গ্রন্থভূক্ত কবিতা (কাব্যগ্রন্থ)
গান
অগ্রন্থিত কবিতা
গল্প
চলচ্চিত্র কাহিনী ও চিত্রনাট্য
সম্পাদকীয়, গদ্য ও বক্তৃতা
সাক্ষাৎকার
1 of 2

ইতর

ইতর

১.

প্রখ্যাত কথাশিল্পী সৈয়দ বাবার আলী তাঁর কথা রেখেছে। এতোটা শরীফা সাক্ৰীন ভাবতেও পারেনি। বাবর যে এতো শিগরি তার সাথে এরকম ভাবে জড়িয়ে যাবে তা সত্যিই শরীফার কল্পনার বাইরে ছিলো। এক ঝলক হালকা হালকা খুশির হাওয়ায় ঝরঝরে হয়ে ওঠে শরীফার মন।

শরীফা সৌন্দর্য সচেতন মেয়ে। তবে আত্মনির্ভরশীল একটি বিজ্ঞানসম্মত পেশায় যুক্ত থেকেও রূপ নিয়ে গর্ব করার মতো মধ্যযুগীয় মূর্খতাকে এখনো সে ত্যাগ করতে পারেনি। সচেতন উদাসিনতায় সে নিজেকে প্রকাশিত করতে অভ্যস্ত। তবে সে সুন্দরী। চেহারায় খুব একটা ঘষামাজা না-কোরেও তার সুগঠিত দীর্ঘ শরীরের জন্যে সে সহজেই দৃষ্টি আকর্ষন করে। আর এ জন্যেই ভেতরে ভেতরে এক নীল অহংকার তার অজান্তেই দানা বেঁধে উঠেছে।

‘সত্যিই অপূর্ব লাগছে তোমাকে। আর তোমাকে যতো দেখছি ততোই নিজের উপর নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেলছি আমি’। হাসতে হাসতে বলে আফসার।

ওরা মুখোমুখি বসেছিলো আফসারের অপিসে। আফসার হোসেন একজন সরকারি কর্মকর্তা। ছাত্র জীবনে সমাজ ভাঙতে আগ্রহী একটি ছাত্র সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলো সে। সমাজে অর্থনৈতিক সমতার পক্ষে এবং শোষনের বিপক্ষে বহু মিছিলে সে নেমেছে। পুলিশের তাড়া খেয়েছে। এখন সে গনতন্ত্রের পোশাকে মোড়া সামরিক সরকারের কাগুজে উন্নয়নের মাহাত্ম প্রচারের দায়িত্বে নিয়োজিত।

শরীফা নিজের চেয়ারে একটু ন’ড়ে চ’ড়ে বসে। সামান্য লজ্জার ভাব নিয়ে আসে মুখে। হাতের বইটি থেকে মুখ তুলে বলে’সত্যি? তুমি তো সব সময়ই অপূর্ব অপূর্ব বোলে কান ঝালাপালা করো। সত্যি না মিথ্যা কি কোরে বুঝি?

শরীফা নিজের সৌন্দর্য সম্পর্কিত বিষয়টিকে দীর্ঘায়িত করতে চায়। আফসার টেবিলে ঝুঁকে আসে, আন্তরিকতা প্রকাশের উদ্দেশ্যে হাত বাড়িয়ে শরীফার হাত ছোঁয়, বলে— ‘সত্যি, সত্যি, তোমায় প্রথম যেদিন দেখেছি…’

‘গানটা কিন্তু খুব সুন্দর।’ শরীফা প্রসঙ্গ পাল্টায়।

হাতে একটা ফাইল নিয়ে পিওন ঘরে ঢোকে। আফসার হাত সরিয়ে নেয়। চেহারায় গম্ভীর ভাব ফিরিয়ে আনে। শরীফা হাতের বইটির পৃষ্ঠা উল্টাতে থাকে।

এটি আফসারের প্রথম কবিতার বই। শরীফাই প্রকাশক, টাকাগুলো জলে গেল, শরীফা ভাবে। আফসার বলেছিলো বই বের হলে বিক্রির ব্যবস্থা ও-ই করবে। তো সে বলা বলাই। বই বের হবার পর আফসাররে কোনো খবর নেই। শরীফা অপিসে খোঁজ নিয়েছিলো। নেই। ছুটিতে বাড়ি গেছে। কবে আসবে? ঠিক নেই। কি আর করা— ব্যাগে ভ’রে কিছু বই নিয়ে ঢাকায় কয়েকটা বইয়ের দোকানে দিয়েছিলো শরীফা। বাকি সমস্ত বই তার খাটের নিচে পরম নিশ্চিন্তে জ’মে আছে এখনো। আফসারকে বোলে বোলে শেষমেশ ক্লান্ত হয়ে ও বিষয়ে ভাবাই ছেড়ে দিয়েছে সে। পিওনটা কাজ সেরে বেরিয়ে যেতে ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শরীফা আফসারের দিকে তাকায়। আক্ষেপ মেশানো ভেজা কণ্ঠে বলে—

‘জানো, আট, আটটা বছর কায়েসের সাথে কাটালাম, একটা দিনও ওর মুখ থেকে শুনিনি— তোমাকে সুন্দর লাগছে। কতোদিন সেজেগুঁজে ওর সামনে ঘুর ঘুর করেছি, ও নির্বিকার। চেহারার কথা সরাসরি কি কোরে বলে, জিগ্যেস করেছি, দ্যাখোতো শাড়িটা কেমন লাগছে। ও চোখ তুলে তাকিয়েছে, মুহূর্তমাত্র দেখেই বলেছে, চলে। আমি জোর করেছি, শুধু চলে? ও বলেছে, বেশতো ভালোই লাগছে। জানো কি যে কষ্ট লাগতো তখন। মন ভেঙে আসতো। আসলে ও কখনোই আমাকে ভালোবাসেনি।’

আফসার মুখে ও কন্ঠস্বরে গম্ভীর একটি দুঃখ দুঃখ ভাব ফুটিয়ে তুলে বলে— ‘কায়েস সত্যিই তোমার উপর অবিচার করেছে। তোমার জায়গায় আমি হলে কখনোই ওকে ক্ষমা করতাম না।’

রমন সম্পর্কিত দুটি লোকজ শব্দ তার জিভের ডগায় এসে গিয়েছিলো। উচ্চারিত হবার আগেই সে শব্দদুটো গিলে ফেল্লো। উচ্চশিক্ষিত একজন সুন্দরীর সামনে এ জাতীয় শব্দ উচ্চারন যে অনুচিত আফসারের পদমর্যাদা আর সামাজিক রীতিনীতি তা তাকে শিখিয়েছে। সে চোখে উদাস দৃষ্টি নিয়ে শরীফার দিকে তাকায়। শরীফা মুখ নিচু কোরে নোখের পালিশ খুঁড়ছে। আসলে সে কোনো এক ভাবনায় ডুবে আছে।

‘ক্ষমা আমিও ওকে করিনি। তিল তিল কোরে আমি শোধ নেবো’। এ কথা সে ভাবে, মুখে বলে ‘আচ্ছা, অনুষ্ঠানের ব্যাপারে কিছু ভাবছো? আমাকে একটু হেল্প করো না, প্লিজ।’

‘ভাবাভাবির আর কি আছে! প্রধান অতিথির সাথে তো কথা বোল্লে। তিনি কনফার্ম। তাছাড়া হাতে এখনো অনেক সময়— তুমিই যথেষ্ট।’

‘আসলে তুমি কাজ করতে চাও না, তাই বলো’ শরীফা রুষ্ট হয়।

‘এই ধরনের কাজ আমি কখনোই করতে পারি না। টলস্টয়ের বইটা নেবে আজকে?’ আফসার চেয়ার ছেড়ে ওঠে। অপিস ঘরের লাগোয়া রুমটাই তার শোবার ঘর। পর্দা ঠেলে ঘরে ঢোকে সে। শরীফা একবার তাকিয়ে দেখে টেবিলে রাখা টেলিফোন গাইডের কভারে এটা সেটা লিখতে থাকে। ভাবনায় ডুবে গেছে সে।

শরীফাদের সংগঠন সাহিত্য আসরের আয়োজন করেছে। একটু আগেই টেলিফোনে বাবর আলীর সাথে কথা হয়েছে তার। বাবর প্রধান অতিথি হয়ে আসবে কথা দিয়েছ। বলতেই রাজি। যেন অপেক্ষা কোরে ছিলো কোনো একটা উপলক্ষে শরীফার কাছে আসার জন্যে। কায়েসের সাথে ছাড়াছাড়ি হবার পর বাবর অবশ্য শরীফার কাছে মাঝে মধ্যে আসবে এরকম কথা দিয়েছিলো। বাবর কথা রেখেছে। এর মধ্যেই বার তিনেক শরীফার কাছে সে এসেছিলো।

শরীফা ভেতরে ভেতরে গর্বিত হয়। বাবরের মতো নামকরা লেখকের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দেখে মফস্বলের নবীন লেখকরা শ্রদ্ধা মেশানো এক ধরনের গদ গদ ভাব করে তার সাথে। শরীফা চুটিয়ে তা ভোগ করে।

ভাবতে ভালো লাগে দেশের জনপ্রিয়তম লেখকের সাথে তার অন্তরঙ্গতা। বিখ্যাত দুজন গায়ক টিভির প্রিয় দুজন নায়কের সাথেও তার ভালো জানাশোনা। যদিও কায়েসের সাথে সংসার করার সময়েই এসব পরিচয়ের শুরু তবে তখন তা যেন কেমন জড়তা মেশানো ছিলো। মনে হতো যেন কায়েসের স্ত্রী হিশেবেই এই সম্পর্ক। ইচ্ছে মতো ওদের সাথে মিশতেও কেমন বাধতো। তার মধ্যেও যে দু একদিন কারো কারো সাথে বাসায় দ্যাখা করেনি, চাইনিজ খায়নি বা একসাথে বেড়ায়নি এমন না। তবে তা এখনকার মতো নয়।

শুধু সে, ব্যক্তিগতভাবে শুধু তার কারনেই তার সাথে সম্পর্ক— এ ব্যাপারটা ভাবতেই শরীফার নিজের গুরুত্বও নিজের কাছে বেড়ে যায়। ভালো লাগে। এটাই সে চেয়েছিলো সব সময়। কিন্তু কায়েসের জন্যে তা হয়ে উঠতো না। তার বড্ড গুটিয়ে থাকার স্বভাব। অজান্তে দীর্ঘশ্বাস পড়ে। শরীফা মাথা তুলে সামনে তাকিয়ে দ্যাখে আফসার নেই। ‘আফসার ভাই—’

‘জ্বী বোন’ শোবার ঘরে থেকে ঠাট্টার স্বরে উত্তর দেয় আফসার। কায়েসের সহপাঠী ছিলো সে। আগে শরীফা তার নামের শেষে ভাই যোগ কোরে সম্বোধন করতো। সাম্প্রতিক ঘনিষ্ঠতায় নামের শেষের ভাইটুকু টিকটিকির লেজের মতো টুক কোরে কখন জানি খ’সে পড়েছ।

পুরোনো সম্বোধনে লজ্জা পায় শরীফা। স্বভাবসলুভ উচ্চস্বরে হেসে ওঠে। আর তখনি হাতে ‘আনা কারেনিনা’ নিয়ে আফসার অপিস ঘরে ঢোকে। বারান্দা থেকে দরোজায় মুখ বাড়িয়ে পিওন জিগ্যেস করে ‘জ্বী স্যার’?

শরীফার হাসি অথবা আফসারের উচ্চকন্ঠ তাকে বিভ্রান্ত করেছে, আফসার উর্ধতন স্বরে বলে ‘কি ব্যাপার?’

পিওন অপ্রস্তুত অবস্থায় ফ্যাল ফ্যাল কোরে চেয়ে থাকে। হাসি চেপে আফসার ধমকে ওঠে ‘যাও, কিছু না…’

অতপর শরীফা ও আফসার উচ্চ হাসিতে ফেটে পড়ে। হাত বাড়িয়ে বইটা নেয় শরীফা। আফসার চেয়ারে বসতে বসতে বলে—

‘টলস্টয় না পড়লে জীবনের ব্যাপকতা আর মানব মনের গভীরতা সম্পর্কে অনেক কিছুই অজানা থেকে যায়— ভালো কোরে টলস্টয় পড়ো।

‘হুমায়ুন, মিলন, সুনীল এদের লেখাই আমার বেশি ভালো লাগে।’

‘মানিক পড়েছো? দস্তয়ভস্কি, চেখভ, হেমিংওয়ে এদের লেখা পড়েছো?’

‘পড়েছি— আছে— মোটামুটি। মানিকের পুরো রচনাবলী আছে আমার। বাবর, ভাইর গত ঈদের উপন্যাসটা পড়েছো? দারুন!’

‘আমার ভালো লাগেনি— ট্রাস। ভাষাটা ভালো বোলে পড়া যায়, এছাড়া একেবারে ভুষা মাল।’

‘আরে রাখো— সবাই ভালো বলছে। সুনীলের চিঠি দেখিয়েছে আমাকে বাবর ভাই। সে কি প্রশংসা তার।’

‘সুনীল বোল্লেই কি সেটা ভালো হয়ে যায় নাকি?’

‘আর তুমি বোল্লেই কি তা খারাপ হয়ে যায়? কে চেনে তোমাকে?’

আফসার মনে মনে আহত হয়। প্রকাশ করে না। আর ঠিক এসময় ব্রিতকর বিতর্কের কবল থেকে দুজনকে উদ্ধার করার জন্যেই যেন টেলিফোনটি কর্কশ কণ্ঠে বেজে ওঠে।

“ওহো, এই আমি যাচ্ছি।’ শরীফা ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায়।

‘আরে বোসো না।’ আফসার হাত বাড়িয়ে রিসিভার না তুলে ধ’রে রাখে। ‘কাজ আছে চলি।’

‘বিকেলে আসবা? নদীতে বেড়াতে যাবো।’ আফসার প্রলুব্ধ করে।

‘না, নদীতে না’ এক মূহূর্ত ভাবে— ‘এক কাজ করো, গাড়ি থাকবে বিকেলে?’ ‘হ্যাঁ’।

‘তাহলে শহরের বাইরে কোথাও যাবো; ঠিক আছে?’ শরীফা বেরিয়ে পড়ে।

আফসার ওর গমনপথের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে রিসিভার কানে ঠেকায়। দারুন শরীর। কায়েসটা চুটিয়ে ভোগ করেছে। শালা লম্পট!

২.

শরীফা বাসায় ফিরে শোনে হাবিব তার জন্যে অনেকক্ষন অপেক্ষা কোরে চ’লে গেছে। খেয়াল হয় ওকে সে আজ আসতে বলেছিলো। কি যে হয়! কিচ্ছু মনে থাকে না। কী ভাববে হাবিব! নাহ্ জঘন্য! নিজেকে বার বার গালি দেয় শরীফা।

খান চারেক চিঠি এসেছে। একটা টেলিগ্রাম। প্রথমেই টেলিগ্রামটা খোলে সে। ‘ঢাকা আসো’– কায়েস। হুঁ, ঢাকা আসো! মনে মনে ক্ষেপে ওঠে শরীফা। কী আদেশ! আমি যেন এখনো ওর বউ আছি! তু তু কোরে ডাকলেই ছুটে যাবো। এখনো ওর ঔদ্ধত্য যায় না। কী ভাবে কি ও আমাকে! ভুল হয়েছে। শরীফা ভাবে। সম্পর্ক শেষ কোরে আসার পর আবার ওর সাথে গিয়ে থাকা ঠিক হয়নি। আর অতো আবেগ নিয়ে ওকে চিঠি লেখা উচিত হয়নি। কিভাবে যে সে আবার ওর কাছে গিয়ে থাকলো ভাবতেই অবাক হয় শরীফা। তবে কি কায়েসের জন্যে এখনো তার দুর্বলতা রয়ে গেছে! ভেতরটা খচ্ খচ্ কোরে ওঠে। পুরুষের আদোর পাবার জন্যে কেঁদে ওঠে মন। অনেকদিন সে একা। তার যুবতী শরীর, তার উদ্দাম মনটাকে সে নিংড়ে ফেলতে পারে না।

সে ঢাকা যাবে। না। কেন আমি ঢাকা যাবো? কায়েসের কাছে যাবো? অসম্ভব। তিল তিল কোরে যে আমাকে ধংশ করেছে, একফোঁটা ভালোবাসা দেয়নি, অপমানে, অবহেলায় শেষ কোরে দিয়েছে, তার কাছে যাবো? আবার?

ভাবতে ভাবতে সে চিঠিগুলো খুলছিলো। প্রথম চিঠিটা তরুন গল্পকার ইকরামুল হকের। সার সংক্ষেপ হলো— জীবনটাকে যদি আবার পেছন থেকে শুরু করা যেতো এই নিয়ে আক্ষেপ, কিছু স্মৃতিচারন। কিছু আবেগে অস্পষ্ট কাছে পাবার প্রস্তাব। শরীফা ভাবে— কায়েস না হয়ে ইকরামুলের সাথে কেন তার প্রেম হলো না! কায়েসের আগেই তো ইকরামুলের সাথে তার চিঠিতে যোগাযোগ হয়েছিলো।

দ্বিতীয় চিঠি ‘উপত্যকা’ নামের একটি লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক হারেস রকিবের। বেচারা নাস্তানাবুদ ভাষায় প্রেম নিবেদন করেছে। এক সময় শরীফা তার প্রতি অকাতরে দুর্বলতা প্রকাশ করেছিলো। বেশ খানিক গড়িয়েও ছিলো সম্পর্কটা। মাঝখানে কায়েস এসে উদয় হওয়ায় ব্যাপারটা ছাইচাপা প’ড়ে যায়। সম্প্রতি আবার তা অগ্নিশিখায় রূপ নিতে চাইছে।

শরীফার বিরক্তিবোধ হয়। পুরুষ মানুষ এতো ন্যাকা ন্যাকা হবে কেন! এ কি ভাষা রে বাবা! অনুমতি পেলেই যেন পদসেবায় লেগে যাবে। সযত্নে চিঠিখানা ভাঁজ করতে করতে শরীফা ভাবে— মন্দ কি, দু’দশজন এরকম কাতর বিনীত প্রেমপ্রার্থী থাকলে কোন মেয়েরই না ভালো না লাগে।

বাকি চিঠি দুটি মফস্বলের পত্রিকা থেকে লেখা চেয়ে পাঠানো হয়েছে। শরীফার চিন্তায় আবার কায়েস হানা দেয়। কায়েসের সাথে তার সম্পর্কটা তালগোল পাকিয়ে গেছে। উকিলের মাধ্যমে ডিভোর্স লেটার পাঠানোর পাঁচদিন পরেই শরীফা কায়েসের বাসায় ফিরে যায় এবং স্বামী-স্ত্রীর মতো থাকতে শুরু করে।

কায়েসের মানসিকতা একেবারেই অস্বাভাবিক। প্রচলিত কোনো নিয়ম-নীতিরই সে ধার ধারে না। নারী পুরুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও তার কোনো সংস্কার নেই। উড়নচন্ডী জীবনযাপনের দিকেই তার অতি মাত্রায় আগ্রহ।

শরীফা লক্ষ্য করে তার ডিভোর্স লেটার কায়েসের বাসায় পৌঁছেনি। উকিলের ঠিকানা লেখায় কোনো ভুলটুল হয়তো থাকবে। ডাক বিভাগের গাফিলতিও হতে পারে। যা হোক চিঠিটা সে পায়নি। তবে বিষয়টা তার অজানা নয়। কারন উকিলের ফি আর আদালত খরচের টাকা কায়েসের কাছে থেকেই শরীফা নিয়েছিলো। শরীফার ঠোঁটের কোনে সামান্য একটু বাঁকা হাসি ঝুলে থাকে। বেশ হয়েছে, ওর টাকা দিয়েই ওকে জব্দ করা হয়েছে।

কিন্তু পরক্ষনেই তার ঠোঁটের বাঁকা হাসি মিলিয়ে গিয়ে শান্ত বিষণ্নতায় ছেয়ে যায় মুখখানা। কায়েসকে কি আসলেই সে জব্দ করতে পেরেছে? কায়েস তো নির্বিকারভাবে মেনে নিয়েছে সবকিছু। এখনো পর্যন্ত সে কারো কাছে শোনেনি যে কায়েস তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করেছে। অবশ্য অভিযোগ করার কি আছেই বা কায়েসের? অভিযোগ তো সব একা তারই এবং কায়েসের বিরুদ্ধে।

“কিরে বুবু, কৈ ছিলি? হাবিব ভাই এসে বোসে ছিলো অনেকক্ষন।’ ছোট বোন আরিফা বাইরে থেকে ঘরে ঢুকে চিঠিপত্র নিয়ে শরীফাকে ঝিম মেরে বোসে থাকতে দ্যাখে। ফ্রিজ খুলে বোতল বের কোরে জল ঢালে গ্লাসে।

‘বেচরাকে এমন নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছিস কেন বলতো? আহা, কতো কথা। তোর চিন্তায় একেবারে অস্থির। পারলে আজই তোকে নিয়ে ঘরে ওঠায়।’ আরিফা বাঁকা কোরে হাসে।

‘তুই ঝুলে পড় না। ডাক্তার ছেলে, খারাপ কি?’ শরীফাও কন্ঠস্বর বাঁকায়।

ভেংচি কাটে আরিফা ‘বাহ্-বাহ্ তুই ঝুলে পড় না। কি একখানা ছেলে আমার! ভ্যাবলাকান্ত, এক্কেবারে ডাঁসা লাল মুলো।’

‘লাল মুলোই তো খেতে স্বাদ বেশি। একবারে গ’লে যায়। চিবোতে পর্যন্ত হয় না।’ শরীফা উপদেশ দেয়।

আরিফা কৃত্রিমভাবে কটমট কোরে বলে ‘চিবিয়ে খেতেই আমার মজা লাগে বেশি। আর তা যদি মাথা হয়, তাহলে তো কথাই নেই।’

শরীফা এবার ঠাট্টার সুর পাল্টে স্বাভাবিক হয়। ‘বাবর ভাই-র সাথে কথা হয়েছে। উনি আসার জন্যে এক পায়ে খাড়া

‘তা-ই’ আরিফা উল্লসিত হয়ে ওঠে। উনি এলে একটা কাজ হবে।

‘এদিকের সব ব্যবস্থা কোরে দিয়ে আমি ঢাকায় যাবো। বাবর ভাইকে নিয়ে অনুষ্ঠানের আগের দিন সন্ধ্যায় এসে পৌঁছবো।’ শরীফা তার পরিকল্পনা জানায়।

‘দেখো, আবার গিয়ে যেন কায়েসের বাসায় উঠো না। তোমাকে তো বোঝা ভার।’ আরিফা সাবধান করে।

৩.

কলিং বেল টিপতেই কাজের ছেলেটি দরোজা খুলে দাঁড়ায়। ছেলেটি নোতুন এসেছে। শরীফা আগে একে দ্যাখেনি। ছেলেটির প্রশ্নবোধক চাউনিকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকতেই শরীফা দেখতে পেলো কায়েস ড্রইংরুমে বোসে কিছু একটা পড়ছে। একই সাথে বিস্ময়, আক্ষেপ আর বিষণ্নতা আক্রমন করলো শরীফাকে। এই ঘোর সন্ধায় কায়েসকে বাসায় পাবে সে ভাবতেই পারেনি। নিজেকে ধিক্কার দিলো শরীফা। কেন এলো সে? এরকম বেহায়াপনার কোনো মানে হয়? সে-ই তো সব সম্পর্ক চুকিয়ে বুকিয়ে গেছে। নিজেকে খুব হ্যাংলা আর কাঙাল মনে হলো। এরকম মনে হতেই বিষন্ন হয়ে গেল তার মুখখানা।

কায়েস মুখ তুলে তাকাতেই শরীফাকে দেখতে পায় ‘তুমি! এসো, বোসো। কেমন ছিলে?’

কায়েসের আচরনে বিস্ময়, আনন্দ বা উচ্ছাস কিছুই প্রকাশ পেলো না। সেটি শরীফার জন্যে আরো বেশি মর্মপীড়ার কারন হলো। আশ্চর্য এই লোকটি। শরীফা ভাবলো। কোনো কিছুতেই কি সে খুশি হতে জানে না? এমন কি অনাকাংখিত ভাবে মূল্যবান কিছু পেয়ে গেলেও বিস্মিত হয় না? নিজেকে কী ভাবে সে?

শরীফা একেবারেই যেন কুঁকড়ে গেল। কায়েসের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে তার পাশের সোফায় বোসে ব্যাগটি টেবিলের ‘পরে রাখলো। কায়েস তার দিকে তাকিয়ে আছে। ঠোঁটের কোনায় যেন হালকা একটু হাসি মাখানো। এরকম একটা ভাব, যেন সে জানতো শরীফাকে অবশ্যই আসতে হবে। যেন তারই জন্যে এই ঘোর সন্ধায় বোসে অপেক্ষা করছিলো। তা না হলে এখন সে বাসায় কেন? তার তো এখন শুঁড়িখানা বা বারে থাকার কথা। গা জ্বালা কোরে উঠলো শরীফার। যথাসম্ভব স্বাভাবিকভাবেই সে বোল্লো ‘দেখতে এলাম, কি রকম আছো।

মাথা ঘুরিয়ে ঘরের চারপাশে চোখ বুলালো সে। ‘বুক সেলফটা দেখছি না?’

‘ভিতরের ঘরে সরিয়ে নিয়েছি।’ কায়েস উত্তর দেয়।

শরীফার মনে পড়ে বুক সেলফটি বাসায় আনার পর কোথায় রাখা হবে তা নিয়ে কায়েসের সাথে তার ঝগড়া হয়েছিলো। রাতে সেদিন না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলো শরীফা। মাঝরাতে কায়েসের দাম্পত্য আদোরে তার ঘুম ভেঙেছিলো। দীর্ঘশ্বাস ফ্যালে শরীফা।

‘ওঠো, হাত মুখ ধোও। কিসে এলে? ট্রেনে?’ কাজের ছেলেটিকে কায়েস চা এবং চায়ের সাথে বিস্কুট দিতে বলে।

একটু কেমন দ্বিধা দ্বিধা ভাব নিয়ে শরীফা কায়েসের সাথে শোবার ঘরে ঢোকে।

এক যুগের অর্ধেকেরও বেশি সময় সে এই ঘরে থেকেছে। এই বিছানায় শুয়েছে। এই ঘরের সব কিছুর সাথেই জড়িয়ে আছে তার পছন্দ অপছন্দ। তার স্মৃতি। তার সুখ। সুখ?

সে কি কখনো সামান্যতম সুখ পেয়েছে? কোনো একটি দিনের জন্যেও কি সে সুখি ছিলো? সুখের একটি কনাও যদি সে কখনো না পেয়ে থাকে তবে এতো দীর্ঘদিন কি ভাবেই বা কায়েসের সাথে সে ঘর করলো? কন্ঠার ঠিক নিচে কি যেন একটা দলা পাকিয়ে যায় তার। কষ্ট হতে থাকে।

‘কৈ দাঁড়িয়ে থাকলে কেন?’ কায়েস তাড়া দেয়।

শরীফা সংলগ্ন বাথরুমে ঢুকে দরোজা আটকে দেবার পর জল পড়ার শব্দ আসতে থাকে। কায়েস জানালাগুলোর পর্দা টেনে দিয়ে ঘরে আলো জ্বেলে দেয়। ঘরখানাকে খুব ছোট আর অন্তরঙ্গ মনে হয়।

কায়েসের ধারনাও ছিলো না শরীফা হঠাৎ এভাবে তার কাছে আসবে। সে অবাক হয়েছে, খুশিও হয়েছে। কিন্তু সব সময় যেমন হয়, এখনো তার আনন্দ বা বিস্ময় বাইরে থেকে দেখে কিংবা তার আচরনে সামান্যতমও বোঝা যায় না। সে যেন একটা কচ্ছপ। শক্ত আবরনে ঢাকা একটা শরীর। ভেতরের কোনো কিছুই বাইরে থেকে বুঝবার উপায় নেই। সন্ধার পর একটা কক্‌টেলে তার দাওয়াত আছে। কায়েস ভাবলো— না, সে যাবে না। বরং শরীফার সাথেই তার থাকা উচিত হবে। আবার যখন ও ফিরে এসেছে, আলাপ আলোচনা কোরে বিরোধগুলোর মীমাংসা করা যায় কিনা— চেষ্টা কোরে দেখতে দোষ কি?

শরীফা বেরিয়ে আসতেই কায়েস ওকে জড়িয়ে ধ’রে চুমু খেতে থাকে।

‘দাঁড়াও, দাঁড়াও, মুখটা আগে মুছে নি।’ শরীফা নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করে কিন্তু পারে না। অথবা সে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চায় না।

অনেকদিন বিরতির পরে হলেও ধীরে ধীরে তারা দাম্পত্যের পরিচিত ও অভ্যস্ত রাস্তায় চলতে শুরু করে। পারস্পরিক বিরোধের কথা তাদের মনে থাকে না। তারা ভুলে যায় দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতার কথা। উদ্দাম শরীর তাদের একটি বিন্দুতে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়।

.

কায়েসের দিকে ফিরে কাত হয়ে শুয়ে আছে শরীফা। একখানা হাত ভাঁজ কোরে মাথার নিচে ঠেস দেয়া। ও তাকিয়ে আছে শুয়ে থাকা কায়েসের চিবুক এবং ঘাড়ের ফাঁক দিয়ে টেবিলে রাখা চায়ের কাপ, গ্লাস পার হয়ে দেয়াল ঘেঁষে থাকা স্টিলের আলমারির আয়নার উপরের কোনে। স্থির হয়ে আছে চোখ। আসলে শরীফা এসবের কিছুই দেখছে না। বিছানায় সম্পূর্ন ছেড়ে দেয়া শ্রান্ত শরীর। খানিক আগের শারীরিক উন্মাদনার তৃপ্তি মেশানো ক্লান্তিতে ভেজা ওর মুখ। শান্ত উদাসিন। ভেতরের তোলপাড়ের সামান্য ছাপ নেই বাইরে। নিজের পাছায় সন্ধিবেত দিয়ে আচ্ছা কোরে পেটাতে ইচ্ছে হয় তার। আবার সেই কায়েসের সাথে শরীরের সম্পর্ক! সেই কায়েস! ক্ষোভে, আক্ষেপে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে ইচ্ছে করে শরীফার। কিন্তু সে কিছুই করে না। খুক কোরে সামান্য একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে শুধু।

কী শনিতে যে পেয়েছিলো। এসে উঠলো কায়েসের বাসায়। আর একটু আদোর পেতেই বিছানায় ল্যাপ্টালেপ্টি। তাহলে কি কায়েস তার আগের স্থানেই রয়ে গেছে এখনো তার মধ্যে! হয়তো সমস্ত অবচেতন জুড়েই রয়েছে শয়তানটা।

এটাকে কী বলবে শরীফা? প্রেম? প্রতিশোধ? শরীরের তাড়না? বিকৃত রুচি? কী? কী বলবে একে? আইনের সম্পর্ক, সামাজিক সম্পর্ক সব শেষ কোরে দিয়ে এই যে আবার শরীরের সাথে সম্পর্ক হওয়া এটা কি ঠিক? আইন বা সমাজ কি শরীরের সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রন করে না?

দুজনের ইচ্ছেতে যদি হয় তবে দোষটা কি? আইন বা সমাজের তাতে কীইবা বলার থাকতে পারে? পশ্চিমে তো এসব একেবারেই ডালভাত। শরীফা নিজের প্রতি আশ্বস্ত হয়। ব্যাপারটা আসলে সম্পূর্ন মনের। মনের সাথে প্রতারনা না করলেই হলো। আইন, সমাজ এসব দ্যাখানো জিনিশ। ওসবের উপর কোনো শ্রদ্ধা রাখা চলে না। মানতে হয় তাই মানা।

এরকম ভেবে শরীফা মাথার নিচ থেকে হাত বের কোরে সামান্য ন’ড়ে শোয়। কায়েস একবার তাকিয়ে দ্যাখে শরীফাকে। এতোক্ষন সে ছাদের দিকে তাকিয়ে নিরবে ধুমপান করছিলো। আরেকবার চা খেতে পেলে মন্দ হয় না। শুয়ে থেকেই জোরে কাজের ছেলেটার নাম ধ’রে ডাকতে ইচ্ছে হলো কায়েসের। কিন্তু ডাক দিতে গিয়ে আবার দিলো না, ভাবলো সেটা অশোভন দ্যাখাবে। অথচ সিগারেটটা শেষ না কোরে উঠতেও ইচ্ছে করছে না।

.

নাহ্ বাবর ভাই-র বাসায়ই যাওয়া উচিত ছিলো। শরীফা ভাবে। যদিও একাই থাকছেন তিনি এখন। স্ত্রীটি তার পুত্র কন্যা নিয়ে কিছুদিন থেকে যুক্তরাজ্যে বাস করছেন। বাড়িতে নিশ্চয়ই আর দু একজন নিদেনপক্ষে কাজের মানুষটানুষ তো থাকতোই। তাছাড়া অভদ্রতা মানে জোর কোরে নিশ্চয়ই তিনি কিছু করতেন না। এতোটা বাজে লোক তাকে ভাবাই যায় না। তবে লোকটির ছোঁয়াছুঁয়ির প্রবনতা আছে। জোস্নার রাত, চর জেগে ওঠা বিশাল পদ্মা আর উড়ে যাওয়া বালিহাঁসের পাখার চমৎকার বর্ননা করতে করতে তার হাত দুটি এমনভাবে গা ছোঁয় যে শিরশির কোরে ওঠে সমস্ত শরীর। আর হাত দুখানের যেন চোখ আছে। বেছে বেছে অনুভূতিপ্রবন জায়গাগুলোয় পাখির পালকের মতো পরশ দিয়ে যায়। হঠাৎ কেন জানি আফসারের কথা মনে হয় শরীফার। বেশ হ্যান্ডসাম ছেলেটা। পাশাপাশি হাঁটতে ভালোই লাগে। খুব বুদ্ধিমান আর ক্রিয়েটিভ ভাবে নিজেকে। বাইরে একটা দার্শনিক মার্কা ভাব নিয়ে থাকে। আবার নেশাও করে। নাহ্ এই নেশা জিনিশটা দুই চোখে দেখতে পারে না শরীফা। স্নায়ুগুলোকে এ্যাবনরম্যাল বানিয়ে আনন্দ পাওয়ার চেষ্টা। লাভের মধ্যে স্বাভাবিক শরীরটাকে ধংশ করা ছাড়া আর কিছু না। পাঠ্যপুস্তকের এই ধারনাটিতে শরীফার স্বতসিদ্ধ আস্থা রয়েছে। নেশা সম্পর্কে তার বাস্তব অভিজ্ঞতা যেটুকু তার বেশির ভাগই বাংলা সিনেমা আর নভেল-নাটক থেকে পাওয়া। বাকিটুকু কায়েসকে দেখে।

কায়েস শোয়া থেকে উঠে হেলান দিয়ে বসে। শরীফার চুলে হাত বুলায়। কণ্ঠে নরোম মাদকতা এনে বলে ‘টেলিগ্রাম কবে পেয়েছিলে?’

‘কবে যেন! সাত আটদিন আগে বোধহয়।’ শরীফা একই রকম শুয়ে থেকেই জবাব দেয়।

‘এতো দেরি করলে যে?’

শরীফা এবার মাথা তুলে কায়েসের চোখের দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসে। ‘ভাবলে কেন যে তোমার টেলিগ্রাম পেলেই আমি আসবো?’

‘বাহ্ এসেছো তো। আগেও তো এসেছিলে।

‘তোমার টেলিগ্রামের কারনে আমি আসিনি কায়েস। আমার অন্য কাজ আছে। তুমি আমাকে আসতে বলো কেন? আমাদের সম্পর্ক তো শেষ হয়ে গেছে।

কায়েস কিছুক্ষন চুপ কোরে থেকে যেন শক্তি সঞ্চয় করে। কিছুটা বাস্তববুদ্ধি সুলভ কণ্ঠে বলে ‘সম্পর্ক যেমন শেষ হয়েছে আমরা চাইলে আবার তা নতুন কোরে শুরু করতে পারি।’

‘সম্পর্ক তো তোমার কারনেই নষ্ট হয়। যা আমি পছন্দ করি না তা-ই তো তুমি বেশি করো। তোমার অবহেলা আমি সহ্য করতে পারি না।’ শরীফা বলে।

‘অবহেলা আমিও সহ্য করতে পারি না। ছেলেদের সঙ্গে তোমার মেলামেশার ধরনটাও আমার পছন্দ নয়। আমি লক্ষ্য করেছি— ছেলেদের সাথে, সে বয়স্ক হোক আর জুনিয়ার হোক তুমি সব সময়ই একটা নায়িকা-নায়িকা ভাব করো। যেন সবাই তোমার প্রেমিক।’

‘আর তুমি যে হাজারটা মেয়ের সাথে শোও সেটা বলো না কেন?’

‘সেসব করি তোমার আচরনের প্রতিশোধ নেবার জন্যে। তোমার আপত্তিজনক মেলামেশার কারনেই সেসব ঘটে।’ কায়েসের কন্ঠে উত্তাপ, শরীফাও ততোধিক উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ‘বাজে কথা বোলো না, কিসের আপত্তিজনক?’

‘একটা জিনিস আমি বুঝি না, ইনক্লুডিং মি যাদের সাথে তুমি ঘনিষ্ঠভাবে মেশো তারা সবাই লম্পট হিশেবে বিখ্যাত। বেছে বেছে এদের সাথেই কেন তোমার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়? তুমিই ভালো জানো এদের কার কার সাথে তুমি শুয়েছো

‘উহ্, জঘন্য! থামবে তুমি।’ শরীফা প্রায় চিৎকার কোরে ওঠে। ‘এই সব শোনার জন্যে কি আমি তোমার কাছে এসেছিলাম। তুমি কী বলছো এসব আমাকে? তুমি আমাকে জানো না? এদ্দিনেও আমাকে চেনোনি?

‘তোমাকে চিনি বোলেই তো বলছি।’

সহসাই দুজনে নিশ্চুপ হয়ে যায়। সিলিং ফ্যানের শোঁ শোঁ শব্দ ছাড়া ঘরে আর কোনো শব্দ নেই। নিজেদের অন্তর্গত ভাবনায় দুজনেই ডুবে থাকে আরো অনেকক্ষন। মাঝে মধ্যে খাপছাড়া দুয়েকটি প্রশ্ন উত্তর ছাড়া প্রায় কোনো কথাই হয় না। পরস্পরের প্রতি আকর্ষনহীন উদাসিনতায় তারা একই রকম আচরন করে।

খাবার টেবিলেও খুব একটা কথা হয় না। নিরবে টেবিলের দিকে চেয়ে শরীফা সামান্য খেয়েই প্লেট ভর্তি খাবার রেখে উঠে পড়ে। কায়েস একবার চোখ তুলে তাকায়। কিছু বলে না। নিজের খাওয়া চালিয়ে যায়। কাজের ছেলেটিকে বাজার এবং রান্না সংক্রান্ত দুয়েকটি কথা বলে কায়েস। তারপর সেও উঠে পড়ে। বেসিনে হাত ধুতে গিয়ে আয়নায় অবাক হয়ে বেশ খানিকক্ষন নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে থাকে সে।

8.

সকালে ঘুম ভাঙতেই শরীফা ব্যস্ত সমস্ত হয়ে বাথরুমে ঢোকে। আটটা বেজে গেছে। একটু সকাল সকাল না গেলে বাবর ভাই আবার বেরিয়ে পড়তে পারেন। ভাবতে ভাবতে বেসিনে কল খুলে মুখে পানির ঝাপটা দিতে থাকে সে। ঢাকায় যে উদ্দেশ্যে আসা সে কাজগুলোই আগে সারা দরকার। প্রথমে বাবর ভাই। তারপর দুপুরে হেমায়েত হাসান। তাকে কয়েকটি লেখা দিতে হবে। প্রেস ক্লাবে হেমায়েতের সাথে লাঞ্চ। সম্ভব হলে সন্ধায় হারেস রকিবের বাসা। ইকরামুলকে টেলিফোন কোরে আগামী কালের জন্যে প্রোগ্রাম ঠিক করতে হবে। ওর বাসায় যাওয়া ঠিক হবে না। বার দুয়েক ওর বাসায় সে গিয়েছে কিন্তু ওর বউটি তা পছন্দ করে না। কিরকম চোখে যেন তাকায়। মোটামুটি দুদিনের প্রোগ্রাম সাজিয়ে ফ্যালে শরীফা।

পোশাক পাল্টে মুখে সামান্য প্রসাধন করে সে। ব্যাগ গোছায়। কায়েস ঘুম জড়ানো চোখে শরীফাকে দু একবার দ্যাখে। শরীফা দু-হাতে মশারির এক পাশ উঁচু কোরে কায়েসকে ডাকে—

‘আমি যাচ্ছি।’

কায়েস চোখ ম্যালে। দৃষ্টিতে কিছুটা ঘুম আর কিছুটা ক্ষোভ।

‘এখন কোথায় যাবে? নাস্তা খেয়ে যাও।’

‘না কাজ আছে।’ শরীফা ব্যস্ততা আনে কন্ঠস্বরে

‘কি কাজ? দশটার দিকে এক সাথে বেরুবো। এখন যেও না।’

‘আছে। না, আমি এখুনি বেরুচ্ছি।’

শরীফা এমনভাবে দাঁড়িয়ে থাকে যেন কায়েসের সম্মতির জন্যে সে অপেক্ষা করছে। আসলে সে কিছু একটা ভাবছে। কায়েস বালিশে মাথা গুঁজে উপুড় হয়ে শোয়।

শরীফা আরো কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে মশারির তুলে ধরা পাশটা ছেড়ে দেয়। স’রে এসে ব্যাগ থেকে তাদের অনুষ্ঠানের একটা কার্ডে কায়েসের নাম লিখে টেবিলে রাখে। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। আশ্চর্য, সাধারন সৌজন্যবোধটুকুও নেই লোকটার মধ্যে! অচেনা অতিথিকেও তো বাসা থেকে বিদায়ের সময় লোকে দরোজা পর্যন্ত আসে। সৌজন্য আলাপে বিদায় দেয়। অলসটা শুয়েই থাকলো! শুয়ে শুয়েই যেন জীবনটা কাটাতে চায়। অকর্মা, অপদার্থ একটা। কিছু একটা যদি করতে পারতো তা হলে বুঝতাম। কী ভুলটাই না হয়েছিলো এর সাথে জীবন জড়িয়ে। শরীফা ভেবে স্বস্তি পায়। যাক, শেষমেশ ভালোয় ভালোয় সম্পর্কটা চুকানো গিয়েছে।

কায়েসের মতো একটা লম্পটের সাথে থেকে নিজের কেরিয়ারটা নষ্ট করার কোনো মানেই হতো না। সমাজ বদলের নামে ছোটলোকদের সাথে মিশে নিজেই একটা ইতরে পরিনত হয়েছে সে।

আসলেই, এই সমাজে উচ্চশিক্ষিত একটি সুন্দরী মেয়ের সাথে যেরকম আচরন করতে হয় কায়েস তার কিছুই করেনি। করতে চায়ও না। সাধারন বাস্তববুদ্ধিটুকু যার নেই তার আবার বড়াই!

সত্যি, কায়েস রসুল একটা নির্ভেজাল ইতর।

০১ জ্যৈষ্ঠ ১৩৯৭ রাজাবাজার ঢাকা

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *