের মা-বাবা থাকবে আমার কিছু থাকবে না! বড়ই কাতর দেখাচ্ছে মিণ্টু-টুটুলকে।
নির্মলা বলল, ছাড়। কাজ আছে কত! আমি তোদের মা হই। দুমবারও।
এই কথায় মিণ্টু কিছুটা সাহস পায়। বলে, দুমবার দাদা আমার পরী আছে জানো।
—কোথা পরী। কে ধরে দিল!
মিণ্টু মাকে ছেড়ে দিয়েই ছুট। সে তার ছোট্ট পুতুল এনে দেখাল, দ্যাখ। কি সুন্দর চোখ, নাক আমার পরী। নির্মলা দেখল, টুটুল মিণ্টু আবার জানলায় উঠে গেছে। দুমবার কিছু কেড়ে নেবে না তাদের। সাহস ফিরে পেয়ে আবার জমে গেছে। এই ফাঁকে সব কাজটাজ করে ফেলা দরকার। কাজের লোক ইচ্ছে করেই রাখে নি যতটা টাকার সাশ্রয় করা যায়। খরচ বাড়ছে সেই অনুপাতে আয় বাড়ছে না। মাঝে মাঝে মানুষটার মুখ দেখলে প্রাণে কেমন ভয় ধরে যায়। চোখ মুখে অদৃশ্য এক যাতনা বয়ে বেড়াচ্ছে। খুলেও কিছু বলে না। লেখার টেবিলে বসে থাকে। কি ভাবে! তারপর কোনও কোনও সকালে সহসা খুব প্রসন্ন হয়ে যায়। বুঝতে পারে, লেখাটা শেষ করতে পেরেছে। একমাত্র লেখা শেষ করতে পারলেই সে শিষ দেয়, বাজার যায়। ভাল মাছটাছ কেনে। মিণ্টু টুটুলের পাশে বসে এক সঙ্গে খায়। নির্মলার সাহস বাড়ে।
কলপাড় থেকে এসে দেখল দুমবার নেই। পুতুলটা নিয়ে ভাই-বোনে মারামারি শুরু করে দিয়েছে। টুটুল চেপে ধরেছে পুতুলের একটা পা। মিণ্টু ভাইয়ের মুখ খামচে ধরেছে। কেউ টু শব্দ করছে না। ঝগড়া করছে—কাছে না গেলে নির্মলা বুঝতে পারত না। টুটুল ক্ষণে ক্ষণে বড় জেদি হয়ে যায়। দিদির যা কিছু সবই তার দরকার। মিণ্টু কিছু নিয়ে বসলেই টুটুল সেটা নিয়ে টানাটানি শুরু করে দেয়। কাছে গিয়ে নির্মলা ছেলেকে কোলে তুলে নিল!
—এভাবে ভাইকে খামচে দেয়। মিণ্টু হেরে গিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকল। আমার সব কিছু ও নিয়ে নেবে। পুতুলটার হাত ভেঙে দিয়েছে। বাবাকে এলে বলব, টুটুল আমাকে মারে। টুটুল আমাকে কামড়ায়।
নির্মলা বলল, দিদিকে তুই মারিস কেন? মারলে দিদি তোকে ভালবাসবে!
মিণ্টু ক্ষেপে গিয়ে বলল, তোকে আজ বেড়াতে নিয়ে যাব না। দুমবার পরী ধরে দেবে, তোকে দেব না। রাতে শুয়ে থাকবি, দুমবা এসে ব্যাঙ্গো ঝুলিয়ে দেবে। নির্মলা ছেলেকে কোলে নিয়ে হাত- পা মুছিয়ে দিচ্ছে। মুখ মুছিয়ে দিচ্ছে, কাজল টেনে দিচ্ছে চোখে এবং সুন্দর পরিপাটি এক শিশু শিশু খেলায় মনটা ভরে আছে তার। মিণ্টুর রাগ এতে আরও বাড়ছে। সে ব্যর্থ হয়ে রান্নাঘরের দরজার আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। যেন সে হারিয়ে গেছে। এবারে মা কাঁদুক। টুটুলটাও কাঁদুক—দিদি নেই।
অতীশ অফিস থেকে তখন হেঁটেই বাসায় ফিরছিল। তার কিছু ভাল লাগছে না। কারখানার দেয়ালে পোষ্টার পড়ছে। নানা রকম দাবী। অতীশ কি করবে বুঝতে পারছে না। আসছে মাসে মাইনে দেবে কিভাবে সে জানে না। বাজারে দেনা বাড়ছে। কোটার টিন তোলার টাকা নেই। অর্ডারপত্র কম। চার পাশ থেকে সাঁড়াশি আক্রমণ। দু’নম্বরী মাল করলে এক্ষুনি কিছু কাস্টমার বড় রকমের অ্যাডভান্স করতে রাজি। কিন্তু অতীশের ভেতরের সেই গোঁয়ার লোকটা মাথা পাততে রাজি হচ্ছে না। কুম্ভবাবুর কাছে তারা বার বার দরবার করছে। বার বার ফিরে যাচ্ছে। নামী কিছু প্রতিষ্ঠান এই কোম্পানীর দীর্ঘকালের খদ্দের। তারা বাজার দর শুধু দেখে না, মালের ফিনিসিং দেখে। মেটালবকস্ কিংবা এই জাতের বড় বড় প্রতিষ্ঠানে সিট মেটালের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। সিট মেটালকে এদিক-ওদিক ছড়ানো-ছিটানো ছোট ছোট কারখানাগুলির সঙ্গে লড়তে হয়। প্রিন্টিং ফিনিসিং দুই তাদের বেশ ভাল। অতীশ জানে লিথো প্রিন্টিং অচল। কিন্তু আপাতত সে কিছু করতে পারছে না। প্রিন্টিং মেশিন কিংবা কিছুটা রদবদল করে জিংক প্লেটে ছাপার ব্যাপারে যে টাকাটা দরকার হাতে সে টাকা নেই। এই সব চিন্তা ভাবনা মাথার মধ্যে কেউ যেন পেরেক ঢোকায়। আর সব সময়ই মনে হয় সেই এক অশুভ প্রভাব সর্বত্র কাজ করছে।
সে ফুটপাথ ধরে হেঁটে যাচ্ছে। পাশে এত লোকজন, অথচ এরা তার কেউ না। হেমন্তকাল এটা। শীতের বেলার মতো কলকাতার রোদ্দুর ঠাণ্ডা তাপহীন। শরীরটা ভাল লাগছে না বলে সে তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বের হয়ে এসেছে। এবং কি যে হয়, অফিস থেকে বের হয়ে এলেই তার মনে হয় কেমন একটা মুক্তির স্বাদ। যতক্ষণ থাকে, এক দণ্ড সে নিজের কথা ভাবতে পারে না। অজস্র সমস্যা। রঙের সমস্যা, ডাইসের সমস্যা, ওভারটাইমের সমস্যা। কেবল মনে হয়, এরা কেন যে ঠিকমত কাজ করে না। ওরা যা পারে তার সিকি ভাগ কাজও দেয় না। এই দুবুদ্ধি তারা যে কোথায় পায়। সে তো জাহাজে কাজ করে দেখেছে—পুরো আট ঘণ্টা কাজ। এক দণ্ড তার ফুরসত ছিল না। কাজে কোনও ফাঁকি ছিল না। মাইনে কম, কিন্তু যা পরিস্থিতি মাইনে বাড়াতে গেলেই প্রডাকসান বাড়ান দরকার। সে সবাইকে ডেকে বার বার বুঝিয়েছে। ওরা বলেছে ভেবে দেখি স্যার। সে বলেছে, এত কম মাইনেতে তোমরা বাঁচবে কি করে? কোম্পানিকে বাঁচাও, আমি তোমাদের বাঁচার পথ দেখছি। তখন ওরা খুব ভাল মানুষের মত স্বীকার করে গেছে, স্যার আপনি ঠিকই বলেছেন। কেউ কেউ গোপনে বলে গেছে, স্যার লাগানি—ভাঙানি হচ্ছে। কিছু করা যাচ্ছে না।
অতীশ হাঁটতে হাঁটতে বুঝতে পারছিল, সংসারে ভাল থাকার কোন দাম নেই। সে ভাবল, কালই কুম্ভবাবুকে এই কাজে লাগাবে। কুম্ভবাবুর স্বভাব তাকে বড় করে দিলে সে সব করতে রাজি হয়। কুম্ভবাবু চায় সবটাই তার হাত দিয়ে হোক। এবং পরদিনই সে কুম্ভবাবুকে অফিসে ডেকে বলল, আপনি দেখুন না ওদের সঙ্গে কথা কয়ে কিছু একটা করতে পারেন কিনা। কুম্ভ বলল, সব বেইমান দাদা। বেটারা খেতে পেতিস না, হাতে পায়ে ধরে ঢুকেছিলি। ঢুকেই অন্য চেহেরা। তা আপনি যখন বলছেন, দেখছি।
কুম্ভ জানে, তার একটা আলাদা সুবিধা আছে। সে যখন এদের টোপ দেবে, তখন অন্য কেউ আর এক পাশে টোপ ফেলে বসে থাকবে না। সব কিছু বানচাল করে দিতে চায়, আর কিছুর জন্য না শুধু সে দেখাতে চায়, সব সেই করতে পারে। অতীশবাবু এভাবে সহজে তার কবজায় আসবে, সে কল্পনাই করতে পারে নি। সারাদিনে মাত্র দু’হাজার মাল দিলে পড়তা পড়ে? বলুন। বলে অতীশ টাইপ করা একটা লিষ্ট কুম্ভবাবুকে দিল। তারপর বলল, ওরা যদি কাজে আন্তরিক হয়—আমি কিন্তু খুব বেশি কিছু চাইনি, আরে কোম্পানি বাঁচলে, আমরা বাঁচব —কেন যে এরা এটা বুঝতে চায় না আমার মাথায় আসে না। আপনি কি মনে করেন? আপনি ত অনেকদিন এখানে। আমার চেয়ে এটা আরও বেশি ভাল বুঝবেন।
কুম্ভ তালিকাটি দেখল। যা পারে তার চেয়ে কমই চেয়েছেন। যতবার অতীশবাবু এ-নিয়ে ফয়সালা করতে চেয়েছে, ততবার সে তলে তলে বাগড়া দিয়েছে। –তোমরা রাজি হলেই মরবে। কোম্পানির কাছে এটা রেকর্ড হয়ে থাকবে। এগ্রিমেন্টে গেলেই ফেঁসে যাবে।
কুম্ভ বলল, মাইনে কি রকম বাড়াতে চান?
অতীশ আরও একটি টাইপ করা তালিকা দিল তাকে। দুজন অফিস অ্যাসিস্ট্যান্ট আছে তার। সে তাদের দিয়েই সব করিয়ে রেখেছে।
তালিকাটি কুম্ভ ভাল করে দেখে বলল, আপনি ত দেখছি রাজাকে দেউলিয়া করে ছাড়বেন দাদা।
অতীশ কিছুটা হতাশ গলায় বলল, এ-কথা কেন?
—আপনি দাদা মনে মনে কম্যুনিষ্ট আছেন। না হলে কেউ এমন এগ্রিমেন্ট করে।
অতীশ বলল, মনোরঞ্জনের সঙ্গে এই নিয়েই তো কথা বলেছি। কিন্তু ওরা রাজি হয় নি। আপনি আরও কমাতে চান।
—তা না হলে অ্যাগ্রিমেন্ট করে লাভ কি। সবটাই ওরা খাবে। রাজার থাকবেটা কি!
—রাজা তো এখান থেকে কিছুই পান না।
—কিছু পান না বলবেন না, পেতেন। আপনি আসায় সেটা বন্ধ হয়েছে। কিন্তু জানেন ত এরা এ-সব শুধু দেখে দেখে আর দেখে। যদি কিছু না করতে পারেন যতই আপনার পেয়ারের লোক হোক…..
অতীশ মুখ নিচু করে বসে আছে। কিছু যে পেতেন না ঠিক না। পেতেন। স্ক্র্যাপ বিক্রির টাকা কিছুটা কুম্ভ মারত, কিছুটা রাজাকে দিত। সে আসার পর স্ক্র্যাপ বিক্রির টাকা রাজাকে এক পয়সাও ঠেকায় না। সব টাকাই কোম্পানির খাতায় জমা করে নেয়। রাজার এতে ক্ষোভ বাড়তেই পারে। তার যেমন জোর আছে অমলা তেমনি কুম্ভবাবুর জোর তার বাবা। সে এসে বুঝেছে এত বড় এস্টেটের এখনও যা কিছু স্থাবর অস্থাবর আছে তার বেচাকেনায় একটা বড় রকমের ব্যভিচার রয়েছে। এই ব্যভিচার সম্পর্কে শুধু ওপর মহলের দু-একজন আমলাই খবর রাখে। রাধিকাবাবু তার একজন। খুব একটা ঘাঁটাঘাঁটি করতে রাজাও তাকে সাহস পায় না।
অতীশ বলল, এটা অন্যায় মনে করেছি। স্ক্র্যাপের টাকা তিনি পেতে পারেন না। আর এতে কটাই বা টাকা, এটা পেলে না পেলে তাঁর কিছু আসবে যাবে না। আমাদের আসবে যাবে।
কুম্ভ হা হা করে হেসে উঠল।—দাদা আপনি কোন যুগের লোক। টাকা মানুষের আত্মার কাছাকাছি। এদের কাছে আত্মার বিনাশ আছে কিন্তু টাকার বিনাশ নেই। শুধু রেখে যাওয়া। বাড়িয়ে যাওয়া।
অতীশের সবই কেমন গুলিয়ে যাচ্ছিল। এই লোকটা রাজার হয়ে এত ভাবে, এই লোকটাই রাজার এমন অপযশ গায়। সে বলল, কোম্পানির লাভ হলে তিনি তো ডিভিডেণ্ড পাবেনই।
—ভালোই হয়েছে। এতদিন সবুর সইবে না। আর কোম্পানির লাভ বলছেন, এত সোজা! লাভ হলেই হতে দিচ্ছেটা কে। এখন নতুন আছেন, রাজা হাত দিচ্ছে না। পরে হাত দেবেনই। শুধু একটু রয়েসয়ে হাত বাড়াবেন এই যা।
অতীশ সবই বুঝতে পারে। যত বুঝতে পারে তত শিটিয়ে যায়। তত এক অশুভ প্রভাব টের পায় মাথার ওপর ঘোরাঘুরি করছে। ওর চোখ কেমন স্থির হয়ে থাকে। অসহায় মানুষের মতো শুধু বলে, যা ভাল বুঝুন করুন।
কুম্ভ বলল, রাজার সঙ্গে সনৎবাবুর সঙ্গে কথা বলে নিয়েছেন?
অতীশ বলল, ওরা দেখেছেন।
—কী বলল দেখে?
—বলেছেন, ঠিক আছে। যদি তোমার মনে হয় এতে সুবিধা হবে তাই কর। তখনই কুম্ভ বলল, চা খাব দাদা। বলেই বেল টিপে সুধীরকে ডাকল। সুধীর এলে চা করতে বলা হল। তারপর ফিসফিস গলায় কিছু যেন বলল কুম্ভ। কিন্তু ও-ঘরে প্রিন্টিং মেশিন চলছে। গুমগুম আওয়াজ। অতীশ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে না। সে তাকিয়ে থাকল। কুম্ভর মনে হল মানুষটা ভারি নিরুপায় এখন। এবং এখনই তাকে নিয়ে খেলা জমিয়ে তোলার প্রকৃষ্ট সময়। সে তালিকা দুটি ভাঁজ করে ব্যাগে ভরে রাখল। পরে ব্যাগের মধ্যে আর যা যা থাকার কথা দেখল ঠিক আছে কিনা। যেন একটা মোক্ষম অস্ত্র পেয়ে গেছে। সে ত আর অতীশবাবুর মতো বলবে না, আমি তোমাদের সঙ্গে কথা বলছি, সে বলবে, রাজার এই ইচ্ছে। রাজা এর চেয়ে এক পয়সাও বাড়াবে না। সে আগেই গেয়ে রেখেছিল মনোরঞ্জনকে, যাই করুন, রাজা এ-সব মানবে না। এগ্রিমেন্টের কোনো দাম নেই। দরকার পড়লে কারখানা বন্ধ করে দেবে। ভেতরে ভেতরে অনেক কিছু হচ্ছে। আসলে সে রাধিকাবাবুর ছেলে, এবং সহজেই রাজবাড়ির অনেক গুহ্য কথা জানার তার সুযোগ আছে। মনোরঞ্জন এটা বিশ্বাস করে। মনোরঞ্জন মানেই তার কর্মীরা। ইউনিয়নের সে এক নম্বর পাণ্ডা।
কুম্ভ চা খেতে খেতে বলল, দেখতো সুধীর, আমার ওখানে কেউ বসে আছে কিনা। যদি থাকে বসতে বলবি। তারপর অতীশের দিকে তাকিয়ে বলল, মাইনে ত দেখছি কারো কারো প্রায় দ্বিগুণ করে দিয়েছেন। যা মাল দেবে, সবটা ত ওরাই খেয়ে নিচ্ছে দেখছি।
—তা হবে কেন। কোম্পানির অন্য সব খরচা একই থাকছে। মার্জিনেল প্রফিট বাড়বে।
কুম্ভ বুঝতে পারে, অতীশবাবুর মাথা পরিষ্কার। সব ঠিক বোঝে। সামান্য ত্যাঁদর হলে আখের গোছাতে পারত। সেটাই নেই। এ সময়ে মানুষের যেটা সব চেয়ে বেশি দরকার। সে আবার সেই ফিসফিস গলায় বলল, আমাদের জন্য কি রাখলেন?
অতীশের এটা মাথায় আসে নি। মাইনে বাড়লে সবার বাড়া উচিত। সে বলল, আগে এটা হোক, অর্ডার-পত্র বেশি আনুন। আমাদেরও হবে।
কুম্ভ তত সহজে বুঝবে কেন। সে বলল, আমরাও দাদা মাইনে ভাল পাই না। একজন কেরানীর মাইনেও দেন না। ওতে চলে না। আসলে সে জন্যই যে তাকে ধান্দাবাজি করতে হয় সেটা ও বলে ফেলল, মানুষ চোর হয়ে জন্মায় না দাদা। পরিবেশ তাকে চুরি করতে শেখায়। কি, আপনি মানেন কিনা বলুন!
অতীশ বলল, সব সময় নয়।
হারামি। নিজের খুঁটি থেকে এক পা নড়বে না। তারপরই মনে মনে সে প্রফুল্ল হয়ে উঠল। আজই পিতৃদেবকে দিয়ে রাজার সঙ্গে একটা গোপন সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করতে হবে। তালিকা দুটো এখন তার সম্বল। সে যে রাজার দিকটা কতটা দেখে, এই তালিকা দিয়েই আর একবার তা প্রমাণ করার চেষ্টা করবে। এবং সে উঠে পড়তেই সুধীর এসে বলল, বসে আছে। কুম্ভ কি ভেবে আবার বসল। লোকটা যখন এসে গেছে তখন কাজটা সেরে যাওয়া ভাল। সে বলল, দাদা দশ টন পি সি আর সি পাওয়া যাচ্ছে। নেবেন? খুব সস্তায় হবে।
—নরম মাল ত!
—নরম মাল।
—কত করে বলছে?
—সে দামের কথাটা লিখে দিল।
অতীশ বলল, পাঁচশ করে হবে কিনা দেখুন।
কুম্ভর খিস্তি করতে ইচ্ছে হল। ঠিক সব খবর রাখে। তবু তার পনের টাকা করে দালালি থাকবে। অনেক কমে গেল। অগত্যা বলল, টাকাটা আজই দিন। না হলে রাখা যাবে না।
অতীশ বলল, মালটা পাঠিয়ে দিতে বলুন। সবটাই এক সঙ্গে দিয়ে দেব। তারপর কি মনে হতেই বলল, কত গেজ।
কুম্ভ বলল, চলে যাবে। ত্রিশ একত্রিশ হবে। এসর্টেড।
.
পরদিন কুমারবাহাদুরের ঘরে তিনজনের এক সঙ্গে ডাক পড়ল। সনৎবাবু ভিতরে ঢোকার আগে সবটা বুঝে নিয়েছেন। আসলে অতীশ হেলপারদের মাইনে অনেক বাড়াবার প্রস্তাব দিয়েছে। যারা সাতাশ টাকা পেত, তারা পাবে পঞ্চাশ টাকার মত। পাঞ্চম্যান, ফিটার কামড়িম্যান, লেম্যানের মাইে বাড়াবার প্রস্তাব দিয়েছে গড়ে কুড়ি টাকা করে। প্রিন্টার ব্লকম্যানদের আরও কম। এই এগ্রিমেন্ট সবচেয়ে উপকৃত হবে হেলপাররা। তারাই সংখ্যায় বেশি। অতীশ এ-সব ভেবেই এটা করেছে। সে গরিষ্ঠের সমর্থন পেতে চায়। এরাই সবচেয়ে বেশি শোষিত। তালিকা দুটো করার সময় অতীশের মাথায় এই ভাবনাই কাজ করেছে। কিন্তু মনোরঞ্জন এবং ইউনিয়নের পাণ্ডারা সায় দিচ্ছে না। এই এগ্রিমেন্ট মেনে নিলে, তাদের ওভার-টাইম বন্ধ হয়ে যাবে—এমন কেউ বুঝিয়েছে। অতীশ বলেছে, আমরা পার্টিদের কাছ থেকে আরও অর্ডার আনব। প্রথম দিকে অসুবিধে হলেও আখেরে তোমাদের লাভ হবে। এত সব করেও সে পারে নি। এখন কুম্ভবাবুর হাতে ভার দিতেই রাজার ঘরে ডাক পড়েছে। সে বুঝতে পারছে না, কেন আবার কুমারবাহাদুর তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। সনৎবাবুর সঙ্গে পরামর্শ করেই এই তালিকা তৈরি করেছিল।
ভিতরে ঢুকেই অতীশ দেখল রাজেনদা বড় গম্ভীর। নীল রঙের টাই পরেছেন। চোখে নীল রঙের চশমা। গোঁফে দুটো একটা পাকা চুল সে আগে দেখেছে—আজ তাও নেই। মুখে পাইপ। তিনজনই ঢুকে প্রথমে দাঁড়িয়ে থাকল। অতীশ দেখছে, তিনি একটা ডিডের পাতা উল্টে। যাচ্ছেন। এরা যে এসেছে, দাঁড়িয়ে আছে তা যেন তিনি বিন্দুমাত্র টের পান নি। অতীশ বুঝতে পারে বড়লোকদের এটা অভিনয়। এত ব্যস্ততার কিছু থাকতে পারে না। বাড়ির তিন চার বিঘে জমির ওপর গম চাষ হয়েছে। গমের সবুজ গাছগুলির ওপর দিয়ে কিছু শালিখ পাখি এখন ওড়াউড়ি করে। শহরের মানুষজন যখন ফুটপাথে বস্তিতে জায়গার অভাবে কালাতিপাত করছে, তখন তার চার বিঘে জমিতে অমলার সখের গম গাছগুলি সহসা চোখের উপর মাথা দুলিয়ে গেল। প্রাসাদের বিশাল এলাকার একপাশে ট্রাম লাইন, আর একপাশে রেল লাইন, উত্তরে হাসপাতাল, ইস্কুল, বস্তি বাড়ি এবং ঘিঞ্জি শহর। কত সুন্দরভাবে এরই মধ্যে মানুষটা বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে। শহরের ময়লা জল পথ ঘাট উপচে এই বাড়িতে কোনওদিন ঢুকে যেতে পারে তিনি বোধ হয় একেবারেই ভাবেন না সেটা। কুমারবাহাদুর বললেন, বোসো। সন বাবুকে বললেন, বসুন। ওরা উভয়ে বসে পড়ল। কুম্ভ তখনও দাঁড়িয়ে আছে। অন্য দিন অতীশই বলে, এ-পাশে এসে বসুন। আজ সে কিছু বলতে পারল না। সে কেমন টের পায়, কুম্ভবাবু জল বেশ ঘোলা করে দিয়েছে। রক্ত মাথায় উঠে যাচ্ছে। এবং মাথা ঝিমঝিম করছে। সে মাথা নিচু করে বসে থাকল।
কুমারবাহাদুরই বললেন, তুই আবার দাঁড়িয়ে থাকলি কেন? বোস। সেই বাড়ির ছেলের মতো, কুম্ভ যে এ-বাড়িতেই জন্মেছে, বড় হয়েছে, এ-বাড়ির জন্য তার যে একটা মায়া থাকবে তাতে আর অবিশ্বাসের কি আছে।
কুম্ভ বসতেই বললেন, তোর কি মনে হয়?
—এগ্রিমেন্ট ঠিকই আছে তবে…
—তবে কি বল!
—অর্ডারপত্র কম। অর্ডারপত্র না বাড়িয়ে এই এগ্রিমেন্টে যাওয়া ঠিক হবে না।
—কেন হবে না? কুমারবাহাদুর আবার প্রশ্ন করলেন।
—কুম্ভ বলল, কাজ ঠিক ঠাক না পেলে ফাঁকা মাঠ হয়ে যাবে।
—স্পষ্ট করে বল!
—লোকজন বসে পড়বে।
অতীশের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি এ দিকটা ভেবে দেখেছ?
অতীশ বুঝতে পারছে, কুম্ভবাবু সুযোগ সন্ধানী হয়ে উঠছে। কুম্ভবাবু অন্যভাবে বিষয়টা তার বাবাকে বুঝিয়েছে। তার বাবা কুমারবাহাদুরের সঙ্গে কাজ সেরে ওঠার সময় হয়ত বলেছিল, কুম্ভ বলল, অতীশ ত ঠিক বোঝে না, ভাল মানুষ, ভাল মানুষ দিয়ে ত কুমারবাহাদুর সব কাজ হয় না, ঐ ত কি একটা এগ্রিমেন্ট করতে যাচ্ছে, গোড়ায় গলদ … এবং এই সবই মাথায় অতীশের কিলবিল করে পাক খাচ্ছে। সে কি বলবে বুঝতে পারছে না। মনে হল, সত্যি সে এদিকটা ভেবে দেখে নি। সে খুবই অক্ষম মানুষ। তার পক্ষে ঠিক এভাবে এগ্রিমেন্ট করার কথা ভাবা ঠিক হয় নি। তারপরই সে কেমন ম্রিয়মান হয়ে যাচ্ছিল—আর ঠিক সেই সময় মনে হল কুম্ভবাবু চায় আবার সেই দু’নম্বর মাল ছাপাবার সুযোগটাকে কব্জা করতে। এই সুযোগে রাজার কাছ থেকে অনুমোদনটা করিয়ে নিতে চায়। সঙ্গে সঙ্গে মাথার মধ্যে রক্তপাত শুরু হয়ে যায় মানুষের পক্ষে এতটা ধান্দাবাজি ঠিক না। দু’নম্বর মাল দিয়ে কি হয় সে জানে। সে পীড়িত বোধ করতে থাকল।
সনৎবাবু বললেন, প্রচুর অর্ডারপত্র হাতে থাকলেই অতীশ এটা তোমার সম্ভব।
অতীশ কোথায় যেন এবার দৃঢ়তা পেয়ে যাচ্ছে। সে বলল, যা আছে তাতে বসে যাবার কথা না।
কুমারবাহাদুর পাইপ খুঁচিয়ে আবার চোখ বুজে ধোঁয়া টানলেন। ধোঁয়া আসছে না। খুক খুক কাশলেন কেমন একটা জব্দ করার মতলবে যেন ওরা তিনজনই ওর চারপাশে এখন কাশতে শুরু করেছে। বেশ সময় নিয়ে কুমারবাহাদুর তারপর বললেন এরা যদি মাল বাড়িয়ে দেয়, তুমি যদি মালের দাম না কমাও যদি বাজার হাত ছাড়া হয়ে যায় তখন কি করবে?
চাপটা প্রবলভাবে আসছে। অতীশ বলল, দাম কমালেও এর চেয়ে অর্ডারপত্র বেশি আসবে না। আমাদের নতুন কাস্টমার খুঁজতে হবে। মান্ধাতার আমল থেকে যারা আছে তারাই নিচ্ছে।
কুমারবাহাদুর বললেন, তার কিছু ব্যবস্থা নিয়েছ?
—কিছু কিছু চিঠি পাঠিয়েছি। ধরুন কে এম পি রাজি হয়েছে! প্রিন্টিং আরও ভাল চায়। লিথো ব্লকে চলবে না। জিংক প্লেটে যেতেই হবে। কোটা, ইমপোর্ট লাইসেন্স সব দরকার। টাকা নেই।
—তুমি বেশ আছ, টাকা নেই, তুমি এদিকে সবার মাইনে বাড়াতে চাইছ।
—ওরা মানবে না। আপনাকে বাড়াতে হবেই। সেটা আজ নয় কাল।
কুমারবাহাদুর বললেন, আজ-কালের মধ্যে তফাত অনেক হে ভায়া। তোমরা সেটা বুঝতে শেখ নি। হাতের কাছে যা পাবে তাই নিয়ে নাও এখন। তারপর এগ্রিমেন্টে যাও।
সেই দু’নম্বরী মালের প্রসঙ্গে আসছে। শেঠজি, রামলাল, কিশোরীলাল, পিয়ারীলালেরা ঘোরাফেরা করছে। অতীশ বলল, আগে ইউনিয়নের সঙ্গে এগ্রিমেন্ট হোক। তারপর দেখি বসে যায় কিনা। যদি যায় এরা ত আছেই। এখন তাড়াহুড়ো করে খুব লাভ নেই।
এবার কুমারবাহাদুর কুম্ভবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, তাহলে ওটা করে ফেল। অতীশ তো রাজি আছে। বসে যদি যায়, তখন না হয় শেঠজীদের মালের কথা ভাবা যাবে। কুম্ভর মনে হল হেরে যাচ্ছে। সে বলল, আজ্ঞে তাই তবে হবে। কিন্তু কুম্ভের মুখ দেখে অতীশ বুঝতে পারল, সে সহজে তাকে নিস্তার দেবে না।
কুম্ভর মেজাজ বিগড়ে গেলে চোখ দুটো লাল হয়ে যায়। এটা মানুষের পক্ষে খারাপ। অতীশের কাছে এটা মনে হয় ভারি বিপদজনক বিষয়! সে আর্চিকেও দেখেছে, রেগে গেলে মাথা ঠিক রাখতে পারত না। আর্চির ছিল বনির ওপর প্রলোভন। এবং প্রলোভনে পড়ে গিয়ে সে ছোটবাবুকে যখনই সুযোগ পেত নির্যাতন করত। কুম্ভবাবু টাকার প্রলোভনে সেই একই কাজ করছে। এবং এটা যে কখন নিদারুণ নিষ্ঠুর হয়ে উঠবে, অতীশ আবার দেখতে পাবে একটা বাঘের মতো মুখ— যেন ডোরাকাটা, প্রায় আর্চির মতো মাথা উঁচিয়ে বসে আছে—সে ভীত হয়ে পড়েছিল। সে মনে মনে বলল, না না, ওটা বাঘের মুখ না। মানুষের মুখ। বাঘের মুখ হয়ে গেলেই মনে হবে, হত্যায় কোন পাপ নেই। যদি আর্চির মুখে সে সামান্যতম মানুষের অবয়ব খুঁজে পেত! তবে বোধহয় খুন করতে পারত না। সে পেছন থেকে ডাকল, কুম্ভবাবু। আসলে সে আবার মুখটা দেখতে চায়। মুখের অবয়বে মানুষের মুখ দেখতে চায়। কারণ সে নিজেকে বড় ভয় পায়। নিজেকে সে বিশ্বাস করে না।
কুম্ভবাবু বারান্দায় এসে বলল, আমাকে ডাকছেন দাদা?
অতীশ অপলক দেখতে থাকল মুখটা। আর্চির মতো বেঁটে, রং ফর্সা, নাক থ্যাবড়া, চোখ গোল গোল, ঝাঁটা গোঁফ এবং মাথায় কদমছাঁট চুল। সে বলল, গোঁফটা অত বড় কেন রেখেছেন কুম্ভবাবু?
কুম্ভ বলল, কি হয়েছে তাতে?
অতীশ ভীরু বালকের মতো বলল, আমার ভয় করে।
কুম্ভ হা হা করে হেসে উঠল। এবং সেই হাসিতে অতীশ কেমন ম্রিয়মান হয়ে যায়। বুঝতে পারছে, সে স্বাভাবিক কথাবার্তা বলছে না। সে এমন হয়ে যায় কেন! তার মাথার মধ্যে কে টরে টক্কা বাজায়!