3 of 3

ইঁদুর

ইঁদুর

‘কিরকম হচ্ছে?’

‘আজ্ঞে, সাঙ্ঘাতিক হচ্ছে। আপনার আর মা ঠাকরুনের বড় দুটো ছবি দামী ফ্রেমে গোল্ডেন বর্ডার দিয়ে বাঁধিয়ে আই লেভলে ঝুলিয়েছি। তলায় কারুকার্য করা চমৎকার ব্রাকেট। ধূপদানি থেকে ধূপের মিষ্টি ধোঁয়া। দুপাশে দুটো ইলেকট্রিক মোমবাতি। শ্যামবাজারের পাঁচমাথার মোড় থেকে কিনেছি। একজন একটা বাঘছালের টুকরো দিয়েছে, সেটাকে ভেলভেটের আসনে ফিট করে তার ওপর সিদ্ধাসনে বসি। আগে পদ্মাসনেই বসতুম, ইদানীং টান ধরে, তাই। তারপর গোলাপের আতর মাখানো জপের মালা ঘুরতে থাকে। মাঝে মাঝে পিটপিট করে আপনাদের দিকে তাকাই। নো রেসপন্স।’

‘তারপর?’

‘ঐ যে আপনি বলেছেন, জপের চেয়ে ধ্যান বড়। মালাটাকে ডিবের মধ্যে রেখে ধ্যান।’

‘গভীর ধ্যান?’

‘আজ্ঞে, আমার ধারণা, গভীর ধ্যান, বাড়ির দুষ্ট লোকেরা বলে গভীর ঘুম। মাঝে মাঝে নাকি নাকও ডাকে! কিছুতেই বোঝাতে পারি না, নাক ডাকছে কাকে? তাঁকে। যেমন মেঘ জলকে ডাকে।’

‘ধ্যান কোথায় কর?’

‘আগে ভুরুর মাঝখানে করতুম।’

‘কি করতে?’

‘একটা গোল জ্যোতি, ঐ অম্বলের ট্যাবলেটের সাইজে আনার চেষ্টা করতুম। মাসের পর মাস চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিলুম। একবার ভাবলুম তোতাপুরী যেমন করেছিলেন, ভাঙা কাচের টুকরো দিই বিধিয়ে! সাহস হলো না। যদি নির্বিকল্প হয়ে যায়, কে ফিরিয়ে আনবে! ডলপুতুলের মতো বসেই রইলুম!’

‘তারপর?’

‘প্রবলেম ঠাকুর। লাঠালাঠি!’

‘মানে?’

‘কাকে কোথায় রাখি? আপনি, মা ঠাকরুন, মা কালী আর আমার গুরু। এই চারজন। ঐটুকু তো জায়গা! পাশাপাশি রাখলে বুক ফুরিয়ে যাচ্ছে। প্রথমে ভাবলুম সহস্রারে গুরুকে বসাই। ভ্রমধ্যে মা কালী। আর হৃদয়ে আপনি ও মা ঠাকরুন। ধ্যানে বসে দেখি কী, ধ্যান লিফট হয়ে গেছে, গ্রাউন্ড ফ্লোর টপ ফ্লোর, টপ ফ্লোর গ্রাউন্ড ফ্লোর। আমি এক উর্দিপরা লিফট অপারেটর। নানারকম চিন্তা। সব বড়বাবু, মেজবাবু আসছে। গেট খুলছি, বন্ধ করছি, ওপরে উঠছে, ওপর থেকে নামছে। নানা পোশাকের নানা চিন্তা।’

‘অবশেষে?’

‘অবশেষে ধ্যুৎ তেরিকা!’

‘জপটা আছে না গেছে?

‘আজ্ঞে, দীক্ষার পর প্রবল উৎসাহে তিন মালা, চার মালা হতো।‘

‘অতঃপর?’

‘এখন কনসেনট্রেটেড জপ, তিনবার।’

‘ইংরেজীটা কি বললে?”

‘আজ্ঞে, দুধ মেরে যেমন ক্ষীর হয়, সেইরকম জপ মেরে জপের ক্ষীর, মানে ঘন জপ।’

‘বাঃ, অতি সুন্দর! তা তোমার এই ধর্ম-বাসনার কারণটা জানতে পারি কি?’

‘ঠাকুর, এই প্রশ্ন নিজেকে আমিও বহুবার করেছি। যা পারি না আড়ম্বর করে তা করতে যাই কেন! আবার ছাড়তে চাইলেও ভাল লাগে না।’

‘উত্তর পেলে?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ, মনে শ্রীরামকৃষ্ণ লেগে গেছে। আঠার মতো। আপনি প্ৰভু বটপাতার আঠা। যতই ছাড়াতে চাই ততই জড়িয়ে যায়। কেবলই একটা অস্বস্তি—ঠাকুর যা করতে বলেছিলেন, যা হতে বলেছিলেন তা করতে পারিনি, তা হতে পারিনি। সকলের সঙ্গে সবকিছু করেছি, যেই একা হচ্ছি, তখনি মনের আকাশে বিষণ্ণতার মেঘ—কেন আমি পারছি না, কেন আমি পারব না? পঞ্চবটীতে অভিভাবকের মতো স্বামীজী ও তাঁর ব্রাহ্মবন্ধুদের ধ্যান পরিচালনা করতে করতে আপনি বলেছিলেন : “ধ্যান করবার সময় তাঁতে মগ্ন হতে হয়। ওপর ওপর ভাসলে কি জলের নিচে রত্ন পাওয়া যায়!” গান গেয়েছিলেন—

“ডুব দে রে মন কালী বলে। হৃদি রত্নাকরের অগাধ জলে।
রত্নাকর নয় শূন্য কখন, দু-চার ডুবে ধন না পেলে,
তুমি দম-সামর্থ্যে এক ডুবে যাও, কুলকুণ্ডলিনীর কুলে!”

ঠাকুর! আপনার সমস্ত উপদেশ আমার মুখস্থ! আপনি মাস্টারমশাইকে বলেছিলেন, হৃদয় ডঙ্কাপেটা জায়গা। হৃদয়ে ধ্যান হতে পারে, অথবা সহস্রারে। এগুলি আইনের ধ্যান শাস্ত্রে আছে। তবে তোমার যেখানে অভিরুচি ধ্যান করতে পার। সব স্থানই তো ব্রহ্মময়; কোথায় তিনি নেই? দুরকম ধ্যানের কথা বলেছিলেন—নিরাকার ধ্যান ও সাকার ধ্যান। বলেছিলেন, নিরাকার ধ্যান বড় কঠিন। সে-ধ্যানে যাকিছু দেখছ শুনছ লীন হয়ে যাবে; কেবল স্ব-স্বরূপ চিন্তা। সেই স্বরূপ চিন্তা করে শিব নাচেন। “আমি কি”, “আমি কি”–এই বলে নাচেন। একে বলে “শিবযোগ”। ধ্যানের সময় কপালে দৃষ্টি রাখতে হয়। “নেতি”, “নেতি” করে জগৎ ছেড়ে স্ব-স্বরূপ চিন্তা। আর এক আছে “বিষ্ণুযোগ”। নাসাগ্রে দৃষ্টি; অর্ধেক জগতে, অর্ধেক অন্তরে। সাকার ধ্যানে এইরূপ হয়। শিব কখনো কখনো সাকার চিন্তা করে নাচেন। “রাম” “রাম” বলে নাচেন।

‘এইসব নির্দেশে তোমার তো কোন লাভই হলো না!’

‘একটা লাভ হয়েছে, সেটা হলো—আপনি আমার নিদ্রা কেড়ে নিয়েছেন। সব হওয়ার মধ্যেও কি যেন একটা হলো না—এই অস্বস্তি পুরে দিয়েছেন মনোপুরে।’

‘তাহলে আজ তোমাকে আরেকটা আরো সরল কথা বলি। যারা একান্ত পারবে না তারা দুবেলা দুটো করে প্রণাম করবে। তিনি তো অন্তর্যামী—বুঝছেন যে, এরা কি করে! অনেক কাজ করতে হয়। তোমাদের ডাকবার সময় নেই— তাঁকে আমমোক্তারি দাও। কিন্তু তাঁকে লাভ না করলে—তাঁকে দর্শন না করলে কিছুই হলো না।’

‘আজ্ঞে, আপনাকে দেখাও যা ঈশ্বরকে দেখাও তা।

‘ওকথা আর বলো না। গঙ্গারই ঢেউ, ঢেউ-এর গঙ্গা নয়। আমি এত বড়লোক, আমি অমুক—এইসব অহঙ্কার না গেলে তাঁকে পাওয়া যায় না। “আমি” ঢিপিকে ভক্তির জলে ভিজিয়ে সমভূমি করে ফেল।’

‘সংসারে কেন তিনি রেখেছেন?’

‘সৃষ্টির জন্য রেখেছেন। তাঁর ইচ্ছা। তাঁর মায়া। কাম-কাঞ্চন দিয়ে তিনি ভুলিয়ে রেখেছেন।’

‘কেন ভুলিয়ে রেখেছেন? কেন তাঁর ইচ্ছা?”

‘তিনি যদি ঈশ্বরের আনন্দ একবার দেন তাহলে আর কেউ সংসার করে না, সৃষ্টিও চলে না। তাহলে শোন, চালের আড়তে বড় বড় ঠেকের ভিতরে চাল থাকে। পাছে ইঁদুরগুলো ঐ চালের সন্ধান পায়, তাই দোকানদার একটা কুলোতে খই-মুড়কি রেখে দেয়। ঐ খই-মুড়কি মিষ্টি লাগে, তাই ইঁদুরগুলো…. সমস্ত রাত কড়মড় করে খায়। চালের সন্ধান আর করে না। কিন্তু দেখ, এক সের চালে চোদ্দগুণ খই হয়। কাম-কাঞ্চনের আনন্দ অপেক্ষা ঈশ্বরের আনন্দ কত বেশি! তাঁর রূপ চিন্তা করলে রম্ভা, তিলোত্তমার রূপ চিতার ভস্ম বলে বোধ হয়। বুঝলে?’

‘আজ্ঞে!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ইঁদুর

ইঁদুর

ইঁদুর

অল্পের জন্য বেঁচে গেছে যতীন।

আর-একটু হলেই ডান হাতের আঙুল ক’টা ওর ইঁদুর-মারা কলে থেঁতলে যেত। র‍্যাশন-আনা ক্যাম্বিসের থলেটা বার করতে হাত বাড়িয়েছিল বেঞ্চির তলায়। কে জানত, ওরই তলায় ওত পেতে বসে আছে সর্বনেশে কলটা। লোহার ধারালো দাঁত আঙুলে ফুটতেই চট করে হাত সরিয়ে নিয়েছে, তাই না রক্ষে।

সাবধানে কলটাকে বাইরে টেনে আনে যতীন। তীক্ষ্ণদন্ত ইস্পাতের যন্ত্রটা হাঁ করে রয়েছে; সদ্য-ধার-দেওয়া অর্ধচন্দ্রাকার দুটি করাতের ফলা শিকার ধরার সম্ভাবনায় তখনও অপেক্ষমান।

“কই শুনছ, শীঘ্রি একবার এস তো এখানে !” রুক্ষ গলায় হাঁক পাড়ে যতীন।

সামনে দালানে বসে বাসী রুটিগুলো দালদায় ভেজে নিচ্ছে মলিনা। বসে বসেই উত্তর দেয়, “আমার হাত জোড়া। কী বলছ বলো ?”

“এখান থেকে বললেই যদি হবে তবে তোমায় সোহাগ করে ডাকছি কেন ? ঘরে এসে স্বচক্ষে তোমার কাণ্ডটা একবার দেখে যাও।”

যতীনের তাগিদ গ্রাহ্যের মধ্যে আনে না মলিনা। পরিপাটি করে স্বামীর জলখাবারের থালা গুছোয়। দালদায় লালচে করে ভাজা খানচারেক বাসী রুটি, দু-টুকরো বেগুন ভাজা, একটু গুড়।

স্বামীর দিকে জলখাবারের থালাটা এগিয়ে দিয়ে মলিনা বলে, “অমন করে হাঁক পাড়ছ কেন, হয়েছে কী?”

“হয় নি, তবে আর-একটু হলেই মোক্ষম একটা কিছু হত— !” মুখ চোখের এক বিচিত্র ভঙ্গি করে যতীন কলটার দিকে ইঙ্গিত করে।

মেঝের দিকে তাকিয়ে মলিনা একটু অবাকই হল হয়ত।

“ওটা আবার টেনে বের করতে গেলে কেন?”

“না বার করব কেন, ভেতরে ঢুকিয়ে রেখে দি—তারপর আমার আঙুল ক’টা উড়ে যাক, না হয় তোমার পায়ের গোড়ালি—!” রুটি ছিঁড়তে ছিঁড়তে যতীন ভুরু কুঁচকোয়।

“আহা, কী আমার বাক্যি রে—” মলিনা স্বামীর প্রতি ভ্রূভঙ্গি হেনে মেঝেতে উবু হয়ে বসতে বসতে বলে, “ধান ভানব মরণকালে, দাঁড়িয়ে থাকি ঢেঁকিশালে। কবে তোমার হাত কাটবে, পা কাটবে, তাই ভেবে কলটাকে সিন্দুকের মধ্যে পুরে রাখি!”

আহার-পর্ব শুরু হয়েছে। তবু চটেমটেই উত্তর দেয় যতীন, “মেয়েলি শ্লোক কেটো না। আর একটু হলেই তো আমার আঙুল ক’টা সাবাড় হয়ে গিয়েছিল, মরণকাল পর্যন্ত তোমায় আর ঢেঁকিশালে অপেক্ষা করতে হত না।”

ইঁদুরকলে হাত দিয়েছিল মলিনা; স্বামীর কথাটা কানে যেতেই হাত সরিয়ে নিল। তাকাল যতীনের মুখের দিকে।

“বেঞ্চির তলায় হাত ঢুকিয়েছিলে কেন?”

“থলে বের করতে।”

“একটু আর তর সইছিল না, যত রাজ্যির জিনিসপত্র হাঠকাতে লাগলে!” উষ্ণস্বরে বলে মলিনা; ইঁদুরকলটা ঠেলে এক পাশে সরিয়ে রাখে।

বেঁকা চোখে যতীন স্ত্রীর ক্রিয়াকলাপ লক্ষ করছিল। কলটা সম্পর্কে এতটা তাচ্ছিল্য তার মনঃপূত নয়।

“আবার, আবার সেই—কথাটা গ্রাহ্যি হল না?”

“না, হল না।” মলিনা উঠে দাঁড়ায়। কথা দিয়েই ও যেন ধমক দেয় যতীনকে, “অযথা তুমি সর্দরি কোরো না তো! আমার সংসার, আমি যা ভাল বুঝব করব!”

“কোথায় ইঁদুর তার ঠিক নেই কল পেতে বসে আছে!” যতীন বিড়বিড় করে।

“কোথায় ইঁদুর তুমি তার কী জান? আমি বুঝি, তাই কল পেতে বসে থাকি! তুমি মাথা ঘামাও কেন?” পালটা জবাব দেয় মলিনা। কথার শেষে ঘর ছেড়ে চলে যায়। স্ত্রীর অহেতুক একগুঁয়েমিতে বিরক্ত হয়ে ওঠে যতীন।

চায়ের কাপ হাতে করে একটু পরেই মলিনা আবার ঘরে ঢোকে।

“টাকা নেবে না?” স্বামীকে লক্ষ করতে থাকে মলিনা।

“নেব না তো টাকা পাব কোথায়? মুফতিতে র‍্যাশন দেবে, অফিসটা আমার শ্বশুরবাড়ি কিনা!” এঁটো থালাটা মেঝেতে রাখতে রাখতে মেজাজী গলায় বলল যতীন। চায়ের কাপটাও উঠিয়ে নিল।

“আবার সেই কথা? কতদিন না বলেছি আমার বাপ-মা নিয়ে যা মুখে আসে বলবে না!” চট করে চটে ওঠে মলিনা।

“আমার বয়েই গেছে তোমার বাপ-মা নিয়ে কথা বলতে!”

“ও! শুনি তবে শ্বশুরটা তোমার কে?”

মলিনার কথার কোনো জবাবই দেয় না যতীন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চায়ের কাপটা শেষ করে বেরিয়ে পড়তে পারলেই ও যেন বাঁচে।

মলিনা নিরুত্তরে র‍্যাশনের থলে গুছোয়; বাক্স খুলে টাকা বের করে তক্তপোশের ওপর রাখে।

চা খাওয়া শেষ হয়েছে যতীনের। পায়ের মোজাটা ঠিকঠাক করে হাঁটুর নিচে দড়ি বাঁধে। তাক থেকে পেন্সিল আর নোট-খাতাটা উঠিয়ে নিয়ে বুকপকেটে গোঁজে। তারপর একটা বিড়ি ধরায়।

“আর টাকা?” পাঁচ টাকার নোটটা হাতে করে যতীন স্ত্রীর মুখের দিকে তাকায়।

“টাকার গাছ আছে নাকি আমার—যা ছিল দিলুম। দুটো টাকা আর বাজারের আছে। ভালো কথা, বাজার করে দিয়ে যেও!” মলিনার গলায় বেশ ঝাঁঝ।

একটু বুঝি হতভম্ব হয়ে পড়ে যতীন, চট করে জবাব খুঁজে পায় না। সামলে নিয়ে বলে, “পনেরো দিনের র‍্যাশন পাঁচ টাকায় হয় নাকি? ফি বার দিচ্ছ।”

“এবার নেই তো দেব কোত্থেকে? চুরি বাটপাড়ী করব?” ফিরতি প্রশ্ন মলিনার।

এক মুহূর্ত স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে যতীন বলে, “বেশ! পাঁচ টাকায় যা হয় নিয়ে আসব।” কথার শেষে নোটটা খাকি হাফ-প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে নেয়।

যতীন বেরিয়ে যাচ্ছিল। মলিনা বলল আবার, “বাজার করে দিয়ে যাও।”

“সময় নেই। আটটায় ডিউটি, সাড়ে সাতটা বেজে গেছে।”

“ভালোই তো, আমার আর কি, ডালভাত বেঁধে রেখে দেব। আমার মুখে সব রোচে।”

“আমারও।” যতীনের জবাব।

“কিন্তু তোমার বন্ধুটির? তাঁর তো আজ সকালেই ফিরে আসার কথা। সন্ন্যাসী মানুষ, তায় আবার প্রাণের ইয়ার পঞ্চাতেলী। ফল চাই, মূল চাই, কলা চাই। কোনো ত্রুটিটুকু হবার জো নেই। হলে তোমার মাথা কাটা যায় আর আমার বাপ ঠাকুরদাকে সগ্‌গ থেকে টেনে এনে হেলাফেরা করা হয়—।” তাকের ওপর অযথা খুঁটিনাটি কি একটা গুছোতে গুছোতে ভারী গলায় বলল মলিনা।

“বাসু আজই কল্যাণেশ্বরী থেকে ফিরছে নাকি?” যতীন ঘুরে দাঁড়ায়।

“কী জানি, বলে তো গেছে—”

“হুঁ।” যতীন মাথা নাড়তে নাড়তে টানা একটা শব্দ করে মুখ বুজেই তারপর মুখ খোলে, “আমার আর সময় নেই। যা হয় ক’রো।”

দালানে নেমে যতীন তার ঝড়ঝড়ে সাইকেলটার চাকা পরখ করছে, দেখছে পাম্প আছে কি না—শুনল ঘর থেকে তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে মলিনা বলছে, “করব আবার কি? আমি কিচ্ছু করব না, রোজ রোজ পরকে পায়ে ধরে সেধে বাজার আনাব? আমি আর কাউকে সাধাসাধি করতে পারব না—যা আছে ঘরে তাই ফুটিয়ে রেখে দেব। এতে কার পেট ভরল না, মন উঠল না, অত আমার দেখার দরকার নেই।”

যতীন চলে গেল। খোলা দরজা দিয়ে দেখল মলিনা—সাইকেলের হ্যান্ডেলে হাত রেখে সেই একইভাবে স্বামী তার প্রস্থান করল। ওর চলে যাবার ভঙ্গিটাই এমন—যা থেকে মনে করা যায় সকালবেলার দাম্পত্যকলহের জের সবটুকুই স্ত্রীর কাছে জিম্মা দিয়ে ও নিজে খালাস পেল; চলে গেল।

মলিনা দু’ চার মুহূর্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল—শুধু শুধুই। তারপর ঘরের চারপাশটা লক্ষ করল একবার। পরক্ষণেই তাকে দেখা গেল এঁটো বাসন আর কাপ দুটো নিয়ে দালানে রেখে এসেছে। আবার একবার বিছানা ঝাড়ল; ঘর ঝাঁট দিল। জলের ন্যাতা দিয়ে মুছতে লাগল ঘরের মেঝে।

বসে বসে উবু হয়েই ঘর মুছছিল মলিনা। বেঞ্চির কাছে আসতেই ইঁদুরমারা কলটা আবার তার চোখে পড়ে। ঠিক আগের মতোই মুখব্যাদান করে বসে আছে যন্ত্রটা। হাতের কাজ থামিয়ে মলিনা একমনে তাই দেখে।

এই নিয়েই তো যত গণ্ডগোল, মলিনা ভাবছিল: অফিস যাবার আগে অযথা কথা কাটাকাটি। যতীন হয়ত রাগ মনেই পুষে রাখল। অফিসে একটা কেলেঙ্কারীও বাধাতে পারে—চাই-কি দুপুরে হয়ত খেতেই আসবে না বাড়িতে। এমন ঘটনা মাঝে মাঝে হয়েছে বহাক। বাড়তে কিছু বলে নি যতীন, ওর মুখ দেখে বোঝবারও উপায় ছিল না, রাগের আঁচে তেতে আছে তার মন। মলিনা বসে আছে তো বসেই আছে—দুপুর গেল, বিকেল গেল—সেই সন্ধের গোড়ায় সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে ফিরল যতীন। শুকনো মুখ, রুক্ষ চুল, চোখ বসে গেছে। কোথায় ছিলে, কেন দুপুরে খেতে আস নি, কী খেয়েছ? জানো, তোমার জন্যে আজ একটু ইলিশ মাছ আনিয়ে ঝাল রেঁধেছি, বড়ি ভেজেছি, টক করেছি লাউয়ের। আর হ্যাঁ মশাই, আমিও দাঁতে কাঠি দিয়ে পড়ে আছি সারাদিন। থাক থাক, সোহাগ দেখাতে হবে না। কতই তো বউয়ের ওপর টান। তাই তো—! মলিনা অভিমানে কেঁদে ফেলেছে। তখন যতীন ওর কান্না থামিয়েছে—চোখের জল দিয়েছে মুছে। বলেছে, আর কখনও এমন গর্হিত কর্ম করব না, লক্ষ্মীটি; সত্যি বলছি, মাইরি, তোমার দিব্যি। …আবার ওরা জোড় বেঁধে থালা সাজিয়ে খেতে বসেছে, গল্প করেছে হিজিবিজি, হাসিতে হাসিতে ছোট্ট ঘরখানাও যেন হেসে উঠেছে।

আনন্দে, খুশিতে, পরিচ্ছন্নতায়, নিবিড় সাহচর্যে এই ছোট্ট ঘরখানা হেসে উঠুক, খুশিতে টইটম্বুর হয়ে থাক ওরা দু-জন, দুটি মন—মলিনা তো তাই চেয়েছে। তাইতো এত! কিন্তু এটা বাড়ি নয়, বস্তি। তবু বাড়িই বল। এমন বাড়িতেই তাদের মত গৃহস্থরা থাকে। খোলার চালের ঘর একখানা আর একফালি দালান। সামনে একটু মাটির উঠোন। ভাড়া কুড়ি টাকা। তাও অনেক ধরা-কওয়া করে; নয়ত এই বাড়িরই নাকি ভাড়া ছিল চব্বিশ।

অফুরন্ত উৎসাহ নিয়ে মলিনা এ বাড়িতে পা দিয়েছিল। কিন্তু প্রথম দিনই ঘরে ঢুকে সমস্ত উৎসাহ যেন হঠাৎ উবে গেল। কেমন যেন ফ্যাকাশে, ভয়-পাওয়া মুখে প্রশ্ন করল, “কু-ড়ি টাকায় এই বাড়ি?”

বিছানা খুলছিল যতীন। লণ্ঠনের আলোয় মলিনার মুখভাব তেমন ভালো করে দেখতে পেল না।

কুড়ি টাকা একরকম তত সস্তাই। সে আসানসোল আর আছে নাকি! যুদ্ধের হিড়িকে আসানসোলের জমিগুলো সোনা হয়ে গেল। আর বাড়ি—তা যেমনই হোক, মানুষকে বাঁচতে হলে চালচুলো রাখতেই হবে। খড়ের ছাউনি, খোলার চাল, টিনের চালা—চোখের পলকে এক-একটা রাজত্ব বনে গেল। এই শালার ঘর তিন বছর আগে তিন টাকাতেও ভাড়া হত না। আর এখন—। বিছানা খোলা শেষ করে যতীন হাঁফ ছাড়ল।

লণ্ঠন নিয়ে মলিনা তখন ঘরের ইতি-উতি দেখছে। ইস, মাগো, ঘরের মেঝের কী ছিরি! সিমেন্টের একটা পাতলা প্রলেপ না থাকলে স্যাঁতসেঁতে মাটির ওপরই তারা দাঁড়িয়ে থাকত। সিমেন্টেও কি আছে নাকি—ফেটে ফুটে একাকার। ঘরের এখানে ওখানে বড় বড় গর্ত—দেওয়ালে চিড় ধরেছে। আর ঘরের মাথা! কোন্ যুগের ছেঁড়া চট দিয়ে সিলিং করা এখনও তাই টিকে আছে। তবু রক্ষে যেমন-তেমন করেও ঘরে সদ্য একবার কলি ফিরিয়ে দিয়ে গেছে বাড়িঅলা। এখনও চুনের গন্ধ ভাসছে। নয়তো দুর্গন্ধেই প্রাণ যেত।

“ও, মাগো—” হঠাৎ বিশ্রী রকম কঁকিয়ে উঠল মলিনা। ধড়মড় করে চৌকির ওপর লাফিয়ে উঠতে গেল। লণ্ঠনটা চৌকিতে ধাক্কা লেগে ছিটকে পড়ল মেঝেতে। দপ দপ করে লণ্ঠনের কাঁপা, অসম, এলানো শিষটা কাচের মধ্যে কিলবিল করল, ধোঁয়া, জমল খানিকটা আর তারপরই সব অন্ধকার । নিকষ কালো রঙে সবকিছু ডুবে গেল, মুছে গেল।

“কী হল? অ্যাঁ—?” যতীন উদ্বেগভরা কণ্ঠে প্রশ্ন করল।

“ইঁদুর!” মলিনার গলার স্বর দ্রুত, হ্রস্ব, আতঙ্কভরা।

“ইঁদুর!” যতীন প্রথমে বোবা, তারপর তাচ্ছিল্যমাখা তরল সুরে প্রত্যুত্তর দিয়ে অট্টহাসিতে ভেঙে পড়ে, “বাব্বা! যেমন করলে তুমি, আমি চমকে উঠেছিলুম। ভাবলাম না জানি সাপ-খোপ হবে।”

লণ্ঠন জ্বালাল যতীন। মলিনাকে দেখল। ওর মুখচোখে তখনও ভয় লেপ্টে রয়েছে।

“আরে, অমন মুখ করে বসে আছ কেন? মনে হচ্ছে যেন—”

যতীনের কথায় বাধা দিয়ে মলিনা বলল, “কই, দেখি, তোমার হাত দেখি। দেখ আমার বুকটা এখনও ধকধক করছে।” যতীন হাত দিয়ে অনুভব করল; সত্যিই মলিনার হৃদপিণ্ড দ্রুততালে বেজে চলেছে।

“আশ্চর্য, এত ভয় তোমার ইঁদুরে!”

“তা বাপু ভয়ই বলো আর ঘেন্নাই বলো, ও বিদিকিচ্ছি জন্তুগুলো দেখলে আমার গা গুলিয়ে আসে।” আস্তে আস্তে জবাব দিল মলিনা বিকৃত মুখভঙ্গি করে, স্বামীর চোখে চোখ রেখে। একটু থেমে বলল আবার, “এ বাড়ির চৌকাঠে পা দিয়েই আমার জন্মশত্তুরগুলো চোখে পড়ল। তখন থেকেই গা বিড়োচ্ছে। তার ওপর পড়বি তো পড়, হতভাগা একেবারে পায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল গা।”

“আজব কাণ্ড তোমার?” যতীন বলল, “ইদুর কোথায় না থাকে?”

“থাক্‌, সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জুড়ে থাক; আমার ঘরে থাকা চলবে না। দু চোখের বিষ আমার। পাজি, নোংরা, কুচ্ছিত—” মলিনার ঠোঁট, চোখ, নাক, মুখ ঘৃণায় কুঁচকে কুশ্রী হয়ে উঠল।

মুখে যা বলেছিল মলিনা—সেইদিন সেই প্রথম এ বাড়িতে পা দিয়ে, অক্ষরে অক্ষরে তা ফলিয়ে ছেড়েছে। প্রথম দিন থেকেই, মলিনার সে কী অসাধ্য-সাধন। মেঝেতে কোথায় গর্ত, দেওয়ালে কোন্‌ কোণে ফাটল, দালানে জঞ্জাল জড় করা কেন—এ সবের মধ্যেই তো ইঁদুরের রাজত্ব। ইটের গুঁড়ো, কাঁকর, বালি, পাথরকুচি যা পায় ঠেসে ঠেসে গোঁজে, ভরাট করে গর্তের ফাঁক, তারপর মাটি দিয়ে লেপে দেয়। যতীনদের ডিপোতে শেডের কাজ হচ্ছে। অফিস-ফেরতা যতীন ভোলাবাবুর কাছ থেকে সিমেন্ট চেয়ে রুমালে বেঁধে আনে। একটা কর্নিক কিনে আনল একদিন। সারা দুপুর কোমরে কাপড় জড়িয়ে মিস্ত্রিগিরি করে মলিনা।

একটু হয়ত বাড়াবাড়িই হবে এই ইঁদুর-ভীতি। তবু কে অস্বীকার করবে ইঁদুর তাড়াতে গিয়ে মলিনা ঘরের শ্রী পাল্টে দেয় নি? আসলে তাই। কুড়ি টাকার খোলার ঘর মলিনার হাতে পড়ে শ্রী পেল। শৌখিন না হোক শোভন হল। যতীন মনে মনে ভাগ্যবান মানল নিজেকে। লক্ষ্মীমন্ত বউ তার; দেখতে দেখতে সংসারের হাল ফিরিয়ে দিল।

ঝকঝকে তকতকে করে ঘর সাজাল মলিনা। কাঁঠাল কাঠের তক্তপোশ, একটা বেঞ্চি, দুটো জলচৌকি, কেরোসিন কাঠের তেথাকা—এমনি সব টুকিটাকি জিনিস। প্রথম ক’টা মাস খুবই টানাটানি চলে সংসারে। মাইনের একশোটা টাকা থেকে বাঁচিয়ে এটা-ওটা কেনা কি সহজ।

যতীন একদিন ঠাট্টা করেই বলেছিল, “ভাগ্যিস ভগবান আমায় রাজা করে নি গো। বেঁচে গেছি!”

“কেন?” জানতে চেয়েছে মলিনা অবাক হয়ে।

যতীন হাসতে হাসতে উত্তর দিয়েছে, “তা হলে তুমি প্রাসাদ বানাতেই ব্যস্ত থাকতে। এ অধম তোমার প্রসাদ পেত না!”

যতীনের কথায় হেসে ফেলেছে মলিনা; স্বামীর গলা জড়িয়ে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়েছে কানে, আধো-আধো স্বরে বলেছে, “আমি ম্যুখ্যুসুখ্যু লোক, তোমার অত কাব্যি কি বুঝি—! তুমি যদি রাজা হতে আমি কি আর রানী হতাম!”

“রানী হতে না—? তবে হতেটা কি!” চোখ বড় বড় করে রহস্য করেছে যতীন।

“দাসী!” ছোট করে উত্তর দিয়েছে মলিনা।

“বল কি, এত থাকতে দাসী?”

“হুঁ দাসী-ই। যা ময়লা রং আমার, বাপ-মা দেখে শুনেই নাম দিয়েছে মলিনা। রানী কি ময়লা হয়!” মলিনার গলার স্বরে আশ্চর্য জড়তা এসেছে কথাগুলো বলতে গিয়ে।

যতীন এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলে উঠেছে, “বয়েই গেছে; হোক না গায়ের রং ময়লা—মন তো আর ময়লা নয়।”

তাই, মলিনার মন ময়লা নয়। অন্তত মলিনা যেন সেই কথাটাই মনে প্রাণে বিশ্বাস করে নিয়েছে বলে মনে হয়। ময়লার উপর তাই কি ওর অত বিজাতীয় ঘৃণা? নোংরা যা কিছু, কুৎসিতদর্শন যেখানে যা আছে, বিকৃত, বীভৎস যা—চোখকে যা পীড়া দেয়, মনকে অসুস্থ করে, মলিনার কাছে তা অসহ্য। সেখানে তার এতটুকু দয়া নেই, ক্ষমা নেই।

ইঁদুরকে ঠিক এইজন্যেই বুঝি এত ঘেন্না মলিনার। দেখতে যেমন, থাকেও তেমনি অন্ধকার নোংরা আবর্জনার স্তূপে। একটু ভালো করবে তোমার—বয়েই গেছে, বরং ক্ষতির বহরটা একবার হিসেব করে দেখ। চাল, ডাল, তরিতরকারি, কাপড়, বই—সর্বত্রই ওর সমান গতি। আর নষ্ট করা ছাড়া অন্য কোনো কাজ নেই।

তালপুকুরের ঘরে অত যে ইঁদুরের উৎপাত, সে উৎপাতও বন্ধ করল মলিনা। এল ইঁদুর-মারা কল, তারপর এল বেড়াল, শেষ পর্যন্ত ইঁদুর মারা বিষ।

মলিনার সংসার থেকে একদিন দূর হল এই নোংরা জীবগুলো। একেবারেই। চিরকালের মতই।

তারপর? তারপর তো বেশ ছিল মলিনা। হঠাৎ আজ ক’দিন থেকে কেমন করে যেন একটা ইঁদুর আবার এসে পড়েছে। শব্দ শুনেছে মলিনা, বুঝতে পারছে। কিন্তু কই দেখতে তো পায় না? কিছুতেই ধরতেও পারে না।

কে! মলিনা চমকে উঠল। কে যেন ডাকল।

ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল মলিনা। হাতে তার ইঁদুরকল। দরজার কাছে সরে আসতেই উঠোনে যে দাঁড়িয়ে রয়েছে তার সঙ্গে চোখাচুখি হয়ে গেল মলিনার। মুণ্ডিত মস্তক, গৈরিক বাস, দীর্ঘদেহ এক মূর্তি। সর্বাঙ্গে রোদ আর তপ্ত নিয়ে দাঁড়িয়ে।

“ফিরলাম কল্যাণেশ্বরী থেকে,” উঠোন থেকে স্বর ভেসে আসে; “সব যে বড় চুপচাপ। যতীন কই? অফিস বেরিয়ে গেছে?”

বাসুদেব উঠোন থেকে দালানে উঠে আসে।

মলিনার হাত থেকে কলটা পড়ে যায়। একেবারে পায়ের কাছেই। শব্দ কানে যেতে ও সম্বিত ফিরে পায়। পায়ের দিকে নজর পড়তেই দেখে মাটিতে কলটা কাত হয়ে পড়ে রয়েছে—করাতের ফলার মত মুখ দুটো বন্ধ। তাড়াতাড়ি মাথায় ঘোমটা টেনে মলিনা বলে, “আসুন। আপনার বন্ধু তো অনেকক্ষণ হল বেরিয়ে গেছে।”

দুপুর বেলায় খেতে এল যতীন; রোজ যেমন আসে।

ঘরে পা দিতেই বাসুদেবের সঙ্গে দেখা। বন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে যতীন যেন আকাশ থেকে পড়ল।

“করেছিস কি রে—অ্যাঁ—! মাথা কামিয়ে এলি কল্যাণেশ্বরী থেকে?”

নিজের মাথায় নিজেই হাত বুলিয়ে বাসুদেব হাসল, “খারাপ দেখাচ্ছে?”

“না, খারাপ কেন হবে? একেবারে মঠের মহারাজের মত দিব্যি দেখাচ্ছে”, ঠাট্টা করে যতীন।

“দীক্ষা নিলুম কি না—তাই!”

গায়ের জামাটা আলনায় টাঙিয়ে যতীন ঘুরে দাঁড়ায়, “দীক্ষা—!”

আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে বাসুদেব । চুপ করে থাকে, হাসে মুচকি মুচকি । বন্ধুর হাসির অর্থভেদ করতে না পেরে যতীন বলে, “দাঁড়া, মাথায় দু’ ঘটি জল ঢেলে নি—তারপর তোর দীক্ষা নেওয়ার কথা শুনছি।”

স্নান সেরে খেতে বসল যতীন; পাশে বাসুদেব। মলিনা বাসুদেবের সামনে থালা সাজিয়ে দিয়ে গেল পরিপাটি করে। তারপর স্বামীর। আর-এক দফা অবাক হবার পালা যতীনের।

“ব্যাপার কি? আমি ভাত, তুই রুটি?” যতীন বাসুদেবের পাতের দিকে দৃষ্টি রেখেই প্রশ্ন করল।

“আমি নিরামিষ আর তুই আমিষ! আমার পাতে দুধ কলা, তোর পাতে কিন্তু ভাই কাঁচকলা।” বাসুদেব উচ্চগ্রামে হাসে।

ততক্ষণে মলিনা সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

খেতে খেতে বাসুদেব বলে, “আজ পূর্ণিমা; ভাত খাওয়া নিষেধ।”

“কার নিষেধ, তোর গুরুদেবের?” যতীন চোখ তুলে তাকায়।

“না। নিজে থেকেই খাই না।” বাসুদেব আড়চোখে মলিনার দিকে তাকায়।

খেতে বসে গলগল করে ঘামতে শুরু করেছে যতীন। বাসুদেবেরও মুখে ঘাড়ে ঘাম জমে উঠেছে। মলিনা চুপটি করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাই দেখে। যতীনের খোলা গায়ে ঘামের প্রাবল্য একটু বোধহয় দৃষ্টিকটুই হবে। অথচ তারই পাশে বসে বাসুদেব। ধবধবে ফরসা গোলগাল মুখের ছাঁদ লোকটার। কপালটাও তেমন চওড়া নয়। ভরাট গলা। ঘাম জমেছে ফোঁটা ফোঁটা, সারা মুখ ভরে। ভিজে চন্দন দিয়ে মুখে তিলক আঁকলে বুঝি এমনই দেখায়।

“তোমার পাখা নেই?” যতীন মলিনার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে।

কী যেন ভাবছিল মলিনা। স্বামীর কথা কানে যায় নি। জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে সে তাকিয়ে থাকে।

“কী? নেই পাখা?” যতীনই আবার জানতে চায়।

মলিনা ঘর থেকে পাখা নিয়ে আসে।

“জোরসে একটু বাতাস কর তো। খাব কি ঘেমেই মলুম। যা ভ্যাপসা গরম।” ভিজে গামছায় বুক মুছে যতীন বললে।

“কাল কল্যাণেশ্বরীতে বৃষ্টি হল!” বাসুদেবও কপালের ঘাম মোছে।

“পাহাড় জায়গা তো; ওখানে তুই এত গরম পাবি না।”

“কই, দিনের বেলায় এমন আর কম কি? রাত্তিরে অবশ্য ঠাণ্ডাই।”

“কোথায় ছিলি রাত্তিরে?”

“মন্দিরে। বেশ লাগল। এক সাধুর সঙ্গে দেখা; কথাবার্তা বললাম অনেকক্ষণ। বয়স হয়েছে তাঁর। আশ্ৰম আছে দেওঘরের দিকে। গৃহী অথচ সাধু। আশ্চর্য!” বাসুদেব কেমন যেন আনমনা হয়ে ওঠে।

“ব্যাস, আর কি! সাধু মানুষ, বয়স হয়েছে, আশ্রম আছে, তুই একেবারে গলে গেলি!” যতীন জোরে হেসে উঠল, “দীক্ষাটাও চট করে নিয়ে নিলি, কি বল?”

বাসুদেব ওর স্বভাবমত মুচকি হাসি হেসে মাথা নাড়ল।

“ওঁর আশ্রমে আপনার একটা জায়গা হল না?” মলিনা ঠোঁট কুঁচকে হাসল।

মলিনার মুখের হাসি তার কণ্ঠস্বরের তীক্ষ্ণতা ঢাকতে পারল না। বাসুদেব আবার আড়চোখে তাকাল। তেমনি ভাবেই মাথা নাড়ল আবার, “না । আমি তো জায়গা খুঁজি নি।”

“খুঁজলেই পারতেন। আশ্রম না হলে সন্ন্যাসীদের মানাবে কেন?” হাতের পাখা জোর হয়ে ওঠে মলিনার।

আশ্চর্য, এত জোরে বাতাস করছে মলিনা তবু যতীন ঘামছে। বাসুদেবের মুখের ঘাম কিন্তু শুকিয়ে গেছে।

“আমি তো সন্ন্যাসী নই”, বাসুদেব আস্তে আস্তে বলল।

“সন্ন্যাসী নন তো গেরুয়া পরেন কেন?” মলিনার রুক্ষ দৃষ্টি বাসুদেবের দৃষ্টির সঙ্গে মিলে যায়।

“এমনি। ভাল লাগে তাই। সুবিধেও কম নয়। বিনি টিকিটে ট্রেনে চড়ি—কারুর বাড়িতে গেলে দু’বেলা অন্নও জুটে যায়। এ ও প্রণাম করে—দু’চার পয়সা দেয়। মন্দ কি! দিন তো চলে যাচ্ছে।” বাসুদেব যেন কৌতুক করছে—এমনি ভাবে কথাগুলো বলে। পরিহাসের তরলতা তার গলায়। পরিচ্ছন্ন হাসি হেসে বাসুদেব এবার যতীনকে বলে, “কি রে, ঠিক বললুম না?”

“উঁহু। নেহাতই বাজে কথা!” যতীন উত্তর দেয়।

“কি রকম?”

“ওর আর কোনও রকম নেই! ঘরে মা নেই, থাকলে তোর বিয়ে দিত। তখন বউয়ের ভেঁড়ুয়া হতিস। বউ নেই তাই গেরুয়া ধরেছিস।” যতীন বললে মুরুব্বি চালে। তাকাল মলিনার দিকে।

ঘরের মধ্যে আস্তে আস্তে যে ভারী আবহাওয়া জমে উঠেছিল যতীনের কথা আর হাসিতে অনেকটা ফিকে হয়ে এল। সশব্দে হেসে উঠল বাসুদেবও।

মলিনাও হাসল। তবে তার হাসি শব্দবহুল নয়—এমন কি কৌতুক-স্নিগ্ধ সহজ সাদা হাসি যে—তাও নয়। বরং মলিনার ঠোঁটের কোণে যে বাঁকা হাসির রেখা ফুটে উঠল তার জের টেনে ও কথা বলল বাঁকা সুরেই, “বেবাগী লোকের বউতে কি যায় আসে? কথায় আছে না তাই—থাকলে সর, না থাকলে পর।”

বেফাঁস কথাটা মলিনার মুখ থেকে কেমন করে যে বেরিয়ে গেল সে বুঝতেও পারল না। জিভকে রাশ বেঁধে সব সময় কি রাখা যায়—কখনো-সখনো আলগা হয়ে যায় বই কি!

কথাটা কারও কান এড়ায় নি। যতীন ভাতের থালা থেকে হাত উঠিয়ে তাকাল মলিনার দিকে। সোজাসুজি চোখে তাকাল বাসুদেবও।

ক’টা মুহূর্ত। নিঃশব্দে তিনটি প্রাণী মনের ফেনা মাখল নিজেদের মনেই; বিমূঢ়, বিব্রত হয়ে। শেষ পর্যন্ত মনের ফেনায় মলিনার চোখের কোণে কেমন করে যে জল এসে পড়ল, করকরিয়ে উঠল দুই চোখ, কে বলবে, কে জানে!

পাখা মাটিতে নামিয়ে রেখে উঠে পড়ল মলিনা। দালান থেকে ঘরে এসে ঢুকল। বুকটা অযথাই ধড়ফড় করছে! ব্যথার মোচড়ে বুকের হাড় ক’টাও কনকনিয়ে ওঠে।

বিকেল না হতেই মলিনা ঘর-দোর পরিষ্কার করে উনুন ধরিয়ে দিলে । আনাজের ঝুড়ি নিয়ে কুটনো কুটতে বসল দালানে। দমকে দমকে ধোঁয়া আসছে। ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল মলিনা। ভিতরে বিছানায় বসে বাসুদেব “সদ্‌গুরুসঙ্গ” পড়ছে।

দালান ভরে কটু ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ল—আর সেই ধোঁয়ার মাঝে বসে থাকল মলিনা অনেক—অনেকক্ষণ। ধোঁয়া যখন সরে গেল, বাতাসে চোখ মেলে মলিনা দেখে উনুন তার ধরে উঠেছে দাউ দাউ করে। চোখের জলে মনটাও থিতিয়ে গেছে। মলিনা মরমে মরে যাচ্ছে এখন।

তাড়াতাড়ি চা তৈরি করল মলিনা। ধবধবে কাচের গ্লাসে চা নিয়ে ঘরে ঢুকল; “কই, নিন, চা নিন!” হাত বাড়িয়ে চা দিল মলিনা।

বই থেকে মুখ তুলে বাসুদেব আনমনা-চোখে তাকাল। ‘সদ্‌গুরুসঙ্গে’র সঙ্গী মন যে নিঃসঙ্গ নয়—এ কথা মনে করতে বাসুদেবের খানিকটা সময় লাগে। চায়ের গ্লাস হাতে নিয়ে বাসুদেব প্রশ্ন করল, “বিকেল হয়ে গেল নাকি?”

“তা কি আপনার আমার জন্যে বসে থাকবে?” মৃদু হাসল মলিনা। শাড়ির আঁচলে ‘সদ্‌গুরুসঙ্গ’ ঢেকে নিয়ে বলল, “চা খেয়ে আমার একটা কাজ করে দিন তো দেখি।”

“কী কাজ?” জানতে চায় বাসুদেব ।

“একটু বাজার যেতে হবে।” মলিনার স্বরে লজ্জা।

“তা বেশ তো।”

নিজেকে আরও স্পষ্ট, ব্যক্ত করার আশায় মলিনা বলে, “আপনার বন্ধু ফিরে আসতে সন্ধে হয়ে যাবে ততক্ষণ অপেক্ষা করলে আমার আর যাওয়া হয় না—হাঁড়ি আগলেই বসে থাকতে হবে। রান্নাবান্না শেষ করে রাখি । উনি এলেই আমরা আজ আপনার সঙ্গে আশ্রমে বেড়াতে যাব।”

একটু হয়ত অবাকই হয়েছিল বাসুদেব। কিন্তু সবাক হল যখন, তখন তার গলার সুরে সহজ একটা প্রশ্নই শোনা গেল। “আশ্রমে যাও নি কখনো?”

“একটিবার শুধু। ঠাকুরের আরতি হয় শুনেছি—দেখি নি। আজ চলুন, দেখে আসি।” উৎসাহ জানাল মলিনা।

“বেশ তো চল।”

বেশ খুশীই হয়েছে মলিনা। ওর মুখ দেখে তাই অন্তত মনে হয়। তাকের ওপর ‘সদ্‌গুরুসঙ্গ’ তুলে রেখে মলিনা এবার বলল, “এতক্ষণে নিশ্চিত হলাম, যা ভয় হচ্ছিল।”

“কেন?”

“আমি ভাবলাম আপনি বুঝি খু-ব রেগে রয়েছেন—” মলিনা নতচোখে বলল হাতের আঙুলে আঁচল জড়াতে জড়াতে, “তখনকার কথায় রাগ করেন নি তো?”

বাসুদেব তার অভ্যাস মত নীরবে হাসে। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে মলিনার মাথা থেকে ঘোমটা খসে পড়েছে। ক্লান্ত কপালে ফিকে সিঁদুরের টিপ; আরও যেন কিছু—একটু মমতা, হয়ত বা করুণা। সব মিলে-মিশে মনমরা একটি মুখ। “পাগল, রাগ করব কেন?”

সবেমাত্র গা ধুয়ে কাপড়-চোপড় ছেড়ে মলিনা ভব্য হচ্ছে, ওদিকে সন্ধের আবছা অন্ধকার দালান পেরিয়ে জুড়ে বসছে, ঘর, উঠোনে তুলসী গাছের চারার তলায় প্রদীপটা জ্বলছে তখনও কেঁপে কেঁপে, হঠাৎ দমকা ঝড় এল যেন।

হুড়মুড় করে সদর দরজা পেরিয়ে যতীন উঠোনে পা দিয়েই হাঁক দিল, “কই গো, শীঘ্রি তোমার রান্না সারো।”

উঠোনে বেতের মোড়া টেনে বসেছিল বাসুদেব। মলিনা ঘরে প্রসাধন সারছে তখনও।

“এই যে তুই বাড়িতেই আছিস? ভালোই হল।” বাসুদেবের দিকে তাকিয়ে বলল যতীন, “ভাগ্যিস তুই ছিলি, না হলে আচ্ছা এক বিপদে পড়া যেত।”

স্বামীর ডাক শুনে মলিনা দালানে এসে দাঁড়াল। স্ত্রীর দিকে এক লহমা তাকিয়ে যতীন বলল, “চট করে তোমার রান্নাটা সেরে নাও তো। দুটো মুখে দিয়ে বেরিয়ে পড়ি। সারা রাত ট্রেনের ধকল সইতে হবে। ভাল কথা, আমার ধোয়ানো কাপড়-চোপড় বাক্সে আছে না কিছু?”

মলিনা অবাক হয়ে স্বামীর পানে তাকিয়ে থাকে। বুঝতে পারে না হঠাৎ ধকল সওয়ার কারণ কি ঘটল। একটু ভয়ই হয়। বাড়ি থেকে চিঠি এসেছে নাকি!

“হঠাৎ ট্রেন? যাবি কোথায়?” প্রশ্ন করে বাসুদেব!

“কলকাতা।” দ্রুত, উত্তেজনা-ভরা গলায় বলতে থাকে যতীন, “অফিসে চিঠি এসেছে আমাদের পাঁচ টাকা করে ডিয়ারনেস বেড়েছে এপ্রিল মাস থেকে। গত এপ্রিল থেকে এই এপ্রিল। পাক্কা এক বছর পাঁচ টাকা করে পাব—মানে তোর ষাট টাকা। অনিলবাবুকে দিয়ে আজই বিল করিয়ে নিয়েছি। সাহেবও সই করে পাস করে দিয়েছে। কাল হেড অফিসে পৌঁছে বিলটা দেব; আমাদের টাকাটি নেব আর ব্যস রাত্রে ট্রেনে উঠব। ভাগ্যিস তুই ছিলি, নয়ত কি আর একা বউ ফেলে যাওয়া যেত! …কই গা একটু চা খাওয়াবে না? আর হ্যাঁ, কথা বলছ না যে, কাপড়-চোপড় নেই?”

“আছে।” মলিনা থমথমে গলায় বললে ।

ফিরে গিয়ে নিবে আসা উনুনে চায়ের জল চড়াচ্ছে, শুনল—বাসুদেব বলছে “দেখ্‌ তো কাণ্ড। আমি কোথায় ঠিক করে রাখলাম কাল সকালে যাব তো তুই সব ভেস্তে দিলি!”

“কাল সকালে তুই যাবি? কোথায় যাবি?”

“কোথায় তা কি ঠিক করে রেখেছি? তবে কালই বেরিয়ে পড়ব ঠিক করে রেখেছিলাম। এখানে অনেকদিন থাকা হয়ে গেল, প্রায় তিন হপ্তা।”

“আরে নে তোর তিন হপ্তা। যাবি, যাস না। আমি তোকে আটকাচ্ছি? কালকের দিনটা থেকে যা। পরশুদিন সকালে আমি ফিরে আসছি, তারপর যাস।”

স্বামীর জন্যে চা ঢালতে ঢালতে মলিনা সব শুনল, প্রত্যেকটি কথা। মনটা তার হঠাৎ তিক্ত হয়ে উঠেছে আবার।

যতীনের হাতে চা তুলে দিয়ে মলিনা বলল, “বাক্স থেকে কাপড়-জামা কি বেছে নেবে, নাও এসে।”

কাপড় জামা বেছে নেওয়ার কিছুই ছিল না। এ শুধু একটা অজুহাত। যতীন ঘরে এল। বাক্স খুলে হাঁটু গেড়ে বসল মলিনা। এক হাতে তুলে ধরল লণ্ঠন। আলোটা কিন্তু বাক্সের চেয়ে মলিনার মুখকেই বেশি আলোকিত করেছে।

“বা, বেশ দেখাচ্ছে তো তোমায় আজ।” স্ত্রীর গম্ভীর অথচ সুশ্রী মুখের দিকে তাকিয়ে যতীন বলল।

“দেখাক্‌, তোমার কি! আমার মুখ দেখবার জন্যে তো আর তুমি বসে থাকবে না। নাও, তাড়াতাড়ি করো, আমার কাজ আছে।”

মলিনা যে চটে উঠেছে সে কথা বুঝতে যতীনের দেরি হয়নি। আমতা আমতা করে যতীন অফিসের সব কথা বুঝিয়ে বলল আবার। শেষে মলিনার গাল ধরে বলল, “ছিঃ, অবুঝ হয়ো না। গরিব লোক আমরা। যে ক’টা টাকাই পাই না কেন হাতে না পাওয়া পর্যন্ত ঘুম হবে না। কত লোকের কত দরকার, এই টাকাটা পেলে কাজে লাগবে সকলেরই।”

“তা যাও না কলকাতা, আমি কি বাদ সাধছি!” বলে মলিনা অভিমানভরে মুখ সরিয়ে নিল।

“বাদ না সাধলেও বাধা দিচ্ছ।”

“মোটেই নয়।”

“বেশ, তবে বলো তোমার জন্যে কী আনব কলকাতা থেকে?”

“কী আর আনবে! বেশ মোটা দেখে দড়ি কিনে এনো খানিকটা।” থমথমে গলায়, চোখে জল ভরে বললে মলিনা, খুব আস্তে আস্তে।

কাজকর্ম সেরে মলিনা যখন ঘরে ঢুকল রাত তখন খুব বেশি নয়। তবু পাড়াটা নিস্তব্ধ, নিঝুম হয়ে গেছে। রোজই যায়। রোজ তবু এ বাড়িটা অন্তত আরও খানিকক্ষণ সজাগ থাকে। কথায়, চিৎকারে, হাসিতে এতটুকু বাড়ি সরগরম করে রাখতে যতীনের জুড়ি নেই। খাওয়া সারতেই একঘণ্টা। মলিনার সঙ্গে যত রাজ্যের অফিসের গল্প করবে যতীন। তারপর বন্ধুদের কথা—কি হয়ত বাড়ির। শুতে এসে দুজনায় কত যে খুনসুটি করে তার কি শেষ আছে। বাতি নিবিয়ে বকবকমের শেষ হতে কি-বা এমন কম রাত হয়। আজ সব চুপ। অনেকক্ষণ হল যতীন চলে গেছে। এতক্ষণে গাড়িই হয়ত স্টেশন ছেড়ে চলে গেল।

মুখে দু’চার কুচি সুপুরি পুরে মলিনা দরজা ভেজিয়ে দিল। একবার শুধু দেখে নিল বাসুদেব শুয়েছে কি না। না, বাসুদেব এখনো শোয় নি। উঠোনে দড়ির খাটিয়ার ওপর চুপ করে বসে। আকাশের দিকে তাকিয়ে গুনগুন করে কি যেন গাইছে। কীর্তনের সুরের মতই কানে লাগে। চাঁদের আলোয় সারা উঠোন ভেজা। বাসুদেবের চোখ মুখ পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যায়। দরজা বন্ধ করে দেয় মলিনা। খিল আঁটে। হঠাৎ কি যেন খেয়াল হয় তার, আবার খিল খোলে। মেঝে থেকে লণ্ঠন তুলে নিয়ে ভালো করে পরীক্ষা করতে থাকে। খিল আঁটে আর খোলে। একটু যেন নড়বড় করছে খিলটা। বাইরে থেকে ধাক্কা দিলে খিল হয়ত ভেঙেই যাবে। যা ফাঁক দরজায়—পেরেক কী পাতলা লোহার শিক গলিয়েই তো খিল খোলা যায়। মলিনার বুকটা হঠাৎ ধড়াস করে ওঠে। দুর দুর করতে থাকে বুক। ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। দরজা ভেজিয়ে খিল এঁটে দেয় তাড়াতাড়ি।

এত ভয় কিসের তার—কে আসবে ঘরে, রাতদুপরে? মলিনা ভাববার চেষ্টা করে। কে আসবে তা ভাবতে গেলে প্রথমেই চোখের ওপর ভেসে ওঠে যে—সে ওই উঠোনে বসে। আর কারুর কথা তো মনের কোণেও উঁকি দেয় না। তবে? এ ভয় কি বাসুদেবের জন্যে? কিন্তু বাসুদেব—!

স্বামীর ওপর ভীষণ রাগ হয় মলিনার। এ কী? বন্ধু, তোমার বন্ধু—আমার কী! পা ফেলতে জায়গা নেই এমন এক ফালি ঘর—সেই ঘরে—দিনের পর দিন বন্ধুকে শুতে খেতে বসতে ঠাঁই দাও। কি অসুবিধেই যে হয়! আড়াল আবডাল বলে কিছুই নেই—বাইরের লোকের কাছে নিত্যি ওঠা, বসা, কথা বলা।

বাসুদেবও যেন কেমন। সেই এসেছে তো এসেইছে; যাবার নামটি করে না। হঠাৎ এল, যতীনের খোঁজখবর নিয়ে। একই গ্রামে নাকি ওদের বাড়ি, একই সঙ্গে ছেলেবেলা থেকে মানুষ। বাড়িতে বাড়িতে জানা-শোনা—দহরম-মহরম। বাসুদেবের মা মারা যাবার পর ঘরে তালা দিয়ে ছেলে বিবাগী হয়ে যায়। আর গ্রামে ফেরে নি। যতীনের বিয়ের কথা কার মুখে যেন শুনেছিল—ঠিকানা জেনে নিয়েছিল—তারপর হাজির হয়েছে উটকো ভাবেই।

স্বামীর কাছে কথায় কথায় মলিনা শুনেছে বাসুদেবের নাকি কোনো এক ডানাকাটা পরীর সঙ্গে বিয়ে হবার কথা হয়েছিল। সব ঠিকঠাক, হঠাৎ বাসুদেবের মা শুনলেন—মেয়েটি বালবিধবা। বাসুদেব জানত। বিয়ের ইচ্ছেটা তারই। তবু মা গোপন কথাটা জানতে পেরে আঁতকে উঠলেন। হ’লই বা সুন্দরী—সমাজ ধর্ম জলাঞ্জলি দিয়ে সুন্দরী ঘরে আনতে হবে এমন কথা কেউ কি শুনেছ? না—তা হবে না। বাসুদেবের মার দৃঢ় আপত্তি। ওদিকে বাসুদেবেরও গোঁ। হ্যাঁ-না-এর টানা-পোড়েন চলছে, এমন সময় হঠাৎ বাসুদেবের মা মারা গেলেন; ছেলেও গৃহত্যাগ করলে।

কী যে ত্যাগ করেছে বাসুদেব—মলিনা তাই ভাবে। কে বলবে ও ঘর ছেড়েছে? এই কি ঘর ছাড়ার লক্ষণ? নিজের ঘর ছেড়েছে বটে কিন্তু জুড়ে বসেছে অপরের ঘর, অপরের ঘরণী।

কথাটা মনে হতেই মলিনার চোখদুটো কপাটের খিলে আটকে গেল। আবার দুরু দুরু করতে লাগল বুক। সত্যি, লোকটা যেন কেমন! প্রথম যে দিন এল, ওর চেহারা আর কাঁধ-পর্যন্ত চুলের বহর দেখেই মলিনার মন বিষিয়ে গিয়েছিল। তারপর প্রথম প্রথম সে কী কাছে ঘেঁষার ঘটা! উঠতে বসতে মুচকি-মুচকি হাসা, আস্তে-আস্তে ওর নাম ধরে ডাকা—মলিনা, ও মলিনা। …আর এমন ভাবে লোকটা তাকাত যেন মলিনা ওর কত জন্মের চেনা, কতই না আপনজন।

প্রথম দর্শনেই যাকে দেখে পিত্তি জ্বলে গিয়েছিল তার গেরুয়া-বসনের ঘটাপটায় ভেকভড়ং ছাড়া আর কিছু যে আছে মলিনা তা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারে নি। আজও পারে না। কেনই বা না হবে? সবল সুস্থ মানুষ, এ সংসারে তার কোনো কাজ নেই গা? বন্ধুর ঘাড়ে বসে খাবে আর তার বউয়ের দিকে চোরা-চোরা তাকাবে? তাও যদি বন্ধু বড়লোক হত। একে তো নিজেদেরই চলে না; আনতে, খেতে, পরতে শুধু নেই, তবু পরের জন্য ধার করো আর মরো।

রাগ শুধু নয়, যতীনের ওপরেও মলিনার মন বিষিয়ে ওঠে। এ কী! কোথাকার কে—তার জিম্মায় ঘর ছেড়ে, বউ ছেড়ে দিব্যি তুমি চলে গেলে! কিছু যদি একটা হয়!

মাঝরাতে মলিনা হয়ত ঘুমিয়ে পড়বে—আর হঠাৎ যদি দরজা খুলে ওই—। …ভয়ে মলিনার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। ঘাম জমতে থাকে ঘাড়ে, কপালে।

হঠাৎ কি মনে হতে মলিনা ইঁদুর-মারা কলটা বেঞ্চির তলা থেকে বের করে নেয়। প্রাণপণে তার তীক্ষ্ণধার ফলা দুটি খোলে। তারপর আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে ইঁদুরকলটা দরজার চৌকাঠের ঠিক মাঝখানেই রেখে দেয়।

বাতির শিখা কম করে বিছানায় শুয়ে পড়ে মলিনা। চোখের দৃষ্টি মেলা থাকে দরজার ওপর—আলকাতরা-রাঙানো কালো কাঠ পুরু একটা যবনিকার মতন ভাসতে থাকে।

কখন যেন চোখের পাতায় তন্দ্রা নেমেছিল—হয়ত শেষ রাতেই, কিসের একটা খুট্‌ করে শব্দ হতে ধড়মড় করে উঠে বসল মলিনা। কই, কিছু না তো? তবে? অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর মলিনা অত্যন্ত সন্তর্পণে দরজা খুলে উঠোনে চোখ মেলে তাকাল।

ভোর হয়ে আসছে। ফরসা হয়ে গেছে আকাশ। বাসুদেব ঘুমিয়ে।

পা টিপে টিপে উঠোনে নেমে এল মলিনা। বাসুদেব ঘুমোচ্ছে। তার চোখের পাতায় ভোর বেলার প্রগাঢ় ঘুম, ঠোঁটের কোলে একটু মিষ্টি হাসি। হয়ত স্বপ্নই দেখছে। কার স্বপ্ন? মলিনা হঠাৎ চমকে ওঠে, শিরশিরিয়ে যায় ওর সর্বাঙ্গ। শাড়ির আঁচলটা গায়ে জড়াতে গিয়ে হঠাৎ খেয়াল হয়—কাল আশ্রমে বেড়াতে যাবার জন্যে মলিনা যা সাজগোজ করেছিল, এখন সে সবই তার দেহে। সেই শাড়ি, ব্লাউজ, সেই কুমকুমের টিপ, পায়ের আলতা। এখনো গায়ে সেন্টের ফিকে গন্ধ।

আশ্চর্য, রাতে শোবার আগে শাড়ি ব্লাউজটাও খুলে রাখি নি? কেন এমন ভুল?

আঁচলটা আঙুলের পাকে জড়াতে জড়াতে মলিনার কেমন যেন মনটা ফাঁকা হয়ে যায়, বুকের মধ্যে একরাশ বাতাস পাক খেতে থাকে।

ফাঁকা মন নিয়েই মলিনার সারা দিন কেটে যায়। আনমনা উদাস। টুকটাক কাজ-কর্মে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চায়; পারে না। দুপুরে গরম পড়ে—অসহ্য গরম। মলিনার মনের জ্বালাও মন থেকে মনে ছড়িয়ে পড়ে। বার দুয়েক গা ধুয়ে নেয়। একটু যদি জুড়োয় শরীর।

দুপুরের একটু পর থেকেই মেঘ জমতে থাকে। বিকেলের গোড়ায় ঘোর হয়ে আসে আকাশ। ধুলো বালির ঘূর্ণি ওঠে, তারপর জল নামে অঝোর ধারায়। ক’দিন ধরে যা গরম পড়েছে তাতে বৃষ্টি হবে এ এমন কিছু আশ্চর্য নয়—কিন্তু এই বৃষ্টি দেখে মলিনার মুখ আরও কালো হয়ে ওঠে।

আবার রাত। নিস্তব্ধ, নিঝুম হয়ে আসে তালপুকুরের পাড়া। সমানে বৃষ্টি পড়ছে। কখন ঝিমিয়ে আসে, কখন জোর হয়ে ওঠে। ছেদ নেই। ছন্নছাড়া এলোমেলো বৃষ্টির ছাঁট আলুথালু করে মলিনাকে ভিজিয়ে দিয়ে যায়; ভিজে জলে থই থই করতে থাকে দালান। উঠোনে জল দাঁড়িয়ে যায়।

এমন ভাবনায় আর কখনো পড়ে নি মলিনা—সমস্যাটা খুবই কঠিন। তবু সে সমস্যা তেমনি ভাবেই সমাধান করতে হয়—ঠিক যেমন ভাবে বাসুদেবের মা ছেলের বিয়ের সমস্যার সমাধান করেছিলেন। জলে গলা পর্যন্ত ডুবে যাক বাসুদেব, দালানে দাঁড়িয়ে থাক—তবু এক ঘরে মলিনার সঙ্গে তার শোয়া চলে না।

মুখ ফুটে বলতে হয় নি মলিনাকে, বাসুদেব নিজেই দালানের একটু কোণ ঘেঁষে দড়ির খাটিয়ায় শুয়ে পড়ল।

আজ যেন আরও ভয় করছে মলিনার। আকাশই শুধু কালো নয়, বৃষ্টির জলই শুধু জল নয়, মলিনার মন রাতের প্রতিটি প্রহরে প্রহরে যত রাজ্যের কালি শুষে শুষে কালো হতে লাগল; আর চোখের জলে সেই কালো গলে গলে ওর সর্বাঙ্গে কালি মাখাল।

কে? কিছু না, বাতাস!—কে যেন হাঁটছে দালানে; জলে পা পড়ার শব্দ, পা টানার আওয়াজ। কার চোখ বুঝি দরজার ফাঁক দিয়ে চেয়ে আছে! কী দেখছে ও? মলিনাকে? অষ্টাদশী মলিনা ভয়ে লজ্জায় আঁট হয়ে থাকে। ধুকধুক করে বুক, হাত-পা কাঁপে, অবশ হয়ে আসে।

কত রাত এখন? গভীর রাত নিশ্চয়। যতীন নেই। কলকাতায়। না, কলকাতায় নয়, গাড়িতে। বাড়ি ফিরছে যতীন। পকেটে টাকা। মলিনা আরও ক’টা টাকা জমাবে এবার। বাঁচিয়ে-বঁচিয়ে লুকিয়ে এ ক’মাসে প্রায় গোটা তিরিশেক টাকা জমিয়েছে। এবার যদি আর কিছু জমায়—ভারী দুটো কানবালা গড়াবে মলিনা। বড় শখ তার। কিম্বা একটা সেই শাড়ি কিনবে—পূর্ণিমার মতন। কিন্তু যতীন যদি তাকে টাকা না দেয়—যদি পুরো টাকাটাই পাঠিয়ে দেয় তার বাবাকে, গলসীতে। না, কখনই তা হবে না। পাঠিয়ে দেখুক যতীন; যাচ্ছে-তাই ঝগড়া করবে মলিনা এবার। বিয়ে করেছ, কচি খোকাটি নও, তবু বউয়ের জন্যে দরদ নেই তোমার। শুধু দুবেলা দুটি ডাল-ভাত আর মিষ্টি কথা? একটা পয়সাও যদি হাতে তুলে দিয়ে থাকে কখনো; একটা কিছু কিনে থাকে নিজে শখ করে! কষ্টেসৃষ্টে যা বাঁচাবার মলিনাকেই বাঁচাতে হয়েছে লুকিয়ে-চুরিয়ে। চুরি? কথাটা মনে হতেই মলিনার বুকটা ধক করে ওঠে। চুরি ছাড়া কি? চুরি-ই বলে একে। যতীন জানে না, মলিনা লুকিয়ে লুকিয়ে টাকা জমায়; লকিয়ে এটা-ওটা কেনে। হোক না তা দু’চার আনা, কী দু’এক টাকা। কালও যাবার সময় যতীন চেয়েছে; চেয়েছে র‍্যাশন আনতে, চেয়েছে কলকাতা যাবার সময় দু-চার টাকা, ট্রেনে হাত খরচের জন্যে। মলিনা দেয় নি। বলেছে ‘টাকা কই, কোথায় পাব?’

শেষ পর্যন্ত যতীন বাসুদেবের কাছ থেকে ক’টা টাকা নিয়ে গেছে। বাসুদেব! এই লোকটাকেও আজ তিন হপ্তা ধরে চর্বচোষ্য খাওয়াতে হচ্ছে। কোথাকার কে, তার জন্যে গতর দাও, নিজেদের মুখের ভাত তুলে দাও। এক পো দুধ পেলে যতীনের হাড়ভাঙা খাটুনির খানিকটা যেন পূরণ হয়—কিন্তু তার কপালে এক ঝিনুকও দুধ জোটে না, অথচ বাসুদেবের বেলায় দুধ চাই। কেন? কে তার বাসুদেব?

বাসুদেবই বা কে, যতীনের বাবা মা-ই বা কে মলিনার? মলিনা কি তার স্বামীকে দুধ খাওয়াতে পারে না? একটু ঘি বা একটু বেশি মাছ। কানবালার জমানো টাকা, ব্লাউজের ছিট, পাড়াপড়শীর সঙ্গে মাঝদুপরে সিনেমা যাওয়া। মাসে এই ক’টা টাকাও তো বাঁচিয়ে স্বামীর জন্যে ব্যয় করতে পারে মলিনা। শ্বশুর শাশুড়ির ওপরেই বা এত রাগ কেন?

মলিনার মাথা গরম হয়ে ওঠে ভাবতে ভাবতে। এমন ভাবে কোনোদিন সে ভাবে নি। এত ভয় হয় নি তার নিজের জন্যে। আজ যেন সব একে একে খুলে যাচ্ছে—মনের যত গ্লানি, জট। স্বামী তার, স্বামীর সংসার তার, কর্তৃত্ব তার। সব পেয়েছে মলিনা, কিন্তু পেয়েও মন কি তার কানায় কানায় ভরে উঠেছে? না! স্বামী আর সে ছাড়া আর কিছুই তার সহ্য নয়। আর যা আছে সবই তার চিন্তার গণ্ডী থেকে দূরে।

কে ডাকল না! মলিনা ধড়মড় করে উঠে বসল। সম্বিত ফিরে পেয়েছে এতক্ষণে। কান পেতে শুনল—বাইরে আবার অঝোর ধারায় জল নেমেছে; আকাশ-ভাঙা বৃষ্টি। ঘরের বাতিও প্রায় নিবু-নিবু।

কে যেন দরজায় ঠেলা দিচ্ছে! একটু পরেই আধো-আলো অন্ধকারের একটা মুখ ভেসে উঠবে। ইঁদুর-কলটা পাতা আছে তো দরজার গোড়ায়? আছে।

বিবর্ণ মুখে বসে থাকে মলিনা দরজায় চোখ রেখে রুদ্ধ নিশ্বাসে। মিনিটের পর মিনিট কেটে যায়—কেউ তো আসে না। কেউ না।

আজও এল না তা হলে!

জানলা দিয়ে আকাশ দেখল মলিনা। শ্লেট-রঙের আকাশ। ভোর হল এই, বৃষ্টি থেমেছে।

আস্তে আস্তে দরজা খুলে দালানে পা দেয় মলিনা। জলে ভেসে যাচ্ছে দালান। এক কোণে সিক্তবাস সিক্তদেহ বাসুদেব গালে হাত রেখে চুপ করে বসে আছে। যেন সপাং করে একটা চাবুক কষিয়ে দিলে মলিনাকে। জ্বালা ধরে গেল সর্বাঙ্গে! হাত পা অসাড় হয়ে এল ক্ষণেকের জন্যে। কোমর পর্যন্ত জলে ডুবে যে লোকটা পাথরের মতো বসে আছে তার দিকে তাকিয়ে মলিনার মনে হল—বড্ড ছোট ঘরে ও বাস করে, বড্ড ছোট মন নিয়ে। নোংরা মন। ইঁদুর কি!

বাসুদেবের পাশে এসে মলিনা ডাকে, “এ কী? এমনি ভাবেই বসে আছেন সারারাত?”

বাসুদেব চোখ তুলে তাকায়। চোখ দুটো জবা ফুলের মতো লাল। বাসুদেবের হাত ধরে মলিনা।

“ছি ছি। আপনি কি বলুন তো! সারা রাত এ ভাবে বসে থাকলেন? একবার তো ডাকতে হয়। আমিও মরণ-ঘুম ঘুমিয়েছি।”

বাসুদেব তেমনি ভাবেই তাকায়। মলিনার চোখে মুখে কোথাও কি ঘুম লেগে আছে?

“গাটাও খুব গরম মনে হচ্ছে। উঠুন। আসুন আমার সঙ্গে।” মলিনা বাসুদেবের হাত ধরে টানে।

সেদিনই মাঝরাতে যতীনের পাশ থেকে উঠে মলিনা দরজার খিল খুলতে গেল নিঃশব্দে। কে জানত আজও দরজার গোড়ায় ইঁদুরকল পাতা আছে। মনেও পড়েনি ঘুণাক্ষরে মলিনার। ইঁদুর-কলে পা পড়ল ওর। করাতের দাঁত কামড়ে ধরেছে মলিনার পা। কঠিন কামড়। পায়ের পাতা যেন থেঁতলে গেল। কী তীব্র যন্ত্রণা! কঁকিয়ে উঠল মলিনা। যতীন অঘোরে ঘুমোচ্ছে। কোনো সাড়া শব্দ নেই।

কেমন করে যে মলিনা বাতি জ্বেলেছে; অসহ্য যন্ত্রণা সম্বরণ করেছে দাঁতে দাঁত চেপে, কেউ তা জানতে পারল না।

পরের দিন একটু বেলায় গম্ভীর মুখে যতীন একটা রিকশা ডেকে আনল। গায়ের মোটা চাদরটা জড়িয়ে কাঁধের থলে কাঁধে ফেলে বাসুদেব বললে, “আসি রে! বেশ কাটল ক’টা দিন। আবার আসবো কখনো।”

“খবরদার! এ বাড়িতে আর পা দিবি নে, তোর গুরুর দিব্যি। আমি তোর কে?”

“বন্ধু”, ম্লান হেসে বলে বাসুদেব।

“থাক-থাক শালা, আর বাক-ফট্টাই করিস নে। অনেক ভড়ং দেখলাম। গা ভর্তি জ্বর। বাড়ি ছেড়ে চললেন উনি। কেন রে? এতদিন কাটল, আর ক’টা দিন তোর এখানে কাটত না?”

“রাগ করিস কেন? আমার হয়ত বসন্ত হবে। তোদের বাড়িতে বিষ ছড়াব। তাই।” একটু থামল বাসুদেব, তারপর বললে আবার, “যাই দেওঘরের গাড়ি চলে গেলে ফিরে আসতে হবে।”

“দেওঘরে যাচ্ছ? যাও—।” ক্ষুদে ক্ষুদে চোখে তাকাল যতীন, “কোথায় উঠবে? সেই আশ্রমে তো! যদি না উঠতে দেয়?”

“পাগল, তিনি আমার গুরু। আচ্ছা আসি। মলিনা কই—ঘরে? থাক থাক, আসতে হবে না। চললুম—আবার আসব।”

বাসুদেব গিয়ে রিকশায় উঠল। বড় রাস্তা পর্যন্ত বাসুদেবকে এগিয়ে দিয়ে যতীন ফিরে এল। উঠোনে, দালানে কোথাও মলিনা নেই।

ঘরে ঢুকে যতীন দেখে মলিনা জানলার কাছে চুপটি করে দাঁড়িয়ে।

“কী গো, কী হল, দাঁড়িয়ে যে?”

স্বামীর গলার স্বরে মুখ ফেরাল মলিনা। চোখ দুটো তার লাল; ছল ছল করছে।

অবাক হয়ে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে যতীন বলে, “কী ব্যাপার, কাঁদছ নাকি?”

মলিনার খেয়াল হল। তাড়াতাড়ি চোখ মুছে বলল, “পা’টায় বড় যন্ত্রণা হচ্ছে।”

মলিনার পায়ের দিকে যতীনের এই প্রথম নজর গেল। ছেঁড়া কাপড়ে মলিনার পা জড়ানো। বেশ ফুলেছে। কী হয়েছে জানতে চায় যতীন।

মলিনা বলে, “ইঁদুর কলে কেটে গেছে।”

নিমেষে যতীনের মেজাজ চড়ে যায়।

“কোথায় সেই সর্বনেশে যন্তরটা? আজ আমি ওকে বাড়ি থেকে বিদেয় করব।”

খাটের তলায় ইঁদুরকল খুঁজতে বসে যতীন।

স্বামীর দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে মলিনা ধীরে ধীরে বলে, “খাটের তলায় নেই।”

“কোথায় তবে?”

“ফেলে দিয়েছি জানলা দিয়ে।”

চমক লাগে যতীনের। দাঁড়িয়ে উঠে সন্দিগ্ধ কণ্ঠে প্রশ্ন করে, “সত্যি?”

আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে মলিনা। বলে, “হ্যাঁ, সত্যি।”

“তা হলে তোমার ইঁদুর—?” স্ত্রীর অবোধ্য চোখে চোখ রেখে যতীন থতমত খেয়ে বলে।

স্বামীর কথার জবাব দেয় না মলিনা। মনে মনে ভাবে: ওর ইঁদুর তো বাইরে নেই—ঘরেই রয়েছে। কুরকুর করে কাটছে দিনরাত— কত যে ক্ষতি করেছে তার কি লেখা-জোখা আছে—না থাকবে কোনও দিন। আরও কত হয়ত করবে। কিন্তু যতীন একটুর জন্যে বেঁচে গেছে, এই তার ভাগ্যি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *