ইফেল টাওয়ার বিক্রি হয়ে গেল
জোচ্চোরদের জগতে কাউন্ট ভিক্টর লাসটিগ একটা বিস্ময়। একটানা বিশ বছর ধরে সে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিয়েছে দু-দুটো মহাদেশের বাঘা-বাঘা পুলিশ অফিসারদের। আশ্চর্য তার প্রতিভা। তার বৈষ্ণব-বিনয় কুঁদে রাষ্টদূতকেও লজ্জা দেয়; তার অভিনয় দক্ষতা শ্রেষ্ঠ অভিনেতাকেও তটস্থ করে। তার বুকের পাটা বনের বাঘকেও হার মানায়।
কাউন্ট ভিকটর লাসটিগ কখনও কারও নকল করেনি। তার মৌলিক কুকীর্তির শ্রেষ্ঠ নজির হল প্যারিসের ইফেল টাওয়ার বিক্রি। এতবড় প্রতারণা জোচ্চুরির ইতিহাসে বিরল।
ইফেল টাওয়ার বিক্রির পুরো ফন্দিটা লাসটিগের মাথায় এসেছিল খবরের কাগজ পড়তে পড়তে।
লাসটিগের হাতে তখন কোনও কাজ নেই। সাতদিনও হয়নি নোট-নকলের ম্যাজিক বাক্স বিক্রি করে এক হঠাৎ বড়লোককে পথে বসিয়ে প্যারিসে পালিয়ে এসেছিল লাসটিগ। হাতে মেলাই টাকা। অফুরন্ত সময়। কাজের মধ্যে শুধু ফুটপাতের কাফেতে বসে ভারমুথ খাওয়া আর হাই তুলতে তুলতে কাগজ পড়া। সঙ্গে রয়েছে পাপকাজের দোসর ড্যাপার ড্যান কলিনস। বাইরের লোকের কাছে তার পরিচয় অবশ্য কাউন্ট ভিকটর লাসটিগের প্রাইভেট সেক্রেটারি হিসেবে।
লাসটিগের কুঁড়েমি দেখে কলিনস যখন তিতিবিরক্ত, ঠিক তখুনি খবরের কাগজটা ভজ করে এগিয়ে দিল কাউন্ট।
বলল, শিকার পাওয়া গেছে। কে টোপ গিলবে, এখুনি তা বলতে পারব না। তবে তার ধান্দা জেনো পুরোনো জং-ধরা লোহা কেনাবেচা। শাঁসালো পার্টি। দুপয়সা আছে। তক্কেতক্কে রয়েছে নতুন দাঁও পেটবার তালে। নাও, পড়ো।
বলে, একটা বিশেষ প্রবন্ধ দেখিয়ে দিল লাসটিগ। তাতে লেখা আছে, ইফেল টাওয়ারের যা ঝরঝরে অবস্থা, তাতে শুধু মেরামতি কাজেই হাজার ফ্ৰা খরচ হবে। তাই গভর্নমেন্ট ভাবছে, খামোকা ঠাট বজায় না রেখে ওটাকে ভেঙে ফেললেই ল্যাটা চুকে যায়। খরচও অনেক কম হয়।
চোখ কপালে তুলে ড্যাপার ড্যান বলল,–অসম্ভব। এ কাজ আমাদের দ্বারা হবে না। তোমার মাথা খারাপ হয়েছে?
মোটেই অসম্ভব নয়। শক্ত কাজটা খবরের কাগজওয়ালারা আমাদের হয়ে সেরে দিয়েছে। এখন দরকার শুধু সরকারি শিলমোহর আর চিঠির কাগজ। তা নিয়ে ভেবো না। আমার এক বন্ধু আছে, চাইলেই পাঠিয়ে দেবে। এবার গা তোলো, কাজে নামা যাক।
দিনকয়েক পরে প্যারিসের পাঁচজন কালোয়ারের কাছে সরকারি চিঠি পৌঁছে গেল। চিঠি লিখছেন এমন এক ডেপুটি ডিরেক্টর-জেনারেল ইফেল টাওয়ার যার এখতিয়ারে পড়ে। পাঁচজনকেই তিনি নেমন্তন্ন করেছেন সরকারি চুক্তি সম্পর্কে কথাবার্তা বলার জন্যে। সময় ও শুক্রবার। বেলা তিনটে। স্থান ও ক্রিন হোটেলে ডেপুটির স্যুট।
যথাসময়ে এল পাঁচজনে। লাসটিগ বললে, সিয়েরা মন দিয়ে শুনুন। প্রধানমন্ত্রী আর প্রেসিডেন্ট ছাড়া এ গোপন খবর আর কেউ জানে না।
এই পর্যন্ত বলে নাটকীয় ভাবে একটু বিরতি দেওয়া হল। চাট্টিখানি ব্যাপার নয়ত। ক্লাইম্যাক্স সৃষ্টি না করলে কদর পাওয়া যাবে না। সবার কৌতূহল যখন তুঙ্গে, তখন থেমে-থেমে বলল– গভর্নমেন্ট ঠিক করেছে, ইফেল টাওয়ার ভেঙে ফেলবে।
আবার থামল লাসটিগ। তারপর বলল, মন খারাপ হওয়ার মত খবরই বটে। কিন্তু ভেঙে ফেলা ছাড়া আর পথও নেই। টাওয়ার মেরামতের খরচ তো কম নয়। কাগজে তো দেখেছেনই। ইফেল টাওয়ার তৈরি হয়েছিল ১৮৮৯ সালে প্যারিস প্রদর্শনীর আকর্ষণ হিসেবে। তখন কিন্তু শহরের বুকের ওপর বারো মাস টাওয়ার খাড়া রাখবার কোনও প্ল্যান ছিল না। রুচি যাদের সূক্ষ্ম, তাঁরা তো গোড়া থেকেই রাগারাগি করে এসেছেন টাওয়ারের ছিরিছাঁদ দেখে। প্যারিসের মত শহরে এ টাওয়ার একেবারেই বেমানান। আপনারাই বলুন মানায় কিনা।
কাউন্টের পাঁচ মক্কেলের অতশত রুচিবোধ না থাকলেও মুনাফা লোভ ছিল বিলক্ষণ। কাজেই পাঁচজনেই একবাক্যে রায় দিল, অবিলম্বে ইফেল টাওয়ারকে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া উচিত।
লাসটিগ তখন পাঁচ মক্কেলকে নিয়ে টাওয়ার পরিদর্শনে বেরুল। বুঝিয়ে দিলে, যে টাওয়ার তৈরি করতে সত্তর লক্ষ ফ্রাঁ লাগে, তার ভাঙা লোহা বেচলেও কম মুনাফা হয় না। ভাঙা লোহার মোট ওজন দাঁড়াবে সাত হাজার টন। ঝানু ব্যবসাদারের মত কড়ি বরগার মোট সংখ্যা, প্রতিটির চুলচেরা মাপ, এমনকী ওজন পর্যন্ত বলে গেল গড়গড়িয়ে। সবশেষে বলল, ক্রেতারা যেন আগামী বুধবারের মধ্যে শিলমোহর করা টেন্ডার হোটলের ঠিকানায় পৌঁছে দেয়। একথাও যেন মনে থাকে, বিষয়টা গভর্নমেন্ট সিক্রেট। অত্যন্ত গোপনীয়। পাঁচকান না হয়।
আসল শিকার কে হবে, সেটা অবশ্য আগেই আঁচ করে নিয়েছিল লাসটিগ। নাম তার আঁদ্রে পয়সন। চাষার ছেলে। সমাজে পাত্তা পায় না। তাই মরিয়া হয়ে পণ করেছে, ঝটপট আরও টাকা কামিয়ে নাক উঁচুদের মুন্ডু ঘুরিয়ে দিয়ে সমাজে গাট হয়ে বসতে হবে।
টেন্ডার বুধবারের আগেই এসে গেল। বেস্পতিবার ড্যাপার ড্যান আঁদ্রে পয়সনকে গিয়ে বলে এল, তিনিই সবচাইতে বেশি দাম হেঁকেছেন। সুতরাং এক সপ্তাহের মধ্যেই টাকা জোগাড় করে ফেলল আঁদ্রে পয়সন। আবার গেল ড্যাপার ড্যান। খবর দিল, লাসটিগের হোটেল সুটে আর একটা মিটিং হবে এই নিয়ে। ফিরে এসে বলল লাসটিগকে শিকার ভড়কেছে মনে হচ্ছে। জিগ্যেস করছিল, সরকারি ব্যাপারে দপ্তর ছেড়ে হোটেলে কেন?
শুনে মোটেই ভড়কালো না ফিচেল শিরোমণি লাসটিগ। বলল, বেশ তো, আমরা যে সত্যি সত্যিই সরকারি অফিসার, সেটা প্রমাণ করে দিলেই তো মনে আর ধাঁধা থাকে না। সে ভার আমার।
যথাসময়ে এল শাঁসালো পার্টি। সোল্লাসে বলল লাসটিগ, মঁসিয়ে পয়সন, অভিনন্দন নিন। আসুন, আপনার সৌভাগ্যলক্ষ্মীর সম্মানে আগে এক গেলাস মদ খাওয়া যাক।
কনট্রাক্টটা আগে সই করলে হয় না? আমতা-আমতা করল পয়সন।
তাও তো বটে। আগে কাজ, পরে মদ্যপান, বলে কলিনস-এর দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল লাসটিগ, তুমি আপিসে যাও। তিনটের সময়ে আমি আসছি।
কলিনস চৌকাঠ পেরোতে না পেরোতেই মুখের চেহারা পালটে গেল লাসটিগের। উবে গেল অফিসারি দাপট। কঁচুমাচু মুখে বলল–আপনাকে ডেকেছি একটা রফা করার জন্যে। সরকারি অফিসারদের হাঁড়ির হাল কেনা জানে বলুন। ঠাটঠমক বজায় রাখতেই মাইনের টাকা ফুটকড়াই হয়ে যায়। তাই রেওয়াজ দাঁড়িয়ে গেছে চুক্তি সই করার আগে অফিসারদের
ঘুষ দিতে হয়? ফস করে বলে ফেলল পয়সন।
মঁসিয়ে দেখছি দারুণ ঠোঁটকাটা!
সেইজন্যেই বুঝি আপিসে না ডেকে বারবার হোটেলে ডাকাচ্ছেন?
যা বলেন, কাষ্ঠহাসি হাসল লাসটিগ।
হঠাৎ নিজেকে কী-হনু মনে হল পয়সনের। ঘুষখোর জাঁদরেল অফিসারের তুলনায় নিজেকে কেউকেটা ঠাউরে নিল। বিজ্ঞের হাসি হেসে বললে, দেখুন মঁসিয়ে, আমাকে গেঁইয়া ভাববেন না। এসব কাজে আমি পোক্ত। বলে, এক পকেট থেকে বার করল সার্টিফাই করা একটা চেক। আর এক পকেট থেকে নোটঠাসা মানিব্যাগ। স্মিতমুখে আবার মদের গেলাস এগিয়ে ধরল লাসটিগ। একঘণ্টার মধ্যেই পয়সনের চেক ভাঙিয়ে লাসটিগ কেটে পড়ল অস্ট্রিয়ায়।
মাসখানেক ভিয়েনার সেরা হোটেলে খুব ফুর্তি করল দুই জোচ্চোর–লাসটিগ আর কলিনস। সেইসঙ্গে তন্নতন্ন করে পড়ল প্যারিসের সবকটা দৈনিক। একমাস পর লাসটিগ বলল, ওহে কলিনস, বোকাপাঁঠা পয়সন তো দেখছি পুলিশের ছায়াও মাড়াল না। বুঝেছি, কেন। লজ্জা হয়েছে। আহাম্মকি চেপে যেতে চাইছে, পুলিশকে জানানো মানেই তেঁড়া পিটে নিজের বোকামো জাহির করা। এদিকে ইফেল টাওয়ারের দখলও নিল না। তাই ভাবছি, আরেকবার টাওয়ার বেচলে কেমন হয়?
সত্যি সত্যিই আবার মোটা দামে ইফেল টাওয়ার বেচে দিল লাসটিগ।
তৃতীয়বার বেচবার জন্যে খদ্দের খুঁজছে, এমন সময় দুনম্বর শিকার এমন হায়-হায় করে উঠল যে পিঠটান দেওয়া ছাড়া পথ রইল না কাউন্ট ভন লাসটিগের।
*মাসিক গোয়েন্দা পত্রিকায় প্রকাশিত। শারদীয় সংখ্যা, ১৩৭৯।