2 of 2

ঈর্ষা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

ঈর্ষা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

বিনয়েন্দ্র বললেন, সব ঠিক হয়ে গেল। আজ অ্যাডভান্স জমা দিয়ে এলুম, বুঝলে!

অণিমা ড্রেসিং টেবিলের আয়না মুছছিলেন, বললেন, জানালাগুলো রং করে দেবে তো? বারান্দার কোলাপসিবল গেটটাও ঢক ঢক্ করে নড়ছিল!

—সব ঠিক করে দেবে। বাড়িওলা লোকটি ভালো। একতিরিশ তারিখ রোববার আছে, সেদিনই সিফট করব। যতীনকে বলেছি, দুটো লরি পাঠাতে।

বাবলু আর অদিতি দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল। ওরা কৌতূহলে ছটফট করছে।

বাবলু বলল, বাবা, ওখানে ফুটবল খেলার মাঠ আছে?

বিনয়েন্দ্র হাসলেন, বললেন, অত বড় মাঠ নেই, তবে ছোটখাটো একটা লন আছে, ইচ্ছে করলে ব্যাডমিন্টনের নেট ফেলতে পারবি!

—রাস্তার নাম কি বাবা?

—রত্নাকর সেন রোড। সিক্স রত্নাকর সেন রোড়, মুখস্ত করে রাখো। পোস্টঅফিসে একটা চিঠি লিখে দিতে হবে।

বাবলু তাড়াতাড়ি ছুটে গেল পাশের ফ্ল্যাটে ওর বন্ধু সুজিতকে খবরটা জানাতে। অদিতি এসে দাঁড়াল মায়ের পাশ ঘেঁষে। অণিমা বললেন হ্যাঁ গো, ভাড়া সেই সাড়ে পাঁচশো-ই রইল? এত টাকা ভাড়া দিয়ে কুলোতে পারবে তো? কমাল না?

—নাঃ! ভাড়া কি আর আজকাল কেউ কমায়? তবে পাড়াটা ভালো, ওদের ইস্কুল কাছে হল। সামনের বছর অদিতি পাশ করলে ওকে ব্রেবোর্ণে ভর্তি করব—তাও খুব দূরে হবে না।

—যাক, ভালোই হল। এ বাড়িটা আর আমার একটুও পছন্দ হচ্ছিল না। আশেপাশে যা হই-হট্টগোল দিনরাত!

অদিতি অনুযোগের সুরে বললে, বাড়ি ঠিক হয়ে গেল, আমরা এখনও দেখলুম না! যদি এর থেকে ভালো না হয়।

—এর চেয়ে ঢের ভালো। বাইরে থেকেও কত সুন্দর দেখতে—গোলাপি গোলাপি রং, সামনের লনে একটা ছোট্ট ইউক্যালিপটাস গাছ আছে—কলকাতা শহরে কোনও বাড়িতে তুই ইউক্যালিপটাস গাছ পাবি? ওটা একেবারে ঠিক আমাদের জানালার পাশে। একটা ছোট্ট ঘর আছে—ওটা আমি ভেবে রেখেছি তোর জন্যে একেবারে আলাদা। পড়াশুনোর সুবিধে হবে—সঙ্গে ছোট্ট ব্যালকনি, অ্যাটাচড বাথ।

—বাথরুমে শাওয়ার আছে?

—হ্যাঁ, খুব মোটা জল পড়ে দেখে এলুম।

—কলিং বেল আছে?

—কলিং বেল কি বাড়িওলা দেয়। এটা আমাদেরই গিয়ে লাগিয়ে নিতে হবে। আজ বা কাল তোরা গিয়ে বাড়িটা দেখে আয় না। দেখিস, তোদের ঠিক পছন্দ হবে।

বাবলু গিয়ে সুজিতকে বলল, জানিস, আমরা সামনের মাস থেকে চলে যাচ্ছি। সব ঠিক হয়ে গেছে।

—কোথায় রে? অনেক দূরে?

—হুঁ, বহুত দূর, বালিগঞ্জে যাচ্ছি।

—বালিগঞ্জ আবার দূর নাকি? এই তো পরশুদিন টুবলুমামার গাড়িতে ঘুরে এলুম বালিগঞ্জ, টালিগঞ্জ—টুবলুমামা একটা দোকানে আইসক্রিম খাওয়ালেন, দোকানটা কি ঠাণ্ডা! তোরা বেশ রোজ রোজ ওই দোকানে আইসক্রিম খেতে পারবি।

—বাবা বলেছেন, আমাদের নতুন বাড়ির ঠিক পাশেই একটা আইসক্রিমের দোকান আছে। জানিস, আমি এই ইস্কুল ছেড়ে দেব।

—ইস্কুল ছেড়ে দিবি? তারপর কী করবি?

—ওখানে ইংরিজি ইস্কুলে পড়ব? সেই ইস্কুলের বাস আছে, রোজ আমাদের বাড়ির সামনে বাস থামবে।

সুজিত একটুক্ষণ চিন্তা করল, তারপর বলল, যাবার সময় তোরা ছাদ থেকে রেডিও’র এরিয়ালটা খুলে নিয়ে যাবি?

—হ্যাঁ। এরিয়াল নিয়ে যাব, জানালার পর্দা, নিয়ন লাইট সব নিয়ে যাব।

সুজিত বলল, ভালোই হল। তোদের এরিয়ালটার জন্য ছাদে ভালো করে ঘুড়ি ওড়াতে পারতুম না। এখন বেশ পুরো ছাদটা ফাঁকা পাব। তোদের ফ্ল্যাটে যতদিন না অন্য ভাড়াটে আসে—ততদিন তো পুরো দোতলাটাই আমাদের—কী মজা হবে তখন! শানু, পিন্টু, শুভ্রাদের ডেকে রোজ চোর-চোর খেলব।

বাবলু গম্ভীর ভাবে জানাল, আমাদের নতুন বাড়িতে ব্যাডমিন্টন খেলা হবে।

সুজিতের দাদা ইন্দ্রজিৎ পাশের বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল। সদ্য কলেজে ভর্তি হয়েছে ইন্দ্রজিৎ, এই কিছুদিন আগেও সে সিঁথি কেটে চুল আঁচড়াত—এখন উল্টে আঁচড়ায় বলে মুখখানা একটু বদলে গেছে। স্বভাবও একটু বদলেছে তার—আগে সে যখন তখন বাবলুদের সঙ্গে ক্যারাম খেলতে বসত— এখন আর খেলতে চায় না। সে গম্ভীর ভাবে বলল, তোমাদের বাড়ি বদলানো ঠিক হয়ে গেল বাবলু?

—হ্যাঁ ইন্দ্রদা, খুব চমৎকার বাড়ি। বাবা বললেন—

—তোমাদের তো বদলানো দরকারই। তোমার বাবার কাছে কত লোক আসেন—কিন্তু এখানে তোমাদের একটা ভালো বসবার ঘর নেই…

—ওখানে আমাদের ছ’খানা ঘর, তার মধ্যে দুটো বসবার ঘর, বাবার একটা, মার একটা…

—কবে যাচ্ছ তোমরা?

—এই তো একত্রিশ তারিখ রবিবার—বাবা বলেছেন, সকালবেলাই চলে যেতে হবে—চারখানা লরি আসবে—

—চারখানা লরি? কিসে লাগবে—

—বাঃ—অ্যাত্ত জিনিস—আমি প্রথম লরিটার ড্রাইভারের পাশে বসবো।

অণিমা বললেন, বাড়িটা তো বেশ ভালই ঠিক হয়েছে। কিন্তু আপনাদের ছেড়ে চলে যাব—ভাবতে এত খারাপ লাগছে—

সুজিতের মা রত্নপ্রভা বললেন, এমন তো কিছু দূর নয়। বাসে চড়লে দশ মিনিট। যাওয়া আসা তো থাকবেই।

—আচ্ছা তা তো থাকবেই। তবু এখানে যেমন আপনজনের মতন পাশাপাশি ছিলুম শান্তিতে— কোনও ঝঞ্ঝাট ছিল না, এসব ছেড়ে নতুন জায়গায়—অবশ্য পাড়াটা ভালো—আশেপাশে কোনও বস্তি নেই, সব নতুন বাড়ি।

—আমার এক মাসতুতো ভাইও ওই সি আই টি রোডে বাড়ি করেছে। বলছিল যে, সবই ভালো, শুধু বর্ষাকালে বড্ড জল জমে। আর মশা খুব। আমাদের এদিকটায় কিন্তু মশা নেই। তোমাদের ভাড়া কত পড়বে?

—ভাড়া? ইয়ে, সাড়ে ছশো ঠিক হয়েছে, গ্যারেজ নিলে পুরো সাতশো-ই পড়বে। ভাবছি আপিসের গাড়িটা এখন থেকে বাড়িতেই রাখব।

—আমরাও ভাবছি যাদবপুরের জমিটায় এইবার একটা বাড়ি তোলা শুরু করব। এখন ব্রিজ হয়ে গেছে তো—ওদিকটা এমন সুন্দর হয়েছে—ভাড়া বাড়িতে আর ভালো লাগে না। অজিত এবার কানপুরের ট্রেনিং শেষ করে ফিরবে—তখন আর কি ও এই বাড়িতে থাকতে চাইবে।

—তা ঠিক। নিজের বাড়ির তুলনায় কী আর ভাড়া বাড়ি! আমাকেও তো মা আর দাদারা বলছেন বাড়ি করো, বাড়ি করো। বাড়ি তো করাই যায়—কিন্তু ওঁর আপিস থেকে যে এতগুলো টাকা বাড়ি ভাড়া দেয়—নিজের বাড়ি হলে তো আর দেবে না। শুধু শুধু এতগুলো টাকা ছাড়ি কেন বলুন?

—তোমার কি বলে, ইয়ে, অদিতির বাবা আর ক’ বছর চাকরি আছে?

—এখনও সাত বছর। যাই, প্রেসার কুকারে মাংস চাপিয়ে এসেছি। দূরে চলে যাচ্ছি বলে ভুলে যাবেন না আমাদের রাত্নাদি। বিপদে-আপদে আপনাদের কাছে কতরকম সাহায্য পেয়েছি!

—আহা সাহায্য আবার কি? পাশাপাশি ছিলুম দু’বোনের মতন—দূরে গেলে, তুমিও কি আমাদের ভুলতে পারবে?

ছাদে একটা ছোট্ট ঘর, সেটা ইন্দ্রজিতের দখলে। একটা চেয়ার, একটা টেবিল আর একটা ছোট্ট বুক শেলফ—এখানেই সে জানালার ধারে বসে পড়াশুনো করে আর মাঝে মাঝে মুখ তুলে দেখে পায়রাদের ওড়াওড়ি। আর তার নতুন শেখা সিগারেট খাওয়ার জন্যই সারা বাড়িতে এই একটিমাত্র জায়গা। যখনই তার মন খারাপ হয়—আজকাল প্রায়ই হয়—সে এসে এই ছাদের ঘরে জানালার পাশে বসে। এখান থেকে সে বহু দূর পর্যন্ত তাকিয়ে দেখতে পারে—তার আস্তে আস্তে মন ভালো হয়ে যায়। ইন্দ্রজিৎ সেই ঘরে বসে ছিল, পিছন দিক দিয়ে অদিতি এসে টক করে টেবিলের ওপর বাটি রেখে বলল, এই নাও!

ইন্দ্রজিৎ মনোযোগ দিয়ে বাংলা উপন্যাস পড়ছে, ঘাড় না ফিরিয়ে বলল, কী?

—আচার। যা ঝাল হয়েছে না, আমরা কেউ খেতে পারছি না—তোমার খুব পছন্দ হবে।

—উঁহু, আমি এখন আচার খাবো না।

—কেন?

—আমি এইমাত্র সিগারেট খেয়েছি। এখন আচার খেলে মুখের স্বাদ নষ্ট হয়ে যাবে।

—ইস, এর মধ্যেই পাকা নেশাখোরের মতন কথা। রঞ্জিতদাকে বলে দেব একদিন, তখন বুঝবে।

—বলতে হয় এখুনি বলে দাও, পরে তো আর সুযোগ পাবে না।

অদিতির কিশোরী মুখখানি এমন ঝকঝকে স্পষ্ট যে সমস্ত মনোভাবের তৎক্ষণাৎ ছায়া পড়ে। তাদের সিঁড়িতে ওঠার সময় তার মুখ ছিল ঝাল লেগে বিব্রত, ঘরে ঢোকার পর কৌতুকের, এইমাত্র সে মুখে ম্লান ছায়া পড়ল। সে ইন্দ্রজিতের কাছে সরে এসে বলল, আমরা এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি, তুমি শুনেছ?

—হুঁ।

—তোমার বইটা এখন রাখো তো! আমার এখন মন খারাপ লাগছে—আর উনি বসে বসে বই পড়ছেন?

—কেন, মন খারাপ লাগছে কেন?

—নতুন বাড়িতে যাব শুনে বেশ আনন্দও হচ্ছে, আবার মন খারাপও লাগছে।

—মন খারাপ লাগছে কী জন্য?

—তুমি জানো না বুঝি?

—না তো। আমি কেমন করে জানব—কি জন্য তোমার মন খারাপ!

—ঠিক আছে জানতেও হবে না। জানি তো, আমার কথা কেউ ভাবে না—

অদিতি সত্যিই রাগ করে চলে যাচ্ছিল, ইন্দ্রজিৎ দ্রুত উঠে গিয়ে তার হাত ধরল। বলল, এই, এই, রাগ করে না। শোনো, অনেক কথা আছে—।

—না, আমি কোনও কথা শুনতে চাই না—আমার সময় নেই!

ইন্দ্রজিৎ জোর করে ওকে টেনে চিলেকোঠার সিঁড়িতে বসালো। নিজেও বসল পাশে। অদিতির কচি হাতের আঙুলগুলো নিয়ে খেলা করতে করতে বলল, জানো অদিতি, তোমরা চলে যাবে শুনে প্রথমটায় আমারও মন খারাপ লাগছিল—এখন কিন্তু বেশ ভালো লাগছে।

—কেন, ভালো লাগছে কেন?

—আমি বিকেলবেলা কলেজ থেকে ফেরার পথে প্রত্যেকদিন তোমাদের বাড়িতে যাব—

—সত্যি যাবে? না, মিথ্যে কথা। বিকেলবেলা তোমার কত বন্ধুবান্ধব—

—না, না, সত্যিই। শোনো, বিকেলবেলা তো এ বাড়িতে তোমার সঙ্গে আমার দেখা হয় না— মায়েরা তখন ছাদে আসেন, তা ছাড়া, দাদা তো আমাকে দেখলেই একটা না একটা কাজে পাঠাবে— তোমাদের বাড়িতে তো আর কোনও কাজ থাকবে না, আমরা তখন…

—আমরা বিকেলে ওখানে ব্যাডমিন্টন খেলব…

—হ্যাঁ, খেলব, আর বাগানে বসে গল্প করব। আমার প্রত্যেকদিন বিকেলবেলা কেমন যেন মন খারাপ মন খারাপ লাগে, কলেজ থেকে বাড়ি আসতে ইচ্ছে করে না—এখন থেকে তোমাদের নতুন বাড়িতে…

অদিতি আলতোভাবে ইন্দ্রজিতের আঙুলে চাপ দেয়। সে মনোভাব লুকোতে জানে না, খুশি ঝলমল মুখে বলল, বাড়ি বদলে তাহলে খুব ভালো হল, না? ভালো—কি খারাপ, আমি এতক্ষণ বুঝতে পারছিলুম না।

—খুব ভালো হল। মাঝে মাঝে আমরা আলাদা বেড়াতে যাব। কি করে যাব জানো? তোমার মাকে বলব, মাসিমা, অদিতিকে আমাদের বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি! আসলে কিন্তু আমাদের বাড়িতে আসব না। আমরা আলাদা বেড়াব—

—মা জানতে পারবেন না?

—উঁহু! এমন কায়দা করে ম্যানেজ করব—। আমরা কক্ষনও একসঙ্গে বেড়াইনি, দেখো কী ভালো লাগবে—! তুমি লেকে গেছ কখনও? আমি তোমাকে লেক দেখাতে নিয়ে যাব—

—যদি আমাদের কেউ রাস্তায় দেখে ফেলে?

—কেউ দেখবে না, আমি অনেক অচেনা অচেনা রাস্তা জানি।

আর পাঁচদিন বাদেই একতিরিশের রবিবার। জিনিসপত্র গুছনো, বাঁধাছাদা শুরু হয়ে গেছে। ইন্দ্রজিতের দাদা রঞ্জিত এসব কাজে খুব পাকা, সে ওদের সাহায্য করছে খুব। একটা পায়া ভাঙা টেবিল অণিমা রঞ্জিতকে দানই করে দিলেন। বাবলুর খুব ইচ্ছে আগে একবার গিয়ে নতুন বাড়ি দেখে আসে। রোজই তাই নিয়ে বায়না ধরছে। বিনয়েন্দ্রর সময় নেই, অণিমা তাই বললেন, আচ্ছা, তুই আর দিদি আজ বিকেলবেলা ঘুরে আয়। ইন্দ্রজিৎকে বল না তোদের সঙ্গে নিয়ে যাবে!

বাইরে বেরুবার সময় অদিতি আজকাল আর ফ্রক পরে না, একটা কালো রঙের সিল্কের শাড়িতে ওকে একটা ফুরফুরে দোয়েল পাখির মতন দেখাচ্ছে। বাবলু কিছুতেই মোজা পরতে চায় না, অদিতি ওকে জোর করে শু এবং মোজা পরিয়েছে। ইন্দ্রজিৎ পরেছে পায়জামা আর মুগার পাঞ্জাবি, তার চটি পরা পা দুখানি তার মুখের মতনই ঝকঝকে পরিষ্কার। পথে বেরিয়ে অত্যন্ত দায়িত্বসম্পন্ন মানুষের মতন সে বাবলুর হাত ধরে রইল, বাসে ওঠবার সময় সে সাবধানে বলল, লেডিজ, একদম রোখকে। পকেট থেকে মানিব্যাগ বার করে গম্ভীরভাবে টিকিট কাটল। মাঝে মাঝে অদিতির সঙ্গে চোখাচোখি হতে গভীরভাবে তাকিয়ে রইল। বাবলু সঙ্গে আছে—তাই যে-সব কথা বলতে ইচ্ছে করছে তা সে বলতে পারছে না। একবার সে শুধু একটু ফিসফিস করে বলেছিল, তোমাকে কী সুন্দর দেখাচ্ছে অদিতি, সত্যি।

অদিতি অনাদিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, যাঃ।

ইন্দ্রজিৎকে কেউ বলে দেয়নি, তবু যেন সে মনে মনে কল্পনা করে রেখেছিল অদিতিদের নতুন বাড়ি হবে একটা সুন্দর বাংলো ধরনের একতলা আলাদা বাড়ি, সামনে থাকবে চমৎকার একটা বাগান, কেন জানি না সে ভেবেছিল, বাড়িটার রং হবে ধবধবে সাদা। বাগান পেরিয়ে শ্বেতপাথরের সিঁড়ি, তার কাছেই থাকবে বৈঠকখানা।

ঠিকানা মিলিয়ে এসে দেখল, একটা লালচে রঙের দোতলা বাড়ি, সামনে একটুখানি জমি আছে বটে, তাতে কয়েকটা এলোমেলো গাছ—কোনও বাগান নেই। বাড়ির দোতলায় বাড়িওলা থাকে, একতলাটা শুধু অদিতিদের। দরজায় অন্য লোকের নাম লেখা পাথরের ট্যাবলেট লাগানো। গেটের কাছে এসে দাঁড়াতেই একটা বিশাল কুকুর ঘেউ ঘেউ করে ছুটে এল। ইন্দ্রজিৎ কুকুরকে বিষম ভয় পায়, সে সঙ্কুচিত হয়ে এক পাশে সরে দাঁড়াল।

একটু পরেই ভেতর থেকে একুশ-বাইশ বছরের একটি সুন্দর মতন ছেলে বেরিয়ে এল, তার পরনে প্যান্ট ও তোয়ালে জামা, মাথা ঝাঁকড়া-কোঁকড়া চুল। ছেলেটি বলল, কী চাই? ওরা কেউ কিছু বলার আগেই বাবলু বলে উঠল, আমরা এই বাড়িটা ভাড়া নিয়েচি। আমরা বাড়ি দেখতে এসেছি। ছেলেটি বলল, ও, আপনারা মিঃ সেনগুপ্তর ফ্যামিলি থেকে? আসুন।

ছেলেটি শক্ত হাতে কুকুরটার বগলস চেপে ধরে গেট খুলল। মাঠটা পেরুবার সময় বলল, আপনারা তিন ভাই বোন?

ইন্দ্রজিৎ বলল, না, না।

অদিতি বলল, উনি আমার দাদা নন।

ইন্দ্রজিৎ বলল, আমি ওদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকি। সঙ্গে এসেছি।

ছেলেটি বলল, ও, নমস্কার। আমার নাম সিদ্ধার্থ মজুমদার।

ইন্দ্রজিং বলল, নমস্কার। আমার নাম ইন্দ্রজিৎ রায়চৌধুরী। ওর নাম অদিতি, আর এর নাম বাবলু ভাল নাম দেবকুমার।

একতলায় সাড়ে তিনখানা ঘর অদিতিদের, নতুন বাড়ি—তাই ঘরগুলো বেশ পরিষ্কার, বাথরুমটা বেশ বড়সড়ো, রান্নাঘরে গ্যাসের কানেকশান আছে। সিদ্ধার্থ ওদের ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাল। সিঁড়ির পাশের ঘরটাও ওরা ভেবেছিল অদিতিদের, কিন্তু সেই ঘরের দরজা খুলে সিদ্ধার্থ বলল, এইটা আমার পড়ার ঘর। আসুন, একটু বসবেন। চা খাবেন তো? আপনি নিশ্চয়ই খাবেন, আর আপনি? দ্বিতীয় প্রশ্ন করা হল অদিতিকে, সে উত্তর দেবার আগেই বাবলু বলল, আমিও চা খাব।

অদিতিকে এর আগে কোনও ছেলে আপনি বলে কথা বলেনি, সে লাজুকভাবে ঘাড় হেলাল শুধু। সিদ্ধার্থ বলল, বসুন, দাঁড়িয়ে রইলেন কেন, বসুন।

বেশ ছিমছাম সাজানো ঘরখানা। রেক্সিন মোড়া বড় টেবিল, বইয়ের তাকে অনেক বই—বেশির ভাগই ইংরেজি। দেয়ালে ব্র্যাডমান, ফ্র্যাঙ্ক ওরেল, ডব্লু জি গ্রেস ইত্যাদি বাঁধানো ছবি। চাকর এসে চা দিয়ে গেল। ইন্দ্রজিৎ ছবিগুলো দেখছিল, তাই সিদ্ধার্থ বলল, আমি কলেজের ক্রিকেট টিমের স্কিপার। আপনার কোন্ কলেজ? আমার সেন্ট জেভিয়ার্স। থার্ড ইয়ার।

ইন্দ্রনাথ বলল, আমি আশুতোষে পড়ি।

—ও। কোন ইয়ার?

—ফার্স্ট ইয়ার।

দুনিয়ার সমস্ত থার্ড ইয়ারের ছেলে সমস্ত ফার্স্ট ইয়ারের বালকদের দিকে যে-রকম কৃপার দৃষ্টিতে তাকায়, সিদ্ধার্থ সেইরকম সূক্ষ্মভাবে তাকিয়ে বলল, আপনাদের আশুতোষে স্পোর্টসের ব্যাপারে বোধহয় তেমন এনকারেজমেন্ট নেই। ওখানে তো ইউনিয়ন নিয়েই সব সময় গণ্ডগোল লেগে আছে—

ইন্দ্রজিৎ বিব্রতভাবে বলল, আমি ওসবের মধ্যে থাকি না। বাড়ির কাছে বলেই আশুতোষে ভর্তি হয়েছি, ইচ্ছে করলে আমি প্রেসিডেন্সিতেও পড়তে পারতুম। আমিও ফার্স্ট ডিভিশান পেয়েছিলুম।

কথাটা বলেই ইন্দ্রজিৎ লজ্জা পেল। ছি, ছি, ফার্স্ট ডিভিশনের কথাটা নিজের মুখে বলা তার উচিত হয়নি। অদিতি চকিতে একবার ওর দিকে তাকাল। সিদ্ধার্থ খুব ভদ্র, সে ওর লজ্জা ঢাকা দেবার জন্য তাড়াতাড়ি বলল, না, না, সব কলেজেই পড়াশুনা প্রায় এক। বাড়ির কাছে কলেজই ভাল৷ আননেসেসারিলি বাস জার্নির অরডিয়েল ভোগ করতে হয় না। আর, আপনি কোন কলেজে?

এবার অদিতির লজ্জা পাবার পালা। সে টেবিলে আঙুল দিয়ে আঁচড় কাটতে কাটতে বলল, আমি কলেজে পড়ি না। আমার ক্লাশ ইলেভেন—

বাবলু বলল, আমি ক্লাশ সিক্সে পড়ি। আচ্ছা, এ বাড়ির ছাদ আছে?

—হ্যাঁ আছে, ওই সিঁড়ি দিয়ে সোজা উঠে যাও। যাও না কোনও ভয় নেই, আমি কুকুর বেঁধে রেখেছি।

অদিতি আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করল, আপনার কুকুরটার নাম কি?

—জুলি। আপনি কুকুর ভালবাসেন?

—হ্যাঁ।

—ওই কুকুরটাকে নিয়েই আমার বেশি সময় কাটে। বাড়ি তো ফাঁকা—মা, বাবা আর আমি। আমার বাবা টেনান্ট নেবাব ব্যাপারে খুব সিলেক্টিভ। পছন্দ না হলে নেন না, তিন মাস আমাদের ওই অ্যাপার্টমেন্ট খালি পড়ে আছে। আপনারা এলে আবার বাড়িটা বেশ জমজমাট হবে।

বেশি দেরি করলে বাড়িতে চিন্তা করবেন, তাই ইন্দ্রজিৎ এবার ওঠার কথা বলল। বাবলুকে ডেকে আনা হল। ঢোকার সময় নজর করেনি, এবার ওরা লক্ষ করল সামনের জমিটায় একটা ছিপছিপে সাদা রঙের গাছ। ইন্দ্রজিৎ জিজ্ঞেস করল, এইটা ইউক্যালিপটাস, না?

সিদ্ধার্থ বলল, হ্যাঁ। আমাদের মধুপুরের বাড়িতে অনেক ইউক্যালিপটাস আছে। এখানে তিনটে লাগানো হয়েছিল, ওই একটাই বেঁচেছে।

—এর পাতাগুলোর গন্ধ এমন সুন্দর হয়!

বাবলু বলল, ইন্দ্রাদা, আমায় দুটো পাতা পেড়ে দাও না।

ইন্দ্রজিৎ বলল, এখন না, এ বাড়িতে তো থাকবেই, মাটিতে অনেক শুকনো পাতা পাবে—শুকনো পাতাতেও গন্ধ হয়।

—না, এখন দাও—

নীচে একটাও শুকনো পাতা পড়ে নেই। ইন্দ্রজিৎ এদিক-ওদিক তাকিয়ে খুঁজছিল। সিঁড়িতে দাঁড়ানো সিদ্ধার্থ বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, নিন না কয়েকটা পাতা। গন্ধটা ভাল লাগবে।

হাতের নাগালে একটাও পাতা নেই। সাদা রঙের গুঁড়িটা সোজা উঠে গেছে। একটু উঁচুতে কচি-কচি চিকন পাতা। ইন্দ্রজিৎ গোড়ালির ওপর ভর দিয়েও পাতা ছুঁতে পারল না। তখন একটু ছোট লাফ দিয়ে ধরার চেষ্টা করল, তাও হাত যায় না। বাবলু সোৎসাহে বলছে, ইন্দ্রদা, আরও জোরে লাফাও, আর একটু। ইন্দ্রজিৎ আরও জোরে লাফাল, তবু হাত যায় না, আরও জোরে লাফাতেই পকেট থেকে মানিব্যাগ, কলম ছিটকে পড়ে গেল। সে সেগুলো নিচু হয়ে তুলতে যেতেই সিদ্ধার্থ বলল, দাঁড়ান, আমি পেড়ে দিচ্ছি।

সিদ্ধার্থ সাবলীলভাবে একটিমাত্র লাফ দিয়ে একটা ছোট ডাল ধরে ফেলল, কয়েকটা পাতা ছিঁড়ে এনে, দুটো দিল বাবলুকে বাকিগুলো হাতের তালুতে মুড়ে কচলাবার পর বলল, এবার দেখুন, কী সুন্দর গন্ধ! সে হাতটা বাড়িয়ে দিল অদিতির দিকে। অদিতি মুখ নিচু করে বড় শ্বাস টেনে বলল, আঃ, কি সুন্দর কচি কচি গন্ধ! আঃ!—অদিতি আবার নিজের থেকেই নাকটা কাছে এনে সিদ্ধার্থের হাতে ছুঁইয়ে বলল, কী চমৎকার লাগছে না গন্ধটা, ইন্দ্রদা, দেখুন!

ইন্দ্রজিৎ নিজের নাকটা নিয়ে এল সিদ্ধার্থর হাতের দিকে। কিন্তু দমবন্ধ করে রইল। নিশ্বাসে সে ঘ্রাণ নিল না।

বাইরে বেরিয়ে বাবলু অবিরাম বকবক করছিল, অদিতি একবার জিজ্ঞেস করল, ইন্দ্রদা, অ্যাপার্টমেন্ট মানে কি?

—ভাড়া দেবার ফ্ল্যাটকেই কায়দা করে অ্যাপার্টমেন্ট বলছিল।

—ওঁর ইংরিজি উচ্চারণ ভারী চমৎকার না? কী রকম সুন্দরভাবে বলছিলেন!

কথা ছিল ইন্দ্রজিৎ আর রঞ্জিত মালপত্র নিয়ে ওদের সঙ্গেই যাবে। কিন্তু শনিবার দিন বেশি রাত্রে বাড়ি ফিরে ইন্দ্রজিৎ মাকে বলল, মা, কাল আমায় খুব ভোরে ডেকে দেবে। আমাদের কলেজের পিকনিক আছে।

রত্নপ্রভা বললেন, সে কি রে? কাল ওরা বাড়ি পাল্টাচ্ছে, তুই ওদের সঙ্গে যাবি না?

—না, উপায় নেই। কলেজের প্রফেসাররা সব যাচ্ছেন—আমাকে যেতেই হবে। ডেকে দিও, ঠিক।

ইন্দ্রজিৎ পাশের ঘরে যেতেই রত্নপ্রভা স্বামীকে বললেন, ও পাশের গিন্নি দুটো মিষ্টি কথা বলে ছেলে দুটোকে একেবারে চাকরের মতন খাটাচ্ছে। আমি হলে পরের ছেলেকে ওরকমভাবে খাটাতে পারতুম না।

ইন্দ্রজিৎকে ডাকতেও হয়নি, সারারাত বুঝি সে জেগেই ছিল। খুব ভোর, তখনও আলো ফোটেনি, কারুকে কিছু না বলে হাতমুখ ধুয়ে জামাকাপড় বদলে সে বেরিয়ে পড়ল। হাঁটতে হাঁটতে শিয়ালদহ স্টেশনে এসে শুনল ফার্স্ট ট্রেন ছাড়ছে ক্যানিং-এর দিকে। ক্যানিং-এর টিকিট কেটে সে উঠে পড়ল। এই প্রথম সে একা একা ট্রেনে যাচ্ছে, কিন্তু তার একটুও ভয় করছে না। জানলার ধারে মাথা রেখে সে ভোরের টাটকা হাওয়া বুক ভরে নিতে লাগল।

খানিকটা বাদেই দেখল, একটা স্টেশনের নাম চম্পাহাটি। হঠাৎ সেখানেই নেমে পড়ল ইন্দ্রজিৎ। প্ল্যাটফরমে দাঁড়িয়ে চা আর এস বিস্কুট খেল। তারপর স্টেশন ছেড়ে পুকুর পাড় দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাজারে এসে পৌঁছুল। বাজার পেরিয়েও সোজা রাস্তা, সেই রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে সে দেখল একটা কচুরিপানা ভর্তি খাল। খালের উঁচু পাড় ধরে ইন্দ্রজিৎ আপন মনে হাঁটতে লাগল, পাশে দু’-একখানা নতুন বাড়ি তৈরি হচ্ছে—তারপর ফাঁকা মাঠ। একটা ফণিমনসার গাছে দুটো প্রজাপতি ছুঁই-ছুঁই খেলার মতন একবার করে বসেছে আর উড়ে যাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে ইন্দ্রজিৎ আপন মনে বলল, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়লেই ভাল ইংরিজি জানা হয় না। আমিও ইংরিজিতে সিক্সটি সিক্স পারসেন্ট নম্বর পেয়েছিলুম। অমন কথায় কথায় কায়দা করে ইংরিজি বলা আমি পছন্দ করি না। বুঝলে?

খালের পাড় ধরেই ইন্দ্রজিৎ হাঁটতে লাগল। ভোরের ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা হাওয়ায় তার এত ভাল লাগছিল যে সে ঠিক করল সারাদিন ওই মাঠের মধ্যেই থাকবে। একটু বাদে সে আপন খেয়ালে দৌড়তে লাগল। যেন সে ছুটতে ছুটতে গিয়ে ওই খালটা কোথায় শেষ হয়েছে—তাই দেখবে! বেশ কিছুক্ষণ দৌড়োবার পর সে হাঁপিয়ে গিয়ে এক জায়গায় বসল। তখন বড় বড় নিশ্বাস নিচ্ছে। খালের জলের অল্প স্রোতে কচুরিপানাগুলো ভেসে যাচ্ছে। কয়েকটা মাটির ডেলা কুড়িয়ে নিয়ে টুপটুপ করে জলে ছুড়তে লাগল। এবার আমি ওই ফুলটায় লাগাব, ওই যে, ওইটা।

ঠিক টিপ মতন এক জায়গায় ঢিল লাগাবার পর ইন্দ্রজিৎ মনে মনে বলল, সবাই উঁচু দিকে লাফাতে পারে না। আমি হাই জাম্পে পারব না। কিন্তু আমার সঙ্গে রানে রেস দিয়ে কেউ পারবে? আসুক দেখি! আমি সামনে ছুটে যাবার প্রতিযোগিতায় ফার্স্ট হব!

৭ মে ১৯৬৭

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *