2 of 2

ঈর্ষা – আবুল বাশার

ঈর্ষা – আবুল বাশার

গৈরিকা বুঝতে পারছিল না ঠাকুরদা উমেশচন্দ্র দেবজিৎকে কেন ডেকেছেন। মাত্র মাস তিন হল দেবজিৎ মফস্বল শহরে অধ্যাপকের চাকুরি পেয়েছে, সেই খবর পৌঁছনোর পর ওর সঙ্গে গৈরিকার আর দেখা হয়নি। চাকুরিতে যেদিন দেবজিৎ যোগ দিতে গেল কেবল সেদিন গৈরিকাকে অদ্ভুত সুরে বলেছিল—অধ্যাপকের চাকরি আমাকে ঠিক মানায় না।

সলজ্জ সেই উক্তি শুনে গৈরিকা সকৌতুকে মন্তব্য করেছিল—বিদ্যাসাগরমশাই তোমার চেয়েও দেখতে খাটো ছিলেন। ব্যক্তিত্বের জোর থাকলে সব মানায়। তুমি সাগর নও মানি, তবু মস্ত দিঘি তো বটে।…

—ফের তোমার সঙ্গেও আমায় মানায় না কিন্তু। এবার বলো, ভালবাসার জোর থাকলে সবই মানায়।—সঙ্গে সঙ্গে দেবজিতের সকুণ্ঠ জবাব।

বলে ফেলে দেবজিৎ আপন মনে হো হো করে হেসে যেন তার মিষ্ট কোমল ভদ্র চরিত্রটিকে আরও মধুময় করে তুলেছিল গৈরিকার ঘনিষ্ঠ নিবিড় চোখের অপলক দৃষ্টির ছায়ায়। গৈরিকার চোখ দুটি ঈষৎ আহত হয়েছিল এক চাপা অভিমানে শুধু। তার মনের মানুষটি ওই রকম, চরম সাফল্যের মুহূর্তেও নিজের কোথায় খামতি টেনে বার করে অন্যের সামনে সেই আপন সার্থকতার যেন আধেক মর্যাদা স্নান করে দিতে চায়। এত কম বয়েসে এম. এ. পাশ করেছে ফার্স্ট ক্লাশ পেয়ে এবং ছ’মাস মাত্র বেকার থেকেছে—তবু যেন এসব কোনও গৌরবেরই বিষয় নয়।

দেবজিৎ বলে—হতভাগ্য দেশে চরম বেকারত্ব। এখানে চাকরির সাফল্যে গর্ব করে মূর্খরা। আমি ক্ষীণকায় বটে, কিন্তু মূৰ্থ নই।

—মেধার অহঙ্কার কি খারাপ?

গৈরিকার এই সবিস্ময় প্রশ্নের জবাবে বুদ্ধিমান দেবজিতের অভিব্যক্তি সরেস বড়।—রূপসী সুন্দরীর সামনে মেধার অহঙ্কার ভাল। তদ্ব্যতীত সর্বত্র খারাপ।

গৈরিকা বুঝতে পারে এই আক্রমণ তারই উদ্দেশে। গৈরিকা তখন চোখে অদ্ভুত কটাক্ষ হেনে বলে—সুন্দরীরা তবে নিরভিমানীর অহঙ্কারও টের পায়, কী বলো?

বাংলা ভাষার সকল মাধুরী মুখের শব্দে আয়ত্ত করা কঠিন, এ বিষয়ে ইংরেজির অধ্যাপক অতি তরুণ দেবজিৎ সবিশেষ সচেতন, কিন্তু অসম্ভব না হলে কথার মধ্যে ইংরেজি শব্দের দ্বারস্থ হতে তার আপত্তি আছে। বাংলা ভাষার প্রতি তার এই মমতা আর পক্ষপাত গৈরিকাকে আশ্চর্য করে। কথার ফাঁকে ইংরেজি শব্দের যোগ্য ব্যবহারে ভাবের যে ঘনত্ব তৈরি হয়, তাকে পরিহার করে চলা সহজ নয়। সহজ তখনই হয়, যখন কেউ একজন বাংলা ভাষার ভিন্ন এক যোগ্যতা মুখের শব্দে যোজনা করতে সক্ষম, শব্দের গূঢ় রহস্যও সে জেনেছে। তার শব্দের চালে থাকে শব্দেরই এক অতিরিক্ত শক্তি। শব্দকে শব্দাতিরিক্ত করার মৌখিক ব্যবহার থ হয়ে শোনে গৈরিকা। অথচ অচেনা কোনও শব্দ যে হাতড়ে ফেরে এমন মানুষ দেবজিৎ নয়। এই ধরনের বিশেষ সম্পন্ন এক বাঙালি অভ্যাস গৈরিকাকে খর্বাকৃতি দেবজিতের প্রেমে ফেলে দেয়।

অবশ্য দেবজিৎ আকারে ছোট, কিন্তু নিন্দনীয় রকমের বেঁটে নয়। চোখে লাগে সামান্যই, চাইলে সেই লাগাটিকে উপেক্ষাও করা যায়। অপর পক্ষে গৈরিকা রূপেই শুধু দৃপ্ত নয়, স্বাস্থ্যে আর গঠনে আর উচ্চতায় গড়পড়তা মাঝারির দল ছাড়িয়ে অনির্বচনীয় রকমের সুন্দর। টানা চোখে স্নিগ্ধ আলো গভীর কালো বৃত্তে প্রকীর্ণ থাকে, সাদা আয়ত ডিমে মায়া পড়ে উদগত মাধুর্যে, যেন তা ভরাট বুকের তল থেকে আসে, বুকে থাকে পুরুষের পক্ষে অলঙ্ঘ্য অহঙ্কার, বলিষ্ঠ তীক্ষ্ণতা এক—মুখের ডৌল থুতনি দীপ্র আর ঠোঁটে দৃঢ় ভাবখানি লেগে আছে ঈষৎ হাসির স্ফুরণে আর আছে অলক্ষ্য বিষন্নতার ছোঁয়া— সব মিলে গৈরিকা দেবজিতের সব খর্বতার ওপর আগুন ধরা রাধাচূড়ার মতো আলো ফেলে দাঁড়ালে সব সময় মনে হয় পৃথিবী কোথাও তাপূর্ণ থাকেনি—রূপের চেহাবার স্বাস্থ্যের সব অভাব ঘুচিয়ে দিয়ে দেবজিৎকে সৌন্দর্যের আলো দিয়ে ঢেকে ফেলেছে গৈরিকা—এও এক মায়া—পাশে দাঁড়ানোব সাহসে সম্পন্ন হয় সে মায়াবী আলোর জয়। কারণ যে অভাব মোচন না করতে পারলেও, আড়াল করতে পারে, সে কম নয়।

উমেশচন্দ্র কত দিন তাঁর নাতনির পাশে দেবজিৎকে দেখে ভেবেছেন সৌন্দর্যের এমন আপ্রতিহত প্রাচুর্যের কাছে ছেলেটি যেন কাঙাল। নাতনির পছন্দের তারিফ তিনি কিছুতেই করতে পারেন না। দৃষ্টি কতবার যে ব্যাহত হয়!

একদিন ওদের দুটির দিকে অপলক চেয়ে থাকতে থাকতে উমেশচন্দ্র তাঁর প্রাচীন গাম্ভীর্যে কী ভেবে সহসা বললেন—শুনেছি তোমার মা খুবই সুন্দরী। এবং এখনও তিনি যথেষ্ট সুন্দর দেখতে। শোনা যায়, এখনও তিনি ইচ্ছা করলে বিবাহ করতে পারেন। তোমার বাবা কি তোমার মতো ছিলেন?

উমেশচন্ত্রের কথার তলদেশবর্তী চাপা শীতল অপমান দেবজিতের কাঁধে এসে চেপে পড়ে, ফলে কাঁধের একদিক সামান্য কাত হয়ে যায়। সে তখন স্পষ্ট সুরে বলে ফেলে—মা আমার সুন্দরীই নয়, তার এক প্রেমিক আছে, আমি জানি। বিয়ের আগে থেকে মায়ের একটি প্রেম ছিল। আমার জন্মের তিন মাস আগে বাবার মৃত্যু হয়। আমার বুদ্ধি পড়া অবধি মায়ের প্রেম আমি দেখে আসছি। ইন্দ্রনাথবাবু আমার পরিচিত। এসব কথা আপনাকে আমার আগেই বলা উচিত ছিল। গৈরিকাও ঠিক জানে না, ইন্দ্রনাথবাবু আমাদের বাড়ি কেন আসেন।

—আমার কথায় তুমি কি অপমানিত হলে?

—আপনার কথার মধ্যে কোথাও কোনও আড়াল নেই। যা ভেবেছেন প্রকাশ করেছেন। কথার মধ্যে একটা তির্যক ইঙ্গিতও আমি লক্ষ করেছি।

—না দেবজিৎ। কোনও ইঙ্গিত করা আমার স্বভাব নয়। তোমার মা বিয়ে করলেই তো পারেন। তা হলে আমরা খানিকটা স্বস্তি লাভ করি। আমার কিছু বন্ধু বলেছে, গৈরিকা-দেবজিতেব বিয়ের চেয়ে তারা মানসী-ইন্দ্রনাথের বিয়েতে বেশি আগ্রহী।

—আমার আর গৈরিকার সম্বন্ধের ব্যাপারে আপনার কিছু অনাগ্রহ আছে। সেটা প্রকাশ করার জন্য আমার মায়ের প্রসঙ্গ না টানলেই পারতেন। ইন্দ্রনাথবাবুকে আমি পছন্দ করি।

—সেকথা এমন করে বলার কোনওই বাহাদুরি নেই দেবজিৎ। তোমার কথা খুব অশ্লীল শোনাচ্ছে। তোমার স্বভাবে একটা উগ্রতা আছে, আমি তা পছন্দ করি না।

—তাই বটে। তবু তর্ক করব না। তবে একটা কথা বলতেই হবে আমাকে। মায়ের মধ্যে আমি কিছু অশ্লীল দেখিনি। মাকে আমার ভাল লাগে। আমি ইন্দ্রনাথবাবুর কাছে ভদ্রতা আর মায়ের কাছে আত্মসংযম শিখেছি।

জানালার কাছে গেলাসভর্তি ঈষদুষ্ণ দুধ হাতে নিঃশব্দে এসে দাঁড়িয়ে গৈরিকা সেদিন ওদের কথা শুনতে শুনতে চৌকাঠে ছায়ার মতো সরে আসে। চাপা প্রবল এক উত্তেজনায় এবং ভয়ে ওর হাত কেঁপে যায়। এই ধরনের এক চোরা আশঙ্কা মনে মনে সে পোষণ করত অকারণ। ভাবত, ঠাকুরদা দেবজিৎকে হয়তো কবে আক্রমণ করে বসবেন অতর্কিতে। গৈরিকার কাছেও দু’একদিন দেবজিতের মায়ের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন তিনি। ইন্দ্রনাথবাবুর নাম করে জানতে চেয়েছেন, দেবজিৎ ওই লোকটিকে মেনে নেয় কী করে? লোকটিকে প্রশ্রয় দেবার মানে কী? মানসী আর ইন্দ্রনাথের সম্বন্ধ কি সত্য?

এসব প্রশ্নের উত্তর গৈরিকা জানে না। কখনও দেবজিৎ তাকে কিছুই জানায়নি। নিজে থেকে না বললে তার মায়ের গোপন সম্পর্ক বিষয়ে প্রশ্ন করা কখনওই শোভন নয়।

গৈরিকার হাত কেঁপে যায়। হঠাৎ সে শুনতে পায়, ঠাকুরদা কঠিন সুরে যেন আর্তনাদ করে উঠলেন—তোমার ভদ্রতা এবং সংযম কী বস্তু আমার জানা নেই। ইন্দ্রনাথের সঙ্গে তোমার মায়ের যে ধরনের মাখামাখির খবর কানে আসে, তা আমার মতো প্রাচীন মানুষের পক্ষে কানে করা রীতিমত কষ্টকর। অথচ তুমি কী করে অবিচলিত থাকো ভেবে পাইনে। তোমার কি কিছুই চোখে লাগে না? তোমার হয়তো কোনও উচ্চ আধুনিক রুচি আছে—কিন্তু আমি পুরনো লোক, সমাজে থাকি—এই অবস্থায় গৈরিকা তোমাকে বিয়ে করে কীভাবে বসবাস করবে তাই ভাবি।

—আমার মায়ের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে আপনার কৌতূহল দেখতে পাচ্ছি। আপনার বন্ধুরা প্রতিদিন এই নিয়ে বৈঠক করেন, শুনতে পাই। ভাবছি, এ পাড়ায় আমরা আর থাকব না। নামেই মাত্র শহরের উপকণ্ঠ—এত গ্রাম্যতা এখানে যে দম বন্ধ হয়ে আসে।

—তুমি আমার বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাও দেবজিৎ। কোনও প্রয়োজনেই এখানে আর আসবে না। তোমার মুখের ভাষার খুব জোর, নাতনিকে তুমি মুগ্ধ করেছ, আমায় মজানো সহজ নয় জানবে। যাও, চলে যাও। তোমার মতো জ্ঞানের চর্চা আমি করিনি। বৈঠক করি চাষাভুষোর সঙ্গে, তাই বেশ। তাই করব।

ঠিক এই মুহূর্তে গৈবিকার হাতের গেলাস মেঝেয় খসে পড়ে সশব্দে। দুধ গড়িয়ে যায় গাঢ় ধারায়। সেদিকে চোখ যায় দেবজিতের। লক্ষ করে গৈরিকার মুখমণ্ডলে অস্বাভাবিক রক্তোচ্ছ্বাসে রক্তাভ এক লজা ছায়ার মতো চঞ্চল হয়েছে, ঠোঁট কাঁপছে মৃদু মৃদু, চোখে তার চরম সঙ্কোচ কুণ্ঠাজড়িত হয়ে কেমন যেন দিশে হারিয়েছে।

দেবজিৎ তারপর আব দাঁড়ায় না। এবং তারপর তিন মাস কেটে যায়। উমেশচন্দ্র কেন দেবজিতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান, তাকে কেন ডাকছেন গৈরিকা কোনও প্রকার অনুমান করতে পারে না, ফলে সে নানা প্রকার ভাবতে থাকে। ঠাকুরদা ডাকছেন একথা মুখ ফুটে বল গৈরিকার পক্ষে অত্যন্ত কঠিন।

ইন্দ্রনাথকে এই প্রথম যে দেখছে এমন নয়, কিন্তু গৈরিকার চোখে আজ সেই ব্যক্তিটি যেন অন্য রকম—প্রৌঢ় লোকটি মাথা উচু করেন না কখনও, কারও চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারেন না। অন্যকে যখন তিনি কোনও কথা বলেন, তা উদ্দিষ্ট ব্যক্তির অস্তিত্বকে অতিরিক্ত সমীহ করার কারণে, সেই কথা তখন আপন মনে আপনাকে শোনানোর সামিল হয়ে ওঠে। কণ্ঠস্বর, অনেকটা অনুচ্চ গলায় কোনও কিছু সুর করে পড়ার মতো শোনায়। ভাবতে আশ্চর্য লাগে, মানুষটি আজও বিয়ে করে উঠতে পারেননি। মানসীর স্বামী বেঁচে থাকতেই তিনি এই বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ গড়েছিলেন। দেবজিৎ জন্মাবধি তাকে দেখছে।

ইন্দ্রনাথ বললেন—তুমি কি এক কাপ খাঁটি দুধের কফি খাবে মা? আমি ঘোষপাড়া থেকে ওই দুধ জোগাড় করে আনি। কফি আমি নিজে হাতে তৈরি করে দেব। পাশের ঘরে দেবজিতের মা বিছানায় শুয়ে নভেল পড়ছেন, তাঁর উঠে এসে কফি তোয়ের করতে অসোয়াস্তি হবে। বরং আমরা ওঁকে এক কাপ যদি করে দিতে পারি, উনি প্রসন্ন হবেন। আমার কোনও কাজ নেই। করবার মতো কোনও কাজও এরা আমায় দেয় না। ফলে আমি চাকর-বাকরের কাজগুলো নিজে থেকে জোগাড় করে নিই। খারাপ করি, তুমিই বলো? অবশ্য তোমায় বলতে হবে না, আমি জানি, খারাপ কিছুই করি না। দেবজিতের বাবা বেঁচে থাকলে, এই সবই করতেন।

কফি তৈরি করে এক কাপ তিনি মানসীর শায়িত শরীরের মাথার কাছের তেপায়ের ওপর সসংকোচে নিঃশব্দে রাখলেন, তারপর অন্য আর এক কাপ গৈরিকাকে এগিয়ে দিলেন। অবশিষ্ট কাপটি নিজে নিয়ে একটা টানা উষ্ণ চুমুক দিয়ে বললেন—তা বলে ভেবো না, আমি এদের কোনও আপনজন। আমি কেউ না। দেবজিতের বিয়ে হয়ে গেলে আমি চলে যাব। আমি আর থাকব না। ক্যানিং-এর ওধারে রেললাইনের ধারে একখণ্ড জমি কিনে রেখেছি। বাড়ি করে একলা থাকব। আমি নিজে হাতে রান্না করতে পারি। এঁচোড় যে গাছ-পাঁঠা আমার রান্না না খেলে বুঝবে না। বলে ইন্দ্রনাথ হো হো করে হাসতে লাগলেন, তারপর বললেন—আমার কোনওই অসুবিধা নেই। মানসী ইদানীং হামেশাই বলছে আমি যেন এখানে আর না আসি। দেবজিতের অনুপস্থিতিতে এখানে আসা উচিত না। তোমার ঠাকুরদা উমেশচন্দ্র চিঠি লিখে মানসীকে এই পরিবারের মর্যাদা রক্ষার কথা লিখেছেন।

গৈরিকা ইন্দ্রনাথের কথায় চমকে উঠল। ঠাকুরদা শেষ অবধি চিঠি লিখে এদের অপমান করতে দ্বিধা করেননি। বোঝাই যায় কতকাল পর এ সংসারে অশান্তির কালো ছায়া পড়েছে। মাথা নিচু করা শান্ত নিরীহ সংসারে অধিকারহারা মানুষটি এবার চরম এক দুর্দশার মধ্যে পড়বেন। কোথায় কীভাবে থাকবেন নিজেও স্থির করতে পারছেন না

দেবজিৎ কোথায় গেছে এঁরা জানেন না। খুব ভোরে বেরিয়েছে। কেবল বলে গেছে ফিরতে দেরি হবে। দেরি মানে কত দেরি। বিকেল হয়ে এল। গৈরিকার মন দমে গেল ঠাকুরদার পত্রাঘাতের কথা শুনে। বুঝতে পারছিল, ইন্দ্রনাথের কোনও ধরনের উপস্থিতিই ঠাকুরদা সহ্য করতে পারছেন না। বেচারি এই সংসার না ছাড়লে তিনি তাঁর নাতনির বিয়েতে সম্মত হবেন না।

ইন্দ্রনাথ বললেন—দেবজিৎ খুব ছেলেবেলা থেকে অনেক সহ্য করেছে। ইন্দ্ৰকাকা কে? কেন তোমাদের বাড়ি আসে? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে না পেরে ছেলেবেলায় দেবজিৎ গোপনে একলা অনেক কান্নাকাটি করেছে। আমি ওর কষ্ট টের পেতাম। আমার ওপর ওর বিদ্বেষ ছিল, আবার শ্রদ্ধা আর মায়াও যে না ছিল তা নয়। আমি খুব লোভী। জোর করে এখানে এসে থেকেছি দিনে রাতে। আমি তো একটা পুরনো মেসে থাকি—সেখান থেকে যাই আসি। এখন সেই মেসেও আর ঠাঁই হবে না।

কথা শেষ করতে পারলেন না ইন্দ্রনাথ কাঁধে কাপড়ের থলে, ধুতি পাঞ্জাবি পরা, পায়ে কোলাপুরি চটি, দেবজিৎ এসে ঘরে ঢুকল। ইন্দ্রনাথের সঙ্গে চোখাচোখি হতে তার দাঁড়া ঈষৎ শক্ত হয়ে গেল যেন। শক্ত দৃষ্টি ইন্দ্রনাথকে বিঁধছে বলে মনে হয়।

থতমত ভঙ্গিতে ইন্দ্রনাথ বললেন—গৈরিকাকে আমি কোনও দুঃখের কথা বলিনি দেবজিৎ। কোনও স্বার্থের কথাও বলিনি। আমি ওর কাছে আশ্রয় চাইনি। তোমার কোনও অসম্মান আমার দ্বারা হবে না। গৈরিকাকে আমি মাত্র এক কাপ গরম কফি করে দিতে পেরেছি। তুমি এসেছ, এবার আমি চলে যাব।

বলতে বলতে ইন্দ্রনাথ পাশের ঘরে ঢুকে সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে চলে আসেন। তারপর আপন মনে বলেন—মানসী আমার তোয়ের করা কফি খায়নি। আমার মতো মানুষের ওপর কি কারও রাগ করা উচিত? কফি জুড়িয়ে জল হয়ে গেছে। মানসী ঘুমিয়ে পড়েছে। দুঃখ পাবে, যখন ঘুম ভাঙবে, শুনবে গৈরিকা চলে গেছে। অবশ্য গৈরিকাকে বসবার জন্য বলেছে, উপন্যাসটার শেষ পাঁচ পাতা শেষ করে আসছি বলে বিছানায় গড়িয়ে পড়েছে। আজ আমার সাহস নেই, আগের মতো ওকে ডেকে তোলার সাধ্য হবে না।

হঠাৎ দেখা যায় মানসী তন্দ্রাতুর চোখ মেলে এ ঘরের চৌকাঠের কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন। গৈরিকার চোখে চোখ রেখে মিষ্টি করে নিঃশব্দে হাসলেন। তারপর বললেন—তাড়াতাড়ি ওকে চলে যেতে বলো খোকা। নইলে ট্রেন পেতে দেরি হবে।

—তোমরা কি আজকাল ভাববাচ্যে কথা বলতে শুরু করেছ? কাকার তৈরি কফি না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়া তোমার অন্যায় হয়েছে। গৈরিকাকে বসিয়ে রেখে নভেল পড়া ঠিক হয়নি। গৈরিকা কী ভাবছে, ওকে প্রশ্ন করে জেনে নাও।—সহাস্য ভদ্রতায় বলে ওঠে দেবজিৎ।

বলে কাঁধের ব্যাগ নামিয়ে রেখে দেবজিৎ বাথরুমে ঢুকে যায়। প্রৌঢ় ইন্দ্রনাথ পথে নেমে চলে যান। যেতে যেতে বারবার পিছন ফিরে দেখছিলেন। আশ্চর্য এক অভিজ্ঞতা হচ্ছিল গৈরিকার।

ফেরার সময় গৈরিকাকে বাসস্টপ অবধি এগিয়ে দিতে আসে দেবজিৎ। পথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পাশাপাশি কথা হয়।

গৈরিকা হঠাৎ প্রশ্ন করে—আমার কাছে উনি আশ্রয় চাইবেন কেন?

দেবজিৎ ম্লান হেসে বলে—ওঁর এত দিনের মানসিক আশ্রয়টুকু হারিয়ে যেতে বসেছে বলে ধারণা হয়েছে। তুমি যদি বউ হয়ে আসে, তা হলে ওঁর ধারণা, এ বাড়িতে তাঁর আর প্রবেশ করার সাধ্য হবে না। ঠাকুরদা চিঠিতে সেই ধরনের প্রস্তাবও রেখেছেন। ঠাকুরদার আভিজাত্যের পক্ষে ওই মানুষটি অর্থহীন, ওকে না সরালে সম্মান বাঁচে না গৈরিকা।

—তা হলে এখন কী হবে?—সকাতরে বিষণ্ণ গলায় প্রশ্ন করে গৈরিকা ব্যানার্জি।

দেবজিৎ চুপ করে থাকে। আকাশে বিকেলের স্নিগ্ধ সূর্যের রঙে মাতাল বসন্তের ফাগ। ছোট ছোট পাখিরা উড়ছে কালো বিন্দুর মতো। একটা সাদা ইস্পাত রঙের নিঃশব্দ বিমান চলে যাচ্ছে অসীম গম্ভীর নৈঃশব্দ্যে।

সহসা দেবজিৎ বলল—ইন্দ্ৰকাকার কাছে আমি ইংরেজি শিখেছি। ওঁর যত্নের শেষ ছিল না। মায়ের সঙ্গে ওঁর সম্বন্ধের একটা দূরত্ব লক্ষ করলে! আজ বলে নয়, বরাবরই এরকম। মা বেচারিকে উপেক্ষা করেই আনন্দ পায়।

গৈরিকা বলল—উনি ওঁর একটা লোভের কথা বলছিলেন।

—হ্যাঁ। ওই উপেক্ষার সেটা জবাব। একটা পরাজয় বলতে পারো। তবু আমাদের উনি ছেড়ে যেতে পারছেন না। তবে তোমাকেও তো আমি ছাড়তে পারছি না গৈরিকা। ঠাকুরদার অহঙ্কারের কাছে আমি চূর্ণ হয়েছি। আমি মেনে নেব স্থির করেছি।

—কী মেনে নেবে? যেন ঈষৎ আর্তনাদ করল গৈরিকা।

—চন্দননগরে, যেখানে আমার কলেজের চাকরি, বিয়ের পর আমরা সেখানে চলে যাব। মা যাবে আমাদের সঙ্গে। এভাবে সব শেষ হবে। একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে দেবজিৎ দূরে কোথায় চেয়ে রইল।

শেষ হবে—এই উচ্চারণে অদ্ভুত বিচ্ছেদ-ব্যথা গুমরে উঠল। গৈরিকা বুঝল, ইন্দ্রনাথকে ত্যাগ করার জন্য চন্দননগরে চলে যেতে হবে। কারণ, ইন্দ্ৰকাকা সেখানে যাওয়ার অধিকার পাবেন না। এই জন্যই কি গৈরিকার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা? গৈরিকার বুকটা মুচড়ে উঠল।

হঠাৎ প্রায় আর্তনাদের সুরে গৈরিকা বলল—আমি তোমাকে অন্য রকম ভেবেছিলাম দেবজিৎ। তুমি তা নও। তোমার মুখের ভাষায় মোহভঙ্গ হয়েছে আমার। এরপর তোমার মুখের কথায় আমি আর অবাক হব না। তুমি ঠাকুরদার সঙ্গে দেখা করো।

কথা শেষ হওয়া মাত্র বাসে লাফ দিয়ে উঠে চলে গেল গৈরিকা। দেবজিৎ বিমূঢ় হয়ে চলে যাওয়া বাসের দিকে চেয়ে রইল।

বিয়ের সাত দিন পর ওরা চন্দননগরে চলে যাওয়ার জন্য আজ সকাল থেকে তোড়জোড় লাগিয়েছে। একটা ম্যাটাডরে সাজিয়ে নেওয়া হয়েছে প্রয়োজনের জিনিস।

উমেশচন্দ্র ইন্দ্রনাথকে সর্বক্ষণ আগলে নিয়ে কথা বলছেন ইন্দ্রনাথের ভবিষ্যৎ বিষয়ে। ক্যানিং-এ ঘর তুলছ তাহলে…আজ্ঞে ওটা আমার অভিমানের কথা। জমি আমি কিনিনি।

…কী সর্বনাশ করলে! তা হলে থাকবে কোথায়! পথে… গৈরিকা-দেবজিৎ সুখী হয়, তুমি চাও না? তুমি যদি চন্দননগর গেছো বলে শুনি, আমি গুণ্ডা দিয়ে তোমাকে খুন করে ফেলব। …তুমি একটা সামাজিক কলঙ্ক ইন্দ্রনাথ…

ইন্দ্রনাথের চোখ ছলছল করে উঠল। আজ তার কেউ নেই, বোঝা যায়। তিনি উমেশচন্দ্রের সমস্ত কথা ঘাড় পেতে মেনে নিচ্ছিলেন। ভয়াবহ এক নিঃসঙ্গতাবোধ তাঁকে ক্রমশ গ্রাস করে ফেলছিল। তিনি দেখলেন, মানসী যেন প্রায় পাল্লা দিয়ে সেজেছেন গৈরিকার সঙ্গে। ভীতু চোখে তাঁকে চেয়ে দেখছিলেন ইন্দ্রনাথ। এত আনন্দ মানসীর? শুধু সিঁথিতে সিঁদুর পড়লে মানসী যেন হতে পারতেন নতুন কনের মতো অপূর্বা। মানসীর চোখে মেদুর বিহ্বলতা। নতুন শাড়ির গন্ধে, স্নো, পাউডার আর অন্য প্রসাধনে বর্ণে মানসী যেন বিবাহ-পূর্ব এক স্মৃতি, শুধু শাড়িখানির মেঝেয় হালকা ফুল আঁকা শুভ্রতা তাঁর বিপুল বৈধব্য স্মরণ করিয়ে দেয়।

বিদায়ের মুহূর্ত ঘনিয়ে এল। উমেশচন্দ্র বললেন—এবার তোমায় পথে নামতে হবে ইন্দ্রনাথ।

ইন্দ্রনাথ দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন—আমায় তবে কাঁধের কাপড়ের থলেটা দাও মানসী।

কতকাল পর এভাবে সরাসরি কথা হয় ওঁদের। তা দেখে গৈরিকা বিদীর্ণ হয়ে নিঃশব্দে কেঁদে ফেলে।

একটি অখ্যাত কানাগলির মেসে জীবন কেটেছে আর মানসীর কাছে এসেছেন ইন্দ্রনাথ। এই বাড়ির অযাচিত অভিভাবক হওয়ার নিষ্ফল চেষ্টা করে গেছেন। সেই মেসটাও গত সপ্তাহে উঠে গেছে। মেস বাড়ি ভেঙে পড়ে সাতজন মারা পড়েছে। ভাগ্য দোষে বেঁচে রইলেন ইন্দ্রনাথ। এবার তাঁর পথে নামার পালা। তিনি সব অবস্থা ঘাড় পেতে মেনে নিচ্ছেন। কেবল চেয়ে দেখছেন মানসীর সৌন্দর্য। শুধু বানানো ভাষার এক অথর্ব সম্রাটকে আজ বরণ করে নিয়েছে গৈরিকা। অথচ চোখের সামনে এক সত্যিকার প্রেমিক জীবনের শেষে এসে তারই কারণে বাস্তু হারালেন। দেবজিৎ একটি কথাও বলল না।

মানসী এগিয়ে আসেন ইন্দ্রের কাছে। কাঁধের থলে এগিয়ে দিয়ে বলেন—নাও। এবার পা বাড়াও ইন্দ্রনাথ।

ইন্দ্রনাথের দেহ অপূর্ব এক অনুভূতিতে শিহরিত হয়। পথের ওপর নেমে গিয়েছে গৈরিকা আর দেবজিৎ। ঘরে তালা লাগিয়ে দিলেন মানসী। সবার চোখের ওপর চাবিগাছা আঁচলে বাঁধলেন। প্রতিবেশীরা সকলে এই দৃশ্য লক্ষ করছিল। উমেশচন্দ্র একটি মানুষকে সব স্থানে উচ্ছেদ করে দিলেন। তাঁর অহঙ্কার, সামাজিক সম্মান বনেদি অট্টালিকার মতো খাড়া হয়ে উঠল অদৃশ্য চূড়ায়।

গাড়ি ছেড়ে গেল। ম্যাটাডর আর ভাড়ার ট্যাক্সি। সহসা কাঁধেব থলে অত্যন্ত ভারী ঠেকল ইন্দ্রনাথের। পথে চলতে চলতে দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি। থলেয় হাত চালিয়ে অবাক হয়ে গেলেন। ক’খানা মহৎ উপন্যাস আর রিঙে বাঁধা একগুচ্ছ চাবির গোছা। আর উঠে এল রঙিন শুভেচ্ছা কার্ডে যত্ন করে লেখা মানসীর চিঠি।

প্রথম প্রেমপত্র।

ইন্দ্রনাথ,

চাবিগোছা ডুপ্লিকেট। তোমার জন্য। তুমি আমার ঘরে শোবে। আমি চন্দননগর থেকে তোমার কাছে আসব। তুমি কোথাও চলে যেও না। ছেলের বউকে দেখে আমার ভারী ঈর্ষা হয়েছে। তাই এত সেজেছি—তাও তোমার কারণে ইন্দ্র। ইতি তোমার মানসী।

অত্যন্ত অবৈধ চাবিগোছার দিকে চেয়ে রইলেন ইন্দ্রনাথ। তাঁর দেহ কাঁপতে লাগল অপর্যাপ্ত প্রণয়ের আঘাতে—যেন তিনি সদ্য যৌবনে পা বাড়িয়েছেন।

ট্যাক্সিতে বসে দেবজিৎ মদির চোখে গৈরিকার কানে ফিসফিসিয়ে বলল—মায়েব একখানা আশ্চর্য চিঠি আমি গোপনে পড়েছি গৈরিকা। শুনলে তোমার ভাল লাগবে। পরে বলছি তোমাকে। এত ভালো বাংলা খুব কম পড়েছি। ঈর্ষাও যে কত সুন্দর হয়।

৫ মে ১৯৯১

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *