1 of 2

ঈশ্বরের বাগান – ১১

।। এগার।।

এই পাগল কতকালের চেনা। গাছের নিচে বসে ফকিরচাঁদ হরিশের দিকে তাকিয়ে থাকল। বুড়ো অথর্ব ফকিরচাদকে হরিশ এই সেদিন সারা দিনমান জ্বালিয়েছে। কথা নেই বার্তা নেই ঊর্দ্ধবাহু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা। ফকিরচাঁদ অভিশাপ দিয়েছে, হরিশ তোর মরণ ফুটপাথে। বেজন্মার বাচ্চা তুই, ভাবিস মরণ নাই। স্বার্থপর তুই –খাওয়া ছাড়া আর কিছু বুঝিস না। ঝুপড়িতে কে কোথায় কি লুকিয়ে রাখে তক্কে তক্কে থাকিস। পাগল সেজে বেশ কালাতিপাত করে গেলে হে। ঢ্যামনামি করে গেলে হে।

হরিশ তেরিয়া হয়ে গেল। কুকথা বলছে ফকরা। সে দু ঠ্যাং-ফাঁক করে চিৎকার করে উঠল, ফকরা তোর মুখে চুনকালি পড়বে।

পাশে হবু যুবতী চারু চিৎকার শুনে উঠে বসেছিল। এবং পিতামহের হাত ধরে ফুটপাথের অন্য প্রান্তে চলে গিয়েছিল। ওরা হরিশের ঝোলাঝুলির মধ্যে সতী বিবির ঝোলঝুলির মধ্যে পচা গন্ধ পাচ্ছিল কারণ এই ঝোলাঝুলি বরফ ঘরের মতো। সবই দুর্দিনের জন্য সংগ্রহ করা এবং কত রকমের যে উচ্ছিষ্ট খাবার! পাগলিনী সতীবিবি পাশেই চিৎ হয়ে শুয়েছিল। মাংসের হাড় অনবরত চোষার জন্য গালের দু’ধারে ঘায়ের মতো সাদা দাগ। শরীরে দীর্ঘ দিনের ময়লার পলেস্তারা মুখের অবয়বকে নষ্ট করে দিয়েছে। চেনা যাচ্ছিল না ওরা জন্মসূত্রে কোনো গ্রাম্য গৃহস্থের ঔরসজাত না অন্য কোনওভাবে অযথা কোনও অলৌকিক ঘটনার নিমিত্ত এই ফুটপাথ সংলগ্ন অসংখ্য ডাকবাক্সের মতো পাতলা অস্থায়ী প্লাইউডের ঝুপড়িতে বসবাস করছে।

পাশের বাড়িটা চারতলা এবং নিচে ফুটপাথের ওপর ছাদের মতো গাড়িবারান্দা। সামনে হাসপাতাল এবং রাজবাড়ি। সদর দরজায় কোন এক গোপন চক্রান্তকারী এক হাত লম্বা গন্ডারের ছবি ঝুলিয়ে রেখে গেছে। কেউ লক্ষ্যই করছে না দেউড়ির মাথায় বাঘ সিংহের পাশে ছবিটা লেপ্টে আছে। রাজবাড়ির ছাদের কার্নিসে কার্নিসে সব পরীদের মূর্তি। ওরা যেন বসনভূষণ আলগা করে বাতাসে উড়ে যেতে চাইছে। সময়ে অসময়ে বুড়ো ফকিরচাঁদ সেইসব বৈভবের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে! হাসপাতালের বাড়িটাও দীর্ঘদিন খালি পড়েছিল, শুধু কাক উড়ত ছাদে এবং পাঁচিলের পাশের পেয়ারা গাছটাতে এক জোড়া ঘুঘু পাখি আশ্রয় নিয়েছিল। ইদানীং চুনকাম হবার সময় মোষের মতো একটা ইতর ছোকরা কিছু চুনগোলা জল ছাদ থেকে নালির ফুটোর মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। মোষটা চারুকেও চেটেপুটে রেখে গেছে। সেই থেকে গাছটায় পাখিরা আর বসবাস করে না। সময়ে উড়ে এসে বসে, সময়ে হাওয়া পেলে উড়ে চলে যায়। কেউ আর গাছটায় বাসা বানায় না। নিচে চারু মাঝে মাঝে ছায়া পেলে গামছা পেতে শুয়ে থাকে।

আর এই বাড়িটার জন্যই ভোরের দিকে সূর্যের উত্তাপ ছাদের নিচে নামতে পারে না। অথবা লম্বা হয়ে যখন সূর্য হাসপাতালের মৃত মানুষের ঘর অতিক্রম করে পেয়ারা গাছটার মাথায় এসে নামে তখন ছাদের ছায়া পুরো ফকিরচাঁদকে রক্ষা করতে থাকে। এই জন্যে অভ্যাসের মতো এই জায়গাটা বসবাসের পক্ষে ফকিরচাঁদের পক্ষে বড়ই উপযোগী। স্টেশন থেকে সে বেশিদূর হেঁটে যায়নি। কাছেই জায়গাটা পেয়ে গিয়ে ফকিরচাঁদ হাতের কাছে স্বর্গ পেয়ে গেছিল। বাসস্থান মিলে যাওয়ায় সে আর নিজেকে উদ্বাস্তু ভাবতে পারে না। প্রায় নিজের ফেলে আসা বাড়ি ঘরের মতোই জায়গাটাকে সে ভালোবেসেছে। কেবল উপদ্রব বলতে এই পাগলটা। যখন তখন সামনে এসে উর্ধ্ববাহু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। পচা দুর্গন্ধে তখন টেকা যায় না।

চারু পাশে নেই। কোথাও আহারের জন্য অন্ন সংস্থান করতে গেছে। একটা শতচ্ছিন্ন তালিমারা চাদর ফুটপাথে ছড়ানো। সে তাতে শুয়ে আছে। পাশে গোটা গোটা অক্ষরে লিখে রেখেছে জীবনের কিছু কথা। পথচারীরা যায়, দেখে –কেউ দয়াপরবশে দু-পাঁচ পয়সা ফেলে দিয়ে যায়। সকাল থেকে একটা পয়সাও পড়ে নি। ফলে ফকিরচাঁদ মানুষজনের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছে।

কি আর করে ফকিরচাঁদ। প্রচন্ড দাবদাহ যাচ্ছে। অনাবৃষ্টি। একটা ছেঁড়া কাগজে সে ফসলহানির কথা পড়ে ভারি চিন্তান্বিত। সবার হলে, খেয়ে পরে বাঁচলে তবে তার বরাদ্দ! সবাই ভাল থাকলে, খেতে পেলে সে খেতে পাবে। কিন্তু অনাবৃষ্টিতে ফসলহানি হলে, তার চলবে কেন। কিছু তুকতাক মন্ত্রপাঠ সে জানে। সে বিশ্বাস করে, কোনও জাদুটোনা করতে পারলে আকাশ উপুড় হয়ে ঢল নামাবে। সে পানের দোকান থেকে চুনের টোফা চুরি করে এ জন্য কাল রাত থেকে নিজের খুপরিতে লুকিয়ে রেখেছে। রোদ উঠলেই সেটা নিয়ে সে যায়। হরিশ ব্যাটা ঠিক টের পেয়ে গেছে। ও বেটা বুঝি আরও বড় গুনিন। হিতে বিপরীত হতে পারে ভেবে টোফাটা রোদে রাখার সময় ভারি সতর্ক দেখে ফেললেই গেল। সে বাণ মেরে তার অভিসন্ধি উড়িয়ে দিতে পারে। ফকিরচাঁদ বড়ই অস্বস্তিতে আছে। মন দিয়ে বাবা দয়া করেন, পুত্র কন্যা সুখে থাকবে, মঙ্গল হবে আপনার, ঠিকঠাক বলতে পারছে না। বড়ই সমস্যা তার। চুনের টোফায় লোহা ডুবিয়ে তাতে দিলে বরুণদেবের কলিজা ফেটে যায়—ভয়ে বৃষ্টি নিয়ে আসে এমন বিশ্বাস ফকিরচাঁদের। কিন্তু তাতে দিলেই ঢ্যামনা হরিশ ঠিক টের পেয়ে পালটা তুকতাক করে ফেলতে পারে। বেটা মনুষ্যজাতির অপোগন্ড। ভাল চায় না। রসাতলে সব গেলে সে হাহা করে হাসতে পারে। ফকিরচাঁদ মানুষের ভালর জন্য বৃষ্টি নামাচ্ছে জানতে পারলেই ধুন্ধুমার কান্ড বাধিয়ে বসবে। সেদিন যেমন লাঠি নিয়ে পড়েছিল, আজ ফকিরচাঁদকে। পুলিশে জানাজানি হলে জেল হাজতবাস হতে পারে। না বলে না কয়ে টোফা চুরি অসাধু কাজ।

সব কিছু রোদের উত্তাপে পুড়ে যাচ্ছে। বর্ষাকাল কে বলবে! গ্রীষ্মের মতো পিচে কাদা ধরেছে। চটচট করছে। বাস ট্রাক গেলে চটর চটর শব্দ সে শুনতে পায়। কর্পোরেশনের গাড়ি রাস্তায় বালি ছিটিয়ে যাচ্ছে। তখন পাগলা হরিশ পিচগলা পথে, মাথায় দুপুরের রোদ, লাঠিতে পাখির পালক বাঁধা—বিজয় গর্বে হেঁটে যাচ্ছে। যত শহরটা দাবানলে পুড়ছে তত হরিশ উৎক্ষিপ্ত হয়ে উঠছে।

দুরে অদুরে সব ডাস্টবিনের জংশন এবং সেখানে হয়ত চারু পোড়া কয়লা, ছেঁড়া কাগজ, লোহার টুকরো খুঁজছে? ফকিরচাঁদের বিশ্বাস খুঁজতে খুঁজতে একদিন চারু ঠিক শহরের গুপ্তধনের সন্ধান পেয়ে যাবে। এই আশায় ফকিরচাঁদ এখনও বেঁচে আছে—না হলে সে কবেই মরে যেত। ফকিরচাঁদ এবার উঠে পড়ল। এক মগ চা এ-সময়টায় সে খায়। চেয়েচিন্তে কিছু পয়সা দিয়ে চা নিয়ে এসে বসতেই মনে হল ঢ্যামনা হরিশ এদিকটায় আসছে। বড় জ্বালা হয়েছে। কিছু মুখে দিতে পারে না। সে হামাগুড়ি দিয়ে খুপরির মধ্যে ঢুকে ঝাঁপ টেনে দিল আর তখনই মনে হল টোফাটা রোদের তাতে রয়েছে। ওটা হরিশ এক ফাঁকে তার ঝোলাঝুলিতে ঢুকিয়ে ফেলতে পারে। এতবড় একটা শত্রুপক্ষ তার—মোকাবেলা করতে পর্যন্ত ভয় পায়। সে চা খাবে না টোফা তুলবে। কোনটা আগে দরকার। আসলে শরিকী ঝগড়া। ফকিরচাঁদ ভাবে এলাকাটা তার, হরিশ ভাবে তার। এই নিয়ে উভয়ের মধ্যে কতদিন থেকে একটা অদৃশ্য যুদ্ধ চলছে শহরের মানুষেরা যদি টের পেত। তাদের কি, খায় দায়—আছে সুখে। গাড়ি বাড়ি করে আছে বেশ। ঝামেলা ঝঞ্ঝাট কিছুই পোহানোর দায় নেই। বুঝত, ঠ্যালা বুঝত, যদি হরিশের মতো থাকত একটা বড়ই হিসেবী শত্রুপক্ষ।

না হরিশ টেয় পায় নি। সে চা খাচ্ছে টের পায় নি। সে টোফা রোদে দিয়ে বসে আছে টের পায় নি। যাক নিশ্চিন্তি। পরম আরাম। হরিশ উত্তর থেকে দক্ষিণে চলে যাচ্ছে। গির্জার ওদিকটায় চলে যাচ্ছে। পথ থেকে সে তার অমূল্য আসবাবপত্র কুড়িয়ে নিতে ভুলছে না। কোনটা কখন কি মহার্ঘ কাজে লেগে যাবে কে জানে।

রাতের আহারের জন্য খড়কুটো অথবা পাতলা কাঠ সংগ্রহ করতে হয়। চারু সাঁজবেলায় গাছতলায় আগুন দেয়। হাঁড়িতে চাল দিয়ে কুমড়ো আলু কাটতে বসে। কোত্থেকে পচা মাছটাছও নিয়ে আসে চারু। খুবই সংসারী। চারু যে ঘরে যাবে, আলো হয়ে যাবে সে ঘর। বুড়ো ফকিরচাঁদ চোখ বুজে সুখের স্বপ্ন দেখে।

বুড়ো ফরিকচাঁদ এবার পা দিয়ে নিজের হস্তাক্ষর মুছে দিল। পাঁচিল সংলগ্ন ওর ছোট প্লাইউডের সংসার। বসবাসের উপযোগেী নয়, শুধু তৈজসপত্র রাখার জন্য পাতলা প্লাসটিকের চাদর দিয়ে সব ঢাকা। ফকিরচাঁদ কি মনে করে আজ সব টেনে বের করতে থাকল—হাঁড়ি পাতিল, ছেঁড়া কাঁথা, ভাঙা জলের কুঁজো সবই চারুর সংগ্রহ করা—ডাস্টবিন থেকে। মেয়েটার সারাদিন ঘুরে ঘুরে ঐ এক সংগ্রহের বাতিক—ঠিক ঢ্যামনা হরিশের মতো। এবং চারুই স্টেশন থেকে এই বাড়িসংলগ্ন পরিত্যক্ত গাড়িবারান্দা আবিষ্কার করে ফকিরচাঁদের হাত ধরে চলে এসেছিল এবং জায়গাটার দখল নিয়েছিল। দখল নিলেই হয় না, তাকে রক্ষা করতে হয়। এক বছরে পাঁচ সাতবার এই রাজ্যটার ওপর নানারকম আক্রমণ ঘটেছে। চারুর চোপার গুণে কেউ তিষ্ঠতে পারে নি। মেয়েটার চোপা ছিল বলেই এ-যাত্রা ফকিরচাঁদ বেঁচে গেল। পরজন্মে চারুর মতন একটা নাতিন যদি না মেলে জীবনে হেনস্থা আছে। সে-জন্য সে হরিশের মতো চুরি-চামারি করতেও ভয় পায়। ভগবান বড়ই সতর্ক প্রহরী।

ফকিরচাঁদ এ-সময় চারপাশটা দেখল। কত বড় শহর, কত লম্বা ট্রাম লাইন, কত মানুষজন, কেবল যাচ্ছে আর আসছে। শেষ নেই। সকাল থেকে মানুষের পেছনে কোন এক অদৃশ্য শক্তি তাড়া করে বেড়াচ্ছে। কাউকে নিস্তার দিচ্ছে না। তাড়া খেয়ে কেবল ছুটছে। দু’দন্ড বিশ্রাম নেবে তারও সময় নেই। এইসব মানুষের জন্য ফকিরচাঁদের কষ্ট হয়। কে সেই কাকতাড়ুয়া যে মানুষকে স্বস্তি দিচ্ছে না। মানুষজন, বাস, ট্রাম, ঝোলাঝুলি দেখতে দেখতে এ-সব মনে হয় ফকিরচাঁদের। তার হাই ওঠে। মগের চা কিছু খেয়ে কিছুটা চারুর জন্য রেখে দিয়েছে। একটু দূরেই হরিশের আস্তানা। দুজনের একজনও কাছে-ভিতে নেই। দু’জনেই সারা রাস্তায় ঢ্যামনামির জন্য বের হয়ে গেছে। দু’জনই কোমর দুলিয়ে পাগলামি করে হোটেলের উচ্ছিষ্ট খাবার নিয়ে আসতে গেছে।

আর তখনই গাড়ি থেকে একটা সুন্দর মতো বউ নেমে বলল, পাগলা বাবা কাঁহা?

ফকিরচাঁদ বউটাকে চেনে না। কে জানে কি বিশ্বাস, বউটা এক ঝুড়ি ফলমূল হরিশের আস্তানায় রেখে দাঁড়িয়ে থাকল। সঙ্গের চাপরাশিটাকে বলল, দেখত পাগলা বাবা কাঁহা?

ফকিরচাঁদ বলল, দে যান আমাদের, হরিশ এলে দেব। হরিশ কবে থেকে পাগলা বাবা হল। নধরকান্তি বউটির নাকে নথ দুলছে। ফকিরচাঁদকে হয়ত ফেরেববাজ ভাবছে। বউটি কিছু বলল না। চাপরাশি এসে বলল, গির্জার ওদিকটায় হাঁটু মুড়ে বসে আছে। এবার গাড়ি থেকে এক স্থূলকায় বাবু নামলেন, তিনি হনহন করে হাঁটতে পারেন না, বউটি হনহন করে হাঁটতে থাকল। তারপর সেই পাগলা বাবার পায়ে গড় হতেই হরিশ বুঝল আরে সেই নারী, যারে সে মুতে দিয়ে বলেছিল খা, দেখবি তোর ভাল হবে। কে জানে কি হল, বউটি সত্যি সামান্য কণিকামাত্র ধূলিকণার মতো আঙুলে তুলে মুখে মাথায় দিয়েছিল। স্বামীর বাড়াবাড়ি তা নিয়ে সে গেছিল ঠনঠনে। সেখানে পূজা দিয়ে ফেরার সময় পাগলা বাবার দেখা। পাগলা বাবা তার বিড়ম্বনা টের পেয়ে সাধু বাক্য উচ্চারণ করেছে। রমণী সবই সেই বিধাতার নিবন্ধ ভেবে মুখে দিয়ে বাড়ি ফিরেছিল এবং অলৌকিক কিছু প্রায় তার স্বামীর শরীরে ঘটে গিয়েছিল। মানুষটা চোখ মেলে তাকিয়েছে। সেই থেকেই হরিশের খোঁজ। খুঁজে খুঁজে পেয়েও গেল একদিন। পাগলা বাবার জন্য হাঁড়ি পাতিল ভর্তি দই সন্দেশ ফলমূল নিয়ে এসেছে। হরিশ দেখেই হাঁ হাঁ করে তেড়ে গেল। পাগলামি আরও বাড়িয়ে ফেলল। রাস্তায় অপোগড় সব হাজির। দু’হাতে সে সব বিলিয়ে দিয়ে খালি পাতিল মাথায় টুপির মতো পরে দৌড়াতে থাকল। তারপর গলি গুঁজিতে ঢুকে উঁকি দিতে থাকল, বাবু মানুষের বউ আর খুঁজছে কিনা। উঁকি দিয়ে দেখতে থাকল।

অতীশ অফিস যাবার মুখেই দেখল, দেবদারু গাছটার নিচে পরিচিত কেউ যেন দাঁড়িয়ে আছে। আর এ যে শেঠজী! সিট মেটালের এক নম্বর খদ্দের। এত বড় মানুষটা এখানে! মাঝে খুব অসুখ শুনেছিল। কুম্ভবাবু খুব যাতায়াত করত তখন। তাকেও বলেছিল চলুন। সময়ে অসময়ে কোম্পানির টাকা যোগায়। লে। তার ভাল মন্দের সঙ্গে কোম্পানির নসিব জড়িয়ে আছে। অতীশ যাব যাব করেও যেতে পারে নি। সেই মানুষ দেবদারু গাছের নিচে! সে ট্রাম রাস্তা পার হতেই শেঠজী তাকে দেখে বলল, বাবুজী আপ!

—আপনি!

—আর বলবেন না। বহুং মুসিবৎ মে গির গিয়া। পাগলা বাবা থুথু ফিক দিয়া। কাঁহা চলে গেল! রাস্তায় লোকজন জমা হয়ে গেছে। কারণ এই রাস্তার পাগলটাকে খাওয়াবার জন্য খানদানী ঘরের একজন বউ ছুটাছুটি করছে। পাগলটা সব রাস্তার অপোগন্ডদের দিয়ে-থুয়ে খালি পাতিল মাথায় দিয়ে কোন দিকে চলে গেল! অতীশ শেঠজীর এই পাগলপ্রীতিতে কিছুটা অবাক হয়ে গেল। দু’নম্বরী কাজ করে মানুষটা বছর দশেকের মধ্যে কলকাতায় মোকাম, দেশে মোকাম ইস্কুল, মন্দির বানিয়ে ফেলেছে। এবং সিট মেটাল না থাকলে এটা সে পারত না। কোম্পানি সুযোগ পেলে দু’নম্বরী মাল তৈরি করে। অতীশ গতকাল এটা টের পেয়েই মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছে। তেল পাউডার, ওযুধের সব ডিব্বা বানিয়ে দিতে হয়। ছাপ নম্বর হুবহু এক থাকে। আজ এ-নিয়ে সে রাজেনদার সঙ্গে কথা বলেছে। রাজেনদা খুব দূর থকে দেখার মতো দার্শনিক গলায় জবাব দিয়েছেন, চারপাশটা ভাল করে দেখ। বোঝ সব। আরও কিছুদিন লাগবে দেখছি তোমার।

অতীশ বলেছিল, এতে জেল হাজতের ভয় আছে। ধরা পড়লে।

বিশ বছর ধরে এই হচ্ছে। কেউ ধরা পড়ছে বলে ত জানি না! তুমি পড়বে কেন? সব দিকে নজর রাখ, ঠিকঠাক রাখ, তবে দেখবে কেউ কিছু করতে পারবে না। তারপরই বাঙালীর অধঃপতন নিয়ে কিছু ভাষ্য—এর জন্যই জাতটা গেল। বাইরের লোক এসে দু’ দিনেই টু পাইস করে ফেলছে। দেশের লোক, নিজের শহর, রামমোহন, বিদ্যাসাগর মশাই এ শহরে বড় হয়েছেন, তোমরা তার উত্তরাধিকার, বাইরের লোক সব লুটেপুটে নিচ্ছে—আটকাতে পারছ না।

শেঠজী কানে কানে বলল, ই রাজবাড়ি হ্যায়। কেতনা বড়া মোকাম। রাজাবাবু কো একদিন দেখিয়ে দেবেন।

অতীশ বলল, দেব।

—বহুত পুণ্যবান আদমী। দর্শনে মুক্তি ভি হয়।

অতীশ বলল, হয়।

অতীশ তারপর বলল, রাস্তায় লোক জমে যাচ্ছে। গিন্নিকে নিয়ে বাড়ি যান।

—হামার বাত ও শুনবে! পাগলা বাবা পাগলা বাবা করে ওয়ার ত জান গেল!

এই হচ্চে মানুষ, অতীশের এমনই মনে হল। নিজের জন্য সব পাপ কাজ করছে—পুণ্য কাজও করছে। সেও ভালো নেই। একটা চক্রান্তের মধ্যে সে নিজেও জড়িয়ে পড়ছে। এখান থেকে সে নিস্তারও পাবে না। এক জটিল আবর্তে সে পড়ে গেছে। আর এ-সময় কেন জানি নির্মলার ওপর সে খেপে গেল। তারপর ভাবল যেভাবেই হোক বাজারে দু’নম্বরী মাল সাপ্লাই সে বন্ধ করবে। আর তখনই দেখা গেল শহরের ওপর দিয়ে কেউ দুই অতিকায় বাহু বাড়িয়ে দিয়েছে আকাশে। সে তখনই শেঠজীকে বলল, চলি।

শেঠজী বলল, নেহি নেহি। হামার সাথে যানে হোগা। এ ভজনলাল তেরা ভাবিকো বোলা। বাবুজী ইধর হায়।

কিন্তু ভাবিজীর এখন মাথা খারাপ। পাগলা বাবা খেপে গিয়ে কিছু খেল না। সে পাগলা বাবাকে খাওয়াতে পারল না। নসিবে কি আছে কে জানে। কোথায় আবার কোন অপদেবতা এসে ভর করবে সংসারে। সেই ভয়ে ভাবিজীর চোখ মুখ উদ্বিগ্ন। কাছে এলে শেঠজী তার বহুকে বলল, বাবুজী দেবতা আছেন।

অতীশ কোন উত্তর করল না। হাত তুলে নমস্কার করল। রাস্তায় দাঁড়িয়ে এই আলাপ তার খুব ভাল লাগছিল না। চারপাশের মানুষজন লক্ষ্য করছে। সে কিছুটা অস্বস্তিবোধ করছিল। গাড়ি এলে উঠে বসল। শেঠজী তাকে সিট মেটালে নামিয়ে দিয়ে চলে যাবে।

শেঠজীর বহু সারাটাক্ষণ ঘোমটা টেনে বসে থাকল। বয়স শেঠজীর তুলনায় খুব কম। চোখ দুটো ছোট, বেঁটেখাট, ঠোঁট ভারি, ভরাট যৌবন। এই যুবতী এত ধর্মপরায়ণ, ভীরু ভাবতে কেমন অতীশের কষ্ট হচ্ছিল। মানুষ সম্পর্কে অতীশের এমনিতেই নালিশ কম, সে মানুষকে খুব ছোট ভাবতে পারে না, শেঠজী আসলে যে একজন প্রতারক সেটা সে সোজাসুজি ভাবতে পারছে না। বরং মনে হল, সে নিজেই প্রতারক। সে কোম্পানির ম্যানেজার। দু’নম্বর মাল তার কোম্পানি সাপ্লাই দিয়ে যাচ্ছে। সে সব বন্ধ করে দিতে পারে –ফলে সে শুধু নিজেকেই বিপন্ন করে তুলবে না, যে মানুষগুলি এই কনসার্নের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাদের জীবনও বিপন্ন করে তুলবে। কাল সারারাত সে ঘুমাতে পারে নি, মাথা গরম। মাথা গরম হলেই কেমন এক অন্ধকার গ্রহনক্ষত্রের দেশ তাকে গ্রাস করে। তার এও মনে হল সহসা সে কিছু করতে পারে না। তাকে ধীরে ধীরে এগোতে হবে। তার প্রথম কাজ কস্টিং। সে কালি, টিন, বার্নিশ ম্যানুফ্যাকচারিং কস্ট এবং মিসলেনিয়াস খরচাসহ প্রতিটি আইটেমের একটি তালিকা তৈরি করেছে। সারারাত জেগে এই কাজটা করেছে। তাকে গোপনে এ-সব করতে হচ্ছে। কারণ কুম্ভবাবুর পছন্দ না, এক্ষুনি মালের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হোক। যে কটা কাস্টমার আছে তবে তারাও ভাগবে বলে কুম্ভবাবু অতীশকে ভয় দেখিয়েছে।

অফিসে ঢুকে অন্য দিন, একবার সব শেডগুলি ঘুরে দেখে। কোথায় কি কাজ হচ্ছে, ছাপাখানায় কি ছাপা হচ্ছে, একবার ঘুরে না দেখলে সে স্বস্তি পায় না। কিন্তু আজ কেন জানি কোনও শেডে ঢুকতে ইচ্ছে হল না। সুইংডোর ঠেলে সোজা নিজের ঘরে ঢুকে গেল। এক গ্লাস জল রাখা থাকে। সে বসে জলটা খেল। টেবিলের ওপর কিছু ফাইল, বিল ভাউচার। ক্যাস বুক। বাইরে সুধীর বসে আছে। ভারি ভীতু মুখ ছেলেটার। সব সময় কেমন মুখ গোমড়া করে রাখে। আজ এক মাস হয়ে গেল, অতীশ কখনও ওকে হাসতে দেখে নি। কুম্ভবাবু সব সময় ধমকের ওপর রাখে। কাজে ত্রুটি বের করে পেছনে লাগে। এখানে আসার পর অতীশের কেন জানি ছেলেটির প্রতি একটা মায়া জন্মে গেছে। একবার চুপি চুপি ডেকে বলতে ইচ্ছে হয়েছিল, অত ভয় পাস কেন। কিসের ভয়। কত মাইনে পাস যে ভয় পাবি! আমার মতো বেশি মাইনে পেলে না হয় চাকরির ভয় ছিল। তাছাড়া বিয়ে থা করিস নি। ছেলেপুলে হয় নি। এখনই ত সময় মাথা উঁচু করে চলার। কিন্তু সে বলতে পারে নি। এ রকমেরই স্বভাব তার। মনে মনে অষ্টপ্রহর সব অসাম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, খোলাখুলি সে প্রতিবাদ করতে পারে না।

এখানে এসে সে আজ পর্যন্ত একবার ও নির্মলার বাপের বাড়ির খোঁজ নেয় নি। নির্মলা প্রতিটি চিঠিতেই লিখেছে তোমার ফোন নম্বর জানাচ্ছ না কেন! দাদাকে লিখেছি, তুমি কলকাতায় কাজ পেয়েছ। দাদা তোমার ওখানে ঘুরেও এসেছে। পায় নি। তোমার একবার যাওয়া দরকার ছিল। বাবা মাই বা কি ভাববেন। আসলে সে এই কাজটা নেবার পর কেমন হতাশও হয়ে পড়েছে। এই গোল্ড মাইনে এসে বুঝেছে, স্বর্ণ অন্বেষণে এখানে কুম্ভবাবুর মতো লোকেরই লেগে থাকা সম্ভব। যত দিন যাচ্ছে, তত জটিলতা উপলব্ধি করতে পারছে। রবিবার সন্ধ্যার গাড়িতে নির্মলাও চলে আসছে। সে মুখ ফুটে বলতেই পারবে না, নির্মলা আমি এখন একজন প্রতারকের ভূমিকা পালন করছি। টুটুল মিণ্টুর দিকেও সে আর সহজে যেন চোখ তুলে তাকাতে পারবে না। শিশুরা বোধহয় সবচেয়ে বেশি বুঝতে পারে সব। তারাই প্রথম বুঝতে পারবে তাদের বাবা ভাল নেই। ঠিকঠাক বেঁচে নেই। এখানে আসার পর একটা লাইন সে লিখতে পারে নি। দু’ একজন লেখক বন্ধুকে সে ফোন করেছিল। তারা তার সঙ্গে কফি হাউসে দেখা করেছে। কেউ কেউ অফিসেও এসেছিল। এই বয়সে এমন একটা ভাল কাজ পাওয়ায় কেউ কেউ ঈর্ষা বোধও করেছে। অথচ সে তাদেরও বলতে পারে নি, আমি ভাল নেই। আমি ঠিকঠাক বেঁচে নেই। আর্চির প্রেতাত্মা আমাকে আবার গোলমালে ফেলে দিল।

সুইং ডোর ঠেলে কেউ ঢুকছে। বুড়ো দারোয়ান রঘুবীর। ফতুয়া গায়ে হাঁটুর ওপর কাপড়। সে ঢুকে এক বান্ডিল টাকা রেখে বলল, মন্টু সাহা দিয়ে গেছে।

—কত টাকা?

—আঠারশ টাকা। আরও দশ হাজার সুরমা নেবে বলেছে। বাজার ফিরতি দেখা করে যাবে। অতীশ টাকাটা গুণে ক্যাশবাকসে রেখে দিল। ক্যাশবুক খুলে টাকাটা মন্টু সাহার নামে জমা করে ভাবল একবার বিলগুলি চেক করে দেখে। তখনই সুধীর মুখ বাড়িয়ে বলল, দুজন লোক দেখা করতে চায়।

—ডাক!

দুজন দু’রকমের মানুষ। দু’রকম মানুষ ঘরে ঢুকে দুটো চেয়ারে বসতে বসতে বলল, রাম রামজী। এই ধরনের অভিবাদনে সে আজকাল অভ্যস্ত হয়ে গেছে। মধ্যবয়সী মানুষের একজনের হাতে ছটা আংটি। মুখে খৈনি। ধুতি পাঞ্জাবি পরনে। পায়ে বুট জুতো। অন্য জনের মুখে কেমন শয়তানের ছাপ। কথা বলতে বলতে একটা কনটেনার পকেট থেকে বের করে বলল, এ-রকম মাল চাই।

অতীশ দেখল একটা চালু ওযুধের কৌটা।

সে বলল, হবে।

—ঠিক এরকম হবে না বাবুজী।

—কি রকম হবে?

—একটা হসসু বাদ। লাল মার্জিন থাকবে না।

অতীশ বুঝল সেই নকল মালের পার্টি। মেজাজটা কেমন বিগড়ে গেল, বলল হবে না।

—বাবুজী ভাল দাম দেব।

—হবে না। এখানে দু-নম্বরী মাল হয় না।

এ-কথা শুনে লোকটা মুচকি হাসল। বলল, বিশোয়াস কা বারে মে কৈ হুজ্জুতি নেই হোগা।

অতীশের মনে হল লোক দুটো শয়তানের প্রতিভূ। সব খবরাখবর নিয়ে এসেছে। এদের পাশাপাশি

আরও একজন অলক্ষ্যে দাঁড়িয়ে শীতল চোখে তাকিয়ে আছে। যেন বলছে, ছোটবাবু আমি এদের চেয়ে খারাপ ছিলাম না। জাহাজে তুমি আমার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলে, মুখে বালিশ চাপা দিয়ে খুন করেছ। সবার অলক্ষ্যে সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলে। এখন কি করবে?

অতীশ মুখ নিচু করে বসে থাকল।

তখনই ঢুকল কুম্ভবাবু। লোক দুটোকে দেখেই অবাক হয়ে গেছে যেন। আরে আপনারা। কি ব্যাপার!

—মাল চাই। লিকিন বাবুজী বলছেন হোবে না।

কি মাল যেন কুম্ভবাবু কিছুই জানে না।

ওরা টেবিল থেকে কৌটাটা তুলে নিয়ে দেখাল।

কুম্ভবাবু অতীশের দিকে তাকিয়ে বলল, আমাদের ডাইস আছে। হবে না কেন?

অতীশের কেন জানি এ সময় চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছা হল। বলতে ইচ্ছা হল, দু-নম্বরী কারবার সব বন্ধ করে দেব ভাবছি। নতুন কোনও আর অর্ডার নেব না। কিন্তু বলতে পারল না। শুধু বলল, ওরা দু-নম্বরী মাল চায়।

কুম্ভ বলল, তাহলে ত মুশকিল। আমরা করি না সে স্পষ্ট করে বলতে পারল না। তাকে আরও চতুর হতে হবে। সে সোজাসুজি ওদের সামনে বলতে পারল না, হবে। সেই যে পাঠিয়েছে, কপিলদেব তাকে ধরেই যে এই দুজন লোককে পাঠিয়েছে তাও বুঝতে দিল না। শুধু বলল, আসুন। আমার সঙ্গে আসুন।

ওরা বের হয়ে গেলে অতীশ হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। এত গরম লাগছে কেন। এই শহরে গরম কি খুব একটা বেশি। ফুল স্পিডে পাখা চালিয়েও সে রেহাই পায় না। এবং তখনই আবার কুম্ভবাবু হাজির। বলল, ভাল রেট দেবে। দেড় গুণ রেট। মোটা অ্যাডভান্স দেবে। কাল মাইনে। টাকা নেই। বুঝতেই পারছেন সাধা লক্ষ্মী পায়ে ঠেলা ঠিক হবে না।

অতীশ বলল, মন্টু সাহা কিছু টাকা দিয়ে গেছে। কপিলদেবের লোক আসার কথা। আর ব্যাঙ্কে যা আছে হয়ে যাবে।

—এরাই কপিলদেবের লোক।

সে আর কোনও কথা বলল না। কিছু জেনুইন কাস্টমার আছে। সে তাদের একজনকে ‘ফোনে ধরার চেষ্টা করল। বৈদ্যনাথ সাধনার কিছু মাল কোম্পানি সাপ্লাই করে থাকে। যোগেশবাবুকে ধরতে পারলে কাজ হয়। এবং ফোনে পেয়েও গেল। সে তার অসুবিধার কথা বললে, তিনি তার রেট আরও কমাবার সুযোগ নিলেন। অতীশ হতাশ গলায় বলল, তাই হবে।

কুম্ভবাবু আজ কিছুতেই অতীশকে দিয়ে অর্ডার বুক করাতে পারল না। লোকসানের কোম্পানিকে আরও লোকসানে ফেলে দিচ্ছে। কুম্ভ ভীষণ অপমানিত বোধ করল। পার্টিদের কাছে তার প্রভাব অতীশের চেয়ে বেশি। সততার ঢ্যামনামি কুম্ভ একদম পছন্দ করে না। সে বিকেলেই এই নিয়ে বেশ বড় রকমের একটা গোলযোগ বাধিয়ে অফিস ফেরত সোজা সনৎবাবুর কাছে চলে এল।

সনবাবু দোতলার বারান্দায় একটা ইজিচেয়ারে আরাম করছিলেন। পাশে বড় ছেলের নাতনি। সামনে গ্যারেজ, পাশে লম্বা দুটো তালগাছ। একটা পাখি ডানা মেলে এসে বসল। নাতনি দুধ খাচ্ছে না। ছোটাছুটি করছে, দাপাদাপি করছে। তিনি পাজামা পাঞ্জাবি পরে সন্ধ্যের সময় সমুদ্রের হাওয়া খাওয়ার মতো একটা টেবিলে পা তুলে বসে আছেন। খুব বড় ঝড় গেল কদিন। বস্তিগুলি হাত ছাড়া হতে যাচ্ছিল। প্রাইভেট লিমিটেড করে দিয়ে আপাতত ঠেকা দেওয়া গেছে, বছরকার আয় লাখ টাকার ওপর রক্ষা পেয়ে যাওয়ায় কুমারবাহাদুর এ মাস থেকে আরও দুটো ইনক্রিমেন্ট দিয়েছেন। এখন রিটায়ার করার বয়সে যত তিনি নিজেকে কাজের মানুষ প্রতিপন্ন করবেন, তত বাড়তি সুযোগ। সরকারি কাজে যে যাননি, যোগ্যতা থাকতেও এই রাজবাড়িতে এসে যে প্রথমেই অফিসার পদে চাকরি পেয়ে গেছিলেন, সেটা আজ মনে হচ্ছে বড়ই সৌভাগ্য। পাশে কিছু আঙুর আপেল এবং বেদানার কোয়া। এক গ্লাস দুধ। কুটকুট করে খাচ্ছেন। রোগা কালো ছিমছাম চেহারা। মাথা ভর্তি সাদা চুল। খুব প্রাজ্ঞ মানুষের মতো মুখের অবয়ব। টেবিলের একপাশে একটা ইংরেজি দৈনিক। ওপরে ওয়ালেস স্টিভেনসের কবিতা সংগ্রহ। এটা পড়বেন বলে এনেছেন। নানারকম আইনের মার-প্যাঁচ মাথায় ঘোরার জন্য তিনি এতদিন বইটি উল্টেও দেখেন নি। কুমীরবাহাদুরের প্রিয় কবি। কুমারবাহাদুরই পড়তে দিয়েছেন। এবং এটা পড়ে নতুন কিছু আরও আবিষ্কার করতে পারলে বিদ্যের দৌড়ে এই বয়সেও কম যান না তিনি প্রমাণ করতে পারবেন। সুতরাং আর দশটা রাজকীয় কাজের সঙ্গে সম্প্রতি কবিতা পাঠও যোগ হয়েছে।

সিঁড়ি ধরে কেউ উঠছে। পুত্রবধূ ফিরতে পারে। কলেজ করে বাপের বাড়ি হয়ে আসার কথা। শঙ্কু ফিরতে পারে অফিস ছুটির পর। কিছু টুকিটাকি বাজার সেরে ফেরার কথা। সিঁড়িতে কিন্তু পায়ের আওয়াজে তিনি ঠিক ধরতে পারছেন না। কে উঠে আসছে। খুব সতর্ক পা ফেলে কেউ উঠে আসছে। তারপরই বুঝতে পারলেন, কুম্ভ। এ বাড়িতে সিঁড়ি ভাঙার সময় কুম্ভই একমাত্র টেনে টেনে পা তুলে হেঁটে আসে। এ-বাড়িতে কে কি খায়, কার দু পয়সা ফাউ রোজগার আছে তলেতলে সবারই জানার আগ্রহ। এবং তিনি একজন সৎ এবং অভিজ্ঞ মানুষ হিসাবে সম্মানীয় ব্যক্তি—প্রায় কুমারবাহাদুরের পরই। তবু এত সব ভাল খাবার দেখলে কুম্ভর চোখ টাটাতে পারে। বাপকে বলতে পারে –স্যারেরও বেশ দু-পয়সা আলগা তাহলে হচ্ছে। তিনি তৎক্ষণাৎ খাবারের প্লেট ঘরে পাঠিয়ে কবিতার বই খুলে গম্ভীর মুখে বসে থাকলেন। কারণ এই মুখোশটাকে রাজবাড়ির সবাই বড় ভয় পায়। এটি তাঁর প্রিয় মুখোশ।

ভিতরে ঢুকলে, সনৎবাবু বই থেকে মুখ না তুলেই বললেন, বোসো। কুম্ভ বসল, কিছু বলল না। স্যার বইয়ে নিমগ্ন। বড়ই অসময়ে এসে গেছে। কিন্তু এখন উঠে চলে যেতেও পারে না। এই লোকটার হাতে অনেক ক্ষমতা। এর পরামর্শ ছাড়া সিট মেটাল সম্পর্কে কুমারবাহাদুর কোন সিদ্ধান্ত নেন না। তাছাড়া সে যে চোরছ্যাঁচোড় জাতের লোক স্যার তা আন্দাজ করে ফেলেছে। দু-একবার হাতেনাতে ধরা পড়তে পড়তে বেঁচে গেছে। এজন্য কুম্ভ খুব সরল বিনয়ী এবং বাধ্য ছোকরার মতো এখন চেয়ে আছে কখন মুখ তুলে একটু কথা বলবেন।

সনৎবাবু এবার বইয়ের পাতায় একটা বাসের টিকিট গুঁজে দিলেন। তারপর বই বন্ধ করে বললেন, কিছু বলবে?

—স্যার কোম্পানি লাটে উঠলে আমায় দোষ দেবেন না। কাস্টমাররা সব খেপে যাচ্ছে। অতীশবাবু অর্ডার নিচ্ছেন না। ভাল ভাল অর্ডার হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। এই বলে সহসা চুপ করে গেল কুম্ভ। সনৎবাবু বললেন, খুলে বল সব। এতে কি আমি বুঝব। কুম্ভর ভেতরে যে অপমানের দাপাদাপিটা চলছিল সেটা কিছুটা প্রশমিত হচ্ছে। সে বুঝতে পারছিল—তার কথাবার্তা এখন অনেক স্পষ্ট। এবং সনৎবাবু সব শুনে কিছুক্ষণ দু-আঙুলে চোখ টিপে ধরলেন। গভীর বিষয়ে চিন্তা করলে এটা তাঁর হয়। কুম্ভ মনে মনে আর কিভাবে লাগানো ভাঙানো যায়, আর কি কুটকৌশলের সাহায্য নেওয়া যায়, কারণ অতীশবাবুর এই শুচিবাই কোম্পানির ভরাডুবির কারণ হতে পারে, যেভাবেই হোক স্যারকে বোঝানো দরকার।

সনৎবাবু উঠে দাঁড়ালেন। রেলিং-এ ঝুঁকে দেখলেন কিছু। বৌমা এখনও এল না। শঙ্কুরও ফেরার সময় হয়ে গেছে। গিন্নি শনিপূজা দিতে গেছে কোথায়। বাড়িতে চাকর নাতনি এবং নিজে। সমস্যা একের পর এক। তিনি বললেন, কাল অফিসে এস। কুমারবাহাদুরের সঙ্গে কথা বলে রাখব। আমার মনে হয় সবার কাছেই বিষয়টা পরিষ্কার হওয়া দরকার।

কুম্ভ বুঝল জল ঘোলা করে তুলতে পেরেছে। এবং পরদিনই সে সেটা টের পেল। সকাল নটায় দুজনেরই ডাক পড়েছে। বারান্দায় অতীশবাবু একটা হলুদ কলার দেয়া গেঞ্জি গায়ে বসে। সে কাছে গিয়ে বলল, দাদা কি ব্যাপার আমাদের সহসা এলো!

অতীশ দেখল কুম্ভ ভারি প্রসন্ন আজ। তলে তলে যে ঠান্ডা যুদ্ধটা চলছে অতীশ আজ টের পেতে দিল না। আসলে নিজেও ধূর্ত হয়ে উঠছে। ধূর্ত না হলে সে হেসে বলতে পারত না, বোধহয় রাজবাড়িতে নেমন্তন্ন। আমাদের খেতে ডেকেছেন। তারপরই অতীশ সুরেনকে ডেকে বলল, কি হে পাত পাড়বে কখন?

নধরবাবু জানকীবাবু ভিতরে আছেন। বের হলেই স্যার পাত পড়বে।

একটু পরে সনৎবাবুই মুখ বার করে বললেন, তোমরা এস।

সনৎবাবু আগে, মাঝে কুম্ভবাবু সে পেছনে। দরজার গোড়ায় জুতো খোলার পাট। সে তা করে না। সে পেছনে দাঁড়িয়ে দেখছে। প্রথম দিন থেকেই সে এই দাস মনোভাব থেকে আত্মরক্ষা করে আসছে। বাড়ির আমলারা কেউ এটা পছন্দ করছে না—কিন্তু রাজার মর্জি বোঝা ভার। এই আমলারা ভেতরে ঢুকে সামনের চেয়ারে বসারও সাহস পায় না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাজ সেরে আসে। সনবাবু একমাত্র বসতে পারেন। তিনি ভিতরে ঢুকে প্রথম গড় হলেন। কুম্ভ আরও বেশি মাথা নুয়ে গড় হল। খালি পা দুজনের পেছনে অতীশ তামাশা দেখার মতো দাঁড়িয়ে। রাজেনদা তাকে দেখেই বললেন, আরে এস এস। কি খবর, সদলবলে দেখছি। সে পাশের চেয়ারটা দখল না করে মাঝখানেরটায় গিয়ে বসে পড়ল। সনৎবাবু পাশে বসলেন। কুম্ভ বসতে ইতস্তত করছিল। আশ্চর্য রাজেনদা কুম্ভকে বসতে বলছেন না। অতীশের নিজেরই গায়ে কেমন খোঁচা লাগছে। সে বলল, বসুন না।

রাজেনদা যেন বাধ্য হয়ে বললেন, বোস বোস।

কুম্ভ বড়ই বিনয়ী এখন। যেন জীবনে কোনও কুবাক্য শোনেনি। যেন পৃথিবীটা সাধুজনে ভরে আছে।

অতিকায় টেবিলটার ওপাশটায় একজন রাজা মানুষের এত প্রভাব! ফুলকো লুচির মতো টাক। জুলপি এবং গোঁফে চুলের খামতি ঢাকার চেষ্টা রাজেনদার। তিনি সনৎবাবুর মুখ থেকে বিস্তারিত রিপোর্ট শুনলেন। হুঁ হাঁ করছেন। কথার মাঝেই একবার অতীশকে বললেন, বৌমা কবে আসবে? তোমার বাবা-মা কেমন আছে। আরে তোমার ঐ গল্পটার নিয়ে এক ভদ্রলোক খুব তারিফ করলেন—এ রকমের কিছু কথাবার্তা। সাংঘাতিক বিচারালয়ে এমন হাল্কা মেজাজে কেউ সব অভিযোগ শুনতে পারে অতীশের কেমন অবিশ্বাস্য ঠেকছিল। এবং পরে রাজেনদা শুধু বললেন, অতীশ, এ শহরে লোকে খালি হাতে আসে। ফুটপাথে থাকে। তুমি খালি হাতে আসনি! এটা তোমার জীবনের পক্ষে বড় সৌভাগ্য ভাবতে পার।

অতীশ বুঝতে পারছে রাজেনদা তাকে তিরস্কার করছেন। তার তিরস্কারের ভঙ্গীটাও মনোরম। তবু তার চোখ মুখ লাল হয়ে উঠছে। সে মাথা নিচু করে বলল, আমাদের অ্যাকুমুলেটেড লস দু’লাখের উপর। এটা এ-বছর আরও বাড়বে। কাস্টমার ব্যাঙ্ক সর্বত্র দেনা। জাল মাল করলে কাস্টমারদের হাতের মুঠোয় চলে যাব। পরে দেখবেন ওখানটায় একটা অশ্বত্থ গাছ আছে। আর কিছু নেই।

কুম্ভবাবু একটা কথাও বলছে না। সে আগেই সব বলে রেখেছে। সে কেবল রাজার নির্দেশ জানতে চায়। কোম্পানির প্রতি কত নিষ্ঠা তার তাও সে বোঝাতে চায়। সে নিজের জন্য অভিযোগ দায়ের করেনি। যেন তার মূল লক্ষ্য কোম্পানিকে সমূহ ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করা। কিন্তু অতীশবাবু একটা বেশ বড় বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখাল! রাজার মাথায় কি গেছে কথাটা! শুধু একটা অশ্বত্থ গাছ থাকবে। ওটা রাজাকে একটা বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখানোর শামিল। রাজা এটা বুঝছে না কেন!

অতীশ আগে একবার সব হজম করে গেছে। আজ কেন জানি সে তার সিদ্ধান্ত থেকে নড়তে চাইল না। সে তেমনি ঠান্ডা গলায় বলল, দু-আড়াই মাস আগে যা ছিলাম এখন আর তা নেই। কিছু কিছু আমিও বুঝি। তারপর থেমে গেল। যেন বাকিটা বললে অশোভন হবে। তবু শেষে না বলে পারল না, আপনার হাতে অন্যে তামাক খেয়ে যাবে কেন? তামাকটা আপনিই খান।

সনৎবাবু বললেন, তুমি বোঝ না কিছু কে বলেছে?

—না কেউ কেউ এমন ভেবে থাকতে পারে।

কুম্ভর মনে হচ্ছিল সে হেরে যাচ্ছে। সে বলল, এই মুহূর্তে মালের দাম বাড়াবার আমি পক্ষপাতি নই স্যার।

অতীশ বলল, আমি পক্ষপাতি। কস্টিং করে দেখলাম মার্জিনাল প্রফিট দূরে থাক খরচাই ওঠে না।

কুম্ভ বলল, আরও তো কারখানা আছে। তারা কি রেটে কাজ করে দেখুন না।

—কেউ বলে না কি রেটে কাজ করে।

—কাস্টমারদের জিজ্ঞেস করলে জানতে পারবেন।

অতীশ বেশ দূর থেকে যেন বলল, ওরা রেট নিয়ে মিছে কথা বলে। কম বলে। পার্টিদের এত অ্যাডভান্স রাখার কি কারণ থাকতে পারে। যদি একদিন সব পার্টি অ্যাডভান্স ফেরত চায় কোম্পানির ঘটি বাটি বিক্রি করে দিতে হবে।

রাজেনদা কি যেন বুঝলেন। দুজনই কোম্পানির ভাল চায়। দুজনই দু-রকমের কথা বলছে। সন বাবু অভিযোগ দায়ের করার পর চুপ। তবু অতীশ নতুন। রাজেনদা অতীশকে বললেন, আপাতত নকল আসল সব অর্ডারই বুক কর। কাজ চালু রাখতে হবে ত!

অতীশ কেমন মরিয়া হয়ে বলল, নকল অর্ডার আমি বুক করতে পারব না। কুম্ভবাবু যদি করেন করুন। অর্ডার বুকের বই ওঁকে দিয়ে দিচ্ছি।

কুমারবাহাদুর সনৎবাবুর দিকে তাকিয়ে কি যেন জানতে চাইলেন। অতীশের মুখ থমথম করছে। তখনই একটা চিরকুট কেউ দিয়ে গেল কুমারবাহাদুরের হাতে। তিনি বললেন, অতীশ ভিতরে যাও। তোমাকে ডাকছে। শঙ্খ হাজির। অতীশ বের হয়ে গেলে কুমারবাহাদুর বললেন, ভীষণ সেনসেটিভ ছেলে। টেকল করা মুশকিল। কি করবেন?

আসলে মানুষ শৈশবে ফিরে যেতে বার বার ভালবাসে। এই মুহূর্তে অতীশের সব রাগ ক্ষোভ কেমন উবে গেল। অমলা তাকে ডেকে পাঠিয়েছে। সেই যেন বিশাল ছাদের কার্নিসে দাঁড়িয়ে আছে অমলা। কখন সেই ছেলেটা আসবে বলে দাঁড়িয়ে আছে। তার কাছে যাচ্ছে অতীশ। আপনজন বলতে এ বাড়িতে তার অমলা। এবং এ-মুহূর্তে এটা মনে হতেই চোখমুখে রক্তচাপ বেড়ে যেতে থাকল। চারপাশে জাঁকজমক —ধনাঢ্য পরিবারগুলোর যা হয়—ঘরের পর ঘর।

আশ্রিতজনেরা একসময় এই বাড়ির তলাকার অসংখ্য ঘরে গিজগিজ করত। এখন তারা নেই। বৈভবের শেষ পর্যায় চলছে বোধহয় এটা। আর দু-এক পুরুষে এরা আর দশজনের মতো নামগোত্রহীন হয়ে যেতে পারে।

শঙ্খ আগে যাচ্ছে। যেন অনেকদূরে কোথাও আজ অতীশকে নিয়ে যাবে বলে সে রওনা হয়েছে। কোথাও বেশ অন্ধকার কোথাও আসবাবপত্রে ঠাসা ঘর, তারপরই সিঁড়ি, নীল সবুজ আর লাল গালিচা পাতা সিঁড়ি ধরে উঠতে থাকল। সেই গন্ধটা চারপাশে। লেভেন্ডার জাতীয় গন্ধ—অথবা ধূপদীপের মতো গন্ধ—কিন্তু ধূপদীপ নয়—সে উঠে যাচ্ছে। সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠতেই ঝাউগাছগুলোর ফাঁকে সূর্য দেখতে পেল। একেবারে শেষ মহলায় তাকে নিয়ে আসা হয়েছে। বিরাট প্রাসাদে মানুষজন কম। চাকর চোপদার, খাজাঞ্চি নায়েব গোমস্তা অথবা সেরাস্তায় যেসব লোক থাকত তারা আর তেমনভাবে জাঁকিয়ে বসে নেই। মাঝে মাঝে দু-একজন দাসী বাঁদি চোখে পড়ছে—অতীশ আসছে দেখেই ওরা মুহূর্তে অন্ধকারে কোথায় লুকিয়ে পড়ল।

শঙ্খ বলল, যান ভিতরে বউরাণী আছেন।

সামনে বিশাল লম্বা বারান্দা। কারুকাজ করা মোজেইক। নীলরঙের চিক ফেলা। কথা বললেই গমগম করে বাজছে। শঙ্খের গলা বড়ই গম্ভীর শোনাচ্ছিল।

অতীশ ইতস্তত করছিল। ভেলভেটের পর্দা প্রকান্ড দরজায় ঝুলছে। এর ভেতরে যেতে হবে তাকে। এতক্ষণ মনটা যেভাবে যতটা হাল্কা হয়ে গেছিল, এখানে এসে আবার তা ভারি হয়ে গেল। তার মনে হল সহসা, সে আর সেই নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে নেই। অনেক দূর অতীতে সে তা ফেলে এসেছে। আর তখনই পর্দা তুলে বউরাণী বলল, আয়।

যেন নির্দেশ। তার কিছু করণীয় নেই।

যেতে যেতে বৌরাণী বলল, খুব খেপে গেছিস শুনলাম।

সব খবর এখানে তবে আগেই পাচার হয়ে যায়। সেদিন যে সে মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরেছিল, তার খবরও বোধহয় রাখে।

বউরাণী আগে আগে যাচ্ছে। এখন সে এই রমণীকে অমলা কিংবা কমলা কিছুই ভাবতে পারছে না। লম্বা দৃঢ় মজবুত রমণী। পুরো শরীর হাল্কা সবুজের ওপর লাল ফুল ফল আঁকা ম্যাকসিতে ঢাকা। ইতিহাসের পাতার ছবির মতো কোনও সম্রাজ্ঞী যথার্থই তার সামনে হেঁটে যাচ্ছে যেন। ম্যাকসির ঝালর মেঝেয় অনেকটা ছড়িয়ে চলে যাচ্ছে। রুপোলী চুমকিতে সারা অঙ্গ জ্বলজ্বল করছিল। কোমর এবং বাহু দুই ভারি কামনার উদ্রেক করে। অতীশ ভয়ে রমণীর দিকে তাকাচ্ছে না। সে দেয়াল এবং দু-পাশের বিদেশী শিল্পীদের আঁকা ছবি দেখতে দেখতে চলে যাচ্ছে। অমলা সামান্য বেহুঁশের মতো হেঁটে যাচ্ছিল।

দরজা ঠেলে পর্দা তুলে ফের বলল, আয়।

সে ঢুকলে বলল, বোস। তারপর জরুরী কাজ পড়ে আছে মতো অন্য দরজার দিকে এগোলে, অতীশ বলল, আমি কিছু বুঝতে পারছি না অমলা, তুমি আমাকে এখানে নিয়ে এলে কেন! বউরাণী কেমন সহসা অতর্কিতে ফিরে দাঁড়াল। বলল, ঠিক বলছিস আমি অমলা!

—হ্যাঁ, তুমি অমলা। অমলা। কমলা নও। কমলার চুল নীল ছিল।

—তাহলে তোর সব মনে আছে?

—আছে।

—ছাদের কথা?

—মনে আছে।

—নদীর ধারে সেই কাশবন……

—মনে আছে।

—ল্যান্ডোতে পূজা দেখতে বের হয়েছিলাম তোকে নিয়ে……

—মনে আছে।

—স্টীমার ঘাটের সেই আলো তারপর সেই বনটা—কত শত পাখি, রাতের জোৎস্না…..সব মনে আছ তোর! যেন এবারে অমলা বলতে বলতে চিৎকার করে উঠবে।

মনে আছে তোর সেই শ্যাওলাপিচ্ছিল ধূসর পৃথিবীর কথা! কিন্তু বলতে পারল না। গ্রীকরমণীর মতো চোখেমুখে এক আশ্চর্য মুহ্যমান দৃষ্টি। সোনার মজবুত দৃঢ় লম্বা শরীরের দিকে তাকিয়ে কেমন অস্পষ্ট কন্ঠে বলে উঠল, সোনা তুই একটা দস্যু। তুই দস্যু সোনা। কেন তুই এখানে মরতে এলি সোনা!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *