1 of 2

ঈশ্বরের বাগান – ১২

।। বার।।

অন্যদিনের চেয়ে চন্দ্রনাথের আজ আরও সকালে ঘুম ভেঙে গেল। দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়ালেন। খালি পা। খেটো ধুতি পরে আছেন। পায়ে খড়ম। বাইরে বের হয়ে উঠোনে এসে দাঁড়ালেন। পূব আকাশটা এখনও ফর্সা হয়নি। নিঃশব্দ ব্রাহ্মমুহূর্ত। এই মুহূর্তটি তাঁর অতি প্রিয়। কোথা থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিরা মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যে যায়! রাত শেষ হয়ে আসছে, কিছু নক্ষত্রের শেষ ঝিকিমিকি। কীট-পতঙ্গের ডাক তেমন শোনা যাচ্ছে না! আবছা অস্পষ্ট আলো পৃথিবীতে জেগে উঠছে। তিনি সোজা দাঁড়িয়ে থাকলেন। গলায় উপবীত। আবছা অস্পষ্ট আলোয় ঈশ্বরের মহিমা অনুভব করলেন। জায়া জননীর মতো এই নিবাস। সব কিছুর মধ্যে চন্দ্রনাথ অনুভব করলেন অশেষ করুণা তাঁর। তিনি প্রতিদিনের মতো নতজানু হলেন, তারপর উঠোন থেকে নখাগ্রে মাটি তুলে কপালে তারপর জিবে এবং বাকিটুকু মাথায় ঘষে দিলেন।

চারপাশের গাছপালা আকাশ সমান উঁচু হয়ে উঠতে চাইছে। বাতাস বইছিল। সামান্য হাওয়ায় গাছগুলির শাখা-প্রশাখা আন্দোলিত হচ্ছে। এই সব গাছপালা সবই তাঁর রোপন করা। ঘন জঙ্গল কেটে তিনি এখানে তাঁর ঘর-বাড়ি তৈরি করেছিলেন। যখন যেখানে খবর পেয়েছেন সুস্বাদু আম জামের গাছ আছে, সেখানে ছুটে গেছেন। একবার তিনি বালির ঘাট থেকে একটি আমের কলম নিয়ে এসেছিলেন। হাতে পয়সা ছিল না। দশ ক্রোশ রাস্তা হেঁটে সেই কলম কাঁধে করে নিয়ে এসেছিলেন। সব ফলমূলের গাছগুলিই এখন সজীব। তারা এই বাড়িঘরে সন্তান সন্ততির মতোই বেঁচে আছে। কেউ ডাল পাতা ছিঁড়লেও তাঁর কষ্ট হয়। শেকড় ক্রমেই গভীরে প্রবেশ করছে।

এই ব্রাহ্মমুহূর্তে তিনি কেন জানি সব গাছপালার নিচে দিয়ে হেঁটে যেতে থাকলেন। গাছগুলো ছুঁয়ে দেখলেন। পরপর আমগাছ, তারপর দু’টো কাঁঠাল গাছ। নারকেল গাছের সারি পশ্চিমের দিকে। বাঁদিকে দুটো সফেদা ফলের গাছ, লিচু গাছ। কাঠাখানেক জুড়ে লেবু গাছের ঝোপ। এদিকটায় তিনি গন্ধপাঁদালের লতা লাগিয়ে রেখেছেন। কাঠাখানেক জুড়ে আছে বাঁশের ঝাঁড়। তাঁর এই গাছপালার মধ্যে তিনি এক আশ্চর্য সবুজ ঘ্রাণ অনুভব করেন। এত প্রিয় এই সব কিছু তার অথচ আজ তাঁর কিছুই ভাল লাগছে না। চন্দ্রনাথ ধীরে ধীরে এসে এবার করবী গাছটার নিচে দাঁড়ালেন। দূরবর্তী বড় সড়কে গরুর গাড়ির আওয়াজ উঠছে। সদরে যাবে বলে শাক-শবজী বোঝাই করে চাষী মানুষেরা বের হয়ে পড়েছে। আর মাথার ওপরে পাখিদের ডানার শব্দ। এরা বোধহয় সবার আগে টের পায়, রাত শেষ হতে বেশি দেরি নেই। যে যার জায়গা মতো চলে যাবার জন্য আকাশের প্রান্ত দিয়ে উড়ে যায়।

চন্দ্রনাথ সকলের অলক্ষ্যে প্রতিদিন এই ঘোরাঘুরিটা করেন। মানুষ জানেই না এই সময়টাতে ঈশ্বরের কাছাকাছি আসার প্রকৃষ্ট সময়। এই সময়টায় পৃথিবীর রূপ বদল ঘটে। চন্দ্রনাথ এসব ভাবতে ভাবতে খালের পাড়ে এসে দাঁড়ালেন। ওপারে তাঁর বিঘে কয় ভুঁই—ধানী জমি, সবুজ আভা নিয়ে চারা বড় হচ্ছে। হাত দিলেই টের পাওয়া যায় পাতায় পাতায় শিশির ভেজা আশ্চর্য এক সমারোহ। প্রতিটি মুহূর্তে অনুভব করেন চন্দ্রনাথ, বড় মূল্যবান সময় চলে যাচ্ছে। ঘোরাঘুরি করে এসব না দেখলে বোঝাই যায় না, কত মূল্যবান এই চাষ আবাদ। সব সময় উত্তেজনা। সেই কাদান থেকে আরম্ভ করে বীজ বপন, তার বীজতলা থেকে চারা গাছ তুলে রুয়ে দেওয়া, তাদের জমিতে লেগে যাওয়া, বড় হওয়া, কি এক বড় প্রতীক্ষা যেন। এই প্রতীক্ষার মতো অমূল্য ইচ্ছে মানুষের আর কি থাকতে পারে চন্দ্রনাথ বুঝতে পারেন না। এর মতো প্রবল আকর্ষণ মানুষের আর কি থাকতে পারে। অতীশ এসব উপেক্ষা করে চলে গেল! আজ বউমা দাদু দিদিভাইও চলে যাবে। তাই কদিন থেকেই চন্দ্রনাথের নাড়িতে বড় টান ধরেছে। সকলের অজ্ঞাতে দিশেহারার মতো নিজের আবাসে ঘোরাঘুরি করছেন।

কিছু কাক তখন কা-কা করে উঠল। তিনি দাঁড়িয়ে কাকের শব্দ শুনলেন। কাকেরা নানাভাবে ডাকে। এদের ডাকে শুভ অশুভ ধরা যায়। এদের ডাকে কখনও প্রবল দীর্ঘশ্বাস থাকে। বড়ই আর্ত সে ডাক। গেরস্থের তাতে অমঙ্গল বাড়ে। কাকের ডাকে মানুষ টের পায় আর শুয়ে থাকার সময় নেই। তিনি তার আগেই উঠে পড়েছেন। কিছু ঘাস মাড়িয়ে তিনি খালি পায়ে এখন হেঁটে যাবেন। শিশির ভেজা ঘাসে হেঁটে বেড়ালে আয়ু বাড়ে তাঁর এমন একটা বিশ্বাস আছে। রোগভোগ কম হয়। ধানের আলে তিনি নেমে গেলেন। গাছের গোড়ায় পরিমিত জল আছে। কিছু আগাছা জন্মাচ্ছে। এগুলি সাফ করা দরকার। যত গাছ বাড়ে তত কালো হয়ে ওঠে ধানগাছের গুচ্ছ। তত তিনি ছেলেমানুষের মতো পুলক বোধ করেন। মনে হয় ঈশ্বরের মতো নিজেও সৃষ্টি করে যাচ্ছেন একটা নতুন পৃথিবী। এই পৃথিবীর বাসিন্দা রামি ভামি। গোলা পায়রার দল, দুটো কুকুর, একপাল হাঁস, তিনটে গাভী এবং ধনবৌ সন্তান-সন্তুতি আর নিরিবিলি নানাবিধ ফলের গাছ। দূর থেকে নিজের আবাসের প্রতি তখন তাঁর ভারি মমতা বাড়ে। লোকজনে ভরে আছে—সেই বাড়িটা আজ অনেকাংশে খালি হয়ে যাবে। এই দুঃখে তিনি ভারি পীড়িত হচ্ছিলেন।

পূব আকাশ ফর্সা হয়ে উঠছে। আকাশের নিচে গাছপালা এবং পাখিদের এবার স্পষ্ট চেনা যাচ্ছে। কেমন যেন গভীর স্বপ্ন থেকে এটা তাঁর ধীরে ধীরে জেগে ওঠা। একটায় ট্রেন। প্রহ্লাদ সঙ্গে যাবে। লটবহর কাল রাতেই বাঁধাছাঁদা হয়ে গেছে। কালই বউমাদের যাত্রা করিয়ে রেখেছেন। অলকার সঙ্গে উত্তরের ঘরে আক্ত বউমা শুয়েছে। বড় ঘরে আজ তারা আসতে পারবে না। মিণ্টু অত সব বোঝে না। বড়ই অবুঝ। তার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। কারণ চন্দ্রনাথের বিশ্বাস বড় ঘরে এলে শুভ যাত্রার বিঘ্ন ঘটবে।

একবার ভেবেছিলেন নিজেই সঙ্গে যাবেন। কেমন জায়গায় অতীশ তার আবাস ঠিক করেছে, নিজে দেখে এলে শান্তি পেতেন। কিন্তু সন্তোষের মাতৃ বিয়োগ হওয়ায় যাওয়া হচ্ছে না। কাল ষোড়শ শ্রাদ্ধ। যজমানের শান্তি অশান্তি বলে কথা। তিনি অন্য পুরোহিতের কথা বলেছিলেন, কিন্তু সন্তোষ মুখ ব্যাজার করে ফেলেছিল। আর ওর মার পূজাপার্বণে বড় খুঁতখুঁতে স্বভাব ছিল। যত দেরিই হোক, যত উপবাসে কষ্টই পাক, তিনি ফুল বেলপাতা না দিলে বৃদ্ধা তৃপ্তি পেত না। কিছু আহারও করত না। লাঠি ঠুকে ঠুকে সকালবেলায় চলে আসত ওর মা। ঠাকুর প্রণাম, চন্দ্রনাথের পায়ের ধুলো নিয়ে ঠুকঠুক করে আবার চলে যেত। গাছের যা কিছু কর্তাকে না দিয়ে নিজে খেয়ে তৃপ্তি পেত না। এ একটা ঠেক রয়ে গেছে বলেই চন্দ্রনাথ নিজে যেতে পারছেন না। মনে মনে অস্বস্তি বোধ করছেন।

আর সকাল হলেই চন্দ্রনাথের হাঁক-ডাক, ও বউমা ওঠো। প্রণাম সেরে ফুল বেলপাতা তুলে দাও। পূজার ঘরে একটু সকাল সকাল ঢুকতে হবে বউমা। হাসু ওঠ। রাধানাথকে বলবি যেন তিনটে রিকশা আনে। প্রহ্লাদ তুই বাবা ঘাসপাতা কেটে রেখে যা। বাড়ি থাকবি না, গরুগুলি খাবে কি। এই বলে তিনি টং থেকে কবুতরগুলো ছেড়ে দিলেন। পায়ে পায়ে সেই শ্রাবণীর কুকুর দুটো ঘুরছে। শ্রাবণীর মেলা থেকে আসার পথে কেন জানি কুকুর দুটো তাঁর পিছু নিয়েছিল। যতই তিনি দূরছার করেন, নড়ে না। হাঁটতে থাকলে, কুকুর দুটো পেছনে হেঁটে আসে। বাড়িতে ফিরে দেখেন, ওরা তেমনি আসছে। সেই থেকে ওরাও এবাড়ির বাসিন্দা হয়ে গেল। আগের কুকুরটা নিরুদ্দেশ হয়ে যাবার পর যে জায়গাটা সংসারে খালি পড়েছিল, এরা আসায় তা আবার ভরভর্তি হয়ে গেছে। তিনি সেই কুকুরটাকে আর খুঁজেই পেলেন না। প্রথম মনে হয়েছিল বেইমান, পরে মনে হয়েছে, দূরের রাস্তায় গাড়ি চাপা পড়ে মরে থাকলে কে টের পাবে। কেউ লোভ দেখিয়ে নিয়েও যেতে পারে। বড় সাবলীল ছিল কুকুরটা। এই শ্রাবণীরা আসায় তাঁর সেই দুঃখটা এখন অনেক কমে গেছে। রামিটা দুদিনের জন্য কোথায় চলে গিয়েছিল, আবার ফিরে এসেছে। যে যায় সে ফিরে আসে না, এই ভয়টা বড়ই তাঁর বেশি। বড় ছেলে সতীশ কী রকমের হয়ে গেল! অতীশও চলে গেল। বউমা চলে যাচ্ছে। নাড়ির টান ছিঁড়ে গেলে কে আর সুস্থির থাকতে পারে। তিনি আজ সকাল থেকে আরও বেশি বিমর্ষ হয়ে উঠেছেন। হাসুর সহজে ঘুম ভাঙে না। সে শুয়ে উঁ আঁ করছে। উঠছে না। চন্দ্রনাথ বললেন, ও ধনবৌ তোমার সন্তানেরা তো কেবল ঘুমাতে শিখেছে। আর কিছু শিখল না। কখন থেকে ডাকছি, কিছুতেই উঠছে না।

ধনবৌ অন্যদিন হলে বিরূপ আচরণ করত। কিন্তু আজ ভারি চুপচাপ। সংসারে ত কাজের শেষ নেই! এখন ছেলেদের নিয়ে পড়লে অশান্তি বাড়বে। টুটুল ঘুম থেকে উঠেই ঠামা ঠামা করছিল। গোটা তিনেক কথা টুটুল বলতে পারে। মা বাবা ঠামা। দাদু বলতে পারে না। এজন্য ধনবৌ মনে মনে খুশি। দেখ সংসারে কার টান কত বেশি। শুধু ঈশ্বর ঈশ্বর করে সারাটা জীবন কাটালে। দুটো পয়সা সঞ্চয় করলে না। ছেলের হাত তোলার ওপর বাঁচতে হবে ভেবেই ঘাবড়ে গেছ। বুঝি না কিছু মনে কর! বড়টা তো কবেই সম্পর্ক ছিঁড়েছে। শুধু চিঠিপত্র আর অসুখ-বিসুখের খবর দেয়। অভাবের খবর দেয়। এখন দ্যাখো এরা গিয়ে কি করে। সকালবেলায় ধনবৌ বিরূপ হয়ে উঠলে এসবই বলতেন। কিন্তু আজ এরা চলে যাবে। সকালবেলায় ঝগড়া করতে মনটা সায় দিচ্ছিল না।—বাসি কাপড় চোপড় ছেড়ে ঠাকুরঘরে ঢুকে গেল। ঠাকুরের বাসনপত্র, তামার টাট কোষাকুষি সব বের করে সোজা ঘাটে। অলকাকে ডেকে তুলে দিয়ে গেল। বলল, টুটুলকে নিয়ে একটু গাছতলায় বেড়া। আমার কাছে এখন আর আনিস না।

চন্দ্রনাথ আজ নিজেই গুণে গুণে একশ একটা তুলসীপাতা তুললেন। পাতাগুলিতে আবার কোনও খুঁত না থাকে। তুলসীপাতা কলাপাতায় ভাঁজ করে ঠাকুরঘরে রেখে এলেন। শালগ্রামের মাথায় এই একশ একটা তুলসীপাতা তিনি উৎসর্গ করবেন। রাস্তাঘাটে কত রকমের চোর-জোচ্চোর অগ্নিকান্ড, দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। কলকাতায় পৌঁছাতে যাতে কোনও অসুবিধা না হয়, এজন্য তিনি তার হাতের পাঁচ কাছে রেখে দিচ্ছেন। তা না হলে নিশ্চিন্তে রাতে ঘুমাতে পারবেন না। আত্মীয় অনাত্মীয় প্রতিবেশীর বেলায় যেমন তিনি ঠাকুরের সামনে বসে খুব নিমগ্ন হলে চোখের ওপর ছবি ভেসে উঠতে দেখেন—নিজের সন্তান-সন্তুতির বেলায় সেটা সহজে দেখতে পান না। ফলে বয়স যত বাড়ছে তত আরও বেশি ধর্মভীরু, বেশি উচাটন, বেশি যেন কঠিন হয়ে পড়ছে ঘরবাড়ি ঠিকঠাক রেখে যাওয়া। শত্রুপক্ষ চারিদিকে। কে কখন কি তুলে নেবে—ঈশ্বর নিজেও কম যায় না। তার কোপকেই সব চেয়ে বেশি ভয়। ফলে সকালবেলায় তিনি ঠেঙিয়ে গেছেন বুড়ি-বিবির হাতায়। হাতার দীঘি থেকে দুটো পদ্ম তুলে এনেছেন, লক্ষ্মী জনার্দনের পায়ে দেবেন বলে। গাছ থেকে নিজেই আজ গোটা গোটা সব পদ্ম ভুলে আর কি করণীয় কাজ বাইরের পড়ে থাকল —ফুল বউমাই তুলবে—বাড়তি আর কি কাজ আছে, বিগ্রহ আর কি পেলে আরও বেশি তুষ্ট হবেন—এইসব চিন্তার জাল থেকে মুক্তি পেলে মনে হল সামান্য তামাকু সেবনও চায় ঠাকুর। প্রহ্লাদকে তামাক সাজতে বলে নিজে একটা কুশাসনে পদ্মাসন করে বসলেন। সকালবেলায় বিগ্রহের পূজা না হওয়া পর্যন্ত জল গ্রহণ করেন না। মাঝে মাঝে তামাকু সেবন। তিনি চোখ মেলে দেখলেন টুটুল হামাগুড়ি দিয়ে উঠে আসছে। পৈঠায় ভর দিয়ে উঠে আসছে। তারপর পিঠে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে টিকি টানছে।

—ও বউমা দেখ, আবার আমার টিকি টানছে। আমি কিন্তু চিমটি কাটব। আ আমার লাগছে!

টুটুল অ আ তু তু করছে। বিচিত্র রহস্য টের পায় বুঝি টুটুল এর মধ্যে। চন্দ্রনাথ ভারি আরাম বোধ করছিলেন। গায়ে গা লেপ্টে আছে। টুটুলের শরীরে আশ্চর্য উষ্ণতা আছে। চন্দ্রনাথ চোখ বুজে টের পাচ্ছিলেন—বংশের পিন্ডদানের প্রথম অধিকারী এখন তার গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এতে তিনি কেমন এক পরম আনন্দ পান। মানুষের আর কি লাগে। বড়টার কেবল মেয়েই হচ্ছিল। তিনি মেয়েদের ব্যাপারটাকে কিছুটা অচ্ছুতের মতো মনে করেন। এদের পিন্ডদানে আত্মা পরিতৃপ্ত হয় না। যেন কোন দূর গ্রহলোকে বসে আছেন চন্দ্রনাথ। তাঁর এত কষ্টের ঘরবাড়ি দেখতে পাচ্ছেন। পূর্বপুরুষদের জল দেবার অধিকারী এই শিশু। এবং মনে হয় দূরের গ্রহলোক থেকে তাঁর পিতামহ প্রপিতামহ সবাই দেখছেন, চন্দ্রনাথের পাশে তাঁর নাতি অভীক দীপঙ্কর ওরফে টুটুল বসে বসে তাঁর টিকি টানছে।

চন্দ্রনাথ বললেন, দাদু পারবি ত ঘাড় দিতে।

টুটুল আরো সজোরে টিকি ধরে টান দিল। খুব বড় নয়, লম্বা নয় বেঁটে খাটো টিকি। টুটুল ওটাকে কব্জা করতে পারছে না। ব্রহ্মতালু থেকে টুটুল বোধহয় চায় ওটা তুলে নিতে। বার বার চেষ্টার পরও যখন পারল না, তখনই টুটুল ভ্যাক করে কেঁদে দিল।

চন্দ্রনাথ নাতিকে কি আর করেন। কাঁধে তুলে নিয়ে বের হয়ে গেলেন। কোথাও যাবেন মনে হয়। আসলে তিনি এই বাড়ি-ঘরের জন্য যে মায়া বোধ করেন তাঁর এই উত্তরাধিকার তেমন মায়া বোধ করুক মনে মনে বোধ হয় এমন চাইছিলেন। গাছ-পালায় ভর্তি বাড়ি-ঘর। পাখ-পাখালি কত—প্রজাপ্রতি ফড়িং কীট-পতঙ্গ সব মিলে এক প্রবহমান জীবন ধারা। এই জীবনধারায় তাঁর এক বছরের নাতি অভীক দীপঙ্করকে নিয়ে পরিভ্রমণে বৃত হলেন। তিনি হেঁটে যাচ্ছেন, পায়ে পায়ে শ্রাবণীরা আসছে। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। গাছপালার ভিতর দিয়ে তিনি যাচ্ছিলেন, আর অজস্র কথা বলছিলেন। কথাগুলো বড়ই অকিঞ্চিতকর। তবু কেমন গভীর এবং তীক্ষ্ণ।

চন্দ্রনাথ বললেন, কত বড় আকাশ দেখ।

আবার বললেন, সামনে কি বিস্তৃত মাঠ!

বললেন, এখানেই আমরা ঘোরাঘুরি করব। কেউ বেশি দূরে যাব না। বেশি দূর যেতে পারি না। পরমায়ু শেষ হলে আমি তোমাদের সবাইকে দেখতে পাব। সুখে থাকলে আত্মা শান্তি পাবে।

ধীরেনের মা সামনে পড়ে গেছে।—মা কর্তার ঘাড়ে এ কে গ। কি কথা বলছেন গ ঠাকুর।

চন্দ্রনাথ বড়ই লজ্জায় পড়ে গেলেন।—আর বলিস না। ঘাড়ে চড়ে ঘুরবে বলছে। খুব কান্নাকাটি করছিল।

—বউমারা নাকি চলে যাবে আজ?

—হ্যাঁ।

—এই ত সংসার গ কর্তাঠাকুর। কে কোনদিকে যায় ঠিক থাকে না। মরণ আপনার। জ্বালায় জ্বলবেন।

অলকা তখন মিণ্টুকে খাওয়াচ্ছিল। দুধ মুড়ি কলা। মিণ্টু খাচ্ছে আর বলছে আমরা বাবার কাছে আজ চলে যাব না পিচি!

নির্মলার সামান্য গোছগাছ বাকি। সেটা সকাল সকাল সেরে নিচ্ছিল। আজ আড়াই মাস মানুটা নেই। এদিকে একবার আসেও নি। কত সহজে ভুলে থাকতে পারে। অভিমান, বড় অভিমান, কেন যে ভিতরে এই চাপা অভিমান—কোনও প্রকাশ নেই। কাছে গেলেও প্রকাশ করতে পারবে না। এত দিন থাকি কি করে! তুমিই বা থাক কি করে! এবং অভ্যন্তরে কেমন রোমাঞ্চ। মানুষটাকে কত দীর্ঘকাল যেন না দেখে আছে! দু-আড়াই মাস সময়টা এত দীর্ঘ হয় এই প্রথম সেটা টের পেল নির্মলা। আর যে কি হয়, যেন সময় শেষই হচ্ছে না। তারপর যাত্রা, রিকশা, ট্রেন উন্মুখ আকাঙ্খা—এই নিয়ে সে কতকাল যেন প্রতীক্ষায় বসে থাকবে। মনের মধ্যে এক অব্যক্ত সুখানুভূতি যা পরম এবং চরম, কদিন থেকে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। যেন স্টেশনে নামলে নির্মলা চোখ তুলে মানুষটার দিকে তাকাতেই পারবে না। সে কত দীর্ঘ চিঠি দিয়েছে। চিঠিতে মাঝে মাঝে সে নির্লজ্জ বেহায়ার মত তার রাতে ঘুম হয় না জানিয়েছে। আরও কত ইচ্ছের কথা ছিল—ভাবতেই কেমন লজ্জা বোধে নির্মলা পীড়িত হতে থাকল। চিঠিতে অত উতলা না হলেই যেন তার ভাল ছিল। চার বছরে তাকে মানুষটা যা না চিনেছে, এই আড়াই মাসে চিঠির মারফতে তাকে যেন আরও বেশি চিনে ফেলেছে। এবং সেখানে কিছুটা এমন ইচ্ছের প্রকাশ ছিল, যা ভাবলে চোখে-মুখে রক্তচাপ বেড়ে যায়। ফলে নির্মলা সকাল থেকে একটু বেশি চুপচাপ আজ। কারণ তার মনে হয়, এই পরিবার থেকে ছিন্ন হবার সময় তাকে কিছুটা দুঃখী দেখানো দরকার।

চন্দ্রনাথ আজ সকাল সকাল হাতার পুকুর থেকে স্নান সেরে এলেন। স্নান সারতে তিনি নিত্যকালী স্তোত্র, সূর্য কবচ, গায়ত্রী কবচ পাঠ করেন। আজও সেই মন্ত্রোচ্চারণ—কেমন গম্ভীর নিনাদের মতো শোনায়। বাড়ির মানুষজন প্রাণিকুল সহ এই গাছপালা মাঠ, প্রতিবেশিদের মঙ্গলার্থে তার এই বিশ্বাস এই মন্ত্রপাঠ, মানুষের অকাল মৃত্যু অপমৃত্যু বিনাশ করে। জনপদ শস্যহানি থেকে বেঁচে যায়! দুর্ভিক্ষ মহামারী দেখা যায় না। নিরন্তর বিশ্বাসের মধ্যেই তাঁর এই মন্ত্রোচ্চারণ। ধরণীর শান্তি বজায় রাখার জন্য এটি তাঁর কাছে অমোঘ আয়ুধ। আজ আরও বেশি এ বিষয়ে তিনি কেমন সচেতন হয়ে পড়েছেন। কারো সঙ্গে তিনি এখন একটা কথাও বলছেন না। পূজা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ঠাকুরঘরে এক সমাহিত মানুষের মতো বসে থাকবেন। ঠাকুরঘরে ঢোকার সময় নির্মলা শুনতে পেল বাবা বলে চলেছেন—ব্রহ্মোবাচ—গায়ত্রা কবচং বক্ষ্যে ধর্মকামার্থ সিদ্ধিদ্ম। তারপর তিনি দরজা ভেজিয়ে দিলেন। নির্মলা আগেই স্নান সেরে নিয়েছে। আজ তাকে অন্যদিনের চেয়েও পবিত্র দেখাচ্ছিল। কপালে গোল লাল বড় সিঁদুরের টিপ, সূর্যাস্তের মত সিঁথিতে লাল আভা। লাল পেড়ে শাড়ি পরনে, ভেজা চুল সারা পিঠে ছড়ানো। সে আগেই ফুলফল নৈবেদ্য সব সাজিয়ে রেখে এসেছে। যেখানে যা দরকার দূর্বা আতপচাল, হরিতকী তিল তুলসী সব। পঞ্চ দেবতার উপাচার সহ ঠাকুরের আলাদা আলাদা নৈবেদ্য। এছাড়া সন্তানের শুভ কামনায় তিনি স্থির করেছিলেন সামান্য ভোগ দেওয়া হবে লক্ষ্মীজনার্দনকে। ফলে আরও সকালে মা স্নান সেরে ভোগের আয়োজন সেরে ফেলেছে। এবং এগারোটা বাজতে না বাজতেই চন্দ্রনাথ পূজা-আর্চার কাজ সেরে ঘন্টা কাঁসি বাজালেন। শঙ্খে ফুঁ দিলেন। এই সব তাঁর করার অর্থ, যত দূর এই শব্দ তরঙ্গ যাবে, তত দূর মানুষজনের কোনও আপদ-বিপদ থাকবে না। ধর্মবিশ্বাসী মানুষটা এতক্ষণে যেন কিছুটা বিচলিত ভাব কাটিয়ে উঠেছেন। হাসিমুখে পূজার ঘর থেকে বের হয়েই ডাকলেন, টুটুল কৈ রে।

টুটুলকে ভানু কোলে নিয়ে ঘুরছিল, সে দাদুর ডাকে ঠিক সাড়া পায়। সে বুঝতে পারে, দাদু তাকে এখন খেতে দেবে। ভানুর কোল থেকে জোরজার করে নেমে হেঁটে যাবার চেষ্টা করলে, চন্দ্রনাথ এসে ধরে ফেললেন—এখনও খুব ভাল হাঁটতে পারে না। কিছুটা গিয়েই পড়ে যায়। কিন্তু শিশুও ঈশ্বরের মহিমা বুঝি টের পায়। ঠিক হাত তুলে বলছে, আমা আমা। অর্থাৎ প্রসাদ দাও। আমি খাব। মিণ্টু কোথায় খেলছিল, সেও দৌড়ে এসেছে। প্রতিবেশীদের বালকবালিকারা দৌড়ে এসেছে। তারা হাত পেতে দাঁড়িয়ে আছে। সবার হাতে হাতে চন্দ্রনাথ ঈশ্বরের মহিমা বিতরণ করতে লাগলেন। বললেন, তোরাই ঈশ্বর। চাল কলা নারকেল এবং সামান্য পায়েস সবাইকে বিলিয়ে দিয়ে বললেন, ওদের খেতে দিয়ে দাও ধনবৌ। প্রহলাদ কোথায় রে? খেয়ে নে। সময় হয়ে গেছে।

হাসু ভানু আজ বাড়ি থেকে নড়েনি। সারাটা সকাল ভাইপো ভাইঝিকে নিয়ে পড়েছিল। অলকা সহসা চিৎকার করে বলছে, মা এখন আর কার তুমি নাক টানবে। ধনবৌ রান্নাঘরে—কোন সাড়া দেয়নি। অলকা আবার বলছে, মা তোমার নাতির বোঁচা নাক তুলতে পারলে না। এ সংসারে সবাইর নাক দীর্ঘ। টুটুল মায়ের গড়ন পেয়েছে। নির্মলার নাক কিছুটা চাপা। ধনবৌর কাজই ছিল স্নানের আগে টুটুলের সারা শরীর ভাল করে তেল মালিশ করে রোদে ফেলে রাখা। দু’আঙুলে তেল নিয়ে নাকটাকে টেনে তোলা। নিত্য কাজের মধ্যে এই বড় কাজটা আজ থেকে আর করতে পারবে না। বোঁচা নাক নিয়েই টুটুলটা আজ চলে যাবে। এজন্য ধনবৌ বড়ই কাতর হয়ে পড়েছে। চোখে তার জল এসে গেছিল।

দেশভাগের পর সংসারটা অগাধ জলে পড়ে গিয়েছিল। কিনা দিন গেছে! কত জায়গা ঘুরে শেষ পর্যন্ত এই আবাস, বাড়ি ঘর। সুখে দুঃখে সব সন্তান-সন্তুতি নিয়ে এই বাড়িটা যখন ডালপালা মেলে দিচ্ছিল, তখনই সতীশ লিখল, মেসের খাওয়া সহ্য হচ্ছে না। সে বাসা করেছে। চন্দ্রনাথ চিঠি পেয়ে গুম হয়ে বসে ছিলেন। তারপর সব খালি করে ওরা চলে গেল।

এদেশে আসার পর চন্দ্রনাথ মাঝে মাঝেই অভাবের তাড়নায় উধাও হয়ে যেতেন। তখন চন্দ্রনাথ একদন্ড স্থির হয়ে বসতে পারতেন না। কখনও স্টেশনে কখনও পোড়ো বাড়িতে কখনও রাস্তায় স্ত্রী- পুত্র ফেলে কোথায় না কোথায় চলে গেছেন। তারপর ফিরে এসেছেন আবার। মাথায় বড় পুঁটলি। তারপর এই বাড়িঘর—সেও কত অনটনের মধ্যে। যখন সুখের মুখ দেখার কথা তখন আবার অন্য রকম এক কষ্ট। মানুষের কপালেই বুঝি এমন থাকে। মুখ গুঁজে ধনবৌ রান্নাঘরে কাজ সারতে সারতে এমনই ভেবে যাচ্ছিল আর মাঝে মাঝে কেন যে চোখ জলে ভার হয়ে আসছে।

যেন সেই মা মা ডাকটা ধনবৌ এখনও শুনতে পায়। গভীর রাতে দরজায় দাঁড়িয়ে কেউ ডাকছে, মা মা আমি। আমি ফিরে এসেছি। বাঁশের মাচান থেকে ধড়ফড় করে জেগে উঠেছিল ধনবৌ। পাশের মানুষটাকে ঠেলে তুলে বলেছিল হ্যাগ সোনা ডাকছে। শুনতে পাচ্ছ। চন্দ্রনাথ এটা আগেও দেখেছে, ধনবৌ হঠাৎ হঠাৎ রাতে জেগে উঠে বলত, ঐ শোন সোনা ডাকছে না! কাজেই মানুষটার বিশ্বাসই হয়নি। মনের ভুল। সেদিনও চন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ঘুমোও। মন হাল্কা কর। ঈশ্বরকে ডাক। তিনিই তোমার সন্তান আবার ফিরিয়ে দেবেন। কিন্তু সেদিন ধনবৌ কোন কথাই শোনেনি। বিছানা থেকে নেমে দরজা খুলে দাঁড়াতেই –বারান্দার অন্ধকারে ছায়ামুর্তি—দেখেই বুকে জড়িয়ে ধরেছিল।—ওগো আমি ভুল বলিনি? এস না।

চন্দ্রনাথ, অন্ধকারে ধনবৌ কি সব হাবিজাবি প্রলাপ বকছে ভেবে নিজেও দ্রুত পায়ে নেমে গেলেন। দেখলেন অন্ধকারে কেউ ধনবৌর পায়ে পড়ে আছে। ক্ষমা প্রার্থীর মতো। চন্দ্রনাথ বলেছিল, কে?

—সোনা। তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না। অলকা ওঠ। আলোটা জ্বাল। আলো জ্বাললে চন্দ্রনাথ পুত্রের লম্বা চওড়া সাহেব-সুবো চেহারা দেখে বিশ্বাস করতে পারেননি, এ তাঁর সোনা। কৈশোরে হারিয়ে যাওয়া এ তাঁর মেজ পুত্র। যেন যৌবনের সেই বড়দা এসে হাজির হয়েছেন আবার। যেন সোনা সেই পাগলঠাকুর—যে কৈশোরে হারিয়ে গিয়ে আবার ফিরে এসেছে। একেবারে অবিকল বড়দার মতো চোখ মুখ গায়ের রঙ, তেমনি দীর্ঘকায়, চন্দ্রনাথ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছিলেন বলতে বলতে। ধনবৌ বলেছিল, ঠিক বলছ! বড় ভাসুরঠাকুর যৌবনে এমন দেখতে ছিলেন!

—ঠিক এই রকম। এই রকম উঁচু লম্বা মানুষ। এমনই বড় বড় চোখ। ভারি সুন্দর পোশাক ছিল গায়ে।

অতীশকে নিয়ে সেই থেকে কেমন একটা আশঙ্কা ধনবৌর মনে। কারণে অকারণে অতীশের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখত—যদি সেই সব চিহ্ন অবিকল কখনও ধরা পড়ে যায়। এই ভয়ে সে বেশিক্ষণ অতীশের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতেও পারত না। বুকটা কখনও হিম হয়ে আসত। পরিবারে কে যেন বলে গেছে বংশে বড় অভিশাপ। কেউ না কেউ পাগল হয়ে যাবেই। যদি বংশ দোষে অতীশ পাগল হয়ে যায়—সুপুরুষ—ভারি সুপুরুষ হয়ে গেছে অতীশ। তিন চার বছরে শরীরে ভারি পরিবর্তন এসে গেছে। ঠিক সেই পাগল মানুষটার মতো আচ্ছন্ন থাকতে ভালবাসে। বড় গভীর চোখ। গভীরে কোথাও কিছু বুঝি বাজে। সেটা কি, কখনও ধনবৌ ধরতে পারেনি। চুপচাপ শান্ত নিরীহ —আবার পড়াশোনা, কাজ এবং সংসারে লেপ্টে থেকেও যেন সে ভারি আলাদা মানুষ। অতীশকে ধনবৌ কিছুতেই বুঝতে পারত না। আবার জাহাজে যেতে চেয়েছিল। বাপের ইচ্ছে নয়, ধনবৌ না পেরে কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছিল—তারপরই অতীশ অবাধ্য হতে বুঝি সাহস পায়নি। এখানেই থেকে গেল। গাছপালার মতো শেকড় গজিয়ে দিল। সে ঘরবাড়ি ছেড়ে কখনও খুব বেশিদূর হেঁটে যেত না। কেমন আচ্ছন্ন থাকার স্বভাব। কিন্তু কেন সে এত আচ্ছন্ন থাকে চুপচাপ থাকে, বড় বিষাদ চোখে মুখে—তার কারণ ধনবৌ এতদিনেও টের পায়নি! মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক থাকলে বলেছে, সোনা তুই এত কি ভাবিস?

অতীশ বলত, কৈ কিছুই নাত।

—তুই আমার পেটে হয়েছিস না আমি তোর পেটে হয়েছি! আমি বুঝি না!

অতীশ তখন হেসে ওঠার চেষ্টা করত। মার ভয় দূর করার জন্য বলত, লীলাময় বলেছে, ওর জামাইবাবুকে বলে কোনও স্কুলে ঢুকিয়ে দেবে।

—হ্যাঁ বাবা, এখানেই দেখ কিছু একটা হয় কিনা। তুই ছিলি না—তোর বাবা কেমন জলে পড়ে গেছিল। কাছে থাক, খাই না খাই শান্তি।

তারপর ধনবৌর মনে হয়েছিল বিয়ে থা দিলে হয়ত চোখ মুখের আচ্ছন্ন ভাবটা কেটে যাবে। আর গাছের নিচে চুপচাপ বসে থেকে বিকেলটা কাটিয়ে দেবে না। কিংবা একা একা হেঁটে বেড়াবে না কোথাও। নির্মলা আসার পরও সেই ভাবটা গেল না। মিণ্টু হবার পর ভেবেছিল ঠিক হয়ে যাবে। মিণ্টু টুটুল হবার পর ধনবৌ লক্ষ্য করেছে, অতীশ কিছুটা সুস্থির বোধ করছে। এভাবে যদি সেরে যায়। ইদানীং মনে হয়েছে ধনবৌর অতীশের আচ্ছন্নতা কেটে গেছে। কিন্তু নির্মলা সেদিন চুপি চুপি বলতেই বুকটা আবার কেঁপে গেছে। নির্মলা বলেছে আমি বলেছি বলবেন না। ও বলতে বারণ করেছে। কিন্তু বড় ভয় হয়।

—কি ভয়!

—ও রাতে মাঝে মাঝে ঘরে ধূপকাঠি জ্বালিয়ে বসে থাকে।

—ধূপকাঠি জ্বালিয়ে বসে থাকে!

—হ্যাঁ, মা।

—তুমি কিছু বল না?

—কি বলব! এমন চোখ-মুখ, বলতে সাহস হয় না।

ধনবৌ চন্দ্রনাথকে ডেকে বলেছিল, শুনছ!

চন্দ্রনাথ হাতে দাঁ নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। হাতে ঘাস পাতা লেগে আছে। ধনবৌ চাল বাছছিল, সেসব ফেলে রেখে ফিসফিস গলায় বলেছিল, বৌমা কি বলছে!

—কি বলছে!

—অতীশ মাঝরাতে ঘরে ধূপকাঠি জ্বালিয়ে বসে থাকে।

নির্মলা বলেছিল, চোখে মুখে কেমন আতঙ্ক। ভয় পেলে, ঘাবড়ে গেলে যেমনটা হয়।

—কবে থেকে হয়েছে?

—স্কুলের ঝামেলার পর থেকেই।

চন্দ্রনাথ দা’টা পাশে রেখে বারান্দায় বসে পড়েছিলেন—কিছুক্ষণ মাথাটা নিচু করে দূর অতীতে কোনও পাপ কাজ করেছিলেন কিনা যেন স্মরণ করার চেষ্টা। না। তেমন কোনও পাপ কাজ তিনি করেন নি। তাঁর পুত্র পাগল হয়ে যাবে তিনি ভাবতে পারেন না। শুধু বললেন, কিছু বল না। আমি দেখছি। তারপর একদিন খেতে বসে এটা-ওটা নিয়ে কথা হবার সময় চন্দ্রনাথ প্রশ্ন করেছিলেন, সোনা তুমি কি ভয় পাও?

—ভয় পাব কেন?

—দেখ সোনা জীবনে নানাভাবে গোলযোগ দেখা দেয়। তুমি বাঁচবে, অথচ কোন গোলযোগ পোহাবে না সে হয় না। তোমার ভীতির কারণ আমি বুঝতে পারছি না।

অতীশ বুঝতে পেরেছিল, নির্মলা ভয় পেয়ে সব বলে দিয়েছে। সে বলেছিল, মাঝে মাঝে নাকে কিসের দুর্গন্ধ লেগে থাকে। ঘুম ভেঙে যায়। আর ঘুম আসে না। তখন ধূপকাঠি জ্বালাই। স্বস্তি বোধ করি।

—দুর্গন্ধটা কিসের?

অতীশ চুপ করে থাকত।

—দুর্গন্ধটা কিসের বলবে ত!

—মানুষের। অতীশ কেমন মরিয়া হয়ে যেন না বলে পারল না।

—আমার গায়ে কি সেটা পাও? তোমার মার! বউমার! পুত্রকন্যার!

অতীশ ভাত নাড়ছিল। খাচ্ছিল না। বড় কঠিন প্রশ্ন তুলেছেন বাবা। সেকি জবাব দেবে বুঝতে পারছিল না।

চন্দ্রনাথ কিছুটা দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন, জবাব দাও। কথা বলছ না কেন? পাপ কাজ করলে মানুষের শরীরে দুর্গন্ধ থাকে। সবাই টের পায় না। কেউ কেউ টের পায়। তবে আমার বিশ্বাস মানুষের কোনও পাপ কাজের দুর্গন্ধ দশটা ভাল কাজে মুছে যায়।

অতীশ ক্রমেই গম্ভীর হয়ে যাচ্ছিল।

চন্দ্রনাথ ফের বলেছিলেন,বুঝলে পৃথিবীতে যখন এসেই গেছ, তখন প্রশান্ত চিত্তে সব ভাল মন্দ মেনে নাও। এতে কম কষ্ট পাবে।

সোনার মনে হয়েছিল, যেন সেই স্যালি হিগিনস তাকে পৃথিবী সম্পর্কে সুপরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। সে খেতে খেতেই বুড়োর সেই মন্ত্রোচ্চারণের মতো কথাগুলি হুবহু মনে করতে পারছিল—ছোটবাবু মনে রাখবে গুডম্যান ইট টু লিভ, ব্যাডম্যান লিভস টু ইট। সে বলল, গন্ধটা সব সময় পাই না। এখানে এসে ভালই ছিলাম। স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কাজটা নিয়েই ফেরে পরে গেছি। কটুবাবুদের মিথ্যে অভিযোগের পর থেকেই এক রাতে ঘুম ভেঙে গেল বাবা। ওরা মিথ্যে করে আমার নামে ডি পি আইয়ের কাছে অভিযোগ করেছে। যাতে কাজ ছেড়ে দি সে-জন্য। মানুষের নীচতা আমাকে বড় কষ্ট দেয়।

—তারপরই বুঝি গন্ধটা পাচ্ছ!

—তাই।

—মনে কর না, তারা কেউ তোমার কোনও অনিষ্ট করতে পারেন। তিনি যদি অনিষ্ট না করেন তাদের কি ক্ষমতা অনিষ্ট করার। মনে কর না এটাও তোমার জীবনের পক্ষে তাঁর কোন শুভ ইচ্ছার প্রকাশ।

অতীশ হেসে দিয়েছিল। কারণ এছাড়া তাঁর অন্য কোনও উপায় ছিল না। সে বলেছিল, আপনার একটা আশ্রয় আছে। আমার তাও নেই।

চন্দ্রনাথ জানেন শৈশব থেকেই তার এই পুত্রটি ঈশ্বরের প্রতি বিরাগ। পরিবারের আর দশজনের মতো তার ধর্মবোধ গড়ে ওঠেনি। আচারবিচার নিয়ে মাঝে মাঝে পিতাপুত্র কথা কাটাকাটি হয়েছে, ঈশ্বর আছেন, এও তাঁর পুত্র বিশ্বাস করতে কষ্ট পায়। মৃত্যুর পর সব শেষ সে এমন ভেবে থাকে। আত্মা এবং পরলোক সম্পর্কেও ভারি অবিশ্বাস। তিনি কিছু বইয়ের উল্লেখ করে বলেছিলেন, এসব পড়, জানতে পারবে।

অতীশ ভিতর থেকে ভীষণ বেয়াড়া হয়ে উঠেছিল। বলেছিল, মৃত্যুর পর কি আছে কেউ জানে না বাবা। যদি কেউ কিছু বলে থাকে, মিছে কথা বলেছে। আমার বোধবুদ্ধিতে তোমাদের ঈশ্বরকে ধরতে পারি না।

—এখন পারবে না। আর একটু বয়েস হোক সবই পারবে। তারপরই চন্দ্রনাথ বিচলিত বোধ করেছিলেন। যদি সেটা না হয় অতীশের, তবে মানুষের দুর্গন্ধ তার নাকে লেগেই থাকবে। এবং এই দুর্গন্ধটাই তাকে শেষ পর্যন্ত পাগল করে দিতে পারে। তিনি বলেছিলেন, তোমার জন্য তিনি না থাকুন, তোমার সন্তান সম্ভতির জন্য অন্তত থাকুন। চন্দ্রনাথ কিছুটা বিরক্ত হয়েই যেন পুত্রকে এমন কথা বলতে বাধ্য হয়েছিলেন।

অতীশ শুধু বলেছিল, আমারও ভরসা এরা যদি বেঁচে থাকে, ভাল হয়, সজ্জন হয়, তবে তা আপনার পুণ্যফলেই হবে।

চন্দ্রনাথ আবার অনেক সুদূর থেকে একথা বলেছিলেন যেন, আমি চাই আমার পাপ-পুণ্য বলে যদি কিছু থাকে তা তোমাকে স্পর্শ করুক। ঈশ্বর তোমাকে দুর্গন্ধ মুক্ত করুন।

নির্মলা পাশের ঘর থেকে শুনতে শুনতে কাঠ হয়ে গেছিল। এমন ঈশ্বরবিহীন মানুষ নিয়ে তাকে সারা জীবন ঘর করতে হবে। ভাবতে গিয়ে ভয়ে কান্না উঠে আসছিল। তবু আশা, বাবা বলেছেন, তাঁর পাপপুণ্য বলে যদি কিছু থাকে তা মিণ্টু টুটুলকে স্পর্শ করবে। সেই আশায় আজ যাবার সময় বাবার দেওয়া সবকিছু যত্নের সঙ্গে নিয়ে নিল। বাবার হস্তাক্ষরে লেখা কালীর স্তোত্র, গায়ত্রী কবচ—কবচ পাঠ করতে বলেছেন, বিপদে আপদে কবচ পাঠ করলে সব আপদ কেটে যায়। আর ঠাকুরের ফুল-বেলপাতা—সেও সঙ্গে দিয়েছেন। সব শেষে তিনি যাত্রা করার আগে টুটুলকে বারান্দায় বসিয়ে তার মাথার ওপর গোটা পাটা তুলে দিয়ে বলেছেন, ঈশ্বর তোমাকে অনুসরণ করুক। ঈশ্বর তোমার সহায় হোন।

সারি সারি তিনটে রিকশা যাচ্ছে। গাছপালার অভ্যন্তরে তিনটে রিকশা চলে যাচ্ছে। গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছেন চন্দ্রনাথ ধনবৌ অলকা এবং প্রতিবেশীরা। চন্দ্রনাথ হাত তুলে দিয়েছেন। টুটুলও মায়ের মাথা ডিঙিয়ে পিতামহের প্রতি হাত তুলে দিয়েছে। নির্মলা পেছন ফিরে শুধু দেখল। যাত্রা আরম্ভ। কোথায় শেষ সে জানে না। তার চোখে জল নেমে এল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *