ইঁদুর
‘কিরকম হচ্ছে?’
‘আজ্ঞে, সাঙ্ঘাতিক হচ্ছে। আপনার আর মা ঠাকরুনের বড় দুটো ছবি দামী ফ্রেমে গোল্ডেন বর্ডার দিয়ে বাঁধিয়ে আই লেভলে ঝুলিয়েছি। তলায় কারুকার্য করা চমৎকার ব্রাকেট। ধূপদানি থেকে ধূপের মিষ্টি ধোঁয়া। দুপাশে দুটো ইলেকট্রিক মোমবাতি। শ্যামবাজারের পাঁচমাথার মোড় থেকে কিনেছি। একজন একটা বাঘছালের টুকরো দিয়েছে, সেটাকে ভেলভেটের আসনে ফিট করে তার ওপর সিদ্ধাসনে বসি। আগে পদ্মাসনেই বসতুম, ইদানীং টান ধরে, তাই। তারপর গোলাপের আতর মাখানো জপের মালা ঘুরতে থাকে। মাঝে মাঝে পিটপিট করে আপনাদের দিকে তাকাই। নো রেসপন্স।’
‘তারপর?’
‘ঐ যে আপনি বলেছেন, জপের চেয়ে ধ্যান বড়। মালাটাকে ডিবের মধ্যে রেখে ধ্যান।’
‘গভীর ধ্যান?’
‘আজ্ঞে, আমার ধারণা, গভীর ধ্যান, বাড়ির দুষ্ট লোকেরা বলে গভীর ঘুম। মাঝে মাঝে নাকি নাকও ডাকে! কিছুতেই বোঝাতে পারি না, নাক ডাকছে কাকে? তাঁকে। যেমন মেঘ জলকে ডাকে।’
‘ধ্যান কোথায় কর?’
‘আগে ভুরুর মাঝখানে করতুম।’
‘কি করতে?’
‘একটা গোল জ্যোতি, ঐ অম্বলের ট্যাবলেটের সাইজে আনার চেষ্টা করতুম। মাসের পর মাস চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিলুম। একবার ভাবলুম তোতাপুরী যেমন করেছিলেন, ভাঙা কাচের টুকরো দিই বিধিয়ে! সাহস হলো না। যদি নির্বিকল্প হয়ে যায়, কে ফিরিয়ে আনবে! ডলপুতুলের মতো বসেই রইলুম!’
‘তারপর?’
‘প্রবলেম ঠাকুর। লাঠালাঠি!’
‘মানে?’
‘কাকে কোথায় রাখি? আপনি, মা ঠাকরুন, মা কালী আর আমার গুরু। এই চারজন। ঐটুকু তো জায়গা! পাশাপাশি রাখলে বুক ফুরিয়ে যাচ্ছে। প্রথমে ভাবলুম সহস্রারে গুরুকে বসাই। ভ্রমধ্যে মা কালী। আর হৃদয়ে আপনি ও মা ঠাকরুন। ধ্যানে বসে দেখি কী, ধ্যান লিফট হয়ে গেছে, গ্রাউন্ড ফ্লোর টপ ফ্লোর, টপ ফ্লোর গ্রাউন্ড ফ্লোর। আমি এক উর্দিপরা লিফট অপারেটর। নানারকম চিন্তা। সব বড়বাবু, মেজবাবু আসছে। গেট খুলছি, বন্ধ করছি, ওপরে উঠছে, ওপর থেকে নামছে। নানা পোশাকের নানা চিন্তা।’
‘অবশেষে?’
‘অবশেষে ধ্যুৎ তেরিকা!’
‘জপটা আছে না গেছে?
‘আজ্ঞে, দীক্ষার পর প্রবল উৎসাহে তিন মালা, চার মালা হতো।‘
‘অতঃপর?’
‘এখন কনসেনট্রেটেড জপ, তিনবার।’
‘ইংরেজীটা কি বললে?”
‘আজ্ঞে, দুধ মেরে যেমন ক্ষীর হয়, সেইরকম জপ মেরে জপের ক্ষীর, মানে ঘন জপ।’
‘বাঃ, অতি সুন্দর! তা তোমার এই ধর্ম-বাসনার কারণটা জানতে পারি কি?’
‘ঠাকুর, এই প্রশ্ন নিজেকে আমিও বহুবার করেছি। যা পারি না আড়ম্বর করে তা করতে যাই কেন! আবার ছাড়তে চাইলেও ভাল লাগে না।’
‘উত্তর পেলে?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ, মনে শ্রীরামকৃষ্ণ লেগে গেছে। আঠার মতো। আপনি প্ৰভু বটপাতার আঠা। যতই ছাড়াতে চাই ততই জড়িয়ে যায়। কেবলই একটা অস্বস্তি—ঠাকুর যা করতে বলেছিলেন, যা হতে বলেছিলেন তা করতে পারিনি, তা হতে পারিনি। সকলের সঙ্গে সবকিছু করেছি, যেই একা হচ্ছি, তখনি মনের আকাশে বিষণ্ণতার মেঘ—কেন আমি পারছি না, কেন আমি পারব না? পঞ্চবটীতে অভিভাবকের মতো স্বামীজী ও তাঁর ব্রাহ্মবন্ধুদের ধ্যান পরিচালনা করতে করতে আপনি বলেছিলেন : “ধ্যান করবার সময় তাঁতে মগ্ন হতে হয়। ওপর ওপর ভাসলে কি জলের নিচে রত্ন পাওয়া যায়!” গান গেয়েছিলেন—
“ডুব দে রে মন কালী বলে। হৃদি রত্নাকরের অগাধ জলে।
রত্নাকর নয় শূন্য কখন, দু-চার ডুবে ধন না পেলে,
তুমি দম-সামর্থ্যে এক ডুবে যাও, কুলকুণ্ডলিনীর কুলে!”
ঠাকুর! আপনার সমস্ত উপদেশ আমার মুখস্থ! আপনি মাস্টারমশাইকে বলেছিলেন, হৃদয় ডঙ্কাপেটা জায়গা। হৃদয়ে ধ্যান হতে পারে, অথবা সহস্রারে। এগুলি আইনের ধ্যান শাস্ত্রে আছে। তবে তোমার যেখানে অভিরুচি ধ্যান করতে পার। সব স্থানই তো ব্রহ্মময়; কোথায় তিনি নেই? দুরকম ধ্যানের কথা বলেছিলেন—নিরাকার ধ্যান ও সাকার ধ্যান। বলেছিলেন, নিরাকার ধ্যান বড় কঠিন। সে-ধ্যানে যাকিছু দেখছ শুনছ লীন হয়ে যাবে; কেবল স্ব-স্বরূপ চিন্তা। সেই স্বরূপ চিন্তা করে শিব নাচেন। “আমি কি”, “আমি কি”–এই বলে নাচেন। একে বলে “শিবযোগ”। ধ্যানের সময় কপালে দৃষ্টি রাখতে হয়। “নেতি”, “নেতি” করে জগৎ ছেড়ে স্ব-স্বরূপ চিন্তা। আর এক আছে “বিষ্ণুযোগ”। নাসাগ্রে দৃষ্টি; অর্ধেক জগতে, অর্ধেক অন্তরে। সাকার ধ্যানে এইরূপ হয়। শিব কখনো কখনো সাকার চিন্তা করে নাচেন। “রাম” “রাম” বলে নাচেন।
‘এইসব নির্দেশে তোমার তো কোন লাভই হলো না!’
‘একটা লাভ হয়েছে, সেটা হলো—আপনি আমার নিদ্রা কেড়ে নিয়েছেন। সব হওয়ার মধ্যেও কি যেন একটা হলো না—এই অস্বস্তি পুরে দিয়েছেন মনোপুরে।’
‘তাহলে আজ তোমাকে আরেকটা আরো সরল কথা বলি। যারা একান্ত পারবে না তারা দুবেলা দুটো করে প্রণাম করবে। তিনি তো অন্তর্যামী—বুঝছেন যে, এরা কি করে! অনেক কাজ করতে হয়। তোমাদের ডাকবার সময় নেই— তাঁকে আমমোক্তারি দাও। কিন্তু তাঁকে লাভ না করলে—তাঁকে দর্শন না করলে কিছুই হলো না।’
‘আজ্ঞে, আপনাকে দেখাও যা ঈশ্বরকে দেখাও তা।
‘ওকথা আর বলো না। গঙ্গারই ঢেউ, ঢেউ-এর গঙ্গা নয়। আমি এত বড়লোক, আমি অমুক—এইসব অহঙ্কার না গেলে তাঁকে পাওয়া যায় না। “আমি” ঢিপিকে ভক্তির জলে ভিজিয়ে সমভূমি করে ফেল।’
‘সংসারে কেন তিনি রেখেছেন?’
‘সৃষ্টির জন্য রেখেছেন। তাঁর ইচ্ছা। তাঁর মায়া। কাম-কাঞ্চন দিয়ে তিনি ভুলিয়ে রেখেছেন।’
‘কেন ভুলিয়ে রেখেছেন? কেন তাঁর ইচ্ছা?”
‘তিনি যদি ঈশ্বরের আনন্দ একবার দেন তাহলে আর কেউ সংসার করে না, সৃষ্টিও চলে না। তাহলে শোন, চালের আড়তে বড় বড় ঠেকের ভিতরে চাল থাকে। পাছে ইঁদুরগুলো ঐ চালের সন্ধান পায়, তাই দোকানদার একটা কুলোতে খই-মুড়কি রেখে দেয়। ঐ খই-মুড়কি মিষ্টি লাগে, তাই ইঁদুরগুলো…. সমস্ত রাত কড়মড় করে খায়। চালের সন্ধান আর করে না। কিন্তু দেখ, এক সের চালে চোদ্দগুণ খই হয়। কাম-কাঞ্চনের আনন্দ অপেক্ষা ঈশ্বরের আনন্দ কত বেশি! তাঁর রূপ চিন্তা করলে রম্ভা, তিলোত্তমার রূপ চিতার ভস্ম বলে বোধ হয়। বুঝলে?’
‘আজ্ঞে!’