1 of 2

ঈশ্বরের বাগান – ১৪

।। চৌদ্দ।।

চার-পাঁচ দিন ধরে কি বৃষ্টি। সঙ্গে ঝড়ো হাওয়া। পথঘাট ট্রাম-বাস বাড়ি-ঘর সব বৃষ্টিতে লেপ্টে ছিল। সকালের কাগজে শুধু এক খবর। দেশের কোথায় বন্যা, কোথায় ব্রিজ ভেঙে গেছে, কোথায় ট্রেন অচল হয়ে থেমে আছে তার খবরে সকালের কাগজটা ভরা। বড় বড় হেড লাইন, যেন কাগজে তখন এই খবরটাই মানুষের পড়ার কথা। সব কাগজগুলোয় সংবাদদাতাদের নিদারুণ অভিজ্ঞতার বর্ণনা, শষ্যহানির খবর। গবাদি পশু সব ভেসে গেছে। জলবন্দী মানুষজন উদ্ধারের জন্য মিলিটারি নেমেছে। বর্ষাকাল এলেই এই এক খবর। তারপর হেমন্ত আসে। সোনালী ধানের মাঠ তখন দিগন্তব্যাপী। বান বন্যায় ভেসে গিয়েও মানুষের জন্য কিছু না কিছু আবাদ টিকে থাকে।

মানসনারায়ণ চৌধুরীর ঘরেও আজকাল কেউ কাগজ দিয়ে যায়। সে বাথরুম থেকে ফিরেই দেখতে পায় কাগজটা পড়ে আছে। আজকাল সে আর উত্তেজিত হয় না। উত্তেজিত হলেই মাথার মধ্যে অযথা সব রেলগাড়ি ঢুকে যায়। সে ঠাণ্ডা মাথায় আজকাল কাগজ পড়তে পারে। এখন তার ঘরে তালা পড়ে না। সে ইচ্ছে মতো রাস্তায় বের হতে পারে। একদিন গড়ের মাঠে গিয়েও বসেছিল। বাইরে যেতে চাইলে তাকে পুরানো ভকসল গাড়িটা দেওয়া হয়। বাহাদুর তাকে শহরটা ঘুরিয়ে দেখায়। কোনো পার্কে তার পায়চারি করতে ভাল লাগলে রাত করে ফিরতে ভালবাসে। কিন্তু রাজেনটা আবার কি মনে করবে—সেতো স্বাভাবিকভাবেই সব করে যায়, কিন্তু ঠিক সময় না ফিরলেই একটু বেশি হাঁটাহাঁটি করতে চাইলেই কেমন সংশয়ের চোখে তাকায় রাজেন। যেন সে বড়ই কুকর্ম করে ফেলছে।

বৃষ্টির জন্য কদিন এই ঘরেই বন্দী হয়ে আছে। কাগজটা সারাদিন উল্টে-পাল্টে দেখে। কখনও কখনও একই লাইন বার বার পড়ে। নবীন যুবকের পাশে বসে থাকলে সে কেমন স্বস্তি পায়। অতীশের চোখে এমন কিছু আছে যা তাকে বেঁচে থাকার প্রেরণা দেয়। সেটা কি সে ধরতে পারে না। বেচারা পঞ্চানন বলেছে, হুজুর অতীশবাবুকে বলেন ত ডেকে দি। পঞ্চানন কি বুঝতে পেরেছে সে অতীশের জন্য টান বোধ করে। সে ত কখনও কাউকে কিছু বলে নি। কিছু দিন তার পাশের ঘরটায় অতীশ ছিল। ওর ছবির খুব প্রশংসা করেছে অতীশ। বলেছে, দাদা আপনি কেন ছবি আঁকা ছেড়ে দিলেন। ওটা ছাড়বেন না। মানুষের ত বেঁচে থাকার জন্য কিছু একটা চাই। কতদিন পর যেন শুনতে পেল সে সত্যি ভাল ছবি আঁকে। তাঁর হাত পরিষ্কার। মাষ্টারমশাইরাও এমন বলতেন। মডেলের ক্লাসে তার মত সুন্দর সতেজ ছবি কেউ আঁকতে পারত না। সবচেয়ে ওটাই ছিল তার প্রিয় ক্লাস। ইদানীং সে আবার ছবি আঁকা শুরু করেছিল। বৃষ্টিতে বের হতে পারে নি। সরকারবাবুর কাছে পঞ্চাননকে দিয়ে একটা লিষ্ট পাঠিয়েছিল। একটা ইজেল, কিছু জলরঙ এবং বুরুশ পঞ্চানন দিয়ে গেছে। ছবি আঁকতে না পারলে তাঁর মাথার মধ্যে রেলগাড়ি ঢুকে না গেলেও পাশ দিয়ে চলে যায়। ছবি আঁকতে না পারলে তাঁর কষ্ট হয়—তখন হাবিজাবি মাথায় যা আসে তাই দেয়ালে লিখতে থাকে। যেন গত জন্মের কথা লিখে যাচ্ছে। সেই কথাগুলো রাজেন এত ভয়াবহ ভাবে কেন সে বোঝে না। ঘরে যারা ঢুকতে পায় তারা দেখে ফেলবে ভয়েই রাজেনটা তখন তালা দিয়ে দিতে বলে? তারপর আবার নদীর জল সরে গেলে যেমন বালিয়াড়ি পড়ে থাকে তেমনি কখনও সে গত জন্মের কথা ভুলে গেলে, ভাল পোশাকে, বনেদীয়ানার সব পুরস্কার কপালে—আর তারপরই ঘরে চুনকাম হয়ে যায়। বার বার, পাঁচ-সাত বার বছরে ঘরটা চুনকাম করা হয়ে যায় এভাবে

কিন্তু সেই নবীন যুবক উসকে দিয়ে গেল, প্রায় আগুনে ঘি ঢালার মত, বলে গেল মানসদা মানুষের বেঁচে থাকার জন্য এটা বড় দরকার। আপনার কি হারিয়েছে আমি জানি না, মানুষ কিছু না হারালে এমন হয় না। আপনার ছবি আঁকা খুব দরকার। অভ্যাসটা রাখুন। অন্য এক রহস্য খুঁজে পেলে যা হারিয়েছে তা আবার ফিরে পাবেন।

অতীশ চলে যাবার পর সে পঞ্চাননকে দিয়ে একটা ফিরিস্তি পাঠিয়ে দিয়েছিল। ঘরে এখন ইজেল, রঙ, বার্নিস যা দরকার সব আছে। বৃষ্টির কদিনে সে একটা মাত্র ছবি আঁকার চেষ্টা করেছে। কিন্তু কি এঁকেছে সে নিজেই বুঝতে পারছে না। সে প্রথম আঁকতে চেয়েছিল, নদীর পাশে রাজবাড়ি, সামনে বালির চর, দুজন অশ্বারোহী যুবক রাজবাড়ির দিকে উঠে আসছে। ঘোড়া দুটো কদম দিচ্ছিল। প্রথম ছোট একটা আর্ট পেপারে স্কেচ করতে গিয়ে মনে হল একটা ঘোড়ার মুখ বড়ই লম্বা। আর একটা বড়ই বেঁটে। তারপর মনে হল, ঘোড়ার মুখই হয় নি কেমন জিরাফের মুখের মত লম্বা। তবু রঙ তুলি নিয়ে যখন বসল—সেটা শেষ পর্যন্ত কি দাঁড়াল বুঝতে পারছে না। আবছা অন্ধকারে এক বিশাল রাজবাড়ির ছায়া, আরও অস্পষ্ট দুটো ঘোড়া, অশ্বারোহী আছে কি নেই বোঝা যায় না। কেবল সাদা বালিয়াড়ি আর নদীর জল স্পষ্ট। তার মনে হল, কাগজে রঙ দেয় নি বলে বালিয়াড়িটা সাদা দেখাচ্ছে। সেটা এই ছবির সঙ্গে বেমানান। সে সেখানে কিছু পিংক কালার এবং ব্লু রঙে আবছা ছাই রঙ করে দিতেই গোটা ছবিটা বিশ্রী হয়ে গেল। মনে হল ঘোড়ায় চড়ে ফেরার পথে প্রাসাদ অলিন্দে কিরানা ঘরানার ধারক কোনও সঙ্গীতশিল্পীর সুর ছবিতে জেগে উঠছে না। গোটা ছবিটাই তার কাছে কেন জানি অর্থহীন মনে হচ্ছে। তারপর মানস ছবিটা দু’দিন ফেলে রেখে অন্য একটা ছবিতে মন দিয়েছিল। কিছু কাঁচের গ্লাস। লাল মদ। দুজন প্রবীণ মানুষ দরজা দিয়ে ঢুকছেন। একজনের মাথায় উষ্ণীষ, গায়ে রাজার পোশাক। অন্যজন টাক মাথা বেঁটে-খাটো মানুষ। ধুতি পাঞ্জাবি পরনে। কিন্তু মুখটা একজনের উটের মত হয়ে গেল। অন্যজনের বাঘ। সে বুঝল, হবে না। সে তারপর কদিন কিছুই আঁকেনি। কদিন থেকে অতীশের পাত্তা পাওয়া যাচ্ছে না, যে তাকে ডেকে দেখাবে। সে দেখলে বুজতে পারত ছবিটা কিভাবে শেষ করা যায়। মাথায় এক রকমের চিন্তা থাকে, ছবিটা আঁকতে গেলে সেই চিন্তা গুলিয়ে যায়। তখন আর মনে করতে পারে না আসলে সে কি আঁকতে চেয়েছিল।

পঞ্চানন সকালের খাবার নিয়ে এসেছে। ওর খাওয়া হলে সব নিয়ে যাবে। সে খেতে খেতে বলল, অতীশবাবুকে ডেকে আনবি বলছিস?

—হুজুর আপনার চোখ মুখ ভাল নয়। অতীশবাবু ছিলেন বলে বেশ ভাল ছিলেন।

—তা ছিলাম। কিন্তু বেচারা বৌ-ছেলেপিলে নিয়ে এসেছে। কারখানার কাজের চাপ। রাত-দিন পড়ে থাকছে শুনছি, বাড়িতে কি পাবি?

—হুজুর দেখে আসব?

—আয়।

—কিছু বলব?

—আজ রববার না?

পঞ্চানন বলল, আজ্ঞে।

—দাঁড়া। বলে মানস একটি চিঠি লিখল—অতীশ, তুমি আমাকে ভুলে গেছ। আমি তোমার মানসদা। বড়ই বিপদে আছি। সময় এবং সুযোগমতো একবার পারলে এস।

পঞ্চানন অতীশকে একেবারে সঙ্গে নিয়েই এসেছে। বারান্দায় ঢুকে পঞ্চানন বলল, যান ভিতরে যান।

অতীশ ভিতরে ঢুকে দেখল, মেঝেতে অজস্র ছবি ছড়ানো! সে খুব আগ্রহের সঙ্গে একটা তুলে নিয়ে দেখল—বিরাট ফাঁকা ঘরে দুজন সারেঙ্গিবাদক বসে আছে। নামাজ পড়ার মত হাঁটু ভাঁজ করে বসার ভঙ্গী। চোখ উর্ধ্বনেত্র। ছাদের ফুটো থেকে একটা হাত বের হয়ে আসছে। ঠিক এমনই একটা ছবি বিলিয়ার্ড টেবিলটা যে ঘরে আছে সেখানে বাঁধানো রয়েছে। অতীশের মনে হল, তবে সেই ছবিটাও এই মানুষ এঁকেছেন। ছবিটা দেখে সে প্রথম ভয় পেয়ে গেছিল। একটা কালো কোট তার হাত দেয়াল ফুটো করে বের করে দিয়েছে। নিচে নিস্তরঙ্গ জল। ছবিটা দেখে ভয় পাওয়ায় শরীর বেশ শিরশির করে উঠেছিল।

অতীশ বলল, অনেক ছবি দেখছি।

—অনেক কোথায়। দুটো ত।

সে বলল, এই যে।

মানস বলল, ওগুলো কিছু না। তুমি এটা দেখ। কিছু হয়েছে কিনা দেখ। অতীশ দাঁড়িয়েই ছবিটা দেখছিল।

—বসে দেখ না। এই পঞ্চানন, চেয়ারটা এগিয়ে দে-না।

অতীশ বসতে বসতে বলল, আপনি করেছেন কি!

মানস কিছুটা যেন শঙ্কা বোধ করল। তাহলে কি সে সত্যি যা আঁকতে চেয়েছিল সেটাই ফুটে বের হচ্ছে। আর অতীশ সেটা বুঝতে পেরে ভয় পেয়ে গেছে। রাজবাড়ির চেহারাটা অতীশ তাহলে দেখতে পাচ্ছে। সে বলল, তুমি ভয় পাচ্ছ?

অতীশ মানসদার কথার অর্থ ধরতে পারল না। ছবিটা থেকে মুখ তুলে মানসদার দিকে তাকিয়ে থাকল।

—ভয় পাচ্ছ কিনা বল! ছবিটা তাহলে যা আঁকতে চেয়েছি তাই হয়েছে বলছ। রাজেনটা তবে ক্ষেপে যাবে। কি যে করি!

অতীশ ভারি অবাক হল। বলল, ছবিটা আমাকে দিন। বাঁধিয়ে রাখব। দেয়ালে টাঙাব। রাজেনদা রাগ করবে কেন।

—কি জানি। আমি ত রাজেনকে ক্ষমাই করে দিয়েছি।

তার বলতে ইচ্ছে হল, রাজেনদা আপনার কে হয়! এ-বাড়িতে এসে বুঝেছি, সবাই এখানে বুঝে ফেলেছে, এই শেষবেলা, যে যে ভাবে পারো গুছিয়ে নাও। সিগনাল ডাউন হল বলে। একমাত্র আপনিই নির্বিকার। রাজার সব লোক এখন টের পেয়েছে—এদের যা অবশিষ্ট আছে তার কিছুটা লুটেপুটে নিলেও তিন পুরুষের নিশ্চিন্তি। কিন্তু আপনি বসে আছেন। আপনি এই রাজবাড়িতে আশৈশব মানুষ। পুরানো লোকেরা কিছু খবর রাখে। কুম্ভ মাঝে মাঝেই বলে, বলতে পারি বলব না। এ-ব্যাপারে আমার আগ্রহ অনাগ্রহ সমান। ভয় যদি কুম্ভ আপনাকে ছোট করতে চায়, রাজেনদাকে ছোট করতে চায়। মানুষ ছোট হয়ে যাচ্ছে দেখলে আমার কেন জানি কষ্ট হয়।

—এই কি—তুমি ছবিটা নিজেই কেবল দেখছ! কি দেখছ বলছ না কেন!

—একটা বড় স্মৃতিসৌধ মনে হচ্ছে আঁকতে চেয়েছেন।

তারপর কি ভেবে অতীশ বলল, গভীর অন্ধকার থেকে দু’জন অশ্বারোহী পুরুষ উঠে আসছে। পেছনে সাদা বালিয়াড়ি। বোধহয় জ্যোৎস্না পড়ায়, সেটা হয়েছে। আকাশ আবছা মেঘে ঢাকা। ফাঁকে ফাঁকে জ্যোৎস্না বৃষ্টির জলের মতো নেমে আসছে। তার পেছনে নদী, ওপরে অস্পষ্ট কুয়াশা। সময়টা শীতকাল—ছবিটা দেখে তাই তো মনে হচ্ছে।

মানস ছবিটা ওর হাত থেকে টেনে নিল। নিজে ভাল করে দেখল, আবার। কিন্তু কিছুই মিলছে না। সেই কুমারদহ রাজবাটীর ছবি এটা যেন নয়। সে ত এখন ভগ্ন প্রাসাদ। দেবোত্তর সেবাইত, দু’জন গোমস্তা একজন খাজাঞ্চি মাত্র থাকে। বিরাট সব আম বাগান, শহরে কিছু বাড়ি ভাড়া, একটা বাজার, কিছু বালির চর এবং বড় বড় সব ভৈলচিত্র, মাঝে মাঝে রাজেনটা বিদেশ গিয়ে কি করে সব, তারপরই সাহেব-সুবোরা আসে। সব নিয়ে গাড়ি করে চলে যায়—কাঠের কাজ করা বাতিদান থেকে মিনে করা সব সৌখিন আসবাবপত্র, পূর্বপরুষদের সংগ্রহ করা ছবিও পাচার করে দেয় তারা। এই রাজবাড়ির ঘরে ঘরেও জমে আছে সব এমন কত অমূল্য সম্পদ। সব খালি করে দিচ্ছে রাজেনটা। সে ত আঁকতে চায় নি। আঁকতে চাইলে শস্য-বিহীন একটা মাঠের সে ছবি আঁকত। তাতেই বড় রকমের শূন্যতা ধরা যায়। আসলে যে পাপ বাপ-পিতামহের আমল থেকে জমা হয়ে আছে তার কিছুটা প্রথা-প্রকরণ মেনে ছবি আঁকা ছিল তার বিষয়বস্তু। অতীশ ধরতে পারছে না। না সে চেয়েছিল, ঘোড়ায় সে এবং রাজেন। পেছনের অন্ধকারে খুব আবছা নারী মূর্তি—সেটা অতীশ কেন খেয়াল করল না। সেই আবছা নারীমূর্তিটা রাজপ্রাসাদ গ্রাস করছে সেটা অতীশের নজরে এল না কেন! অতীশ অন্য সব ছবিগুলিও তুলে তুলে দেখছে। ছবিগুলির নাম দিয়েছেন, সাদা ফুল। বসন্ত। নদীতটে আমি জারজ সন্তান। কালের ঘোড়া। পতিতালয়। এমন সব কত হিজিবিজি নাম। ছবির সঙ্গে নামগুলির প্রায় কোন দিক থেকেই মিল নেই। যেমন ‘বসন্ত’ ছবিটাতে শুধু কালো কিছু ফুটকরি। আঁকাবাঁকা গাছের অভ্যন্তরে কোনও পক্ষী শাবকের লেজ। দুটো সরীসৃপ গাছের গোড়ায় এং পেতে বসে আছে। অতীশ এ-বয়েসেই কিছু কিছু শিল্পীর জীবনী পড়েছে। কোনও না কোনওভাবে এরা অধিকাংশই অর্ধ উন্মাদ। সে এবার মানসদার দিকে তাকাল। কিছু তাকে বলছেনও না। কোথাও যদি আরও ছবি থাকে—সেখানে যদি মানসদা নিজেকে তুলে ধরেন। সে তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকল। একটা ছবি আশ্চর্য লাল রঙে আঁকা। আগুনের লেলিহান গ্রাসের মধ্যে নির্বিঘ্নে এক উলঙ্গ নারী বসে আছে। মুখ চোখ আশ্চর্য রকমের শাস্ত। নাম দিয়েছেন ব্যভিচারিনী। একমাত্র এই ছবিটার সঙ্গে নামকরণের আশ্চর্য সার্থকতা পেয়ে বলল, মানসদা এ ছবিটা কবে আঁকলেন।

ছবিটা দেখে বলল, ও ওটা অমলার ছবি। ফেলে দাও। আমার কাছে ছবিটার কোনও দাম নেই। ইচ্ছে করলে নিয়ে যেতে পার। তোমার সঙ্গে শুনেছি খুব ভাব। তারপরই কেমন সচকিত হয়ে গেলেন। কি যেন তার জিজ্ঞেস করার আছে অতীশকে। মানসদা এবার হাত থেকে ছবিটা ঝেড়ে ফেলে দিলেন। এতক্ষণ যেন বড়ই অপবিত্র বিষয় নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছিলেন, বললেন অমলাকে তুমি চেন শুনেছি।

—কার কাছে শুনলেন?

—আমার কাছে সবাই খবর দিয়ে যায়। ও বাবু এবারে আবার খেলা জমে উঠল।

অতীশ বলল, একথা কেন?

—এই আর কি। ওরা বোঝে রাজেনটা আমাকে ঠকাচ্ছে। আমাকে সম্পত্তির উত্তরাধিকার দিচ্ছে না। আমাকে ওরা খুব ভালবাসেনা!

অতীশ এইসব পারিবারিক রেষারেষি শুনতে কখনও আগ্রহী হয় না। বিষয় আশয়ের প্রতি এমনিতেই একটা তার উদাসীনতা আছে। সেটা বোধহয় সে বাবার কাছ থেকেই পেয়েছে। মানুষের চলে যাবার মতো উপার্জন থাকলে খুব ছোটাছুটি তার পছন্দ নয়। সে তা করেও না। সংসারে ব্যভিচার ঢুকলে যা হয়। সেটা টাকার হতে পারে, নারীর হতে পারে, যেমন এখন সে বুঝেছে যে কোনভাবে সব সম্পত্তি স্বনামে রাখা রাজেনদার আর নিরাপদ নয়। তার সম্পত্তি গ্রাস করার জন্য সবাই উদ্যত। আইন বদলাচ্ছে। এবং এমন একসময় আসবে যখন বসবাস এবং উপার্জনে চলে যায় মতো সম্পত্তি ছাড়া তার আর কিছুই থাকবে না। রাজেনদার বাবার ঠাকুদা দুটো কোলিয়ারি বিক্রি করে এই এস্টেট গিলেণ্ডার কোম্পানী থেকে উদ্ধার করেছিলেন। তারপর থেকেই বাড়িয়ে যাওয়া ছিল তাঁর স্বভাব। প্রভুত্ব এবং পৌরুষ এই দুই মিলে এস্টেটের যখন রমরমা তখনই স্বাধীনতা। জমিদারী চলে গেল। সরকারী কমপেনসেসন বাদে যা থাকল তাও কয়েক কোটি টাকা। খেলিয়ে তুলতে পারলে অনেক বার চোদ্দ বছরে রাজেনদা বুঝি সব বুঝে ফেলেছেন, অকর্মণ্য সব মানুষজন পুষে রেখেছেন, সব ব্যবসাই যেতে বসেছে এবং এ জন্য দায়ী তাঁর আমলারা। আসলে আভিজাত্য যে জীবনে কাঁটা হয়ে আছে সেটা রাজেনদা বুঝতে পারছেন না। ফলে বেনামে সম্পত্তি বিক্রি বাট্টার সময় টাকাটার হিসেব থাকে না। পচা টাকায় এই রাজপ্রাসাদ ভরে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে এই পচা টাকার গন্ধ সে পায়, মানসদা পায়। সুরেন পায়। তারপরই মনে হয় বড়ই বিদঘুটে সব চিন্তাভাবনা। এগুলি নিয়ে তার মাথাব্যথা থাকার কথা নয়। কিন্তু সে বুঝতে পারে আগুনের ওপর দাঁড়িয়ে থাকবে শরীর পুড়বে না, এমন রসিকতার কথা কবে কে শুনেছে। সেজন্য অতীশ ভারি বিমর্ষ বোধ করছিল।

মানসদা বললেন, নবীন যুবক তোমার কপালে সন্ন্যাস-টন্ন্যাস নেই ত!

অতীশ হাসল।

—কথা বলছ না কেন। মাথা গুঁজে ছবিতে এত কি দেখছ। যা দেখছ তা ঠিক। এই জরুলটাও জঙ্ঘায় আছে। হাত দিলে টের পাবে। আমি মিছিমিছি ছবি আঁকি না।

আসলে আগুনে উবু হয়ে বসে থাকা নারীমূর্তিটি অতীশকে ভয় ধরিয়ে দিয়েছে। বুঝি অমলার সঙ্গে মানসদার কোনও গভীর সম্পর্ক আছে।

ছবিটা যে কোনও নারীমূর্তিরই হতে পারে। কারণ উবু হয়ে বসা। মুখ দেখা যাচ্ছে না। চুল আগুনের মধ্যে ঝলকাচ্ছে। এবং পেট জঙ্ঘা বাহু সবই স্পষ্ট। ছবিটা একবার দেখার পরই চোখ সরিয়ে নিয়েছিল অতীশ। কিন্তু মাথা তোলেনি বলে মানস ভেবেছে, সে ছবিটাই দেখছে। মানসদার কথায় অতীশ ফের ছবিটা দেখে আঁতকে উঠল। তাঁর মনে হল সত্যি অমলা তাঁর সামনে উলঙ্গ হয়ে বসে আছে। সে ভিতরে কাঁপছিল।

—তুমি অমলাকে তবে চেন?

অতীশ বলল, চিনি

—কবে থেকে?

—অনেককাল আগে। আমি তখন খুব ছোট। ওদের জমিদারিতে আমার বাপ জ্যাঠারা কাজ করতেন।

—তাহলে এখন থেকে তুমিই আমার হয়ে অমলাকে যা বলবার বলবে।

অতীশ চুপ করে থাকল।

—কী চুপ করে থাকলে কেন?

—ওকে ত আমি দুদিনের বেশি এখানে দেখিনি। তাছাড়া আমার সঙ্গে দেখাও হয় না।

—হবে।

—হলে বলব।

—কি বলবে শুনলে নাত।

—কি বলব?

—শুধু বলবে আমি সত্যি পাগল নই। ওকে এটা তোমায় বোঝাতে হবে। –আপনি সত্যি তো পাগল নন। কে বলেছে আপনি পাগল!

—সে তুমি বললে হবে কেন? পৃথিবী শুদ্ধ সব লোক বললেও হবে না। তারপরই তিনি উঠে দাঁড়ালেন। জানালায় গিয়ে কি দেখার চেষ্টা করলেন। গলা বাড়িয়ে ডাকলেন, পঞ্চানন। পঞ্চানন এলে বললেন, আমাদের একটু চা খাওয়া।

অতীশ কেমন আবার বিভ্রমের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। সে বলল, আচ্ছা মানসদা, প্রাসাদের বড় হলটায় একটা ছবি দেখলাম। একটা কোটের কালো হাতা, কাঠের বেড়ার ফুটো দিয়ে বের হয়ে আছে। এটা আপনার আঁকা?

—মনে করতে পারছি না।

—বিলিয়ার্ড টেবিলটা যে-ঘরে আছে।

—অমলা হয়ত এখনও দু একটা ছবি রেখেছে। হতে পারে। আবার নাও হতে পারে। রাজেনটা আমার কিছুই রাখতে দেয় না। ছেলেবেলা থেকেই ও বড় হিংসুটে স্বভাবের ছিল। আমার সব কিছু কেড়ে নিতে চাইত। তারপর সামান্য থেমে কেমন নির্লিপ্ত গলায় বললেন, তুমি পল সেজনের নাম শুনেছ?

অতীশ বলল, না।

—সে যাই হোক। ছবিটা দুই নারীর। সম্ভবত মা মেয়ের। সম্ভবত দুই বোনের। কি ছবি এখন আমি ঠিক মনে করতে পারছি না। কিন্তু চোখ দুটো আমি নিবিষ্ট হলে এখনও দেখতে পাই। সেই চোখ বালিকার সেই চোখ যুবতীর, চোখ মায়ের, চোখ বারবনিতার। এতগুলো চোখ সেই দুই নারীর চোখে তিনি এঁকে ছিলেন। এক জোড়া চোখ কখন কেমন হবে বলতে পার না।

মানসদার কথাবার্তা শুনতে শুনতে অতীশের কেমন মাথা ধরে যাচ্ছিল। এই মুহূর্তে সে যা ভাবছে, তিনি সেখানে থেকে তাকে কত সহজে অন্য জায়গায় নিয়ে যাচ্ছেন। সে বলতে চেয়েছিল, সেই হাতটা আপনার আঁকা কিনা। সেই হাতটাই আমি ভুলে নির্মলার আসার আগের দিন রাতে দরজার পাশে ঝুলতে দেখেছি কিনা। সেই হাতটাই আমার মাথার মধ্যে আর্চির প্রেতাত্মার ভয় আবার ঢুকিয়ে দিয়েছে কিনা! কিন্তু বলে লাভ নেই। অমলাই হয়ত বাঁধা দেবে। আর্চির কথাটা তাঁকে বললে কেমন হয়। কারণ এই মানুষ তার কাছে প্রথম যেন কত গোপন খবর এ বাড়ির বলে দিল। অথবা দৈন্যের কথা, পরাজয়ের কথা—এসব কথা সহজে মানুষ অন্য মানুষকে বলতে চায় না। মানসদা তাকে বেশ স্পষ্টই যেন বলে দিল, তোমার কাছে আমার কিছু গোপনীয় নেই। তোমাকে অতীশ আমি বিশ্বাস করি।

অতীশ বলল, আপনার প্রেতাত্মায় বিশ্বাস আছে?

মানসদা উঠে দাঁড়ালেন, চোখ বড় বড় করে বললেন, সেটা আবার কি?

অতীশ একেবারে জলে পড়ে গেল। এমনভাবে সে বোকা বনে যাবে বুঝতে পারে নি। সে তবু মরিয়া হয়ে বলল, কালো কোট গায়ে একটা হাত শুধু আঁকলেন কেন! কি অর্থ এ ছবির।

—দেখ সত্যি আমি মনে করতে পারছি না।

—আপনি সব পারেন। ইচ্ছা করলে সব পারেন। ভূতেও বিশ্বাস করতে পারেন। আপনি পারেন না এটা আমি বিশ্বাস করি না।

পাজামা পাঞ্জাবি পরা মানুষটিকে বড়ই সুদীর্ঘ এক মহিমময় পুরুষের মতো মনে হচ্ছে। এবং তখনই মনে হল মৃত রাজার চেহারার সঙ্গে মানসদা’র বড় বেশি মিল। কিন্তু সে শুনেছে, রাজেনদা এই সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী। রাজার সঙ্গে রাজেনদার চেহারার অমিলটাই বেশি। আদৌ দীর্ঘকায় নয়, গৌরবর্ণ নয়, বড় চোখ নয়, নাক, নাকটা কার মতো! কারো মতো নয়। মানুষের মতো নয়! কিছুটা শিম্পাজির মতো। এত চাপা নাক নিয়ে রাজেনদাকে শেষ পর্যন্ত মোটা গোঁফের আশ্রয় নিতে হয়েছে।

অতীশ চা খেয়ে উঠে পড়ল।

—তা হলে তুমি কিন্তু বলবে।

অতীশ মনে করতে পারল না তাকে কি বলতে হবে। কারণ কালো কোট এবং হাত, আগুনে ছবি, দুই নারী এবং দুই অশ্বারাহী ক্রমাগত তার মাথার মধ্যে ঠোকাঠুকি করছিল। এখানে এসে আর্চিব প্রভাব বেড়ে যাওয়ায় সে সব সময় শঙ্কার মধ্যে থাকে। প্রথম দিন থেকেই এখানে একটা কালো হাত মাথার মধ্যে ঢুকে বসে আছে এবং ওটাই ওকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। মানসদার ছবিগুলি না দেখলে সেটা যেন মনে হত না। অন্তত একটু যুক্তি খাড়া করতে পেরে সে নিশ্চিন্ত হতে গিয়ে কি বলতে হবে ভুলে গেছে। সে কিছু না ভেবেই বলল, বলব।

নিচে নামতেই নবর সঙ্গে দেখা। সে বলল, স্যার, আপনার কাছে যাচ্ছিলাম।

নব একটা ধুতি ফেরতা দিয়ে পরেছে। খালি গা। গলায় পৈতাটা ভারি চকচক করছিল। সে আজকাল খালি গায়েই ঘোরাফেরা করছে। পৈতাটা রোজই বোধ হয় মাজে। একদিন মিণ্টুকে ডাকতে গিয়ে দেখেছিল পুকুরে নাই-জলে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে মন্ত্রপাঠ করছে। অতীশ বুঝতে পেরেছিল নব এখন তার কাজে কর্মে খুব আন্তরিক। দেখা হয়ে যাওয়ায় সে বলল, ভাল আছ।

নব ও-সব কথার উত্তর দিল না। –একদিন গেলেন না স্যার।

অতীশ বলল, যাব।

—স্যার জমে উঠেছে খুব!

নব তার শনিপূজার কথা বলছে,

—পয়সা হচ্ছে?

—একাউণ্ট রাখছি। তবে সবই পাঁচ পয়সা দশ পয়সা। গুড বিজনেস সেন্টার। কমপিটিশনও আছে স্যার। আমার দেখাদেখি পাশেই আর একটা শনির থান গজিয়ে উঠছে। পাল্লা চলছে খুব। আসছে শনিবারে আসুন না স্যার। তিনজন ঢাকি ঢাক বাজাবে। একটা ছিল ওরা দুটো করায় আমি তিনজন ঢাকি বায়না করেছি। আপনারা পূজার সময় থাকলে শোভা বাড়ে। বৌদি যদি যান! আপনারা গণ্যমান্য লোক যদি পূজার সময় কাছে থাকেন গুডউইল বাড়ে।

সে নবর হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্যই বলল, যাব এবং সে বাসার দিকে হাঁটা দিলেই নব ছুটতে ছুটতে আবার আসছে।

—স্যার, এখানে বলব কি –না বাসায় গিয়ে বলব?

—কী বলবে!

—চলুন। খুব জুররী কথা।

ভারি ঝামেলা করছে নব। কিন্তু চাকরির কথা দিয়ে রাখতে পারে নি, অতীশের এই একটা অস্বস্তিও আছে। সে সোজা বলতে পারল না, এখন নয়। আমার মেলা কাজ পড়ে আছে। সে বলল, এখানেই বল না!

—স্যার, রাজার সঙ্গে এখানকার এম এল এর খুব ভাব। ওরা মিলে যদি উদ্বোধন করে আমার পূজাটা।

—সে এখন কি করে হবে? পূজা ত তুমি আরম্ভই করে দিয়েছ।

—পঞ্চম হপ্তা-পূর্তি উপলক্ষে এই সিলভার জুবলি-টুবলির মত! এই উপলক্ষে যদি…..

অতীশ বিরক্ত হচ্ছিল। আবার মজাও পাচ্ছিল। কিন্তু তাকে নির্মলার কাজের বিষয়ে একজন স্কুল সেক্রেটারির সঙ্গে আজ দেখা করার কথা। খুবই গণ্যমান্য লোক। রাজেনদা নিজেই চিঠি দিয়েছেন। এখন এসব নিয়ে তার ভাববার একদম সময় নেই। সে বলল, কাল সকালে এস। আলোচনা করা যাবে।

তবু নব যায় না।—স্যার, ওরা মাইক লাগিয়ে শনিমাহাত্ম্য প্রচার করছে। ওরা স্যার এম এল একে দিয়ে উদ্বোধন করিয়েছে, ইস মাইরি স্যার কি যে ভুল হয়ে গেল!

অতীশ ছাড়া পাবার জন্য বলল, তুমি তো সপ্তাহ পূর্তি করছই তখন না হয় ভেবে দেখা যাবে। হঠাৎ নব প্রায় পায়ে পড়ে গেল। স্যার আমার প্রেস্টিজ নিয়ে টানাটানি। আপনি আমাকে বাঁচান। অতীশ বলল, আমার ত কোন পরিচিত এম এল এ নেই। পাবলিক ফাংসন করে এমন লোককে ধর।

নব কিছুটা হতাশ গলায় বলল, হামুবাবুকে বলেছি। তিনি পারেন। কিন্তু টাকা চায়। অত টাকা দেব কোত্থেকে।

অতীশ দেখল নবকে ভারি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখাচ্ছে। আসলে কাকে ধরলে কিভাবে হবে সেটা নব ঠিক জানে না। অন্ধকারে হাতড়াচ্ছে। কাছে তাকে পেয়ে ভেবেছে এই সেই লোক —একে ধরলে হয়ে যেতে পারে। কিন্তু অতীশ তাকে কোন ভরসা দিতে পারছে না। এবং পরদিন সকালে শুনল অতীশ, নব কাকে ধরে একজন হবু কবি ঠিক করেছে। তিনিই বক্তৃতা করবেন। তারপর সে আরও এক সকালে শুনল নবকে ধরে পাড়ার ছেলেরা খুব ঠ্যাঙ্গিয়েছে। তার জায়গা কেড়ে নিয়েছে। এত পয়সা হচ্ছিল নবর, সেটা তাদের সহ্য হয় নি। অবশ্য পরে নব তাকে বলেছে আসলে প্রতিপক্ষ দলের কারসাজি। পাড়ার ছেলেরা মিলে দুটো জায়গাই দখল করে নিয়েছে। বেকার যুবক শুধু তুমি না আমরাও। বে-পাড়া থেকে এসে লুটেপুটে খাবে সে হচ্ছে না। নব শেষে বাধ্য হয়ে তার পুরানো প্রফেসানেই আবার ফিরে এল। সে কিছুদিন ধরে মনোযোগ দিয়ে আবার অঙ্ক কষে যাচ্ছে। অঙ্ক কষলে মাথা পরিষ্কার হয়, এমন একটা সুন্দর প্রফেসান হাত ছাড়া হয়ে গেছে শুধু নির্বুদ্ধিতার জন্য। মাথা সাফ না থাকলে কিছু হবে না। সে মাথা সাফ করার জন্য আবার বসে যেতেই কুম্ভবাবু খবর দিল, বুঝলেন দাদা নবর হয়ে গেল!

কত মানুষেরই এভাবে হয়ে যাচ্ছে। অতীশ বলল, কার কবে হবে ঠিক কি! নব কি…

—না না খুন-টুন হয়নি। গাড়ির তলায়ও পড়েনি।

অতীশ ফোনে কথা বলছিল। ঠিক মন দিয়ে শুনতে পারছে না। কুম্ভবাবু ইতিমধ্যে আরও কিছু ঝামেলা তৈরী করেছে। কাস্টমারদের দিয়ে কিছু মিথ্যা অভিযোগ তৈরী করিয়েছে। মাল পাঠালে রঙ ঠিক হয় নি, কামড়ি খুলে যাচ্ছে, ঢাকনা আলগা এমন সব রিপোর্ট দিয়ে মাল ফেরত পাঠাবার বেশ একটি পাকা বন্দোবস্ত তলে তলে করে এসেছে। অতীশকে এ-জন্য সব সময় সতর্ক থাকতে হচ্ছে। সুপারভাইজারকে বলেছে, সব ডাইস মেরামত করান। কোটার টিন থেকে খরচ করুন। বাজারের টিন থেকে কাজ করবেন না। এক গেজের মাল দিন। আর এ সময়ই কুম্ভবাবু বলল, নবর হয়ে গেল।

ফোন ছেড়ে দিয়ে বলল, নবর কি হয়ে গেল!

—নব দেশ ভ্রমণে বের হয়ে গেল।

—সে খুবই ভাল কথা।

—টেপিটাকে বলেছে আমার বৌর কাছেই রেখে যাবে। খেতে দিলেই হবে। বউদির কাছে সুখীকে রাখুন না। সুখীর রান্নার হাত ভাল। সুরেন ত পাগলা কুকুর হয়ে গেছে। কাকে এখন কামড়ায় দেখুন। হামু কাকা বলেছে, বাতাসীর খোরাক পোশাক দেবে। অতীশ বলতে পারত, বাগড়া না দিলে নবটার দেশ ভ্রমণ হাতে লেখা থাকত না। সুরেনটাও হাঁফ ছেড়ে একটু বাঁচত। তারপরই মনে হল মানুষের মধ্যে কি যে থাকে! কুম্ভবাবু সত্যি সুরেনের ভাল করার জন্য বেশ চিন্তিত। তাঁর কথাবার্তা খুবই আন্তরিক, যেন দায়টা সুরেনের নয় তার নিজের। কুম্ভবাবুকে আজ বড় ভালমানুষ মনে হল তার। শেষে বলল, আপনার বউদিকে বলে দেখি।

—বউদির চাকরি হলে ত লোক লাগবেই। রাজার চিঠি নিয়ে গেছেন যখন…

অতীশ বলতে পারত, হবে না। সবারই নিজেদের লোকজন আছে। ওদের না হয়ে নির্মলার হবে সে আশা করে না। সংসারে বেশ টানাটানি। মাসের শেষটা আর কাটতে চায় না। লেখা থেকে টাকা পেলে চলে যায়, না হলে নির্মলার সংসার টানতে কষ্ট হয়। প্রাচুর্য থেকে এলে মানুষ সেই কষ্টটা আরও বেশি টের পায়। মাঝে মাঝে নির্মলার মুখ দেখলে সে সেটা ধরতে পারে। নিৰ্মলা শান্ত স্বভাবের মেয়ে, তবু গত মাসে বলেছিল, টুটুলের জুতো নেই। বাবাকে ক’টা কম টাকা পাঠাও। অতীশের মনে হয়েছিল, নির্মলা বাড়ির দিকটা বুঝতে চাইছে না। টাকা কম দিলে বাবা কষ্ট পাবেন। বাবা কষ্ট পেলে কোথায় যেন সে জোর হারিয়ে ফেলে। শুধু বলেছিল, লেখা থেকে কিছু টাকা আসবে। ও দিয়ে করে নিও।

নির্মলা বলেছিল, কোন সঞ্চয় নেই। অসুখ-বিসুখ হলে কি করবে। কত রকমের দায় অদায় থাকে। তখনই কুম্ভ বলল, আপনি আমার মেয়ের নামটা আর দিলেন না। আপনারা আলাদা জাতের মানুষ, হাসির খুব ইচ্ছে আপনি নাম রাখেন।

অতীশের মুখে কুট হাসি ফুটে উঠল। এই মানুষটাই তাকে সর্বক্ষণ বিড়ম্বনার মধ্যে দেখতে চাইছে। এই মানুষটাই তার সবচেয়ে উপকারী লোক। কারণ এই মানুষটাই তার নামে ব্যাঙ্কে একটা একাউণ্ট খুলে দিয়ে বলেছে, লেখা থেকে আপনার যা চেক আসে, ব্যাংকে জমা রাখুন। টাকার জন্য তাহলে মায়া বাড়বে। মায়া বাড়লে সংসারে মন বসবে। আপনি বড় অসংসারী লোক মশাই। তখন মনেই হয় না, কনটেনারের দাম বাড়িয়েছে বলে, সে পার্টিদের ঘরে ঘরে গিয়ে পরামর্শ দিয়ে এসেছে, রিজেক্‌ট বলে ফেরত পাঠিয়ে দাও। ধৰ্ম্মপুত্তুর কোথায় যায় দেখি। আগরয়াল কিছু মাল ফেরতও পাঠিয়েছে। সে বড় বিপদের মধ্যে আছে। ভয়ে ভয়ে আছে। আবার কে কখন ফোন করে বলবে, এই ছাপা? চলবে না। ঢাকনা লুজ চলবে না। খুঁত বের করলেই হল!

এমনিতেই কনটেনারের দাম বাড়াবার জন্য অর্ডারপত্র কম আসছে। এতেও কুম্ভবাবুর হাত আছে কিনা কে জানে। ওভারটাইম কমে গেছে। ভিতরে ভিতরে শ্রমিক অসন্তোষ বাড়ছে। অতীশ অফিস ঘরে বসেই সেটা টের পায়। আসলে সারাদিনে যা কাজ দেয়, তিনঘণ্টা ওভারটাইম দিলে তারা প্রায় সেই কাজটা তুলে দেয়। উৎপাদন বাড়াতে না পারলে সে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবে না। মাইনে বাড়াবার দাবি করেছিল, সে বলেছে, সব হবে, আগে ঠিক হোক, কতটা তোমরা মাল বানাতে পার। ওরা বলেছে, যা হয় তাই। তার বেশি হবে না। কুম্ভ দুদিকেই তাল দিচ্ছে। সে যে কোনওভাবে গণ্ডগোল পাকাতে চায়। অতীশ বুঝতে পারে তার চারপাশে তখন আর্চি ঘোরাফেরা করে। সে সুদূরে দেখতে পায়, বনি হাঁটু মুড়ে বসে বাইবেল পড়ছে। প্রার্থনা করছে বনি, ঈশ্বরের কাছে নতজানু হয়ে বসে আছে। ছোটবাবুর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছে দু’হাত তুলে।

চারপাশে শান্ত সমুদ্র। বাতাস পড়ে গেছে। এক ফোঁটা মেঘ নেই আকাশে। আগুনের মতো সমুদ্রের জলে তাত। বনি ছোটবাবুকে বলছে, এস পাশে বোসো। আমাদের এখন আর ঈশ্বর ছাড়া কেউ নেই। শুধু প্রাণ বলতে জলের নিচে কিছু পারপয়েজ মাছের ঝাঁক। এলবা দুদিন হল নিখোঁজ। সে আর রাতে ফিরে আসছে না। একটু থেমে কি ভেবে বনি আবার বলল, ছোটবাবু, কবরে আমার ছোট্ট একটু জায়গা দরকার।

ছোটবাবু বুঝতে পারছিল না, বলল, বনি এ-সব আজেবাজে বকছ কেন। তখনই ছোটবাবু শুনতে পেল, হাই। সেই কণ্ঠস্বর ঠিক অবিকল সে মনে করতে পারছে। স্যালি হিগিনস, শেষ বারের মতো সব বলে যাচ্ছেন, আর্চিকে তুমি খুন করেছ, সে তোমাকে ক্ষমা করবে না। সুতরাং সমুদ্রের অতীব মায়ায় পড়ে গেলে মরীচিকা দেখতে পাবে। তেষ্টায় যখন বুক ফেটে যাবে সমুদ্রে স্নান করে নিতে পার। ঘামে যে নুন বের হয়ে যাবে, শরীর ঠাণ্ডা হলে তা লাঘব হবে। সামান্য লোনা জলও খেতে পার। ঘাম কম হবে তবু পিপাসা না গেলে বুঝতে পারবে চোখ মুখ বসে যাচ্ছে—গলা শক্ত হয়ে যাচ্ছে কাঠের মতো। তখন যদি পার কোন মাছ শিকার করে ইউ ক্যান সাক হার ব্লাড। মনে রাখবে যা হয়ে থাকে, মানুষ দিশেহারা হয়ে যায়। পাগল হয়ে যায়। পাশের লোকটির ওপর ঝাঁপিয়ে তার টুটি কামড়ে ধরে। তুমি বনিকে অনায়াসে ধরতে পার। ইউ ক্যান সাক হার ব্লাড। তাহলে তুমি আর মরীচিকা দেখতে পাবে না। প্রাণ ফিরে পাবে।

ছোটবাবু বুঝল সমুদ্রের হাহাকার দেখে বনি পাগল হয়ে যাচ্ছে। সে চিৎকার করে উঠল, বনি প্লিজ মাথা খারাপ কর না। আমরা শিগগির গাছপালা মাটি দেখতে পাব।

বনি হাসল। দু চোখ বেয়ে জল ঝরছে। ছোটবাবু দুটো হাত নিজের হাতে তুলে বাইবেল থেকে কিছু পাঠ করে শোনাল। ছোটবাবু বুঝতে পেরেছিল, ঈশ্বর এবং সমুদ্র সাক্ষী রেখে বনি তার সব অস্তিত্ব ওকে অর্পণ করেছে। তারও মনে হল প্রজ্বলিত কোনও অগ্নি সাক্ষী রেখে সে সেই দায়িত্ব যেন গ্রহণ করছে।

আবার সেই পীড়ন, অতীশ বুঝতে পারছে, ছোটবাবু তাকে পীড়ন করছে। শরীরে আবার এসে পোকার মতো উড়ে বসেছে। মগজের ঘিলু থেকে অস্থি মজ্জায় সবর্ত্র প্রচণ্ড কামড়। মাথাটা তার কেমন করছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *