1 of 2

ইতুর কথা

ইতুর কথা

এক দেশে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ আর ব্রাহ্মণী থাকতেন। তাঁদের দুটি মেয়ে, উমনো আর ঝুমনো। একদিন ব্রাহ্মণ বললেন, ‘ব্রাহ্মণী, আমাদের একদিন পিঠে করলে হয় না?’ ব্রাহ্মণী বললেন, ‘কোথায় চাল, কোথায় নারিকেল, কোথায় গুড়; পেটে ভাত জোটে না, আবার পিঠে খেতে ইচ্ছে?’ ব্রাহ্মণ ভিক্ষে করে সেই সব এনে দিলেন। ব্রাহ্মণী মেয়ে দুটিকে ঘুম পাড়িয়ে পিঠে গড়তে বসলেন, আর ব্রাহ্মণ একটা দড়ি নিয়ে কানাচে বসে রইলেন। যতবার ছ্যাঁক ছ্যাঁক শব্দ হয়, ততবার ব্রাহ্মণ একটি করে গেরো বাঁধেন। প্রথম রাত্রে উমনো উঠে বলছে, ‘মাগো মা, কী করছিস মা! জন্মে কখনও দেখিনি, জন্মে কখনও খাইনি, একখানি পিঠে দে মা, খাই।’ তিনি একখানি দিলেন, দিয়ে বললেন, ‘আর চেয়ো না মা, জানতে পারলে তিনি এখনি বনবাস দিয়ে আসবেন।’ সে পিঠেখানি খেয়ে কাঁথায় মুখ মুছে শুয়ে পড়ল। আবার খানিক রাত্রে ঝুমনো উঠে বলছে, ‘মাগো মা, কী করছিস মা! একখানি দে মা, খাই।’ মা তাকেও একখানি দিলেন। সে খেয়ে কাঁথায় মুখ মুছে শুয়ে রইল। রাত পোহাল। সকালে ব্রাহ্মণের মুখ ধোয়া নেই, দাঁতন করা নেই, গায়ত্রী জপা নেই, কাপড় ছাড়া নেই, অখন্ড কলার পাতা কেটে এনে দাওয়ায় পেতে বসলেন। ব্রাহ্মণী পাতাভরে পিঠে দিলেন। ব্রাহ্মণ একখানা করে পিঠে খান, আর একটি করে গেরো খোলেন। ব্রাহ্মণী, চোঁয়া পোড়া যেগুলি নিজের জন্য রেখেছিলেন, সবগুলি এনে দিলেন। তবুও দরিদ্র ব্রাহ্মণের পেট ভরে না। শেষে দুখানি পিঠে কম পড়তে বললেন, ‘ব্রাহ্মণী, রাক্ষসী মেয়ে দুটোকে দিয়ে সব পিঠে খাইয়ে রেখেছো,—আজ তাদের বনে দিয়ে আসব।’

তারপর বেলা হতে মেয়ে দুটি ঘুম থেকে উঠল। ব্রাহ্মণ বললেন, ‘ওমা! তোরা পিসির বাড়ি যাবি?’ উমনো ঝুমনো বললে, ‘যাব।’ ব্রাহ্মণী কেঁদেই অস্থির, কিছু বলতে পারলেন না। একলা থাকলে পেট ভরে খেতে পাবেন, দরিদ্র ব্রাহ্মণের এই প্রধান উদ্দেশ্য। মেয়ে দুটিকে বনে দিয়ে এলে, যেন তাঁর সকল দুঃখ দূর হবে। তিনি উমনো ঝুমনোকে সঙ্গে করে বরাবর বনের দিকে যাচ্ছেন। উমনো বললে, ‘বাবা! পিসির বাড়ি কতদূর, আর যে চলতে পারছি না।’ ব্রাহ্মণ বললেন, ‘এইখানে একটু শুবি?’ তারা বললে, ‘হাঁ বাবা, তোমার কোলে মাথা দিয়ে শোব।’ ব্রাহ্মণ সেইখানে বসলেন; উমনো ঝুমনো বাপের পায়ের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল। ব্রাহ্মণ অমনি সুযোগ পেয়ে মেয়ে দুটির মাথায় দুটি মাটির ঢেলা দিয়ে, আলতার লুটি, শাঁকের ঘুঁটি রেখে চলে গেলেন। উমনো ঝুমনো উঠে দেখে সন্ধ্যা হয়েছে বাপ কাছে নেই। উমনো বললে, ‘বোন রে বোন, বাবাকে বাঘে খেয়ে গেছে।’ ঝুমনো ছোটো হলেও তার বুদ্ধি কিছু বেশি, সে বললে, ‘না দিদি! বাবাকে কখনও বাঘেও খায়নি, ভাল্লুকেও খায়নি। দেখছিস না, এগুলো কি হাড় না রক্ত? সেই যে দিদি, আমাদের মা দুখানি পিঠে দিয়েছিলেন, তাই বাবা আমাদের বনবাস দিয়ে পালিয়ে গেছেন।’ উমনো কেঁদে অস্থির। ঝুমনো বললে, ‘কাঁদলে কি হবে, দিদি? রাত্রি হল, চল, যদি কোথাও আশ্রয় পাই দেখি।’ ভয়ানক বন, তায় রাত্রিকাল—আশ্রয় আর পাবে কোথায়! একটি বটবৃক্ষের কাছে গিয়ে বললে, ‘হে বটবৃক্ষ! মা আমাদের দশমাস দশদিন গর্ভে স্থান দিয়েছেন, তুমি আজ রাত্রের মতো আমাদের দুটি বোনকে স্থান দাও।’ তখন চড়মড় মড়মড় করে গাছের গুঁড়িটি দু-ফাঁক হয়ে গেল। দুটি বোনে তার মধ্যে প্রবেশ করলে। সমস্ত রাত্রি বাঘ আসে, ভাল্লুক আসে, গাছের গোড়ায় আঁচড়ায় কামড়ায়, গা ঘষে, কিন্তু কিছুই করতে পারে না। রাত পোহাল, আবার বটবৃক্ষ দু-ফাঁক হয়ে গেল। উমনো ঝুমনো বেরিয়ে গাছকে নমস্কার করে বরাবর যেতে লাগল।

তারা কতদূর গিয়ে দেখে দেবকন্যারা ইতুপুজো করছেন। উমনো ঝুমনো কাছে যাবামাত্র তাঁদের ঘট উলটে পড়ল। তখন দেবকন্যাগণ ডেকে বললেন, ‘কে রে পাপিষ্ঠি! এখানে এসেছিস? কাছে আয়, নইলে ভস্ম করে ফেলব!’ তখন দুটি বোনে কাঁপতে কাঁপতে তাঁদের কাছে গেল। দেবকন্যারা বললেন, ‘তোরা কারা, এখানে কেন এসেছিস?’ ঝুমনো বললে, ‘আমরা দুখানি পিঠে খেয়েছিলুম বলে, আমাদের বাপ বনে দিয়ে গেছেন।’ দেবকন্যাগণ বললেন, ‘যা, তোরা ওই পুকুরে স্নান করে আয়। আমরা তোদের সব জিনিস দেব—ব্রত কর, তোদের ভাল হবে।’ উমনো ঝুমনো নাইতে গেল, অমনি পুকুরের জল শুকিয়ে গেল। মাছগুলো সব ধড়াস ধড়াস করে আছাড় খেতে লাগল, ধোপার কাপড় কাচা বন্ধ হয়ে গেল। কত লোক নাইতে এসেছে, জল নিতে এসেছে, তারা গালাগালি দিতে লাগল। দুটি বোনে কাঁদতে কাঁদতে ফিরে এল। দেবকন্যারা জানতে পেরে বললেন, ‘এই নে দূর্বার আংটি, নিয়ে পুকুরে ফেলে দিগে যা, জল হবে।’ উমনো তাই করলে, পুকুরে জল হল; দুটি বোনে স্নান করে এসে দাঁড়াল। কেউ দিলেন ইতুর ভাঁড়, কেউ দিলেন কলা-পাটালি, কেউ দিলেন ফুল-চন্দন, তাই দিয়ে তাদের ইতুপূজো করালেন; তারপর বললেন, ‘এইবার তোরা বর মেগে নে।’ বল, ‘আমার বাপের দুঃখ দূর কর, আউরি চৌরি দক্ষিণ দুয়ারি বাড়ি হোক। হাতি শালে হাতি হোক, ঘোড়া শালে ঘোড়া হোক, ধন দৌলৎ হোক, দাস-দাসী হোক, আমাদে রাজার মতন বর হোক।’ উমনো ঝুমনো সেই কথা বলে প্রণাম করলে। তারপর দেবকন্যারা ইতুর প্রসাদ দিয়ে বললেন, ‘যা, তোরা প্রসাদ খেয়ে ঘরে যা।’ দুটি বোনে প্রসাদ খেয়ে ইতুর ঘট নিয়ে ঘরে যেতে লাগল।

পথে যেতে যেতে তারা দেখল একটা ডোবায় কলমিশাক হয়ে আছে। উমনো বললে, ‘চল ভাই, চারটি শাক তুলে নিয়ে যাই, মা কত আহ্লাদ করবেন।’ তারা যেমনি শাকের ক্ষেতে নেমেছে, অমনি একটা সোনার ঘাড়মুড়ো উমনোর পায়ে লেগে গেল। উমনো বললে, ‘বোন রে বোন, যেন একটা মড়ার মাথা পায়ে লাগল।’ ঝুমনো দেখে সেটা চুপি চুপি কলমি শাকের ভেতরে করে নিয়ে চলল। দুটি বোনে বাড়ির কাছে গিয়েছে, অমনি একটা লোক গিয়ে বললে, ‘ও বামনি! দেখ, তোর উমনো ঝুমনো আসছে।’ বামনি তাড়াতাড়ি বাইরে এসে মেয়ে দুটিকে চুমু খেয়ে আদর করে ঘরে নিয়ে গেলেন। ব্রাহ্মণ এসে তাদের দেখে রেগে বললেন, ‘আবার ওই অপয়া মেয়ে দুটোকে ঘরে এনেছিস? ওদের বনে দিয়েই আমার এত সুখ হয়েছে।’ উমনো ঝুমনো বললে, ‘অত অহঙ্কার করো না বাবা! আমরা ইতু পুজো করছি, তাই তোমার সুখ হয়েছে; এখনি মনে করলে সব ছাই করে দিতে পারি।’ ব্রাহ্মণ তাদের কাছে সোনার মাথাটা দেখে বললেন, ‘ও আবার কিরে! আমার হাতে দড়ি দিবি নাকি?’ এই বলে মাথাটা নিয়ে বনে ফেলে দিয়ে এলেন। আবার সেই মাথাটি এসে ঘরে পড়ল। তখন ব্রাহ্মণ দেখে অবাক হলেন, আর কিছুই বললেন না।

ইতুপুজো করে দিন কতক পরে ব্রাহ্মণীর একটি চাঁদের মতন ছেলে হল। উমনো ঝুমনোকে কেউ কিছু বলে না। কিছুদিন পরে এক রাজা পাত্র সঙ্গে করে কতকগুলি সৈন্যসামন্ত, হাতি ঘোড়া নিয়ে শিকার করতে যাচ্ছেন। পথে সকলের তেষ্টা পাওয়ায়, ওই ব্রাহ্মণের বাড়িতে জল চেয়ে পাঠালেন। ঝুমনো ইতুর ভাঁড়ে করে একটু জল দিলে। রাজপুত্র একটুখানি জল দেখে রেগেই অস্থির; বললেন, ‘আমাদের সঙ্গে কি ঠাট্টা করে পাঠিয়েছে। আমাদের এত লোক, হাতি, ঘোড়া, এতটুকু ভাঁড়ের জলে কী হবে?’ উমনো বলে পাঠালে ওই জলে ঢের হবে। তখন রাজা খেলেন, পাত্র খেলেন, অন্য কত লোক খেলেন—যত ঢালেন ততই জল, হাতি ঘোড়া খেয়ে এলে গেল। রাজা বড়ই আশ্চর্য হলেন। তখন রাজা ব্রাহ্মণকে ডেকে পাঠালেন। ব্রাহ্মণ এসে দাঁড়ালেন। রাজা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনার মেয়েটির কি বিয়ে হয়েছে?’ ব্রাহ্মণ বললেন, ‘আমার দুটি মেয়ে, কারুরই বিয়ে হয়নি।’ তখন রাজা বললেন, ‘তবে ওই মেয়ে দুটিকে আমাদের সঙ্গে বিয়ে দিন।’ ব্রাহ্মণ বললেন, ‘রাজা ও পাত্র জামাই হবে, সেতো আমার ভাগ্যের কথা।’ তখন রাজা আর শিকার করতে গেলেন না। রাজবাড়িতে খবর গেল যে, ‘আমরা আজ বিয়ে করে কাল সকালে বউ নিয়ে বাড়ি যাব।’ তখন ব্রাহ্মণ বিয়ের সব আয়োজন করলেন। তারপর সেই দিন রাত্রে খুব ঘটা করে রাজা ও পাত্রের সঙ্গে উমনো ঝুমনোর বিয়ে হয়ে গেল। উমনো ঝুমনো দেখতে খুব সুন্দরী, রাজা ও পাত্র দেখে খুব খুশি হলেন। পরদিন উমনো ঝুমনো শ্বশুরবাড়ি যাবে; বাপ বললেন, ‘তোমাদের কী কী চাই মা বলো?’ বড়োটি বললে, ‘আমার জন্যে মাগুর মাছ আনাও, ছাঁচি পান আনাও, মাছের ঝোল ভাত খেয়ে পান চিবুতে চিবুতে পালকিতে উঠব।’ ছোটো মেয়ে বললে, ‘আজ অঘ্রাণ মাসের রবিবার, কলা, পাটালি, ফল-মূল, যা পাবে নিয়ে এস বাবা। ইতুপুজো করে, নিরামিষ খেয়ে, ঘট নিয়ে পালকিতে উঠব।’ বাপ তাই যোগাড় করে দিলেন।

তারপর দুইদিক দিয়ে দুই বর যেতে লাগল। যে পথ দিয়ে উমনো যায়, সে দিকে মড়া মরে, ছড়া পড়ে, ঘরে আগুন লাগে, যত অলক্ষণ হতে লাগল। যে পথে ঝুমনো যায়, সে পথে বিয়ে হচ্ছে, শাঁক বাজছে, কত আমোদ আহ্লাদ হচ্ছে, চারিদিকে মঙ্গলধ্বনি, লুচির ছড়াছড়ি হচ্ছে। তারপর ওখানে রাজার মা সোনার পিঁড়ি, সোনার ঝারি, সোনার বরণডালা সাজিয়ে, জলছত্র দিয়ে ঘর বার করছেন। পাত্রের মাও সমস্ত আয়োজন করে বসে আছেন। বাজনা বাদ্যি করে বর-কনে এল। রাজার মা বউ বরণ করতে গেলেন, সোনার পিঁড়ি, সোনার ঝারি সব লোহা হয়ে গেল। তিনি বউয়ের গালে ঠোনা মেরে বউ তুললেন। পাত্রের মা বউ বরণ করতে গেলেন, সব জিনিস সোনা হয়ে গেল। অমনি বউয়ের মুখে চুমু খেয়ে, বউ ঘরে তুললেন। তারপর, দিনকতক পরে রাজার আজ হাতিটা মরে, কাল ঘোড়াটা মরে, ক্রমে যত অমঙ্গল হতে লাগল। পাত্রের দিন দিন উন্নতি হতে লাগল। একদিন রাজা পাত্রকে ডেকে বললেন, ‘ভাই, তুমিও বন-কন্যা বিয়ে করলে, আমিও বন-কন্যা বিয়ে করলাম, তোমার ভালো হচ্ছে, আমারই বা মন্দ হচ্ছে কেন? আমি ও রানির মুখ দেখতে চাই না, তুমি তাকে কেটে আমায় রক্ত দেখাও।’ উমনোকে কাটবার হুকুম হয়ে গেল। কোটাল উমনোকে ঝুমনোর বাড়ির দরজায় ছেড়ে দিয়ে একটা কুকুর কেটে রক্ত নিয়ে রাজাকে দেখালে। উমনো বাড়ির ভেতর গিয়ে বোনকে খুঁজতে লাগল। শেষে বাগানে এসে আড়াল থেকে দেখে যে ঝুমনো ফুল তুলে ঘাটে বসে স্বামীর জন্য মালা গাঁথছে। উমনো মনে মনে ভাবতে লাগল, আহা ঝুমনো আমার কত মনের সুখে আছে! স্বামী কত ভালোবাসে! শেষে ডাকলে, ‘ভাই ঝুমনো! আমার বড় বিপদ।’ ঝুমনো তাড়াতাড়ি পেছন ফিরে দেখে বললে, ‘কে—দিদি! এ কি, তুমি কী করে এখানে এলে?’ এই বলে উমনোকে ডেকে এনে কাছে বসিয়ে সব বৃত্তান্ত শুনলে। শেষে দুঃখ করে বললে, ‘দিদি, ইতুর কোপে তোমার এমন হল।’ সেই অবধি উমনো ঝুমনোর কাছে লুকিয়ে রইল, ঝুমনোর স্বামী টেরও পেলেন না।

ওখানে উমনোর বাপ ছেলের বিয়ে দিতে যাবেন, বাজনা বাদ্যি করে বর নিয়ে যাচ্ছেন, পথে গিয়ে ছেলে বললে, ‘বাবা! জাঁতি ভুলে এসেছি।’ ব্রাহ্মণ ছুটে বাড়িতে এসে দেখেন, গিন্নি ঘরে খিল দিয়ে ইতুর কথা শুনছেন। ব্রাহ্মণ কপাটে ধাক্কা মেরে, কপাট ভেঙে ফেললেন। ‘আজ শুভদিন, কী বিড় বিড় করছিস!’ বলে লাথি মেরে ঘট ফেলে দিয়ে জাঁতি নিয়ে চলে গেলেন। সেখানে গিয়ে দেখেন, লোকলস্কর, বাজনাবাদ্যি কিছুই নেই, কেবল ছেলেটি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। ব্রাহ্মণ পাগল হয়ে ছেলেটিকে সঙ্গে করে বাড়িতে ফিরে এলেন। এসে দেখেন যে, সে বাড়ি নেই, হাতি ঘোড়া নেই, কেবল সেই কুঁড়েঘর আর ব্রাহ্মণী। তিনি খুব কান্নাকাটি করতে লাগলেন। ব্রাহ্মণী বললেন, ‘এখন হয়েছে তো? ইতুর দৌলতে ধনকড়ি, ইতুর দেওয়া ছেলে, ইতু হতেই সব, সেই ইতুকেই লাথি মারলে?’ ব্রাহ্মণ বললেন, ‘যা হবার হয়েছে, তুমি আবার ইতুপুজো করো।’ ব্রাহ্মণী বললেন, ‘আবার এক বৎসর যাক, অঘ্রাণ মাস আসুক। এখন তুমি ঝুমনোর বাড়ি যাও, যদি কিছু দেয় তাহলে দশ দিন খেয়ে বাঁচবো।’

ব্রাহ্মণ একদিন সাত ছেঁড়া কাপড় পরে, একখানি ময়লা চিরকুট চাদর নিয়ে মেয়ের বাড়ি চললেন। ঝুমনোর বাড়ির কাছে একটা পুকুরধারে বসে আছেন, ভয়ে বাড়ির ভেতর যেতে পারছেন না। দাসী জল নিতে এসেছে, তাকে বলছেন, ‘তুমি কার জল তুলছো বাছা!’ দাসী বললে, ‘ঝুমনোর জল তুলছি!’ ‘তাকে বলো তোমার বাপ এসেছে।’ দাসীর সে কথা মনে নেই, আবার জল নিতে এসেছে।’ ব্রাহ্মণ বললেন, ‘বলেছ বাছা?’ ‘না গো ভুলে গেছি,’ এই বলে দাসী তাড়াতাড়ি গিয়ে বললে, ‘হাঁ মা ঠাকরুণ! তোমার কি বাপ আছে?’ ঝুমনো বললে, ‘যা, বাড়ির ভেতর নিয়ে আয়।’ ব্রাহ্মণ বাড়ির ভেতর গেলেন। ঝুমনো পা ধুইয়ে, তেল মাখিয়ে, স্নান করিয়ে, পঞ্চাশ ব্যঞ্জন ভাত করে খাইয়ে ভারে ভারে জিনিসপত্র দিয়ে বাপকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলে। অর্ধপথ যেতে না যেতে সব জিনিসপত্র ইতুর চরেরা ডাকাতি করে নিয়ে সেই ঝুমনোর ভান্ডারে এনে দিলে। ঝুমনো আর কী করবে! ব্রাহ্মণ সব কথা বুঝতে পারলেন, তখন কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি চলে গেলেন। ব্রাহ্মণী বললেন, ‘মেয়েরা কি মরেছে?’ আমাদের এত কষ্ট শুনেও কিছু দিলে না?’ ব্রাহ্মণ বললেন, ‘গালাগালি দিও না গো! বাছা আমায় সব দিয়েছিল,—পথে ডাকাতে সব লুটে নিয়েছে। তা তুমি একবার যাও না,—মেয়ে মানুষ, চুলের ভেতর, কাপড়ের ভেতর করেও যদি কিছু আনতে পারো।’ ব্রাহ্মণীও সেই পুকুরধারে গিয়ে বসে রইলেন। দাসী জল নিতে এল। ব্রাহ্মণী বললেন, ‘তুমি কার জল তুলছো বাছা?’ দাসী বললে, ‘ঝুমনোর জল তুলছি।’ ব্রাহ্মণী বললেন, ‘তাকে বল, তোমার মা এসেছে।’ দাসী গিয়ে ওই কথা বলতেই, ঝুমনো খিড়কি দিয়ে গিয়ে মাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেল। তার পর তেল মাখিয়ে, স্নান করিয়ে, নূতন কাপড় পরিয়ে, পঞ্চাশ ব্যঞ্জন করে মাকে খাওয়ালে, আর বললে, ‘মা তোমার এখন যাওয়া হবে না। দিনকতক থাকো, অঘ্রাণ মাস এলে ইতুপুজো করবে। ইতুকে অবহেলা করেই তো দিদির ও তোমার এই দুর্দশা হয়েছে।’ ব্রাহ্মণী জামাই বাড়িতেই রইলেন।

আবার অঘ্রাণ মাস এল। ঝুমনো বললে, ‘দিদি! মা! মনে থাকে যেন কাল সংক্রান্তি, ইতুপুজো করতে হবে, যেন সকালে কিছু খেয়ে ফেলো না।’ পর দিন সকালে উঠেই ঝুমনো ডাকলে ‘মা এস, দিদি এস, আমরা স্নান করে আসিগে।’ মা, বোন বললেন, ‘ওমা, আমরা যে খেয়ে ফেলেছি। তোর ছেলেরা খেতে পারেনি, সব এঁটো ছিল, তাই কুড়িয়ে খেয়েছি।’ ঝুমনো মাথায় হাত দিয়ে বললে, ‘হায়রে কপাল! লোকে বলে এরই নাম অদৃষ্ট, একেই বলে দরিদ্র দশা।’ এমনি চারটে রবিবার গেল। সংক্রান্তির আগের দিন ঝুমনো, মা বোনের আঁচলে আঁচলে চুলে চুলে বেঁধে নিয়ে শুয়ে রইল। বেলা না হতে হতেই দুজনকে নিয়ে স্নান করে ঠাকুরঘরে গেল। পূজো হয়ে গেল। তখন বললে ‘মা, দিদি, ইতু লক্ষ্মীর কাছে বর মেগে নাও।’

উমনো তখন জোড়হাতে করে বললে, ‘আমার যেমন সংসার ছিল তেমনি হোক, অস্মরণ রাজার স্মরণ হোক।’ ব্রাহ্মণী বললেন, ‘আমার যেমন ঘর, বাড়ি, দাস-দাসী, হাতি-ঘোড়া হয়েছিল আবার তেমনি হোক, আমাদের দুঃখ দূর করো মা।’ অমনি ব্রাহ্মণের ওখানে আবার তেমনি সুখ স্বচ্ছন্দ হল। তিনি রেগেই অস্থির! তাড়াতাড়ি ঝুমনোর বাড়ি এসে ব্রাহ্মণীকে বলতে লাগলেন, ‘জামাই ভাতি! এখানে পড়ে থাকতে লজ্জা করে না? আমার ধন দৌলৎ কে খায় তার ঠিক নেই, চল, বাড়ি চল।’ ঝুমনো বললে, ‘বাবা! ওই অহঙ্কারেই তো সব গিয়েছিল! মা ইতুপুজো করেছেন বলেই আবার সব পেয়েছ।’ তখন ঝুমনো ভারে ভারে জিনিসপত্র দিয়ে পালকি করে মা-বাপকে পাঠিয়ে দিলে। এখানে রাজার আবার সুদিন হয়েছে। রাজা পাত্রকে ডেকে বললেন, ‘আমার রানিকে এনে দেবে তো দাও, নইলে সকলের মাথা নেব।’ ‘কী বিপদ! অসময় হলে রানিকে কেটে রক্ত দেখাও, আবার সুসময় হলেই রানিকে এনে দাও। আপনার এ কি রকম হুকুম, এখন রানিকে কোথায় পাব?’ পাত্র জানেন না যে তাঁর বাড়িতেই রানি আছেন। তিনি ভাবতে ভাবতে এসে ঝুমনোকে সব কথা বললেন। ঝুমনো বললে, ‘তার আর ভাবনা কী? আমি মহারাজের রানিকে এনে দেব। রাজাকে বল আমার বাড়ির দরজা থেকে রাজবাড়ির দরজা পর্যন্ত কলাগাছ পুঁতে, কড়ির জাঙ্গাল দিয়ে তাঁবু ফেলে দিন; তাহলে রানিকে পাবেন।’

পাত্র রাজাকে ওই কথা বললেন, রাজাও তাই করলেন। ঝুমনো তখন দিদিকে সাজিয়ে-গুজিয়ে প্রণাম করে বললে, ‘যাও দিদি, এইবার রাজার সুমতি হয়েছে।’ উমনো তখন সকলের সঙ্গে দেখা করে, ঝুমনোর কাছে বিদায় নিয়ে, তার ছেলেমেয়েদের আশীর্বাদ করে বাড়ি চললেন। পথে যেতে যেতে দুর্বার শেকড় লেগে পায়ে রক্ত পড়ল। তিনি উঁচু হয়ে বসে পড়লেন। রাজা বললেন, ‘এ্যাঁ, এমন ঘাস ছুলেছে যে, শেকড় পুটে মহারানির পায়ে রক্ত পড়ল? যাতো রে, আঠারো হাড়ির মাথা নিয়ে আয়, আর বুড়ো হাড়িনীর চোখ তুলে নিয়ে আয়।’ রাজ-অনুচরেরা তাই করলে। মহারাজ উমনোর হাত ধরে ঘরে নিয়ে গেলেন।

দিনকতক পরে মহারাজের বাপের শ্রাদ্ধ হল। সেদিন রাজবাড়িতে খুব ঘটা; দীন-দুঃখী কেউ উপবাসী নেই। এমন সময় উমনোর মনে হল, ‘আজ যে আমার ইতুপুজো, এখন কেউ তো উপবাসী নেই, কাকে নিয়ে কথা শুনবো।’ রাজা বললেন, ‘সেই যে হাড়িনীর আঠারো ছেলের মাথা কেটেছি, সে বোধহয় কিছু খায়নি, তবে তাকে নিয়েই কথা শোন।’ তৎক্ষণাৎ বুড়ো হাড়িনীকে আনান হল। হাড়িনী এসেই চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল, ‘সর্বনাশি! একবার এসে রাজার সর্বস্ব খেয়েছ, এবার এসে আমার আঠারো বেটার মাথা খেয়েছ, আমার দুটি চোখ খেয়েছ, এখনও কি পেট ভরেনি? এবার বুঝি আমায় খাবে? তা খাও না, আর আমার বাঁচায় সুখ কি?’ উমনো চোখের জল মুছে বললেন, ‘না মা! আমায় ভয় করিসনি, আয় ব্রত করি, আবার তোর সব হবে।’ হাড়িনী কিছু না বলে চুপ করে রইল।

উমনো তাকে স্বহস্তে স্নান করিয়ে, নূতন কাপড় পরিয়ে, কাছে করে নিয়ে ব্রতকথা শোনাতে বসলেন। কথা সাঙ্গ হতে বললেন, ‘বর মেগে নে মা, যেন তোর সব আবার তেমনি হয়।’ হাড়িনী তখন বললে, ‘মা ইতুলক্ষী! আমার আঠারো বেটা ফিরে আসুক, আমার চোখ হোক, আমাদের দুঃখ নিবারণ করো মা!’ দেখতে দেখতে হাড়িনীর দুটি চোখ হল। রানি বললেন, ‘এই এক গামলা ভাত তরকারি নিয়ে যা, তোর ছেলেরা খাবে।’ হাড়িনী আবার চীৎকার করে কেঁদে উঠল। ‘আহা, বাছারা কি আমার আছে মা! তাদের যে মহারাজ কেটে ফেলেছেন।’ উমনো বললেন, ‘দেখগে যা, তোর ছেলেরা বেঁচেছে।’ হাড়িনী তখন কাঁদতে কাঁদতে ভাতের গামলা মাথায় করে বাড়ি গেল। যেতেই ছেলেরা বললে, ‘ওমা, কোথায় গিয়েছিলি মা! আমরা না খেতে পেয়ে মরে গেলুম, দে বলছি খাবার দে।’ এই রকম করে আঠারো ছেলে হাড়িনীর কাছে এল। হাড়িনী বললে, ‘চুপ কর বাবা! এই নে ভাত খা, তোরা কি ছিলি বাছা! রাজা যে তোদের মাথা নিয়েছিলেন। রানি মা কি ব্রত জানেন, সেই ব্রত করে তবে তোদের বাঁচিয়েছেন।’

রাত না পোহাতেই হাড়িনী আহ্লাদে আটখানা হয়ে রাজবাড়ি পরিষ্কার করতে লাগল। রাজা উঠে হাড়িনীর হাত ধরে বললেন, ‘ছি রানি, তুমি কেন এসব কাজ করছ? তোমার জন্যে আঠারো হাড়ি গিয়েছে, আমি আঠারো হাজার হাড়ি আনিয়ে দেব।’ হাড়িনী লজ্জায় জড়সড় হয়ে বললে, ‘মহারাজ, আমায় ছুঁলেন কেন? আমি যে হাড়িনী।’ রাজা বললেন, ‘এ্যাঁ, তুমি হাড়িনী? তুমি কী করে এত সুন্দরী হলে? আর তোমার চোখ হল কী করে?’ হাড়িনী তখন উমনোর ব্রতের কথা বলতে লাগল। ‘মহারাজ, আমার আঠারো বেটা বেঁচেছে, আর আমাদের কোনও দুঃখ নেই। মা ইতুলক্ষ্মী আমাদের অনেক ধনদৌলৎ দিয়েছেন।’

রাজা তখন উমনোকে গিয়ে বললেন, ‘তুমি যদি এমন ব্রত জানো রানি, তবে আমরা মর্ত্যে থাকি কেন? চল স্বর্গে যাই।’ তখন রাজা ছেলে মেয়ের বিয়ে দিলেন, পাত্রও ছেলে মেয়ের বিয়ে দিলেন, ব্রাহ্মণ ছেলের বিয়ে দিলেন, হাড়িনী আঠারো ছেলের বিয়ে দিয়ে বউ আনলে। সকলেই ছেলেদের সংসার বুঝিয়ে দিয়ে, ঝি বউদের ইতুর ব্রত করতে বললেন। তারপর উমনো, ঝুমনো, রাজা, পাত্র, ব্রাহ্মণ, ব্রাহ্মণী এবং সেই হাড়িনী একত্র হয়ে ইতুপুজো করলেন। ইতুলক্ষ্মী দেখা দিয়ে বললেন, ‘তোমরা কী বর চাও?’ সকলেই বললেন, ‘মা! আমাদের সংসারে সুখ স্বাচ্ছন্দ্য সবই হয়েছে, আর এখানে থাকব না। আমাদের স্বর্গে নিয়ে চল।’ তখন চুয়া চন্দনের ছড়া পড়তে লাগল; আকাশ থেকে পুষ্পবৃষ্টি হল, স্বর্গ থেকে রথ এল। সকলে, ছেলে মেয়েদের বুঝিয়ে রেখে, আশীর্বাদ করে, ইতুর রথে চড়ে স্বর্গে গেলেন।

কাটি মুটি কুড়াতে গেলাম,
ইতুর কথা শুনে এলাম।
এ শুনলে কী হয়?
নির্ধনের ধন হয়,
অপুত্রের পুত্র হয়,
আইবুড়োর বিয়ে হয়,
অস্মরণের স্মরণ হয়,
অন্ধের চক্ষু হয়,
অন্তকালে স্বর্গে যায়।

অঘ্রাণ মাসের ইতুর কথা সমাপ্ত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *